সংযোজন-৩
অমুসলিমদের অধিকার : কতিপয় মৌলিক প্রশ্নের জবাব
ক. ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিক
প্রশ্ন : আমি হিন্দু মহাসভার কর্মী। গত বছর হিন্দু মহাসভার প্রাদেশিক প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছি। কিছুদিন হলো আমি আপনার সম্পর্কে জানতে পেরেছি। ইতোমধ্যে আপনার কতিপয় গ্রন্থও পড়েছি। যেমন, মুসলমান ও বর্তমান রাজনৈতিক সংঘাত ১ম ও ৩য় খণ্ড, [এ গ্রন্থেগুলো বর্তমান ‘উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুসলিম’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত।- সম্পাদক] ইসলাম রাজনৈতিক মতবাদ, ইসলামী বিপ্লবের পথ ও শান্তি পথ প্রভৃতি। এ গ্রন্থগুলো অধ্যয়নের ফলে ইসলাম সম্পর্কে আমার ধারনার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এ জিনিসটা যদি আরো কিছুদিন আগে প্রতিষ্ঠিত হতো, তবে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা এতোটা জটিল হতো না। আপনি যে ইসলামী রাষ্ট্রের দাওয়াত দিচ্ছেন, তার অধীনে জীবনযাপন করা গৌরবের বিষয়। তবে কতিপয় প্রশ্ন আছে। এগুলোর জবাবের জন্য চিঠিপত্র ছাড়া প্রয়োজন হলে আমি আপনার সান্নিধ্যে হাযির হবো।
আমার প্রথম প্রশ্ন হলো, ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনের হিন্দুদের কি মর্যাদা প্রদান করা হবে? তাদের কি আহলে কিতাবদের সমপর্যায়ের অধিকার দেয়া হবে। নাকি যিম্মি ধরা হবে। আহলে কিতাব এবং যিম্মিদের অধিকারের বিস্তারিত বিবরণ আপনার উক্ত গ্রন্থগুলোতে নেই। আরবদের সিন্ধু অভিযানের ইতিহাস আমি যতোটা জানি, তাতে দেখা যায় মুহাম্মদ বিন কাসিম এবং তার উত্তরসূরীরা সিন্ধু হিন্দুদেরকে আহলে কিতাবের অধিকার প্রদান করেছিল। আশা করি এ বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা পেশ করবেন। আহলে কিতাব এবং যিম্মীদের অধিকারের মধ্যে কি পার্থক্য রয়েছে তাও লিখবেন। তারা দেশের প্রশাসনিক কাজে সমানভাবে অংশগ্রহন করতে পারবে কি? যদি না পারে তবে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহে ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে আপনি হিন্দুদেরকে কোন মর্যাদা প্রদান করতে চাচ্ছেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, কুরআনের ফৌজদারী বিধানসমূহ মুসলমানদের মতো হিন্দুদের উপরও কার্যকর হবে? হিন্দুদের জাতীয় আইন
[Personal Law] তাদের উপর কার্যকর হবে কিনা? আমার বক্তব্য হচ্ছে হিন্দুরা তাদের উত্তরাধিকার আইন, যৌথ পরিবার ব্যবস্থা, পালকপুত্র গ্রহণ ইত্যাদি বিধি ব্যবস্থা অনুযায়ী [মনু শাস্ত্রের ভিত্তিতে] জীবন যাপন করতে পারবে কি?
প্রকাশ থাকে যে, প্রশ্নগুলো একজন সত্য সন্ধারীর প্রশ্ন।
জবাব : পত্রে প্রকাশিত আপনার ধ্যান ধারণা আমার নিকট সম্মানার্হ। এটা বাস্তব যে ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলিম সম্পর্ককে জটিল ও তিক্ত করার ব্যাপারে সেসব লোকেরাই দায়ী, যারা ন্যায় ও সত্য মূলনীতির পরিবর্তে ব্যক্তিগত, বংশগত, শ্রেনীগত, সম্প্রদায়গত এবং জাতিগত মূলনীতির ভিত্তিতে মানুষের জীবন সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছে। এর পরিণাম অনিবার্যভাবেই তাই হওয়ার ছিলো যা এখন আমরা সচক্ষে দেখছি। আমরা আপনারা সকলেই এ মন্দ পরিণতির সমান অংশীদার। কল্যাণ কেউই লাভ করতে পারেনি।
আপনার প্রশ্নগুলোর সংক্ষিপ্ত জবাব ক্রমানুসারে নিম্ন প্রদত্ত হলো :
১. ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তার ব্যবস্থা এরূপ হবে না যে একটি জাতি আরেকটি জাতি বা অন্য জাতিগুলোর উপর শাসক হয়ে বসবে। বরঞ্চ তার মৌলিক বৈশিষ্ঠ্য এই হবে যে, একটি আদর্শের ভিত্তিতে দেশে সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। এ কথা পরিষ্কার যে, এরূপ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেশের সেসব নাগরিকরাই বহন করতে পারবে যারা হবে উক্ত আদর্শের ধারক ও বাহক। যারা এ আদর্শের ধারক ও বাহক হবে না, অন্তত এর উপর সন্তুষ্ট হবে না, স্বাভাবিকভাবেই তারা এ রাষ্ট্রে যিম্মীর মর্যাদা লাভ করবে। অর্থাৎ তাদের নিরাপত্তার যিম্মাদারী’ সেসব লোকেরা গ্রহন করবে যারা উক্ত মূলনীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রের পরিচালক হবে।
২. আহলে কিতাব এবং সাধারন যিম্মীদের মধ্যে একটি ছাড়া আর কোন পার্থক্য থাকবে না। সেটি হচ্ছে এই যে, আহলে কিতাবের মহিলাদেরকে মুসলমানরা বিয়ে করতে পারবে এবং অন্যদের পারবে না। কিন্তু অধিকারের ব্যাপারে আহলে কিতাব এবং অন্য যিম্মীদের মধ্যে কোনো প্রকার পার্থক্য থাকবে না।
