জীন
এক
সূর্য তখন ডুবু ডুবু। হঠাৎ একটি মোটা কালো সাপ এঁকে–বেঁকে গড়াগড়ি যায় আমাদের রাস্তার উপর; সাপটি প্রায় শিশুর বাহুর মতো পুরু এবং লম্বায় হবে হাতেক। থেমে গিয়ে সাপটি আমাদের দিকে তার মাথা তোলে। অনেকটা স্বয়ংক্রিয় গতিতে আমি পিছনে নেমে পড়ি জীন থেকে, আমার ঘাড় থেকে হালকা বন্দুকটি নামিয়ে হাঁটু গেড়ে বসি েএবং তাক করি, আর সেই মুহূর্তের আমি আমার পেছনে শুনতে পাই মানুষের কন্ঠস্বর–
–‘গুলি করবেন না.. . গুলীঅ।’ কিন্তু আমি এরি মধ্যে বন্দুকের ঘোড়া টিপে দিয়েছি; সাপটি ঝাকুনি খায়, গড়াগড়ি যায়.. . তারপর সব শেষ!
মনসুর তার নারাজ মুখ আমার উপর তুলে ধরেঃ সাপটিকে মারা আপনার উচিত হয়নি.. . আর যা–ই হোক সূর্যাস্তের সময়ে তা নয়ই; কারণ , এ সময়ে জিনেরা বেরিয়ে আসে মাটির নিচ থেকে এবং প্রায়ই ওরা সাপের সুরত ধরে!
আমি তার কথায় হেসে ফেলি এবং বলি, ‘মনসুর, তুমি কি সেকালের মেয়েরা সাপরূপী জিনের যে–সব গাল গল্প বলতো, সেগুলি সত্যি বিশ্বাস করো?
–‘নিশ্চয় আমি জিনে বিশ্বাস কির। আল্লাহর কিতাবে কি তার উল্লেখ নেই? তবে ওরা যেসব সুরতে মাঝে মাঝে আমাদের নিকট আসে আমি তা জানি না.. তবে আমি শুনেছি, ওরা অতি বিস্ময়কর এবং অপ্রত্যাশিত সুরত গ্রহণ করতে পারে.. .
তোমার কথা ঠিক হতে পারে মনসুর, আমি মনে মনে বলি, কারণ আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় যেসব বাস্তবকে প্রত্যক্ষ করতে পারে সে –সবের বাইরেও যে অমন সব অস্তিত্ব রয়েছে যা আমাদের ইন্দ্রিয়ের অগোচর, এ–ধারণা কি সত্যি খুব দূরকল্পনা? এটা কি এক ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক তুকাব্বরি নয়, যা আধুনিক মানুষকে সে নিজে যা দেখতে ও মাপতে পারে তাছাড়া অন্য কোনো রকম প্রাণ–সত্তার সম্ভাবনাকে অস্বীকার করতে শেখায়? জিনেরা যাই–হোক, তাদের অস্তিত্ব বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রমাণ করা যায় না, কিন্তু তাই বলে বিজ্ঞান অমন জীব–সত্তার অস্তিত্বের সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দিতে পারে না, যাদের জীবনের নিয়ম–কানুন এমন সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারে যে, আমাদের নিজস্ব ইন্দ্রিয়গুলি অতি বিরল কোনো অবস্থায়ই কেবল তাদের সাথে যোগ স্থাপন করতে পারে। একি সম্ভব নয় যে, এসব অজ্ঞাত জগত ও আমাদের জগতের মধ্যে কখনো কখনো এ ধরনের রাস্তা ক্রসিং হয় তখন অদ্ভুত সব অভিব্যক্তি ঘটে, যাকে আদিম খেয়াল, ভূত–প্রেত, দেও–দানে এবং এ ধরণের অন্যান্য অতিপ্রাকৃত অভিব্যক্তি বলে ব্যাখ্যা করেছে?
আমি যখন আবার আমার উটে চড়ি, মনে মনে এই প্রশ্নগুলি আওড়াতে আওড়াতে এমন এক মানুষের অবিশ্বাসের অর্ধস্মিত হাসি হেসে হেসে যার পরিবেশ ও শিক্ষা–দীক্ষা, যারা সবসময়ই প্রাকৃতির একেবারে কাছে আছে, তাদের থেকে তাকে স্থূল চর্ম করেছে!জায়েদ গম্ভীর মুখে আমাকে বলে সাপটাকে মারা আপনার ঠিক হয়টি। একবার বহু আগে ইবনে সউদ হাইল কবজা করার পর যখন আমি সে শহর ত্যাগ করেছি, আমি আমার ইরাকের পথে এরি মতো একটি সাপকে গুলি করে মেরেছিলাম। সূর্য তখন ডূবছে। এর কিছুক্ষণ পরেই যখন আমরা মাগরিবের সালাতের জন্য আসি, হঠাৎ আমি আমার পা দু’টির উপর সীসার ভার অনুভব করি, আর মাথার ভেতরে জ্বালা; উচু থেকে পড়ন্ত পানি মতো গর্জন করতে লাগলো এবং অংগ–প্রত্যংগুলি হয়ে উঠলো আগুন; আমি দাঁড়াতে পারলাম না সোজা হয়ে, একটি খালি বস্তার মতো ধপ করে পড়ে গেলাম জমিনের উপর; আমার চারদিকে আঁধার হয়ে উঠলো সমস্ত কিছু। আমি জানি না, আমি কতোক্ষণ সেই অন্ধকারে ডুবেছিলাম, তবে আমার মনে পড়ছে, শেষপর্যন্ত আবার আমি পায়ের উপর ভর করে দাঁড়িয়েছিলাম। অচেনা একটি মানুষ আমার ডান পাশে দাঁড়ালো, আরেকজন দাঁড়ালো বাঁ পাশে এবং ওরা আমাকে নিয়ে গেলো মস্ত বড়ো একটি আলো–আঁধারিতে রহস্যময় হল ঘরে–সেখানে ভর্তি ছিলো লোকজন আর ওরা চঞ্চলভাবে পায়চারি করছিলো এবং কথা বলছিলো একে অপরের সাথে। কিছুক্ষণ পর আমি বুঝতে পারলাম–ওরা দু’টি সম্পূর্ণ পৃথক দল, যেমন হয়ে থাকে আদালতের সামনে। পশ্চাদভুমিতে মেঝে থেকে কিছুটা উঁচু একটা মঞ্চের উপর বসে আছেন খুবই ছোট আকৃতির এক বৃদ্ধ। মনে হরো, ইনি একজন বিচারক অথবা সর্দার কিংবা ঐ রকম একটা–কিছু এবং মূহুর্তের মধ্যেই আমি জানতে পারলাম, আমিই আসামী।
একজন বললো,-‘ও তাকে হত্যা করেছে সূর্য ডুবার আগে রাইফেলের গুলীতে, ও অপরাধী।’ বিবাদী পক্ষের একজন পাল্টা জবাব দেয়, ‘কিন্তু ও জানতো না ও কাকে হত্যা করছে এবং রাইফেলের ট্রিগার টিপার সময় ও আল্লাহর নাম উচ্চারণ করেছিলো। ‘কিন্তু বাদী পক্ষ তখন চিৎকার করে উঠলো,-‘না,ও তা উচ্চারণ করেনি।’ –যার জবাবে বিবাদী পক্ষের সবাই একত্রে কোরাসে বলে উঠলো, ‘সে উচ্চারণ করেছিলো–সে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করেছিলো’ এবং এভাবেই তা চলতে লাগলো কিছুক্ষণ, একদল আগাচ্ছে আরেকদল পিছাচ্ছে, অভিযোগ আর খন্ডন চললো পালাক্রমে এবং শেষপর্যন্ত মনে হলো, আসামী পক্ষের সমর্থকরাই যেনো জিততে চলেছে। পেছনদিকে বসা বিচারক তাঁর রায় ঘোষণা করলেন এবারঃ ‘ও জানতো না, ও কাকে হ্ত্যা করছে এবং তখন আল্লাহর গুণ–গান করছিলোঃ ওকে যেখানে থেকে এনেছো সেখানে রেখে এসো।’
এবং যে লোক দু’টি আমাকে বিচার কক্ষে নিয়ে এসেছিলো ওরাই আবার আমাকে ওদের বাহুর নিচে চেপে ধরে, একই পথ দিয়ে নিায়ে গেলো সেই বিশাল অন্ধকারের মদ্যে যা থেকে আমি বের হয়ে এসেছিলাম এবং আমাকে ওরা জমিনের উপর শুইায়ে দিরো। আমি আমার চোখ দু’টি মেলি এবং দেখতে পাই, আমার দু’পাশে স্তূপীকৃত করে রাখা কয়েক গমের বস্তার মাঝখানে আমি পড়ে আছি, আর বস্তার উপর মেলা রয়েছে এক টুকরা তাঁবুর কাপড়, সূর্যের রশ্নি থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্য। মনে হরো তখন বেলা পূর্বাহ্ণের পয়লা দিক এবং আমার সাথীরা এখানে থেমেছে। দুরে দেখতে পেলাম আমাদের উটগুরি চরছে একটি পাহাড়ের ঢালূতে। আমি হাত তুলবার চেষ্টা করি, কিন্তু আমর অংগ–প্রত্যংগগুলি একেবারে ক্লান্ত। আমার সাথীদের একজন যখন তার মুখ নিচু করে আমার উপর ধরলো, আমি বললাম, ‘কফি.. .’, কারণ আমি কাছেই কফি গুঁড়া করার পাত্রের আওয়াজ শুনতে পেলাম।
আামর বন্ধু লাফিয়ে উঠলো, ‘কথা বলছে.. কথা বলছে.. . ফিরে এসেছে ও! –এবং ওরা আমার সন্মুখে নিয়ে এরো টাটকা গরম কফি।
আমি জিজ্ঞাস করি, আমি কি সারা রাতিই বেহুঁশ ছিলাম এবং ওরা উত্তারে বলালো, ‘সারা রাত! পুরা চারটা দিন তুমি একটু নড়োনি! কেবল একদিন আমরা তোমাকে একটি উটের উপর চাপিয়েছি বস্তার মতো, রাতে আবার নামিয়েছি উট থেকে। এবং আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, এখানেই তোমাকে কবর দিতে হবে। কিন্তু তারিফ তাঁরই যিনি জীবন দেন ও নেন–চিরঞ্জীব, যারঁ মৃত্যু নেই.. .
–‘কাজেই আপনি দেখতে পাচ্ছেন চাচা সন্ধ্যায় সময় কারো সাপ মারা উচিত নয়।
এবং যদিও জায়েদের বর্ণনায় আমার অর্ধেক মন তখনো হাসছে, কিন্তু বাকি অর্ধেকটা মনো হলো, ঘনায়মান সন্ধ্যায় অদৃশ্য শক্তিগুলির জাল –বোনা প্রত্যক্ষ করচে, সূক্ষ্ণ ধ্বনি এক লোহমর্ষক শোরগাল, যা শ্রুতি গ্রাহ্য নয় আর আমরা প্রত্যক্ষ করছি চারপাশে হাওয়ায় একটা শক্রতার নিশ্বস এবং সূর্য ডোবার কালে সাপটিকে মেরে ফেলার জন্য অনুশোচনার একটি অস্পষ্ট অনুভূকি হলো আমার..।
দুই
‘হাইল’ ছেড়ে আসার তৃতীয় দিনের বিকালে আমরা আর্জার কুয়ায় আমাদের উটগুলিকে পানি খাওয়ানোর জন্য আনি, নিচু নিচু পাহাড়ে বেষ্টিত প্রায় বৃত্তাকার একটি উপত্যকায়; মিঠা পানিতে ভর্তি বৃহৎ কুয়া দু’টি উপত্যকার একেবারে মাঝখানটায় অবস্থিত। এ দু’য়ের প্রত্যেকটি একটি কবিলার সামাজিক সম্পত্তি–পশ্চিমেরটি ‘হারব’ নামক গোত্রের এবং পুবেরটি মুতায়েরদের। এদের চারপাশের মাটি হাতের তালুর মতোই শূণ্য; কারণ রোজ বিকারে শত শত উট আর ভেড়াদের দূরদূরান্তের চারণক্ষেত্র থেকে এখানে হাঁকিয়ে নিয়ে আসা হয় পানি খাওয়ানো জন্য এবং এই জমিনে ঘাসের যে কচি পাতাটিই গজাই, তা একটু দম ফেলার ফুরসৎ পর্যন্ত পায় না, তার আগেই আলতো করে কামড়ে তুলে সাবাড় করে দেয় ওরা।
আমরা পৌঁছানোর পর দেকতে পাই গোটা উপত্যকাটি গিজ–গিজ করছে জীব– জানোয়ারে এবং রৌদ্র–স্লাত পাহাড়গুলির মাঝখান দিয়ে দেখা দিরো পালের পর পাল ভেড়া এবং উট গাঁধা। কুয়াগুলির চারপাশে ভীষণ ভীড়, চাঞ্চল্য ও শোরগোল; কারণ, অতোগুলি জানোয়ারের পিয়াস মিটানো সহজ। পশুচারীরা লম্বা রশিতে ঝুরানো চামড়ার থলিতে করে পানি তোলে এবং তার সাথে এক ধরনের গান গায় রশি ধরে, ওরা যে একেকটা টান দিচ্ছে সেই টানগুলির মধ্যে সংগতি ও সমতা রাখার জন্যঃ কারণ বালতিগুলি মস্ত বড়ো এবং পানিতে ভর্তি হবার পর এগুলি অতো ভারি হয়ে ওঠে যে, কুয়ার তলা থেকে টেনে তুলতে বহু হাতের দরকার হয়।
যে কুয়াটি আমাদের সবচেয়ে নিকটে–যা মুতায়ের কবিলার সম্পত্তি–আমি শুনতে পাই সেখানে থেকে ওরা গান গাইছে উটগুলিকে লক্ষ্য করে–
‘গান করে এবং বাকি রেখো না পানি,
রহমতে ভরপুর এই কুয়া, এর নেই কোনো তল!
লোকজনের অর্ধেকে গায় প্রথম পদটি এবং বাকি অর্ধেকে গায় দ্বিতীয় পদটি–দুটিই তারা আবৃতিত্ত করে চলে দ্রুততালে, যাতোক্ষণ না বালিতিটি উঠে আসে কুয়ার কাঁধির উপর; এরপরের কাজ রমণীদের; ওরা পানিটা ঢালে চামড়ার ডোঙায়। আর বহু উট এক সাথে ঠেলাঠেলি করে ঝুঁকে পড়ে সামনের দিকে, ডাক ছেড়ে সশব্দে নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে, উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে, ভীড় করে ডোঙাগুলির চার–পাশে এবং মনে হয়, মানুষের সান্তনার ডাক–‘হু উইহ্–হু উইহ্’ পারছে না ওদের শান্ত করতে। উটগুরির একেকটি তার লম্বা নমনীয় গ্রীবা তার সংগীদের ফাঁক দিয়ে বা উপর দিয়ে ঠেরে দেয় সামনের দিকে, যতো শ্রীঘ্র সম্ভব পানির পিয়াস মিটানোর জন্য; হালকা বাদামী, গাঢ–বাদামী, হলদে–সদা, কালো–বাদামী এবং মধ–বর্ণ কতকগুরি শরীর এদিক ওদিক দুলছে, ঠেলাঠেলি করছে, আন্দোরিত হচ্ছে,, ভিড় করছে আর জানোয়ারের ঘাম ও মূত্রের কড়া উৎকট গন্ধে ভরে তুলছে বাতাসকে। এরি মধ্যে বালতি আবার ভর্তি করা হয়ছে এবং আরো আরেকটি দুই ছত্রের কবিতা আবৃত্তির সংগে সংগেই রাখলেরা টেনে তুললো বালিতিটিঃ
‘কিছুই দূর করতে পারে না উাটের পিয়াস
পারে কেবল আল্লাহর রহমত আর রাখারের শ্রম।
এবং সারাটা জায়গা জুড়ে আবার শুরু হয় চাঞ্চল্য এবং পানি খাওয়ার দৃশ্য আর হাঁক–ডাক এবং গানের হুঞ্জরণ।
একজন বুড়ো মানুষ ইদারার কিনারের উপর দাঁড়িয়ে তার বাহু প্রসাতি করে আমাদের দিকে আর ডেকে বলেঃ ‘ওগো মুসাফিরেরা, আল্লাহ, তোমাদের হায়াত দারজ করুন। আমাদের মেহমানদারী গ্রহণ করো।’–এরপর ইদারার চারপাশের ভিড় থেকে কয়েকজন লোক ছুটে আসে আমদের দিকে। ওদের একজন আমার উটের লাগাম ধরে উটটিকে হাঁটু গাড়িয়ে বসায়, যাতে আমি সোয়ারী থেকে নামতে পারি আরামে। অত্যন্ত দ্রুততার সাথে একটি পথ করা হলো যেনো আমাদের উটগুলি পৌঁছুতে পারে পানির ডোঙার কাছে এবং রমণীরা পানি ঢারতে শুরু করে উটগুরির জন্যঃ কারণ আমরা হচ্ছি মুসাফির আর সে কারণে আমাদের দাবি অগ্রগণ্য!
জায়েদ অনেকটা আপন মনে যেনো নিজেকে শোনানোর জন্যই , ‘হারব এবং মুতায়ের খান্দান পরস্পর যুদ্ধ করার পর এখন কী চমৎকার শান্তিতে বসবাস করছে! (কারণ , এ তো মুতায়ের কবিলার বিদ্রোহের পর তিন বছরের কথা যখন হারব কবিলা ছিলো বাদশাহর সবচাইতে বিশ্বস্ত সমর্থকদের অন্যতম) । আপনার কি মনে আছে চাচা, আগের বার যখন আমরা এখানে ছিলাম–কেমন করে আমরা রাতের বেলা আরজা অতিক্রম করেছিলাম অনেক ঘুরে, একটি বৃত্তের আকারে, এই কুয়াগুলি কাছে আসতে সাহস না করে–এখানে দোস্ত না দুশমন আছে, তা জানতাম না বলে..?
