১. অমুসলিম নাগরিক কত প্রকার?
ইসলামী আইন অমুসলিম নাগরিকদের তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করেঃ
এক. যারা সন্ধি বা চুক্তি বলে ইসলামী রাষ্ট্রের আওতাভুক্ত হয়েছে।
দুই. যারা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
তিন. যারা যুদ্ধ কিংবা সন্ধি ছাড়া অন্য কোনো পন্থায় ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
যদিও উক্ত তিন প্রকারের নাগরিকরাই সংখ্যালঘু অমুসলিমদের জন্য নির্ধারিত সাধারণ অধিকারগুলোতে সমভাবে অংশীদার, কিন্তু প্রথমোক্ত দুই শ্রেণী সংক্রান্ত বিধিতে সামান্য কিছু পার্থক্যও রয়েছে। তাই অমুসলিম সংখ্যালঘুদের অধিকার বিশদভাবে বর্ণনা করার আগে আমি এই বিশেষ দুটি শ্রেণীর আলাদা আলাদা বিধান বর্ণনা করবো।
চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিক
যারা যুদ্ধ ছাড়া অথবা যুদ্ধ চলাকালে বশ্যতা স্বীকার করতে সম্মত হয়ে যায় এবং ইসলামী সরকারের সাথে সুনির্দিষ্ট শর্তাবলী স্থির করে সন্ধিবদ্ধ হয় তাদের জন্য ইসলামদের বিধান এই যে, তাদের সাথে সকল আচরণ তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির শর্তানুযায়ী করা হবে। আজকালকার সভ্য জাতিগুলো এরূপ রাজনৈতিক ধড়িবাজীতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে যে, শত্রু পক্ষকে বশ্যতা স্বীকারে উদবুদ্ধ করার জন্য কিছু উদার শর্ত নির্ধারণ করে নেয়। তারপর যেই তারা পুরোপুরি আয়ত্তে এসে যায় অমনি শুরু হয়ে যায় ভিন্ন ধরনের আচরণ। কিন্তু ইসলাম এটাকে হারাম ও মহাপাপ গণ্য করে। কোনো জাতির সাথে যখন কিছু শর্ত স্থির করা হয়ে যায় (চাই তা মনোপুত হোক বা না হোক) এখন তাতে চুল পরিমাণও হেরফের করা যাবেনা। চাই উভয় পক্ষের আপেক্ষিক অবস্থান, শক্তি ও ক্ষমতায় [Relative position] যতোই পরিবর্তন এসে থাক না কেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
“যদি তোমরা কোনো জাতির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হও, বিজয়ী হও এবং সেই জাতি নিজেদের ও নিজেদের সন্তানদের প্রাণ রক্ষার্থে তোমাদের মুক্তিপণ দিতে রাযী হয় (অপর বর্ণনায় আছে যে, তোমাদের সাথে কোনো সন্ধিপত্র সম্পাদন করে) তাহলে পরবর্তী সময়ে ঐ নির্ধারিত মুক্তিপণের চেয়ে কণা পরিমাণও বেশী নিও না। কেননা সেটা তোমাদের জন্য বৈধ্য হবে না।” [আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ]
অপর হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
“সাবধান! যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ নাগরিকের ওপর যুলুম করবে কিংবা তার প্রাপ্য অধিকার থেকে তাকে কম দেবে, তার সামর্থ্যের চেয়ে বেশী বোঝা তার ওপর চাপাবে অথবা তার কাছ থেকে কোনো জিনিস তার সম্মতি ছাড়া আদায় করবে, এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন আমি নিজেই ফরিয়াদী হবো।” [আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ]
উক্ত উভয় হাদীসের ভাষা ব্যাপক অর্থবোধক। তাই ঐ হাদীস দুটি থেকে এই সাধারণ বিধি প্রণয়ন করা হয় যে, চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিকদের সাথে সন্ধিপত্রে যেসব শর্ত নির্ধারিত হবে, তাতে কোনো রকম কমবেশী করা কোনোক্রমেই জায়েয হবে না। তাদের ওপর করা খাজনাও বাড়ানো যাবে না। তাদের জমিজমাও দখল করা যাবে না, তাদের ঘরবাড়ী দালান কোঠাও কেড়ে নেয়া যাবে না। তাদের ওপর কড়া ফৌজদারী দণ্ডবিধিও চালু করা যাবে না, তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতায়ও হস্তক্ষেপ করা যাবে না। তাদের ইজ্জত সম্মানের ক্ষতি করা যাবে না এবং তাদের সাথে এমন কোন আচরণ করা যাবে না, যা যুলুম, অধিকার হরণ, সামর্থ্যের মাত্রাতিরিক্ত বোঝা চাপানো অথবা সম্মতি ব্যতিরেকে সম্পত্তি হস্তগত করার পর্যায়ে পড়ে। এই নির্দেশাবলির কারণেই ফকীহগণ সন্ধি বলে বিজিত জাতিগুলো সম্পর্কে কোনো আইন প্রণয়ন করেননি বরং শুধুমাত্র একটি সাধারণ সংক্ষিপ্ত বিধি প্রণয়ন করেই ক্ষান্ত থেকেছেন। সেটি এই যে, তাদের সাথে আমাদের আচরণ হুবহু সন্ধির শর্ত অনুসারে পরিচালিত হবে। ইমাম আবু ইউসুফ লিখেছেনঃ
“তাদের সন্ধিপত্রে যা নেয়া স্থির হয়েছে, তাদের কাছ থেকে শুধু তাই নেয়া হবে। তাদের সাথে সম্পাদিত সন্ধুর শর্ত পূরণ করা হবে। কোনো কিছু বাড়ানো হবে না।” [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৩৫]
যুদ্ধে বিজিত অমুসলিম নাগরিক