৩. যিম্মীদের অধিকারের বিস্তারিত বিবরণ তো এ চিঠিতে দেয়া সম্ভব নয়। তবে এ ব্যাপারে মৌলিক কথা হচ্ছে এই যে, যিম্মী দুপ্রকারের হতে পারে। এক প্রকার হচ্ছে সেসব যিম্মী, যারা কোনো চুক্তির ভিত্তিতে ইসলামী রাষ্ট্রের যিম্মী হয়েছে বা নিরাপত্তা গ্রহণ করেছে। দ্বিতীয় প্রকার যিম্মী হচ্ছে তারা, যারা কোনো প্রকার চুক্তি ছাড়াই যিম্মী হয়েছে। প্রথম ধারনের যিম্মীদের সংগে কৃত চুক্তি মুতাবিক আচরণ করা হবে। দ্বিতীয় প্রকার যিম্মীদের যিম্মী হওয়া দ্বারাই আমাদের উপর এ দায়িত্ব ন্যস্ত হয় যে, আমরা তেমন করে তাদের জান মাল ও ইজ্জত আবরুর হেফাযত করবো যেমন করে হিফাযত করি আমাদের নিজেদের জান, মাল ও ইজ্জত আবরুর। তাদের আইনগত অধিকার তাই হবে যা হবে মুসলমানদের। তাদের রক্তমূল্য তাই হবে যা মুসলমনাদের রক্তমূল্য। নিজেদের ধর্ম পালনের পূর্ণ আযাদী তাদের থাকবে। তাদের উপাসনাসমূহ নিরাপদ থাকবে। তাদেরকে তাদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের অধিকার দেয়া হবে এবং বাধ্যতামূলকভাবে তাদের উপর ইসলামী শিক্ষা চাপিয়ে দেয়া হবে না।
৪. অমুসলিমদের ‘পার্সোনাল ল’ তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতার আবশ্যিক অংশ। সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্রে তাদের বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার, পালকপুত্র গ্রহন এবং অনুরূপ অন্যান্য আইন যা দেশীয় আইনের [Law of the land] সাথে সাংঘর্ষিক নয়, তাদের উপর প্রয়োগ করবে। কেবল সেসব ক্ষেত্রে তাদের পার্সোনাল ল’ কে বরদাশত করা হবে না যেগুলোর কুফল জনগণকে প্রভাবিত করবে। যেমন কোনো অমুসলিম জাতি যদি সুদকে বৈধ রাখতে চায় তবে ইসলামী রাষ্ট্রে সুদী লেনদেনের অনুমতি আমরা দেবো না। কারণ এতে গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রভাবিত হবে। কিংবা কোনো অমুসলিম জাতি যদি ব্যভচার বৈধ রাখতে চায়, তবে এ অনুমতিও আমরা দেবো না। তারা নিজেদের মধ্যেও এ কুকর্মের [Prostitution] ব্যবসা চালু রাখতে পারবে না। কেননা এটা সর্বস্বীকৃতভাবে মানব জাতির নৈতিকতা বিরোধী কাজ। আর এটা আমাদের ফৌজদারী আইনের [Criminal Law] সাথেও সাংঘর্ষিক। একথা স্পষ্ট যে, এটাই হবে রাষ্ট্রীয় আইন। এবার এরি ভিত্তিক আপনি অন্যান্য বিষয়গুলোর অনুমান করতে পারেন।
৫. আপনি প্রশ্ন করেছেন, অমুসলিমরা ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন শৃংখলার কাজে সমান অংশীদার হতে পারবে কিনা? যেমন পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় হিন্দুরা অংশ গ্রহন করতে পারবে কিনা? যদি না পারে, তবে আপনারা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহে মুসলমানদের জন্যে সে অবস্থা মেনে নেবেন কি, ইসলামী রাষ্ট্রে যে মর্যাদা আপনারা হিন্দদের প্রদান করবেন? আমার মতে আপনার এ প্রশ্নের ভিত্তি ভুল ধারণার উপর প্রমিষ্ঠিত। কারণ এখানে আপনি একদিকে আদর্শিক অজাতীয়তা ভিত্তিক রাষ্ট্রের’ [Idiological non-National state] সঠিক মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রাখেননি। অপরদিকে এ প্রশ্নের মধ্যে ব্যবসায়িক লেনদেনের মানসিকতা পরিস্ফুট বলে মনে হচ্ছে।
পহেলা নম্বর জবাবেও আমি একথা বলেছি যে, একটি আদর্শিক রাষ্ট্র পরিচলনা এবঙ তার নিরাপত্তার দায়িত্ব কেবল সেসব লোকেরাই বহন করতে পারে, যারা সেই আদর্শের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী। তারাই তো এ আদর্শের মুল স্পিরিট অনুধাবন করতে পারবে। এদের থেকেই তো এ আশা করা যেতে পারে যে, পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে নিজেদের দ্বীনি ও ঈমানী দায়িত্ব মনে করে তারা এ রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজ পরিচলনা করবে এবং একে টিকিয়ে রাখার জন্যে প্রয়োজনে লড়াইয়ের ময়দানে নিজেদের জীবন কুরবানী করবে।
যারা এ আদর্শে বিশ্বাসী নয়, তাদেরকে যদি এ রাষ্ট্র পরিচালনা এবং এর নিরাপত্তার দায়িত্বে অংশীদার করাও হয়, তাবে তারা এ আদর্শিক এবং নৈতিক স্পিরিট অনুধাবন করতে সক্ষম হবে না। সে অনুযায়ী তারা কাজ করতেও সক্ষম হবে না। আর এ আদর্শের জন্যে তাদের সেরূপ আন্তরিকতা সৃষ্টি হবে না যার ওপর রাষ্ট্রিয় অট্টালিকার ভিত প্রতিষ্ঠিত থাকবে। তারা যদি বেসামরিক বিভাগে কাজ করে, তবে তাদের কেবল কর্মচারী সুলভ মানসিকতার প্রকাশ পাবে এবং উপার্জনের জন্যেই তারা নিজেদের সময় ও যাবতীয় যোগ্যতা বিক্রি করবে। আর যদি তাদেরকে সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয় তবে তাদের অবস্থা হবে ভাড়াটে সৈনিকের [Meucenaries] মতো। তারা নৈতিক চরিত্রের সেইদাবী ও পূর্ণ করতে পারবে না ইসলামী রাষ্ট্র তার মুজাহিদদের থেকে যা আশা করে থাকে।
