বাংলাদেশে ইলমে হাদীস গৌড় থেকে পান্ডুয়া
আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ ইবনে সায়েদ আশরাফী মক্কী বাংলাদেশে রাজত্ব করেন ৯০০ হিজরী থেকে ৯২৪ হিজরী পর্যন্ত। তিনি গৌড়স্থ গুররিয়ে শহীদ নামক স্থানে (বর্তমান মালদহ জিলার অন্তর্ভুক্ত) ৯০৭ হিজরী সনে একটি উন্নত ধরনের মাদ্রাসা স্থাপন করেন। তিনি পান্ডুয়াতে একটি কলেজও স্থাপন করেন। এ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইলমে হাদীসের শিক্ষা দেয়া হতো। সহীহ আল বুখারীকে খাজেগীর শীরওয়ানী যার আসল নাম মুহাম্মদ ইবনে ইয়াজদান বখশ ৯১১ সনে তিনখন্ড নকল করেন।বর্তমানে এ খন্ড তিনটিকে বাকীপুরের অরিয়েন্টাল লাইব্রেরীতে আছে।
সোনার গাঁও
সায়াদাতের (৯০০-৯৪৫) রাজত্বকালে মুহাদ্দিস শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা বোখারী হাম্বলী(মৃ ৭০০ হি) সপ্তম শতকে ঢাকা জেলাধীন সোনারগাঁও আগমন করেন। তিনি হাদীস শিক্ষার জন্য ব্যপক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। নুসরত ইবনে হুসাইন শাহ-এর রাজত্বকালে প্রসিদ্ধ হাদীস বিজ্ঞ তকীউদ্দীন আইনদ্দীন(৯২৯ হি)এখানে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন।তখন সোনারগাঁও ছিল পূর্ববাংলার রাজধানী। ফলে প্রচুর হাদীস বিশারদ এখানে এসে জড়ো হন এবং এটাকে ইলমে হাদীসের কেন্দ্রে পরিণত করেন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ হওইয়ার পর থেকে অনেক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সেখানে হাদীসের শিক্ষাদানের চেষ্টা করা হয়েছে এবং এখনও করা হচ্ছে। তবুও বলতে হয় আগের কালের শিক্ষার্থীদের ন্যায় বর্তমানের শিক্ষার্থীরা পারদর্শিতা অর্জন করতে পারেনি।এর পিছনে একটি মাত্রই কারণ বলা যায়,তা হল শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি।
তাহমীদ
রাসূল (সাঃ)সম্মন্ধে হাদীসে যে সব বিষোয়ে আলোকপাত করা হয়েছে-
১। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর চেহারা ও গঠনাকৃতির আলোচনা
২। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর চুলের আলোচনা
৩। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর পাকা চুলের আলোচনা
৪। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর চুল আঁচড়াবার আলোচনা
৫। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর চুলে খেজাব লাগাবার আলোচনা
৬। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর চোখে সুরমা লাগাবার আলোচনা
৭। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর পোশাকের আলোচনা
৮। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর জীবন যাপনের আলোচনা
৯। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর মোজার আলোচনা
১০। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর পাপোশের আলোচনা
১১। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর আংটির মোহরের আলোচনা
১২। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর তলোয়ারের আলোচনা
১৩। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর লৌহ বর্মের আলোচনা
১৪। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর লৌহ শিরস্থানের আলোচনা
১৫। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর পাগড়ীর আলোচনা
১৬। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর পায়জামার আলোচনা
১৭। রাসুলুল্লাহ (স;) এর চলার আলোচনা
১৮। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর মুখে কাপড়ের আলোচনা
১৯। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর বসার আলোচনা
২০। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর বিছানা ও বালিশের আলোচনা
২১। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর হেলান দেবার আলোচনা
২২। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর আহার করার আলোচনা
২৩। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর রুটি খাওয়ার আলোচনা
২৪। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর গোশত ও ত্বকের আলোচনা
২৫। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর অযু করার আলোচনা
২৬। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর আহারের পূর্বে ও পরে দোয়া পাঠের আলোচনা
২৭। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর পেয়ালার আলোচনা
২৮। রাসূলুলাহ (সঃ) এর ফলের আলোচনা
২৯। রাসূলুল্লাহ (সঃ) কি কি পান করতেন তার আলোচনা
৩০।রাসুলুল্লাহ(সঃ) কিভাবে পান করতেন তার আলোচনা
৩১।রাসুলুল্লাহ(সঃ) এর খোশবু লাগানোর আলোচনা
