স্বপ্ন
এক
একজন মহান আরব ‘আমীরে’র দোস্ত এবং মেহমান হওয়া মানেই হচ্ছে তাঁর সকল কর্মচারী, সকল ‘রাজাজিল’, রাজধানীর সকল দোকানদার, এমনকি তাঁর হুকুমতের অধীন সকল বেদুঈনের দ্বারা দোস্ত এবং মেহমান বলে বিবেচিত হওয়া। মেহমান এমন কোন ইচ্ছা ক্বচিৎ ব্যক্ত করতে পারেন যা সহসা পূরণ করা হচ্ছে না- যখনি তা পূরণ করা সম্ভব; ঘণ্টায় ঘণ্টায় তিনি আচ্ছন্ন অভিভূত হন আবেগ-উষ্ণ নির্বিকার সহৃদয়তায়, যা তাঁকে ঘিরে থাকে, যেমন কিল্লার প্রশস্ত হলঘর এবং করিডোরগুলিতে তেমনি শহরের বাজারগুলিতে- একটুও কম নয়।
আগে যেমন প্রায়ই ঘটেছে এবারো তাই ঘটলো আমার বেলায়, হাইলে আমার দু’দিনের অবস্থিতিকালে। যখন আমি কফি খেতে ইচ্ছা করি সংগে সংগে আমার ব্যক্তিগত অভ্যর্থনা কক্ষে বেজে ওঠে কাসার হামানদিস্তার সুরেলা ধ্বনি। কিছুক্ষণ আগে বাজারে আমি যে-সুন্দর জীনটি দেখেছিলাম তার কথা জায়েদের নিকট উল্লেখ করি, আমীরে’র ওকরদের একজন তা শুনতে পায় এবং বিকালে সে জিনিসটি এনে রেখে দেওয়া হয় আমার পায়ের কাছে। দিনের মধ্যে কয়েকবারই আসে একেকটি সওগাত- একেকটি উপহার; আামের নকশা আঁকা কাশ্মীরী পশমের একটি লম্বা জোব্বা, একটি ফুলতোলা ‘কুফিয়া’ জীনের জন্য একটি সফেদ বাগদাদী ভেড়ার চামড়ার অথবা রূপার হাতলাওয়ালা একটি বাঁকা নযদী ছোরা… আর আমি, ভবঘুরে আমি তার বদলে ইবনে মুসা’কে কিছই দিতে পারছি না, আরব মুলুকের একটি বড় মাপের ইংরেজি মানচিত্র ছাড়া। তিনি ভারী খুশি হলেন যখন দেখলেন আমি সেই মানচিত্রটিকে কষ্ট করে চিহ্নিত করেছি বিভিন্ন আরবী নাম দিয়ে।
ইবনে মুসা’দের মহানুভবতার একটি প্রবল সাদৃশ্য রয়েছে বাদশাহ ইবনে সউদের ব্যবহারের সাথে। অবশ্য তাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা বিচার করলে কেই তাতে বিস্ময় বোধ করবে না। তাঁরা সম্পর্কে যে কেবল জ্ঞাতি ভাই তাই নয়, ইবনে সউদ যখন তরুণ ছিলেন এবং ইবনে মুসা’দের ছিলেন তখনো একটি বালক, সে সময় থেকেই তাঁরা, বাদশাহর রাজত্বের প্রথমদিকের প্রায সকল বিপদ-আপদে, বিপর্যয়ে ও স্বপ্নে ছিলেন একে অপরের সাথী। তাছাড়া, বহু বছর আগে তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক আরো মজবুত হয় ইবনে মুসা’দের বোন যওহারার সাথে ইবনে সউদের শাদির ফলে। বাদশাহ এরআগে বা পরে যতো শাদি করেছেন তাঁদের সকলের চেয়ে এ মহিলার ইজ্জৎ ছিলো তাঁর নিকট অনেক বেশি।
….. …… ….. …….
যদিও বহু মানুষ তাঁর বন্ধুত্ব পেয়েছেন তবু খুব বেশি লোক ইবনে সউদের প্রকৃতির সবচেয়ে নিবিড় এবং সম্ভবত সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিকটি নিরীক্ষণ করার সুযোগ পাননি। সেই দিকটি কী? তাঁর ভালোবাসার বিপুল সামর্থ্য, যাকে বিকশিত হতে ও টিকে থাকতে দিলে, তিনি যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন হয়তো তার চেয়ে অনেক বেশি উচ্চতায় পৌঁছুতে পারেতেন। তিনি যে-সব রমনীকে শাদি করেছেন ও তালাক দিয়েছেন তাঁদের বিপুল সংখ্যার উপর এত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে, বাইরের বহু লোক মনে করে তিনি একজন লম্পট, একজন কামুক বিশেষ, যিনি ডুবে আছেন দৈনিক উল্লাসের অনন্ত অন্বেষায়; এবং যদি এমন কেউ আসলে থেকেও থাকে, তাহলেও অতি অল্প লোকই এ বিষয়ে সজাগ যে রাজনৈতক কারণে যে-সব বৈাহিক রিশতা স্থাপিত হয়েছিলো সেগুলো বাদ দিলে, ইবনে সউদের আর প্রত্যেকটি বিয়েই হচ্ছে হারানো প্রেমের কিছুটা ফিরে পাওয়ার অস্পষ্ট-অতৃপ্ত বাসনার ফল।
তাঁর দুই পুত্র মুহাম্মদ আর খালিদের আম্মা ছিলেন ইবনে সউদের আলা মাহবুবা, মহিমান্বিতা প্রেয়সী। এখনো, তাঁর মৃত্যুর তেরো বছর পরেও বাদশাহ যখনই তাঁর কথা বলেন তাঁর কণ্ট ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
নিশ্চয়ই, তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ মহিলা-কেবল খুব সুরতই নন (কারণ বাদশাহ তাঁর অত্যুচ্ছল বৈবাহিক জীবনে বহু খুবসুরত রমণীকে জানবার এবং পাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, বরঞ্চ তিনি ছিলেন সেই সহজাত নারীসুলভ বোধশক্তির অধিকারী যা আত্মার উল্লাস আর দেহের উল্লাসের মধ্যে রচনা করে সেতু। ইবনে সউদ রমনীদের সাথে তাঁর সম্পর্কের সংগে তাঁর আবেগ- অনুভূতিকে প্রায়ই গভীরভাবে জড়িত হতে দেন না। আর সম্ভবত এটাই হচ্ছে কারণ, যার জন্য এত সহজভাবে তিনি শাদি করেন এবং তালাকও দেন। কিন্তু যওহারার ব্যাপার স্বতন্ত্র কথা; মনে হয়, তাঁর মধ্যে তিনি তাঁর আকাংখার এমন একটা তৃপ্তি লাভ করেছিলেন যা আর কখনো পাননি। যদিও যওহারা যখন বেঁচেছিলেন তখনো তাঁর আরো স্ত্রী ছিলেন, তবু তাঁর জন্য তাঁকে উদ্দেশ্য করে ইশকের কবিতা লিখতেন; এবং একবার তিনি তাঁর এক অধিকতরো দীলখোলা মুহূর্তে আমাকে বলেীছলেন- ‘যখন পৃথিবী আঁধার হয়ে এসেছে আর যে-সব বিপদ-আপদ আমার পথ রুদ্ধ করেছে সেগুলো থেকে যখনি আমি বেরিয়ে আসার কোন পথ খুঁজে পেতাম না তখনি আমি বসে পড়তাম এবং একটি গান রচনা করতাম যওহারার উদ্দেশ্যে। গানটির রচনা যখন শেষ হতো সহসা পৃথিবী আবার আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠতো এবং আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতো আমার কর্তব্য কী’।
কিন্তু যাওহারা ১৯১৯ সনে ইনফ্লুয়েঞ্জা যখন মহামারী রূপে দেখা দেয়, তখন ইন্তেকাল করেন। একই অসুখে ইবনে সউদের প্রথম সন্তান এবং সবচেয়ে প্রিয় পুত্র তুর্কীও ইন্তেকাল করেন। দুটি ক্ষতি তাঁর জীবনে এমন একটি যখন রেখে গিয়েছে যা কখনো শুকায়নি।
কেবল যে তিনি স্ত্রী আর পুত্রের প্রতিই নিজের হৃদয়কে এমন পূর্ণরূপে ঢেলে দিতে পেরেছিলেন তা নয়; তিনি তাঁর পিতাকে যেমন ভালোবাসতেন খুব কম মানুষই তার পিতাকে তেমন ভালোবাসে। তাঁর পিতা আবদুর রহমান, যাঁর সংগে আমি পরিচিত হয়েছিলাম রিয়াদে আমার প্রথমদিকের বছরগুলিতে, যদিও তিনি মানুষ হিসাবে ছিলেন দয়ালু এবং নেক, তবু তাঁর পুত্রের মতো অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী তিনি নিশ্চয়ই ছিলেন না। এবং তাঁর দীর্ঘ জীবনে তেমন কোন লক্ষ্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকাও পালন করেননি। নিজের চেষ্টায় একটি রাজ্য লাভের পরেও এবং দেশের একচ্ছত্র শাসক হওয়া সত্ত্বেও ইবনে সউদ তাঁর পিতার প্রতি ব্যবহারে এতোই নম্র আর বিনীত ছিলেন যে, আবদুর রহমান কিল্লার কোন কামরায় থাকলে তার উপরের কামরায় পা রাখতেও তিনি রাজী ছিলেন না, ‘কারণ’ তিনি বলতেন, ‘আমি আমার আব্বার মাথার উপরে কী করে নিজেকে হাঁটতে দিতে পারি?’ তিনি কখনো তাঁর সামনে বসতেন না বসার জন্য প্রকাশ্যভাবে না ডাকলে। এই রাজকীয় নম্রতায় আমি একবার যেভাবে অপ্রতিভ হয়েছিলাম তার কথা আজো আমার মনে পড়ছে। (আমার মনে হয় তা ঘটেছিলো ডিসেম্বরে, ১৯২৭ সনে)। শাহী কিল্লায় বাদশাহর পিতার থাকার ঘরে আরো অনেকবারে মতো প্রথানুযায়ী একবার আমি তাঁর সথে মুলাকাত করতে গিয়েছিলাম; আর বৃদ্ধ আমাকে বুঝাচ্ছিলেন তাঁর প্রিয় একটি ধর্মীয় বিষয়। হঠাৎ একজন খিদমতগার এসে সেই কামরায় প্রবেশ করে বলে উঠলো, ‘শূয়ুখ আসছেন’। পর-মুহূর্তেই ইবনে সউদ এসে দরোজায় দাঁড়ালেন। স্বাভাবিকভাবেই আমি চাইলাম উঠে পড়তে; কিন্তু বৃদ্ধ আবদুর রহমান আমার কব্জিতে ধরে আমাকে টেনে বসিয়ে দিলেন, যেন তিনি বলতে চান, ‘তুমি হচ্ছো আমার মেহমান’।– বাদশাহ যখন দূর থেকে তার পিতাকে সালাম জানিয়ে দরোজায় দাঁড়িয়ে আছেন, বোঝাই যাচ্ছে, কামরায় ঢোকার জন্য তিনি তাঁর পিতার অনুমতির অপেক্ষায়, তখন আমাকে বসে থাকতে হচ্ছে নিশ্চল হয়ে। আমি যে এতে কতোটা বিব্রত-বোধ করেছিলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু বাদশাহ নিশ্চয়ই তাঁর পিতার এ ধরনের খেয়ালীপনার সাথে পরিচিত ছিলেন, কারণ তিনি স্মিত হাসির সাথে আমার প্রতি চোখের ইশারায় করলেন, আমার বিব্রত অবস্থা দূর করে আমাকে সহজ শান্ত করার জন্য। এদিকে বৃদ্ধ আবদুর রহমান তাঁর আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন, যেন মাঝখানে কোন ছেদই পড়েনি। কয়েক মিনিট পর তিনি মুখ তুলে তাঁর পুত্রের দিকে চেয়ে মাথার নাড়লেন, তারপর বললেন, ‘কাছে আসো বেটা, বসো’। বাদশাহর বয়স তখন সাতচল্লিশ কিংবা আটচল্লিশ বছর হবে!
