পারস্যের চিঠি
এক
এখন বিকাল। মদীনার দক্ষিণ দাখিল দরোজার ঠিক বাএর আমি বসে আছি আমার এক বন্ধুর সাথে তার পা’ম বাগিচায়। বাগিচার অগণিত পা’ম গাছের কাণ্ড বাগিচার পশ্চাদভূমিতে সৃষ্টি করেছে এক ধূসর সবুজ আলে – আঁধারী, যার ফলে মনে হয়, এর যেনো কোনো শেষ নেই। গাছগুলি এখনো তরুণ এবং নীচু; সূর্যের আলো নৃত্য করছে ওদের কাণ্ডের উপরে ওপরে এবং ওদের শাখঅর পরস্পর জড়াজড়ি করে সৃষ্টি করা সূক্ষ্ণাগ গম্বুজের উপরে। বছরে এই সময়টাতে প্রায় রোজই যে ধুলিঝড় হয় তার ফলে বাগিচার পাম গাছগুলির সবুজ রং কিছুটা ধুলট। কেবল পাম গাছের নীচে লুসার্নের পুরা গালিচাই বজায় রেখেছে তার উজ্জ্বল নিখুত সবুজ রং।
আমার সামনেই –খুবু বেশি দূরে নয় –ভেসে উঠছে নগরীর দেয়ালগুলি, পুরান, ধূসর শিলা এবং মাটির ইট দিয়ে তৈরি–এখানে –ওখানে দুর্গ –প্রাচীর ঠেলে বা’র হয়ে পড়েছে নগর প্রাচীর থেকে। দেয়ালের পেছন থেকে মাথা উঁচু করে উঠেঠে নগরীর ভেতরে, আরেকটি বাগিচার দ্রুত বেড়ে ওঠা পাম গাছ–এবং ঘর–বাড়ি, যার দরোজা জানালার খড়গুলি রোদে পুড়ে বাদামী হয়ে গেছে, এবং ঘেরা দেওয়া ব্যালকনিগুলি; এর কোনো কোনোটি নগর প্রাচীরের মধ্যেই নির্মিত হয়ে সেগুলি হয়ে উঠেছে প্রাচীরের অংশ। কিছু দূরে আমি দেখতে পাই, সে মসজিদে নববীর পাঁচটি মীনার, উঁচু এবং বাঁশির সুরের মতোই নাজুক, দেকতে পাই, সেই মহৎ সবুজ গম্বজুটি যা রসূলুল্লাহর ছোট্ট ঘরটির উপর একটি ছাদের মতো অবস্থান করে ঘরটিকে লুকিয়ে রেকেছে, যে–ঘর ছিলো তাঁর জীবৎকালে তাঁর আবাসগৃহ এবং তাঁর ওফাতের পর যা হয়েচে তাঁর কবর; আরো দূরে নগরী ছাড়িয়ে চোকের সামনে ভেসে ওঠে অনাবৃত শিলাময় পর্বতমালা ওহুদঃ যেনো মসজিদে নববীর সাদা মীনার, পাম বৃক্ষের মাথঅ এবং শহরের বহু ঘর–বাড়ির পটভূমিতে ঝুলানো তামাটে–লাল রংয়ের চিত্রিত পর্দা।
বিকালের রোদ ঝলসানো আলোকে আলোকিত আসমান দুধের মতো সাদা উজ্জ্বল ঝরমল মেঘপুঞ্জের উপর ঝুলে আছে, কাঁচের মতো স্বচ্ছ সে আকাশ, আর নগরিটি যেনে গোসল করে উঠেছে এক নীল সোনালী–সবুজ আভা মেশানো আলোতে। মোলায়েম মেঘের চারপাশে খেলা করছে বাতাস অনেক উঁচুতে, যে বাতাস আরব দেশে কী ছলনাময় বলেই না প্রমাণিত হয়ে থাকে! এখানে কখনো আপনি বলতে পারবেন না, ‘এখন আকাশ মেঘলা , বৃষ্টি হবে শিগগিরিই’। কারণ মেঘ যখন পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠে, ঝ্ঞ্ঝা–গর্ভ এই মেঘ, ঠিক সে সময় প্রাই এরূপ ঘটে যে, হঠাৎ মরুভূমি থেকে ছুটে আসে বায়ূর এক গর্জন এবং ঘন মেঘকে তা তাড়িয়ে নিয়ে একেবারে সাফ করে; আর যেসব লোক ছিল বৃষ্টির ইন্তেজারিতে তারা তাদের মুখ নীরব আত্মসমর্পণে ঘুরিায় নেয় আকাশ থেকে এবং গুনগুন করতে থকে ‘আল্লাহ ছাড়া কারো হাতে নেই কোনো ক্ষমতা, কোনো শক্তি’ – যখন আকাশ আবার নতুন কর নির্দয়ভাবে ঝলসাতে থাকে হারকা নীল স্বচ্ছতায়।
আমি আমার দেস্তকে বিদায় সম্ভাষণ জানাই এবং নগরীর বাইরে প্রবেশদ্বারের দিকে আবার হাঁটতে শুরু করি। আমার পাশ দিয়ে চলে যায় একটি লোক, লুর্সান ঘাসের বোঝা চাপানো দুটি গাধা হাঁকিয়ে এবং নিজে তৃতীয় আরেকটি গাধায় চড়ে। সে সালাম জানাবার জন্য তার হাতের ছড়িটি উচ্চে তুলে ধরে এবং বলে, আসসালামু আলাইকুম। আমিও তাকে এই কথাগুলি দিয়ে জবাব দিই। এরপর আসে এক বেদুঈন তরুণী, তার পরণের কালো জোব্বার প্রান্তদেশ তার পেছনে পেছনে গড়াচ্ছে, তার মুখের নিম্মভাগ নেকাব দিয়ে ঢাকা। তার জ্বলজ্বল চোখ দুটি এতোই কালো যে, তার চোখের সাদা অংশ এবং কালো পুতুল মিশে গেছে এক সাাষে; আর তার চলার ভংগীটি স্তেপ অঞ্চরে তরুণ প্রাণীর দোদুল্যমান গতির মতোই দ্বিধাগ্রস্ত!
আমি নগরীতে প্রবেশ করি এবং আল–মানখার উন্মুক্ত বিশাল চক অতিক্রম করে পৌছুই ভেতরে নগর প্রাচীরে, মিসরীয় প্রবেম দ্বারের ভারী তোরণের নীচে, যেখানে মুদ্রা ব্যবসায়ীরা বসে তাদের সোনা এবং রূপার মুদ্রাগুলি ঝনঝন করে বাজাচ্ছে। আমি ঢুকে পড়ি প্রধান বাজারটিতে, যা বড় জোর চব্বিশ ফিট চওড়া একটি রাস্তা, দোকানপাটে ঠাসা–ঠাসি, যাকে ঘিরে স্পন্দিত হচ্ছে একটি ক্ষুদ্র অথচ আবেগাষ্ণ জীবন।
বিক্রেতার উৎফুল্ল; গানের মাধ্যমে তাদের জিনিসপত্রের তারিক করছে। চমৎকার মাথার পাগড়ী, সিল্কের শাল এবং চিত্রিত কাশ্মীরী চাদর পথচারীর দৃষ্টি আক র্ষণ করে। রৌপ্যকারেরা হামাগুড়ি দিয়ে বসেছে বেদুঈন–গহনাপতিতে ভর্তি কাঁচের বাক্সের পেছনে –বাজুবন্দ এবং পায়ে খাড়ু, গলার হার এবং কানের দুল–সেইসব গহনা। খোশবু বিক্রেতারা দেখাচ্ছে ওদের মেহেদী ভর্তি পাত্র, চোখের লোম রাঙানোর জন্য সুরমা ভর্তি ছোট ছোট লাল প্যাকেট, তেল এবং সুগন্ধির বহু –বর্ণ শিশি এবং মসলা –স্তূপ। নযদের সওদাগরেরা বিক্রি করছে বেদুঈন কাপড় চোপড়, পূব– আরবের উটের জীন এবং জীন থেকে ঝোলানো রেশমের লম্বা ঝালরওয়ালা ব্যাগ। এক নীলামদার রাস্তায়, স্বর যতেদূর সম্ভব উচ্চে তুলে চীৎকার করতে করতে ছুটছে – তার কাঁধের উপর একটি পারস্য গালিচা এবং উটের পশমের ‘আবায়া’ আর বগলের নীচে একটি পিতলের স্যামোভার নিয়ে। উভয়দিকে চরেছে মানুষেল ঢল, মদীনার লোক এবং আরবে অন্যান্য অঞ্চলের রোক, সেনিগালের স্তেপ –অঞ্চল আর কিরগিজের স্তেপ–অঞ্চলে মধ্যকার সকল দেশের লোক, ইস্ট–ইন্ডিজ ও আটলান্টিক মহাসাগরের এবং অস্ত্রখান ও জাঞ্জিবারের মধ্যবর্তী সব দেশের মানুষঃ কারণ হজ্জ মাত্র কিছুদিন আগেই শেষ হয়েছে। কিন্তু মানুষের এতো ভিড় সত্তেও এবং রাস্ত এতো সংকীর্ণ হলেও এখানে কোনো আতি ব্যস্ততার মাতলামি নেই, কেউ কাউকে একানে ধাক্কা দেয় না, কারে গায়ের উপর এসে পড়ে না, কারণ মদীনায় কোন কিছুকে ধরা বা পাওয়ার জন্য সময় পাখা মেলে না!
কিন্তু এর চাইতেও যা বিস্ময়কর মনে হয় তা এই যে, এখানে ভিড় করা মানুষের চেহারা আর আকৃতিতে এবং তাদের পোশাক–পরিচ্ছদে এতো বৈচিত্র ও ভিন্নতা সত্তেও মদীনার রাস্তায় বিদেশী কিছুর ‘জগা–খিচুড়ি’ ঘটেছে বরে মনে হয় না। যার বিশ্লেষণ করতে চায় কেবর তাদের চোখেই ধরা পড়বে চেহারার এই বৈচিত্র। আমার মনে হয়, এই নগরীতে যারা বাস করে তারা সকলেই, এমনকি আস্থায়ী ভাবে কিছু দিনের জন্য যারা এখানে আসে, বলা যায়, তারাওঅচিরেই হারিয়ে যায় একটা সাধারণ মন–মেজাজের মধ্যে, আর এভাবেইতাদের চাল–চল, এমনকি তাদের মুখের অভিব্যক্তি পর্যন্ত এক হয়ে ওঠেঃ কারণ তাদের সকলেই পড়ে গেছে মহানবী অনিবার্য প্রভাবে–একদা এই নগরী ছিলো যাঁর এবং এখন ওরা মেহমান যাঁর.. .
১৩০০ বছর পরেও আত্মিক উপস্থিতি এখানে তেমনি জীবন্ত যেমন ছিলো তখন। কেবলমাত্র তাঁরই উসিলায় কতকগুলি বিচ্ছিন্ন ইতস্তত বিক্ষপ্ত পল্লী, যাকে বলা হতো ইয়াসরেব হয়ে ওঠে একটি নগরী এবং আজ পর্যন্ত তা সকল মুসলমানের এতো গভীর ভালোবাসা পেয়ে এসেছে যেমনটি পৃতিবীর আর কোনো দেশের কোন নগরীকে ভালোবাসেনি মানুষ। এই নগরীর নিজের একটা নাম পর্যন্ত নেই, তেরো শো বছরেরও অধিককাল ধরে একেক ‘মদীনাতুন্নবী’ –‘নবীর শহর’ বলা হচ্ছে। তেরো শো’ বছরেরও অধিককার ধরে এখানে এতো প্রেম এতো অনুরাগ এসে মিলিত হয়েচে যে, সকল আকার–আকৃতি এবং গতিবিধি লাভ করেছে একটা পারিবারিক সাদৃশ্য এবং চেহারার সকল পার্থক্য রূপান্তরিত হয়েচে একটি সাধারণ, সাদৃশ্যে, বিভিন্ন সুরের মিলিত ঐকতানের মতো।
এই সেই আনন্দ–সামঞ্জস্য সৃষ্টি করার এই ঐকতান, মানুষ যা এখানে উপলব্ধি করে প্রতি মুহূর্তে। যদিও রসূলুল্লাহ (সা) যা চেয়েছিলেন তার সাথে মদীনার আজকের জীবনের কেবল একিট আনুষ্ঠানিক এভং সুদুর সম্পর্কই রয়েছে, যদিও মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য আরো অঞ্চলের মতোই এখানে ইসলামের রূহানী চেতনাকে সস্তা করে ফেলা হয়েছে তবু এর মহান আত্মিক অতীতের সাথে একিট অনির্বচনীয় আবেগময় সম্পর্ক সবসময়ই জীবন্ত রয়েছে। । কেবল একটি মানুষের জন্য কোন নগরীকেই মানুষ কখনো এতো ভালোবাসেনি; কোন মানুষকেই, যিনি ইন্তেকাল করেছেন তেরো শো বছর আগে, যিনি সমাহিত আছেন এই মহান সবুজ গম্বজের নীচে, তাঁর মতো এতো আপন মনে করে এবং এতো বিপুর সংখ্যায় মানুষ ভালোবাসেনি কখনো।
অথচ তিনি কখনো দাবি করেননি তিনি মরণশীল মানুষ ছাড় অন্য কিছু এবং কখনো মুসলমানেরা তাঁর প্রতি আরোপ করেননি দেবত্ব যা করেছে অন্যান্য নবীর বহু–অনুসারী, সেইসব নবীদের মৃত্যুর পরে। বলাবাহুল্য, খোদ কুরআনেই রয়েছে বহু উক্তি, যাতে জোর দেয়া হয়েছে মুহাম্মদের মানবিকতার উপরঃ ‘মুহাম্মদ নবী ছাড়া আর কিছু নন। তাঁর আগে অতীত হয়েছেন সকল নবী; তিনি যদি মারা যান বা নিহত হন তোমরা কি পশ্চাদপসরণ করবে?’ আল্লাহর বিরাটত্বের সামনে তাঁর একান্ত দীনতা কুরআনে ঘোষিত হয়েচে এভাবেঃ ‘বল, হে মুহাম্মদ, তোমাদের মন্দ কিংবা ভালো করার কোন ক্ষমতা নেই, এমনকি আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা ছাড়া আামার ক্ষমতা নেই আমার নিজের ভালোমন্দের উপরও। আমি যদি অদৃশ্যের খবরই জানতাম আমি তো লাভ করতাম প্রভুত কল্যাণ আর কোনো অমংগলই স্পর্শ করতে পারতো না আমাকে। আমি তো বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য কেবল সতর্ককারী এবং সু সংবাদ দাতা.. ..।’
তিনি যে কেবল মানুষই ছিলেন, তিনি যে জীবন-যাপন করেছেন অন্য মানুষের মতো এবং তা করতে গিয়ে মানব –জীবনের আনন্দ উপভোগ এবং দুঃখ –কষ্টের স্বাদ গ্রহণ করেছেন, কেবল এ কারণেই তাঁর চারপাশে যাঁরা ছিলেন তাঁরা এতো প্রীতি ভালোবাসা দিায়ে এমনভঅবে তাঁকে ঘিরে রাখতে পেরেছিলেন।
এই প্রেম তাঁর মৃত্যুর পরও বেঁচে আছে এবং তাঁ অনুসারীদের হৃদয়ে তা আজো জাগ্রত রয়েছে বহু সুরের সম্মিলনে সৃষ্ট একটা ‘রাগিনীর’ মূল প্রেরণার মতো। এই প্রেম মদীনায় এখনো জীবন্ত রয়েছে। পুরানো নগরীর প্রত্যেকটি শিলা থেকে এ প্রেম কথা বলবে আপনার সংগে। আপনি আপনার হাত দিয়ে একেপ্রায় স্পর্শ করতে পারবেন, কিন্তু শব্দে একেবন্দী করতে পারবেন না.. ..।
দুই
আমি যখন মহান মসজিদ অভিমুখে বাজারের মধ্য দিয়ে চলছি, তখন আমার অনেকদিনের পরিচিত অনেকে পথ চলতে চলতে আমাকে অভিনন্দন জানায়। আমি কখনো এই দোকানীর প্রতি, কখনো বা ঐ দোকানীর প্রতি কিছুটা মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানাই। শেষ পর্যন্ত আমার বন্ধু আয- যুগাইবি আমাকে টেনে টেনে নিয়ে হাজির করলে সেই ছোট্ট প্লাটফরমটির উপর যেখানে বসে বেদুঈনদের কাছে কাপড় বিক্রি করেন।
-‘তুমি কখন ফিরছো মুহাম্মদ, আর কোত্থেকেই বা ফিরছো? তুমি এখানে ছিলে, সে তো কয়েক মাস আগের কথা!’
-‘আমি আসছি হাইল থেকে- আসছি নুফুদ থেকে।’
-‘তুমি কি কিছুদিন থাকবে না ঘরে?’
-‘না ভায়া, আমি পরশুই মক্কা রওয়ানা করছি।’
আয –যুগাইবী রাস্তার ওপারে কফির দোকানে যে ছেলেটি কাজ করে তাকে চীৎকার করে ডাকেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা শুনতে পাই ছোটো ছোটো পেয়ালার টুংটাং শব্দ।
-‘কিন্তু কেন মুহাম্মদ, এই মুহূর্তে তুমি মক্কা যাচ্ছো কেন? হজ্জে’র মৌসুম তো চলে গেছে… ’
-‘হজ্জ করার বাসনায় আমি মক্কা যাচ্ছি না। ভালো কথা, আমি কি পাঁচ-পাঁচবার হজ্জ করিনি? কিন্তু কেন যেনো আমার মনে হচ্ছে, আরব দেশে আমি আর বেশি দিন থাকবো না। তাই আবার সে নগরটি একবার দেখতে চাই, যেখানে আামর এদেশের জীবনের শুরু হয়েছিলো.. . ‘তারপর সশব্দ হাসির সংগে আমি যোগ করি ‘কিন্ত ভাই, তোমকে আমি সত্য কথা বললো আসলে আমি নিজেই জানি না কেন আমি মক্কা যাচ্ছি; কিন্তু আমি জানি আমাকে যেতে হবে.. .’
আয –যুগাইবী নৈরাশ্যে তাঁর মাথা নাড়েন-‘এদেশ ছেড়ে এবং তোমার ভাইদের ছেড়ে চলে যাবে, এমন কথা তুমি কী করে বলতে পারলে?’
একটি পরিচিতি লোক দীর্ঘ স্ত্রস্ত পদক্ষেপে আমার পাশ কেটে আগিয়ে যায়-লোকটি জায়েদ, কাউকে খোঁজ করছে নিশ্চয়।
-‘জায়েদ, কোথঅয় যাচ্ছে?’