এ জন্যে আদর্শিক ও নৈতিক কারণে ইসলামী রাষ্ট্র তার সামরিক বাহিনীতে যিম্মীদের কোনো খিদমত গ্রহণ করে না। পক্ষান্তরে যাবতীয় সামরিক নিরাপত্তার দায়িত্ব মুসলমানরা নিজেদের ঘাড়ে তুলে নেয় এবং অমুসলিম নাগরিকদের থেকে শুধু একটা প্রতিরক্ষা কর গ্রহন করাকেই যথেষ্ট মনে করে। কিন্তু কর এবং সামরিক সেবা এ উভয়টাই নাগরিকরা স্বয়ং নিজেদেরকে সামরিক সেবার জন্যে পেশ করে তবে তা গ্রহণ করা হবে এবং এমনবস্তায় তাদের থেকে প্রতিরক্ষা কর গ্রহণ করা হবে না।
বেসামরিক বিভাগের Key Post গুলো তো সামরিক বিভাগ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, এগুলো নীতি নির্ধারণী কাজের সাথে সম্পর্কিত। এগুলোতে কোনো অবস্থাতেই অমুসলিম নাগরিকদের নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে না। অবশ্য কর্মচারী হিসেবে তাদের খেদমত নিতে কোনো দোষ নেই। এমনি করে রাষ্ট্রীয় পরামর্শ সভায় [মজলিশে শূরা] অমুসলিমদের কোন সদস্য নেয়া হবে না। অবশ্য অমুসলিমদের ভিন্ন কাউন্সিল বানিয়ে দেয়া হবে। এ পরিষদ তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের দেখা শুনা ছাড়াও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তাদের ইচ্ছা ব্যক্ত করবে। তাদের প্রয়োজন, অভিযোগ এবং প্রস্তাবাবলী পেশ করবে। রাষ্ট্রীয় মজলিসে শূরা [Assembly] এগুলো যথোপযুক্তভাবে বিবেচনা করবে।
সোজা কথা হচ্ছে এই যে, ইসলামী রাষ্ট্র কোনো জাতির ইজারাকৃতি সম্পত্তি নয়। যে কেউ তার আদর্শ গ্রহণ করবে, সে তার পরিচালনায় অংশ গ্রহণ করতে পারবে, চাই সে কোনো হিন্দুর পুত্র হোক কিংবা কোনো শিখের। কিন্তু যে এ রাষ্ট্রের আদর্শকে গ্রহণ করবে না, মুসলমানের পুত্র হোক না কেন, সে এ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে বটে কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ গ্রহন করতে পারবে না।
আপনি প্রশ্ন করেছেন, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহে কি মুসলমানরা সে অবস্থা গ্রহণ করবে ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে হিন্দুদেরকে যে পজিশন দেয়া হবে? এ প্রশ্ন আসলে মুসলিমলীগ নেতাদের কাছে করাই উচিত ছিলো। কারণ লেনদেনের কথা তো তারাই বলতে পারে। আমাদের নিকট জানতে চাইলে আমরা তো নিরেট আদর্শিক জবাবই দেবো।
যেখানে হিন্দুরা রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠার অধিকার লাভ করবে, সেখানে আপনারা মূলত দুই ধরণের রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠা করতে পারেন: হিন্দু ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, কিংবা ভৌগলিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেও প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
প্রথমোক্ত অবস্থায় আপনাদের মধ্যে এ প্রশ্ন জাগ্রহ হওয়া উচিত হবে না যে, ইসলামী রাষ্ট্রে হিন্দুদের যতোটুকু অধিকার দেয়া হবে, আমরা ‘রামরাজ্যে’ ও মুসলমানদেরকে ততোটুকু অধিকারই দেবো। বরঞ্চ এ বিষয়ে হিন্দু ধর্মে যদি কোনো দিক নির্দেশনা থাকে তবে কোনো প্রকার রদবদল ছাড়া হুবহু সেটাই কর্যকর করুন। নিজেদের ধর্মীয় নির্দেশ উপেক্ষা করে এ বিষয়ে অন্যদের অনুসরণ করা ঠিক হবে না। আপনাদের বিধান যদি আমাদের বিধানের চেয়ে উন্নততর হয় তবে নৈতিক ময়দানে আপনারাই বিজয়ী হবেন এবং এমনও হতে পারে যে, আমাদের ইসলামী রাষ্ট্র আপনাদের রামরাজ্যে পরিবর্তন হয়ে যাবে। আর প্রকৃত ব্যাপার যদি এর বিপরীত হয়, তবে দেরীতে হোক কিংবা সত্ত্বর পরিণতি এর বিপরীতই হবে। আর যদি শেষোক্ত নীতি গ্রহণ করেন, অর্থাৎ ভৌগলিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, তাবে এ অবস্থায় আপনাদেরকে দুটির যে কোনো একটি পথ গ্রহণ করতে হবে। হয়তো গণতান্ত্রিক [Democratic] নীতি অবলম্বন করতে হবে এবং মুসলমানদেরকে তাদের সংখ্যার ভিত্তিতে অংশ নিতে হবে। নয়তো একথা পরিষ্কারভাবে বলে দিতে হবে যে, এটা হিন্দু জাতির রাষ্ট্র এবং মুসলমানদেরকে এখানে বিজিত জাতি [Subject Nation] হিসেব থাকতে হবে।