জায়েদ স্মরণ করছে ১৯২৮ –২৯ এর প্রচন্ড বেদুঈন বিদ্রোহের কথা–একটি রাজনৈতিক নাটকের চূড়ান্ত পর্যায়ে–যার ফলে, ইবনে সউদের রাজ্যের বুনিয়াদ পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিলো এবং কিছুকালের জন্য আমিও তাতে নিজেকে জড়িত করে ফেলেছিলাম।
.. .. .. .. . .. . . .
১৯২৭ সনের যবনিকা উঠলো, তখন সৌদী আরবের বিশাল এলাকায় শান্তি বিরাজ করছে, ক্ষমতারত জন্য বাদশাহ ইবনে সউদের সংগ্রাম তখন শেষ হয়েছে। কোনো প্রতিদ্বন্ধী শাহী খান্দান নযদে তাঁর কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে আর দাবি তুলছে না। হাইল এবং শাম্মারদের এলাকা এখন তাঁরই এবং ১৯২৫ সনে হেজাজ থেথে শরীফীয় খান্দানের বহিষ্কারের পর হেজাজ ও এখন তাঁর। সে সময়ে বাদশাহর আগেকার বছরগুলিতে বাদশাহর জন্য প্রচুর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। বাদশাহর কর্মচারী হিসাবে আদ্–দাবীশ নিজের বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বার বার তিনি প্রমাণ করেন তাঁর আনুগত্যঃ ১৯২১ সনে তিনি বাদশাহর পক্ষে হাইর জয় করেন; ১৯২৪ সনে তিনি এক দুঃসাহসী অভিযান পরিচালনা করেন ইরাকের অভ্যন্তরে, যেখান থেকে ব্রিটিশের ছত্রছায়ায় শরীফ পরিবার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছিলো ইবনে সউদের বিরুদ্ধে। ১৯২৫ সনে তিনি মদীনা জয় করেন এবং জেদ্দা জয়ে পালন করেন একটি চূড়ান্ত ভুমিকা। আর এখন, ১৯২৭ সানের গ্রীষ্মে তিনি তাঁর এই সব বিজয় –মাল্য নিয়ে আরতাবীয়ার ইখওয়ান উপনিবেশে বিশ্রাম করেছেন, যা ইরাক সরহদ থেকে খুব দূরে নয়।
বহু বছর ধরে ঐ সীমান্তটি ছিল প্রায় নিরবিছিন্ন বেদুঈন হামালার ক্ষেত্র। এই হামলা চালিয়ে এসেছে চারণভূমি ও পানির সন্ধানে বেরিয়ে পাড় বিভিন্ন গোত্র ও কবিলার লোকেরা । ইবনে সাউদ এবং মানডেটারী শক্তি হিসাবে ইরাকের জন্য দায়ী ব্রিটিমের মধ্যে উপর্যুপরি অনেকগুলি চুক্তির মাধ্যমে স্থির হলোঃ এ ধরণের অনিবার্য হিজরতের সম্মুাখে কোনা বাধা সৃষ্টি করা চলবে না। এবং নযদ–ইরাক সীমান্তের কোনো পাশেই কোন প্রাচীর বা কিল্লা তৈরি করা চলবে না। অবশ্য ১৯২৭ সনের গ্রীষ্মের বিসায়ার সীমান্তবর্তী কুয়াগুরির নিকট ইরাক সরকার একটি কিল্লা তৈরি করে তাতে সৈন্য মোতয়েন করে এবং সীমান্ত বরাবর আরো কিল্লা তৈরির সিদ্ধান্তের কথা সরকারীভঅবে ঘোষণ করে। এর ফলে উত্তর নযদের বিভিন্ন কবিলার মধ্যে একটি অস্বস্থির তরংগ ছড়িয়ে পড়ে।দেখতেপেরা তাদের অস্তিত্বেই বিপন্ন ;কারণ যেসব কুয়ার উপর তার সম্পূর্ণ নির্ভর করতো সেগুলি থেকো তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ইবনে সউদ খোলাখুলি এই চুক্তি ভংগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন, যার জন্য কয়েকমাস পরে ইরাকে অবস্থান রত ব্রিটিশ হাই কমিশনারের কাছ থেকে পেলেন কেবল একটি ছলনা পূর্ণ জবাব।
সদা উদ্যেগ কর্মচঞ্চল ফয়সল আদ দাবীশ মনে মনে বললেঃ ব্রিটিশের সাথে ঝগড়া শুরু করা বাদশাহর জন্য সুবিধা জনক না হতে পারে। তবে সেটা ‘আমিই করবো’। এবং ১৯২৭–এর অক্টোবরের শেষ দিনগুলিতে তিনি তাঁর ‘ইখওয়ানে’র দলপতি হিসাবে বেরিায়ে পড়লেন, বিসায়ার কিল্লা আক্রমণ করে তা ধ্বংস করে দিলেন, কিল্লার ইরাকী গ্যরিসনকে কোনো পাত্তাই দিলেন না। অকুস্থলের উপর ব্রিটিশ হাওয়াই জাহাজ দেখা গেলো এবং পরিস্থিতি জরিপ করে ফিরে গেলো, তাদের স্বভাবের বিরুাদ্ধে, একটি বোমাও না ফেরে। তাদের জন্য সহজ হতো হামলা প্রতিরোধ করা। (এ অধিকার তাদের ছিলো ইবনে সউাদের সংগে তাদের চুক্তির বদৌলতে) এবং পরে কূটনৈতিক আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে কিল্লাগুলির সমস্যা সমাধান করা। ব্রিটিশ–ইরাকী সরকার কী সত্যি বিবাদের আশু এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের উৎসুক ছিলেন!
উত্তর নযদের কবিলাগুরি থেকে ডেপুটেশন এলো ইবনে সউদের কাছে ইরাকের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর দাবি নিয়ে। ইবনে সউদ এ ধরনের সব দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন, আদ্–দাবীশকে সীমালঙ্গনকারী বলে ঘোষণা করেন এবং সীমান্ত এলাকাগুরির উপর কড়া নযর রাখার জন্য হাইলের ‘আমীর’কে আদেশ দেন। বাদশাহ্ ‘ইখওয়ানে’র অধিকাংশ সদস্যকে আ র্থিক ভাতা দিয়ে আসছিলেন; তাদের মধ্যে আদ্–দাবীমের নিয়ন্ত্রণাধীন কবিরাগুলির সদস্যদের ভাতা এখন তিনি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিলেন। খোদ আদ্ –দাবীশকে নির্দেশ দেওয়া হলো। আরতাবিয়া থেকে বাদশাহর সিদ্বান্তের জন্য অপেক্ষা করতে। ইরাক সরকারকে এই সব ব্যবস্থা সম্পর্কে সরকারীভাবে অবহিত করা হলো এবং জানিয়ে দেওয়া হলো যে, আদ–দাবীশকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। এর সাথে ইবনে সউদ এ দাবিও করেন যে, ভবিষ্যতে ইরাকের সীমান্ত চু্ক্তিগুলি আরও কঠোরভাবে পালন করতে হবে।
এভাবে সহজেই এই নতুন সংঘর্ষের অবসান ঘটানো সম্ভব ছিলো, কিন্তু ঘটনা যখন এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছিলো তখন ব্রিটিশ হাই কমিশনার ইবনে সউদকে জানালেন, তিনি আদ্–দাবিশের ‘ইখওয়ান’কে (যারা অনেক আগেই ফিরে গিয়েছিলো তাদের নিজ অঞ্চলে) শাস্তি দেবার এবং তাদের বাদশাহর প্রতি তাদেরকে আনুগত্যশীল হতে বাধ্য করার জন্য এক স্কোয়াড্রান বিমান পাঠাচ্ছেন। সে সময়ে রিয়াদে কোন টেলিগ্রাম অফিস ছিলো না। তাই বাদশাহ ইবনে সউদ তাড়াহুড়া করে এক পত্রবাহককে পাঠান বা্হরাইনে আর সেখান থেকেই বাগদাদে পাঠানো হলো একটি টেলিগ্রাম, প্রস্তাবিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং চুক্তির কথা উল্লেখ করে, যাতে উভয় পক্ষকে সীমান্ত অতিক্রম করে আইন ভংগকারীকে পশ্চাদ্ধবন বারণ করা হয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বললেন, আদ–দাবীশের উপর জোর করে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ সাহায্যের কোন প্রয়োজন তাঁর নেই এবং সবশেষে তিনি এই হুশিয়ারি উচ্চারণ করলেন–নযদ অঞ্চলের উপর বিমান হামলা হলে ইখওয়ানদের মধ্যে তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হবে; কারণ. ইখওয়ানের সদস্যরা যথেষ্ট পরিমানে উত্তেজিত ও বিক্ষুদ্ধ হয়ে আছে!
এই হুশিয়ারি কে উপেক্ষা করা হলো। ১৯২৮ এর জানুয়ারির শেষের দিকে, বিসায়ার ঘটনার তিন মাস পরে এক সোকয়াড্রান ব্রিটিম বিমান সীমান্ত অতিক্রম করে নযদী এলাকায় বোমা ফেলে মুতায়েবীর বেদুঈন তাঁর বসতিগুলি ধ্বংস করে এবং নারী–পুরুষ ও গৃহপালিত জীব –জানোয়ারকে নির্বিচারে হত্যা করে। এর ফলে উত্তর অঞ্চলের সকল ইখওয়ান ইরাকের বিরুদ্ধে বদরা নেওয়ার জন্য তৈরি হতে শুরু করে। বিভিন্ন কবিলার মধ্যে কেবল ইবনে সউদের বিপুল মর্যাদা ও ইজ্জতের জন্যই যথাসময়ে এই অভিযান থেকে যায় এবং ছোট –খাটো কয়েকটি সীমান্ত সংঘর্ষেরর মধ্যে সীমিত থাকে।
ইত্যবসের বিসিয়ার বিধ্বস্ত কিল্লাটি ব্রিটিশ সরকার আবার চুপি চুপি নির্মাণ করে এবং সীমান্তের ইরাকী এলাকায় আরো নতুন কিল্লা তৈরি হয়।
.. . .. . .. . .. . ..
ফয়সাল আদ্–দাবীশকে রিয়াদে আহবান করা হলে তিনি তাঁর কাজের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য রিয়াদে আসতে অস্বীকার করলেন–কারণ, তাঁর মতে, তিনি যা করেছেন বাদশাহর স্বার্থেই করেছেন। তাঁর তিক্ততা আরো বেড়ে গেলো। ব্যক্তিগত বিক্ষোভের দরুণ। ফয়সাল আদ্–দাবীশ, যিনি এতো বিশ্বস্ততার সংগে চমৎকারভাবে বাদশাহর খিদমত করেছেনে, তিনি তো আরতাবিয়ার ‘আমীর’ মাত্র বিপুর পরিমাণ জনবসতি সত্ত্বেও আসলে যা একিট বর্ধিষ্ণু গ্রামের বেশি কিছু নয়। হাইল বিজয়ে চূড়ান্ত ফয়সারা হয় তাঁরই নেতৃত্বে। কিন্তু তাঁকে নয়, বাদশাহর চাচাত ভঅই ইবনে মুসাদকে নিযুক্ত করা হলো হাইলের ‘আমীর’। হেজাজ অভিযানকালে আদ—দাবীশই মাসের পর মাস মদীনা অবরোধ করে রাখেন এবং শেষ পর্যন্ত তাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন; কিন্তু তাঁকে তার ‘আমীর’ করা হলো না। ক্ষমতার জন্য তাঁর তীব্র কামনা তাঁকে অস্থির করে তোলে। তিনি মনে মনে বললেন, ‘ইবনে সউদ আনাজা কাবিরার লোক, আর আমার কবিরা হচ্ছে মুতায়ের– খান্দানের, আভিজাত্যের দিক দিয়ে আমরা একে অপরের সমান; আমি কেন ইবনের সউদের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেবো?
এই ধরনের চিন্তা –ভাবনা ও যুক্তি চিরদিনই আরবের ইতিহাসের অভিশাপ হয়ে রয়েছেঃ কেউ স্বীকার করবে না যে, অন্য কেউ তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
একের পর এক অন্যান্য নাখেশ ইখওয়ান সর্দারের ভুরে যেতে লাগলো ইবনে সউদর কাছে তারা কত ঋণী! এঁদের মধ্যে ছিলেন শক্তিশালী আতায়বা কবিরার শায়খ এবং নযদ অঞ্চলের অন্যতম বৃহত্তম ইখওয়ান বসতি ঘাটঘাটের আমির সুরতান ইবনে বুজাদ। এই সুলতান ১৯১৮ সনে শরীফ হোসাইনের ফৌজের বিরুদ্ধে তারবার যুদ্ধে জয়লাভ করেন। ১৯২৪ সনে তিনি জয় করেন তায়েফ ও মক্কা। কেন তিনি কেবল ঘাটঘাটের ‘আমীর’ হয়েই সন্তুষ্ঠ থাকবেন? কেন তাঁকে নিদেনপক্ষে তায়েফের ‘আমীর’ করা হলো না? ফয়সাল আদ্–দাবীশের মতো তাঁরও মনো হলো, তাঁর বিবেচনায় যা তাঁর প্রাপ্য তা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আর সুলতান ইবনে বুজাদ যেহেতু আদ্–দাবীশেল ভগ্নিপতি, তাই তাদের দুজনের জন্য ইবনে সউদের বিরুদ্ধে একমত হয়ে দাঁড়ানো একান্তই যুক্তিসংগত মনে হলো।
১৯২৮ –এর শরতকালে এসব বিবাদ–বিসংবাদ সমাধানের উদ্দেশ্যে রিয়াদে এক সম্মেলনে ডাকা হলো সরদার ও ‘আলিমদের’ –প্রায় সকল কবিলার সরদারেরাই এলো, ইবনে বুজাদ ও আদ্–দাবীশ ছাড়া। বিরোধিতায় উগ্র–অনমনীয় ইবনে বুজাদ ও আদ—দাবীশ ঘোষণা করলেন, ইবনে সউদ একজন পাষন্ড, প্রচলিত ধর্মমতে বিরুদ্ধচারী; কারণ তিনি কি কাফিরদের সংগে চুক্তি করেননি? এবং আরবদের দেশে কি মোটর–কার, টেলিফোন, বেতার–যন্ত্র ও উড়োজাহাজের মতো শয়তানের যন্ত্রপাতি প্রবর্তন করেননি? রিয়াদে ‘যেসব আলিম’ একত্র হলেন, তাঁরা এক বাখ্যে ঘোষণা করলেনঃ এসব নতুন কারিগরী যন্ত্রপাতি যে কেবল অনুমোদনের যোগ্য তাই নয়, বরং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও পরম বাঞ্ছনীয়, কারণ, এসবের সাহায্যে মুসলমানদের জ্ঞানের পরিসীমা বর্ধিত হচ্ছে িএবং তাদের ক্ষমতা বাড়ছে। তারা ইসলামের নবীর বরাত দিয়ে আররা ঘোষণা করলেন, অমুসলমান শক্তির সংগে চুক্তি ও একই রূপ বাঞ্ছনয়–যদি তা মুসলমানদের জন্য নিয়ে আসে শান্তি ও মুক্তি।
কিন্তু দুই বিদ্রোহী সরদার তাদের নিন্দাবাদ চালিয়ে যেতে থাকেন এবং যেসব সরলমতি ইখওয়ান ইবনে সউদের বিভিন্ন কাজে শয়তানের আছড় ছাড়া অন্য কিছু দেখার মতো যথেষ্ট জ্ঞান রাখতো না, তাদের কাছ থেকে ওঁরা পেতে লাগলেন স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া। ইবনে সউদ যে আগে ইখওয়ান’কে শিক্ষিত করে তুরতে এবং তাদের ধর্মীয় জোশকে নিশ্চিত লক্ষ্যের দিকে ঘুরিয়ে দিাতে পারেনি তারই মর্মান্তিক ফল এবার ফলতে শুরু করলো–
নযদের স্তেপ অঞ্চলগুলি গুঞ্জরিত হতে লাগলো মৌচাকের মতো। দ্রুতগতিতে উষ্ট্রীর পিঠে সওয়ার হয়ে রহস্যময় জাসুসেরা ছুটাছুটি করতে শুরু করলো এক কবিলা থেকে আরেক কবিলার মধ্যে; দূরবর্তী ইঁদারাগুলিতে সরদারেরা গোপন বৈঠক করতে লাগলো। শেষমেষ বাদশাহর বিরুদ্ধে আন্দোলনে ফেটে পড়লো প্রকাশ্য বিদ্রোহে–এবং তাতে মুতায়ের ও আতায়েব কবিলা ছাড়া আরো বহু কবিলা জড়িত হয়ে পড়রো। বাদশাহ কিন্তু অবিচলিত, তিনি সহানুভূতির সাথে সব কিছু বুঝবার চেষ্টা কররেন। তিনি বিদ্রোহী কবিলা–সরদারদের নিকট কাসেদ পাঠিয়ে তাদের যুক্তি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলেন; কিন্তু তাতে কোনো ফল হলো না। মধ্য ও উত্তর আরব ব্যাপক গেরিলা যুদ্ধের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ারো। এককালে দেশে যে নিরাপত্তা ছিরো প্রায় প্রবাদ বাক্যের বিষয় তা লোপ পেলো এবং নযদে পুরা বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়লো; দলে দলে বিদ্রোহী ইখওয়ান যেসব গ্রাম কাফিলা এবং কবিলা বাদশাহর প্রতি অনুগত ছিলো, তাদের উপর আঘাত হানতে হানতে এই এলাকার ভেতর দিয়ে সকল দিকে ধাবিত হলো ঝড়ের মতো।
বিদ্রোহী এবং অনুগত কবিলাগুলির মধ্যে স্থানীয় অসংখ্য ছোটো ছোটো সংঘর্ষের পর,১৯২৯–এর বসন্তকালে মধ্য নযদের সিবিলা ময়দানে একটি যুদ্ধে চূড়ান্ত ফয়সালা হয়। এক পক্ষ বাদশাহ তাঁর বিশাল ফৌজ নিয়ে, অন্যদিকে কবিলার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দরের সমর্থনপুষ্ট মুতায়ের ও আতায়বা কবিলা। এই যুদ্ধে বাদশাহ জয়ী হন। ইবনে বুজাদ বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁকে জিঞ্জীরে বেঁধে আনা হলো রিয়াদে–আদ–দাবীশ যখম হন মারাত্মকভাবে। বলা হলো, আদ–দাবীশ আর বাঁচবেন না। আরবের বাদশাহদের মধ্যে সবচাইতে নরম ও কোমল ইবনে সউদ তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসককে পাঠালেন তাঁর চিকিৎসার জন্য এবং সিরিয়ার সেই তরুণ ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখতে পেলেন কলিজায় গুরুতর যখম। তিনি বললেন, আদ্–দাবীশ বড় জোর এক সপ্তাহ বাঁচতে পারেন। ডাক্তাতের মুখে এ কথা শোনার পর বাদশাহ স্থির করলেনঃ আমরা চাই যে, তার মৃত্যু শান্তিতে হোক, সে তার প্রাপ্য শাস্তি পেয়েছে আল্রাহর কাছ থেকে। তিনি আহত দুশমনকে আরতাবিয়ায় তার পরিবারের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য আদেশ দিরেন।
কিন্তু আদ –দাবীশের মৃত্যুর কোনো লক্ষণই দেখা গেলো না। তরুণ ডাক্তার তাঁর যখম যতোটা গুরুতর মনে করেছিলেন আসলে তা তার কাছাকাছিও ছিলো না। কয়েক সপ্তহের মধ্যেই যথেষ্ট সেরে উঠে তিনি পালিয়ে গেলেন আরতাবিয়া থেকে, প্রতিশোধ গ্রহনের দৃঢ়তরো প্রতিজ্ঞা নিয়ে, আগরে চাইতেও।
.. . .. . .. .
