২. অমুসলিম নাগরিকদের সাধারণ অধিকার
এবার আমি অমুসলিম নাগরিকদের সাধারণ অধিকারগুলো বর্ণনা করবো। উল্লেখিত তিন শ্রেণীর নাগরিকদের সকলেই এ অধিকারগুলোতে অংশীদার।
প্রাণের নিরাপত্তা
অমুসলিম নাগরিকদের রক্তের মূল্য মুসলমানদের রক্তের মূল্যের সমান। কোনো মুসলমান যদি অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করে, তাহলে একজন মুসলমান নাগরিককে হত্যা করলে যেমন তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো ঠিক তেমনি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলে জনৈক মুসলমান অমুসলিমকে হত্যা করলে তিনি খুনীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তিনি বলেনঃ
“যে নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়া হয়েছে, তার রক্তের বদলা নেয়ার দায়িত্ব আমারই।” [ইনায়া শরহে হিদায়া, ৮ম খণ্ড, ২৫৬ পৃষ্ঠা]
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর আমলে বকর বিন ওয়ায়েল গোত্রের এক ব্যক্তি জনৈক হীরাবাসী অমুসলিম যিম্মীকে হত্যা করে। তিনি খুনীকে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের হাতে সমর্পনের আদেশ দেন। অতঃপর তাকে উত্তরাধিকারীদের হাতে সমর্পণ করা হলে তারা তাকে হত্যা করে। [বুরহান শরহে মাওয়াহিবুর রহমান, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮৭]
হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর আমলে হযরত ওমরের ছেলে উবায়দুল্লাহকে হত্যার পক্ষে ফতোয়া দেয়া হয়। কেননা তিনি হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর হত্যার সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে হরমুযান ও আবু লুলুর মেয়েকে হত্যা করেন।
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর আমলে জনৈক মুসলমান জনৈক অমুসলিমের হত্যার দায়ে গ্রেফতার হয়। যথারীতি দোষ সাব্যস্ত হওয়ার পর তিনি মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। এই সময় নিহত ব্যক্তির ভাই এসে বললো, “আমি মাফ করে দিয়েছি।” কিন্তু তিনি তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে বললেন, “ওরা বোধ হয় তোমাকে ভয় দেখিয়েছে।” সে বললো, “না, আমি রক্তপণ পেয়েছি এবং আমি বুঝতে পেরেছি যে, ওকে হত্যা করলে আমার ভাই ফিরে আসবে না।” তখন তিনি খুনীকে ছেড়ে দিলেন এবং বললেনঃ
“আমাদের অধীনস্থ অমুসলিম নাগরিকদের রক্ত আমাদের রক্তের মতোই এবং তাদের রক্তপণ আমাদের রক্তপণের মতোই।” [বুরহান, ২য় খণ্ড, ২৮২ পৃষ্ঠা]।
অপত এক বর্ণনা মুতাবিক হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেছিলেনঃ
“তারা আমাদের নাগরিক হতে রাজি হয়েছেই এই শর্তে যে, তাদের সম্পত্তি আমাদের সম্পত্তির মতো এবং তাদের রক্ত আমাদের মতো মর্যাদাসম্পন্ন হবে।”
