সামাজিক সৌন্দর্যের বিধান
মাতা–পিতার সাথে সদ্ব্যবহার
১. মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে, এ উত্তম ব্যবহারের সুযোগ উভয় জাহানের জন্যে সৌভাগ্য মনে করবে, আল্লাহর পর মানুষের ওপর সব চাইতে বড় অধিকার হলো মাতা-পিতার। মাতা-পিতার অধিকারের গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহর অধিকারের সাথে বর্ণনা করেছেন এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বীকারের নির্দেশের সাথে সাথে মাতা-পিতার কৃতজ্ঞতা স্বীকারের নির্দেশ ও দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন-
“আর তোমার প্রতিপালক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত করবে না এবং মাত-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে”।
(সূরায়ে বনী ইসরাইল)
“হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ বলেছেন, একদা রাসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, কোন আমল আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়? রাসূল (সাঃ) বললেন, নামায সময় মত পড়া। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,এর পর কোন কাজ আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়? তিনি বললেন, মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করা। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, এর পর কি? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা”।
(বুখারী, মুসলিম)
হযরত আবদুল্লাহ বলেছেন যে, এক ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে হাযির হয়ে বলা আরম্ভ করলো আমি আপনার সাথে হিজরত ও জিহাদের জন্যে বাইয়াত করছি। আর আল্লাহর নিকট এর সওয়াব চাই। রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মাতা-পিতার মধ্যে কেউ কি জীবিত আছেন? সে বলল, জ্বী, হ্যাঁ, তাদের উভয়ই জীবিত আছেন। তিনি বললেন, তা হলে তুমি কি সত্যি আল্লাহর নিকটে তোমার হিজরত ও জিহাদের পুরস্কার চাও? সে বলল, জ্বী, হ্যাঁ, আমি আল্লাহর নিকট পুরস্কার চাই। রাসূল (সাঃ) বললেন, “যাও তোমার মাতা-পিতার খেদমতে থেকে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার কর”।
(মুসলিম)
হযরত আবু উমামা বলেছেন, “এক ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ)! সন্তানের উপর মাতা-পিতার কি অধিকার? তিনি বললেন, “তারাই তোমার বেহেশত এবং তারাই তোমার দোযখ”।
(ইবনু মাজাহ)
অর্থাৎ তুমি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করে বেহেশতের অধিকারী হবে এবং তাদের অধিকারসমূহকে পদদলিত করে দোযখের ইন্ধনে পরিগণিত হবে।
২. মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। উপকারীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও ভদ্রতা প্রধান কর্তব্য এবং ইহা প্রকৃত সত্য যে, আমাদের অস্তিত্বের বাহ্যিক অনুভূতির কারণ হলো মাতা-পিতা। অতঃপর তাদের লালন-পালন থেকে আমরা লালিত-পালিত হয়ে বড় হই এবং বোধ জ্ঞান সম্পন্ন হই। তাঁরা যে অসাধারণ ত্যাগ, অনুপম চেষ্টা ও অত্যন্ত ভালবাসার সাথে আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন, তার দাবী হলো, আমাদের বক্ষস্থল তাঁদের আন্তরিক ভরসা মাহাত্ম্য ও ভালবাসায় মশগুর থাকবে এবং অন্তরের প্রতিটি তন্ত্রী তাদের কৃত্জঞতায় আবদ্ধ থাকবে। এ কারণে আল্লাহ তাআলা নিজের কৃত্জ্ঞতা স্বীকারের সাথে সাথে মাতা-পিতার কৃতজ্ঞতা স্বীকারের নির্দেশ দিয়েছেন-
আরবি
“আমার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো এবং মাতা-পিতারও। (লোকমান)
৩. মাতা-পিতাকে সর্বদা সন্তুষ্ট রাখতে চেষ্টা করবে। তাদের ইচ্ছা ও মেজাজের বিপরীত এমন কোন কথা বলবে না যা দ্বারা তারা তাদের অন্তরে ব্যথা পায়। বিশেষতঃ বৃদ্ধাবস্থায় যখন তাদের মেজাজ বা স্বভাব খিটখিটে হয়ে যায়, তখন মাতা-পিতা এমন কিছু দাবী করে বসে যে, যা অবাস্তব। এমতাবস্থায় তাদের প্রতিটি কথ সস্তুষ্টচিত্তে সহ্য করবে এবং তাদের কোন কথায় বিরক্ত হয়ে এমন বলবে না যা দ্বারা তাদের অন্তরে ব্যথা পায় এবং তাদের আবেগে আঘাত লাগে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা এ সম্পর্কে বলেন-
আরবি
“তাঁদের একজন বা উভয়জন যদি তোমার কাছে বৃদ্ধাবস্থায় থাকে তখন তাদের আচরণে রাগ করে উহ করবে না এবং তাদেরকে ধমকও দেবে না”।
মূলতঃ এ বয়সে কথ সহ্য করার শক্তি থাকে না, দুর্বলতার কারণে নিজের গুরুত্ব প্রাধান্য পায়, এর ফলে সাধারণ কথাও কর্কশ অনুভূত হয়, সুতরাং এ নাজুক অবস্থার প্রতি দৃষ্টি দিয়ে নিজের কোন কথা বা কাজে মাতা-পিতাকে অসন্তুষ্টই হবার সুযোগ দেবে না।
হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “পিতার সন্তুষ্টিই আল্লাহর সন্তুষ্টি, পিতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি”।
(তিরমিযি, ইবনে হাব্বান, হাকেম)
অর্থাৎ-কেউ যদি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে চায় সে যেন পিতাকে সন্তুষ্ট করে, পিতাকে অসন্তুষ্ট করলে সে আল্লাহর গযব ও আযাব ডেকে আনে।
হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) থেকৈ বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি মাতা-পিতাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় রেখে রাসূর (সাঃ)-এর কাছে হিজরতের ওপর বাইয়াত করার জন্যে উপস্থিত হলো। তখন রাসূল (সাঃ) বললেনঃ যাও তোমার মাতা-পিতার নিকট ফিরে যাও, তাদেরকে তেমনিভাবে সন্তুষ্ট করে এসো যেমনিভাবে তাদেরকে কাঁদিয়েছিলে।
(আবু দাউদ)
৪. মনে প্রাণে মাতা-পিতার খেদমত করবে। আল্লাহ যদি তোমাকে এ সুযোগ দিয়ে থাকেন তা হলে তোমাকে যেন এ তাওফীক দান করেছেন যে, তুমি নিজেকে বেহেশতের অধিকারী ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অধিকারী করতে পার। মাতা-পিতার খেদমত দ্বারাই ইহকাল ও পরকালের পুণ্য, সৌভাগ্য এবং মহত্ব অর্জিত হয় এবং উভয় জগতের বিপদাপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি তার বয়স এবং জীবিকা বাড়াতে চায় সে যেন তার মাতা-পিতার সাথে সৌজন্যমূলক ব্যবহার ও তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করে”।
(আততারগীব ওয়াততারহীব)
রাসুল (সাঃ) বলেছেনঃ “সে ব্যক্তি অপমানিত হোক, আবার সে অপমানিত হোক এবং আবার সে অপমানিত হোকঅ সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কে সে ব্যক্তি? তিনি উত্তর দিলেন, যে ব্যক্তি তার মাতা-পিতাকে বৃদ্ধাবস্থায় পেলো অথবা তাদের কোন একজনকে পেলো-তারপরও (তাদের খেদমত করে) বেহেশতে প্রবেশ করতে পারেনি”।
(মুসলিম)
এক জায়গায় তো তিনি মাতা-পিতার খেদমতকে জিহাদের মত মহান ইবাদতের সাথেও স্থান দিয়েছেন এবং এক সাহাবীকে জিহাদে যাওয়া থেকে বিরত করে মাতা-পিতার খেদমত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে গিয়ে জিহাদে শরীক হবার উদ্দেশ্য প্রকাশ করলো। রাসূল (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মাতা-পিতা কি জীবিত আছে? সে উত্তর দিল, জ্বী, হ্যাঁ। তিনি বললেন, যাও আগে তাদের খেদমত করতে থাক, এটাই তোমার জিহাদ।
(বুখারী, মুসলিম)
৫.মাতা-পিতাকে আদব এবং সম্মান করবে এবং এমন কোন কথা বা কাজ করবে না যার দ্বারা তাদের সম্মানের হানি হয়।
আরবি
“তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলবে”।
একবার হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) হযরত ইবনে আব্বাসকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি চান যে, দোযখ থেকে দূরে থাকুন এবং বেহেশতে প্রবেশ করুন? ইবনে আব্বাস (রাঃ) বললেন, নিশ্চয়ই! হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) আবারও জিজ্ঞেস করলেন, আপনার মাতা-পিতা জীবিত আছে। ইবনে ওমর (রাঃ) বললেন, আপনি যদি তাঁদের সাথে নম্র ব্যবহার করেন তাঁদের খোরপোষের দিকে খেয়াল রাখেন, তাহলে নিশ্চয়ই আপনি বেহেশতে প্রবেশ করবেন। তবে শর্ত হলো যে, কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকতে হবে”।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
৬. মাতা-পিতা সাথে বিনয় ও নম্র ব্যবহার করবে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন-আরবি
“তাদের (মাতা-পিতার) সাতে বিনয় ও নম্রতাসুলভ আচরণ করবে।
বিনয় ও নম্র ব্যবহারের অর্থ হলো সব সময় তাঁদের মর্যাদার প্রতি খেয়াল রাখবে, কখনো তাদের সামনে নিজের বাহাদুরী প্রকাশ করবে না এবং তাঁদের মর্যাদা হানিকর কোন ব্যবহার থেকে বিরত থাকবে।
৭. মাতা-পিতাকে ভালবাসবে এবং তাদেরকে নিজের সৌভাগ্য ও পরকালে পুরস্কার লাভের জন্য মনে করবে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ
“যে নেক সন্তান মাতা-পিতার প্রতি একবার ভালবাসার দৃষ্টিতে তাকাবে আল্লাহ তা’আলা প্রতিদানে তাকে একটি মকবুল হজ্বের সওয়াব দান করবেন। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ। কেউ যদি দয়া ও ভালবাসার সাথে একদিনে একশতবার দেখে? তিনি বললেন, জ্বী, হ্যাঁ, কেউ যদি একশতবার এরূপ করে তবুও। আল্লাহ তোমাদের ধারণা থেকে অনেক প্রশস্ত এবং সংকীর্ণতা থেকে পবিত্র”।
(মুসলিম)
৮. মনে-প্রাণে মাতা-পিতার আনুগত্য করবে। এমনকি তারা যদি কিছুটা সীমালংঘনও করে তবুও সন্তুষ্টচিত্তে তাদের আনুগত্য করবে, তাদের মহান উপকারসমূহের কথা চিন্তা করে তাদের কোন দাবী যদি তোমার রুচি ও স্বভাব বিরোধী হয় তবুও তা সন্তুষ্টচিত্তে পূরণ করবে, তবে তা দীনি বিধানসম্মত হওয়া চাই।
হযরত আবু সায়ীদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, ইয়ামনের এক ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হলো, রাসূল (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়ামনে তোমার কেউ আছে? লোকটি উত্তর দিল, আমার মাতা-পিতা আছে। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তারা তোমাকে অনুমতি দিয়েছে কি? সে বলল, না, তিনি বললেন, আচ্ছা, তা হলে তুমি ফিরে যাও এবং মাতা-পিতার কাছ থেকে অনুমতি নাও। তারা যদি অনুমতি দিয়ে দেয় তাহলে জিহাদে শরীক হবে নতুবা তাদের খেদমত করতে থাক।
(আবু দাউদ)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত ,রাসূল (সাঃ) বলেছেন, কোন ব্যক্তি এমন অবস্থায় ভোর করলো যে, আল্লাহ তা’আলা তাঁর পবিত্র কুরআনে মাতা-পিতা সম্পর্কে বর্ণিত নির্দেশগুলেঅ ঠিক ঠিক পালন করেছে তা হলে সে এমন অবস্থায় ভোর করেছে যে, তার জন্যে বেহেশতের দু’টি দরজা খোলা হলো। আর মাতা-পিতার মধ্য থেকে একজন জীবিত থাকলে খোলা হলো এক দরজা। আর যে ব্যক্তি এ অবস্থায় ভোর করলো যে, তার মাতা-পিতা সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে সে এমন অবস্থায় ভোর করলো যে, তার জন্যে দোযখের দুটি দরজা খোলা এবং মাতা-পিতার মধ্য থেকে একজন জীবিত থাকলে দোযখের একটি দরজা খোলা হলো। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো, আয় আল্লাহর রাসূল! মাতা-পিতা যদি তার সাথে সীমা অতিক্রম করে তবুও কি? আল্লাহর রাসূল বললেন, তবুও। যদি সীমা অতিক্রম করে তবুও। যদি সীমা অতিক্রম করে তবুও।
(মেশকাত)
৯.মাতা-পিতাকে তোমার ধন-সম্পদের প্রকৃত মালিক মনে করবে এবং তাদের ন্যে খরচ করবে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন-
“লোকেরা আপনাকে জিজ্ঞেস করে, তারা কিসে খরচ করবে? আপনি তাদেরকে বলে দিন, যা খরচ করবে তার প্রথম হকদার হল মাতা-পিতা”।
(সূরা বাকারা)
একবার রাসূল (সাঃ) এর দরবারে এক ব্যক্তি এসে তার মাতা-পিতার সম্পর্কে ফরিয়াদ করলো যে, সে যখন ইচ্ছে তখনই আমার ধন-সম্পদ নিয়ে নেয়। রাসূল (সাঃ) তার পিতাকে ডেকে পাঠালো। এক বৃদ্ধ দুর্বল ব্যক্তি এসে উপস্থিত হলো। আল্লাহর রাসূল তাকে ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, তখন সে বলা শুরু করলোঃ
“আয় আল্লাহর রাসূল! এমন এক সময় ছিল যখন এ ছেলে ছিল দুর্বল ও অসহায়, আমি ছিলাম শক্তিমান। আমি ছিলাম ধনী আর এ ছিল শূন্য হাত। আমি কখনও আমার সম্পদ নিতে বাধা দেইনি। আজ আমি দুর্বল আর এ শক্তিশালী। আমি শূন্য হাত আর এ ধনী। এখন সে তার সম্পদ আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে।
বৃদ্ধের এ সকল কথা শুনে দয়াল নবী কেঁদে দিলেন আর বৃদ্ধের ছেলেকে সম্বোধন করে বললেন, “তুমি এবং তোমার ধন-সম্পদ সবই তোমার পিতার”।
১০. মাতা-পিতা অমুসলিম হলেও তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে, তাদের সম্মান সম্ভাষণ ও খেদমত করতে থাকবে। তবে সে যদি শিরক ও গুনাহের নির্দেশ দেয় তাহলে তারেদ আনুগত্য অস্বীকার করবে এবং তাদের কথা বা নির্দেশ পালন করবে না।
“মাতা-পিতা যদি কাউকে আমার সাথে শরীক করার জন্যে চাপ প্রয়োগ করে যে সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই তাহলে তাদের কথা কখনও মানবে না আর পার্থিব ব্যাপারে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে”।
(সূরা লুকমান)
হযরত আসমা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ)-এর জীবিতাবস্থায় আমার মাতা মুশরিক থাকা কালীন আমার নিকট আসে, আমি রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে আরজ করলাম, “আমার মাতা আমার নিকট এসেছে অথচ সে ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন। সে ইসলামকে ঘৃণা করে, এমতাবস্থায়ও কি আমি তার সাথে সদ্ব্যবহার করবো? রাসূল (সাঃ) বললেন, অবশ্যই তুমি তোমার মায়ের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে থাকো”।
(বুখারী)
১১. মাতা-পিতার জন্যে নিয়মিত দোআ করতে থাকবে, তাদের অনুগ্রহের কথা স্মরণ করে আল্লাহর দরবারে কেঁদে কেঁদে দোআ করবে এবং অত্যন্ত আন্তরিকতা ও আন্তরিক আবেগের সাথে তাদের দয়া ও ক্ষমার জন্য প্রার্থনা করবে।
আল্লাহ পাক বলেন-
আরবি
“আর এ দোআ কর, হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া করো যেমনি তারা আমাকে শৈশবকালে প্রতিপালন করেছিল”।
অর্থাৎ-হে প্রতিপালক! শৈশবকালে নিরুপায় অবস্থায় তারা যেভাবে আমাকে দয়া ও করুণা, চেষ্ট তদবীর, এবং মহব্বত ও ভালবাসা দিয়ে লালন-পালন করেছে এবং আমার জন্যে তাদের সুখ শান্তি পরিহার করেছে, আয় আল্লাহ! এখন তারা বার্ধক্যজনিত দুর্বলতা ও নিরুপায় হয়ে আমার থেকে বেশী দয়া ও করুণার মুখাপেক্ষী, আয় আল্লাহ! আমি তাদের প্রতিদান দিতে সক্ষম নই। তুমিই তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করো এবং তাদের দুরাবস্থার প্রতি রহমতের দৃষ্টি নিক্ষেপ করো।
১২. মায়ের খেদমতের দিকে খেয়াল রাখবে বিশেষভাবে। মা স্বভাবগতভাবে অত্যন্ত দুর্বল ও অনুভূতিশীল হয়ে থাকে। তিনি সেবা-যত্ন ও সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে বেশী মুখাপেক্ষী, আবার তাঁর অনুগ্রহ ও ত্যাগ পিতার তুলনায় অনেক বেশী, অতএব ইসলাম মায়ের অধিকার বেশী দান করেছেন এবং মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার করার জন্য বিশেষভাবে উৎসাহ দান করেছেন।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-
“আমি মানুষদেরকে মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি, তার মা তাকে পেটে ধারণ করেছে, প্রসবকালে কষ্ট করেছে, পেটে ধারণ এবং দুধ পানের এ সময় হলো ত্রিশ মাস”।
(সূরায়ে আহকাফ)
পবিত্র কুরআনে মাতা এবং পিতা উভয়ের সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়ে বিশেষভাবে পর্যায়ক্রমে মায়ের দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার চিত্রগুলো প্রভাব বিস্তারকারী দৃষ্টিতে তুল ধরেছেন এবং অত্যন্ত সুন্দরভাবে মানবিক দিক থেকে এ সত্য উদঘঅটন করেছেন যে, প্রাণ উৎসর্গকারিণী মাতা, পিতা থেকে আমাদের খেদমত ও সদ্ব্যবহার পাওয়ার বেশী অধিকারিণী মাতা, পিতা থেকে আমাদের খেদমত ও সদ্ব্যবহার পাওয়ার বেশী অধিকারিণী আবার রাসূল আকরাম (সাঃ) এ সত্যকে বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন।
হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-এর দরাবারে এসে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমার সদ্ব্যবহার পাওয়ার সব থেকে বেশী অধিকারী কোন ব্যক্তি? রাসূল (সাঃ) বললেন, তোমার মাতা। লোকটি আবারও জিজ্ঞেস করলো, অতঃপর কে? তিনি (সাঃ) উত্তর দিলেন, তোমার মাতা। লোকটি পুনঃ জিজ্ঞেস করলো, অতঃপর কে? তখন তিনি বললেন, তোমার পিতা।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
হযরত জাহেমাহ (রাঃ) নবী করীম (সাঃ)-এর দরবারে হাযির হয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার ইচ্ছা যে আমি আপনার সাথে জিহাদে অংশ গ্রহণ করবো, এখন এ ব্যাপারে পরামর্শ গ্রহণের জন্য আপনার নিকট এসেছি বলুন কি নির্দেশ? রাসূল (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মাতা জীবিত আছেন? জাহেমাহ (রাঃ) বললেন, জ্বী, জীবিত আছেন। রাসূল (সাঃ) বললেন, তাহলে ফিলে যাও, তার খেদমতে লেগে থাকো, কারণ বেহেশত তাঁর পায়ের নিচে।
(ইবনে মাজাহ, নাসায়ী)
হযরত ওয়াইস ক্বরণী (রহঃ) রাসূল (সাঃ)-এর যুগে জীবিত ছিলেন, কিন্তু তাঁর সাক্ষাত পেয়ে ধন্য হতে পারেন নি। তার এক বৃদ্ধা মাতা ছিলেন, রাতদিন তাঁর খেদমতে লেগে থাকতেন। তার নবী করীম (সাঃ)-কে দেখার বড়ই আকাংখা ছিল। সুতরাং হযরত ওয়াইস ক্বরণী (রহঃ) রাসূল (সাঃ)-এর সাথে দেখা করতে আসতেও অনুমতি চেয়েছিল। রাসূল (সাঃ) নিষেধ করলেন। হজ্ব পালনেরও তার অত্যন্ত আগ্রহ থাকা সত্বেও যতদিন তাঁর মা জীবিত ছিলেন ততদিন তাঁকে একাকী রেখে যাওয়ার চিন্তায় হজ্ব করেননি। তার মৃত্যুর পরই এ আগ্রহ পূরণ করেন।
১৩. দুধ মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার করবে, তাঁর খেদমত করবে এবং তাকে সমান মর্যাদা দান করবে। হযরত আবু তোফাইল (রাঃ) বলেন, আমি জে’রানা নামক স্থানে দেখতে পেলাম যে, রাসূল (সাঃ) গোস্ত বন্টন করছেন। এমতাবস্থায় এক বৃদ্ধা এসে রাসূল (সাঃ)-এর একেবারে নিকটে চলে গেলেন। তিনি তার বসার জন্যে নিজের চাদর বিছিয়ে দিলেন, তিনি তার ওপর বসে পড়লে আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ মহিলাটি কে?” লোকেরা উত্তর দিল যে, ইনি রাসূল (সাঃ)-এর দুধ মা।
(আবু দাউদ)
১৪.মাতা-পিতার মৃত্যুর পরও তাদেরকে মনে রাখবে এবং সদ্ব্যবহার করার জন্যে নিম্নের কথাগুলোর প্রতি সংকল্প থাকবে।
(i)মাতা-পিতার মাগফিরাতের জন্যে সর্বদা দোআ করবে। পবিত্র কুরআনে মুমিনদেরকে এ দোআ শিক্ষা দেয় হয়েছে।
“হে আমাদের প্রতিপালক!আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং সকল মুমিনকে কিয়ামতের দিন ক্ষমা করে দিন”।
হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তি যখন তার প্রাপ্ত মর্যাদা দেখতে পায় তকন আশ্চর্য্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, এটা কিভাবে হলো? আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তর দেয়া হয় যে, তোমার সন্তানেরা তোমার জন্যে সর্বদা আল্লাহর দরবারে মাগফিরাতের দোয়া করছে এবং আল্লাহ তা কবুল করেছেন।
হযরত আবু হুরাইরাহ থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন- মানুষ মারা গেলে যখন তার আমলের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়, শুধু তিনটি এমন কাজ আছে যা মৃত্যুর পরও উপকারে আসে, (ক) ছদকায়ে জারিয়া,অর্থাৎ এমন নেক কাজে দান করা যা মৃত্যুর পরও চলতে থাকে, (খ) তার ইলম যা হতে লোক দীনি উপকার পায়, (গ) সেই নেক্কার সন্তানেরা যারা তার জন্যে মাগফিরাতের দোআ করতে থাকে।
(ii)মাতা-পিতার কৃত ওয়াদা ও অছিয়ত পূরণ করবে। মাতা-পিতা জীবনে অনেক লোকের সাথে ওয়াদা করতে পারে, আল্লাহর সাথে কোন ওয়াদা করতে পারে, তাদের যিম্মায় ঋণ থাকতে পারে যা তারা আদায় করার সুযোগ পায়নি, মৃত্যুকালে কোন অছিয়ত করতে পারে, অবশ্যই সন্তান তার ক্ষমতানুযায়ী সেগুলো পূরণ করবে।
(iii) পিতামাতার বন্ধু বান্ধবের সাথেও সদ্ব্যবহার করবে। তাদের সম্মান করবে, তাদের সাথে পরামর্শ করবে এবং নিজে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় সম্মানিত ব্যক্তিদের মতামত গ্রহণ করবে। তাদের মত ও পরামর্শকে মর্যাদা দেবে। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “সব চাইতে বেশী ভাল ব্যবহার হলো, যে ব্যক্তি তার পিতার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ভাল আচরণ করবে”।
“একবার হযরত আবু দরদা (রাঃ) অসুখে পড়লেন এবং অসুখ বাড়তেই থাকলো। এমনকি তার বাঁচারও কোন আশা রইল না, তখন হযরত ইউসাফ বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) অনেক দূর থেকে সফর করে তাকে দেখতে এলেন, হযরত আবু দরদা (রাঃ) তাকে দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথা থেকে এসেছেন? হযরত ইউসুফ বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) জবাবে বললেন, “আমি এখানে শুধু আপনাকে দেখতেই এসেছি। কেননা আপনার সঙ্গে আমার পিতার বন্ধুত্বপূর্ণ গভীর সম্পর্ক ছিল”।
হযরত আবু দারদাহ (রাঃ) বলেন, আমি মদীনায় আসার পর হযরত আবদুল্লাহ বি ওমর (রাঃ) আমার নিকট এসে বলতে লাগলেন, আবু দারদাহ, তুমি কি জান আমি কেন তোমার নিকট এসেছি? আমি বললাম, আমি কি করে জানবো যে আপনি কেন এসছেন? তখন হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বললেন, রাসূল (সাঃ)-কে বরতে শুনেছি যে, “যে ব্যক্তি কবরে তার পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে চায় সে যেনো তার পিতার বন্ধু-বান্ধবদের সাথেও সদ্ব্যবহার করে”। তারপর বললেন, ভাই! আমার পিতা হযরত ওমর (রাঃ) ও আপনার পিতার মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। আমি চাই যে, ঐ বন্ধুত্ব অটুট থাকুক এবং আমি তার হক আদায় করি”।
(ইবনে হাব্বান)
(iv) মাতা-পিতার আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সর্বদা ভাল আচরণ করবে এবং তাদের নিকটাত্মীয়দের প্রতিও অসদাচরণ করবে না। ঐ সকল আত্মীয়দের থেকে অমনোযোগী হওয়া মূলতঃ মাতা-পিতা থেকে অমনোযোগী হওয়ার তুল্য। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, বাপ-দাদা ও মাতা-পিতা থেকে অমনোযোগী হওয়া আল্লাহর অকৃতজ্ঞতার শামিল”।
১৫.আল্লাহ না করুন! মাতা-পিতার জীবিতাবস্থায় যদি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার ও তাদের প্রতি হক আদায়ের ত্রুটি হয়েও থাকে তবুও আল্লাহর নিকট সদা সর্বদা তাদের জন্যে মাগফিরাতের দোআ করবে। আশা করা যায় যে, আল্লাহ তাআলা তোমার ত্রুটিসমূহ ক্ষমা করে তার নেক বান্দাহদের মধ্যে শামির করে নেবেন।
হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহর কোন বান্দাহ যদি মাতা-পিতার জীবিতাবস্থায় তাদের প্রতি অসদ্ব্যবহার করে থাকে, এবং এমতাবস্থায় মাতা-পিতার কোন একজনের অথবা্ উভয়ের মৃত্যুবরণ হয়ে থাকে তাহলে এখন তার উচিৎ যে, সে যেন আল্লাহর নিকট তাদের জন্যে মাগফিরাত কামনা করতে থাকে, যেনো আল্লাহ তাকে তাঁর রহমতের দ্বারা তাঁর নেক বান্দাহদের অন্তর্ভূক্ত করে নেন।
বৈবাহিক জীবনের আদবসমূহ
