সংযোজন-২
নাগরিকত্ব ও তার ভিত্তি
এখন নাগরিত্বের বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। ইসলাম যেহেতু চিন্তা ও কর্মের একটি পূর্ণঙ্গ ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থার ভিত্তিতে সে একটি রাষ্ট্রও কায়েম করে। তাই ইসলাম তার রাষ্ট্রের নাগরিকত্বকে দুই শ্রেনীতে বিভক্ত করে। উপরন্তু সততা ও ন্যায় পরায়ণতা যেহেতু ইসলামের মূল প্রাণসত্তা, তাই কোনো প্রকার ধোঁকা বা প্রতারনা ব্যতিরেকেই সে নাগরিকত্বের এই দুই শ্রেণীকে সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছে। মুখে মুখে সকল নাগরিককে সমান মর্যাদা দানের কথা বলে এবং কার্যত তাদের মধ্যে কেবর পার্থক্য করেই নয় বরং তাদের বিরাট অংশকে মানবীয় অধিকার দিতে কুণ্ঠিত হওয়ার মতো মারাত্মক প্রতারণা কিছুতেই ইসলাম করতে পারে না। যেমন আমেরিকায় নিগ্রোদের, রাশিয়ায় অ-কমিউনিষ্টদের এবং দুনিয়ার সমস্ত ধর্মহীন গণতন্ত্রের [Secular Democracy] রাষ্ট্রে দেশের সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার বর্জিত দুরাবস্থার কথা দুনিয়ার কার না জানা আছে?
ইসলাম নাগরিকদের নিম্নোক্ত দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেছে :
১. মুসলিম
২. জিম্মী [অমুসলিম]
মুসলিম নাগরিকদের সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হয়েছে :
“যারা ইমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং নিজেদের জানমাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে; আর যারা তাদের আশ্রয় দিয়েছে এবং তাদের সাহায্য করেছে, তারা একে অপরের বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক। প্রক্ষান্তরে যারা [শুধু] ইমান এনেছে কিন্তু হিজরত করে [দারুল ইসলাম] চলে আসেনি, তাদের বন্ধুতা ও পৃষ্ঠপোষকতার দয়িত্ব তোমাদের নয়- যতক্ষণ না তারা হিজরত করলো।“ [সূরা আনফাল : ৭২]
এ আয়াতে নাগরিকত্বের দুইটি ভিত্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম ঈমান, দ্বিতীয় দারুল ইসলামের [ইসলামী রাষ্ট্রের] প্রজা [পূর্ব থেকেই কিংবা পরে] হওয়া। একজন মুসলমান তার ইমান আছে; কিন্তু কাফেরী রাজ্যের আনুগত্য ত্যাগ করে হিজরত তরে দারুল ইসলামের নাগরিক বরে বিবেচিত হতে পারে না। পক্ষান্তরে দারুল ইসলামের সকল ইমানদার বাসিন্দাগণ দারুল ইসলামের নাগরিক, তাদের জন্ম দারুল ইসলামে হোক কিংবা দারুল কুফর থেকে হিজরত করেই আসুক এবং তারা পরস্পর পরস্পরের সাহায্যকারী ও সহযোগী।[হিজরত করে যারা আসে তাদের সম্পর্কে কুরআন একটি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বনের কথা বলেছে, যে, এই ধরণের লোকদের পরীক্ষা [Examine] করে দেখা আবশ্যক [সুরা মুমতাহিনা, ১০ নং আয়াত দ্র.] এই ব্যবস্থা যদিও মুহাজির স্ত্রীলোকদের ব্যাপারে বর্ণনা করা হয়েছে, কিন্তু তা থেকে এই সাধারন মূলনীতি জানা যায় না। বহিরাগত ও হিজরতের দাবিদার ব্যক্তিকে দারুল ইসলামে গ্রহণ করার পূর্বে তার প্রকৃত মুসলমান ও মুহাজির হওয়া সম্পর্কে নিশ্চয়তা লাভ করতে হবে। যাতে করে হিজরতের সুযোগ ভিন্ন উদ্দেশ্য সম্পন্ন কোনো লোক আল্লাহ ভিন্ন আর কেউ জানতে পারে না, কিন্তু ব্যহ্যিক উপায়ে যতদূর যাচাই করা সম্ভব তা করতে হবে।]