এ কারণেই ফকীহগণ এই বিধি প্রণয়ন করেছেন যে, কোনো অমুসলিম নাগরিক কোনো মুসলমানের হাতে ভুলক্রমে নিহত হলে তাকেও অবিকল সেই রক্তপণ দিতে হবে, যা কোনো মুসলমানের নিহত হবার ক্ষেত্রে দিতে হয়। [দুর্রুল মুখতার, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২০৩]
ফৌজদারী দণ্ডবিধি
ফৌজদারী দণ্ডবিধি মুসলিম অমুসলিম সকলের জন্য সমান। অপরাধের যে সাজা মুসলমানকে দেয়া হয়, অমুসলিম নাগরিককেও তাই দেয়া হবে। অমুসলিমের জিনিস যদি মুসলমান চুরি করে, কিংবা মুসলমানের জিনিষ যদি অমুসলিম চুরি করে, তাহলে উভয় ক্ষেত্রেই চোরের হাত কেটে ফেলা হবে। কারো ওপর ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ আরোপ করলে অপবাদ আরোপকারী মুসলমানই হোক আর অমুসলমানই হোক উভয়কেই একই শাস্তি দেয়া হবে। অনুরূপভাবে ব্যভিচারের শাস্তিও মুসলিম ও অমুসলিমের জন্য একই রকম। তবে মদের বেলায় অমুসলিমদেরকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। [কিতাবুল খারাজ, পৃ. ২০৮, ২০৯; আল-মাব্সূত, ৯ম খণ্ড, পৃ. ৫৭-৫৮। ইমাম মালেকের মতে অমুসলিমকে মদের ন্যায় ব্যভিচারের শাস্তি থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ইমাম মালেকের অভিমতের উৎস হলো হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এই সিদ্ধান্ত যে, অমুসলিম নাগরিক ব্যভিচার করলে তার ব্যাপারটা তাদের সম্প্রদায়ের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। অর্থাৎ তাদের ধর্মীয় বা পারিবারিক আইন অনুসারে কাজ করতে হবে।]
দেওয়ানী আইন
দেওয়ানী আইনেও মুসলমান ও অমুসলমান সমান। “তাদের সম্পত্তি আমাদের সম্পত্তির মতো” হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এই উক্তির তাৎপর্য এই যে, মুসলমানের সম্পত্তি যেভাবে হিফাযত করা হয় অমুসলিমের সম্পত্তির হিফাযতও তদ্রূপ সাম্যের অনিবার্য দাবী অনুসারে দেওয়ানী আইনের আলোকে মুসলমানদের ওপর যেসব দায় দায়িত্ব অর্পিত হয় অমুসলিমের ওপরও তাই অর্পিত হবে।
ব্যবসায়ের যেসব পন্থা আমাদের জন্য নিষিদ্ধ, তা তাদের জন্যও নিষিদ্ধ। তবে অমুসলিমরা শুধুমাত্র শূকরের বেচাকেনা, খাওয়া এবং মদ বানানো, পান ও কেনাবেচা করতে পারবে। [আল-মাসবূত, ১৩শ খণ্ড, পৃ. ৩৭-৩৮]
কোনো মুসলমান কোনো অমুসলিমের মদ বা শূকরের ক্ষতি সাধন করলে তার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে। দুর্রে মুখতারে আছেঃ
“মুসলমান যদি মদ ও শূকরের ক্ষতি করে তবে তার মূল্য দিতে বাধ্য থাকবে।” [৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৭৩]
সম্মানের হিফাযত
কোনো মুসলমানকে জিহবা বা হাত পা দিয়ে কষ্ট দেয়া, গালি দেয়া, মারপিট করা বা গীবন করা যেমন অবৈধ, তেমনি এসব কাজ অমুসলিমের বেলায়ও অবৈধ। দুর্রুল মুখতারে আছেঃ
“তাকে কশঝট দেয়া থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব এবং তার গীবত করা মুসলমানের গীবত করার মতোই হারাম।” [৩য় খণ্ড, পৃঃ. ২৭৩-২৭৪]