সে হঠাৎ তার গতি থামিয়ে উৎসুক মুখে আমার দিকে তাকায়-‘আপনাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছি চাচা, আপনার জন্য এক তাড়া চিঠি জমা ছিলো ডাকঘরে। এই নিন চিঠিগুলি । আর শায়ক আয –যুগাইবী, আসসালামুআলাইকু –আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।’
আয – যুগাইবীর দোকানের সামনে পায়ের উপর পা রেখে বসে খামগুলি ছিড়ে পড়তে থাকিঃ মক্কার বন্ধুদের কাছ থকে এসেছে কয়েকটি চিঠিঃ একটি চিঠি লিখেছেন সুইজারল্যান্ডের ‘নিউ শারখার সুইটুঙে’র সম্পাদক, আমি যে পত্রিকার সংবাদদাতা গত ছয় বছর ধরে। একটি চিঠি এসেছে ভারত থেকে, যাতে আমাকে তাগিদ দেয়া হয়েছে ওখানে গিয়ে পৃথিবীর একক বৃহত্তম মুসলিম সম্প্রদায়ের সংগে পচিয় করতে। কয়েকটা চিঠি লেখা হয়েছে নিকট প্রাচ্যের বিভিন্র অঞ্চল থেকে। আর একটি চিঠির উপর রয়েছে তেহরানের ডাকঘরের ছাপ। চিঠিটা লিখেছেন আমার পরম বন্ধ আলী আগা, যাঁর কাছ থেকে এক বছরেরও বেশি হলো আমি কোনো খবর পাইনি। আমি সেটি খুলে আলী আগার সুন্দর পরিপাটি শিকস্তা ১[শাব্দিক অর্থে ভাঙা-আরবী হরফের একটি পারস্য রূপ, যা দ্রুত লিখনের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।]হরলে লেখা পৃষ্ঠাগুলি উপর চোখ বুলিয়ে যাইঃ
আমার প্রিয়তম বন্ধ এবং ভাই , আমার হৃদয়ের জ্যোতি, পরম শ্রদ্ধার পাত্র আসাদ আগার প্রতি, আল্লাহ তাঁর হায়াত দারাজ করুন এবং প্রতি পদে তাঁর নিগাবান হোন। আমীন!
আস –সালামু আলাকুম, আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক, বর্ষিত হোক আল্লাহর রহমত, হরদম – সবসময়। আল্লাহর কাছে মুনাজাত করি, তিনি যেনো আপনাদে দেন স্বাস্থ্য ও সুখ, আর এ কথাও যখন জানি যে, আপনি খুশী হবেন, আমিও পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য ভোগ করছি, তাই প্রশাংসা আল্লাহর।
আমি আপনাকে দীর্ঘকাল চিঠিপত্র লিখিনি। কারণ গত কয়েখ মাস ধরে আমার জীবন আগিয়োছে এলোমেলো, বিশৃংখলভাবে। আমার পিতা, আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন, এক বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন এবং আমি যেহেতু তাঁর ছেলেদের মধ্যে সকলের বড় সেজন্য আামদের পারিবারিক ব্যাপার –বিষয়াদি গুছাতে গিয়ে আমাকে অনেক সময় দিতে হয়েছে েএবং দুচিন্ত পোহাতে হয়েছে। আর এ আল্লাহরই মর্জি, তাঁর এ অযোগ্য বান্দার জীবনে এসেছে অপ্রত্যাশিত সমৃদ্ধি, কারণ গভর্নমেন্ট তাঁকে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল পদে উন্নীত করোছেন। তদুপরি, আমি আশা করছি শীঘ্রই আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবো –এক লাবণ্যময়ী সুন্দরী মহিলা আমার চাচাতো বোন শিরির সংগে; আর এভাবে আমার পুরানো অব্যবস্থিত দিনগুলির সমাপ্তি আসছে ঘনিয়ে। আপনার বন্ধসুলভ হৃদয়ের কাছে এ তো খুবই জানা কথা যে , অতীতে আমি গোনাহ খাত এবং ভুলক্রটির উর্ধ্বে ছিলাম না, কিন্তু হাফিজ কি বলেননিঃ
‘হে আল্লাহ, মধ্য সাগরে তুমি নিক্ষেপ করেছে একটি তক্তা, তুমি কি আশা করতে পারো তক্তাটি শুকনা থাকুক?’
কাজেই প্রবীণ আলী আগা শেষ পর্যন্ত ঘর বাঁধতে এবং শ্রদ্ধার পাত্র হতে যাচ্ছেন। তিনি অতোটা শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন না যখন বাম নামক শহরে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাত হয়, সাত বছরে কিচু আগে। আলী আগাকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিলে এই শহরটিতে। তাঁর বয়স ছিলো তখন মাত্র ছাব্বিশ বছর। তবু তাঁর অতীত দিনগুলি ছিলো চাঞ্চল্য ও কর্মতৎ পরতায় ভরপুর। রিজা খান ক্ষমতা দখল করার আগে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তেহরানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ সম্ভব ছলো তাঁর জন্য যদি না তিনি অতিমাত্রায় আমোদ –ফূর্তির মধ্যে নিজেকে ভাসিয়ে দিতেন। তাঁকে তাঁর উদ্বিগ্ন এবং প্রভাবশালী পিতা ইরানের দক্ষিণ –পূর্বতম এই অঞ্চলের যোগাযোগবিহীন বাম শহরে এই আশায় এনেছিলেন যে, তেহরানের আমোদ –ফুর্তি থেকে তাঁকে দরে সরিয়ে ফেললে তিনি শুধরে যেতে পারেন। কিন্তু বামে এসে আলী আগা নারী, শরাব আর আফিঙের মিঠা বিষের মধ্যে তার ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলে বলে মনে হয়। বলাবাহুল্য এ সবের প্রতি নিদারণ আসক্তি ছিলো আলী আগার।
১৯২৫ সালের এই সময়ে আলী আগা ছিলেন জেলা সামরিক পুলিশের একজন কমান্ডার। তাঁর মর্যাদা ছিলো একজন লেফটেন্যান্টের । আমি যখন বিলাল দশত-ই-লুত মরুভূমি পার হতে যাচ্ছি তখন আমি কিরমান প্রদেশের গভর্নরের প্রতি একটি পরিচয় –পত্র নিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাত করি। ঐ পরিচয় –পত্রটি লিখিত হয়েছিলো প্রধানমন্ত্রী এবং ডিকটেটর রিজা খানে একটি চিঠিকে ভিত্তি করে। আমি তাঁকে পাই কমলারেবু, আলিয়েন্ডারও পাম গাছের এক ছায়াময় বাগিচায়, যেখানে ধারালো পাম পাতার তোরণের ফাঁকে ফাঁকে এসে পড়ছিলো সূর্যের রশ্নি। তাঁর পরণে ছিলো লম্বা হাতওয়ালা শা্র্ট। লনের উপর ছিলো একটি গালিচা বিছানো আর সে গালিচার উপর ছিলো লম্বা হাতাওয়ালা শার্ট। লনের উপর ছিলো একটি গালিচা বিছানো আর সে গালিচার উপর চিলো বর্তন আর অর্ধেক শূন্য হওয়া আরকের বোতল। বর্তনগুলতে খাদ্যবিশেষ ছিলো তখনো। আলী আগা বিনীতভাবে কৈফিয়ত দেন – ‘এই অভিশপ্ত গর্তের মধ্যে শরাব খাওয়া সম্ভব নয়’ এবং তারপর তিনি আমাকে বাধ্য করেন স্থানীয় আরক পান করতে; এ এমনি এক কড়া জিনিস যে, আমার মগজে গিয়ে পৌছুলো একটা ঘুষির মতো। পারস্যের উত্তর অঞ্চলের একজন মানুষের সন্তরণশীল চোখ দিয়ে কিরমানের চিঠিটির উপর তিনি দৃষ্টি বুলিয়ে যান; তারপর সেটিকে টোকা দিয়ে একদিকে রেখে বলেন, আপনি যদি কোন পরিচয় পত্র ছাড়াই আসতেন তবু আমি দশটি লোকের ভেতর দিয়ে আপনার এই সফরে অবশ্যই আপনার সংগী হতাম। আপনি আমার মেহমান। আমি কখনো আপনাকে বালুচী মরুভূমির ভেতর দিয়ে একা সওয়ারী হাঁকিয়ে যেতে দিতাম না।
কোনো এক যুবতী তখনো একটি গাছের ছায়ায় নিজেকে লুকিয়ে বসেছিলো। ধীরে ধীরে সে উঠে দাঁড়ালে- পরণে তার হাঁটু পর্যন্ত লম্বা হালকা আসমানী –রং সিল্কের কোর্তা এবং প্রকাণ্ড সাদা বালুচী সালোয়ার। মুখটা ওর ইন্দ্রিয়জ বাসনার প্রতীক , মনে হয় যেনো ভেতর থেকে তা জ্বলছে, স্পষ্ট ঠোঁটগুলি লাল এবং সুন্দর , তবে চোখ দুটি বিস্ময়করভাবে ঘোলাটে এবং উদাসীন, চোখের পাতা সুরমা দিয়ে রঞ্জিত।
-মেয়েটি অন্ধ, আলী আগা ফরাসী ভাষায় ফিসফিস করে আামকে বলেন, ‘কিন্তু ও গান গায় অদ্ভুত , চমৎকার!’
আলী আগা যে মহৎ নম্রতা ও শ্রদ্ধর সাথে মেয়েটির প্রতি ব্যবহার করলেন আমি তার প্রশংসা না করে পারি না। মেয়েচি একটি পেশাদার গায়িকা, ইরানের মেয়েদের এমন একটি শ্রেণীতে সে পড়ে যা কম –বেশি বারাঙনাদেরই সমান।অথচ তেহরানের কোনো সম্ভ্রান্ত মহিলার প্রতিও এর চেয়ে উত্তম ব্যবহার তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলো না।
আমরা তিনজনই গালিচার উপর বসে পড়ি এবং আলী আগা যাখন তা৭র কলকে এবং আফিঙের পাইপ টানতে ব্যস্ত তখন আমি বলুচী মেয়েটির সংগে কথা বলি। মেয়েচি তার অন্দতা সত্ত্বেও এমনভাবে হাসতে পারে যা কেবল তারাই পারে যারা বাস করে হৃদযের আনন্দের গভীরে এবং কথার ফাঁকে ফাঁকে সে এমন চাতুর্য এবং বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্য করে চললো যাতে এই বিশাল পৃথিবীর কোনো সম্ভ্রান্ত মহিলার লজ্জিত হবার কোনো অবকাশ নেই। আলী আগা তাঁর পাই শেষ করে আলতো করে ওর হাত নিজের হাতে নিয়ে বলেন, ‘এই যে বিদেশী এখানে রয়েছেন, ইনি হচ্ছেন একজন অস্ট্রীয়। ইনি নিশ্চয়ই তোমার একটি গান শুনতে পছন্দ করবেন। ই এখন পর্যন্ত কখনো বলুচীদের গান শোনেননি।
সে দৃষ্টিহীন মুকের উপর ছিলো একটি সুদূর স্বপ্নিল মুকের ছাপ, যখন সে আলী আগার দেয়া বাঁশীটি নিয়ে তার তারে আঙুল বুলাতে লাগলো। সে গভীর ভাঙা স্বরে গাইলো একটি বালুচী গান, যার তার আবেোগষ্ণ ঠোঁট থেকে যেনো জীবনেরই একটি প্রতিধ্বনির মতো সুরেলা হয়ে উঠেছে বলে মনে হলো।
আমি চিঠির কথায় ফিরে যাচ্ছিঃ
ভাই এবং সম্মান্তি বন্ধু, আমি জানি না আপনার এখনো স্মরণ আছে কিনা, কিভাবে আমরা দু’জন এক সাথে সেই পুরানো দিনগুলিতে সফর করেছিলাম দশত-ই-লুতের মধ্য দিয়ে এবং কিভাবে আমাদেরকে বাঁচানোর জন্য লড়তে হয়েছিলো সেই বালুচী দস্যুদের সাথে.. .?
আমার কি মনে আছে, আলী আগার এই অপ্রাসাংগিক প্রশ্নে আমি মনে মনে হাসি এবং আমাকে ও আলী আগাকে দেখতে পাই সেই নগ্ন মরুভূমির জনশূন্য দশত-ই-লুত, যা তার বিশাল শূণ্যতাকে ছড়িয়ে রেখেছে বালুচীস্তানথেকে অনেক গভীরে, ইরানের একেবারে মাঝামাঝি পর্যন্ত। ইরানের পূর্বতম প্রদেশ সিসতান হয়ে সেখান থেকে আফগানিস্তান যাওয়ার জন্য আমি এই মরুভুমি পাড়ি দেবার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। যেহেতু আমি আসছিলাম কিরমান তেকে, এ ছাড়া অন্য কোন পথ ছিলো না আমার জন্য। উট ভাড়া করা এবং আমাদের সামনে যে দীর্ঘ পথ রয়েচে সে পথের জন্য খাবার কেনার উদ্দেশ্যে মরুভূমির কিনারে একটি সবুজ মরূদ্যানে আমরা থাকি, আমাদের সাথে এক প্রদর্শক হিসাবে যে বালুচী পুলিচেরা রয়েছে তাদের নিয়ে। ইন্দো-ইউরোপীয় টেলিগ্রাফের ষ্টেশন ঘর হলো আমাদের অস্থায়ী হেড কোয়ার্টার । লম্বা মোটা হাড্ডিওয়ালা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন ষ্টেশন মাষ্টারটি মুহূর্তের জন্য আমাকে তার দৃষ্টির বাইরে যেতে দিতের রাজী নয়। মনে হলো সে তার দৃষ্টি নিযে আমার অবস্থা সম্পর্কে একটা ধারণা করাবার চেষ্টা করছে।
-‘এর সম্পর্কে হুঁশিয়ার খাকবেন’, আলী আগা আমাকে কানে কানে বলেন, ‘এ একটি ডাকাত, আমি একে চিনি। আর ও জানে যে, আমি ওকে চিনি। কয়েক বছর আগে এ ছিলো একটি সত্যিকার দস্যু। কিন্তু এখন সে অনেক টাকা –কড়ি করেছে এবং মানী হয়ে উঠেছে। এখন সে তার সাবেক সংগীদের অস্ত্রসশ্ত্র সরবরাহ করে আরো অনেরক বেশি টাকা-পয়সা রোজগার করছে। আমি ওকে হাতে-নাতে ধরবার জন্য একিট সুযোগের অপেক্ষায় আছি; কিন্তু লোকটি ধূর্ত এবং কোনো কিছু প্রমাণ করা সত্যি কঠিন। আপনি অষ্ট্রিয়ার লোক, একথা শুনে সে ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে উটেছে। বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্ট্রিয়া এবং জার্মানীর কিছু এজেন্ট এই অঞ্চলের গোত্রগুলিকে বৃটিশের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে চেয়েছিলো। তাদের সংগে ছিলো সোনার মোহরের থলে; আর আমাদের এই বন্ধুটি মনে করে-প্রত্যেক জার্মান এবং অস্ট্রিয়ানই একইভাবে সজ্জিত।
কিন্তু ষ্টেশন মাষ্টারের চাতুর্যে আমরা উপকৃত হই; কারণ সে আমার জন্য ওই এলাকার সবচেয়ে ভাল সরওয়ারী উটের দুটি যোগাড় করতে সক্ষম হয়েছিলো। দিনের বাকী অংশটি কাটলো মশক, উটরে পশমের দড়ি, চাউল, বিশুদ্ধ মাখন এবং মরু-সফরের জন্য প্রয়োজনীয় আরা নানা জিনিসের জন্য দর-কষাকষিতে।
পরদিন বিকাল বেলা আমরা যাত্র শুরু করি। আলী আগা স্থির করলেন, তিনি চারটি পুলিশসহ আমাদের আগে আগে গিয়ে রাত্রে তাঁবু গাড়ার জন্য একটি স্থান প্রস্তুত করবেন। তাঁদের উটগুলি লম্বিত রেখা দেখতে না দেখতে মিলিয়ে যায় দিগন্তের আড়ারে। আমরা-ইবরাহীম, আমি এবং পঞ্চম পুলিমটি-ওদের অনুসরণ করি অপেক্ষাকৃত মন্থর গতিতে।
আমরা হেলতে দুলতে থাকি, ( তখন তা কতো নতুনই না মনে হয়েছিলো আমার কাছে) হালকা-পাতলা উটগুলির হেরে –দুলে অদ্ভুদ কদমতালে চলার সংগে সংগে – প্রথমে হলদে বালিয়াড়ির ভেতর দিয়ে, মাঝে মাঝে দূরে দূরে ঘাসের গুচ্ছ –চিহ্ণিত, বালিয়াড়ি, তারপর আরো গভীরে, আরো ভেতরে প্রান্তরের মধ্যে – এক অন্তহীন, ধূসর প্রান্তর যা সমতল এবং শূণ্য – এতো শূণ্য যে, মনে হলো এ যেনো প্রবাহিত হচ্ছে না, বরং ভেঙে পড়েছে দিগন্তের দিকে; কারন চোখের সামনে এমন কিছু নেই যার উপর চোখ একটু বিশ্রাম করতে পারে- নেই ভূমির উপর কোনো উঁচু স্থান, কোনো পাথর, কোনো ঝোঁপঝাড়, এমন কি ঘাসের এটি ডগা – কেনো প্রাণীর শব্দ, পাখির কিচির-মিচির বা গুবরে পোকার গুনগুণ আওয়াজ এ বিশাল নীরবতা ভংগ করছে না; এমনকি বাতাস সামনে কোনো বাধা না থাকায় শূন্যের উপর নীচু দিয়ে বয়ে চলে নিঃশব্দে – না, তা নয়, শূন্যের মধ্যে তা পতিত হয়, মেন একট পাতর পড়ে অতর গর্তের বেতরে .. . এ মৃত্যুর নীরবতা নয়, বরং এখনো যার জন্ম হয়নি তারই নীরবতা, যা এখন পর্যন্ত কখনো জন্মলাভ করেনি তারই স্তব্ধতা – আদি শব্দে পূর্বর্তী নৈঃশ্বদ।
