তৃষ্ণা
এক
আমরা দু’জন দু’টি উটের উপর, চলেছি তো চলেছি; মাথার উপর সূর্য জ্বলছে, সর্বত্র আালো ঝলমল করছে, ঝলসাচ্ছে, একাধারে নির্জনতা আর রোদ –ঝলসানো নীরবতা এবং তারই মধ্য দিয়ে চলেছি আমরা দুটি মানুষ, দুটি উটের উপর-চলেছি দুলতে দুলতে, চলার সেই ছন্দে ও ভংগীতে যা মানুষকে নিদ্রালূ করে তোলো, আর তাকে ভুলিয়ে দেয় দিনের কথা, রোদের কথা, উষ্ণ হাওয়া আর সুদীর্ঘ পথের কথা। বালিয়াড়ির মাথায় কোথাও কোথাও হলদে ঘাসের গুচ্ছ আর এখানে ওখানে গ্রন্থিল হামদ-লতার ঝোপ, মস্ত বড় অজগরের মত বালির উপর কুন্ডলি পাকিয়ে পড়ে আছে। ইন্দ্রিয়গুলি যেন ঘুমিয়ে পড়েছে । জিনের উপর বসে দুলছি। কিছুই টের পাচ্ছি না উটের পায়ের নিচে বালি গুঁড়ানোর আওয়াজ এবং হাঁটুর ভেতরের দিক জিন-আঁটানো কাঠের পেরেকের ঘষা ছড়া। রোদ আর বাতাস থেকে মুখটাকে বাঁচানোর জন্য পাগড়ীর গুচ্ছ দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছি। মনে হলো, আমি যেন আমার আপন নিঃসংগতাকে একটি বস্তুরই মতো ধরা ছোঁয়া যায় একন একটা পদার্থের মতো এরই মধ্যে দিয়ে, হ্যাঁ ঠিক এরই মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছি তায়েমার কুয়াগুলির দিকে… তায়েমার সেই গহীন কুয়াগুলির দিকে, যা পানি যোগায় তৃষ্ণার্তকে.. ঠিক নুফুদের ভেতর দিয়ে তায়েমার দিকে-আমি একটা স্বর শুনতে পেলাম, জানি না স্বপ্নে শোনা স্বর, না আমার সংগীর কন্ঠস্বরঃ
-‘তুমি কিছু বলছিলে জায়েদ?’
-‘বলছিলাম’ আমার সংগী জবাব দেয়, ‘তায়েমার কুয়া দেখার জন্য ঠিক আড়াআড়িভাবে নুফুদ পাড়ি দেবার দুঃসাহস খুব বেশি লোক করবে না।’
আমি আর জায়েদ গিয়েছিলাম নজদ-ইরাক সীমান্তের কসর আসাইমনে, বাদশাহ ইবনে সাউদের অনুরোধে। সেখান থেকে আমরা দু’জন ফিরছিলাম। আমার কাজ শেষ করার পর হাতে ছিল প্রচুর অবসর। তাই ঠিক করলাম, প্রায় দু’শ, মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত তায়েমার সুদূর এবং প্রাচীন মরুদ্যানটি একবার দেখতে যাবো। ওল্ড টেস্টামেন্টের সেই ‘তোমা’-আর এর সম্পর্কেই ঈসায়া বলেছিলেন, ‘তোমা’র বাসিন্দারা তৃষ্ণার্তদের পানি যোগায়’। তায়েমার অঢেল পানি আর এর বড়ো ইঁদারা, সারা আরবে এমনটি কোথাও মিলে না। এই পানি আর ইঁদারার জন্য ইসলাম-পূর্ব যুগে তায়েমা হয়ে উঠেছিল ক্যারাভাঁ বাণিজ্যের একটা মস্ত বড়ো কেন্দ্র আর সেকেলে আরব তমদ্দুনের এক পীঠস্থান। স্থানটি দেখার ইচ্ছা আমার অনেকদিনের। তাই মরু-কাফেলা যে –সব ঘুরতি পথে চলে সে-সব পথে না গিয়ে কসর আসাইমিন থেকে আমরা সোজা ঢুকে পড়লাম বিশাল নুফুদের ভেতরে। মধ্য আরবের উঁচু এলাকাগুলি আর সিরীয় মরুভূমির মাঝখানে ছড়িয়ে আছে লালচে বালি মরু নুফুদ, বিশাল তার আয়তন । এই ভয়ংকর নির্জন এলাকার এই অংশে নেই কোনো পায়ের রেখা, নেই কোনো পথ। বাতাস যেন দায়িত্ব নিয়েছে –যাতে মানুষ বা কোনো পশুর পদক্ষেপ এই নরম দেবে-যাওয়া ঝুরঝুরে বালিতে স্থায়ী চিহ্ন রেখে যেতে না পারে এবং জমির কোনো নিশানা মুসাফিরকে পথ দেখানোর জন্য বেশিদিন টিকে না থাকে! বাতাসের ধাক্কায় বালিয়াড়িগুলির রূপরেখা হরদম বদলাচ্ছে, আস্তে আস্তে, টের পাওয়া যায় না এমনি মৃদু গতিতে প্রবাহিত হয়ে আকারের পর আকার নিচ্ছে। পাহাড় রূপান্তরিত হচ্ছে উপত্যকায়, উপত্যকায়, উপত্যকা রূপ নিচ্ছে নতুন মৃদু মর্মর ধ্বনি তোলে। উটের মুখেও তেতো ছাইয়ের মত সে ঘাস!
বহুবার দিক দিয়ে এ মরুভূমি আমি পার হয়েছি। তবুও কারো মদদ না নিয়ে নিজে নিজে এর মধ্য দিয়ে রাস্তা খুঁজে নেবার হিম্মত আমার নাই। কাজেই জয়েদকে আমার সংগে পেয়ে আমি ভীষণ খুশী। দেশের এই এলাকারই লোক জায়েদ। তার বংশের নাম শাম্মার, আল—নুফুদের দক্ষিণ এবং পূর্ব সীমানায় শাম্মার খান্দানের বসতি। শীতকারের ধারা বর্ষণে বালিয়ড়িগুলি যখন হঠাৎ ঘন সবুজ মাঠে রূপান্তরিত হয়, তখন বছরের কয়েক মাস ধরে ওরা নুফুদের মাঝখানে উট চরায়। মরুভূমির পরিবর্তনশীল মেজাজের সংগে জায়েদের সম্বন্ধ রক্তের, এর সাথে সাথে স্পন্দিত হয় জায়েদের হৃদয়।
আজ পর্যন্ত যত মানুষের সংগে আমার পরিচয় হয়েছে মনে হয় জায়েদই তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর। চওড়া তার কপাল, পাতলা শরীর, মাঝারি আকার, সুন্দর গঠন, প্রচন্ড তার শক্তি, সুগঠিত মজবুত চোয়াল, আর একাধারে কঠোর এবং লালসাপূর্ণ মুখ নিয়ে তার গোধুম-রঙা সংকীর্ণ মুখমন্ডল-তাতে রয়েছে সেই প্রত্যাশিত গাম্ভীর্য যা মরু –আরবের বাসিন্দাদের একটি খাস বৈশিষ্ট্য-মর্যাদাবোধের সংগে একটা আন্তরিক মাধুর্যপূর্ণ আত্মসমাহিত ভাব। খাঁটি বেদুঈন রক্ত এবং নজদী শহরে জীবনের এক সুন্দর সংমিশ্রণ সে; বেদুঈনী ভাবাতিশয্যের গলদ থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেও বেদুঈনের সহজ প্রবৃত্তির নিশ্চয়তা সে নিজের মধ্যে অক্ষুণ্ণ রেখেছে এবং শহরে লোকের বৈষয়িক কৃত্রিমতার শিকার না হয়েও তাদের সংসার জ্ঞান সে হাসিল করেছে। আমার মতো সেও এ্যডভেঞ্চার জীবন নানা ঘটনা এবং উত্তেজনায় ভরা। মহাযুদ্ধের সময় সিনাই উপদ্বীপে অভিযান চালানোর জন্য তুর্কী সরকার এক অনিয়মিত উট সওয়ার বাহিনী গঠন করেছিলো, বালক বয়সে জায়েদ ছিলো তারই একজন সিপাই। তা ছাড়া, ইবনে সউদের হামলা থেকে তার শাম্মার খান্দানের বসত–ভূমি রক্ষা করার জন্য সে লড়েছে। কিছুদিন আবার অস্ত্রের চোরাচালান দিয়েছে পারস্য উপসাগরে। আরব জাহানের বহু এলাকায় বহু আওরতের সংগে প্রেম করেছে প্রচন্ডভাবে। অবশ্য প্রত্যেকের সাথেই কোনো –না কোনো সময় আইনত তার শাদী হয়েছে এবং তারপর আইন মোতাবেক তাদেরকে সে তালাকও দিয়েছে। মিসরে সে কিছুকাল ঘোড়ার ব্যবসা করেছে। আর ইরাকে সে ছিরা ভাগ্যান্বেষী সৈনিক, সবশেষে প্রায় পাঁচ বছর ধরে সে রয়েছে আমার সহচর হিসাবে, আরব মুলুকে। এবং এখন উনিশ শ’ বত্রিশের গ্রীষ্মের এই শেষ দিকে আমরা দু’জন আরো অনেকবারের মতো চলেছি উটের উপরে বসে, বালিয়াড়ির মধ্যে নির্জন পথে ঘুরতে ঘুরতে; চওড়া চত্বরবিশিষ্ট কোন কোন কুয়ার পাশে আমরা থামছি এবং তারা –ঝিলমিল আকাশের নিচে আরাম করছি রাতের বেলা। তপ্ত বালুর উপর উটের পায়ের একটা সুইশ্ সুই্শ্ আওয়াজ, কখনো কখনো চলার মাঝে উটের পায়ের আওয়াজের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে জায়েদ নীরস কন্ঠে গান ধরে; রাত্রে আমরা তাঁবু খাটাই, কফি বানাই, ভাত রাঁধি এবং কখনো কখনো পাকাই শিকার-করা বুনো প্রাণীর গোশত। রাতের বেলা যখন আমরা বালির উপর শুয়ে থাকি বাতাস আমাদের উপর একটা ঠান্ডা পরশ বুলিয়ে যায়। বালিয়াড়ির উপর সূর্য ওঠে, লালচে সূর্য প্রচন্ড বিস্ফোরণে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয় আতশবাজির মতো এবং আজকের মতো কখনো কখনো আমরা দেখতে পাই, হঠাৎ পানি পেয়ে জীবনের বিস্ময়কর প্রকাশ ঘটেছে তৃণলতার মধ্যে।
যোহরের সালাতের জন্য আমরা থেমেছি, একটা মশক থেকে পানি নিয়ে আমি হাত-মুখ এবং পা ধুচ্ছি। কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো আমার পায়ের কাছে ঘাসের একটা শুকনো গুচ্ছের উপর-একটা অসহায় ক্ষুদ্র তৃণের গুচ্ছ, সূর্যের নিষ্ঠুর তাপে রং হয়েছে হলদে, নেতিয়ে প্রাণহীন হয়ে পড়ে আছে বালির উপর। কিন্তু কয়েক ফোঁটা পানি ওর উপর পড়ার সংগে সংগেই ওর কোঁকড়ানো পাতাগুলির মধ্যে দিয়ে এক আশ্চর্য শিহরণ বয়ে গেলো, স্পষ্ট দেখতে পোম, কিভঅবে সেগুলি মেলে গোলো আমার চোখের সামনে। আরো কয়েকটি ফোঁটা.. . ছোট্ট পাতাগুলি নড়ে উঠলো, কুঁকড়ে গেলো এবং তারপর ধীরে ধীরে যেন সংকোচের সংগে শিউরে সেগুলি সোজা হয়ে গেলো। আমি নিরুদ্ধ শ্বাসে আরো কিছুটা পানি ঢালি তৃণ গুচ্ছটির উপর। আরো দ্রুত, আরো প্রচন্ডভাবে নড়ে উঠলো তৃণটি, যেন কোন অদৃশ্য শক্তি ওকে মৃত্যু-স্পন্ন থেকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলছে। আর ওর পাতাগুলি, কী আনন্দের সে দৃশ্য! তারা মাছের বাহুগুলির মতো সংকুচিত ও প্রসারিত হতে লাগলো, যেন লাজুক অথচ অদম্য উত্তেজনায় ইন্দ্রিয়জ আনন্দের একটি সত্যিকার ক্ষণিক বিস্ফোরণে সে অভিভূত। কিছুক্ষণ আগেও যা মৃতের শামিল, এমনি করে তারই মধ্যে আবার ফিরে এলো তার প্রাণ, প্রকাশ্যে, প্রবলভাবে, যে প্রানের কাছে হার মানে মৃত্যু এবং যার ঐশ্বর্য মানুষের বুদ্ধির অগম্য।
মরুভূমিতে আপনি প্রাণকে তার রাজকীয় রূপে অনুভব করবেন সবসময়ে। প্রাণকে টিকেয়ে রাখা এতো কষ্টকর, এতো কঠিন বলেন মরুভূমিতে প্রাণ যেন সবসময়েই একটা বহমত, একটা সম্পদ, একটা বিস্ময়। আর মরুভূমি সবসময়েই চমকপ্রদ মানুষের জন্য। মরুভূমির সাথে বহু বছরের জানাজানি থাকলেও বিস্ময়ের অবকাশ হামেশাই রয়েছে। কখনো কখনো যখন মনে হয় , মরুভূমি তার সমস্ত কঠোরতা আর শূন্যতা নিয়ে রয়েছে আমাদের চোখের সামনে তখন মরুভূমি যেন তার স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে বিশ্বাস ফেলতে শুরু করে এবং গতকাল যেখানে বালু আর টুকরো পাথর ছাড়া আর কিছু ছিলো না, আমরা দেখতে পাই, হঠাৎ সেখানে জেগে উঠেছে কচি ফিকে সবুজ ঘাস। আবার মরুভূমির শ্বাস বইতে শুরু করে, আর এক ঝাঁক ছোটো পাখি ডানার আওয়াজ তুলে বাতাসের মধ্য দিয়ে উড়তে আরম্ভ করে। কোত্থেখে এলো, কোথায় যাবে এই ক্ষীণ-দেহ লম্বা ডানাওয়ালা পান্না-সবুজ পাখিগুলি? কিংবা হয়তো এক ঝাঁক পংগপাল হঠাৎ তীব্র বেগে এবং ঝুমঝুম ছেড়ে উঠলো আসমানে, ধূসর এবং ক্ষুধার্ত, যোদ্ধা-বাহিনীর মতো হিংস্র আর অশেষ.. .
প্রাণের প্রকাশ তার রাজকীয় রূপেঃ মরুভূমিতে প্রাণ বিরল বলেই তার রাজকীয় রূপ হামেশাই বিস্ময়কর, সর্বদাই চমকপ্রদ, আর এখানেই নিহিত আছে আরবের এমনিতরো বালুমরু এবং আরো বহু পরিবর্তনশীল ল্যাণ্ডস্কেপের নামহীন সমগ্র সুবাসটুকু!
কখনো কখনো পথে পড়ে লাভা-মৃত্তিকা –কালো এবং অসমতল, কখনো বা বালিয়াড়ি, যার শেষ নেই । কাঁটা ঝোপ-ঢাকা ‘ওয়াদি’ বা উপত্যকা দুই পাথুরে পাহাড়ের মাঝখানে, আর সেই ঝোপ থেকে চকিত ভীত খরগোশ লাফ মেরে আমাদের পথের এক পাশ থেকে আরেক পাশ গিয়ে পড়ছে কখনো কখনো। কখনো-বা পাচ্ছি হরিণের পায়ের দাগ-পড়া শিথিল বালু আর আগুনে কালো হয়ে যাওয়া দু’চারটি পাথর, যার উপর অনেক অনেক আগে, বিস্মৃতির গর্ভে হারিয়ে যাওয়া মুসাফিরেরা, বহু পূর্বে, বিস্মৃত কোনো দিনে তাদের খাবার রেঁধেছিলো। কখনো কখনো চোখে পড়ছে খেজুর-বীথির ছায়া-পড়া কোনো পল্লী, আর কুয়ার উপরে কাঠের চাক্কাগুলি ঘুরছে এবং তাতে করে এক ধরণের সংগীত সৃষ্টি হচ্ছে.. . আর মুসাফিরেরা শুনছে সেই একটানা সংগীত। কখনো কখনো পাচ্ছি মরু –উপত্যকার মাঝখানে একটি কুয়া আর তার চারপাশে বেদুঈন পশু-পালকেরা জটলা পাকাচ্ছে তাদের তৃষ্ণার্ত মেষ এবং উটগুলিকে পানি খাওয়ানোর জন্য। তারা কোরাসে গান গাইতে চামড়ার বড় থলেতে করে পানি তুলছে আর ঝরাৎ করে সেই পানি চামড়ার পাত্রে ঢালার সঙ্গে সঙ্গে পশুগুলির উত্তেজনা চরমে পৌঁছুচ্ছে। তার উপর রয়েছে নিষ্করণ রোদে অভিভূত স্তেপভূমির নির্জনতা, এখানে- ওখানে হলদে ঘাস আর সাপের মতো শাখা ছড়িয়ে মাটির উপর হামাগুড়ি দিয়ে চলা পত্রঘন ঝোপগুলি কোনো কোনো স্থানকে করে তোলে উটের জন্য সাদর চারণ ক্ষেত্র। একটা নিঃসঙ্গ বাবলাজাতীয় বৃক্ষ হয়তো ইস্পাত-নীল আকাশে ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাটির স্তূপ আর পাথরের মাঝখান থেকে ডানে-বাঁয়ে নজর ছুঁড়ে মারতে মারতে বেরিয়ে আসছে সোনালী গিরগিটি, তারপর আবার মিলিয়ে যাচ্ছে একটা ছায়ার মতো, ভৌতিক ব্যাপারের মতো। লোকের বিশ্বাস, এই স্বর্ণ-গিরগিটি কখনো পানি খায় না। দেবে-যাওয়া নিচু জায়গায় দাঁড়িয়ে ছাপ-পশমের কালো কালো তাঁবুগুলি! বিকালের দিকে এক পাল উঢকে হয়তো তাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে ঘরের দিকে আর তরুণ উটের খালি পিঠে চড়েছে পশু-পালকেরা। তারা যখন তাদের পশুগুলিকে ডাকে তখন মরুভূমির নীরবতা যেনো তাদের কন্ঠস্বরকে চুমুক দিয়ে চুষে নেয়, কোন প্রতিধ্বনি না জাগিয়ে সে কন্ঠস্বর হারিয়ে যায় ঐ নীরবতায়।
কখনো কখনো দূর দিগন্তে দেখা যায় ঈষৎ উজ্জ্বল ছায়া-ওগুলি কি মেঘ? ওরা নিচু দিয়ে ভেসে যায়। ঘন ঘন বদলায় তাদের রং আর অবস্থান। এই মুহূর্তে হয়তো দেখাচ্ছে ধূসর তামাটে পাহাড়ের মতো-অবশ্যি শূন্য দিগন্তের কিছুটা উপরে-এবং পরমুহূর্তেই সারা দুনিয়ার কাছে ওরা পাথুরে দেওদারের ছায়াদার বীথিকার রূপ নিচ্ছে-কিন্তু শূন্যে,তারপর ওরা যখন আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসে আর হ্রদে এবং বয়ে-চলা নদীতে রূপান্তরিত হয় এবং তাদের হাতছানি দেয়া পানিতে পাহাড় পাহাড় ও গাছপালার প্রতিবিম্ব কাঁপতে থাকে তখন হঠাৎ আপনি চিনতে পারেন ওরা কী! ওরা হচ্ছে জ্বিনের হাতছানি-সেই মরীচিকা যা বারবার মুসাফিরদের মনে মিছে আশা জাগিয়েছে এবং ‘তাতে করে’ ডেকে এনেছে তাদের সর্বনাশ আর অনিচ্ছাকৃতভঅবেই মুসাফিরের হাত তখন আগিয়ে যায় জিনের উপর মশকের দিকে.. .