অমুসলিমদের চিরস্থায়ী নিরাপত্তা
অমুসলিমদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চুক্তি মুসলমানদের জন্য চিরস্থায়ীভাবে বাধ্যতামূলক অর্থাৎ এই চুক্তি করার পর তারা তা ভাংতে পারে না। অপরদিকে অমুসলিমদের এখতিয়ার আছে যে, তারা যতোদিন খুশী তা বহাল রাখতে পারে এবং যখন ইচ্ছা ভেংগে দিতে পারে ‘বাদায়ে’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ
“অমুসলিমদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দানের চুক্তি আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক। মুসলমানরা কোনো অবস্থাতেই তা ভাংতে পারে না। পক্ষান্তরে অমুসলিমদের পক্ষে তা বাধ্যতামূলক নয়। অর্থাৎ তারা যদি আমাদের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে চায় তবে তা করতে পারে।” [দুর্রুল মুখতার, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১২]
অমুসলিম নাগরিক যতো বড় অপরাধই করুক, তাদের রাষ্ট্রীয় রক্ষাকবচ সম্বলিত নাগরিকত্ব বাতিল হয় না। এমনকি জিযিয়া বন্ধ করে দিলে, কোনো মুসলমানকে হত্যা করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বেয়াদবী করলে অথবা কোনো মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করলেও তার নিরাপত্তার গ্যারান্টিযুক্ত নাগরিকত্ব বাতিল হয় না। এসব কাজের জন্য তাকে অপরাধী হিসেবে শাস্তি দেয়া হবে। কিন্তু বিদ্রোহী আখ্যায়িত করে নাগরিকত্বহীন করা হবে না। এক যদি সে মুসলমানদের দেশ ছেড়ে গিয়ে শত্রুদের সাথে মিলিত হয়। দুই যদি সে ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে খোলাখুলি বিদ্রোহে লিপ্ত হয়ে অরাজকতার সৃষ্টি করে [বাদায়ে, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১১৩; ফাতহুল কাদীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৮১-৩৮২]
পারিবারিক বিষয়াদি
অমুসলিমদের পারিবারিক কর্মকাণ্ড তাদের নিজস্ব পারিবারিক আইন [Personal Law] অনুসারে স্থির করা হবে। এক্ষেত্রে তাদের ওপর ইসলামী আইন কার্যকর হবে না। আমাদের ঘরোয়া জীবনে যেসব জিনিস অবোইধ, তা যদি তাদের ধর্মীয় ও জাতীয় আইনে বৈধ হয়, তাহলে ইসলামী আদালত তাদের আইন অনুসারেই ফয়সালা করবে। উদাহরণ স্বরূপ সাক্ষী ছাড়া বিয়ে, মুহ্র ছাড়া বিয়ে, ইদ্দ্তের মধ্যে পুনরায় বিয়ে অথবা ইসলামে যাদের সাথে বিয়ে নিষিদ্ধ তাদের সাথে বিয়ে যদি তাদের আইনে বৈধ থেকে থাকে, তাহলে তাদের জন্য এসব কাজ বৈধ বলে মেনে নেয়া হবে। খোলাফায়ে রাশেদীন এবং তাদের পরবর্তী সকল যুগে ইসলামী সরকারগুলো এই নীতিই অনুসরণ করেছে। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয এ ব্যাপারে হাসান বস্রীর কাছে নিম্নরূপ প্রশ্ন করেছিলেনঃ
“খোলাফায়ে রাশেদিন অমুসলিম নাগরিকদেরকে নিষিদ্ধ মেয়েদের সাথে বিয়ে, মদ ও শূকরের ব্যাপারে স্বাধীন ছেড়ে দিলেন কিভাবে?”