এই মুসলিম নাগরিকদের উপরই ইসলাম তার পরিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার দায়িত্বভার চাপিয়ে দিয়েছে। কারণ তারাই নীতিগতভাবে এই ব্যবস্থাকে সত্য বলে মানে। তাদের উপর ইসলাম তার পরিপূর্ণ আইন জারী করে, তাদেরকেই তার সমগ্র ধর্মীয়, নৈতিক, তামাদ্দুনিক এবং রাজনৈতিক বিধানের অনুসারী হতে বাধ্য করে। তার যাবতীয় কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের ভারও সে তাদের উপরও অর্পণ করে। দেশ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার জন্য সকল প্রকার কুরবানী সে কেবল তাদের নিকটই দাবী করে। অতপর সে এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধান ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা নির্বাচনের অধিকারও তাদেরই দান করে এবং তার পরিচালনার জন্য সংসদে অংশ গ্রহণ এবং তার দায়িত্বপূর্ণ পদসমূহে নিযুক্ত হওয়ার সুযোগও তারাই লাভ করে। যাতে এই আদর্শবাদী রাষ্ট্রের কর্মসূচী তার মূল নীতিসমূহের সাথে সংগতি রেখে বাস্তবায়িত হতে পারে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনকাল এবং খিলফতে রাশেদার স্বর্ণ যুগ উল্লেখিত মূলনীতি সত্যতা ও যৌক্তিকতার দৃষ্টান্ত। যেমন এ সময় শূরার সদস্য হিসেবে কোনো প্রদেশের গভর্ণর হিসেবে কিংবা সরকারী কোনো বিভাগের মন্ত্রী, সেক্রেটারী, বিচারক বা সৈন্য বাহিনীর অধিকানয়ক হিসেবে কোনো যিম্মীকে নিযুক্ত করা হয়নি। অথচ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগেও ইসলামী রাষ্ট্রে তারা বর্তমান ছিলো। একথা আমাদের বুঝে আসেনা যে, এসব রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাদের অংশ গ্রহনের যদি কোনো অধিকারও থাকতো, তবে আল্লাহর নবী তাদের সে অধিকার কিভাবে হরণ করতে পারেন এবং স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট সরাসরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকগণ ক্রমাগভাবে ত্রিশ বছর পর্যন্ত কেমন করে তাদের অধিকার আদায় না করে থাকতে পারেন।
২. যিম্মী নাগরিক বলতে সেসব অমুসলিমকে বোঝায়ে যারা ইসলামী রাষ্ট্রের চতুর্সীমার মধ্যে বসবাস করে তার আনুগত্য ও আইন পালন করে চলার অংগীকার করবে, চাই তারা দারুল ইসলামে জন্ম গ্রহণ করে থাকুক কি বাইরের কোনো কাফের রাজ্যে [দারুল কুফর] থেকে এসে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রজা হওয়ার আবেদন করে থাকুক। এই দিক দিয়ে তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা যায় না। ইসলাম এই শ্রেনীর নাগরিকদের ধর্ম, সংস্কৃতি, ব্যক্তি আইন [Personal Law] এবং জান মাল ও সম্মানের পূর্ণ নিরাপত্তা দান করে। তাদের উপর রাষ্ট্রের কেবল গণআইন [public Law] জারী করা হবে। এই গণআইনের দৃষ্টিতে তাদেরকেও মুসলমান নাগরিকদের সমান অধিকার ও মর্যাদা দেয়া হয়। দায়িত্ব পুর্ণ পদ [Key post] ব্যতীত সকল প্রকার চাকরিতেও তাদের নিযুক্ত করা যাবে। নাগরিক স্বাধীনতাও তারা মুসলমনাদের সমান ভোগ করবে, অর্থনৈতিক ব্যাপারেও তাদের সাথেও মুসলমানদের অপেক্ষা কোনরূপ স্বতন্ত্র আচরণ করা হয় না। রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দায়িত্ব থেকে তাদেরকে অব্যহতি দিয়ে তা সম্পুর্ণরূপে মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