এবং তারপর তা ঘটলো। নীরবতা টুটে গেলো। এমনি মানুষের গলার স্বর পাখির গানের মতো মৃদু আঘাত হানলো বাতাসের আর যেনো তা ঝুলে রইলো শূন্যে আর আমার মনে হলো, আমি যেনো কেবল তা শুনছি না, বরং দেখছি –এমনি একাকী এবং অপ্রচ্ছন্নভাবে তা ভেসে চলেছে মরুপ্রান্তরের উপর দিয়ে। এ আর কেউ নয় , আমাদের বালুচী সেপাইটি। াতর যাযাবর জীবনের একটি গান গাইাছে যার অর্ধেকটা গাইছে সুর করে আর অর্ধেক করছে আবৃত্তি, দ্রুত তালে, পর্যায়ক্রমে –আবেগোষ্ণ এবং নাজুক শব্দের এক বিচিত্র সংগীত যা আমি বুঝতে পারচিরাম না। স্বল্প কয়েকটি রাগের মধ্যে বেজে উটলো তার গরার স্বর, একটিমাত্র সমতলে, যার মধ্যে নেই কোনো উত্থান এবং পতন, এবং এমনি একটানা সে গেয়ে চললো যে ক্রমে ক্রমে তা রূপান্তরিত হলো এক ধরনের উজ্জ্বল দীপ্তিতে, যখন তা ভাঙা ভাঙা রাগিনীটিকে ঢেকে দিলো কন্ঠ্য শব্দের আনুষংগিত ক্রীড়ায় এবং কেবল একই বিষয়ের বারবার আবৃত্তি এবং অদল –বদরের মাধ্যমে উম্মেচিত কররো তার সমতল সুরের মধ্যে এ অপ্রত্যাশিত ঐশ্বর্য –সমতল এবং সীমাহীন সেই দেশেরই মতো, যেখানে জন্ম হয়েছে এই গানের .. .।
আমরা মরুভূমির মধ্য দিয়ে যে অঞ্চল সফর করচি তাকে বলা হয় ‘আহমদের ঘন্টার মরুভূমি’। বাহু বছর আগে আহমদ নামে কোনো এ ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি কাফেলা পথ হারিয়ে ফেলে এখানে এসে এবং ওরা সকলেই –মানুস এবং জানোয়ার প্রত্যেকেই –পিয়াসে প্রাণ হারায়। আর আজো লোকে বলে, আহমদের উটেরা গলা যে ঘুঙৃর পরেছিলো তার ধ্বনি মাঝে মাঝে শুনতে পায় মুসাফিরেরা –ভৌতিক কান্নার মতো সেই শব্দ, যা গাফেল পথিককে মোহবিষ্ট করে তাদের পথ থেকে নিায়ে যায় দূরে এবং মরুভূমিতে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়।
আমরা সূর্যাস্তের কিছু পরেই আলী আগা এবং অগ্রবর্তী দলটিকে ধরে ফেলি এবং ‘কাহুর ’ তৃণের মধ্যে আমাদের তাঁবু গাড়ি –কয়েকদিনের জন্য এই শেস দেখতে পেলাম এই তৃণ। শুকনা ডারপালা দিয়ে আগুন ধরানো হরো এবং তৈরি হলো যা না হলেই নয় সেই চা, যকন আলী আগা তাঁর অভ্যাস টেনে চলেছেন আফিঙের পাইপ। উটগুলিকে খাওয়ানে হলো মোট বার্লি তৈরি খাবার আর আমদের চারদিকে বৃত্তাকারে সেগুলিকে বসিয়ে দেওয়া হলো হাঁটুর উপর। পুলিমের তিনজন লোককে ক্যাম্পের বাইরে বালিয়াড়ির উপর মোতায়েন করা হলো সন্ত্রাসী হিসাবে, কারণ আমরা যে অঞ্চলটিকে নিজেদের নিয়ে এসেছিলাম ঐ দিনগুলিতে সে অঞ্চরটি ছিলো মরুভূমির ভয়াল দানবদের ক্রীড়াক্ষেত্র – দক্ষিণ দিক থেকে আগত বালুচ উপজাতির হানা্দারদের।
আলী আগা সবেমাত্র তাঁর পাইপ এবং চা শেস করেছেন এবং পান করছেন আরক একাই – কারণ এ ব্যাপারে তাঁর সংগী হওযার মতো মন- মেজাজে ছিলো না আমার। হঠাৎ একটি রাইফেলের আওয়াজ রাত্রির নীরবতাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়। আমাদের সন্ত্রাসীদের রাইফেল থেকে দ্বিতীয় একটি আওয়াজ তার জবাব দেয় এবং পরপরই অন্ধকারের মধ্যে কোথাও শোনা গেলো একটি চিৎকার। ইবরাহিম তার চমৎকার উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে বালু ছুঁড়ে মারে আগুনের উপর। চারদিক থেকে আরো উঠতে লাগরো রাইফেলের আওয়াজ। সন্ত্রাসীদের এখন দেখাক যাচ্ছে না। কিন্তু ওরা একে অপরকে ডাকছে তা আমরা শুনতে পাচ্ছি। আত্রমণকারীদের সংখ্যা কতো বুঝতে পারলাম না। কারণ ওরা নীরবতা বজায় রেখেছিলো –ভৌতিক নীরবতা –কেবল মাঝে মাঝে কোনো রাইফেল থেকে একটা অস্পষ্ট আলোর ঝিলিক – যা ছুরির মতো বিদ্ধ করছে অন্ধকারকে ওরা যে আছে তা জানিয়ে দিচ্ছে এবং দু একবার আবছা দেখতে পেরাম অন্ধকারের ভেতর দিয়ে নিঃশব্দ ছুটে চলেছে সাদা পোশাক পরা কতকগুলি মূর্তি। নীচু লেবেলে তাক করে ছোড়া কয়েকটি বুলেট মাঁ করে আমাদের মাথার উপর চলে যায়; কিন্তু আমাদের কারো গায়ে লাগলো না। আস্তে আস্তে এই চাঞ্চল্য ও উত্তেজনা থেকে গেলো। আরো কয়েকটি গুলি ছোড়া হলো এবং রাত্রি শুষে নিলো তার শব্দ, আর হানাদারেরা আমাদের সতর্কতায় স্পষ্টতই নিরাশ হয়ে যেমন চুপি চুপি এসেছিলো তেমনি চুপি চপি গায়েব হয়ে গেলো।
আলী আগা সন্ত্রাসীদের ডাকলে পরে আমরা ছোটো –খাটো একটা আলোচনা বৈঠকে বসি। প্রথমে আমরা ঠিক করেছিলাম রাতটা এখানেই কাটাবো। কিন্তু যেহেতু আক্রমণকারী এ দলটি কতো শক্তিশালী সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই এবং আরো লোকজন নিয়ে ওরা আবার ফিরে আসবে কিনা তাও যখন আমরা জানি না, আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এখনি তাঁবু গুটিযে আমাদের রওয়ানা দেওয়া উচিত।
পীচের মতোই কালো আজকের রাত। ঘন নীচু মেঘপুঞ্জে ঢাকা পড়ে গেছে চাঁদ এবং তারা। সাধারণত গ্রীষ্মকালে মরুভূমিতে রাতের বেলা পথ চলাই ভালো। কিন্ত স্বাভাবিক অবস্থায় আমরা এরূপ অন্ধকারে পথ চলার ঝুঁকি নিতাম না। কারণ, এতে পথ হারানো আশংকা রয়েছে- কেননা দশত –ই-লুতের কঠিন নুড়ি পাথর কোনো পথের চিহ্ণ ধরে রাখে না। প্রাচীনকালে এ ধরণের মরুভূমিতে ইরানের বাদশাহরা কাফেলার রাস্তা চিহ্নিত করার জন্য ইট দিয়ে তৈরি করতেন গাইড পোষ্ট, কিন্তু সেকালের অনেক ভালো জিনিসের মতোই এসব চিহ্ন মুছে গেছে বহুকাল আগে। আসলে এগুলির আর এখন দরকারও এখন নেই। ভারতের সীমান্ত থেকে দাশত-ই-লুতের ভেতর দিয়ে কিরমান পর্যন্ত ইন্দো-ইউরোপীয় টেলিগ্রাফের যে লাইন এই শতকের শুরুতে ব্রিটিশ সরকার স্থাপন করেচে তা-ই একই রকম সার্থকতার সংগে –বলা যায়, তারো চেয়ে উৎকৃষ্টভাবে –কাজ করছে গাইডের; কিন্তু রাতে তার এবং টেলিগ্রাফের খুঁটিগুরি দেখা যাচ্ছিলো না চোখে।
আতংকের সংগে আমরা আবিষ্কার করলাম এ ব্যাপারটি যখন আমাদের গাইডরূপে আগে আগে উট হাঁকিয়ে চলছিলো যে-পুলিশটি , সে প্রায় আধ ঘন্টা পর হঠাৎ তার উটের লাগাম টেনে ধরে লজ্জিত মুখে আলী আগাকে জানালোঃ
-হযরত, আমি আর টেলিগ্রাফের তার দেখতে পাচ্ছি না.. .।
মুহূর্তের জন্য আমরা সকলে স্তব্ধ হয়ে যায়। আমরা জানতাম টেলিগ্রাফ লাইন দ্বারা চিহ্নিত রাস্তার পামেই কেবল কুয়া রয়েছে; আর কুয়াগুলিরও একটি থেকে আরেকটির দুরত্ব অনেক। এখানে পথ হারানো মানেই হচ্ছে আহমদের সেই গল্পের কাফেলার মতোই চিরতরে হারিয়ে যাওয়া.. .।
এরপর আলী আগা এমনভাবে কথা বললেন যা তাঁর স্বাভাবিক কথা বলার ধরণের চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা। যে কেউ নিরাপদে এই ধারণা করতে পারে যে, আরক এবং আফিঙই এর জন্য দায়ী। তিনি তার তার পিস্তল বার করে গর্জন করে উঠলেনঃ
-‘কোথায় তার? কুত্তার বাচ্চারা, কেন তার হারালি বল? হ্যাঁ, আমি জানি তোরা ঐ ডাকাতদের সংগে জোট বেঁধেছিস এবং আমাদের গুমরাহ করতে চাইছিস- যাতে আমরা মরি পানির অভাবে, আর তোদের সহজ লুটতরাজের বস্তু হয়ে উঠি।’
সত্যই এ তিরষ্কার ছিলো অন্যায়; কারণ কোনো বালুচ একবার যার সাথে বসে নুন-রুটি খেয়েছে সে কখনো তার বিশ্বাসের খেয়ানত করবে না। আমাদের পুলিশগুলি ওদের লেফটেন্যান্টের অভিযোগ পষ্টই আহত হয়ে আমাদের এই আশ্বাস দিলো যে, ওদের কোনো দোষ নেই, কিন্তু আলী আগা আবার চীৎকার করে ওঠেনঃ
-‘খামোশ, এক্ষুণি টেলিগ্রাফের তার খুঁজে বের কর; অন্যথায় আমি তোমাদের প্রত্যেককে গুলী করে সাবাড় করে দেবো-বুঝলে জাহান্নামীর পুত্ররা!’
অন্ধকারে আমি ওদের মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, ওরা, এই আজাদ বালুচেরা এ অপমানে কতো গভীর আঘাত পেয়েছে! এমনকি, জবাব দেবার প্রয়োজন ও ওরা আর বোধ করলো না। তারপর হঠাৎ ওদের একজন- কিছুক্ষণ আগেই যে ছিলো আমাদের গাইড-আলাদা হয়ে দাঁড়ালো দল থেকে, চাবুক হানলো তার উটের গায়ে, তারপর এক লাফে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
-‘কোথায় যাচ্ছে?’ চীৎকার করে ওঠেন আলী আগা এবং জবাবে তিনি শুনতে পান কয়েকটি অস্পষ্ট শব্দ। কয়েক সেকেন্ডের জন্য শোনা গেলো উটের পায়ের নরম মোলায়েম আওয়াজ। তারপর সেই শব্দ ডুবে গেলো রাত্রিতে।
বালুচ পুলিমের কোনো দোষ নেই, এ বিষয়ে আমরা যে প্রত্যয় হয়েছিলো মুহূর্তকাল আগে, তা সত্ত্বেও আমার মনে দ্বিধাজড়িত এই ভাবনা খেলে যায়ঃ এখন সে গিয়েছে দস্যূদের কাছে! যা-ই হোক, আলী আগার ধারণাই ঠিক.. . আমি শুনতে পেলাম আলী আগা পিস্তল-কেস থেকে টেনে বের করছেন তাঁর পিস্তল, আর আমিও তাই কির। ইবরাহীম আস্তে আস্তে হাতে তুলে নেই তার গুলতি। আমরা আমাদের জীনের উপর বসে আছি নিশ্চল নিস্তব্ধ। পুলিশের একজন ঘোঁৎঘোঁৎ করে ওঠে অনুচ্চ স্বরে: অপর একজন পুলিশের রাইফেলের বাঁটের গুঁতা লাগে একটি জীনের উপর। দীর্ঘ কয়েক মিনিট চলে যায়। নীরবতা এমনি যে, সব কটি মানুষের নিশ্বাসের শব্দই যেনো প্রায় শোনা যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ বিচ্ছিন্নভাবে একটি শব্দ ছুটে এলো অনেক দূর থেকে। আমার কাছে মনে হলো এটি কেবলই একটি ধ্বনি ‘–ও-ও-ও’। কিন্তু বালুচেরা এর অর্থ জানে এবং তার জবাবে ওদের একজন দুহাত মুখের উপর পেয়ালা মতো রেখে উত্তেজিতভাবে ব্রাহুই ভাষায় চীৎকার করে কিছু বলে। আবার সেই দূরের চীৎকার। পুলিশদের একজন এবার আলী আগার দিকে ফিরে ফার্সি ভাষায় বলেঃ
‘তার, ‘হযরত’, তার পেয়েছে ও!’
চাপা উত্তেজনা এবার মুক্তি পায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেরি আমরা সকলে, অনুসরণ করতে থাকি অদৃশ্য গাইডের গলার আওয়াজ, যে কিছুক্ষণ পর পর আমাদের দিচ্ছে পথের ডিরেকশন। আমরা যখন ওর কাছে পৌছলাম, সে তার জীনের উপর উঠে দাঁড়ালো এবং অন্ধকারের দিকে ইশারা করে বললোঃ
-‘এই যে টেলিগ্রাফের তার!’
এবং ঠিকই, কয়েক মিনিট পরই আমরা টেলিগ্রাফের একটি খুঁটির সংগে ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে যাই। আলী আগা প্রথম যে কাজটি করলেন তা তাঁরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক। তিনি সিপাইটির বেল্ট ধরে টেনে নিলেন নিজের কাছে এবং জীনের উপর ঝুঁকে পড়ে তার দুই গালে চুমু খেলেনঃ
‘-ভাইটি, তুমি নও, আমি কুত্তার বাচ্চা। আমাকে মাফ করে দাও!
পরে জানা গেলো মরুভূমির শিশু এই বালুচ সিপাইটি এঁকেবেঁকে চলছিলো উট হাঁকিয়ে কখনো ডাইনে কখনো বাঁয়ে। তারপর , একসময়ে আধ মাইল দূর থেকে শুনতে পেলো বাতাস তারের উপর আঘাত করে সাঁ সাঁ শব্দ-এই মুহূর্তে যখন আমি ঠিক তার নীচ যাচ্ছি, তখনো আমার ইউরোপীয় কানে প্রায় অনুভবের অতীত!
আমরা আস্তে আস্তে সতর্কতার সাথেআগাতে থাকি আঁধারে ঢাকা রাত্রির মধ্যে দিয়ে, অদৃশ্য টেলিগ্রাফের খুঁটি তেকে অদৃশ্য আরেক টেলিগ্রাফের খুঁটি পর্যন্ত। একজন পুলিশ সব সময়ই চলছে আমাদের আগে। আর যখন তার হাত একটা খুঁটির সাথে লাগছে সে চীৎকার করে তা বলছে আমাদের । আমরা আমাদের পথ খুঁজে পেয়েছি এবং আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, আমরা আমাদের পথ আর হারাবো না। আমি আমার স্বপ্ন থেকে জেগে উঠি এবং ফিরে যাই আলী আগার চিঠিতেঃ
লেফটেন্যান্ট বর্ণেল পতে উন্নীত হবার পর এই অধমকে নিযুক্ত করা হয়েছে সামরিক বাহিনীর জেনারেল স্টাফ-এ; আর কাজ, হে আমার বন্ধু এবং ভাই, একটি প্রাদেশিক শহরের গ্যারিসনের জীবন তেকে আমার কাছে বেশি আবেদন রাখে।
এ আবেদন সম্পর্কে আমি নিশ্চিত; রাজধানীর জীবন সম্পর্কে এবং তার চক্রান্ত, বিশেষ করে এর রাজনৈতিক চক্রান্ত সম্পর্কে সব সময়ই একটি স্বাভাবিক বিবেচনা রয়েছে আলী আগার। বস্তুত তিনি তার চিঠিতে তেহরানের রাজনৈতিক আবহাওয়া বর্ণনা করছেন-মসৃণ সমতলের নীচে সেইসব অন্তহীন বাদ-বিসংবাদের কথা, সেইসব জটিল চালের কথা যা দিয়ে বৈদেশিক শক্তিগুলি ইরানকে এতদিন রেখেছে একটা অস্থির অবস্থার মধ্যে, যে –কারণে এ বিস্ময়কর প্রতিভাশালী জাতি তার নিজস্ব রূপে প্রকাশ করে উঠতে পারছে না নিজেকে।
ঠিক এই মহূর্তে আমরা ইংলিশ তৈল কোম্পানী কর্তৃক হয়রান হচ্ছি। আমাদের সরকারের উপর সাংঘাতিক চাপ দেওয়া হচ্ছে কনসেশন আরো বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য এবং আমাদের গোলামকে আরো দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য। বাজার গুলিতে গুজবের জন্য কান পাতা যায় না আল্লাহই জানেন এ সবের পরিণতি কী!.. .