কয়েক মাস পর- আমরা তখন মক্কায়- বাদশাহর কাছে খবর এলো, তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেছেন রিয়াদে। আমি কখনো ভূলবো না তিনি যে অবোধ্য অপলক দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড পত্রবাহকের দিকে তাকিয়েছিলেন সেই দৃশ্য, যে নৈরাশ্য তাঁর স্বভাবত এতো স্নিগ্ধ এবং আত্মসমাহিত মুখ ধীরে ধীরে, দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবেই আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো, তার কথা; ভূলতে পারো না কেমন করে তিনি লাফ দিয়ে উঠেছিলেন প্রচণ্ড গর্জনের সাথে ‘আমার আব্বা নেই! আমার আব্বা নেই!!’ এবং লম্বা লম্বা ধাব ফেলে ছুটে বের হয়ে গিয়েছিলেন কামরা থেকে, আর তাঁর পেছনে গড়াচ্ছিলো মাটির ওপর; এবং কেমন করে তিনি সিঁড়ি বেয়ে উঠেছিলেন লাফ মেরে মেরে, তাঁর দেহরক্ষী ভীত-আতংকগ্রস্ত মুখের উপর দিয়ে, চিৎকার করতে করতে, ‘আমার আব্বা ইন্তেকাল করেছেন! আমার আব্বা নেই!” দুদিন তিনি কারো সংগে দেখা করলেন না, কিছু খেলেন না বা পান করলেন না এবং রাতদিন কাটালেন প্রার্থনায়।
মধ্যবয়সী ক’জন পুত্র, রাজা যাঁরা নিজের শক্তি দিয়ে রাজ্য লাভ করেছেন এভাবে মাতম করতে পারতেন এক পিতার মৃত্যুতে যিনি বৃদ্ধ বয়সে ই ন্তেকাল করেছেন, শান্তির সাথে!
দুই
কারণ আবদুল আজীজ ইবনে সউদ সম্পূর্ণভাবে নিজেরই চেষ্টায় তাঁর এতো বড় রাজ্য কায়েম করেছিলেন। যখন তিনি শিশু সে সময়েই মধ্য আরবে তাঁর বংশ তার শেষ ক্ষমতাটুকু হারিয়ে ফেলে এবং এককালে এই শাহী খান্দানের তাবেদার হাইলের ইবনে রশিদ পরিবার তার স্থলাভিষিক্ত হয়। সে দিগুলো ছিো আবদুল আজীজের জন্য বড় নিষ্ঠুর, বড় যন্ত্রণাকর। গর্বিত এবং সংযতবাক বালকটি দেখতে পাচ্ছিলো- আসলে একজন বিদেশীই ‘আমির’ ইবনে রশিদের নামে তার পৈতৃক নগরী রিয়াদ শাসন করছে। কারণ এখন, এককালের প্রায় গোটা আরবের শাসক ইসনে সউদের পরিবার ইবনে রশিদের ভাতাভোগী মাত্র, যাদেরকে সহ্য করা হয়, কিন্তু আর ভয় করেন না ইবনে রশিদ। শেষ নাগাদ তাঁর শান্তিপ্রিয় পিতা আবদুর রহমানের জন্য তা অশোভনীয় হয়ে ওঠে। তিনি তাঁর গোটা পরিবারসহ রিয়াদ ত্যাগ করেন এই আশায় যে, তিনি তাঁর পুরানো বন্ধু কোয়েতের সুলতানের বাড়িতে বাকি দিনগুলি কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু তাঁর জন্য কী ভবিষ্যৎ রয়েছে তার তিনি জানতেন না- কারণ তিনি অবগত ছিলেন না তাঁর পুত্রের হৃদয়ে কী রয়েছে, তাঁর পুত্র কী ভাবছে!
পরিবারের সকল লোকের ম্যধ্যে একজনই কেবল এই বিক্ষুদ্ধ হৃদয়ে যা ঘটছে তার সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না; কেবল এটুকুই জানি যে, বাদশাহ যখন তাঁর যৌবনের দিনগুলি নিয়ে কথা বলেন, তিনি সমসময়ই তাঁর কথা উল্লেখ করেন প্রগাঢ় তাজিসের সাথে।
-‘আমি মনে করি, তিনি আমাকে পেয়ার করতেন তাঁর নিজের সন্তানদের চাইতেও বেশি। যখন আর কোন লোকজন থাকতো না তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে তাঁর কোলের উপর বসাতেন এবং তারপর আমি যখন বড়ো হবো তখন আমাকে বড়ো বড়ো কী কাজ করতে হবে আমাকে সেসব কথা বলতেন- ‘তোমাকে অবশ্যই পুনরুদ্ধার করতে হবে ইবনে সউদ খান্দানের গৌরব-গরিমা’। একথা তিনি বার বার আমাকে বলতেন এবং তাঁর কথাগুলি ছিলো গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করার মতোই স্নিগ্ধ, মোলায়েম।
-‘কিন্তু হে আজায়িজ, [শব্দটি আদুল আজীজের একটি সংক্ষিপ্ত রূপ। আদর করে তাঁকে এ নামে ডাকা হতো।] আমি চাই যে তুমি একথা জানো’, তিনি বলতেন, ‘ইবেন সউদ খান্দানের গৌরব- গরিমাও কিছুতেই তোমার চেষ্টা ও উদ্যোগের শেষ কথা হওয়া উচিত নয়। তোমাকে সংগ্রাম করতে হবে ইসলামের গৌরবের জন্য। তোমার কওম তীব্রভাবে অনুভব পথের দিকে এবং তুমিই হবে সেই নেতা। এই কথাগুলি সব-সময় জীবন্ত রয়েছে আমার হৃদয়ে’।
সত্যই কি তা-ই রয়েছে?
ইবেন সউদ সারা জীবন ইসলাম সম্পর্কে এভাবে কথা বলতে পছন্দ করেছেন যে, ইসলাম হচ্ছে তাঁর উপর অর্পিত একটি পব্রিত কর্তব্য। এমনকি, পরবর্তী দিনগুলিতেও, অনেক আগেই যখন স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তাঁর কিছুকাল আগেকার একটি আদর্শের নেতৃত্বের চাইতেও রাজক্ষমতা তাঁর জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তখনো তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতা প্রায় বহু মানুষের, এমন কি খোদ বাদশারও, এ প্রত্যয় জন্মিয়েছে যে, সে আদর্শটি এখনো তাঁর লক্ষ্য রূপে রয়েছে।
এ ধরনের শৈশব স্মৃতির রোমন্হন প্রায়ই চলতো রিয়াদে, অন্তরংগদের বৈঠকগুলিতে, যা সাধারণত বসতো ‘এশা’র সালাতের পর। কিল্লার মসজিক সালাত শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আমরা ক্ষুদ্রতরো কামরাগুলির একটিতে একটিতে বসতাম বাদশাহকে ঘিরে এবং এক ঘন্টা ধরে শুনতাম রাসূলের হাদীস থেকে কিংবা কুরআনের কোন তফসীর থেকে পাঠ। এরপর বাদশাহ আমাদের দু’জন কিংবা তিনজনকে বলতেন তাঁর সাথে খাস মোকামের একটির ভেতরে যাওয়ার জন্য। এক সন্ধ্যায়, আমার মনে পড়েছে, আমি যখন বাদশাহর সাথে সভাকক্ষ ত্যাগ করছি, আমি নতুন করে বিস্মিত হই তাঁর গরিমাময় উচ্চতায়। এই উচ্চতার ফলে তাঁর চারপাশের সকলের উপরে ছিলো তাঁর শির। নিশ্চয়ই তিনি আমার সশ্রদ্ধ দৃষ্টি লক্ষ্য করছিলেন, কারণ তিনি তাঁর সেই অনির্বচনীয় মাধুর্যের সাথে সংক্ষিপ্ত হাসি হেসে আমার হাত ধরে বলতেনঃ
-‘হে মুহাম্মদ! তুমি আমার দিকে এমন করে তাকাচ্ছো কেন?’
-‘আমি ভাবছিলাম, হে দীর্ঘজীবী পুরুষ, আপনি যে বাদশাহ, কোন মানুষই তা প্রত্যক্ষ না করে পারে না, যখন সে দেখতে পায় আপনার মাথা জনতার মাথার এতো উপরে’।
ইবনে সউদ হাসলেন; তখনো আমার হাতে তাঁর হাত; তিনি আমাকে নিয়ে করিড়োরের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীর চলতে বললেন- ‘হ্যাঁ, লম্বা হওয়াতে সুখ আছে; কিন্তু একবার আমার উচ্চতা আমাকে কেবল মর্মবেদনাই দিয়েছিলো। সে বহু আগের কথা। আমি তখন এক বালক এবং কোয়েতে বাস করছিলাম শায়খ মুবারকের কিল্লায়। আমি ছিলাম খুবই হ্যাংলা এবং আমার বয়সের তুলনায় বেশি লম্বা; কিল্লার জন্য ছেলেরা- শায়খে’র পরিবারের এবং আমার নিজের পরিবারেরও- আমাকে তাদের হাসি-ঠাট্টআর একটি লক্ষ্য করে বসে, যেন আমি প্রকৃতির এক অদ্ভুত খেয়াল। আমি আমার উচ্চতা নিয়ে এতোই শরমিন্দা ছিলাম যে, আমি যখন শাহী বালাখানার কামরার ভেতর দিয়ে অথবা কোয়েতের রাস্তা দিয়ে চলতাম তখন আমাকে ছোট দেখানোর উদ্দেশ্যে আমি মাথা নিচু করে কাঁধ ঝুঁকিয়ে চলতাম’।
ততোক্ষণে আমরা বাদশাহর কামরায় পৌঁছে গেছি। জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহযাদা সউদ সেখানে অপেক্ষা করছিলেন তাঁর পিতার জন্য; শাহজাদা আমারই বয়সী এবং তাঁর পিতার মতো লম্বা না হলেও চেহারায় তিনি বেশ জাঁকালো। তাঁর মুখারয়ব তাঁর পিতার চেয়ে অনেক বেশি অমসৃণ, রুক্ষ এবং বাদশাহর মুখের নমনীয়তা ও প্রাণময়তার কিছুই তাতে নেই; তবু, তিনি দয়ালু এবং লোকের ধারনায় মানুষ হিসাবে উত্তম।
বাদশাহ বসলেন দেয়াল বরাবর পাতা কুশনে এবং আমাদের সবাইকে ইশারা করলেন আসন গ্রহণ করতে। তারপর তিনি হুকুম জারি করলেন, ‘কাহওয়া!’ দরজায় দাঁড়ানো সশস্ত্র নওকারটি করিডোরের দিকে মুখ করে চিৎকার করে ওঠে: ‘কাহওয়া’ এরপর গোটা করিডোরের মধ্য দিয়ে পর পর নওকরদের দ্রুত একজনের মুখ থেকে আর একজনের মুখে উচ্চারিত হতে থাকে, ‘কাহওয়া’- ‘কাহওয়া’! এভাবে বাদশাহর আদেশ এক উৎফুল্ল পুনরাবৃত্তির অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কয়েক কোঠা দূরে বাদশাহর কফি তৈরির ঘরে গিয়ে পৌছায়। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই কোমরের পেটি থেকে এক সোনালি বাটওয়ালা ছুর ঝুলিয়ে একটি নওকর এসে হাজির হয়, এক হাতে পিতলের কফি পাত্র, অন্য হাতে ছোট ছোট কফির পেয়ালা নিয়ে। প্রথম পেয়ালাটি গ্রহণ করলেন বাদশাহ নিজে এবং বাকি পেয়ালাগুলি পরিবেশন করা হলো মেহমানদেরকে, তাঁদের আসনের ক্রম অনুসারে। এ ধরনের ঘরোয়া পরিবেশে ইবনে সউদ তাঁর মনে যা-ই আসে সে বিষয়ে কথা ব লেন স্বাধীনভাবে- পৃথিবীর সুদূর অঞ্চলগুলিতে যা ঘটছে, কোন আশ্চর্য নতুন আবিষ্ত্রিয়ার কথা, যার সম্পর্কে আকর্ষণ করা হয়েছে তাঁর দৃষ্টি। বিভিন্ন জাতি এবং রীতিনীতি ও প্রথা- প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে তাঁর মনে যে কথা উদয় হয় তাই তিনি ব্যক্ত করেন অবাধে। তবে সবার উপরে নিজের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে কথা বলতে তিনি আনন্দ পান বেশি এবং অন্যরাও যাতে আলোচনায় যোগ দেয় সে জন্য তাদেরও তিনি উৎসাহ দিয়ে থাকেন। সেই বিশেষ সন্ধ্যায় আমীর সউদ এক নতুন আবিষ্ক্রিয়ার সূচনা করেন, যখন তিনি সহাস্যে আমার দিকে ফিরে বললেনঃ
-‘মুহাম্মদ! আজ কোন এক ব্যক্তি তোমার ব্যাপারে তার একটি সনেদ্হ প্রকাশ করেছে। ও বলেছে, তুমি মুসলিম ছদ্মবেশে একজন ইংরেজ গুপ্তচর কি না, এ সম্পর্কে ও মোটেই নিশ্চিত হতে পারছে না.. যা-ই হোক, এ নিয়ে তুমি ভেবো না। আমি তাকে বোঝাতে পেরেছি তুমি সত্যি একজন মুসলমান’।
আমি শুকনা হাসি গোপন করতে না পেরে বললাম, ‘হে আমীর; এ আপনার মেহেরবানী! আল্লাহ আপনার হায়াত দারাজ করুন। কিন্তু এ ব্যাপারে আপনি এতো নিশ্চিত হতে পারলেন কী করে? এটো কি সত্য নয় যে, আল্লহই জানেন, মানুষের অন্তরে কী রয়েছে?’