জবাবে হযরত হাসান লিখেছেনঃ
“তারা জিযিয়া দিতে তো এজন্যই সম্মত হয়েছে যে, তাদেরকে তাদের আকীদা-বিশ্বাস অনুসারে জীবন যাপন করার স্বাধীনতা দিতে হবে। আপনার কর্তব্য পূর্ববর্তীদের পদ্ধতি অনুসরণ করা, নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা নয়।”
তবে কোনো ক্ষেত্রে যদি বিবদমান উভয় পক্ষ স্বয়ং ইসলামী আদালতে আবেদন জানায় যে, ইসলামী শরীয়ত মুতাবিক তাদের বিবাদের ফায়সালা করা হোক, তবে আদালত তাদের ওপর শরীয়তের বিধান কার্যকর করবে। তাছাড়া পারিবারিক আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো বিবাদের যদি একপক্ষ মুসলমান হয়, তবে ইসলামী শরীয়ত মুতাবিক ফায়সালা হবে। উদাহরণ স্বরূপ, একজন খৃষ্টান মহিলা কোনো মুসলমানের স্ত্রী ছিলো এবং তার স্বামী মারা গেলো। এমতাবস্থায় এই মহিলাকে শরীয়ত মুতাবিক স্বামীর মৃত্যুজনিত ইদ্দত পুরোপুরি পালন করতে হবে। ইদ্দতের ভেতরে সে বিয়ে করলে সে বিয়ে বাতিল হবে। [আল-মাবসূত, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৮-৪১]
ধর্মীয় অনুষ্ঠান
অমুসলিমদের ধর্মীয় ও জাতীয় অনুষ্ঠানাদি প্রকাশ্যভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে উদযাপন করা সম্পর্কে ইসলামের বিধান এই যে, অমুসলিমরা তাদের নিজস্ব জনপদে এটা অবাধে করতে পারবে। তবে নির্ভেজাল ইসলামী জনপদ্গুলোতে ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার ইচ্ছা করলে তাদেরকে এ ব্যাপারে অবাধ স্বাধীনতাও দিতে পারবে, আবার কোনো ধরনের কড়াকড়ি আরোপ করতে চাইলে তাও করতে পারবে। [নির্ভেজাল ইসলামী জনপদ শরীয়াতের পরিভাষায় “আমসারুল মুসলিমীন” (বিধিরুদ্ধ ইসলামী জনপদ) আখ্যায়িত অঞ্চলকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যেসব অঞ্চলের ভূসম্পত্তি মুসলমানদের মালিকানাভুক্ত এবং যেসব অঞ্চলকে মুসলমানরা ইসলামী অনুষ্ঠানাদি ও উদযাপনের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। বাদায়ে গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ
“যেসব জনপদ বিধিবদ্ধ ইসলামী জনপদ নয়, সেখানে অমুসলিমদেরকে মদ ও শূকর বিক্রি, ক্রুশ বহন করা ও শঙ্খ ধ্বনি বাজানোতে বাধা দেয়া হবে না। চাই সেখানে মুসলিম অধিবাসীদের সংখ্যা যতোই বেশী হোক না কেনো। তবে বিধিবদ্ধ ইসলামী অঞ্চলে এসব কাজ পছন্দনীয় নয়। অর্থাৎ যেসব জনপদকে জুমুয়া, ঈদ ও ফৌজদারী দণ্ডবিধি প্রচলনের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে।… তবে যে সমস্ত পাপ কাজকে তারাও নিষিদ্ধ মনে করে, যেমন ব্যভিচার ও অন্যান্য অশ্লীল কাজ, যা তাদের ধর্মেও নিষিদ্ধ সেসব কাজ প্রকাশ্যে করতে তাদেরকে সর্বাবস্থায় বাঁধা দেয়া হবে। চাই সেটা মুসমানদের জনপদে হোক কিংবা তাদের জনপদে হোক।” [বাদায়ে, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১১৩]
কিন্তু বিধিবদ্ধ ইসলামী জনপদগুলোতে তাদেরকে শুধুমাত্র ক্রুশ ও প্রতিমাবাহী শোভাযাত্রা বের করতে এবং প্রকাশ্যে ঢাকঢোল বাজাতে বাজাতে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে প্রাচীন উপাসনালয়গুলোর অভ্যন্তরে তারা সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে পারবে। ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার তাতে হস্তক্ষেপ করবে না। [শর্হু সিয়ারিল কবীর, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৫১]