আরতাবিয়া থেকে আদ্–দাবীশের বিদ্রোহ নতুন প্রেরণা যোগায়। শোনা গেলো তিনি নিজে রয়েছেনে কোয়েত সরহদের কাছাকাছি কোথা, যেখানে থেকে তিনি উপজাতিগুলির মধ্যে থেকে নতুন মিত্র সংগ্রহ করছেন তাঁর নিজস্ব মুতায়ের বাহিনীর জন্য, যে বাহিনী এখনো বেশ গুরুত্ব রাখে। তাঁর সাথে প্রথম যোগ দেয় একটি ছোট্ট অথচ দুর্ধর্ষ কওম ‘আজামন’–ওদের বসতি ছিল পারস্য উপসাগরের নিকটববর্তী আলহাসা প্রদদেশে। ওদের ‘শায়খ’ ইবনে হাজলায়েন ছিলেন ফয়সাল আদ্–দাবীশের মামা । এটুকু বাদ দিলে, ইবনে সউদ এবং আজমান কওমের মধ্যে সম্প্রীতি ছিলো অক্ষুণ্ণ। কয়েক বছর আগে ওরা বাদশাহর কনিষ্ঠ ক্রাতা সাদকে হত্যা করেছিলো এবং তিনি বদলা নিতে পারেন, এই ভেয়ে তারা বাড়ি–ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিরো কোয়েত। পরে ইবনে সউদ তাদেরকে মাফ করে দেন এবং পৈত্রিক আবাসভূমিতে ফিরে আসার অনুমতি দেন। তবু পুরানো বিক্ষোভ বাড়তেই থকে। এর অভিব্যক্তি ঘটলো প্রকাশ্য দুশমনীতে, যখন আপোসের কথাবার্তা চলাকারে ইবনে সউদের আত্মীয়, আল –হাসার আমীরে’র জ্যেষ্ঠ পুত্রের তাঁবুতে, আজমানদের সরদার এবং তার কয়েকজন অনুসারীকে বিশ্বাসঘাতকতা করে হত্যা করা হয়।
আজমান এবং মুতায়ের কবিলার মধ্যে মৈত্রী –নযদের আতায়বা গোত্রগুলির মধ্যে সৃষ্টি করে একটা নতুন স্ফুলিংগ। তাদের ‘আমীর’ ইবনে বুজাদ কয়েদ হওয়ার পর তার আবার জমায়েত হলো এক নতুন সরদারের নেতৃত্বে। আবার ওরা দাঁড়ালো বাদশাহর বিরুদ্ধে। এজন্য তিনি তাঁর প্রায় সকল শক্তি উত্তর নযদ থেকে তুলে নিয়ে সমাবেশ করলেন মধ্য নয্ দে। তীব্র লড়াই হলো, তরে ধীরে ধীরে ইবনে সউদই বিজয়ী। তিনি আতায়বার বিভিন্ন দলকে একটির পর একটি করে পরাভূত করালেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত তারা প্রস্তাব পাঠালো–আত্মসমর্পণ করবে। রিয়াদ এবং মক্কার মাঝামাঝি এক গ্রামে ‘শায়খরা’ আনুত্যের শপথ নিলো বাদশাহর নিকট এবং বাদশাহ আবর তাদের মাফ করে দিলেন এই আশায় যে, এরপর তিনি আদ –দাবীশ এবং উত্তরাঞ্চলের আর সকল বিদ্রোহীর বিরুদ্ধে যে–কোনো ব্যবস্থা গ্রহনে সক্ষম। কিন্তু তিনি রিয়াদে ফিরতে না ফিরতেই আতায়বা কবিলা দ্বিতীয়বারের মতো তাদের ওয়াদা ভংগ করে নতুন করে লড়াই শুরু করে দেয়। এ যুদ্ধ ছিলো শেষ যুদ্ধ, শত্রুকে নির্মূল করার লড়াই। তৃতীয়–বারেরমতো আতায়বা হেরে গেলো এবং তাদের প্রায় এক–দশমাংশ লোক তাতে নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেলো। এভাবে রিয়াদের চাইতে বড়ো ঘাটঘাটের ‘ইখওয়ান’ বসতি সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ায় বাদশাহর কর্তৃত্ব মধ্য নযদে আবার প্রতিষ্ঠিত হলো।
উত্তর অঞ্চলে সংগ্রাম কিন্তু তখনো চলেছে। ফয়সল–আদ –দাবীশ এবং তাঁর মিত্ররা সরহদের কাছাকাছি ট্রেঞ্চ খুঁড়ে মজবুত হয়ে বসেছেন। বাদশাহর পক্ষ হয়ে হাইলের ‘’আমীর’ ইবনে মুসাদ আক্রমণের পর আক্রমণ চালান ওদের ওপর। দুবার খবর রটরো, আদ্ –দাবীশ নিহত হয়েছেন এবং প্রত্যেকবারই এ খবর মিথ্যা প্রমাণিত হরো । তিনি বেঁচে রইলেন; মাথা নিচু করবো না, আপোস করবো না, এই জিদ নিয়ে। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং সাতশত যোদ্ধ নিহত হরো যুদ্ধক্ষেত্রে। কিন্তু তবু তিনি যুদ্ধ করে চললেন। তখন প্রশ্ন জাগলো, আদ্ –দাবীশ টাকা –কড়ি পান কোথেকে,যা আরবের মতো দেশেও যুদ্ধ চালিয়ে যাাবর জন্য অপরিহার্য। কোথেকে আসে তাঁর অস্ত্রশস্ত্র আর গোলা বারুদ?
নিশ্চয়তাবিহীন এই রিপোর্ট চালু হয়ে গেলো যে, যে–বিদ্রোহী এককালে কাফিরদের সংগে ইবনে সউদের বিভিন্ন চুক্তির ঘোর সমালোচক ছিলেন তিনিই এখন ব্রিটিশের সংগে গোপন সন্ধি–সূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন। গুজব রটে গেলো, তিনি ঘনঘন কোয়েত সফর করছেনঃ এ কাজ কি তাঁর পক্ষে সম্ভব, লোকেরা বলাবলি করতে লাগলো, ব্রিটিশ কর্তপক্ষের অজ্ঞাতসারে? বরং এটাই কি সম্ভব নয় যে, ইবনে সউদের দেশে বিদ্রোহ–বিশৃংখলা তাদের মতরব হাসিলের জন্য খুব উপযোগী।
.. . .. . . ..
রিয়াদে ১৯২৯ –এর গ্রীষ্মের এক সন্ধ্যায় আমি সকাল শয্যা গ্রহণ করি;ঘুমিয়ে পড়ার আগে ওমানের বিভিন্ন বাজবংশের উপর রচিত একটি পুরানো বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে নিজেকে যখন বিষয়ান্তরে নেবার চেষ্টায় ছিলাম তখন হঠাৎ অনেকটা আকস্মিকভাবেই জায়েদ এসে ঢুকলো আমার কামরায়ঃশুয়ুখ থেকে এখানে একজন লোক এসেছেন, আপনার সংগে দেখা করতে চান।
আমি তাড়াতাড়ি পোশাক পরে কিল্লায় গিয়ে পৌছুই। ইবনে সউদ তাঁর ব্যক্তিগত কামরায় অপেক্ষা করছেন আমার জন্য; তিনি একটি দিওয়ানের উপর পায়ের উপর পরা রেখে বসে আছেন। তাঁর চারপাশে স্তূপীকৃত আরবী খবরের কাগজ এবং তাঁর হাতে কায়রোর একটি পত্রিকা। তিনি সংক্ষেপে আমার সালামের জবাব দিলেন এবং নিজের পড়ায় ছেদ না ঘটিয়ে ইশারায় আমাকে তাঁর পাশে দিওয়ানের উপর বসতে বললেন। কিছুক্ষণ পর তিনি কাগজ থেকে চোখ তুললেন এবং দরজায় যে গোলমাটি দাঁড়িয়েছিলো তার দিকে তাকালেন এবং হাত নেড়ে ইংগিতে বোঝালেন–তিনি আমার সংগে কিছুক্ষণ একা থাকতে চান। গোলামটি বেরিয়ে যেতে যেই দরজা বন্ধ করলো, বাদশাহ তাঁর হাতের কাগজ রেখে দিলেন এবং কিছুক্ষণেল জন্য আমার দিকে তাকালেন তাঁর ঝকঝকে চশমার পেছন থেকে, যেনো তিনি বহুদিন হলো আমাকে দেখেননি (যদিও সেদিনই সকালে আমি তাঁ সংগে কয়েকটি ঘন্টা কাটিয়েছি)।
–‘লেখা নিয়ে ব্যস্ত!’
–‘না, দীর্ঘজীবী সুলতান! বহু হপ্তা হলো আমি কিছুই লিখিনি।’
–‘ইরাকের সংগে আমাদের সীমান্ত সমস্যা নিয়ে যে প্রবন্ধগুলি লিখেছিলে চমৎকার হয়েছিলো সেগুলি।’
স্পষ্টই প্রায় দু’মাস আগে আমি আমার কন্টিনেন্টাল খবরের কাজগগুলির জন্য ধারাবাহিক যে সব রিপোর্ট লিখছিলাম তিনি তারই উল্লেখ করছিলেন। এর কোনো কোনোটি কায়রোর একটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিলো যেখানে–আমি বলতে গৌরব বোধ করছি–ঐ রিপোর্টগুলি একটা খুব জটিল অবস্থার মীমাংসার সহায়ক হয়েছিলো। বাদশাহকে জানতাম বলে নিশ্চিত ছিলাম যে, বাদশাহ এলোমেলোভাবে কথা বলছেন না, তাঁর মনে স্থির বক্তব্য বলতে থাকবেন। তিনি সত্যই তাঁর বক্তব্য অব্যাহত রেখেছিরেন।
–‘হয়তো নযদে যা ঘটেছে সে সম্পর্কে, এই বিদ্রোহ ও তার শুভ ছায়া সম্পর্কে, তুমি আরো বেশি কিছু লিখতে চাইছো।’ তাঁর গলার স্বরে আভাস দেখা গেলো যখন তিনি বললেন, ‘শরীফ খান্দান আমাকে ঘৃণা করে; হুসাইনের পুত্ররা যারা এখন ইরাকে এবং ট্রান্স–জর্ডানের রাজত্ব করছে, আমাকে সবসময়ই ঘৃণা করবে, কারণ তারা ভূলতে পারে না আমি ওদের নিকট থেকে হেজাজ ছিনিয়ে নিয়েছি। ওরা চায় আমার রাজ্য ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে পড়ুক, কারণ তা হলেই ওরা ফিরে আসতে পারবে হেজাজে.. . এবং ওদের বন্ধুরা, যারা আমার বন্ধু বলে ভান করে, হয়তো তা অপছন্দ করবে না.. . ওরা ঐ কিল্লাগুলি খামাখাই তৈরি করেনিঃ ওরা ‘চেয়েছিলো’ আমাকে পেরেশান করতে এবং ওদের সরহদ থেকে দূরে ঠেলে দিতে.. .।
ইবনে সউদের কন্ঠ–উচ্চারিত শব্দরাজির পেছনে আমি শুনতে পাচ্ছিলাম তালগোল পাকানো ভৌতিক ধ্বনিসমূহ.. . রেলগাড়ির ঘড় ঘড় গর্জন, যা এখনো কাল্পনিক হলেও সহজে আগামী কালই হয়ে উঠতে পারে বাস্তবঃ হাইফা থেকে বসরা পর্যন্ত একটি ব্রিটিশ রেল সড়কর প্রেতচ্ছায়া।
এ ধরণের একটি পরিকল্পনার কথা কয়েক বছর ধরে চালু রয়েছে। একথা সুবিদিত যে, ব্রিটেন উদগ্রীব ছিলো ‘ভারত পর্যন্ত একটি স্থলপথ’ স্থাপনের জন্য–আর ফিলিস্তিন ট্রান্স–জর্ডান ও ইরাকের উপর ওদের মানডেটের অর্থও আসলে ছিলো তাই। ভূমধ্যসাগর থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত একটি রেল সড়ক যে ব্রিটেনের সামাজিক যোগোযোগ ব্যবস্থায় কেবল একটি নতুন এবং মূল্যবান সূত্রই হবে তা নয়, বরং ইরাক থেকে সিরীয় মরুভূমির আড়াআড়ি হাইফা পর্যন্ত তেরের যে পাইপ লাইন বসানো হবে তার জন্যও এতে বৃহত্তর রক্ষা–কবচ নিশ্চিত হবে। তা ছাড়া, হাইফা এবং বসরার মধ্যে সরাসরি রেল যোগাযোগ অগ্রসর হবে ইবনে সউদের উক্ত পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলির বুক চিরে রেল যোগাযোগ অগ্রসর হবে ইবনে সউদের উক্ত পূর্বাঞ্চরের প্রদেশগুলর বুক চিরে–এবং বাদশাহ কিছুতেই এ ধরণের ইংগিত ও কখনো গ্রহণ করতে পারেন না। এটাই কি সম্ভব নয় যে, এই সংকটপূর্ণ এলাকার ভেতরে যথেষ্ট গোলযোগ সৃষ্টি করার জন্য বলবৎ সকল চুক্তির খোলাখুলি বিরোধিতা করে ইরাক –নযদ সরহদ বরাবর কিল্লার পর কিল্লা নির্মাণ করা ছিলো একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের প্রথম পর্যায়, যাতে করে ব্রিটেনের প্রতি নমনীয়তা একটি ‘ছোট্ট আধা স্বাধীন বাফার’–রাষ্ট স্থাপনের যৌক্তিকতা প্রমান করা যায়? ফয়সর আদ্–দাবীশ এই উদ্দেশ্যের সহায়ক হতে পারেন, এমন কি শরীফ খান্দানের কোন সদস্যের চাইতেও বেশি সাহায্য করতে পারেন এ ব্যাপারে;কারণ তিনি নিজেও নযদী এবং ‘ইখওয়ানে’র মধ্যে রয়েছে তাঁর প্রবল একদল সমর্থক। কিন্তু তাঁর অতীতের সাথে পরিচিতি যে কারো কাছে দিবালোকের মতোই এ সত্য ছিলো যে, তাঁর অতীতের সাথে পরিচিত যে –কারো কাছে দিবালোকের মতোই এ সত্য ছিলো যে, তাঁর সম্পর্কে যে–ধর্মীয় আবেগ আতিশয্যের কথা উল্লেখ করা হয়ে থাকে, তা একটা মুখোশ মাত্র। আসলে কেবল ক্ষমতাই ছিলো তাঁর লক্ষ্য। এতে কোনো সন্দেহই নেই যে, তাঁর কোনো সাহায্যকারী না থাকলে একাকী তাঁর পক্ষে ইবনে সউদের বিরুদ্ধে এতো দীর্ঘদিন টিকে থাকা মোটেই সম্ভব হতো না । সতি্যি কি তিনি একলা?