-‘তা সত্য,’ জবাবে আমীর বললেন, ‘তবে এ বিষয়ে আমাকে বিশেষ অন্তদৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। আমাকে এ অন্তদৃষ্টি দিয়েছে গত রাতের একটি স্বপ্ন.. আমি দেখলাম মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি এবং মিনারের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ মিনারের সিঁড়িতে দেখা গেলো একটি লোককে সে তার হাত দু’টি একত্র করে বাড়ির মতো করে মুখে রেখে আযান দিতে শুরু করেছে। ‘আল্লাহু আকবার’- আল্লাহ সুমহান, আল্লাহই মহান’ এবং শেষ পর্যন্ত আযাদ দিয়ে চলেঃ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’- আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই- এবং যখন আমি নিবিড়ভাবে তাকালাম, দেখতে পেলাম, সে লোক হচ্ছো তুমি! যখন আমার ঘুম ভেঙে গেল আমি নিশ্চিতভাবে জানতে পারলাম- যদিও আমি কখনো আগে সন্দেহ করিনি- তুমি একজন খাঁটি মুসলমান; যে স্বপ্নে আল্লাহর নাম ঘোষণা করা হয়েছে তা মিথ্যা হতে পারে না’।
আমার সত্যতা ও আন্তরিকতা সম্বন্ধে শাহজাদার অযাচিত বলিষ্ঠ ঘোষণায় এবং যে- আন্তরিকতার সাথে বাদশাহ মাথা নেড়ে আমীর সউদের বিস্ময়কর বর্ণনা সমর্থন করলেন’ তাতে আমি খুবই অভিভূত হয়ে পড়ি। ইবনে সউদ কথার সূত্র ধরে বললেনঃ
‘এরূপ প্রায়ই ঘটে যে, আল্লাহ স্পপ্নের মাধ্যমে আমাদের হৃদয় আলোকিত করেন- এই স্পপ্ন ভবিষ্যতের কথা আগাম বলে দেয় এবং কখনো কখনো বর্তমানকে স্পষ্ট করে তোলে। হে মুহাম্মদ! তোমার নিজের কি কখনো এ ধরনের স্বপ্নে অভিজ্ঞতা হয়েছে হয়নি?’
-‘হে ইমাম, নিশ্চয়ই আমার সে অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেক আগে, আমি মুসলমান হওয়ার চিন্তাও যখন করিনি, তারো অনেক আগে- এমনকি কোন মুসলিম দেশে পদার্পণ করারও আগে। তখন আমার বয়স উনিশ বছরে কাছাকাছি এবং আমি তখন ছিলাম ভিয়েনায়, আমার আব্বার বাড়িতে। আমি তখন মানুষের অন্তর্জীবন সম্পর্কিত বিজ্ঞানের প্রতি (বাদশাহকে আমি এভাবেই ‘মনোবিকলনে’র একটি নিকটতম সংজ্ঞা দিয়েছিলাম) আকৃষ্ট এবং আমার অভ্যাস ছিলো, আমার বিছানার মাশে কাগজ এবং পেন্সিল রাখা, যাতে করে ঘুম ভাঙার সংগে সংগেই আমার স্বপ্নগুলিকে টুকে রাখতে পারি। এই অভ্যাসের ফলে, আমি দেখতে পেলাম যে, স্বপ্নগুলিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্মরণ রাখতে পারি, যদিও আমি স্বপ্নগুলিকে নিয়ে হামেশা চিন্তা করতাম না্ সেই বিশেষ স্বপ্নটিতে আমি দেখতে পেলাম- আমি বার্লিনে আছি এবং ওখানে মাটির নিচে যে রেলপথ আছে আমি সেই পথে সফর করছি- গাড়িটি কখনো চলছে মাটির নিচে সুড়ংড়ের ভেতর দিয়ে এবং কখনো চলছে রাস্তার উপরে পুলের উপর দিয়ে। কামরাটি ভর্তি ছিলো একগাদা মানুষে- এতো বেশি মানুষ যে বসার কোন জায়গাই ছিলো না। কামরায় একটি মাত্র বাড়ি থেকে মিটমিটি করে আলো জ্বলছিলো। কিছুক্ষণ পর গাড়িটি বের হয়ে এলো সুড়ংগ থেকে, কিন্তু গাড়িটি ঐ সব উঁটু পুলের কোন একটিতে উঠলো না, বরং তা এসে উঠলো এক প্রশস্ত নির্জন কাদামাটির প্রান্তরে এবং গাড়ির চাকাগুলি কাদায় আটকে গেলো আর গাড়িটি গেলো থেমে; সামনে কিংবা পেছনে কোনোদিকেই চলবার ক্ষমতা রইলো না গাড়িটির।
-‘সকল যাত্রীই এবং তাদের সংগে আমিও গাড়ি থেকে নেমে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকি। আমাদের চারদকিদের প্রান্তরটি দিগন্তহীন, শূণ্য এবং উষর। তাতে কোন ঝোপঝাড়; ঘরবাড়ি, এমনকি একটি পাথরও নেই। এক ভীষণ পেরেশানিতে, আমাদের হৃদয় ছেয়ে গেলো তখন, আমরা যখন এখানে আটকা পড়ে গেছি, অন্য মানুষেরা যেখানে বাস করে আমরা সেখানে ফিরে যাবার পথ কী করে খুঁজে পাবো! সুবহে সাদেকের সময় যে ধূসর আলোর আভাস দেখা যায় তেমনি একটা আলো ছড়িয়ে আছে বিশাল প্রান্তরের উপর।
-‘তবে যেমন করেই হোক, অন্যদের এই পেরেশানিতে আমি পুরা শরীক হতে পারিনি। আমি সে দলের মধ্য থেকে বের হয়ে পড়ি এবং দেখতে পারি, হাত দশেক দূরে একটি উট হাঁটু ভেঙে শুয়ে আছে জমিনের উপর। উটটির পিঠে পুরোপুরি চাপানো ছিলো একটি জীন- ‘হে ইমাম, পরবর্তীকালে আপনার দেশে উটের উপর যেভাবে জীন চাপাতে দেখেছি ঠিক সেইভাবে’- এবং সে জীনের উপর ছিলেন একজন মানুষ, খাটো হাতাওয়ালা সাদা-বাদামী, ডোরা-কাটা ‘আবায়া’ পরিহিত। তার ‘কুফিয়া’টি টেনে নেওয়া ছিলো মুখের উপর, যার জন্য আমি তাঁর মুখের আকৃতি বুঝতে পারছিলাম না। আমার অন্তরে হঠাৎ এই উপলব্ধি হলো যে, উটটি আমার জন্যই অপেক্ষা করছে এবং নিশ্চল আরোহীটি হবে আমার হাদী বা রাহমুনা। কাজেই, আমি একটি কথাও না বলে এক লাফে উঠে পড়লাম জীনের পেছনে, উটটির পিঠে, যেভাবে আরব দেশগুলিতে একজন রাদিফ’ বা পশ্চাদারোহী উটের উপর চড়ে থাকে। পর মুহূর্তে উটটি দাঁড়িয়ে গেলো এবং সামনের দিকে চলতে শুরু করলো একটি দীর্ঘায়িত সহজ ভংগীতে এবং আমি অনুভব করলাম আমার ভেতের এক নাম-না-জানা সুখের স্ফূরণ ঘটছে। সেই ত্বরিৎ মসৃণ চলার ভংগীতে আমরা সফর করি, প্রথমে মনে হলো, কয়েক ঘন্টা এবং তারপর কয়েক দিন এবং তারপর কয়েক মাস এবং শেষপর্যন্ত সময়েল সব হিসাব আমি ভূলি যাই; এবং উটটির প্রত্যেকটি পদক্ষেপের সাথে সাথে ছাপিয়ে উঠতে থাকে আমার সুখ, আর শেষপর্যন্ত আমার মনে হলো, আমি সাঁতার কাটছি, শূন্যে, হাওয়ার মধ্য দিয়ে। অবশেষে আমাদের ডানদিকে দিগন্ত রক্তিম হয়ে ওঠে উদয়োন্মুখ সূর্যের কিরণে। কিন্তু আমাদের সামনে, বহুদূর যে দিগন্ত রয়েছে, আমি সেখানে দেখতে পেলাম আরেকটি আলো; সে আলোটি আসছে দুটি ঝলসানো সাদা আলো, আমাদের ডানদিকে যে সূর্য উঠছে তার আলোর মত লাল নয়, একটি ঠাণ্ডা আলো, যা আমরা যতোই আগাচ্ছি ততোই উজ্জ্বলতরো হয়ে উঠছে আর আমার হৃদয়ের আনন্দকে আমার সমগ্র চেতনায় এমনভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে যা অনির্বচনীয়। এবং আমরা এভাবে আগাতে আগাতে প্রবেশদ্বার আর তার আলোকের নিকটে এসে পড়ি। তখন আমি শুনতে পেলাম এক কণ্টস্র, কে যেনো কোথা থেকে ঘোষণা, করছে, ‘এইটি সর্ব পশ্চিম নগরী’। এবং জেগে উঠলাম ঘুম থেকে”।
-‘সুবহানাল্লাহ’- আল্লাহ মহান ও পবিত্র! বিস্মিত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন ইবনে সউদ, যখন আমি আমার কথা শেষ করি। ‘আর এই স্বপ্নই কি তোমাকে বলে দেয়নি, ইসলামের জন্যই তুমি ছিলে মনোনীত?’
আমি আমার কথা নেড়ে বলি, ‘না, দীর্ঘজীবী পুরুষ; কী করে তা আমার পক্ষে জানা সম্ভব ছিলো? আমি কখনো ইসলামের কথা ভাবিনি এবং এমনকি, কখনো কোন মুসলমানের সংগে আমার পরিচয়ও হয়নি।… সাত বছর পর, স্বপ্ন ভুলে যাওয়ার অনেককাল পরে, আমি ইসলাম গ্রহণ করি। মাত্র ক’দিন আগে এটি আমি পেয়েছি আমার কাগজপত্রের মধ্যে- সে রাত্রে ঘুম থেকে উঠে যেভাবে টুকে রেখেছিলাম হুবহু সেইভাবে’।
-‘কিন্তু বেটা, সেই স্বপ্নে আল্লাহ, তোমাকে যা দেখিয়েছিলেন আসলে তা ছিলো তোমার ভাগ্যে। তুমি কি তা’ পরিষ্কার বুঝতে পারছো না? সেই জনতার ভীড় এবং তা দের সংগে তুমি এক পথ-চিহ্নহীন প্রান্তরে এসে হাজির হয়েছো, আর তাদের বিভ্রান্তি, একি তাদেরই অবস্থা নয় যাদের কুরআনের সুরা ফাতেহা বর্ণনা করেছে ‘পথভ্রষ্ট’ বলে? আর যে উটটি তার সওয়ারসহ অপেক্সা করছিলো তোমার জন্য, তা কি কুরআন বারবার যাকে হেদায়েত বলেছে, তা-ই নয়? আর যে আরোহীটি তোমার সংগে কথা বলেননি এবং যাঁর মুখ তুমি দেখতে পাচ্ছিলে না, তিনি রাসূলুল্লাহ (স) ছাড়া আর কে হতে পারেন? তিনি খাটো হাতাওয়ালা জোব্বা পরতে ভালোভাসতেন… এবং আমাদের বহু বই-পুস্তক থেকে কি আমরা জানি না যে, যখনি তিনি স্বপ্নে কোন অমুসলিমকে অথবা যারা এখনো মুসলমান হয়নি তাদেরকে দেখা দেন, তাঁর মুখ সব সময়েই ঢাকা থাকে? তারপর দিগন্তের উপরে সেই ঠাণ্ডা স্নিগ্ধ আলোঃ তা ঈমানের যে-আলো না জ্বলেও আলোকিত করে তার প্রতিশুতি ছাড়া আর কী হতে পারে? তুমি তোমার স্বপ্নে সেখানে পৌঁছুতে পারোনি, কারণ যেমন আমাদেরকে বললে, বহু বছর পরেই তুমি ইসলামকে জানতে পেরেছিলে খোদ সত্যরূপে…’।
-‘হে শায়খ, আপনার ধারণা ঠিক হতে পারে… কিন্তু সেই ‘সর্ব পশ্চিমের নগরীটি কী যেখানে দিগন্তের দাখিল-দরোজা আমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলো? কারণ আর যা-ই হোক, আমার ইসলাম গ্রহণ আমাকে পাশ্চাত্যের দিকে নিয়ে যায়নি। বরং তার আমাকে পাশ্চাত্য থেকে দূরেই নিয়ে গেছে’।
ইবনে সউদ মুর্হর্তের জন্য চুপ করে গিয়ে চিন্তামগ্ন হন! তারপর তিনি তাঁর মাথা সোজা করেন এবং আমার কাছে খুবই প্রিয় তাঁর সেই মিষ্টি হাসির সাথে তিন বলেন, “হে মুহাম্মদ, এর অর্থ কি এ হতে পারে না যে, তোমার ইসলাম গ্রহণই হবে তোমার জীবনের ‘পশ্চিমতম’ বিন্দু এবং এরপর পাশ্চাত্য জীবন আর তোমার থাকবে না?”