উপসনালয়
নির্ভেজাল মুসলিম জনপদ্গুলোতে অমুসলিমদের যেসব প্রাচীন উপাসনালয় থাকবে, তাতে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। উপাসনালয় যদি ভেংগে যায়, তবে একই জায়গায় পুননির্মাণের অধিকারও তাদের আছে। তবে নতুন উপসনালয় বানানোর অধিকার নেই। [বাদায়ে, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১৪; শরহু সিয়রিল কবীর, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৫১]
তবে যেগুলো নির্ভেজাল মুসলিম জনপদ নয়, তাতে অমুসলিমদের নতুন উপাসনালয় নির্মাণের অবাধ অনুমতি রয়েছে। অনুরূপভাবে যেসব এলাকা এখন আর বিধিবদ্ধ ইসলামী জনপদ নেই, সরকার যেখানে জুম্য়া, ঈদ ও ফৌজদারী দণ্ডবিধির প্রচলন বন্ধ করে দিয়েছে, সেখানেও অমুসলিমদের নতুন উপাসনালয় নির্মাণ নিজস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের অধিকার রয়েছে। [দায়ে, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১৪; শরহু সিয়রিল কবীর, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৫৭]
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর ফতোয়া নিম্নরূপঃ
“যেসব জনপদকে মুসলমানরা বাসযোগ্য বানিয়েছে, সেখানে অমুসলিমদের নতুন মন্দির, গীর্জা ও উপাসনালয় বানানো, বাদ্য বাজানো এবং প্রকাশ্যে শূকরের গোশত ও মদ বিক্রি করার অধিকার নেই। আর অনারবদের হাতে আবাদকৃত, পরে মুসলমানদের হাতে বিজিত এবং মুসলমানদের বশ্যতা স্বীকারকারী জনপদে অমুসলিমদের অধিকার তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির শর্ত অনুসারে চিহ্নিত হবে। মুসলমানরা তা মেনে চলতে বাধ্য থাকবে।”
জিযিয়া ও কর আদায়ে সুবিধা দান
জিযিয়া ও কর আদায়ে অমুসলিম নাগরিকদের ওপর কঠোরতা প্রয়োগ করা নিষিদ্ধ। তাদের সাথে নম্র ও কোমল ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। তারা বহন করতে পারে না এমন বোঝা তাদের ওপর চাপাতে নিষেধ করা হয়েছে। হযরত ওমরের নির্দেশ ছিলো, “যে পরিমাণ সম্পদ রাষ্ট্রকে প্রদান করা তাদের সামর্থের বাইরে তা দিতে তাদেরকে বাধ্য করা চলবে না।” [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৮, ৮২]
জিযিয়ার বদলায় তাদের ধন সম্পদ নিলামে চড়ানো যাবে না। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তার জনৈক কর্মচারীকে নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন যেঃ
“কর খাজনা বাবদে তাদের গরু, গাধা কাপড় চোপড় বিক্রি করো না।” [ফাতহুল বায়ান, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৩]