৩২। রাসুলুল্লাহ(সঃ) এর কথার বলা আলোচনা
৩৩। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর কবিতা পাঠের আলোচনা
৩৪। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর রাত্রে কথা-বার্তা ও গল্প বলার আলোচনা
৩৫। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর নিদ্রার আলোচনা
৩৬। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর ইবাদাতের আলোচনা
৩৭।রাসুলুল্লাহ(সঃ) এর হাসির আলোচনা
৩৮। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর রসিকতার আলোচনা
৩৯। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর চাশত নামাযের আলোচনা
৪০।রাসুলুল্লাহ(সঃ) এর গৃহে নফল পড়ার আলোচনা
৪১।রাসুলুল্লাহ(সঃ) এর রোযা রাখার আলোচনা
৪২। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর কোরআন পাঠের আলোচনা
৪৩। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর রোনাজারির আলোচনা
৪৪। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর নম্রতার আলোচনা
৪৫। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর আচার ব্যবহারের আলোচনা
৪৬। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর ক্ষৌর কাজের আলোচনা
৪৭। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর নামসমূহের আলোচনা
৪৮। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর জীবনের বিভিন্ন অবস্থার আলোচনা
৪৯। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর জন্ম তারিখ ও বয়সের আলোচনা
৫০। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর মীরাস ও পরিত্যক্ত বস্তুর আলোচনা
এই তথ্য থেকে আমরা জানতে পারলাম রাসূল (সঃ) সম্পর্কে সাহাবীগণ,তাবেয়ী,তাবে তাবেয়ীগণ ও হাদীস বিশারদগণ কত সচেতন ছিলেন।
আসহাবে সুফফা
রাসুল (সঃ) এর সাহাবীদের ভেতর ৭০ (সত্তর) জন সাহাবী ছিলেন যারা নিজেদের জীবনকে ইসলামের জন্য উৎসর্গ করেন।তাদেরকে আসহাবে সুফফা বলা হতো। মসজিদে নববীর উঠোন ছাড়া তাদের মাথা গুজবার দ্বিতীয় কোন স্থান ছিল না। দুনিয়ায় তাদের মালিকানায় পরনের এক টুকরো কাপড় ছাড়া কিছুই ছিল না। এমন উৎসর্গিত প্রাণের কথা কল্পনাও করা যায়? তারা দিনের বেলা প্রয়োজনে জংগলে গিয়ে কাঠ কেটে আনতেন এবং তা বিক্রি করে নিজদের ভরণ পোষণ চালাতেন।এমন কি এ থেকে আল্লাহর পথেও ব্যয় করতেন।
আসহাবে সুফফার উল্লেখযোগ্য ২৪ জন সদস্য
১। আবু হুরায়রা(রাঃ) (মৃ ৫৭ হি)
২। আবু জর গিফারী (রাঃ) (মৃ ৩২ হি)
৩। কাব ইবনে মালেক আল আনসারী(রাঃ) (মৃ ৩৪ হি)
৪। সালমান ফারসী(রাঃ) (মৃ ৩৪ হি)
৫। হানজালা ইবনে আবু আমির(রাঃ)
৬। হারিসা ইবনে নুমান(রাঃ)
৭। হুজায়ফা ইবনুল য়ামান(রাঃ)
৮। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রাঃ)
৯। সুহায়ব ইবনে সিনান রুমি(রাঃ)
১০। সালেম মাওলা আবি হুজায়ফা(রাঃ)
১১। বিলাল বিন রাবাহ(রাঃ)
১২। সা’দ বিন মালিক আবু সাইদ খুদরী(রাঃ)
১৩। আবূ উবায়দাঃ ‘আমির ইবনুল জাররাহ(রাঃ)
১৪। মিকদাদ ইবনে আমের(রাঃ)
১৫। আবু মারছাদ(রাঃ)
১৬। আবু লুবাবা(রাঃ)
১৭। কাব ইবনে আমর(রাঃ)
১৮। আবদুল্লাহ ইবনে উনায়স(রাঃ)
১৯। আবু দ্দারদা (রাঃ) (মৃ ৩২ হি)
২০। ছাওবান [মাওলা রাসুলিল্লাহ (সঃ)](রাঃ)
২১। সালিম ইবনে উমায়র (রাঃ)
২২। খাব্বাব ইবনে আরাও(রাঃ)
২৩। মিসতাহ ইবনে উছাছা(রাঃ)
২৪। ওয়াছিলা ইবনুল আসকা(রাঃ)
ওহী ও হাদীস
শায়খ আবুদুল্লাহ শারকাভী লিখেছেন-‘ওহী’ অর্থ জানাইয়া দেয়া।আর শরীয়তের পরিভাষায় ওহী হল- ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে তার নবীগণকে কোন বিষয় বলে দেয়া বা ফেরেশতা পাঠান কিংবা স্বপ্ন যোগে অথবা ইলহামের সাহায্যে জানিয়ে দেয়া।এই শব্দটি ‘আদেশ দান’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়।(হাদীস সংকলনের ইতিহাস পৃঃ ৪৯)
রাসুলে করীম(সঃ) এর নিকট বিভিন্ন উপায়ে ওহী নাযিল হত। উপায়গুলি হল-
১। সত্য স্বপ্নঃ নবুয়ত লাভের প্রথম পর্যায়ে নবী করীম(সঃ) স্বপ্ন দেখতে পেতেন এবং তার এ স্বপ্ন বাস্তবে হুবহু মিলে যেতো।এই স্বপ্নগুলো ছিল অত্যন্ত ভালো।
২। দিল বা মনের পটে উদ্রেক হওয়াঃ রাসূল(সঃ) এ সম্মন্ধে বলেছেন-“জিবরাঈল ফেরেশতা আমার মনের পটে এই কথা ফুঁকে দিলেন যে নির্দিষ্ট রেজেক পূর্ণ রূপে গ্রহণ করার ও নির্দিষ্ট আয়ুষ্কালপূর্ণ হওয়ার আগে কোন প্রাণীই মরতে পারে না।”(হাদীস সংকলনের ইতিহাস পৃঃ ৫০)।
৩। ঘন্টা ধ্বনির মত শব্দে ওহী নাযিল হওয়াঃহযরত আয়েশা(রাঃ) হযরত হারেস ইবনে হিশাম(রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন,তিনি নবী করীম(সঃ) কে জিজ্ঞেস করেন-“আপনার নিকট ওহী কিভাবে নাযিল হয়?”এর জবাবে নবী করীম (সঃ) বলেন “কখনও ওহী আমার নিকট প্রচন্ড ঘন্টার ধ্বনি মত আসে।যা আমার উপর বড় কঠিন ও দুঃসহ হয়ে থাকে।পরে ওহীর তীব্রতা ও প্রচন্ডতা আমার উপর দিয়ে যায়।এই অবসরে যা বলা হল তা সবই আমি আয়ত্ব ও মুখস্ত করে লই।”(বোখারী শরীফ ১ম খন্ড ১ম পৃ)
