দাজ্জাল
এক
আমি মদীনার সবচেয়ে প্রচীন অঞ্চলে সর্পিল গতিপথে প্রবেশ করি। ছায়াতে শিকড় গেড়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের দেয়াল, পাথরে তৈরি; গলির উপর ঝুলে আছে ঘুলঘুরি দেয়া জানালা এবং ব্যালকনি.. . গলিগুলি দেখতে গিরিসংকটের মতোই এবং কোনো কোনো জায়গা এতা চিপা যে, দুজন মানুষের পক্ষেও একে অন্যের পাশ দিয়ে বিপরীতদিকে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। এক সময় আমি নিজেকে দেখতে পেলাম, প্রায় একম বছর আঘে একজন তুর্কী পন্ডিত কর্তৃক স্থাপিত ধূসর পাথরে তৈরি কুতুবখানার সম্মুখভাগের সামনে এই প্রংগণে, গেচের পেটানো ব্রোঞ্জের গ্রিলের পশ্চাতে রয়েছে এমন একটি নীরবতা –যেনো একিট আমন্ত্রণ! আমি পাথর বিছানো প্রাংগণ পার হয়ে প্রাংগণের মাঝখানে যে একাকী গাছটি নিশ্চল সারি সারি কাঁচ ঢাকা বুক-কেস-হাজার হাজার হাতে লেখা বই-আর সে-সবের মধ্যে আছে ইসলামী বিশ্বের জানা কিছু –কিছু দুর্লভ পান্ডুলিপি। এধরনের বই পুস্তকই গৌরব দান করেছে ইসলামী তমদ্দুনকে, যা হারিয়ে গেছে গত কালকের হওয়ার মতো!
আমি যখন যন্ত্রের সাহায্যে কাজ করা চামড়ার মলাটে ঢাকা এই পুস্তকগুলির দিকে তাকাই,তখন মুসরিমের অতীত ও মুসলিমের বর্তমানের অসংগতি আমাকে আঘাত করে এক যন্ত্রণাদায়ক ঘুষির মতো.. .
-‘তোমাকে কি যেনো পীড়া দিচ্ছে বেটা? মুখে এই তিক্ততার ছাপ কেন বলো তো?
আমি এই কন্ঠস্বরের দিকে ঘুরে দাঁড়াই এবং দেখি একটি ঘুলঘুলি দেয়া জানালার মাঝখানে, হাঁটুর উপর একটি ফলিও ভলিয়ম নিয়ে কার্পেটের উপর বসে আছেন আমার পুরানো বন্ধু ছোট্ট অবয়বের শায়খ আবদুল্লাহ বুলাইহদ। তাঁর তীক্ষ্ণ কৌতুকতরা চোখ দুটি একটি অন্তরংগ ঝিলিয়ে সংগে আমাকে অভিনন্দন জানালো, যখন আমি তাঁর কপালে চুমু খাই এবং তাঁর পাশেই বসে পড়ি। তিনি নযদের সর্বশ্রেষ্ঠ আলীম এবং ওয়াহাবী-দৃষ্টিভংগির সাথেমতবাদঘটিত এক ধরনের যে –সংকীর্ণতা জড়িত রয়েছে তা সত্ত্বেও মুসলিম দেশগুলিতে আজ পর্যন্ত যে-সব পরম তীক্ষ্ণধী মানুষের সাক্ষাৎ আমি পেয়েছি তিনি তাঁদেরই অন্যতম। আমার প্রতি তাঁর বন্ধুত্ব আরবে আমার জীবনকে সহজ এবং আনন্দময় করে তোলার জন্য অনেকখানি দায়ী। কারণ, ইবনে সউদের রাজত্বে খোদ রাজা ছাড়া আর যে কোনো মানুষের কথার চাইতে তাঁর কথারই মূল্য বেশি। তিনি চট করে তাঁর বইটি বন্ধ করে ফেলেন এবং আমাকে তার কাছে টেনে নেন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে, আমার দিকে তাকিয়ে।
-‘হে শায়খ, আমি ভাবছিলাম, আমরা মুসলমানরা কতো দূরে চলে গেছি এ থেকে’- এবং তাকে রাখা বইগুলি দিকে আমি ইশারা করি-আমাদের বর্তমান দুঃখ-দুর্দশা আর অধপতনের দিকে!’
-‘বেটা’, জবাব দেন বৃদ্ধ,‘আমরা যা বুনেছি তাই তুলছি। একদিন আমরা মহান ছিরাম। ইসলামই আমাদেরকে বড়ো করেছিলো। আমরা ছিলাম একটি পয়গামের বাহক। যতোদিন আমরা সেই পয়গামের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলাম ততোদিন আমাদের হৃদয় ছিলো উদ্দীপিত, অনুপ্রাণিত আর আমাদের মন ছিলো আলোকিত, উদ্ভাসিত। কিন্তু যেই আমরা ভুলে গেলাম, কী উদ্দেশ্যে আল্লাহ মানোনীত করেছিলেন আমাদের, তখনিই ঘটলো আমাদের পতন। আমরা অনেক দূর চলে গেছি এ থেকে’ – এবং বইগুলির দিকে আমি যেভাবে ইশারা করছিলাম ‘শায়খ’ তারই পুনরাবৃত্তি করেন – ‘কারণ রসুলূল্লাহ সাল্লালাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে ১৩০০ বছর আগে যা শিখিয়েছিলেন আমরা তা থেকে চলে গেছি অনেক –অনেক দূরে .. .’
-আর হ্যাঁ, তোমার কাজ কেমন চলছে?’ একটু থেমে তিনি জিজ্ঞাস করেন, কারণ তিনি জানের, আমি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম দিকের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলি সম্পর্কে অধ্যয়নে মগ্ন আছি।
-‘আমাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, শায়খ, কাজ খুব ভালো আগাচ্ছে না। আমি আমার অন্তরে স্বস্তি পাচ্ছি না এবং জানি না এর কারণ কী? আর এজন্যই আবার আমি ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছি মরু প্রান্তরে।’
ইবনে বুলাইহদ আমার দিকে তাকান স্মিত হাস্যস্ফুরিত তীর্যক চোখে –বুদ্ধি –দ্বীপ্ত মর্মভেদী সেই চোখে –এবং তাঁর মেহেদী-রাঙা দাড়ি আঙুল দিয়ে পাকাতে পাকাতে বলেনঃ মনের যা পাওনা তা পাবে মন আর দেহের যা পাওনা তা পাবে দেহ . .. তোমার এখন শাদি করা উচিত .. .’
অবশ্য আমি জানি যে, নযদে প্রায় সকল রকম পেরেশানিরই সমাধান বিবেচিত হয় ‘শাদি।’ আমি হাসি চেপে রাখতে পারলাম না।
-‘কিন্তু শায়খ, আপনি ভালো করেই জানেন আমি মাত্র দুবছর আগে আবার শাদি করেছি এবং এ বছর আমার একটি ছেলেও হয়েছে।
বৃদ্ধ তাঁর কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে বলেনঃ কোনো পুরুষ যদি স্বস্তি পায় তার স্ত্রীতে সে তার সাধ্যমতো বেশি সময় ঘরেই থাকে। তুমি ঘরেও তো সময় কাটাও না. .. আর তা ছাড়া দোসরা শাদি করে আজ পর্যন্ত কোন পুরুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি।’ (বর্তমানে তাঁর নিজেরও তিন স্ত্রী রয়েছেন যদিও তাঁর বয়স সত্তর এবং আমি শুনেছি তাঁর কনিষ্ঠা স্ত্রী, যাকে তিনি শাদী করেছেন মাত্র মাস দুয়েক আগে, তার বড় জোর ষোলো বছর হছেয়ে।)
-‘তা হতে পারে’, আমি পাল্টা জবাব দিই, ‘হতে পারে দোসরা স্ত্রী গ্রহণ করলে তাতে পুরুষ কষ্ট পায় না, কিন্তু জরুর ব্যাপার কী? তার কষ্ট কি বিবেচনার অপেক্ষা রাখে না?
-‘বেটা, কোনো রমণী যদি তার স্বামীর পুরা হৃদয়টাই দখল করে থাকে, সে ফের শাদি করার কথা চিন্তা করবে না, তার আর শাদির প্রয়োজনও হবে না। কিন্তু স্বামীর হৃদয় যদি সম্পূর্ণভাবে তার স্ত্রীর সংগে না থাকে, সেই স্ত্রীর কি কোনো লাভ হবে তার প্রতি উদাসীন খসমকে কেবল তার নিজের জন্য আটকে রেখে?
নিশ্চয়ই এর কোনো উত্তর নেই। এটা নিশ্চিত যে, ইসলাম এক বিয়ের পরামর্শ দেয়,কিন্তু বিশেষ অবস্থায় পুরুষকে চারটি পর্যন্ত বিয়ে করার অনুমতি দেয়। যে কেউ জিজ্ঞাস করতে পারে, এ অধিকার নারীকেও কেন দেওয়া হলো না। জবাবটি সহজ। মানুষের বিকাশ ও অগ্রগতির ধারায় মানুসের জীবনে প্রেমের যে আত্মিক বিষয়টি অনুপ্রবেশ করেছে, তা সত্ত্বেও, নারী-পুরুষ উভয়ের বেলায় যৌন কামনার অন্তর্নিহিত জীবতাত্ত্বিক যুক্তি হচ্ছে প্রজনান; এবং যেখানে একজন স্ত্রীলোক একবারে কেবল একজন পুরুষের কাছ থেকেই একটি সন্তান ধারণ করতে পারে এবং নয়টি মাস তাকে গর্ভে ধারণ করতে হয় আরেকবার গর্ভধঅরণ করতে সক্ষম হওয়ার পূর্বে, সেখানে এভাবেই পুরুষকে তৈরি করা হয়েছে যে, যতোবার একটি নারীকে সে আলিংগন করবে ততবারই সে একটি সন্তানের জন্ম দিতে পারে। কাজেই, যেখানে নারীর মধ্যে বহুপতিক হওয়ার সহজাত প্রবৃত্তি হতো প্রকৃতির জন্য কেবল অপচয়, সেখানে পুরষের বহু নারী সম্ভোগের সন্দেহাতীত প্রবণতা প্রকৃতির দৃষ্টিকোণ থেকেই জীবতত্ত্বের দিক দিয়ে যুক্তিসংগত। অবশ্য, একথা খুব স্পষ্ট যে, জৈবতাত্ত্বিক ব্যাপারটি হচ্ছে ভালোবাসার অনেকগুলি দিকের একটি দিক মাত্র এবং তাও কোনক্রমেই সবচেয়ে গুরিুত্বপূর্ণ দিক নয়। তা সত্ত্বেও এটি হচ্ছে একটি মৌলিক উপাদান। মানব প্রকৃতিকে ইসলামে যে প্রজ্ঞার সংগে সবচেয়ে বিচার করা হয় সে প্রজ্ঞাবশত ইসলামী আইন বিয়ের সামাজিক-জৈবতাত্ত্বিক ক্রিয়াটিকেই হিফাজত করে –এর বেশি কিছু করে না (এর মধ্যে অবশ্য সন্তানের যত্ন ও পড়ে)। আর এ কারণেই, পুরুষকে দেয় একাধিক বিয়ে করার অনুমতি এবং একই সংগে রমণীকে একাধিক স্বামী গ্রহনের অনুমতি দিতে করে অস্বীকার। বিয়ের আত্মিক দিকটি যেহেতু অচিন্তনীয় এবং আইনের ইখতিয়ার-বহির্ভূত, সেজন্য তা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে স্বামী আবার বিয়ে করার প্রশ্ন স্বভাতই ওঠে না। যখনি স্বামী তার স্ত্রীকে সমুদয় হৃদয় দিয়ে ভালোবাসায় অন্যকে অংশ দিতে রাজী নয় এবং স্ত্রী যদি এতো রাজী না হয সে তালাক দিতে পারে এবং স্বাধীনভাবে পরে আাবার বিয়ে করতে। যে কোন অবস্থায়, ইসলামী বিয়ে যেহেতু একটা পবিত্র ব্যাপার নয় বরং একটা সামাজিক চুক্তি, সেজন্য স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তালাকের আশ্রয় নিতে পারে। এর বিশেষ কারণ আছে। অন্যত্র কম-বেশি যে কলংক জড়িত রয়েছে তালাকের সাথে, মুসলিম সমাজে তার অস্তিত্ব নেই (একমাত্র সম্ভাব্য ব্যতিক্রম হচ্ছে ভারতীয় মুসলমানেরা, যারা হিন্দু সমাজের সাথে শত শত বছরের সম্পর্কের ফলে এ বিষয়ে প্রভাবিত হয়েছে, কারণ হিন্দু সমাজে তালাক একেবারেই নিষিদ্ধ)।
বিয়ে কর এবং বিয়ের সন্ধান ছিন্ন করার ব্যাপারে নারী-পুরুষ উভয়কে ইসলামী আইন যে স্বাধীনতা দিয়েছে, তাতেই ব্যখ্যা মিলবে কেন ইসলামে ব্যভিচারকে জঘন্যতম অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। কারণ এ ধরনের স্বাধীনতা যেখানে রয়েছে সেখানে, আবেগাত্মক বা ইন্দ্রিয়জ যোগাযোগ ওজর হিসাবে গৃহীত হতে পারে না। এটা সত্য যে, মুসলমানদের অবনতির জয়েক শততে সামাজিক রীতিনীতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, আইন –প্রদাতা যেমনটি ইচ্ছা করেছিলেন সেরূপ স্বাধীনভাবে তারাক দেবার অধিকার প্রয়োগ স্ত্রীলোকের পক্ষে প্রায় কঠিন হয়ে পড়েছে। অবশই এর জন্য দায়ী ইসলাম নয়, দায়ী হচ্ছে প্রথা – ঠিক যেমন , স্ত্রীলোককে এতোকাল ধরে বহু মুসলিম দেশে অবরোধের অন্তরালে বন্দী রাখার জন্য দায়ী হচ্ছে প্রথা, ইসলামী আইন নয়; কারণ কুরআনে কিংবা নবীর সুন্নাহতে এই প্রথার সর্মথনে কিছুই পাওয়া যায় না, যা মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করেছে বাইজান্টিয়ানদের কাছ থেকে।
শাইখ ইবনে বুলাইহিদ আমার আত্মগত চিন্তার বাধা দেন আমার দিকে এমনভাবে তাকিযে, যেনো তিনি সব জানেন। ‘তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত গ্রহনের দরকার নেই, বেটা। সিদ্ধান্ত যখনা আসার সময় হবে, তখন তা তোমার কাছে অমনি আসবে।’
দুই
কুতুব খানাটি নীরব নিস্তব্ধ; বৃদ্ধ শায়খ এবং আমি – কেবল এ দুজনেই রয়েছি গম্বুজওয়ালা কক্ষটিতে। কাছাকাছি ছোট্ট একটি মসজিদ থেকে আমে মাগরিবের আযান এবং পরমুহূর্তেই একই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয় মসজিদের নবীর পাঁচটি মীনার থেকে। নবীর মসজিদটি এই মুহূর্তে আমাদের কাছে অদৃশ্য এবং বিপুল গাম্ভীর্য আর মাধুর্যময় গর্বের সংগে যেনো তাকিয়ে আছে সবুজ গম্বুজটির উপর। মীনারগুলিতে একটি থেকে ‘মুয়াজ্জিন’ বলছেঃ ‘আল্লাহু আকবর ’.. . গভীর , গাঢ়, নিম্মগ্রামে, ধীরে ধীরে সুর ওঠা –নামা করছে ধ্বনির দীর্ঘ বলয়ের আকারের মতোই। ‘আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ’… ‘আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ’… সে তার বাক্যাংশটি শেষ করার আগেই আমাদের সবচেয়ে নিকটে যে মীনার রয়েছে সে মীনার থেকে কিছুটা উচ্চগ্রামে শুর করে ‘মুয়াজ্জিন’ ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’, ‘আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ’এবং তৃতীয় মীনারে যখন একই সংগীত উচ্চতরো গ্রামে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে, ততোক্ষনে প্রথম ‘মুয়াজ্জিন’ প্রথম বাক্যটির শেষ করে দ্বিতীয় শ্লোকটি শুরু করেছে.. . চতুর্থ এবং পঞ্চম মীনার থেকে ওঠা প্রথম বাক্যটির ধ্বনিগুলির একটা সুদূর স্বর-সংগতির সাথে মিরিত হয়েঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই,’ যখন প্রথম, দ্বিতীয় এবং পরে তৃতীয় মীনার থেকে কন্ঠস্বর নেমে আসে মোলায়েম পাখনায় ভর করে .. .‘এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মদ আল্লাহর রসূল’। এভাবে প্রত্যেক শ্লোকয় দুবা্র করে আবৃত্তি করে পাঁচজন মুয়াজ্জিনের প্রত্যেকের আর আযান চলে আগিয়ে – ‘সালাতে আসো, সালাতে আসো, চিরস্থায়ী সুখের দিকে ছুটে আসো’। প্রত্যেকটি কন্ঠস্বর যেনো জাগিয়ে দেয় অন্যদেরেএবং সবকটি স্বরকে নিয়ে এসে মিলিত করে এক জায়গায়, যেনো তার একমাত্র উদ্দেশ্য, স্থান ছেড়ে দিয়ে সরে পড়া এবং অন্য এক বিন্দুতে গিয়ে আবার সুরটিকে কন্ঠে ধারণ করে, আর এভাবে একে নিয়ে যাওয়া শেষ শ্লোক পর্যন্ত ‘আল্রাহ সর্বশ্রেষ্ট, আল্রাহ সর্বশ্রেষ্ট, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই।’
মানুষের কণ্ঠস্বরের এই যে বুলন্দ, গভীর আলিংগন, পরস্পর থেকে দূরে সরে পড়া, এক হয়ে যাওয়া এবং এবং আলাদা হয়ে যাওয়া, মানুষের আর কোনো সুরের সংগে এর মিল নেই। এই নগরী এবং এর স্বরধ্বনির প্রতি উন্মাদ ভালোবাসায় যখন আমার হৃদপিণ্ড আছাড় –পিছাড় খাচ্ছে আমার কণ্ঠ পর্যন্ত, তখন আমি অনুভব করতে শুরু করি – আমার এই সব সফর আর বাউণ্ডুলেপনার একটি মাত্র অর্থই ছিলো সব –সময় –এই আহ্বানের অর্থ উপলব্ধি করা.. .