কিছুক্ষণ পর বাদশাহ আবার কথা বললেন, “ভবিষ্যৎ কেউ জানে না আল্লাহ ছাড়া, কিন্তু কখনো কখনো তিনি ভবিষ্যতে আমাদের জীবনে কী ঘটবে, স্বপ্নের মাধ্যমে তার আভাস দিয়ে থাকেন। আমি নিজে দু’তিনবার এ রকম স্বপ্ন দেখেছি এব প্রত্যেক বারই তা সত্য হয়েছে। বলতে কি, আমি আজ যা হয়েছি তা-ও একটি স্বপ্নের ফলেই হয়েছে…. তখন আমার বয়স সতের বছর। আমরা কোয়েতে নির্বাসিতের জিন্দেগী কাটাচ্ছি, কিন্তু আমার স্বদেশের উপর ইবনে-রাশিদের পরিবার বাদশাহী করবে তেমন চিন্তাও ছিলো আমার পক্ষে অসহনীয়। প্রায়ই আমি আব্বার নিকট কাতর মিনতি জানাতাম- তাঁর উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক- ‘যুদ্ধ করো আব্বা এবং ইবনে-রশিদের খান্দানকে তাড়িয়ে দাও, রিয়াদের তখতের উপর তোমার চাইতে কারো বেশি দাবি নেই, আব্বা’। কিন্তু আমার আব্বা আমার উত্তেজনাপূর্ণ দাবিগুলি উড়িয়ে দিতেন অলীক কল্পনা বলে এবং আমাকে মনে করিয়ে দিতেন, আরবদের দেশগুলিতে মুহাম্মদ ইবনে রাশিদই হচ্ছেন সবচেয়ে পরাক্রমশালী শাসক; তিনি যে মুলূকের উপর বাদশাহী করেন তা উত্তরে সিরীয়া মরুভূমি থেকে দক্ষিণে শূণ্য প্রান্তরে বালূরাশি পর্যন্ত বিস্তৃত- তাঁর ইস্পাত কঠিন মুষ্টির সামনে সকল বেদুঈন কবিলাই ডরে-ভয়ে থরথর করে কাঁপে। যা-হোক, এক রাত্রে আমি এক আজব স্বপ্ন দেখি। আমি দেখতে পেলাম, রাতের বেলা, এক নির্জন স্তেপ অঞ্চলে আমি ঘোড়ার পিঠে বসে আছি, আর সামনেই ঘোড়ার উপর রয়েছেন বৃদ্ধ মুহাম্মদ ইবনে রশিদ, আমার খান্দানের রাজ্য অপহরণকারী। আমরা- দু’জনেই নিরস্ত্র, কিন্তু ইবনে রশিদ একটা মস্ত বড়ো উজ্জ্বল লণ্ঠন তুলে ধরে আছেন। যখন তিনি আমাকে তাঁর দিকে আগাতে দেখে বুঝতে পারলেন যে, আমি তাঁর দুশমন, তিনি হঠাৎ ঘুরে ঘোড়ার পেটে পায়ের আঘাত করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। কিন্তু আমিও তাঁর পেছনে ঘোড়া ছুটিয়ে দিই, ঘোড়া ছুটাতে ছুটাতে তাঁর জোব্বার একটি প্রান্ত আমি ধরে ফেলি, তারপর ধরে ফেলি তাঁর বাহু এবং পরে তাঁর লণ্ঠনটি নিভিয়ে দিই। যখন আমি ঘুম থেকে উঠে বসলাম, আমার এই নিশ্চিত উপলব্ধি হলো যে, ইবনে রশিদ খান্দানের হাত থেকে শাসন ক্ষমতা অবশ্যি ছিনিয়ে আনবো আমি একদিন’।
১৮৯৭ সালে, স্বপ্নের সেই বছরটিতে, মুহাম্মদ ইবনে রশিদ ইন্তেকাল করেন। আবদুল আজীজ ইবনে সউদের মনে হলো, আঘাত হানার এই তো প্রকৃষ্ট মুহূর্ত! কিন্তু তাঁর পিতা আবদুর রহমান এ ধরনের একটি অনিশ্চিত কাজের ঝুঁকি নিয়ে কুয়েতের শান্তিপূর্ণ নির্বিঘ্নে জীবনকে বিপন্ন করতে রাজী ছিলেন না। তবে পিতার নিষ্ত্রিয়তা থেকে পুত্রের উৎসাহ ছিলো প্রবলতরো। তাই, শেষতক পিতা রাজী হয়ে যান। তার বন্ধ কুয়েতের শায়খ মুবারকের সাহায্যে তাঁর খান্দানের প্রতি যে অল্প ক’টি বেদুঈন কবিলা তখনো অনুগত ছিলো তাদের নিয়ে তিনি এক ফৌজ গড়ে তোলেন এবং পুরানো আরবীয় কায়দায়, উট আর ঘোড়া হাঁকিয়ে নিজ নিজ কবিলার ঝাণ্ডা উড়িয়ে ইবনে রশিদের পরিবারের বিরুদ্ধে ময়দানে যুদ্ধের জন্য হাজির হন, আর উন্নততরো শক্র ফৌজের দ্বরা পর্যদন্ত হন অতি অল্প সময়েই এবং সম্ভবত তাঁর হৃদয়ের গভীরে, হতাশ হওয়ার চাইতেও অনেক বেশি ভারমুক্ত হয়ে তিনি ফিরে আসেন কোয়েতে, প্রতিজ্ঞা করেন আর কখনো তিনি তাঁর জীবনের সান্ধ্যকালটিকে লড়াইয়ের মতো কোন দুঃসাহসিক অভিযানের দ্বারা বিঘ্নিত করবেন না।
কিন্তু পুত্র অতো সহজেই হার মানতে রাজী ছিলেন না। তিনি সবসময়েই স্মরণ করতেন মুহাম্মদ ইবনে রশিদের উপর তাঁর বিজয়ের আবাল্য স্বপ্নের কথা; এবং পিতা যখন নযদের উপর তাঁর রাজত্বের সকল দাবী-দাওয়া ছেড়ে দেন তখন তরুণ আবদুল আজীজের এই স্বপ্নই তাঁকে ক্ষমতা লাভের দুর্বঅর প্রয়াসে উদ্দীপিত করে। তিনি তাঁর অল্প ক’টি বন্ধুকে পান তাঁর সংগী হিসাবে, তাঁদের মধ্যে ছিলেন তাঁর চাচাত ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জিলবী এবং ইবনে মুসা’দ। ঢোল পিটিয়ে আরো ক’টি বেদুঈনকে তিনি যোগাড় করেন। এভাবে ওদের সংখ্যা এসে দাঁড়ায় চল্লিশে। ওরা সওয়ারী হাঁকিয়ে কুয়েত থেকে বেরিয়ে পড়ে দস্যুর মতো, চুপি, চুপি, ঝাণ্ডা না উড়িয়ে, দফ না বাজিয়ে, গান না গেয়েঃ যে-সব রাস্তায় কাফেলা বেশি চলাচল করে সে-সব রাস্তা পরিহার করে এবং দিনের বেলা লুকিয়ে থেকে ওরা গিয়ে পৌঁছোয় রিয়অদের সন্নিকটে এবং নির্জন উপত্যকায় তাঁবু গাড়ে। সেদিনই আবদুল আজিজ চল্লিশ জন সংগীর মধ্য থেকে বেছে নেন পাঁচজনকে এবং বাকি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ
-‘আমরা ছ’জন এখন আমাদের ভাগ্যকে সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছি আল্লাহর হাতে। আমরাই যা্চিছ রিয়াদে; হয় রিয়াদ জয় করবো না হয় চিরদিনের জন্য তা হারাবো। তোমরা যদি শহর থেকে জংগলে শোরগোল শুনতে পাও, আমাদের মদদ করতে এসো; কিন্তু কাল সন্ধ্যার মধ্যে যদি তোমরা কোন কিছু শুনতে না পাও, তাহলে তোমরা মনে করো আমরা মৃত এবং আল্লাহ যেন আমাদের দোয়া কবুল করেন। যদি তাই ঘটে, তোমরা সকলে পুশিদা যতো দ্রুত পারো ফিরে যেয়ো কুয়েতে’।
এবং ছ’টি মানুষ বের হয়ে পড়ে পায়দল। রাতের প্রথমদিকেক ওরা শহর পৌঁছায় এবং কয়েক বছর আগে, শহরের বাসিন্দাদের অবমাননার উদ্দেশ্যে ইবনে রশিদ বিজিত নগরের দেয়ালের যে ক’টি জায়গা ভেংগে দিয়েছিলেন তারি একটির ভেতর দিয়ে ওরা দাখিল হয় শহরে। ওরা ওদের অস্ত্রশস্ত্র জোব্বার নিচে লুকিয়ে সোজা ঢুকে পড়ে রশিদী ‘আমীরে’র গভর্নরের কামরায়। ঘরটি ছিলো তালাবদ্ধ, কারণ শক্রভাবাপন্ন জনতার ভয়ে, বিপরীতদিকে যে দুর্গ রয়েছে সাধারণত তাতেই তিনি রাতগুলি কাটাতেন। আবদুল আজীজ এবং তাঁর সংগীরা দরোজার কড়া নাড়েন। একটি গোলাম দরোজা খুলে দেয়, কিন্তু সাথে সাথেই তাকে তাবুতে এনে হাত-পা বেঁধে ওর চোখমুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়; একই দশা ঘটলো সে ঘরে আর যে ক’জন লোক ছিলো তাদের প্রত্যেকেরইঃ সে সময় কেবল কয়েকজন নওকর এবং স্ত্রীলোকই ছিলো ঘরটিতে। অভিযানকারী ছ’জন, ‘আমীরে’র খাবারের ভাণ্ডার থেকে কিছু খেজুর নিয়ে তা খায় এবং পর্যায়ক্রমে কুরআন তিলাওয়াত করে রাতটা কাটিয়ে দেয়।