কোনো কোনো রাত আবার ভিন্নতরো বিপদে পূর্ণ। বিভিন্ন কবিলার মধ্যে তখন যুদ্ধের উত্তেজনা, যুদ্ধের চাঞ্চল্য; মুসাফির তাঁবু খাটায়, কিন্তু আগুন জ্বালে না, যেন দূর থেকে তাদের কেউ দেখতে না পায়। দু’হাঁটুর মধ্যে রাইফেল রেখে ঘন্টার পর ঘন্টা ওরা জেগে থাকে। আর সেই শান্তির দিনগুলি, যখন নিঃসঙ্গ দীর্ঘপথ ঘুরতে ঘুরতে মুসাফির কোনো কাফেলার দেখা পায় আর সন্ধ্যাকলে তাঁবুর আগুনের চারপাশে বসা রোদে-পেড়া গম্ভীর লোকগুলির কথা কান পেতে শোনে-ওরা জিন্দেগী এবং মওতের, ক্ষুধা এবং তৃপ্তির, গর্ব, মহব্বত এবং ঘেন্নার, দেহের লালসা ও সে লালসা নিবৃত্তির, যুদ্ধ এবং সূদূর পল্লীগৃহের খেজুর-বীথিকার সহজ আর বৃহৎ বিষয় সম্বন্ধে আলাপ করে এবং কখনো আপনি শুনবেন না ওরা বাজে বকছে, কারণ মরুভূমিতে কেউ বাজে বকতে পারে না।.. .
আর প্রাণের দাবি আপনার মালুম হবে তৃষ্ণার সে দিনগুলিতে যখন শুকনা এক টুকরা কাঠের মতো জিব লেগে থাকে তালুর সংগে এবং দিগন্ত থেকে মুক্তির কোনো পয়গাম আসে না, বরং তার জায়গায় আসে জ্বলন্ত ‘মরু-সাইমুম’ এবং ঘূর্ণমান বালু-ঝড়ঃ আরো ভিন্নতরো দিনে আপনি হয়তো কোনো বেদুঈন তাঁবুতে মেহমান, পুরুষেরা আপনার জন্য নিয়ে আসবে পাত্র ভর্তি দুধ, বসন্তের শুরুতে মোটা-তাজা উষ্ট্রীর দুধ, যখন ধারা বর্ষনের পর স্তেপ আর বালিয়াড়িগুলি বাগানের মতো সবুজ হয়ে ওঠে, জানোয়ারের উর হয়ে ওঠে সুগোল আর ভারী। তাঁবুর এক পাশ থেকে আপনি শুনতে পাবেন আপনার সম্মানে মেয়েরে খোলা আগুনে ভেড়ার গোশত পাক করছে আর সশব্দে হাসছে।
রক্তিম ধাতুর মতো সূর্য হারিয়ে যায় পাহাড়ের আাড়লে। পৃথিবীর যে কোন স্থানের চাইতে রাতের বেলার তারা ঝিলমিল আকাশ এখানে উচ্ছতরো আর এই তারার নিচে আপনার ঘুম গভীর এবং নিঃস্বপ্ন; সকালগুলি ফিকে ধূসর এবং মৃদু ঠান্ডা, আর শীতল শীতকালের রাতগুলি, হাড় কাঁপানো বাতাস তাঁবুর আগুনের উপর ঝাপটা মারছে, যে আগুনের চারপাশে আপনি আর আপনার সংগীরা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছেন একটুখানি গরমের জন্য। আর গ্রীষ্মের দিনগুলি হচ্ছে অগ্নিঝরা, যখন আপনি চলেছেন আপনার হেলতে-দুলতে চলা উটের পিঠের উপর বসে, ঘন্টার পর ঘন্টা যেন অনন্তকাল ধরে আপনি চলেছেন; ঝলসানো বাতাস থেকে বাঁচানোর জন্য আপনার মুখ আপনার অনেক-অনেক উপরে একটি শিখারী পাখি চক্রাকারে ঘুরছে, চক্কর খাচ্ছে.. .
দুই
ধীরে ধীরে বিকাল গড়িয়ে যায় তার বালিয়াড়ি, তার নীরবতা আর তার নিঃসংগতা নিয়ে। কিছুক্ষণ পর নির্জনতা ভাঙে একদল বেদুঈন। ওরা চার কি পাঁচজন পুরুষ আর দু’জন মেয়ে। সবাই উটের উপর সওয়ার। আর একটি ভারবাহী জানোয়ারের পিঠে ওদের ভাঁজ করা কালো তাঁবু, বাসন-কোসন এবং বেদুঈন জীবনের অন্য সব তৈজসপত্র। আসবাবপত্রের স্তূপের উপর বসে আছে দু’টি শিশু। দলটি আমাদের পথ অতিক্রম করছিলো। আমাদের একদম কাছাকাছি এসে পড়ারপর ওরা ওদের জানোয়ারগুলির লাগাম টেনে ধরে বলেঃ
-‘আস-সালামু আলাইকুম-তোমাদের উপর শান্তি বার্ষিত হোক।’ আমরা জবাব দিই-‘এবং তোমাদের উপরও শান্তি বর্ষিত হোক আর বর্ষিত হোক তাঁর আশিস।’
-‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ মুসাফির?’
-‘ইনশাআল্লাহ, তায়েমা।
-‘তোমরা আসছো কোত্থেকে?’
-‘কসর – আসাইমিন থেকে’, জবাব দিই আমি। তারপর সব চুপচাপ। এদের মধ্যে একজন লোক বয়স্ক, সে রোগাটে, তার মুখমন্ডল ধারালো আর তীক্ষ্ণ এবং দাড়ি কালো আর সূঁচালো। সে যে এদের নেতা তাতে সন্দেহ নেই। তার নজর আরো ধারালো ও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো যখন তা জায়েদের উপর থেকে এসে সন্দেহজনকভাবে স্থির হরো আমার উপর-রং যার ফরসা এমন একজন বিদেশী আমি। এই পথহীন ঊষর প্রান্তরে হঠাৎ আমি আবির্ভূত হয়েছি শূণ্য থেকে, অপ্রত্যাশিত-আমি ব্রিটিশ দখলভূক্ত ইরাকের দিক থেকে আসছি। হতে পারে আমি একজন (সে তীক্ষ্ণ মুখওয়ালা লোকটির হাত যেনো হতবুদ্ধি হয়েই তার জিনের সম্মুখভাগটি নিয়ে খেলা করছে। আর একক্ষণে আমদের চারপাশ তার সংগীরা ফাঁক ফাঁক হয়ে অপেক্ষা করছে। কথা তো দলের সরদার হিসাবে ও-ই করবে। কয়েকটি মুহূর্ত পর, মনে হলো,সে যেন আর এ নীরবতা বরদাশত করতে পারছে না,আমাকে সে জিজ্ঞেস করেঃ
-‘কোন আরবদের লোক তুমি?’ – অর্থাৎ আমি কোন কওম বা এলাকার ও জানতে চায়। কিন্তু আমি জবাব দিয়ে ওঠার আগেই আমাকে চিনতে পেরে আচমকা হাসিতে তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে।
-‘ওহ, এখন তোমাকে চিনতে পারছি। আবদুল আজীজের সংগে তোমাকে দেখেছি। কিন্তু সে তো অনেকদিন-পুরা চার বছর আগের কথা, তাই না?’
সে তার বন্ধত্বভরা হাত বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে। তারপর বলে সেই সময়ের কথা, যখন আমি বাস করছিলাম রিয়াদের শাহী কিল্লায়-আর সে এসেছিলো শাম্মার খান্দানের এক সরদারদলের সংগে, ইবনে সউদের কবিলাকে শ্রদ্ধা জানাতে। ইবনে সউদকে বেদুঈনেরা সবসময় তাঁর পয়লা নাম ‘আব্দুল আজীজ’ বলে ডাকে। আনুষ্ঠানিক সম্মানসূচক কোনো খেতাব তারা যোগ করে না তাঁর নামের সংগে, কারন বেদুঈনেরা মুক্ত মানুষ। বাদশাহকে তারা শুধু একজন মানুষ বলেই জানে-বেশক তিনি সম্মানের পাত্র, কিন্তু মানুষ যতোটুকুর যোগ্য তার বেশি নয়। এমনিভাবে আমরা কিছুক্ষণ সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলিকে স্মৃতির সাহয্যে জীবন্ত করে তুলি, হয় এর কথা না হয় ওর কথা বলি। আর রিয়াদ সম্পর্কে ও এক কাহিনী বলে তো আমি আর এক কাহিনী-সেই রিয়াদ, যার ভেতরে ও বাইরে রোজ হাজার মেহমান বাদশাহর খরচে বাস করে আর যাবার সময় ওরা পায় ইনাম-প্রত্যেক ব্যক্তির ইজ্জত অনুসারে-এক মুঠা রূপার মুদ্রা বা একটা ‘আবায়া’ থেকে শুরু করে সোনার মোহর ভর্তি থলে, ঘোড়া অথবা উট যা বাদশাহ প্রায়ই দিয়ে থাকেন সরদারদেরকে।
কিন্তু বাদশাহর এই মাহনুভতা অর্থের যতোটা না তার চাইতে ঢের বেশি তাঁর হৃদয়ের। হয়তো সবার উপরে তাঁর হৃদয়ানুভূতির এই উষ্ণতার জন্যই চারপাশে সবাই তাঁকে ভালবাসে এবং আমিও ভালবাসি।
আরবে যে বছরগুলি আমি কাটিয়েছি ইবনে সউদের বন্ধত্ব যেন একটা ঊষ্ণ আলোর দীপ্তির মতো সবসময়েই ছড়িয়েছিলো আমার জীবনের উপর। তিনি আমাকে বন্ধু বলে ডাকেন যদিও তিনি একজন বাদশাহ আর আমি একজন সাংবাদিক মাত্র। তাঁর রাজ্যে আমি যে –বছরগুলি কাটিয়েছে সেই বছরগুলিতে সবসময়ে আমি তাঁর বন্ধুত্ব দেদারছে পেয়েছি বলেই যে আমি তাঁকে ভালবাসি, তা নয়। কারণ বন্ধুত্ব তিনি বহু মানুষকেই বিতরণ করেন। আমি তাঁকে আমার বন্ধু বলে ডাকি, কারণ বহু মানুষের মধ্যে যেমন তাঁর টাকার থলে মেলে ধরেন, তেমনি তিনি কখনো কখনো তাঁর হৃদয়েকে মেলে ধরেন আমার কাছে। আমি তাঁকে আমার বন্ধু বলতে ভালোবাসি, কারণ তাঁর সকল দোষক্রটি সত্ত্বে ও আর দোষক্রটি কারই বা না আছে- তিনি একজন অতিশয় মহৎ ব্যক্তি; ঠিক ‘দয়ালু’ নন, কারণ দয়ালুতা কোন কোন সময় একা সস্তা চিজ হয়ে উঠতে পারে। একটা পুরানো দামেস্ক-তরবারী দেখে যেমন আপনি মুগ্ধ বিস্ময়ে বলেন, হ্যাঁ, এ একটা ‘উৎকৃষ্ট’ হাতিয়ার বটে, কারন, এ ধরনের একটি অস্ত্রে আপনি যা-কিছু চান সবই আছে, ঠিক তেমনিভাবে আমি ইবনে সউদকে একজন মহৎ ব্যক্তি বলে মনে করি। তিনি নিজের মধ্যে সমাহিত এবং সবসময় নিজের পথে চলেন এবং তিনি যদি তাঁর কাজে-কর্মে প্রায়ই ভুলও করেন, তারও কারণ তিনি নিজে যা তা’ছাড়া আর কিছুই কখনো তিনি হতে চান না।
বাদশাহ আব্দুল আজীজের সাথে আমার প্রথম মুলাকাত হয় মক্কায়, ১৯২৭ ইংরেজীর প্রথমদিকে, আমার ইসলাম গ্রহনের কয়েক মাস পরেই।
আমার-স্ত্রী-যিনি মক্কায় আমার এই প্রথম হ্জ্জ্ব-যাত্রায় আমার সংগিনী ছিলেন-সম্প্রতি তাঁর আকস্মিক ইন্তেকাল আমাকে করে তুলেছিলো বিষণ্ণ; আমি অসামাজিক হয়ে উঠেছিলাম। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম অন্ধকার থেকে, চরম নৈরাশ্য থেকে মুক্তি পাবার জন্য। বেশির ভাগ সময় আমি আমার ঘরেই কাটাচ্ছিলাম। এ সময়ে আমার সম্পর্ক ছিলো মাত্র গুটিকয়েক লোকের সাথে এবং বাদশাহর সাথে প্রথামতো সৌজন্যমূলক মূলাকাতও এড়িয়ে যাচ্ছিলাম কয়েক হপ্তা ধ’রে। তারপর, একদিন বাদশাহ ইবনে সউদের একজন বিদেশী মেহমান –ইন্দোনেশিয়ার হাজী আজোস সলিমের সাথে মুলাকাত করতে গিয়েই জানতে পারলাম, বাদশাহর হুকুমে আমার নামও তাঁর মেহমানদের তালিকায় তোলা হয়ে গেছে। মনে হয়, তিনি আমার নীরবতার কারণ জানতে পেরেছিলেন এবং নীরব সহৃদয়তার সংগে তা তিনি গ্রহণ করেছিলেন। এভাবে একজন মেহমান হিসাবে –যে-মেহমানের আজ পর্যন্ত একবারের জন্য ও তাঁর মেহমানদারের মুখ দেখার নসিব হয়নি, আমি মক্কার দক্ষিণ প্রান্তে, শিলাময় গিরি-সংকটের নিকটে একটি সুন্দর বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। এই গিরি-সংকটের মধ্য দিয়েই রাস্তা চলে গেছে ইয়েমেনের দিকে। চত্বর থেকে আমি নগরীর একটি বড় অংশ দেখতে পাচ্ছিলাম-মসজিদুল কুবরার মীনার, রঙিন ইঁটের ছাদবিশিষ্ট হাজার হাজার গৃহের সারি এবং নিষ্প্রাণ মরু-পাহাড়, যার উপর গম্বুজের মতো রয়েছে আকাশ, তরল ধাতুর মতো ঝলসানো আকাশ।
তবু, বাদশাহর সাথ আমার মুলাকাত হয়তো আমি মুলতবিই রেখে দিতাম যদি না মসজিদুল কুবরার বারান্দায়, একটা বই-ঘরে, ঘটনাক্রমে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র আমীর ফয়সারের সাথে আমার দেখা হতো। পুরানো আরবী, ফারসী এবং তুর্কী পুঁথি-পান্ডুলিপিতে পরিবেষ্টিত হয়ে সেই দীর্ঘ সংকীর্ণ কামরাটিতে বসা ছিলো একটা আনান্দের ব্যাপার; কামরাটির নিশ্চলতা ও অন্ধকার আমাকে ভরে দিতো এক অপূর্ব শান্তিতে। অবশ্যি, একদিন এই স্বাভাবিক নীরবতা একদল মানুষের সশব্দ উপস্থিতিতে ভেংগে গেলো। দলটির আগে আগে ছিলো সশস্ত্র দেহরক্ষীরা। আমীর ফয়সাল তাঁর সাংগ-পাংগ নিয়ে বই-ঘরের মধ্যে দিয়ে কাঁবায় যাচ্ছিলেন। তিনি ছিলেন লম্বা আর হ্যাংলা এবং তাঁর বয়স ও দাড়িশূণ্য মুখখানার তুলনায় অনেক-অনেক বেশি মর্যাদাবান। তাঁর বয়স অল্প হওয়া সত্ত্বেও তাঁর পিতা দু’বছর আগে তাঁর হিজায জয়ের পর পরই তাঁকে হিজাযে বাদশাহর প্রতিনিধির গুরুদায়িত্ব দিয়েছিলেন (নজদে বাদশাহর প্রতিনিধি ছিলেন ফয়সালের বড়ো ভাই শাহযাদা সউদ-যদিও বাদশাহ নিজে বছরের অর্ধেকটা কাটাতেন হিজাযের রাজধানী মক্কায় আর বাকী সময়টা কাটাতেন নজদের রাজধানী রিয়াদে)।
বই-ঘরের পরিচালকটি ছিলেন মক্কার একজন তরুণ পন্ডিত। তাঁর সংগে কিছুকাল ধরে আমার দোস্তী। শাহযাদার সংগে তিনি আমার পরিচয় করিয়ে দেন।
ফয়সল আমার সাথে হাত মেলালেন এবং আমি যখন তাঁর দিকে মাথা নিচু করলাম, তিনি আঙুলের ডগায় আলতো করে আমার মাথাটা একটু পেছনদিকে ঠেলে দিলেন; তাঁর মুখ হৃদ্যতাময় স্মিত হাস্যে দীপ্ত হলো।
তিনি বললেন- ‘আমরা, নজদের মানুষেরা, বিশ্বাস করি না যে, এক মানুষ আরেক মানুষের নিকট মাথা নোয়াবে! সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে শুধু আল্লাহরই নিকট সে নোয়াবে মাথা।
শাহযাদাকে দয়ালু, স্বাপ্নিক এবং কিছুটা গম্ভীর ও লাজুক বলে মনে হলো। তাঁর সম্পর্কে আমার এ ধরণা আমাদের পরিচয়ের শেষ বছরগুলোতে আরো দৃঢ়মূল হয়। তাঁর ভাবভংগির আভিজাত্য কৃত্রিম নয়, এ যেন তাঁর ভেতর থেকে ঠিকরে পড়ছে, বিকিরিত হচ্ছে। সেদিন আমরা দু’জনে কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমার একটা তীব্য ইচ্ছা হলো, এই পুত্রের পিতার সাথে মুলাকাতের।
-‘বাদশাহ আপনাকে দেখলে খুশিই হবেন’, আমীর ফয়সল বললেন, ‘আপনি তাঁকে এড়িয়ে চলছেন কেন?’