৪। ব্যক্তি বেশেঃ এ প্রসংগে রাসুল(সঃ) বলেছেন- “কখনও ফেরেশতা কোন ব্যক্তির রূপ ধারণ করে আমার নিকট আসেন,তিনি আমার সাথে কথা বলেন এবং যা বলেন তা আমি ঠিকভাবে আয়ত্ত করে লই।“(বোখারী শরীফ ১ম খন্ড ১ম পৃঃ)
ব্যক্তি বেশে জিবরাঈল (আঃ) বেশির ভাগ সময় হযরত দাহিয়া কালবী নামক সাহাবীর রূপ ধরে আসতেন।ফেরেশতা কেন দাহিয়া কালবীর রূপ ধারণ করতেন এর কারণ বলতে গিয়ে আল্লামা বদর উদ্দীন আইনী লিখেছেন-“অন্যান্য সাহাবীদের পরিবর্তে বিশেষভাবে দাহিয়া কালবীর রূপ ধারণ করে ফেরেশতার আগমন করার কারণ এই যে,তিনিই সে সময়ের লোকদের মধ্যে সর্বাধিক সুশ্রী ও সুন্দর চেহারা বিশিষ্ট ছিলেন।”(হাদীস সংকলনের ইতিহাস পৃ ৫৪)।
৫। জিবরাঈল(আঃ) এর নিজস্ব আকৃতিতেঃ এ সম্পর্কে রাসূলে করীম(সঃ) বলেছেন-“আমি পথ চলছিলাম হঠাৎ উর্ধ্বদিক হতে একটি আওয়াজ শুনতে পেলাম। আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেলাম সেই ফেরেশতা যিনি ইতোপূর্বে হেরার গুহায় আমার নিকট এসেছিলেন, তিনি আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে একটি আসনে উপবিষ্ট।অতঃপর আল্লাহ তায়ালা সূরা মুদাসসির নাযিল করেন।”(বোখারী শরীফ ১ম খন্ড ৭৩৩ পৃ)
৬।পর্দার অন্তরাল থেকে রাসূলে করীম(সঃ) এর সাথে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার কথা বলা এবং ওহী নাযিল করা- এই প্রকার ওহী নাযিলের ব্যাপারে কোন মধ্যস্থতাকারী অর্থাৎ ফেরেশতার দরকার হয় না।আল্লাহ তায়ালা সরাসরি তার রাসূলকে পর্দার অন্তরাল থেকে ওহী নাযিল করেন।এ প্রসংগে পবিত্র কোরআন এ বলা হয়েছে-
“আল্লাহ কোন লোকের সাথে কথা বলেন না,তবে তিনি ওহী নাযিল করেন কিংবা পর্দার অন্তরাল হতে কথা বলেন।”(সুরা আশশুরা ৫১ আয়াত)
এতক্ষন ওহী সম্মন্ধে এই জন্যই আলোচনা করলাম যে,হাদীস কোথা থেকে আসলো,বিষয়টা বুঝা সহজ হবে। আসলে হাদীসও কি ওহী ?
এ সম্পর্কে মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম তার হাদীস সংকলনের ইতিহাসের ৬২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-“আল্লাহ তায়ালা বিশ্বনবীর প্রতি যে ওহী নাযিল করেছেন,তাই হচ্ছে হাদীসের মূল উৎস।আল্লাহ প্রেরিত ওহী প্রধানত দুই প্রকারের- প্রথম প্রকারের ওহীকে বলে ওহীয়ে মাতলু-সাধারণ পঠিতব্য ওহী,যাকে ওহীয়ে জ্বলীও বলে।আর দ্বিতীয় প্রকারের ওহীকে ‘ওহীয়ে গায়রে মাতলু’ বলে।এটা সাধারণত তেলাওয়াত করা হয় না। যার অপর নাম ‘ওহীয়ে খফ’ প্রচ্ছন্ন ওহী। যা হতে জ্ঞান লাভ করার সুত্র এবং এ সুত্রে লব্ধ জ্ঞান উভয়ই বুঝানো হয়।”
আমরা জানি কোরআনের পরই হাদীসের স্থান।আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন-“হে নবী ! আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব ও হিকমত নাযিল করেছেন এবং তুমি যা জানতে না তা তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন।
এই আয়াতে উল্লেখিত আল-কিতাব অর্থ কোরআন মজীদ এবং হিকমত অর্থ সুন্নাত বা হাদীসে রাসূল(এবং এ উভয় জিনিসই আল্লহর নিকট হতে আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ।”)
এখন নিশ্চয়ই বুঝা গেল হাদীসও এক প্রকার ওহী।
ইসলামী জীবনব্যবস্থায় হাদীসের গুরুত্ব
ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় হাদীসের গুরুত্ব এত যে সে কথা বলে শেষ করা যায় না। এ প্রসংগে আল্লাহ নিজেই বলেছেন-“বল হে নবী,আল্লাহ ও রাসূলকে মেনে চল,যদি তা না কর তবে জেনে রাখ আল্লাহ কাফেরদের ভালবাসেন না।”(সূরা আল ইমরান,২২ আয়াত)
এই আয়াত থেকেই হাদীসের গুরুত্ব যে কত তা স্পষ্ট বুঝা যায়- রাসূলকে(সাঃ) মেনে চল অর্থ হলো নবী (সঃ) যা করেছেন,বলেছেন,অনুমোদন করেছেন তা এনে চলা।
অন্যস্থানে একটু ব্যপকভাবে বলা হয়েছে- “হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ ও রাসূলের(সাঃ) আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্য হতে দায়িত্বশীল লোকদেরও অনুগত হও,কোন বিষয়ে তোমরা পরষ্পর মতবিরোধ করলে তাকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফেরাও।”
এই আয়াতে তিনটি বিভিন্ন সত্তার আনুগত্য করার কথা বলা হয়েছে- ১।আল্লাহর আনুগত্য ২।রাসূল(সাঃ) এর আনুগত্য ৩।মুসলিম দায়িত্বশীল লোকদের আনুগত্য করা। যেহেতু ইসলাম সর্বকালের সর্ব মানুষের জন্য, এই জন্য তৃতীয় স্তরে দায়িত্বশীলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
হাদীসের অপরিহার্যতা