ইসলাম যে সভ্যতা ও সংস্কৃতির আশা করে তা তখনই অস্তিত্ব লাভ করতে পারে যখন ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে পবিত্র শান্তিময় সমাজ গঠন করা সম্ভব হয়। পবিত্র সমাজ গঠনের জন্যে আবশ্যক হচ্ছে যে,পারিবারিক ভিত্তিতে স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে জীবনের যে সূচনা হয় তার সৌন্দর্য ও দৃঢ়তা। আর তখনই সম্ভব যখন স্বামী-স্ত্রী উভয়ে তাদের বৈবাহিক জীবনের নীতি ও কর্তব্য সম্পর্কে সুন্দরভাবে অবহিত থাকে এবং ঐ সকল নীতি ও কর্তব্য পালনে উভয়ে সচেতন হলে তাদের জীবন সুখময় হয়।
স্বামীর সাথে সম্পর্কিত নীতি ও কর্তব্যসমূহ
১. স্ত্রীর সাথে উত্তম আচরণের অভ্যাস করবে। তার অধিকারসমূহ স্বতস্ফূর্তভাবে আদায় করবে এবং প্রত্যেক ব্যাপারে উপকার ও আত্মোৎসর্গের পন্থা অবলম্বন করবে, আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
“তোমরা স্বামীরা তোমাদের স্ত্রীদের সাথে উত্তম আচরণ করবে”।
রাসূল (সাঃ) বিদায় হজ্বের ভাষণে বিপুল জনতাকে সম্বোধন করে বলেছেন শুন! নারীদের সাথে উত্তম আচরণ করো, কেননা,তারা তোমাদের নিকট কয়েদীর মত আবদ্ধ, তাদের পক্ষ থেকে কোন প্রকার অবাধ্যতা প্রকাশ পাওয়া ব্যতীত তাদের সাথে তোমাদের খারাপ আচরণ করার কোন অধিকার নেই। তারা যদি কোন অপরাধ করেই ফেলে তাহলে তাদের বিছানা পৃথক করে দাও আর তাদেরকে যদি মারতেই হয় তাহলে এমনভাবে মারবে না যাতে তারা মারাত্মক আঘাত পায়-অতঃপর তারা যদি তোমাদের কথামত চলতে আরম্ভ করে তখন তাদের ব্যাপারে অনর্থক অজুহাত খুঁজবে না।
তোমাদের কিছু অধিকার তোমাদের স্ত্রীদের ওপর আছে, তাহলো তারা তোমাদের বিছানাকে ঐ সকল লোকদের দ্বারা পদদলিত করবে না যাদেরকে তোমরা অপছন্দ করো আর তোমাদের ঘরে এমন লোকদের কখনো প্রবেশ করতে দেবে না যাদেরকে তোমরা অপছন্দ করো। শুন! তোমাদের অধিকার এই যে, তোমরা তাদেরকে যথাসাধ্য ভাল খানা খাওয়াবে এবং উত্তম কাপড় পরিধান করাবে।
(রিয়াদুস সালেহীন)
অর্থাৎ খানাপিনার এমন ব্যবস্থা করবে যাতে স্বামী-স্ত্রীর অনুপম নৈকট্য আন্তরিক সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের যথোপযুক্ত নিদর্শন পরিস্ফুটিত হয়।
২. যথাসম্ভব স্ত্রীর প্রতি সুধারণা পোষণ করবে। তার সাথে জীবন-যাপনে ধৈর্য্য, সহ্য এবং সহনশীলতার পরিচয় দেবে। যদি তার আকৃতি অথবা শুভ্যাস ও চরিত্র অথবা আচার-ব্যবহার এবং জ্ঞান বুদ্ধিতে কোন ত্রুটিও থাকে তাহলে ধৈর্য্যের সাথে তা মেনে নিবে আর তার মধ্যে যেসব গুণ আছে তার প্রতি লক্ষ্য করে উদারতা, ক্ষমা, ত্যাগ এবং আপোষমূলক আচরণ করবে।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন,’ওয়াছলুহু খায়রুন’ ‘আপোষকামিতা বড়ই উত্তম’।
মুমিনদের হেদায়তের উদ্দেশ্যে আল্লাহ পাক বলেছেন-
“অতঃপর কোন স্ত্রী যদি তোমাদের অপছন্দ হয় তাহলে সম্ভবতঃ তার মাত্র একটি বিষয় তোমাদের অপছন্দ অথচ আল্লাহ তার মধ্যে (তোমাদের জন্যে) অনেক ভাল জিনিস রেখে দিয়েছেন”।
(সূরায়ে নিসা-১৯)
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ
“কোন মুমিন তার ঈমানদার স্ত্রীকে ঘৃণা করবে না, যদি স্ত্রীর কোন এক অভ্যাস তার অপছন্দও হয় তবে সম্ভবতঃ তার অন্য স্বভাব পছন্দনীয় হবে”।
মূলকথা হলো, প্রত্যেক মহিলার মধ্যে কোন না কোন ত্রুটি অবশ্যই থাকবে। যদি স্বামী তার কোন একটি দোষ দেখেই তার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় এবং মন খারাপ করে ফেলে তাহলে কোন পরিবারেই পারিবারিক সুখ-শান্তি পাওয়া যাবে না। উত্তম পন্থা হলো এই যে, স্ত্রীদেরকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে স্ত্রীর সাথে সুখে শান্তিতে জীবন-যাপন অতিবাহিত করার চেষ্টা করবে। সম্ভবতঃ আল্লাহ তাআলা ঐ স্ত্রীর মাধ্যমে এমন কিছু উত্তম বস্তু দান করতে পারেন যা পুরুষের দুর্বল দৃষ্টি শক্তির অনেক ঊর্ধ্বে। যেমনঃ হয়তো স্ত্রীর মধ্যে দীন, ঈমান, স্বভাব ও চরিত্রের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যার জন্য সে পূর্ণ পরিবারের জন্য রহমত হিসেবে পরিগণিত হতে পারে অথবা তার থেকে এমন একটি সু-সন্তান জন্মলাভ করতে পারে যার দ্বারা দ্বারা সমগ্র পৃথিবী উপকৃত হবে এবং সে সারা জীবন পিতার জন্যে সাদক্বায়ে জারিয়া হিসেবে পরিগণিত হবে। অথবা স্ত্রী স্বামীর চরিত্র সংশোধনের হিসেবে পরিগণিত হবে অথবা তার সৌভাগ্যের কারণে আল্লাহ তাআলা ঐ পুরুষকে দুনিয়াতে রুজি রোজগার ও স্বচ্ছলতা দান করবেন। যা হোক স্ত্রীর কোন দোষ দেখে অবিবেচকের মত বৈবাহিক সম্পর্ককে ছিন্ন করবে না বরং উত্তম পন্থায় ধীরে ধীরে ঘরের পরিবেশকে সুন্দর করতে চেষ্টা করবে।
৩. বিবেচকের পন্থা অবলম্বন করবে। স্ত্রীর ত্রুটি-বিচ্যুতি, অজ্ঞতা ও অবাধ্যতা সুলভ আচরণসমূহকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে। মহিলারা স্বভাবতঃ জ্ঞান-বুদ্ধিতে একটু বেশী দুর্বল ও আবেগ প্রবণ হয়, সুতরাং ধৈর্য্য, সহনশীলতা ও ভালবাসা এবং আন্তরিকতার সাথে তাদেরকে সংশোধন করার চেষ্টা করবে এবং ধৈর্য্য ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জীবন-যাপন করবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন-
“মুমিনগণ ! তোমাদের কোন কোন স্ত্রী ও কোন কোন সন্তান তোমাদের শত্রু। সুতরাং তাদের থেকে দূরে থাক, দি তোমরা ক্ষমা, দয়া, মার্জনা ও উপেক্ষা করো তাহলে নিশ্চিত আল্লাহ মহান ক্ষমাপ্রদানকারী ও দয়াবান।
(সূরা তাগাবুন-১৪)
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“নারীদের সাথে সদাচরণ কর। নারীগণ পাঁজড়ের হাড্ডি দ্বারা সৃষ্ট এবং পাঁজযের হাড় এর উপরের অংশ সব চাইতে বেশী বাঁকা, তাকে সোজা করার চেষ্টা করলে ভেঙ্গে যাবে, যদি ঐভাবেই ছেড়ে দাও তা হলে বাঁকাই থেকে যাবে, সুতরাং নারীদের সাথে সদ্ব্যবহার কর”।
(বুখারী, মুসলিম)
৪. স্ত্রীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করবে এবং প্রেম ও ভালবাসাসুলভ আচরণ করবে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
যে উত্তম চরিত্রের অধিকারী সে পূর্ণ মুমিন আর তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সর্বাধিক উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট সর্বাধিক উত্তম”।
(তিরমিযি)
উত্তম চরিত্র ও নম্র স্বভাবের পরীক্ষা ক্ষেত্র হলো পারিবারিক জীবন। পরিবারের লোকদের সাথে সব সময় সুসম্পর্ক থাকে। আর ঘরের অকৃত্রিম জীবনেই স্বভাব ও চরিত্রের প্রতিটি দিক ফুটি উঠে। আর এটাই মূল কথা যে, ঐ ব্যক্তিই পরিপূর্ণ মুমিন যে পরিবারের লোকদের সাথে উত্তম ব্যবহার, হাসি খুশী ও দয়া সুলভ ব্যবহার করে। পরিবারের লোকদের অন্তর আকর্ষণ করবে এবং স্নেহ ও ভালবাসা প্রদান করবে।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, আমি রাসূল (সাঃ)-এর ঘরে পুতুল নিয়ে খেলা করতাম, আমার সাথীরাও আমার সাথে খেলা করতো, যখন রাসূল (সাঃ) আসতেন তখন সকলে এদিক ওদিক লুকিয়ে যেতো, তিনি তাদেরকে খোঁজ করে প্রত্যেককে আমার সাথে খেলা করতে পাঠিয়ে দিতেন।
(বুখারী, মুসলিম)
৫. অত্যন্ত প্রাণখোলাভাবে জীবন সঙ্গিনীর আবশ্যকীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করে দেবে এবং খরচের বেলায় খুব বেশী সংকোচ করবে না। সংগ্রহ করে দেবে এবং খরচের বেলায় খুব বেশী সংকোচ করবে না। নিজের পরিশ্রমের রুজি পরিবারের লোকদের জন্য খরচ করে মানসিক শান্তি ও খুশী অনুভব করবে। খাদ্য ও বস্ত্র স্ত্রীর অধিকার আর এ অধিকারকে খুশী ও প্রশস্ততার সাথে আদায় করার জন্যে যথাসম্ভব চেষ্টা ও তদবীর করা স্বামীর কর্তব্য, খোলা অন্তরে এ কর্তব্য সম্পাদনে শুধু এ পার্থিব জগতেই বৈবাহিক জীবনের সুফল লাভ হয় তা নয় বরং মুমিন ব্যক্তি আখিরাতেও পুরস্কার ও নেয়ামতের অধিকারী হবে।
রাসুল (সাঃ) বলেছেন-
এক দীনার যা তুমি আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেছো, যা তুমি কোন গোলামকে আযাদ করতে ব্রয় করেছো, যা তুমি ভিক্ষুককে দান করেছো এবং যা তুমি পরিবারের লোকদের জন্যে ব্যয় করেছো, এগুলোর মধ্যে সর্বাধিক পুরস্কার ও সওয়াবের অধিকারী ঐ দীনার যা তুমি নিজ পরিবারের লোকদের জন্যে ব্যয় করেছ।
(মুসলিম)
৬. স্ত্রীকে দীনি বিধি-বিধান সংস্কৃতি বা আচার-আচরণে শিক্ষিত করে তুলবে। দীনি শিক্ষা দান করবে। ইসলামী চরিত্রে চরিত্রবান করে সাজিয়ে তুলবে এবং তার প্রশিক্ষণ ও সংশোধনের জন্যে সম্ভাব্য চেষ্টা চালাবে যেনো সে একজন উত্তম স্ত্রী, উত্তম মাতা এবং আল্লাহর নেক বান্দি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে আর তার ওপর নির্ধারিত কর্তব্যসমূহ সুন্দর ও সঠিকভাবে আদায় করতে পারে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন
“মুমিনগণ! নিজেদেরকে ও নিজেদের পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো”।
রাসূল (সাঃ) বাইরে যেমন দাওয়াত ও শিক্ষাদানের কাজে ব্যস্ত থাকতেন তেমনি ঘরেও উক্ত কর্তব্যসমূহ সুচারুরূপে সম্পাদন করতেন। এদিকে ইঙ্গিত করেই পবিত্র কুরআন নবী পত্নীগণকে সম্বোধন করেছে।
“তোমাদের ঘরে আল্লাহর যে সকল আয়াত পাঠ করা হয় এবং বিজ্ঞান সম্মত কথাবার্তা আলোচনা করা হয় এগুলো স্মরণ রেখো”।
পবিত্র কুরআনে রাসূল (সাঃ)-এর মাধ্যমে সকল মুমিনকে হেদায়াত করার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছেঃ
“আপনার পরিবারবর্গকে সালাতের নির্দেশ দিন এবং আপনি নিজেও তার ওপর কায়েম থাকুন”।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“যখন কোন পুরুষ রাতে নিজ স্ত্রীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দুজনে দু’রাকাত (নফল) নামায আদায় করে তখন স্বামীর নাম যিকিরকারীদের মধ্যে এবং স্ত্রীর নাম যিকিরকারিণীদের মধ্যে লিখে নেয়া হয়”।
(আবু দাউদ)
দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ) রাতে আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে ইবাদত করতেন এবং শেষ রাতে জীবন সঙ্গিনীকে ঘুম থেকে জাগাতেন এবং বলতেন, উঠো, নামায পড়ো। অতঃপর কুরআনের আয়াত পাঠ করতেন।
৭. যদি একাধিক স্ত্রী হয় তবে সকলের সাথে সমান ব্যবহার করবে। রাসূল (সাঃ) বিবিদের সাথে সমান আচরণ করতে চেষ্টা করতেন। সফরে যাবার সময় বিবিগণের নামে লটারী দেয়া হতো। লটারীতে যার নাম আসতো তাঁকে সফর সঙ্গিনী করে নিতেন।
হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ) থেকৈ বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“কোন ব্যক্তির যদি দু’জন স্ত্রী হয় আর সে তাদের মধ্যে ইনছাফ ভিত্তিক সমান ব্যবহার না করে তা হলে সে কিয়ামতের দিন এমতাবস্থায় উত্থিত হবে যে, তার অর্ধেক শরীর অচল”।
(তিরমিযি)
অর্থাৎ কিয়ামতের দিন সে অর্ধেক শরীরে উত্থিত হবে।
ইনসাফ ও সম্মানের আসল মর্ম হলো, লেন-দেন ও আচরণে সমতা রক্ষা করা। কোন এক স্ত্রীর প্রতি অন্তরের টান ও প্রেমের জন্যে আল্লাহর নিকট কোন জবাবদিহি করতে হবে না।
স্ত্রী সম্পর্কিত আদব ও কর্তব্যসমূহ
১. অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দে নিজ স্বামীর আনুগত্য করবে এবং এ আনুগত্যে শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ অনুভব করবে, কেননা এটা আল্লাহর নির্দেশ। যে মহিলা আল্লাহর নির্দেশ পালন করবে সে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে। পবিত্র কুরআনে বলা আছে, “ফাসসালিহাতু কানিতাতু” নেককার মহিলাগণ (তাদের স্বামীদের) আনুগত্যকারিণী হয়।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“কোন মহিলা স্বামীর অনুমতি ব্যতীত (নফল) রোযা রাখবে না।
(আবু দাউদ)
স্বামীর আনুগত্য ও শ্রদ্ধার গুরুত্ব প্রকাশ করে রাসূল (সাঃ) নারীদেরকে সতর্ক করেছেন এভাবে-
দু’প্রকারের লোক আছে যাদের নামায তাদের মাথা থেকে উপরে উঠে না-(১) সেই গোলামের নামায, যে গোলাম নিজের মনিব থেকে পলায়ন করে চলে যায় অর্থাৎ পলাতক গোলাম, এবং যে পর্যন্ত (সে মনিবের নিকট) ফিরে না আসে। (২) সেই মহিলার নামায যে স্বামীর নাফরমানী থেকে বিরত না হয়।
(অততারগীব ওয়াত তারহীব)
২. নিজের ইজ্জত ও সতীত্ব রক্ষার পূর্ণ চেষ্টা করবে এবং এমন কথাবার্তা ও কাজ থেকে বিরত থাকবে যার দ্বারা সতীত্বের ওপর কালিমা লেপনের সন্দেহও না হয়, আল্লাহর হেদায়াতের উদ্দেশ্যও তাই এবং বৈবাহিক জীবনকে সুন্দরভাবে গঠন করে নেয়ার জন্যেও ইহা অত্যন্ত জরুরী। স্বামীর অন্তরে যদি এ ধরনের কোন সন্দেহ সৃষ্টি হয় তা হলে স্ত্রীর কোন খেদমত, আনুগত্য এবং কোন নেক কাজ তাকে (স্বামীকে) নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে পারবে না। এ ব্যাপারে সামান্য দুর্বলতার দ্বারাও স্বামীর অন্তরে সন্দেহ সৃষ্টি করতে শয়তান কামিয়াব হয়ে যায়। সুতরাং মানবিক দুর্বলতার প্রতি দৃষ্টি রেখে খুব সাবধানতা অবলম্বন করবে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“স্ত্রীগণ যখন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে, নিজের ইজ্জত রক্ষা করে এবং নিজ স্বামীর আনুগত্য করে তা হলে সে বেহেশতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে।
(আততারগীব ওয়াততারহীব)
৩. স্বামীর অনুমতি ও সন্তুষ্টি ব্যতীত ঘরের বাহির হবে না, স্বামী যে সকল বাড়ীতে যেতে অপছন্দ করে সে সকল বাড়ীতে যাবে না এবং স্বামী যে সকল লোকদের ঘরে আসা পছন্দ করে না তাদেরকে ঘরে আসতে অনুমতি দেবে না।
হযরত মুয়ায বিন জাবাল (রাঃ ) বলেছেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেন-
“আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী কোন মহিলার পক্ষে এমনটি জায়েয নয় যে, সে এমন লোককে স্বামীর ঘরে আসতে অনুমতি দেবে যার আসা স্বামী পছন্দ করে না। স্বামীর অনুমতি নিয়ে স্বামীর ঘর থেকে বের হবে আর স্ত্রী স্বামীর ব্যাপারে অন্য কারো কথা মানবে না।
(তারগীব ও তারহীব)
অর্থাৎ স্বামীর ব্যাপারে স্বামীর ইচ্ছা ও চোখের ইশারা অনুযায়ীই কাজ স্ত্রী করবে, এর বিপরীত অন্যের যক্তি পরামর্শ কখনো গ্রহণ করবে না।
৪. সর্বদা নিজের কথা ও কাজ, চাল-চলন ও রীতি-নীতির দ্বারা স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করবে। সফল বৈবাহিক জীবনের কর্তব্যও এটা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতে প্রবেশের পথও এটা।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“যে মহিলা স্বামীকে খুশী রেখে মৃত্যুবরণ করলো সে অবশ্যই বেহেশতে প্রবেশ করবে”।
রাসুল (সাঃ) আরো বলেছেন-
যখন কোন ব্যক্তি নিজের স্ত্রীকে মানবিক প্রয়োজনে কাছে ডাকে আর সে তার ডাকে সাড়া না দেয় এবং এ কারণে স্বামী সারা রাত তার ওপর অসন্তুষ্ট থাকে এমতাবস্থা ফিরিশতা ভোর পর্যন্ত তার ওপর অভিশাপ করতে থাকে”।
(বুখারী, মুসলিম)
৫. নিজের স্বামীকে ভালবাসবে এবং তার ভালবাসার মর্যাদা দেবে। এটা জীবনের সৌন্দর্য্যের উপকরণ এবং জীবন পথের মহান সহায়। আল্লাহ তাআলার এ নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করবে এবং এ নেয়ামতেরও মর্যাদা দেবে।
রাসূল (সাঃ) একস্থানে বলেছেন-
“দু’জন নারী পুরুষের ভালবাসা স্থাপনকারীর জন্যে বিবাহ থেকে উত্তম আর কোন বস্তু পাওয়া যায়নি”।
হযরত ছুফিয়া (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-কে অকেন ভালবাসতেন। রাসূল (সাঃ) যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন তখন অত্যন্ত দুঃখের সাথে বললেন, “তাঁর স্থলে যদি আমি অসুস্থ হতাম!” রাসূল (সাঃ)-এর অন্যান্য বিবিগণ এরূপ ভালবাসা প্রকাশের কারণে আশ্চর্যান্বিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, “লোক দেখানো নয়, বরং সত্যই বলছে”।
৬. স্বামীর উপকার স্বীকার করবে তার শুকরিয়া আদায় করবে। তোমার স্বামীই তো তোমার সর্বাধিক উপকারী যিনি তোমাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে সর্বতোভাবে ব্যস্ত থাকেন, তোমার প্রত্যেকটি প্রয়োজন পূরণ করে দেন এবং তোমাকে সকল প্রকার সুখ প্রদান করেন।
হযরত আসমা (রাঃ) বলেছেন যে, একবার আমি আমার প্রতিবেশী বান্ধবীর সাথে অবস্থান করছিলাম। এমতাবস্থায় রাসূল (সাঃ) আমাদের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি আমাদেরকে সালাম দিয়ে বললেন, “তোমরা যাদের দ্বারা উপকৃত হয়েছো তাদের নাফরমানী থেকে দূরে থাক, যদি তোমাদের কোন একজন দীর্ঘদীন যাবত মাতা-পিতার নিকট অবিবাহিতা অবস্থায় বসে থাক, অতঃপর আল্লাহ তাআলা (দয়া করে) তাকে স্বামী দান করেন, তারপর আল্লাহ তাকে সন্তান দান করেন, (এতসব উপকার সত্বেও) যদি কোন কারণে স্বামীর ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে পড় তখন বলে ফেল, “আমি কখনো তোমার পক্ষ থেকে অসন্তুষ্ট ছাড়া কোন সৌজন্যমূলক আচরণ দেখিনি”।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
অকৃতজ্ঞ ও উপকার ভুলে যাওয়অ মহিলাদেরকে সতর্ক করে রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“আল্লাহ তাআলা কাল কিয়ামতের দিন স্বামীর প্রতি অকৃতজ্ঞ স্ত্রীর দিকে রহমতের দৃষ্টিতে দেখবেন না। প্রকৃতপক্ষে মহিলাগণ কোন সময়ও স্বামীর থেকে মুক্তি পাবে না”।
(নাসায়ী)
৭. স্বামীর খেদমত করে আনন্দ অনুভব করবে আর যথাসম্ভব নিজে কষ্ট সহ্য করে স্বামীকে শান্তি দান করার চেষ্টা করবে এবং সর্বতোভাবে তার খেদমত করে তার অন্তর নিজের আয়ত্বে রাখার চেষ্টা করবে।
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) নিজ হাতে রাসূল (সাঃ)-এর কাপড় ধুতেন, মাথায় তৈল লাগাতেন, চিরুণী দিয়ে মাথা আঁচড়াতেন, সুগন্ধী লাগাতেন এবং অন্য মহিলা সাহাবীগণও এরূপ করতেন।
একবার রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“কোন এক ব্যক্তির অন্য কোন ব্যক্তিকে সেজদা করা জায়েয নেই, যদি থাকত তা হলে স্ত্রীকে তার স্বামীকে সেজদা করার আদেশ দেয়া হতো। নিজের স্ত্রীর ওপর স্বামীর বিরাট অধিকার, যদি স্বামীর সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয় আর স্ত্রী যদি স্বামীর ক্ষত-বিক্ষত শরীর জিহ্বা দ্বারা চাটে তবুও স্বামীর অধিকার শেষ হতে পারে না।
(মুসনাদে আহমদ)
৮. স্বামীর ঘর-সংসার ধন-সম্পদ ও আসবাবপত্রের রক্ষণাবেক্ষণ করবে স্বামীর ঘরকেই নিজের ঘর মনে করবে এবং স্বামীর ধন-সম্পদকে, স্বামীর ঘরের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিকরণ, স্বামীর সম্মান সৃষ্টি ও তার সন্তান-সন্ততির ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে মিতব্যয়িতা অনুসরণ করবে, স্বামীর উন্নতি ও স্বচ্ছলতাকে নিজের উন্নতি ও স্বচ্ছলতা মনে করবে। কোরাইশী মহিলাদের প্রশংসা করতে গিয়ে রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“কোরাইশী মহিলাগণ কতইনা উত্তম মহিলা। তারা সন্তান-সন্ততির ওপর অত্যন্ত দয়ালূ এবং স্বামীর ঘর সংসারের রক্ষণাবেক্ষণকারিণী”।
(বুখারী)
রাসূল (সাঃ) নেককার স্ত্রীর গুণসমূহ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন-
“মুমিনের জন্য সর্বাধিক উপকারী এবং উত্তম নেয়ামত হলো তার নেককার স্ত্রী, সে যদি তাকে কোন কাজের নির্দেশ দেয় তাহলে সে তা আন্তরিকতার সাথে সুসম্পন্ন করে আর যদি তার প্রতি দৃষ্টি দেয় তা হলে সে তাকে সন্তুষ্ট করে এবং সে যদি তার ভরসায় শপথ করে বসে তা হলে সে তার শপথ পূরণ করে দেয়, যখন সে কোথাও চলে যায় বা তার অনুপস্থিতিতে সে নিজের ইজ্জত ও সম্মান রক্ষা করে এবং স্বামীর ধন-সম্পদ ও আসবাবপত্রের রক্ষণাবেক্ষণে স্বামীর হিতৈষী ও বিশ্বাসী থাকে।
(ইবনু মাজাহ)
৯. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, আচার-আচরণ রীতি, সাজ-সজ্জা এবং শোভা সৌন্দর্য্যকরারও পরিপূর্ণ চেষ্টা করবে। ঘরকেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবে, প্রত্যেক জিনিসকে সুন্দরভাবে সাজাবে এবং উত্তম ব্যবহার করবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘর, নিয়ম-পদ্ধতি অনুযায়ী সাজান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কক্ষসমূহ, ঘরের কাম-কাজে নিয়ম-পদ্ধতি ও সৌন্দর্য্য বিধান, সুসজ্জিত বিবির পবিত্র মুচকি হাসি দ্বারা শুধুমাত্র সংসার জীবনই প্রেম-ভালবাসা এবং নিরাপত্তা ও প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ হয় না এবং একজন নেক স্ত্রীর জন্যে পরকালের প্রস্তুতি ও আল্লাহকে সন্তুষ্ট করারও অছিলা হয়।
একবার ওসমান বিন মাজউন (রাঃ)-এর স্ত্রীর সাথে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ)-এর সাক্ষাৎ হলে তিনি দেখতে পেলেন যে, বেগম ওসমান অত্যন্ত সাদাসিধা পোশাক পরিচ্ছদ ও সাজ-সজ্জা বিহীন অবস্থায় আছেন। তখন হযরত আয়েশা (রাঃ) তাকে আশ্চার্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ
“বিবি! ওসমান কি বাইরে কোথাও গিয়েছেন?” এ আশ্চার্যান্বিত হওয়া থেকে অনুমান করা যায় যে, আদরীনী স্ত্রীদের নিজ নিজ স্বামীর জন্যে সাজসজ্জা করা কত পছন্দনীয় কাজ।
একবার এক মহিলা সাহাবী রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে স্বর্ণের কঙ্কন বা বালা পরিহিত অবস্থায় উপস্থিত হলেন, তিনি “তাকে (অহংকারের উদ্রেককারী) ইতা পরিধান করতে নিষেধ করলে সে বললোঃ
“ইয়া রাসূলাল্লাহ!মহিলা যদি স্বামীর জন্যে সাজ-সজ্জা না করে তা হলে সে স্বামীর দৃষ্টি থেকে বিচ্যুত হবে”।
(নাসায়ী)
সন্তান প্রতিপালনের নিয়ম-কানুন
১. সন্তানকে আল্লাহ তাআলার পুরস্কার মনে করবে, তাদের জন্মে আনন্দ প্রকাশ করবে। একে অন্যকে ধন্যবাদ জানাবে। উত্তম দোআসহ অভ্যর্থনা জানাবে এবং আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করবে যে, তিনি তোমাকে তাঁর (আল্লাহর) এক বান্দাহকে লালন-পালনের সৌভাগ্য দান করেছেন। আর তোমাকে এ সুযোগ দান করেছেন যে, তুমি তোমার পেছনে দীন ও দুনিয়ায় একজন স্থলাভিষিক্ত রেখে যেতে পারছো।
২. তোমার যদি কোন সন্তান না থাকে তা হলে হযরত যাকারিয়া (আঃ) যেমন সুসন্তান লাভের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছিলেন তুমি তদ্রূপ আল্লাহর নিকট সু-সন্তান লাভের জন্য প্রার্থনা কর।
তিনি দোআ করেছিলেন-
“হে, আমার প্রতিপালক! আপনি আপনার নিকট থেকে একটি পূত-পবিত্র সন্তান দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি দোআ শ্রবণকারী”।
(সূরা মরিয়ম)
৩. সন্তানের জন্মগ্রহণে কখনো মনে কষ্ট পাবে না। জীবিকার কষ্ট অথবা স্বাস্থ্যের অবনতি অথবা অন্য কোন কারণে সন্তানের জন্ম গ্রহণে দুঃখিত হওয়া অথবা তাকে একটি বিপদ ধারণা করা থেকে বিরত থাকবে।
৪. সন্তানকে কখনো নষ্ট করবে না, জন্মগ্রহণের পূর্বে অথবা জন্ম গ্রহণের পরে সন্তান নষ্ট করা নিকৃষ্টতম পাষণ্ডতা, ভয়ানক এবং অত্যন্ত আমর্জনীয় অপরাধ, কাপুরুষতা দুনিয়া ও আখিরাতের ধ্বংস ডেকে আনে।
পবিত্র কালামে পাকে রয়েছে-
“যারা নির্বুদ্ধিতা ও অজ্ঞতার কাণে সন্তান হত্যা করলো তারা নিশ্চিত ক্ষতিগ্রস্থ হলো”।
আল্লাহ তাআলা মানবিক অদূরদর্শিতার জবাব দিয়ে পরিষ্কারভাবে নিষেধ করেছেন যে, নিজ সন্তানকে হত্যা কর না।
“তোমরা তোমাদের সন্তানকে অভাব-অনটনের ভয়ে হত্যা কর না, আমিই তাদেরকে রিযিক (জীবিকা) দান করবো আর তোমাদেরকেও আমিই রিযিক দিচ্ছি, নিশ্চিত তাদের হত্যা করা জঘণ্য অপরাধ।
(সূরা বনী ইসরাইল)
“একবার এক সাহাবী জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সর্বাধিক বড় গুনাহ কি? আল্লাহর রাসূল বলেলেন , শিরক! অর্থাৎ আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার করা। জিজ্ঞেস করা হলো, এর পর কি? তিনি বললেন, মাতা-পিতার নাফরমানী (অবাধ্যতা), আবার জিজ্ঞেস করা হলো, এর পর? তিনি বললেন, তোমাদের সাথে খাদ্যে ভাগ বসাবে এ ভয়ে সন্তানদেরকে হত্যা করা।