অনেক্ষণ চুপ করে থাকার পর বাদশাহ আবার বলতে থাকেনঃপ্রত্যেকের মতোই আমিও, আদ্–দাবীশের হাতে যেসব অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ রয়েছে মনে হয়, সেগুলি কোত্থেকে আসছে, সে সম্পর্কে চিন্তা করি। আমি জানতে পেরেছি এসবই তাঁর রয়েছে প্রচুর–এবং বিপুল পরিমাণ টাকা–কাড়িও। আমি বলতে চাই, আদ্–দাবীশ অস্ত্রশস্ত্র গোলা –বারুদের যেসব সরবরাহ পায় সেগুলির রহস্যময় উৎস সম্বন্ধে তুমি কি কিছূ–কিন্তু আমি চাই যে, তুমি যদ্দুর পারো, নিজেই তা খুঁজে বার করো, কারণ আমার ভূল ও হতে পারে।
তাহলে ব্যাপার হচ্ছে এই, যদিও বাদশাহ কথা বলছিলেন খুবই অনড়ম্বরভাবে ঔদাস্যভাবে আলাপী ভংগীতে,তবু সুস্পষ্টভাবে প্রত্যেকটি শব্দই ওজন করে উচ্চারণ করছিলেন। আমিতাঁর দিকে তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানীর দৃষ্টিতে তাকাই। তাঁর যে চেহারা মুহূর্ত কাল আগে ছিলো এতো গম্ভীর তা–ই একউদার হাস্যে উদ্ভাসিত হলো। তিনি তাঁর হাত আমার হাতের উপর রেখে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেন,‘বেটা, আমি চাই তুমি নিজেই খুঁজে বের করো–আবর বলছি, তুমি নিজেই বার করো খুঁজে কোত্থেকে দাবীশ পাচ্ছে তার রাইফেল, তার গোলা–বারুদ আর টাকা কড়ি, যা এমন ঢালাওভঅবে সে বিতরণ করণে, ব্যয় করছে! আমার মনে , বলতে গেলে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু আমি চাই যে, তোমরই মতো কেউ, যে জড়িত নয় প্রত্যক্ষভাবে, দুনিয়াকে জানিয়ে দাও আদ্–দাবীশের বিদ্রোহের পেছনে যে কুটির সত্য রয়েছে তার কথা.. . আমি মনে করি তুমি পারবে আসল ব্যাপারটি উদঘাটন করতে।’
ইবনে সউদ জানতেন তিনি যা করতে যাচ্ছেন, তার তাৎপর্য কি। তিনি সব –সময়ই জেনে এসেছেন আমি তাঁকে ভালোবাসি যদিও আমি তাঁর পলিসি সম্পর্কে তাঁর থেকে প্রায়ই ভিন্নমত পোষণ করি এবং আমার অমত আমি কখনও লুকাই না। তবু ও কখনো তিনি আমার প্রতি তাঁর আস্থা হারান নি; তিনি প্রায়িই আমার পরামর্শ গ্রহণ করেন। আমার বিশ্বাস, তিনি আমাকে আরো বেশি করে বিশ্বাস করেন এজন্য যে আমি তাঁর কাছ থেকে ব্যক্তিগত ফায়দা আশা করি না, এ কথা তিনি খুব ভালো করেই জানেন; তিনি খুবই সচেতন যে, তাঁর সরকারের কোনো চাকরি পর্যন্ত আমি গ্রহণ করবো না– কারণ আমি থাকতে চাই মুক্ত এবং স্বাধীন। এজন্য ১৯২৯ –এর গ্রীষ্মে সেই স্মরণীয় সন্ধ্যায় তিনি শান্তভাবে আমার নিকট তাঁর এই ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন, আমি যেনো ‘ইখওয়ান’ বিদ্রোহের পেছনে যে রাজনৈতিক চক্রান্ত –জাল রয়েছে তার স্বরূপ উদঘাটনের জন্য বেরিয়ে পড়ি। এ ছিলো এমন একটি দায়িত্ব যার মধ্যে নিহিত ছিলো বড়ো রকমের ব্যক্তিগত বিপদের আশংকা আর কেবলমাত্র প্রাণান্ত প্রয়াসের বিনিময়েই তা করা সম্ভব ছিলো।
কিন্তু ‘শুয়ুখ’ আমার প্রতিক্রিয়ায় হাতশ হননি। আমি যে তাঁকে এবং তাঁর দেশকে ভালোবাসি,তা বাদ দিলে আমাকে যে কাজের দায়িত্ব তিনি অর্পণ করলেন, তা আমার মনে হলো একটা দারুণ উত্তেজনাময় এ্যাডভেঞ্ঝারের সম্ভাবনায় পূর্ণ–চমক–লাগানো এক সাংবাদিক বার্তার সম্ভাবনার কথা না হয় অনুল্লিখিতই রইরো।
–‘হে দীর্ঘায়ু পুরুষ’, আমি দেরী না করেই জবাব দিই, ‘আমার চোখ, আমার শির আপনার হুকুমের তাবেদার। নিশ্চয় আমি যা পারি তা আমি করবোই!
–‘এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহই নেই মুহাম্মদ; এবং আমি চাই যে, তুমি তোমার এই মিশন গোপন রাখবে। এতে বিপদ থাকতে পারে। আচ্ছা তোমার বেগমের খবর কি?’
আমার সে স্ত্রী হচ্ছে রিয়াদের একটি বালিকা, যাকে আমি শাদি করেছিলাম আগের বছর। আমি বাদশাকে নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম হয়েছিলাম এ বিষয়েঃ
‘ও কাঁদবে না, হে ইমাম; আজকেই আমি ওকে তালাক দেবার কথা চিন্তা করছিলাম। আমরা একে অপরের উপযুক্ত বলে মনে হয়না।’
ইবনে সউদ সজ্ঞানে স্মিত হাসেন, কারন স্ত্রী তালাক দেবার বিষয়টা অপরিচিত নয়।
–‘কিন্তু অন্যদের খবর কি, তোমার জ্ঞাতি–গোষ্ঠীর?
–‘আমার বিশ্বাস কেউই নেই যে শোক করবে আমার যদি কিছু ঘটে; অবশ্য কেবল জায়েদের কথাই আলাদা–যে কোনো অবস্থায়ই সে থাকবে আমার সাথে এবং আমর যা ঘটবে জায়েদেরও ঘটবে তাই।’
–‘ভালোই তো’, বাদশাহ বললেন, ‘আরে,আমি না শেষে ভুলে যাইঃ এ কাজের জন্য তোমার কিছু টাকা–কড়ির দরকার হবে,’ এবং তাঁর পেছনে কুশনের নিচ হতে গলিয়ে তিনি বের করে আনলেন একটি থলে এবং গুঁজে দিলেন আমার হাতে, ওজন থেকে আমি তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলাম থরেটি সোনার মোহরে ভর্তি। আমার মনে পড়ে, আমি মনে মনে ভাবছিলামঃ আমি যে তাঁর এই নির্দেশ গ্রহণ করবো, এ বিষয়ে আমাকে তিনি জিজ্ঞাস করার আগেও কতোটা নিশ্চিতই না তিনি ছিলেন।.. .
.. . .. . .. . .. .
আমার কোয়ার্টারে ফিরে এসে আমি জায়েদকে ডাকি। আমার ফেরার ইন্তেজারিতে ছিলো জায়েদ।
–‘আচ্ছা জায়েদ, আমি যদি তোমাকে এমন একটি কাজে আমার সংগী হতে বলি যা পরিণামে হতে পারে বিপজ্জনক, তুমি কি আমার সাথে যাবে?’
‘জায়েদ জবাব দেয়, আপনি কি মনে করেন চাচা, আমি আপনাকে একা যেতে দেবো, বিপদ যা–ই হোক? কিন্তু আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
–‘আমরা যাচ্ছি আদ্–দাবিশ কোত্থেকে তার অস্ত্রশস্ত্র টাকাকড়ি পাচ্ছেন, তা উদঘাটন করতে। তাবে বাদশাহর নির্দেশ আমরা কী করছি, যতক্ষণ না সম্পন্ন হয়েছে, কেউ যেনো তা জানতে না পায়। কাজেই তোমাকে সতর্ক থাকতে হবে।’
জায়েদ আমাকে সাহস দেবার চেষ্টা ও পর্যন্ত করলো না। বরং সে আরো বাস্তব প্রশ্নটি উত্থাপন করলোঃ ‘এ বিষয়ে আমরা আদ্–দাবিশ কিংবা তাঁর লোকজনকে নিশ্চয় জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারি না। তাহলে এ কাজে আমরা কিভাবে আগাচ্ছি?
কিল্লা থেকে ফেরার পথেআমিও সমস্যাটি নিয়ে বারবার চিন্তা করছিলাম। আমার মনে হয়েছিলো, মধ্য নযদের শহরগুলির কোনো একটি থেকে শুরু করাই হবে সবচেয়ে প্রশস্ত যেখানে রয়েছে বহু ব্যবসায়ী সওদাগর, যাদের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে ইরাক ও কুয়েতের সংগে। শেষতক আমি বেছেনিলাম শাকরা শহরটি, ওয়াশম প্রদেশের রাজধানী, রিয়াদ থেকে প্রায় তিন দিনের পথ, যেখানে হয়তো আমার দোস্তা আবদুর রহমান আসসিবাই আমাকে সাহায্য করতে পারেন।
পরের দিনটি আমরা ব্যস্ত রইলাম আমাদের অভিযানের প্রস্তুতি নিয়ে। আমি চাইনি যে আমাদের গতিবিধির প্রতি লোকজনের নজর খুব আকৃষ্ট হোক। এ কারনে আমি জায়েদকে হুঁশিয়ার করে দিই আমাদের বরাবরকার রীতি মাফিক, বাদশাহর ভান্ডার থেকে রসদ না নিতে এবং বাজার থেকে আমাদের দরকারী সব কিছু খরিদ করতে। সন্ধ্যার আগেই সে যোগাড় করে ফেলে প্রায় দশ সের চাল, রুটি বানানোর জন্য একই পরিমামন ময়দা, একটা ছোট্ট চামড়ার থলে ভর্তি পরিশোধিত মাখন, খেজুর, কফিদানা এবং নিমক। তাছাড়া সে খরিদ করলো দুটি নতুন মশক, একটি চামড়ার বালতি এবং খুব গভীর ইঁদাররা তলা পর্যন্ত পৌঁছায় তেমন লম্বা ছাগ–পশমের ঝোলানো থলের মধ্যে আমাদের দু’জনের প্রত্যেকের জন্য দু’প্রস্থ কাপড় ঠেসে ভরলাম এবং উভয়ই গায়ে দিলাম ভারী ‘আবায়া’, যা শীতের রাতে জীনের উপর, রাখা কম্বলগুলিসহ আচ্ছাদনের কাজ করবে। আমাদের উষ্ট্রীগুরি কয়েক হপ্তা চারণক্ষেত্রে কাটিয়ে সওয়ারীর জন্য খুবই উপযোগী হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি আমি জায়েদকে যে উষ্ট্র্রীটি দিয়েছি তা হচ্ছে ওমানের একটি দৌড়ের উষ্ট্রী, যা চলে খুবই ক্ষিপ্রগতিতে, আর আমি সওয়ার হলাম উত্তরাঞ্চলের আসরি একটি বয়স্কা সুন্দর উষ্ট্রীর উপর, একদা যার মালিক ছিলেন হইলের রশিদী ‘আমীর’। এটি আমাকে দান করেন ইবনে সউদ।
রাত নেমে আসার পর আমরা সওয়ার হাঁকিয়ে বার হয়ে পড়ি রিয়াদ থেকে। সকালের দিকে আমরা পৌঁছুই ওয়াদি হানিফা, দুটি খাড়া পাহাড়ের মাঝে একটি গভীর বিরান নদীতল, যেখানে চৌদ্ধ’শ বছরের ও আগে একটি চূড়ান্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো–মহানবীর উত্তরাধিকারী ইসলামের প্রথম খলীফা আবু বকরের মুসলিম ফৌজ এবং ‘ভন্ড নবী’, বহু বছর ধরে মুসলমানদের ঘোর বিরোধী মুসায়লামার সেনাদলের মধ্যে। এই যুদ্ধ মধ্য আরবে ইসলামের চূড়ান্ত বিজয়র সূচনা করে। রসুলুল্লাহর প্রকৃত সাহাবীদের অনেকেই এ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন; ‘ওয়াদির’ শিলাময় ঢালুতে আজও তাঁদের কবরগুলি চোখে পড়ে।
দুপুরের আগে আমরা ধ্বংস প্রাপ্ত আইয়ায়ানা নগরী অতিক্রম করলাম;এককালে এই নগরী ছিলো এক বিশাল জনবহুল বসতি, ওয়াদি হানিফার দুই তীর বরাবর বিস্তৃত। সারি সারি দেয়াল, একটি মসজিদের নড়বড়ে খিলান, অথবা এখানে বিদ্যমান বিশাল প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ। এসব কিছুই আজকের দিনের নযদের সাদাসিধা মাটির দালান–কোঠার চেয়ে একটি াশোভনতারো স্থাপত্যরীতির পরিচায়ক। বলা হয়, দেড়’শ দু’শ বছর আগে পর্যন্ত দারীয়া থেকে (ইবনে সউদ খান্দানের প্রথম রাজধানী) ইইয়ায়না পর্যন্ত প্রায় পনের মাইল জায়গা জুড়ে ওয়াদি হানিফার সমস্ত গতিপথ জুড়ে ছিলো একটিমাত্র নগরী এবং দারীয়ার ‘আমীরের কোনো ছেলে জন্মালে কয়েক মিনিটের মধ্যে আইয়ায়নার শেষপ্রান্ত পর্যন্ত সে খবর পৌছে যেতো ছাদের মাথা থেকে মাথায়, রমণীদের মুখে মুাখে। আইয়ায়নার অবক্ষয়ের কাহিনী উপকথায় এমনি আচ্ছন্ন যে, ঐতিহাসিক তথ্য উদ্ধার করা সত্যি কঠিন। খুব সম্ভব, এ শহরের লোকের মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের শিক্ষা ও ব্যাখ্যা কবুল করতে নারায হওয়ায় প্রথম সউদী শাসক এটি ধ্বংস করিয়েছিলেন। কিন্তু ওহাবী উপকথা ভিন্ন। তাদের মতে আল্লাহর গজবের প্রমাণ হিসাবে আরাবার সকল ইদারা এক রাত্রির মধ্যে শুকিয়ে যায়, যার ফলে এর বাসিন্দারা নগর ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হয়।
তৃতীয় দিনের দুপুর বেলা আমাদের চোখে শাকরার মাটির দেয়াল আর কিল্লা আর উচু উচু পাম–গাছ, যা ঘর–বাড়ির উপর তুলে দাঁড়িয়ে আছে আমরা খালি বাগান আর খালি রাস্তার মধ্য দিয়ে উট হাঁকিয়ে যেতে থাকি এবং কেবল তখনি হঠাৎ মনে হলো, আজকে তো শক্রবার, নিশ্চয় সবাই মসজিদে চলে গেছ। কিছুক্ষণ পর পর পথে পড়তে লাগলো এক একজন স্ত্রীলোক, পা থেকে মাথা পর্যন্ত কালো ‘আবায়া’য় মোড়ানো’ অপরিচিতদের দেখে সে চমকে উঠছে এভং এ ত্বরিৎ সলজ্জ ভংগিতে সে তার মুকের ওপর নিকাব টেনে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করছে ঘরের ছায়ায়, খেজুর গাছের মাথার ওপর ঝিমুচ্ছে এক গাঢ উষ্ণতা।
আমরা সোজাসুজি গিয়ে পৌছুলাম আমাদের পেয়ারা দোস্ত আবদুর রহামন আসসিবায়ীর ঘরে। সে সময়ে তিনি ছিলেন প্রদেশের ‘বায়তুলমাল’ বা খাজাঞ্চিখানার দায়িত্বে। খোলা গেটের সামনে আমাদের সওয়ারী থেকে আমরা নেমে পড়ি এবং ঘর থেকে ছুটে এলো একটি নওকর ছেলে, আর সাথে সাথে জায়েদ ঘোষণা করে দিলো, ‘মেহমান হাজির’।
জায়েদ আর ছেলেচি বাড়ির প্রংগণে সওয়ারীর পিঠ থেকে জীন এবং জিনিসপত্র নামাচ্ছে, আর আমি আবদুর রহমানের ‘কফিখানা’য় নিজের বাড়ির মতো বসেছি আরাম করে। অন্য একটি নওকর দেরী না করে কফি তৈরির চুলার ওপর বসানো পিতলের পাত্রের নিচে আগুন ধরিয়ে দিলো। আমি প্রথম চামচ কফি গিলতে না গিলতেই উঠানের গলার আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেলো, প্রশ্ন প্রশ্নের জওয়াব। বাড়ির কর্তা ফিরে এসেছেন। সিঁড়ি থেকে–এখনও তাঁকে দেখা যাচ্ছে না–তিনি চিৎকার করে আমাকে জানান তাঁর খোশ–আমদের, তারপর তিনি দরজার চৌকঠে এসে দাঁড়ালেন দু’হাত প্রসারিত করেঃ একটি ছোটো–খাটো নাজুক স্বাস্থ্যের হালকা–পাতলা লোক, তাঁর দাড়ি হালকা বাদামী রঙের আর এক জোড়া গাঢ় গভীর কৌতুক উচ্ছ্বল চোখ, স্মিত হাসি–বিচ্ছুরিত মুখমন্ডল; গরম সত্তেও তিনি তাঁর ‘আবায়া’র নিচে পরছেন একটি লোমওয়ালা চামড়ার কোট, এই কোটটিকে তিনি সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ মনে করেন। যারা এর ইতিহাস জানতো না, তাদের একথা বলতে তিনি ক্লান্তি বোধ করতেন না যে এ কোটটি ছিলো হেজাজের সাবেক বাদশাহ শরীফ হোসাইনের এবং ১৯২৪ সনে মক্কা বিজয়ের পর এটি তাঁর, অর্থাৎ আবদুর রহমানের হস্তগত হয়। আমি এ কোট ছাড়া তাঁকে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