সকালবেলা কিল্লার দরোজা খোলা হলো এবং ‘আমীর বের হয়ে এলেন সশস্ত্র দেহরক্ষী ও নওকরদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে। ‘হে আল্লাহ, ইবনে সউদ তোমারি নিকট সমর্পিত, চিৎকার করে উঠেন আবদুল আজীজ এবং তাঁর পাঁচ সংগীকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন বিস্মিত হতচকিত দুশমনের উপর। আবদুল্লাহ ইবনে জিলুভী তাঁর বর্শা ছুঁড়ে মারেন ‘আমীরে’র উপর; কিন্তু তিনি তার আগেই মুহূর্তের মধ্যে তাঁর মাথা নুইয়ে দেন। ফলে বর্শাটির দণ্ড কেঁপে কেঁপে বর্শাটি গিয়ে বিঁধে যায় কিল্লার মাটির দেয়ালে, যেখানে সেটি দেখতে পাওয়া যাবে আজও। আমীর ভী সন্ত্রস্ত হয়ে পিছু হটে গিয়ে ঢুকলেন প্রবেশদ্বারে; আবদুল্লাহ যখন একাকী আমীরের পিছনে ধাওয়অ করছেন তখন কিল্লার ভেতরে আবদুল আজীজসহ বাকি চারজন সংগী আঘাত হানেন দেহরক্ষীদের উপর; ওরা সংখ্যায় বেশি হলেও এতোটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলো যে, কার্যকরভাবে নিজেদের আত্মরক্ষার কোন তাকতই তাদের ছিলো না। মুহূর্তকাল পর আবদুল্লা বিন জিলুভীর পিছু পিছু তাড়া খেয়ে আমীর এসে দেখা দেন সমতল ছাদের উপর, তিনি দয়া প্রার্থনা করছিলেন, কিন্তু তা কবুল হলো না; এবং যখন তিনি ছাদের উপর পড়ে গেলেন এবং তাঁর উপর হানা হলো তলোয়ারের মারাত্মক আঘাত, ঠিক সেই মুহূর্তেই আবদুল আজীজ নিচ থে চিৎকার করে উঠলেন ‘আসো, হে রিয়াদবাসীরা আসো! এই যে আমি আবদুল আজীজ ইবনে সউদের খান্দানের আবদুর রহমানের পুত্র- তোমাদের ন্যায়সংগত শাসক!’ এই রিয়াদের লোকেরা, যারা ঘৃণা করতো তাদের উত্তরাঞ্চলের জালিমদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ছুটে এলো তাদের শাহজাদার সাহায্যে এবং তাদের উট হাঁকিয়ে লাফিয়ে ছুটলো তাঁর পঁয়ত্রিশজন সংগী, নগরীর ফটকগুলির ভেতর দিয়ে, ঝনঝবায়ুর মতো তাদের সমুখের সব বাধা উড়িয়ে দিয়ে। এক ঘন্টার মধ্যেই আবদুল আজীজ ইবনে সউদ হয়ে পড়লেন নগরীর অপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসক।
ব্যাপারটি ঘটেছিলো ১৯০১ সালে। তখন তাঁর বয়স একুশ বছর। তাঁর জীবনে তারুণ্যের পর্ব তখন শেষ হয়ে এসেছে এবং তিনি প্রবেশ করেছেন তাঁর দ্বিতীয় অবস্থায়- পরিণত মানুষ এবং শাসকের বয়েসে।
ক্রমে ক্রমে একটি একটি প্রদেশ দখল করে এভাবে ইবনে সউদ গোটা নযদ ভূমি কেড়ে নিলেন ইবনে রাশিদ পরিবারের হাত থেকে এবং ওদের পিছু হটিয়ে নিয়ে গেলেন ওদের স্বদেশভূমি জাবাল শাম্মার ও তার রাজধানী হাইলে। যদিও ইবনে সউদের কোন জেনারেল স্টাফ ছিলো না এবং হয়তো জীবনে কখনো তিনি চোখ বুলাননি কোন মানচত্রের উপর, তবু তাঁর এই রাজ্য বিস্তার ঘটলো এমন সুচিন্তিতভাবে, যেন মানচিত্র, ফৌজ চালনা সম্পর্কিত কলাকৌশল এবং ভৌগোলিক রাজনৈতিক ধারণার উপর ভিত্তি করে একজন জেনারেল স্টাফ দ্বারাই ছিলো তা পরিকল্পিত। রিয়াদকে স্থায়ী কেন্দ্র করে তাঁর বিজয় অভিযানগুলি আগিয়ে চলে শামুকের প্যাঁচের মতো ঘুরে ঘুরে বৃত্তের আকারে এবং এরি মধ্যে যে অঞ্চল জয় করা হয়েছে, তাকে সম্পূর্ণ বশে না এনে এবং সেখানে ক্ষমতা দৃঢ়ভাবে কায়েম না করে কখনো তিনি পা বাড়ান না সমুখদিকে নতুন কোন এলাকায়। প্রথমে তিনি রিয়অদের পূর্ব এবং উত্তরের জেলাগুলি দখল করেন এবং তারপর তাঁর রাজ্য প্রসারিত করেন পশ্চিমের মরুভূমিগুলির উপর। উত্তরদিকে তাঁর অগ্রগতি ছিলো মন্হর। কারণ তখনো ইবনে রশিদ- পরিবারের রয়েছে যথেষ্ট শক্তি, আর তা ছাড়া, তাদের পশ্চাতে ছিলো তুর্কীদের সমর্থন, যাদের সংগে ইবনে রশিদ-পরিবার মজবুত ঐক্যজোট গড়ে তুলেছিলো বিগত কয়েক দশক ধরে। ইবনে সউদের আরো একটি বাধা ছিলো- সে তাঁর দারিদ্র্য। নযদের দক্ষিণ অঞ্চলগুলি থেকে যে রাজস্ব পাওয়া যেতো তা দিয়ে কিছুকালের জন্যও দলে দলে বিপুল সৈন্য প্রেরণ সম্ভব ছিলো না যুদ্ধে।
-‘এক সময়ে,’ তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি এতোই গরীব ছিলাম যে, শায়খ মুবারক আমাকে রত্নখচিত যে তলোয়ারখানা দিয়েছিলেন, তাই আমি বাঁধা রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম কোয়েতে, এক ইহুদী মহাজনের কাছে। এমনকি, আমার জীনের জন্য একটা গালিচা যোগাড় করার ক্ষমতাও আমার ছিলো না- তবু ভেড়ার চামড়ার নিচে খালি বস্তা চাপিয়েই কাজ চলতো আমার’।
এ ছাড়া আরো একটি সমস্যা ছিলো যার ফলে ইবনে সউদের প্রথম জীবন হয়ে পড়েছিলো খুবই কঠিন। সমস্যাটি ছিলো বেদুঈন কবিলাগুলির মতিগতি নিয়ে।
মধ্য আরব, তার সকল শহর ও গ্রাম সত্ত্বেও প্রধানত একটির বেদুঈন এলাকা। তাদের সমর্থন অথবা বিরোধিতাই ইবনে সউদ ও ইবনে রাশিদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্দের প্রায় প্রত্যেক পর্যায়ে ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করে। বেদুঈনেরা খুবই চঞ্চলমতি, তাদেরমত বদল হয় সহজেই এবং যে মুহূর্তেই কোন দল জয়ী হতে চলেছে মনে হতো কিংবা বেশি পরিমাণ গনীমতের আশ্বাস দিতো, সাধারণত তাদের দলেউ তারা যোগ দিতো। এ ধরনের দ্বিমুখী আচরণের শিরোমণি ছিলো ফয়সাল আদ-দাবিশ, শক্তিশারী মুতায়ের কবিলার সর্বপ্রধান সর্দার; তার আনুগত্যের উপর হামেশাই নির্ভর করতো- দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শাহী খান্দানের মধ্যে কখন কে জয়ী হবে আর কখন কে হারবে! সে হাইলে এলে ইবনে রশিদ ইনাম দিতেন বোঝাই ক’রে; সে ইবনে রশিদকে পরিত্যাগ করে আসতো রিয়অদে আনুগত্যের শপথ নিতে ইবনে সউদের প্রতি এবং এক মাস যেতে না যেতেই আবার বিশ্বাস ভংগ করতো, কারো বিশ্বাসই সে রক্ষা করতো নাঃ সাহসী এবং ধূর্ত, ক্ষমতার প্রচণ্ড লোভে সে ছিলো উন্মাদ। তার জন্য ইবনে সউদকে কাটাতে হয় বহু বিনিদ্র রজনী।
এ ধরনের অসুবিধার মুকাবিলায় ইবনে সউদ একটি পরিকল্পনার কথা চিন্তা করেন। শুরুর দিকে হয়তো পরিকল্পনাটি একটি রাজনৈতিক দলের বেশি কিছু ছিলো না, কিন্তু পরিশেষে তাই রূপ দিলো অমন একটি চমৎকার ধারণায় যা গোটা উপদ্বীপটিকেই বদলে দিতে সক্ষমঃ কী সেই পরিকল্পনা?- যাযাবন কবিলাগুলির জন্য স্থায়ী বসতি স্থাপত করতে হবে। সন্দেহ ছিলো না যে, একবার স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করলেই, বিভিন্ন যুদ্ধবাজ দলের মধ্যে বেদুইনেরা যে দ্বিমুখী খেলা খেলে আসছে তা তাদের ছেড়ে দিতে হবে। যাযাবর হিসাবে তাদের পক্ষে সহজ ছিলো মুহূর্তের নির্দেশে তাঁবু গুটিয়ে ফেলা এবং তাদের পশুগুলিকে নিয়ে এখানে-ওখানে বিচরণ করা; একদল ছেড়ে আরেক দলের নিকট চলে যাওয়া; কিন্তু স্থায়ী বসতি গেড়ে জিন্দেগী গুজরান করলে তা সম্ভব হবে না। কারণ আনুগত্য তুলে নিয়ে দুশমনের প্রতি আনুগত্য স্থাপন করলে ভয় রয়েছে তাদের বাড়ি-ঘর বাগ-বাগিচা হারানোরঃ আর বেদুঈনের কাছে তার নিজ অধিকারের মতো মূল্যবান কিছুই নেই!