-‘আসো’, শায়খ ইবনে বুলাইহিদ আমাকে বলেন, ‘চলো, আমারা মসজিদে মাগরিবের সালাত আদায় করি.. .’
হারম বা মদীনার পবিত্র মসজিদকে তার বর্তমান রূপ দেওয়অ হয়েছে গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে। কিন্তু এর কোনো কোনো অংশ অনেক প্রাচীন –কোনো কোনোটি নির্মিত হয়েছে মিসরের মামলুক বংমের আমলে এবং কোনো কোনোটি তারও আগে। কেন্দ্রের যে হল ঘরটিতে নবীর মাযার রয়েছে তা ঠিক সেই জায়গাটির উপরে নির্মিত যেখানে সপ্তম শতকে তৃতীয় খলীফা উসমান তৈরি করেছিলেন ইমারতটি। এর মাথায় রয়েছে একটি বৃহৎ সবুজ গম্বুজ যার ভেতর দিকটা নানা রংয়ের কারুকার্যময় চিত্রে অপরূপ। ছাদটি দাঁড়িয়ে আছে অনেক –ক’টি পুরু সারি সারি মার্বেল স্বম্ভের উপর, যে স্বম্ভগুলি পারস্পপিরক সামঞ্জস্য বজায় রেখে অনেকগুলি ভাগে ভাগ করেছে ভেতরটাকে। মর্মরের মেঝের উপর বিছানো রয়েছে দামী গালিচা। তিনটি ‘মেহরাবে’র প্রত্যেকটির দুপাশে ঝুলছে অতি নিপুণভাবে কাজ করা ব্রোঞ্জের ঝাড়-বাতি। মেহরাবগুলি অর্ধবৃত্তাকার কুঠরীর মতো, যার মুখ রয়েছে মক্কা অভিমুখে; নীল সাদা চীনামাটির টালি দিয়ে কচিত এই মেহরাবগুলি –এর একটি সবসময়ই ‘ইমামে’র জন্য নির্ধারিত , যিনি পারিচালনা করেন জামাতের সালাত। দীর্ঘ তামার শিকলে ঝুলছে শত শত স্বচ্ছ কাঁচের গোলক; রাতের বেলা এদের ভেতরে জ্বালানো হয় ছোট ছোট বাতি, জায়তুনের তেরে এবং এগুলি সালাতরত সারি সারি মানুষের উপর ছড়িয়ে দেয় একটি মৃদু মোলায়েম ঝিকিমিকি আলো। দিনের বেলা একটা সবুজাত আলো –আঁধারী ভরে রাখে মসজিদটিকে এবং তাতে মনে হয়, এ যেনো একটি হ্রদের তলা, যেনো পানির ভেতর দিয়ে মানুষের মূর্তি সব সাঁতার কেটে চলেছে নগ্ন পায়ে, গালিচা এবং বিছানা মার্বেলের উপর দিয়ে; যেনো পানির দেয়াল দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে সালাতের সময় বৃহৎ হল ঘরের প্রান্ত থেকে ‘ইমামে’র কন্ঠস্ব ধ্বনিত হচ্ছে চাপা গলায়, কোনো প্রতিধ্বনি না তুলে।
রসূলের কবরটি দেখা যায় না, কারণ কবরটি ঝুলন্ত পুরু ব্রকেড দিয়ে ঢাকা এবং ব্রোঞ্জের গ্রীল দিয়ে ঘেরা দেওয়া। মিসরের মামলুক সুলতান কায়েত বে পঞ্চাদশ শতকে এ গ্রীলটি তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। আসলে কবরের মতো কোনো কাঠামো এখানে নেই, কারণ নবীজী যে ছোট্ট কক্ষটিতে বাস করতেন এবং যেখানে তিনি ইন্তেকাল করেছিলেন তারই মেটে মেঝের নিচে তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছিলো। পরবতীকালে এই বাড়িটিকে ঘিরে একটি দরোজা –শূন্য দেয়াল তৈরি করা হয় আর এভাবেই কবরটি সম্পূর্ণ আড়াল করে দেয়া হয় বাইরের দৃষ্টি থেকে। রসূলের আমালে তাঁর ঘরের একেবারে সংগেই লাগানো ছিলো মসজিদটি। কয়েক শতাব্দীর পরিক্রমার পরে, কবরটির উপরে এবং কবরটিকে ছাড়িয়ে মসজিদটিকে সম্প্রসারিত করা হয়।
মসজিদের ভেতরে খোলা চতুষ্কোণ পাথর –বিছানো মেঝের উপর ছড়ানো রয়েছে সারি সারি কম্বল, লম্বা করে। সারি সারি মানুষ তার উপর বসেছে জানু গেঁড়ে, কুরআন পাঠ করছে, একে অপরের সাথে কথা বলছে, ধ্যান করছে অথবা কেবল আসেমী করে সময় কাটাচ্ছে মাগরিবের সালাতের প্রতীক্ষায়। ইবনে মুলাইহিদ যেনো হারিয়ে গেছেন এক নিঃশব্দ প্রার্থনায়।
সবসময় যেমন হয়ে থাকে, মাগরিবের আগে, দূর থেকে ভেসে আসছে একটি কন্ঠস্বর, কুরআনের একটি অংশ তিলাওয়াতের ধ্বনি। আজকে আবৃত্তি করা হচ্ছে ৯৬ তম ‘সূরা’ –মুহাম্মদের কাছে যা নাযিল হয়েছিলো সর্বপ্রথম – যা শুরু হয়েছে এ শব্দগুলি দিয়ে ‘পাঠ করো’ তোমার রবোর নামে –প্রতিপালকের নামে’.. . এই শব্দগুলির মাধ্যমেই মক্কার নিকটে হিরা গুহায় মুহাম্মদদের নিকট প্রথম এসেছিলো আল্লাহর আহ্বান।
প্রায়ই যেমন করেছেন তেমনি তিনি প্রর্থনা করছিলেন নির্জনে, ধ্যান করছিলেন আলো ও সত্যের সন্ধানে, যখন অকস্মাৎ তাঁর সামনে আবির্ভূত হলেন ফেরেশতা এবং তাঁকে আদেশ করলেন, ‘পাঠ করো’ এবং মুহাম্মদ –যিনি তাঁর আশেপাশের প্রায় সকল লোকের মতোই কখনো পড়তে শিখেননি – আর সবার উপরে তিনি জানতেন না কী পড়তে হবে – তাকে জবাব দিলেন, ‘আমি পড়তে পারি না’। এ কথা শোনার পর ফেরেশতা তাঁকে এতো জোরে আলিংগন করেন যে, মুহাম্মদের মনে হলো তাঁর গায়ের সমস্ত শক্তি যেনো নিঃশেষ হয়ে গেছে। তখন ফেরেশতা তাঁকে ছেড়ে দিয়ে তাঁর আদেশের পুনরাবিৃত্তি করলেন, ‘পড়ো, পাঠ করো’। আবার মুহাম্মদ উত্তর করালেন, ‘আমি পড়তে জানি না’। তখন ফেরেশতা আবার তাঁকে সজোরে চেপে ধরলেন নিজের সংগে যার ফলে একসময় তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়লেন এবং তাঁর মনে হলো তাঁর মৃত্যু আসন্ন। আবার বজ্র গম্ভীর স্বরে আওয়াজ হলো, ‘পাঠ করো’ এবং তৃতীয়বারের মতো মুহাম্মদ যখন যন্ত্রণাকাতর হৃদয়ে ফিস ফিস করে বললেনঃ ‘আমি তো পড়তে জানি না’.. . তখন ফেরেশতা তাঁকে ছেড়ে দিয়ে বললেনঃ
পাঠ করো তোমার প্রতিপালকের নামে –
যিনি সৃষ্টি করেছেন –
সৃষ্টি করেছেন মানুষকে শুক্রবিন্দু থেকে
পাঠ করো, তোমার প্রতিপালক মহিমান্বিত
তিনি শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে কলমের সাহায্যে
শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না.. .
আর এইভাবে মানুষের চৈতন্য, মেধা এবং জ্ঞানের প্রতি ইশারা করে নাযিল হতে শুরু করলো কুরআন, যে প্রক্রিয়া চলতে থাকে দীর্ঘ তেইশটি বছর ধরে, তেষট্টি বছর বয়সে মদীনায় রসূলের ওফাত পর্যন্ত।
তাঁর ঐশী প্রত্যাদেশের এই প্রথম অভিজ্ঞতার কাহিনী আমাদের একদিন দিয়ে স্মরণ করিয়ে দেয় বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব খণ্ডে ইয়াকুবের সাথে ফেরেশতার ধ্বস্তাধ্বস্তির কথা। কিন্তু ইয়াকুব যেখানে বাধা দিয়েছিলেন, ষেখানের মুহাম্মদ ভীতি –মিশ্রিত শ্রদ্ধা ও যন্ত্রণায় নিজেকে সমর্পণ করেন ফেরেশতার আলিংগন, যার ফলে একসময়ে তাঁর সমস্ত শক্তিই চলে গেলো এবং তাঁর মধ্যে আর কিছুই রইলো না একটি কণ্ঠস্বর শোনার সামর্থ্য ছঅড়া –সে স্বর সম্পর্খে এ প্রশ্ন তোলা আর বলা আর সম্ভব ছিলো নাঃ স্বরটি কি ভেতর থেকে এলো না এসেছে বাইরে থেকে! তখন পর্যন্ত তিনি জানেন না যে, এর-পর থেকে তাঁকে একই সময়ে হতে হবে পূর্ণ এবং শূন্য এমন একজন মানুষ যার মধ্যে পুরাপুরি রয়েছে মানবসুলভ কামনা –বাসনা আর নিজের জীবন সম্পর্কে চেতনা, আর একই সংগে যিনি একটা পয়গাম গ্রহণ করার জন্য একটি নিষ্ক্রিয় যন্ত্রণারূপ। তাঁর হৃদয়ের কাছে মেলে ধরা হচ্ছিল চিনন্তন সত্যের অদৃশ্য গ্রন্থণা- যে সত্যৈই কেবল অনুভবযোগ্য সকল বস্তু ঘটনাকে দেয় তাৎপর্য –এই প্রত্যাশায় যে, তিনি সে –সবের মর্ম বুঝবেন –এবং তাঁকে বলা হলো সে কিতাব থেকে ‘পাঠ’ করে দুনিয়াকে শোনাতে , যাতে মানুষ বুঝতে পারে কী তারা জানে না এবং কার্যত কেবলমাত্র নিজের শক্তিতে তাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয় কী!
দিব্যদৃষ্টির বিস্ময়কর তাৎপর্য মুহাম্মদকে অভিভূত করে। জ্বলন্ত ঝোপের সামনে মূসার মতো তিনিও নিজেকে নবুয়তের সুউচ্ছ মর্যাদার অনুপযুক্ত মনে করলেন এবং আল্লাহর সম্ভবত তাঁকে মনোনীত করেছেন একথা ভেবে কাঁপতে শুরু করলেন। আমরা শুনেছি, এরপর তিনি নিজের শহরে নিজের ঘরে ফিরে গেলেন এবং তাঁর স্ত্রী খাদিজাকে বললেনঃ ‘আমাকে চাদর দিয়ে ঢাকো’। কারণ তিনি ঝড়ের মুখে গাছের ডালের মতো কাঁপছিলেন। খাদিজা তাঁকে একটি কম্বল দিয়ে ঢেকে দেন এবং ধীরে ধীরে একসময় তাঁর কাঁপুনি থেমে যায়। এরপর তিনি খাদিজার নিকট বর্ণনা করলেন তাঁর কী হয়েছে এবং বললেনঃ ‘সত্যি আমার সম্পর্কে আমার ভয় হচ্ছে!’
কিন্তু কেবলমাত্র প্রেমই যে –স্বচ্ছ দৃষ্টি দান করতে পারে খাদিজা সেই দৃষ্টি দিয়ে তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলেন, মুহাম্মদের সামনে যে দায়িত্ব রয়েছে তাঁর বিরাটত্বে তিনি ভীত এবং তিনি উত্তর করলেনঃ ‘না আল্লাহর কসম! তিনি কখনো আপনার উপর এমন ভঅর চাপাবেন না যা আপনি বহন করতে অক্ষম এবং কখনো তিনি আপনাকে অপমানিত করবেন না; কারণ সবাই জানে, আপনি মানুষ হিসাবে উত্তম, আপনি আপনার আত্মীয়-স্বজনের প্রতি দায়িত্ব পালন করেন, দুর্বলকে সাহায্যে করেন, অসহায়ের উপকার করেন এবং মেহমানদের প্রতি আপনি মহানুভব উদার, আর যারা সত্যি সত্যি বিপন্ন, তাদেরকে আপনি সাহায্য করে থাকেন।’ তাঁকে সান্তনা দেওয়ার দেওয়ার জন্য খাদিজা তাঁকে নিয়ে গেলেন তাঁর এক সুশিক্ষিত চাচাতো ভাই ওরাকার কাছে। ওয়ারাকা বহু বছর ধরে খৃষ্টধর্ম পালন করেছেন; আর জনশ্রুতি এই যে, তিনি বাইবেল পাঠ করতে পারতেন হিব্রু ভাষায়। সে সময়ে ওয়ারাকা বৃদ্ধ হয়েছেন এবং তিনি অন্ধ। খাদিজা তাঁকে বললেন, হে আমার পিতৃব্য পুত্র, আপনার এই স্বজনের প্রতি মনোযোগী হোন’। এবং মুহাম্মদ যখন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা আবার বললেন, তখন ওয়ারাকার ভয় –মেশানো শ্রদ্ধার সংগে তুললেন উপরে আর বললেন, ‘ইনিই তো ওহীর সেই ফেরেশতা, যাঁকে আল্লাহ পাঠিয়েছিলেন পূর্বেকার নবীদের নিকট। আহ্যি, আমি যদি বয়সে তরুণ হতাম! আমি যদি তখন বেঁচে থাকতাম এবং আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারতাম যখন আপনার জাতি আপনাকে তাড়িয়ে দেবে আপনার দেশ থেকে! একথা শুনে বিস্ময়প্লুত মুহাম্মদ জিজ্ঞাস করেনঃ ‘কেন, কেন ওরা আমাকে তাড়িয়ে দেবে দেশ থেকে?’ এবং জ্ঞানী ওয়ারাকা জবাবে বললেন, হ্যাঁ, ওরা আপনাকে তাড়িয়ে দেবে। আজ পর্যন্ত আপনার মতো এমন কোনো মানুষ তার জাতির কাছে আসেনি যে আপনি যা নিয়ে এসেছেন তা-ই নিয়ে এসেছিলো, অথচ উৎপীড়িত হয়নি!
হ্যাঁ, দীর্ঘ তের বছর ধরে ওরা তাঁর উপর চালায় জুলুম, যার ফলে একদিন তিনি বাধ্য হয়ে মক্কা ছেড়ে চলে গেলেন এবং পৌছুলেন গিয়ে মদীনায়। কারণ মক্কার লোকেরা চিরকালই ছিলো কঠিন –হৃদয়। .. .