তিনি আমকে আলিঙ্গ করলেন উষ্ণ আবেগের সংগে এবং তাঁর পায়ের আঙুলের উপর দাঁড়িয়ে আমার দু’গালে চুমু খেতে বললেনঃ ‘আহলান ওয়া সাহলান ওয়া মারহাবা, ভাইজান।এ গরীবখানায় আপনার খোশেআমদেদ। সৌভাগ্যময় এই মুহুর্তটি, যা আপনাকে এখানে এনেছে।
তারপর শুরু হলো চিরচারিত প্রশ্নাদিঃ কোত্থেকে এসেছেন, কোথায় যাবেন, বাদশাহ কেমন আছেন, পথে কি বৃষ্টি হয়েছে অথবা নিদেনপক্ষে, আপনি কি বৃষ্টির কথা শুনেছেন?-আরবদের সংবাদ আদান – প্রদানের পুরা প্রথাটির পুনরাবৃত্তি! আমি তাঁকে বললাম, আমার গন্তব্য হচ্ছে মধ্য নযদের আনাইজা, যদিও আমার এই উক্তি পুরাপুরি সত্য ছিলো না, অথচ সত্যও হ’তে পারতো।
আগেকার বছরগুলিতে নযদ আর ইরাকের মধ্যে নানা রকমের তিজারতিতে ব্যাপৃত ছিলেন আবুদর রহমান; বসরা এবং কোয়েতের নাড়ি–নক্ষত্রের খবর তিনি জানতেন। স্থানগুলি সম্পর্কে তাঁকে কথা বলতে উৎসাহিত করা এবং হালফিল যেসব লোক ওখানে এসে থাকতে পারে কথা প্রসংগে তাদের সম্পর্কে তাঁকে কিছু জিজ্ঞাস করা মোটেই কঠিন কাজ ছিলো না-(কারণ আমার মনে হয়েছিলো, বলা হচ্ছে ফয়সাল আদ্–দাবিশ যখন কোয়েত সরহদের এতো কাছেই রয়েছেন। তাই তিনি তাঁর রসদ কোত্থেকে পাচ্ছেন–েএই স্থান কিংবা বসরা থেকে–তার কিছু ইংগিত পাওয়া যেতে পারে)। আমি জানতে পেলাম, আনাইজার মশহুর আল–বাসসাম পরিবারের একজন লোক–আমার অনেক দিনের পরিচিত–সম্প্রতি বসরা থেকে ফেরার পথে কোয়েত গিয়েছিলেন এবং বিদ্রোহী–অধ্যূষিত এলাকার মধ্য দিয়ে সফরের বিপদে নিজেকে নিক্ষেপ না করে নযদে ফিরেছেন বাহরাইন হয়ে। এই মুহূর্তে তিনি শাকরাতেই আছেন এবং আমি চাইলে আবদুর রহমান লোক পাঠিয়ে দেবেন তাকে আনার জন্য। কারণ পুরান আরবী রসুম মতে, নবাগত মেহমানের সাথেই এসে মুলাকাত করতে হয়, মেহমান সাক্ষাৎ করনেত যান না। কিছুক্ষণ পরই আবদুর রহমানের ‘কফিখানায় আমাদের সাথে এসে যোগ দিলেন–আবদুল্লাহ আল – বাসসাম।
যদিও আবদুল্লাহ ছিলেন নযদের সম্ভবত সবচেয়ে মর্যাদাবান ব্যবসায়ী পরিবারের লোক, তবু তিনি নিজে ধনী ছিলেন না। তাঁর সারাটা ‘জীবনই উত্থান আর পতনের কাহিনী এবং বেশির ভাগই পতনের–কেবল নযদে নয়, কায়রো , বসরা, কোয়েত, বাহরাইন এবং বোম্বেতে তিনি লাভ করেছেন এ অভিজ্ঞতা। সেব স্থানের কেউকেটা প্রত্যেককেই তিনি জানতেন এবং আরব দেশগুলিতে যা কিছু ঘটছিলো তার প্রত্যেকটি সম্পর্কে তথ্যের এক ভান্ডার তিনি বহন করতেন , তাঁর চতুর মস্তিকে। আমি তাঁকে বললাম, একটি জার্মান ব্যবসা –প্রতিষ্ঠান আমাকে যাচাই করে দেখতে বরোছে, কোয়েত এবং বসরার কৃষি যন্ত্রাদি আমদানি করা যায় কিনা, এবং যেহেতু এই ফার্মটি আমাকে মোট রকমের কমিশন দিতে চেয়েছে এজন্য এ দুটি শহরে স্থানীয় কোন কোন ব্যবসায়ী এ ধরণের প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারে তা খুঁজে বের করবার জন্য আমি উৎসুক। আল –বাসসাম কয়েকটি নাম উল্লেখ করে বলেন-,
–‘আমার বিশ্বাস, কোয়েতের কোনো লোক আপনার এ প্রজেকটের ব্যাপারে আগ্রহী হতে পারে। তারা হর–হামেশাই বিদেশ থেকে জিনিসপাতি আমদানি করে চলেছে এবং আজকাল ব্যবসা খুবই তেজী মনে হয়–এতো তেজী যে, প্রায় প্রত্যেক দিন বিপুল পরিমাণ চাঁদির ‘রিয়াল’ আসছে সোজাসুজি ত্রিয়েস্তের টাকশাল থেকে।’
চাঁদির ‘রিয়ালে’র উল্লেখে আমি রীতিমত ধাক্কা খাই। এই বিশেষ ধরনের ‘রিয়াল’, যার নাম ‘মারিয়া থেরেসা থেলার–আরবের সরকারী মুদ্রা গুলির পাশাপশি, গোটা উপদ্বীপের প্রধান বাণিজ্যিক মুদ্রা বলে গণ্য ছিলো। এটি তৈরী হতো ত্রিয়েস্তে এবং এর চাঁদির মূল্যের সাথে সামান্য কিছু মুদ্রা বানানোর মজুরি যোগ করে বিক্রি করো হতো বিভিন্ন সরকারের কাছে এবং কিছু সংখ্যক বিখ্যাত ব্যবসায়ীর কাছেও–যাদের ছিলো বেদুঈনদের মধ্যে বড় রকমের ব্যবসা–বাণিজ্য, কারণ বেদুঈনরা কাগজী মুদ্রা গ্রহণ করতো না, তারা গ্রহণ করতো কেবল সোনা এবং রুপার মুদ্রা, তার মধ্যে পছন্দ করতো মারিয়া থেরেসা থেলার নামক মুদ্রা। কোয়েতী ব্যবসায়ীদের দ্বারা এই সব মুদ্রার বিপুর আমদানি থেকে মনে হলো তার বেদুঈনদের সাথে তেজী তেজারতি চালাচ্ছে।
–‘কেন,’ আমি আল –বাসসামকে জিজ্ঞাস করি, ঠিক এই মুহূর্তেই কোয়েতী সওদাগরেরা ‘রিয়াল’ আমদানী করছে?’
–‘আমি জানি না’ বাসসাম জবাব দেন।তাঁর গলার আওয়াজে হতবুদ্ধির আভাস, –‘ওরা বলে ইরাকে নিয়ে বিক্রি করার জন্য কোয়েতের আশপাশের বেদুঈনদের কাছ থেকে ওরা কিনে গোশতের জন্য উট। আজকাল ইরাকে দাম নাকি খুবই চড়া–যদিও আমার কাছে ঠিক বোধগম্য নয়, এই দুর্ভোগের দিনে কোয়েতের আশপাশের স্তেপ অঞ্চলে উট তারা কি করে আশা করতে পারে? .. .‘ আমার বরং মনে হয়’, তিনি সহাস্যে যোগ করেন, ‘ইরাকে সওয়ারী উট কিনে আদ্ –দাবিশ এভং তার লোকজনের নিকট বিক্রি করাই হবে অধিকতর লাভজনক। তবে, সমস্য এই, এসবের দাম দেবার মতো টাক–কড়ি যোগাড় করতে পারবেন না আদ –দাবিশ.. .’
–‘পারবেন না, সত্যি?
সেই রাত্রে আমাদের মেজবান আমাদের জন্য যে কামরার ব্যবস্থা করলেন সেখানে ঘুমুতে যাওয়ার আগে আমি জায়েদকে এক কোণে ডেকে নিয়ে বলিঃ
‘–আমরা কোয়েত যাচ্ছি।
–‘এ কাজ মোটেই সহজ হবে না, চাচা– জায়েদ জবাব দেয়; কিন্তু তার কথার চাইতেও তার চোখের ঝিলিক পষ্টতরোভাবে ব্যক্ত হলো এমন একটি কাজের জন্য সে প্রস্তুত রয়েছে, যা কেবল কঠিনই নয়, চূড়ান্ত রকমের বিপজ্জনকও বটে! অবশ্য বাদশাহর প্রতি অনুগত ফৌজ ও বিভিন্ন গোত্রের এখতিয়ারে যে এলাকা রয়েছে তার মধ্য দিয়ে সফর করা তো ছেলেখেলারই শামিল। কিন্তু কোয়েতের সরহদ পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে কমপক্ষে প্রায় এক’শ মাইল চলতে হবে সম্পূর্ণভাবেই আমাদের নিজেদের উপর নির্ভর ক’রে,শত্রু এলাকার ভেতরে, যার মধ্য দিয়ে বিদ্রোহী মুতায়েরিএবং আজকান কবিলার লোকের অবিরাম আনাগোন করছে। অবশ্য আমরা সমুদ্রপথে বাহরাইন হয়ে যেতে পারতাম কোয়েত, কিন্তু তার জন্য দরকার হবে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে একটি অনুমতিপত্র। তার ফলে আমদের গতিবিধি ফাঁস হয়ে যাবে অতৎসুক সন্ধানী দৃষ্টির কাছে। আলযাওফ এবং সিরীয় মরুভূমি হয়ে ইরোকে সফর এবং সেখান থেকে কোয়েত যাত্রার ক্ষেত্রেও এই আপত্তি উঠবে, কারণ ইরাকে যে বহু সংখ্যক নিয়ন্ত্রণ ফাঁড়ি রয়েছে সেগুলির ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়ার কল্পনাও হবে দুরাশা। কাজেই কোয়েত পর্যন্ত সরাসরি স্থলপথটি ছাড়া আর কোনো পথা আমাদের জন্য রইলো না। কী করে ভেতরে ধনা পড়ে খোদ শহরটিতে প্রবেশ করা যাবে, সে এমনে এমন একটি প্রশ্ন যার সহজ জবাব এই মূহুর্তে সম্ভব নয়; কাজেই আমরা তা ছেড়ে ভবিষ্যতের হাতে, আমাদের কপালের উপর ভরসা করে এবং অদৃষ্টপূর্ব সুযোগ সম্ভাবনার প্রত্যাশায়।
আবদুর রহমান আস–সিবায়ী অনুরোধ করলো আমি যোনো তাঁর সংগে কয়েকটি দিন কাটাই। কিন্তু যখন আমি জরুরী কাজের ওজর দেখালাম, তিনি আমাদের পরদিন সকালে ছেড়ে দিলেন; আমাদের সংগে যে রেশন ছিলো তিনি তারসংগে দিলেন প্রচুর পরিমাণ শুকনো উটের গোশত। আগামী দিনগুলিতে আমাদের জন্য যে একঘেয়ে খাবার রয়েছে তার সংগে একটি সুস্বাদু সংযোজন। তিনি জোর দিয়ে বললেন, আমি যেনো তাঁর সংগে দেখা করি ফিরতি পথে যার জবাবে আমি কেবল বলতে পারলামঃ ইনশা আল্লাহ , আল্লাহ মর্জি হলে।
শাকরা থেকে আমরা উত্তর–পূর্ব দিকে চারদিন সফর করি অস্বাভাবিক–কিছুর মোকাবিলা না করেই। এক সময় আমরা অনুগত আওয়াযীম বেদুঈনদের নির্দেশে থামতে বাধ্য হলাম; যারা ছিলো ইবনে মুসাদের সেনাবাহিনীর অংশ। কিন্তু বাদশাহর কাছ থেকে পাওয়া আমার খোলা চিঠি মুহূর্তের মধ্যে ওদের শান্ত করে দেয় এবং রীতি অনুযায়ী মরুভূমির খবরবার্তা আদান–প্রদানের পর আবার আমরা আমাদের পথ ধরি।
পঞ্চম দিনের সূর্যোদয়ের আগেই আমরা এমন একটি এলাকায় এসে পৌছুই যার উপর আর ইবনে সউদের হাত প্রসারিত নয়। এখন থেকে দিনের বেলা সফরের আর প্রশ্নই ওঠে না; আমাদের একমাত্র নিরাপত্তা হচ্ছে অন্ধকারে এবং গোপনে আগানোতে।
বিশাল ওয়াদী আর–রুম্মার মূল গতিপথ থেকে খুব দূরে নয় এমন একটি সুবিধা জনক গলিতে আমরা তাঁবু খাটাই। ওয়াদী আর রুম্মা হচ্ছে বহু পুরানো শুষ্ক নদীতল, যা উত্তর আরবে মধ্য দিয়ে চলে গেছে পারস্য উপসাগরের মাথার দিকে। গলিটির উ পরে ঝুলে আছে ঘন ‘আরফাজ’ ঝোপ যা আমাদের জন্য একটি আড়ালের কাজ করবে, যতক্ষণ আমরা থাকবো প্রায় খাড়া তীর ঘেষে। আমরা আমাদের উটগুলিকে মজবুত করে বাঁধি এবং ওদের খেতে দিই মোটা বার্লির আটা খেজুরের আঁটির সংগে মিশিয়ে; আর এভাবেই ওদেরই চরণক্ষেত্রে ছেড়ে দেবার আবশ্যকাত মিটিয়ে দেই। এরপর আমরা স্থির হয়ে অপেক্ষা করি রাত্রির। আগুন ধরাবার সাহস হলো না আমাদের–কারণ দিনের বেলাও তার ধোঁয়া পারে আমাদের গোপন অবস্থানের কথা ফাঁস করে দিতে। তাই খেজুর আর পানি খেয়েই আমাদের তুষ্ট থাকতে হলো।
আমাদেরে এই সতর্কতা যে কত সুষ্ঠ এবং নির্ভুল তা পষ্ট হয়ে উঠলো শেষ বিকালের দিতে, যখন বেদুঈনী উট–চালকের একটি গানের সুর হঠাৎ আমাদের কানে ভেসে এলো। আমরা তাড়াহুড়া করে উটের লাগাম তুলে নিই যাতে ওরা জোরে জোরে নাকে নিঃশ্বাস ফেলতে না পারে। তারপর আমরা রাইফেল হাতে গলির ঢালস্বরূপ প্রচীর পিঠ চেপে দাঁড়াই।
অপরিচিত উট সওয়ারেরা যতোই কাছে আসছে তাতোই তাদের গানের সুর হয়ে উঠছে প্রবলতার; আমরা এরই মধ্যে পষ্ট বুঝতে পেলাম এই শব্দগুলিঃ ‘লাইলাহা ইল্লাহলাহ – লাইলাহা ইল্লাহলাহ’ – আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। এটি হচ্ছে ‘অসংস্কৃত’ বেদুঈনদের অধিকতর জাগতিক চারণ–সংগীতের বদলে ইখওয়ান–কর্তৃক গৃহীত স্বাভাবিক গান। এতো কোনো সন্দেহ নেই যে, ওরা ‘ইখওয়ান’, আর এ এলাকায় ইখওয়ান মানেই শত্রুভাবাপন্ন ইখওয়ান। কিছুক্ষণ পরেই গলির তীরের সোজা উপরেই একটি টিলার চূড়ায় দেখা দিলো আট –দশ জন ও সওয়ারের একটি দল, ওরা একটি মাত্র সারিতে আগাচ্ছে ধীরে ধীরে –বিকালের আকাশের পটভূমিকায় সুস্পষ্টভাবে চিত্রিত। প্রত্যেকেই মাথায় পরেছে লালসাদা চেকের ‘কুফিয়া’র উপর ‘ইখওয়ানে’র সাদা পাগড়ি , বুকে আড়াআড়িভাবে দুটি কাতুর্জের বেল্ট এবং তার পেছনে জীনের খিলের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে িএকটি রাইফেলঃ গম্ভীর ভয়ংকর উট সওয়ারের এক মিছিল চলেছে, একবার সামনে ঝুঁকে তারপর উট পেছনে হেলে। এভাবে সামনে পেছনে হেলে–দুলে উষ্ট্রীগুলির গতির তালের সংগে তাল মিলিয়ে এবং মহান, কিন্তু বর্তমানে–অপব্যবহৃত ক’টি শব্দ ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহর’ ধ্বনির সাথে সংগতি রেখে। দৃশ্যটি খুবই গাম্ভীর্যপূর্ণ এবং তৎসংগে করুণ ও বটে। ওরা এমন কতকগুলি মানুষ, যাদের নিকট পষ্টতই জীবনের আর সব কিছু অপেক্ষা ধর্ম অনেক বেশি মূল্যবান। ওদের ধারণা ওরা জেহাদ করছে ধর্মের পবিত্রতা এবং আল্লাহর বৃহত্তর মাহাত্মের জন্য, অথচ ওরা জানে না যে, ওদের উৎসাহ আর আগ্রহ আকাংখাকে নিয়োজিত করা হয়েছে এক বিবেক বিচারহীন নেতার উট্চবিলাশ পূরণে, ব্যক্তিগত ক্ষমতাই যার লক্ষ্য.. .