এ দুটি পন্থার যেটির ভিত্তিতে ইচ্ছা আপনারা মুসলমনাদের সাথে আচরণ করতে পারেন। সর্বাবস্থায় আপনাদের নীতি ও আচরণ দেখে ইসলামী রাষ্ট্র তার সেসব নীতিতে বিন্দু পরিমাণ পরিবর্তন সাধণ করবে না, অমুসলমানদের ব্যাপারে কুরআন হাদীসে যেগুলো নির্ধারন করে দেয়া হয়েছে। আপনারা যদি আপনাদের রাজ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যা অভিযারও চালান, এমনকি একটি মুসলমান শিশুকেও যদি জীবিত না রাখেন, তবু ইসলামী রাষ্ট্র এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য অমুসলিম নাগরিকদের একটি কেশাগ্রও বাকা করবে না। পক্ষান্তরে আপনারা যদি প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, সেনাপতি ইত্যাদি পদে মুসলমান নাগরিক মনোনীত করেন, সে অবস্থায়ও ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকদের সে একই মর্যাদা ও অধিকার প্রদান করা হবে যা কুরআন ও হাদীসে নির্ধারিত করে দিয়েছে। [তরজমানুল কুরআন : রজব-শাওয়াল ১৩৩৬ হিঃ জুলাই-অক্টোবর ১৯৪৪খৃ:]
উপরোক্ত বিষয়ের অতিরিক্ত ব্যাখ্যা
প্রশ্ন : আপনার রচিত সবগুলো গন্থ এবং পূর্বের চিঠিটা পড়ার পর আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, আপনি নির্ভেজাল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে ইচ্ছুক। আর এ ইসলামী রাষ্ট্রে যিম্মী এবং আহলে কিতাবের লোকদের পজিশন হবে ঠিক তেমনি, যেমনি হিন্দুদের মধ্যে অছ্যুতদের পজিশন।
আপনি লিখেছেন, “হিন্দুদের উপাসনালয় সমূহের সংরক্ষণ করা হবে এবং তাদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের অধিকার দেয়া হবে।” কিন্তু হিন্দুদেরকে তাদের ধর্ম প্রচারের সুযোগ দেয়া হবে কিনা সেকথা তো লিখিননি? আপনি আরো লিখেছেন, “যে কেউ এ রাষ্ট্রের আদর্শ গ্রহণ করবে, সে এর পরিচালনা কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারবে, চাই সে হিন্দুর পুত্র হোক কিংবা শিখের” মেহেরবানী করে একথাটারও ব্যাখ্যা দিন যে, হিন্দু হিন্দু থেকেও কি আপনাদের রাষ্ট্রের নীতিমালার প্রতি ইমান এনে তা পরিচালনার কাজে শরীক হতে পারবে?
আপনি লিখেছেন আহলে কিতাবের মহিলাদেরকে মুসলমানরা বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু আহলে কিতাব মুসলিম মহিলাদের বিয়ে করতে পারবে কিনা সেকথা পারিস্কার করেননি। এ প্রশ্নের জবাব যদি সূচক হয়, তাবে এ [Superiority complex] সম্পর্কে আরো ভালোভাবে আলোকপাত করবেন কি? এর যথার্থতার জন্যে আপনি যদি ইসলামের প্রতি ঈমান আনার যিম্মীদারী নেন, তবে কি আপনি এ কথা মানতে প্রস্তুত আছেন যে, বর্তমানকার তথাকথিত মুসলমান আপনার বক্তব্য অনুযায়ী এসব ইসলামী নীতিমালার মানদণ্ডে টিকে যাবে? বর্তমানকালের মুসলমানদের কতা বাদই দিলাম, আপনি কি একথা স্বীকার করবেন না যে, খিলাফতে রাশেদার আমলে যেসব লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলো তাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভিলাষী ছিলো? আপনি যদি এ কথা স্বীকার করে নিতে কুণ্ঠিত হন, তবে বলুন তো সেই ইসলামী রাষ্ট্রটি কেন মাত্র ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর টিকেছিলো? হযরত আলীর মতো বিচক্ষণ মুজাহিদের এতো বিরোধিতা কেন হয়েছিলো এবং তার বিরোধীদের মধ্যে হযরত আয়েশা পর্যন্ত কেন ছিলেন?
ইসলামী রাষ্ট্রের অভিলাষী হয়েও আপনি পকিস্তানের বিরোধিতা করছেন। কোনো রাষ্ট্রীয় সীমা ছাড়াই কি আপনি আপনার হুকুমতে ইলাহিয়া প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন? অবশ্যই নয়। তবে তো আপনার হুকুমতে ইলাহিয়ার জন্যে সে ভূখণ্ডটিই উপযুক্ত, মি. জিন্নাহ এবং তার সংগী সাথীরা যেখানে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। পাকিস্তান না চেয়ে সারা ভারতেই কেন আপনি হুকুমতে ইলাহিয়া প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন? এমন একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অতি উচ্চমানের নৈতিক চরিত্রের অধিকারী একদল লোক আপনি কোথা থেকে সৃষ্টি করবেন? যেখানে হযরত আবু বকর, হযরত ওমর এবং হযরত ওসমানের মতো তুলনাহীন মনীষীদের হতে ঐ রাষ্ট্রটি মাত্র কয়েক বছরের বেশী টিকেনি। আজ চৌদ্দশ বছর পর এমন কোন উপযুক্ত পরিবেশ আপনি লক্ষ্য করছেন, যার ভিত্তিতে আপনার দুরদৃষ্টি হুকুমতে ইলাহিয়া বাস্তবসম্মত মনে করছেন? একথা সত্য যে, আপনার পয়গাম সব মত ও পথের মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। মুসলমানদের সাথে আমার যতো মেশার সুযোগ হয়েছে, তাতে আমি দেখেছি তারা আপনার চিন্তার প্রতি সহানুভূতিশীল। তারা বলছে : আপনি যা কিছু বলছেন সেটাই প্রকৃত ইসলাম। কিন্তু প্রত্যেকের মনে সে একই প্রশ্ন যা আমি আপনার সামনে পেশ করলাম। অর্থাৎ খিলাফতে রাশেদার সে আদর্শ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে সেরূপ উচ্চমানের লোক আপনি কোথায় পাবেন? তাছাড়া এ তুলনাহীন উচ্চমানের লোকেরাই যখন ঐ রাষ্ট্রটিকে অর্ধ শতাব্দীও সাফল্যের সাথে চালাতে পারেনি, তখন এ যুগে সে ধরণের রাষ্ট্রের চিন্তা একটি অবাস্তব আশা ছাড়া আর কি হতে পারে?