প্রাচ্যে দেশগুলির রাজনৈতিক জীবনে বাজারের ভূমিকা সবসময়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ; তেহরানের বাজারের বেলায় তা আরো খাস করে সত্যঃ এ বাজারে ইরানের গোপন হৃদয় স্পন্দিত হচ্ছে অব্যাহতভাবে, সকল প্রকার জাতীয় অবক্ষয় এবং সময়ের সকল অগ্রগতিকে অগ্রাহ্য করে। আলী আগার চিঠি পড়তে পড়তে, এই বৃহৎ বাজারটি , যা নিজেই একটা নগরীর মতো, এমন পষ্ট আমার চোখের সামনে আবার ভেসে ওঠে যেনো আমি মাত্র কালই তা দেখেছিঃ বড় বড় ফাঁকের জালির মতো আলো-আঁধারী রহস্যঘেরা অনেকগুলি হলের গোলকধাঁধা আর চলাচরের জন্য বিভিন্ন রাস্তা, যার উপর ছাদ তৈরি করেছে সূক্ষাগ্র তোরণ, দুই দিক থেকে এসে মিলিত হয়ে । সস্তা তুচ্ছ জিনিসপাতিতে ভর্তি আলোহীন ছোট্ট দোকানগুলি ছাড়িয়ে প্রধান রাস্তায় রয়েছে ছাদে ঢাকা প্রাংগণ, যে ছাদের মধ্যে আছে আলো প্রবেশের জন্য কাঁচের জানালা; এগুলি হচ্ছে; দড়ি একেকটি স্টোর, যেখানে ইউরোপ এবং এশিয়ার সবচেয়ে দামী রেশম বিক্রি হচ্ছে; দড়ি নির্মাতাদের কারখানার পরেই রৌপ্যকারদের কাঁচের কেস, যা সূক্ষ্ণ সোনা –রূপার ঝালরের কারুকার্যময়; বোখারা এবং ভারতের নানা রংয়ের সূতীবস্ত্র আর দুর্লভ পারস্য গালিচা মিশে গেছে একষাতে, শিকারের চিত্রসম্বলিত গালিচা; সেলাইর কালের পাশেই রয়েছে কাঁচ-মুক্তার গলার হার ও অটোমেটিক লাইটার, কালো হতভাগা ছাতাগুলি রয়েছে খোরাসানের ভেড়া চামড়ার পোশাকের পাশাপাশি, যার কিনারে কাজ করা হয়েছে হলুদ রংয়ের; এই সুদীর্ঘ হলের মধ্যে এসবই এসে মিশেছে একসাথে, যেনো একটি বৃহৎ এবং কিছুটা অযত্ন বিন্যস্ত দোকানের জানালায়।
এই পরস্পর বিজড়িত কুটির শিল্প ও বাণিজ্য দ্রব্যাদির অগণিত ছোট্ট – ছোট্ট গলিতে দোকানগুলি সাজানো হয়েছে পেশা অনুসারে। এখানে আপনি দেখতে পাবেন জীন নির্মাতা ও চর্মকারদের এক দীর্ঘ সারি, আরতার সাথে প্রধান রং হিসাবে পাবেন রং-করা চামড়ার লাল রং এবং চামড়ার কিছুটা টকটক গন্ধ, যা ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে; রয়েছে দর্জিরা –প্রর্তেকের জন্য নির্ধারিত উচু স্থান থেখে আপনি শুনতে পাচ্ছেন নিপুণ সেলাই কলগুলির একটানা শব্দ; প্রত্যেকটি দোকানীর জন্যই তিন থেকে চার বর্গফুট উঁচু একটা মেঝের উপর রয়েছে একেকটি দোকান; লম্বা লম্বা জামা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বিক্রির জন্য, সবসময় একই রকমের জামা, যার ফলে, আপনি যখন হাঁটেন,কখনো কখনো আপনার মনেহবে আপনি নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছেন। বাজারের অন্যান্য বহু অংশৈও একই রকমের অনুভুতি হবে আপনার । তা সত্ত্বেও প্রত্যেকটি পৃথক ক্ষেত্রে এই বিপুল সাদৃশ্যেরি সাথে একঘেঁয়েমীর কোনো সম্পর্ক নেই। অপরিচিত লোকের মধ্যে এ সাদৃশ্য নেশা ধরিয়ে দেয় এবং একটা অস্বস্তিকর তৃপ্তিতে তার অন্তরকে দেয় পূর্ণ করে। আপনি যদি একশ বারও আসেন, আপনি সবসময়ই দেখবেন আপনার চারপাশে মেজাজ –মর্জি এবং আবহাওয়া একই, মনেহবে যেন কেনা পরিবর্তন ঘটেনি; কিন্তু সে মেজাজ এবং আবহাওয়অ হচ্ছে সমুদ্র-তরংগের সেই অফুরন্ত অনুরণশীল পরিবর্তনহীনতা যা সবসময়ই তার রূপ বদলায়, কিন্তু তার মূলকে রাখে অপরিবর্তিত।
আর তাম্রকারদের বাজারঃ যেনো দোলায়মান হাতুড়ির আঘাতে ব্রোঞ্জের তৈরি অনেকগুলি ঘন্টার ঐকতানঃ সে হাতুড়িগুলি তামা, ব্রোঞ্জ এবং পিতল পিটিয়ে দেয় বহু বিচিত্র রূপ, আকারহীন ধাতুন পাতকে রূপান্তরিত করে গামলা, বেসিন ও বড় বড় পাত্রে।ধ্বনির কী নিশ্চয়তার সংগে চলতে থাকে হাতুড়ির এই আঘাত, তাল কখনো উুঁচতে তুলে কখনো নীচুতে নামিয়ে, বাজারের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত, প্রত্যেকেই হাতুড়ির বাড়ি দিতে গিয়ে অনুসরণ করছে অন্যের ছন্দকে, যাতে কানে কিছু অসংগত, বেসুরো না শোনায়; একশ কারিগর হয়তো হাতুড়ি চালাচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন ধাতুর উপর ভিন্ন ভিন্ন দোকানে- কিন্তু সারা বাজারে শুনতে পাওয়া যাবে একটিমাত্র সংগীত – একটিমাত্র রাগিণী .. . একটা সমন্বয় খুঁজে পাওয়ার জন্য এই গভীর, প্রায়-সামাজিক বাসনার মধ্যে –যা কেবল সংগীতের চাইতে আরো গভীর কিছু –ধরা পড়ে ইরানের আত্মার গোপন মাধুর্য।
এরপর মসলার বাজারঃ নীরব অলিগলি, যার দুই পাশে সজ্জিত সাদা জমাট মিশ্রীর তাল, চাউলের বস্তা, বাদাম এবং পেস্তার স্তূপ, হেজেল নাট ও তরমুজের শাঁস, শুকনা খোবানী ও আদা-ভর্তি ডালা, দারুচিনি,হলুদ, গোলমরিচ, জাফরান ও পোস্তাদানা ভর্তি কাঁসার থালা, মৌরী মসলা, ভেনিলা, জিরা, লং এবং আরো অসংখ্য লতাগুল্ম ও শিকড়- ভর্তি বহু পাত্র, যেসব মসলা থেকি নির্গত হচ্ছে গাঢ়, অভিভূত করা সৌরভ। বুদ্ধের মতো পদ্মাসনকরে বসে আছে এইসব বিসম্য়কর বস্তুর মালিকেরা উজ্জ্বল পিতলের দাড়ি পাল্লার উপর ঝুঁকে এবং কখনো কখনো নীচু গলায় পথাচারীকে ডাকছে আর তার নিকট কি চই জিজ্ঞাস করচে। এখানে কথঅ মানে অস্ফুট ধ্বনি, ফিসফিস করে কিছু বলা, কারণ যখন ব্যাগ থেকে পাল্লায় চিনি তোলা হয় আস্তো আস্তে তখন কারো পক্ষে শোরগোল করা সম্ভব হয় না – যখন ওজন করা হচ্ছে .. . থাইম কিংবা জিরা.. . এর আর কিছু নয়; মন মেজাজকে হাতের উপকরণের সাথে খাপ খাইয়ে নেবার সেই ক্ষমতা যার বলে ইরানীরা পারে অগণিত রংয়ের পশমের সূতা থেকে গেরো দিয়ে চমৎকার গালিচা বুনতে –একটি একটি সূতা করে ইঞ্চির ভগ্নাংশের সঙ্গে ইঞ্চির ভগ্নাংশ জুড়ে দিয়ে- যে পর্যন্ত না গোটা গালিচাটি তৈরি হয়েওঠে তার লীলাময় পূর্ণতায়। পৃথিবীতে যে ইরানী গালিচার কোনো তুলনা নেই এ কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়। নিজের হাতের কাজের এই গভীর নীরবতা, েএ চিন্তামগ্নতা, এ আত্ম –নিমজ্জন আর কোথায় পাবেন? –কোথায় পাবেন এই চোখ, এই গভীর অতলতা যার কাছে সময় এবং সময়ের গতি এতো তুচ্ছ!
কোটরাবিশিষ্ট তাকগুলিতে, যা স্বাভাবিক তাকগুলির চাইতে বড়ো, বসে কাজ করছে চিত্রকরেরা –ছোটো ছোটো ছবি আঁকছে। ওরা বহুকাল আগে যেসব হাতে লেখা পুঁথি ছিঁড়েছুড়ে গেছে তা থেকে ছোটো ছবি নকল করছে, জীবনের বৃহৎ বিষয়গুলিকে রূপ দিচ্ছে নিশ্বাসের মতোই সূক্ষ্ণ রেকা এবং রঙেঃ যুদ্ধ এবং শিকারের চিত্র, প্রেম সুখ এবং দুঃখের ছবি। ওদের ব্রাশ স্নায়ুতন্ত্রের মতোই মিহি এবং সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ বড়ি এবং বিন্দু বানিয়ে তা মাখানো হচ্ছে তার বাম হাতের আঙুল গুলিতে। নিখুঁত শুভ্র নতুন পাতাগুলিতে পুরানো চিত্রগুলি নতুন জীবন লাভ করে তুলির আঁচড়ের পর আঁচড়ে, শেডের পর শেড। মূলের থাক থাক সোনালী পটভূমির পাশাপাশি ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে নকলগুলি; উজ্জল পশ্চাদভূমি। একটা শাহী পার্কে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কমলালেবুর গাছগুলি এক নব বসন্তের আবর প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। রেশমী এবং পশমী পোশাক পরা তন্বীরা আবার তাদের চিত্তহারী অংগভংগীতে হয়ে ওঠে জীবন্ত; সেই পুরান বীর যোদ্ধাদের পলো খেলার উপরে নতুন সূর্য ওঠে .. আঁচড়ের পর আঁচড়ের শেডের পর শেড .. নির্বাক মানুষেরা অনুসরণ করে এক মৃত শিল্পীর বলিষ্ঠ সৃজনধর্মী প্রয়াসকে এবং সেই মৃত শিল্পীর মধ্যে ছিলো যেমন যাদু এদের মধ্যে রয়েছে তেমনিতরো প্রেমঃ আর এই প্রেম আপনাকে প্রা্রয় ভুলিয়ে দেয় নকরের অসম্পূর্ণতার কথা… ..
সময় আগিয়ে চলে; চিত্রকরেরা মাথা নুয়ে কাজ করে চলে, দিনের সাথে ঘটে না তাদের পরিচয়। সময় আগিয়ে চরে; বজারের পশ্চিম খন্ডের নিকটের রাস্তাগুলি ধীর গতিতে ক্রমশ আগিয় আগিয়ে ঢুকে পড়েছে দোকানগুলির মধ্যে; শিকাগো থেকে আমদানি করা কেরোসিনের বাতি, মাঞ্চেষ্টারের ছাপানো কাপড় এবং চেকোশ্লাভিকিয়ার চা-পাত্র আগিয়ে আসছে বিজয়ীর বেশে; কিন্তু চিত্রকরেরা তাদের জীর্ণ খড়ের মাদুরের উপর পদ্মাসন করে বসে সেকালের পরম আন্দময় সুরের মধ্যে প্রবেশ প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে নাজুক চোখ আর আঙুলের ডগা এবং তাদের শাহী শিকার এবং বিহ্বল প্রেমিকদের দিচ্ছে নতুন প্রাণ, দিনের পর দিন.. .
বাজারে লোক বেশুমার –অগুণতি; এদের মধ্যে রয়েচে ইউরোপীয় পোশাক পরা এবং প্রায়ই, ইউরোপীয় অথবা অর্ধ-ইউরোপীয় পোশাক পরা এবং প্রায়ই , ইউরেপীয় অথবা অর্ধ ইউরোপীয় স্যুটের উপর মাটির উপর ঝুলে পড়া আরবী ‘আবায়া’ পরা ভদ্রলোকেরা, দীর্ঘ ‘কাফতান’ পরা এবং কোমরে রেশমী ফিতা বাঁধা রক্ষণশীল শহুরে লোকেরা, আর নীল অথবা মেটে জ্যাকেট পর কৃষক ও কুটির শিল্পীরা। ইরানের শরীফ ভিক্ষুক গায়ক দরবেশদের দেকতে পাবেন তাদের সাদা ঢিলাঢালা লম্বা ঝুলাওয়ালা পোশাকে, কখনো চিতাবাগের একটি চামড়া কাঁধে, মাথায় বাবরি চুল এবং প্রত্যেকেরই শরীরের গঠন চমৎকার। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেয়েলোকের তাদের সামর্থ অনুসারে কেউ পরে সিল্কের কাপড়, কেউ বা সূতী বস্ত্র। কিন্তু কাপড়ের রং সবসময়ই কালো আর প্রত্যেকের মুখের উপরই ঝোলানো থাকে ঐতিহ্যপূর্ণ খাটো তেহরানী নেকাব। যারা গরীব তারা পরে হালকা রঙের ফুলওয়ালা সূতী চাদর। সেকেরে মোল্লারা সুন্দর কাজ করা বস্ত্র দিয়ে ঢাকা গাধা অথবা খচ্চরে পিছে চড়ে চলাফেরা করে সাড়ম্বরে এবং অপরিচিত কাউকে দেখলে তার দিকে এমন গোঁড়া দৃষ্টি হানে যে, মনে হয় যেনো তা জিজ্ঞাস করছেঃ কি করছো তুমি এখানে? আমাদের দেশকে ধ্বংস করার জন্য যারা কাজ কর ছে তুমি তাদেরই একজন ?
পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের যে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ইরানীদের হয়েছে তার ফলে ইরানী মানুষেরা হয়ে উঠেছে সন্দেহপরায়ণ। ফিরিংগিদের দ্বারা তাদের দেশের কোনো উপকার হতে পারে এ আশা কোনো ইরানীই আসলে করে না। কিন্তু আলী আগাকে অনাবশ্যক নৈরাশ্যবাদী বলেও মনে হয় নাঃ
ইরানের বয়স হয়েছে, কিন্তু নিশ্য় ইরান মরতে এখনো প্রস্তুত নয়। আমাদের উপর বারবার জুলুম করা হয়েছে। বন্যাস্রোত বয়ে গেছে বহু জাতি আমাদের উপর দিয়ে এবং তাদের সবাই মৃত্যুবরণ করোছে; কিন্তু আমরা আছি। এর কারণ, আমরা ইরানীরা সবসময়ই আমাদের নিজের পথে চলি। কতবার বহিবিশ্ব নতুন জীবন পদ্ধতি চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে আমাদের উপর এবং প্রত্যেকবারই ব্যর্থ হয়েছে। আমরা বাইরের শক্তিকে শক্তি দিয়ে মুকাবিলা করি না, যার ফলে মাঝে মাঝে মনে হতে পারে আমরা যেনো ওদর কাছে আত্মসমর্পণ করেছি। কিন্তু আমরা হচ্ছি ‘মবিউন’ খান্দানের লোক সেই ক্ষুদ্র উপপোকা যা বাস করে দেয়ালের নীচে। আপনি, আমার হৃদয়ের জ্যোতি, আপনি ককনো না কখনো ইরানের নিশ্চয়ই দেখেছেন কিভাবে চাক্ষুষ কোনো কারন ছাড়াই হঠাৎ ধ্বসে পড়ে সুদৃঢ় দেয়ালবিশিষ্ট মজবুত দালানকোঠা। এর কারণ কি? আর কিছুই নয়, এ ছোট্ট পিঁপড়াগুলি যারা বহু বছর ধরে অক্লান্ত চেষ্টায় দালানের ভিতের মধ্যে খুঁড়ে খুঁড়ে সৃষ্টি করে রাস্তা এবং গহবর, সবসময় তারা আগায় চুল পরিমাণ দূরত্বে, ধীরগতিতে, ধৈর্যের সংগে, সকল দিকে! ফলে শেষ পর্যন্ত গৃহ- প্রাচীর হারিয়ে ফেলে তার ভারসাম্য েএবং পড়ে যায় হুমড়ি কেয়ে। আমরা ইরানীরা হচ্ছি এ ধরনের পিঁপড়া । আমরা পৃথিবীর কেনো শক্তিকে শোরগোল পূর্ণ অর্থহীন বল দিয়ে মুকাবিলা করি না। বরং ওদের ওদের সাধ্যমতো অন্যায় এবং জুলুম করবার সুযোগ দিই এবং আমরা নীরবে খুঁড়েতে থাকি আমাদের রাস্তা এবং গহ্বর, যতক্ষণ না একদিন ওদের ইমারত হঠাৎ ধ্বসে পড়ে।
আর আপনি কি দেখেননি পানিতে যখন পাথর পড়ে তখন কী ঘটে? পাথরটি ডুবে যায়; পানির সমতলের উপর দেখা যায় কয়েকটি বৃত্ত। বৃত্তগুলি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। শেষপর্যন্ত শুরতে পানি যেমন নিস্তরংগ ছিলো আবার তেমনি নিস্তরংগ হয়ে যায়।
শাহ – আল্লাহ তাঁর হায়াত দারাজ করুন – তাঁকে বহন করতে হচ্ছে একট গুরুতর বোঝা, যার একদিকে রয়েছে ইরংরেজরা আর অন্যদিকে রয়েছে রুশরা। কিন্তু আমাদের কোনো সন্দেহ নেই যে, আল্লাহর রহমতে তিনি খুঁজে পাবেন ইরানকে বাঁচাবার পথ…
বাহ্যত রিজা শাহের উপর আলী আগার দৃঢ়মূল বিশ্বাস অপাত্রে বিশ্বাস বলে মনে হয় না। আমি মুসলিম বিশ্বে যেসব গতিশীল ব্যক্তিত্বের সংগে মিলিত হবার সুযোগ পেযেছি শাহ হচ্ছেন নিঃসন্দেহে তাদের অন্যতম এবং যেসব রাজাকে আমি জানি তাদের মধ্যে কেবল িইবনে সউদকে তাঁর সংগে তুলনা করা যেতে পারে।
রিজা শাহের ক্ষমতারোহনের কাহিনী একটি কাল্পনিক রূপকথার মতো, যা কেবল প্রাচ্য জগতেই সম্ভব, যেখানে কখনো ব্যক্তির হিম্মত এবং প্রবল ইচ্ছা-শক্তি মানুষকে অখ্যাতি, অশ্রুতির অন্তরাল থেকে টেনে তুরতে পারে নেতৃত্বের শীর্ষ চূড়ায়। আমি যখন প্রথম তাঁকে জানবার সুযোগ পাই ইরানে আামর প্রথম অবস্থানকালে, ১৯২৪ সালের গ্রীষ্মের দিনগুলিতে, তখন তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী এবং ইরানের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ডিকটেটর। কিন্তু তাকে এতো আকস্মিকতার সংগে এতো অপ্রত্যাশিতভাবে দেশের হাল-হাকিকতের নিয়ন্ত্রণে দেখতে পেয়ে দেশের মানুষ যে ধাক্কা খেয়েছিরো, তার ধকল তারা তকনো পুরাপুরি কাটিয়ে ওঠেনি। আমার এখনো মনে আছে, তেহরানে জার্মানীর দূতবাসের এক বৃদ্ধ ইরানী ক্লার্ক কী তাজ্জবের সংগে একদিন আমাকে বলেছিলোঃ “আপনি কি জানেন, খুব বেশি দিন নয়, মাত্র দশ বছ আগে আমাদের এই প্রধানমন্ত্রী এই দূতাবাসের গেটের একজন সাধারণ সিপাইরূপে পাহারা দিতেন, আর এই আমি, নিজে মাঝে মাঝে তার হাতে দিতাম কোনো চিঠি বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ে পৌছিয়ে দেওয়ার জন্য এবং তাকে বকুনি দিয়ে বলতাম- “এই এই কুত্তার বাচ্চা, ছুটে যা বাজারে, বাজে কাজে সময় নষ্ট করিস না।…!”