আমাদের দিক থেকে দেখলে ওরা ছিলো খাতের দক্ষিণ কিনারে। কারণ ওরা যদি বিপরীত দিকের পথ ধরতো ওরা খুব পরিষ্কার আমাদের দেখতে পেতো, যেমন এখন আমরা ওদের দেখতে পাচ্ছি আমাদের উপর ঝুলে–পড়া আবরণস্বরূপ ঝোঁপের নীচ থেকে । যখন ওরাা ওদের ধর্ম –সংগীত ভাঁজতে ভাঁতে আমাদের দৃষ্টি থেকে পাহাড়ের ঢালুতে হারিয়ে গেলো, আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
–‘ওরো জিনের মতো,’ ফিস ফিস করে জায়েদ, ‘হ্যাঁ জিনদের মতো–যারা জীবনের আনন্দ বলে কিছুই জানে না, মৃত্যুভয় বলে কিছু জানে না.. . ওরা সাহসী, ওদের ঈমান মজবুত, কেউ তা অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু ওরা স্বপ্ন দেখে কেবল খুন, মৃত্যু এবং বেহেশতের.. .
এবং কতকটা যেনো ‘ইখওয়ানে’র বিষণ্ণ শুদ্ধাচারিতার খেলাফেই অনেকটা ‘নীচু স্বরে’ সে আনমনা গাইতে শুরু করে একটা খুবই জাগতিক সিরীয় প্রেমের গান– ‘ওগো স্বর্ণাব বাদামী বরণের তন্বী কুমারী.. .
বেশ অন্ধকার হয়ে ওঠার সংগে সংগেই আমরা আবার শুরু করি আমাদের গোপন অভিযান, সুদূর কোয়েত অভিমুখে।
–‘দেখুন, দেখুন চাচা,’ হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে জায়েদ, ‘আগুন!
একটি বেদুঈন তাঁবুর জন্য অতি ক্ষুদ্র এ আগুন! হয়তো কোনো একাকী রাখাল রয়েছে ওখানে, কিন্তু বিদ্রোহীদের কেউ না হলে কোন রাখালের এ হিম্মত আছে যে এখানে আগুন জ্বালাবে? তুব ব্যাপারটি কী, খুঁজে দেখাই হবে ভাবে। যদি ওখানে কেবল একজন মানুষই থাকে, আমরা সহজেই তাকে বাগে আনতে পারি এবং হয়তো এ এলাকায় দুশমনের গতিবিধি সম্পর্কে কিছু মূল্যবান তথ্যও যোগাড় করতে পারি।
এখানকার মাটি বালুময় এবং আমরা যখন সতর্কতার সাথে আগুনটির দিকে আগাতে থাকি আমাদের উটগুলির পা থেকে কোনো শব্দই ওঠে না। সেই আগুনের আলোতে এখন আমাদের কাছে পষ্ট হয়ে উঠলো একাকী–বেদুঈনের হাঁটু গেড়ে বসা মূর্তি। মনে হলো, সে অন্ধকারের ভেতর উঁকি দিচ্ছে আমাদের দিকে এবং তারপর, সে যা দেখেছে তাতে সন্তুষ্ট হয়ে যেনো উঠে দাঁড়ালো ধীরে সুস্থে, বাহু দুটি আড়াআড়িভাবে রাখলো বুকের উ পর, হয়তো একথা বোঝাবার জন্য যে সে নিরস্ত্র এবং শান্তভাবে , বিন্দুমাত্র ভয় প্রকাশ না করেই অপেক্ষা করতে লাগলো আমাদের আগমনের জন্য।
–‘কে তুমি?’ জায়েধ তীক্ষ্ণ কন্ঠে প্রশ্ন করে,ছেঁড়া তালি–দেয়া কাপড়–পরা অপরিচিত লোকটির দিকে রাইফেল উঁচিয়ে ধ’রে।
বেদুঈনটি প্রশান্তভাবে মৃদু হাসে এবং গভীর ব্যঞ্জনময় স্বরে বলে, ‘আমি সুলুব্বি.. .।
তার প্রশান্তির কারণ এতোক্ষণে স্পষ্ট হয়ে এলো। সে যে অদ্ভুদ যাযাবর –সদৃশ গোত্রটির (অথবা বলা যায়, গোত্রগুলির একটি দলের) লোক যে গোত্র বেদুঈনদের প্রায় অন্তহীন যুদ্ধ–বিগ্রহে কখনো অংশ গ্রহণ করেনি; ওরা কারোরই শত্রু নয়, কেউই আ্ক্রমণ করে না ওদের।
সুলুব্বা গোত্রটি (একবচনে সুলুব্বি) এখনো একট দুর্বোধ্য রহ্যেই রয়ে গেছে অনুসন্ধানকারীদের কাছে। ওদের উদ্ভব সম্বন্ধে কেউ কিছু জানে না। ওরা যে আরবীয় নয় তা নিশ্চিত; ওদের রোদে গাত্রবর্ণ দেখে ওদের উদ্ভব সম্বন্ধে যা মনে হয়, ওদের নীল চোখ এবং হালকা বাদমী রঙের চুল তা থেকে ভিন্ন ইংগিত দেয় এবং বহন করে আরো উত্তরের অঞ্চলগুলির স্মৃতি। প্রাচীন আরব ঐতিহাসিকেরা বলেন, ওরা হচ্ছে সেই সব ক্রসেডারের বংশধর যাদের সালাহউদ্দিন গ্রেফতার করে আরবে নিয়ে এসেছিলেন। সেখানে পরে তারা মুসলমান হয়ে যায়। এবং আসলেই , সুলুব্বা নাম এবং ‘সলীব’ শব্দটির মূল একই অর্থাৎ ‘ক্রশ’, এবং ‘সুলুব্বী’ অর্থ ‘ক্রসেডার’।এ ব্যখ্যাটি সঠিক কি না বলা শক্ত। যা–ই হো, বেদূঈনরা সুলুব্বাদের আন–আরব বলে মনে করে– এবং ওদের প্রতি ব্যবহারে বেদুঈনদের রয়েছে কিছুটা উদার তাচ্ছিল্য। এই যে তাচ্ছিল্য, যা অতি স্পষ্টভঅবেই মানবিক সাম্যবোধের প্রত্যক্ষ বিরোধী এর ব্যখ্যা করতে গিয়ে ওরা, বেদুঈনেরা েএ কথারই উপর জোর দেয় যে, এ লোকগুলি একীনের দিক দিয়ে আসলে মুসলমান নয়, ওরা মুসলমানের মতো জীবন যাপন করে না। ওরা বলে, সুলুব্বারা বিয়ে করে না। ওরা ‘কুকুরের মতো অবাদ যৌন মিলনে অভ্যস্থ’;এমনকি, এ বিষয়ে ওরা নিকট–রক্ত সম্পর্ককেও গুরুত্ব দেয় না। তাছাড়া ওরা মরা খায় যা মুসলমানদের বিবেচনায় নাপাক, অপবিত্র। একটা কিছু ঘটে যাওয়ার পর তার যুক্তিসিদ্ধতা প্রতিষ্ঠতার প্রয়াসও এ হতে পারে। আামর বরং মনে হয়ে, সুলুব্বার জাতিগত বৈদেশিকতা সম্পর্খে বেদুঈনদের চেতনাই চরম বংশ–সচেতন, বেদুঈনদের ওদের চারিদিকে তাচ্ছিল্যের একটি ঐন্দ্রজিালিক বৃত্ত আঁতে বাধ্য করে, আর এ হচ্ছে ওদের রক্তের সংগে অন্য জাতের রক্ত–মিশ্রণের বিরুদ্ধে বেদুঈনদের একটি সহজাত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা সুলুব্বুদের ক্ষেত্রে ছিলো নিশ্চয়ই খুব আক র্ষণীয়ঃ কারণ, প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবেই ওরা হচ্ছে একটি সুন্দর জাতি, অন্য সকল আরবের চেয়ে দীর্ঘদেহী এবং ওদের অংগ প্রত্যংগে বিন্যাসের মধ্যে রয়েছে চমৎকার পারিপাট্য; বিশেষ করে, ওদের মেয়েরা অতি লাবণ্যময়ী, মোহময় দৈহিক সৌন্দর্য এবং অংগ সঞ্চালনের মাধুর্যে ডগমগ।
কিন্তু কারণ যাই হোক, সুলুব্বার প্রতি বেদুঈনদের তাচ্ছিল্যই ওদের জীবরেন দিয়েছে নিরাপত্তা; কারণ , ওদের যে –ই আক্রমণ করে, অথবা যে ব্যক্তিই ওদের ক্ষতি করে, সে–ই তার কবিলার লোকজনের দৃষ্টিতে মান –ইজ্জত খুইয়েছে বলে মনে করা হয়। তা ছাড়াও, সকল মরুবাসীর কাছেই সুলুব্বুদের খুব কদর–পশু চিকিৎসক, জীন নির্মাতা, টিনের কারিগর ও কামার হিসাবে। বেদুঈনেরা নিজেরা যদিও কুটির –শিল্প তথা হাতের কাজকে খুবই ঘেন্না করে তবু েএ সব জিনিসের প্রয়োজন হয় তাদেরও; এবং তাদের এই প্রয়োজনে সাহায্য করবার জন্য রয়েছে সুলুব্বা। তা ছাড়া ওরা পশুপালক হিসাবেও পটু, আর সবার উপরে, শিকারে ওরা সন্দেহতীতভাবেই উস্তাদ। ওদের পথের চিহ্ণ বোঝঅর ক্ষমতা প্রায় উপকথার পর্যায়ের;আর এক্ষেত্রে ওদের সাথে তুলনীয় হচ্ছে একমাত্র আল–মুররা বেদুঈনরো যারা বাস করে জনশূন্য এলাকার ১[Empty Quarter] উত্তরাঞ্চলের প্রান্তদেশে।
আমাদের নতুন পরিচিতি লোকটি যে একজন সুলুব্বী একথা জানতে পেরে আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমি ওকে খোলখুলি বললাম, আমরা ইবনে সউদের লোক। ওকে ওর আগুন নিবিয়ে ফেলার জন্য অনুরোধ করলাম। এভাবে আমাদের পরিচয় দান ছিলো বেশ নিরাপদ। কারণ এ লোকগুলি ওদের উপরওয়ালাদের খুবই সম্মানের চোখে দেখে। এরপর আমরা মাটির উপর বসে পড়ি এবং দীর্ঘ আলাপ জুড়ে দিই।
আদ –দাবিশের ফৌজের বিন্যাস সম্পর্কে এ বেশি কিছু বলতে পারলো না। ‘কারণ’, ও বললো, ‘ওরা সবসময়ে চলছে আর চলছেই জিনদের মতো এবং একনো এক জায়গাই বেশিক্ষণের জন্য ওরা থামে না।’ অবশ্য এটুকু জনা গেলো, ঠিক এ মূহুর্তে আমাদের খুব আশেপাশে শত্রুভাবাপন্ন ইখওয়ান –এর বড় কোন আড্ডা নেই, যদিও ছোটো ছোটো দল অনবরত মরুভূমি অতিক্রম করছে বিভিন্নমুখে হঠাৎ আমার মনে একটা ধারণ এলোঃ আমরা কি আমাদের কোয়েতের পথ দেখিয়ে যাওয়ার জন্য সুলুব্বির শিকারের এভং পথ চেনার সহজাত ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারি না?
–‘তুমি কি কখনো কোয়েত গিয়েছো?’ আমি তাকে জিজ্ঞাস করি। সুলুব্বি হেসে ফেলে– ‘বহুবার। আমি ওখানে হরিণের চামড়া বিক্রি করেছি এবং মাখন আর উটের পশম পরিষ্কার করেছি। কেন, আমি তো মাত্র দশদিন হলো ওখান থেকেই ফিরেছি।’
–‘তাহলে তো তুমি আমাদের কোয়েতের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারো? –অর্থাৎ আমাদের এভাবে নিয়ে যেতে পারো যাতে পথে ‘ইখওয়ান’কে এড়িয়ে আমরা কোয়েত পৌঁছুতে পারি।
আমার এ প্রশ্ন সম্পর্কে কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে সুলুব্বি। তারপর দ্বিধঅর সাথে বলে, ‘আমি হয়তো পারি, কিন্ত আপনাদের সাথে ‘ইখওয়ানের হাতে ধরা পড়লে হবে খুবই বিপদ। হ্যাঁ আমি অবশ্যি পারি,.. . কিন্তু আপনাদের জন্য তা হবে খুবই ব্যয়বহুল।’
–‘কতো?’
–‘বেশ’, এবং আমি ওর কন্ঠস্বর ধরতে পারলাম লোভের স্পনদন, ‘বেশ হুযুর, আপনি যদি আমাকে একশ’ রিয়াল দেন, আমি আপনাকে এবং আপনার বন্ধুকে এভাবে কোয়েত নিয়ে যেতে পারি যে, আকাশের পাখি ছাড়া আর কারো নজর পড়বে না আমাদের উপর।
একশ\’ রিয়াল দশটি আশরফির সমান, আমাদের জন্য এর তাৎপর্যের কথা বিচার করলে অংকটি হাস্যকরভাবেই তুচ্ছ। কিন্তু সুলু্ব্বি হয়তো ওর নিজের হাতে এত নগদ অর্থ জীবনে কখনো দেখেনি।
–আমি তোমাকে একশ’ রিয়ালই দেবো, বিশ রিয়াল এই মুহুর্তে এবং বাকীটা দেবো কোয়েত পৌঁছুনোর পর।’
ওর দাবী যে এত সহজেই মঞ্জুর হয়ে তা হয়তো আশা করেনি আমাদের পথ প্রদর্শক। হয়তে, সে কেন আরো মোটা অংক দাবী করেনি এজন্য তার অনুশোচনাই হলো। কারণ একটু চিন্তা করে সে বললো–‘কিন্তু আমর উটটির কি হবে? আমি যদি আমার উট হাঁকিয়ে আপনাদের সাথে কোয়েত নাগাত যাই এবং আবার ফিরে আসি, বেচারা জানোয়ারটির একেবারেই দফারফা হয়ে যাবে, আর আমার উট তো মাত্র একটিই।’
আমি কথাবার্তা আর দীর্ঘ হতে না দিয়ে ত্বরিৎ জবাব দিইঃ ‘আমি তোমার উটটি কিনে নেবো। তুমি এই উটে চড়ে কোয়েত যাবে এবং সেখানে আমি তোমাকে উপহার দেবো এটি। তবে আমদের ফিরতি পথও দেখিয়ে নিয়ে আসতে হবে তোমাকে।
এ ছিলো তার আশার অতীত। খুশীতে ডগমগ হয়ে দেরী না করে সে উঠে দাঁড়ালো এবং অন্ধকারে হারিয়ে গেলো। কয়েক মিনিট পরে সে আবার ফিরে এলো এবং রশি ধরে টেনে টেনে নিয়ে এলো একটি বয়স্ক অথচ সুন্দর, স্পষ্টতই শক্ত–সমর্থ জানোয়ার। কিছুক্ষণ দর–কষাকষির পর আমরা ওর দাম স্থির করি এশ পঞ্চাশ রিয়াল। শর্ত হলো, আমি এখন ওকে পঞ্চাশ রিয়অল শোধ করবো এবং বাকীটা ওর পুরষ্কার সহ ওকে দেওয়া হবে কোয়েতে। আমাদের জীনের পাশে ঝোলানো ব্যগ থেকে জায়েদ বের করে রিয়ল–ভর্তি িএকটি থলো এবং আমি মুদ্রাগুলি গুণে গুণে সুলুব্বির কোলে ফেলতে থাকি। সে ওর বিছানার চাদরের তৈরি পোশাকের নীচ থেকে এক চুকরা কাপড়া বের করে, যাতে বাঁধঅ ছিলো ওর টাকাকড়ি এবং যখন সে আমার রিয়ালগুলি ওর পুঁজির সাথে যোগ করতে শুরু করলো একটা নতুন মুদ্রার দ্যুতি আমার চোখে ভেসে উঠলো।
–‘থামো,’ – ওর হাতের উপর আমার হাত রেখে আমি প্রায় চিৎকার করে উঠি, ‘তোমার ঐ ঝকঝকে রিয়ালটি আমাকে দেখতে দাও।’
একটু দ্বিধঅর ভংগি করে, যেনো সে লুণ্ঠিত হাবর ভয়ে আতংকিত, সুলুব্বি ওর মুদ্রাটি আলতো করে অতি মোলায়েমভাবে আমার হাতে তালুর উপর রাখলো। নতুন মুদ্রার মতোই মুদ্রাটির কিনার বেশ ধারালো মনো হলো। তবু ও নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি একটি দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মুদ্রাটির দিকে তাকাই। হ্যাঁ, এটি অবশ্যই একিট নতুন ‘মারিয়া থেরেসা’ মুদ্রা, যেনো এইমাত্র টাকশাল থেকে এসেছে। এবং সুলুব্বির বাকী মুদ্রাগুলির উপর দেশলাইয়ের কাঠি ধরে আমি দেখতে পেলাম আরো পাঁচ–ছয়টি মুদ্রা, একই রকম বিস্ময়কররূপে নতুন।
–‘তুমি এ রিয়ালগুলি কোথায় পেলে?’
–‘আমি .. . আমি কসম করে বলছি হুজুর , আমি এগুলি সদুপায়েই পেয়েছি।.. . আমি এগুলি চুরি করিনি। কয়েক হপ্তা আগে কোয়েতে এক মুতায়েরী আমাকে এগুলি দিয়েছে। সে আমার নিকট থেকে একটি নতুন উটের গদি কিনেছিলো। কারণ তার গদিটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।’
–‘মুতায়েরী? তুমি ঠিক বলছো?’