‘পরদিন আমীরের সেক্রেটারী আমাকে একটা মোটরে করে নিয়ে গেলেন বাদশাহর প্রাসাদে। আমরা যাচ্ছি আল-মা’আলার বাজারের রাস্তা দিয়ে, যাচ্ছি ধীরে ধীরে –উট, বেদুঈন ও নিলামদারদের হট্টগোলে ভিড়ের মধ্য দিয়ে। নিলামদাররা বিক্রি করছে বেদুঈনদের দরকারী সমস্ত জিনিস-উটের জিন, আবায়া, গালিচা রূপার কাজ করা তরবারি, তাঁবু পিতলের তৈরি কফি –পাত্র। এদেরকে ছাড়িয়ে আমরা বের হলাম এক প্রশস্ততরো, নীরবতা ও অধিক খোলা রাস্তায়, এবং আখেরে গিয়ে পৌঁছলাম বাদশাহ যেখানে থাকেন সেই বিশাল প্রাসাদে। প্রাসাদের সামনেকার খোলা জায়গাটি জিন-আঁটা উটে গিজগিজ করছে এবং কয়েকজন সশস্ত্র খিলানওয়ালা কামরায়, যার মেঝেতে ছিলো কম-দামী গালিচা বিছানো, দেয়াল ঘেঁষে ছিলো খাকী কাপড়ে ঢাকা সুদীর্ঘ দীওয়ান এবং জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিলো সবুজ পাতাঃ এ হচ্ছে একটি বাগিচার শুরু, যা মক্কার মাটিতে অতি কষ্টের সাথে ফলানো হচ্ছিলো।
এক কৃষ্ণাংগ বান্দা এসে হাযির হলো-‘বাদশাহ আপনাকে দাওয়াত করেছেন।’
যে কামরা থেকে আমি এই মাত্র বের হয়ে এলাম তেমনি একটি কামরায় ঢুকলাম। তফাৎ এই যে, কামরাটি ছোটো এবং হালকা, তবে এর একটা দিক বাগিচার দিকে সম্পূর্ণ খোলা। দামী ইরানী গালিচায় মেঝে; বাগিচার দিকে খোলা একটা ঘুলঘুলি-জানালায় দীওয়ানের উপর বাদশাহ বসেছিলেন পায়ের উপর পা রেখে। তাঁর পায়ের কাছেই মেঝের উপর বসে সেক্রেটারী তাঁর ডিকটেশন নিচ্ছিলেন। আমি যখন ঢুকলাম, বাদশাহ দাঁড়িয়ে গেলেন, তারপর দু’হাত বাড়িয়ে বললেনঃ ‘আহলান ওয়া সাহলান’- ‘এ আপনারই ঘর,সহজ হোন।’
এ অভ্যর্থনার অর্থ ‘আপনি এখন আপনার নিজ পরিবারে প্রবেশ করেছেন; আপনি যেন আপনার আসন এখন সহজ জায়গার উপর রাখতে পারেন’ঃ খোশ-আপদেদ জানানোর এই প্রকাশ-ভংগিটি হচ্ছে সবচেয়ে পুরোনো এবং সবচেয়ে সুন্দর আরবীয় প্রথা।
মুহূর্তের জন্য সবিস্ময়ে আমি তাকাই বাদশাহ ইবনে সউদের বিশাল উচ্চতার দিকে। যখন (ততোদিনে আমি নজদী রীতির সাথে পরিচিতি হয়ে উঠেছি) আমি আলতো করে তাঁর নাকের ডগা ও কপালে চুমু খেলাম, আমার উচ্চতা ছয় ফুট হওয়া সত্ত্বেও আমাকে পায়ের আঙ্গুলে ভর করে দাঁড়াতে হলো, আর বাদশাহকে মাথা নিচু করে ঝুঁকে পড়তে হলো আমার দিকে। তারপর তাঁর সেক্রেটারীর প্রতি একটি কৈফিয়তের দৃষ্টি হেনে তিনি বসে পড়লেন দীওয়ানে, আর আমাকে তাঁর পাশেই বসিয়ে দিলেনঃ
-‘একটি মিনিট, চিঠিখান শেষ হলো বলে।’
যখন তিনি শান্তভাবে ডিকটেশন দিয়ে যাচ্ছিলেন তখনি তিনি আমার সাথে আলপও শুরু করছিলেন-অথচ দু’বিষয়ের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে গেলো না একটিবারও। কয়েকটি আনুষ্ঠানিক বাক্যের পর আমি তাঁর হাতে একটি পরিচয়পত্র দিলাম। তিনি তা পড়লেন, অর্থাৎ একইসংগে তিনটি কাজ তিনি করে চললেন, এবং তারপর, ডিকটেশন বন্ধ না ক’রে অথবা আমার ভালোমন্দের খবর নেয়া না থামিয়ে তিনি হুকুম দিলেন কফির জন্য।
ইতিমধ্যে আমি তাঁকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে দেখবার সুযোগ পেলাম। তাঁর দেহ এতো সুগঠিত এবং অংঘ –প্রত্যংগের বিন্যাস এতো পরিমিত যে তাঁর বিশাল দেহ-তিনি কমপক্ষে সাড়ে ছয় ফুট নিশ্চয় হবেন-শুধু তখনি ধরা পড়ে যখন তিনি দাঁড়ান। চিরাচরিত নীল –শাদা চেক ‘কুফিয়া’য় ঘেরা এবং জরীর কাজ-করা ‘ইগাল’ মাথায় তাঁর মুখমন্ডল তীব্র পৌরুষব্যঞ্জক। নজদী ফ্যাশন অনুযায়ী তিনি তাঁর দাড়ি ও গোঁফ ছেঁটে ছোটো করে রাখেন। তাঁর কপাল প্রশস্ত, নাক মজবুত আর উন্নত, ঈগল পাখীর ঠোঁটের মতো; তাঁর পূর্ণ মুখ, মোলায়েম না হয়েও ইন্দ্রিয়জ লাজুকতায় কখনো কখনো একেবারেই নারীসুলভ মনে হতো। যখন তিনি কথা বলেন তাঁর চেহারা মুখের পেশীর অস্বাভাবিক গতিময়তার জীবন্ত হয়ে ওঠে, কিন্তু যখন তিনি চুপ করেন তখন তাঁর মুখখানাকে কেমন যেন করুণ মনে হয়-যেন তিনি তাঁর অন্তরের একাকীত্বে আবার ফিরে গেছেন। বাদশাহর চোখ দুটির গভীর অবস্থান এর জন্য কিছুটা দায়ী হতে পারে। তাঁর বাঁ-চোখের ঝাপসা দৃষ্টি তাঁর মুখমন্ডলের পরম সৌন্দর্য ক্ষুণ্ণ করেছে খানিকটা! একটা পর্দা দেখা যাচ্ছিলো বাদশাহর চোখটিতে। পরে তাঁর এই কষ্টের কাহিনী আমি জানতে পেরেছিলাম, যদিও বেশির ভাগ লোকই না জেনে বলতো বাদশাহর বাঁ- চোখটি আপনিতেই এমনটি হয়েছে; আসলে কিন্তু ব্যাপারটি ঘটেছিলো একটি দুঃখজনক অবস্থায়।
ক’বছর আগে, তাঁর বেগমদেরই একজন, বাদশাহকে মেরে ফেলার প্রকাশ্যে মতলবে বাদশাহর প্রতিদ্বন্দ্বী ইবনের রশিদের খানদানের প্ররোচনায় আতরদানিতে বিষ ঢেলে দিয়েছিলো। এ ধরণের পিতলের তৈরি আতরদানি নজদে আনুষ্ঠানিক মজলিসে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রথামতো, আতরদানিটি বাদশাহর মেহমানদের সামনে রাখার পূর্বে প্রথমে তা দেয়া হয় বাদশাহকে। প্রথমবার গন্ধ নিয়েই ইবনে সউদ টের পান গন্ধটা যেন কেমন বিদঘুটে লাগছে- সংগে সংগেই তিনি আতরদানিটি নিক্ষেপ করেন মেঝের উপর। তাঁর সতর্কতায় তাঁর জান বেঁচে গেলো, কিন্তু তার আগেই তাঁর বাঁ –চোখ আহত ও কিছুটা অন্ধ হয়ে পড়লো। তাঁর অবস্থায় বহু রাজ –বাদশাহ নিশ্চিতভাবেই এর বদলা নিতেন; কিন্তু ইবনে সউদ বিশ্বাসঘাতিনী নারীর উপর বদলা না নিয়ে তাকে ক্ষমা করে দেন-কারণ, তিনি স্থির নিশ্চিত ছিলেন যে, নারীটি তার আপন পরিবারের অনিবার্য প্রভাবেই এ কাজ করোছে, যেহেতু রশিদের পরিবারের সাথে সম্পর্কিত ছিলো এ নারীর পরিবার। তিনি শুধু তাকে তালাক দিলেন, তারপর প্রচুর সোনরূপা ও ইনামসহ তাকে পাঠিয়ে দেন ‘হইলে’, তার আপন বাড়িতে।
সেই পয়লা মুলাকাতের পর বাদশাহ প্রায় রোজই আমাকে ডেকে পাঠাতে লাগলেন। এক সকালে আমি তাঁর কাছে গেলাম একটি ইচ্ছা নিয়ে। বেশি আশা করিনি যে তা মঞ্জুর হবে, কারণ, আমি অনুমতি চেয়েছিলাম দেশের ভেতরে সফর করার, অথচ বাদশাহ সাধারণ বিদেশীদেরকে নজদ সফরের এজাজত দেন না। সে যা-ই হোক, আমি যখন প্রস্তাবটি তুলি-তুলি করছি বাদশাহ হঠাৎ আমার প্রতি একটা সংক্ষিপত্ত অথচ তীব্র দৃষ্টি হানলেন; এ এমন এক দৃষ্টি যে, মনে হলো তা আমার অনুক্ত ভাবনা-চিন্তার একেবারে মর্মে গিয়ে প্রবেশ করেছে; বাদশাহ স্মিত হাসলেন, তারপর বললেন-‘ও মুহাম্মদ তুমি কি আমার সংগে নজদ আসবে না, এবং মাস কতক রিয়াদে থাকবে না?’
আমি একেবারে অবাক হয়ে গেলাম এবং আর যাঁরা ওখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁদের অবস্থাও হুবহু আমারই মতো মনে হলো। কোনো বিদেশীর প্রতি এমন স্বতস্ফূর্ত দাওয়াত প্রায় অশ্রুতপূর্ব ব্যাপার।
তিনি বলে চললেন, ‘আমি চাই যে, আসছে মাসে তুমি আমার সাথে মোটরে সফর করবে।
আমি বুক ভরে দম নিলাম এবং তারপর বললাম, ‘হে ইমাম, আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন। তবে মোটরে সফর করে আমার কি ফায়দা হবে? পাঁছ-ছ’দিনে মক্কা থেকে রিয়াদ ছুটে গিয়ে কি লাভ হবে আমার যদি না আমি আপনার দেশের কিছুই দেখতে পেলাম… মরুভূমি, কিছু বালিয়াড়ি এবং দিগন্তের ধারে কোথাও কিছু মানষ, ছায়ার মতো কিছু মানুষ ছাড়া? আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন, আপনার সকল মোটরের চাইতে একটি উটই হবে আমার জন্য বেশি উপযোগী!
ইবনে সউদ হাসলেনঃ ‘তোমার কি তাহলে আমার বদুদের চোখে চোখে তাকাবার লোভ হয়েছে? আমি তোমাকে আগে থেকেই হুঁশিয়ার করে দিচ্ছিঃ ওরা বড় অনুন্নত। আর আমার নজদ হচ্ছে মরুভূমি, এর কোন আকর্ষণই নেই; এ সফরে উটের জিন শক্ত মালুম হবে আর খাবার হবে দুষ্প্রাপ্য; ভাত, খেজুর এবং কচিৎ কখনো গোশত ছাড়া আর কিছু মিলবে না। কিন্তু তা যা-ই হোক, তুমি যদি উটে চড়েই সফর করতে চাও, তা-ই হবে এবং শেষতক এ-ও হতে পারে যে, আমার কওমকে চেনার পর তুমি আফসোস করবে নাঃ তারা গরীব, তারা কিছুই জানে না, তারা কিছুই নয়, কিন্তু তাদের হৃদয় সরল বিশ্বাসে পূর্ণ।’
এবং এর কয়েক হপ্তা পরেই একটি ঘুরতি পথে আমি বার হয়ে পড়ি রিয়াদের দিকে; সফরের সম্বলস্বরূপ বাদশাহ দিলেন উট, খাদ্যসম্ভার, একটি তাঁবু ও একজন হাদী বা পদ-প্রদর্শক। রিয়াদে পৌঁছুতে আমার লাগলো দু’মাসেরও বেশি। এ-ই ছিলো আররের অভ্যন্তরে আমার পহেলা সফর, -আমার বহু সফরের মধ্যে প্রথম। কারণ বাদশাহ যে অল্প ক’মাসের কথা বলেছিলেন, সেই ক’মাসই গড়িয়ে গিয়ে ক’য়েক বছরে দাঁড়িয়ে গেলো, কত সহজেই না কয়েক বছর হয়ে উঠলো-যে বছরগুলি আমি শুধু রিয়াদে নয়, আরবের প্রায় প্রত্যেক এলাকাতেই ঘুরে বেড়িয়েছি এবং উটের জিন এখন আর কঠিন মালুম হয় না!
‘আল্লাহ আবুদল আজীজকে দীর্ঘজীবী করুন,’ বললো তীক্ষ্ণমুখো লোকটি,- ‘তিনি ‘বদু’কে ভালোবাসেন এবং ‘বদুরা’ তাঁকে ভালোবাসে!’ আর কেনই বা তারা ভালোবাসবে না?- আমি নিজেকে শুধাই। নজদের বেদুঈনদের প্রতি বাদশাহ মুক্তহস্ত এবং তাঁর এই সাহায্য তাঁর হুকুমতের একটি স্থায়ী বৈশিষ্ট্য। হয়তো খুব প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য নয়, কারণ বাদশাহ বিভিন্ন কাবিলার সর্দারদের ও তাদের অনুগতদের মদ্যে নিয়মিত যে –সব অর্থ- উপহার বিতরণ করেন তার ফলে তারা বাদশাহর ইনামের উপর এতোটা নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে যে, তারা নিজের চেষ্টায় নিজেদের জীবনের অবস্থা উন্নত করার উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলেছে এবং ক্রমে ক্রমে তারা হয়ে উঠেছে খয়রাত –ভোজী –জাহিল এবং অলস থাকতেই খুশি।
তীক্ষ্ণমুখোর সংগে আমার আলাপের আগাগোড়া আমি লক্ষ্য করলাম-জায়েদ যেন কিছুটা অধৈর্য হয়ে উঠেছেঅ। সে যখন ওদের একজনের সংগে কথা বলছে তখনি ঘন ঘন তার চোখ রাখছে আমার উপর, যেনো সে দৃষ্টি আমাকে ইয়াদ করিয়ে দিতে চাইছে-এখনো দূর –দরাজ পথ রয়েছে আমাদের সামনে এবং পুরানো স্মৃতির রোমন্থন, ফেলে আসা অতীতের চিন্তা-ভাবনা উটের গতিকে ত্বরান্বিত করে না। আমরা বিদায় নিই। শাম্মার বেদুঈনেরা উট হাঁকিয়ে পূর্ব মুখে আগাতে থাকে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই বালিয়াড়ির আাড়লে হারিয়ে যায়। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকেই আমরা শুনতে পাই-ওদের একজন একটা যাযাবরী সুর ধরেছে-এমন গান, যা উট তাঁর সওয়ারীর গতি বাড়ানোর জন্য এবং উটে চড়ে চলার একঘেঁয়েমি দূর করার জন্য গেয়ে থাকি এবং জায়েদ আর আমি আবার আমাদের পশ্চিম মুখো পথ ধরি সুদূর তায়েমার দিকে, তখন সে সুরটি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায় আমদের পেছনে এবং নীরবতা আবার ফিরে আসে।
তিন
-‘দেখুন, দেখুন,’ জায়েদের গলার স্বর নীরবতা ভাঙে,-‘একটি খরগোশ!
একটি ঝোপ থেকে এইমাত্র ধূসর পশমের যে বান্ডিলটি লাফ দিয়ে বের হলো আমি তার দিকে তাকাই আর জায়েদ পিছলে নেমে পড়ে তার জিন থেকে, জিনের আগা থেকে যে কাঠের ডাণ্ডাটি ঝুলে থাকে তাই খুলে নিয়ে। সে খরগোশটির পেছনে লাফিয়ে পড়ে এবং ছুঁড়তে যাবে অমনি তার পা আটকে যায় একটি ‘হামদে’র শিকড়ে, সে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় মুখের উপর-আর খরগোশটি চোখের আড়ালে গায়েব হয়ে যায়।
-‘একটা চমৎকার খাবার হারালাম বটে’, আমি জায়েদের দিকে তাকিয়ে হাসি। জায়েদ নিজে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, তার নিজের হাতের ডাণ্ডাটি দিকে অনুশোচনা –মেশানো দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে।
-‘কিন্তু এজন্য দুঃখ করো না, জায়েদ, খরগোশটি আলবৎ আমাদের কিসমতে ছিলো না।..
-‘না, আমাদের কিসমতে ওটি ছিলো না-কিছুটা আনমনা হয়ে সে জবা দেয়। তারপর দেখি কি-ও কিছুটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে।
-‘তুমি কি আঘাত পেয়েছ, জায়েদ?’