এতক্ষণের আলোচনায় আমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারলাম হাদীসের গুরুত্ব কতটুকু।হাদীসের অপরিহার্যতা হলো এই যে হাদীস ছাড়া কোরআনের ব্যাখ্যা করা যায় না। তাছাড়া কোরআন ও হাদীস সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) নিজেই বলেছেন-“আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি।এই দুটি অনুসরণ করতে থাকলে অতঃপর তোমরা কখনও পথভ্রষ্ট হবে না।তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব ও আমরা সুন্নাত(হাদীস) এবং কিয়ামতের দিন হাওযে কাওসার এ উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত এই দুটি জিনিস কখনই পরষ্পর হতে বিচ্ছিন্ন হবে না।”(মুস্তাদরাক হাকেম ১ম খন্ড ৯৩ পৃঃ)
বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূল(সাঃ) বলেছেন- “দুটি জিনিস যা আমি তোমাদের মাঝে রেখে যাচ্ছি তোমরা যতক্ষণ এই দুটি জিনিস দৃঢ়ভাবে ধরে থাকবে তোমরা কখনও গোমরাহ হবে না।তা হলো, আল্লাহর কিতাব ও তার রাসূলের সুন্নাত।”(মালেক ইবনে আনাস বর্ণিত- মুস্তাদরক হাকেম)
এবার নিশ্চয়ই বুঝতে বাকী থাকার কথা নয় কেন আজ সারা বিশ্বে মুসলমানদের এই দশা।আসলে আমরা কোরআন হাদীসের শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেছি। এরপর, আমাদের দেশে এমনি এক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে যা ইংরেজ প্রবর্তিত। এতে কোরান হাদীস শিক্ষার তেমন সুব্যবস্থা নেই। শুধু মাদরসার ভাইয়েরা যা একটু আদটু জ্ঞান পেয়ে থাকেন। তারাও আবার আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান থেকে বঞ্চিত থাকেন। বলতে কুন্ঠা নেই যে, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হওয়া সত্ত্বেও এই জন্যই আমরা এত নির্যাতিত। তাই আর বসে থাকলে চলবে না,নিজদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে ইসলামী জ্ঞান অর্জনের জন্য।
হাদীস সংরক্ষণ
হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে মুসলমানদের ভিতরে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়েছে।কতিপয় প্রাচ্য পন্ডিত ও শিক্ষিত মিশনারী যাদের মধ্যে স্যার উইলিয়াম মুর ও গোলডজার সবচাইতে অগ্রণী,তারা রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এর হাদীস গুলোর সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করার কাজ তার ইন্তেকালের ৯০ বছর পর শুরু হয়েছে বলে এগুলির ত্রুটিহীনতা ও প্রামাণ্যতার ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন।
এমনকি মুসলমানদের ভেতর এ ধারণা সৃষ্টি করতেও সক্ষম হয়েছেন যে,হাদীসও নবী চরিত সংকলন ও রচনার কাজ শুধু তাবেঈগণ শুরু করেন।
তাই অনেকে স্বাভাবিকভাবেই মনে করে থাকেন নবী চরিত সংগ্রহ ও সংকলনের কাজ তার ওফাতের একশো বছর পর শুরু হয়েছে। কিন্তু আমরা বলতে চাই- একথাগুলো ভাওতা ছাড়া আর কিছুই নয় অথবা অজ্ঞতার বশবর্তী হয়েই এ কথা প্রচার করা হয়েছে।আসলে এ কাজ নবী (সাঃ) এর জীবিত অবস্থা থেকেই শুরু হয়েছে।তার প্রমাণ-
হযরত আবু হুরায়রা(রাঃ) বলেন আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আ’স(রাঃ) ব্যতীত কারো আমার চাইতে অধিক সংখ্যক হাদীস স্মরণ নেই। আমার চাইতে তার নিকট অধিক সংখ্যক সংরক্ষিত থাকার কারণ হচ্ছে এই যে,তিনি রাসুলুল্লাহ(সাঃ) এর নিকট যা কিছু শুনতেন সব লিখে রাখতেন।কিন্তু আমি লিখে রাখতাম না।(বোখারী শরীফ)
আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বলে উল্লেখিত হয়েছে যে, কতিপয় সাহাবা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমরকে বললেন- রাসুলুল্লাহ(সাঃ) কখনো ক্রুদ্ধ অবস্থায় আনার কখনো প্রফুল্ল অবস্থায় থাকেন অথচ তুমি সকল অবস্থায়ই সব কিছু লিখে রাখো। একথার পর আবদুল্লাহ ইবনে আম(রাঃ) লেখা বন্ধ করলেন এবং রাসুলুল্লাহর(সাঃ) নিকট বিষয়টি বললেন। রাসুলুল্লাহ(সাঃ) নিজের মুখের দিকে ইশারা করে বললেন- তুমি লিখতে থাকো এ স্থান থেকে যা বের হয় সত্যই হয়ে থাকে। (আবু দাউদ-দ্বিতীয় খন্ড ৭৭ পৃষ্ঠা
আবদুল্লাহ ইবনে আমর(রাঃ) তার এ সংকলনের নাম রাখেন ‘সাদেকা’। (ইবনে সায়াদ- দ্বিতীয় খন্ড ২য় অধ্যায় পৃষ্ঠা ১২৫)। তিনি বলতেন মাত্র দু’টি জিনিসের জন্য আমি জীবিত থাকার আকাংখা করেছি।তন্মধ্যে একটি হচ্ছে এই সাদেকা এবং সাদেকা এমন একটি কিতাব যা রাসুলুল্লাহর(সাঃ) এর পবিত্র মুখ থেকে শুনে শুনে আমি লিখেছি। [দারেমীঃ ৬ পৃষ্ঠা]