এছাড়া আরেকটি কথাও নিবেদন করতে চাই
কিছুকাল পূর্বে আমার ধারনা ছিলো, আমরা হিন্দুরা এমন একটি জাতি যাদের সম্মুখে কোনো একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বর্তমান নেই। অথচ মুসলমানদের সামষ্টিক ও সংঘবদ্ধ জীবন রয়েছে এবং তাদের সম্মুখে রয়েছে একটি মাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। কিন্তু এখন ইসলামী রাজনীতির গভীর অধ্যয়নের ফলে জানতে পারলাম যে, ওখানকার অবস্থা আমাদের চেয়েও করুণ। বাস্তব অবস্থা আপনার নিকট গোপন নয়। একজন সত্যসন্ধানী হিসেবে আমি বিভিন্ন ধ্যান ধারণার মুসলিম নেতৃবৃন্দের নিকট তাদের উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থা সম্পর্কে কতিপয় বিষয়ের জবাব চেয়ে পাঠাই। তাদের জবাব আমার হাতে পৌছার পর আমার পূর্ব ধারণা ভ্রন্ত প্রমাণ হয়েছে। এখন আমি জানতে পারলাম, মুসলমানদের মধ্যেও কর্মপন্থা ও উদ্দেশ্য লক্ষ্যের ব্যাপারে সাংঘাতিক মতবিরোধ রয়েছে। [প্রশ্নকারী এখানে জামায়াতে ইসলামীর সাথে মতবিরোধ রাখেন এমন কতিপয় ব্যক্তির লেখা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করেন।]
দেখলেন তো আপনাদের একই আকীদা বিশ্বাসের নেতাগণ কতো কঠিন মতবিরোধে নিমজ্জিত। এসব বাস্তব সত্যকে উপেক্ষা করে কোন কিছু কেবল বইয়ের পৃষ্ঠায় মতাদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করা এক জিনিস আর সেটার বাস্তবায়ন একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। রাজনীতি একটা বাস্তব সত্য ব্যাপার। এটাকে কোনো অনস্থাতেই অস্বীকার করা যেতে পারে না। আমার এ গোটা নিবেদনকে সামনে রেখে আপনি আপনার কর্মপন্থা ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত করাবেন কি?
জাবাব
আপনার প্রশ্নাবলীর মূল টার্গেট এখনো আমার কাছে পৌছায়নি। এ করণে যে জবাব দিচ্ছি সেগুলো থেকে আপনার আরো এমন কিছু প্রশ্ন সৃষ্টি হচ্ছে, যেগুলো সৃষ্টি হওয়ার অবকাশ আমার কাছে নেই। আপনি যদি মৌলিক বিষয় থেকে প্রশ্ন আরম্ভ করেন, অতপর শাখা প্রশাখা এবং সমসাময়িক রাজনীতির [Current politics] দিকে প্রত্যাবর্তন করেন, তাবে আপনি আমার জবাবের সাথে পূর্ণ একমত না হলেও অন্ততপক্ষে আমাকে পরিস্কারভাবে বুঝতে পারবেন। এখন তো আমার মনে হয়, আমার পজিশন আপনার নিকট পুরোপুরি স্পষ্ট নয়।
আপনি লিখেছেন, আপনি যে ইসলামী রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখলেন, তাতে “যিম্মী এবং আহলে কিতাবের পজিশন তাই হবে, যা নাকি হিন্দুদের মধ্যে অচ্ছ্যুতদের।” বাক্যটি দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। আমি স্পষ্টভাবে লেখার পরও আপনি হয়তো ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকদের পজিশন সম্পর্কে বুঝতে পারেননি। নয়তো হিন্দু সমাজে অচ্ছ্যুতদের পজিশন সম্পর্কে আপনি ওয়াকিফহাল নন। প্রথম কথা, অচ্ছ্যুতদের যে পজিশন মনুর ধর্মশাস্ত্র থেকে জানা যায়, তার সাথে ঐ সকল অধিকার ও সুযোগ সুবিধার কোনো সম্পর্ক নেই, ইসলামী ফিকহ শাস্ত্রে যা যিম্মীদের প্রদান করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এ অস্পৃশ্যবাদের ভিত্তি হচ্ছে বংশগত তারতম্য। পক্ষান্তরে যিম্মীর ভিত্তি হচ্ছে আদর্শ ও বিশ্বাস। কোনো যিম্মী ইসলাম গ্রহণ করলে তিনি আমাদের নেতা এবং রাষ্ট্রপ্রধান পর্যন্ত হতে পারেন। কিন্তু শুদ্র তার বিশ্বাস এবং মত ও পথ পরিবর্তনের পরও কি অরুণ আশ্রমের বিধি নিষেধ থেকে মুক্ত হতে পারে?