৫. প্রসবকালে প্রসবকারিণী মহিলার নিকট বসে আয়াতুল কুরসী ও সুরায়ে আ’রাফের ৫৪ ও ৫৫ নং আয়াত দুটি তেলাওয়াত করবে এবং সূরায়ে ফালাক ও সূরায়ে নাস পাঠ করে ফুঁক দেবে।
৬. জন্ম গ্রহণের পর গোসল দিয়ে পরিষ্কার করে ডান কানে আযান ও বাম কানে ইক্বমত দেবে। হযরত হোসাইন (রাঃ) যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন রাসূল (সাঃ) তার কানে আযান ও ইক্বামত দিয়েছিলেন।
(তিবরানী)
রাসুল (সাঃ) বলেছেন যে, যার ঘরে সন্তান জন্মগ্রহণ করলো আর সে তার ডান কানে আযান ও বাম কানে ইক্বামত দিলো, সে বাচ্চা মৃগী রোগ থেকে নিরাপদ থাকবে।
(আবু ইয়া’লা ইবনে সুন্নী)
জন্মগ্রহণের সাথে সাথে সন্তানের কানে আল্লাহ ও তার রাসূলের নাম পৌঁছিয়ে দেয়ার মধ্যে বড় ধরনের রহস্য রয়েছে, আল্লামা ইবনে কাইউম তার ‘তোহফাতুল ওয়াদুদ’ নামক গ্রন্থে বলেনঃ
ইহার উদ্দেশ্য হলো মানুষের কানে সর্বপ্রথম আল্লাহর মহত্ব ও শ্যেষ্ঠত্বের আওয়াজ পৌঁছুক। যে শাহাদাতকে সে বুদ্ধি অনুযায়ী আদায় করে ইসলামের গণ্ডিতে প্রবেশ করবে তার শিক্ষা জন্মগ্রহণের দিন থেকেই শুরু করা যাক। যেমন মৃত্যুর সময়ও কালেমায়ে তাওহীদের তালক্বীন করা হয়। আযান ও ইক্বামতের দ্বীতিয় উপকার এই যে, শয়তান গোপনে ওঁৎ পেতে বসে আছে যে, সন্তান জন্মগ্রহণের পরই তাকে শয়তানের দাওয়াতের আগেই ইসলাম বা ইবাদতে এলাহীর দাওয়াত তার কানে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়।
৭. আযান ও ইক্বামতের পর কোন নেককার পুরুষ অথবা মেয়েলোকের দ্বারা খেজুর চিবিয়ে সন্তানের মাথার তালুতে লাগিয়ে দেবে এবং সন্তানের জন্যে পূর্ণ প্রাচুর্যের (বরকতের) দোআ করাবে।
হযরত আসমা (রাঃ) বলেছেন, আবদুল্লাহ বিন যোবাইর জন্মগ্রহণ করলে আমি রাসূল (সাঃ)-এর কোলে দিলাম। তিনি খোরমা আনিয়ে তা চিবিয়ে বরকতময় থু থু আবদুল্লাহ বিন যোবইয়েরের মুখে লাগিয়ে দিলেন এবং খোরমা তার মাথার তালুতে মালিশ করে খায়ের বরকতের দোআ করলেন।
হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা (রাঃ) থেকৈ বর্ণিত, সদ্য প্রসূত বাচ্চাদরকে রাসূল (সাঃ)-এর নিকট নিয়ে আসা হতো। তিনি ‘তাহনীক’1 করতেন এবং তাদের জন্য খায়ের ও বরকতের দোআ করতেন।
(মুসলিম)
হযরত আহমাদ বিন হাম্বলের স্ত্রী সন্তান প্রসব করলে তিনি ঘরে রাখা মক্কার খেজুর আনলেন এবং উম্মে আলী (রহঃ) নামাযী একজন মহিলার নিকট তাহনীকের জন্য আবেদন করলেন।
৮. বাচ্চার জন্য উত্তম নাম নির্বাচন করবে, যা হবে কোন নবীর নাম অথবা আল্লাহর নামের পূর্বে ‘আবদ’ শব্দের সংযোগে যেমনঃ-আব্দুল্লাহ আবদুর রহমান ইত্যাদি।
রাসুল (সাঃ) বলেছেন, কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে স্ব-স্ব নামে ডাকা হবে সুতরাং উত্তম নাম রাখো।
রাসূল (সাঃ) আরো বলেছেন যে, আল্লাহর নিকট তোমাদের নামসমূহ থেকে আবদুল্লাহ আব্দুর রহমান নাম বেশী পছন্দনীয়। তিনি আরো বলেছেন যে, তোমরা নবীদের নামে নাম রাখো।
বুখারী শরীফে আছে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে তোমরা আমার নামে নাম রাখ, আমার উপনামে নয়।
৯. অজ্ঞতাবশতঃ কখনো যদি ভূল নাম রেখে দেয়া হয় তাহলে তা পরিবর্তন করে ভাল নাম রাখবে। রাসূল (সাঃ) ভুল নাম পরিবর্তন করে দিতেন্ হযরত ওমর (রাঃ) এর এক কন্যার নাম ‘আছিয়া’ ছিল, তিনি উহাকে পরিবর্তন করে ‘জামিলা রাখলেন’।
(মুসলিম)
হযরত যয়নব (রাঃ) এর (হযরত আবু সালমা (রাঃ) এর কন্যার)নাম ছিল ‘বাররাহ’। বাররাহ শব্দের অর্থ হল পবিত্রতা, রাসূল (সাঃ) ইহা শুনে বললেন, নিজেই নিজের পবিত্রতার বাহাদুরী করছো? সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন তাহলে কি নাম রাখা যায়? তিনি বললেন, তার নাম রাখ ‘যয়নাব’
(আবু দাউদ)
১০. সপ্তম দিন আকীকা করবে। ছেলের পক্ষ থেকে ২টি ছাগল এবং মেয়ের পক্ষ থেকে ১টি ছাগল দেবে। তবে ছেলের পক্ষ থেকে ২টি ছাগল জরুরী নয়, ১টি ছাগলও দেয়া যেতে পারে। শিশুর মাথা মুণ্ডন করিয়ে চুল সমান স্বর্ণ অথবা রূপা দান করবে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “সপ্তম দিন শিশুর নাম ঠিক করবে এবং তার চুল মুণ্ডন করিয়ে তার পক্ষ থেকে আকীকা করবে”।
(তিরমিযি)
১১. সপ্তম দিনে খাতনাো করিয়ে দেবে। কোন কারণবশতঃ না পারলে ৭ বৎসর বয়সের মধ্যে অবশ্যই করিয়ে ফেলবে। খাতনা ইসলামী রীতি।
১২. শিশু যখন কথা বলতে আরম্ভ করে তখন তাকে কালেমায়ে “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু” শিক্ষা দাও। তারপর কখন মরবে সে চিন্তা করা না, যখন দুধের দাঁত পড়ে যাবে তখন নামায পড়ার নির্দেশ দাও।
হাদীসে ইহাও উল্লেখ আছে যে, হুযুর (সাঃ)-এর পরিবারের শিশু যখন কথা বলা আরম্ভ করতো তখন তিনি তাকে সূরা আল-ফুরকানের দ্বিতীয় আয়াত শিক্ষা দিতেন, যাতে তাওহীদের পূর্ণ শিক্ষাকে একত্রিত করা হয়েছে।
১৩. শিশুকে নিজের দুধ পান করানো মায়ের ওপর শিশুর অধিকার। পবিত্র কুরআনে সন্তান-সন্ততিকে মায়ের এ উপকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। মায়ের কর্তব্য হলো, সে দুধের প্রতিটি ফোঁটার সাথে তাওহীদের পাঠ, রাসূলের প্রেম এবং দীনের ভালবাসাও পান করাবে এবং তার মন ও প্রাণে স্থায়ী করার চেষ্টা করবে। লালন-পালনের দায়িত্ব পিতার ওপর দিয়ে নিজের বোঝা হাল্কা করবে না বরং এ আনন্দময় দীনি কর্তব্য নিজে সম্পাদন করে আধ্যাত্মিক শান্তি ও আনন্দ অনুভব করবে।
১৪. শিশুকে ভয় দেখানো ঠিক নয়। শিশুকালের এ ভয় সারাজীবন তার মন ও মস্তিষ্কে ছেয়ে থাকে আর এরূপ শিশুরা সাধারণতঃ জীবনে কোন বীরত্ব প্রদর্শন করতে পারে না।
১৫. সন্তানদের কথায় কথায় তিরস্কার করা, ধমক দেয়া ও মন্দ বলা থেকে বিরত থাকবে এবং তাদের ত্রুটিসমূহের কারণে অসন্তুষ্টি ও ঘৃণা প্রকাশ করার স্থলে উত্তম পন্থায় ও হৃদয়ে আবেগ নিয়ে তার সংশোধনের চেষ্টা করবে। সর্বদা শিশুদের মনে এ ভয় জাগরুক রাখবে যেন, তারা শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ না করে।
১৬. সন্তানদের সাথে সর্বদা দয়া, মায়া ও নম্রতাসুলভ ব্যবহার করবে। সাধ্যানুযায়ী তাদের প্রয়োজনসমূহ পূরণ করে তাদেরকে সন্তুষ্ট রাখতে চেষ্টা করবে এবং আল্লাহর আনুগত্য ও আদেশ পালনের আবেগে উদ্বুদ্ধ করব্
একবার হযরত মুআবিয়া (রাঃ)আহনাফ বিন কায়েস (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, বলুন! সন্তানদের বেলায় কিরূপ ব্যবহার করা উচিত? তখন আহনাফ বিন কায়েস বললেনঃ
আমিরুল মুমেনীন! সন্তানগণ আমাদের অন্তরের ফসল, এবং কোমরের খুঁটি বা অবলম্বন, আমাদের মর্যাদা ও যোগ্যতা তাদের জন্য জমি সমতুল্য। যা অত্যন্ত নরম ও নির্দোয় এবং আমাদের অস্তিত্ব তাদের জন্য ছায়াদাত আকাশ সমতুল্য, আমরা তাদের দ্বারাই বড় বড় কাজ সমাধা করতে সাহস করি। তারা যদি আপনার নিকট কিছু দাবী করে তাহলে তা পূরণ করে দেবেন এবং তারা যদি অসন্তুষ্ট বা দুঃখিত হয় তাহলে তাদের অন্তরের দুঃখ দূর করে দেবেন। তারা আপনাকে ভালবাসবে, আপনার পিতৃসুলভ আচরণকে শ্রদ্ধা করবে। এরূপ ব্যবস্থা করবে না যার জন্য তারা আপনার প্রতি বিরক্ত হয়ে আপনার মৃত্যু কামনা করবে, আর আপনার নিকট থেকে পলায়ন করবে।
আহনাফ! আল্লাহর শপথ! আপনি যেসময় আমার নিকট এসে বসলেন, ঐ সময় তিনি ইয়াযীদের ওপর রাগে গম্ভীর হয়ে বসেছিলেন।
অতঃপর হযরত আহনাফ (রাঃ) চলে গেলে হযরত মুআবিয়া (রাঃ) এর রাগ পড়ে গেল এবং ইয়াযীদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে ইয়াযীদের নিকট দু’শত দিরহাম ও দু’শত জোড়া কাপড় পাঠিয়ে দিলেন। ইয়াযীদের নিকট যখন এ উপহার সামগ্রী পৌঁছালো তখন ইয়াযীদ এ উপহার সামগ্রীকে সমান দু’ভাগে ভাগ করে একশত দিরহাম ও একশত জোড়া (কাপড়) হযরত আহনাফ বিন কায়েস (রাঃ) এর জন্য পাঠিয়ে দিলেন।
১৭. ছোট শিশুদের মাথার ওপর স্নেহপূর্ণ হাত বুলাবে শিশুদেরকে কোলে নেবে, আদর করবে এবং তাদের সাথে সর্বদা হাসিমাখা ব্যবহার করবে। সর্বদা বদমেজাজ ও কঠোর হয়ে থাকবে না, আচরণ দ্বারা শিশুদের অন্তরে মাতা-পিতার জন্য ভালবাসার আবেগও সৃষ্টি হয়, তাদের আত্মবিশ্বাসও সৃষ্টি হয়, এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনের প্রভাব পড়ে।
একদা হযরত আক্বরা বিন হারেস (রাঃ)রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে আসলেন। হুযুর (সাঃ) ঐ সময় হযরত হাসান (রাঃ)-কে আদর করছিলেন। আক্বরা (রাঃ) দেখে আশ্চার্যান্বিত হয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আপনিও কি শিশুদেরকে আদর করেন? আমারতো দশ সন্তান আছে কিন্তু আমিতো তাদের কাউকে কোন সময় আদর করিনি। রাসূল (সাঃ) আক্বরা (রাঃ)-এর দিকে চেয়ে বললেন, আল্লাহ যদি তোমার অন্তর থেকে দয়া ও স্নেহ দূর করে দিয়ে থাকেন তাহলে আমি কি করতে পারি?
ফারুকে আযম (হযরত ওমর) (রাঃ) এর খেলাফত আমলে হযরত আমের (রাঃ) বিশেষ একটি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। একবার হযরত ওমর (রাঃ) এর সাথে সাক্ষাত করার জন্য তাঁর কাছে গিয়ে দেখতে পেলেন যে, হযরত ওমর (রাঃ) বিছানায় শুয়ে আছেন আর একটি শিশু তার বুকে চড়ে খেলা করছে-
হযরত আমেরের নিকট এ ঘটনা পছন্দ হলো না। আমিরুল মুমেনীন তার কপাল উঠা নামার অবস্থা দেখে তার অপছন্দের ব্যাপার বুঝে ফেললেন এবং হযরত আমের (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, বলুন, আপনার নিজের সন্তানদের সাথে আপনার কিরূপ ব্যবহার হয়ে থাকে।
হযরত আমের (রাঃ) বললেন, আমিরুল মুমিনীন! আমি যখন ঘরে প্রবেশ করি পরিবারের লোকজন নীরব হয়ে যায়। সকলে নিজ নিজ স্থানে শ্বাসবন্ধ করে চুপ হয়ে থাকে। হযরত ওমর (রাঃ) অত্যন্ত আক্ষেপের সাথে বললেন,
আমের! আপনি উম্মতে মুহাম্মদী (সাঃ)-এর সন্তান হওয়া সত্ত্বেও আপনি এটা জানেন না যে, একজন মুসলমানকে তার পরিবার-পরিজনের সাথে কিরূপ নম্রতা ও ভালবাসার আচরণ করা উচিত।
১৮. সন্তানদেরকে পবিত্র শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্যে নিজের সার্বিক চেষ্টা ওয়াকফ করে দেবে এবং এ পথে সবরকম ত্যাগ স্বীকার করতেও পিছু হঠবে না। এটা দীনি দায়িত্ব।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, পিতা নিজের সন্তানদেরকে যা কিছু দিতে পারে তার মধ্যে সর্বোত্তম দান হলো সন্তানদেরকে উত্তম শিক্ষা দেওয়া।
(মিশকাত)
রাসূল (সাঃ) আরো বলেছেন যে, মানুষ মারা গেলে তার আমল শেষ হয়ে যায় কিন্তু তিনটি আমল এমন যার পুরস্কার ও সওয়াব মৃত্যুর পরও পেতে থাকে। (১) সদক্বায়ে জারিয়ার কাজকরে গেলে, (২) এমন ইলম যার দ্বারা লোকেরা তার মৃত্যুর পরও উপকৃত হয়, (৩) নেক সন্তান, যারা পিতার জন্যে দোআ করতে থাকে।
(মুসলিম)
প্রকৃতপক্ষে সন্তানরাই আপনার পর আপনার চারিত্রিক বর্ণনা, দীনি শিক্ষা ও তাওহীদের বার্তাকে জীবিত রাখার যথার্থ মাধ্যম আর মুমিন ব্যক্তি সন্তানের আকাংখা এ জন্যই করে যেনো সে তার পরে তার কর্মকাণ্ডকে টিকিয়ে রাখতে পারে।
১৯. শিশুদের বয়স যখন ৭ বৎসর হয় তখন তাদেরকে নামায পড়ার নিয়ম-কানুন শিক্ষা দেবে। নিজের সাথে মসজিদে নিয়ে গিয়ে উৎসাহ দান করবে আর তাদের বয়স যখন ১০ বছর হয়ে যাবে এবং নামাযে ত্রুটি করবে তখন দরকার হলে তাদেরকে উপযুক্ত শাস্তিও দেবে। তাদের নিকট তোমার কথা ও কাজের দ্বারা প্রকাশ করে দেবে যে, নামাযের ত্রুটিকে তুমি সহ্য করবেনা।
২০. শিশুদের বয়স যখন ১০ বছর হবে, তখন তাদের বিছানা পৃথক করে দেবে এবং প্রত্যেককে পৃথক পৃথকভাবে শুতে দেবে।
রাসুল (সাঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের সন্তানদের বয়স যখন ৭ বছর হয়ে যাবে তকন তাদেরকে নামায পড়ার শিক্ষা দাও আর তাদের বয়স যখন ১০ বছর হয় যাবে তকন তাদের নামাযের জন্য শাস্তি দাও। এ বয়স হওয়ার পর তাদের বিছানা পৃথক করে দাও”।
২১ শিশুদের সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবে। তাদের পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ও গোসলের প্রতি দৃষ্টি রাখবে, কাপড় পরিষ্কার রাখবে, তবে অতিরিক্ত সাজ-সজ্জা ও লোক দেখানো প্রদর্শনী থেকে বিরত থাকবে।মেয়েদের কাপড়ও অত্যন্ত সাদাসিধে রাখবে এবং জাঁকজমকের পোশাক পরিদান করিয়ে শিশুদের মন মেজাজ নষ্ট করবে না।
২২.অপরের সামনে শিশুদের দোষ বর্ণনা করবে না। এবং কারো সামনে তাদের লজ্জা ও তাদের আত্মমর্যাদার আঘাত দেয়া থেকেও বিরত থাকবে।
২৩. শিশুদের সামনে কখনো শিশুদেরকে সংশোধনের বিষয়ে নৈরাশ্য প্রকাশ করবে না বরং তাদের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য তাদের সাধারণ ভাল কাজেরও প্রাণ খুলে প্রশংসা করবে। তাদের সাহস বৃদ্ধি, আত্মবিশ্বাস ও উৎসাহ সৃষ্টির চেষ্টা করবে সে যেনো এ জীবনের কর্মক্ষেত্রে উচ্চতম স্থান লাভ করতে পারে।
২৪. নবীদের কাহিনী, নেককার লোকদের জীবনী এবং সাহাবায়ে কেরামের মুজাহিদ সুলভ ইতিহাস তাদেরকে শুনাতে থাকবে। প্রশিক্ষন ও সংস্কার, চরিত্র গঠন এবং দীনি আকর্ষণ সৃষ্টির জন্যে এটা অত্যন্ত জরুরী মনে করবে এবং হাজাো ব্যস্ততা সত্ত্বেও এর জন্যে সময় বের করে নেবে। সর্বাধিক ও অধিকাংশ সময় তাদেরকে সুন্দর স্বরে কুরআন শরীফ পাঠ করে শোনাবে ও সুযোগ মত রাসূল (সাঃ) এর প্রভাবশীল বাণীসমূহ শিক্ষা দেবে আর প্রাথমিক বয়স থেকেই তাদের অন্তরে রাসূল প্রেমের আবেগ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করবে।
২৫. কখনো কখনো শিশুদের হাত দ্বারা গরীবদেরকে কিছু খাদ্য অথবা পয়সা ইত্যাদি দেওয়াবে যেনো তাদের মধ্রে গরীবদের সাথে সদ্ব্যবহার ও দান-খয়রাতের আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। কখনো এ সুযোগও গ্রহণ করবে যে, তাদের হাতে বোন-ভাইদের মধ্যে খাদ্য ও পানীয় বন্টন করাবে যেনো তাদের মধ্যে অন্যের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, অনুভূতি এবং ইনসাফের অভ্যাস সৃষ্টি হয়।
২৬. কর্কশ স্বরে কথা বলা ও গলা ফাটিয়ে চিৎকার ও চেঁচামেচি থেকে নিজেকে বিরত রাখবে এবং তাদেরকেও নির্দেশম দেবে যে, মধ্যম স্বরে ও নম্রতার সাথে কথাবর্তা বলবে এবং আপোষে একে অন্যের ওপর হৈ হুল্লোড় ও চেঁচামেচি পরিত্যাগ করবে।
২৭. শিশুরা নিজের কাজ নিজে করার অভ্যাস সৃষ্টি করবে। প্রত্যেক কাজেই চাকরের সাহায্য নেবে না, এর দ্বারা শিশুরা দুর্বল, অলস ও পঙ্গু হয়ে যায়। শিশুদেরকে উদ্যমশীল, পরিশ্রমী হিসেবে গঠন করবে।
২৮. শিশুদের মধ্যে পরস্পর বিবাদ বেঁধে গেলে অন্যায়ভাবে নিজের শিশুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবে না, এ ধারণা রাখবে যে, তোমার শিশুর জন্য তোমার জন্যও করছে। তুমি সর্বদা তোমার শিশুর ত্রুটির প্রতি দৃষ্টি রাখবে এবং প্রত্যেক অপছন্দনীয় ঘটনায় নিজের শিশুর ভুল-ত্রুটি খোঁজ করে বিচক্ষণতা ও মনোযোগের সাথে তা সংশোধন করার আন্তরিক চেষ্টা করবে।
২৯. সন্তানদের সাথে সখ্যতাপূর্ণ ব্যবহার করবে এবং এ ব্যাপারে বিবেকবানের ভূমিকা পালন করবে। স্বাভাবিকভঅবে যদি কোন সন্তানের প্রতি অধিক মনোযোগ হয় তা ক্ষমাযোগ্য কিন্তু আচার ব্যবহারে লেন-দেনে সর্বদা ইনসাফ ও সমতার দৃষ্টি রাখবে এবং কখনো কোন এক সন্তানের প্রতি এরূপ এক পাক্ষিক ব্যবহার করবে না যা অন্যান্য সন্তানরা বুঝতে পারে।
একদা হযরত নোমান (রাঃ)-এর পিতা হযরত বশীর (রাঃ) নিজের ছেলেকে সাথে নিয়ে হুযুর (সাঃ)-এর সামনে হাযির হয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার নিকট একটি গোলাম ছিল, তাকে আমি আমার এ ছেলেকে দান করেছি। রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি তোমার প্রত্যেক ছেলেকে এক একটি গোলাম দান করেছো? বশীর (রাঃ) বললেন, না। হুযুর (সাঃ) তখন বললেন, “এ গোলামটি তুমি ফেরৎ নিয়ে নাও”। আরও বললেন, আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমার সন্তানদের সাথে সমান ও সমতার ব্যবহার করো। অতঃপর হযরত বশীর (রাঃ) ঘরে ফিরে এসে নোমন (রাঃ) থেকে নিজের দেয়া গোলাম ফেরৎ নিয়ে নিলেন। অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছে যে তিনি বলেছেন, “তুমি আবার গুনাহের উপর আমাকে সাক্ষী কর না, আমি অত্যাচারের সাক্ষী হবো না। অন্য এক বর্ণনায় এরূপ আছে যে, হুযুর (সাঃ) জিজ্ঞাসা করেছেন, “তুমি কি ইহা চাও যে, তোমার সকল ছেলে তোমার সাথে সদ্ব্যবহার করুক”? হযরত বশীর (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কেন নয়? রাসূল (সাঃ) বললেন, “তা হলে এরূপ কাজ করো না”।
(বুখারী, মুসলিম)
৩০. শিশুদের সামনে সর্বদা উত্তম উদাহরণ পেশ করবে। তোমার চারিত্রিক গুণাবলী তোমার শিশুদের জন্য সার্বক্ষণিক শিক্ষক, যার থেকে শিশুরা সব সময় পড়তে ও শিখতে থাকে। শিশুদের সামনে কখনো ঠাট্টার ছলেও মিথ্যা বলবে না।
হযরত আবদুল্লাহ বিন আমের (রাঃ) নিজের এক কাহিনী বর্ণনা করলেন যে, একদা হুযুর (সাঃ) আমাদের ঘরে উপস্থিত ছিলেন, আমার মাতা আমাকে ডেকে বললেন, “এখানে এসো, আমি তোমাকে একটি জিনিস দেবো”। হুযুর (সাঃ) দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি শিশুকে কি দিতে চেয়েছো?” আমার মা বললেন, “আমি তাকে খেজুর দিতে চেয়েছি”। তিনি আমার মাকে বললেন, “তুমি যদি দেয়ার ভান করে ডাকতে আর শিশু আসার পর কিছু না দিতে, তাহলে আমলনামায় এ মিথ্যা লিখে দেয়া হতো।
(আবু দাউদ)
৩১. কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করায় ঐরকম আনন্দ ও খুশী প্রকাশ করবে যেরূপ ছেলে জন্মগ্রহণের পর করা হয়। মেয়ে হোক অথবা ছেলে উভয়ই আল্লাহর দান। আর আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন বান্দার জন্যে মেয়ে ভাল না ছেলে ভাল। কন্যা সন্তানের জন্মগ্রহণে বিরক্তি প্রকাশ করা, মন ভাঙ্গা প্রকৃত মুমিনের পক্ষে কখনো শোভা পায় না। এটা না শোকরীও বটে এবং মহান জ্ঞানী ও মহান দাতা আল্লাহর মর্যাদা হানিও বটে।
হাদীসে আছে যে, “কারো ঘরে যখন কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে তখন আল্লাহ তাআলা তার ঘরে একজন ফিরিশতা পাঠিয়ে দেন এবং তিনি এসে বলেন, হে ঘরের অধিবাসী! তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, তিনি কন্যা সন্তানটিকে নিজের পাখার নিচে নিয়ে নেন এবং তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ইহা একটি দুর্বল প্রাণ থেকে জন্মগ্রহণ করেছে। যে ব্যক্তি এ কন্যা সন্তানটির লালন-পালন করবে কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর সাহায্য তার ওপর জারী থাকবে।
(তিবরানী)
৩২. কন্যাদের প্রশিক্ষণ ও লালন-পালন অত্যন্ত সন্তুষ্টিচিত্তে, আন্তরিক শান্তি এবং দীনি অনুভূতির সাথে করবে। এর বিনিময়ে উপহার স্বরূপ সর্বোচ্চ বেহেশতের আকাংখা করবে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি তিনটি কন্যা সন্তান অথবা তিনটি বোনের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে তাদেরকে দীনি ইলম শিক্ষা দিয়েছে এবং তারা স্বাবলম্বী হওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে দয়া সুলভ ব্যবহার করেছে এমন ব্যক্তির জন্যে আল্লাহ তাআলা বেহেশত ওয়াজিব করে দেন। এ কথা শুনে এক ব্যক্তি বলল, যদি দু’জন হয়? রাসূল (সাঃ) বললেন, তার জন্যেও এ পুরস্কার। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, লোকেরা যদি একটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতো তাহলে তিনি একটির লালন-পালন সম্পর্কেও একই সু-সংবাদ দিতেন।
(মেশকাত)
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) বলেছেন, একদিন এক মহিলা তার দুই কন্যা সন্তানসহ আমার কাছে ভিক্ষা চাইল, ঐ সময় আমার নিকট শুধু একটি খেজুর ছিল। আমি তাই তার হাতে দিয়ে দিলাম, মহিলা খেজুরটিকে দু’টুকরা করে দু’কন্যার মধ্যে ভাগ করে দিল অথচ নিজে কিছুই খেল না। এরপর মহিলা চলে গেল। এ সময় রাসূল (সাঃ) ঘরে আসলেন। আমি এ ঘটনা তাঁকে শুনালাম। তিনি শুনে বললেন, যে ব্যক্তিকে এই কন্যা সন্তানের জন্মের দ্বারা পরীক্ষা করা হয়েছে এবং সে তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে তা হলে এ কন্যারা তার জন্যে কিয়ামতের দিন জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার অন্যতম কারণ হয়ে যাবে।
(মেশকাত)
৩৩. কন্যা সন্তানকে তুচ্ছ মনে করবে না, ছেলে সন্তানদেরকে কন্যাদের ওপর কোন ব্যাপারেই প্রাধান্য দেবে না। উভয়ের সাথে একই ধরনের ভালবাসা প্রকাশ করবে এবং একই প্রকার ব্যবহার করবে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যার কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে এবং অন্ধকারর যুগের ন্যায় জীবিত কবর দেয়নি, তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করেনি, ছেলে সন্তানকে তার ওপর প্রাধান্য দেয়নি এবং বেশী যোগ্য মনে করেনি এমন ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা বেহেশতে প্রবেশ করাবেন।
(আবু দাউদ)
৩৪. সম্পত্তিতে কন্যাদের নির্ধারিত অংশ সম্মানের সাথে দিয়ে দেবে। এটা আল্লাহর নির্ধারিত অংশ এতে কম ও বেশী করার কারো কোন ক্ষমতা নেই। কন্যার অংশ দেবার বেলায় কুট কৌশল অবলম্বন করা অথবা নিজের মন মত কিছু দিয়ে দেয়ায় নিরাপদ হয়ে যাওয়া প্রকৃত মুমিনের কাজ নয়।এরূপ করা খেয়ানতও বটে এবং আল্লাহ তাআলার দীনের খেয়ানত।
৩৫. এ সকল চেষ্টার সাথে সাথে অত্যন্ত আবেগ-অনুভূতির সাথে সন্তানদের জন্যে আল্লাহর দরবারে দোআও করতে থাকবে। তাহলে মহান আল্লাহর নিকট আশা করা যায় যে, মাতা-পিতার গভীর আন্তরিক আবেগময় দোআসমূহ নষ্ট করবেন না।
বন্ধুত্বের নীতি ও আদর্শ
১. বন্ধুদের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার করবে এবং বন্ধদের জন্য বন্ধত্বের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে থাকবে। সেই ব্যক্তি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যাকে তার বন্ধুবান্ধব ভালবাসে এবং সেও বন্ধু-বান্ধবকে ভালবাসে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যবান সে যার প্রতি লোকেরা অসন্তুষ্ট এবং সেও লোকদের থেকে দূরে থাকে। যার ধন-সম্পদ নেই সে নিঃস্ব বরং প্রকৃত নিঃস হলো ঐ ব্যক্তি যার কোন বন্ধু নেই, বন্ধুর জীবন সৌন্দর্য্য জীবন-যাত্রার সাহয়ক এবং আল্লাহর নেয়ামত। বন্ধু তৈরী করুন এবং বন্ধু হয়ে থাকুন।
পবিত্র কুরআনে আছে-
“মুমিন পুরুষ ও নারীগণ পরস্পর একে অন্যের বন্ধু ও সাহায্যকারী”।
(সূরা তওবাহ)
রাসূল (সাঃ) তাঁর সাহাবীগণকে অত্যন্ত ভালবাসতেন এবং প্রত্যেকেই অনুভব করত যে রাসূল (সাঃ) তাকেই সকলের থেকে বেশী ভালবাসেন।
হযরত আমর বিন আছ (রাঃ) বলেছেন যে, রাসূল (সাঃ) আমার সাথে এরূপ মনোযোগ ও একাগ্রতার সাথে আলাপ করতেন এবং খেয়াল রাখতেন যে, আমার মনে হতে লাগলো আমিই আমার কওমের সর্বাধিক উত্তম ব্যক্তি। একদিন আমি রাসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করে বসলাম যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি সর্বাধিক উত্তম না আবু বকর (রাঃ)? রাসূল (সাঃ) উত্তর দিলেন, আবু বকর। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, আমি উত্তম না কি ওমর (রাঃ)? তিনি উত্তর দিলেন, ওমর (রাঃ)। আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমি রাসূল (সাঃ) থেকে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে মূল তথ্য জানলাম, তিনি পক্ষপাতহীনভাবে পরীক্ষার কথা বলেছিলেন। তখন আমি আমার এ অশোভনীয় পদক্ষেপে অত্যন্ত লজ্জিত হলাম এবং মনে মনে বলতে লাগলাম যে, এরূপ কথা জিজ্জেস করার আমার কি এমন প্রয়োজন ছিল!