কিন্তু মক্কার বেশির ভাগ লোক মুহাম্মদের প্রথম দাওয়াতের পর হৃদয়ের যে কাঠিন্য দেখিয়েছিালো তা বোঝা কি সত্যই তাতো কঠিন? ওদের মধ্যে কোনো রূহানী তৃষ্ণা ছিলো না; ওরা জানতো কেবল বাস্তব ব্যবহারিক উদ্যোগ। কারণ , ওরা বিশ্বাস করতো জীবনের পরিধি সম্প্রসারিত করা যেতে পারে কেবলমাত্র সেই উপায়গুলিকে প্রশস্ততরো করে যার সাহায্যে বাহ্য আরাম-আয়াস বাড়ানো সম্ভব। এই সব লোকেরা পক্ষে একটা নৈতিক দাবির কাছে আপোসহীনভাবে নিজেদের সমর্পণ করার চিন্তা সত্যি হয়তো অসহনীয় মনে হয়েছিলো –কারণ, ইসলাম শব্দটির মানেই তো শাব্দিক অর্থে ‘আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ’। তাছাড়া মক্কার লোকদের কাছে তাদের প্রতিষ্ঠিত নিয়মশৃংখলা এবং গোত্রগত রীতি –প্রথা ছিলো অতি মাত্রায় প্রিয়; মুহাম্মদের শিক্ষায় এসবই বিপন্ন হয়ে পড়লো। যখন তিনি আল্লাহর একত্বের কথা প্রচার করতে শুরু করলেন এবং প্রতিমা পূজাকে সবচেয়ে বড় পাপ বলে প্রকোশ্যে নিন্দা করতে আরম্ভ করলেন তখন ওরা তার মধ্যে ওদের চিরচারিত বিশ্বাসের উপরই কেবল আক্রমণ দেখলো না, বরং ওরা এও দেখতে পেলো যে, এতে করে ওদের জীবনের সামাজিক প্যার্টানটিকেই ধ্বংস করে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিশেষ করে , যে-সব বিষয়কে ওরা ধর্মের এখতিয়ারের বাইরে নেহাতই ‘জাগতিক’ ব্যাপার বলে মনে করতো – যেমন অর্থনীতি, সামাজিক সাম্য ও সুবিচারের প্রশ্ন এবং সাধারণভাবে, কারণ ওদের ব্যবসাগত অভ্যাস, ওদের অবাধ যৌনচার ও গোত্রের মংগল সম্পর্কে ওদের দৃষ্টিভংগির সংগে এ হস্তক্ষেপ খুব খাপ খাচ্ছিলো না। ওদের কাছে ধর্ম ছিলো একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার –একটা মনোগত ভংগির বিষয়, আচরণের বিষয় নয়।
আর এ ছিলো তারই সম্পূর্ণ বিপরীত যার কথঅ আরবের নবী ধর্মের কথঅ বলতেন তখন তাঁর মনে ছিলো। তাঁর বিচারে সামাজিক –আচার –আচরণ এভং অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানগুলি ধর্মের গণ্ডির মধ্যে পড়ে নিশ্চয়ই এবং তিনি নিশ্চয়ই বিস্মিত হতেন যদি কেউ তাঁকে বলতো –ধর্ম হচ্ছে একেবারেই ব্যক্তিগত বিবেকের বিষয় এবং সামাজিক আচরণের সংগে এর কোন সম্পর্ক নেই। অন্য সবকিছুর চাইতে বেশি করে তাঁর পয়গামে এই দিকটাই তাঁর পয়গামকে মক্কার কাফিরদের নিকট অতোটা অরুচিকর করে তুলেছিলো। তিনি যদি সামাজিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করতেন নবীকে নিয়ে তাদের অসন্তোষ হয়তো আরো কম তীব্র হতো। এতে সন্দেহ নেই যে, ইসলাম তাদের বিরক্তি উৎপাদন করতো, কারণ ইসলামের ধর্মতত্ত্ব সংঘর্ষ সৃষ্টি করেছিলো তাদের নিজেদের ধর্মীয় দৃষ্টিভংগীর সংগে। কিন্তু খুব সম্ভব প্রথমদিকে কিছুটা আপত্তির পরও তারা এর সংগে মানিয়ে নিতো-কিছুকাল আগে যেমন তারা মানিয়ে নিয়েচিলো খৃষ্ট –ধর্মের খন্ড বিচ্ছিন্ন প্রচারের সংগে –যদি রসূলুল্লাহ কেবল খৃষ্টান পাদ্রীদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতেন এবং নিজের প্রচারকে সীমিত রাখতেন কয়েকটি বিষয়েঃ আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য মানুষকে তাগিদ দেওয়া, নাজাতের জন্য তাঁর কাছে প্রর্থনার করা এবং নিজেদের ব্যক্তিগত বিষয়ে সুন্দর আচরণ করা। কিন্তু তিনি খৃষ্টান দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেননি এবং নিজেকে বিশ্বাস, ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ও ব্যক্তিগত নৈতিকতার মধ্যে সীমাব্ধ রাখেননি। কী করেই বা তাঁর পক্ষে তা সম্ভব ছিলো? তাঁর আল্লাহ কি তাঁকে আদেশ করেননি এই প্রার্থনা্ করতেঃ ‘হে আমাদের প্রতিপালক, তুমি আমাদেরকে দাও এ জগতের কল্যাণ এবং ভাবী জগতের কল্যাণ।’
কুরআনের এই বাক্যটিরে কাঠামের ভেতরে ‘এই জগতের কল্যাণ’কে স্থান দেওয়া হয়েছে ‘ভাবী জগতের কল্যাণে’র আগে – প্রথমত এ কারণে যে, বর্তমানের স্থান ভবিষ্যতের আগে, বর্তমান ভবিষ্যতের অগ্রগামী এবং দ্বিতীয়ত এ করণেও যে, মানুষকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যার ফলে আত্মার ডাকে সাড়া দিতে হলে এবং পরবর্তী জীবনের কল্যাণ চাইতে হলে পূর্বে তাকে অবশ্যি তার দৈহিক এবং পার্থিব প্রয়োজনগুলি মেটানোর জন্য চেষ্টা করতে হবে। মুহাম্মদের পয়গামে এমন কোনো আধ্যাত্মিকতার ধারণা নেই যা দৈহিক জীবনের সাথে সম্পর্কহীন বা তার বিরোধী। এ পয়গাম সর্ম্পর্ণ রূপে দাঁড়িয়ে আছে এই ধারণার উপর যে, দেহ এবং আত্মা হচ্ছে একই সত্যের ভিন্ন দুটি দিক; কী সেই বাস্তব সত্যঃ মানুষ্য –জীবন।তাই, স্বভাবতই তিনি ব্যক্তি-মানুষেল মধ্যে কেবলমাত্র একটা নৈতিক মনোভংগি লালন করেই তুষ্ট হতে পারেন নি, বরং তিনি চেয়েছিলেন এই মনোভংগিটিকে এমন একটি নির্দিষ্ট সামাজিক স্কীমে রূপান্তরিত করেতে যা, সমাজের প্রত্যেকটি ব্যক্তির জন্য সাম্ভাব্য বৃহত্তম পরিমাণ দৈহিক এবং বৈষয়িক স্বাচ্ছন্দ্যর বিধান করবে আর এভাবেই আত্মিক বিকাশেরও বৃহত্তম সুযোগের নিশ্চয়তা দেবে।
তিনি তাঁর প্রচার শুরু করলেন মানুষকে এই কথা ‘বলেঃ আমল বা কর্ম হচ্ছে ঈমানের অংগঃ’ কারণ আল্লাহ কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ধার ধারেন; তিনি নারী-পুরুষ প্রত্যেকের কর্মও দেখেন, বিশেষ করে সেই সব কর্ম যার প্রভাব পড়ে ব্যক্তির জীবনের গণ্ডির বাইরে অন্য মানুষের উপর। তিনি দুর্বলের উপর সবলের জুলুমের বিরুদ্ধে প্রচার করেন অগ্নি –গর্ভ শব্দালংকারের সাহায্যে, যা আল্লাহ তাঁকে দিয়েছিলেন। তিনি অশ্রুতপূর্ভ এই যুক্তি-বক্তব্য পেশ করলেন যে, আল্লাহর কাছে নারী এবং পুরুষ হচ্ছে সমান এবং সকল ধর্মীয় কর্তব্য ও আশা –আকাংখা দুয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য সমানভাবে; মক্কার সকল (১-একচেটিয়া ব্যবসা। ২- ইচ্ছামতো চড়া দামে আবর বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে পণ্যদ্রব্য সমুদয় ক্রয় করে ফেলা।)সরলমনা পৌত্তলিকের আতংকের সীমা থাকলো না যখন তিনি একথা পর্যন্ত ঘোষণা করে বসলেন যে, নারী তার নিজস্ব অধিকার বলেই একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি, পুরুষের সংগে মা, বোন, স্ত্রী অথবা কন্যা হিসাবে তার সম্পর্খের কারণেরই কেবল সে আলাদা ব্যক্তি নয়; আর এ কারণে, নারীর অধিকার আছে সম্পত্তির স্বত্বাধিকারী হওয়ার , নিজের ব্যবসা –বাণিজ্য পরিচালনা করার এবং বিয়েতে স্বাধীনভাবে তার নিজেকে অন্যের হাতে তুলে দেবার! তিনি সকল রকমের জুয়া খেলা ও সকল প্রকার মরাব দূষণীয় বলে ঘোষণ করলেন, কারণ আল –কুরআনের ভাষায়ঃ ‘এ সবের মধ্যে মন্দ অনেক বেশি এবং সামান্য উপকারিতা আছে। কিন্তু উপকারিতার চাইতে ক্ষতিকর দিকটাই বেশি।’ সর্বোপরি তিনি দাঁড়ালেন, মানুষ মানুষেল উপর পুরুষানুক্রমিক যে জুলুম করে আসছে তার বিরুদ্ধে, দাঁড়ালেন সুদভিত্তিক কর্জের লাভের বিরুদ্ধে, সুদের হার যা-ই হোক , দাঁড়ালেন ব্যক্তি মনোপলি ১() এবং ‘কর্ণারে’র২()বিরুদ্ধে, অন্য মানুষের সম্ভাব্য প্রয়োজন নিয়ে জুয়া খেলার বিরুদ্ধে – যাকে আমরা আজাকল বলে থাকি ‘স্পেকুলেশন’ –দাঁড়ালেন গোত্রগত গ্রুপ সেন্টিমেন্টের দৃষ্টিতে ভালো অথবা মন্দ নিরূপণের বিরুদ্ধে, আধুনিক পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘জাতীয়তাবাদ’। বস্তুত গোত্রগত মনোভাব এবং বিচার –বিবেচনার কোনো নৈতিক বৈধতা আছে বলে তিনি স্বীকার করলেন না। তাঁর দৃষ্টিতে, সম্প্রদায়ভিত্তিক দলের জন্য একমাত্র বৈধ, অর্থাৎ নৈতিক মূল্যবোধের একটা সাধারণ মানদণ্ডের স্বাধীন সচেতন স্বীকৃতি- একই বংশ থেকে উৎপত্তির আকস্মিক ব্যাপারটাই নয়।
কার্যত যেসব সামাজিক ধ্যান –ধারণার তখন পর্যন্ত অলংঘনীয় বলে বিবেচিত হয়ে এসেছে তিনি তার প্রত্যেকটির ব্যাপক সংশোধনের জন্য জোর দিলেন এবং এ ভাবে, -বর্তমানকালের লোক যেমন বলে থাকে –তিনি ধর্মকে নিয়ে এলেন ‘রাজনীতিতে’। বলাবাহুল্য, সে সময়ের জন্য এ ছিলো রীতিমতো বৈপ্লবিক এক পরিবর্তন।
সকল কালের প্রায় সকল জাতির মতোই মক্কার পৌত্তলিক শাসকদের এই বিশ্বাস ছিলো যে, তারা যেসব সামাজিক রীতিনীতি, চিন্তা-ভাবনা ও প্রথা –পদ্ধতির অভ্যাসের মধ্যে লালিত হয়ে এসেছে, সেগুলি হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম এবং তার চেয়ে ভালো আর কিছু ধারণাই করা যায় না। তাই, রাজনীতিতে ধর্ম আমদানী অর্থাৎ সামাজিক পরিবর্তনের জন্য আল্লাহর উপলব্ধিকে আরম্ভ বিন্দু করে তোলার জন্য নবীর এ প্রয়াসে স্বভাবতই ওরা বিক্ষুদ্ধ হয় এবং একে নীতি-বিগর্হিত, বাজদ্রোহমূলক এবং উচিত –অনুচিতের সকল ধারণার খেলাফ বলে নিন্দা করে। এবং যখন ওদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠলো মুহাম্মদ কেবল একজন স্বপ্নচারী নন, বরং তিনি মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করতে পারেন কর্মের উদ্দীপনা তখন প্রতিষ্ঠিত সমাজ –ব্যবস্থার রক্ষকেরা গ্রহণ করে এক জবরদস্ত পাল্টা ব্যবস্তা এবং তাঁকে এবং তাঁর সহচরগণকে নিপীড়ন শুরু করে দেয়.. .।
আসলে, একভাবে না একভাবে সকল নবীই তাঁদের নিজ –নিজ কালের প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। কাজেই, এ কি খুবই আশ্চর্যজনক যে, তাঁদের প্রায় সকলেই তাঁদের জাতি –গোষ্ঠীর দ্বারা উৎপীড়িত এভং উপহাসিত হয়েছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে যিনি সকলের পরে এসেছেন সেই মুহাম্মদ আজো উপহাসিত হচ্ছেন পাশ্চাত্য জগতে?
তিন
‘মাগরিবে’র সালাত শেষ হওয়ার সাথে সাথে শায়খ ইবনে বুলইহিদ নযদি বেদুঈন এবং শহরবাসীদের এক উৎসুক চক্রের কেন্দ্র হয়ে উঠেন, কারণ, এরা তাঁর পাণ্ডিত্য এবং জাগতিক প্রজ্ঞা থেকে ফায়দা নিতে ইচ্ছুক। তিনি নিজেও ওদের অভিজ্ঞতা এবং দূর –দেশে ওদের সফর সম্পর্কে ওরা তাঁকে কী বলতে পারে তা শুনতে আগ্রহী। নযদিদের মধ্যে দীর্ঘ সফর মোটেই বিরল নয়; ওরা নিাজেদের বলে ‘আহলে আশশিদাদ’ –‘উটের জীনের উপর সওয়ার লোক’ – এবং ওদের অনেকের নিকট বাড়ির শয্যার চেয়ে উটের জীন অনেক বেশি পরিচিত। হার্বের যে তরুণ বেদুঈন ইরাকে তার সাম্প্রতিক সফর কালের অভিজ্ঞতার কথা এই মাত্র শায়েখের নিকট বর্ণনা করলো তার নিকট নিশ্চয় তা বেশি পরিচিত। এই সফরকালেই সেই তার জীবনে প্রথম ফিরিংগী অর্থাৎ ইউরোপীয়কে দেখতে পায়(ইউরোপীয়দের এই নামে তখনি আখ্যায়িত করে আরবরা যখন ওরা ক্রুসেডের যুদ্ধের সময় ফ্রাংকদের সম্পর্কে আসে।)
-‘আমাকে বলুন শায়খ, ফিরিংগীরা সবসময় মাথায় কেন হ্যাট পরে যা ওদের চোখ ঢেকে রাখে? ওরা আকাশ কী করে দেখতে পায়?’
-‘ওরা এ জিনিসটাকে দেখতে চায় না’,-শায়খ জবাব দিলেন, আমার দিকে চেয়ে চোখের পলক নেকেড় –‘হয়তো ওরা এই ভয় করে যে, আকাশের দৃশ্য ওদের স্মরণ করিয়ে দিতে পারে আল্লাহর কথা; ওরা চায় না যে, হপ্তার দিনগুলিতে কেউ ওদের আল্লাহর কথা মনে করিয়ে দেয়.. .’
আমরা সবাই হেসে উঠি। কিন্তু তরুণ বেদুঈনটি তার জ্ঞানের সন্ধানে রীতিমতো জেদী।– ‘তাহলে আল্লাহ কেন ওদের প্রতি এতো দয়ালু এবং ওদের দিচ্ছেন ঐশ্চর্য, যা তিনি মুমিনদের দিচ্ছেন না?’
-‘ওহো, এতো খুবই সোজা কথা বেটা, ওরা সোনা –রূপার পূজা করে। তাই ওদের দেবতা ওদের পকেটে.. . কিন্তু আমার এই যে দোস্ত’, তিনি তাঁর হাত রাখেন আমার হাঁটুর উপর, ‘ইনি ফিরিংগীদের সস্পর্কে আমার থেকে অনেক বেশি জানেন, কারণ তিনি ওদের মধ্য থেকে এসেছেন, -আল্লাহ –মহিমান্বিত হোত তাঁর নাম –তিনিই তাঁকে অন্ধকার থেকে নিয়ে এসেছেন ইসলামের আলোতে।’
-‘ব্যাপার কি তাই ভাইয়া?’ জিজ্ঞাস করে উৎসুক বেদুঈন, ‘এ কি সত্য যে, আপনি নিজেই একজন ‘ফিরিংগী’ ছিলেন?’ –যখন আমি মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দিই, সে ফিস ফিস করে বলে, প্রশংসা আল্লাহরই , যিনি যাকে ইচ্ছ পরিচালিত করেন সুপথে-আমাকে বলুন ভাইয়া, ‘ফিরিংগীরা’ যে আল্লাহ সম্পর্কে এত উদাসীন তার কারণ কী?’
-‘এ এক লম্বা কাহিনী, আমি জবাব দিই, কয়েক কথায় এর ব্যাখ্যা করা যাবে না। আমি এই মুহূর্তে তোমাকে যা বলতে পারি তা এই যে, ‘ফিরিংগীদের দুনিয়া হয়ে উঠেছে ‘দাজ্জালে’র দুনিয়া –চোখ ঝলসানো প্রবঞ্চকের দুনিয়া। তুমি কি আমাদের নবীর এই ভবিষ্যৎবানীর কথা কখনো শোনোনি যে, আখেরী জামানায় দুনিয়ার বেশি ভাগ লোকই এই বিশ্বাসে ‘দজ্জালে’র অনুসারী হয়ে উঠবে যে, সে –ই আল্লাহ!’
এবং ও যখন জিজ্ঞাসু চোখে আমার দিকে তাকালো , আমি তখন শায়খ ইবনে বুলাইহিদের সম্মতি নিয়ে বর্ণণা করি বাইবেলের সর্বশেষ গ্রন্থে উল্লিখিত ‘দাজ্জালে’র আবির্ভাব সম্পর্কিত ভবিষ্যতবাণী –যার একটি চোখ হবে অন্ধ কিন্তু তার থাকবে আল্লাহর দেয়া রহস্যময় ক্ষমতা। পৃথিবীর দূরতম অঞ্চলে যা বলা হচ্ছে তা-ও সে শুনতে পাবে তার কান দিয়ে এবং অসীম দূরত্বে যা কিছু ঘটছে তার এক চোখ দিয়ে দেখতে পাবে; সে উড়ে কয়েকদিনের মধ্যে ঘুরে আসবে পৃথিবী; মাটির নিচে থেকে হঠাৎ করে নিয়ে আসবে সোনা-রূপার ভাণ্ডার; তার হুকুমে বর্ষণ হবে, তরুলতা উৎপন্ন হবে, সে হত্যা করবে খোদ আল্লাহ বলে এবং ভক্তিতে তার সামনে সিজদায় যাবে-কিন্তু যাদের ঈমান মজবুত তারা আগুনের হরফে তার কপালে যা লেখা আছে তা পড়তে পাবেঃ ‘আল্লাহকে অস্বীকারকরী’ এই কথা –এবং এভাবে তারা জানতে পারবে যে, মানুষের বিশ্বাস পরীক্ষা করার জন্য দজ্জাল একটা ছলনা ছাড়া কিছু নয়.. .