মুজাদি বলেন- আমি আবদুল্লাহ ইবনে আমর(রাঃ) এর নিকট কিতাব রক্ষিত দেখেছি।জিজ্ঞেস করলাম এটি কি কিতাব? বললেন ‘সাদেকা’।এটি রাসুলুল্লাহ(সাঃ) এর মুখ থেকে শুনে শুনে আমি লিখেছি।এই কিতাব আমার ও রাসুলুল্লাহ(সাঃ) এর মাঝখানে আর কেঁউ নেই (ইবনে সায়াদঃ ২-২-১২৫)। বোখারী শরীফে উল্লেখ আছে যে,মদীনায় হিজরত করার কিছু কাল পর রাসুলুল্লাহ(সাঃ) মুসলমানদের আদমশুমারী করে তাদের নামের তালিকা প্রণয়ন করেন। উক্ত তালিকায় পনের শ নাম ছিল (বাবুল জিহাদ)। বর্তমানে বোখারী শরীফে দু পৃষ্ঠা ব্যাপী যাকাত সম্পর্কিত যে সব নির্দেশ বিভিন্ন বস্তুর ওপর দেয়া যাকাত এবং তার হার সম্পর্কে যে আলোচনা রয়েছে,তা রাসুলুল্লাহই(সাঃ) লিখিত আকারে দায়িত্বশীল কররমচারীদের নিকট প্রেরণ করেন। হযরত আবুবকর (রাঃ) এর নিকট আবুবকর ইবনে হাযমের খান্দানে এবং আরও কিছু লোকের নিকট এই নির্দেশনামা মওজুদ ছিল(দারে কুতনী- কিতাবুজ্জাকাত – ২০৯ পৃঃ)।
সুস্পষ্টরূপে হাদীসের সাথে সম্পর্কিত কয়েকটি দস্তাবেজের নাম উল্লেখ করছি-
১।হোদায়বিয়ার সন্ধিনামা।(বোখারী প্রথম খন্ড ৩৭ পৃষ্ঠা)
২।বিভিন্ন কবিলা ও গোত্রের প্রতি বিভিন্ন সময়ে লিখিত ফরমান।(তাবাকাতে ইবনে সায়াদ,কিতাবুল আমওয়াল আবু ওবাইদ পৃঃ-২১০)।
৩।বিভিন্ন দেশের বাদশাহ ও রাষ্ট্র নেতাদের নিকট লিখিত ইসলামী দাওয়াতের পত্রাবলী।(বোখারী শরীফ দ্বিতীয় খন্ড ৬৩১ পৃঃ)
৪।আবদুল্লাহ ইবনে হাকীম সাহাবীর নিকট রাসূলের প্রেরিত চিঠি। এই চিঠিতে মৃত জন্তু ইত্যাদি সম্পর্কিত আইন লিখিত হয়েছিল।(মু’জিমুসসগীর,তীবরাণী)।
৫।ওয়ায়েল ইবনে হাজার সাহাবীর জন্য নামাজ,মদ্যপান ও সুদ ইত্যাদি সম্পর্কে নবী করীম(সাঃ) বিধান লিখাইয়া দিয়াছিলেন।(মু’জিমুসসগীর তীবরাণী)।
এইভাবে প্রচুর উদাহরণ তুলে ধরা যাবে যা রাসুলুল্লাহ(সাঃ) এর আমলেই লিখিত হয়েছিল।
আর যা লিখিত ছিল না হাফেজে হাদীসের কন্ঠস্থ ছিল।সে সময়কার আরবজাতির স্মরণ শক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিল,একবার শুনলে তারা তা আর কখনো ভুলতো না।যেমন- “হযরত আবু হুরায়রা(রাঃ) বিপুল সংখ্যক হাদীসের হাফেজ ছিলেন।কিন্তু উমাইয়া বংশের শাসক খলিফা মারওয়ান ইবনে হেকামের মনে এ সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক হয়। তিনি হযরত আবু হুরায়রার পরীক্ষা লওয়ার জন্য একটি কৌশল অবলম্বন করেন। একদিন কিছু সংখ্যক হাদীস শুনাবার অনুরোধ করলেন। আবু হুরায়রা(রাঃ) তখন নির্দেশ মোতাবেক কিছু সংখ্যক হাদীস শুনিয়ে দিলেন। মারওয়ানের নির্দেশ মোতাবেক পর্দার অন্তরালে বসে হাদীসসমূহ লিখে নেওয়া হয়। বাৎসরিক কাল পরে একদিন ঠিক এই হাদীসসমূহ শুনাবার জন্য হযরত আবু হুরায়রা(রাঃ) কে অনুরোধ করা হলে তিনি সেই হাদীসসমূহই এমনভাবে মুখস্ত শুনিয়ে দেন যে পূর্বের শুনানো হাদীসের সাথে এর কোনই পার্থক্যই হয়নি। এ ঘটনার হতে হযরত আবু হুরায়রার স্মরণ শক্তির প্রখরতা অনস্বীকার্যভাবে প্রমাণ হয়।
হাদীস সংগ্রহ
এ এক মজার কাহিণী। বিভিন্ন হাদীস সংগ্রহের জন্য দেখা যায় হাদীস সংগ্রহকারীরা অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছেন,এমনকি নিজেদের জীবন বিপন্ন করেও হাদীস সংগ্রহের জন্য বাড়িঘর পরিবার পরিজন ত্যাগ করে,দেশে বিদেশে,পাহাড়-পর্বত, সাগর-নদী ডিঙ্গিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন,যদি রাসূল(সাঃ) এর একটি হাদীস পাওয়া যায়। দু’একটি উদাহরণ দিলে আমার মনে হয় বুঝতে সুবিধা হবে যে, হাদীস সংগ্রহকারীরা কি কষ্ট স্বীকার করেছেন ও সতর্কতা অবলম্বন করেছেন-
বোখারী শরীফে উল্লেখ আছে-“হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রাঃ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উনাইসের নিকট হতে একটি হাদীস শ্রবণের উদ্দেশ্যে একমাস দূরত্বের পথ অতিক্রম করে গিয়েছিলেন। তিনি সংবাদ জানতে পেরেছিলেন যে,সুদূর সিরিয়ার অবস্থানকারী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস (রাঃ) রাসূলে করীমের (সাঃ) একটি হাদীস জানেন,যা অপর কারও নিকট রক্ষিত নেই।সংবাদ পাওয়া মাত্রই তিনি উষ্ট্র ক্রয় করে সিরিয়ার পথে রওয়ানা হয়ে যান। একমাস কালের পথ অতিক্রম করে সিরিয়ার গ্রামাঞ্চলের নির্দিষ্ট স্থানে পৌছে তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস(রাঃ) এর সাক্ষাৎ লাভ করেন।তাকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমার নিকট হতে আমার নিকট একটি হাদীস পৌছেছে যা তুমি রাসুলুল্লাহ(সাঃ) নিকট হতে শুনেছ। আমার ভয় হলো যে তোমার নিজের নিকট হতে তা কানে প্রবেশ করার পূর্বেই হয়তো আমি মরে যাবো। (এই ভয়ে অনতিবিলম্বে তোমার নিকট হাযির হয়েছি।)”
এই বর্ণনা থেকে বুঝা গেল হাদীস শোনা সত্ত্বেও তারা(হাদীসের) সঠিকতা যাচাই করার জন্য সুদূর একমাসের কষ্ট সহ্য করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। তাহলে তাদের নিকট হাদীসের গুরুত্ব কত ছিল?