অপর এক ঘটনায় হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু স্বীয় কর্মচারীকে পাঠানোর সময় বলে দেনঃ “তাদের শীর গ্রীষ্মের কাপড়, খাবারের উপকরণ ও কৃষি কাজের পশু খাজনা আদায়ের জন্য বিক্রি করবে না, প্রহার করবে না, দাঁড়িয়ে রেখে শাস্তি দেবে না এবং খাজনার বদলায় কোনো জিনিস নিলামে চড়াবে না। কেননা আমরা তাদের শাসক হয়েছি বলে নরম ব্যবহারের মাধ্যমে আদায় করাই আমাদের কাজ। তুমি আমার আদেশ অমান্য করলে আল্লাহ্ আমার পরিবর্তে তোমাকে পাকড়াও করবেন। আর আমি যদি জানতে পারি যে, তুমি আমার আদেশের বিপরীত কাজ করেছো, তাহলে আমি তোমাকে পদচ্যুত করবো। [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৯]
জিযিয়া আদায়ে যে কোনো ধরনের কঠোরতা প্রয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু গভর্নর হযরত আবু উবায়দাকে যে ফরমান পাঠিয়েছিলেন তাতে অমান্য নির্দেশের পাশাপাশি এ নির্দেশও ছিলোঃ
“মুসলমানদেরকে অমুসলিমদের ওপর যুলুম করা, কষ্ট দেয়া এবং অন্যায়ভাবে তাদের সম্পত্তি ভোগ দখন করা থেকে বিরত রাখো।” [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৮২]
সিরিয়া সফরকালে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু দেখলেন, সরকারী কর্মচারীরা জিযিয়া আদায় করার জন্য অমুসলিম নাগরিকদের শাস্তি দিচ্ছে। তিনি তাদের বললেন, “ওদের কষ্ট দিও না। তোমরা যদি ওদের কষ্ট দাও তবে আল্লাহ্ কিয়ামতের দিন তোমাদের শাস্তি দিবেন।” [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৭১]
হিশাম ইবনে হাকাম দেখলেন, জনৈক সরকারী কর্মচারী জিযিয়া আদায় করার জন্য জনৈক কিবতীকে রোদে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তিনি তাকে তিরস্কার করলেন এবং বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ
“যারা দুনিয়ায় মানুষকে শাস্তি দেবে, আল্লাহ্ তাদেরকে শাস্তি দেবেন।” [আবু দাউদ]
মুসলিম ফিক্হ্ শাস্রকারগণ জিযিয়া দেয়া অস্বীকারকারীদের বড়জোর বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়ার অনুমতি দিয়েছে। ইমাম আবু ইউসুফ বলেন,
“তবে তাদের সাথে সদয় আচরণ করা হবে এবং প্রাপ্য জিযিয়া না দেয়া পর্যন্ত আটক করে রাখা হবে।” [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৭০]
যেসব অমুসলিম নাগরিক দারিদ্র্যের শিকার ও পরমুখাপেক্ষী হয়ে যায়, তাদের জিযিয়া তো মাফ করা হবেই, উপরন্তু ইসলামী কোষাগার থেকে তাদের জন্য নিয়মিত সাহায্যও বরাদ্দ করা হবে। হযরত খালিদ হীরাবাসীদের যে লিখিত নিরাপত্তা সনদ দিয়েছিলেন, তাতে একথাও লেখা ছিলোঃ
“আমি হীরাবাসী অমুসলিমদের জন্য এ অধিকারও সংরক্ষণ করলাম যে, তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বার্ধক্যের দরুন কর্মক্ষমতা হারিয়ে বসেছে, যার ওপর কোনো দুর্যোগ নেমে এসেছে অথবা যে পুর্বে ধনী ছিলো, পরে দরিদ্র হয়ে গেছে, ফলে তার স্বধর্মের লোকেরাই তাকে দান-দক্ষিণা দিতে শুরু করেছে, তার জিযিয়া মাফ করে দেয়া হবে এবং তাকে ও তার পরিবার পরিজন ও সন্তানদের বাইতুলমাল থেকে ভরণপোষণ করা হবে।” [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৮৫]