ইবনে সউদ তাঁর কর্মসূচীতে সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দিলেন বেদুঈনদের স্থায়ী বসতি স্থাপনের উপর। এ ব্যাপারে তিনি ইসলামের শিক্ষা থেকে সাহায্য পান প্রচুর। যাযাবর জীবন থেকে স্থায়ী বসতির শ্রেষ্ঠত্বের উপর ইসলাম জোর দিয়েছে বারবারই। বাদশাহ ধর্ম প্রচারদের পাঠালেন বিভিন্ন কবিলার নিকট। ওরা এই সব গোত্রকে ধর্ম শিক্ষা দেন এবং তাদের নিকট নতুন চিন্তাধারা প্রচার করেন; তাতে যে ফল পাওয়া গেলো তা ছিলো অপ্রত্যাশিত। ধীরে ধীরে ‘ইখওয়ান’ (ভ্রাবৃসংঘ) নামক সংগঠনটি রূপ নিলো- যে নামে স্থায়িভাবে বসতি গেড়ে বসা বেদুঈনেরা পরিচয় দিতে শুরু করলো নিজেদের। সর্বপ্রথম ‘ইখওয়ান’ বসতি ছিলো- আদ-দাবিশ গোত্রের আলওয়া মুতাইয়ের বসতি। ওদের বসতি আরতাবিয়া অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই তিরিশ হাজার লোকের এক শহর হয়ে দাঁড়ালো। আরো বহু গোত্র একই পথ অবলম্বন করলো।
‘ইখওয়ানে’র ধর্মীয় উদ্দীপনা আর যোদ্ধা হিসাবে তাদের সম্ভাবনা ইবনে সউদের হাতে শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে ওঠে। তখন থেকে তাঁর যুদ্ধগুলি নেয় এক নতুন রূপঃ ‘ইখওয়ানের ধর্মীয় উদ্দপনায় পরিচালিত এইসব যুদ্ধ তাদের আগেকার বিভিন্ন শাহী খান্দানের ক্ষমতা দ্বন্দ্বের প্রকৃতি অতিক্রম করে ধর্মীয় জিহাদের রূপ নেয়। অবশ্য ‘ইখওয়ান’দের কাছে ধর্মের এই পুনর্জন্মের অর্থ একটা ব্যক্তিগত তাৎপর্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। আঠারো শতকের মহান মুজাদ্দিদ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের শিক্ষার প্রতি ওদের আপোসহীন আনুগত্যের বিচারে, ‘ইখওয়ান’ নিজেরা যে ব্যক্তিগতভাবে সদাচারী, এই বিশ্বাসের অতিশয্যে ওরা প্রায়ই ছিলো ভরপুর। কিন্তু ওদের বেশির ভাগই যা কামরা করতো তা কেবল ব্যক্তিগত সদাচার নয় এবং তাদের লক্ষ্য ছিলো এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠা যাকে ন্যায়সংগতভাবেই বলা যেতে পারে ইসলামী সমাজ। মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিলো- ইসলামকে তার শুরুর দিকের সকল বাহুল্য-বর্জিত বিশুদ্ধতায় ফের প্রতিষ্ঠিত করা; এ শিক্ষা পরবর্তী সকল বিদ’আত তথা নবতরো সকল সংযোজনকেই প্রত্যাখ্যান করে। এ কথা সত্য, ‘ইখওয়ানের’ বহু ধারণাই ছিলো একেবারে আদিম, আর উদ্দীপনা প্রায়ই গিয়ে পৌঁছতো অন্ধ গোড়ামীর কাছাকাছি। কিন্তু উপযুক্ত পরিচালনা ও শিক্ষা পেলে তাদের গভীর ধর্মনিষ্ঠাই হয়তো তাদের সক্ষম করে তুলতো তাদের দৃষ্টিভংগিকে প্রসারিত করতে এবং কালে তাই হয়ে উঠতে পারতো সমগ্র আরবের একটি খাঁটি সামাজিক ও আধ্যাত্মিক পুনরুত্থানের কেন্দ্রবিন্দু। দুর্ভাগ্যক্রমে এ ধরনের একটি পরিণতির প্রচণ্ড তাৎপর্য বুঝতে পারেননি ইবনে সউদ। তিনি ‘ইখওয়ানকে ধর্মীয় এবং লোকায়ত শিক্ষার কেবল একেবারে প্রাথমিক কথাগুলি দিয়েই ক্ষান্ত ছলেন। বস্তুত ওদের গোঁড়া আগ্রহকে জিইয়ে রাখার জন্য যতোটুকু শিক্ষাদান প্রয়োজন মনে হয়েছিলো, সেই পরিমাণ শিক্ষাই তিনি ওদের দিয়েছিলেন। অন্য কথায়, ইবনে সউদ ইখওয়ান আন্দোলনকে কেবলমাত্র ক্ষমতার এক হাতিয়ার রূপেই দেখেছিলেন। পরবর্তী বছরগুলিতে তাঁর এই ব্যর্থতার শিকার হয় তাঁর নিজেরই বিভিন্ন নীতি এবং এক পর্যায়ে এসে, তিনি যে-রাজ্য সৃষ্টি করেছিলেন তার অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তোলে, আর হয়তো এতেই এই প্রথম আভাস পাওয়া গেলো যে, তাঁর জাতি তাঁর মধ্যে যে হৃদয়ের মহত্ত্ব আশা করেছিলেন ইবনে সউদ তা থেকে বঞ্চিত। কিন্তু বাদশাহর ব্যাপারে ইখওয়ান- এর মোহভংগ এবং ইখওয়ান এর ব্যাপারে বাদশাহর হাতাশার সুচনা হয়েঠিছলো অনেক আগে থেকেই…।
১৯১৩ সালে প্রচণ্ড আক্রমনের জন্য প্রস্তুত ‘ইখওয়ানকে হাতে পেয়ে শেষপর্যন্ত ইবনে সউদের মনে হলো, পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী আলহাসা প্রদেশটি বিজয়ের জন্য তিনি এখন যথেষ্ট শক্তিশালী। আলহাসা নযদের এলাকা হলেও পনের বছর আগে তা দখল করে নিয়েছিলো তুর্কীরা।
তুর্কীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা ইবনে সউদের জন্য নতুন নয়। প্রায়ই তিনি তুর্কী লশকরের মুকাবিলা করেছেন, বিশেষ করে ইবনে রাশিদের সেনাবাহিনীল অন্তর্গত স্থল গোলন্দাজদের। কিন্তু তুর্কীদের প্রত্যক্ষ শাসনাধীন আলহাসার উপর আক্রমণ করা ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপারঃ এর অর্থ হবে একটি বৃহৎ শক্তির সংগে সাক্ষাৎ মুকাবিলা। কিন্তু কোন গত্যন্তর ছিলো না ইবনে সউদের জন্য। তিনি যদি আলাহাসা এবং তার বন্দরগুলিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারেন তার ফল হবে এই, তিনি সবসময়ই বিচ্ছিন্ন থাকবেন বহির্জগত থেকে, আর অত্যাবশ্যক অস্ত্রশস্ক, গোলাবারুদ এবং জবনের প্রয়োজনীয় বহু জিনিসই পারবেন না সংগ্রহ করতে। প্রয়োজনের দ্বারাই সমর্থিত হলো বিপদের এই ঝুঁকি। কিন্তু এই ঝুঁকি এতো মারাত্মক ছিলো যে, আলহাসা এবং তার রাজধানী আল-হুফুফের উপর আঘাত হানার আগে দীর্ঘদিন তিনি ইতস্তত করেছেন। কী অবস্থার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছিলো আজো তা স্মরণ করতেতিনি আনন্দ পানঃ
-‘আমরা এরই মধ্যে আল-হুফুফের দৃষ্টিসীমায় এসে পড়েছি। আমি যে বালিয়াড়ির উপর বসেছিলাম সেখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম মজবুত দুর্গের দেয়ালগুলি; দুর্গটি যেন তাকিয়ে আছে শহরটির দিকে। আমার এই উদ্দেশ্যের ফায়দা এবং বিপদগুলি সম্বন্ধে বিচার করে আমি ভয়ানক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যাই। আমি ভীষণ ক্লান্ত বোধ করছি; আমার হৃদয় শান্তি ও গৃহের কামনায় লালায়িতঃ এবং ঘরের কথা মনে হওয়ার সংগে সংগে আমার স্ত্রী যওহারার মুখ ভেসে উঠলো আমার চোখের সামনে। সেই সব কবিতার কথা আবার ভাবতে লাগলাম যা আমি তাঁকে আবৃত্তি করে শোনাতাম, তিনি আমার পাশে থাকলে এবং আমি তা উপলব্ধির আগেই তাঁর জন্য রচনা করতে শুর করি একটি কবিতা- আমি কোথায় আছি এবং কী বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত আমাকে নিতে হচ্ছে, সে-সব সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে! কবিতাটি আমার মনে রূপ নেয়ার সংগে সংগে আমি তা লিখে ফেলি এবং তা সীলমোহর করে আমার কাসেদদের একজনকে ডেকে হুকুম দেইঃ সবচেয়ে দ্রুতগামী দু’টি উট নাও। সেই উট হাঁকিয়ে চলে যাও রিয়াদ, কোথাও না থেমে, আর এটি দাও মুহাম্মদের মায়ের হাতে। কাসেদটি ধূলি-মেঘের আাড়ালে যখন হারিয়ে যাচ্ছে হঠাৎ আমি দেখতে পেলাম, আমার মন একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যুদ্ধের ব্যাপারেঃ আমি আল-হুফুফ আক্রমণ করবো এবং আল্লাহ অবশ্যি সাফল্য দেবেন আমাকে।
তাঁর আত্মবিশ্বাস সার্থক প্রমাণিত হলেঅ। এক দুঃসাহসিক হামলা চালিয়ে সিপাইরা দখল করে নিলো কিল্লা। তুর্কী লশকরেরা আত্মসমর্পণ করে; তাদেরকে তাদের অস্ত্রশস্ত্র সাজসরঞ্জাম নিয়ে কিল্লা ছেড়ে উপকূলে সরে যাওয়অর ইজাযত দেওয়া হলো। সেখান থেকে ওরা জাহাজে চড়ে রওয়ানা হয় বসরার পথে। অবশ্য উসমানী হুকুমত তাদের অধিকার এতো সহজে ছেড়ে যাবার জন্য তৈরি ছিলো না। ইস্তাম্বুলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো- ইবনে সউদের বিরুদ্ধে এক শাস্তিমূলক অভিযান পাঠানার। কিন্তু সে অভিযান পাঠানোর আগেই মহাযুদ্ধ বেঁধে যায়, যার ফলে তুর্কীরা বাধ্য হয় তাদের সমস্ত জংগী ফৌজ অন্যত্র সমাবেশ করতে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর উসমানী সাম্রাজ্য আর টিকে রইলো না।
তুর্কীদের মদদ থেকে বঞ্চিত হয়ে এবং উত্তরাঞ্চলে এখন ব্রিটেন ও ফ্রান্স শাসিত এলাকাগুলির দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে ইবনে রশিদ আর পারছিলেন না কার্যকরভাবে দুশমনকে প্রতিরোধ করার কোন ব্যবস্থা করতে। ফয়সল আদ- দাবিশ এখন বাদশাহ ইবনে সউদের সবচেয়ে সাহসী সামন্ত যোদ্ধাদের অন্যতম। তারই নেতৃত্বে বাদশাহর ফৌজ হাইল দখল করে ১৯২১ সনে এবং তার ফলে ইবনে রশিদ তাঁদের সর্বশেষ মজবুত ঘাঁটিটিও হারিয়ে বসেন।
ইবনে সউদের রাজ্য বিস্তার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে ১৯২৪-২৫ সালে, যখন তিনি মক্কা, মদীনা এবং জিদ্দাসহ হিজাজ জয় করেন, এবং ১৯১৬ ইংরেজিতে, ব্রিটিশ সমর্থন ও সাহায্যে শরীফ হোসেন তুর্কীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পর যে শরীফ বংশ হিজাজে ক্ষমতায় এসেছিলো, তাদের হিজাজ থেকে বিতাড়িত করেন। ইসলামের এই পবিত্র ভূমি বিজয়ের পরেই ইবনে সউদ- তাঁর বয়স এখন পঁয়তাল্লিশ বছর- পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত হলেন বাহির্বিশ্বের চোখের সামনে।
মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সকল দেশই যখন পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের পায়ের তলায় পিষ্ট ঠিক সেই সময়ে ইবনে উদের এই অভূতপূর্ব বিজয় গোটা আরব জাহনে এক প্রবল আশার সঞ্জার করে; প্রত্যাশাটি এই যে, শেষপর্যন্ত তাদের মধ্যে এমন একজন নেতার আবির্ভাব হয়েছে যিনি সমগ্র আরব কওমকে উদ্ধার করবেন গোলামি থেকে। তাছাড়া আরবদের বাদ দিলেও আরো বহু মুসলিম জনসমষ্টি উৎসুক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালো এ আশায় যে, তিনি একটি রাস্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী আদর্শকে তার সামগ্রিক অর্থেই পুনরুজ্জীবিত করবেন, যে রাষ্ট্রে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের পরম নিয়ামক হবে আল- কুরআনের মর্মবাণী। কিন্তু এসব আশা পূর্ণ হলো না, অপূর্ণই রয়ে গেলো। তাঁর ক্ষমতা বেড়ে যাবার পর যখন তা সংহত হলো তখন এ কথা পরিষ্কার হয়ে উঠলো যে, ইবনে সউদ একজন বাদশাহ বৈ কিছুই নন, এমন একজন বাদশাহ, প্রাচ্য দেশগুলিতে তাঁর আগের বহু স্বৈরাচারী শাসক থেকে যাঁর কোন মহত্তর লক্ষ্য নেই।