আপনি প্রশ্ন করেছেন, “কোনো হিন্দু কি হিন্দু থেকেও আপনাদের রাষ্ট্রীয় আদর্শের প্রতি ঈমান এনে তা পরিচালনায় অংশ গ্রহণ করতে পারবে?” আপনার এ প্রশ্ন খুবই বিস্ময়কর। সম্ভবত আপনি চিন্তা করে দেখেননি যে, ইসলামী রাষ্ট্রের আদর্শেরহ প্রতি ঈমান আনার পর হিন্দু আর হিন্দু থাকবে না, বরঞ্চ সে মুসলমান হয়ে যাবে। এ দেশের কোটি কোটি মুসলমান তো আসলে হিন্দুরই সন্তান। ইসলামী আদর্শের প্রতি ঈমান আনার ফলেই তারা মুসলমান হয়েছে। এমনি করে ভবিষ্যতেও যেসব হিন্দুর সন্তান এ আদর্শ গ্রহণ করবে, তারাও মুসলমান হয়ে যাবে। আর তারা যখন মুসলমান হয়ে যাবে, তখন অবশ্যি ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা আমাদের সংগে সমান অংশীদার হবে।
ইসলামী রাষ্ট্রে হিন্দুরা তাদের ধর্ম প্রচারের সুযোগ পাবে কি? আপনার এ প্রশ্নটি যতোটা সংক্ষিপ্ত তার জবাব ততোটা সংক্ষিপ্ত নয়। প্রচার কাজ কয়েক প্রকারের হতে পারে। এক প্রকার হচ্ছে এই যে, কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠী তার ভবিষ্যত বংশধর এবং নিজ জনগণকে নিজস্ব ধর্মের শিক্ষা প্রদান করবে। সকল প্রকার যিম্মীরাই এমনটি করার অধিকার লাভ করবে। দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে, কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় লেখনী কিংবা বক্তৃতার মাধ্যমে নিজ ধর্মকে অন্যান্য সম্প্রদায়ের নিকট পেশ করবে এবং ইসলামসহ অন্য সকল ধর্মের সাথে তাদের মতভেদের কারণ জ্ঞানের যুক্তিতে পেশ করবে। এর অনুমতিও যিম্মীদের প্রদান করা হবে। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের অধিবাসী থাকা অবস্থায় আমরা কোনো মুসলমানকে নিজের ধর্ম পরিবর্তনের অনুমতি দেবো না। তৃতীয় প্রকার হচ্ছে, কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় নিজেদের ধর্মীয় আদর্শের ভিত্তিতে এ উদ্দেশ্যে কোনো সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তুলবে যে বর্তমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করে ইসলামী আদর্শের পরিবর্তে তার নিজের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করবে, আমাদের রাষ্ট্রীয় সীমার মধ্যে এরূপ প্রচার কার্যের অধিকার কাউকেও প্রদান করবো না। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা সম্বলিত আমার প্রবন্ধ ইসলামে মুরতাদ হত্যার নির্দেশ’ দেখে নিন। [প্রবন্ধটি পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়েছে।]
মুসলমানদের জন্য আহলে কিতাবের নারীদের বিয়ে করা বৈধ হওয়া এবং আহলে কিতাবের জন্যে মুসলিম নারীদের বিয়ে অবৈধ হওয়ার ভিত্তি এক নিগূঢ় সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। পুরুষরা সাধারনত প্রভাবিত হয কম এবং প্রভাব বিস্তার করে অধিক। আর নারীরা সাধারণত প্রভাবিত হয় বেশী এবং প্রভাব বিস্তার করে কম। একজন অমুসলিম নারী যদি মুসলমানের সংগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তবে তার দ্বারা এ মুসলমান ব্যক্তিকে অমুসলিম বানানোর আশংকা খুবই কম, বরঞ্চ তারই মুসলমান হযে যাবার সম্ভাবনা বেশী। কিন্তু একজন মুসলিম নারী কোনো অমুসলিম ব্যক্তির বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে তার অমুসলিম হয়ে যাবার আশংকাই বেশী এবং তার স্বামী ও সন্তানদের মুসলমান বানাতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম। এ জন্যে নিজ কন্যাদের অমুসলিমদের নিকট বিয়ে দেবার অনুমতি মুসলমানদের দেয়া হয়নি। অবশ্য আহলে কিতাবের কোনো ব্যক্তি নিজ কন্যাকে কোনো মুসলমানের নিকট বিয়ে দিতে রাজী হলে সে তাকে বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু কুরআনের যে স্থানে এ অনুমতি প্রদান করা হয়েছে সেখানে এ ধমকও দেয়া হয়েছে যে, তোমরা যদি অমুসলিম স্ত্রীদের প্রেমে বিগলিত হয়ে নিজেদের দ্বীন খুইয়ে ফেলো তবে তোমাদের সমস্ত সৎকর্ম বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকবে। তাছাড়া এ অনুমতি কেবল বিশেষ প্রয়োজনের সময়ই কার্যকর করা যাবে। এটা কোনো সাধারণ অনুমতি নয় এবং পছন্দনীয় কাজও নয়, বরঞ্চ কোনো অবস্থায় তো এ কাজ করতে নিষেধও করা হয়েছে, যাতে মুসলিম সোসাইটিতে অমুসলিম লোকদের আনাগোনার ফলে কোনো অনাকাংখিত নৈতিক ও ধ্যান ধারণার বিকাশ ও লালন হতে না পারে।
ইসলামী রাষ্ট্র কেন মাত্র ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরের বেশী টিকেনি আপনার এ প্রশ্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত। আপনি যদি খুব মনোযোগের সাথে ইসলামের ইতিহাস অধ্যয়ন করেন, তবে এর কারণসমূহ অনুধাবন করা আপনার জন্য কোনো কঠিন ব্যাপার হবে না। কোন আদর্শের পতাকাবাহী দল যে জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে তা তার পরিপূর্ণ মর্যাদার সাথে পরিচালিত হওয়া এবং টিকে থাকার জন্যে প্রয়োজন এর নেতৃত্ব এমন বাছাইকৃত লোকদের হাতে থাকা যারা হবে সে আদর্শের প্রকৃত ও পরিপূর্ণ অনুসারী। আর এ ধরনের লোকদের হাতে নেতৃত্ব কেবল সে অবস্থায়ই থাকতে পারে, যখন সাধারণ লোকদের উপর এদের প্রভাব বজায় থাকবে এবং সাধারণ নাগরিকদের একদল বিরাট সংখ্যক লোক এতোটা শিক্ষা দীক্ষা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হবে, যাতে করে এ আদর্শের সাথে