হ্যাঁ,এ খুব বহু বছর আগের কথা নয়, যখন অশ্বারোহী পুলিশ রিজা তেহরানের দূতাবাস এবং সরকারী ভবনগুলির সামনে কাজ করতেন সান্ত্রী হিসাবে। আমি কল্পনায় তাঁর ছবি দেখতে পাচ্ছি যখন তিনি ইরানী কোসাক –ব্রিগেডের বিশ্রী উর্দী পরে দাঁড়াতেন তাঁর রাইফেলে ঠেস দিয়ে এবং চারপাশে বিভিন্ন রাস্তায় যে কর্মতৎপরতা চলছে তা দেখতেন তাকিয়ে তাকিয়ে; তাঁর চোখের সমুখ দিয়ে ইরানী লোকেরা পায়চারী করতো স্বপ্নের মতো, অথবা বিকালের ঠান্ডায় পানির খালের ধারে বসতো ওরা, যেমন আমি ওদের করতে দেখেছি। আর শুনতেন তাঁর পিঠের পেছনে ইংরেজদের ব্যাংক থেকে টাইপরাইটারদের বিশেষ শব্দ, ব্যস্ত মানুষের শোরগোল, চাঞ্চল্যের সমুদয় অস্ফুট ধ্বনিটি যা সুদূর ইউরোপ নিয়ে এসেছে তেহরানের ঐ প্রাসাদটিতে, যার সম্মুখ-ভাগটি খচিত নীল বর্তনের টুকরা দিয়ে। হতে পারে,প্রথম বারের মতো (আমাকে কেউ একথা বলেনি, কিন্তু কেন যেনো আামর মনে হয়, ঠিক এ রকমটিই ঘটে থাকবে) সিপাই রিজার অশিক্ষিত মাথায় জেগেছিলো এই বিস্ময়সূচক জিজ্ঞাসময় চিন্তুাঃ এই রকম হওয়াই কি অপরিহার্য?.. . হ্যাঁ, এ রকমটি হওয়াই কি অনিবার্য যে, অন্যান্য জাতির লোকের যখন কাজ করছে, চেষ্টা করচে, তখন আমাদের জীবনে বয়ে চলবে একটি স্বপ্নের মতো?
এবং হয়তো সেই মুহূর্তের পরিবর্তনের সেই বাসনা-যা সমস্ত মহৎ কর্ম, আবিস্ক্রিয়া ও বিপ্লবের জন্ম দেয় – দীপ্তিময় হয়ে উঠতে শুরু করেছিলো তাঁর মগজে এবং নির্বাক অবস্থায় চাইছলো তার অভিব্যক্তি….
অন্যান্য সময় তিনি হয়তো বৃহৎ কোনো ইউরোপীয় দূতবাসের দাখির দরোজার বাগানের সম্মুখে দাঁড়িয়ে সান্ত্রী হিসাবে। সযত্ন-লালিত গাছগুলি আন্দোলিত হচ্ছে বাতাসে এবং নুড়ি পাতর বিছানো পায়ে –চলা রাস্তাগুলি মসমস করছে সাদা পোশাক পরা নওকরদের দরোজার ভেতর দিয়ে যে –সব ইরানী বার হয়ে যায় তার প্রত্যেকেই এর জন্য থাকে ভীত েএবং আত্মসচেতভাবেই তাকে তার পোমাক আর কাপড় –চোপড় টেনে লম্বা করে ধরতে বাধ্য করে এভং তার হাতগুলিকে করে তোলে কুন্ঠিত এলোমেলো। কখনো কখনো আসে সুন্দর নিখুঁত ঘোড়ার টানা গাড়ি এবং তার তার েভেতর থেকে বের হয়ে আসেন ইরানের রাজনীতিবিদেরা। সিপাই রিজা এদের অনেককেই দেখে চিনতে পারেন; ইনি হচ্ছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, উনি হচ্ছে অর্থমন্ত্রী। ওঁরা যকন সেই দরোজা দিয়ে প্রবেশ করেন সবসময়ই দেখা যায় তাঁদের মুখে উত্তেজনা এবং আশংকার ছাপ; আর যখন ওঁরা দূতাবাস ত্যাগ করেন তখন ওঁদের মুখ খুবই উজ্জ্বল, যেনো ওঁদের উপর মস্তবড় একটা অনুগ্রহ বর্ষিতহয়েছে; কখনো কখনো দেখা যায় ওঁদের মুখ বিমর্ষ এবং হাশামগ্ন যেনো এইমাত্র তাঁদের উপর মৃত্যুদণ্ড উচ্চারিত হয়েছে। প্রসাদের ভেতরকার ঐ বহস্যময় লোকেরাই ঘোষণা করেছে এই দণ্ড। সিপাই রিজা বিস্মিত হয়ে ভাবেন – এই রকমটি হওয়াই কি অনিবার্য …’
মাঝে মাঝে এ রকম হয় যে, রিজা যে অফিস-ভবন পাহারা দিচ্ছেন সেখান থেকে ছুটে বের হয়ে আসে একজন ইরানী ক্লার্ক আর তাঁর হাতে একটি চিঠি গুঁজে দিয়ে বলেঃ জলদি এটি অমুকের নিকট পৌছিয়ে দে। কুত্তার বাচ্চা, দৌড় দে, নইলে রাষ্ট্রদূত চটে যাবেন।’ এ ধরনের সম্বোধনে অভ্যস্ত ছিলেন রিজা, কারণ বিশেষণের ব্যবহারে তাঁর নিজের অফিসারেরা কম পটু নয়। তবে সম্ভবত – তাই বা কেমন করে বলি-প্রায় নিশ্চিতভাবেই ‘কুত্তার বাচ্চা’ এই শব্দ কটি তাঁকে ছুরির মতো বিদ্ধ করতো অপমানে, কারণ তিনি জানতেন, তিনি কুত্তার বাচ্চা নন; তিনি একটি মহান জাতির সন্তান, যে জাতি রুস্তম, দারায়ুস, নওশেরয়া, কাযখসরু, শাহ আব্বাস, নাদির শাহর মতো নামগুলিকে আপন বলে জানে। কিন্তু এই প্রাসাদের ভেতরে যারা বাস করে তারা এর কী জানে? চল্লিশ বছরের একটি সিপাইয়ের বুকের বেতর দিয়ে অন্ধকার বোবা স্রোতের মতো যে শক্তিগুলি প্রবাহিত হচ্ছে এবং কখনো কখনো যার চাপে তাঁর বুকের পাঁজরের বাঁধন ছিড়ে যেতে চাইছে আর অক্ষমের হতাশায় তাঁকে বাধ্য করছে নিজের হাত নিজেই কামড়াতে, ওহো, আমি যদি কেবল.. .?
এবং প্রত্যেক ইরানীর হৃদয়ে কান্নার সংগে বাসকরে যে আত্ম –প্রতিষ্ঠার বাসনা –কখনো কখনো তা যন্ত্রণাদায়ক অপ্রত্যাশিত প্রচণ্ডতার সংগে জেগে উঠতো সিপাই রিাজার বুকের ভেতরে আর তার মনকে করে তুলছো স্বচ্ছ, যার ফরে, তিনি হঠাৎ দেখতে পেতেন একটি বিস্ময়কর, প্যাটার্ন, যা –কিছু তা৭র নযরে আসতো সমস্ত কিছুর মধ্যে. ..।
মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে। বলশেভিক বিপ্লবের পর রুশ সৈন্যরা পূর্বে ইরানের যে –উত্তরাঞ্চল দখল করেছিলো সেখান থেকে সরে পড়ে। কিন্তু তার পরে পরেই প্রভাবশালিী কুচুক খানের নেতৃত্বে এবং নিয়মিত রুশ স্থল ও নৌবাহিনীর সমর্থনে কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী ইরানের গিলান প্রদেশে কমিউনিষ্টরা বিদ্রোহ করে বসে। সরকার ফৌজ প্রেরণ করে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে, কিন্তু ইরানী সিপাইদের ছিলো না তেমন শৃংখলাবোধ আর তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও ছিলো খুব কম, যার ফলে তারা বারবার হারতে থাকে। যে ব্যাটেলিয়ানে যোদ্ধ ছিলেন তখন সার্জেন্ট রিজা- পঞ্চাশের মতো তাঁর বয়স – সেই ব্যাটেলিয়নও একই ভাগ্যবরণ করে। কিন্তু একবার যখন দুর্ভাগ্যজনক হামলার পর তাঁর ইউনিটটি পলায়ন করতে উদ্যত, তখন রিজা নিজেজে স্থির রাখতে পারলেন না। তিনি তাঁর ভাঙা দল থেকে বার হয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে চীৎকার করে উঠলেন, যাতে প্রত্যেকেই শুনতে পাইঃ ‘কেন তোমরা পালাচ্ছে, ইরানীরা, শোনো ইরানীরা, কেন তোমরা পালাচ্ছে?’ তিনি তখন নিশ্চয়ই অনুভব করেচিলেন তাঁর চেতনার গভীরে –সুইডেনের দ্বাদশ চার্লসের মতো –যখন তিনি জখম হয়ে পড়েছিলেন পোলতাবা যুদ্ধক্ষেত্রে আর দেখছিলেন তাঁর সিপাইরা তাঁর পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে বধির, উদ্দেশ্যহীনভাবে এবং হতাশাব্যঞ্জক কন্ঠে তাদের ডেকে বলেছিলেন চীৎকার করে, ‘তোমরা কেন পালাচ্ছে সুইডিসরা? ওহে সুইডিসরা! কিন্তু তফাত এই যে, রাজা চার্লস আঘাতে আঘাতে জর্জরিত ছিলেন বলে রক্ত বের হচ্ছিলো তাঁর সারা গা তেকে। কিন্তু সিপাই রিজা ছিলেন অক্ষত আর তাঁর হাতে ছিলো গুরি ভর্তি একটি মাউজার পিস্তল আর তাঁর গলার স্বর ছিলো দৃঢ় এবং ভীতিজনক যখন তিনি সতর্ক করছিলেন তাঁর সংগীদেরকে, ‘যে-ই পালাবে, আমি তাকে গুগিল করে হত্যা করবো –সে যদি আমার ভাই হয়, তবুও।
ইরানী সিপাইদের কাছে এ ধরণের বিস্ফোরণ ছিলো নতুন জিনিস। তাদের দিশাহারা অবস্থা কেটে গিয়ে সৃষ্টি হলো বিস্ময়। তারা হয়ে উঠলো উৎসুক, জিজ্ঞাসুঃ কী রয়েছে এই লোকটির মনে? কয়েকজন অফিসার প্রতিবাদ করে এবং তাদের অবস্থা যে একেবারেই নৈরাশ্যজনক সে কখা বলে এবং ওদের একজন ব্যংগ করে ওঠেঃ ‘তাহলে ‘তুমিই’ আমাদের জন্য নিয়ে আসবে বিজয়!’ সেই মুহূর্তে রিজা হয়তো তার জীবনের আগেকার বছরগুলির সমস্ত হতাশা থেকে মুক্ত হয়ে উঠেছিলেন এবং তাঁর সব নির্বাক আশা হয়তো উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিলো সহসা। তিনি তাঁর সামনে দেখতে পেলেন এক যাদু –রজ্জুর প্রান্তদেশ, তিনি তা ধরলেন হাতের মুঠায়। ‘হ্যাঁ, দায়িত্ব নিলাম’– তিনি চীৎকার করে উঠলেন এবং সিপাইদের দিকে ফিরে বললেন, ‘তোমরা কি আমাকে তোমাদের নেতা বলে মেনে নেবে?
কোনো জাতির মধ্যেই বীরপূজার মনোবৃত্তি অমন গভীরভাবে প্রোথিত নয় যেমন দেখা যায় ইরানীদের মধ্যে; আর এই মুহূর্তে এই লোকটিকে মনে হলো একজন বীর বলে! সিপাইগুলি তাদের আতংক আর পলায়নের কথা ভুলে যায় আর সহর্ষে গর্জন করে ওঠে, ‘তুমিই হবে আমাদের নেতা।’ ‘তা-ই হোক’, বলেন রিজা, ‘আমি নেতৃত্ব দেবো তোমাদের এবং যে কেউ পালাবার চেষ্টা করবে, আমি তাকে হত্যা করবো’। কিন্তু কেউ পালাবার কথা ভাবলো না। ভারী ন্যাপস্যাক ছুড়ে ফেলে দিয়ে ওরা ওদের রাইফেলে সংগীন ফিট করে। তারপর রিজার নেতৃত্বে গোটা ব্যাটেলিয়ানটি ঘুরে দাঁড়ায় এবং হঠাৎ আক্রমন করে একটি রুশ মোর্চা দখল করে আর সংগে অন্যান্য ইরনী ইউনিটগুলির সাহায্যে শত্রুকে পদদলিত করে, আর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ইরানীদের পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়ে যায় এই যুদ্ধে।
কয়েকদিন পর তেহরান থেকে প্রেরিত একটি টেলিগ্রাম দ্বারা রিজাকে উন্নীত করা হয় ক্যাপ্টেন পদে। এখন তিনি তাঁর নামের সংগে যুক্ত করতে পারলেন । ‘খান’ পদবীটি।
রশির মাথা ধরে তিনি লাফ মেরে চড়েছেন রশির উপর। হঠাৎ তার নাম হয়ে উঠেলো মশহুর। পর্যায়ক্রমে অতি দ্রুত তিনি উন্নীত হলেন মেজর পদে, মেজর থেকে কর্ণেল, কর্ণেল থেকে ব্রিগেডিয়ার। ১৯২১ সনে তিনি তরুণ সাংবাদিক জিয়াউদ্দীন এবং আরো তিনজন অফিসারকে ‘সংগে নিয়ে দখল করেন’ ক্ষমতা, দুর্নীতিপরায়ণ মন্ত্রীসভার সদস্যদের গ্রেপ্তার করেন এবং তার বিশ্বস্ত ব্রিগেডের সাহায্যে দুর্বল এবং তুচ্ছ তরুণ শাহ আহমদকে বাধ্য করলেন এটি নুতন মন্ত্রীসভা গঠন করতেঃ জিয়াউদ্দীন হলেন প্রধানমন্ত্র্রী এবং রিজা খান হলেন যুদ্ধমন্ত্রী। তিনি পড়তে জানতেন না, লিখতে জানতেন না, কিন্তু ক্ষমতা লাভের প্রচেষ্টায় তিনি ছিলেন অসুরের মতো এবং তিনি তাঁর সেনাবাহিনী ও লোকের কাছে হয়ে উঠলেন অকুণ্ঠ শ্রদ্ধ ও ভক্তির পাত্র, যারা বহু যুগ পরে এই প্রথম তাদের সামনে দেখতে পেলো একটি মানুষঃ একজন নেতা!