২. বন্ধুদের সাথে অন্তরঙ্গ পরিবেশে জীবন-যাপন করবে এবং অকৃত্রিম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করার চেষ্ট করবে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “যে মুসলমান লোকদের সাথে মিলেমিশে থাকে এবং তাদের পক্ষ থেকে আগত কষ্ট মেনে নেয় সে ঐ ব্যক্তির চেয়ে কতইনা উত্তম যে ব্যক্তি লোকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে এবং তাদের পক্ষ থেকে আগত কষ্টে অধৈর্য্য ও অস্থির হয়ে পড়ে।
(তিরমিযি)
৩. সর্বদা সৎ ও নেককার লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করবে এবং বন্ধু নির্বাচনে এ কথার প্রতি অবশ্যই খেয়াল রাখবে যে, যাদের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক বাড়াচ্ছ তারা দীন ও চারিত্রিক দিক থেকে তোমার জন্য কতটুকু উপকারী হতে পারে? “কারো চারিত্রিক অবস্থা জানতে হলে তার বন্ধদের চারিত্রিক অবস্থা জেনে নাও”। রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “মানুষ তার বন্ধুর দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়, সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তির চিন্তা করা দরকার, সে কার সাথে বন্ধুত্ব করছে”।
(মুসনাদে আহমদ, মেশকাত)
বন্ধুর দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অর্থ এই যে, সে যখন বন্ধুর সাহচর্যে আসবে তখন তার মধ্যে ঐ আবেগ ও চিন্তাধারা আর ঐ আস্বাদন ক্ষমতা ও প্রবণতাই সৃষ্টি হবে যা তার বন্ধুর মধ্যে বিদ্যমান। আর পছন্দ অপছন্দের নিরিখ তাই-ই হবে যা তার বন্ধুর আছে। সুতরাং মানুষের বন্ধু নির্বাচনে অত্যন্ত গভীর চিন্তা ও বিবেচনা করা উচিত আর এমন ব্যক্তির সাথে আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত যার চিন্তাধারা ও ধ্যান-ধারণা এবং চেষ্টা-তদবীর দীন ও ঈমানের শর্ত অনুযায়ী হয়। রাসূল (সাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন যে, “মুমিন ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক মজবুত কর। তার সাথেই পানাহার করো”।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “মুমিনের সাহচর্যে থাকো আর যেন তোমাদের দস্তরখানে পরহেজগার লোকেরাই আগে খানা খায়”।
এক দস্তরখানে বসে পানাহার করা আন্তরিক সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকারী আর এ সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব স্বরূপ মুমিনদের সাথেই হওয়া উচিত যে আল্লাহকে ভয় করে। অমনোযোগী, দায়িত্বহীন, বে-আমল ও চরিত্রহীন লোকদের নিকট থেকে সর্বদা দূরে থাক। রাসূল (সাঃ) ভাল ও মন্দ বন্ধুরসাতে সম্পর্কের অবস্থাকে একটি সুন্দর উদাহরণ দ্বারা বর্ণনা করেছেনঃ
ভাল এবং মন্দ বন্ধুর উদাহরণ কস্তুরি (মেশক) বিক্রেতা ও কামারের চিমনী বিক্রেতা। কস্তুরি বিক্রেতার সাহচর্যে তুমি কোন উপকার পেতে পার হয়তো কস্তুরি খরিদ করবে অথবা তার সুগন্ধ পাবে, কিন্তু কামারের চিমনী তোমার বাড়ী ঘর অথবা কাপড় জ্বালিয়ে দেবে অথবা তোমার মস্তিষ্কে দুর্গন্ধ পৌঁছবে।
(বুখারী, মুসলিম)
আবু দাউদ শরীফের হাদীসের শব্দসমূহ এরূপ আছেঃ
নেককার (সৎ) বন্ধুর উদাহরণ এরূপ তার যেমন কস্তুরী বিক্রেতা বন্ধুর দোকান থেকে আর কোন উপকার না পেলেও সুগন্ধিতো অবশ্যই আসবে আর অসৎ বন্ধুর উদাহরণ এরূপ যেমন, কামারের চিমনী থেকে আগুন না লাগলেও তার ধুঁয়াতে কাপড় তো অবশ্যই কালো হয়ে যাবে”।
৪. বন্ধুদের সাথে শুধু আল্লাহর জন্যই বন্ধুত্ব করবে, আল্লাহর প্রিয় বান্দাহগণ তারা যারা আল্লাহর দীনের জন্য একত্রিত হয় এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অন্তরের সাথে অন্তর মিলিয়ে আল্লাহর দীনের প্রতিষ্ঠা ও কর্তব্য সম্পাদন করে যে, তাদেরকে সীসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায় মজবুত মনে হয়।
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আছেঃ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাদেরকেই ভালবাসেন যারা আল্লাহর পতে দৃঢ়ভাবে সারিবদ্ধ হয়ে লড়াই করে, যেন সীসা ঢালা প্রাচীর।
(সূরায়ে ছফ-৪)
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“কিয়ামতের দিন যাদের গৌরবময় জাঁকজমকপূর্ণ মর্যাদা লাভ হবে তাদের সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ
আল্লাহর বান্দাহদের মধ্য থেকে সেই সকল বান্দাহ এমন সৌভাগ্যবান যারা নবীও নন শহীদও নন কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে এমন মর্যাদায় সমাসীন করবেন, যে নবী ও শহীদগণও তাদের মর্যাদায় ঈর্ষান্বিত হবেন। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি কারা? আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন, এরা ঐ সকল লোক যারা শুধু আল্লাহর দীনের ভিত্তিতে একে অন্যকে ভালবাসতো, তারা পরস্পর আত্মীয়-স্বজনও ছিল না এবং তাদের মধ্যে কোন অর্থ সম্পদের লেন-দেনও ছিল না। আল্লাহর শপথ কিয়ামতের দিন তাদের চেহারা নূরে ঝকঝক করতে থাকবে, তাদের আপাদমস্তক শুধু নূর হবে আর সমস্ত লোক যখন ভয়ে ভীত হয়ে কাঁপতে থাকবে তখন তাদের কোন ভয়ই হবে না এবং সকল লোক যখন দুঃখে পতিত হবে তখন তাদের কোন দুঃখই হবে না। অতঃপর তিনি পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করলেনঃ (আবু দাউদ)
“সাবধান! নিশ্চয়ই আল্লাহর বন্ধুগণের কোন ভয় নেই আর তাঁরা চিন্তিতও হবে না”।
হযরত আবু দরদা (রাঃ) বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ
কিয়ামতের দিন কিছু লোক তারেদ কবর থেকে এমন অবস্থায় উঠবেন যে, তাদের মুখমণ্ডল নূরে ঝকঝক করতে থাকবে। তাদেরকে মুক্তা খচিত মিম্বরে বসানো হবে এবং লোকেরা এদের মর্যাদা দেখে ঈর্ষা করবে, অথচ এরা নবীও নন এবং শহীদও নন, এক বেদুঈন জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অথচ এরা কোন লোক? আমাদেরকে এদের পরিচয় দিন। তিনি উত্তর দিলেন, এরা তারা যারা পরস্পর আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব করতো”।
(তিবরানী)
৫. সৎ লোকদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করাকে পরকালের মুক্তি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উপায় মনে করবে এবং আল্লাহর নিকট দোআ করবে যে, আয় আল্লাহ! আমাকে সৎ লোকদের বন্ধুত্ব দান করুন এবং তাদের অন্তর্ভূক্ত করুন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, “এক ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বলতে লাগলো যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এক ব্যক্তি কোন নেক লোকের সাথে তার নেকীর কারণে বন্ধুত্ব করে, কিন্তু সে নিজেই ঐ ব্যক্তির মত নেক কাজ করে না। আল্লাহর নবী বললেন, কোন ক্ষতি নেই, মানুষ কিয়ামতের দিন তার সাথেই হবে যাকে সে ভালবাসবে।
(বুখারী)
একরাতে রাসূল (সাঃ) আল্লাহর দীদার লাভ করলেন, আল্লাহ তাআলা রাসূল (সাঃ) কে বললেন, কিছু দোয়া করুন। তখন রাসূল (সাঃ) এই দো’আ করলেনঃ
“আয় আল্লাহ! আমি তোমার নিকট নেক কাজ করার তাওফীক চাই। খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে চাই। মিসকিনদের ভালবাসা চাই, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। কোন জাতিকে আযাব দেবার মনস্থ করলে আমাকে তার আগে উঠিয়ে নিও। আমি তোমার নিকট তোমার বন্ধুত্বের কামনা করি, আর তার বন্ধুত্ব কামনা করি, যে তোমার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে আর যে আমল দ্বারা বন্ধুত্বের নিকটবর্তী হওয়া যায় সেরূপ আমল করার তাওফীক প্রার্থনা করি”।
(মুসনাদে আহমদ)
হযরত মুআয বিন জাবাল (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “আল্লাহ বলেন, আমার উচিত যে, আমি তাদেরকে ভালবাসব যারা আমার জন্য পরস্পর ভালবাসা ও বন্ধুত্ব স্থাপন করে, যারা আমার আলোচনায় একত্রিত হয়, যারা আমার বন্ধত্বের কারণে পরস্পর সাক্ষাত করে আর আমার সন্তুষ্টির জন্য পরস্পর সদ্ব্যবহার করে”।
(আহমদ তিরমিযি)
রাসূল (সাঃ) দু’বন্ধুর সাক্ষাতের এক উত্তম চিত্র তুলে ধরে বলেছেনঃ
“এক ব্যক্তি অন্যস্থানে তার বন্ধুর সাথে সাক্ষাত করার জন্যে রওয়ানা হলো। আল্লাহ তার পেছনে একজন ফিরিশতা নিয়োগ করলেন। ফিরিশতা তাকে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাওয়ার ইচ্ছা করেছো? সে উত্তর দিল, ঐ মহল্লায় আমার এক বন্ধু থাকে তার সাথে সাক্ষাত করতে যাচ্ছি। ফিরিশতা বলেন, তোমার কি তার নিকট কিছু পাওনা আছে যা তুমি আদায় করতে যাচ্ছ? সে বলে, না, আমি তাকে আল্লাহর জন্য ভালবাসি। অতঃপর ফিরিশতা বলেন, তাহলে শুন! আল্লাহ তাআলা আমাকে তোমার কাছে প্রেরণ করেছেন এবং এ সংবাদ দান করেছেন যে তিনি (আল্লাহ) তোমার সাথে ঐরকম বন্ধুত্ব রাখেন যেমন তুমি তোমার বন্ধুর সাথে আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব রাখছো”।
(মুসলিম)
৬. ইসলামের দৃষ্টিতে বন্ধত্বের উপযুক্ত লোকদের সাথেই বন্ধুত্ব স্থাপন করবে। অতঃপর সারা জীবন ঐ বন্ধুত্ব অটুট রাখার জন্য চেষ্টাও করবে। বন্ধুত্বের জন্যে যেমন সৎ লোক নির্বাচন করা প্রয়োজন তদ্রূপ উক্ত বন্ধুত্বকে অটুট ও স্থায়ী রাখাও প্রয়োজন।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহর আরশের ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না, তখন সাত প্রকারের লোক আল্লাহর আরশের নিচে ছায়া পাবে। তার মধ্যে এক প্রকারের লোক হলো যারা দু’জন এক অন্যকে শুধু আল্লাহর জন্য ভালবাসতো। আল্লাহর মহব্বত তাদেরকে পরস্পরের সংযোগ করেছে এবং এ ভিত্তির উপরই তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে। অর্থাৎ তাদের বন্ধুত্ব আল্লাহর জন্যই হবে আর তারা জীবনভর এ বন্ধুত্বকেও অটুট রাখতে চেষ্টা করবে। আর যখন এদের মধ্যে কোন একজন মৃত্যুবরণ করবে তকন বন্ধুত্বের অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করবে।
৭. বন্ধুদের ওপর বিশ্বাস রাখবে, তাদের সঙ্গে হাসি-খুশি থাকবে। নিরুৎসাহ থাকতে এবং বন্ধুদেরকে নিরুৎসাহ করা থেকে বিরত থাকবে,বন্ধুদের সাহচর্যে আনন্দিত ও প্রফুল্ল থাকবে। বন্ধু-বান্ধবদেরও প্রফুল্ল সহচর হতে চেষ্টা করবে। তাদের সাহচর্যে বিরক্ত না হয়ে বরং আনন্দময় জীবন ও আকর্ষণ অনুভব করবে।
হযরত আবদুল্লাহ বিন হারেস (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (সাঃ)-এর চেয়ে বেশী মুচকি হাসতে আর কাউকে দেখিনি।
(তিরমিযি)
হযরত জাবের বিন সামুর (রাঃ) বলেছেন যে, রাসূল (সাঃ) এর সাহচর্যে আমি এক শতেরও অধিক মজলিসে বসেছি, এ সকল মজলিসে সাহাবায়ে কেরামগণ কবিতা পাঠ করতেন এবং জাহেলীযুগের কিচ্ছা-কাহিনীও শুনাতেন। রাসূল (সাঃ) চুপ থেকে এসব শুনতেন এবং কখনো তিনি তাদের সাথে হাসিতেও অংশ গ্রহণ করতেন।
(তিরমিযি)
হযরত শারীদ (রাঃ) বলেন যে, আমি একবার রাসূল (সাঃ)-এর সওয়ারীর উপর তাঁর পেছনে বসার সুযোগ পেয়েছিলাম। সওয়ারীর উপর বসে বসে আমি রাসূল (সাঃ)-কে উমাই বিন ছালাহর একশত কবিতা শুনালাম। প্রত্যেক কবিতার পর তিনি বলতেন, আরো কিছু শুনাও আর আমি শুনাতাম।
রাসূল (সাঃ) তাঁর মজলিসে নিজেও কিচ্ছা-কাহিনী শুনাতেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন যে, একবার তিনি পরিবার এর লোকদেরকে একটি কাহিনী শুনালেন। এক মহিলা বলে উঠলেন, এ বিস্ময়কর অদ্ভুত কাহিনী বিস্তৃতভাবে শুনালেন। এরূপ একবার হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে এগার রমণীর এক চিত্তাকর্ষক কা্হিনী শুনালেন।
হযরত বকর বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-এর আনন্দ-স্ফূর্তির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেনঃ
সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) হাসি ও আনন্দ-স্ফূর্তির আবেগে একে অন্যের প্রতি তরমুজের খোসা পর্যন্ত নিক্ষেপ করতেন। সে লড়াই প্রতিরোধ করার দায়িত্বশীলও হতেন সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)।
(আল-আদাবুল মুফরাদ)
হযরত মোহাম্মদ বিন যিয়াদ (রহঃ) বলেছেনঃ আমি পূর্ববর্তী নেককার লোকদেরকে দেখেছি যে, কয়েক পরিবার বাড়ীতে বসবাস করত। অনেক সময় এরূপ হতো যে, কারো ঘরে মেহমান এবং অন্য কারো ঘরের চুলায় হাঁড়ি চড়ানো থাকতো। তখন মেহমানওয়ালা তার মেহমানদের জন্য বন্ধুর হাঁড়ি নামিয়ে নিয়ে যেতো, পরে হাঁড়ির মালিক হাঁড়ির খোঁজ করে ফিরত এবং লোকদেরকে জিজ্ঞেস করত যে, আমার হাঁড়ি কে নিয়ে গিয়েছে? ঐ মেজবান বন্ধু তখন বলতো যে, ভাই। আমার মেহমানের জন্য আমি নিয়ে গিয়েছিলাম। ঐ সময় হাঁড়ির মালিক বলতো, আল্লাহ তোমার জন্য বরকত দিক। মোহাম্মদ বিন যিয়াদ (রহঃ) বলেছেন যে, তারা যখন রুটি বানাতো তখনও প্রায়ই এ অবস্থা হতো।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
হযরত আলী (রাঃ) বলেন, “কখনও কখনও অন্তরকে স্বাধীনভাবে উন্মুক্ত কর। আনন্দদায়ক রসিকতারও চিন্তা করো। কেননা শরীরের মত অন্তরও ক্লান্ত হয়ে যায়।
৮. রুক্ষ স্বভাব ও মনমরা হয়ে থাকবে না। আনন্দ ও হাসি-খুশি থাকবে। কিন্তু এ বিষয়ে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করবে যে, নিজের আনন্দিত হওয়া যেনো সীমাহীন না হয়। সীমালংঘন না করে। প্রফুল্লতা ও আমোদ-প্রমোদের সাথে সাথে দীনি গাম্ভীর্য, মর্যাদাবোধ, লজ্জাবোধ এবং সমতা ও মিথ্যাচারের প্রতিও সতর্ক লক্ষ্য রাখবে।
(তিরমিযি)
রাসূর (সাঃ)-এর সাহাবী হযরত আবদুর রহমান (রাঃ) বলেন যে, রাসূল (সাঃ)-এর সাহাবীগণ কখনো রুক্ষ স্বভাবের ছিলেন না এবং মরার মতও চলতেন না। তারা তাদের মজলিসে কবিতাও পাঠ করতেন এবং জাহেলী যুগের কিচ্ছা-কাহিনীও বর্ণনা করতেন। কিন্তু কোন ব্যাপারে যখন তাদের নিকট থেকে সত্যের বিপরীত কোন কথার দাবী উঠতো তখন তাদের চেহারা জ্বীনে ধরা ব্যক্তির ন্যায় বিবর্ণ হয়ে যেত।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
প্রসিদ্ধ হাদীস বিশারদ (মশহুর মুহাদ্দিস) হযরত সুফিয়ান বিন ওয়াইনার নিকট কোন এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো, হাসি-ঠাট্টা কি এক প্রকার বিপদ? তিনি উত্তর দিলেন, না বরং সুন্নাত কিন্তু ঐ ব্যক্তির জন্য যে তার মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত আছে এবং উত্তম ঠাট্টা করতে পারে।
(শরহে শামায়েলে তিরমিযি)
৯. তুমি যে ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব কর তার নিকট তোমার বন্ধুত্বের কথা প্রকাশ করবে। তাতে তার মানসিক প্রভাব এমন হবে যে, তার মধ্যে নৈকট্যের ও আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টি হবে। উভয়পক্ষের আকর্ষণ ও অনুভূতির বিনিময়ে বন্ধুত্ব বৃদ্ধি পাবে। অতঃপর বন্ধুত্ব শুধু এক আন্তরিক অবস্থা থাকবে না বরং তার দাবী কর্মজীবনের উপর প্রভাবশীল হবে আর এভাবে ব্যক্তিগত ব্যাপারে মনোযেগ দিতে ও একে অন্যের সর্বাধিক নিকটবর্তী হবার সুযোগ পাবে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “যখন কোন ব্যক্তির অন্তরে তার দীনি ভাইদের জন্য বন্ধুত্বের আকর্ষণ সৃষ্টি হয় তখন তার উচিত তার বন্ধুকে এ বিষয়ে অবহিত করা যে, সে তার সাথে বন্ধুত্ব রাখে।
(আবু দাউদ)
একবার রাসূল (সাঃ) এর সামনে দিয়ে এক ব্যক্তি যাচ্ছিল, ঐ সময় কিছু লোক তার সম্মুখে বসা ছিল। তন্মধ্য থেকে এক ব্যক্তি বলে উঠলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই ব্যক্তির সাথে আমার শুধু আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব আছে। শুনে রাসূল (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি ঐ ব্যক্তিকে একথা জানিয়ে দিয়েছো? সে বলল, না। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, যাও, তার নিকট প্রকাশ করে দাও যে, তুমি আল্লাহর জন্যে তার সাথে বন্ধুত্ব করেছো। সে ব্যক্তি তাড়াতাড়ি গিয়ে পথে ঐ ব্যক্তির নিকট নিজের আবেগের কথা প্রকাশ করলো। তার উত্তরে ঐ ব্যক্তি বললো, তোমার সাথে তিনি বন্ধুত্ব করুন যার জন্যে তুমি আমার সাথে বন্ধুত্ব করেছো।
(তিরমিযি, আবু দাউদ)
বন্ধুত্বের সম্পর্ককে সর্বাধিক মজবুত এবং ফলপ্রসূ করা ও বন্ধুদের নিকটবর্তী হওয়ার জন্য প্রয়োজন হলো, বন্ধুদের ব্যক্তিগত ও অন্যান্য ব্যাপারে পছন্দ-অপছন্দনীয় সীমারেখা পর্যন্ত মনোযোগ দেবে এবং তাদের সাথে নৈকট্য ও বিশেষ সম্পর্কের কথা অবলীলায় প্রকাশ করবে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“একজন মানুষ যখন অন্য মানুষের সাথে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের সংযোগ স্থাপন করে তখন তার কাছ থেকে তার নাম, তার পিতার নাম এবং তার পারিবারিক অবস্থার কথা জেনে নেবে, এতে করে পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধন মজবুত ও দৃঢ় হয়।
(তিরমিযি)
১০. বন্ধত্বের প্রকাশ ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে সর্বদা মধ্যম পন্থা অবলম্বন করবে, এরূপ নিরুত্তাপ ভাব প্রদর্শন করবে না, যাতে নিজের বন্ধুত্ব ও সম্বন্ধ সন্দেহজনকবাবে দৃষ্টিগোচর হয় আর বন্ধুত্বের আবেগে এতটুকু অগ্রসর হবে না যে, বন্ধুত্ব ও ভালবাসা উন্মাদনার আকার ধারণ করে। যদি কোন সময় অনুশোচনা করতে হয়, সমতাও মধ্যম পন্থার প্রতি সর্বদা দৃষ্টি রাখবে এবং স্থির মস্তিষ্কে এরূপ ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা যা সব সময় সম্পাদন করতে পারবে। হযরত আসলাম (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, তোমাদের বন্ধুত্বের মাঝে যেনো উন্মাদনা প্রকাশ না পায় আর তোমাদের শত্রুতা যেনো কষ্টদায়ক না হয়। আমি বললাম হযরত কিভাবে? তিনি বললেন, যখন তোমরা বন্ধুত্ব করতে আরম্ভ করো তকন শিশুদের মত জড়িয়ে ধরো এবং আবেগে শিশু সুলভ আচরণ করতে আরম্ভ করো। আর কারো সাথে যদি মনোমালিন্য হয় তা হলে তার প্রাণ ও ধন-সম্পদ ধ্বংস করতে প্রবৃত্ত হয়ে যাও।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
হযরত ওবাইদ কিন্দী (রহঃ) বলেন, “আমি হযরত আলী (রাঃ) নিকট থেকে শুনেছি, তোমার বন্ধুর সাথে বন্ধুত্বে নম্রতা ও মধ্যম পন্থা অবলম্বন করো, কেননা সে কোন সময় তোমার শত্রুও হয়ে যেতে পারে। তদ্রূপ শত্রুর সাথে শত্রুতায় নম্রতা ও মধ্যম পন্থা অবলম্বন করো সম্ভবতঃ সে কোন সময় তোমার বন্ধুও হয়ে যেতে পারে”।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
১১. বন্ধুদের সাথে বিশ্বস্ততা ও শুভাকাংখী সুলভ ব্যবহার করবে। বন্ধুর সাথে সর্বাধিক মঙ্গল কামনা কর যে, তাকে চারিত্রিক দিক থেকে সর্বাধিক উপরে উঠাতে চেষ্টা করবে আর তার পার্থিব উন্নতি থেকে পরকালীন উন্নতির অধিক চিন্তা কর। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “দীন সম্পূর্ণটাই মঙ্গল কামনা”। মঙ্গল কামনার মূল এই যে, যা তুমি বন্ধুর জন্যে পছন্দ কর তা তুমি তোমার জন্যে পছন্দ করবে। কেননা মানুষ কখনো নিজের মন্দ কামনা করে না।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “সেই সত্তার শপথ আমার প্রাণ যার হস্তে। কোন ব্যক্তি খাঁটি মুমিন হতে পারে না যে পর্যন্ত সে তার ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ না করে যা সে নিজের জন্য করে”।
এক মুসলমানের ওপর অন্য মুসলমানের ছয়টি অধিকারের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “সে তার ভাইয়ের মঙ্গল কামনা করবে, সে অনুপস্থিত বা উপস্থিত থাকুক”। তিনি আরো বলেছেনঃ নিশ্চিত আল্লাহ তাআলা ঐ ব্যক্তির ওপর জাহান্নামের আগুন ওয়াজিব ও বেহেশত হারাম করে দিয়েছেন যে শপথ করে কোন মুসলমানের অধিকারে আঘাত করেছে (সাহাবাদের মধ্য থেকে একজন জিজ্ঞেস করলেন) যদি উহা কোন সাধারণ বস্তু হয়? হুযুর (সাঃ) বললেন, উহা পিলুর সাধারণ ডালও হোকনা কেন (পিলু এক প্রকার লতা জাতীয় গাছ যার দ্বারা মেসওয়াক তৈরী করা হয়।)
১২. বন্ধুদের দুঃখে-কষ্টে এবং আনন্দে ও খুশীতে অংশ গ্রহণ করবে। তাদের শোকে শরীক হয়ে সান্ত্বনা দানের চেষ্টা করবে, তাদের আনন্দ স্ফূর্তিতে অংশ গ্রহণ করে তা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করবে। প্রত্যেক বন্ধুই তার খাঁটি বন্ধুদের থেকে স্বাভাবিকভাবেই এ আশা পোষণ করে যে, তারা বিপদের সময় তার সাথে থাকবে এবং প্রয়োজনের সময়ও তার সঙ্গ ত্যাগ করবে না। অনুরূপ সে এও আশা করে যে, বন্ধু তার আনন্দ-স্ফূর্তি বৃদ্ধি করেবে এবং সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যোগদান করে অনুষ্ঠানের শোভা ও সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করবে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
এক মুসলমান অপর মুসলমানের জন্য ইমরাত স্বরূপ। যেমন ইমারতের এক ইট অন্য ইটের শক্তি ও সহায়তা যোগায়। এরপর তিনি এক হাতের আঙ্গুলগুলো অপর হাতের আঙ্গুলগুলোর মধ্যে প্রবেশ করালেন। (আর মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ককে ও ঘনিষ্ঠতাকে পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দিলেন।)
(বুখারী, মুসলিম)
তিনি আরো বলেছেনঃ “তোমরা মুসলমানদের পরস্পরে দয়াদ্র হৃদয় বন্ধুত্ব ও ভালবাসা এবং পরস্পর কষ্টের অনুভূতিতে এমন হবে যেমন এক শরীর, যদি তার এক অঙ্গ অসুস্থ হয় তা হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে থাকে”।
(বুখারী, মুসলিম)
১৩. বন্ধুদের সাথে সন্তুষ্টি, ন্ম্র স্বভাব, আনন্দ প্রফুল্লতা ও অকৃত্রিমভাবে মিশবে আর অত্যন্ত মনোযোগ ও হাসিমুখে তার অভ্যর্থনা করবে। বেপরোয়াভাব ও রুক্ষতা থেকে দূরে থাকবে। এসব অন্তর বিদীর্ণকারী কুস্বভাব। সাক্ষাতের সময় সর্বদা আনন্দ উল্লাস, শান্তি এবং শুকরিয়া ও হামদ এর শব্দসমূহ ব্যবহার করবে। দুঃখ-কষ্ট ও মনে ব্যথা পায় এমন কথা কখনো মুখে আনবে না। সাক্ষাতের সময় এরূপ চালচলন করবে যে, বন্ধু আনন্দ অনুভব করে। এমন নির্জীব ভাবে তাকে অভ্যর্থনা করনে না যে, তার মন দুর্বল হয়ে যায় এবং সে তার সাক্ষাতকে নিজের জন্য আযাব মনে করে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “নেকসমূহের মধ্য থেকে কোন নেকে তুচ্ছ মনে করবে না তা এমনই হোক না যে, তুমি তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে মিলিত হচ্ছ”।
(মুসলিম)
অন্য একস্থানে রাসূল (সাঃ) বলেছেঃ “তোমার আপন ভাইকে দেখে হাসি দেওয়অও সদক্বাহ”।
(তিরমিযি)
নম্র স্বভাব এবং উত্তম চরিত্রর দ্বারাই অন্তরে ভালবাসা ও বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয় আর এসব গুণের কারণে সুন্দর সমাজ সৃষ্টি হয়।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “আমি তোমাদেরকে ঐ ব্যক্তির পরিচয় দিচ্ছি যার ওপর জাহান্নামের আগুন হারাম এবং জাহান্নামের আগুনের ওপরও সে হারাম, এ ব্যক্তি হলো সেই ব্যক্তি যে নম্র প্রকৃতি, নম্র স্বভাব ও নম্র চরিত্রের”।
(তিরমিযি)
সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) বলেছেন, রাসূল (সাঃ) সাক্ষাতের সময় যখন কারো দিকে নিবিষ্ট হতেন তখন সম্পূর্ণ শরীর তার দিকে ফিরাতেন আর যখন কেউ তাঁর সাথে আলাপ করত তখন তিনি পূর্ণ মনোযোগী হয়ে তার কথা শুনতেন।
একবার তিনি মসজিদে বসা ছিলেন। এমন সময় একজন লোক আসায় তিনি শরীরকে নাড়া দিয়ে একটু সংকোচিত হলেন, লোকটি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! জায়গা তো আছে। রাসুল (সাঃ) বললেনঃ “মুসলমান এমন হবে যে, তার ভাই যখন তাকে আসতে দেখে তখন সে তার জন্যে নিজের শরীরকে একটু নাড়া দেবে”।
(বায়হাকী)
মুমিনদের প্রশংসায় পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ “তারা মুমিনদের জন্য অত্যন্ত নরম স্বভাবের”।
রাসূল (সাঃ) এর মূল তত্ত্বকে এভাবে প্রকাশ করেছেন।
“মুমিন ঐ উটের ন্যায় সহনশীল ও নরম স্বভাবের হবে যার নাকে দড়ি লাগান হয়েছে, তাকে টানলে চলে আবার পাথরের ওপর বসালেও সে বসে যায়”।
(তিরমিযী)
১৪. কখনো যদি কোন কথায় মতভেদ হয় তা হলে সত্বর আপোষ করে নেবে। সর্বদা ক্ষমা চাইতে ও নিজের অন্যায় স্বীকার করতে অগ্রণী ভূমিক পালন করবে।
১৫. বন্ধুদের কোন কথা যদি তোমার স্বভাব ও রুচির বিরুদ্ধ হয় তা হলে তুমি তোমার মুখের জবানকে সংযত রাখবে আর উত্তরে কখনো কর্কশ কথা অথবা মুখ খারাপ করবে না বরং বিজ্ঞতা ও নম্রতার সাথে কথা পরিহার করে যাবে! ক্ষমা করে দেবে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহর নিকট জিজ্ঞেস করলেন, আয় আমার প্রতিপালক! আপনার বান্দাদের মধ্য থেকে কে আপনার নিকট সবচেয়ে প্রিয়? আল্লাহ জবাব দিলেন, যে প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মাফ করে দেবে।
রাসূল (সাঃ) আরো বলেছেন-
“মুমিনের পাল্লায় কিয়ামতের দিন সর্বাধিক ওজনীয় যে বস্তু রাখা যাবে তা হলো তার উত্তম চরিত্র। যে নির্লজ্জ মুখে কথা বলে এবং গালি দেয় আল্লাহর নিকট সে ব্যক্তি অত্যন্ত ঘৃণিত”।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন মুবারক (রাহ) সচ্চরিত্রের পরিচয় দিয়েছেন তিনটি বাক্য দ্বারাঃ
১. যখন মানুষ কারো সাথে সাক্ষাৎ করে তখন হাসি মুখে সাক্ষাৎ করে’।
২.অভাব গ্রস্ত ও কপর্দকহীন বান্দাদের জন্য খরচ করে।
৩. কাউকে কষ্ট দেয় না।
হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেছেন কিয়অমতের দিন আল্লাহ তালার দৃষ্টিতে সর্বাধিক খারাপ লোক হলো সেই ব্যক্তি যার গালি ও কর্কশ কথার কারণে মানুষ তার নিকটে আসা ছেড়ে দিয়েছে।
(বুখারী ও মুসলিম)