তাদের গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তারা ঐসব লোকদের কথা শুনতে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে যায় যারা তাদেরকে তাদের এ নির্দিষ্ট আদর্শের বিপরীত অন্য কোনো পথে চালাতে উদ্যত হয়। একথা ভালোভাবে বুঝে নেয়ার জন্য ইসলামের ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে একটি সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত হয়ে যে নতুন জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, তার বুনিয়াদী কথা এ ছিলো যে, আরব ভূখণ্ড এক প্রকার নৈতিক বিপ্লব সাধিত হয়েছে এবং নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বে সৎ লোকদের যে ছোট দলটি তৈরী হয়েছিলো, গোটা আরব বাসী তার নেতৃত্ব কবুল করে নিয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীকালে খিলাফতে রাশেদার যুগে যখন দেশের পর দেশ জয় হতে লাগলো, তখন যতোটা দ্রুত ইসলামী রাজ্যের চৌহদ্দী বিস্তৃত হতে থাকলো, আদর্শিক মজবুতি ততোটা দ্রুততার সাথে এগুলো সম্ভব হয়নি। সে যুগে যেহেতু প্রচার প্রকাশনা এবং প্রচার ও প্রশিক্ষণের ব্যাপক কোনো মাধ্যম ছিলো না, যেমনটি রয়েছে বর্তমানে, সে যুগে বর্তমানকালের মতো যানবাহনও যেহেতু ছিল না, এসব কারণে তখন যেসব লোক দলে দলে ইসলামী সমাজে প্রবেশ করছিলো নৈতিক, মানসিক এবং আমলী দিক থেকে তাদের পূর্ণাংগভাবে ইসলামী আন্দোলনের ছাচে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। এর ফলে সাধারণ মুসলমান বাসিন্দাদের মধ্যে খাটি ধরনের মুসলমানদের সংখ্যা আনুপাতিক হারে একেবারে কম হয়ে যায় এবং কাচা ধরনের মুসলমানদের আনুপাতিক হার বিপুল সংখ্যায় বেড়ে যায়। কিন্তু আদর্শিক দিক দিয়ে মুসলমানদের ক্ষমতা, অধিকার এবং মর্যাদা খাটি ধারনের মুসলমানদের তুলনায় ভিন্নতর হওয়া মোটেই সম্ভব ছিলো না। এ কারণে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর খিলাফতকালে যখন প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলসমূহের [অর্থাৎ যেসব আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিলো ইসলাম থেকে প্রত্যাবর্তন করে কোনো না কোনো জাহেলিয়াতের দিকে ফিরে যাওয়া।] [Reactionary Movements] ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়, তখন সাধারণ মুসলমানদের এক বিরাট অংশ তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে এবং যারা বিশুদ্ধ ইসলামী পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতা রাখতেন তাদের হাত থেকে নেতৃত্ব ছুটে যায়। এ ঐতিহাসিক নিগূঢ় সত্যকে উপলব্ধি করার পর খালিস ইসলামী রাষ্ট্র ত্রিশ পয়ঁত্রিশ বছরের বেশী টিকে ছিলো না সে প্রশ্ন জাগ্রত হবার কোনো অবকাশই থাকে না।
আজো যদি আমরা সৎ লোকদের এমন একটি দলকে সুসংগঠিত করতে পারি, যাদের ধ্যাণ ধারণা ও মানসিকতা এবং সীরাত ও নৈতিক চরিত্র হবে ইসলামের বাস্তব নমুনা, তবে আমি আশা রাখি আধুনিক উপায় উপকরণ ব্যবহার করে আমরা শুধু আমাদের দেশেই নয়, বরঞ্চ অন্যান্য দেশেও একটি নৈতিক ও সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করতে সক্ষম হবো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে যে, এমন লোকদের একটি শক্তিশালী সংগঠন কায়েম হয়ে যাবার পর সাধারণ মানুষের নেতৃত্ব তাদের ছাড়া অন্য কোন পার্টির হাতে যেতে পারে না। মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা থেকে আপনি যে মত প্রতিষ্ঠা করেছেন, ঐ উজ্জ্বল অবস্থার সংগে তার তুলনা হতে পারে না যা আমাদের সম্মুখে রয়েছে।
বিশুদ্ধ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী লোকেরা বাস্তব ময়দানে নেমে এলে শুধু মুসলমান জনসাধারণেরই নয়, বরঞ্চ হিন্দু, খৃষ্টান, পারসিক, শিখ সকলেই তাদের ভক্ত অনুরক্ত হয়ে যাবে এবং নিজেদের ধর্মীয় নেতাদের ত্যাগ করে এদের প্রতি আস্থাশীল হয়ে যাবে। শিক্ষা দীক্ষা দিয়ে সুসংগঠিত করার মাধ্যমে এমন একদল লোক তৈরী করার কাজ এখন আমি হাতে নিয়েছি। আমি আল্লাহর নিকট বিনয়াবনত হয়ে দোয়া করুছি, তিনি যেনো এ কাজে আমাকে সাহায্য করেন।
খ. ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার
প্রশ্ন : ইসলামী রাষ্ট্রে খৃষ্টান হহুদী, বৌদ্ধ, জৈন, পারসিক প্রভৃতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কি মুসলমানদের মতো যাবতীয় অধিকার ভোগ করতে পারবে? আজকাল পাকিস্তান এবং অন্যান্য দেশে যেভাবে এসব সম্প্রদায়ের লোকেরা অবাধে ধর্ম প্রচারে লিপ্ত, ইসলামী রাষ্ট্রে কি তারা তেমনিভাবে নিজ নিজ ধর্ম প্রচার করতে পারবে? মুক্তিফৌজ [Salvation Army] ক্যাথড্রোল, কনভেন্ট, সন্ট জন, সেন্ট ফ্রান্সিস ইত্যাদির ধর্মীয় অথবা আধা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কি আইন প্রয়োগ করে বন্ধ করে দেয়া হবে? [সম্প্রতি শ্রীলংকায় অথবা অন্যান্য দুএকটি দেশে যেমন হয়েছে] অথবা মুসলমান শিশুদের কি ঐসব প্রতিষ্ঠানে অবাধে আধুনিক শিক্ষা লাভের অনুমতি দেয়া হবে? এই শতাব্দীতেও এসব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছ থেকে জিযিয়া আদায় করা সতীচীন হবে কি [বিশ্ব মানবাধিকার সনদের আলোকে বিবেচ্য]? বিশেষত তারা যখন সেনাবাহিনী ও সরকারী চাকরীতে নিয়োজিত এবং সরকারের অনুগত?