ইরানের রাজনৈতিক ইতিহাসে দৃশ্য বদল হয় দ্রুত। জিয়াউদ্দীন অন্তর্হিত হলেন মঞ্চ থেকে এবং পুনরায় আবির্ভূত হলেন ইউরোপে, নির্বাসিতরূপে। রিজা খান রয়ে গেলেন প্রধান মন্ত্রী হিসাবে। সেই দিনগুলিতে গুজব রটেছিলো তেহরানেঃ রিজা খান, জিয়াউদ্দীন এবং শাহের ছোট ভাই, যুবরাজ –এই তিনজন মিলে ষড়যন্ত্র করছেন শাহকে সিংহাসন থেকে অপসারণ করার জন্য এবং কানা –ঘুষা চলছিলো – আজ পর্যন্ত কেউই তা জানে না তা সত্য কিনা- শেষমুহূর্তে এ ধরনের অনিশ্চিত এক প্রায়াসে তাঁর নিজের ভবিষ্যতে যাতে বিপন্ন হয়ে না পড়ে এজন্য রিজা কন তাঁর বন্ধদের কথা শাহর কাছে ফাঁস করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সত্য-মিথ্যা যা-ই হোক, প্রধানমন্ত্রী রিজা খান শিগগির কিছুদিন পরেই তরুণ শাহ আহমদকে প্রমোদ ভ্রমণের জন্য জাকজমকের সংগে ইরাক সীমান্ত পর্যন্ত যান শাহর সাথে সাথে, এবং শোনা যায়, তিনি নাকি শাহকে বলেছিলেন, ‘মহামান্য শাহ যদি কখনো ইরানে ফিরে আসেন, আপনি বলতে পারবেন রিজা খান এই দুনিয়ার কিছই বোঝে না।’
কারো সংগে ক্ষমতা ভাগাভাগি করার প্রয়োজন তার ছিলো না; নামে না হলেও কাজে তিনি হয়ে উঠরেন ইরানের প্রকচ্ছত্র প্রভু। ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো তিনি লাফ মেরে পড়লেন কাজের উপর। গোটা ইরানের সংস্কার করতে হবে শির থেকে তল পর্যন্ত। এতোদিনকার শিথিল প্রশাসন ব্যবস্থা ছিলো এককেন্দ্রিক; সর্বোচ্চ নিলামদারের কাছে প্রদেশ –কে-প্রদেশ ইজারা দেওয়ার পুরানো প্রথা তিনি তুলে দিলেন; গভর্নরেরা ্পার প্রদশপাল রইলেন না, এখন থেকে তাঁরা হলেন কর্মচারী। ডিকটেটরের পোষ্য শিশু- সামরিক বাহিনীকে পুনর্গঠিত করা হলো পাশ্চাত্য প্যাটার্নে। পূর্বে যসব অবাধ্য উপজাতীয় সর্দার নিজেদের ছোটোখাটো রাজরাজড়া বলে গণ্য করতো এবং প্রায়ই তেহরান সরকারকে মানতে চাইতো না, তাদের বিরুাদ্ধে রিজা খান শুরু করলেন অভিযান; যে সব দস্যু –তুরস্ক যুগ যুগ ধরে গ্রামাঞ্চলে আতংক সৃষি।ট করে রেখেছিলো তাদেরকে তিনি দমন করলেন কঠোরভাবে; একজন আমেরিকান উপদেষ্টার সাহায্যে তিনি দেশের অর্থ- ব্যবস্থায় কিছুটা শৃংখলা ফিরিয়ে আনলেন; কর এবং শুল্ক আসতে লাগলো নিয়মিত। বিশৃংখলা দূর করে আনা হরো শৃংখলা।
মনে হয়, যেনো তুর্কীর মোস্তফা কামালের আন্দোলনের প্রতিধ্বনি তুলেই প্রজাতন্ত্রের ধারণা জেগে উঠলো ইরানে, প্রথমে একটা গুজব হিসাবে, তারপর জনগণের মধ্যকার অধিকতরো প্রগতিশীল লোকদের দাবি হিসাবে এবং শেষ পর্যায়ে , খোদ ডিকটেটরের জাহিরা লক্ষ্যরূপে। কিন্তু এখানে রিজা খান তাঁর বিচারে একটি ভুল করে বসেছিলেন বলে মনে হয়ঃ ইরানী জনতার মধ্য থেকে উঠলো প্রতিবিাদের বলিষ্ঠ চীৎকার।
প্রজাতন্ত্রী প্রবণতার বিরুদ্ধে জনগনের এই যে আপত্তি তার কারণ এ নয় যে, তারা শাসক রাজ পরিবারকে ভালবাসে, কারণ কাজার রাজবংশের প্রতি ইরানের কারোরই কোনো টান ছিলো না। এই পরিবারটি রক্তের দিক দিয়ে তুর্কোম্যান হওয়াতে সবসময়েই একে মনে করা হয়েছে বিদেশী; এর কারণ এও নয় যে, শাহ আহমদের গোলগাল, বাল-সুলভ মুখের জন্য ওদের কোনো আবেগাত্মক পূর্বানুরাগ ছিলো। এর কারণ সম্পূর্ণ ভিন্নঃ জনগণের নিজেদের ধর্ম হারাবার ভয়ই এর মূলে কাজ করেছে, যেমন তুর্কীরা তাদের ধর্মকে হারিয়েছে আতাতুর্কের বিপ্লবের পর। অজ্ঞতার কারণে ইরানীরা ঠিক সেই মুহূর্তে বুঝতে পারেনি যে, প্রজান্ত্রী ধরনে রাষ্ট্র-ব্যবস্থার অনেক বেশি মিল রয়েছে ইসলামের জীবন পরিকল্পনার সংগে –রাজতন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থার চাইতে। তাদের ধর্মীয় নেতাদের রক্ষণশীলতা দ্বারা পরিচালিত হয়ে – এবং হয়তো সংগতভাবেই রিজা খান কর্তক কামাল আতাতুর্কের প্রকাশ্য প্রশংসায় আতংকিত হয়ে –ইরানীরা প্রস্তাবের মধ্যে তাঁর দেশে সবচেয়ে প্রভাবশালা শক্তি হিসাবে ইসলামের একটি বিপদই কেবল দেখতে পায়।
এক ভীষণ উত্তেজনায় পেয়ে বসে শহুরে লোকদের , বিশেষকরে যারা তেহরানে বাস করতো তাদের। এক উন্নত্ত জনতা লাঠি আর ঢিল –পাটকেলে সজ্জিত হয়ে রিজা খানের অফিস ভবনের সামনে জমায়েত হয় এবং ঠিক আগের দিন যিনি ছিলেন প্রায় দেবতুল্য তাঁকে অভিশাপ দেয় ও ভয় দেখাতে শুরু করে। রিজা খানের দেহরক্ষীরা জোর দিয়ে তাঁকে বোঝালো, তিনি যেনে এই উত্তেজনা থেমে যাওয়ার আগে বাইরে না বার হন। কিন্তু তাদের ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে একটিমাত্র আর্দালীকে সংগে নিয়ে এবং সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় তিনি অফিস প্রাংগণ ত্যাগ করেন একটি জানালা-ঢাকা ঘোড়ার লাগাম ধরে ঘোড়াগুলিকে খামিয়ে দেয়। ওদের মধ্যে কেউ কেউ গাড়ীর দরজা ভেংগে ফেলে আর চীৎকার করতে থাকেঃ ‘ওকে টেনে বের করে নিয়ে আসো – ওকে টেনে বের করো রাস্তায়!’ কিন্তু ইতিমধ্যে তিনি চাবুক নিয়ে তাঁর আশেপাশে যারা দাঁড়িয়েছিলো তাদের মাথায় এবং কাঁধে আঘাত করতে শুরু করলেনঃ কুত্তার বাচ্চারা, পালা, এখান থেকে পালা। কী হিম্মত তোদের! আমি হচ্ছি রিজা খান, তোরা তোদের মাগীদের কাছে ফিরে যা, ফিরে যা তোদের বিছানায়! এবং মাত্র কয়েক মিনিট আগে যে উন্নত্ত জনতা তাঁকে ভয় দেখাচ্ছিলো তারা পেছনে হটে যায়, একজন একজন করে সরে পড়ে এবং পামের অলি –গলিতে অদ্যৃ হয়ে যায়। একজন মহান নেতা আবার কথা বলেছেন তাঁর জাতির উদ্দেশ্যে; তিনি কথা বলেছেন ক্রোধের সংগে এবং তাতেই ওরা নত হয়ে পড়েছে। হতে পারে রিজা খান তাঁর জাতিকে যে ভালোবাসতেন সেই ভালোবাসা ভেদ করে সেই মুহূর্তে জন্ম নিয়েছিলো একটা ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের অনুভূতি, এবং তাই হয়তো দেশবাসীর প্রতি তাঁর প্রেমকে চিরদিনের জন্য আচ্ছন্ন হয়ে রেখেছিলো।
কিন্তু রিজা খানের গৌরবজনক সাফল্য সত্ত্বেও প্রজাতন্ত্র আর বাস্তবে রূপ নিলো না। এই পরিকল্পনার সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় এই –ই স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে, জনগণের প্রতিরোধের মুকাবিলায় কেবলমাত্র সামরিক শক্তির পক্ষে একটি ‘সংস্কার আন্দোলন’ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। ব্যাপার এ নয় যে, ইরানীরা সংস্কার মাত্রেরই বিরোধী। কিন্তু তাদের এই সহজাত উপরব্দি ঘটেছিলো যে, আমদানি করা পাশ্চাত্য রাজনৈতিক মতবাদের পরিণতিই হবে- নিজেদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়পটভূমিকায় কোনো সময়ে একটি সুস্থ বিকাশ লাভের সকল আশার শেষ।
তখনো কিংবা খনো রিজা খনা তা বুঝতে পারেননি, যার ফলে তিনি তাঁর দেশের মানুষের সংগে সম্পর্ক হারিয়ে ফেলেন। তাঁর প্রতি ওদের ভালোবাসা উবে যায় এবং ধীরে ধীরে তার স্থান দখল করে ভয়ংকর এক ঘৃণা ও বিদ্বেষ। ওরা জিজ্ঞাস করতে শুরু করলো নিাজেদেরঃ বীর প্রবর তাঁর জাতির জন্য আসলে কী করতে পেরেছেন? ওরা রিজা খানের সাফল্যগুলি গুণে দেখরো এক এক করেঃ সৈন্যবাহিনী পুনর্গঠন – কিন্তু তার জন্য দিতে হয়েছে ভয়ংকর মূল্যঃ যার জন্য পিঠ ভেংগে দেওয়া ট্যাক্সের বোঝা চাপানো হয়েছে এমনিতে জীবন্মৃত জাতির উপরে। উপজাতীয় বিদ্রোহগুলি দমন? কিন্তু তার সংগে দমন করা হয়েছে দেশপ্রেমিক অংশটিকেওঃ তেহরানে লোক দেখানোর মতো নির্মাণ তৎপরতা চলছে; কিন্তু পল্লী অঞ্চলে কৃষক সমাজের দুঃখ-দরিদ্র্য কেবল বেড়েই চলেছে। লোদের স্মরণে আসলে লাগলো মাত্র কয়েক বছর আগেই রিজা খান ছিলেন একজন দরিদ্র সিপাই, কিন্তু এখন তিনি ইরানের সবচেয়ে ধনী মানুষ এবং নিজের নোমেই যে কতো একর জমি রয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। এই গুলিই কি সংস্কার যা নিয়ে ঢাকঢোল পেটানো হয়েছিলো? ডিকটেটরে প্রভাবে তেহরানে যে অল্প কটি ঝকঝকে অফিস ভবন গড়ে উঠেছে এবং এখানে –ওখানে যে কটি বিলাস-বহুর হোটেল নির্মিত হয়েছে সেগুলি কি জনসাধারনের ভাগ্যোন্নয়নের কোন প্রমাণ বহন করে?
তাঁর জীবনের ঠিক এই পর্যায়ে আমি রিজা খানের পরিচয় জানতে পাই। তারঁ-ব্যক্তিগত উচ্চভিলাস এবং তাঁর বিরুদ্ধে স্বার্থপরতার যে অভিযোগ আনা হয়ে থাকে, এ সম্পর্খে গুজব যাই রটুক না কেন, যে মুহূর্তে তিনি ‘যুদ্ধ ওজারত’-এ তাঁর অফিসে আমাকে স্বাগত জানালেন, এই লোকটির মহত্ত্ব আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গেলো না। হয়তো এই অফিসটি ছিলো সবচেয়ে সাদাসিধা অফিস, যা কোথাও কখনো ব্যবাহর করেছেন একজন প্রধানমন্ত্রীঃ একটা ভেক্স, কালো অয়েলক্লতে মোড়া একটি সোফা, একজোড়া চেয়ার, ছোট্ট একটি বুক –শেলফ এবং মেঝেতে বিছানো উজ্জ্বল অথচ কম দামের একটি গালিচা ছাড়া আর কিছু না সেই কামরাটিতে। এবং পঞ্চাশ ও ষাটের মাঝামাঝি বয়সে, দীর্ঘদেহী ভারী গড়নের যে মানুষটি ডেক্সের পেছন থেকে ধীরে ধীরে দাঁড়ালেন, তাঁর পরনে ছিলো সাদামাটা একটি খাকি উর্দী, যাতে ছিলোনা পদ-মর্যাদাসূচক কোনো পদক রিবন অথবা ব্যাজ।
আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন জার্মান রাষ্ট্রদূত কাউন্ট ফন ডার শুলেনবার্গ (কারণ আমি নিজে অস্ট্রীয় এবং একটা মশহুর জার্মান সংবাদপত্রের প্রতিনিধি)। সেই প্রথম আনুষ্ঠানিক কথাবার্তার মধ্যেও আমি রিজা খানের প্রকৃতির গুরুগম্ভীর গতিময়তা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠি। ধূসর খোঁচা –খোঁচা ঘন ভ্রূর তল থেকে এক জোড়া তীক্ষ্ণ বাদামী রঙের চোখ তাকাচ্ছিলো আমার দিকে –খাস পারসিকের চোখ, যা সাধারণত ঢাকা থাকে চোখের পুর পাতার নীচেঃ বিষণ্ণতা ও দৃঢ়তার অদ্ভুদ এক মিশ্রণ! তাঁর নাক এবং মুখের আশপাশে গাঢ় রেখাগুলিতে তিক্ততার অভিব্যক্তি, কিন্তু মোটা হাড্ডির উপর তাঁর মুখাবয়ব থেকে ফুটে উঠছিলো এক অসাধারণ ইচ্ছাশক্তি যার ফলে তাঁর ঠোঁটের উপর ঠোঁট বসেছে চেপে এবং চোয়াল পড়েছে কঠিন চাপ। আপনি যখন মন দিয়ে শুনছেন তাঁর নীচু গলায় সুন্দর লেহানে কথাবার্তা, যা এমন একজন মানুষের কণ্ঠস্বর যিনি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এবং কথাকে শব্দ হয়ে উঠতে দেয়ার আগেই প্রত্যেকটি কথাকে তাঁর জিবের উপর ওজন করে দেখতে অভ্যস্ত –আপনার মনে হবে, আপনি এমন একলোকের সংগে কথা বলছেন যাঁর পেছনে রয়েছে ত্রিশ বছর স্টাফ অফিসার ও পদস্থ সামরিক কর্মকর্তার জীবনঃ এবং আপনার বিশ্বাস করা কঠিন হবে যে, মাত্র ছয় বছর আগে রিজা খান ছিলেন একজন সার্জেন্ট এবং মাত্র তিন বছর আগে তিনি লিখেতে ও পড়তে শিখেছেন!
তা৭র প্রতি আসার ঔৎসুক্য এবং হয়তো তাঁর জাতির প্রতি আমার অনুরাগ ও তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কারণ তিনি প্রায় পীড়াপীড়ি করেই বললেন এই সাক্ষাৎ যেনো শেষ না হয় এবং আামাকে আর শুলেনবার্গকেও অনুরোধ করলেন – আমরা যেনো পরের হপ্তায় তেহরান তেকে কয়েক মাইল দূরে মানোরম মনোরম উদ্যান শেমরানে তাঁর গ্রীষ্মনিবাসে তাঁর সংগে চা খাই।
শুলেনবার্গের সংগে আমি ঠিক করলাম আমি প্রথম তাঁর কাছেই আসবো (বেশির –ভাগ বিদেশী দূতের মতোই তিনিও গ্রীষ্মকালটি কাটাচ্ছিলেন শেমরানে) এবং আমরা দুজন একত্রে যাবো প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে। কিন্তু কার্যত আমি পৌছুতে পারলাম না ঠিক সময়ে। কয়েকদিন আগে আমি শিকারের জন্য কিনেছি দুটি তাজী ঘোড়াসহ চার চাক্কার একটি ছোট্ট গাড়ি। ঘোড়াগুরি যে কী রকম তেজী ছিলো তা সম্পূর্ণ ধরা পড়লো তেহরানের বাইরে কয়েক মাইল দূরে, যখন কোনো একটা বদ প্রবৃত্তি বশে ওরা এমন একরোখা বেঁকেবসরো যে, কিছুতেই সামনে আগাবেনা, বরং ঘরে ফিরে যাবার জন্য ওরা জেদ করতে লাগলো। প্রায় কুড়ি মিনিট আমি ওদে সাথে সংগ্রাম করি। আখেরে আমি ইবরাহিমকে ঘোড়া এবং গাড়ি ঘরে ফিরে নিয়ে যেতে বলে পয়দল রওয়ান হই, অন্য কোনা যানবাহন পাওয়অ যায় কিনা তারই খোঁজে। দুমাইর পায়ে হাঁটার পর আমি এসে পৌছুই একটি গ্রামে; সেখানে ভাগ্রক্রমে পেয়ে গেলাম একট ‘দ্রসকী’, নিচু চার চাক্কাওয়ালা খোলা ঘোড়ার গাড়ি। কিন্তু যখন আমি জার্মান দূতবাসে পৌছলাম তখন নির্দিষ্ট সময় থেকে আমার প্রায় দেড় ঘন্টা দেরী হয়ে গেছে। আমি দেখতে পেরাম শলেনবার্গ ক্রদ্ধ বাঘের মতো পায়চারী করছেন এদিক-ওদিক; তাঁর চেহারায় স্বাভাবিক নম্রতা একদম নেই; তাঁর প্রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত এবং তাঁর শৃঙ্খলাবোধের বিচারে সময় রক্ষা না করার অপরাধ অধার্মিকতার চাইতে কম ছিলো না। আমাকে দেকেই তিনি ক্রোধে ফেটে পড়েলেনঃ ‘তুমি এ পারো না, একজন প্রধানমন্ত্রীর সংগে তুমি এ করতে পারো না! ‘তুমি ভুলে গেছো যে, রিজা খান একজন ডিকটেটর এবং আর সকল ডিকটেটরের মতোই অতি মাত্রায় স্পর্শকাতর?’
-‘কাউন্ট শুলেনবার্গ, আমার ঘোড়গুলি এ সূক্ষ্ণ পয়েন্টটি দেখতে পায়নি বলে মনে হয়’। -এছাড়া আমি কোনো জবাব খুঁজে পেলাম না, ‘চীনের সম্রাট হলেও আমার পক্ষে এর আগে পৌছুনা সম্ভব হতো না।’
এতো কাউন্টের রসবোধা আবার ফিরে আসে এবং তিনি বিপুল হাস্যে ফেটে পড়লেনঃ
-‘আল্লাহর কসম! এ রকম ব্যাপার আমার জীবনে ককনো ঘটেনি। তাহলে চলো যাই –পদাতিক সাম্ত্রী আমাদের মুখের উপর দরোজা বন্ধ না করে দিলেই হয় .. .।
সে তা করেনি। আমরা রিজা খানের প্রসাদে পৌছুনোর অনেক আগেই চায়ের মজলিস শেষ হয়ে গেছে এবং বাকি সব মেহমান বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু আমি যে প্রটোকল ভংগ করেছি, এজন্য রিজা খানকে মোটেই আহত হলো না। আমাদের দেরীর করণ শুনে তিনি উচ্চৈঃস্বরে বললেনঃ
-‘চমৎকার,আসি তোমার এই ঘোড়াগুলিকে দেখতে চাই। আমি মনে করি, নিশ্চয় এগুলি বিরোধী দলের। আমি জানি না এদের পুলিশ হেফাজতে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে কি না!
আমার এ অসময়ে আগমন, ইরানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রধানমন্ত্রী এবং একজন তরুণ সাংবাদিকের মধ্যে আনুষ্ঠানিকতা বহির্ভূত একটি সহজ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পথে বাধা না হয়ে সহায়কই হয়েছিলো। এর ফলে, পরবর্তীকালে আমি এমন স্বাধীনভাবে দেশের সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে পেরেছি যা বেশির ভঅগ বিদেশীকেই করতে দেয়া হয় না।
কিন্তু আলী আগার চিঠিতে সেই প্রথমদিকের দিনগুলির রিজা খান সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই, যিনি এমনিতরো সরলভাবে জীবন কাটাতেন যা প্রদর্শনী –প্রিয় ইরানীদের কাছে প্রায় অবিশ্বাস্যঃ এ চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে রিজা শাহ পাহলভীর , যিনি ১৯২৫ সানে আরোহণ করেন ময়ূর সিংহাসনে। এতে উল্লে খ রয়েছে রাজার কখা যিনি বিনয় নম্রতার সমস্ত ভানই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন এবং এখ চাইছেন কামাল আতাতুর্কের অনুকরণে তাঁর প্রাচীন প্রাচ্য দেশে একটি সাড়ম্বর অহংকারী প্রতীচ্য মুখাবয়ব গড়ে তুলতে .. .
আমি এখন চিঠির শেষ কথা গুলিতে আসছিঃ
-‘প্রিয় দোস্ত, আপনি যদিও এখন পবিত্র মদীনাতুন্নবীতে আছেন, তবু আমি বিশ্বাস করি, আপনি আপনার এই নালায়েক দোস্ত এবং তার দেশকে ভোলেননি এবং কখনো ভুলবেন না।’
হে আলী আগা, আমার তরুণ বয়সের দিনগুলি দোস্ত – ‘আমার হৃদয়ের আলো ’এই বাকভংগীতেই আপনি নিজে হয়তো বলতেন, আপনার চিঠি আপনার চিঠি আমাকে স্মৃতিতে মাতাল করেছে; কারণ আমি পারস্যমতাল হয়ে পড়েছিলাম যখন আমি আপনার দেশকে জানতে শুরু করি, সেই পুরানো নিস্প্রভ রত্ন, যা স্থাপিত হয়েছে পুরাকালের স্বর্ণ, চিড় খাওয়া মর্মর ধূলাবালি এবং ছায়ায়, আপনার বিষণ্ণ দেশের সকল দিন রাত্রির, আপনার কওমের গাঢ় কালো স্বপ্নিল চোখের ছায়াপটে.. .