-‘ওহ কিচ্ছুনা। শুধু আমার গোড়ালিটা মচকে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেরে যাবে।
কিন্তু সত্যি সে সেরে উঠলো না। জিনের পর বসে আরো ঘন্টাখানেক চলার পর আমি জায়েদের মুখে কিছু ঘাম দেখতে পাই এবং তার পায়ের দিকে যখন একবার তাকালাম-দেখতে পেলাম-তার গোড়ালিটি একদম মচকে গেছে এবং ভয়ানক ফুলেও উঠেছে।
-‘এভাবে চলার কোনো মানে নেই জায়েদ, চলো, আজ আমরা এখানেই তাঁবু খাটাই। এক রাতের বিশ্রামে তুমি সেরে যাবে।
জায়েদ সারারাত ছটফট করে যন্ত্রণায়। সুবহে সাদেকের অনেক আগেই সে উঠে পড়ে আর তার হঠাৎ চাঞ্চল্য আমাকেও জাগিয়ে দেয় আমার অস্বস্তিকর ঘুম থেকে।
-শুধ একটি উটই দেখতে পাচ্ছি, সে বলে, তারপর, আমরা চারদিকে তাকিয়ে আবিষ্কার করি, জানোয়ার দু’টির একটি- জায়েদের উটটিই গায়েব হয়ে গেছে। আমার উট চড়ে জয়েদ তার উটের খোঁজে বার হতে চায়-কিন্তু তার পয়ের জখমের জন্য দাঁড়ানোই তারপক্ষে কঠিন; হাঁটা আর উটে চড়া এবং উট থেকে নামার তো কথাই ওঠে না।
-তুমি বরং আরাম করো জায়েদ, -তোমার বদলে আমি যাচ্ছি, আমি যে পথে যাবো সেই পথ ধরে আবার ফিরে আসা আমার পক্ষে কঠিন হবে না।
এবং সূর্যোদয়ের সাথে সাথে আমি হারানো উটটির পায়ের নিশানা ধরে বের হয়ে পড়ি আমার উটে চটে; পায়ের দাগ আগিয়ে যায় বালু-উপত্যকার মধ্য দিয়ে একেবেঁকে, তারপর তা হারিয়ে গেলো বালিয়াড়ির আড়ালে।
আমি এক ঘন্টা চলি-তারপর আরেক ঘন্টা, তারপরও এক ঘন্টা; কিন্তু হারিয়ে যাওয়া জানোয়ারটির পদচিহ্ণ অনেক দূর গড়িয়ে যায় যখন আমি কিছুক্ষণের জন্য উট থেকে নামি-কয়েকটা খেজুর আর উটের সংগে বাঁধা মশক থেকে কিছু পানি খাই। সূর্য অনেক উপরে। কিন্তু কেন জানি, ওর চোখ ঝলসানো দীপ্তি এখন আর নেই। বছরের এই সময়ে সচরাচর যা ঘটে না, পিঙলবর্ণ মেঘ নিশ্চল ভাসছে আসমানের নিচে; এক বিস্ময়কর পুরু এবং ভারী বাতাস মরুভূমির বুকে চেপে আছে আর বালিয়াড়ির রূপরেখা, সাধারণত যেমন মোলায়েম হয়ে থাকে তার চাইতে সেগুলেকে অনেক অনেক বেশি স্নিগ্ধ করে তুলেছে।
আমার সম্মুখে উঁচু বালু পাহাড়ের চূড়ায় একটা অদ্ভূদ আন্দোলন আমর দৃষ্টি আকর্ষণ করে-ওটি একটি জানোয়ার? হয়তো হারানো উটটি! কিন্তু আরো মনোযোগ দিয়ে তাকালে পরে দেখতে পাই – আন্দোলনটি চূড়ার উপরে নয়-চূড়ারই মধ্যে । চূড়াটি চলতে শুরু করেছে খুব ধীরে, বিরাম না নিয়ে হালকাভাবে চলছে, অস্পষ্ট ঢেউ-খেলানো লহরী তুলে চলছে সামনের দিকে-তারপর মনে হলো ঢালু বেয়ে আমার দিকে গড়িয়ে পড়ছে-আস্তে আস্তে গড়িয়ে পড়া একট ঢেউ-এর মাথার চূড়ার মতো। বালিয়াড়ির ওপাশ থেকে একটা গাঢ় রক্তিমতা লতিয়ে ওটে আসমানের দিকে। এই রক্তিমতার নিচে, বালিয়াড়ির রেখাগুলির তাদের তীক্ষ্ণতা হারিয়ে অস্পষ্ট হয়ে ওঠে-যেনো হঠাৎ একটা যবনিকা টেনে দেয়া হয়েছে মাঝখানে; লালাভ এক ফিকে উদয়-রশ্নি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে মরুভূমির উপর। বালু-মেঘ আমার মুখের উপর ও চারপাশে ঘুরপাক খেতে শুরু করে এবং সহসা বাতাস প্রচন্ড আঘাতে উপত্যকাটিকে ছেদ করে, ভেদ ক’রে ছিন্নভিন্ন করে চারিদিক থেকে শুরু করেলো গর্জন। প্রথম পাহাড়-চূড়াটির মতোই আমার দৃষ্টির ভেতরকার সকল বালু-পাহাড়ের চূড়াই বিন্দু বিন্দু হয়ে ঝুরে ঝুরে গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আসমান একটি গভীর মরচে কাটা রং ধারণ করে এবং বাতাস ভরে ওঠে ঘূর্ণমান বালুকণায়, যা লালাভ ঘন কুয়াশার মতো সূর্য এবং দিবস, দুটিকেই ঢেকে দেয়। এ যে ধূলিঝড় এতে কোনোই সন্দেহ নেই!
হামাগুড়ি দিয়ে বসা উটটি আতংকে উঠে দাঁড়াতে চায়। বাতাস ততোক্ষণে ঝড়ের রূপ নিয়েছে। বাতাসের মধ্যে নিজেকে সোজা করে রাখার চেষ্টা করি এবং উটটির গলায় দড়ি বেঁধে বসিয়ে দিই; উটটির সামনের পা দু’টি আমি রশি দিয়ে বাঁধি এবং আরও নিশ্চয়তার জন্য ওর পেছনের একটি পা-ও। এরপর আমি নিজে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ি মাটির উপর এবং আমার মাথার উপর ‘আবায়া’টি টেনে দিই। উড়ন্ত বালুতে যাতে শ্বস রোধ না হয় সেজন্য আমি উটটির বগলে আমার মুখ চেপে ধরি। আমি টের পাই, জানোয়ারটিও তার মুখ চেপে ধরেছে আমার কাঁধের উপর, সন্দেহ নেই; এ কারনে আমি অনুভব করি- আমার যে দিকটায় উটের শরীরের আড়াল নেই । সে দিক থেকে বালু স্তূপীকৃত হচ্ছে আমার উপর;বালুর নিচে যাতে আমি একদম চাপা না পড়ে যাই সেজন্য আমি কিছুক্ষণ পর পর বাধ্য হয়ে স্থান বদলাতে থাকি।
আমার উদ্বেগ অহেতুক নয়, কারণ মরুভূমিতে হঠাৎ বালু-ঝড়ে পড়া আমার জন্য এ পয়লা নয়। আমার নিজের ‘আবায়ায় নিজেকে খুব এটেসেঁটে ঢেকে লম্বা হয়ে মাটির উপর পড়ে থাকি।
ঝড় কতোক্ষণে থামবে তার জন্য অপেক্ষা করি। বাতসের গর্জন আর আমার পোশাকের পতপত শব্দ ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই, রশি ছেড়ে দেওয়া পালের পতপত শব্দ-অথবা বাতাসে পতাকার শব্দ-মার্চ করে চলা বেদুঈন ফৌজের হাতে দীর্ঘ-দণ্ডের মাথয় কওমী পতাকার পতপত শব্দের মতো, যেমনটি পতাকা নেচেছিলো এবং পতপত করেছিলো প্রায় পাঁচ বছর আগে নজদী বেদুঈন সওয়ারদের উপর; ওরা ছিলো কয়েক হাজার এবং আমিও ছিলাম ওদের মধ্যে। হজ্ব করার পর আমরা আরাফাত থেকে ফিরছিলাম মক্কায়! এ ছিলো আমার দ্বিতীয় হ্জ্ব যাত্রা। আরব উপদ্বীপের অভ্যন্তরভাগে বছর খানেক কাটিয়ে পবিত্র নগরীর পূর্বে আরাফাত প্রান্তরে হাজীদের জমাতে ঠিক হজ্বের সময়ে শামিল হবার জন্য আমি দেখতে পেলাম-আমি ছিলাম সাদা পোশাক-পরা নজদী বেদুঈনদের এক বিপুল জনতার সংগে-ধূলি প্রান্তরে হাজীদের জমাতে ঠিক হজ্বের সময়ে শামিল হবার জন্য আমি কোনো রকমে ফিরে এসেছিলাম মক্কায়। এবং আরাফাত থেকে ফেরা পথে আমি দেখতে পোম-আমি ছিলাম সাদা পোশাক-পরা নজদী বেদুঈনদের এক বিপুল জনতার সংগে-ধূীল প্রান্তরের উপর দিয়ে ঘন পদক্ষেপ এবং দ্রুত গতিতে উট হাঁকিয়ে চলেছে, সাদা পোশাক –পরা মানুষের এক সমুদ্র যেনো –কেউ মধুরাঙা হলদে উটের; উচ্চকিত পৃথিবী-কাঁপানো গতিতে নর্তন-কুর্দন করতে করতে আগিয়ে চলেছে হাজার হাজার উট যেন একটা অপ্রতিরোধ্য তরংগ ধেয়ে চলেছে সামনের দিকে-কওমী ঝাণ্ডাসমূহ গর্জন করছে বাতাসে এবং কওমী হাঁক-ডাক যার মাধ্যমে ওরা ওদের বিভিন্নর কওমের এবং ওদের পূর্বপুরুষদের বীরত্বপূর্ণ কার্যকলাপের কথা ঘোষণা করে থাকে-ঢেউয়ের আকারে উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠেছে প্রত্যেক দলের মধ্য থেকে। আসলে নজদের বাসিন্দাদের জন্য তথা মধ্য আরবে উচ্চ ভূমিসমূহের অধিবাসীদের জন্য যুদ্ধ আর হজ্বের উৎস একই.. . এবং অন্যান্য দেশের অসংখ্য হজ্বযাত্রী-যারা এসেছে মিসর থেকে, ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে, উত্তর আফ্রিকা এবং জাভা থেকে- যারা এ ধরণের মত্ততায় অভ্যস্ত নয়, আতংকে ওরা আমাদের সন্মুখ থেকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো, কারণ সে গর্জনশীল বাহনিীর পথের কাছে দাঁড়িয়ে জানে বেঁচে থাকা কারো পক্ষে সম্ভব নয়, ঠিক যেমন ছুটে চলা হাজার হাজার উটের মধ্যে কোন আরোহী তার উটের পিঠ থেকে গড়িয়ে পড়লে মৃত্যুই তার জন্য অবধারিত।
উঠের পিঠে সেদিনকার সে চলা যতো উন্মদাপূর্ণই হোক, আমি সে উন্মদনায় শারিক হয়েছিলাম এবং আমার অন্তরে একটা বুনো আনন্দ, বোঁ-বোঁ শোঁ – শোঁ ধ্বনি, আমি নিজেকে সঁপে দিয়েছিলাম সেই বিশেষ মুহূর্তটির নিকট, গতি ও গর্জনের নিকট-আর আমার মুখের উপর দিয়ে ছুটে-যাওয়া বাতাস যেন গেয়ে উঠলে, ‘তুমি আর কখনো পরদেশী থাকবে না-আমার জাতির মধ্যে আর কখনো তুমি পর বলে গণ্য হবে না।
আমরা পতপত করা ‘আবায়া’র নিচে বালুর উপর শুয়ে থেকে আমি শুনতে পাই ধূলি-ঝড়ের গর্জন থেকেও যেনো প্রতিধ্বনি উঠছে-‘কখনো তুমি আর পরদেশী থাকবে না।
আমি পরদেশী নই। আরব আমার স্বদেশ হয়ে উঠেছে। আমার পশ্চিমা অতীত যেনো বহু আগে দেখা একটা স্বপ্ন- এতোটা অবাস্তব নয় যে ভুলে যেতে পারি এবং এতোটা বাস্তব নয় যে আমার বর্তমানের অংশ হয় উঠবে । কথা এ নয় যে, আমি অলস স্বপ্ন-বিলাসী হয়ে উঠেছি- বরং যখনই আমি কোনো শহরে কয়েক মাস ধরে থাকি –যেমন মদীনায়, যেখানে আমার এক আরবী বিবি এবং এক শিশু ছেলে রয়ে, আর আছে ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসের উপর লেখা বইয়ে ভর্তি একটি বইঘর – আমি চঞ্চল হয়ে উঠি এবং কর্ম ও গতির জন্য, মরুভূমির শুল্ক প্রাণবন্ত হওয়ার জন্য, উটের ঘ্রাণ এবং উটের জিনের পরশের জন্য প্রলুব্ধ হয়ে উঠ। আশ্চর্যের বিষয় হলো, জীবনের বেশির ভাগ সময়ে (আমার বয়স এখন বত্রিশ-এর কিছু উপরে) ঘুরে বেড়ানোর যে তাগিদ আমাকে এতোটা অস্থির করেছে এবং বার বার আমাকে সকল রকমের ঝুকি ও বিপদ-আপদ মুকাবেলার প্রতি প্রলুব্ধ করেছে তার উৎস এ্যাডভেঞ্চারের নেশায় ততোটা নয়, যতোটা পৃথিবীতে আমার নিজের জন্য একটা স্বস্তির স্থান খুঁজে বার করার বাসানার মধ্যে, এমন একটা বিন্দুতে পৌঁছানোর জন্য, যেখানে আমি যা কিছু ভাবি, অনুভব করি, কামনা করি,তার সংগে। এবং আমি যদি ঠিকমতো বুঝে থাকি, এই বছরগুলিতে অন্তরের এই আবিষ্কারের বাসনাই আমার ইউরোপীয় জন্ম এবং ইউরোপীয় পরিবেশে লালন-পালন যা কিছু আমার ভাগ্যে নির্ধারিত করেছে বলে মনে হয়েছিলো সেসব থেকে আমাকে ঠেলে দিয়েছে চিন্তা এবং বাইরের রূপ, উভয়দিক দিয়েই সম্পূর্ণ আলাদা এক নতুন জগত।
ঝড় যখন সম্পূর্ণ থামলো আমার চারদিকে জমে-ওঠা বালুর স্তূপ থেকে গা ঝেড়ে বের হয়ে এলাম। আমার উটটিও বালুতে অর্ধেকটা ডুবে আছে, কিন্তু তাই বলে অভিজ্ঞতা হিসাবে তা খুব খারাপ ছিলো না, কারণ এ রকমের অভিজ্ঞতা উটটির জীবনে অবশ্যি আরো বহুবার ঘটেছে। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হলো, বালুতে আমার মুখ-কান এবং নাক ভর্তি করে দেওয়া আর আমার জিনের উপর থেকে ভেড়ার চামড়ার উড়িয়ে নেওয়া ছাড়া ঝড় আমাদের তেমন কোন ক্ষতি করেনি। কিন্তু শিগগীরিই আমার ভুল বুঝতে পারলাম।
আমার চারপাশে সব কটি বালিয়াড়ির রূপরেখা একেবারে বদলে গেছে। হারানো উটের ও আমার পায়ের দাগ মুছে গেছে ঝড়ে। আমি দাঁড়িয়ে আছি সম্পূর্ণ নতুন ভূমির উপর। এখন আর তাঁবুতে ফিরে যাওয়া অথবা নিদেনপক্ষে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করা ছাড়া আর কিছু করবার নেই; সহায় কেবল সূর্য এবং দিক সম্পর্কে সাধারণ একটা ধারণা যা মরুভূমির সফরে অভ্যস্ত যে –কোন ব্যক্তিরই প্রায় একটা সহজাত অনুভূীতিবিশেষ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এ দুটি সহায়ও সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য নয়; কারণ বালিয়াড়ির জন্য আপনি একটা সোজা সরল পথে আগাতে পারবেন না – পারবেন না আপনি যে দিক অনুসরণ করতে চান সেই দিকে আগাতে।
ঝড়ের ফলে আমার পিয়াস লেগেছে ভীষণ, কিন্তু অল্প কয়েক ঘন্টার বেশি আমাকে তাঁবু থেকে দূরে থাকতে হবে না, এই ভরসায় আমি আমার ছোট্ট মশক থেকে শেষ চুমুক পানিটুকু অনেক আগেই খেয়ে ফেলেছি। যাইহোক, আমি তাঁবু থেকে দূরে এাসে পড়িনি তা নিশ্চিত এবং আমার উটটি, যদিও দুদিন আগে কুয়ার পাশে শেষবার যখন আমরা থেমেছিলাম তারপর আর পানি খায়নি, তবু আমার এই উটটি হচ্ছে একটি অভিজ্ঞ অভিযাত্রী এবং সে আমাকে বহন করে তাঁবুতে নিয়ে যেতে পারবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যে দিকে তাঁবুটি রয়েছে বলে আমর মনে হলো সেই দিকেই আমি ফিরিয়ে দিলাম আমর উটটির মুখ, তারপর রওনা দিলাম ত্বরিত পদে।
এক ঘন্টা কেটে গেলো, তারপর আরেক ঘন্টা, তারপর আরেক ঘন্টা, কিন্তু জায়েদ কিংবা আমাদের তাঁবুর জায়গাটির কোন চিহ্ণ নেই। নারাঙ্গি –রঙ পাগাড়গুলির কোনো একটিরই আর পরিচিতি চেহারা নেই। ঝড় যদি না –ও হতো তবু এই পাহাড়গুলির মাঝে পরিচিতি কিছু খুঁজে বের করা সত্যি খুব মুশকিল হতো।
শেষ বিকালের দিকে আমি এসে পৌঁছি বালুর মধ্য থেকে বেরিয়ে থাকা কতকগুলি গ্রানাইট শিলার নিকট; এসব বালু-বিস্তারের মধ্যে এ রকম শিলার সাক্ষাৎ মিলে ক্বচিৎ। দেখা মাত্রই আমি এগুলিকে চিনতে পারলাম। আমি আর জায়েদ গতকালই বিকালে, রাতের জন্য তাঁবু গাড়ার খুব আগে নয়, এর পাশ দিয়ে গিয়েছিলাম। আমি অনেকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, কারণ জায়েদকে আমি যে জায়গায় পাবো বলে আশা করেছিলাম সেখান থেকে যে আমি দূরে এসে পড়েছি তাতে কোন সন্দেহ নেই; কালকের মতো কেবলমাত্র দক্ষিণ-পশ্চিম মুখে সোজা এগিয়ে গেলেই চলবে, ওকে পেতে আর খুব বেগ পেতে হবে না।
আমার মনে আছে, এই শিলাগুলি আর আমাদের রাতের তাঁবুর মধ্যে ছিলো তিন ঘন্টার পথ; কিন্তু এখন যখন আমি আরো তিন ঘন্টার জন্য উট হাঁকিয়েছি, কিন্তু তাঁবু বা জায়েদের কোনো নিশানাই খুঁজে পেলাম না, আমি কি তবে তাকে আবার হারিয়েছি? আমি আগাতে থাকি, আগাতে থাকি বারবার দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে, আসমানে সূর্যের গতিবিধির দিকে সযত্ন লক্ষ্য রেখে। যখন রাত্রি নামলো, আমি স্থির করলাম আর আগানো একেবারেই অর্থহীন। তার চেয়ে বরং একু জিরিয়ে নিই এবং ভোরের আলোর জন্য অপেক্ষা করি! আমি উটটি থেকে নেমে তাকে বাঁধি এবং চেষ্টা করি কয়েকটি খেজুর চিবাতে কিন্তু বলতে কি, আমার ভীষণ পিয়াস পেয়েছে, তাই আমি খেজুরগুলি উটের সামনে রেকে ওর গায়ের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ি।
থেকে থেকে আমার তন্দ্রা আসছে-ঠিক ঘুমও নয়, ঠিক ঘুমও নয়, ঠিক জাগরণও নয়, পর পর কয়েকটি স্বপ্নাবস্থা, যার মূলে রয়েছে শ্রান্তি। সেই তন্দ্রা বারবার টুটে যাচ্ছে তৃষ্ণার দরুন যা ক্রমেই ভয়ানক পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া অন্তরের গহীনতম প্রদেশের কোথাও, যা মানুষ নিজের কাছেও খুলে ধরতে চায় না, রয়েছে ভযের সেই শুভ্র সততা গা- মোচড়ানো মলাস্ক ১[শামুকজাতীয় কোমলাংগ প্রাণীবিশষ]- আমার কী হবে যদি আমি জয়েদ ও আমাদের মশকগুলির নিকট ফিরে যাবার পথ আর না পাই? কারণ, এখানে থেকে যে –কোনো দিকেই রওনা করি না কেন, বহুদিন সফর করলেও কোনো বসতি বা পানি আর মিলবে না।
আবার রওনা করি ফজরে। রাতের বেলা ভেবে-চিন্তে এই সিদ্ধান্তে আসি যে, আমি নিশ্চয় দক্ষিণদিকে অনেক দূর চলে এসেছি। কাজেই আমি যেখানে রাত কাটিয়েছি জায়েদের তাঁবু সেখান থেকে উত্তর কিংবা উত্তর-পূর্বে কোথাও হওয়া উচিত। তাই,আমরা উত্তর, উত্তর-পূর্ব মুখে চলেছি বালু তরঙ্গ ভেদ করে এক উপত্যকা থেকে আরেক উপত্যকায়, কখনো ডানদিকের কখনো বামদিকের বালুর পাহাড়ের চারপাশে ঘুরে ঘুরে। দুপুরে আমরা আমরা জিরাই। আমার জিব লেগে আছে তালুর সাথে এবং মনে হচ্ছে এ যেন পুরানো চিড়-খাওয়া পুরু চামড়া। গলায় ঘা হয়ে গেছে আর চোখ জ্বালা করছে। আমার ‘আবায়াটা’ মাথার উপর টেনে দিয়ে আমি উটের পেটের সংগে গা ঘেঁষে কিছুক্ষণের জন্য ঘুমানোর চেষ্টা করি, কিন্তু ঘুম হলো না। বিকালে আবার আমরা রওনা করি, তবে এবার আরো পূর্বমুখে, কারণ এতোক্ষণে আমি বুঝতে পেরেছি আমরা পশ্চিমমুখো হয়ে অনেক দূর চলে এসেছি;কিন্তু আশ্চর্য, এখনো জায়েদ বা তাঁবুর কোন হদিসই নেই।
এমনি করে আসে আরেকটি রাত। তৃষ্ণা হয়ে ওঠে যন্ত্রণা এবং পানির আকাংখা হয়ে ওঠে মনের একমাত্র অদম্য ভাবনা, যে-মন আর গুছিয়ে চিন্তা করতেও সক্ষম নয়। কিন্তু ভোরের সূর্য সমান আলো করার সাথে সাথে আমি আবার উঠে বসি আমার উটের পিঠে; সকাল গড়িয়ে, দুপুর গড়িয়ে আরো একটি দিনের বিকাল আসে; আমি উট হাঁকিয়ে চলেছি তো চলেছি। কেবল বালিয়াড়ি এবং তার শেষ নেই। কিংবা এই কি শেষ-আমার সকল পথের, চাওয়ার সকল পাওয়ার ইতি? -যাদের মধ্যে আমি আর কখনো পরদেশী বলে গণ্য হবো না তাদের মধ্যে আমার সমাপ্তি ..? ‘আল্লাহ গো’, আমি প্রার্থনায় ভেঙে পড়ি- ‘তুমি আমাকে এভাবে ধ্বংস হতে দিওনা .. .।
বিকালে আমি একটা উঁচু বালিয়াড়ির চড়ি, চারদিকের ভূ-প্রকৃতি একটু ভালোভাবে দেখতে পাবো এই আশায়। যখন দেখলাম পূবে, বহুদূরে একটা কালো বিন্দুর মতো কী দেখা যাচ্ছে, আমার ইচ্ছা হলো, উল্লাসে চিৎকারের সামর্থ্য্ও আমার নেই। আমার সন্দেহ নেই যে, এই কালো দাগটি আর কিছু নয়, জায়েদের তাঁবু এবং মশক দুটি –পানি ভর্তি দুটি মস্ত মশক! ফের উটে চড়তে গিয়ে আমার হাঁটু দুটি ঠকঠক করে কাঁপাতে লাগলো। ধীরে ধীরে হুঁশিয়ারির সাথে আমরা সেই কালো দাগটির দিকে আগাতে থাকি-ওটি যে জায়েদের তাঁবু তাতে একটুও সন্দেহ নেই। আবার যাতে দিক না হারাই এজন্য এবার সব রকমের সতর্কতা অবলম্বন করি। আমি সোজা এক সরলরেখায় আগাতে থাকি –চলতে চলতে কখনো উঠি বালুর পাহাড়ে, কখনো নামি বালু উপত্যকায়, এইভাবে আমাদের কষ্ট দু’গুণ তিনগুন বাড়িয়ে। শুধুমাত্র এ আশাই আমাকে উদ্দীপিত করেছে যে, কিছুক্ষণ, বড় জোর এক দু’ঘন্টার মধ্যেই, আমি পৌছুবো আমার মঞ্জিলে। শেষ নাগাদ, শেষ বালিয়াড়ির চূড়াটি অতিক্রম করার পর আমার সেই মঞ্জিল স্পষ্ট হয়ে উঠলো আমার চোখের সামনে; আমি উটের মুখের লাগাম টেনে ধরি এবং প্রায় আধ মাইল দূরের সেই কালো দাগটির দিকে তাকাই। মনো হলো, আমার হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেছে, কার আমার সামনে যা দেখতে পেলাম তা আর কিছু নয়, বালুর ভেতর থেকে বের হয়ে থাকা সেই কালো গ্রানাইট শিলাগুলি যা আমি জায়েদের সংগে তিন দিন আগে অতিক্রম করেছিলাম এবং দুদিন আগে একা আমি আবার অতিক্রম করেছি.. .