এই দুই শ্রেণীর নাগরিকত্ব ও তার পৃথক পৃথক মর্যাদা সম্পর্কে কারো আপত্তি থাকলে সে যেনো পৃথিবীর অন্যান্য আদর্শবাদী রাষ্ট্র অথবা জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র তার মুলনীতিসমূহ মানতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী সংখ্যালঘু নাগরিকদের প্রতি যে আচরণ করে সে দিকে দৃষ্টিপাত করে। বাস্তবিকই এ কথা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা যায় যে, একটি রাষ্ট্রের মধ্যে তার মূলনীতির সম্পূর্ণ পৃথক মুলনীতিতে বিশ্বাসী, যা অনেক জটিলতার সৃষ্টি করে, ইসলামের চেয়ে অধিক ইনসাফ, সহিষ্ণুতা, উদারতা ও বদান্যতার সাথে অন্য কোনো ব্যবস্থা সে জটিলতার সমাধান করেনি। অন্যরা এ জটিলতার সমাধান প্রায়ই দুইটি পন্থায় করেছে, হয় তাকে [সংখ্যালঘুকে] নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা করেছে অথবা শূদ্র বা অস্পৃশ্য শ্রেনী বানিয়ে রেখেছে। ইসলাম উপরোক্ত পন্থায় পরিবর্তে তার নীতিমালা মান্যকারী ও অমান্যকারীদের মধ্যে ন্যায়ানুগ একটি সীমা নির্ধারন করে দেয়ার পন্থা গ্রহণ করেছে। ইসলাম তার অনুসারীদেরকে তার নীতিমালা পূর্ণরূপে অনুসরণ করতে বাধ্য করে এবং উক্ত নীতিমালা অনুযায়ী রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্বভার তাদের উপর অর্পন করে। আর যারা তার নীতিমালার অনুসারী নয় তাদেরকে সে দেশের প্রশাসন ব্যবস্থা বহাল রাখার জন্য অত্যাবশ্যক সীমা পর্যন্ত তার বিধান মানতে বাধ্য করে। ইসলাম তাদেরকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়ার সাথে সাথে তাদের যাবতীয় সাংস্কৃতিক ও মানবীয় অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করে।
নাগরিক অধিকার
এরপর আমাকে বলতে হবে যে, ইসলামে নাগরিকদের কি কি মৌলিক অধিকার [Fundamental Rights] স্বীকার করে নেয়া হয়েছে।
সর্ব প্রথম ইসলাম নাগরিকদেরকে জান মাল ও ইজ্জত আব্রুর পূর্ণ নিরাপত্তার অধিকার দান করেছে। আইন সংগত বৈধ কারণসমূহ ব্যতীত অন্য কোনো কারণে তাদের উপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রচুর সংখ্যক হাদীসে এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন। বিদায় হজ্জের প্রাক্কালে তিনি তাঁর সুপ্রসিদ্ধ ভাষণে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার নীতিমালা বর্ণনা করেছেন। সে ভাষণে তিনি বলেছেন :
“তোমাদের জান, তোমাদের মাল, তোমাদের মান সম্মান তদ্রুপ সম্মানার্হ যেমন আজকের এই হজ্জের দিনটি সম্মানার্হ।”
কেবল একটি অবস্থায় তা সম্মানার্হ থাকবে না। তা তিনি অপর এক হাদীস এভাবে বলেছেন :
“ইসলামী আইনের আওতায় কারো জান মাল অথবা ইজ্জত আব্রুর উপর কোনো হক [অধিকার] প্রমাণিত হলে আইন অনুমোদিত পন্থায় অবশ্যই তা আদায় করতে হবে।”
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হচ্ছে, যে কোনো নাগরিকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সংরক্ষণ। দেশে প্রচলিত এবং সর্বজন স্বীকৃতি আইন সংগত পন্থায় দোষ প্রমাণ না করে এবং আত্মপক্ষ সমর্থণের সুযোগ না দিয়ে ইসলাম কারও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হরণ করা যায় না। সুনানে আবু দাউদ-এর একটি হাদীসে বর্নিত হয়েছে :