এবং যখন আমার বেদুঈন বন্ধুটি দু’চোখ বিস্ফারিত করে আামার দিকে তাকায় এবং গুনগুন করে বলে, ‘আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় মাগি’, আমি তখন ইবনে বুলাইহিদের দিকে ঘুরে বলিঃ
-‘হে শায়খ, এই রূপক কাহিনীটি কি আধুনিক কারিগরী সভ্যতার একটি যথোচিত বর্ণনা নয়? এ সভ্যতা হচ্ছে এক-চক্ষুঃ অর্থাৎ এ কেবল জীবনের একটি দিক, তার বৈষয়িক উন্নতির দিকে তাকায় এবং জীবনের রূহানী দিক সম্পর্কে এ বে-খবর। এর কারিগরী তেলেসমাতির সাহায্যে মানুষকে দিয়েছে তার স্বাভাবিক সামর্থ্যের বাইরে অনেক দূরের বস্তু দেখার ও দূরের শব্দ শোনার ক্ষমতা, দিয়েছে ধরণাতীত গতিতে অসীম দূরত্ব অতিক্রম করার সামর্থ্য। এই সভ্যতার বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দ্বারা ‘বর্ষানো’ হয় বৃষ্টি এবং জন্মানো হয় তরুলতা’ এবং মাটির নিচে থেকে উদঘাটিত করা হয় অপ্রত্যাশিত ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার। এই বিজ্ঞানের ওষুধ জীবন দেয় তাকে যার মৃত্যু মনে হয় অবশ্যম্ভাবী, অন্যদিকে এর যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং বৈজ্ঞানিক ধ্বংসলীলা ধ্বংস করে জীবনকে আর এ বৈষয়িক অগ্রগতি এতোই প্রচণ্ড এবং এতোই চোখ ঝলসানো যে, দুর্বল ঈমানের লোকেরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, নিজের অধিকারেই এ হচ্ছে একজন ‘খোদা’, কিন্তু যারা তাদের স্রষ্টা সম্পর্খে সচেতন রয়েছে তারা স্পষ্টতই বুঝতে পারে যে, ‘দজ্জালে’র পূজা করা মানে আল্লাহকে অস্বীকার করা.. .।’
-‘তুমি ঠিক বলেছো মুহাম্মদ, তুমি ঠিক বলেছো’, উত্তেজিতভাবে আমার হাঁটুর উপর থাবা মারতে মারতে চীৎকার করে উঠেন বুলাইহিদ, -‘দাজ্জাল’ সম্পর্কিত ভবিষ্যত বাণীটির প্রতি এভাবে তাকানোর কথা কখনো আমার মনে হয়নি, কিন্তু তুমি ঠিক বলেছে! মানুষের অগ্রগতি এবং বিজ্ঞানের উন্নতি যে আমাদের আল্লাহরই একটা রহমত, এটা উপলব্ধি না করে অজ্ঞাবশত মানুষ ক্রমেই বেশি –বেশি সংখ্যায় ভাবতে শুরু করেছে যে, এ খোদাই একটা লক্ষ্য এবং পূজা পাওয়ার যোগ্য।’
হ্যাঁ, আমি নিজে নিজে ভাবি –পশ্চিমের লোক সত্যই নিজেদের সঁপে দিয়েছে ‘দাজ্জালে’র পূজায়। অনেককাল আগেই পশ্চিমের মানুষ হারিয়েছে তার সকল নিষ্কলুষতা এবং প্রকৃতির সংগে তার সকল অভ্যন্তরীণ সংহতি। তার কাছে জীবন হয়ে উঠেচে একট হয়রানী। সে সন্দেহবাদী এবং সে কারণে সে তার ভাই থেকেত বিচ্ছিন্ন এবং নিজের অন্তরে নিঃসংগ। এই নিঃসংগতার মধ্যে যাতে নিশ্চিহ্ন হযে যেতে না হয় সেজন্য বাহ্য উপায়ে জীবনের উপর প্রবুত্ব করার জন্য অবশ্যি চেষ্টা করতে হবে তাকে –‘বেঁচে আছি’ কেবলমাত্র এই অনুভূতি তাকে আর দিতে পারছে না অন্তরের নিরাপত্তা; যন্ত্রণার সংগে মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে তাকে অবশ্যই হামেশা কুস্তি লকড়তে হবে জীবনের সাথে, যেহেতু সে সকল প্রকার অতীন্দ্রিয় জিজ্ঞাসা হারিয়ে বসেছে এবং স্থির করেছে যে, তাকে বাদ দিয়েই সে চলবে, তাই তাকে ক্রমাগত উদ্ভাবন ও আবিষ্কার করতে হবে তার নিজের জন্য যান্ত্রিক মিত্র। আর এভাবেই শুরু হয়েছে কারিগরি ক্ষেত্রে তার উন্মত্ত বেপরোয়া প্রয়াস। সে প্রত্যেকদিন নতুন নতুন মেশিন আবিষ্কার করছে এবং তার প্রত্যেকটিকে দিচ্ছে তার আত্মার কিছু না কিছু যেনো সেগুলিই তার অস্তিত্বের জন্যে লড়াই করে। মেশিনগুলি তা অবশ্যই করে কিন্তু একই সংগে সেগুলিই তার জন্য দৃষ্টি করে নিত্য-নতুন অভাব,নতুন নুতন বিপদ, নতুন নতুন ভয় এই নতুনতরো আরো কৃত্রিম মিত্রের জন্য এক অতৃপ্ত তৃষ্ণা। তার আত্মা নিজেকে হারিয়ে ফেলে উৎপাদনশীল মেশিনের নিয়ত প্রবলতরো, নিয়ত উদ্ভটতরো, নিত্য প্রচণ্ডতরো চাকার ঘূর্ণনে; এবং মেশিনটিও হারিয়ে ফেলে তার নিজের সত্যিকার উদ্দেশ্য-মানব জীবনকে রক্ষা এবং ঐশ্বর্য্যশালী করাই যায় মানে –এবং নিজেই হয়ে ওঠে একটি দেবতা, ইস্পাতের সর্বগ্রাসী রাক্ষস। এই অতৃপ্ত দেবতার পুরুত প্রচারকেরা এ বিষয়ে সচেতন বলে মনে হয় না যে, আধুকি কালের কারিগরি উন্নতির দ্রুততা কেবল জ্ঞান –বিজ্ঞানের নিশ্চিত বিকাশেরেই ফল নয়, আত্মিক হতাশারও ফল, এবং পশ্চিমের মানুষ যে-চমকপ্রদ বৈষয়িক উন্নতির আলোকে প্রকৃতির উপর প্রভুত্ব স্থাপন করবে বলে আপন ইচ্ছার কথা ঘোষণা করে, সেগুলি কিন্তু তাদের অন্তরতম তাৎপর্যের দিক দিয়ে আত্মরক্ষামূলক ধরনেরঃ ওদের উজ্জ্বল মুখাবয়বের পেছনে ওঁত পেতে আছে অজানার আতংক।
পাশ্চাত্য সভ্যতার মানুষ ও সমাজের প্রয়োজন ও তার আত্মার চাহিদার মধ্যে একট সামঞ্জস্যপূর্ণ ভারসাম্য স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে। এ সভ্যতা তার কিছুকাল আগের ধর্মীয় নীতিশাস্ত্র বর্জন করেছে, কিন্তু নিজের মধ্য থেকে অন্য কোনো নৈতিক পদ্ধতি সৃষ্টি করতে পারেনি য, যতো তত্ত্বমূলকই হোক, যুক্তিগ্রাহ্য হবে। শিক্ষায় এর অতো অগ্রগতি সত্ত্বেও লোক-মাতানো চুতর বক্তারা যেসব স্লোগান উদ্ভাবন করা প্রয়োজন মনে করে, উদ্ভট হলেও সে –সবের শিকার হওয়ার জন্য মানুষের মধ্যে যে নির্বোধ প্রস্তুতি রয়েছে, পাশ্চাত্য সভ্যতা তা জয় করতে পারেনি। এ সভ্যতা সংগঠনের কৌশলকে একট চারুকলায় উন্নীত করেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও পাশ্চাত্য বিজ্ঞানীরা যেসব শক্তির জন্ম দিয়েছে সেগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে পাশ্চাত্য জাতিগুলি রোজই তাদের চূড়া্ত অক্ষমতার প্রমাণ দিচ্ছে, এবং এই মুহূর্তে তা এমন একটি পর্যায়ে এসে পৌছেছে যখন বাহ্যত অপরিসীম বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা আর বিশ্বব্যাপী বিশৃংখলা পাশাপাশি আগাচ্ছে, হারত ধরাধরি করে। তার বিজ্ঞানে জ্ঞানের যে আলো ছাড়চ্ছে –যে আলো নিঃসন্দেহেই মহৎ – তা থেকে সর্বপ্রকার ধর্মমুখিনতা বঞ্চিত পাশ্চাত্যবাসী আজ আর নৈতিক কোনো ফায়দাই লাভই করতে পারছে না। তার ক্ষেত্রে কুরআনের এ কথাগুলি প্রযোজ্যঃ
ওদের উপমা হচ্ছে অমন একটি জাতের উপমা যারা প্রজ্জ্বলিত করেছে আগুন, কিন্তু যখন তা তাদের রেখে দিলেন অন্ধকারে যার মধ্যে ওরা দেখতে পায় না –বোবা, বধির এবং অন্ধঃ এবং তবু ওরা ফিরে আসে না।
এবং, তবু ওদের অন্ধত্বের অহমিকায় পাশ্চাত্যের লোকেরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, অন্য কিছু নয়, ‘ওদের’ সভ্যতাই পৃথিবীতে আনবে আলো আর সুখ-শান্তি.. . আঠারো এবং উনিশ শতক ওরা সারা পৃথিবীতে খৃষ্টধর্মের সত্য বিস্তার করতে চেয়েছিলো; কিন্তু এখন যেহেতু ওদের ধর্মীয় উদ্দীপনা এতাটা ঠাণ্ডা হয়ে পড়েছে যে, ধর্মকে ওরা নেপথ্য সংগীতের বেশি কিছু মনে করে না-যাকে ‘বাস্তবে’ জীবনের সহচর হিসাবে থাকতে দেওয়া হয়, কিন্তু তার উপর প্রভাব খাটাতে দেওয়া হয় না-তখন তারা খৃষ্টধর্মের পরিবর্তে ‘পাশ্চাত্য জীবন পদ্ধতির’ জড়বাদী তত্ত্ব প্রচার করতে শুরু করেছেঃ তত্ত্বকথাটি কী?-এ বিশ্বাস যে কারখানায়, গবেষণাগারে এবং পরিসংখ্যান –বিদদের টেবিলের উপরই মানুষের সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব।
এবং এভাবে ‘দজ্জাল’ আবির্ভূত হয়েছে স্বরূপে.. .।
চার
নীরবতা জেঁকে থাকে অনেকক্ষণ। এরপর ‘শায়খ’ আবার বলেনঃ আবার বলেনঃ ‘বেটা, ‘দজ্জাল’ বলতে কী বোঝায় এই উপলদ্ধিই কি তোমাকে ইসলাম কবুল করতে বাধ্য করেছে?
-‘একদিক দিয়ে, আমার মনে হয়, তা’ই হয়েছে, কিন্তু এ ছিলো কেবল শেষ পদক্ষেপ।’
-‘শেষ পদক্ষেপ.. .হ্যাঁ তুমি কী করে ইসলামের পথ ধরেছো যে কাহিনী একবার আমাকে বলেছিলে। কিন্তু ঠিক কখন এবং কেমন করে তোমার মনে একথঅ প্রথম উদয় হলো যে, তোমার অভীষ্ট লক্ষ্য হতে পারে ইসলাম?’
-‘কখন? একটু ভাবতে দিন আমাকে.. . আমার মনে হয়; ব্যাপারটি ঘটেছিলো আফগানিস্তানে, শীতকালের একদিনে, যখন আমার ঘোড়ার একটি নল হারিয়ে গিয়েছিলে, আর সে কারণে, এক গ্রামে এক কমারকে খুঁজতে হচ্ছিলো আমার। গ্রামটি ছিলো আমার পথ থেকে বেশ দূরে। সেখানেই এক জন লোক আমাকে বলেছিলো, কিন্তু আপনি তো তো একজন মুসরমান, কেবল আপনি নিজে তা জানেন না এই যা.. . এ হচ্ছে আমার ইসলাম গ্রাহণের আট মাস আগরে কথঅ.. . আমি হিরোত থেকে যাচ্ছিলাম কাবুলে.. .’
হিরাত থেকে কাবুরের পথ ধরে আমি চলছি সওয়ারী পিঠে। আমার সংগে রয়েছে ইবরাহীম এবং একজন আফগান সৈনিক। মধ্য আফাগানিস্তানের বরফ –ঢাকা পার্বত্য উপত্যকা আর হিন্দুকুশের গিরি-পথগুলি ধরে আমরা চলছিলাম-সওয়ারী হাঁকিয়ে। ভীষণ ঠাণ্ডা পড়েছে তখন, বরফ চকচক করছে এবং আমাদের সকল দিকেই দাঁড়িয়ে আছে সাদা-কালো খাড়া উচু পাহাড়।
সেদিন আমার মনের মধ্যে একটা দুঃখ , আর একই সংগে আমি অনুভব করছিলাম আশ্চর্যজনক এ সুখ। আমি দুঃখ বোধ করছিলাম এজন্য যে, যে –লোকগুলির সংগে আমি গত ক’টি মাস এক সাথে বাস করেছি ওদের ঈমান যে আলো, যে-শীক্ত, যে-বুদ্ধি ওদের দিতে পারতো, মনে হলো তা থেকে ওদের আড়াল করে রেখেছে একটি পুরু অস্বচ্ছ পর্দাঃ আর আমি সুখ বোধ করছিলাম এ কারণে যে, সেই ঈমানের আলো, শক্তি এবং বুদ্ধি রয়েছে আমারই সাথে সম্মকে, সাদা-কালো পাহাড়গুলির নিকটে, েএতো নিকট যেনো হাত দিয়ে আমি স্পর্শ করতে পারছি।
আমার ঘোড়া খোঁড়াতে শুরু করলো এবং কিচু একটা যেনো তার খুরের মধ্যে ক্লিং করে শব্দ করে উঠলোঃ একট নাল ঢিলা হয়ে পড়েছে এবং কেবলমাত্র দুটি পেরেকের উপর ভর করে ঝুলে আছে।
-‘ধারে কাছে কি এমন কোনা গাঁ আছে যেখানে একজন কামার পেতে পারি?’ আমি আমাদের আফগান সংগীদের জিজ্ঞাস করি।
-‘এখানে থেকে এক লীগেরও কিছু কম দূরে দেহ-জাংগি নামে একটি গাঁ রয়েছে। ওখানে একজন কামার আছে, আর আছে হাজারাজাতের ‘হাকিমে’র একটি কিল্লা।’
সুতারাং চকচকে বরফের উপর দিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ৈ আমরা চললাম দেহ-জংগি, একটু মন্থর গতিতে, যাতে আমার ঘোড়া ক্লান্ত হয়ে না পড়ে।
‘হাকিম’ বা জেলা শাসকটি ছিলেন বেঁটে-খাটো হাসি –খুশি এক তরুণ। বন্ধুভাবাপন্ন এই লোকটি তাঁর ছোটো –খাটো নির্জনতায় একজন বিদেশী মেহমান পেয়ে খুশী হলেন। তখন পর্যন্ত যে সব আফগানের সংগের আমার দেখা হয়েছে এবং পরেও আমি যে –সব আফগানকে দেখেছি তাদের মধ্যে এই তরুণই ছিলেন সবচেয়ে সাদাসিধা নিরহংকার, যদিও তিনি ছিলেন বাদশাহ আমান উল্লাহর খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তিনি ওখানে আমকে দুদিন অবস্থান করতে বাধ্য করেন।
দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যায় আমরা বসেছি রোজকার মতো ভুরি ভোজনে। এরপর একজন গেঁয়ো লোক সেতারের সংগে একটি গাঁধা গেয়ে আমাদের আপ্যায়িত করে। সে গান গাইছিলো পুশতুতে –যেভাষা আমি বুঝি না –কিন্তু তার গানের কয়েকটি ফার্সী শব্দ স্পষ্ট যেনো লাফ দিয়ে উঠলো মৃদুষ্ণ গালিচা –ঢাকা গরম পক্ষ এবং জানালার ফাঁক দিয়ে বরফের যে ঠাণ্ডা দীপ্তি এসেছে তারই পটভুমিতে।আমার মনে আছে, সে গাইছিলো গোলিয়াতের সংগে দাউদের যুদ্ধের কথা-ঈমানের সংগে পশু-শক্তির সংগ্রামের কথা-যদিও আমি গানের শব্দগুলি খুব অনুসরণ করতে পারছিলাম না, তবু গানের বক্তব্য স্পষ্ট হয়ে উঠলো আমার কাছে যখন তা শুরু হরো নরম মোলায়েম সুরে এবং তারপর তা উর্ধ্বাভিসারীহলো আবেগের প্রচণ্ড উচ্ছ্বাসে, একটা চূড়ান্ত বিজয়ের সহর্ষ চিৎকারে!
গানটি যখন থামলো, হাকিম মন্তব্য করেনঃ ‘দাউদ ছিলেন ক্ষুদ্র কিন্তু তাঁর ঈমান ছিলো বড়.. .