আমি বৃত্তাকারে ঘুরছি দুদিন ধরে।
চার
যখন জিন থেকে নামলাম তখন আমি একেবারেই ক্লান্ত, গায়ে জোর নেই একটু। এমনকি, উটের পা বাঁধার দিকেও আমর খেয়াল নেই। বলতে কি, জানোযারটিও এক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে যে, পালিয়ে যাওয়ার ই্চ্ছাও তার নেই। আমার কান্না পেলো কিন্তু আমার শুকনো ফোলা ফোলা চোখ থেকে আসু এলো না এক ফোঁটাও।
আমি যখন কেঁদেছি তারপর কতো সময় অতিক্রান্ত হলো! .. . কিন্তু যা-ই হোক, সব কিছুই কি দূর অতীতের ব্যাপার নয়? সব কিছুই অতীতের বস্তু এবং বর্তমান বলে কিছুই নেই! আছে কেবল তৃষ্ণা .. . আর গরম .. আর যন্ত্রণা।
প্রায় তিন দিন হলো আমি পানি খাইনি। আর আমার উটটি শেষবার পানি খেয়েছে পাঁচদিন আগে। এভাবে হয়তো আরো একদিন, বড় জোর দু’দিন চলতে পারে। কিন্তু আমি জানি, আমি ততোক্ষণ আর চ লতে পারবো না। হয়তো আমার মৃত্যুর আগে আমি পাগলই হয়ে যাবো, কারণ আমার গায়ের ব্যাথার সাথে জড়িয়ে আছে আমার মনের ভয়; একটি থেকে জন্ম নেয় আরেকটি – জ্বালাময়, যন্ত্রণাপ্রদ-বিদারক! .. .
আমি চাই বিশ্রাম নিতে, আরম করতে, কিন্তু সংগে সংগে আমি এ কথাও জানি যে, আমি যদি এখন আরাম করি আর কখনো উঠে বসতে পারবো না। আমি নিজেকে কোন রকমে টেনে নিয়ে আবার জিনের উপর চড়ি, তারপর আঘাত করে লাথি মেরে উটটিকে দাঁড়াতে বাধ্য করি। আমি প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম জিনের উপর থেকে যখন উটটি পেছনের পা দুটির উপর দাঁড়াতে গিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে-এবং আবার যখন সে সামনের পা দুটি সোজা করতে গিয়ে হেলে পড়ে পেছনদিকে। আমরা চলতে শুরু করি ধীরে ধীরে যন্ত্রণার মধ্যে, পশ্চিমদিকে। পশ্চিমদিকেঃ কী তামাশা! কিন্তু আমি বাঁচতে চাই, আর এ জন্যই আমরা চলি, আগাতে থাকি।
আমাদের যেটুকু কুওৎ বাকি আচে তারি সাহায্যে সারা রাত থপথপ করে পা ফেলে চলি। আমি যখন জিন থেকে পড়ে যাই তখন নিশ্চয়ই হয়ে ভোর হয়ে গেছে। আমি শক্ত কিছুর উপর পড়িনি; বালু খুবই মোলায়েম এবং আরামদায়ক; মনে হলো যেনো আদরে আলিংগন করছে আমাদের। কিছুক্ষণের জন্য উটটি নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, পয়লা হাঁটুর উপরে তারপর পেছনে পা দুটির উপরে সে নিজের শরীরটাকে ছেড়ে দেয় এবং বালুর উপর গলা ছড়িয়ে দিয়ে আমার পাশে গুটিগুটি মেরে শুয়ে পড়ে।
আমিও শুয়ে পড়ি আমার উটের সংকীর্ণ ছায়ায়, বালুর উপর। আমার ‘আবায়া’ দিয়ে আমি নিজেকে মুড়ে দিই, আমার বাইরে মরুভূমির যে জ্বালা রয়েছে- এবং ভেতরে যে ব্যাথা তৃষ্ণা এবং ভয় রয়েছে তা থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য। আমার আর চিন্তা করার কোনো তাকৎ নেই। আমি আমার চোখ দুটি বন্ধ করতে পারছি না। চোখের পাতা একটু নড়লেই মনে হয় চোখের পুতুলের উপর যেনো উত্তপ্ত ধাতু নড়ছে। তৃষ্ণা এবং উত্তাপ.. .তৃষ্ণা এবং সর্বনেশে নীরবতা-উষ্ণ-শুল্ক নীরবাত, যা আমাকে ঢেকে দেয় তার নির্জনতা ও নৈরাজ্যের কাফনে, আমার কানে রক্তের ধ্বনি উটের ক্ষণিক দীর্ঘশ্বাসকে করে তোলে ভয়ংকর-যেন, পৃথিবীতে এগুলিই হচ্ছে শেষ ধ্বনি, আর আমরা দু’জন একটি মানুষ, একটি জানোয়ার-আমরা হচ্ছি পৃথিবীর বুকে হতভাগ্য শেষ জীবন্ত প্রাণী- ধ্বংস যাদের অবধারিত!
আামদের অনেক উপরে, তরল গরমের মধ্যে চক্কর খাচ্ছে একটি শকুন, একবারো না থেমে, আসমানের বিবর্ণ পটভূমিকায় একটি সূঁচের মাথা যেনো, উড়ছে মুক্তভাবে, সকল দিগন্তের উপর..
আমার গলা ফুলে গেছে-শুকিয়ে প্রায় রুদ্ধ হয়ে গেছে কন্ঠনালী, আর প্রত্যেকটি নিশ্বাস যেন হাজার সূঁচ ফুটিয়ে দিচ্ছে আমার জিবের গোড়ায় –সেই বড় সেই মহৎ আলজিব, যার নড়ার কথা নয়, অথচ নড়াচড়া না ক’রে একটুও থামতে পারছে না। আমার ভেতরের সবকিছুই জ্বলছে, সবকিছু রূপ নিয়েছে এক বিরামহীন যন্ত্রণায়। কয়েক সেকেন্ডের জন্য ইস্পাত-সদৃশ আসমান উজ্বল হয়ে উঠলো আমার বিস্ফারিত চোখের সামনে!
আমার হাত যেন নিাজে নিজেই প্রসারিত হয় এবং জিনের খিলের সংগে ঝুলানো ছোট বন্দুকটির কঠিন কোঁদার উপর গিয়ে লাগে। সংগে সংগে হাত থেকে যায় এবং আকস্মিক স্বচ্ছতায় আমার মন দেখতে পায়-কার্তুজের খোপে পাঁচটি তাজা কার্তুজ এবং ট্রিগারে একটু চাপ দিলেই ত্বরিত যা ঘটতে পারে তার স্বরূপ –কী যেন আমার ভেতরে , ফিসফিস করে বলে উঠলোঃ শিগগীর করো, আবার তুমি চলতে অক্ষম হয়ে পড়ার আগেই বন্দুকটি হাতে নাও।
এবং সেই মুহূর্তে আমি অনুভব করলাম, আমার ঠোঁট নড়ছে এবং আমার মনের গহীন গুহা থেকে যেসব ধ্বনিহীন শব্দ আসছে সেগুলিকে আকার দিচ্ছেঃ ‘আমি তোমাদেকে পরীক্ষা করবো .. . নিশ্চয় পরীক্ষা করবো’, এবং ঝাপসা অস্পষ্ট শব্দগুলি ধীরে ধীরে আকার নেয়, হয়ে ওঠে কুরআনের একটি আয়াতের মতোঃ ‘আমি অবশ্য তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো ভয় দিয়ে, ক্ষুধা দিয়ে, সম্পদ জীবন ও ফল-ফসলের স্বল্পতা দিয়ে; তুমি খোশ খবর দাও তাদেরকে যারা ধৈর্যশীল এবং যখনি কোন মুসিবত আসে বলেঃ আমরা আল্লাহরই এবং আমাদের প্রত্যাবর্তন আল্লাহরই দিকে।
সবকিছুই তপ্ত এবং বিষণ্ণ। এই জ্বালাময় বিষণ্ণতার মধ্যে আমি বাতসে একটি প্রাণ জুড়ানো নিশ্বাস অনুভব করি এবং তার মৃদু ঝিরঝির ধ্বনি শুনি, যেনো গাছপালার মধ্যে মর্মর ধ্বনি তুলে বাতাস বইছে-পানির উপর দিয়ে – এবং সেই পানির হচ্ছে সবুজ ঘাসে ঢাকা দু’পারের মধ্যে ধীরে ধীরে বয়ে চলা একটি ক্ষীণ স্রোত, আমার শিশুকালের বাড়ি কাছে। আমি শুয়ে আছি নদীর পারে – নয় কি দশ বছরের ছোট্ট বালক, একটা ঘাসের ডগা চিবাচ্ছি এবং তাকিয়ে আছি সাদা গরুগুলির দিকে –গরুগুলি ঘাস খাচ্ছে, নিকটেই, বৃহৎ মলিন চোখ মেলে তৃপ্তির সরলতা নিয়ে। দূরে কিষাণ রমণীরা মাঠে কাজ করছে। একজন পড়েছে একটা লাল রুমাল এবং চওড়া লাল ডোরাকাটা নীল স্কার্ট। সাদা হাঁস, পায়ের ধাক্কায় পানিকে ঝলসিয়ে দিয়ে। এবং মোলায়েম বাতাস ধ্বনি তুলে চলেছে আমার মুখের উপর, জানোয়ারে নিশ্বাসের ধ্বনির মতো। হ্যাঁ, তাই বটে- জানোয়ারেরই নিশ্বাস ফেলার আওয়াজ। বৃহৎ সাদা গাভীটি, যার পায়ে সাদার মধ্যে ছিটানো রয়েছে তামাটে রংয়ের ফোঁটা, আমার একেবারেই কাছে এসে পড়েছে এবং এখন নাক দিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে আমাকে ধাক্কা মারছে, আমার পাশেই আমি টের পাই গাভীটির পায়ের নড়াচড়া।
আমি আমার চোখ দুটি মেলি; শুনতে পাই আমার উটের হ্রেষাধ্বনি আর আমার পাশেই ওর পায়ের নড়াচাড় টের পাই; উটটি তার পেছনের পা দুটির উপর অর্ধেক দাঁড়িয়েছে ঘাড় এবং মাথা উপর দিকে তুলে, ওর নাকের ছেদাগুলি স্ফুরিত –যেন সে দুপুরের বাতসে হঠাৎ এবং শুভ সুগন্ধের আভাস পেয়েছে। ফের ও জোরে জোরে শব্দ করে নাক দিয়ে এক আমি টের পাই –ওর উত্তেজনা যেন তরংগের আকারে গলা বেয়ে নেমে কাঁধ হয়ে ওর অর্ধেত্থিক বিশাল দেহের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন মরুসফরের পর পানি গন্ধ পেলে উট এভাবেই নাক দিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নেয় এবং শব্দ করে – এ আমি আগেও দেখেছি। কিন্তু এখানে .. . এখনে তো পানি নেই। .. . আছে কি? আমি আমার মাথা সোজা করে, যে দিকে উটটি মুখ ফিরিয়েছে সেদিকে তাকাই দু’চোখ সেলে। উটটি মুখ ফিরিয়েছে আমাদের সবচেয়ে নিকটের বালিয়াড়িটির দিকে – আকাশের ইস্পাতসদৃশ শূন্যতার পটভূমিকায় একটা নিচু শীর্ষ –সেখানে কিছুই নড়চে না বা কোন শব্দ ও হচ্ছে না –কেবল শোনা গেলো একটা অস্ফুট ধ্বনি, পুরোনো এক বীণার তারের স্পন্দনের মতো, খুবই কোমল এবং ভংগুর, তীক্ষ্ণঃ সে তীক্ষ্ণ, উচ্চ ও ভংগুর ধ্বনি এক বেদুঈনে কন্ঠের –যে উট হাঁকিয়ে গেছে চলেছে উটের পায়ের তালের সাথে ছন্দের মিল রেখে,বালু পাহাড়ের মাথার ঠিক ওপশেই দূরত্বের বিচারে একবারেই নিকটে, কিন্তু মুহূর্তের ভগ্নাংশেল মধ্যে আমি জানতে পারি, আমার নাগালের অনেক দূরে সেই স্থান, আমার কন্ঠস্বর ওখানে কিছুতেই পেছুবে না। নিশ্চয় ওখানে মানুষ আছে, কিন্তু ওদের নিকট পৌছুবার তাকৎ মোটেই নেই আমার। এমনকি, আমি এতো দূর্ব যে, দাঁড়াবার ক্সমতাও আমার নেই। আমি চেষ্টা করি চিৎকার করতে –কিন্তু আমর গলা থেকে কেবল একটি কর্কশ গোঙানি ছাড়া কিছু বার হলো না। তখন, নিজে নিজেই আমার হাত গিয়ে পড়ে জিনের সংগে ঝুলানো আমার ছোট্ট বন্দুকটির শক্ত কোঁদার উপর .. . এবং আমি আমার মনের চোখ দিয়ে দেখতে পাই কার্তুজের খোপে পাঁচটি তাজা কার্তুজ!