ব্যক্তিগত জীবনে মহৎ ও ন্যায়পরায়ণ, বন্ধু ও সমর্থকদের প্রতি বিশ্বস্ত, দুশমনদের প্রতি মহানুভব, বাদশাহ ইবনে সউদ তাঁর প্রায় সকল অনুসারীদের থেকে অনেক- অনেক বেশি ধী-শক্তির অধিকারী। তা সত্ত্বেও তিনি দৃষ্টির সেই ব্যাপ্তির এবং সেই উদ্বুদ্ধ নেতৃত্বের পরিচয় দিতে পারেননি যা তাঁর কাছ থেকে আশা করেছিলো মানুষ। এ কথা সত্য, তিনি তাঁর বিশাল রাজ্যে জনসাধারণের জীবনে এমন এক নিরাপত্তা এনেছেন হাজার বছর আগের প্রথমদিকের খলীফাদের পর আরব দেশগুলিতে যার কোন তুলনা নেই, কিন্তু সেকালের খলীফাদের অনুসারণ না করে তিনি নিরাপত্তা আনয়ন করেন কঠোর আইন ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থঅর মাধ্যমে, তাঁর কওমের মধ্যে নাগরিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে নয়। তিনি কিছু সংখ্যক তরুণকে বিদেশে পাঠিয়েছেন চিকিৎসা শাস্ত্র ও বেতার টেলিগ্রাম অধ্যয়ন করতে; কিন্তু তাঁর গোটা জাতিকে শিক্ষার জন্য উদ্বদ্ধ করবার এবং এভাবে বহু শত বছর ধরে ওরা যে অজ্ঞানের মধ্যে ডুবে আছে তা থেকে তাদের টেনে তোলবার জন্য কিছুই করেনি। তিনি সবসময়ই কথা বলেন ইসলামী জীবন ব্যবস্থার সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য সম্বন্ধে, কথা বলেন আত্মপ্রত্যয়ের জাহিরা প্রত্যেকটি লক্ষণের সাথে; কিন্তু তিনি কিছুই করেননি একটি সুষম প্রগতিশীল সমাজ গড়ে তোলার জন্য, যার মধ্যে সাংস্কৃতিক রূপ পেতে পারতো সেই জীবন পদ্ধতি।
তিনি সরল বিনয়ী এবং কঠোর পরিশ্রমী; তা সত্ত্বেও তিনি নিজে চরম মাত্রায় বেফজুল খরচ ও অর্থহীন বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেন এবং তাঁর চারপাশে যারা রয়েছে তাদের এ ধরনের খরচ ও বিলাসিতায় গা ভাসাতে দেখলেও তিনি আপত্তি করেন না। তিনি গভীরভাবে ধর্মপ্রবণ এবং ইসলামী আইনের আনুষ্ঠানিক নির্দেশগুলির প্রত্যেকটি তিনি পালন করেন অক্ষরে অক্ষরে; কিন্তু এই সব নির্দেশের আধ্যাত্মিক মর্ম ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তিনি খুব ক্বচিৎ কখনো চিন্তা করেন বলে মনে হয়। তিনি দৈনিক পাঁচবেলা ফরজ সালাত আদায় করেন অত্যন্ত নিয়মিতভাবে এবং রাতে ঘণ্টা কাটান গভীর ধ্যানে। কিন্তু মনে হয়, এ কথা কখনো তাঁর মনে উদয় হয়নি যে, সালাত একটা উপায় মাত্র এবং খোদ কোন লক্ষ্য নয়। তিনি নিজ প্রজাদের প্রতি শাসকের দায়িত্ব সম্পর্কে কথা বলতৈ ভালোবাসেন এবং প্রায়ই রাসূল (স)-এর এই বাণীটি উদ্ধৃত করে থাকেনঃ ‘প্রত্যেকটি মানুষই হচ্ছে একটি রাখাল যার উপর অর্পিত হয়েছে তার মেষপালের দায়িত্ব’; কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর নিজের সন্তানদের শিক্ষাকে পর্যন্ত অবহেলা করেছেন এবং এভাবে, তাদের সামনে যে-দায়িত্ব রয়েছে সেই দায়িত্ব পালনের জন্য তাদের প্রস্তুত করেছেন সামান্যই। একবার যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলেঅ, তিনি তাঁর রাষ্ট্রকে এতোটা ব্যক্তিগত ভিত্তিতে গড়ে না তুলে আরো উদারভাবে সংগঠিত করার চেষ্টা কেন করেননি, যাতে করে তাঁর পুত্ররা পেতে পারেন একটি সংগঠিত প্রশাসন-কাঠামো, তিনি জবাব দিয়েছিলেনঃ ‘আমি আমার রাজ্য জয় করেছি আমার নিজের তলোয়ার এবং নিজের চেষ্টার জোরে। আমার পরে আমার ছেলেরা ‘তাদের’ নিজেদের উদ্যোগ নিক’।
বাদশাহর সংগে আমার এক আলোচনার কথা মনে পড়ছে- যাতে সমূহ পরিচয় মেলে তাঁর অদূরদর্শিতা এবং প্রশাসনিক দৃষ্টিভংগির অভাবেরঃ এ আলেঅচনা হয়েছিলো মক্কায় ১৯২৮- এর শেষের দিকে, যখন সিরিয়ার আযাদী আন্দোলনের মশহুর নেতা আমীল শকীব আরসালান বাদশাহর সংগে সাক্ষাৎ করেন। ইবনে সউদ আমার পরিচয় করিয়ে দেন এই ভাষায়ঃ ‘এ হচ্ছে মুহাম্মদ আসাদ, আমার পুত্র, অদ্য ফিরে এসেছে দক্ষিণাঞ্চলগুলি থেকে। ও আমার বেদুঈনের মধ্যে সফর করতে ভালোবাসে’।
আমীল শাকীব কেবল একজন রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন না, তাঁর আগ্রহ ছিলো বহুমুখী এবং তিনি ছিলেন একজন মস্ত বড়ো পণ্ডিত। তিনি যখন শুনলেন আমি একজন ইউরোপীয় এবং ইসলাম কবুল করেছি, সংগে সংগেই তিনি উৎসুক হয়ে উঠলেন আমার অভিজ্ঞতা জানার জন্য। আমি তাঁর নিকট বর্ণনা করি দক্ষিণাঞ্চলের সেই অভিজ্ঞতার কথা, যেখানে আমার আগে আর কোন ইউরোপীয় কখনো সফর করেনি। কৃষিক্ষেত্রে সেই অঞ্চলটির বিপুল সম্ভাবনা, তার পানি সম্পদ এবং তার উর্বর মৃত্তিকা আমার কাছে মনে হয়েছিলো অত্যন্ত আশাপ্রদ এব্ং এই বর্ণনা প্রসংগে আমি বাদশাহকে লক্ষ্য করে বলিঃ
-‘হে ইমাম, আমি এ ব্যাপারে খুবই নিশ্চিত যে, গোটা হেজাজে প্রচুর গম সরবরাহ করার জন্য ওয়াদি বিশা সহজেই হয়ে উঠতে পারে একটি শস্য-ভাণ্ডার, যদি এলাকাটিকে বৈজ্ঞানিক পন্হায় জরিপ ও উন্নত করা হয়’।
আমার এই কথায় বাদশাহ উৎকর্ণ হয়ে উঠলেন,কারণ হেজাজের জন্য গম আমদানি করতে গিয়ে দেশের রাজস্বের একটা মোটা অংশই খরচা হয়ে যাচ্চে আর রাজস্বের ঘাটতি সবসময়ই ইবনে সউদের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে আছে।
-‘এভাবে ওয়াদি বিশাকে উন্নত করতে কতোদিন লাগবে?’ তিনি আমাকে প্রশ্ন করেন।
আমি বিশেষজ্ঞ নই, কাজেই কোন পরিষ্কার জওয়াব দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। আমি পরামর্শ দিই বিদেশী কারিগরী বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করা হোক, যার কাজ হবে অঞ্চলটিকে জরিপ করা এবং উন্নয়নের জন্য বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা পেশ করা। আমি সাহস করে বললাম, এলাকাটি থেকে পুরা ফসল পেতে লাগবে বড় জোর পাঁচ থেকে দশ বছর।
-‘দশ বছর’! –বিস্ময় প্রকাশ করেন ইবনে সউদ, ‘দশ বছর তো অনেক দীর্ঘ সময়! আমারা বেদুঈনেরা কেবল একটি জিনিস জানিঃ যা কিছু আমরা হাতে পাই, তাই আমরা মুখে পুরি এবং আহার করি। দশ বছর পরের জন্য পরিকল্পনা করা, এ যে আমাদের জন্য অত্যন্ত দীর্ঘ ব্যাপার!’
এই বিস্ময়কর মন্তব্যে আমীর শাকীব হা করে স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে, যেন তিনি তাঁর কান দু’টিকে বিশ্বাস করতে পারছেন না; আর এর জবাবে আমিও তাঁর দিকে তাকাই স্থির বিস্ফরিত দৃষ্টিতে….
আর সে সময়ই আমি নিজেকে এই প্রশ্ন করতে শুরু করিঃ ইবনে সউদ কি একজন মহৎ মানুষ যাঁকে আরাম- আয়েশ ও বাদশাহী সরিয়ে নিয়েছে মহত্ত্ব থেকে, অথবা তিনি কি কেবলই একজন প্রচণ্ড সাহসী ও খুবই চালাক ব্যক্তি, যিনি নিজের ব্যক্তিগত ক্ষমতা ছাড়া কিছুই চান না?
আমার পক্ষে আজ পর্যন্ত এ প্রশ্নের একটা সন্তোষজনক জওয়াব দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না যদিও তাঁকে আমি জানি বহু বছর ধরে আর ভালোভাবেই জানি, তবু ইবনে সউদের চরিত্রের একটা দিক আজো আমার কাছে অবোধ্যই রয়ে গেছে। ব্যাপার এ নয় যে, তিনি মনের ভাব অন্যের নিকট থেকে কোন না কোনভোবে গোপন রাখতে অভ্যস্ত; তিনি নিজের সম্বন্ধে কথা বলেন খোলাখুলি এবং প্রায়ই বর্ণনা করেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা; কিন্তু তাঁর চরিত্রের এতোগুলি দিক রয়েছে যে, তা সহজে বোঝা কঠিন এবং তাঁর সরলতার যে চেহারা বাইরে থেকে দেখা যায় তার আড়ালে গোপন রয়েছে সমুদ্রের সতোই বিক্ষুব্ধ একটি হৃদয় এবং মেজাজ-মর্জি ও আভ্যন্তরীণ স্ববিরোধিতার দিক দিয়ে যা সমুদ্রের মতোই ঐশ্বর্যশালী। তাঁর ব্যক্তিগত কর্তৃত্ব বিপুল; কিন্তু তা যতো না নির্ভর করে বাস্তব ক্ষমতার উপর তার চাইতে বেশি নির্ভর করে তাঁর চরিত্রের শক্তির উপর। কথাবার্তায় এবং ভাবভংগিতে তাঁর মধ্যে আহমিকার লেশমাত্র নেই। তাঁর খাঁটি গনতান্ত্রিক মন তাঁকে সাহায্য করে, ময়লা ছেঁড়া তালি দেওয়া কাপড়-চোপড় পরে যে বেদুঈনেরা আসে তাদের সংগে আলাপ- আলোচনা করতে, যেনো তিনি তাদেরই একজন। আর তাঁর এই মন থেকেই তিনি সামর্থ্য পেয়েছিলেন, তাঁকে তাঁর প্রথম নাম ‘আবদুল আজীজ’ বলে সম্বোধন করবে- ওদের এই অধিকার দেওয়ার। পক্ষান্তরে, তিনি উচ্ছপদস্থ আমলাদের প্রতিও হয়ে উঠতে পারেন রূঢ় এবং ঘৃণাপ্রবণ, যখন তিনি তাদের মধ্যে লক্ষ্য করেন দাস মনোভাব, তিনি ঘৃণা করেন সকল রকম শরাফতির ভান। মক্কার একটি ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে। শাহী মহলে আমরা খানা খাচ্ছি, নযদের সবচেয়ে অভিজাত পরিবারগুলির অন্যতম এক পরিবারের সর্দারের নাসিকা কুঞ্চিত হলো সমাগত কোন কোন নযদীর অমার্জিত বেদঈনী’ আচরণে। ওরা উল্লাসের সংগে বড়ো বড়ো মুঠা-ভরা ভাত গিলছিলো গোগ্রাসে; নিজের সুক্ষ্ম রুচিবোধ প্রমাণ করার জন্য মক্কার সেই অভিজাতটি তাঁর খানা আঙুলের ডগা দিয়ে তুলে তুলে যখন খাচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ শোনা গেলো বাদশাহর আওয়াজঃ ‘তোমরা রুচিবান লোকেরা তোমাদের খাবার নিয়ে কেলা করো এতো সাবধানতার সংগেঃ এটা কি এ জন্য যে তোমরা তোমাদের আঙুল দিয়ে ময়লা ঘাটতে অভ্যস্ত? আমরা নযদের লোকেরা আমাদের হাতকে ভয় করি না- আমাদের হাত পাক-সাফ পরিষ্কার এবং সে কারণে আমরা খাই তৃপ্তির সংগে এবং মুঠামুঠা করে’।