আমি তাঁর সংগে এই কথাগুলি যোগ না করে পারলাম না, ‘এবং আপনার সংখ্যায় অনেক কিন্তু আপনাদের ঈমান কম।’
আমার মেজবান আমার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকান এবং আমি প্রায় অনিচ্ছাকৃতভাবে যা বলে ফেলেছি তাতে অপ্রতিভ হয়ে তড়িঘড়ি আমার কথার ব্যাখ্যা শুরু করে দিই। আমার ব্যাখ্যা রূপ নেয় প্রশ্নের তীব্র স্রোতের।
-‘এ কেমন করে হলো যে , আমপনার মুসলমানেরা, আত্মবিশ্বাস হারিয় ফেললেন, যার ফলে একদিন আপনপাদের পূর্বপুরষেরা একশ ‘ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ধর্মকে বিস্তৃত করেছিলেন আরব দেশ থেকে পশ্চিমে সুদূর আটলান্টিক পর্যন্ত এবং পূবদিকে মহাচীনের অভ্যন্তরে, আর এখন নিজেদের এতে সহজে এতা দূর্বলের মতো সমর্পণ করছেন পাশ্চাত্যের চিন্তাধারা ও রীতিনীতির নিকট । কেন! আপনার, – যাঁদের পূর্বপুরুষেরা একদিন এমন একসময়ে পৃথিবীকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার আলোকে উদ্ভাসিত করেছিলেন যখন ইউরোপ নিমজ্জিত ছিলো চরম বর্বরতা ও অজ্ঞতার মধ্যে; এখন সাহস সঞ্চয় করতে পারছেন না আপনাদের আপন প্রগতীশীল উজ্জ্বল ধর্মাদর্শের দিকে ফিরে যাওয়ার? এ কি করে সম্ভব হলো যে, আতাতুর্ক, সেই নগণ্য মুখোশধারী ব্যক্তিটি, যে ইসলামের কোনো মূল্য আছে বলেই স্বীকার করে না, আপনার – মুসলমানদের কাছে সে হয়ে উঠেছে ‘মুসলিম পুনর্জাগরণের প্রতীক?’
আমার মেজবান স্তব্ধ, নির্বাক। বাইরে তখন বরফ পড়ছে। দেহ-জাংগি পৌছানোর আগে আগে আগে আমি বেদিন ও আনন্দ –মিশানো যে তরং অনুভব করছিলাম আবার তা অনুভব করি। আমি উপলদ্ধি করলাম –অতীতের সেই গৌরব যা একদিন ছিলো বাস্তব এবং সেই লজ্জায় যা একটি মহৎ সভ্যতার এই পরবর্তীকালের সন্তানদের অপমানে ঢেকে দিচ্ছিলো!
-আমাকে বলু- এ কেমন করে হলো যে, আপনাদের নবীর ধর্ম এবং এর সকল সরলতা ও স্বচ্ছতা আপনাদের আলিমদের বন্ধ্যা ধ্যান-ধারণা ও কূটতর্কের জঞ্জালের নীচে চাপা পড়ে গেলো? এ কেমন করে হলো যে, আপনাদের রাজা-বাদশাহ এবং বড় বড়ব জমিদারেরা ধন-ঐশ্বর্য এবং বিলাসিতার মধ্যে ফূর্তিতে মাতলামী করছে যখন তাদের বিপুল সংখ্যক মুসলিম ভাইয়েরা কোনো রকম জীবন ধারণ করছে অনির্বচনীয় দারিদ্র ও নোংরা পরিবেশে-যদিও আপনাদের নবী শিখিয়েছিলেন ‘কোনো মানুষই দাবি করতে পারে না সে মুমিন যদি সে নিজে পেট বোঝঅই করে খায় যখন তার প্রতিবেশী থাকে ক্ষুধার্ত?’ আপনি কি আমাকে বোঝাতে পারেন, আপনারা কে কেন স্ত্রীলোকদের ঠেলে সরিয়ে দিয়েছেন জীবনের পশ্চাদভূমিতে যদিও নবী এবং তাঁর সহচরদের চারপাশে যেসব মহিলা ছিলেন তাঁরা তাঁদের পরুষদের জীবনে অংশগ্রহণ করেছিলেন ব্যাপকভাবে? এ কেমন করে হলো যে, আপনার-মুসলমানদের মধ্যে অতো বেশি লোক অজ্ঞ এবং অতি সামান্য সংখ্যক মানুষই কেবল শিখতে ও পড়তে পারে-যদিও আপনাদের নবী ঘোষণা করেছিলেন, ‘জ্ঞানের অনুসন্ধান করা প্রত্যেক মুসলিম নর এবং নারীর জন্য বাধ্যতামূলক পবিত্রম কর্তব্য’, যদিও তিনি বলেছিলেন, ‘কেবলেই যে ব্যক্তি ধার্মিক তার উপার জ্ঞানী মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব অন্য সকল তারার উপ র পূর্ণিমার চাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের মতো?
তখনো কোনো কথা না বলে পলকহীন দৃষ্টিতে মেজবান আমার দিকে তাকিয়ে আছেন এবং আমি ভাবতে শুরু করি, আমার এই বিস্ফোরণে তিনি হয়ত আহত হয়েছেন, তাঁর অন্তরের গভীরে। বীণাবাদক লোকটি আমাকে অনুসরণ করার মতো ফার্সী বোঝে না বলে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে বিদেশী লোকটির দিকে- যে এতো আবেগের সংগে কথা বলেছে ‘হাকিমে’র সাথে। শেষ পর্যন্ত ‘হাকিম’ তাঁর চওড়া হলদে ভেড়ার চাদরটি গায়ে জড়ালেন, যেন তাঁর ঠান্ডা লেগেছে। তারপর ফিসফিস করে বললেনঃ
‘কিন্তু .. . আপনি তো একজন মুসলমান।.. .’
আমি সশব্দ হাসিতে উচ্চকিত হই এবং বলিঃ না, আমি মুসলিম নই। কিন্তু আমি ইসলামের মধ্যে এতো সৌন্দর্য দেখতে পেয়েছি যে, মাঝে মাঝে আমি রেগে যাই যখন দেখি আপনার এর অপচয় করছেন। .. . আমি যদি খুব রূঢ় কথা বলে থাকি আমাকে মাফ করবেন। আমি দুশমন হিসাবে কথা বলিনি।’
আপনি একজন মুসলমান; কেবল আপনি নিজে জানেন না, এই যা.. .।’ কেন আপনি এখানে, এই মুহূর্তে বলছেন না ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ –আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর রাসূল?” এবং কেন কার্যত একজন মুসলমান হচ্ছেন না, যেমনি আপনি ইতিমধ্যেই আছেন আপনার অন্তরে? বলুন ভাই, এখনি একথা উচ্চারণ করুণ, আগামীকাল আমি আপনার সাথে যাবো কাবুল আপনা নিয়ে যাবো ‘আমীরে’র কাছে, আর তিনি দু’বাহু বাড়িয়ে আপনাকে অভ্যর্থনা। তিনি আপনা দেবেন ঘরবাড়ি, বাগান এবং গরু-বাছুর, আর আমরা সবাই আপনাকে ভালোবাসবো। বলুন ভাইজান.. .
-‘আমি যদি কখনো একথা উচ্চারণ করি তা করবো এ কারণে যে, আমার মন শান্তিতে স্তিতি লাভ করেছে –‘আমীরে’র ঘরবাড়ি এবং বাগিচার জন্য নয়।’
কিন্তু তিনি জেদ করতে থাকে, ‘আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ ইসলাম সম্পর্কে যা জানি আপনি তো এখনি তার চাইতে অনেক বেশি জানেন। কী সেই জিনিসটি যা আপনি এখনো বুঝতে পারেননি?’
-‘প্রশ্নটি বোঝার নয়, বরং সন্দেহমুক্ত হয়ে এই বিশ্বাস করার প্রশ্নঃ এ প্রত্যয় যে, কুরআন প্রকৃত আল্লাহর বাণী এবং একজন মহামানবের বিস্ময়কর সৃষ্টি কেবল নয়.. .’
কিন্তু পরবর্তী ক’টি মাস আমার সে আফগান বন্ধুর কথাগুলি মন থেকে আমি কখনো সরিয়ে রাখতে পারলাম না।
কাবুল থেকে আমি দক্ষিণ আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে প্রাচীন নগরী গজনী হয়ে কয়েক হপ্তা ঘোড়ায় চড়ে সফর কর। গজনী থেকেই প্রায় এক হাজার বছর আগে মহাবীর মাহমুদ বার হয়েছিলেন ভারত বিজয়ে। আমি চলি বিদেশী শহরের মতো দেখতে কান্দাহারের ভেতর দিয়ে, যেখানে আপনি সাক্ষাত পাবেন পৃথিবীর দুর্ধর্ষতম যোদ্ধা উপজাতিগুলির। আমি পাড়ি দিই আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের মরুভূমি এবং আবার ফিরে আসি হিরাতে,যেখান থেকে শুরু হয়েছিলো আফগানিস্তা পায়ে চলার রাস্তা।
সে ছিলো ১৯২৬ ইংরেজি। শীতকালের শেষ দিকে আমি হিরাত ত্যাগ করি- আমরার স্বদেশমুখী দীর্ঘ সফরের প্রথম পর্যায়ে আমি ট্রেনে করে যাই আফগান সীমান্তে থেকে রুশ তুর্কিস্থানের মার্ভে, সেখান থেকে সমরখন্দে- সমরখন্দ থেকে বোখারায় এবং তাসখন্দে, আর সেখনা থেকে তুর্কমান স্তেপ অঞ্চল পাড়ি দিয়ে যাই উরাল আর মস্কোতে।
সোভিয়েত রাশিয়ার যে ছাপ আমার মনে প্রথম এবং সবচেয়ে স্থায়ীভাবে মুদ্রিত হয়ে আছে তা হচ্ছে মর্ভের রেল ষ্টেশনে একটা মস্ত বড়ো, অতি সুন্দরভাবে চিত্রিত পোষ্টার-যাতে দেখানো হয়েছিলোঃ নীল রংয়ের ঢিলা জামা পরা এক তরুণ প্রলেতারিয়া বুট জুতা দিয়ে লাথি মেরে মেঘ-ভরা আকাশে থেকে ফেলছে এক হাস্যকর সাদা দাড়িওয়ালা জোব্বা পরা ভদ্রলোককে। পোষ্টারের নীচে এই রুশ উপকথাটি ছিলো লিখিতঃ এভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমিকেরা খোদাকে লাথি মেরে তাড়িয়েছে আকাশ থেকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সোশ্যালিষ্ট রিপাবলিকের ‘বেজবোজনিকি’ (নাস্তিক) এসোসিয়েশন কর্তৃক প্রকাশিত।
যেখানে যাই, প্রত্যেক জায়গাই , এ ধরনের সরকার অনুমোদিত ধর্ম-বিরোধী প্রচারণ হুমড়ি খেড়ে পড়ে চোখের উপরঃ সরকারী দালান-কোঠায়, সড়কে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে যে কোন ইবাদত খানার আশেপাশে। তুর্কিস্থানে স্বভাবতই এসব ইবাদতখানার বেশির ভাগ ছিলো মসজিদ। প্রকাশ্য সালাতের জামাত নিষিদ্ধ ঘোষিত না হলেও মানুষ যাতে জামাতে শরিক হতে না পারে তার জন্য কর্তৃপক্ষ সকল চেষ্টাই করতো। আমি প্রায় শুনতাম, বিশেষ করে বোখারা এবং তাসখন্দেঃ যে মানুষই মসজিদে ঢোকে পুলিশ গোয়েন্দারা তার নাম টুকে রাখছেঃ কুরআনের কপিগুলি এক জায়গায় জমা করে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। আর তরুণ বেজবোজনিকিদের একটি মজার খেলা ছিলো মসজিদের ভেতরে শূকরের মাথা নিক্ষেপ করে। সত্যি একটি চমৎকার রীতি বলতে হয়।
এশীয় এবং ইউরোপীয় রাশিয়ার ভেতর দিয়ে কয়েক হপ্তা ভ্রমনের পর আমি যখন পোলাণ্ডের সীমান্ত অতিক্রম করি, আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমি সোজা চলে যাই ফ্রাংকফুর্ট এবং হাযির হই গিয়ে আমার সংবাদপত্রের এতোদিনের পরিচিত এলাকার মধ্যে। একথা বুঝতে আমার খুব দেরী হলো না যে, আমার অনুপস্থিতিকালে আমার নাম খুবেই মশহুর হযে পড়েছে এবং মধ্য ইউরোপের বৈদেশিক সংবাদদাতাদের মধ্যে সবচেযে যারা বেশি পরিচিত আমাকে এখন তাঁদেরই অন্যতম বলে মনে করা হচ্ছে। আমার কয়েকটি প্রবন্ধ-বিশেষ করে ইরানীদের জটিল ধর্মীয় মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে যে প্রবন্ধগুলি লিখেছিলাম সেগুলি-বিখ্যাত প্রচ্যবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো এবং সেগুলি যে স্বীকৃত লাভ করেছে তা মামুলি নয়। এই কৃতিত্বের বদৌলতে বার্লিনের একাডেমী অব জিওপলিটিক্স-এ কয়েকটি ভাষণ দেওয়ার জন্য আমি আমন্ত্রিণ হই। সেখানেই আমাকে বলা হলো- আমার বয়েসের একজন মানুষকে (তখনো ছাব্বিশ হয়নি আমার বয়ষ) এ ধরণের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে যা এর আগে কখনো ঘটেনি। সর্বসাধারনের অধিকতরো উপযোগী প্রবন্ধগুলি ফ্রাংকফুর্টার শঅইটৃঙের অনুমতি নিয়ে পুনর্মুদ্রণ করেছে অন্য অনেক সংবাদপত্র। আমি জানতে পারলাম, আমার একটি প্রবন্ধ পুনর্মুদ্রিত হযেছে প্রায় ত্রিশ বার সবদিক আমার ইরান সফর হয়েছিলো খুবই ফলপ্রসূ।
.. . …. … .. .. .. .. . এ সময়েই আমি এলসাকে বিয়ে করি। যে দুবছর আমি ইউরোপ থেকে দূরে ছিলাম তা আমাদের ভালবাসাকে দুর্বলতরো না করে বরং আরো মজবুত করেছিলো; আর এমন একটা খুশী আর আনন্দের সাথে আমি আমাদের দু’জনের বয়সের বৃহৎ ব্যবধান সম্পর্খে তার আশংকা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলাম জীবনে যা এর আগে আর কখনো আমি অনুভব করিনি।
-কিন্তু তুমি কেমন করে আমাকে বিয়ে করবে? এলসা যুক্তি পেশ করে, তোমার বয়স এখন ছাব্বিশও নয়, আর আমি এখন চল্লিশের উপরে। একটু ভেবে দেখোঃ তোমার বয়স যখন ত্রিশ হবে আমার বয়স হবে তখন পঁয়তাল্লিশ, আর যখন তুমি যখন চল্লিশে পৌছুবে আমি তো তখন বুড়ি.. .।
আমি উচ্চৈস্বরে হেসে উঠিঃ ‘তাতে কি হয়েছে? তোমাকে ছাড়া আমি আমার ভবিষ্যৎ কল্পনাও করতে পারি না।’
এবং শেষ পর্যন্ত এলসা হার মানে।
আমি অতিশয়োক্তি করিনি যখন আমি বললাম, এলসাকে বাদ দিয়ে ভবিষ্যতের কল্পনা করা আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়। সৌন্দর্য আর সহজাত মাধুর্য এলসাকে আমার নিকট এমন পরম আকর্ষণীয়া করে তুলেছিলো যে, অন্য কোনো স্ত্রীলোকের দিকে আমি তাকাতেও পারতাম না। আর জীবন থেকে আমি কী চাই এ বিষয়ে তার সুগ্রাহী বোধ আমার আশা ও আকাংখাকে করে আলোকিত এবং এগুলিকে করে তোলে আরো বেশি কংক্রীট, আরো বেশি ধার্য- আমার নিজের চিন্তা –ভাবনা যা কখনো করতে পারতো, তা থেকে এগুলিকে আরো কংক্রীট, আরো ধার্য করে তোলে।
একবার –খুব সম্ভব আমাদের বিয়ের এক হপ্তা পরে-এলসা মন্তব্য করেঃকী আশ্চর্য যে সকল মানুষের মধ্যে তুমিই ধর্মে মিষ্টি-সিজমকে অবজ্ঞা করছো.. . তুমি নিজেই তো একজন মিস্টিক-ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে এক ধরনের মিস্টিক, তোমার চারপাশের জীবনের দিকে তুমি আগাচ্ছো তোমার আঙুলের ডগায় পরশ করে করে, প্রত্যেক বস্তুর মধ্যেই একটা সুক্ষ্ণ জটিল মিষ্টিক নকশা দেখে দেখে-অনেক কিছুর মধ্যেই –যা অন্য মানুষের কাছে মনে হয় অতি তুচ্ছ, অতি সাধারণ.. .অথচ যে মুহূর্তে তুমি ধর্মের দিকে তাকাও তুমি তখন একেবারেই মগজসর্বস্ব। অন্য প্রায় সকল লোকের ক্ষেত্রেই তো এর বিপরীতটিই বরং হতো.. .