একদা মদীনার কিছু সংখ্যাক লোক কোনো সন্দেহের কারণে বন্দী হয়েছিলো। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে নববীতে ভাষণদানরত অবস্থায় একজন সাহাবী দণ্ডায়মান হয়ে তাঁর নিকট আরজ করলেন, আমার প্রতিবেশীদেরকে কোন অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছে? মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রশ্নের প্রথম ও দ্বিতীয় বারে কোনো উত্তর না দিয়ে নীরব থাকলেন। শহরের পুলিশ প্রধানকে তাদের গ্রেপ্তারের সংগত কোনো কারণ থাকলে তা পেশ করার সুযোগ দেয়ার জন্য তিনি নিরুত্তর থাকলেন। ঐ সাহাবী তৃতীয় বার তাঁর প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলে এবং পুলিশ প্রধান নিরুত্তর থাকলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন :
“তার প্রতিবেশীদের ছেড়ে দাও।” [আবু দাউদ, কিতাবুল কাদা]
উপরোক্ত ঘটনা থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, কোনো সুনির্দিষ্ট অপরাধে দোষী সাব্যস্ত না করা পর্যন্ত কোনো নাগরিককে গ্রেপ্তার করা যাবে না। ইমাম খাত্তাবী (রা) তাঁর “মায়ালিমুস সুনান” গ্রন্থে উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন : “ইসলামে শুধু দুই প্রকারের গ্রেপ্তারী বৈধ। [এক] শাস্তি প্রদান করা হলে তাকে আটক করা। নিঃসন্দেহে এই আটক সম্পূর্ণ সংগত। [দুই] তদন্তের জন্য আটক করা অর্থাৎ অভিযুক্ত ব্যক্তি বাইরে থাকলে তদন্তকার্যে ব্যাহত হতে পারে এরূপ আশংকা থাকলে তাকে কায়েদ করা যেতে পারে। এতদ্ব্যতীত অন্য প্রকারের আটক বৈধ নয়।” [মায়ালিমুস সুনান, কিতাবুল কাদা]
ইমাম আবু ইউসুফ (র) তাঁর “কিতাবুল খারাজ” গ্রন্থে এই একই কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, কোনো ব্যক্তিকে নিছক সন্দেহের বশবর্তী হয়ে বন্দী করা যাবে না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেবল দোষারোপের ভিত্তিতেই কউকে বন্দী করতেন না। বাদী ও বিবাদী উভয়ই আদালতে হাযির হতে হবে। সেখানে বাদী দলীল প্রমানসহ তার দাবী উত্থাপন করবে। সে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থিত করতে ব্যর্থ হলে বিবাদীকে বেকসুর খালাস দিতে হবে। [কিতাবুল খারাজ, পৃ. ১০৭]
হযরত ওমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুও একটি মুকদ্দমার রায় দিতে গিয়ে ঘোষণা করেন :
“ইসলামে কোনো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে বন্দী করে রাখা যাবে না।” [মুত্তয়াত্তা ইমাম মালেক, বাব শারতিশ শাহিদ]
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকত অধিকার হচ্ছে, মত প্রকাশের এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বিষয়টি সম্পর্কে ইসলামী আইনের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। তার খিলাফত আমলে খারিজী সম্প্রদায়ের অভ্যুদয় হয়েছিলো। বর্তমানকালে নৈরাজ্যবাদী [Nihilist] দলসমূহের সাথে তাদের অনেকটা সামঞ্জস্য ছিলো। আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর খিলাফতকালে তারা প্রকাশ্যে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই অস্বীকার করতো এবং অস্ত্রবলে এর অস্তিত্ব বিলোপের জন্য বদ্ধপরিকর ছিলো। আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এই অবস্থায় তাদেরকে নিম্নোক্ত পয়গাম পাঠান :
