৩. মুসলিম ফকীহদের সমর্থন
হিজরী প্রথম শতাব্দীতে অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে যে আইন প্রণীত হয়েছিল, ওপরের আলোচনায় তার কিছু বিশদ বিবরণ দেয়া হলো। পরবর্তী আলোচনায় পরবর্তী রাজতন্ত্রের যুগে যখনই অমুসলিমদের সাথে অবিচার করা হয়েছে, তখন মুসলিম ফকীহগণ সর্বাগ্রে মযলুম অমুসলিমদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। ইতিহাসের প্রসিদ্ধ ঘটনা যে, উমাইয়া শাসক ওলীদ বিন আবদুল মালেক দামেস্কের ইউহান্না গীর্জাকে জোর পূর্বক খৃষ্টাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মসজিদের অন্তর্ভক্ত করে নিয়েছিলেন। হযরত ওমর বিন আবদুল আযীয ক্ষমতায় এলে খৃষ্টানরা এ ব্যাপারে তাঁর কাছে অভিযোগ দায়ের করলো। তিনি সংশিষ্ট কর্মকর্তাকে লিখে পাঠালেন, “মসজিদের যে টুকু অংশ গীর্জার জায়গার ওপর নির্মান করা হয়েছে তা ভেংগে খৃষ্টানদের হাতে সোপর্দ করে দাও”
ওলীদ বিন ইয়াযীদ রোমক আক্রমণের ভয়ে সাইপ্রাসের অমুসলিম অধিবাসীদের দেশ থেকে বহিষ্কার করে সিরিয়ায় পুনর্বাসিত করেন। এতে মুসলিম ফকীহগণ ও সাধারণ মুসলমানরা ভীষণভাবে বিক্ষুব্ধ হন এবং তারা একে একটা মস্তবড় গুনাহর কাজ বলে আখ্যায়িত করেন। এরপর যখন ওলীদ বিন ইয়াযীদ পুনরায় তাদের সাইপ্রাসে নিয়ে পুনর্বাসিত করলেন, তখন তার প্রশংসা করা হয় এবং বলা হয়, এটাই ইনসাফের দাবী। ইসমাঈল বিন আইয়াশ বলেন :
“মুসলমানরা তার এ কাজে কঠোর অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং ফকীহগণ একে গুনাহর কাজ মনে করেন। অতপর যখন ইয়াযীদ খলীফা হলেন এবং তাদের আবার সাইপ্রাসে ফেরত পাঠালেন। তখন মুসলমানরা এ কাজ পছন্দ করেন এবং একে ন্যায়বিচার আখ্যায়িত করেন”। [ফুতূহুল বুলদান, পৃষ্ঠা ১৫৬]
ঐতিহাসিক বালায়ুরী বর্ণনা করেন, একবার লেবাননের পার্বত্য এলাকার অধিবাসীদের মধ্য থেকে একটি গোষ্ঠী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সালেহ বিন আবদুল্লাহ তাদের দমন করার জন্য একটি সেনাদল পাঠান এই সেনাদল উক্ত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সকল সশস্ত্র পুরুষদের হত্যা করে এবং বাদবাকীদের একদলকে দেশান্তরিত করে ও অপর দলকে যথাস্থানে বহাল রাখে। উমাম আওয়ামী যখন জীবিত ছিলেন। তিনি সালেহকে এই যুলুমের জন্য তিরস্কার করেন এবং একটা দীর্ঘ পত্র লেখেন। পত্রটির অংশ বিশেষ নিম্নে দেওয়া হলো :
“লোবানন পর্বতের অধিবাসীদের বহিস্কারের ঘটনাটা তোমার অজানা নয়। তাদের ভেতরে এমনও অনেকে আছে, যারা বিদ্রোহীদের সাথে মোটেই অংশ গ্রহন করেনি। তথাপি তুমি তাদের কতককে হত্যা করলে এবং কতককে তাদের বাসস্থানে ফেরত পাঠিয়েদিলে। আমি বুঝি না, কতিপয় বিশেষ অপরাধীর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের শাস্তি, সাধারাণ মানুষকে কিভাবে দেয়া যায় এবং তাদের সহায় সম্পত্তি থেকে তাদের কিভাবে উত্খাত করা যায়? অথচ আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশ এই যে, একজনের পাপের বোঝা আরেকজন বহন করবে না।’ এটা একটা অবশ্য করণীয় নির্দেশ। তোমার জন্য আমার সর্বোত্তম উপদেশ হলো, তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই কথাটা মনে রেখো যে, ‘যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিচদ্ধ অমুসলিম নগরিকের ওপর যুলুম করবে এবং তাদের সামর্থের চেয়ে বেশী তার ওপর বোঝা চাপাবে, তার বিরুদ্ধে আমি নিজেই ফরিয়াদী হবো।” [ফুতূহুল বুলদান, পৃষ্ঠা ১৬৯]
ইতিহাসে এ ধরণের অসংখ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এ সব দৃষ্টান্ত থেকে বুঝা যায় যে, মুসলিম আলেম সমাজ চিরদিনই অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণে সোচ্চার থেকেছেন। কখনো কোনো রাজা বা শাসক তাদের ওপর যুলুম ও বাড়াবাড়ি যদি করে থাকে, তবে তত্কালে ইসলামী আইনের যেসব রক্ষক বেঁচে ছিলেন, তারা কখনো সেই যালিমকে তিরস্কার না করে ছাড়েননি।