–‘আমি ঠিকই বলছি হুজুর! আমি যদি মিথ্যা বলি, আল্লাহ যেনো আমাকে তুলে নেয়। ওছিলো আদ–দাবিশের লোকদের একজন সেই দলের লোক, যারা সম্প্রতি লড়াই করছিলো হাইলের ‘আমীরে’র বিরুদ্ধে। তার নিকট থেকে গদীর জন্য টাকা নেওয়া নিশ্চয় অন্যায় হয়নি। আমি না বলতে পারিনি এবং আমার বিশ্বাস ‘শুয়ুখ’ – আল্লাহ তাঁর হায়াত দারাজ করুন – তা বুঝবেন।
আমি তাকে আবার আশ্বস্ত করি এই বলে যে, বাদশঅহ তাকে দুশমন মনে করবেন না। এতে ওর আতংক দূর হলো। আরো প্রশ্ন করে জানতে পারি অনেক সূলুম্বা আদ –দাবিশের পক্ষের বিভিন্ন লোকের নিকট থেকে এ ধরণের মুদ্রা পেয়েছে, জিনিস –পত্র অথবা ছোটোখাটো কাজের বিনিময়ে.. .
আমাদের সুলুম্বি সত্যি প্রমাণ করলো যে, পদপ্রদর্শক হিসাবে সে অসাধঅরণ। তিন রাত ধ’রে সে আমাদের বিদ্রোহী এলাকার মাঝ দিয়ে, সর্গিল গতিতে , পথ–চিহ্ণহীন এলাকা অতিক্রম করে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে–িএমন সব এলাকা যা জায়েদ নিজেও আগে দেখেনি কোনোদিন, যদিও দেশটাকে জায়েদ ভাল করেই চেনে। দিনগুলি কাটলো কিন্তু লুকিয়ে, আত্মগোপন করে। গা ঢাাক দেওয়অর জন্য সন্দেহমুক্ত জায়গা খুঁজে বার করতে সুলুম্বি ছিলো সেরা এক উস্তাদ। এক সময় ও আমাদের নিয়ে গেলো একটি পানির গর্তের কাছে, যা সে অঞ্চলের বেদুঈনদের কাছেও ছিলো অজানা, সুলুম্বি আমাদের বললো। এর কিছুটা লোনা বাদামী পানিতে আমাদের উটগুলি ওদের পিয়াস মিটায় আর আমরাও আমাদের মশকগুলি আবার পানিতে ভর্তি করে নিতে সমর্থ হই। কেবল দু’বার আমরা দেখতে পেলাম ‘ইখওয়ান’দের কয়েকটি দল, কিন্তু কোনবারই ওরা আমাদের দেখে ফেলতে পারে, তেমন সুযোগ ওদের দেওয়া হলো না।
সুলুম্বির সাথে আমাদের সাক্ষতের পর চতুর্থ দিনের পূর্বাহ্ণে আমরা এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছুই যেখনা থেকে কোয়েতের শহর দেখা যায়। নযদ থেকে আগত মুসাফিরদের পক্ষে যা করা স্বাভাবিক আমরা তা করলাম না; দক্ষিণ –পশ্চিম দিক থেকে শহরে প্রবেশের চেষ্টা না করে আমরা আগাই পশ্চিম দিক থেকে, বসরা থেকে আসা সড়ক বরাবর, যেনো আমাদের সংগে কারো দেখা হলে সে মনে করে আমরা ইরাকী ব্যবসায়ী।
কোয়েতে ঢুকেই আমরা এক সওদাগরের প্রংগণে খাতিরজমা হয়ে বসে পড়ি। জায়েদ যখন ইরাকের কনস্টেবল বাহিনীতে ছিলো তখন থেকেই সে এই সওদাগরকে চেনে।
ধূলায় আচ্ছন্ন সড়ক এবং রোদে–পেড়া কাদার ইটে তৈরি ঘরবাড়ির উপর ছড়িয়ে রয়েছে একটা স্যাঁতস্যঁতে পীড়াদায়ক গরম; নযদের মুক্ত স্তেপ অঞ্চলের সাথে অভ্যস্ত আমি দেখতে নাদেখতেই ঘামে একেবারে ভিজে যাই। কিন্তু আরাম করার সময় ছিলো না। সুলুম্বির দায়িত্বে উটগুলি রেখে দিয়ে আমি আর জায়েদ আগিয়ে গেলাম বাজারের দিকে আমদের উদ্দিষ্ট প্রাথমি খোঁজ–খাবর নেবারজন্য। সুলুম্বিকে কড়া আদেশ দিলাম– আমরা কোত্থেকে এবং কেন এসেছি সে যেনো কাউকে না বলে।
যেহেতু কোয়েতের সাথে আমি পরিচিত নই এবং এও আমার ইচ্ছা নয় যে, আমার উপস্থিতির কারনে জায়েদ মানুষের দৃষ্টি আক র্ষণ করে বসে, এজন্য আমি প্রায় ঘন্টাখানেক অবস্থান করি একটি কফিল দোকানে, সেখানে বসে বসে কফি খঅই এবং নারকেলের ‘হুকা’ টানি। অবশেষে জায়েদ যখন আবার দেখা দিলো তার মুখে সাফল্যের অভিব্যক্তি দেখে আমি বুঝতে পারলাম নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু সে আবিষ্কার করেছে।
–‘চাচা, চলুন আমরা বাইরে যাই। কেউ না শুনে এমন কথা বলা বাজারেই সহজতরো। আর এই যে, আপনার জন্য একটি জিনিস এনেছি–আমার জন্যও একটি।’ বলতে বলতে সে তার ‘আবায়া’র নীচ থেকে বের করে টশ–বোনা বাদমী উলের তৈরী দুটি ইরাকী ইগাল। ‘এগুলির দ্বারা আমরা গণ্য হবো ইরাকী ব’লে।’
সতর্ক জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে জায়েদ নিশ্চিত হয়েছে, তার একসাবেক অংশীদার –যে তার সংগী ছিলো পারস্য উপসাগরে তার সেদিনের চোরাই কারবারের দিনগুলিতে–এখন কোয়েতে বাস করছে, আর বাহ্যত এখনো সে তার পুরান অভ্যস্ত ব্যবসাই চালিয়ে যাচ্ছে।
–‘কেউ যদি এ শহরে চোরই বন্দুক আমদানি সম্পর্খে আমাদের কিছু বলতে পারে সে হচ্ছে এই বান্দারঃ বান্দার আমারই মতো ম্যাম্মার কবিলার লোক, সেই একগুঁয়ে যুবকদের একজন, যারা ইবনে সউদের শাসন পুরাপুরি মেনে নিতে পারেনি। কিছুতেই ওকে জানানো উচিত হবে না যে আমরা ‘শুয়ুখে’র জন্য কাজ করছি। এমন কি, আমি মনে করি, আমরা কোত্থেকে এসেছি, তা’ও পর্যন্ত ওকে বলা যাবে না। কারণ, বান্দার আসলে নির্বোধ নয়। সে ভারি ধূর্ত –বলতে কি –অতীতে সে আমাকে এক ঘন ঘন প্রতারণা করেচে যে, আমি ওকে এখন বিশ্বাস করতেই ভয় পাই।’
শেষ পর্যন্ত আমরা বান্দারকে খুঁজে পেলাম বড় বাজারের নিকটে, এক চিপা গলির বাড়িতে। লোকটি দীর্ঘদেহী একহারা গড়নের, হাল্কা পাতলা, চল্লিশের মতো বয়স, চোখ দুটি তার গাঢ় গভীর আর মুখে তার তিক্ততা ও বদহজমির ছাপ। কিন্তু জায়েদকে দেখার সংগে সংগে তার মুখের রেখাগুলি সত্যিকার খুশিতে আলোকিত হয়ে ওঠে। আমার হালকা রঙের জন্য আমার পরিচয় দেওয়া হলো আমি একজন তুর্কী এবং আমি বাস করছি বাগদাদে আর বসরা থেকে বোম্বেতে আরবী তেজী ঘোড়া রফতানীর ব্যবসা করে আসছি।
–‘কিন্তু আজকাল বোম্বেতে ঘোড়া রফতানী করে আর লাভ হয় না’, জায়েদ যোগ করে, ‘আনাইজা আর বুরাইদার সওদাগরেরা ওখনকার বাজার একোবরেই কব্জা করে নিয়েছে।’
–‘আমি জানি’, বান্দার জবাব দেয়, ‘ইবনে সউদের ঐ পাজি দক্ষিণারা আমাদের দেশ দখল করেই তুষ্ঠ নয়; ওরা আমাদের রুজি–রোজগার কেড়ে নেবার জন্য ওঠে ড়ে লেগেছে!
–‘কিন্তু বান্দার, বন্দুকের ব্যবসা সম্বন্ধে তুমি কি বলো?’ – জায়েদ জিজ্ঞেস করে, ‘মুতায়ের এবং আজমান কবিলার লোকেরা যেভাবে ইবনে সউদের ঘাড় মটকাতে চাইছে তাতে তো এ ব্যবসা এন খুবই তেজী হওয়ার কথা, কি বলো?’
–‘হ্যাঁ। ব্যবসা এখানে খুব তেজীই ছিলো’, বান্দার তার কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, ‘কয়েক মাস আগেই আমি বেশ দু’পয়সা কামাই করেছি ট্রান্স– জর্ডানে রাইফেল কিনে, পরে সেগুলি আদ –দাবিশের লোকের কাছে বিক্রি করে। কিন্তু সবই এখন একদম নষ্ট, একদম শেষ! এটি রাইফেলও তুমি আর বিক্রি করতে পারবে না।’
–‘তা কেমন ক’রে হয়? আমার তো মনে হয়, এগুলি আগের চেয়ে অনেক বেশি দরকারী আদ –দাবিশের জন্য।’
–‘হ্যাঁ,’ ‘বান্দার পাল্টা জবাব দেয়, ‘দরকার তার নিশ্চয় আছে। কিন্তু অমন দামে সে এগুলি পাচ্ছে যে দামে তুমি আমি কেউই বিক্রি করতে সমর্থ নই। .. . সে বাক্স বোঝাই ওগুলির পায় সমুদ্রের ওপার থেকে, প্রায় নতুন ইংলিশ রাইফেল এবং দু’শ কার্তুজ –সহ একটি রাইফেলের জন্য সে দাম দেয় দশ রিয়াল।’
–‘আলহামদু লিল্লাহ!’ আন্তরিক বিস্ময়ের সংগে উচ্চারণ করে জায়েদ, দু’শ কার্তুজ সহ প্রায় নতুন একটি রাইফেল দশ রিয়ালে! কিন্তু তা অসম্ভব.. .।
বাস্তবে তা অসম্ভবই মনে হলো– কারণ সে সময়ে কার্তুজ ছাড়াই একটি পুরানা লী–এনফিল্ড রাইফেলের দাম নযদে ছিলো ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ রিয়াল এবং নযদের চাইতে কোয়েতে দাম কম হতে পারে এ কথা বিবেচনা করলেও বিপুল পার্থক্যের কারণ তখনো বোঝা যাচ্ছিলো না।
বান্দার মুখ বাঁকিয়ে হাসে, ‘হ্যাঁ, মনে হয় ক্ষমতাশালী বন্ধু –বান্ধব রয়েছে আদ –দবিমের –খুব ক্ষমতাশালী বন্ধুজন। কেউ কেউ তা বলেঃ একদিন সে স্বাধীন এক ‘আমী’র হয়ে বসবে নযদের উত্তর অঞ্চলে।’
–‘বান্দার, তুমি যা বলছো’, মাঝখানে আমি বলি, ‘তা খুবই ভালো, খুবই ঠিক। আদ –দবিশের হয়তো সত্যি সত্যি ইবনে সউদের আওতার বাইরে নিজের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করবেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, তার টাকা পয়সা নেই, আর টাকা পয়সা ছাড়া বিশ্বজয়ী আলেকজাণ্ডারের পক্ষেও রাজ্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব ছিলো না।
বান্দার উচ্চকণ্ঠে হো হো করে ওঠেঃ টাকা–পয়সা? আদ –দাবিশের প্রচুর আছে–প্রচুর নতুন রিয়াল, যা রাইফেলের মতোই বাক্স – বোঝাই হয়ে তার নিকট আসে সমুদ্রের ওপার থেকে।’
–‘বাক্স বোঝায় রিয়ালা? বড় তাজ্জবের কথা! বেদুঈন কোত্থেকে পাবে বাক্স বোঝঅয় নতুন রিয়াল?’
–‘তা আমি জানি না ’– বান্দার জবাব দেয়, ‘তবে এ আমি জানি, তার কিছু লোক প্রায় রোজই নতুন রিয়ালের ডেলীভঅরী নিচ্ছে যা তাদের নিকট পৌঁছুচ্ছে শহরে বিভিন্ন সওদাগরে মাধ্যমে। কেন, কালই তো আমি দেখলাম, বন্দরে এ ধরনের বাক্স নামানোর কাজ তদারক করছে ফারহান ইবনে মাশহুর।’
এ ছিলো একটি খবরের মতো খবর। আমি ফারহানকে ভালো করেই জানি। সে সিরিয়ার বিখ্যাত বেদুঈন সর্দার নূরী আশ –শালানের ভাইপোর পুত্র। এই নূরীই একদা লরেন্সের সংগে মিলে লড়াই করেছিলো তর্কীদের বিরুদ্ধে। তরুণ ফারহানের সংগে আমার প্রথম দেখা হয় দামেশকে ১৯২৪–এ; ওখানে আমোদ–প্রমোদের সন্দেহপূর্ণ সকল জায়গায় মাতলামির জন্য সে ছিলো কুখ্যাত। কিছুদিন পর তার বড় চাচার পিতার সংগে তার ঝগড়া বাঁধে। তখন সে তার কবিলা ও রুবালার কিছু লোকজন নিয়ে চলে যায় নযদে, আর ওখানেই সে হঠাৎ ‘ধার্মিক’ হয়ে ওঠে এবং ‘ইখওয়ানে’র সাথে যোগ দেয়। তার সংগে আমার আবার দেখা হয় ১৯২৭ সনে, হাইলে ইবনে মুসাআদের কিল্লায়। তখন সে তার নবার্জিত ধর্মের প্রতীক হিসাবে পরতে শুরু করেছে ‘ইখওয়ানে’র সাদা বিশাল পাগড়ী আর উপভেঅগ করছে বাদশাহর আর্থিক অনুগ্রহ। আমি তাকে বাগদাদে আমাদের পূর্বেকার দেখা–সাক্ষাতের কথা মনে করিয়ে দিলে সে সহসা প্রসংগ বদল করে ফেলে। লোকাটি নির্বোধ এবং উচ্চাভিলাষী, আর এ করণেই সে আদ –দাবিশের বিদ্রোহের মধ্যে দেখতে পেলো বিশার ধূ– ধূ নুফুদের উত্তরে একটি ওসেসি আর – জাউফের স্বাধীন আমীররূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার একটি সুযোগ; কারণ , অন্য দেশের মতো আরবেও বিদ্রোহীরা সিংহ শিকার করার আগেই নিজেদের মধ্যে সিংহের চামড়া ভাগ করার সনাতন রীতি অনুসরণ করে থাকে।
–‘তা‘হেলে ফারহান এখনে, কোয়তেই রয়েছে? আমি বান্দারকে জিজ্ঞাস রি।
–‘আলবৎ । আদ –দবিশের মতোই এখানে সে ঘন ঘন আসে এবং ‘শায়খে’র প্রসাদে অবাদে আসা যাওয়া করে। লোকে বলে শায়খ তাকে খুবই ভালোবাসেন।’
–‘কিন্তু কোয়েতে আদ –দাবিশ এবং ফারহানের আগমনে ব্রিটিশ গর্ভমেন্ট কি কোনো আপত্তি করে না? আমার যেনো মনে পড়ে, ক’মাস আগে ওরা একবার ঘোষণা করেছিলো আদ –দাবিশ বা ওর লোকজনদের এ অঞ্চলে ঢুকতে দেবে না .. .?