১৬.তুমি বন্ধুদের সংশোধন ও প্রশিক্ষণ কাজে কখনো অলসতা করবে না, আর নিজের বন্ধুদের মধ্যে এমন রোগ সৃষ্টি হতে কখনো দেবেনা যা সংশোধন বা প্রশিক্ষণের পথ সর্বাধিক প্রতবিন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ আত্মার সন্তুষ্টি ও অহংকার। বন্ধুদের সর্বদা উৎসাহ দান করতে থাকবে, তারা যেনো তাদের ভুলত্রুটিসমূহ স্বীকার করে। নিজেদের ভুল স্বীকার করতে যেনো বীরত্ব প্রদর্শন করে। এ মূলতত্ত্বকে সর্বদা নজরে রাখবে যে, নিজের ভুল স্বীকার না করা এবং নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য হঠকারিতার আশ্রয় নেয়ার দ্বারা প্রবৃত্তি ও আত্মা অত্যন্ত খারাপ খোরাক পায়।
প্রকৃতপক্ষে লোক দেখানো বিনয় ও মিনতি প্রকাশ করা, নিজেকে তুচ্ছ বলা, চলাফেরা ও চালচলনে বিনয় ও মিনতি প্রকাশ করা অত্যন্ত সহজ কিন্তু নিজের মানসিকতার উপর আঘাত সহ্য করা, নিজের ত্রুটিসমূহ ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে শুনা এবং স্বীকার করে নেয়া এবং নিজের মানসিকতার বিপরীত বন্ধুদের সমালোচনা সহ্য করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তিনিই প্রকৃত বন্ধু যিনি সচেতন মস্তিষ্কে একে অন্যের প্রতি খেয়াল রাখেন।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
তিনটি জিনিস মানুষকে ধ্বংস করে দেয়ঃ
১. এমন সব আকাংখা যা মানুষকে অনুগত ও দাস করে রাখে।
২. এমন লোভ যাকে পরিচালক মেনে মানুষ তার অনুসরণ করতে থাকে।
৩. আত্ম-সন্তুষ্টি এ রোগ তিনটির মধ্যে সর্বাধিক ভয়ংকর।
সমালোচনা ও হিসাব-নিকাশ এমন এক অমোঘ অস্ত্রোপচার যা চারিত্রিক দেহের ক্ষতিকর পদার্থগুলোকে সমূলে বের করে দেয়। চারিত্রিক বলিষ্ঠতায় যথার্থ পরিবর্ধন করে ব্যক্তিগত ও সামাজিকতায় নব জীবন দান করে। বন্ধুদের হিসাব-নিকাশ ও সমালোচনায় অসন্তুষ্ট হওয়া, ভ্রু কুঁচকানো আর নিজেকে তার থেকে বেপরোয়া মনে করাও ধ্বংস বা ক্ষতিকর এবং এ পছন্দনীয় কর্তব্য সম্পাদনে ত্রুটি করাও ধ্বংস বা ক্ষতিকর। বন্ধুদের আঁচলে ঘৃণ্য দাগ দৃষ্টিগোচর হলে অস্থিরতা অনুভব করবে, এবং সেগুলো দূর করার জন্য বিজ্ঞোচিত ব্যবস্থা অবলম্বন করবে। অনুরূপ নিজেও খোলা মন ও বিনয়ের সাথে বন্ধুদেরকে সব সময় এ সুযোগ দিবে, তারা যেনো তোমার দাগ-কলঙ্ককে তোমার নিকট তুলে ধরে। রাসূল (সাঃ) বন্ধুত্বের এ অবস্থাকে এক উদাহরণের মাধ্যমে এভাবে প্রকাশ করেছেনঃ
“তোমরা প্রত্যেকেই আপন ভাইয়ের আয়না।
সুতরাং সে যদি তার ভাইয়ের মধ্যে কোন খারাপ কিছু দেখে তা হলে তার থেকে দূর করে দেবে”।
(তিরমিযি)
এ উদাহরণে পাঁচটি ইঙ্গিত পাওয়া যায় যাকে সামনে রেখে তুমি তোমার বন্ধুত্বকে প্রকৃত বন্ধুত্বে রূপদান করতে পার।
(১) আয়না তোমার দাগ ও কলংক তখনই প্রকাশ করে যখন তুমি তোমার দাগ, কলংক দেখার উদ্দেশ্যে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে, আর তুমি যখন তার সম্মুখ থেকে সরে যাও তখন সেও পরিপূর্ণ নীরবতা পালন করে।
অনুরূপভাবে তুমি তোমার বন্ধুর দোষসমূহ তখনই প্রকাশ করবে যখন সে নিজেকে সমালোচনার জন্য তোমার সামনে পেশ করে এবং খোলা মনে সমালোচনা ও হিসাব নিকাশের সুযোগ দেয় আর তুমিও অনুভব কর যে, এ সময় বোধশক্তি সমালোচনা শুুনার জন্য এবং অন্তরে সংশোধন কবুল করার জন্য প্রস্তুত আছে, তুমি যদি অবস্থা না পা্ও তাহলে বুদ্ধিমত্তার সাথে নিজের কথাকে অন্য কোন সুযোগের অপেক্ষায় রাখবে এবং নীরবতা অবলম্বন করবে। তার অনুপস্থিতিতে এরূপ সতর্কতা অবলম্বন করবে যে তোমার মুখে যেন এমন কোন শব্দও না আসে যার দ্বারা তার কোন দোষের দিকে ইঙ্গিত করা হয়, কেননা ইহা হলো গীবত (পরোক্ষ নিন্দা) আর গীবতের দ্বারা অন্তরের মিলন হয় না বরং বিচ্ছেদ হয়।
(২) আয়না মুখমণ্ডলে সেসব দাগ ও কলঙ্কের সঠিক চিত্র তুলে ধরে বা পেশ করে যা প্রকৃতপক্ষে মুখমণ্ডলে বর্তমান আছে সে কমও বলেনা এবং তার সংখ্যা বড়িয়েও পেশ করেনা। আবার সে মুখমণ্ডলের সেসব দোষগুলোকেই প্রকাশ করে যা তার মুখে থাকে। সে গুপ্ত দোষসমূহের অনুসন্ধান করে না এবং তন্ন তন্ন করে দোষসমূহের কোন কল্পনাপ্রসূত চিত্র প্রকাশ করে না। অনুরূপভাবে তুমি ও তোমার বন্ধুর দোষসমূহ কম বর্ণনা কর। অনর্থক খোশামোদে পড়ে দোষ গোপন করবে না আবার নিজের ভাষণ বা্গ্মীতার জোরে তার কোন বৃদ্ধিও করবে না। আবার শুধু ঐ সকল দোষই বর্ণনা করবে না যা সাধারণ জীবন ধারায় তোমার সামনে এসেছে। তন্ন তন্ন করে খোঁজ করা ও ছিদ্রান্বেষণে অবতীর্ণ হবে না। গোপন দোষ খোঁজ করা চারিত্রিক খেদমত নয় বরং এক ধ্বংসাত্মক ও চরিত্র বিধ্বংসী অস্ত্র।
রাসূল (সাঃ) একবার মিম্বরে আরোহণ করে অত্যন্ত উচ্চস্বরে উপস্থিত জনতাকে সাবধান করে বললেনঃ
“মুসলমাদের দোষ ত্রুটির পিছে পড়বে না। যে ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইদের দোষ ত্রুটির পিছে লাগে তখন আল্লাহ তার দোষসমূহ প্রকাশ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান এবং স্বয়ং আল্লাহ যার দোষ প্রকাশ করতে মনস্থ করেন তাকে তিনি অপদস্ত করেই ছাড়েন। যতই সে ঘরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে থাকুক না কেন”।
(তিরমিযি)
(৩) আয়না প্রত্যেক উদ্দেশ্য থেকে পবিত্র হয়ে নিরপেক্ষভাবে নিজের কর্তব্য সম্পাদন করে। আর যে ব্যক্তিই তার সামনে নিজের চেহারা পেশ করে সে কোন উদ্দেশ্য ব্যতীতই সঠিক চিত্র সামনে তুলে ধরে। সে কারো সাথে হিংসা বিদ্বেষ রাখেনা এবং কারো থেকে প্রতিশোধও গ্রহণ করেনা। তুমিও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য, প্রতিশোধ, হিংসা বিদ্বেষ এবং সর্বপ্রকার অসদুদ্দেশ্যে নিজেকে পরিপাটি করে নিতে পারো যেমন আয়না দেখে মানুষ নিজেকে পরিপাটি ও সজ্জিত করে নেয়।
(৪) আয়নায় নিজের সঠিক চিত্র দেখে কেউ অসন্তুষ্ট হয় না আর রাগে অস্থির হয়ে আয়না ভেঙ্গে দেয়ার মত নির্বুদ্ধিতাও কেউ করেনা। বরং তাড়াতাড়ি নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে নেয়ার কাজে লেগে যায় এবং আয়নায় মর্যাদা ও মূল্য অনুভব করে মনে মনে তার শুকরিয়া আদায় করে এবং ভাবে সত্যি আয়না আমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে নেয়ার জন্য বড় সাহায্য করেছে ও তার স্বাভাবিক কর্তব্য সম্পাদন করেছে। অতঃপর তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর যে, সে বন্ধুত্বের হক আদায় করেছে এবং শুধু মুখে নয় বরং আন্তরিকতার সাথে সাথে তার শুকরিয়াও আদায় করে এ মুহূর্ত থেকেই নিজের সংশোধন ও প্রশিক্ষনের জন্য উদ্বেগাকুল হয়ে যায় এবং অত্যন্ত প্রশান্ত অন্তরে ও উপকার স্বীকারের সাথে বন্ধুর নিকট আবেদন কর যে ভবিষ্যতেও সে যেন তার মূল্যবান পরামর্শ দ্বারা পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকে।
(৫) সর্বশেষ ইঙ্গিত এই যে, “মুসলমানদের প্রত্যেকেই তার ভাইয়ের আয়না” ভাই ভাইয়ের জন্য বন্ধুত্বের প্রতিচ্ছবি, বিশ্বস্ত ও হিতাকাঙ্খী এবং ব্যথাতুর হয়। ভাইকে বিপদে দেখে অস্থির হয়ে উঠে এবং সন্তুষ্ট দেখে খুশী হয়ে যায়। সুতরাং ভাই এবং বন্ধু যে সমালোচনা করবে তাতে তোমার উপকার হবে। বন্ধুত্বসূলভ এমনি সমালোচনা দ্বারা বন্ধুত্ব লাভ ও জীবন গঠনের আশা করা যেতে পারে।
১৭. বন্ধুদের সাথেও ভালবাসা প্রকাশ করা এবং বন্ধুত্ব আরো বৃদ্ধি করার জন্য হাদিয়া-তোহফার লেনদেন করবে। হাদিয়ার লেন-দেনে ভালবাসা এবং বন্ধুত্ব বৃদ্ধি পায়।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“এক অন্যকে হাদিয়া আদান প্রদান করলে পরস্পর বন্ধুত্ব সৃষ্টি হবে আর অন্তরে বিষন্নতা দূর হয়ে যাবে।
(মেশকাত)
রাসূল (সাঃ) নিজেও তাঁর আসহাবকে হাদিয়া দিতেন। তাঁর সাহাবগণও পরস্পর হাদিয়া দিতেন ও নিতেন। হাদিয়া মূল্যবান না হওয়ার কারণে বন্ধুর হাদিয়াকেও কখনো তুচ্ছ মনে করবে না। তার আন্তরিকতা ও ভালবাসার প্রতি দৃষ্টি রাখবে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“কেউ যদি আমাকে তোহফা স্বরূপ ছাগলের একটি পাও প্রদান করে তা হলে অবশ্যই তা গ্রহণ করবো। কেউ যদি আমাকে দাওয়াত করে একটি পাও খাওয়ায় তা হলে আমি অবশ্যই ঐ দাওয়াতে যাব।
(তিরমিযী)
হাদিয়অর পরিবর্তে হাদিয়অ অবশ্যই দেবে। রাসূল (সাঃ) এর গুরুত্ব প্রদান করতেন। তাঁর নিকট অধিক পছন্দনীয় তোহফা ছিল সুগন্ধিদ্রব্যের তোহফা। তুমিও এ তোহফাকে পছন্দনীয় কনে করবে। বর্তমান কালে দীনি কিতাবও উত্তম তোহফা।
কখনো কখনো এক সাথে বসে খানা পিনার ব্যবস্তা করবে। বন্ধুদেরকে তোমার ঘরে খাওয়ার জন্য দাওয়াত দিবে। বন্ধু-বান্ধবদের কেউ দাওয়াত দিলে অত্যন্ত খুশী মনে তা গ্রহণ করবে। এর দ্বারা বন্ধুত্বের আবেগ বৃ্দ্ধি ও দৃঢ় হয়। বরং এ ধরণের স্থানসমূহে অসাধারণ লৌকিকতা প্রদর্শন এবং পানাহারের সাজ সরঞ্জামে প্রাচুর্য দেখানোর স্থলে তুমি অকৃত্রিমতা ও বন্ধুত্বের গাঢ়ত্ব বৃদ্ধির প্রতি অধিক মনোযোগ দিবে।
১৮. বন্ধুদের খোঁজ-খবর নেবে। প্রয়োজনে তাদের উপকার করবে। জান ও মাল দ্বারা তাদের সাহায্য করবে। ইবনে হানী (রাঃ)-এর এক বর্ণনায় আছে যে, হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ)-এর নিকট এক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞেস করলো যে আবদুল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় কে? তিনি উত্তর দিলেনঃ
“মানুষে মধ্যে অধিক প্রিয় সেই ব্যক্তি যে মানুষের বেশী উপকার করে আর আমলের মধ্যে অধিক প্রিয় আমল হলো কোন মুসলমানকে সন্তুষ্ট করা এবং এটা এভাবে যে, তুমি তার বিপদ ও অসুবিধা দূর করে দেবে। অথবা তার ক্ষুধা নিবারণ করে দেবে আর কোন ভাইয়ের সাথে তার প্রয়োজন পূরণ করার জন্য যাবে”।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে আল্লাহ তাআলা তার প্রয়োজনও পূরণ করতে থাকবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের বিপদ দূর করবে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের বিপদসমূহ থেকে যে কোন একটি বিপদ তার দূর করে দেবেন”।
(বুখারী, মুসলিম)
তিনি এও বলেছেনঃ “আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের সাহায্য ততক্ষণ পর্যন্ত করতে থাকেন যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা তার ভাইকে সাহায্য করতে থাকে”।
হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) বলেছেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, কোন মুসলমানের প্রয়োজন পূরণ করার পুরস্কার ও সওয়াব এর পরিমাণ দশ বৎসরের ইতেকাফ থেকেও বেশী”।
(তিরবানী)
হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইয়ের নিকট খুশী ও আনন্দের কথা পৌছে দেয় এবং তাকে সন্তুষ্ট করে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাকে সন্তুষ্ট করেন দেবেন”।
(তিবরানী)
১৯. উত্তম বিশ্বস্ত বন্ধু হও। বিশ্বাস করে তোমার নিকট মনের কথা বলে দিলে তার হেফাজত করবে। কখনো বন্ধুর বিশ্বাসে আঘাত দেবেনা। নিজের বক্ষকে গুপ্ত রহস্যের ভাণ্ডার হিসেবে তৈরী কর যেনো বন্ধু নিঃসংশয়ে তার প্রত্যেক ব্যাপারে পরামর্শ নিতে পারে আর তুমি বন্ধুকে সৎপরামর্শ দিতে পার ও সহযোগিতা করতে পারো।
হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, হাফসা (রাঃ) যখন বিধবা হলেন তখন আমি হযরত ওসমান (রাঃ) কে বললাম যে তুমি যদি ইচ্ছা করো তা হলে হাফসা (রাঃ)-এর বিয়ে তোমার সাথে দিই, ওসমান (রাঃ) জবাবে বললেন, এ ব্যাপারে আমি চিন্তা করে জানাবো। আমি কয়েক রাত পর্যন্ত তার অপেক্ষা করলাম, অতঃপর ওসমান (রাঃ) বললেন আমার বিয়ে করার খেয়াল নেই। আমি আবার আবু বকর (রাঃ)-এর নিকট গিয়ে বললাম, আপনি যদি ইচ্ছা করেন তাহলে হাফসা (রাঃ) কে আপনার বিবাহাধীনে নিতে পারেন। তিনি চুপ রইলেন এবং কোন উত্তর দিলেন না। তার চুপ থাকাটা আমার নিকট অত্যন্ত ভারী মনে হলো, ওসমানের চেয়েও ভারি মনে হলো। এ ভাবে কয়েক দিন চলে গেলো। অতঃপর রাসূল (সাঃ)হাফসা (রাঃ) কে বিবাহের প্রস্তাব পাঠালেন, তখন আমি রাসূল (সাঃ)-এর সাথে হাফসা (রাঃ)-এর বিবাহ দিয়ে দিলাম। এরপর আবু বকর (রাঃ) আমার সাথে সাক্ষাৎ করে বললেন, তুমি আমার নিকট হাফসা (রাঃ)-এর কথা আলোচনা করেছিলে কিন্তু আমি চুপ ছিলাম। হতে পারে আমার এ চুপ থাকার দ্বারা তোমার মনোঃকষ্ট হয়েছে। আমি বললাম, হ্যাঁ কষ্ট হয়েছিল। তিনি বললেন, আমি জানতাম যে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরূপ চিন্তা করছেন। এটা ছিল তাঁর একটি গুপ্ত রহস্য যা আমি প্রকাশ করতে চাচ্ছিলাম না। রাসূল (সাঃ) যদি হাফসা (রাঃ)-এর কথা আলোচনা না করতেন তা হলে আমি অবশ্যই তা কবুল করে নিতাম।
হযরত আনাস (রাঃ) ছেলেদের সাথে খেলা করছিলেন। এমন সময় রাসূল (সাঃ) তাশরীফ আনলেন এবং আমাদেরকে সালাম করলেন। অতঃপর একটি প্রয়োজনীয় কথা বলে আমাকে পাঠালেন। আমার কাজ সেরে আসতে একটু দেরী হলো। কাজ শেষ করে আমি যখন ঘরে গেলাম তখন মা জিজ্ঞাসা করলেন, এতক্ষণ কোথায় কাটালে? আমি বললাম, রাসূল (সাঃ) এক প্রয়োজনে পাঠিয়েছিলেন। তিনি বললেন কি প্রয়োজন ছিল? আমি বললাম, গোপন কথা। মা বললেন, সাবধান, রাসূল (সাঃ)-এর গোন কথা ঘুর্ণাক্ষরেও কাউকে বলবে না।
বন্ধুত্ব মূলতঃ তখনই ফলপ্রসূ ও স্থায়ী হতে পারে যখন কেউ সামাজিক চরিত্রে নমনীয়তা এবং অসাধারণ ধৈর্য্য ও সহনশীলতা সৃষ্টি করবে আর বন্ধু সম্পর্কে উদারতা, ক্ষমা ও মার্জনা, দানশীলতা এবং একে অন্যের আবেগের প্রতি লক্ষ্য ও মনোযোগ দেবে। রাসূল (সাঃ) এর কয়েকটি ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়, তিনি কত উন্নত প্রশস্ত অন্তর, ধৈর্য্য সহ্য ও উদারতার সাথে মানুষের স্বাভাবিক প্রয়োজন ও দুর্বলতার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন।
- রাসূল (সাঃ) বলেছেন যখন আমি নামাযের জন্য আসি তখন মন চায় যে, নামাযকে দীর্ঘ করি। যখন কোন শিশুর কান্না শোনা যায় তখন নামায সংক্ষেপ করে দিই কেননা আমার নিকট অত্যন্ত কষ্টকর যে আমি নামাযকে দীর্ঘ করে শিশুর মাকে কষ্টে নিপতিত করছি।
- হযরত মালেক বিন হুয়াইবিস বলেন যে, আমরা কয়েকজন সমবয়স্ক যুবক দীনী জ্ঞানার্জনের জন্য রাসূল (সাঃ)-এর মজলিসে উপস্থিত হলাম। ২০ দিন পর্যন্ত হুজুরের দরবারে ছিলাম। রাসূল (সাঃ) অত্যন্ত দয়ালু ও নম্র ছিলেন। যখন ২০ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল তকন তিনি বুঝতে পারলেন যে,আমরা বাড়ী ফিরে যেতে আগ্রহী। তখন তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা তোমাদের ঘরে কাকে রেখে এসেছো? আমরা বাড়ীর অবস্থা জানালে তিনি বললেন, যাও তোমাদের স্ত্রী-বাচ্চাদের নিকট ফিলে যাও? আর তোমরা যা শিখেছ তা তাদেরকে শিখাও। তাদেরকে ভাল কাজ করার উপদেশ দাও। অমুক নামায অমুক সময় পড়, নামাযের সময় হলে তোমাদের একজনে আযান দেবে এবং তোমাদের ইলম ও চরিত্রে যে উন্নত সে নামায পড়াবে।
(বুখারী মুসলিম)
- হযরত মুআবিয়া বিন সুলামী (রাঃ) নিজের এক ঘটনা বর্ণনা করেন যে, আমি রাসূল (সাঃ)-এর সাথে নামায পড়ছিলাম, এর মধ্যে এক ব্যক্তির হাচিঁ আসলে নামাযরত অবস্থায়ই আমার মুখ থেকে “ইয়ারহামুকাল্লাহ” বের হয়ে গেল, লোকেরা আমার দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। আমি বললাম, আল্লাহ তোমাদেরকে শান্তিতে রাখুক। তোমরা আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন? অতঃপর আমি যখন দেখতে পেলাম যে, তারা আমাকে চুপ থাকতে বলছে তখন আমি চুপ হয়ে গেলাম। রাসূল (সাঃ) যকন নামায থেকে অবসর হলেন আমার মাতা-পিতা রাসূল (সাঃ)-এর উপর কোরবান হোক! আমি রাসূল (সাঃ) এর চেয়ে উত্তম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দাতা পূর্বেও দেখিনি এবং পরেও না। তিনি আমাকে ধমক দেননি, মারেন নি এবং ভাল-মন্দ কিছুই বলেন নি। শুধু এতটুকু বলেছেন যে, নামাযে কথা-বার্তা বলা ঠিক নয়। নামায হল আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করার, মহত্ত্ব বর্ণনা করার এবং কোরআন পাঠ করার জন্য।
(মুসলিম)
২০. দোআর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেবে। নিজে ও বন্ধু-বান্ধবদের জন্য দোআ করবে এবং তাদের নিকট দোআর আবেদন করবে। দোআ বন্ধুদের সামনে করবে এবং তাদের অনুপস্থিতেও। অনুপস্থিতিতে বন্ধুদের নাম নিয়েও দোআ করবে।
হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, “আমি রাসূল (সাঃ)-এর নিকট ওমরা করার জন্য অনুমতি চাইলাম”, তিনি অনুমতি দেয়ার সময় বললেন, “হে ওমর দোআ করার সময় আমাদের কথাও মনে রেখ”। হযরত ওমর (রাঃ) বলেন “আমার নিকট এ কথা এত আনন্দদায়ক বোধ হয়েছে যে এর পরিবর্তে আমাকে সারা দুনিয়া দিয়ে দিলেও এত খুশী হতাম না”।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন যে, কোন মুসলমান যখন তার মুসলমান ভাইয়ের জন্য গায়েবানা দোআ করে তখন আল্লাহ তা’আলা তার দোআ কবুল করে নেন আর দোআকারীর মাথার উপর একজন ফেরেশতা নিযুক্ত করে দেন, সে ব্যক্তি যখন তার ভাইয়ের জন্য নেক দোআ করে তখন ফেরেশতা আমীন বলেন আর বলেন, তুমি তোমার ভাইয়ের জন্য যা চেয়েছ তোমার জন্যও ঐসব কিছু বরাদ্দ আছে।
(সহীহ মুসলিম)
নিজের দোআসমূহে আল্লাহর নিকট অকপটে এ আবেদন করতে থাকবে যে, আয় আল্লাহ! আমাদের অন্তরকে হিংসা বিদ্বেষ এবং পঙ্কিলতার ময়লা থেকে ধুয়ে দিন! আমাদের চক্ষুকে অকৃত্রিম ভালবাসা দ্বারা জুড়ে দিন! আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে একতা ও বন্ধুত্বের দ্বারা সুন্দর করে দিন।
পবিত্র কোরআন বুঝে বুঝে পড়বে এবং কোরআনে বর্ণিত এ দোয়ারও গুরুত্ব প্রদান করবে।
আরবি
“আয় আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এবং আমাদের পূর্বে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে ক্ষমা করুন। আমাদের অন্তর থেকে মুমিনদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে দিন। হে আমাদের প্রতিপালক আপনি নিশ্চয়ই দয়াবান ও দয়ালু।
(সূরায়ে হাশর-১০)
আতিথেয়তার আদবসমূহ
১. মেহমান আসলে আনন্দ ও বন্ধুত্ব প্রকাশ করবে আর অত্যন্ত সন্তুষ্টির সাথে তাকে অভ্যর্থনা জানাবে, সংকীর্ণমনা, অবহেলা, অন্যমনষ্কতা ও বিষন্নতা প্রকাশ করবে না।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে তারা যেন তাদের মেহমানের আতিথেয়তা যথোপযুক্তভাবে সম্পন্ন করে।
(বুখারী, মুসলিম)
- রাসূল (সাঃ)-এর নিকট যখন কোন সম্মানিত মেহমান আসতেন তখন তিনি নিজেই তার আতিথেয়তা করতেন।
- রাসূল (সাঃ) যখন মেহমানকে নিজের দস্তরখানে খাবার খাওয়াতেন তখন বারবার বলতেন, “আরো খান, আরো খান”। মেহমান যখন পরিতৃপ্ত হয়ে যেতেন এবং আর খেতে অস্বীকার করতেন কেবল তখনই তিনি বিরত হতেন।
২. মেহমান আসার পর সর্বপ্রথম সালাম ও দোআ করবে এবং কুশলাদি জেনে নেবে।
পবিত্র কোরআনে আছে-
আরবি
“আপনার নিকট কি ইবরাহীম (আঃ)-এর সম্মানিত মেহমানদের কাহিনী পৌঁছেছে? তারা যখন তাঁর নিকট আসল তখন আসা মাত্রই সালাম দিল, ইবরাহীম (আঃ) সালামের উত্তর দিলেন”।
৩. অন্তর খুলে মেহমানের আতিথেয়তা করবে আর যথাসাধ্য উত্তম বস্তু পরিবেশন করবে। হযরত ইবরাহিম (আঃ)-এর মেহমান আসলে ইবরাহিম (আঃ) সত্ত্বর তাদের পানাহারের বন্দোবস্তে লেগে যেতেন এবং ভাল ভাল খাদ্য মেহমানদের সামনে পরিবেশন করতেন।
পবিত্র কোরআনে আছে-
আরবি
তখন ঘরে গিয়ে এক মোটা তাজা গোশাবক (যবেহ করে ভাজি করে) তাদের সামনে পেশ করলেন।
(সূরা যারিয়াহ)
আরবি
এর অর্থ ইহাও যে, তিনি গোপনে ঘরে মেহমানদের আতিথেয়তার ব্যবস্থার জন্য চলে গেলেন, কেননা, মেহমানদের দেখিয়ে ও সংবাদ দিয়ে এদের পানাহার ও আহিথেয়তার জন্য পরিশ্রম করলে তা লজ্জা ও মেজবানের কষ্টের কারণে নিষেধ করবেন এবং পছন্দ করবে না যে, মেজবান তাদের কারণে অসাধারণ কষ্ট করবে। অতঃপর মেজবানের জন্য ইচ্ছামত আতিথেয়তা করার সুযোগ হবেন।
রাসূল (সাঃ) মেহমানের আতিথেয়তার ব্যাপারে যেভাবে উৎসাহিত করেছেন তার চিত্র তুলে ধরে হযরত আবু শোরাহই (রাঃ) বলেছেন-
“আমার এ দুটি চোখ দেখেছে আর এ দুটি কান শুনেছে যখন রাসূল (সাঃ) এ হেদায়েত দিচ্ছিলেন “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে, তাদের উচিত নিজেদের মেহমানদের আতিথেয়তা করা। মেহমানের পুরষ্কারের সুযোগ হলো প্রথম দিন ও রাত।
(বুখারী মুসলিম)
প্রথম দিন রাতের আতিথেয়তাকে পুরস্কারের সাথে তুলনা করার অর্থ এই যে, পুরস্কার দাতা যে ভাবে বন্ধুত্বের সাথে পুরস্কার দিতে গিয়ে আত্মিক
আনন্দ অনুভব করে, ঠিক এমনি অবস্থা প্রথম রাত ও দিনে মেজবানের হওয়া উচিৎ। আর যেভাবে পুরষ্কার গ্রহীতা খুশীতে আবেগ বিহবল হয়ে পুরষ্কার গ্রহণ করে ঠিক মেহমানকেও প্রথম দিন ও রাত তদ্রূপ অবস্থা দেখানো উচিৎ এবং নিজের অধিকার মনে করে আনন্দ ও নৈকট্যের আবেগের সাথে মেজবানের দেওয়া হাদিয়া নিঃসংকোচে গ্রহণ করা উচিৎ।
৪. মেহমান আসা মাত্রই তার প্রয়োজনীয়তার প্রতি লক্ষ্য করবে, পায়খানা-প্রস্রাবের জরূরত আছে কিনা জিজ্ঞেস করবে। মুখ-হাত ধৌত করার ব্যবস্থা করে দেবে, প্রয়োজন গোসলের ব্যবস্থাও করে দেবে, পানাহারের সময় না হলেও অত্যন্ত সুন্দর নিয়মে (যেভাবে মেহমান লজ্জা না পায় সেভাবে) পানাহারের কথা জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে। যে কামরায় মেহমানের শোয়া ও অবস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে তা মেহমানকে জানিয়ে দেবে।
৫. সব সময় মেহমানের কাছে বসে থাকবে না। হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকট যখন মেহমান আসতো তখন তিনি তাদের পানাহারের ব্যবস্থা করার জন্য মেহমানদের কাছ থেকে কিছুক্ষণ দূরে সরে যেতেন।
৬. মেহমানদের পানাহারে আনন্দ অনুভব করবে, মনোকষ্ট ও দুছখ অনুভব করবে না। মেহমান দুঃখ-কষ্ট নয়, আল্লাহর অনুগ্রহ এবং ভাল ও প্রাচুর্যের উপকরণ। আল্লাহ যাকে মেহমান হিসেবে আপনার নিকট প্রেরণ করেন তার রিযিকও পাঠিয়ে দেন। সে তোমার ভাগ্যের অংশ খায় না বরং তার ভাগ্যের অংশই সে খায়। সে তোমার সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ হয়।
৭. মেহমানের মান-সম্মাননের প্রতিও লক্ষ্য রাখবে। তার মান সম্মানকে নিজের মান-সম্মান মনে করবে। কেউ মেহমানের মান-সম্মান এর ব্যঘাত ঘটালে তাকে তোমার মর্যাদা ও লজ্জাবোধের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ মনে করবে।
পবিত্র কোরআনে আছে-
আরবি
“লুত (আঃ) বলেছেন, ভাইসব! এ সব লোক আমার মেহমান সুতরাং তোমরা আমাকে অপমান করোনা। আল্লাহকে ভয় কর আর আমাকে অসম্মান করা থেকে বিরত থাক”।
(সূরায়ে আল হাজ্বার)
৮. অন্তত তিন দিন পর্যন্ত আগ্রহ ও উৎসাহের সাথে আতিথেয়তা করবে। তিন দিন পর্যন্ত আতিথেয়তা মেহমানের হক আর এ হক আদায়ে মুমিনের অত্যন্ত প্রশস্ত অন্তর হওয়া উচিৎ। প্রথম দিন বিশেষ আতিথেয়তার দিন। সুতরাং এদিন আতিথেয়তার পরিপূর্ণ ব্যবস্থা করবে। পরবর্তী দুদিন অসাধারণ ব্যবস্থা না করতে পারলেও কোন ক্ষতি নেই। রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
আরবি
আতিয়েতা হলো তিন দিন, তার পর যা কিছু করবে তা হবে তার জন্য সদকাহ”।
(বুখারী, মুসলিম)
৯. মেহমারে খেদমতকে নিজের চারিত্রিক কর্তব্য মনে করবে এবং মেহমানকে কর্মচারী ও শিশুদের স্থলে নিজেই তার খেদমত ও আরামের ব্যবস্থা করে দেবে। রাসূল (সাঃ) মেহমানদের অতিথেয়তা নিজে নিজেই করতেন। হযরত ইমাম সাফেয়ী (রহ) যখন হযরত ইমাম মালেক (রহ)-এর ঘরে মেহমান হিসেবে গেলেন তখন তিনি অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার সাথে এক কামরায় শোয়ালেন। সাহরীর সময় ইমাম শাফেয়ী (রহ) শুনতে পেলেন যে কেউ দরজা খটখটায়ে অত্যন্ত স্নেহমাখা সুরে বলছেন, “আপনার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক! নামাযের সময় হয়ে গেছে”। ইমাম শাফেয়ী (রহ) তাড়াতাড়ি উঠে দেখলেন যে, ইমাম মালেক (রহ) লোটা হাতে দাঁড়িয়ে! ইমাম শাফেয়ী (রহ) কিছুটা লজ্জা পেলেন। ইমাম মালেক এটা বুঝে মহব্বতের সাথে বললেন, ভাই! তুমি কিছু মনে করবে না। মেহমানের খেদমত করা উচিৎ।
১০. মেহমানকে বসার ব্যবস্থা করার পর পায়খানা দেখিয়ে দেবে। পানির লোটা এগিয়ে দেবে এবং কেবলার দিক দেখিয়ে দেবে। নামাযের স্থান ও মোছল্লা ইত্যাদি সরবরাহ করবে। ইমাম শাফেয়ীকে ইমাম মালেকের খাদেম এক কামরায় অবস্থান করানোর পর বিনয়ীভাবে বলল, “হযরত! কেবলা এদিকে, পানির পাত্র এখানে রাখা আছে, পায়খানা ঐদিকে”।
১১. খাওয়ার জন্য যখন হাত ধোয়াবে তখন প্রথমে নিজে হাত ধুয়ে দস্তর খানে পৌঁছাবে তারপর মেহমানের হাত ধোয়াবে। ইমাম মালেক (রহ) যখন এ কাজ করলেন তখন ইমাম শাফেয়ী (রহ) এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তখন তিনি বললেন, খাওয়ার আগে প্রথমে মেজবানের হাত ধোয়া উচিৎ এবং দস্তরখানে এসে মেহমানকে স্বাগত জানান উচিৎ। খাবার পর মেহমানদের হাত ধোয়ান তারপর মেজবানকে হাত ধুতে হবে কারণ খাবার থেকে উঠার সময় কেউ এসে পড়তে পারে।
১২. দস্তরখানায় খাবার ও পাত্র মেহমানদের সংখ্যা থেকে কিছু বেশী রাখবে। হতে পারে যে, খাবার সময় আরো কোন ব্যক্তি এসে পড়বে, আবার তাদের জন্য ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হতে হবে। এমতাবস্থায় পাত্র ও সাজসরঞ্জাম যদি আগে থেকে প্রস্তুত থাকে তা হলে আগন্তুক ব্যক্তিও অপমানের স্থলে আনন্দ ও সম্মান অনুভব করবে।
১৩. মেহমানের জন্য প্রয়োজনবোধে নিজে কষ্ট করে তাকে আরাম দেবে। একবার রাসূল (সাঃ) এর দরবারে এক লোক এসে বলল, হুজুর! আমি ক্ষুধায় অস্থির! তিনি তার কোন এক বিবির ঘরে বলে পাঠালেন, খাবার যা কিছু আছে পাঠিয়ে দাও! উত্তর আসল, এখানে পানি ব্যতীত আর কিছু নেই। আবার অন্য এক বিবির ঘরে পাঠালেন ওখান থেকে এই জবাবই আসলো, এমনকি তিনি এক এক করে সকল বিবির ঘরে বলে পাঠালেন এবং সকল বিবির ঘর থেকেই এক জবাব আসলো। তখন তিনি নিজের সাহাবীদের দিকে মনোযোগী তলেন এবং বললেন, আজ রাতের জন্য এ মেহমানকে দিকে মনোযোগী হলেন এবং বললেন,আজ রাতের জন্য এ মেহমানকে কে কবুল করতে পার? এক আনসারী সাহাবী বললেনঃ “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি কবুল করতে পারি!