কুর্দীস্তানে পাহাড়গুলি পেছনে ফেলে যাওয়ার পর আমি যে প্রথম ইরানী শহরটি দেখতে পাই সেই কিরমানশহর কথা আমার মনে পড়ছে। এক অদ্ভুদ নিস্প্রভ অস্বচ্ছ আবহাওয়া ঘিরে আছে শহরটিকে, যেনো ঢাকা দেওয়া , অবনমিত –জীর্ণ, ছন্নছাড়া একথা না-ই বললাম। এতে সন্দেহ নেই- প্রতীচ্যের প্রত্যেকটি শহরেই দারিদ্র দৃশ্যমান সমতলের নিকটেই থাকে। ইউরোপের যে-কোন শহর থেকে দারিদ্র এখানে অনেক বেশি চোখে পড়ে। কিন্তু এর সাথে ইতিমধ্যেই আমি ছিলাম অভ্যস্ত। অর্থনীতির অর্থে এ ঠিক দারিদ্র নয়, যা এতা প্রবলভঅবে প্রকাশ পেয়েছে আমার নিকট; কারণ বলা হয় কিরমানশঅহ একটি সমৃদ্ধিশালী শহর। বরং এ হচ্ছে এমন এক ধরণের হতাশঅ যা প্রত্যক্ষভাবে আচ্ছন্ন করেছিলো ওদের, যার সংগে অর্থনৈতিক অবস্থার কোনো যোগ ছিলো বলে মনে হয় না।
এখানকার সবলোকেরই চোখ বিশার এবং কালো। নাকের সন্ধিস্থলের উপর এসে মিলে যাওয়া পুরু কালো ভ্রুর নিচে ভারী চোখের পাতায় পর্দার মতো ঢাকা এই চোখ।ওদের বেশিরভাগই দেখতে চিকন –চাকন (আমি ইরানে কোনো মোটা লোক দেখেছি বলে মনে পড়ে না)। ওরা কখনো শ্বদ করে হাসে না এবং ওদের নীরব স্মিত হাস্যে এমন একটা অস্পষ্ট ব্যংগাত্মক ভাব রয়েছে যা প্রকাশ করে যতোটুকু গোপন করে তার চাইতে অনেক বেশি। মুখাবয়বে কোনো গতিময়তা নেই, নেই আকার ইংগিতে কথা বলার প্রয়াস; কেবলি নিশ্চুপ পরিমিতি গতি ও অংগভংগী- মনে হয় ওরা সবাই যেন মুখোশ পরে আছে।
প্রচ্যের সকল নগরীর মতোই এখানকার শহুরে জীবনের কেন্দ্র হচ্ছে বাজার। একজন অপরিচিত লোকের কাছে বাজারটি ভেসে ওঠে বাদামী, সোনালী-বাদমী এবং গারিচা-লাল কোমলীকৃত মিশ্রণরূপে –যেখানে রয়েছে ইস্তস্তত ঝকঝকে তামার থালা ও গামলা এবং হয়তো বা কাফেলার সরাইখানা দরোজার উপরে চিত্রিত হালকা- -নীল চীনামাটির বাসনের রং, যাতে চিত্রিত রয়েছে কালো চক্ষু যোদ্ধা ও ডানওয়ালা আজদাহার ছবি। আপনি যদি আরো একটু মনোযোগ দিয়ে তাকান, বাজারে আবিষ্কার করবেন দুনিয়ার সকল রং-কিন্তু এ বিচিত্র রংগুলির কোনোটিই সব কিছুকে টেনে নিচ্ছে এক সাথে। ছাদের ধনুকের মতো বাঁকানো তোরণগুরি ছেদা করা হয়েছে নির্দিষ্ট ব্যবধানে যাতে করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফাঁক দিয়ে ভেতরে আসতে পারে দিনের আলো। এসব ছিদ্রের মধ্য দিয়ে জমাট পদার্থ হয়ে ওঠে এবং অস্বচ্ছ তীর্যক আলোক-স্তম্ভের মতো দেখায়ে; মানুষ যে ওসবের ভেতর দিয়ে চলচে তা মনে হয় না, বরং এইগুলি –এই উজ্জ্বল স্তম্ভগুরিই যেনো এইসব ছায়া মানুষের ভেতর দিয়ে আগিয়ে যাচ্ছে .. .
কারণ, এই বাজারের লোকগুলি ভদ্র এবং ছায়ার মত নীরব। যদি কোনো ব্যবসায়ী কোনো পথচারীকে নিচু গলায় ডাকে, কেউই তার জিনিসপত্রের গুণকীর্তনের জন্য চীৎকার করে না বা গান গায় না, যা করা হয়ে থাকে আরবে বাজারগুলিতে। এখানে জীবনের পায়চারী নিঃশব্দ, মোলায়েম। মানুষ এখানে অন্যকে কনুই মেরে বা ধাক্কা দিয়ে আগায় না। ওরা খুবই বিনীত এবং এমনি সে বিনয়, যা মনে হবে নম্রতায় নুয়ে আছে আপনার দিকে; কিন্তু আসলে তা আপনাকে রাখে এক হাত দূরে। পষ্টতই ওরা লোক হিসাবে খুব চালাক এবং অপরিচিত লোকের সাথে কথা বলতে ওদের কোনো আপত্তি নেই; কিন্তু কথা বলে কেবল ওদের ঠোঁট। ওদের অন্তর পশ্চাৎভুমিতে অন্যত্র কোথঅও দাঁড়িয়ে থাকে – দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ৈ অপেক্ষা করে, ওজন করে নিরসক্তভাবে.. .
চায়ের দোকানে বসে আছে মজুর শ্রেণীর কিছু লোক, খড়ের মাদুরের উপর –হয়তো ওরা হস্তশিল্পী দিনমজুর, কাফেলার উট বা ঘোড়া –গাঁধার চালক –সবাই এক সংগে ঘেষাঘেষি করে বসে আছে জ্বলন্ত কয়লা ভর্তি লোহার কাড়াইয়ের চারপাশে। লম্বা লম্বা দুটি পাইপ, আর তার সঙ্গে চীনামাটির কলকে পরিবেশন করাহচ্ছে তাদের নিকট; আফিমের মিষ্টি মিষ্টি গন্ধে ঘরের বাতাস আছে। তারা কোনো শব্দ উচ্চারন না করে পা্প টেনে চলে প্রত্যেক একবার লম্বা টান দিয়ে পাইপটি তুলে দিচ্ছে তার পাশের লোকটির হাতে; আর সেই সময়েই এমন একটি জিনিস দেখতে পেলাম যা আগে আর কখনো দেখিনি। অনেক, অনেক লোক আফিঙ খাচ্ছে, কেউ কেউ বেশ প্রাকশ্যে আর কেউ কেউ কিছুটা কম প্রকাশ্যে; দোকানী বসে থাকে তার গর্তের মতো দোকানটিতে;সরাইখানা তোরণওয়ালা প্রবেশদ্বারের নিচে বসে থাকে ভবগুরে নিষ্কর্মা কোনো লোক; তাম্রকার মুহূর্তের অবকাশ যাপন করছে তার কারখানা। ওরা সকলেই এখন পাইপ টানছে। একই রকম উদাস, কিছুটা ক্লান্ত মুখে, সীমাহীন, অবলম্বনহীন শূন্যতার দিকে নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে..
পুরু ঝুড়িসমেত টাটকা সবুজ পোস্তদান বাজারের সব জায়গায় বিক্রি করছে বিত্রেতারা এবং বাহ্যত একইভাবে তা খাচ্ছে লোকেরা। এ হচ্ছে আফিম খওয়ার আরেকটি মৃদু রূপ। এমন কিন, দরোজায়-দরোজায় কোণায়-কোণায় দাঁড়িয়ে বসে ছেলেরা পর্যন্ত কাচ্ছে পোস্তাদানা। দুই বা তিনজনের মধ্যে ওরা নিজেরা ভাগ করে নিচ্ছে মজার বস্তুটি, পরস্পরের প্রতি সেই বয়স্ক মানুষের সহনশীলতা নিয়ে, শিশুসুলভ স্বার্থপরতা না দেখিয়ে –শিশুসুলভ আনন্দ বা উৎফুল্লতাও প্রদর্শন না করে। কিন্তু েএর চাইতে ভিন্নই বা ওরা কিভাবে হতে পারতো? ওদের জীবনের একেবারে শুরুতেযখন ওরা কাঁদতো এবং ওদের মা-বাপকে বিরক্ত করতো তখন ওদের খাওয়ানো হতো পোস্তাদানা থেকে তৈরি এক কড়া পানীয়। ওরা যখন বড় হয় এবং রাস্তায় ছোটাছুটি করতে শুরু করে তার আগেই ওদের মধ্যে প্রশান্তি, দুর্বলতা ও দয়ামায়ার সীমারেখা অস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এবং তখনই আমি বুঝতে পারলাম কী সেই জিনিস যা আমাকে এতো বিচলিত করেছিলো প্রবলভাবে, যখন আমি প্রথম দেখেছিলাম ইরানীদের ক্লান্ত বিসণ্ণ চোখ। ওদের মধ্যে একটি করুণ নিয়তির লক্ষণ আমি টের পেলাম , মজলুম মানুসের মুখে যেমন লেগে থাকে দুঃখের করুণ হাসি তেমনি; একইভাবে ওদের সংগে জড়িত রয়েছে আফিম; এ ওদের নম্রতার সংগে, ওদের অন্তরের ক্লান্তির সংগে জড়িত; এমনকি ওদের বৃহৎ দারিদ্র ও মহৎ মিতব্যয়িতার সংগেও এর সম্পর্ক রয়েছে। সম্ভবত, ততো বেশি পাপ বলে তা মনে হলো না –যতোটা তা একটা অভিব্যক্তি এবং হয়তো সাহায্যও! সাহায্য কিসের বিরুদ্ধে? প্রশ্নের বিস্ময়কর এক জগত।
আমি প্রতম যে ইরানী নগরীর সংগে পরিচিত হই সেই কিরমান –শহর স্মৃতি ও ছবির মধ্যে আমার মন বিচরণ করলো এতোক্ষণ। কারণ সে ছবিগুলি নানারূপ কিন্তু সব সময়েই মূলত অপরিবর্তিত অবস্থায় আমার সামনে ছিলো। আমি ইরানে যে দেড়টি বছর কাটাই তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি মেলায়েম সর্বব্যাপী বিষণ্ণতা ছিলো সর্বত্রই এর বৈশিষ্ট্য। গ্রামে শহরে, মানুসের রোজকার কাজে তাদের বিভিন্ন ধর্মী বিশ্বাসের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় দুঃখ-শোকের একটি গাঢ় রংঃ ১৩০০ বছর আগে যেসব মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিলো তার জন্য রোদন, নীরব জামাতা আলী এবং আলীর দুই পুত্র হাসন এবং হোসেনের মৃত্যুর জন্য মাতম ওদের কাছে ইসলামের লক্ষ্য কি এবং মানুষের জীবনকে ইসলাম কোন পতে পরিচালিত করতে চায় তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে.. .
বহু সন্ধ্যায় বহু শহরে আমি দেখেছি, নারী এবং পুরুশের বিভিন্ন দল কোনো রাস্তায় জমায়েত হয়েছে এক মুসাফির দরবেশের চারপাশে, যিনি একজন ধর্মীয় সাধু পুরুষ, তাঁর পরণে সাদা পোষাক, পিঠের উপর চিতাবাঘের ছাল, ডান হাতে লম্বা হাতলওয়ালা কুড়াল এবং বাঁ হাতে নারকেলের মালার ভিক্ষা-পাত্র।তিনি আবৃত্তি করে চলেছেন অর্ধেক গানের মাধ্যমে, অর্ধেক কথায় সপ্তম শতকে রসূলুল্লাহর ইন্তেকালের পর খিলাফতনিয়ে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিলো তারই উপর একটি গাঁথা-ঈমান, রক্ত এবং মৃত্যুর এক শোকাবহ কাহিনী এবং সবসময়েই এর রূপ অনেকটা এই রকমঃ
শোনে লোকসকল, আল্লাহ যাদের মনোনীত করেছিলেন তাঁদের ভাগ্যে কি ঘটেছিলো এবং নবী বংশের রক্ত কিভাবে পৃথিবীর উপর বইয়ে দেওয়া হয়েছিলো সে কাহিনী শোনোঃ
এক সময় নবী ছিলেন যাঁকে আল্লাহ তুলনা করেছিলেন জ্ঞানের নগরীরূপে এবং সেই জ্ঞানের নগরীর প্রবেশদ্বার ছিলেন তাঁর অনুসারীদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত সর্বশ্রেষ্ঠ বীর, তাঁর জামাতা আলী-পৃথিবীর জ্যোতি, নবীর পয়গামে অংশীদার, যাঁকে বলা হতো ‘আল্লাহর সিংহ’।
যখন নবীজি ইন্তেকাল করলেন তখন আল্লাহর সিংহ ছিলেন তাঁর সত্যিকার উত্তরাধিকারী, কিন্তু দুষ্টু লোকেরা সেই সিংহের আল্লাহ –নির্দেশিত অধিকার হরণ করে এবং অন্য একজনকে বানায় নবীর খলীফাঃ এবং প্রথম বিনা- অধিকারে জবর দখলকারের মুত্যুর পর তারই মতো দুষ্ট প্রকৃতির আরকজন তার উত্তরাধিকারী হয় এবং পরে আরো একজন।
এবং কেবল এই তৃতীয় তসরুফকারীর ধ্বংসের পর আল্লাহর ইচ্ছা ব্যক্ত হয়ে পড়ে এবং আল্লাহর সিংহ তাঁর এই ন্যায্য স্থানে উপনীত হন আমীরুল ম’মিনীন হিসাবে।
কিন্তু আলী এবং আল্লাহর শত্রুরা ছিলো সংখ্যায় অনেক এবং একদিন যখন তিনি সালাতে সিজদায় গিয়েছেন প্রভুর সম্মুখেতখন এক ঘাতকের তরবারীর আঘাতে তিনি নিহত হন। এই ভয়াবহ পাপ-কর্মে পৃথিবী কেঁপে ওঠে বেদনায়, পাহাড় পর্বত ক্রন্দন করে এবং অশ্রু বিসর্জন করে শিলারশিঃ
হে আল্লাহ, তোমার লানত বর্ষিত হোক অন্যায়চারীদের উপর এবং চিরস্থায়ী আজাব ওদের গ্রাস করুক।
আবার এক পাষণ্ড জালিম দেখা দিলো এবং আল্লাহর সিংগের পুত্র হাসান এবং হোসেন ,হযরত ফাতেমার দুই পুত্রকে সে বঞ্চিত করলো নবীর সিংহাসনে তাঁদের ন্যায্য উত্তরাধিকার থেকে। হাসানকে ষড়যন্ত্র করে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হরো এবং হোসাইন যখন ধর্ম রক্ষার্থে দাঁড়ালেন, তাঁর পরম সুন্দর জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেওয়া হলো কারবালার প্রান্তরে যখন তিনি যুদ্ধের পর তৃষ্ণা মেটাবার জন্য হাঁটু গেঁড়ে বসেছিলেন একটি জলাশয়ের কাছে। ওহো, আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক পাষণ্ডদের উপর আর ফেরেশতাদের অশ্রু একসময় চুম্বন করেছিলেন রসূলুল্লাহ –নির্দয়ভাবে কেটে ফেলা হলো এবং তাঁর মস্তকহীন লাশ নিয়ে আসা হলো তাঁর রোরুদ্যমান সন্তানদের নিকট, যাঁরা অপেক্ষায় ছিলেন তাঁদের পিতার প্রত্যাবর্তনের।
এবং যখন থেকে বিশ্বাসীরা আল্লাহর লানত কামনা করে আসছেন জালিমদের উপর এবং আলী, হাসান এবং হোসাইনের মৃত্যুর জন্য মাতম করে চলেছেন। আর হে বিশ্বাসীরা, তাঁদের মৃত্যুর জন্য তোমরা উচ্চৈঃস্বরে আহাজারী করো, কারণ যারা নবীর বংশধরদের জন্য কাঁদে আল্লাহ তাদের গুনাহ মাফ করে দেন.. .
আর এভাবে গাওয়া গাঁথা যে-সব রমণী শনছে তাদের মধ্যে সৃষ্টি করে আকুল কান্না, আর শুশ্রুমন্ডিত মানুষের মুখের উপর দিদয়ে নীরবে গড়াতে থাকে অশ্রুধারা.. .
আসলে, ইসলামী বিশ্বের যে-ক্ষত কখনো শুকায়নি সে ক্ষত সেই প্রথমদিকে যেসব ঘটনা সৃষ্টি করেছিলো সে –সবের সত্যিকার ঐতিহাসিক চিত্রের সাথে এই বাড়াবাড়ি শোকের মোটেই সম্পর্ক নেই। সে ক্ষতটি কী? মুসলিম সম্পদায় দুভা’গে বিভক্ত –সুন্নী এবং শিয়া দুই মাজহাবে –সুন্নীরা , যাদের নিয়ে মুসলি জাতিগুলির বেশিরভা্গই গঠিত, যারা খলীফার পদের জন্য নির্বাচনের নীতিতে সুদৃঢ়; শিয়ারা, যারা দাবি করে রসূলূল্লাহ তার তাঁর জামাতা হযরত আলীকে তাঁর ন্যায় সঙ্গত উত্তরাধিকারী এবং খলীফা মনোনীত করেছিলেন। আসলে কিন্তু রসূলূল্লাহ তাঁর কোনো খলীফা মনোনীত না করেই ইন্তেকাল করেন, যে কারণে মুসলিম উম্মাহর বিপুল সংখ্যাগুরু কর্তৃক তাঁর সবচেয়ে বয়স্ক এবং বিশ্বস্ত সহচর হযরত আবু বকর ‘খলিফা’ নির্বাচিত হন।আবু বকরের পর খলীফা হন উমর এবং উমরে পর উসমান। উসমানের মৃত্যুর পরই কেবল আলী খলীফা নির্বাচিত হন। আলীর পূর্ববর্তী তিন খলীফা সম্পর্কে মন্দ কিম্বা খারাপ কিছু আমি আমার ইরানের সেই দিনগুলিতে ও খুঁজে পাইন। ওরা রসূলূল্লাহ পরে ইসলামের মহত্তম মানুষ ছিলেন সন্দেহাতীতভাবেই এবং বহু বছর ধরে ওঁরা ছিলেন তাঁর ঘনিষ্টতম সহচর। ইসলাম মানুষকে যে অধিকার দিয়েছে স্বাধীনভাবে সে অধিকার প্রযেগ করেই মুসলিম উম্মাহ নির্বাচন করেছিলেন তাঁদের । তাঁরা জবর দখলকার ছিলেন না। এই তিনি খলীফা কর্তৃক ক্ষমতা লাভ নয়, বরং জনগণের এ সব নির্বাচনের ফল আলী এবং তাঁর অনুসারীরা সর্বান্তকরণে গ্রহণ করতে রাজী না হওয়ার ফলেই শুরু হয় পরবর্তী ক্ষমতার লড়াই, আলী নিহত হন এবং পঞ্চম খলীফা মাবিয়ার নেতৃত্বে মূল প্রজাতন্ত্রী ধরনের ইসলামী রাষ্ট্রের রূপান্তর ঘটলো বংশগত রাজতন্ত্রে –চূড়ান্ত নেতৃত্বে মূল পরিণতি ঘটলো কারবালা ময়দানে হোসাইনের শাহাদাতে।
হ্যাঁ, এসবই আমি জানতাম ইরানে আসার আগেই, কিন্তু আলী, হাসান এবং হোসাইনের নাম উচ্চারণের সংগে সংগেই ইরানীদের মধ্যে ১৩০০ বছর আগেই সেই পুরানা মর্মন্তুদ কাহিনী আজো যে অপরিসীম ভাবাবেগ সৃষ্টি করে তাতে আমি বিস্মিত হই। বিস্ময়ের সংগে আমি নিজেকে জিজ্ঞাস করথে থাকিঃ ওরা যে শিয়া মতবাদকে এভাবে আপন মনে করে আলিংগন করছে তার কারণ কি ইরানীদের স্বভাবজাত বিষাদ এবং ওদের নাটকীয়তাবোধ? না কি শিয়া মতবাদের উদ্ভবে যে ট্রাজিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে তাই ইরানীদের এই গভীর বিষাদের জন্ম দিয়েছে?