যে হাদীসটি শোনার জন্য জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উনাইসের নিকট এসেছিলে – দেখা হলে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস(রাঃ) হাদীসটি মুখস্ত শুনালেন।
“আমি রাসূলে করীম(সাঃ) কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তায়ালা বান্দাদিগকে হাশরের ময়দানে একত্রিত করবেন এবং তাদেরকে এমন এক আওয়াজে সম্বোধন করবেন, যার নিকট ও দূরে অবস্থিত লোকেরা সমান ভাবে শুনতে পাবে। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করবেন- আমিই মালিক আমিই বাদশাহ আমিই অনুগ্রহকারী।” (বোখারী শরীফ ২য় খন্ড)
আর একটি ঘটনা যা হাদীস সংগ্রহে হাদীস সংগ্রহকারীদের ভূমিকা সম্বন্ধে –
হযরত মুয়াবিয়া(রাঃ) শাসন আমলে হযরত আবু আইয়ুব আনসারী(রাঃ) শুধুমাত্র একটি হাদীস শোনার উদ্দেশ্যে মদীনা হতে মিশরের নিভৃত পল্লীতে অবস্থানকারী হযরত আকাবা ইবনে আমের জুহানী(রাঃ) এর নিকট উপস্থিত হন।আকাবা সংবাদ পেয়েই বাইরে আসলেন ও হযরত আবু আইয়ুব (রাঃ) কে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। জিজ্ঞেস করলেনঃ
“আবু আইয়ুব। আপনি কি কারণে এতদূরে আমার নিকট এসেছেন।তখন আবু আইয়ুব(রাঃ) বললেন- মুমিন ব্যক্তির ‘সতর’(বিশেষ জিনিস গোপন রাখা) সম্পর্কে একটি হাদীস আমি রাসূলের (সাঃ) নিকট শুনেছিলাম,কিন্তু এখন তোমার প আমার ছাড়া তার শ্রবণকারী আর কেঁউ দুনিয়ায় বেচে নেই।তাই তোমার নিকট হতে শ্রবণের বাসনা নিয়ে আমি এতদূর এসেছি।”
তখন হযরত আকাবা (রাঃ) নিম্নলিখিত ভাবে হাদীসটি বললেন- “যে ব্যক্তি এই দুনিয়ায় কোন মু’মিন লোকের কোন লজ্জাকর, অপমানকর কাজ গোপন রাখবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার গুনাহকে গোপন (মায়াফ) করে দিবেন।”
হযরত আবু আইয়ুব বাঞ্ছিত হাদিসটি শুনে বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছো সত্যই বলেছো।’ অতঃপর তিনি উষ্ট্রযানে সওর হয়ে মদীনার দিকে এমন দ্রুততা সহকারে রওয়ানা হয়ে গেলেন যে, মিশরের তদানিন্তন শাসনকর্তা মুসলিমা ইবনে মাখলাছ তাকে প্রচুর পরিমাণে উপঢৌকন দেওয়ার আয়োজন করেও তা তাকে দিতে পারলেন না, সেজন্য তিনি একটুও সময়ও বিলম্ব করতে প্রস্তুত হলেন না।” (বায়হাকী ইবনে মাজাহ, জামে বায়নুল ইলম,মুসনাদে আহমদ ৪র্থ খন্ড ৫ পৃষ্ঠা)
হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে বিভিন্ন শর্ত আরোপ করা হয়।ইমাম আবু হানিফা যে সমস্ত শর্ত হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে প্রদান করেন তা নিম্নরূপ।
১। কোন হাদীস বর্ণনা করার পর বর্ণনাকারী যদি তা ভুলে যায়, তবে সাধারণ মুহাদ্দিসদের নিকট তা গ্রহণীয় হলেও ইমাম আবু হানিফা এবং তার শাগরীদগণ তা গ্রহণ করতে রাজী নন।
২। কেবল সেই হাদীসই গ্রহণযোগ্য, যা বর্ণনাকারী স্বীয় স্মরণ ও সৃতিশক্তি অনুসারে বর্ণনা করবেন।
৩। যে সব প্রখ্যাত মুহাদ্দিসের মজলিশে বিপুল সংখ্যক শ্রবণকারীর সমাবেশ হওয়ার কারণে উচ্চ শব্দকারী লোক নিয়োগ করা হয় এবং তাদের নিকট দ্রুত হাদীসকে আসল মুহাদ্দিসের নিকট শ্রুত হাদীস বলে বর্ণনা করা হয়, ইমাম আবু হানিফার নিকট সেই হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।হাফেজ আবু নয়ীম, ফযল ইবনে আকীল, ইবনে কুদামাহ প্রমুখ প্রখ্যাত মুহাদ্দীসগণও এই মত পোষণ করেন। হাফেজ ইবনে হাজার মক্কীর মতে এটা বিবেক সম্মত কথা হলেও সাধারণ মুহাদ্দিসের সহজ সাধ্য।
৪। যে বর্ণনাকারী নিজের খাতায় লেখা লেখতে পেয়ে কোন হাদীস বর্ণনা করেন, কিন্তু তা তার কোন ওস্তাদ মুহাদ্দিসের নিকট শুনেছেন বলে স্মরণে পড়ে না, ইমাম আবু হানিফা এই ধরনের হাদীস সমর্থন করেন না। অপরাপর মুহাদ্দিসের মতে এতে কোন দোষ নেই। (হাদীস সংকলনের ইতিহাস-৩৭৯ পৃঃ)
গ্রন্থাকারে হাদীস