একটা চূড়া্ত চেষ্টার ফলে আমি জিনের খিল থেকে বন্দুকটি খুলতে পারলাম। বেন্ট থেকে বন্দুকে কার্তুজ পোরা –একটা পর্বতকে মাথার উপর তোলার মতো ভারি মনে হলো, তবু, শেষ পর্যন্ত তাতে সক্ষম হলাম। এরপর আমি বন্দুকটি কোঁদার উপর দাঁড় করিয়ে বন্দুকের নল সোজা আকাশের দিকে রেখে ট্রিগার টেনে দিই। বুলেটটি শন করে শূন্যতায় হারিয়ে গেলো অতি করুণভাবে, অতি ক্ষীণ একটি শব্দ করে। আবার বন্দুকের নল ভেঙে তাতে কার্তুজ পুরে ছুঁড়ি আর কান পেতে থাকি। বীণার সুরের মতো সেই গান থেমে গেছে। মুহূর্তের জন্য রইলো কেবল নীরবতা, আর কিছুই না। হঠাৎ বালিয়াড়ির মাথার উপরে দেকা দিলো। একটি মানুষের মাথা, তারপর কাঁধ এবং সেই লোকটির পাশে আরেকটি মানুষ। তারা কিছুক্ষনের জন্য তাকালো নিচের দিকে, তারপর ঘুরে তাদের অদৃশ্য সাথীদের কী যেনো বলো চিৎকার করে উঠলো; এরপর ওরা হামাগুলি দিয়ে বালিয়াড়ির মাথার চড়ে এবং অর্ধেক দৌড়ে, অর্ধেক ঢালু বেয়ে পিছলে নেমে ছুটে এলো আমার দিকে।
আমাকে গিরে প্রচন্ড উত্তেজন, দু’তিনজন মানুষ-এই নিঃসংগ নির্জনতর পর কী বিশাল জনতা! ওরা আমাকে তোলার চেষ্টা করছে; ওদের ক্রিয়া –কলাপ, হাত আর পায়ের এলোপাতাড়ি নড়াচড়ার এক অতি বিভ্রান্তিকর দৃশ্য! আমি যেন জ্বলন্ত ঠান্ডা বরফ এবং আগুন অনুভব করি আমার ঠোঁটের উপর এবং দেখতে পাই এক দাঁড়িওয়াল বেদুঈনের মুখ ঝুঁকে আছে আমার উপর, আর তার হাত এক ময়লা ভেজা তেনা ঠেলে দিচ্ছে আমার মুখের ভেতর। লোকটির আরেকটি হাত ধরে আছে একটি খোলা মশক। আমি আপনা আপনি হাত বাড়াই মকটির দিকে, কিন্তু বেদুঈনটি আমার হাত ঠেলে পেছন-দিকে; তেনাটি পানিতে ডুবিয়ে আবার সে কয়েক ফোঁটা পানি সেই তেনা চিপে আমার ঠোঁটের মধ্যে দেয়;আর এই পানি যাতে আমার মুখে ঢুকে আমার গলা গলা পুড়িয়ে না দেয় সেজন্য আমি দাঁতের সংগে দাঁত চেপে রাখি। কিন্তু বেদুঈন আমার দাঁত আলাদা না করে আমার মুখে আবার কয়েক ফোঁটা পানি দেয়। এ তো পানি নয়, যেন গলানো সীসা। ওরা আমার সাথে এরূপ ব্যবহার করছে কেন? আমি পালিয়ে বাঁচতে চাই এদের জূলুম থেকে। কিন্তু ওরা আমাকে ধরে রাখে। শয়তান সব! আমার চামড়া জ্বলছে; আমার সারা গায়ে আগুন লেগেছে। ওরা কি মেরে ফেলতে চাই আমাকে? হায় যদি কেবল বন্দুকটি ধরবার মতো শক্তি থাকতো আমার আত্মরক্ষার জন্য! কিন্তু ওরা আমাকে হা করিয়ে আমার মুখে কয়েক ফোঁটা পারি দেয়; এ পানি গোলা ছাড়া আমর আর উপায় রইলো না। আশ্চর্য! কিছুক্ষণ আগরে মতো অতো তীব্রভাবে আরদহন করছে না এ পানি; মাথার উপরে ভেজা নেকড়াটা ভালোই লাগছে এবং ওরা যখন পানি ঢাললো গায়ের উপর, ভেজা কাপড়ের স্পর্শ নিয়ে এলো উল্লাসের এক শিহরণ.. .
এরপর সব কিছু কালো হয়ে আসে; আমি নামছি এক গহীন কুয়ায় –এতো দ্রুত গতিতে নামছি যে, বাতাস আমার কানের পাম দিয়ে ছুটে যায় হুহু করে, শোঁ- শোঁ করে, আর সেই শোঁ-শোঁ ধ্বনি রূপ নেয় গর্জনে –গর্জনমুখর কৃষ্ণতায়.. . কালো- কালো.. .
পাঁচ
কালো .. . কালো. .. নরম মোলায়েম কালো, যার কোনো শব্দ নেই –একটা মহৎ সহৃদয় আঁধার, যা আমাকে আলিংগন করে গরম এক কম্বলের মতো এবং মনে জাগায় এই কামনা যে, আমি যেনো সবসময় এভাবেই থাকতে পারি, এমনি আশ্চর্য রকমে ক্লান্ত, নিদ্রালু আর আলসে। কোনো প্রয়োজন নেই আমার চোখ দুটি মেলার কিংবা আমার বাহু নাড়ানোরঃ তবু আমি আমার বাহু নাড়ি, আমার চোখ মেলি, কেবল আমার মাথার উপরে অন্ধকার দেখার জন্য –কালো ছাগ-পশম দিয়ে তৈরি বেদুঈনের তাঁবুর পশমী-আধাঁর, যার সমুখ দিকে রয়েছে সংকীর্ণ খোলা জায়গা, যার ফাঁক দিয়ে আমি দেখতে পাই তারা ঝিলমিল রাতের আসমানের একটি টুকরা এবং তারার আলোতে নিচে একটি ঝলমলো বালিয়াড়ির এক মোলায়মে বাঁক। .. . তাপরপর –তারপর তাঁবুর সেই ফাঁকটুকু আঁধার হয়ে ওঠে এবং একটি মানুষের মূর্তি এসে দাঁড়াই সেই ফাঁকটুকুর মধ্যে – তার ঝূলন্ত জোব্বার নকশা যেন আকাশের গায়ে খোদাই করা এবং আমি শুনতে পাই জায়েদের চিৎকার – ‘জেগে আছেন, ‘উনি জেগে আছেন’! এরপর তার কঠোর সংযত মুখখান ঝুঁকে পড়ে প্রায় আমার মুখের উপর; জায়েদ তার হাত দিয়ে ধরে আমার কাঁধে। আরেকজন মানুষ ঢোকে তাঁবুর ভেতর। আমি তাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু সে যখন আস্তে ভারিক্কি গলায় কথা বলতে শুরু করলো আমি সংগে সংগে বুঝতে পারি, সে শাম্মার কবিলার বেদুঈন।
আবার আমি অনুভব করি এক তপ্ত সর্বশেষে পিয়াস এবং জায়েদ আমার দিকে দুধের যে বাটি আগিয়ে ধরেছে তা চেপে ধরি সাজোরে। কিন্তু আমি যখন তা গিললাম তখন আর কোনো যন্ত্রণা রইলো না। আমি সেই দুধ খাচ্ছি যখন জায়েদ বর্ণনা করে চলে-কীভাবে এই ছোট্ট বেদুঈন দলটি বালু-ঝড় শুরু হলো তার কাছেই তাঁবু খাটাতে এলো,তারপর যখন হারানো উটটি রাতের বেলা নিজে নিজে ফিরে এলো তখন তার কেমন চিন্তিত হয়ে পড়েছিলো এবং কী করে সকলে জোট বেঁধে বের হয়েছিলো আমাকে খুঁজতে, কীভাবে প্রায় তিন দিন পরে যখন তারা সব আশাই একরকম ছেড়ে দিয়েছিলো, তখন ওরা বালিয়াড়ির আড়াল থেকে শুনেছিলো আমার বন্দুকের আওয়াজ…
এরপর, ওরা আমার উপর খাটিয়ে দিলো একটি তাঁবু আর আমাকে হুকুম করা হলো, আমি যেনো আজ রাত এবং আগামীকাল এ তাঁবুর ভেতর পড়ে থাকি। আমাদের বেদুঈন বন্ধুদের কোনা তাড়াহুড়া নেই; তাদের মশকগুলি পানিতে ভর্তি, এমনকি তারা পুরা তিন বালতি পানি দিল আমার উটটিকে, কারণ, ওরা জানে, দক্ষিণদিকে একদিনের পথ গেলেই, ওরা আর আমরা গিয়ে পৌছুবো একটি ওয়েসিস – যেখানে রয়েছে প্রচুর খাদ্য – ‘হামদ –ঝোপ।
কিছুক্ষণ পর জায়েদ আমাকে তাঁবু থেকে বের করে, তারপর বালুর উপর একখানা কম্বল বিছিয়ে দেয়। আমি শুয়ে থাকি তারা –ভরা আসমানের নিচে।
কয়েক ঘন্টা পর আমি জায়েদের কাফি-পাত্রের টুঙটাঙ শব্দে জেগে উঠি-টাটকা কফির গন্ধ যেনো রমণীর উষ্ণ আলিংগন!
-‘জায়েদ’! আমি চিৎকার করে উঠি; বিস্ময়ের সাথে আমি লক্ষ্য করি, আমার গলার আওয়াজ যদিও এখনো ক্লান্ত তবু এখন আর তা কর্কশ নয়- ‘তুমি আমাকে কিছু কফি দেবে?’
-‘আল্লাহর কসম চাচা, অবশ্যি দেবো’, জায়েদ পুরানো আরবী রসুম মুতাবিক জবাব দেয়, আরববাসী এভাবেই তাকে সম্বোধন করে যাকে সে দেখাতে চায় সম্মান, তা সে বক্তার চেয়ে বয়সে বড়োই হোক অথবা ছোটই হোক, (যেমন আমাদের বেলায়- আমি জায়েদের চেয়ে কয়েক বছরের ছোট)-আপনার দীল যতো চায় ততো কফি আপনি পাবেন।’
আমি কফি খাই আর জায়েদের প্রসন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসি-‘আচ্ছ ভায়া, বুদ্ধিমান লোকের মতো ঘরে না থেকে আমরা এরূপ বিপদের মুখে নিজেদের ঠেলে দিচ্ছি কেন বলো তো?’
-‘কারণ, জায়েদ এবার আমার দিকে তাকিয়ে দঁত বের করে হাসে, আপনার আর আমার মতো লোকের পক্ষে যতো দিন না হাত পা কঠিন হয়ে উঠেছে আর আমরা যয়ীফ হয়ে পড়েছি ততোদিন ঘরে বসে থাকা সম্ভব নয়! তাছাড়া মানুষ কি নিজেদের ঘরে থেকে মরে না? মানুষ কি তার অদৃষ্টকে ঘাড়ে করে নিয়ে চলে না-থাকুক না সে যেখানেই?
জায়েদ ‘অদৃষ্ট’ অর্থে ব্যবহার করে ‘কিসমা’ শব্দটি‘-কিসম’ মানে ‘যা ভাগ্যে নির্ধারিত হয়েছে।’ এই শব্দটি তুর্কী রূপ ‘কিসমত’, প্রতীচ্যে সুপরিচিত। আরেক পোয়ালা কিফ পান করতে আমার মনে হলো, এই আরবী শব্দটির একটি গভীরতরো অর্থও আছে –‘যাতে মানুষের অংশ আছে তাই –তো কিসমত।’
যাতে অংশ আছে মানুষের, তা-ই.. .
শব্দগুলি আমার স্মৃতিতে একটা ক্ষীণ বিলীয়মান ধ্বনি জাগায়, সংগে সংগে আমার সামনে ভেসে ওঠে একটি ক্লিষ্ট হাসির দৃশ্য.. . কার হাসি? এক ঝাঁক ধোঁয়া, উৎকট ধোঁয়া, যেন হাশিশের ধোঁয়া, আর তারি আড়ালে একটা ক্লিষ্ট হাসি, হ্যাঁ, এ ছিলো হাশিশেরই ধোঁয়া, আর হাসিটি ছিলো, আজতক আমি যতো মানুষের সাথে মিশেছি, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিচিত্র ব্যক্তিটির হাসি। আমার জীবনের বিচিত্র এক অভিজ্ঞিতার পর ওর সাথে আমার মুলাকাত হয়েছিলো! এক বিপদ. .. যা মনে হয়েছিলো.. . হ্যাঁ কেবলি মনে হয়েছিলো আসন্ন, সে বিপদ থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য আমি না জেনেই ধেয়ে চলেছিলাম, আরেক বিপদের দিকে, আর সে বিপদ –আমি যা এড়াবার চেষ্টা করেছিলাম, তার চেয়ে ছিলো অনেক বেশি বাস্তব, অনেক বেশি আসন্ন.. . এই অবাস্তব ও বাস্তব বিপদ-এ দু’য়ে মিলে আমাকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিলো এক নতুনতরো মুক্তির দিকে।
ব্যাপারটি ঘটেছিলো আট বছর আগে। আমি যাচ্ছিলাম ঘোড়ায় চড়ে আমার তাতার নওকর ইবরাহীমকে সাথে নিয়ে, শিবাজ থেকে দক্ষিণ ইরানে নাইরস হ্রদের কাছে, একটি পাড়ো, পাতলা বসতি, পথ-ঘাটহীন এলাকা কিরমানের দিকে। তখন শীতকাল-আর এই শীতকালে এলাকাটি হয়ে পড়েছিলো প্যাঁচ-প্যাঁচে কর্দমাক্ত একটি স্তেপ বিশেষ; আশেপাশে কোনো গাঁও-গেরাম নেই, দক্ষিণদিকে, কুহ-ই-গুশনেগান অর্থাৎ ‘ভুখাদের পাহাড়’ কর্তৃক ঘেরা সেই জলাভূমি গিয়ে স্পর্শ করেছে হ্রদটির কিনার। বিকালে আমরা যখন একটি আলগোছে পাহড়ের চারদিকে ঘুরছিলাম, হঠাৎ আমাদের নজরে পড়লো হ্রদটি-একটি নিস্তব্ধ সবুজ সমতল, যেখানে নেই কোনো আলোড়ন, শব্দ অথবা জীবন, কারণ এর পানি এতো নোনা যে, এতে কোনো মাছই বাঁচতে পারে না। গুটিকয়েক পংগু গাছপালা আর কিছু মরু-তৃণ ছাড়া হ্রদটির তীরের নোনা মৃত্তিকায় কোন উদ্ভিদই জন্মায় না। ভূমিটি কাদা মেশানো তুষারের পাতলা আস্তরণে ঢাকা এবং তার উজান দিকে তীর থেকে প্রায় দু’শো গজ দূরে চলে গেছে একটি সরু ক্ষীণ পথ।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে; আমাদের আজকের রাতের মঞ্জিল খানই-ই –খেত সরাইখানার কোন নিশানাই মিললো না এখনো। কিন্তু যে-কোনো মূল্যেই হোক আমাদের পৌছুতেই হবে ওখানে। দূরে-বহুদূর তক আর কোনো বসতি নেই এবং জলাভূমিটি কাছে হওয়ায়, অন্ধকারে আমাদের আগানো খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠে। আসলে সকালেই আমাদেরকে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছিলো ওখানে একাকী না আগাতে, কারণ একটিমা্ত্র ভূল পদক্ষেপের ফলেই ঘটতে পারে সহজ এবং আকস্মিক মৃত্যু। তাছাড়া, ভেজা প্যাঁচ-প্যাঁচে জমির উপর দিয়ে দীর্ঘ একটা দিন চলার পর আমাদের ঘোড়াগুলি হয়ে পড়েছিল খুবই ক্লান্ত-ওদের জন্যও এখন দরকার বিশ্রাম এবং খাবার।
রাত আসার সাথে সাথে শুরু হরো মুষলধারে বৃষ্টি। আমরা চলছি ভিজতে ভিজতে বিষণ্ণচিত্তে এবং নীরবে- আমাদের নিজেদের বেফায়দা চোখের চাইতে ঘোড়ার সহজাত অনুভূতির উপরই আমরা নির্ভর করছি বেশি। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায় .. . কিন্তু কোথায় সেই সরাইখানা? কোন নিশনাই নেই! হয়তো আমরা অন্ধকারে ঠাহর করতে না পেরে সরাইখানাটিকে পেছনে ফেলে এসেছি; ফলে আজ হয়তো আমাদেকে রাত কাটাতে হবে খোলা জায়গায় –বর্ষনের নীচে, যে বর্ষণ ক্রমেই তীব্র ও জোরদার হয়ে উটেছে! আমাদের ঘোড়ার খুর পানিতে আঘাত হেনে ছিটাতে থাকে পানি, আমাদের ভেজা কাপড়গুলি ভারি বোঝার মত লেপ্টে থাকে আমাদের গায়ের সাথে। উচ্ছ্বসিত পানির পর্দার আবরনে কালো এবং নিশ্চিদ্র রাত ঝুলে আছে আমাদের চারপাশে। আমাদের হাড্ডি পর্যন্ত শীতে ঠক ঠক করছে-কিন্তু জলাভূমিটি যে আমাদের নিকটেই রয়েছে এ জ্ঞান আমাদেরকে আরে বেশি শংকিত করে তুলেলো। ঘোড়াগুলি একটিবারের মতো কঠিন মৃত্তিকার উপর পা ফেলতে ভুল করে তাহলে আল্লহ যেন আমাদের উপর রহম করেন! –সকালবেলা হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছিলো আমাদেরকে।
আমি চলছি আগে, আর ইবরাহীম আমার পেছনে, সম্ভবত দশ পা তফাতে। বারবার মনে হানা দিতে থাকে সেই ভয়ংকর জিজ্ঞাসা-আমরা কি অন্ধকারে খান-ই-খেত পেছনে ফেলে এসেছি? ঠান্ডা বৃষ্টির নিচে রাত কাটানো-কী যে অশুভ সম্ভাবনা! কিন্তু আমরা যদি অনেক দূর গিয়েই থাকি তাহলে জলাভূমিটি গেলো কোথায়?