ক্রমে দীর্ঘ কয়েকটি মাস ধরে আমার মনে এর একটি চমকপ্রদ জবা ষ্পষ্ট আকারে নেয়।
স্প তম শতকের মাঝামাঝি উমরের সৈন্যবাহিনী যখন প্রাচীন সাসানীয় সাম্রাজ্য দখল করে ইসলামী জীবনাদর্শকে সংগে নিয়ে, তার অনেক পূর্বেই ইরানের জরতুস্ত্রীয় মতবাদ পরিণত হয়েছে একটি অনড় অনুষ্ঠান –সর্বস্বতায়, আর এ কারণে, আরব থেকে যে বেগমান নতুন ভাব –বন্যা এলো তাকে কার্যকরভাবে তা বাধঅ দিতে পারলো না। কিন্তু ইরানের বুকে আরব বিজয়ের বিস্ফোরণ যখন ঘটেছে সেই মুহূর্তে ইরান অতিক্রম করছিলো সামাজিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চাঞ্চল্যের যুগ, যে –চাঞ্চল্যের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছিলো জাতীয় পুনর্জাগরণের এক প্রতিশ্রুতির আভাস। আরব অভিযানের ফলে একটি মানসিক, সাংগঠনিক পুনর্জাগনের এই আশা চূর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যায় এবং ইরানীরা তাদের বিকাশের নিজস্ব ধারণা সাথে তখন থেকেই নিজেদেরকেখাপ খাইয়ে নেই।
অন্য আরো বহু দেশের মতোই ইরানে ইসলামের আবির্ভাব বিস্ময়কর সামাজিক অগ্রগতির পরিচায়ক। এর আঘাতে ইরানের সনাতন বর্ণপ্রথা ভেংগে চুরমার হয়ে যায়। এর স্থলে ইসলাম জন্ম নিলো স্বাধীন সমান মানুসের এই নতুন জনগোষ্ঠীর। সাংস্কৃতিক যে-সব শক্তি দীর্ঘকাল ধরে ছিলো সুপ্ত, অনুচ্চারিত ইসলাম সেগুলির জন্য উন্মুক্ত করে দিলো নব নাব প্রণালী। কিনউত তা সত্তেও দারায়স ও জারেক্সেসের গর্বিত বংশধরেরা কখনো ভুলতেপারলো না যে, তাদরে জাতীয় জীবনে ঐতিহাসিক নিরবচ্ছিন্নতা, তাদের গতকাল এবং আজকের মধ্যে মৌলিকসম্বন্ধ হঠাৎ টুটে গেছে। জেন্দাবেস্তীয় ধর্মের অদ্ভুত দ্বৈতবাদে এবং আব –আতশ – খাক –বাদ এই চারটি উপাদানের প্রায় সর্বেশ্বরবাদী পূজায় যে জাতীয় অন্তরংগতম চরিত্র খুঁজে পেয়েচিলো তার অভিব্যক্তি, সেই জাতিই আজ সম্মখীন হলো ইসলামের কঠোর আপসহীন তাওহীদের এবং পরম সত্যের জন্য তার উন্মাদনার। ইরানীয়দের পক্ষে ইসলামের জাতিচেতনা অতিক্রম করে যাওয়ার ধারণার নিকট তাদের গভীরমূল জাতীয় চেতনা সমর্পণ এ উত্তরণ ছিলো অতিমাত্রায় আকস্মিক এবং যন্ত্রণাদায়ক। এই নতুন ধর্মকে তারা খুব দ্রুত এবং জাহিরা স্বেচ্ছায় কবুল করলেও ওরা ওদের অবচেতন মনে ইসলামী ভাবাদর্শের এই বিজয়কে জাতি হিসাবে ইরানোর পরাজয় বলে গণ্য করতে থাকে, এবং ওরা পরাজিত হয়েছে আর ওদের প্রাচীন সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের পটভূমি থেকে চিরকালের জন্য ওদের উপড়ে ফেলা হয়েছে এই উপলবদ্ধি – সকল অস্পষ্টতা সত্ত্বেও সুগভীর এই উপলদ্ধি-পরবর্তী শতকগুলিকে ওদের জাতীয় আত্মবিশ্বাস বিনাশের কারণ হয়ে ওঠে। অন্য বহু জাতির জন্য ইসলাম গ্রহণের আশু ফল হলো সাংস্কৃতিক বিকাশের পক্ষে একটি অতিশয় ইতমূলক উদ্দীপনা। কিন্তু ইরানীদের বেলায় এর প্রথম- এবং একদিক দিয়ে বলা যায় সবচেয়ে স্থায়ী প্রতিক্রিয়া হলো, গভীর অবমাননাবোধ ও অবদমিত বিক্ষোভ।
এই বিক্ষোভকে অবচেতনের ভাঁজের মধ্যে চাপা দিয়ে ঢেকে রাখতে হলো; কারণ এরই মধ্যে ইসলাম হয়ে উঠেছে ইরানের নিজের ধর্ম। কিন্তু আরব-বিজয়ের প্রতি ঘৃণাবশে ইরানীরা সহজাতভাবে তারই আশ্রই নেয়, মনস্ততত্ত্ব যাকে বর্ণনা করে ‘অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ’ বলেঃ ওরা মনে করতে লাগলো, ওদের আরব –বিজয়ীরা ওদের নিকট যে ধর্ম এনেচে তা একান্তভাবে আরবদেরই নিজস্ব ধর্ম। এ উদ্দেশ্য ওরা খুব সূক্ষ্ণভাবেই আরবদের যুক্তিভিত্তিক, মরমী রহস্য- বর্জিত আল্লাহ- উপলব্ধিকে দিলো এর সম্পূর্ণ বিপরীত এক রূপঃ মরমী গোঁড়ামী এবং বিষণ্ণ ভাববেগে। যে ধর্ম ছিলো আরবদের নিকট বর্তমান, বাস্তব এবং স্থৈর্য ও স্বাধীনতার উৎস, ইরানীদের মনে তাই রূপ নিলো অতিপ্রাকৃত এবং প্রতীকের গুঢ় আর্তিতে। আল্লাহ যে সমস্ত কিছুর উর্ধ্বে এবং তাঁর এই সমস্ত কিছু ছাড়িয়ে যাওয়া বিরাটত্ব যে মানুষের ধারণার অতীত, ইসলামের এ নীতিটিকে রূপান্তরিত করা হলো বিশেষভাবে নির্বাচিত মানুষের মাধ্যমে আল্লাহ নিজেকে দৈহিকভাবে ব্যক্ত করেন, এই মরমী মতবাদের (ইসলাম-পূর্ব ইরানে এ ধরনের অনেকগুলো মতবাদের অস্তিত্ব ছিলো) । এই মতবাদ অনুসারে নির্বাচিত মানুষদের মাধ্যমে আল্লাহ নিজেকে এ উদ্দেশ্যে প্রকাশ করেন যে,এ সব ব্যক্তি তাঁদের বংশধরের নিকট এই ঐশী সত্যের সার দিয়ে যাবেন । এ ধরনের একটা প্রবণতা যেখানে ছিলো সেখানে শিয়া মতবাদের সমর্থন খুবই একটা গ্রহণযোগ্য পন্থা হিসাবে গৃহিত হয়। কারণ, আলী এবং তাঁর বংশধরগণকে শিয়ারা যেভাবে ভক্তি করে, বলা যায় তাঁদের প্রতি প্রায় বেদত্ব আরোপ করে থাকে, তার মধ্যে যে মানুষরূপে আল্লাহর দেহ ধারণের এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে তাঁর বারবার অবতরনের ধারণার বীজ গোপন করয়েছে, এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই: আর এটি এমনি একটি ধারণা যা ইসলামের নিকট সম্পূর্ণ অজ্ঞাত অথচ ইরানী হৃদয়ের নিকট খুবই অন্তরংগ জিনিস।
নবী মুহাম্মদ যে কাউকে তাঁর স্থলবর্তী মনোনীত না করে ইন্তেকাল করেন, এমন কি, তাঁর মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে কোনো একজন মনোনীত করে যাওয়ার পরামর্শ্ দেওয়া হলে তিনি েয মনোনয়ন দান করতে অস্বীকার করেছিলেন, এ কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়। তিনি তাঁর মনোভাব দ্বারা প্রথমে এ কথাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, নবুয়তের রূহানী দিকটি এমনি একিট জিনিস যা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যায় না, দ্বিতীয়ত উম্মাহর ভাবী নেতৃত্ব হবে জনসাধারণ কর্তৃক অবাধ নির্বাচনের ফল এবং নবীর কেনো নির্দেশের ফল নয়। (তিনি স্থলবর্তী নিয়োগ করলে স্বাভাবিকভাবে তার অর্থ তাই মনে হতো)। আর এভাবেই তিনি উম্মাহর নেতৃত্বে কখনো সেকুলার ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে কিংবা আল্লাহ কর্তৃক রসূলের ‘স্থলবর্তী নিয়োগ প্রেরণার মতো কিছু’ হতে পারে – সুচিন্তিতভাবে এ ধারণাকে বাতিল করে দেন। অথচ শিয়া মতাবাদদের আসল লক্ষ্য হচ্ছে এই। ইসলামের মূল শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিভংগি নিয়ে এই মতবাদ যে কেবল রসূলের স্থলবর্তিতার উপরেই জোর দিলো তাই নয় বরং তার স্থলবর্তী হওয়ার অধিকার কেবলমাত্র ‘নবী বংশে’রই আছে অর্থাৎ তাঁরা চাচাতো ভাই এভং জামাতা আলী এবং তাঁর সন্তান-সন্ততিরাই কেবল তাঁর স্থলবর্তী হতে পারবেন, এ অধিকারও তারা সংরক্ষিত রাখলো নবী বংশের জন্য।
ইরানীদের মরমী প্রবণতার সংগে এর সংগতি রয়েছে ষোল আনা। কিন্তু রসূলুল্লাহর রূহানী সত্তা আলী এবং তাঁর পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে বেঁচে আছে এই দাবি যারা করলো, ইরানীরা তাদের দলে অত্যুৎসাহের সংগে যোগ দিয়ে কেবল যে একিট মরমী বাসনা পূরণ করলো তা নয়, তাদের এই সিদ্ধান্তের পেছনে আরো একটি অবচেতন মতলবও কাজ করেছে। আলী যদি রসূলূল্লাহর আইন –সংগত উত্তরাধিকারী এবং স্থলবর্তীই হয়ে থাকে, তাহলে অন্য তিনজন খলীফাই ছিলেন নিঃসন্দেহে অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখলকারী এবং তাঁদের মধ্যে ছিলেন উমর –সেই উমর যিনি ইরান বিজয করেছিলেন। সাসানী সাম্রাজ্যকে যে বিজেতা জয় করেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে জাতীয় ঘৃণার এখন ধর্মীয় অর্থে, ব্যাখ্যা করা সম্ভব যে –ধর্ম হয়ে উঠেছে ইরারের ধর্ম্। আলীঅ এবং তাঁর পুত্র হাসন ও হোসাইনকে ইসলামের খলীফা হওয়ার ইলাহী –নির্দেশিত অধিকার থেকে উমর ‘বঞ্চিত’ করেছেন এবং এভাবে বিরোধিতা করোছেন আল্লাহরই ইচ্ছার –কাজেই আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি আনুগত্যস্বরূপ সমর্থন করতে হবে আলীর দলকে। এভাবে জাতীয় বিরোধিতা থেকে জন্ম নিলো একটি মতবাদ।
ইরানীরা যে এভাবে শিয়া মাতবাদকে তাদের মনের সিংহাসনে বরণ করে নিযেছে এর মধ্যে আমি আরবদের ইরান বিজায়ের বিরুদ্ধে ইরানীদের একিট নিঃশ্বদ প্রতিবাদ দেখতে পেলাম। এখন আমি বুঝতে পারলাম কেন ইরানীরা অন্য দুই ‘ক্ষমতা অপহরণকারী’ আবু বকর এবং উসমানের চেয়ে উমরকে এত বেশি ঘৃণার সাথে লানত দিয়ে থাকে। মতবাদের বিচারে প্রথম খলীফা আবু বকরকেই গণ্য করা উচিত ছিলো প্রধান সীমালংঘনকারী –কিন্তু উমর যে ইরান জয় করেছিলেন.. .
তাহলে, ইরানে আলী পরিবারকে বিস্ময়কর গভীরতার সাথে যে ভক্তি করা হয় তার কারণ এই! ইরানের এই কান্ট আরবের ইসলামের উপর ইরানী প্রতিশোধ গ্রহণেরৃ একটি প্রতীক (যে ইসলাম মুহাম্মদসহ যে কোনো মানুষের প্রতি দেব্ত্ব আরোপের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে অমন আপোসহীনভাবে)। এটা সত্য যে,শিয়া মতবাদের জন্ম ইরানে হয়নি; অন্যান্য মুসলিম দেশেও শিয়া মতাবলম্বঅ বিভিন্ন দল রয়েছে। কিন্তু সকল মানুষের আবেগ ও কল্পনার উপর এমন পরিপূর্ণ প্রভাব আর কোথাও বিস্তার করতে পারেনি এ মতবাদ।
ইরানীরা যখন আলী, হাসান এবং হোসাইনের মৃত্যুর জন্য মাতম করে তখন তারা কেবল আলী পরিবারের ধ্বংসের জন্য কাঁদে না –তারা নিজেদের জন্য এবং তাদের অতীত গৌরব হারানেরা জন্যও কাঁদে. ..
এই ইরানীরা –ওরা এক বিষাদগ্রস্থ কওম। ওদের এই বিষণ্ণতা ইরানী ল্যণ্ডস্কেপ তখা বূদৃশ্যে প্রতিফলিত-প্রতিফরিত পোড়ো যমির অনন্ত বিস্তারে, নির্জন পাহাড়ী রাস্তা এবং রাজপথগুলিতে, মাটির তৈরি বাড়ির দূরে দূরে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গ্রামসমূহে, ভেড়ার পালগুরিতে,যাদের সন্ধ্যার দিকে তাড়িয়ে নেওয়া হয় কুয়ার দিকে, ধূসর তামাটে ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের মতো। শহর বন্দরে কোনো রকম চেষ্টা উচ্ছলাত ছাড়াই জীবন বিন্দু বিন্দু ঝরছে মন্থর গতিতে, নিরবচ্ছিন্ন ফোঁটায়-মনে হয়, সবকিছুই যেনো একটি স্বপ্নের নেকাব দিয়ে ঢাকা এবং প্রত্যেকের মুখে ফুটে রয়েছে এক অলস প্রতীক্ষঅর চাহনি। রাস্তায় কখনো শোনা যেতো না সংগীত। যদি সন্ধ্যায় কোনো তাতার সহিস কোনো সরাইখঅনায় হঠাৎ গলা ছেড়ে গেয়ে উঠতো শ্রোতা যেো তার অজান্তেই বিস্ময়ে উৎকর্ণ হতো। প্রকাশ্যে কেবল বহু দরবেশই গাইতো গানঃ এবং ওরা সবসময়ই আলী, হাসান এবং হোসাইন সম্পর্কে সেই একই পুরানো মর্মান্তিক গাঁধা গাইতো সুর করে। এই গানগুলিকে ঘিরে জাল বুনতো মৃত্যু এবং অশ্রু আর শ্রোতাদের মগজে তা প্রবেশ করতো খুব কড় শরাবের মতো। মনে হতো দুঃখ সম্পর্কে একটা ভীতি যে দুঃখ স্বেচ্ছায়,প্রায় লোভাতুরতার সাথেই গৃহীত-ঘিরে আছে লোকগুলিকে।
ইরানে গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় দেখা যেতো নারী এবং পুরুসেরা স্থির হয়ে বসে আছে যমীনের উপর। রাস্তার দুপাশ বরাবর বিশাল এলম গাছের ছায়ার নিচ দিয়ে যে খালগুলি চলে গেছে সেগুলির তীরে ওরা বসতো আর তন্ময় হয়ে চেয়ে থাকতো প্রবাহমান পানির দিকে। ওরা একে অপররের সাথে কথা বলতো না। ওরা কেবল পানির কুলকুল ধ্বনি শুনতে আর ওদের মাথার উপর দিয়ে বয়ে যেতো পাতার মর্মর ধ্বনি। যখনিই আমি ওদের দেখতাম আমার মনে পড়তো দাউদের স্তেস্ত্রের কথাঃ
ব্যবিলনের নদীগুলির তীরে, আমরা বসেছিলাম সেখানে আর রোদন করেছিরাম.. .
ওরা নহরগুলির কিনারে বসতো বিশাল বোবা অন্ধকার পাখির মতো, যেনো ওরা হারিয়ে গেছে প্রবাহমান পানির নীরব ধ্যানে। ওরা কি ভাবতো কেনো দীর্ঘ বহুকাল লালিত ধারনার কথঅ, যে ধারণা তাদেরই কেবল তাদের? ওরা কি প্রতীক্ষায় ছিলো? .. . কিসের?
এবং দাউদ গেয়েছিলেন, আমরা আমাদের বাণীগুলিকে ঝুলিয়ে রাখলাম উইলো বনের মধ্যে, উইলো শাখায়.. .।
তিন
-‘চলো জায়েদ’, আমরা যাই। এ কথা বলে আমি আলী আগার চিঠিখানা আমার পকেটে রাখি এবং আয-যুগাইবীকে বিদায় জানানোর জন্য উঠে দাঁড়াই।
কিন্তু তিনি মাথা নাড়িয়ে বলেন, ‘না ভাই, জায়েদকে এখানে কিছুক্ষনের জন্য আমার সাথে থাকতে দাও। ফেলে আসা এই মাসগুলিতে তোমার জীবনে যা কিছু ঘটেছে, তুমি যদি তা বলতে খুব বখিরি করে থাকে, তোমার বদলে জায়েদই সে কাহিনী বলুক না। তুমি কি মনে করো যে, তোমার জীবনে যা ঘটছে, তোমার বন্ধুরা সে বিষয়ে উৎসুক নয়?’