আমরা আজকেই যে সুন্দর হাদীস গ্রন্থ দেখছি তা রাসূল(সাঃ) এর জীবিত অবস্থায় সংকলিত হয়নি। আল্লামা ইবনে হাজার আসকালিনী এ সম্পর্কে লিখেছেন-
‘নবী করীম(সাঃ) এর হাদীস তাহার সাহাবী ও শ্রেষ্ঠ তাবেয়ীদের যুগে গ্রন্থকারে সংকলিত ও সুসংবদ্ধ ছিলনা।”
মদীনার ইসলাম- রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ইসলামের দ্বিতিয় স্তম্ভ হাদীসের যথেষ্ট মর্যাদা দেওয়া হয় কিন্তু খোলাফায়ে রাশেদার আমলে হাদীস গ্রন্থকারে সংকলিত হতে পারেনি। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা আমিরুল মুমেনীন হযরত উমর(রাঃ) বিপুল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করে ইসলামী রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশের উচ্চ ও নিম্ন পর্যায়ের শাসকদের নিকট প্রেরণ করেছিলেন এবং সর্ব সাধারণের ব্যাপক প্রচার করার নির্দেশ দেন।
হযরত উমর (রাঃ) এর আমলেই হাদীস সংকলন সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করা এবং তাকে সুসংবদ্ধ করার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। কিন্তু তিনি অনেক চিন্তা ভাবনার পর নিজেই একদিন বলেন-
“আমি তোমাদের নিকট হাদীস লিপিবদ্ধ ও সংকলিত করার কথা বলেছিলাম,এ কথা তোমরা জান। কিন্তু পরে মনে হলো, তোমাদের পূর্বের আহলে কিতাব লোকেরাও এমনিভাবে নবীর কথা সংকলিত করেছিলো, ফলে তারা তাই আকড়ে ধরলো এবং আল্লাহর কিতাব পরিত্যাগ করল। আল্লাহর শপথ,আমি আল্লাহর কিতাবের সাথে কোন কিছুই মিশ্রিত করবো না। অতঃপর তিনি হাদীস সংকলিত করার সংকল্প ত্যাগ করেন।”(হাদীস সংকলনের ইতিহাস-৪১৯ পৃঃ)
এরপর হযরত ওসমান (রাঃ) ও হযরত আলীর (রাঃ) আমলে তেমন কোন উদ্যোগ দেখা যায় না। ৯৯ হিজরীতে হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজ খলীফা নির্বাচতে হওয়ার পরই হাদীস সংকলনের প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভব করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গেলে হাদীস সংকলন যে কোন মূল্যেই করার প্রয়োজন, নইলে ধীরে ধীরে মানুষ তা থেকে গাফেল হয়ে যাবে।তাই তিনি ইসলামী রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশে ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এই ফরমান জারি করলেন যে- “রাসূল করীমের (সাঃ) হাদীসের প্রতি অনতিবিলম্বে দৃষ্টি দাও এবং তা সংগ্রহ ও সংকলন করতে শুরু করো।”
মদীনার শাসনকর্তা ও বিচারপতি ইবনে মুহাম্মদ হাজ্জাকেও ফরমান পাঠান- “রাসূলের হাদীস, তার সুন্নাত কিংবা হযরত উমরের বাণী অথবা অনুরূপ যা কিছু পাওয়া যায় তার প্রতি দৃষ্টি দাও এবং আমার জন্য লিখে নাও।কেননা আমি ইলমে হাদীসের ধারকদের অন্তর্ধান ও হাদীস সম্পদের বিলুপ্তি আশংকা বোধ করেছি।”
ইমাম দারেমী আবদুল্লাহ ইবনে দীনার এর জবানীতে- “রাসূলের যে সব হাদীস তোমার নিকট প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত তা এবং হযরত উমরের হাদীসসমূহ আমার নিকট লিখে পাঠাও। কেননা আমি ইলমে হাদীস বিনষ্ট ও হাদীসের বিদদের বিলীন হয়ে যাওয়া আশংকা বোধ করেছি।(হাদীস সংকলনের ইতিহাস)
এভাবে উমর ইবনে আবদুল আজীজ বহু ফরমান জারি করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে মদীনার শাসনকর্তা কাজী আবু বকর বিপুল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ এবং হাদীস কয়েকখানি খন্ড গ্রন্থকারে সংকলন করেছিলেন।কিন্তু খলীফার ইন্তেকালের পূর্বে ‘দারুল খিলাফতে’ পৌছানো সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি,এ সম্বন্ধে আল্লামা সুয়ুতী ইবনে আবদুল বার লিখিত ‘আত তাহমীদ’ গ্রন্থের সূত্রে উল্লেখ করেছেন-
‘ইবনে হাজম কয়েক খন্ড হাদীস সংকলন করেন; কিন্তু তা খলীফা উমর ইবনে আবদুল আজীজের নিকট পাঠিয়ে দেওয়ার পূর্বেই খলীফা ইন্তেকাল করেন।’’