আনছারী মেহমানকে বাড়ী নিয়ে গেলেন। ঘরে গিয়ে বিবিকে বললেন, আমার সাথে রাসূলাল্লাহ (সাঃ)-এর এক মেহমান আছে, তার আতিথেয়তা কর। বিবি বলল, “আমার নিকট শুধু শিশুদের উপযোগী সামান্য খাদ্য আছে”। সাহাবী বললেন শিশুদেরকে কোন রকম ভুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে চেরাগ নিভিয়ে দেবে এবং মেহমানদের সাথে খেতে বসে যাবে সে যেন বুঝতে পারে যে, আমরাও তার সাথে খাবারে শরীক আছি।
এভাবে মেহমান পেট ভরে খেয়ে নিলেন আর পরিবারের লোকেরা সারা রাত উপবাসে কাটালেন। ভোরে এ সাহাবী যখন রাসূল-এর দরবারে হাযির হলেন এবং তিনি দেখেই বললেন, তোমরা উভয়েই রাতের বেলায় তোমাদের মেহমানের সাথে যে সৎ ব্যবহার করছো ত আল্লাহ তাআলার নিকট অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে।
(বুখারী, মুসলিম)
১৪. তোমার মেহমান যদি কখনো তোমার সাথে অমানবিক ও রুক্ষ্মতা সুলভ ব্যবহার করে তবুও তুমি তার সাথে অত্যন্ত প্রশস্ত হৃদয়, বুদ্ধিমত্তার সাথে ভাল ব্যবহার করবে।
হযরত আবুল আহওয়াস জাশমী (রাঃ)-তার পিতা সম্পর্কে বর্ণনা করেন যে, একবার তিনি রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন, কারো নিকট যদি আমি অতিথি হই আর সে যদি আতিথেয়তার হক আদায় না করে এবং আবার কিছুদিন পর আমার কাছে আসে তা হলে আমি কি তার আতিথেয়তার হক আদায় করব? নাকি তার অমানবিকতা ও অমনোযোগিতার প্রতিশোধ নেবো? রাসূল (সাঃ) বললেন, না বরং যে ভাবেই হোক তার আতিথেয়তার হক আদায় করবে।
(মেশকাত)
১৫. মেহমানের খায়ের ও বরকতের জন্য হযরত আবদুল্লাহ বিন বসর (রাঃ) বলেছেন যে, একদা রাসূল (সাঃ) আমার পিতার নিকট মেহমান হলেন, এবং আমরা তার সামনে খাদ্য হিসেবে হারিসা পরিবেশন করলাম, তিনি সামান্য কিছু গ্রহণ করলেন, তারপর আমরা খেজুর পরিবেশন করলাম। তিনি খেজুর খাচ্ছিলেন তারপর কিছু পানীয় পেশ করা হলো, তিনি পান করলেন এবং তার ডানে বসা ব্যক্তির দিকে বাড়িয়ে দিলেন। তিনি যখন চলে যেতে উদ্যত হলেন তখন সম্মানিত পিতা তার সওয়ারীর লাগাম ধরে আবেদন করলেন যে, হুযুর! আমাদের জন্য দোয়া করুন! রাসূল (সাঃ) দোআ করলেন-
আরবি
“আয় আল্লাহ!আপনি তাদেরকে যে রিযিক দান করেছেন তাতে প্রাচুর্য ও বরকত দান করুন, তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তাদের প্রতি রহমত করুন!
মেহমানের আদবসমূহ
১. কারো বাড়ীতে মেহমান হিসেবে যেতে হলে মেজবানের মর্যাদানুযায়ী মেজবানের শিশুদের জন্য কিছু হাদিয়া তোহফা নিয়ে যাবে। তোহফায় মেজবানের রুচি ও পছন্দের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। হাদিয়া তোহফার লেনদেনে বন্ধুত্ব ও সম্পর্কে অনুভূতি বৃদ্ধি পায়।
২. যার বাড়ীতেই মেহমান হিসেবে যাওয়া হোক না কেন তিন দিনের অতিরিক্ত সময় অবস্থান না করার চেষ্টা করবে কিন্তু অবস্থা বিশেষে মেজবানের কঠোর একাগ্রতায় ভিন্ন কথা।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
মেহমানের জন্য মেজবান পেরেশানিতে পড়ে এমন সময় পর্যন্ত মেজবানের বাড়ীতে অবস্থান করা ঠিক নয়।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
সহীহ মুসলিম শরীফে আছে যে, মুসলমানের জন্য তার ভাইয়ের বাড়ীতে তাকে গুনাহগার করে দেয়া পর্যন্ত অবস্থান করা ঠিক নয়। সাহাবায়ে কেরাম বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, কিভাবে গুনাহগার করবে? তিনি বললেন, “সেভাবে যে, সে তার নিকট অবস্থান করবে অথচ, মেজবানের নিকট আতিথ্যের কিছু থাকবে না”।
৪. শুধু অপরের মেহমানই হবে না, অন্যদেরকেও নিজের ঘরে আসার দাওয়াত দেবে এবং প্রাণ খুলে আতিথেয়তা করবে।
৫.কোথাও মেহমান হিসাবে যেতে চাইলেও মওসুম বা ঋতুর পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম ও বিছানাপত্র ইত্যাদি সাথে নিয়ে যাবে। বিশেষ করে শীতকালে বিছানা-পত্র ছাড়া যাবে না নতুবা মেজবানের কষ্ট হবে এবং এটাও ঠিক নয় যে, মেহমান মেজবানের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
৬. মেজবানের কর্মব্যস্ততা ও দায়িত্বের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। বিশেষকরে লক্ষ্য রাখবে যে, তোমার কারণে মেজবানের কর্ম ব্যস্ততায় যেন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করে এবং দায়িত্বে ব্যাঘাত না ঘটে।
৭. মেজবানের নিকট কিছু দাবী করবে না। সে মেহমানের সন্তুষ্টির জন্য স্বেচ্ছায় যে ব্যবস্থা করে তার উপরই মেজবানের শুকরিয়া আদায় করবে আর তাকে অনর্থক কষ্টে ফেলবে না।
৮. যদি মেজবানের মহিলাদের শরয়ী গায়র মুহরিম হোন তা হলে বিনা কারণে মেজবানের অনুপস্থিতিতে কথা-বার্তা বলবে না বা কারো কথাবার্তাও আন লাগিয়ে শুনবে না। এ নিয়মে থাকবে যে তোমার কথা বার্তা ও চালচলনে যেন তাদের কোন পেরেশানি না হয় এবং কোন ব্যাঘাতও না ঘটে।
৯. তুমি যদি কোন কারণে মেজবানের সাথে খেতে অনিচ্ছা প্রকাশ কর অথবা রোযাদার হও তাহলে অত্যন্ত নম্রভাবে ওযর পেশ করবে। আর মেজবানের সম্পদ বৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্যের জন্য দোআ করবে।
হযরত ইবরাহীম (আঃ) সম্মানিত মেহমানদের জন্য খাদ্য পরিবেশন করলেন আর তারা হাত গুটাতেই রইলেন তখন হযরত আবেদন করলেনঃ
“আপনারা খাচ্ছেন না কেন”? উত্তরে ফিরিশতাগণ হযরতকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “আপনি মনোকষ্ট নেবেন না। মূলতঃ আমরা খেতে পারিনা, আমরা তো আপনাকে শুধুমাত্র যোগ্য ছেলের জন্ম গ্রহণের সুসংবাদ দান করতে এসেছি”।
১০. কারো বাড়ীতে যখন দাওয়াতে যাবে পানাহারের পর মেজবানের সম্পদ বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যের উন্নতির মাগফিরাত ও রহমতের জন্য দোআ করবে। হযরত আবুল হাইসুম বিন তাইহান (রাঃ) রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীগণকে দাওয়াত দিলেন। তারা যখন খাবার শেষ করলো তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, “তোমাদের ভাইকে প্রতিদান দাও। সাহাবাগণ আরজ করলেন কি প্রতিদান দেবো, ইয়া রাসূলাল্লাহ? মানুষ যখন তার ভাইয়ের বাড়ী যায় এবং খাওয়া দাওয়া করে তখন তার জন্য ধন-সম্পদে প্রাচুর্যের দোআ করবে। এটাই হলো তার প্রতিদান”।
(আবু দাউদ)
রাসূল (সাঃ) একবার সায়াদ বিন ওবাদাহ (রাঃ)-এর বাড়ী গেলেন, হযরত সায়াদ (রাঃ) রুটি ও জলপাই পেশ করলেন, তিনি তা খেয়ে এ দোয়া করলেনঃ
আরবি
“তোমাদের নিকট রোযাদারগণ ইফতার করুক! সৎলোকেরা তোমাদের খাদ্য খাক! আর ফিরিশতাগণ তোমাদের জন্য মাগফিরাত ও রহমতের দোআ করুক”!
মজলিসের আদবসমূহ
১. মজলিসের আলোচনায় অংশ গ্রহণ করবে।
২. মজলিসে আলোচনায় অংশ গ্রহণ না করা এবং মাথা নিচু করে বসে থাকা, অহংকারের চিহ্ন। মজলিসে সাহাবায়ে কেরাম যে আলোচনা করতেন রাসূল (সাঃ) ও সে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করতেন। মজলিসে চিন্তান্বিত ও মনমরা হয়ে বসে থাকবে না। অত্যন্ত আনন্দ ফুর্তির সাথে বসবে।
৩. তোমার কোন মজলিসে যেন আল্লাহ ও পরকালের আলোচনা থেকে দূরে না থাকে সে চেষ্টা করবে। তুমি যখন অনুভব করবে যে, উপস্থিত ব্যক্তিগণ দীনি আলোচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করছে না তখন আলোচনার ধারা কোন পার্থিব বিষয়ের দিকে ঘুরিয়ে দেবে অতঃপর যখন উপযুক্ত সুযোগ পাবে তখন অত্যন্ত বিজ্ঞতার সাথে আলোচনার দারা দীনি বিষয়ের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে।
৪. মজলিসে যেখানে স্থান পাওয়া যায় সেখানেই সবে পড়বে। সমবেত জনতাকে ছিন্ন করে লম্ফ ঝম্ফ দিয়ে আগে যাবার চেষ্টা করবে না। এরূপ করলে আগে আসা এবং বসা লোকদেরও কষ্ট হয়। এরূপ ব্যক্তিদের অন্তরেও নিজের অহংকার ও গৌরব সৃষ্টি হয়।
৫. মজলিসে বসা ব্যক্তিদের কাউকে উঠিয়ে দিয়ে তার স্থানে নিজে বসার চেষ্টা করবে না, ইহা একটি বদঅভ্যাস। এর দ্বারা অন্যদের মনে ঘৃণা ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয় আর নিজেকে বড় মনে করা এবং গুরুত্ব দেয়া বুঝায়।
৬. মজলিসে যদি লোকেরা গোল হয়ে বসে তা হলে তাদের মধ্যখানে বসবে না। এটাও একটা বেয়াদবী। রাসূল (সাঃ) এমন ব্যক্তির উপর অভিশম্পাত করেছেন।
৭. মজলিসে বসা ব্যক্তিদের কেউ যদি কোন প্রয়োজনে উঠে চলে যায় তা হলে তার স্থান দখল করে নেবে না। বরং তার স্থান সংরক্ষিত রাখবে। হ্যাঁ, একথা যদি জানা যায় যে, ঐ ব্যক্তি এখন আর ফিরে আসবে না তা হলে বসা যায়।
৮. মজলিসে যদি দু’ব্যক্তি একত্রে বসে থাকে। তাহলে তাদের অনুমতি ব্যতীত তাদেরকে পৃথক করবে না, পরস্পরের বন্ধুত্ব অথবা অন্য কোন যুক্তিযুক্ত কারণে হয়তো তারা একত্রে বসেছে। এমতাবস্থায় তাদেরকে পৃথক পৃথক করে দিলে তাদের মনে দুঃখ হবে।
৯. মজলিসে কোন স্বতন্ত্র সম্মানিত স্থানে বসা থেকে বিরত থাকবে। কারো কাছে গেলে তার সম্মানিত স্থানে বসার চেষ্টা করবে না! তবে সে যদি বার বার অনুরোধ করে তা হলে বসতে কোন দোষ নেই। মজলিসে সর্বদা আদবের সাথে বসবে এবং পা লম্বা করে অথবা পায়ের গোছা খুলে বসবে না।
১০. সর্ববস্থায় সভাপতির নিকটে বসার চেষ্টা করবে না বরং যেখানে স্থান পাওয়া যায় সেখানেই বসে পড়বে আর এমনভাবে বসবে যে, পরে আসা ব্যক্তিদের স্থান পেতে এবং বসতে যেন কোন কষ্ট না হয়। মানুষ যখন বেশী এসে যায় তখন সংকুচিত হয়ে বসবে এবং আগন্তুকদেরকে খুশী মনে স্থান দিয়ে দিবে।
১১. মজলিসে দু’ব্যক্তি পরস্পর চুপে চুপে কথা বলবে না। এ দ্বারা অন্যেরা মনে করতে পারে যে, তারা আমাদেরকে তাদের গোপন কথা শোনার উপযুক্ত মনে করে নি। আর এ কুধারণাও হয় যে, সম্ভবতঃ আমাদের সম্পর্কেই কোন কথা বলছে।
১২. মজলিসে কোন কথা বলতে হলে মজলিসের সভাপতির অনুমতি নিতে হবে, আর আলোচনা অথবা সওয়াল জবাবে এমন ভাবে দেখাবে না যে, আপনাকেই মজলিসের সভাপতি মনে হয়।
১৩. এক সময় এক ব্যক্তিরই কথা বলা উচিৎ আর প্রত্যেক ব্যক্তির কথা মনোযোগের সাথে শোনা উচিত। নিজের কথা বলার জন্যে এরূপ অস্থির হওয়অ উচিৎ নয় যে সব কথা এক সময়েই বলা আরম্ভ করবে এবং মজলিসে হৈ চৈ আরম্ভ করবে।
১৪. মজলিসের গোপনীয় কথা সকল স্থানে বলা উচিৎ নয়। মজলিসের গোন কথাসমূহের হেফাজত করা উচিত।
১৫. মজলিসে যে বিষয় আলোচনা চলছে, সে বিষয়ে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে অন্য বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করবে না, এবং অন্যের কথার মাঝখানে নিজের কথা আরম্ভ করবে না। কখনো যদি এমন কোন প্রয়োজন এসে পড়ে যে, এখনই বলা জরুরী তা হলে কথা বলা ব্যক্তির থেকে অনুমতি নিয়ে নেবে। মজলিসের সভাপতিকে কোন বিষয়ে আলোচনা করতে হলে সকল লোকের দিকে দৃষ্টি ও মনোযোগ রাখা উচিৎ। ডানে বামে প্রত্যেক দিকে মুখ ফিরিয়ে কথা বলা উচিৎ এবং সকলকে স্বাধীন ভাবে মনোভাব প্রকাশের সুযোগ দেয়া উচিৎ।
১৬. মজলিসে মুলতবী হওয়ার পূর্বে এ দোআ পাঠ করবে।
আরবি
“আয় আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে তোমার এমন ভয়-ভীতি ও আতঙ্ক নসীব কর যা আমাদের ও তোমার অবাধ্যতার মধ্যে বিরাট বাধা হয়ে যায়, আর এমন আনুগত্য দান কর যা আমাদেরকে তোমার বেহেশতে পৌঁছিয়ে দেয়, আর আমাদেরকে এমন মজবুত বিশ্বাস দান কর যার ফলে পার্থিব ক্ষয়ক্ষতি মূল্যহীন মনে হয়। আয় আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে যতদিন জীবিত রাখো, আমাদের এবং শারীরিক শক্তি ও সামর্থ দ্বারা উপকার গ্রহণের সুযোগ দাও আর ইহাকে আমাদের পরেও স্থায়ী রাখো, আর যে ব্যক্তি আমাদের উপর অত্যাচার করে তার প্রতিশোধ গ্রহণ কর, আর যে আমাদের দীনের পরীক্ষায় জড়িত করো না! দুনিয়াকে আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য করো না! আর আমাদের উপর এমন ব্যক্তিকে ক্ষমতা দিও না যে আমাদের প্রতি রহম প্রদর্শন করবে না।
সালামের নিয়ম-কানুন
১. কোন মুসলমান ভাইয়ের সাথে যখন সাক্ষাৎ হবে তখন নিজের সম্পর্ক ও সৌহার্দ প্রকাশের জন্য “আসসালামু আলাইকুম” বলবে।
পবিত্র কোরআনে আছেঃ
আরবি
“হে নবী, আমাদের আয়াতের উপর ঈমান রাখে এমন লোকেরা যখন আসে তখন আপনি তাদেরকে “সালামুন আলাইকুম” বলুন”।
(সূরায়ে আন-আনআম)
এ আয়াতে রাসূল (সাঃ) সম্বোধন করে উম্মতকে এ মৌলিক শিক্ষা দান করা হয়েছে যে, এক মুসলমানের সাথে যখন পরস্পর সাক্ষাৎ করবে তখন উভয়েই বন্ধুত্ব ও আনন্দ আবেগ প্রকাশ করবে এবং পরস্পর একে অন্যের জন্য শান্তি ও সুস্বাস্থ্যের জন্য দোআ করবে। একজন “আসসালামু আলাইকুম” বলবে তখন অপর ব্যক্তি তার উত্তরে “ওয়া আলাইকুমুস সালাম” বলবে। সালাম পরস্পরিক স্নেহ-মমতা বন্ধুত্ব বৃদ্ধি ও (দৃঢ়) মজবুত করার উপকরণ।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
তোমরা বেহেশতে যেতে পারবেনা যে পর্যন্ত তোমরা মুসলমান না হও। আর তোমরা মুসলমান হতে পারবে না যতদিন পর্যন্ত তোমরা অন্য মুসলমানকে ভাল না বাস। আমি তোমাদেরকে সে পদ্ধতি কেন শিক্ষা দেব না, যা অবলম্বন করে তোমরা একে অন্যকে ভালবাস, তাহলো পরস্পর সালাম পৌঁছে দেবে।
(মেশকাত)
২.সর্বদা ইসলামী নিয়মে সালাম করবে। পরস্পর কথোপকথনের কারণে বা চিঠিপত্র লিখনে সর্বদা কুরআন ও হাদীসের শব্দগুলোই ব্যবহার করবে। ইসলামী পদ্ধতি ছেড়ে দিয়ে সমাজের প্রবর্তিত শব্দ ও পদ্ধতি গ্রহণ করবে না। ইসলামের শিক্ষা দেওয়া এই সম্বোধন পদ্ধতি অত্যন্ত সরল, অর্থবোধক ও পূর্ণ ক্রিয়াশীল ও শান্তি ও সুস্বাস্থ্যের জন্য পরিপূর্ণ।
তুমি যখন নিজের ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের সময় “আসসালামু আলাইকুম” বল, তখন তার অর্থ হলো আল্লাহ আপনার প্রাণ ও সম্পদ নিরাপদ করুন! ঘর সংসার নিরাপদ রাখুন! পরিবার-পরিজনকে শান্তি দান করুন! দীন ও ঈমান এবং পরকালেও নিরাপদ রাখুন। আল্লাহ আপনাকে সেই সকল শান্তি ও নিরাপত্তা দান করুন যা আমার জানা নেই। আপনি আমার পক্ষ থেকে কোন ভয়-ভীতির আশঙ্কা করবেন না। আমার কার্যক্রম দ্বারা অবশ্যই আপনার কোন দুঃখ হবে না। ‘সালাম’ শব্দের আগে ‘আলিফ ও লাম’ এনে আসসালামু আলাইকুম” বলে আপনি সম্বোধিত ব্যক্তির শান্তি ও সুস্বাস্থ্যের জন্যে দোআ করে নিন।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“আস সালাম” আল্লাহ তাআলার নামসমূহের মধ্য থেকে একটি নাম যাকে আল্লাহ দুনিয়াবাসীদের জন্য রেখে দিয়েছেন। সুতরাং ‘আসসালাম’ কে জড়িয়ে দাও।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ) বলেছেন য রাসূল (সাঃ) বলেছেন আল্লাহ তাআলা যখন হযরত আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করলেন তখন তাকে ফিরিশতাদেরকে সালাম করো। আর সালামের জবাবে তারা যে দোআ করবে তা শুনবে আর তা মুখস্তও করবে, কেননা ইহাই তোমার ও তোমাদের সন্তান-সন্ততির দোআ হবে। সুতরাং হযরত আদম (আঃ) ফিরিশতাদের নিকট পৌঁছে “আসসালামু আলাইকুম” বললেন এবং ফিরিশতাগণ তার উত্তরে বললেন, “আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ” অর্থাৎ ওয়া রাহমাতুল্লাহ বেশী বলে উত্তর দিলেন।
(বুখারী, মুসলিম)
পবিত্র কুরআনে আছে যে, ফিরিশতাগণ যখন মুমিনের রূহ কবয করতে আসে তখন “সালামুন আলাইকা” বলেন।
আরবি
“আল্লাহ তাআলা পুণ্যবানদেরকে (মুত্তাকীগণকে) এরূপ পুরষ্কার দেন যাদের রূহ পবিত্রবস্থায় ফিরিশতাগণ কবজ করেন, তারা বলবে, “সালামুন আলাইকুম” (তোমাদের উপর শান্তি) তোমরা যে নেক আমল করতে তার বিনিময়ে বেহেশতে প্রবেশ কর।
(আননাহল ৩১-৩২)
এ মুত্তাকী লোকেরা বেহেশতের দরজায় যখন পৌঁছব তখন জান্নাতের দায়িত্বে নিয়োজিত ফিরিশতাগণ তাদেরকে জাঁকজমকপূর্ণ অভ্যর্থনা জানাবেন।
আরবি
“আর যারা পবিত্রতা ও আল্লাহ ভীতির উপর জীবন যাপন করে তাদের দলকে অবশ্যই বেহেশতের দিকে রওয়ানা করিয়ে দেয়া হবে। তারা জান্নাতের নিকটবর্তী হলে বেহেশতের দরজা খুলে দেয়া হবে এবং বেহেশতের দায়িত্বে নিয়োজিত ফিরিশতাগণ বলবেন, “সালামুন আলাইকুম” (তোমাদের উপর শান্তি) সুতরাং তোমরা অনন্ত কালের জন্য এখানে প্রবেশ কর”।
(সূরায়ে যুমার ৭৩)
এ সকল লোক যখন বেহেশতে প্রবেশ করবে তখন ফিরিশতাগণ বেহেশতের প্রতিটি দরজা দিয়ে প্রবেশ করে তাদেরকে বলবে, “আসসালামু আলাইকুম”।
আরবি
আর ফিরিশতাগণ তাদের জানানোর জন্য প্রত্যেক দরজা দিয়ে আসবেন আর তাদেরকে বলবেন, “সালামুন আলাইকুম”। আপনারা যে ধৈর্য্যধারণ করেছেন তার বিনিময়ে পুরষ্কার পরকালের ঘর কতই না সুন্দর।
বেহেশতবাসীগণ নিজেরাও একে অন্যকে এ শব্দগুলো দ্বারা অভিবাদন জানাবেন-
আরবি
তাদের মুখে এ দোআও হবে, “আয় আল্লাহ! আপনি মহা পবিত্র আর সেখানে অভিবাদন হবে সালাম”।
মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেও বেহেশতাবাসীদেরকে সালাম জানানো হবে।
আরবি
“জান্নাতবাসীগণ সেদিন আরাম ও আয়েশে মত্ত থাকবে। তারা ও তাদের বিবিগণ ছায়া ঘন সুসজ্জিত খাটে হেলান দিয়ে থাকবে। তাদের জন্য বেহেশতে সর্বপ্রকার ফল মূল এবং তারা যা চাইবে তাই পাবে। মহান দয়ালু প্রতিপালক আল্লাহর পক্ষ থেকে “সালাম” বলা হবে”।
(সূরায়ে ইয়াসীন ৫৫-৫৮)
মোটকথা এই যে, জান্নাতে মু’মিনদের জন্য চতুর্দিক থেকে শুধু সালামের ধ্বনি প্রত্ধ্বিনিত হবে।
আরবি
“তারা সেখানে অনর্থক বাজে কথা ও গুনাহের কথা শুনবেনা। চতুর্দ্দিক থেকে শুধু ‘সালাম’ হবে”।
(ওয়াকেআহঃ ২৫-২৬)
পবিত্র কুরআন ও হাদীসের এ সকল উজ্জ্বল হেদায়েত ও সাক্ষ্য থাকার পরও মুমিনের পক্ষে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত পদ্ধতি ছেড়ে বন্ধুত্ব ও আনন্দ প্রকাশের জন্য অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করা জায়েয নয়।
৩. প্রত্যেক মুসলমানকে সালাম করবে তার সাথে পূর্ব থেকে পরিচয় ও সম্বন্ধ থাকুক বা না থাকুক। সম্পর্ক ও পরিচিতির জন্য এতটুকু কথাই যথেষ্ট যে সে আপনার মুসলমান ভাই আর মুসলমানের জন্য মুসলমানের অন্তরে বন্ধুত্ব একাগ্রতা এবং বিশ্বস্ততার আবেগ থাকাই উচিৎ।
এক ব্যক্তি রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করলো, ইসলামের মধ্যে উত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেন, “গরীবদেরকে আহার করানো, প্রত্যেক মুসলমানকে সালাম করা, তার সাথে জানা শোনা থাকুক বা না থাকুক”।
(বুখারী মুসলিম)
৪. আপনি যখন আপনার ঘরে প্রবেশ করবেন তখন পরিবারস্থ লোকদেরকে সালাম করবেন।
পবিত্র কোরআনে আছে-
আরবি
তোমরা যখন তোমাদের ঘরে প্রবেশ করবে তখন প্রথমে ঘরের লোকদের সালাম করবে। কেননা ইহা তোমার ও তোমাদের পরিবারস্ত লোকদের জন্য শুভ ফল ও প্রাচুর্যের উপায়”।
(তিরমিযি)
অনুরূপ তুমি অন্যের ঘরে প্রবেশ করার পূর্বে সালাম করবে, সালাম করা ব্যতীত ঘরের ভেতর যাবে না।
আরবি
“হে মুমিনগণ! তোমাদের ঘর ব্যতীত অন্যের ঘরে তাদের অধিবাসীদের অনুমতি ছাড়া এবং সালাম করা ব্যতীত প্রবেশ করবে না।
(সূরা আন নূরঃ২৭)
হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর নিকট ফিরিশতাগণ যখন সম্মানিত মেহমান হিসেবে আসলেন তকন তাঁরা এসে সালাম করলেন আর ইব্রাহীম (আঃ) সালামের জবাবে তাদেরকে সালাম করলেন।
৫. ছোট শিশুদেরকেও সালাম করবে। শিশুদেরকে সালাম শিক্ষা দেয়ার উত্তম তরীকাও রাসূল (সাঃ)-এর সুন্নাত। হযরত আনাস (রাঃ) শিশুদের নিকট দিয়ে যাবার সময় সালাম করলেন এবং বললেন, রাসূল (সাঃ) এরূপই করতেন।
(বুখারী মুসলিম)
হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) চিঠিতেও শিশুদেরকে সালাম দিতেন।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
৬. মহিলারা পুরুষদেরকে সালাম করতে পারে, আর পুরুষ ও মহিলাদেরকেও সালাম করতে পারে। হযরত আসমা আনসারীয়া (রাঃ) বলেছেন যে, আমি আমার সাথীদের সাথে বসা ছিলাম, রাসূল (সাঃ) আমাদের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং এমতাবস্থায় তিনি আমাদেরকে সালাম করলেন।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
হযরত উম্মে হানী (রাঃ) বলেছেন যে, আমি রাসূল (সাঃ)-এর দরাবারে হাযির হলাম, তিনি ঐ সময় গোসল করছিলেন। আমি তাঁকে সালাম করলাম,তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে? আমি বললাম, উম্মেহানী! তিনি বললেন, শুভাগমন!