কিন্তু এলসা সত্যিই হতবুদ্ধি হয়নি। আমি যখন ইসলামের কথা তাকে বলতাম তখন আমি যে কিসের সন্ধানে রয়েছি তা সে জানতো, যদিও সে হয়তো আমার মতো এতো তীব্র তাগিদ অনুভব করেনি, তবু আমার প্রতি তার ভালোবাসাই তাকে আমার এ অনুসন্ধানে আমার অংশী করে তোলে।
প্রয়ই আমরা দুজন এক সংগে কুরআন পাঠ করি এবং কুরআনের বিভিন্ন ভাবধঅর নিয়ে দুজনে আলোচনা করি; আর এলসাও আমার মতোই এর নৈতিক শিক্ষা এর এর বাস্তব ব্যবহারিক নির্দেশেল মধ্যে যে আন্তরিক সংযোগ রয়েছে ক্রমেই অধিকতরো প্রভাবিত হয়ে উঠতে থাকে। আল –কুরআনের মতে, মানুষেল কাছ থেকে আল্লাহ অন্ধ আনুগত্য চান না, বরং আবেদন জানান তার বুদ্ধির প্রতি; তিনি মানুষের নিয়তি থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকেন না, বরং তিনি ‘তোমার ঘাড়ের রগের চাইতেও তোমার নিকটতরো’। তিনি ধর্ম এবং সামাজিক আচরণের মধ্যে টেনে দেননি কোনো ভেদরেখাঃ আর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সম্ভবত এই যে, আল্লাহ এই স্বতঃসিদ্ধ থেকে শুরু করেননি যে, জীবন মাত্রই জড় ও আত্মার দ্বন্ধে ভারাক্রান্ত এবং আলোর দিকেপথ পেতে হলে আত্মাকে মুক্ত করতে হবে দেহের বন্ধন থেকে। জীবনের অস্বীকৃতি এবং আত্মা –নিগ্রহ, তা যে ধরনেরই হোক না কেন, রসূল তাঁর নিন্দা করেছেন তাঁর এই ধরনের উক্তিতে, ‘জেনে রেখো, কৃচ্ছসাধন আমার জন্য নয়’ এবং ‘ইসলামে সন্ন্যাসবাদের স্থান নেই’। মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে কেবল যে একিট ইতিবাচক ফলপ্রসূ প্রবৃত্তি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে তা নয়, তাকে একটি নৈতিক স্বতঃসিদ্ধের পবিত্রতায়ও মণ্ডিত করা হয়েছে। কার্যত মানুষকে এই শিক্ষাই দেওয়া হয়েছেঃ তুমি যে কেবল তোমার জীবনের পুরাপুরি ব্যবহারই ‘করতো পারো’ তা নয়, তুমি তা করতে ‘বাধ্যও’ বটে।
ইসলামের একটি সুসংহত রূপ এমন এক চূড়ান্ততা ও নিশ্চয়তা নিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগলো যে, মাঝে মাঝে আমি বিস্ময়-বিমূঢ় হয়ে পড়তাম। এমন প্রক্রিয়ায় এটি আকার নিচ্ছিলো যাকে এক ধরনের মানসিক ওসমসিস বলেই বর্ণনা করা যেতে পারে, অর্থাৎ গত চার বছর ধরে জীবন পথে আমার টুকরা টুকরা যে জ্ঞান হয়েছে আমার পক্ষে সজ্ঞানে সেগুলিকে একত্রে গেঁথে তোলা এবং ‘বিধিবদ্ধ’ করার কোনো চেষ্টা ছাড়াই ধীরে ধীরে তা আকার নিচ্ছিলো। আমি আমার সামনে এমন একটা কিছু দেকতে পেলাম, যা এক নিখুঁত স্থাপত্য-শিল্পেরই অনুরূপ, যার সব কটি উপাদান-উপকরণকেই এরূপ সংগুতি রেকে ধারণ করা হয়েছে, যেনো প্রত্যেকটিই অপরের পরিপূরক ও সহায়ক হয়, যাতে বাহুল্য কিছু নেই এবং অভাবও কিছুরই নেই-এমন একটি সমতা ও সমাহিত ভাব, যা মানুষেল মধ্যে এ ধারণার জন্ম দেয় যে, ইসলামের দৃষ্টিভংগি এবং স্বতঃসিদ্ধের মধ্যেই রয়েছে প্রত্যেকটি বিষয়ের অবস্থান ‘তার যথাযথ স্থানে’।
তের-শ বছর আগে একটি মানুষ দাঁড়িয়ে এই ঘোষণা করেছিলেনঃআমি একজন মরণশীল মানুষ মাত্র; কিন্তু যিনি এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন, তিনি আমাকে আদেশ করেছেন তাঁর বাণী তোমাদের নিকট পৌছে দেওয়ার জন্য। তোমরা যাতে তাঁর দৃষ্টি-পরিকল্পনার সাথে সংগুতি রেখে জীবন-যাপন করতো পারো, সেজন্য তিনি আমকে আদেশ করেছেন, তাঁর অস্তিত্ব, সর্বশক্তিমত্তা ও সর্বদর্শিতার বিষয় তোমাদের ‘স্মরণ করিয়ে দিতে এবং তোমাদের সামনে আরচরণের একটি কর্মসূচী পেশ করতে। তোমরা যদি আমার এই তাগিদ ও এই কর্মসূচী গ্রহণ করো, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো’। এই ছিলো মুহাম্মদ (সা) –এর নবুয়তের সারকথা।
তিনি যে সামাজিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন সে হচ্ছে এক সরল জীবনের পরিকল্পনা, যা কেবল প্রকৃত মহত্তের সংগেই ধরাধরি করে চলে। এর সূচনা এই সূত্র থেকে যে, মানুষ এক জৈব সত্তা, যার রয়েছে জৈব চাহিদা এবং মানুষের স্রষ্টা কর্তৃক মানুষের প্রকৃতি এমনভাবেই সৃষ্ট যে, তাদের দৈহিক-মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়োজন পুরাপুরি মিটানোর জন্য তাদের অবশ্যি দলবদ্ধভাবে জীবন যাপন করতে হবেঃ সংক্ষেপে, মানুষ একে অন্যের উপর ‘নির্ভরশীল’। কোনো ব্যক্তির আধ্যাত্মিক উচ্চতা (সকল ধর্মেরই মূল লক্ষ্য) লাভে ধারাবাহিকতা নির্ভর করে সে তার চতুষ্পার্শের লোকদের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছে কি না, তাদরে দ্বারা উৎসাহিত ও রক্ষিত হয়েছে কি না, তার উপরঃ অবশ্য তার চারপাশের লোকেরাও তার কাছ থেকে আশা করে একই রূপ সহযোগীতা। মানুষের এই পারষ্পরিক নির্ভরশীলতাই হচ্ছে সেই কারণ যার জন্য ইসলামের ধর্মকে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীনীতি থেকে আলাদা করা যায়নি। মানুষের বাস্তব ব্যক্তিত্বের বিকাশের পথে বাধা পায় নূন্যতম সংখ্যক এবং উৎসাহ পায় যতো বেশি সম্ভব মনে হয়। এই-ই-আর কিছুই নয়-সমাজের সত্যিকার কর্তব্য সম্পর্কে ইসলামের ধারণা! আর এ কারণেই এটা খুব স্বাভঅবিক ছিলো যে, নবী মুহাম্মদ তাঁর রিসালাতের তেইশ বছরে যে –ব্যবস্থাকে রূপ দিয়েছিলেন তার সম্পর্খে কেবল রূহানী ব্যাপারের সংগেই ছিলো না, সকল প্রকার ব্যক্তিগত ও সামাজিক কাজকর্মের একটা কাঠামোও তাতে দেওয়া হয়েছিলো। এ ব্যবস্থায় কেবল ব্যক্তিগত সদাচরণের ধঅরণাকেই উচ্চে তুলে ধরা হয়নি, এই সদাচরণের ফলস্বরূপ যে সুষম সমাজের উদ্ভব হওয়া উচিত সে ধারণাকেও দিয়েছে সম্যক গুরুত্ব। একটি রাষ্ট্রনৈতিক সম্প্রদায়ের রূপরেখা মাত্র এতে দেওয়া হয়েছে-কেবল রূপরেখাই, কারণ মানুসের রাজনৈতিক প্রয়োজনের খুঁটিনাটি কালের দ্বারা সীমিত এবং সে কারনে পরিবর্তনশীল-আরো রয়েছে ব্যক্তিগত অধিকার ও সামাজিক দায়িত্বের স্কীম, যাতে ঐতিহাসিক বিবর্তনতের বাস্তবতাকে আগাম ধরে নেওয়অ হয়েছে সঠিকভাবে। ইসলামী জীবনপদ্ধতির আওতায় পড়ে জীবনের সকল দিক-নৈতিক এবং দৈহিক, ব্যক্তিগত এবং সামাজিক। রাসূলের শিক্ষায় দেহ এবং মনের সমস্যাকে, যৌন ও অর্থনৈতিক প্রশ্নকে তাদের ন্যায্য স্থান দেওয়া হয়েছে ধর্মতত্ত্ব ও ইবাদতের সমস্যার পাশাপশি এবং জীবনের সংগে যা –কিছু সম্পর্কিত কখনো এতোটা তুচ্ছ বিবেচিত হয়নি যে, ধর্মীয় চিন্তার বৃত্তের মদ্যে তাকে আনা যাবে না – এমন কি, ব্যবসা- বাণিজ্য, উত্তরাধিকার, সম্পত্তির অধিকার অথবা ভূমি স্বত্বের মতো নেহাৎ জাগতিক সমস্যাকে ও অতোটা তু্চ্ছ জ্ঞান করা হয়নি!
ইসলামী আইনের সবকটি ধারাই পরিকল্পিত হয়েছে জন্ম, জাতি , লিংগ পার্থক্য না করে অথবা সামাজিক আনুগত্য নির্বিশেষে, সমাজের সকল সদস্যের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা ও কল্যাণ বিধান হিসাবে। এ সমাজের প্রতিষ্ঠাতা বা তাঁর বংশধরদের জন্য কোন সুযোগ সুবিধা ও সংরক্ষিত ছিলো না। এবং অসিত্ব ছিলো না শ্রেণীর ধারণার। যার ইসলামে বিশ্বাস করে তাদের সকলের জন্য একইভাবে প্রযোজ্য সকল অধিকার, কর্তব্য সুযোগ-সুবিধা । আল্লাহ এবং মানুষের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্য কোনো কোনো পুরোহিতের প্রয়োজন নেই, কারণ তিনি জানেন যা তাদে হাতে আছে তাদের সম্মুকে এবং যা ওরা গোপন করে ওদের পশ্চাৎদেশে । আনুগত্য কেবল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি, নিজের মা-বাপের প্রতি ,এবং যে সমাজের লক্ষ্য পৃথিবীতে আল্লাহর রাজ্য স্থাপন সেই সমাজের প্রতি। এছাড়া আর কারো প্রতি কোনো আনুগত্যকে ইসলাম স্বীকার করে না, এবং এতে ঐ জাতীয় আনুগত্যের কোনো অবকাশ নেই যাতে বলা হয়, ‘ভালো হোক মন্দ হোক আমার দেশ’, অথবা ‘আমার জাতিই ঠিক’। এই নীতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মহানবী অত্যন্ত স্পষ্টভাবে একাধিকবার বলেছেনঃ সে আমার উম্মত নয় যে গোত্রগত দলীয় লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করে; সে আমার উম্মত নয় গোত্রগত দলীয় স্বার্থের জন্য লড়াই করে এবং সে আমার উম্মত নয় যে গোত্রগত দলপ্রীতির জন্য মারা যায়।
ইসলামের পূর্বে সকল রাজনৈতিক সংগঠন-এমকি ধর্মতান্ত্রিক অথবা আধা-ধর্মতান্ত্রিক ভিত্তির সংগঠনগুলিও-সীমাবদ্ধ ছিলো গোত্র এবং গোত্রগত সমরূপতার সংকীর্ণ ধারণার দ্বারা। তাই প্রাচীন মিসরের দেবতা-রাজারা নীল উপত্যকা এবং তার অধিবাসীদের সীমান্তের ওপারে কোনো কিছুর চিন্তা করতো না এবং হিব্রুদের প্রথম- দিকের ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যখন আল্লাহই রাজ্য শাসন করেন বলে মনে করা হতো তখনো অনিবার্যভাবেই আল্লাহ ছিলেন বনি-ইসরাঈলের আল্লাহ! পক্ষান্তরে, কুরআনী চিন্তাধঅরার কাঠামোর মধ্যে জন্ম অথবা গোত্রের প্রতি আনুগত্যের কোন স্থান নেই। ইসলামে এমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় সমাজের ধারণা করা হয়েছে যা গোত্র ও জাতের গতানুগতিক বিভাগকে অস্বীকার করে। এদিক দিয়ে ইসলাম ও খৃষ্টধর্মের লক্ষ্য অভিন্ন; একথা বলা যেতে পারেঃ উভয়েই একটি আন্তর্জাতিক সম্প্রাদায় গঠন করতে চায় , যা গড়ে উঠবে সাধারণ একটি আদর্শের প্রতি তাদের আনুগত্যের ভিত্তিতে। কিন্তু খৃষ্টধর্মে যেখানে এই নীতির কেবল নৈতিক ওকালতি করেই সন্তুষ্ঠ থেকেছে এবং সীজারকে তার প্রাপ্য দেবার জন্য খৃষ্টধর্মের অনুসারীদের পরামর্শ দিয়ে এ ধর্মের বিশ্বজনীন আবেদনকে কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে সীশাবদ্ধ রেখেছে, সেখানে ইসলাম দুনিয়ার সামনে এমন একট রাষ্ট্রনৈতিক সংগঠনের স্বপ্ন মেলে ধরেছে যেখানে ঐশী চেতনাই হবে মানুষের ব্যবহারিক আচরণের প্রধান চাবিকাঠি এবং সকল সামাজিক প্রতিষ্ঠানের একমাত্র ভিত্তি।
এভাবে, খৃষ্টধর্ম যা অপূর্ণ রেখে দিয়েছিলো তা পূর্ণ করে ইসলাম মানুষের বিকাশের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় যোগ করেঃ আর এক হচ্ছে, একটি মুক্ত আদর্শভিত্তিক সমাজের প্রথম দৃষ্টান্ত যা অতীতের রুদ্ধ, জাত অথবা ভৌগলিক দিক দিয়ে সীমাব্ধ, সমাজগুলি বিপরীত।
ইসলাম এমন একটি সভ্যতা কল্পনা করে এবং জন্ম দেয় যাতে জাতীয়বাদের অবকাশ নেই, নেই কোন কায়েমী স্বার্থ, কোন শ্রেনী-বিভাগ, কোন চার্চ পুরোহিত প্রথা জন্মগত আভিজাত্য। আসলে জন্মগত কোনো বৃত্তিই ইসলামে নেই। লক্ষ্য ছিলো আল্লাহর দিকে লক্ষ্য রেখে ধর্মতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এবং মানুষে মানুষে গণতন্ত্র স্থাপনের। এই নতুন সভ্যতার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য-যা ইসলামকে মানব ইতিহাসে আর সকল আন্দোলন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দিয়েছে –এই বাস্তব বিষয় যে, এ সভ্যতা সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর স্বেচ্ছা –সম্মতির ভিত্তিতে গড়ে উঠবে বরে কল্পনা করা হয়েছিলে এবং কার্যত স্বেচ্ছ-সম্মতির ফলেই তার জন্ম হয়েছিলো। ইতিহাসে পরিচিতি অন্য সকল সম্প্রদায়ে এবং সভ্যতায়ই পরস্পর বিরোধী স্বার্থের চাপ এবং পাল্টা পাপের সামাজিক প্রগতি –ইসলামে কিন্তু তা নয়। এখানে সমাজের প্রগতি হচ্ছে একটি মৌলিক সংবিধানের অবিচ্ছদ্য অংশ অন্য কথায়, মূলেই বিদ্যমান রয়েছে একটি প্রকৃত সামাজিক চুক্তিঃ পরবর্তী কালের ক্ষমতাধিকারীরা তাদের সুযোগ –সুবিধা রক্ষা করার জন্য যে বাক্যলংকারের আশ্রয় নিয়েছিলো সে বিচারে নয়-ইসলামী সভ্যতার বাস্তব ঐতিহাসিক উৎস হিসাবেই। আল কুরআন বলেঃ
দেখো, আল্লাহ বিশ্বাসীদের নিকট থেকে তাদের দেহ –প্রাণ এবং ধন সম্পদ খরিদ করে নিয়েছেন, পরিবর্তে তাদের দিয়েছেন জান্নাতের ওয়াদা.. . তাহলে তোমরা যা খরিদ করেছো তার জন্য আনন্দ করো, কারণ এ তো এক মহাসাফল্য।
আমি জানতাম, এই মহাসাফল্য –ইতিহাসে লিপিব্ধ সত্যিকার সামাজিক চু্ক্তির একমাত্র দৃষ্টান্ত মাত্র কিছু কালের জন্য রূপায়িত হয়েছিলো বাস্তবে। অথবা এ –ও বলা যায়, মাত্র কিছুকালের জন্যই একে বাস্তবে রুপায়িত করার জন্য ব্যাপক আকারে চেষ্টা করা হয়েছিলো। রসূলের মৃত্যুর পর একশ বছরের কম সময়ের মধ্যে ইসলামের আদি-রাষ্ট্রীয় রূপটি দূষিত হতে শুরু তরে এবং পরবর্তী শতকগুলিতে মূল কর্মসূচীটিকে ধীরে ধীরে পশ্চাতভূমিতে ঠেলে দেওয়া হয়। স্বাধীন নরনারীর স্বাধীন সম্মতির স্থান গ্রহণ করে ক্ষমতার জন্য্ বংশগত দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ। বংশগত রাজতন্ত্র যা ইসলামের ধর্মীয় চিন্তাধারার ঘোর বিরোধী যেমন বহু –ঈশ্বরবাদ তেমনি বিরোধী ইসলামের রাষ্ট্রনৈতিক ধ্যান-ধারণার শিগগিরিই মঞ্চ দখল করে বসলো এবং তার সংগে এলো বিভিন্ন রাজবংশের মধ্যে সংঘর্ষ ও ষড়যন্ত্র, গোত্রগত আনুগত্য ও ভালোমন্দের ধারণা,জোর –জুলুম এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার সেবাদাসী স্তরে ধর্মের সাধারণ অধঃপতন। সংক্ষেপে, ইতিহাসে সুপরিচিত ‘কায়েমী স্বার্থবাদী’দের সমগ্র দলটিই এসে হাজির হলো। কিছুকাল মহান ইসলামী চিন্তাবিদেরা ইসলামের সত্যিকার আদর্শকে বিকৃতির হাত থেকে বাঁচিয়ে উচ্ছে তুলে ধরার চেষ্টা করেন, কিন্তু তাঁদের পরে যাঁরা ছিলেন প্রতিভার দিক দিয়ে নিম্মতরো পর্যায়ের; তাঁরা দুই কিম্বা তিন শতাব্দী পরে হারিয়ে গেলেন বুদ্ধিবৃত্তিক মামুলী রীতি-প্রথার বদ্ধ জলায়। তাঁরা নিজেরা চিন্তা করার দায়িত্ব ত্যাগ করলেন এবং পূর্ববর্তী যুগগুলির মৃত বাগধারাগুলির পুনরাবৃত্তি করেই তাঁরা তুষ্ট থাকলেন, তাঁরা ভুলে গেলেন যে, প্রত্যেকটি মানবিক ‘মতই’ সময়ের দ্বারা সীমিত এবং তাতে ভ্রান্তির অবকাশ আচে আর এর কারণে চিরকাল তার নতুন রূপদানের প্রয়োজন আছে। ইসলামের মূল প্রবর্তনা শুরুতে যা ছিলো এতো প্রবল এবং প্রচন্ড-কিছুকালের জন্য মুসলিম কমনওয়েলথকে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশাল উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ছিলো যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক এবং শৈল্পিক কৃতিত্বের সেই উজ্জ্বল স্বপ্নের জগতে, যাকে ইতিহাসবিদেরা বর্ণনা করেন ইসলামের সোনালী যুগ বলে। কিন্তু আর কয়েক শতকের মধ্যেই এই উদ্যম ও প্রবর্তনাও মরে গেলো আত্মিক পুষ্টির অভাবে এবং মুসলিম সভ্যতা ক্রমেই হয়ে উঠলো অধিকতরো মাত্রায় স্রোতোহীন এবং সৃজনী-শক্তিবর্জিত।
. .. .. . .. . .. .