বান্দার আবার হো হো করে ওঠে – হ্যাঁ তা–ই করেছিলো ওরা, তা–ই করেছিলে! কিন্তু আমি তো আমাকে বলেছি, আদ –দাবিশের রয়েছে খুব ক্ষমতাশালী বন্ধু–বান্ধব .. . এই মুহূর্তে সে এ শহরে আছে কি না এ ব্যাপারে আমি নই;কিন্তু ফারহান আছে। সে রোজ সন্ধ্যায় ‘মাগরিবে’র সালাতের জন্য বড় মসজিদে যায়। যদি আমাকে বিশ্বাস না করো, এখানে তুমি ওকে তোমার নিজের চোখেই দেখতে পারো .. .।
এবং সত্যিই আমরা দেখতে পেলাম ওকে। বান্দারের কাছ থেকে এই ইংগিত পাওয়ার পর বড় মসজিদের সন্নিকটে সন্ধ্যার প্রথমদিকে আমি আর জায়েদ যখন পায়চার করছিলাম, একদল বেদুঈনের সাথে আমরা প্রায় ধ্ক্কা খাই আর কি! চেহারায় সন্দেহাতীতভাবেই নযদী এই বেদুঈনগুলি রাস্তার একটি কোণ থেকে বের হয়ে এসেছিলো। ওদের অগ্রভাগে রয়েছে চৌত্রিশ–পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের একজন লোক,যে–সব দীর্ঘদেহী বেদুঈন ওকে ঘিরে আছে এবং অনুসরণ করছে তাদের চাইতে কিছুটা খাটো, আর সুন্দর মুখখানায় তার শোভা পাচ্ছে খাটো কালো দাড়ি। আমি মুহূর্তেই তাকে চিনতে পারলাম। অবশ্য আজো আমি জানি না, সে আমাকে চিনতে পেরেছিলো কি না। তার চোখ এক ঝলকের জন্য স্থির হলো আমার চোখেল উপর; তারপর পলকের জন্য আমার উপর সে তার চোখ বুলিয়ে নেয় একটা বিমুঢ় দৃষ্টিতে, যেনো একটা ঝাপসা অস্পষ্ট স্মৃতিকে সে স্মরণে আনবার চেষ্টা করছে। তারপর সে তার মুখ ফিরিয়ে নিলো। মুহুর্তকাল পর মসজিদের দিকে ধাবমান মানুষেরে ভিড়ের মধ্যে সে আর তার দলের লোকেরা হারিয়ে গেলো।
আমরা স্থির করি কোয়েতে আমদের এই গোপন সফর আদ – দাবিশকে দেখার একটি সুযোগের প্রতীক্ষায় দীর্ঘায়িত করা যায় না। বান্দার আমাদের কাছে যা ব্যক্ত করেছে তা আরো মজবুত হলো শহরে পরিচিত অন্যান্য লোকজনের নিকট জায়েদের সুচতুর অনুসন্ধানের মাধ্যমে। আদ –দাবিশ লী –এনফিল রাইফেলের যে রহস্যপূর্ণ সাপ্লাই পাচ্ছে, লোককে ধোঁকা দেবার জন্য প্রকাশ্যে যা চালানো হচ্ছে ‘ক্রয়’ হিসাবে,স্পষ্টই তা ইশারা করছিলো এক কোকেতী সওদাগরের দিকে। অস্ত্র আমদানীর জন্য এ সওদাগর সবসময়ই এ এলাকায় ছিলো বিশিষ্ট এবং কোয়েতের বাজারগুলিতে টাকশাল থেকে সদ্য বের হয়ে আসা যে বিপুল পরিমাণে মারিয়া থেরেসা রিয়াল চালু ছিলো, প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, সেগুলি এসেছে আদ – দাবিশ এবং তার চারপাশেল লোকজনের কাছ থেকে । তাঁর আসল ডিপোগুলি দেখা এবং চালানের কাগজপত্র পরীক্ষঅ – যা সম্ভব নয় বললেই চলে – তা বাদ দিলে আমাদের সাথে আলাপের সময় বাদশাহ যে –সব সন্দেহের কথা বলেছিলেন সেগুলির সত্যতার প্রচুর সাক্ষ্য –প্রমাণ আমরা পেয়ে গেলাম।
আমার মিশন পূর্ণ হলো। এবং পরের রাত, যে রকম লুকিয়ে আমরা কোয়েতে পৌঁছেছিলাম ঠিক তেমনি গোপনোই আমরা বের হয়ে পড়লাম কোয়েত থেকে। বাজারগুলতে জায়েদ আর আমি যখন খোঁজ –খবর নিচ্ছিলাম তখন আমদের সুলুম্বি খুঁজে পেতে দেখতে পেলো – এই মূহূর্তে কোয়েতের দক্ষিণে বিদ্রোহীদের কোনো দলের অস্তিত্ব নেই। এজন্য আমরা রওয়ানা করি দক্ষিণ দিকে আলহাসা প্রদেশের দিকে, যা ছিলো সম্পূর্ণভাবেই বাদশাহর নিরংকুশ নিয়ন্ত্রণে। এভাবে দুরাতের উদ্যম ও উৎসাহপূর্ণ সফরের পর আমরা উপকূলের অদূরে বনু হাজার বেদুঈনদের একটি দলের মুখোমুখি হই, যাদের আল – হাসান আমীর পাছিয়েছিলেন বিদ্রোহীদের সাম্প্রতিকতম অবস্থানগুলি সম্পর্কে গোপন খবর নিতে; এবং তাদের সাথে আমরা আবার প্রবেশ করি বাদশাহর অনুগত এলাকায়।
ইবেনে সউদের রাজ্য নিরাপদে পৌঁছানোর পরই আমরা আমাদরে পথচালক সুলুম্বিকে ছেড়ে দিই। সে সান্দদে তার স্বোপার্জিত পুরস্কার পকেটে পুরে, আমি তাকে উটটি উপহার দিলাম সে উটটি হাঁকিয়ে, মিলিয়ে গেলো পশ্চিমদিকে, যখন আমরা চলেছি দক্ষিণে, রিয়াদের দিকে।
পরে আমি প্রবন্ধের যে–সিরিজ লিখি তাতে প্রথমবারের মতো একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, বিদ্রোহীদের মদদ যোগাচ্ছে একটি বৃহৎ ইউরোপীয় শক্তি। প্রবন্ধগুলিতে দেখানো হলো,এসব ষড়যন্ত্রের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ইবনে সউদের রাজ্যের সীমানাকে দক্ষিণদিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে, তার উত্তরতম প্রদেশদিকে সউদী আরব এবং ইরাকে মধ্যে দিয়ে একটি ‘স্বাধীন’ সর্দার শাসিত অঞ্চলে পরিণত করা যা বৃটেনকে সে এলাকার মধ্যে দিয়ে একটি রেল লাইন তৈরির সুযোগ করে দেবে। এছাড়াও, আদ –দাবিশের বিদ্রোহ ইবনে সউদের রাজ্যের মধ্যে এমন বিপুল বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ এনে দিয়েছে যে, বাদশাশ ইবনে সউদের পক্ষে ব্রিটেনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কনসেশনের দাবীর বিরোধিতা আর সম্ভব হবে না, যে দাবীর বিরোধিতা তিনি করে বরাবর এসেছেন তখন পর্যন্তঃ এ কনসেশনগুলির একটি হলো ব্রিটেনের নিকট জেদ্দার উত্তরে অবস্থিত লোহিত – সাগরের বন্দর রাবিগের ইজারা, যেখানে ব্রিটেন অনেকদিন ধরে চেয়ে এসেছে নৌবাহিনী একটি ঘাঁটি স্থাপন করতে; অন্যটি হলোঃ দামেশক – মদীনা রেল সড়কের যে –অংশটি সউদী এলাকার মধ্যে পড়েছে তার নিয়ন্ত্রণ। আদ –দাবিশের হাতে ইবনে সউদের পরাজয় ঘটলে এই স্কীমগুলি একেবারে বাস্তব সম্ভাবনার আওতায় এসে যেতো।
আমার প্রবন্ধগুলি ইউরোপীয় এবং আরবী (প্রধানত মিসরীয়) পত্রিকাসমূহে ছাপা হওয়ার সাথে সাথে অকস্মাৎ দারুন এক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এও খুবই সম্ভব যে, গোপন ষড়যন্ত্র আগেই ফাঁস হয়ে যাওয়াই হয়তো পরে এ ষড়যন্ত্রের বিফলতা অন্যতম কারণ। যতোই হোক, হাইফা থেকে বসরা পর্যন্ত ব্রিটেনের রেল সড়ক তৈরির পরিকল্পনাটি ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যায়। প্রাথমিক জরিপের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছিলো তা সত্ত্বেও এ পরিকল্পনার কথা পরে আর কখনো শোনা যায়নি।
এরপরে যা ঘটনো তা সবই ইতিহাসের বিষয়ঃ ১৯২৯ সনের সে গ্রীষ্মে কোয়োতে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনার জন্য আদ –দাবিশকে যে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে ইবনে সউদ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেন ব্রিটেনের নিকট। যেহেতু একটি বিদেশী শক্তি কর্তক এসব অস্ত্র সরবরাহের কোনো বাস্তব প্রমাণ তার কাছে ছিলো না, সেজন্য বাদশাহর পক্ষে এ ধরণের বিক্রয়ের বিরুদ্ধে আপত্তি জানানো সম্ভব ছিলো না। জবাবে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ জানায়, কোয়েতের ব্যবসায়ীরাই অস্ত্র সরবরাহ করছে বিদ্রোহীদের নিকট এবং তা বন্ধ করার জন্য ব্রিটেন কিছুই করতে পারে না, –কারণ, ১৯২৭ সনের জেদ্দার সন্ধি মোতাবেক ব্রিটেন আরবে অস্ত্র আমদানির উপর তাদের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে। ইবনে সউদ যদি চান, তার ব ললো, তিনিও অস্ত্র আমদানি করতে পারেন কোয়েতের ভেতর দিয়ে .. . ইবনে সউদ যখন আপত্তি করে বললেন, ঐ একই সন্ধিমতে ব্রিটেন এবং সউদী আরব উভয়ে নিজ নিজ এলাকার অপরের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে সকল প্রকার ক্রিয়াকলাপ বন্ধ করতে বাধ্য, তখন তিনিও এ জবাব পেলেন – কোয়েতকে ব্রিটিশ এলাক বলা যায় না, কারণ এটি একটি স্বাধীন শেখ রাজ্য, যার সাথে ব্রিটেনের সন্ধি – সম্পর্কের বেশি কোনো সম্পর্ক নেই . . .।
এবং এজন্য গৃহযুদ্ধ চললো অব্যাহত গতিতে ১৯২৯ সনের শরতের শেষের দিকে। ইবনে সউদ নিজেই অবতীর্ণ হলেন ময়দানে; এবার তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞঃ তিনি আদ – দাবিশকে ধাওয়া করবেন কোয়েতের অভ্যন্তরেও যদি – অতীতে সবসময়ে যেমন হয়েছে – কোয়েত থেকে যায় বিদ্রোহীদের আশ্রয়ের জন্য একটি মুক্ত এলাকা এবং নবতরো অপারেশনের জন্য ঘাঁটি। এ দৃঢ় মনোভঅবের মুকাবিলায়, যা ইবনে সউদ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিতে ভুল করবে না, ওরা মনে হয় বুঝতে পারলো যে, ওদের এই খেলায় আর বেশিদূর অগ্রসর হওয়া খুবই বিপজ্জনক হবে। আদ – দাবিশ যাতে পিচু হটে আবার কোয়েত এলাকায় ঢুকতে না পারেন সেজন্য পাঠানো হলো ব্রিটিশ যুদ্ধ–বিমান আর সাঁজোয়া গাড়ি। বিদ্রোহী বুঝতে পারালেন তাঁর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে গেছে। খোলাখুলি যুদ্ধে তিনি আর কখনো পারবেন না বাদশাহকে ঠেকাতে। বাদশাহর শর্তগুলি ছিল সংক্ষিপ্ত এবং পরিষ্কারঃ বিদ্রোহী কবিলাগুলিকে অবশ্যই আত্মসমর্পণ করতে হবে; ওদের অস্ত্রশস্ত্র, ঘোড়া ও উটগুলি ওদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হবে আদ –দাবিশের জীবন রক্ষা করা হবে। কিন্তু তাঁকে তাঁর জীবনে বাকী দিনগুলি কাটাতে হবে রিয়াদে।
আদ –দাবিশ, যিনি প্রতি মুহূর্তেই সক্রিয় এবং গতিময়, এ ধরনের নিস্ক্রিয়তা এবং গতিহীনতার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলেন না। তিনি বাদশাহর প্রস্তাব প্রত্যাখান করলেন। বাদশাহর বিপুল বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত করলেন। বাদশাহর বিপুল বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে বিদ্রোহীরা সম্পূর্ণভাবে পরাভূত হলো; আদ –দাবিশ এবং আরো কয়েকজন নেতা– তাঁদের মধ্যে ছিলেন ফারহান ইবনে মশহুর এবং আজমান কবিলার সর্দার নায়েক আবু কিলাব পালিয়ে গেলেন ইরাকে।
ইবনে সউদ আদ –দাবিশের বহিষ্কার দাবী করলেন। কিছুদেনের জন্য মনে হয়েছিলো আতিথেয়তা ও আশ্রয় দানের পুরানো আরবীয় নিয়মের কথা উল্লেখ করে ইরাকের বাদশাহ ফযসলা হয়তো তাঁর দাবী প্রত্যাখান করবেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি রাজী হয়ে যান। ১৯৩০–এর প্রথমদিকে ভয়ানক রকমে অসুস্থ আদ –দাবিশকে বাদশাহর নিকট অর্পণ করা হলো এবং তাঁকে নিয়ে আসা হলো রিয়াদে। কয়েক সপ্তাহ পর যখন স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে, প্রবার সত্যি আদ –দাবিশের মুত্যু আসন্ন, বাদশাহ ইবনে সউদ তাঁর চিরচারিত মহানুভতার সাথে তাঁকে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন আরতাবিয়ায়, তাঁর পরিবার–পরিজনের নিকট। এভাবে এক উত্তাল ঝড়ো জীবনের সমাপ্তি। এবং ইবনে সউদের রাজ্যে আবার নেমে এলো শান্তি.. .
.. . … .. . .. .
এবং আবার নতুন করে শান্তি নামে আরযার কুয়াগুলির চারপাশে।
‘‘ওগো মুসাফিরেরা, আল্লাহ তোমাদের জীবন দান করুন। তোমরা অংশ নাও আমাদের দাক্ষিণ্যের। –উচ্চকন্ঠে বলে বৃদ্ধ মুতায়বী বেদুঈন এবং তার লোকজনেরা আমাদেরকে আমাদের উটগুলিকে পানি খাওয়াতে সাহা্যে করে। মাত্র কিছুকাল আগের সকল বিদ্বেষ এবং শত্রুতা বলে কোনো কিছুর অস্তিত্বই ছিলো না।
কারণ, এই বেদুঈনেরা এক বিস্ময়কর জাত। এমনকি, কাল্পনিক উস্কানিতেও মুহূর্তের মধ্যেই ওরা জ্বলে উঠতে পারে অদম্য রাগে ও রোষে, আবার এমনি মুহূর্তে মধ্যেই ওরা ফিরে যেতে পারে জীবনের সেই নিয়তির ছন্দ–প্রবাহে যেখানে বিরাজ করে নম্রতা এবং মায়াঃ জান্তা এবং জাহান্নাম, সবসময় পাশাপাশি, নিকট সান্নিধ্যে।
এবং মুতায়বী উট–রাখালেরা তাদের বড় বড় চামড়ার বালতিতে করে আমাদের উটগুলি জন্য পানি তোলে আর কোরাস গায়ঃ
পিও, এবং বাকী রেখো না পানি,
রহমতে পরিপূর্ণ এ ইদারা এবং এর নেই কোনো তল।
তিন
আমাদের হাইল ত্যাগরে পঞ্চম রাতে আমরা মদীনার প্রান্তরে পৌছুই এবং ওহুদ পর্বতের গাঢ় রূপরেখা দেখতে পাই। ক্লান্ত পদক্ষেপে আগিায়ে চলে আমাদের উটগুলি। খুব ভোর থেকে শুরু করে এই রাত নাগাদ আমরা পেছনে ফেলে এসেছি দীর্ঘ পথ। জায়েদ এবং মনসুর নিশ্চুপ, আমিও নীরব। জ্যোৎস্নার আলোতে মদীনা তার সংকীর্ণ পথবিশিষ্ট প্রাচীর এবং নবীর মসজিদের চিকন সরল মীনারসমূহ আমাদের সম্মুখে উদ্ভাসিত হয়।
আমরা সেই দাখিল দরোজার সামনে উপস্থিত হই যা উত্তর দিকে অবস্থিত বলেই সিরীয় প্রবেশদ্বার বলে পরিচিত। উটগুলি সেই প্রবেশদ্বারের ভারী স্বম্ভগুলির ছায়াতে কিছুটা আড়ষ্ট ও সংকুচিত; ফলে, ওদের দরোজায় ঢুকতে বাধ্য করার জন্য আমরা আমাদের হাতের চাবুক ব্যবহার করি।
এখন, এই মুহূর্তে আম িআবার রয়েছি নবীর শহরে, দীর্ঘদীন নান জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর পর আবার ঘরের চেলে ঘরে ফিরে এসেছি; কারণ এই নগরী কয়েক বছর ধরেই আমার বাড়ি–ঘর। এক গাঢ় পরিচিত প্রশান্তি ছড়িয়ে আছে মদীনার ঘুমন্ত নির্জন রাস্তাগুলির উপর। উটের পায়ের শব্দে এখানে–ওকানে আলস্য ভরে উঠে বসেছে কুকুর। একটি তরুণ হেঁটে চলেছে গান গাইতে গাইতেঃ তার স্বর একটি মোলায়েম ছন্দে আন্দেলিত হয়ে পাশের একটি গলিতে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। খোদাই করে বেলকনিগুলি আর রাস্তার উপর বের করা ঘরের জানালাসমূহ আমাদের উপর ঝুলে আছে আঁধারের মতো, নীরবে। সদ্য দোহন করে টাটকা দুধের মতোই জ্যোৎস্না–দোয়া বাতাস মৃদুষ্ণ। আর এখানেই আমার ঘর।
মনসুর তার বন্ধুদের সাথে দেখা করার জন্য আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়। আর আমরা দু’জনে আমদের উটগুলিকে হাঁটু গেঁড়ে বসিয়ে দিই। জায়েদ কোনো কখা না বলে উটের পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিয়ে গদীগুলি নামাতে শুরু করে দেয়। আমি দরোজায় টোকা দিই। কিছুক্ষণ পর আমি ভেতরে মানুষের গলার আওয়াজ ও পায়ের শব্দ শুনতে পাই। খেঅলা পাখার মতো জানালার মধ্য দিয়ে লণ্ঠনের আলো, দরোজা বন্ধ করার হুড়কা নামিায়ে ফেলা হলো আর আমার বৃদ্ধা ঝি আমিনা উল্লাসে কলরব করে উঠলোঃ
–‘ওহো, আমার মুনিব ফিরেছেন ঘরে!’