৭. বেশী বেশী সালাম করার অভ্যাস গড়ে তুলবে এবং সালাম করার ব্যাপারে কখনো কৃপণতা করবে না। পরস্পর বেশী বেশী সালাম করবে। কেননা সালাম করার দ্বারা বন্ধুত্ব বৃদ্ধি পায়। আর আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রকার বিপদাপদ থেকে রক্ষা করেন।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
আমি তোমাদেরকে এমন এক পদ্ধতি শিক্ষা দিচ্ছি যা অবলম্বন করলে তোমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও ভালবাসা মজবুত হবে, পরস্পর একে অন্যকে সালাম কর।
(মুসলিম)
রাসূল (সাঃ) আরো বলেছেন যে, “সালামকে খুব বিস্তৃত কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে শান্তিতে রাখবেন”।
হযরত আনাস (রাঃ) বলেছেন যে, রাসূল (সাঃ)-এর সাহাবীগণ অনেক বেশী সালাম করতেন। অবস্থা এরূপ ছিল যে,তাঁদের কোন সাথী যদি গাছের আড়াল হয়ে যেতেন অতঃপর আবার সামনে আসলে তাঁকে সালাম করতেন।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করে সে যেন তাকে অবশ্যই সালাম করে। আর যদি গাছ অথবা দেয়াল অথবা পাথর আড়াল হয়ে যায় অতঃপর আবার তার সামনে আসে তাহলে তাকে আবার সালাম করতেন।
(রিয়াদুস সালহীন)
হযরত তোফাইল (রাঃ) বলেছেন যে, আমি অধিকাংশ সময় হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ)-এর খেদমতে হাযির হতাম এবং তার সাথে বাজারে যেতাম। অতঃপর আমরা উভয়ে যকন বাজারে যেতাম তকন হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) যার নিকট দিয়েই যেতেন তাকেই সালাম করতেন, চাই সে কোন ভাঙ্গা চুড়া কম দামী জিনিস বিক্রেতা হোক বা বড় দোকানদার হোক, সে গরীব ব্যক্তি হউক বা নিঃস্ব কাঙ্গাল ব্যক্তি হোক। আসল কথা যে কোন ব্যক্তিই হোক না কেন তাকে অবশ্যই সালাম করতেন।
একদিন আমি তাঁর খেদমতে হাযির হলে তিনি আমাকে বললেন, চল বাজারে যাই। আমি বললাম হযরত আপনি বাজারে গিয়ে কি করবেন? আপনি না কোন সদায় ক্রয় করার জন্য দাঁড়ান, না কোন জিনিস সম্পর্কে জিজ্ঞসাবাদ করেন, না দাম-দস্তুর করেন, না বাজারের কোন সমাবেশে বসেন, আসুন এখানে বসে কিছু কথা-বার্তা বলি। হযরত বললেন, হে পেটুক! আমি তো শুধু সালাম করার উদ্দেশ্যেই বাজারে যাই, যার সাথেই আমাদের সাক্ষাৎ হবে তাকেই সালাম করব।
(মুয়াত্তা ইমাম মালেক)
৮. সালাম মুসলমান ভাইয়ের অধিকার মনে করবে আর সে অধিকার আদায় করা অন্তরের প্রশস্ততার প্রমাণ দেবে। সালাম দেয়ায় কখনো কৃপণতা করবে না।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন যে, মুসলমানের উপর এই অধিকার আছে যে, সে যখনই মুসলমান ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করবে তখনই তাকে সালাম করবে।
(মুসলিম)
হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ) বলেছেন যে সব চাইতে বড় কৃপণ হলো সে, যে সালাম করতে কার্পণ্য করে।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
৯. সর্বদা আগে সালাম করবে, সালামে অগ্রগামী হবে। আল্লাহ না করুন! কারো সাথে কোন সময় যদি মনের অমিল হয়ে যায় এজন্য সালাম করা ও আপোষ মীমাংসায় অগ্রগামী হবে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“সে ব্যক্তি আল্লাহর নিকটবর্তী যে আগে সালাম করে”।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ কোন মুসলমানের জন্য এটা জায়েয নয় যে, সে তার মুসলমান ভাইয়ের সাথে তিন দিনের বেশী সম্পর্ক ছিন্ন করে থাকবে উভয়ের যখন সাক্ষাৎ হয় তখন একজন একদিকে যাবে আর অন্যজন আরেক দিকে, এদের মধ্যে সেই ব্যক্তি শ্রেষ্টতম যে সালাম করায় অগ্রগামী হয়।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) সালাম করার এত গুরুত্ব প্রদান করতেন যে, কোন ব্যক্তিই তাকে আগে সালাম দিতে পারতো না।
১০. মুখে “আসসালামু আলাইকুম” বলে আর একটু উচ্চস্বরে সালাম করবে যেন যাকে সালাম করছ সে শুনতে পায়। অবশ্য কোথায়ও যদি মুখে “আসসালামু আলাইকুম” বলার সাথে সাথে হাত অথবা মাথায় ইশারা করার প্রয়োজন হয় তবে তাতে কোন ক্ষতি নেই। তুমি যাকে সালাম করছ সে তোমার দূরে অবস্থিত, ধারণা করছ যে, তোমার আওয়ায সে পর্যন্ত পৌঁচবে না অথবা কোন বধির যে তোমার আওয়ায শুনতে অক্ষম এমতাবস্থায় ইশারা করবে।
হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বলেছেন যে, কাউকে যখন সালাম কর তখন তোমরা সালাম তাকে শোনাও। সালাম আল্লাহর পক্ষ থেকে অত্যন্ত পবিত্র ও বরকতময় দোআ।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
হযরত আসমা বিনতে ইয়াযীদ (রাঃ) বলেছেন যে, একদিন রাসূল (সাঃ) মসজিদে নববীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং সেখানে কিছু মহিলা বসা ছিল তিনি তাদেরকে হাতের ইশারায় সালাম করলেন।
(তিরমিযি)
১১. কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে কারো বৈঠকে অথবা বসার স্থানে পৌঁছলে অথবা কোন সমাবেশের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অথবা কোন মজলিসে পৌঁছলে পৌঁছার সময়ও সালাম করবে এবং সেখান থেকে যখন ফিরে আসবে তখনও সালাম করবে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“তোমরা যখন কোন মজলিসে পৌঁছ তখন সালাম কর আর যখন সেখান থেকে বিদায় নেবে তখনও সালাম করবে।
আর স্মরণ রেখো যে, প্রথম সালাম দ্বিতীয় সালাম থেকে বেশী সওয়াবের অধিকারী। (যাবার সময় সালামের বেশী গুরুত্ব দেবে আর বিদায় হবার সময় সালাম করবে না এবং বিদায় বেলার সালামের কোন গুরুত্বই দেবে না।)
(তিরমিযি)
১২. মজলিসে গেলে পূর্ণ মজলিসকে সালাম করবে বিশেষভাবে কারো নাম নিয়ে সালাম করবে না। একদিন হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) মসজিদে ছিলেন, এক ভিক্ষুক এসে তার নাম ধরে সালাম করলো। তিনি বললেন, আল্লাহ সত্য বলেছেন, “রাসূল (সাঃ) প্রচরের হক আদায় করে দিয়েছেন” অতঃপর তিনি ঘরে চলে গেলেন। লোকেরা তার একথা বলার উদ্দেশ্য কি তা জানার জন্য অপেক্ষায় বসে রইল। তিনি যখন আসলেন তখন হযরত তারেক (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, জনাব আমরা আপনার কথার উদ্দেশ্য বুঝতে পারিনি তখন তিনি বললেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “কিয়ামতের নিকটবর্ত্তী সময়ে লোকেরা মজলিসে লোকদেরকে বিশেষভাবে সালাম করা আরম্ভ করবে”।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
১৩.কোন সম্মানিত অথবা প্রিয় বন্ধুকে অন্য কোন ব্যক্তির দ্বারা সালাম করার সুযোগ হলে অথবা কারো চিঠিতে সালাম লিখার সুবিধা হলে এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে এবং সালাম পাঠাবে।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন যে, রাসূল (সাঃ) আমাকে বলেছেনঃ আয়েশা, জিবরীল (আঃ) তোমাকে সালাম করেছেন, আমি বললাম, “ওয়া আলইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু”।
(বুখারী, মুসলিম)
১৪. তুমি যদি এমন কোন স্থানে গিয়ে পৌঁছো যেখানে কিছু লোক ঘুমিয়ে আছে তা হলে এমন আওয়াযে সালাম করবে যে, লোকেরা শুনবে এবং নিদ্রিত লোকদের ঘুমের ব্যাঘাত হবে না। হযরত মেদাদা (রাঃ) বলেন, যে, আমরা রাসূল (সাঃ) এর জন্য কিছু দুধ রেখে দিতাম তিনি যখন রাতের কিছু অংশ অতিবাহিত হওয়ার পর আসতেন তখন তিনি এমনভাবে সালাম করতেন যে, নিদ্রিত ব্যক্তিরা যেন না জাগে এবং জাগ্রত ব্যক্তিরা যেন শুনে। অতঃপর রাসূল (সাঃ) আসলেন এবং পূর্বের নিয়মানুযায়ী সালাম করলেন।
(মুসলিম)
১৫. সালামের জবাব অত্যন্ত সন্তুষ্ট চিত্তে ও হাসিমুখে দেবে কেননা এটা মুসলমান ভাইয়ের অধিকার, এ অধিকার আদায় করায় কখনো কার্পণ্য দেখাবে না।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
মুসলমানের উপর মুসলমানের পাঁচটি অধিকার রয়েছে-
- সালামের জবাব দেয়া
- অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া
- কফিনের সাথে যাওয়া
- দাওয়াত কবুল করা এবং হাঁচির জবাব দেওয়া।
রাসূল (সাঃ) রাস্তায় বসতে নিষেধ করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের তো রাস্তায় বসা ছাড়া উপায় নেই! তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, তোমাদের বসা যদি খুব জরুরী হয় তাহলে বসো, তবে রাস্তার হক অবশ্যই আদায় করবে। লোকেরা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ), রাস্তার আবার হক কি? তিনি বললেন, দুষ্টি নিচে রাখা, কাউকে দুঃখ না দেয়া, সালামের জবাব দেয়া, ভাল কাজ শিক্ষা দেয়া আর খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে।
(মুত্তাফিকুন আলাইহে)
১৬. সালামের জবাবে “ওয়াআলাইকুমুস সালাম” কেই যথেষ্ট মনে করবে না বরং “ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু” এ শব্দগুলোও বৃদ্ধি করবে।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-
আরবি
“আর যখন তোমাদের কেউ শুভেচ্ছা জানায় তখন তোমরা তার থেকে উত্তম শুভেচ্ছা জানাবে অথবা তারই পুনরাবৃত্তি করবে”।
অর্থাৎ সালামের জবাবে কার্পণ্য করো না। সালামের শব্দে কিছু বৃদ্ধি করে তার থেকে উত্তম দোআ করো অথবা ঐ শব্দগুলোর পুনরাকৃত্তি করো।
হযরত ইমরান বিন হুছাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সাঃ) তাশরীফ রাখলেন। এ সময় এক ব্যক্তি এসে “আসসালামু আলাইকুম বলল, তিনি সালামের জবাব দিলেন এবং বললেন দশ নেকী পেলো। আবার এক ব্যক্তি এসে “আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ বলল, তিনি সালামের জবাব দিলেন এবং বললেন, বিশ নেকী পেলো। তারপর তৃতীয় এক ব্যক্তি এসে “আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু” বলল। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, ত্রিশ নেকী পেলো।
(তিরমিযি)
হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেনঃ একবার আমি হযরত আবু বকর (রাঃ) এর পেছনে সোয়ারীর উপর বসা ছিলাম। আমরা যাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম আবু বকর (রাঃ) তাদেরকে বলেন, “আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ” তখন লোকেরা জবাব দিল ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমামুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু? এরপর আবু বকর (রাঃ) বললেন, আজ তো লোকের ফজীলতে আমাদের চেয়ে এগিয়ে গেল।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
১৭. কারে সাথে যখন সাক্ষাত হবে তখন আগে “আসসালামু আলইকুম” বলবে, হঠাৎ আলোচনা আরম্ভ করবে না যে আলোচনাই করতে হয়, সালামের পর করবে।
১৮. যে অবস্থায় সালাম দেয়া নিষেধ।
(ক) যখন লোকেরা কোরআন ও হাদীস পড়তে-পড়াতে অথবা শুনতে ব্যস্ত থাকে।
(খ) যখন কেউ আযান অথবা তাকবীর বলতে থাকে।
(গ) যখন কোন মজলিসে কোন দীনি বিষয়ের ওপর আলোচনা চলতে থাকে অথবা কেউ কাউকে কোন দীনি আহকাম বুঝাতে থাকে।
(ঘ) যকন শিক্ষক পড়াতে ব্যস্ত থাকেন।
যে অবস্থায় সালাম দেয়া যাবে না।
(চ) যখন কোন ব্যক্তি পাপাচার এবং শরীয়ত বিরোধী খেল তামাসা ও আনন্দ-ফূর্তিতে লিপ্ত থেকে দীনের অবজ্ঞা করতে থাকে।
(ছ) যখন কেউ গাল-মন্দ, অনর্থক ঠকবাজি, সত্য-মিথ্যা খারাপ কথা ও অশ্লীল ঠাট্টা-কৌতুক করে দীনের বদনাম করতে থাকে।
(জ) যকন কেউ দীন ও শরীয়ত বিরোধী চিন্তাধারা ও দর্শনের প্রচার করতে থাকে এবং লোকদেরকে দ্বীন থেকে বিদ্রোহী এবং বেদআত ও বেদ অবলম্বন করার জন্য উত্তেজিত করতে থাকে।
(ঝ) যখন কেউ দীনি আকীদা বিশ্বাস এবং নিদর্শনের সম্মান না করে, শরীয়তের মূলনীতি ও বিধি-বিধানের বিদ্রুপ করে এবং নিজের অভ্যন্তরীণ ভ্রষ্টতা ও দ্বিমুখী নীতির প্রমাণ দিতে থাকে।
১৯. ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে সালাম করায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে না। পবিত্র কুরআন সাক্ষী, ইহুদীগণ নিজেদেরকে বেদীন,সত্যের শত্রুতা, অত্যাচার, মিথ্যাবাদিতা ও ধোকাবাজি এবং প্রবৃত্তির দুশ্চরিত্রে নিকৃষ্টতম জাতি। তাদেরকে অসংখ্য পুরস্কার বর্ষণ করেছেন কিন্তু তারা সর্বদা অকৃতজ্ঞতা, কুকর্মের প্রমাণ দিয়েছে। এরা সেই জাতি যারা আল্লাহর প্রেরিত সম্মানিত, নবীগণকেও হত্যা করেছে। এ কাণে মুমিনদেরকে ঐ আচরণ থেকে বিরত থাকা উচিত যার মধ্যে ইহুদীদের সম্মান ও মর্যাদার সম্ভাবনা আছে। বরং তাদের সাথে এরূপ আচরণ করা উচিৎ যাতে তারা বার বার এ কথা অনুভব করতে পারে যে, সত্যের নিকৃষ্টতম বিরোধিতার প্রতিফল সর্বদা হীনতাই হয়ে থাকে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে আগে সালাম দেবে না, বরং রাস্তায় যখন তোমাদের সাথে তাদের সাক্ষাত হয় তখন তাদেরকে রাস্তার এক পাশে সংকুচিত হয়ে যেতে বাধ্য কর।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
অর্থাৎ এরূপ গাম্ভীর্য ও জাঁকজমকের সাথে চল যে, তারা নিজেরা রাস্তায় একদিকে সংকুচিত হয়ে তোমাদের জন্য রাস্তা ছেড়ে দেয়।
২০. তবে কোন মজলিসে যখন মুসলমান ও মুশরিক উভয় একত্রিত হয় তখন সেখানে সালাম করবে, রাসূল (সাঃ) একবার এরূপ মজলিসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন যার মধ্যে মুসলমান ও মুশরিক উপস্থিত ছিল তকন তিনি তাদেরকে সালাম করেছেন।
২১. কোন অমুসলিমকে যদি সালাম করা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে তখন “আসসালামু আলাইকুম” না বলে বরং আদাব আরয, তাসলীমাত ইত্যাদি প্রকারের শব্দ ব্যবহার করবে। আর হাত ও মাথা দ্বারাও এরূপ কোন ইশারাও করবে না যা ইসলামী আকীদাহ ও ইসলামী স্বভাব বিরোধী হয়।
রাসূল (সাঃ) রুমের বাদশাহ হিরাক্লিয়াসের নিকট যে চিঠি লিখেছিলেন তার ভাষা ছিল এমনআরবি
অর্থাৎ যে হেদায়েতের অনুসরণ করে তার উপর সালাম।
২২. সালামের পর বন্ধুত্ব ও আনন্দ প্রকাশার্থে মুসাফাহাও করবে। রাসূল (সাঃ) নিজেও তা করতেন এবং তাঁর সাহাবীগণও পারস্পরিক সাক্ষাতে মুসাফাহা করতেন। তিনি সাহাবীগণকে মুসাফাহ করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং তার মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব সম্পর্কে বিভিন্নভাবে আলোকপাত করেছেন।
হযরত কাতাদাহ (রাঃ) হযরত আনাস (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কি মুসাফাহার প্রচলন ছিল? হযরত আনাসে (রাঃ) জবাব দিলেন জ্বী, হ্যাঁ ছিল।
হযরত সালামাহ বিন দাবদান (রহ) বলেছেন যে, আমি হযরত মালেক বিন আনাস (রহ) কে দেখেছি যে, তিনি লোকদের সাথে মুসাফাহা করেছেন। আমাকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? আমি বললাম, বনী লাইসের গোলাম! তিনি আমার মাথায় তিনবার হাত ফিরালেন আর বলেন, আল্লাহ তোমাকে নেক ও প্রাচুর্য দান করুন।
একবার ইয়ামেনের কিছু লোক আসলো, রাসূল (সাঃ) সাহাবীগণকে বললেন, “তোমাদের নিকট ইয়ামেনের লোকেরা এসেছে আর আগত ব্যক্তিদের মধ্যে এরা মুসাফাহার বেশী হকদার।
(আবু দাউদ)
হযরত হুযাইফাহ বিন ইয়ামনে (রাঃ) বলেছেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, দু’জন মুসলমান যখন সাক্ষাৎ করে এবং সালামের পর মুসাফাহা করার জন্য পরস্পরের হাত নিজের হাতের মধ্যে নেয় তখন উভয়ের গুনাহ এমন ঝরে যায় যেমন গাছ থেকে শুকনা পাতা ঝরে পড়ে।
(তিবরানী)
হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) বলেছেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ পরিপূর্ণ সালাম এই যে মুসাপফাহার জন্য হাতও মিলাবে।
২৫. বন্ধু প্রিয়জন অথবা মহান কোন ব্যক্তি সফর থেকে ফিরলে মুআনাকা করবে।হযরত যায়েদ বিন হারেসা (রাঃ) যখন মদীনায় এসে রাসূল (সাঃ)-এর নিকট পৌঁছে দরজা খটখট করলেন, তখন তিনি তার চাদর টানতে টানতে দরজা খুলে তার সাথে মুআনাকাহ করলেন এবং কপালে চুমু দিলেন।
(তিরমিযি)
হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) যখন পরস্পর সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি মুসাফাহা করতেন আর কেউ সফর থেকে প্রত্যাবর্তন করলে মুআনাকাহ করতেন।
(তিবরানী)
রুগ্ন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাতের নিয়ম
১. রোগী দেখাশুনা করবে। রোগী দেখাশুনার মর্যাদা শুধু এতটুকুই নয় যে সামাজিক জীবনের একটা আবশ্যকীয় বিষয় অথবা পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহানুভূতিশীলতার আবেগকে গর্বিত করার একটি উপায় বরং এটা এক মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের দীনি অধিকার এবং আল্লাহর সাথে বন্ধুত্বের একটি অপরিহার্য দাবী, আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তি কখনো, আল্লাহর বান্দাহদের সাথে সম্পর্কহীন হতে পারে না। রোগীর সমবেদনা, সহানুভূতি ও সহযোগিতা থেকে অমনোযোগী হওয়া মূলতঃ আল্লাহ থেকে অমনোযোগী হওয়া।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন কিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে পরিচর্যা করনি? বান্দাহ বলবে, প্রতিপালক! আপনি তো সমস্ত সৃষ্টির প্রতিপালক, আমি কিভাবে আপনার পরিচর্যা করতাম? আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দাহ অসুস্থ হয়েছিল তুমি তার পরিচর্যা করনি, তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে তাহলে আমাকে সেখানে পেতে! অর্থাৎ তুমি আমার সন্তুষ্টির হকদার হতে পারতে।
(মুসলিম)
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
এক মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের ছয়টি অধিকার। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সেগুলো কি? তিনি বললেনঃ
- তোমরা যখন অন্য মুসলমান ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করবে তখন তাকে সালাম করবে।
- তোমাকে দাওয়াত করলে তার দাওয়াত গ্রহণ কর।
- যখন তোমার নিকট কেউ সৎ পরামর্শ চায় তখন তার শুভ কামনা কর এবং সৎ পরামর্শ দাও।
- যখন হাঁচি আসে এবং সে “আলহামদুলিল্লাহ” বলে তখন তুমি জবাবে “ইয়ারহামুকাল্লাহ” বল।
- যখন কোন ব্যক্তি রুগ্ন হয়ে পড়ে তখন তার পরিচর্যা করো, যখন মৃত্যুবরণ করে তখন কফিনের সাথে যাও।
(মুসলিম)
হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ যখন কোন বান্দাহ তার কোন মুসলমান রুগ্ন ভাইকে দেখতে যায় অথবা তার সাথে সাক্ষাত করার জন্য যায় তখন একজন ফেরেস্তা আকাশ থেকে চীৎকার করে বলেন, তুমি ভাল থাক, তুমি বেহেশতে তোমার ঠিকানা করে নিয়েছো।
(তিরমিযি)
২. রোগীর শিয়রে বসে তার মাথা অথবা শরীরে হাত বুলাবে এবং সান্ত্বনা ও সন্তোষের কথা বলবে, যেমন তার বোধশক্তি পরকালের পুরষ্কার ও সওয়াবের দিকে মনোযোগী হয়। আর অধৈর্য্য, অভিযোগ ও অসন্তোষের কোন কথা যেন তার মুখে না আসে।
হযরত আয়েশা বিনতে সাআদ (রাঃ) বলেন, আমার পিতা নিজের জীবনের ঘটনা শুনিয়েছেন এভাবে যে, “আমি একবার মদীনায় মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। রাসূল (সাঃ) আমাকে দেখার জন্য আসলেন। তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি যথেষ্ট সম্পদ রেখে যাচ্ছি আমার মাত্র একটি মেয়ে। আমি কি আমার সম্পদ অর্ধেক মেয়ের জন্য রেখে যাবো? তিনি বললেন, না। অতঃপর আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তা হলে এক তৃতীয়াংশ অছিয়ত করে যাবো? তিনি বললেন, হাঁ। এক তৃতীয়াংশের অছিয়ত করে যাও আর এক তৃতীয়াংশই অনেক”। তারপর রাসূল (সাঃ) তাঁর হাত আমার কপালে রাখলেন এবং আমারও পেটের উপর ফিরালেন আর দোয়া করলেন।
“আয় আল্লাহ! সাআদকে সুস্থতা দান কর এবং তার হিজরতকে পূর্ণতা দান কর”! এরপর থেকে আজ পর্যন্ত যখনই মনে পড়ে তখনই রাসূল (সাঃ) এর মুবারক হস্তের শিহরণ আমার মুখ কলিজার উপর অনুভব করি।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
হযরত যায়েদ বিন আরকান (রাঃ) বলেছেন যে, একবার আমার চোখ উঠলো। রাসূল (সাঃ) আমাকে এসে বললেন, যায়েদ! তোমার চোখে এতো কষ্ট! তুমি কি করছো? আমি আরয করলাম যে, ধৈর্য্য ও সহ্য করছি, তিনি বললেন, “তুমি চোখের এ কষ্টে ধৈর্য্য ও সহ্য অবলম্বন করছো এজন্য আল্লাহ তায়ালা তোমাকে এর বিনিময়ে বেহেশত দান করবেন”।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সাঃ) যখন কোন রোগী দেখতে যেতেন তখন তার মাথার কাছে বসে সাতবার বলতেন।
আরবি
আমি মহান আরশের মালিক মহান আল্লাহর নিকট তোমার আরোগ্যের জন্য শাফায়ত কামনা করছি।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “এ দোয়া সাতবার পাঠ করলে, তার মৃত্যু নির্দ্ধারিত না হয়ে থাকলে, সে অবশ্যই আরোগ্য লাভ করবে”।
(মেশকাত)
হযরত জাবের (রাঃ) বলেছেন যে, রাসূল (সাঃ) এক বৃদ্দা মহিলা উম্মুস সায়ের (রাঃ) কে রোগ শয্যায় দেখতে আসলেন। উম্মুস সায়ের তকন জ্বরের প্রচন্ডতায় কাঁপছিলেন, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কি অবস্থা? মহিলা বললেন, আল্লাহ এ জ্বর দিয়ে আমাকে ঘিরে রেখেছেন। এ কথা শুনে রাসূল (সাঃ) বললেন, আল্লাহ এ জ্বরকে বুঝুক। মন্দ-ভাল বলোনা। জ্বর গুনাহসমূহকে এভাবে পরিস্কার করে দেয় আগুনের চুল্লি লোহার মরিচাকে যেমন পরিস্কার করে দেয়”।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
৩. রোগীর নিকট গিয়ে তার রোগের প্রকৃত অবস্থা জিজ্ঞেস করবে এবং তার আরোগ্য লাভের জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করবে। রাসূল (সাঃ) যখন রুগীর নিকট যেতেন তখন জিজ্ঞেস করতেন, “তোমার অবস্থা কেমন? অতঃপর সান্ত্বনা দিতেন এবং বলতেনঃ
আরবি
ভয়ের কোন কারণ নেই, আল্লাহর ইচ্ছায় ভাল হয়ে যাবে। ইহা গুনাহ মাফের একটি উপায়। কষ্টের স্থানে ডান হাত বুলিয়ে এ দোয়া করতেন।
আরবি
“আয় আল্লাহ! এ কষ্টকে দূর করে দাও! আয় মানুষের প্রতিপালক! তুমি তাকে আরোগ্য দান করো, তুমিই আরোগ্য দাতা, তুমি ব্যতীত আর কারো কাছে আরোগ্যের আশা নেই। এমন আরোগ্য দান করো যে, রোগের নাম-নিশানাও না থাকে”।
৪. রোগীর নিকট অনেকক্ষণ বসবেনা এবং হৈ চৈ করবে না। হ্যাঁ রোগী যদি তোমার বন্ধু অথবা প্রিয়জন হয় এবং সে যদি অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখতে চায় তা হলে তার অনুরোধ রক্ষা করবে।
হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) বলছেন যে, “রোগীর নিকট অনেকক্ষণ বসে না থাকা এবং হৈ চৈ না করা সুন্নাত”।
৫. রোগীর আত্মীয়দের নিকটও অসুখের অবস্থা সম্পর্কে ভালোভাবে জিজ্ঞেস করবে আর সহানুভূতি প্রকাশ করবে এবং খেদমত ও সহযোগিতা করা সম্ভব হলে অবশ্যই করবে। যেমন ডাক্তার দেখানো, রোগীর অবস্থা বলা, ঔষধ ইত্যাদি আনা এবং প্রয়োজনবোধে আর্থিক সাহায্য করা।