মুসলিম বিশ্বের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমার ধারণায় কোনো অস্পষ্টতা ছিলো না। যে-চার বছর আমি ঐসব দেশে কাটিযেছি তা থেকেই আমি দেখিছি যদিও ইসলাম এখনো জীবন্ত, যা ইসলামের অনুসারীদের বিশ্বকে দেখার বিশিষ্ট ভংগিতে এবং ইসলামের নৈতিক কর্তব্য বিষয়ক সূত্রগুলির নীরব স্বীকৃতিকে দৃশ্যমান, তবু তারা নিজেরা সেই সব লোকের মতোই ইসালমের পরিকল্পনাকে কার্যকরী করতে আজকের মুসলমানদের ব্যর্থতার চাইতেও, ঐ স্কীমের মধ্যেই যে –শক্তি ও সম্ভাবনা নিহিত রযেছে তার প্রতিই আমি ছিলাম বেশি আকৃষ্ট। আমার জন্য এটুকু জ্ঞানই যথেষ্ট ছিলো যে, ইসলামের ইতিহাসের একেবারে শুরুতে স্বল্পকালের জন্য হলেও ঐ স্কীমটিকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য একট সফল চেষ্টা ‘করা হয়েছিলো’। এবং যা এক সময়ে সম্ভব মনে হয়েছিলো তা অন্য সময়েও হয়তো সত্যি সম্ভব হতে পারে। আমিনিজেকে বলি- মুসলমানেরা যদি মূল শিক্ষা থেকে সরে গিয়ে আলস্য এবং অজ্ঞতায় নিমজ্জিত হয়েই থাকে,তাতে কী হয়েছে? আরবের নবী তেরোশো বছর আগে তাদের সামনে যে আদর্শ তলে ধরেছিলেন তার যদি সে আদর্শ মোতাবিক জীভন যাপন না করে তাতেই বা কি হলো-যদিসেই আদর্শটিই, যার এর বাণী শুনাবর জন্য আন্তরিকভাবেই ইচ্ছুক তাদে সকলের জন্য আজো উন্মক্ত থেকে থাকে?
এবং এ-ও হতে পারে, আমি মনে মনে ভাবি, পরে যারা এসেছে তাদের জন্য এ বাণীর প্রয়োজন আরে অনিবার্যভাবেই বেশি-মুহাম্মদের কালের লোকদের চাইতেও । াতরা এমন একটা পরিবেশে বাস করতো যা আমদের পরিবেশ থেকে ছিলো অনেক বেশি সরল, আর এজন্য তাদরে সমস্য এবং অসুবিধাদির সমাধান ছিলো অনেক বেশি সহজ। আমি যে জগতে বাস করছি তার সমগ্রটাই টলটলায়মান;কারণ আত্মিক দিক দিয়ে এবং সে কারণে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়েও ভাল কি এবং মন্দ কি সে সম্পর্কে কেনো ঐক্যমত্য নেই। আমি বিশ্বাস করতাম না যে, ব্যক্তি মানুসের ‘পরিত্রাণে’র প্রয়োজন আছেঃ কিন্তু এ আমার বিশ্বাস যে, আধুনিক সমাজের পরিত্রাণ আবশ্যক রয়েছে। আগের যে কোন সময়ের চাইতে ক্রমবর্ধমান নিশ্চয়তার সংগে আমি অনুভব করি, আমাদের এই কাল নতুন এক সমাজচুক্তির জন্য একটি দার্শনিক ভিত্তির মুখাপেক্ষীঃ এ কালের জন্য দরকার এমন একটি বিশ্বাসের, যা কেবল প্রগতির জন্য বৈষয়িক-প্রগতির শূন্যতা আমাদের নিকট উদঘটিত করে দেবে এবং তা সত্ত্বেও এই পৃথিবীর জীবনকে দেবে ন্যায্য পাওনা, আমাদের তা শেখাবে কী করে রূহানী এবং দৈহিক প্রয়োজনের মধ্যে স্থাপন করতে হবে ভারসাম্য; আর এভাবেই আমাদের বাঁচাবে সেই বিপর্যই থেকে যার মধ্যে আমরা ধেয়ে চলেছি হঠকারিতার সংগে।
.. . … …… .. .
একথা অত্যুক্তি হবে না যে, আমর জীবনেরে এই সময়টিতে,মনকে দখল করেছিলো ইসলামের সমস্যা – এটা তখন সমস্যই ছিলো আমার নিকট – অন্য সবকিছুকে আড়াল করে। সেই মুহূর্তে আমার একান্ত সমাহিত ভাব উঠেছিলো তার প্রাথমিক পর্যায়গুলিকে-যখন তা একটি অপরিচিত হয়তো বা আকর্ষণীয় আদর্শ ও সংস্কৃতির প্রতি এক বুদ্ধিবৃত্তিক আকর্ষনই কেবল ছিলো। কিন্তু তখন তা সত্যের জন্য এক তীব্র আবেগময় অনুসন্ধান হয়ে উঠেছে। এই অনুসন্ধানের সাথে তুলনায় গত দুবছরের সফরের দুঃসাহসিক অভিযানের চাঞ্চল্য পর্যন্ত তুচ্ছ হয়ে গেলোঃ পরিণাম হলো এই ফ্রাঙ্কফুর্টার শাইটুঙ-এর সম্পাদক আমার কাছ থেকে যে নতুন বইটি ন্যায় সংগতভাবেই আশা করছিলেন তা লেখার জন্য মনোযোগ দেওয়া আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়লো।
ডাঃ সাইমন বইটির রচনার ব্যাপারে আমর স্পষ্ট গড়িমাসি পহেলা প্রশ্রয়ের নযরেই দেখেছিলেন। আর যা-ই হোক আমি একটা দীর্ঘ সফর শেষে এই মাত্র ফিরে এসেছি এবং কোনো-না-কোনো রকমের ছুটি আমার পাওনা হয়েছে। আমার সাম্প্রতিক বিয়েও লেখার রুটিন থেকে কিছুটা অবকাশের প্রযোজনীয়তা আবশ্যক করে তুললো। কিন্তু এ ছুটি আর অককাশ যখন ডাঃসাইমন যা যুক্তিসঙ্গত মনে করেন তা ছাড়িয়ে, দীর্ঘতর হতে লাগলো তখন তিনি বললেন, আমর এখন মর্ত্যলোকে ফিরে আসা উচিত। পেছনের দিকে তাকালে মনে হয় তিনি ছিলেন খুবই বিবেচক; কিন্তু এ সময়ে তাকে ভিন্ন রকম মনে কহলো। ‘বইটি’ সম্পর্কে তাঁর ঘন ঘন এবং জরুরী জিজ্ঞাসার ফল তাঁর আশার বিপরীত হলোঃ আমার মনে হলো, যেনো একটা বোঝা আমার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে, আমি বইটির কথা মনে হলেই বিরক্ত বোধ করতে শুরু করলাম। আমি এখন পর্যন্ত যা দেখেছি তা বর্ণনা করার চাইতে এখনো আমাকে যা আবিষ্কার করতে হবে তাই নিয়ে ছিলাম অধিকতর ব্যস্ত।
শেষ পর্যন্ত ডঃ সাইমন ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে কর্কশ ;মন্তব্য করে বসলেনঃ আমি মনে করি না যে, কখনো তোমার দ্বারা এই বইটি লেখা হবে। তুমি তো ‘হরর লিব্রি’তে ভুগছো।
কিছুটা যেনো হুলবিদ্ধ নিয়েই আমি জবাব দিইঃ আমর অসুখ এর চেয়ে আরো মারাত্মক কিছুও হতে পারে। সম্ভবত আমি ভুগছি ‘হরর স্ক্রিভেন্ডিতে’।
-‘ভালো, তোমার যদি ঐ পীড়াই হয়ে থাকে’, তিনি তৎক্ষণাৎ মুখের উপর জবাব দেন –‘তুমি কি মনে করো’, ‘ফ্রাংকফুটার শাইটুঙ’ তোমার উপযুক্ত স্থান’? কথার পিঠে কথা বেড়ে চলো এবং আমাদের মতানৈক্য ক্রমে রূপ নেয় বিবাদে। সেদিনিই আমি ‘ফ্রাংকফুটার শাইটুঙ’ থেকে ইস্তফা দিই এবং এক হপ্তা পর এলসাকে নিয়ে বার্লিনের পথে রওয়ান করি।
অবশ্য সাংবাদিকতা ত্যাগ করার ই্চ্ছা আমার ছিলো না। কারণ , লেখা আমাকেযে স্বচ্ছন্দ জীবিকা এবং আনন্দ যুগিয়েছিলো (যা সাময়িক ভাবে নষ্ট করে দিয়েচিলো ওই ‘বইটি’) তা বাদ দিলেও মুসলিম জাহানে আবার আমার ফিরে যাওয়ার একমা্রত উপায় এই-ই ছিলো। আর মুসলিম জাহানে আমি ফিরে যেতে চাইছিরাম যে কেনো মূল্যে। কিন্তু গত চার বছরে আমি যে খ্যাতি লাভ করেছি, তাতে আমর জন্য খবরের কাগজের সংগে নতুন সংযোগ স্থাপন কঠিন ছিলো না। ফ্রাংকফুটারের সংগে আমর সম্পর্ক কেটে যাওয়ার পর আমি খুবেই সন্তোষজনক চুক্তি করি অন্য তিনটি সংবাদপত্রের সংগেঃ পত্রিকাগুলি হচ্ছে –জুরিখের ‘নিউজরখা শাইটুঙ’, আমস্টার্ডামের ‘টেলিগ্রাফ’ এবং কোলানের ‘কোলনিশে শাইটুঙ’। এখন থেকে এই তিনটি পত্রিকায় একযোগে মুদ্রিত হবে মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কিত আমার প্রবন্ধগুলি। ফ্রাংকফুটার শাইটুঙ –এর সাথে এই সংবাদপত্রগুলি তুলনীয় না হলেও ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাসমূহের অন্তর্গত ছিলো এগুলি।
সাময়িকভাবে আমি আর এলসা বার্লিনে ঠিকান গাড়ি। ওখানে আমি ‘একাডেমী অব জিও-পলিটিক্স-এ আমার ধারাবাহিক ভাষণগুলি সম্পূর্ণ করবো এবং ইসলাম বিষয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যাবো, এই ছিলো আমার ইরাদা।
আমাকে আবার দেখতে পেয়ে আমার সাবেক সাহিত্যিক বন্ধুরা খুশী হলো। কিন্তু আমি যখন মধ্যপ্রাচ্য যাই তখন আমাদের সাবেক সম্পর্কের সূত্রগুলি যেস্থানে রেখে গিয়েছিলাম ঠিক সেই জায়গা থেকে সে সম্পর্ক আবার শুরু করা কেন যেনো আর সহজ ছিলো না। আমরা অপরিচিত হয়ে উঠেছি, আমরা আর এই বুদ্ধিবৃত্তিক ভাষায় কথা বলীছ না। বিশেষ করে, আমি যে ইসলাম নিয়ে মগ্ন রয়েছি সে বিষয়ে আমার কোন বন্ধু থেকেই সহৃদয় কোনো উপলব্ধি পেলাম না। আমি যখন তাদের বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে, একটি বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সামাজিক ধারণা হিসাবে ইসলাম তুলনায় অন্য যে কোন ভাবাদর্শ থেকে শ্রেষ্ঠতর, তখন তারা প্রত্যেকেই, বলা যায় ব্যতিক্রম ব্যতিরেকেই, বিস্ময় বিমূঢ়তার সংগে মাথা নাড়লো। কখনো কখনো ইসলামের কোনো –না কোনো প্রস্তাবের যুক্তিবত্তা ওরা স্বীকার করলেও ওদের অধিকাংশরেই মত ছিলোঃ পুরানো ধর্মগুলি হচ্ছে অতীতের বিষয় আর আমাদের কালের দাবী হচ্ছেঃ এক নতুন ‘মানবতাবদী’ দৃষ্টিভংগি। এমনকি, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সকল বৈধতা যারা এক কথায উড়িয়ে দিতো না, তারা ও এই পশ্চিমী জনসাধারণের এ মনোভাব ত্যাগ করতে কিছুতেই প্রস্তুত ছিলো না যে, জাগতিক ব্যাপরের সংগে প্রকাশ্য সম্পর্কিত হওয়ায় সেই –‘অতীন্দ্রিয়বাদ’ ইসলামে নেই, মানুষ যা ধর্ম থেকে প্রত্যাশা করার অধিকার রাখে।
এ আবিষ্কারে বরং আমি তাজ্জব হই যে, ইসলামের সে দিকটিই, যা আমাকে পয়রা আকৃষ্ট করেছে, অর্থাৎ দৈহিক এবং আত্মিক এই পৃথক পৃথক সত্যকে ভাগ না করা এবং ঈমান লাভের জন্য যুক্তির উপর তাগিদ –তা সে-সব বুদ্ধিজীবীর হৃদয়ে অতি সামান্যই আবেদন জাগালো যারা অন্য দিক দিয়ে জীবনে যুক্তির প্রভাব সবচেয়ে বেশি বলে দাবী করতে অভ্যস্ত। কেবলমাত্র ধর্মীয় ক্ষেত্রে এসেই ওরা ওদের খুবই –অভ্যস্ত যু্ক্তিবাদী ও বাস্তববাদী ভূমিকা থেকে সহজভাবেই পিছু হটে যায়। এ ব্যাপারে আমার সেই স্বল্প কটি বন্ধু, যার ধর্মের প্রতি অনুরাগী এবং তারা যারা ধর্মকে জীর্ণ প্রথার বেশি কিছু ভাবতে আর রাজী নয়, তাদের মধ্যে কোনো ব্যবধানই আমি দেখতে পেলাম না।
অবশ্য ওদের সংকট কোথায় এক সময আমি বুঝতে পারি। আমি দেখতে শুরু করলাম –যেসব মানুষ খৃশ্চান ভাবধারার পরিবেশে মানুষ হয়েছে – যে চিন্তাধারায় জোর দেওয়া হয়েছে, সকল সত্যিখার ধর্মীয় অভিজ্ঞাতায় নিহিত বলে অনুমতি ‘অতি প্রাকৃতের উপর’ –তাঁদের দৃষ্টিতে একটি প্রবল যুক্তিবাদী দৃষ্টিভংগির ধর্মের আধ্যাত্মিক মূল্য থেকে একটা বিচ্যুতি বলে মনে হয়ে থাকে। এই মনোভংগি বিশ্বাসী খৃশ্চানদের মধ্যেই কেবল সীমাবদ্ধ ছিলো না –অন্য কোনো ধর্মের সংস্পর্শে না এসে কেবল খৃষ্টধমেৃর সংগে ইউরোপের সূদীর্ঘ সহবাসের ফলে সংশয়বাদী ইউরোপীয়রা পর্যন্ত অবচেতনভাকে খৃশ্চীয় ধ্যান-ধারণার লেন্স দিয়ে সকল ধর্মীয় অভিজ্ঞতার প্রতি তাকাতে শিছেছে। এবং কেবল সেই অবস্থায়ই এরা ধর্মীয় অভিজ্ঞতাকে ‘সত্য’ বলে গণ্য করে যদি এর সংগে গুপ্ত এবং বুদ্ধির অজ্ঞেয় কোনো কিছুর সামনে সভয় ঐশী ভক্তির পুরক-রোমাঞ্চ থাকে। ইসলাম সে চাহিদা পূরণ করে নাঃ একটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক সমতলে জীবেনের দৈহিক এবং আত্মিক দিকগুলির মধ্যে একটি সমন্বয় সাধনের উপর ইসলাম জোর দেয়। বস্তুত ইসলামের বিশ্ব –দৃষ্টি-খৃশ্চীয় বিশ্ব –দৃষ্টি থেকে এতই পৃথক যে, একটির সত্যতা গ্রহণ করলে অন্যটির সত্যতা সম্পর্কে অপরিহার্যভাবেই প্রশ্ন উঠবে, কারণ খৃশ্চীয় বিশ্ব-দৃষ্টির উপরই পাশ্চাত্যের প্রায় সকল নৈতিক ধ্যান-ধারণার ভিত্তি।
আর আমার ক্ষেত্রে ব্যাপার হলো এইঃ আমি টের পাচ্ছিলাম আমাকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ইসলামের দিকে। কিন্তু শেষবারের মতো একটি দ্বিধা আমাকে বাধ্য করলো চূড়ান্ত অপরিবর্তনীয় পদক্ষেপটি মূতবি রাখতে। ইসলাম গ্রহণ করার চিন্তা মনে হলো একট সেতুতে ওঠার প্রাস, যে-সেতুটি দুটি ভিন্ন জগতের মধ্যকার শূন্যতার উপর দাঁড়িয়ে আছেঃ এত দীর্ঘ সে সেতু যে, সেতুর অপর প্রান্ত দৃষ্টিগোচর হয়ে ওঠার আগে এমন একবিন্দু পর্যন্ত পৌছুতে হবে যেখান থেকে ফিরে আসার আর পথ নেই। আমি খুব ভাল করেই জানতাম –আমি যদি মুসলমান হয়ে পড়ি তাহলে যে জগতের মধ্যে আমি মানুষ হয়েছি তার সাথে আমার সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলতে হবে। এর অন্য কোনো বিকল্পই আর সম্ভব ছিলো না। মুহাম্মদের বাণী সত্যি সত্যি অনুসরণ করা আর সম্পূর্ণ উল্টা ধ্যান-ধারণায় শাসিত সমাজের সাথে একই সংগে অন্তরের সম্পর্ক বজায় রেখে চলা সম্ভব ছিলো না। কিন্তু ইসলাম কি সত্যিই আল্লাহর কাছ থেকে আগত বাণী –নাকী কেবলই একজন মহান অথচ ভূল-ক্রটির অধীনে মানুষের প্রজ্ঞামাত্র.. .?