হঠাৎ আমি শুনতে পাই একটি নরম মোলায়েম চপচপ শব্দ, আমার ঘোড়ার খুরের নিচে। আমি টের পেলাম জানোয়ারটি কাদার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে-কিছুটা ডুবে যাচ্ছে, কিছুটা ডুবে গেছে,তারপর মরিয়া হয়ে একটা পা তুলছে এবং আবার ডুবে যাচ্ছে। সহসা এই চিন্তা আমার মনকে বিদীর্ণ করে দেয়-আমরা কি তাহলে জলাভূমিতে পা দিয়েছি? আমি সাজোরে লাগাম টেনে ধরি এবং ঘোড়ার দু’পাশে দু’পা দিয়ে সাজোরে লাথি মারতে থাকি। ঘোড়াটি তার মাথা উপর দিকে তুলে ভীষণ ভাবে দাপাদাপি শুরু করে। আমার চামড়া ফেটে নির্গত হতে লাগলো ঠান্ডা ঘাম। রাতটা এতো কালো যে, আমি আমার নিজের হাত দুটি পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না; কিন্তু নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে ঘোড়াটি শরীর যেভাবে স্ফীত হচ্ছে, তাতে টের পেলাম, কাঁদার আলিংগন থেকে বাঁচার জন্য কী মরিয়া হয়েই না ও চেষ্টা করছে। প্রায় কোনো রকম ভাবনা না করেই আমি হাতে নিই ঘোড়ার চাবুকটি যা ব্যবহার না করে সাধারণত ঝুলানো থাকে আমার হাতের কব্জিতে এবং আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে সেই চাবুক দ্বারা আঘাত করি ঘোড়াটির পাছার উপর; উদ্দেশ্য –এভাবে যদি ঘোড়াটিকে কার শেষ শক্তিটুক খাটানোর জন্য উত্তেজিত করা যায়, কারন ঘোড়াটি যদি এই মুহূর্তে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে সে দেবে যাবে এবং তার সাথে আমিও ডুবে যাবো এ কাঁদার মধ্যে, গভীর হতে গভীরে। এ ধরণের মার কেতে অনভ্যস্ত হতভাগা জানোয়ারটি-অসাধারণ গতি ও শক্তির অধিকারী কাশগাই টাটু –পেছনের দুপায়ের উপর দাঁড়িয়ে গেলো-তারপর চারটি পায়ে আবার আঘাত করতে লাগলো জামিনের উপর; কাঁদা থেকে বাঁচার জন্য ঘন ঘন দম ফেলতে মরিয়া হয়ে সে চেষ্টা করে, লাফ দেয়, আবার নিজেকে নিক্ষেপ করে সম্মুকদিকে, আাবর পিছলে পড়ে যায়- এবং বিরতি না দিয়ে নরম কাদামটির উপর বারবার পড়তে থাকে ঘোড়াটির খুরের আঘাত।
আমার মাথার উপর দিয়ে একটি রহস্যময় বস্তু বয়ে যায় শোঁ শোঁ আওয়াজ ক’রে, আমি আমার মাথা তুলি সংগে সংগে, আর আমার উপর এসে পড়ে এটা কঠিন ধারণা-বহির্ভূত আঘাত, কিন্তু কোত্থেকে? সময় এবং চিন্তা একে অপরের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আর তালগোল পাকিয়ে যায়।
মুহূর্তের জন্য মনে হলো, ঘন্টার পর ঘন্টার মতোই দীর্ঘ, বৃষ্টির ছাট আর ঘোড়ার হাফানির ফাঁকে ফাঁকে আমি শুনতে পাচ্ছি সেই জলাটি চুষে চুষে পান করছে সেই ধ্বনি। আমাদের অন্তিম মুহূর্ত নিশ্চয় আসন্ন। রেকাব থেকে আমি আমার পা দুটি শিথিল করে দিলাম, তারপর তৈরি হলাম জিনের উপর থেকে লাফিয়ে পড়া একা আমার ভাগ্য পরীক্ষা করতে .. হয়তো কাদার উপর চিৎ হয়ে পড়ে থাকলে আমি নিজেকে বাঁচাতেও পারি – আমার মনের অবস্থা যখন এই , হঠাৎ অবিশ্বাস্য রকমে আমার ঘোড়াটি খুব শক্ত কঠিন মাটির উপর আঘাত হানলো সজোরে একবার .. . দুবার .. এবং আমি, মুক্তির উল্লাসে ফুপিয়ে উটে লাগাম টেনে ধরলাম আর কাঁপতে থাক জানোয়ারটিকে থামিয়ে দিলাম। আমরা বেঁচে গেলাম।
এই মুহূর্তে হঠাৎ আমার মনে পড়লো সংগীর কথা, আর আমি ভয়ে বিহ্বল হয়ে চিৎকার করে উঠরাম.. . ‘ইবরাহীম!’ কিন্তু কোনো জবাব নেই। আমার হৃদপিণ্ড জমে গেলো।
‘ইবরাহীম!’ কিন্তু আমাকে ঘিরে রয়েছে কেবল এক আধাঁর রাত আর বর্ষণ। ও কি তাহলে নিজেকে বাঁচাতে পারেনি? কর্কশ স্বরে আমি আবার চিৎকার করে ডাকি ‘ইবরাহিম।’
এবং তখন প্রায় অবিশাস্য রকমে, অনেক দূর থেকে অস্পষ্ট ভেসে এলো একটা চিৎকারের আওয়াজ ‘এই যে.. . আমি এখানে।;
এখন আমার বুদ্ধি স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার পালা! আর এতে বিপুল ব্যবদানে একজন আরেকজন থেকে আলাদা হয়ে পড়লাম কী করে?
-‘ইবরাহীম!’
-‘এই যে .. .এই যে’.-
এবং আমি ঐ শব্দ অনুসরণ করে ঘোড়ার লাগাম ধরে ঘোড়াটাকে টানতে টানতে প্রতি ইঞ্চি মাটি পা দ্বারা পরখ করে খুব ধীরে ধীরে অত্যন্ত সতর্কতার সংগে দূরবর্তী সে কন্ঠস্বরের দিকে হাঁটতে থাকিঃ ইবরাহীম .. . ইবরাহীম শান্তভাবে বসে আছে ঘোড়ার জিনের উপর।
-‘তোমার কি হয়েছিলো ইবরাহীম? তুমিও কি ভুল করে জলাভূমিতে গিয়ে পড়েছিলে?’
– জলাভূমী? না তো। কেন জানি না আপনি হঠাৎ যখন ঘোড়া হাকিয়ে গায়েব হয়ে গেলেন আমি তখন –নড়ন-চড়ন নাস্তি, একটুও নড়লাম না, যেখানে ছিলাম সেখানেই থেমে গেলাম।’
-ঘোড়া হাঁকিয়ে গায়েব হয়ে গেলেন!’ এতোক্ষণে সমাধান হলো রহস্যের! জলাভূমিতে হাত থেকে বাঁচার এই চেষ্টা তাহলে আমার কল্পনারই পরিণতি। নিশ্চয়ই আমার ঘোড়াড়াটি এসে পড়েছিলো একটি কর্দমাক্ত রাস্তায় এবং আমার মনে হয়েছিলে, আমি আর আমার ঘোড়া তলিয়ে যাচ্ছি জলাভূমিতে আর তাই ঘোড়াটিকে চাবুক মেরে হাঁকিয়েছিলাম পাগলের মতো! আঁধারে দ্বারা প্রতারিত হয়ে আমি ঘোড়াটির অগ্রগতিকে, তার সম্মুকে ছুটে চলাকে জলাভূমির কবল থেকে বাঁচার প্রাণান্ত চেষ্টা বলে ভূল করেছিলাম এবং রাতভর ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছিলাম, জানতাম না যে, মাঠের এখানে –ওখানে ছড়িয়ে রয়েছে বহু গ্রন্থিল গাছপালা। জলাভূমি নয়, এই গাছগুলিই ছিলো আসন্ন এবং প্রকৃত বিপদঃ যে শাখাটি আঘাত করেছিলো আমার হাতে, তা ছোট না হয়ে হতে পারতে আরো বড় একটি শাখা, যা গুঁড়িয়ে দিতে পারতো আমার খুলি এবং এভাবেই দক্ষিণ –ইরানের একটি চিহ্নিত করবে চূড়ান্ত অবসান ঘটতো আমার সফরের।
আমি ক্ষেপে গেলাম নিজের বিরুদ্ধে –ক্ষেপে গেলাম এ কারনেও যে, আমরা সব দিশা হারিয়ে ফেলেছি এবং রাস্তার কোনো নিশানাই আর খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। আমরা আর সরাইখানা ফিরে পাবো না।
কিন্তু আমি আবার ভুল করে বসি।
ইবরাহীম ঘোড়ার উপর থেমে নেমে পড়লো হাত দিয়ে জমিনের অবস্থা অনুভব করবার জন্য এবং হয়তো এভাবেই নতুন করে পথ খুঁজে বের করার জন্য। এভাবে যখন সে হামাগুড়ি দিচ্ছে হঠাৎ তার মাথা গিয়ে ঠেকলো এক দেয়ালে-খান –ই-কেত সরাইখানার কালো প্রাচীরে!
জলাভূমিতে ঢুকে পড়ার কাল্পনিক ভুলটি যদি আমি না করতাম আমরা হয়তো আগাতেই থাকতাম, হয়তো সরাইখানাটিকে পেছনে ফেলে চলে যেতাম অনেক দূরে, তারপর হয়তো সত্যি সত্যি আমরা হারিয়ে যেতাম সেই জলাভূমিতে, কারণ পরে আমরা জানতে পেরেছিলাম, দুশ গজেরও কম সামনে থেকেই সেই জলাটি শুরু হয়েছে।
মহান শাহ আব্বাসের আমলের বহু ধ্বংসাবশেষের একটি হচ্ছে এই সরাইখানাটি। সারি সারি মজবুত ইমারতের খিলানের নিচে দিয়ে রয়েছে আসা-যাওয়ার পথ, হা-করা দরজা এবং ভেঙে পড়া উনান। এখানে-ওখানে লিণ্টেলের এবং ফাটল ধরা মেজলিকা টালির উপর আমি দেখতে পেলাম পুরানো খোদাই-এর কিছু চিহ্ন। বাসের অযোগ্য কোঠা কটিতে ছড়ানো রয়েছে পুরানো খড়কুটা আর ঘোড়ার লাদ। আমি আর ইবরাহীম প্রধান ‘হল’ কামরায় ঢুকে দেখতে পেলাম সরাইখানার ওভারশিয়র খালি মেঝেয় খোলা আগুনের পাশে বসে আছে আর তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি মানুষ, খালি পা, আকারে বামন এবং পরনে ছেঁড়া কাপড়। আমরা ঢোকার সাথে সাথে দুজনেই দাঁড়িয়ে গেলো। বামনাকৃতি লোকটি গম্ভীরভাবে, নিখুঁত প্রায় নাটকীয় ভংগিতে মাথা নিচু করে অভিবাদন জানালো ডান হাতটি বুকের উপর রেখে। তার গারে জামাটিতে অসংখ্য তালি, নানা রঙের; লোকটি নোংরা, একেবারেই অগোছালো, এলোমেলো, কিন্তু তার চোখ দুটি জ্বল জ্বল করছে এবং মুখটি শান্ত স্নিগ্ধ।
আমাদের ঘোড়া কটির তদারক করার জন্য ওভারশিয়র কোঠা থেকে বের হয়ে গেলো একবার। আমি আমার ভেজা জামা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম আর ইবরাহিম দেরী না করে সেই খোলা আগুনের উপর চায়ের পানি বসিয়ে দিলো। যে মহৎ সামস্ত প্রভু তার চাইতে যারা হীন তাদের প্রতি ভদ্র হয়েও নিজের ইজ্জত হারায় না, তারি ভংগিতে সুন্দরভাবে সেই বামনটি ইবরাহীম কর্তৃক তার দিকে তুরে ধরা চায়ের পেয়ালটি গ্রহণ হরে।
বিন্দু মাত্র অস্বাভাবিক ঔৎসুক্য না দেখিয়ে, যেন একটি বৈঠকী আলাপ শুরু করার জন্যেই সে তাকালো আমার দিকে – ‘জনাব-ই আলী, আপনি কি ইংরেজ?
-‘না, আমি নামসাভী (অস্ট্রীয়)’
– ‘আমি যদি জিজ্ঞাস করি, আপনি কি তেজারতির উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন তা কি অশোভন হবে?’
-‘আমি খবরের কাগজের লেখক, আমি জবাব দিই, আমি তোমাদের দেশে সফর করছি – আমার কওমের নিকটে তোমার দেশের পরিচয় জানাবার জন্য। আমার কওম অন্যেরা কীভাবে জীবন-যাপন করে তা জানতে ভালোবাসে।’
সম্মতিসূচক স্মিত হাসির সাথে সে মাথা নাড়ে, তারপর চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ পর সে তার জামার ভাঁজ থেকে বের করলো একটি মাটির হুঁকা, আর একটি বাঁশের দন্ড; বাঁশের দন্ডটি সে মাটির পাত্রটির সাথে লাগিয়ে দেয়; তারপর স েতার দুই হাতের চেটোয়, দেখতে তামাকের মতোই কী একটা জিনিস ডরতে থাকে; পরে যত্নের সাথে, যেনো সোনার চাইতেও দামী সেই জিনিসটি ছিলিমের মধ্যে রেকে ঢেকে দেয় জ্বলন্ত আংগার দিয়ে বাঁশের দণ্ডটি সে মাটির পাত্রটির সাথে লাগিয়ে দেয়;তারপর চুপ করে যায়। কিছু্ক্ষণ পর সে তার জামার ভাঁজ থেকে বের করলো একটি মাটির হুঁকা, আর একটি বাঁশের দণ্ড; বাঁশের দণ্ডটি সে মাটির পাত্রটির সাথে লাগিয়ে দেয়; তারপর সে তার দুই হাতের চেটোয়, দেখতে তামাকের মতোই কী একটা জিনিস ডলতে থাক; পরে যত্নের সাথে, যেনো সোনার চাইতেও দামী সেই জিনিসটি ছিলিমের মধ্যে রেখে ঢেকে দেয় জ্বলন্ত অংগার দিয়ে। বাঁশের নলটি মুখে পুরে অনেকটা জোরে জোরেই সে ধোঁয়া টানতে লাগলো এবং ধোঁয়া টানতে টারতেই প্রচন্ডভাব কেশে উঠলো এবং এভাবে তার গলা পরিষ্কার করে নিলো। মাটির হুঁকার ভেতর পনি বগবগ করতে থাকে এবং একটা উৎকট গন্ধে ধীরে ধীরে কোঠাটি ছেয়ে যায়। এখন আমি বুঝতে পারলাম – এহচ্ছে ভারতীয় গাঁজা ‘হাশিশ’। এতোক্ষণে তার অদ্ভুত আদব –কায়দা ও ভাবভংগির অর্থ পরিষ্কার হলোঃ ও একজন ‘হাশশাশী’, গাঁজাখোর! আফিমখোরদের মতো তার চোখ দুটি ঢাকা নয়, এক ধরনের অনাসক্ত নৈর্ব্যক্তিক গভীরতায় তার চোখ দুটি জ্বল জ্বল করছে-বহুদূরে তার নজর , তার আশেপাশে বাস্তব দুনিয়া থেকে এতো দূরে যে, তা অপরিমেয়।
আমি চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। ও ধূমপান শেষকরে আমাকে জিজ্ঞাস করে – ‘আপনি কি একটু চেষ্টা করে দেখবেন’?
আমি ধন্যবাদের সাথে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিই। জীবনে দুএকবার আফিম চেষ্টা করে দেখেছি, (অবশ্যি তাতে কোনো আনন্দ পাইনি; কিন্তু এই হাশিশ পানের চেষ্টাও আমার কাছে খুবই কষ্টসাধ্য, এমনকি অরুচিকর মনে হয়। হাশশাশী নিঃশব্দে হাসে –এক বন্ধুত্বপূর্ণ শ্লেষের সাথে তার তীর্যক চোখের নজর আমার উপর বুলিয়ে নেয়ঃ
-`আমি জানি, মাননীয় দোস্ত, আপনি কী ভাবছেন। আপনি ভাবছেন-হাশিশ খাওয়া হচ্ছে শয়তানের কাজ এবং আপনি একে ভয় করছেন। এক্কেবারে বাজে কথা। হাশিশ হচ্ছে আল্লাহর একটি দান-রহমত। অতি উত্তম.. . বিশেষ করে মনের জন্য। হযরত, লক্ষ্য করুন, আমি বুঝিয়ে বলছি আপনাকে। আফিম খারাপ –এতে কোনো সন্দেহ নেই, কারণ আফিম মানুষের মনে জাগায় এমন জিনিসের কামনা যা পাওয়া যাবে না। আফিম মানুষের স্বপন্গুলিকে করে তোলে লোভী, জন্তু-জানোয়ারের কামনার মতোই। কিন্তু হাশিশ সব লোককে শান্ত করে দয়ে এবং দুনিয়ার সব কিছুর প্রতি মানুষকে করে তোলো উদাসীন। হ্যাঁ তাই। হাশিশ মানুষকে দেয় তুষ্ঠি। একজন হাশশাশীর সামনে আপনি রেখে দিতে পারেন এক মণ সোনা সে যখন হাশিশ পান করছে কেবল সেই সময় নয়, যে কোনসময়ে – হাশশাশী তার একটি আঙুল ও সে সোনার দিকে বাড়াবে না। আফিম মানুষকে দুর্বল ও কাপুরুষ করে তোলে, কিন্তু হশিশ.. . হাশিশ সব ভয় দূর করে দেয় এবং মানুষকে করে তোলে সিংহের মতোই সাহসী। আপনি যদি শীতকালের মাঝামাঝি বরফের স্রোতে ডুব দিতে বলেন ‘হাশশাশী’কে, সে সোজা ঝাঁপিয়ে পড়বে সেই স্রোতে আর হাসবে.. . কারণ সে জেনেছে,যার লোভ নেই তার ভয় নেই- এবং মানুষ যদি ভয়কে জয় করতে পারে, সে বিপদকেও জয় করে, কারণ- সে জানে, তার জীবনে যা কিছুই ঘটেছে তা তারই অংশ, সৃষ্টিতে যা কিছু ঘটে চলেছে সে সবের মধ্যে.. .’
আবার ও হাসে, সেই সংক্ষিপ্ত ঢেউ তোলা নিঃসব্দ হাসি, যাঁকে বিদ্রূপ বলা যায় না; সদাসয়তাও বলা যায় না –দুয়ের মাঝামাঝি একটা অবস্থা। এরপর তার হাসি থেমে যায়, কুণ্ডলী পাকানো ধূঁয়ার আড়ালে কেবল তার দাঁতগুলি বিকশিত হয় এবং তার উজ্জ্বল দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় এক স্থির অনড় দূরত্বের প্রতি।
‘যা কিছু ঘটে চলেছে তাতে আমার অংশ…’ বন্ধুত্বপূর্ণ, আরবীয় আকাশের তারকাপুঞ্জের নিচে শুয়ে শুয়ে আমি মনে মনে ভাবি-আমি .. হাড্ডি ও গোশতের, সংবেদন ও উপলব্দির এই বাণ্ডিল –আমাকে রাখা হয়েছে বিশ্বনিয়ন্তার কক্ষে এবং যা কিছু ঘটে চলেছে আমি আছি তারি মধ্যে। ‘বিপদ’, এ তো অলীক কল্পনা মাত্র – এ আমাকে কখনো ‘পরাভূত’ করতে পারে না – কারণ, আমার জীবনে যা কিছু ঘটছে তা তো সর্বত্রগামী সেই স্রোতেরই একটা অংশ – আমি নিজেই যে স্রোতের অংশ। এ-ও হতে পারে যে, এই বিপদ ও নিরাপত্তা, মৃত্যু ও আনন্দ, নিয়তি ও পূর্ণতা, সবকিছুই এই যে ক্ষুদ্র অথচ মর্যাদাবান একটি ‘বণ্ডিল’, আমি, তারই বিভিন্ন দিক মাত্র। কী অননত্ মুক্তি, হে আল্লাহ, তুমি দান করেছো মানুষকে!’