দ্বিতীয় প্রকারের অমুসলিম নাগরিক হচ্ছে যারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুসলমানদের সাথে লড়াই করেছে এবং ইসলামী বাহিনী যখন তাদের সকল প্রতিরোধ ভেংগে তাদের আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করেছে, কেবল তখনই অস্ত্র সংবরণ করেছে। এ ধরনের বিজিতদেরকে যখন “সংরক্ষিত নাগরিকে” (যিম্মী) পরিণত করা হয়, তখন তাদের কয়েকটি বিশেষ অধিকার দেয়া হয়। ফিক্হ্ শাস্ত্রীয় গ্রন্থাবলীতে এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। নিম্নে এই সকল বিধির একটা সংক্ষিপ্তসার দেয়া হচ্ছে। এ থেকে এই শ্রেণীর অমুসলিম নাগরিকদের সাংবিধানিক মর্যাদা ও অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যাবেঃ
১. মুসলমানদের সরকার তাদের কাছ থেকে জিযিয়া গ্রহণ করা মাত্রই তাদের সাথে সংরক্ষণ চুক্তি সম্পাদিত হয়ে যাবে এবং তাদের জান ও মালের হিফাযত করা মুসলমানদের জন্য ফরয হয়ে যাবে। কেননা জিযিয়া গ্রহণ করা মাত্রই প্রমাণিত হয় যে, জান ও মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। [বাদায়েউস্ সানায়ে, ৭ম খণ্ড, ১১১ পৃষ্ঠা]
এরপর মুসলিম সরকারের বা সাধারণ মুসলমানদের এ অধিকার থাকে না যে, তাদের সম্পত্তি দখন করবে বা তাদেরকে দাসদাসী বানাবে। হযরত ওমার রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত আবু উবায়দাকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেছিলেনঃ
“যখন তুমি তাদের কাছ থেকে জিযিয়া গ্রহণ করবে, তখন তোমার আর তাদের ওপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার থাকবে না।” [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৮২]
২. “সংরক্ষিত নাগরিকে” (যিম্মী) পরিণত হয়ে যাওয়ার পর তাদের জমির মালিক তারাই হবে। সেই জমির মালিকানা উত্তরাধিকার সূত্রে হস্তান্তরিত হবে এবং তারা নিজেদের সম্পত্তি বেচা, কেনা, দান করা ও বন্ধক রাখা ইত্যাদির নিরঙ্কুশ অধিকারী হবে। ইসলামী সরকার তাদেরকে বেদখল করতে পারবে না। [ফাতহুল কাদীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫৯]
৩. জিযিয়ার পরিমাণ তাদের আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। যারা ধনী তাদের কাছ থেকে বেশী, যারা মধ্যবিত্ত তাদের কাছ থেকে কিছু কম এবং যারা দরিদ্র তাদের কাছ থেকে অনেক কম নেয়া হবে। আর যার কোনো উপার্জনের ব্যবস্থা নেই অথবা যে অন্যের দান-দিক্ষিনার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে, তার জিযিয়া মাফ করে দেয়া হবে। জিযিয়ার জন্য যদিও কোনো বিশেষ পরিমাণ নির্দিষ্ট নেই, তবে তা অবশ্যই এভাবে নির্ধারিত হওয়া চাই যাতে তা দেয়া তাদের পক্ষে সহজ হয়। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ধনীদের ওপর মাসিক এক টাকা, মধ্যবিত্তদের ওপর মাসিক ৫০ পয়সা এবং গরীব লোকদের ওপর মাসিক ২৫ পয়সা জিযিয়া আরোপ করেছিলেন। [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৩৬]
৪. জিযিয়া শুধুমাত্র যুদ্ধ করতে সক্ষম লোকদের ওপর আরোপ করা হবে। যারা যুদ্ধ করতে সমর্থ নয়, যথা শিশু, নারী পাগল, অন্ধ, পংগু, উপাসনালয়ের সেবক, সন্যাসী, ভিক্ষু, খুনখুনে বৃদ্ধ। বছরের উল্লেখযোগ্য সময় রোগে কেটে যায় এমন রোগী, এবং দাস দাসী ইত্যাদিকে জিযিয়া দিতে হবে না। [বাদায়ে, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১১-১১৩; ফাতহুল কাদীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৩, ৩৭২; কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৭৩]
৫. যুদ্ধের মাধ্যমে দখলীকৃত জনপদের উপাসনালয় দখল করার অধিকার মুসলমানদের রয়েছে। তবে সৌজন্য বশত এই অধিকার ভোগ করা থেকে বিরত থাকা এবং উপাসনালয়গুলোকে যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় বহাল রাখা উত্তম। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর আমলে যতো দেশ বিজিত হয়েছে তার কোথাও কোনো উপাসনালয় ভাঙ্গা হয়নি বা তাতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হয়নি। ইমাম আবু ইউসুফ লিখেছেনঃ
“সেগুলোকে যেমন ছিলো তেমনভাবেই রাখা হয়েছে। ভাঙ্গা হয়নি বা তাতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হয়নি।” [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৮৩]
তবে প্রাচীন উপাসনালয়গুলোকে ধ্বংস করা কোনো অবস্থায়ই বৈধ নয়। [বাদায়ে, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১৪]