একবার হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জনৈক বৃদ্ধ লোককে ভিক্ষা করতে দেখে তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বললো, “কী আর করবো বাপু, জিযিয়া দেয়া জন্যে ভিক্ষে করছি।” এ কথা শুনে তিনি তৎক্ষণাৎ তার জিযিয়া মাফ ও ভরণপোষণের মাসিক বৃত্তি নির্ধারণ করে দিলেন। তিনি কোষাগারের কর্মকর্তাকে লিখলেন, “আল্লাহর কসম! এটা কখনো ইনসাফ নয় যে, আমরা যৌবনে তার দ্বারা উপকৃত হবো, আর বার্ধক্যে তাকে অপমান করবো।” [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৭২; ফাতহুল কাদীর, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৭৩]
দামেস্ক সফরের সময়ও হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু অক্ষম অমুসলিম নাগরিকদের জন্য বৃত্তি নির্ধারণ করার আদেশ জারী করেছিলেন। [বালাযুরী, ফুতূহুল বুলদান, পৃষ্ঠা ১২৯]
কোনো মুসলিম নাগরিক মারা গেলে তার কাছে প্রাপ্য বকেয়া জিযিয়া তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে থেকে আদায় করা হবে না এবং তার উত্তরাধিকারীদের ওপরও এর দায়ভার চাপানো হবে না। ইমাম আবু ইউসুফ বলেনঃ
“কোনো অমুসলিম নাগরিক তার কাছে প্রাপ্য জিযিয়া পুরো অথবা আংশিক দেয়ার আগেই মারা গেলে তা তার উত্তরাধিকারীদের কাছ থেকে বা তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে আদায় করা হবে না।” [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৭০; আল-মাসবূত, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮১]
বাণিজ্য কর
মুসলিম ব্যবসায়ীদের মতো অমুসলিম ব্যবসায়ীদেরও বাণিজ্য পণ্যের ওপর কর আরোপ করা হবে যদি তাদের মূলধন ২০০ দিরহাম পর্যন্ত পৌঁছে অথবা তারা ২০ মিসকাল স্বর্ণের মালিক হয়ে যায়। [কিতাবুল খারাজ, পৃ. ৭০। তবে আজও কর আরোপের জন্য অবিকল এই পরিমাণ নিসাব নির্ধারণ করা জরুরী নয়। এটা সেই সময়কার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত হয়েছিল।] এ কথা সত্য যে, ফিকাহ শাস্ত্রকারকগণ অমুসলিম ব্যবসায়ীদের ওপর বাণিজ্যের শতকরা ৫ ভাগ এবং মুসলিম ব্যবসায়ীদের ওপর আড়াই ভাগ আরোপ করেছিলেন। তবে এ কাজটা কুরআন বা হাদীসের কোনো সুস্পষ্ট বাণীর আলোকে করা হয়নি। এটা তাদের ইজতিহাদ বা গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত ছিলো। এটা সমকালীন পরিস্থিতির চাহিদা অনুসারে করা হয়েছিল। সে সময় মুসলমানগণের অধিকাংশই দেশ রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিলেন এবং সমস্ত ব্যবসায় বাণিজ্য অমুসলিমদের হাতে চলে গিয়েছিল। এজন্য মুসলিম ব্যবসায়ীদের উৎসাহ বৃদ্ধি এবং তাদের ব্যবসায়ের সংরক্ষণের জন্য তাদের ওপর কর কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
সামরিক চাকুরী থেকে অব্যাহিত
অমুসলিমগণ সামরিক দায়িত্বমুক্ত। শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করা এককভাবে শুধু মুসলমানদের দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত। কারণ একটা আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কেবল তারাই উপযুক্ত বিবেচিত হতে পারে, যারা ঐ আদর্শকে সঠিক বলে মানে। তাছাড়া লড়াইতে নিজেদের আদর্শ ও মূলনীতি মেনে চলাও তাদের পক্ষেই সম্ভব। অন্যেরা দেশ রক্ষার জন্য লাড়াই করলে ভাড়াটে সৈন্যের মতো লড়বো এবং ইসলামের নির্ধারিত নৈতিক সীমা রক্ষা করে চলতে পারবে না। এজন্য