এই চিন্তার আনন্দের বেদনা এতো তীব্র এবং তীক্ষ্ণ যে, আমি আমার চোখ বুঁজতে বাধ্য হই এবং আমার মুখের উপর দিয়ে যে ঝিরঝির হাওয়া বয়ে যাচ্ছে তা-ই যেনো দূর থেকে মুক্তির পাখনারূপে নীরবে আমার উপর পরশ বুলিয়ে দেয়।
ছয়
এতোক্ষণে উঠে বসার মতো যথেষ্ঠ শক্তি আমি অনুভব করছি। আমি যাতে হেলান দিয়ে বসতে পারি সেজন্য জায়েদ আমাদের উঢের জিনের একটি নিয়ে আমার কাছে এলো।
-চাচা, আপনি আরাম করুন; আপনাকে মৃত মনে করে আপনার জন্য মাতম করেছি, আজ আপনাকে বহাল তবিয়তে পেয়ে আমি কতো যে আনন্দিত হয়েছি!
-‘তোমাকে সবসময় এক পরম বন্ধুরূপে পেয়েছি! তুমি যদি আমার ডাক শুনে আমার কাছে ছুটে না আসতে, তোমাকে ছাড়া বছরগুলি আমি কীভাবে চলতাম, বলো তো?
-“চাচা, আমি যে আপনার সাথে এই বছরগুলি কাটিয়েছি – তার জন্য কখনো অনুশোচনা হয়নি। আমার এখনো সেই দিনটির কথা মনে আছে যেদিন আমি আপনার চিঠি পেয়েছিলাম পাঁচ বছরেরো আগে। সেই চিঠিতে আপনি আমাকে মক্কায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আপনার সাথে আবার দেখা হবে এই চিন্তাটাই ছিলো আমার নিকট প্রিয়। তার বিশেষ কারণ ও ছিল – আপনি এরই মধ্যে ইসলামের আর্শীবাদ লাভে ধন্য হয়েছিলেন। ঠিক সেই সময়ই আমি শাদি করেছিলাম এক কুমারী মুন্তাফিক বালিকাকে; তার ভালোবাসায় আমার আনন্দের অবধি ছিলনা। ঐসব ইরাকী বালিকার কোমর খুবই চিকন, আর স্তন মজবুত, কঠিন, ঠিক এরি মত – অতীতের দৃশ্য স্মরণ করে মৃদু হেসে সে তার তর্জনী চেপে ধরে আমি যে জিনের উপর হেলান দিয়ে আছি তারি শক্ত অগ্রভাগের উপর – ‘এবং এদের আলিংগন থেমে মুক্ত হওয়া খুবই কঠিন।’ তাই আমি মনে মনে বললাম, ‘আমি যাবো তবে ঠিক এক্ষুণি নয়। কয়েক হপ্তা অপেক্ষা করতে হবে আাকে।’ কিন্তু হপ্তার পর হপ্তা গড়িয়ে যায়… গাড়িয়ে যায মাসের পর মাস এবং যদিও আমি কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই স্ত্রীলোকটিকে –সেই কুত্তীর বাচ্চাকে তালাক দিয়েছিলাম – ও কি না ওর চাচাত ভাইয়ের দিকে তাকচ্ছিলো আশনাই –এর দৃষ্টিতে, তবু আমি ইরাকী ‘আগায়েল’ আমার নোকরি ছাড়তে পারছিলাম না, ছাড়তে পারলাম না আমার দোস্ত-ইয়ারদেরকে, বাগদাদ ও বসরার আনন্দ –উল্লাসকে এবং সবসময়ই নিজেকে বলে চলছিলাম একথা ঠিক এখুনি নয়, আরো কিছু পরে।’ কিন্তু একদিন যখন আমি আমাদের তাঁবু থেকে আমার মাইনের টাকা নিয়ে চলেছিলাম উটে চড়ে এবং ভাবছিলাম, রাতটা আমার কোন দোস্তের বাড়িতে কাটাবো, হঠাৎ তখন মনে পড়লো আপনার কথা, মনে পড়লো, আপনার চিঠিতে আপনার প্রিয় সহধর্মিণী-আপনার রফিকার ইন্তিকার সম্বন্ধে আপনি লিখেছেন- আল্লাহ তাঁর উপর সদয় হোন এবং আমি ভাবলাম, তাঁকে হারিয়ে কতো নিঃসংগ বোধ করছেন আপনি এবং সংগে সংগে আমি বুঝতে পারলাম, আমার আর অপেক্ষা করা চলে না –আমাকে ছুটে যেতে হবে আপনার কাছে সেখানেই এবং তক্ষুণি, আমি আমার ইরাকী ‘ঈগাল’ থেকে তারকাটি ছিড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম; তারপর আমি আমার কাপড় –চোপড়গুলি নেবার জন্য ঘরে পর্যন্ত গেলাম না। আমার উটের রোখ আমি ফিরিয়ে দিলাম নুফুদের দিকে… নজদের দিকে, তারপর রওনা করে দিলাম –শুধু পরের গেরামটিতেই একবার থেমেছিলাম একটা মশক এবং কিছু খাবার কেনার জন্য … তারপর চললাম উট হাঁকিয়ে দিনের পর দিন –যতক্ষণ না আপনার সাথে মুলাকাত হলো মক্কায়, চার হপ্তা পরে…’
– ‘এবং তোমার মনে আছে জায়েদ, আররে অভ্যন্তরে আমাদের দুজনেরেই সেই পয়লা সফরের কথা, দক্ষিণ মুখে, খেজুর বাগিচার এবং ওয়াদি বিশার গম ক্ষেতের দিকে এবং সেখান থেকে রানিয়ার বালু বিস্তারের দিকে, যা আগে অতিক্রম করেনি কোন অন-আরব !
-‘কতো স্পষ্ট না তা আমার মনে পড়ছে, চাচা। আপনি কতো উৎসুকই না ছিলেন সেই শূন্য এলাকা ১[রাব আলখালি-নামক সুাবিশাল জনবসিতিশূন্য বালুময় মরুভূমি যা আরব –উপদ্বীপে এক –চতুর্থাংশ জুড়ে রয়েছে।] দেখতে যেখানে জীনের প্রভাবে বালুরাশি গান গায় সূর্যের নিচে। আর সেই এলাকার কিনারে যে-সব ‘বদু’ বাস করে তাদের কথা? যারা তাদের জীবনে তখনো চশমা দেখেনি এবং মনে করেছিলো আপনার চশমা জমাট পানি দিয়ে তৈরি? ওরা নিজেরাই জিনের মতো; অন্য মানুষ যেমন বই-কিতাব পড়ে তেমনি পড়ে ওরা বালুর উপর পথের রেখাসমূহ এবং পড়ে আকাশ আর হাওয়া থেকে ধূলি –ঝড়ের আগমনের কথা-ঝড় আসার বহু ঘন্টা আগেই। আর চাচা, আপনার কি মনে আছে রানিয়াতে আমরা যে গাইড ভাড়া করেছিলাম তার কথা –সেই শয়তান ‘বাদাভীর’ কথা-যাকে আপনি গুলি করে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, সে আমাদেরকে মরুভূমির মাঝখানে ফেলে চলে যেতে চেয়েছিলো বলে। আপনি যে যন্ত্রটি দিয়ে ছবি তোরেন তার বিরুদ্ধে সে কী ক্ষেপেই না গিয়েছিলো!’
আমরা দুজনেই আাদের বহু দূরে ফেলে আসা সেই এ্যাডভেঞ্চার হাসি। কিন্তু তখন আমাদের মোটেই হাসির মতো অবস্থা ছিলো না। আমরা ছিলাম রিয়াদের দক্ষিণে ছ-সাত দিনের পথ দূরে যখন সেই গাইড, আর রাইনের ‘ইখওয়ান’ বস্তির এক গৌড়া বেদুঈন, গোস্বায় ফেটে পড়েছিলো আমি তাকে ক্যামেরার উদ্দেশ্য বুঝিয়ে বলাতে। সে তখুনি এবং সেখানেই আমাদেরকে ফেলে চলে যাবার জন্য তৈরি হলো, কারণ এ ধরনের জাহেলী ছবি তোলায় তার রূহ বিপন্ন হয়ে পড়েছিলো। ওর হাত থেকে ছাড়া পেতে আমার মোটেই আপত্তি ছিলো না , যদি এ আশংকা না থাকতো যে আমরা তখন অমন একটি এলাকায় এসে পড়েছিলাম যার সাথে আমার বা জায়েদের কোনে পরিচয় ছিলো না –যেখানে আমাদের দুজনকে একলা ছেড়ে গেলে নিশ্চয় আমরা দিশাহারা হয়ে পড়তাম। পয়লা আমি আমাদের সেই ‘বেদুঈন শয়তান’কে বুঝাতে চাইলাম যুক্তি দিয়ে। কিন্তু কোনো ফায়দাই হলো না। ও কিছুতেই বুঝতে চাইবে না। বরং উটের রোক ও ফিরিয়ে দেয় রানিয়ার দিকে। আমি তখন ওকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলাম, আমাদের এভাবে তৃষ্ণায় প্রায় নিশ্চিত মৃত্যুর হাতে যদি ও রোখে যায় তাহলে সে জান নিয়ে কিছুতেই পালাতে পারবে না। এই হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও যখন ওর উট চালাতে শুরু কররো আমি তখন ওর দিকে আমার রাইফেল তাক করে তৈরি হলাম ওকে গুলি করতে –গুলি করার পুরা ইচ্ছাই ছিলো; এবং মনে হলো তাতেই শেষ পর্যন্ত আমাদের বন্ধুটি রূহ নিয়ে যতো ভাবনা –চিন্তা চাপা পড়ে গেলো। কিছুক্ষণ বিড়বিড় করার পর সে রাজি হলো, ওখান থেকে তিন দিনের রাস্তা পরবর্তী বস্তি পর্যন্ত আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে –যেখানে আমরা পারবো আমাদের বিতর্কিত বিষয়টিকে বিচারে জন্য কাজীর সামনে পেশ করতে। আমি আর জায়েদ মিলে ওর অস্ত্র কেড়ে নিলাম, তারপর পালাক্রমে পাহাড়া দিতে লাগলাম যাতে সে সরে পড়তে না পারে। কয়েক দিন পর আমরা যখন –কুবাইয়ার ‘কাজী’র নিকট বিচার প্রর্থনা করলাম তিনি প্রথমে রায় দিলেন আমাদের গাইডেরই পক্ষে। ‘কারণ’ (রসূলের একটি হাদীসের ভূল ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করে তিনি বললেন, ‘জীবিত প্রাণীর ছবি তোলা নিন্দনীয় কাজ’ কিন্ত জীবিত প্রাণীর ছবি তোলা নিষিদ্ধ –বর্তমান কাল পর্যন্ত বহু মুসলমানের মধ্যে প্রবল এই বিশ্বাস সত্ত্বেও, এ ব্যাপারে ইসলামী আইনে কোনো বিধান নেই। তখন আমি ‘দেশের সকল আমীর এবং যে কেউ এটা পড়বে’ তার জন্য লিখিত বাদশাহর খোলা চিঠি ‘কাজী’র সামনে মেলে ধরলাম –এবং পড়তে গিয়ে ‘কাজী’র মুখ ক্রমেই লম্বাটে হয়ে উঠতে লাগলো – ‘মুহম্মদ আসাদ আমার মেহমান, দোস্ত এবং আমার প্রিয়জন, যে কেউ তার প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করবে সে আমার প্রতিই তা করবে এবং যে কেউ তার প্রতি শত্রুতা করবে সে আমারই শত্রু বলে গন্য হবে,… ইবনে সউদের কথা এবং মোহর যাদুর মতো কাজ করলো কঠোর কাজীর উপর। শেষ পর্যন্ত তিনি এ রায় দিলেন যে, ‘কোনো কোনো অবস্থায়’ ছবি তোলা অনুমোদন করা যেতে পারে। … এই রায়ের পর আমরা আমাদের গাইডকে ছেড়ে দিলাম এবং আমাদেকে রিয়াদের দিকে নিয়ে যাবার জন্য নিযুক্ত করলাম নতুন গাইড।
-‘চাচা, রিয়াদের সেই দিনগুলির কথা মনে আছে কি, যখন আমরা ছিলাম বাদশাহর মেহমান এবং পুরানো শাহী আস্তাবাল ঝকঝকে মোটর গাড়িতে ভর্তি দেখে আপনি কতো মর্মাহত হয়েছিলেন!.. এবং আপনার প্রতি বাদশাহর মেহেরবানির কথা?’
-‘আর তোমার কি মনে পড়ছে জায়েদ, বাদশাহ কীভাবে আমাদের পাঠয়েছিলেন বেদুঈন বিদ্রোহের রহস্য উদঘাটন করতে এবং কীভাবে আমরা রাতের পর রাত সফর করে লুকিয়ে ঢুকেছিলাম কুয়েত –এ; শেষ পর্যন্ত জানতে পেরেছিলাম ঝকঝকে নতুন ‘রিয়াল’ এবং সমুদ্দুর পাড়ি দিয়ে যেসব অস্ত্রশস্ত্র বিদ্রোহীদের নিকট আসছিলো তার আসল রহস্য… .?’
-‘আর চাচা, আমাদের সেই মিশনের কথা যখন সৈয়দ আহমদ –আল্লাহ তাঁর হায়াত দারাজ করুন –আমাদেরকে পাঠিয়েছিলেন সাইরেনিকায় এবং কেমন করে আমরা গোপনে একটি ‘ধাও’ –এ করে সমুদ্দুর পার হয়ে ঢুকেছিলাম মিসরে এবং কীবাবে আমরা সেই ইতালীয়দের দৃষ্টি এড়িয়ে আল্লাহর লানত হোক ওদের উপরে প্রবেশ করেছিলাম জবল আখদারে এবং উমর আল –মুখতারের নেতৃত্বে যোগদান করেছিলাম, মুজাহিদিনের সংগে? কী উত্তেজনাপূর্ণই না ছিলো !
তারার আলোকে আলোকিত মরুভূমির রাতের নীরবতায় যখন এক নাজুক ঈষদুষ্ণ হাওয়ায় ছোটো ছোটো ঢেউ জাগে বালুতে –অতীত আর বর্তমানের ছবি একে আরেকের সাথে বারবার জড়িয়ে যায়, আবার আলাদা হয় পড়ে এবং স্মৃতিকে জিইয়ে তোলা এক বিস্ময়কর ধ্বনির সংগে একে অপর পেছন দিকে ডাকে, বহু বছর পেরিয়ে, আমার আরবীয় বছরগুলির শুরতে মক্কায় আমার পয়লা হজ্ব এবং যে আঁধার সেই শুরু দিনগুলিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো, তার প্রতিঃ সেই নারীর মৃত্যুর প্রতি যাকে আমি এমন ভালোবেসেছিলাম, যেমন আর কোন নারীকেই ভালোবাসিনি পরে, যে এখন শুয়ে আছে মক্কার মাটির নীচে, একটা সাদাসিধা পাথর রয়েছে তার শিয়রে যাতে কোন লেখা নেই, যা চিহ্নিত করছে তার পথের শেষ এবং আমার এক নতুন পথের শুরু, একটি শেষ এবং একটি শুরু, একটি ডাক এবং একটি প্রতিধ্বনি মক্কার শিলাময় উপত্যকায়, আশ্চর্য্জনকভাবে একে অপরের স্বপ্নের সাথে জড়িত!
-‘জায়েদ, আরো কিছু কফি হবে?’
-‘আপনার হুকুমের অপেক্ষায় চাচা!’ জায়েদ জবাব দেয়। সে ব্যস্ত সমস্ত না হয়ে দাঁড়িয়ে যায়, তার বাঁ হাতে লম্বা চিকন কফি পাত্র। তারপর মিনিট দু’এক, হাতলশূন্য পেয়ালা টুঙটু করে ওঠে তার ডান হাতে– একটি আমার জন্য আর একটি ওর নিজের জন্য-পয়লা পেয়ালাটিতে কিছু কফি ঢেলে সে আমার হাতে দিলো। লাল এবং সাদা চেক-‘কুফিয়া’র ছায়ার নিচে থেকে তার চোখ দুটি আমাকে নিরীক্ষণ করে গভীর মনোনিবেশের সাথে, যেন সামান্য কফির পেয়ালার চাইতে এভাবে শ্রদ্ধা প্রদর্শনই অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ! এই লম্বা লম্বা পশম শোভিত, গভীর, সংযত, শান্ত অবস্থায় করুণ অথচ অতি আনন্দে ঝলসে উঠতে সাদা উৎসুক দুটি চোখ বলছে স্তেপ অঞ্চলে মু্ক্তির মধ্যে শত পুরুষের জীবন কথাঃ এ চোখ এমন মানুষের চোখ যার পূর্ব পুরুষেরা শোষিত হয়নি কখনো এবং অন্যকেও শোষণ করেনি কোনোদিন। কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে ওর চলনের ভংগিগুলি, প্রাশান্ত, প্রতিটি ভংগির নিজস্ব ছন্দ সম্বন্ধে সচেতন, কখনো তাড়াহুা নেই –দ্বিধাগ্রস্থ নয় কখনোঃ এমন নিখুঁত এবং বাহুল্য বর্জিত যে, আপনাকে তা একটা সুসমন্বিত অর্কেষ্টার ঐকতানের মধ্যে বিভিন্ন যন্ত্রের পারস্পরিকক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কথা মনে করিয়ে দেবে। বেদুঈনদের মধ্যে আপনি প্রায় দেখতে পাবেন এ ধরনের চলনভংগি মরুভূমির বাহুল্যহীনতা ওদের মধ্যে প্রতিফলিত। কারণ অল্প কটি শহর এবং গ্রাম বাদ দিলে, আরব দেশের মানুষের জীবন মানুষের হাতে এতো সামান্য্য আকৃতি পেয়েছে যে, প্রকৃতি তার কঠোর নিয়মকে মানুষকে বাধ্য করেছে আচার –আচরণে সকল প্রকার বিক্ষিপ্ততাকে বর্জন করতে এবং তার নিজের ইচ্ছা অথবা প্রয়োজনে করা সকল কাজকে রূপান্তরিত করতে স্বল্প কটি অতি নির্দিষ্ট, মৌলিক রূপে –যা অসংখ্য পুরুষ দরে একই রয়ে গেছে এবং কালক্রমে অর্জন করেছে স্পটিকের মসৃণ স্পষ্টতা। আর উত্তরাধিকারসূত্রে অর্জিত এই সরলতাই এখন আমরা দেখতে পাই খাঁটি আরবের অংগভংগিতে যেমন, তেমনি জীবনে প্রতি তার মনোভঅবে।
-‘জায়েদ, তুমি আমাকে বলো, কাল আমরা কোথায় যাচ্ছি!’
জায়েদ স্মিত হাসির সাথে আমার দিকে তাকায় –‘কেন চাচা, আমরা তো তায়েমার দিকেই যাচ্ছি.. . ?’
-‘না ভায়া, আমি অবশ্যি চেয়েছিলাম তায়েমা যেতে! কিন্তু এখন আর আমি তা চাইছি না। আমরা যাচ্ছি মক্কা .. .’