“তোমরা যেখানে ইচ্ছা বসবাস করতে পরো। তোমাদের ও আমাদের মাঝে এই চুক্তি রইলো যে, তোমরা রক্তপাত করবে না, ডাকাতি করবে না এবং কারও উপর যুলুম করবে না।” [নায়লুল আওতার, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৩০]
অপর এক জায়গায় তিনি তাদের বলেন :
“তোমরা যতক্ষণ বিপর্যয় ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে না, ততক্ষন পর্যন্ত আমরা তোমাদের আক্রমণ করবো না।” [ নায়লুল আওতার, ৭ম খণ্ড, পৃ.,১৩৩]
উপরোক্ত বক্তব্য থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, কোনো দলের মতবাদ যাই হোক না কেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের মত যেভাবেই প্রকাশ করুক না কেন, ইসলামী রাষ্ট্র তাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। কিন্তু তারা যদি নিজেদের মত শক্তি প্রয়োগ [By violent Means] বাস্তবায়িত করতে এবং রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা চূর্ণ বিচূর্ণ করার চেষ্টা করে তবে তাদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আরও একটি মৌলিক অধিকারের প্রতি ইসলাম যথেষ্ট জোর দিয়েছে। তাহলো ইসলামী রাষ্ট্র তার চতর্সীমার মধ্যে বসবাসকারী কোনো নগরিককে তার জীবন যাপনের মৌলিক প্রয়োজন থেকে বঞ্চিত রাখতে পারবে না। ইসলাম এ উদ্দেশ্যে যাকাত প্রদান ফরয করেছে এবং এ সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
“তাদের ধনীদের নিকট থেকে তা আদায় করা হবে এবং তাদের গরীবদের মধ্য তা বন্টন করা হবে।” [বুখারী ও মুসলিম]
অপর এক হাদীসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মূলনীতি হিসেবে ইরশাদ করেন :
“যার পৃষ্টপোষক বা অভিভাবক নেই, তার পৃষ্ঠপোষক বা অভিভাবক হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকার।”
অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “মৃত ব্যক্তি যে বোঝা [ঋণ অথবা পরিবারের অসহায় সদস্য] রেখে গেলো তার দায়িত্ব আমাদের উপর।” [বুখারী ও মুসলিম]
এ ক্ষেত্রে ইসলাম মুসলিম ও অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে মোটেই পার্থক্য করেনি। কোনো নাগরিককেই অন্ন বস্ত্র ও আশ্রয়হীন অবস্থায় ত্যাগ করা যাবে না। ইসলাম মুসলিম নাগরিকদের মতো তার অমুসলিম নাগরিকের অন্ন বস্ত্র ও বাসস্থানের নিরাপত্তা বিধান করে থাকে। হযরত ওমর ফরূক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এক ইহুদী বৃদ্ধকে ভিক্ষা করতে দেখে তার উপর আরোপিত কর মওকুফ করেন এবং তার জন্য রাজকোষ থেকে ভাতা মঞ্জুর করে রাজকোষ কর্মকর্তাকে লিখে পাঠান :
“আল্লাহর শপথ! এ লোকটির যৌবনকালে যদি তার দ্বারা কাজ করিয়ে থাকি এবং এখন তার এই বার্ধক্যে তাকে নিরূপায় অবস্থায় ত্যাগ করি তবে তার সাথে মোটেই সুবিচার করা হবে না।” [ইমাম আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, পৃঃ ৭২]
হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হীরা নামক এলাকার অমুসলিম নাগরিকদের জন্য যে চুক্তিপত্র লিখে দিয়েছিলেন তাতে পরিস্কার ভাষায় বলা হয়েছিলো যে, যে ব্যক্তি বার্ধক্য পৌছবে অথবা যে ব্যক্তি আকস্মিক বিপদে পতিত হবে অথবা যে ব্যক্তি গরীব হয়ে যাবে তার নিকট থেকে কর আদায় করার পরিবর্তে রাজকোষ থেকে তার এবং তার পরিবার পরিজনের জীবিকার ব্যবস্থা করা হবে। [কিতাবুল খারাজ, পৃঃ ৮৫]