ইসলাম অমুসলিমদের সামরিক দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দিয়েছে এবং কেবলমাত্র দেশ রক্ষার কাজের ব্যয় নির্বাহে নিজেদের অংশ প্রদানকে তাদের কর্তব্য বলে চিহ্নিত করেছে। এটাই শুধু যে আনুগত্যের প্রতীক তা নয় বরং সামরিক কর্মকাণ্ড থেকে অব্যাহতি লাভ ও দেশ রক্ষার বিনিময়ও বটে। এজন্য জিযিয়া শুধুমাত্র যুদ্ধ করতে সক্ষম পুরুষদের ওপরই আরোপ করা হয়। আর কখনো যদি মসলমানরা অমুসলিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অক্ষম হয়, তাহলে জিযিয়ার টাকা ফেরত দেয়া হয়।[এ বিষয়ে বিস্তারিত অধ্যায়নের জন্য দেখুন আল-মাবসূত, ১০খণ্ড, পৃ. ৭৮-৭৯: হিদায়া, কিতাবুল সিয়ার: ফাতহুল কাদীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩২৭-৩২৭ এবং ৩৬৯-৩৭০। কোনো বহিশত্রুর আক্রমণের সময় দেশের অমুসলিম নাগরিকরা যদি দেশ রক্ষার কাজে অংশগ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করে, তবে আমরা তাদেরকে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে পারি। তবে সে ক্ষেত্রে তাদের জিযিয়া রহিত করতে হবে। উল্লেখ যে, জিযিয়ার নাম শুনতেই অমুসলিমদের মনে যে আতংক জন্মে সেটা শুধু মাত্র ইসলামের শত্রুদের দীর্ঘকাল ব্যাপী অপপ্রচারের ফল। অন্যথায় এই আতংকের কোনো ভিত্তি নাই। জিযিয়া মূলত ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরা যে নিরাপদ ও সুরক্ষিত জীবন যাপনের সুযোগ পায় তারই বিনিময়। শুধু মাত্র সক্ষম ও প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষদের কাছ থেকে এটা নেয়া হয়। এটাকে যদি ইসলাম গ্রহণ না করার জরিমানা বলা হয়, তাহলে যাকাতকে কি বলা হবে? যাকাত তো শুধু প্রত্যেক সক্ষম পুরুষই নয় বরং সক্ষম নারীর কাছ থেকেও আদায় করা হয়। ওটা কি তাহলে ইসলাম গ্রহণের জরিমানা?] ইয়ামুকের যুদ্ধে যখন রোমকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিশাল সমাবেশ ঘটালো এবং মুসলমানরা সিরিয়ার সকল বিজিত এলাকা পরিত্যেগ করে একটি কেন্দ্রে নিজেদের শক্তি কেন্দীভূত করতে বাধ্য হলো, তখন হযরত আবু উবাইদা নিজের অধীনস্থ সেনাপতিদের নির্দেশ দিলেন, তোমরা যে সব জিযিয়া ও খাজনা অমুসলিমদের কাছ থেকে আদায় করেছিলে তা তাদের ফিরিয়ে দাও এবং বলো যে, “এখন আমরা তোমাদের রক্ষা করতে অক্ষম, তাই যে অর্থ তোমাদের রক্ষা করার বিনিময়ে আদায় করেছিলাম তা ফেরত দিচ্ছি“। [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ১১১]
এই নির্দেশ মুতাবিক সকল সেনাপতি আদায় করা অর্থ ফেরত দিলেন। এ সময় অমুসলিম নাগুরকদের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে ঐতিহাসিক বালাযুরী লিখেছেন, মুসলমান সেনাপতিগণ যখন সিরিয়ার হিমস নগরীতে জিযিয়ার অর্থ ফেরত দেন, তখন সেখানকার অধিকাসীবৃন্দ সমস্বরে বলে উঠে, “ইতিপূর্বে যে যুলুম অত্যাচারে আমরা নিষ্পেষিত হচ্ছিলাম, তার তুলনায় তোমাদের শাসন ও ন্যায়বিচারকে আমরা বেশী পছন্দ করি। এখন আমরা যুদ্ধ করে পরাজিত হওয়া ছাড়া কোনো মতেই হিরাক্লিয়াসের কর্মচারীদেরকে আমাদের শহরে ঢুকতে দেবো না।” [ফুতূহুল বুলদান, পৃষ্ঠা ১৩৭]