কখনো কখনো, যখন তিনি একেবারেই আরামে গা ঢেলে দিয়ে আছেন, স্মিত হাসি খেলা করে ইবনে সউদের মুখের উপর এবং তাঁর মুখমণ্ডলের সৌন্দর্যের উপর তা ছড়িয়ে দেয় প্রায় আধ্যাত্মিক এক বৈশিষ্ট্য। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ইবনে সউদ যে গোঁড়া ওয়াহাবী বিধান মেনে চলেন সে বিধানে সংগীত গর্হিত বলে গণ্য না হলে সংগীতের মাধ্যমেই তিনি প্রকাশ করতেন নিজেকে। কিন্তু আসলে তিনি তাঁর সংগীতধর্মিতার পরিচয় দিয়ে থাকেন তাঁর ছোট্ট কবিতাগুলিতে, তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণাঢ্য বর্ণনাগুলিতে এবং তাঁর যুদ্ধ এবং প্রেমের গানগুলিতে, যা ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র নযদে, যা পুরুষেরা গায় মরু বিয়াবানের মধ্য দিয়ে উটের পিঠে চলতে চলতে এবং রমনীরা গায় তাদের নিজ নিজ ঘরের নির্জনতায়। তাঁর রোজকার জীবন বাদশাহী দায়িত্বের উপযোগী যে নিয়মিত এবং নমনীয় ছন্দ অনুসরণ করে চলে তাতেই ঘটে তাঁর সংগীতধর্মিতার অভিব্যক্তি। জুলিয়াস সিজারের মতোই এক সংগে এবং একই সময়ে অনেক কটি চিন্তার সূত্র অনুধাবন করার সামর্থ্য তাঁর রয়েছে উচ্চ পর্যায়ের এবং তিনি তা করতে পারেন- যে তীব্রতার সংগে তিনি প্রতিটি সমস্যা মুকাবিলা করেন তা বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ন না করে, আর এই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সহজাত গুণের জন্যই তিনি পারেন বিভ্রান্তির মধ্যে না পড়ে অথবা অতিরিক্ত পরিশ্রমের দরুন ভেংগে না পড়ে তাঁর বিশাল রাজ্যের সকল বিষয় ব্যক্তিগতভাবে পরিচালনা করতে এবং তাঁর পরও সময় করে নিতে এবং আগ্রহ বাঁচিয়ে রাখতে- রমনীর সাহচর্য নিয়ে এতো ব্যয়বহুল বিলাসিতায় মগ্ন হতে। তাঁর অনুভূতির সূক্ষ্মতা অনেক সময় প্রায় ভৌতিক, লোমহর্ষক। যে-সব লোকের সংগে তাঁর কারবার, তাদের মনের গতিবিধির একেবারে মর্মস্থলে পৌঁছুবার একটি প্রায় অব্যর্থ সহজাত অন্তদৃষ্টি রয়েছৈ তাঁর- প্রায়ই যেমন আমি নিজে প্রত্যক্ষ্য করবার সুযোগ পেয়েছি- মানুষ কথায় ব্যক্ত করার আগেই মানুষের চিন্তা বা মনের ভাব তিনি বুঝতে পারেন এবং কোন মানুষ কামরায় প্রবেশ করার সংগে সংগেই তাঁল প্রতি সেই মানুষটির মনোভাব তিনি টের পেয়ে যান বলে মনে হয়। এই ক্ষমতার জন্যই ইবনে সউদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে তাঁর জীবন নাশের কয়েকটি অতি সুপরিকল্পিত চেষ্টাকে বানচাল করে দিতে এবং রাজনৈতিক বিষয়ের অকুস্থলে বসেই সৌভাগ্যজনক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে।
সংক্ষেপে, যে-সব গুণের বদৌলতে একটি মানুষ মহৎ হতে পারে তার অনেকগুলিই রয়েছে ইবনে সউদের; কিন্তু মহত্ত্ব অর্জনের জন্য কোন সত্যিকার চেষ্টা তিনি কোনদিনই করেননি। মেজাজের দিক দিয়ে অন্তর্মুখী না হওয়ায় তাঁর যুক্তিভিত্তিক বিচার-শক্তি প্রয়োগের বিপুল ক্ষমতা রয়েছে, একেবারে জ্বলজ্যান্ত সব ভূল-ক্রটির মুকাবিলায় তিনি নিজে যে সঠিক পথে আছেন এ বিষয়ে আত্মপ্রত্যয় সৃষ্টির। আর তাই তিনি সহজেই এড়িয়ে যান সকল প্রকার আত্মবিচার। তাঁকে যারা ঘিরে থাকে- তাঁর সভাসদেরা এবং তাঁর দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভরশীল অসংখ্য কৃপাভিক্ষুক- নিশ্চয়ই তারা তাঁর এই দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতাকে রুখবার জন্য কিছুই করেনি।
তাঁল তারুণতরো বছরগুলিতে যখন মনে হয়েছিলো তিনি উত্তেজনা জাগানো স্বপ্নের স্বাপ্নক, সেই সময়ের বিপুল প্রতিশ্রুতিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে তিনি হয়তো নিজের অজ্ঞাতেই উচ্ছ স্বরগ্রামে বাঁধা একটি জাতির মনকে ভেঙে দিয়েছেন, যে জাতি আগ্রহী ছিলো তাঁকে আল্লাহ-প্রেরিত একজন নেতা বলে ভাবতে। তাঁর কাছে ওদের প্রত্যাশা অতো বেশি ছিলো যে, ওদের পক্ষে নির্বিকারচিত্তে হতাশাকে মেনে নেওয়া কঠিন; নযদের বাসিন্দাদের মধ্যে যারা সর্বোক্তম তাদের অনেকেই আজকাল অত্যন্ত তিক্ত ভাষায় কথা বলে, তাদের মতে, তাদের বিশ্বাসের প্রতি যে বেওফাই করা হয়েয়ে, তার বিরুদ্ধে।
আমি কখনো ভূলবো না আমি যে দুর্দশা ও নৈরাশ্যের রূপ দেখেছিলাম আামার এক নযদী দোস্তের মুখে, যিনি এককালে ছিলেন ইবনে সউদের নেতৃত্বে অতি তীব্র বিশ্বাসী এবং বাদশাহর শাহী জিন্দেগীর সবচেয়ে কঠিন বছরগুলিতে বাদশাহর সংগী ছিলেন সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে, যখন তিনি বাদশাহ সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে একদিন আমাকে বলেনঃ
-‘সেই প্রথমদিকের বছরগুলিতে, আমরা যখন ইবনে সউদের সংগে উট হাঁকিয়ে অভিযানে বেরিয়েছিলাম ইবনে রশিদের বিরুদ্ধে এবং আমরা যখন ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ- ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই’- এই বাণীখচিত ঝাণ্ডার নিচে উট হাঁকিয়ে বের হয়ে পড়েছিলাম ইসলামের প্রতি সেই বিশ্বাসঘাতক শরীফ হোসেনের বিরুদ্ধে, তখন আমাদের মনে হয়েছিলো ইবনে সউদ এক নতুন মূসা, যিনি তাঁর কওমকে জাহিলিয়াত এবং অবক্ষয়ের বন্ধুন থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাবেন প্রতিশ্রুত ইসলামের ভূমিতে। কিন্তু তিনি যখন তাঁর কওম এবং তাঁর ভবিষ্যতকে ভুলে গিয়ে কায়েম হয়ে বসলেন তাঁর নবার্জিত আরাম-আয়েশ এবং বিলাসিতা নিয়ে, আমরা ভয়ে শিউরে উঠে দেখতে পেলাম, ইিন এক ফেরাউন…’।
অবশ্য আমার দোস্ত ইবনে সউদের নিন্দাভাষণের বেলায় ছিলেন অতি.. অতিমাত্রায় রূঢ়, এমনকি অবিচারী; কারণ তিনি ফেরাউন নন, জালিক নন; তিনি একজন দয়ালূ মানুস এবং আমার কোন সন্দেহ নেই যে, তিনি তাঁর কওমকে ভালোবাসেন। কিন্তু তাই বলে তিনি মূসাও নন। তাঁর ব্যর্থতা বরং এখানেই যে, তাঁল কওম তাঁকে যতো মহৎ বলে কল্পনা করেছিলো সে মহত্ত্বে তিনি পৌঁছুতে পারেননি- এবং যৌবনের তুর্যধ্বনির অনুসরণ করলে তিনি সম্ভবত যা হতে পারতেন তা তিনি হতে পারেননি। তাঁর তুলনা এবং ঈগল যে কখনো ডানা মেলেনি আকাশে।
তিনি অনেক… অনেক বড়ো আকারে, কেবল একজন মহানুভব গোত্র- প্রধানই রয়ে গেছেন….। [এই বইটি সম্পূর্ণ হবার (১৯৩৫) কিছুকাল পরেই ইবনে সউদ ৭৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন এবং তাঁর ইন্তেকারে সংগে সংগে আরবীয় ইতিহাসে একটি যুগের অবসান ঘটে। তাঁর সংগে যখন শেষবার ১৯৫১ ইংরেজির শরৎকালে দেখা করি (পাকিস্তান সরকারের পক্ষে সউদি আরবে একটি সরকারী সফর উপলক্ষে) তখন আমার মনে হয়েছিলো, শেষপর্যন্ত তিনি তার জীবনের মর্মানিত্ক অপচয় সম্বন্ধে সজাগ হয়ে উঠেছেন। এককালে তাঁর যে মুখমণ্ডল ছিলো এতোটা দৃঢ় এবং জীবন্ত, তাই হয়ে উঠেছিলেঅ তিক্ততাব্যঞ্জক এবৃং নিস্পৃহ। তিনি নিজের সম্পর্কে কথা বলেছিলেন- মনে হলো, তিনি যেনো এমন কিছু সম্পর্কে কথা বলছেন, ইতিমধ্যেই যার মৃত্যু হয়েছে এবং যাকে কবরও দেওয়া হয়ে গেছে, যাকে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়!]
তিন
যেদিন সকালে আমি হাইল ত্যাগ করি সেদিন আমার ঘুম ভাঙলো এক উচ্চগ্রামের সংগীতের মধ্যে যা বেয় আসছিলো আমার দুর্গ প্রকোষ্ঠের খোলা জানালার ভেতর দিয়েঃ এমন এক গান, একন এক কিচির-মিচির, এমন এলাপাতাড়ি অপটু বাজনা, যেনো একটি জমকালো অপেরা শুরু করার আগে শত শত বীণাযন্ত্র এবং বাঁশরীতে সুর তোলা হচ্ছেঃ সেই বহু রাগবিশিষ্ট পৃথক পৃথক সুরের সংক্ষিপ্ত বেসুরো তাল, যা সংখ্যায় এতো বেশি এব্ং এতো নিয়ন্ত্রিত বলেই মনে হয়- যেনো এক রহস্যময়, প্রায় ভৌতিক সুরের ঐকতান জাগিয়ে তুলেছে।…. কিন্তু নিশ্চয়ই এটি একটি বিশাল অর্কেস্ট্র, আর সে কারণেই এ থেকে যে ধ্বনিতরংগ জাগছে, সেগুলি এতো প্রবল…।
আমি যখন জানালায় গিয়ে দাঁড়াই এবং বাইরের দিকে তাকাই- জনশূণ্য বাজারের উপর এবং বাজার ছাড়িয়ে শহরের মৃত্তিকা ধূসর ঘর-বাড়িগুলোর উপর ক্রমে ফুটে-ওঠা ভোরের ধূসরতার দিকে, তাকাই পাহাড়গুলির তলদেশের দিকে, যেখানে জন্মায় ঝাউ ও সারি সারি খেজুর গাছ- আমি তখন বুঝতে পারলাম এ হচ্ছে বাগানের মধ্যকার পানি তোলার ইদরার সংগীত- যে ইদরাগুলি সংখ্যায় শত শত হবে, সবেমাত্র শুরু হচ্ছে তাদের দিনের কাজ। মস্ত বড়ো বড়ো মশকে করে টেনে টেনে পানি তুলছৈ উটগুলি, পানি টানার রশিগুলি এবড়ো-থেবড়োভাবে তৈরি কাঠের কপিকালের উপর দিয়ে টানা হচ্ছে এবং প্রত্যেকটি কপিকল ঘষা খাচ্ছে তার কাঠের অক্ষদণ্ডটির সাথে আর গান গাইছে, বাঁশী বাজাচ্ছে, ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করছে এবং শোঁ শোঁ করছে বহু সংখ্যক উঁচু এবং নিচু সুরে, যতক্ষণ না রশিটির পাক সম্পূর্ণ খুলে গেছে এবং কপিকলটি থেমেছে; সংগে সংগে ওঠে একটি প্রচণ্ড ধ্বনি, যেনো একটি চিৎকার আর সেই চিৎকার ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় রশিগুলির দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে, যার সংগে এখন প্রবলভাবে মিশেছে কাঠের গামলার দিকে ধাবমান পানির দ্রুত বেগ;দ তারপর উটটি আবার মুখ ফেরায় এবং মন্হর গতিতে ফিরে যায় কুয়াটিতে আর আবার কপিকলটি সৃষ্টি করে চলে সংগীত, তখন রশিগুলি তার উপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নামে এবং মশকটি নেমে ডুব দেয় ইদরার ভেতরে।
ইদারার সংখ্যঅ এতো বেশি বলেই মুহূর্তের জন্যও এ সংগীতের বিরতি নেই; বিভিন্ন তার কখনো এক সুরে মিলে যায়, আবার কখনো আলাদা হয়ে যায়; কোন কোন সুর যখন শুরু হয় নতুন প্রাণোন্মাদনা নিয়ে, অন্য সব সুর তখন ধীরে ধীর হারিয়ে যায়। অবোধ্য ছন্দের একেকটি গোটা ফোয়ারা যেনো প্রবাহিত হচ্ছে একই সংগে এবং একে অপর থেকে আলাদা হয়ে গর্জন করে ক্যাঁচকোঁচ ধ্বনি তুলে শিস দিয়ে, গান গেয়ে গেয়ে- কী চমৎকার! কী মহৎ এক অর্কেষ্ট্রা! এই ঐকতান মানুষের পরিকল্পনার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়নি এবং সে কারণে এর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব প্রকৃতির শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্তেরই প্রায় কাছাকাছি- যে প্রকৃতির ইচ্ছা অজ্ঞেয় ও অভেদ্য।