আমরা হয়ত মনে করতে পারি উমর ইবনে আবদুল আজীজের জীবিত অবস্থায় কোন হাদীস গ্রন্থই তার নিকট এসে পৌছেনি,আসলে একথা ঠিক নয়। তিনি তো রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে হাদীস সংকলনের জন্য হুকুম দিয়েছিলেন- তাই অনেক স্থান থেকে তার জীবিত অবস্থায়ই হাদীস গ্রন্থকারে এসেছিল। এ প্রসংগে-
ইমাম ইবনে শিহাব জুহরী নিজেই বলেন- “উমর ইবনে আবদুল আজীজ আমাদের হাদীস সংগ্রহ ও সংকলন করার জন্য আদেশ করলেন। এ আদেশ পেয়ে আমরা হাদীসের বিরাট গ্রন্থ লিখে তার নিকট পাঠিয়ে দিলাম। অতঃপর তিনি নিজেই তাহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি প্রদেশে এক এক খানি গ্রন্থ পাঠিয়ে দিলেন।”
খলিফা শুধু হাদিস সংকলনের প্রতিই গুরুত্ব দিলেন না,হাদীস শিক্ষা দানের জন্যেও তিনি গুরুত্ব দেন এবং ফরমান জারি করেন-“হাদীসবিদ ও বিদ্বান লোকদেরকে আদেশ করুন তারা যেন মসজিদে মসজিদে হাদীসের শিক্ষা দান ও এর ব্যপক প্রচার করেন। কেননা,হাদীসের জ্ঞান প্রায় বিলীন হয়ে যাবার উপক্রম হচ্ছে।”
ইমাম যুহরীর পরবর্তী যারা ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে ইন্তেকাল করেন তাদের তালিকা দেওয়া হল।
সর্বশেষ ইন্তেকালকারী সাহাবা
বিভিন্ন শহরে সর্বশেষে ইন্তেকালকারী সাহাবাগণের নাম ও মৃত্যু সন নিম্নে দেওয়া হলোঃ
নাম | শহরের নাম | মৃত্যু সাল |
১। আবু উমামা বাহেলী(রাঃ) | সিরিয়া | ৮৬ হিঃ |
২। আবদুল্লাহ ইবনে হারেস ইবনে জুয’আ (রাঃ) | মিশর | ৮৬ হিঃ |
৩। আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফা(রাঃ) | কুফা | ৮৭ হিঃ |
৪। সাইয়েব ইবনে ইয়াযীদ(রাঃ) | মদীনা | ৯১ হিঃ |
৫। আনাস ইবনে মালিক(রাঃ) | বসরা | ৯৩ হিঃ |
যে সমস্ত সাহাবী বেশি হাদীস বর্ণনা করেছেন
নিম্নে যে সমস্ত সাহাবী বেশি হাদীস বর্ণনা করেছেন পর্যায়ক্রমে তাদের নাম,মৃত্যু সন, জীবনকাল এবং বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা দেওয়া হলো-
নাম | মৃত্যু | জীবনকাল | সংখ্যা |
১। হযরত আবু হুরায়রা(রাঃ) | ৫৭ হিঃ | ৭৮ বছর | ৫৩৭৪ টি |
২। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা(রাঃ) | ৫৮ হিঃ | ৬৭ বছর | ২২১০ টি |
৩। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) | ৬৮ হিঃ | ৭১ বছর | ১৬৬০ টি |
৪। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) | ৭০ হিঃ | ৮০ বছর | ১৬৩০ টি |
৫। হযরত জাবেদ ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) | ৭৪ হিঃ | ৯৪ বছর | ১৫৪০ টি |
৬। হযরত আনাস ইবনে মালেক(রাঃ) | ৯৩ হিঃ | ১০৩ বছর | ১২৮১ টি |
৭। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) | ৪৬ হিঃ | ৮৪ বছর | ১১৭০ টি |
৮। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) | ৩২ হিঃ | -বছর | ৮৪৮ টি |
৯। হযরত আমর ইবনুল আ’ল (রাঃ) | ৬৩ হিঃ | -বছর | ৭০০ টি |
আশারায়ে মুবাশশারা
রাসূল (সাঃ) এর যে দশজন সাহাবী ঈমানের সর্বোত্তম পরীক্ষায় পরীক্ষিত হয়ে জীবিত কালেই বেহেশতের সুসংবাদ পান সেই দশজন সম্মানিত সাহাবীকে একত্রে আশারায়ে মোবাশশারা বলে।
যে দশজন সাহাবী আশারায়ে মোবাশশারার অন্তর্ভুক্ত তারা হলেন-
১। হযরত আবু বকর সিদ্দীক বিন আবু কোরাফা(রাঃ)
২। হযরত উমর ফারুক বিন আল খাত্তাব(রাঃ)
৩। হযরত ওসমান জুননুরাইন বিন আফফান(রাঃ)
৪। হযরত আলী মোর্তজা বিন আবু তালিব(রাঃ)
৫। হযরত তালহা বিন ওবাইদুল্লাহ(রাঃ)
৬। হযরত জোবায়ের বিন আল আওয়াম(রাঃ)
৭। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ(রাঃ)
৮। হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস(রাঃ)
৯। হযরত সায়ীদ বিন জায়েদ(রাঃ)
১০। হযরত আবু ওবায়দা ইবনে জাররাহ(রাঃ)