জবাব : ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম সম্প্রদায়গুলো সকল নাগরিক অধিকার [Civil rights] মুসলমানদের মতোই ভোগ করবে। তবে রাজনৈতিক অধিকার [Political Rights] তারা মুসলমানদের সমকক্ষ হতে পারে না। কারণ ইসলামে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন চালানো মুসলমানদের দায়িত্ব। মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেখানেই তারা শাসন ক্ষমতার অধিকারী হবে, সেখানে যেনো তারা কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা মুতাবিক সরকারী প্রশাসন চালায়। যেহেতু অমুসলিমরা কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষাও মানে না, তার প্রেরণ ও চেতনা অনুসারে বিশ্বস্ততার সাথে কাজ করতেও সক্ষম নয়, তাই তাদেরকে এ দায়িত্বে অংশীদার করা চলে না। তবে প্রশাসনে এমন পদ তাদেরকে দেয়া যেতে পারে, যা রীতিনির্ধারক পদ নয়। এ ব্যাপারে অমুসলিম সরকারগুলোর আচরণ হয়ে থাকে মুনাফিকী ও ভন্ডামীতে পরিপূর্ণ। কিন্তু ইসলামী সরকারের আচরণ হয়ে থাকে নিরট সততার প্রতীক। মুসলমানরা তাদের এ নীতি খোলাখুলিভাবে জানিয়ে দেয়া এবং এর প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের বেলায় আল্লাহর কাছে জবাবদিহির অনুভূতি নিয়ে মুসলিম নাগরিকদের সাথে সর্বোচ্চ উদারতা ও ভদ্রতার আচরণ করে থাকে। আর অমুসলিমরা বাহ্যত লিখিতভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে [National minirities] যাবতীয় অধিকার প্রদান করে বেটে, কিন্তু আস্তব মানবিক অধিকারও দেয় না। এতে যদি কারো সংশয় থাকে, তবে সে যেনো আমেরিকায় নিগ্রোদের সাথে, রাশিয়ায় অকম্যুনিষ্টদের সাথে এবং চীন ও ভারতের মুসলমানদের সাথে কি আচরণ করা হচ্ছে তা দেখে নেয়। অনর্থক অন্যদের সামনে লজ্জাবোধ করে আমাদের নিজস্ব নীতি খোলাখুলি বর্ণনা না করা এবং সে অনুসারে দ্বিধাহীন চিত্তে কাজ না করার কি কারণ থাকতে পারে তা আমার বুঝে আসে না।
অমুসলিমদের ধর্ম প্রচারের ব্যাপারটা অবশ্য আলাদা। এটা আমাদের ভালোভাবে বুঝে নেয়া দরকার যে, আমরা যদি একেবারে আত্মহত্যার জন্য প্রস্তুত না হই, তাহলে আমাদের দেশে অমসলিমদের ধর্ম প্রচারের অনুমতি দিয়ে শক্তিশালী সংখ্যালঘু সম্প্রদায় গড়ে উঠতে দেয়ার মতো নির্বুদ্ধিতার কাজ করা সংগত হবে না। বিদেশী পুঁজির দুধ কলা খেয়ে ও বিদেশী সরকারের আস্কারা পেয়ে সংখ্যালঘুরা লালিত পালিত হোক এবং শক্তি ও সংখ্যা বৃদ্ধি করে ফুলে ফেপে উঠে তুরস্কের মতো সংখ্যালঘু খৃষ্টানরা আমাদেরকেও সংকটে ফেলে দিক, এটা কিছুতেই হতে দেয়া হবে না।
খৃষ্টান মিশনারীদের এখানে বিদ্যালয় ও হাসপাতাল চালু রেখে মুসলমানদের ঈমান খরিদ করার এবং মুসলমানদের নতুন বংশধরদেরকে আপন জাতীয় ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করার [De-nationalise] অবাধ অনুমতি দেয়াও আমার মতে জাতীয় আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের শাসকরা এ ব্যাপারে চরম অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। নিকটবর্তী উপকারিতা তো তাদের বেশ চোখে পড়ে কিন্তু সদূর প্রসারী কুফল তারা দেখতে পায় না।
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের কাছ থেকে জিযিয়া আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয় কেবল তখনই, যখন তারা বিজিত হয় অথবা কোনো চুক্তির ভিত্তিতে জিযিয়া দেয়ার সুস্পষ্ট শর্ত অনুসারে তাদেরকে ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব দেয়া হয়। পাকিস্তানে যেহেতু এই দুই অবস্থার কোনোটাই দেখা দেয়নি, তাই এখানে অমুসলিমদের ওপর জিযিয়া আরোপ করা শরীয়তের বিধান অনুসারে জরুরী নয় বলে আমি মনে করি। [তরজমানুল কুরআন, অক্টোবর ১৯৬১]
— সমাপ্ত —