৬. অমুসলিম রোগীকেও দেখতে যাবে এবং সুযোগ বুঝে তাকে সত্য দীনের দিকে মনোযোগী করবে, অসুস্থ অবস্থায় মানুষ তুলনামূলকভাবে আল্লাহর দিকে বেশী মনোযোগী হয়। তখন ভাল জিনিস গ্রহণের আগ্রহও সাধারণতঃ বেশী জাগ্রত হয়।
হযরত আনাস (রাঃ)-বর্ণনা করেছেন যে, এক ইহুদীর ছেলে রাসূল (সাঃ)-এর খেদমত করতো। একবার সে অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তাকে দেখার জন্য গেলেন। তিনি শিয়রে বসে তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। ছেলে পাশে অবস্থিত পিতার দিকে দেখতে লাগলো, পিতা ছেলেকে বলল, বৎস! আবুল কাসেম-এর কথাই মেনে নাও, সুতরাং ছেলেটি মুসলমান হয়ে গেল। এখন রাসূল (সাঃ) সেখান থেকে এ কথা বলতে বলতে বের হলেন, সেই আল্লাহর শোকর যিনি এ ছেলেটিকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করলেন।
(বুখারী)
৭. রোগীর বাড়ীতে তাকে দেখতে গিয়ে এদিক সেদিক তাকাবে না এবং সতর্কতার সাথে এমনভাবে বসবে যাতে ঘরের মহিলাদের প্রতি দৃষ্টি না পড়ে।
হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) একবার কোন এক অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে গেলেন। সেখানে আরো কিছু লোক বর্তমান ছিল। তার সাথীদের কেউ মহিলার দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) যখন বুঝতে পারলেন, তখন বললেন, তুমি যদি তোমার চোখটি ছিদ্র করে নিতে তা হলে তোমার জন্য ভাল হতো।
৮. যে ব্যক্তি প্রকাশ্য পাপ ও দুষ্কৃতিতে লিপ্ত থাকে আর নির্লজ্জতার সাথে আল্লাহর নাফরমানী করতে থাকে তার রুগী দেখতে যাওয়া উচিত নয়। হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেছেনঃ মদখোর যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তবে তাকে দেখতে যেয়োনা।
৯. রোগী দেখতে গেলে রোগীর পক্ষ থেকেও নিজের জন্য দোআ করবে। ইবনে মাজায় বর্ণিত আছে, তুমি যখন রোগী দেখতে যাও তবে তার কাছ থেকে নিজের জন্য দোআর আবেদন কর, রোগীর দোআ ফিরিশতাদের দোআর সমতুল্য।
সাক্ষাতের নিয়ম-কানুন
১. সাক্ষাতের সময় হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাবে বন্ধুত্বের প্রকাশ ঘটাবে এবং সালামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে, এ হচ্ছে বড় সওয়াব।
২. সালাম ও দোআর জন্য অন্য কোন শব্দ ব্যবহার করবে না, রাসূল (সাঃ)-এর দেয়া শব্দ “আসসালামু আলাইকুম” ব্যবহার করবে, তারপর সুযোগ পেলে মুসাফাহা করবে, অবস্হার কথা জিজ্ঞেস করবে আর উপযুক্ত মনে হলে পরিবারস্থ লোকদেরও খোঁজ খবর নেবে, রাসূল (সাঃ)-এর শিক্ষা দেয়া শব্দ “আসসালামু আলাইকুম” অনেক বেশী অর্থপূর্ণ। এতে দীন ও দুনিয়ার সর্বপ্রকার শান্তি ও নিরাপত্তা এবং শুভ ও সুস্বাস্থ্য অন্তর্ভূক্ত। খেয়াল রাখবে যে রাসূল (সাঃ) মুসাফাহা করার সময় নিজের হাত তাড়াতাড়ি ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেন না, অপর ব্যক্তি নিজেই হাত ছাড়িয়ে নেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন।
৩. কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে পরিষ্কার কাপড় পরে যাবে। ময়লা কাপড় পরিধান করে যাবে না, আর মূল্যবান পোশাক দ্বারা অন্যের উপর প্রভাব খাটানোর উদ্দেশ্যেও যাবে না।
৪. কারো সাথে যখন সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা করবে তখন তার সাথে আগে আলোচনাক্রমে সময় ঠিক করে নেবে, এমনিভাবে সময়-অসময়ে কারো নিকট যাওয়া ঠিক নয়, এর দ্বারা অন্যের সময় নষ্ট হয় এবং সাক্ষাৎকারীকেও অনেক সময় হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়।
৫. কেউ যখন তোামর নিকট সাক্ষাৎ করতে আসে, তখন বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি দ্বারা অভ্যর্থনা করবে। সম্মানের সাথে বসাবে এব সুযোগমত উপযুক্ত অতিথেয়তাও করবে।
৬. কারো কাছে গেলে তখন কাজের কথা বলবে। অকাজের কথা বলে অযথা সময় নষ্ট করবে না। নতুবা লোকদের নিকট যাওয়া ও বসাটা বিরক্তিবোধ হবে।
৭. কারো কাছে গেলে দরজায় দাঁড়িয়ে অনুমতি নেবে। আর অনুমতি পাওয়া গেলে আসসালামু আলাইকুম বলে ভিতরে যাবে আর যদি তিনবার আসসালামু আলাইকুম বলে ভিতরে যাবে আর যদি তিনবার আসসালামু আলাইকুম বলার পরও জবাব না মিলে তা হলে সন্তুষ্ট চিত্তে ফিরে আসবে।
৮. কারো কাছে যাবার সময়ও কখনো কখনো উপযুক্ত তোহফাও সাথে নিয়ে যাবে। তোহফা দেয়া নেয়ায় বন্ধুত্ব বৃদ্ধি পায়।
৯.কোন অভাবী ব্যক্তি তোমার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলে যথাসম্ভব তার অভাব পূরণ করে দেবে। সুপারশের আবেদন করলে সুপারিশ কবুল করে কারো অভাব পূরণ করতে না পারলেও তাকে সৌহার্দ্য পূর্ণ পদ্ধতিতে নিষেধ করে দেবে। অনর্থক তাকে আশাবাদী করবে না।
১০. কারো নিকট নিজের প্রয়োজনে গেলে ভদ্রভাবে নিজের প্রয়োজনের কথা বলবে এবং প্রয়োজন পূর্ণ হলে শুকরিয়া আদায় করবে, না হলে তখন সালাম করে খুশী হয়ে ফিরে আসবে।
১১. লোকেরা সাক্ষাৎ করতে আসবে এ আকাঙ্খা করবে না, নিজেই অন্যের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাবে। পরস্পর মেলামেশা বৃদ্ধি করা এবং একে অন্যের উপকার করা বড় পছন্দনীয় কাজ, কিন্তু খেয়াল রাখবে যে, মুমিনদের মেলামেশা সর্বদা সদুদ্দেশ্যেই হয়ে থাকে।
১২. সাক্ষাতের সময় যদি দেখা যায় সাক্ষাৎকারীর মুখমণ্ডল দাড়ি অথবা কাপড়ে খড়কুটা অথবা অন্য কোন জিনিস লেগে আছে তাহলে তা সরিয়ে দেবে, আর অন্য কেউ যদি তোমার সাথে এ সদ্ব্যবহার করে তখন শুকরিয়া আদায় করবে আর তার জন্য এ দোআ করবে-
আরবি
আপনার নিকট যা অপছন্দনীয় তা আল্লাহ দূর করে দেবেন।
১৩. রাতের বেলায় কারো নিকট যাবার প্রয়োজন হলে তার আরামের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। অনেকক্ষণ বসে থাকবে না আর যাবার পর যদি অনুমান হয় যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে তা হলে কোন প্রকার মনোকষ্ট না নিয়ে খুশী মনে ফিরে আসবে।
১৪. কয়েকজন একত্রে কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে তখন আলোচনাকারীকে আলোচনায় নিজের সাথীদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করা আর সম্বোধিত ব্যক্তিকে নিজের ব্যক্তিত্বের দিকে মনোযোগী করা থেকে কঠোর ভাবে বিরত থাকবে।
আলোচনার আদবসমূহ
১. সর্বদা হক কথা বলবে। যত বড় ক্ষতিই হোক না কেন, কখনো হক কথা বলতে ইতঃস্তত করবে না।
২. প্রয়োজনীয় কথা বলবে আর যখনই কথা বলবে কাজের কথা বলবে। সব সময় কথা বলা এবং নিষ্প্রয়োজনে কথা বলা গাম্ভীর্য ও মর্যাদাবোধ বিরোধী। আল্লাহর নিকট সব কথারই জবাব দিতে হবে, মানুষ যে কথাই মুখ থেকে বের করে, আল্লাহর ফিরিশতাগণ তার সবই নোট করে রাখে।
আরবি
“যে কথাই মুখ থেকে বের হয় তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তার নিকট এক সতর্ক পরিদর্শক প্রস্তুত আছে”।
(আল কুরআন)
৩. যখন কথা বলবে, নম্রতার সাথে মিষ্টি স্বরে বলবে। সর্বদা মধ্যম আওয়াযে কথা বলবে না যে, সম্বোধিত ব্যক্তি শুনতে না পারে আর এতো চীৎকার করেও বলবে না যে সম্বোধিত ব্যক্তির প্রতি প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা হতে পারে। পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে-
আরবি
নিশ্চয়ই ঘৃণ্যতম স্বর হলো গাধার স্বর’।
৪. কখনো খারাপ ভাষা দ্বারা মুখ অপবিত্র করবে না। অপরের সম্পর্কে খারাপ কথা এবং একজনের কথা অন্যকে বলবে না, অভিযোগ করবে না, নিজের মহাত্ব প্রকাশ করবে না, নিজের প্রশংসা করবে না, কারো উপর বিদ্রূপ করবে না, কাউকে অপমানসূচক কোন নামে ডাকবে না, কথায় কথায় কসম খাবে না।
৫. ন্যায় বিচারের কথা বলবে তাতে নিজের অথবা বন্ধু এবং আত্মীয়েরে ক্ষতি হলেও।
আরবি
“আর যখন তোমরা কিছু বলো তখন ইসাফের কথা বলো, যদিও তারা নিকটআত্মীয়ও হয়”।
৬. নম্রতা, যুক্তিপূর্ণ এবং সান্ত্বনার স্বরে কথা বলবে, কর্কশ ও কষ্টদায়ক শক্ত কথা বলবে না।
৭. মহিলাদের যদি কোন সময় গায়ের মুহরেম পুরুষের সাথে কথা বলার প্রয়োজন হয় তখন পরিষ্কার, সরল এবং কর্কশ স্বরে কথা বলবে। স্বরে কোন নম্রতা ও কমনীয়তা সৃষ্টি করবে না যেন শ্রোতা কোন কুধারণা অন্তরে আনতে পারে।
৮. কোন মূর্খ ব্যক্তি যদি কথার প্যাচে জড়িত করতে চায় তা হলে যথাযথভাবে সালাম করে সেখান থেকে বিদায় হয়ে যাবে। অতিরিক্ত কথা বলা ব্যক্তি ও বাজে কথায় লিপ্ত ব্যক্তি উম্মতের মধ্যে নিকৃষ্টতম লোক।
৯. সম্বোধিত ব্যক্তি কথা সুন্দর ভাবে বুঝার জন্য অথবা কোন কথার গুরুত্ব ভালোভাবে অনুধাবন করার জন্য সম্বোধিত ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা ধারাকে সম্মখে রেখে যথার্থ পদ্ধতি অবলম্বন করবে আর সম্বোধিত ব্যক্তি যদি কথা বুঝতে না পারে বা শুনতে না পায় তাহলে পুনরায় বলবে এবং এতে মোটেও মনোকষ্ট নেবে না।
১০. আলোচ্য বিষয় সংক্ষেপ ও উদ্দেশ্যের কথা বলবে, বিনা কারণে আলোচনা দীর্ঘ করা ঠিক নয়।
১১. দীন সম্পর্কে যদি কখনো কোন কথা বুঝতে হয় অথবা দীনের কিছু বিধিনিষেধ ও মাসায়েল বোধগম্য করাতে হয় তখন অত্যন্ত সাদা-সিধাভাবে আবেগের সাথে নিজের কথা পরিস্কার করে বুঝিয়ে বলবে।
১২. কখনো খোশামোদ ও তোশামোদের কথা বলবে না। নিজের সম্মানের খেয়াল রাখবে আর কখনো নিম্নমানের কথা বলবে না।
১৩. দু’ব্যক্তি কথা বলতে থাকলে তখন তাদের অনুমতি ব্যতীত কথার মধ্যে অংশগ্রহণ করবে না, আর কখনো কারো কথা কেড়ে কথা বলার চেষ্টা করবে না, বলা যদি জরুরীই হয় তা হলে অনুমতি নিয়ে বলবে।
১৪. ধীরে ধীরে দক্ষতা ও গাম্ভীর্যের সাথে আলোচনা করবে এবং তাড়াতাড়ি ও তীব্রতা করবে না, সব সময় হাসি-ঠাট্টা করবে না। এর দ্বারা মানুষের মর্যাদা কমে যায়।
১৫. কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে প্রথমে অত্যন্ত মনোযোগের সাথে তা শুনবে। আর খুব চিন্তা করে জবাব দেবে। বিনা চিন্তা ও না বুঝে জবাব দেয়া বড় মুর্খতার কাজ। কেউ যদি অন্য কাউকে প্রশ্ন করে তাহলে নিজে যেচে জবাব দেবে না।
১৬. কেউ কিছু বলতে থাকলে আগেই বলবে না যে, আমি জানি। হতে পারে যে, তার বলাতে নতুন কোন কথা এসে যাবে অথবা কোন বিশেষ কথা দ্বারা অন্তরে বিশেষ কোন ক্রিয়া সৃষ্টি হবে।
১৭. যার সাথে কথা বলা হোক তার মর্যাদা ও তার সাথে নিজের সম্পর্কের প্রতি লক্ষ্য রেখে বলেব। মাতা-পিতা, শিক্ষক এবং অন্যান্য মুরব্বীদের সাথে আদবের সাথে কথা বলবে। অনুরূপভাবে ছোটদের সাথে কথা বলতে নিজের মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে স্নেহ ও ভক্তিসুলভ আলোচনা করবে।
১৮. আলোচনা করার সময় কারো দিকে ইংগিত করবে না, যাতে অন্যের কুধারণা হয় এবং অনর্থক সন্দেহ সৃষ্টি হয়। অন্যের কথা লুকিয়ে শোনা ঠিক না। অন্যের কথা বশেী করে শুনবে এবং তার চাইতে কম বলবে। গোপন কথা কারো কাছেই বর্ণনা করবে না। নিজের গোপন কথা অপরের নিকট বর্ণনা করে তার থেকে হেফাজতের আশা করাটা সরাসরি মুর্খতা।
চিঠি লেখার নিয়ম-নীতি
১. বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম দ্বারা শুরু করবে, সংক্ষেপে করতে চাইলে “বিইসমিহি তাআলা” লিখেব। রাসূল (সাঃ) বলেছেন যে কাজ “বিসমিল্লাহ” দ্বারা শুরু করা হবে না তা অসম্পূর্ণ এবং বরকতহীন। কোন কোন ব্যক্তি শব্দের পরিবর্তে (সংখ্যা) ৭৮৬ লিখে, তার থেকে বিরত থাকবে, আল্লাহর শিক্ষা দেয়া শব্দে বরকত আছে।
২. নিজের ঠিকানা প্রত্যেক চিঠিতে অবশ্যই লিখবে এবং এর পূর্বে প্রেরকের ঠিকানা দেয়া আছে অথবা তার স্মরণ আছে, এ কথা জরুরী নয় যে, প্রাপকের নিকট ঠিকানা রক্ষিত হবে আর এও জরুরী নয় যে, প্রাপক ঠিকানা মুখস্ত করে রাখবে।
৩. ডান দিকে সামান্য জায়গা বাদ দিয়ে নিজের ঠিকানা লিখবে। ঠিকানা সর্বদা পরিষ্কার ও সুন্দর করে লিখবে ঠিকানার বিশুদ্ধতা ও বানানের দিক থেকে মন স্থির করে নেবে। বাংলা-ইংরেজীতে চিঠি লিখতে হলে বামদিকের প্রান্তে ঠিকানা লিখতে হবে।
৪. নিজের ঠিকানার নিচে অথবা বামদিকে লেখা শুরু করার উপরের দিকে তারিখ লিখবে।
৫. তারিখ লেখার পর সংক্ষিপ্ত উপাধি ও সম্ভাষণের মাধ্যমে প্রাপককে সম্বোধিত করবে। উপাধি ও সম্ভাষণ সর্বদা সংক্ষেপে লিখবে, যার দ্বারা আন্তরিকতা ও নৈকট্য অনুভূত হয়, এরূপ উপাধি থেকে বিরত থাকবে যার দ্বারা রং চড়ান ও অতিরঞ্জিত কোনকিছু অনুভূত হয়। উপাধি ও সম্ভাষণের সাথেই অথবা উপাধির নিচে দ্বিতীয় লাইনে “সালম মাসনুন” অথবা “আসসালামু আলাইকুম” আদব তাসলীমাত লিখবে।
৬. অমুসলিমকে চিঠি লেখার সময় “আসসালামু আলাইকুম” অথবা “সালামুন মাসনুন” লেখার জায়গায় আদব ও তাসলীমাত ইত্যাদি শব্দ লিখবে।
৭. উপাধি ও আদাব এর পর নিজের উদ্দেশ্য ও বাসনার কথা লিখবে যে উদ্দেশ্যে চিঠি লিখিত হচ্ছে। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এরপর প্রাপকের সাথে সম্পর্ক প্রকাশক শব্দের সাথে নিজের নাম লিখে চিঠি শেষ করবে।
৮. চিঠি অত্যন্ত পরিষ্কার করে লিখবে যেন সহজে পড়া ও বুঝা যায়। এবং প্রাপকের অন্তরে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
৯. চিঠিতে অত্যন্ত পরিষ্কার, সহজ ও মার্জিত ভাষা ব্যবহার করবে।
১০. চিঠি সংক্ষেপে লিখবে ও প্রতিটি কথা খুলে পরিষ্কারভাবে লিখবে, শুধু ইশারা করবে না।
১১. পূর্ণ চিঠিতে উপাধি ও সম্ভাষণ থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রাপকের মর্যাদার দিকেও লক্ষ্য রাখবে।
১২. নতুন প্যারাগ্রাফ আরম্ভ করার সময় অন্তত এক শব্দের পরিমাণ স্থান খালি রাখবে।
১৩. চিঠিতে সংযত ভাব ঠিক রাখবে, অসামঞ্জস্য পূর্ণ কথা লিখবে না।
১৪. রাগত অবস্থায় কোন চিঠি লিখবে না, কোন গালা-গালির কথাও চিঠিতে লিখবে না। চিঠি সর্বদা নম্র ভাষায় লিখবে।
১৫. সাধারণত চিঠিতে কোন গোপন কথা লিখবে না।
১৬. বাক্য শেষে দাঁড়ি দেবে।
১৭. বিনা অনুমতিতে কারো চিঠি পড়বে না। এটা সরাসরি আমানতের খেয়ানত। অবশ্য ঘরের মুরুব্বীদের ও পৃষ্ঠ পোষকদের দায়িত্ব যে, ছোটদের চিঠি পড়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেবে, আর যথাযথ পরামর্শ দেবে। মেয়েদের চিঠির উপর বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখবে।
১৮. আত্মীয়দের ও বন্ধু বান্ধবদেরকে খবরাখবর জানিয়ে নিয়মিত চিঠি লিখতে থাকবে।
১৯. কেউ অসুস্থ হয়ে গেলে, কেউ বিছানায় পতিত হলে অথবা অন্য কোন বিপদে ফেঁসে গেলে তখন তাকে সহানুভূতি সূচক পত্র লিখবে।
২০. কারো ঘরে কোন উৎসব হলে কোন প্রিয় ব্যক্তি আসলে অথবা আনন্দের অন্য কোন সুযোগ হলে ধন্যবাদ পত্র লিখবে।
২১. চিঠিপত্র সর্বদা কাল অথবা নীল কালিতে লিখবে, কাঠ পেন্সিল বা লাল কালি দ্বারা কখনো লিখবে না।
২২. কোন ব্যক্তি ডাকে ফেলার জন্য চিঠি দিলে তখন অত্যন্ত দায়িত্বের সাথে সময়মত ফেলবে, কর্তব্যহীনতা ও গড়িমসি করবে না।
২৩. অনাত্মীয় লোকদেরকে জবাব চাই কথার জন্য জবাবী কার্ড, ফেরত কার্ড অথবা টিকেট পাঠিয়ে দেবে।
২৪. লিখে কাটতে চাইলে হালকা হাতে তার উপর একটি আঁক টেনে দেবে।
২৫. পত্রে শুধু নিজের চিত্ত আকর্ষণীয় এবং নিজের উদ্দেশ্য সম্পর্কীয় কথাগুলোই লিখবে না বরং সম্বোধিত ব্যক্তির আবেগ, অনুভূতির প্রতি খেয়াল রাখবে, শুধু নিজ সম্পর্কিত ব্যক্তিদেরই খবার জানাবে। আর স্মরণ রাখবে পত্রে কারো থেকে বেশী দাবী দাওয়া করবে না। বেশী দাবী দাওয়া করলে মানুষের মর্যাদা নষ্ট হয়।
কারবারের আদবসমূহ
১. মনের আকর্ষণ ও পরিশ্রমের সাথে কারবার করবে, নিজের জীবিকা নিজ হাতেই কামাবে, কারো উপর বোঝা হবে না।
একবার রাসূল (সাঃ) এর দরবারে এক আনসারী সাহাবী এসে ভিক্ষে চাইল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ঘরে কি কোন আসবাবপত্র আছে? সাহাবী বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! শুধু দু’টো জিনিস আছে। তার একটি চটের বিছানা, যা আমি গায়েও দিই এবং আমার বিছানাও, আর একটি পানির গ্লাস। তিনি বললেন, এ দুটি জিনিসই আমার নিকট নিয়ে এসো। সাহাবী উহা নিয়ে হাজির হলেন। তিনি উভয়টি নিলামে দু’দিরহামে বিক্রি করে এক দিরহাম তাকে দিয়ে বললেন এ দিরহাম দিয়ে পরিবারস্থ লোকদের জন্য কিছু খাদ্যদ্রব্য কিনে দিয়ে এসো। আর এক দিরহাম দিয়ে একটি কুড়াল কিনে নিয়ে এসো। অতঃপর তিনি নিজ হাতে কুড়ালে হাতল লাগিয়ে দিয়ে বললেন, যাও জঙ্গলে গিয়ে কাঠ কেটে আন এবং তা বাজারে নিয়ে বিক্রি কর, পনের দিন পর এসে আমার কাছে অবস্থা জানাবে। পনের দিন পর ঐ সাহাবী হাজির হলেন, তখন তিনি দশ দিরহাম তহবিল করেছিলেন। একথা শুনে রাসূল (সাঃ) অত্যন্ত খুশ হলেন এবং বললেন, এ পরিশ্রমের উপার্জন তোমার জন্য কতই না উত্তম যে, তুমি মানুষের নিকট থেকে ভিক্ষা করতে আর কিয়ামতের দিন তোমার চেহারায় ভিক্ষার কলংক লেগে থাকতো।
২. শক্ত হয়ে দৃঢ়তার সাথে উপার্জন করবে, বেশী বেশী উপার্জন করবে, যেন মানুষের নিকট ঋণী না থাক। রাসূল (সাঃ) কে একবার সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সব চাইতে উত্তম উপার্জন কোনটি? তিনি বললেন, নিজ হাতে উপার্জন এবং যে কারবারে মিথ্যা ও খেয়ানত না হয়”। হযরত আবু কোলবাহ (রাঃ) বলতেন, বাজারে ধৈর্য্যের সাথে কারবার কর। তুমি দীনের উপর শক্তভাবে স্থির থাকতে পারবে ও লোকদের থেকে মুক্ত থাকবে।
৩. ব্যবসায় উন্নতি লাভ করার জন্য সর্বদা সত্য কথা বলবে, মিথ্যা শপথ করবেনা।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা সেই ব্যক্তির সাথে কথা বলবেন না, তার দিকে মুখ তুলে দেখবেন না, তাকে পাক পবিত্র করে বেহেশতে দাখিল করবেন না, যে মিথ্যা শপথ খেয়ে খেয়ে নিজের কারবারর উন্নতিলাভ করতে চেষ্টা করে।
(মুসলিম)
৪. ব্যবসায়ে দীনদারী ও আমানতদারী অবলম্বন করবে, আর কাউকে কখনো খারাপ মাল দিয়ে নিজের হালাল উপার্জনকে হারাম করবে না। রাসূলাল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “সত্যবাদী ও আমানতদারী ব্যবসায়ী কিয়অমতের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গী হবে।
(তিরমিযি)
৫. খরিদ্দারকে ভাল জিনিস সরবরাহ করতে চেষ্টা করবে, যে নিশ্চিন্ত নয় যে তা ভাল না খারাপ- তা কখনো কোন খরিদ্দারকে দেবে না আর কোন খরিদ্দার যদি পরামর্শ চায় তাহলে তাকে ঠিক পরামশ দেবে।
৬. খরিদ্দারদেরকে নিজের বিশ্বস্ততায় আনতে চেষ্টা করবে যেন সে হিতাকাঙ্খী মনে করে, তার উপর নির্ভর করে এবং তার পরিপূর্ণ বিশ্বাস হয় যে, সে তার নিকট কখনো প্রতারিত হবে না।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি হালাল উপার্জনের ওপর জীবন নির্বাহ করেছে, আমার সুন্নতের উপর আমল করেছে, আমার নির্দ্দেশিত পথে চলেছে এবং লোকদেরকে নিজের দুষ্টামী থেকে নিরাপদ রেখেছে তা হলে এ ব্যক্তি জান্নাতী”। সাহাবীগণ আরজ করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ যুগে এমন লোক তো অনেক আছে। তিনি বললেন, “আমার পরেও এরূপ লোক থাকবে”।
(তিরমিযি)
৭. সময়ের প্রতি খেয়াল রাখবে, সময়মত দোকানে পৌঁছে ধৈর্য্যের সাথে অপেক্ষা করবে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “জীবিকার অন্বেষণ এবং হালাল উপার্জনের জন্য ভোরে উঠে যাও। কেননা ভোরের কাজ সমূহ অধিক বরকতপূর্ণ হয়”।
৮. নিজেও পরিশ্রম করবে আর কর্মচারীদেরকেও পরিশ্রমে অভ্যস্ত করে তুলবে। অবশ্য কর্মচারীদের কাছ থেকে অধিকার, উদারতা ও সহনশীলতার সাথে কাজ আদায় করবে। তাদের সাথে নম্রতা ও প্রশস্ততা মূলক ব্যবহার করবে, কথায় রাগ করা ও সন্দেহ করা থেকে বিরত থাকবে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তাআলা ঐ জাতিকে পবিত্র করবেন না, যারা প্রতিবেশী ও দুর্বলদের অধিকার প্রদান করে না”।
৯. খরিদ্দারদের সাথে সর্বদা নম্র ব্যবহার করবে আর কর্জ প্রার্থীদের সাথে কটু কথা বলবে না, তাদেরকে নিরাশও করবে না এবং তাদের তাগাদায়ও কঠোরতা অবলম্বন করবে না।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তাআলা সে ব্যক্তির উপর দয়া করুন। যে ব্যক্তি কেনাবেচা ও তাগাদায় নম্রতা ও সদাচার ও ভদ্রতা অবলম্বন করে”
রাসূল (সাঃ) এও বলেছেনঃ যে ব্যক্তি এ আকাঙ্খা রাখে যে, আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতের দিন দুঃখ ও অস্থিরতা থেকে রক্ষা করুন তাহলে তার উচিত অসচ্ছল ও অভাবগ্রস্থ ঋণ গ্রহীতাকে সমঙ দেয়া অথবা তার উপর থেকে ঋণের বোঝা রহিত করা।
১০. মালের কোন দোষ গোপন করা যাবে না। মালের দোষের কথা খরিদ্দারকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেবে এবং খরিদ্দারকে ধোকা দেবে না। একবার রাসূল (সাঃ) এক শস্য ভাণ্ডারের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, তিনি স্তুপের মধ্যে নিজের হাত ঢুকালেন তখন আঙ্গুলে কিছুটা ভিজা অনুভব হলো। তিনি শস্যের মালিককে জিজ্ঞেস করলেন, এ কি? দোকানদার বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই স্তুপের উপর বৃষ্টি হয়েছিল। রাসূল (সাঃ) বললেনঃ তবে তুমি ভিজা শস্যগুলো কেন উপরে রাখনি? তাহলে লোকেরা দেখতে পেতো। যে ব্যক্তি ধোকা দেয় তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
১১. মূল্য বাড়ার প্রতীক্ষায় গুদামজাত করে রেখে আল্লাহর সৃষ্টিক অস্থির করা থেকে কঠোরভাবে বিরত থাকবে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “গুদামজাতকারী পাপী”। অন্য এক স্থানে তিনি বলেছেনঃ “গুদাম জাতকারী কত খারাপ লোক যে আল্লাহ যকন সস্তা করে দেন তখন সে দুঃখে অস্থির হয়ে যায়। আর যখন মূল্য বেড়ে যায় তখন সে খুশী হয়ে যায়।
(মেশকাত)
১২. খরিদ্দার তার অধিকার দেবে। মাপে সততার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করবে, লেনদেনও একইভাবে করবে।
রাসূল (সাঃ) ওজনকারী ব্যবসায়ীদের সাবধান করে বলেছেন “তোমাকে এম দু’টি কাজে দায়িত্বশীল করে দেয়া হয়েছে যার দরুন তোমাদের অতীত জাতিসমূহ ধ্বংস হয়েছে”।
পবিত্র কোরআনে আছে-
আরবি
যারা ওজনে কম দেয় তাদের জন্য ধ্বংস! যারা ওজন করে নেবার সময় পুরোপুরি নেয়, আর যখন তাদেরকে ওজন করে দেয় তখন কম দেয়। তারা কি জানেনা যে, তা নিশ্চয়ই পুনরুত্থিত হবে। এক মহান দিনে, সেদিন সৃষ্টিকূলের প্রতিটি প্রাণী মহান আল্লাহর দরবারে দাঁড়াবে।
(সূরায়ে মুতাফফীক্বীন ১৩)
পবিত্র কেরাআনে আরো আছে-
আরবি
হে মুমিনগণ, আমি কি তোমাদেরকে সেই ব্যবসায় শিক্ষা দেবো যা তোমাদেরকে কষ্টদায়ক আযাব থেকে নাজাত দেবে, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনবে, আল্লাহর পথে তোমাদের জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করবে। ইহাই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জান”।
(সূরায়ে ছফ ১১-১২)