একদিন , ১৯২৬ সনের সেপ্টেম্বর মাসে আমি েএবং এলসা আমর দুজন সফর করছিলাম বার্লিনের ভূগর্ভস্থ রেলপথে। ওটি ছিরো একটি প্রথম শ্রেণীর কামরা । আমার উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টি পড়লো আমার ঠিক বিপরীতদিকে বসা পরিপাটি পোশাক পরা একজন মানুষের উপরঃবোঝা যাচ্ছে লোকটি একজন ধনী ব্যবসায়ী,তাঁর হাটার উপর রয়েছে একটি চমৎকার ব্রীফকেস এবং ডান হাতে একটা বড় আকারের হীরার আংটি। আমার মনে এ অলস ভাবনার উদয় হলো এ স্থূলকায় লোকটির চেহারা , তখনকার দিনে মধ্য ইউরোপের সর্বত্র সমৃদ্ধির যে চিত্র দেখ যেতো সেই চিত্রের মধ্যে কি চমৎকারই না মানিয়েছেঃ যে সমৃদ্ধি এ কারণে আরো বেশি পষ্ট যে, তা এসেছিলো কয়েক বছর স্থায়ী মুদ্রাস্ফীতির পরে, যখন গোটা অর্থনৈতিক জীবনই লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়েছিলো এবং কদর্য চেহারা হয়ে পড়েছিলো ব্যতিক্রমহীন। এখন প্রায় সব লোকই ভাল পোশাক পরে, খেতে পায় প্রচুর, আর এজন্য আমার বিপরীতদিকের লোকটিকে কোনো ব্যতিক্রম মনে হলো না। কিন্তু আমি যখন তার মুখের দিকে তাকালাম, মনে হলো একটি সুখী মুখের দিকে তাকাচ্ছি। মনে হলো, লোকটি যেনো উদ্বিগ্নঃ এবং কেবল উদ্বিগ্ন নয়, বরং তীব্র অসুখী; চার চোখ দুটি উদাস দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে আর মুখের কোণা যেনো যন্ত্রণায় কুঁচকানো,তবে দৈহিক যন্ত্রণায় নয়।আমি অভদ্র হতে চাইনা। এজন্য আমি আমার চোখ সরিয়ে নিই এবং তার ঠিক পরেই দেখতে পাই একটি মহিলাকে, দেখতে বেশ নাজনীন,সুন্দরী। তার মুখেও দেখা গেলো এক অদ্ভুত অসুখী অভিব্যক্তি, যেনো এমন যেন এমন কিছু সে ভাবছে অথবা এমন কিছুর অভিজ্ঞতা তার হচ্ছে যা তার জন্য যন্ত্রণাদায়ক। তা সত্ত্বেও তার মুখ অচঞ্চল রয়েছে, যেনো একটা স্থির হাসির মধ্যে; আমার সন্দেহ নেই মেয়েটির জন্য এ ছিলো একটি অভ্যস্ত ব্যাপার। এরপর আমি ঘুরে কম্পার্টমেন্টের অন্য সকল যাত্রীর মুখের উপর তাকাতে থাকি –ব্যতিক্রমহীনভাবে সবিই সেই সব লোকের মুখ, যাদের পরণে রয়েছে মূল্যবান পোশাক, যার খায় দায় প্রচুরঃ আর ওদের প্রায় সকলের মধ্যেই দেখতে পেলাম দুঃখের এক অভিব্যক্তি, এতো গোপন যে, সেই মুখের মালিক সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেতন বলেই মনে হলো।
সত্যি ভাবি অদ্ভুদ ব্যাপার। আমি আমার চারপাশে এর আগে আর কখনো একগুলি অসুখী মুখ দেখিনি, কিংবা ওদের মধ্যে থেকে এই মুহূর্তে যা এতো প্রবলভাবে উচ্চারিত হচ্ছে হয়তো এর আগে আমিই কখনো তার খোঁজ করিনি। ধারণাটা এতো তীব্র হলো যে, আমি এলসাকে সে সম্পর্কে বলি। এবং সেও চারদিকে তাকাতে লাগলো-মানুষের চেহারা পড়তে অভ্যস্ত এক চিত্রকরের সজাগ চোখ মেলে। তারপর সে বিস্মিত হয়ে মুখ ফেরালো আমার দিকে আর বললোঃ ‘তুমি ঠিকই বলেছো, ওরা সকলেই এভাবে তাকাচ্ছে যেনো জাহান্নামের কষ্ট ভোগ করছে- আমি ভেবে বিস্মিত হইঃ ওরা নিজেরা কি জানে, ওদের ভেতর কী ঘটছে?’
আমি জানি যে, ওরা তা জানে না। -যদি জানতোই তাহলে যেভাবে ওরা জীবনের অপচয় করে চলেছে তা করতে পারতো না। বাধ্যতামুলক সত্যে বিশ্বাস ক’রে, নিজেদের জীবন-মান উন্নত করার কামনার বাইরে জীবনের কোনো লক্ষ্য না রেখে, অধিকতরো বৈষয়িক আরাম-আয়েসের উপকরণ, অধিকতরো সুক্ষ্ম যন্ত্রপাতি(gadgets)এবং সম্ভবত অধিকতরো ক্ষমতা অর্জনের আশা ছাড়া অন্য কোনো আশাই রেখে এভাবে জীবনকে বরবাদ করা সম্ভব হতো না ওদের পক্ষে-
আমরা যখন বাড়ি ফিরে এলাম হঠাৎ আমার চোখ পড়লো আমার ডেস্কের উপর, যার উপর মেলা রয়েছে একখন্ড কুরআন যা আমি আগে পড়ছিলাম। যান্ত্রিকভাবে আমি কুরআনটি হাতে তুরে নিই তুলে রাখবার জন্য। কিন্তু আমি যখন ওটি বন্ধ করতে যাচ্ছি আমার চোখ পড়লো আমার সামনে মেলা পৃষ্ঠাটির উপর এবং আমি পড়তে শুরু করিঃ
-তোমরা, আরো চাই, আরো বেশি চাই, এই লোভে আচ্ছন্ন হয়ে থাকো যতক্ষণ না তোমারা পৌছাও তোমাদের কবরে- না, এটা ঠিক নয়, তোমারা জানতে পারবে-না, ওটা ঠিক নয়, অবশ্যই জানতে পারবে তোমরা; যদি তোমরা জানতে সুনিশ্চিত জ্ঞানের সাহয্যে নিশ্চয়ই তোমরা দেখতে পেতে তোমরা রয়েছো জাহান্নামের মধ্যে। একসময় অবশ্য তা দেখতে পাবে নিশ্চিত দৃষ্টিতে এবং সেই দিন তোমাদের জিজ্ঞাস করা হবে তোমরা কি করেছিলে যে –অনুগ্রহ তোমাদের দান করা হয়েছিলো তা দিয়ে?
মুহূর্তের জন্য আমি নির্বাক হয় যাই, আমার মুখে কোনো কথা সরে না। মনো হরো বইটি আমার হাতে কাঁপছে। তারপর আমি তা তুলে দিলাম এলসার হাতে-এটি পড়ো আমরা পাতাল রেলপথে যা দেখেছিলাম একি তারই জবাব নয়?
হ্যাঁ, এটি তারই জবাবঃ এমন এক চূড়ান্ত জবাব যে অকস্মাৎ সমস্ত সন্দেহ চুরমার হয়ে গেলো। এখন আমি উপলব্ধি করলাম সন্দেহতীতভাবে-আমার হাতে যে কিতাবটি আমি ধরে আছি তা একটি ইলাহী প্রত্যাদিষ্ট কিতাবঃ কারণ যদিও তা মানুষের সামনে পেশ করা হয়েছিলো ১৩০০ বছরেও বেশি আগে, তবু এতে এমন কিছুর আগাম ধারণ করা হয়েছে যা কেবল আমাদের এই জটিল যান্ত্রিক, অবাস্তব কল্পনা-কবলিত জামানায়ই,সত্য হতে পারে।
লোভ মানুষের সবসময়ই ছিলোঃ কিন্তু এর আগে লোভ কখনো জিনিসপত্র সংগ্রহের কেবল একটা আগ্রহকে ছাপিয়ে উঠতে পারেনি এবং এমন নেশা হয়ে উঠতে পারেনি যা অন্য সবকিছুর প্রতি দৃষ্টিকে করে দেয় ঝাপসাঃ একটি অদম্য-অধিক পাওয়ার অধিক করার, অধিক ফন্দি আঁটার, গতকালের চাইতে আজকে বেশি এবং আজকের চাইতে আগামীকাল বেশিঃ একটি দানব সওয়ার হয়েছে মানুষের কাঁধের উপরে এবং তাদের হৃদয়ে চাবৃক কষে হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এমন সব লক্ষ্যের দিকে যা ঝলমল করছে দূরে, বিদ্রপাত্মকভাবে এবং যখনি তার কাছে পৌছুনো হচ্ছে তা মিলিয়ে যাচ্ছে তুচ্ছ শূন্যতায়। সবসময়ই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে-সামনে রয়েছে নতুন নতুন লক্ষ্য- আরো অধিক উজ্জ্বল, আরো অধিক প্রলোভন জাগানো লক্ষ্য, যতক্ষণ না সেগুলি দিগন্ত সীমানায় রয়েছে এবং সেই ক্ষুধা, সেই অতৃপ্ত ক্ষুধা, নিত্য-নতুন লক্ষ্যের জন্য যা চিবিয়ে খাচ্ছে মানুষের আত্মাকেঃ না, যদি তোমরা জানতে তোমরা দেখতে পেতে সেই জাহান্নাম, যার মধ্যে তোমরা রয়েছো-
আমি দেখতে পেলাম দূর আরবের সুদূর অতীতের কোনো মানুষের মানবিক প্রজ্ঞামাত্র এ নয়। তিনি যতো প্রজ্ঞাবানই হোন, এ রকম প্রকজন মানুষের পক্ষে কিছুতেই আপন শক্তিতে এই বিশ শতকের নিজস্ব যন্ত্রণা আগাম দেখা সম্ভব ছিলো না। কুরআন থেকে উচ্চারিত হলো একটা কণ্ঠস্বর যা বৃহত্তর মহত্তর মুহাম্মদের কণ্ঠস্বর থেকে. ..।
পাঁচ
নবীর মসজিদের প্রংগনে নেমে এসেছে অন্ধকার, যার মধ্যে এখানে ওখানে কিচু আলো ফুটে উঠেছে কেবল খিলানের থামগুলির মধ্যে লম্বা শিকলে ঝুলানো তেরের প্রদীপগুলি থেকে। শায়খ আবদুল্লাহ বুলাইহিদ তাঁর বুকের উপর মাথা ঝুঁকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। তাঁকে যে জানে না তার মনে হতে পারে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন; কিন্তু আমি জানি, তিনি আমার বর্ণনা শনছেন গভীর তন্ময়তার সাথে এবং মানুষ ও তাদের হৃদয় সম্পর্কে তাঁর নিজের যে বিপুল অভিজ্ঞতা রয়েছে তারই নকশাটির সাথে তা মিলিয়ে দেখবার চেষ্টা করছেন। অনেকক্ষণ পর তিনি তাঁর মাথ তোলেন এবং চোখ মেলে চানঃ
-এবং তারপর? তারপর তুমি কি করলেন?
– যা স্বাভাবিক এবং অনিবার্য তা-ই-শায়খ। আমি আমার এক মুসলিম বন্ধুকে খুঁজে বর করলাম। তিনি একজন ভারতীয় এবং সে সময়ে বার্লিনের ছোট্ট মুসলিম সমাজটির প্রধান ছিলেন তিনি। আমি তাঁকে বললামঃ আমি ইসলাম কবুল করতে চাই। তিনি আমার দিকে তাঁর ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং আমি আমার ডান হাত সেই হাতে রাখলাম আর দু’জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে ঘোষণা করলাম ঃ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ-আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর রসূল ১[ঈমান সম্পর্কে এই ঘোষণা মুসলমান হওয়ার জন্য একমাত্র আবশ্যকীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান ইসলামে রাসূল এবং নবী শব্দ দুটির একটিকে অপরটির পরিবর্র্তে ব্যবহার করা যায় প্রধান প্রধান নবীদের ক্ষেত্রে, যাঁরা একেকটি নতুন বাণী বহণ করেন, যেমন মুহাম্মদ, ঈসা, মূসা, ইবরাহীম] কয়েক সপ্তাহ পরে আমার স্ত্রীও ইসলাম কবুল করেন।
-‘এবং তোমার লোকেরা তখন কি বললো?’
-‘হ্যাঁ, ওরা তা পছন্দ করেনি। আমি যখন আমার আব্বাকে জানালাম আমি মুসলমান হয়েছি, তিনি আমার চিঠির জবাব পর্যন্ত দিলেন না। কয়েকমাস পর আমার বোন আমাকে লিখলো, আমার আব্বা আমাকে মৃত বলে গণ্য করেন.. . তখন আমি আরেকটিক চিঠি পাঠাই এবং তাঁকে এ নিশ্চয়তা দিই যে, আমার ইসলাম গ্রহণ তার প্রতি আমার মনোভাব বা তাঁর জন্য আমার ভালবাসায় কোনো পরিবর্তন আনেনি। বরং ইসলাম আমাকে আমার আব্বা-আম্মাকে সকলের উপরে ভালবাসতে ও সম্মান করতে শেখায়। কিন্তু এ চিঠিরও জবাব মিলেনি।’
-তোমার আব্বা নিশ্চয় তাঁর ধর্মের প্রতি খুবই অনুরাগী.. .’
-‘তা নয় শায়খ, তিনি তা নন এবং এটিই হচ্ছে এ কাহিনীর সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক। আমার মনে হয়, তিনি আমাকে রেনিগেড –মুর্তাদ মনে করেন, তাঁর ধর্ম থেকে ততোটা নয় (কারণ ধর্ম কখনো তেমন প্রবলভাবে তাঁকে ধরে রাখেনি) যতোটা সেই সমাজ থেকে যার মদ্যে তিনি মানুষ হয়েছেন এবং সেই প্রস্তুতি থেকে যার সাথে তিনি যুক্ত।’
-‘আর, এরপর কি তাঁর সংগে তোমার দেখা হয়নি’?
-‘না, আমাদের ইসলাম গ্রহনের পরপরই আমি এবং আমার স্ত্রী ইউরোপ ত্যাগ করি। ওখানে আর থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। আর কখনো ফিরে যাইনি আমি’.. .২[১৯৩৫ সনে আমাদের সম্পর্ক আবার পুনরুজ্জীবিত হয়, যখন আমার পিতা আমার ইসলাম গ্রহণের কারণগুলি শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারলেন এবং তার মর্যাদও দিতে পারলেন, যদিও আর কখনো আমাদের সাক্ষাৎ বা দেখা হয়নি। ১৯৪২ সাল পর্যন্ত আমরা নিয়মিত পত্র যোগাযোগ বজায় রাখি; ঐ বছরই নাৎসীরা আমার আব্বা ও বোনকে ভিয়েনা থেকে নির্বাসন দেয় এবং পরে তারা নাৎসী বন্দী শিবিরে মারা যান।