দ্বিতীয় অধ্যায়
যে সকল সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর যুগে ফতোয়া দিতেন
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর যুগে যে সকল সাহাবী ফতোয় প্রদান করতেন তাঁরা হলেনঃ হযরত আবু বকর (রাঃ) , হযরত উসমান (রাঃ) , হযরত আলী (রাঃ) , হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) , হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) , হযরত উবাই ইবনে কাব (রাঃ) , হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রাঃ) , হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রাঃ) , হযরত হোযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) , হযরত যায়িদ ইবনে ছাবিত (রাঃ) , হযরত আবু দারদা (রাঃ) , হযরত আবু মুসা আল আশয়ারী (রাঃ) এবং হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) ।
কোন কোন সাহাবা তুলনামূলকভাবে বেশি ফতোয়া প্রদান করেছেন। যাঁরা বেশি সংখ্যক ফতোয়া প্রদান করেছেন তাঁরা হলেন, উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) , হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) , এবং তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ (রাঃ) , হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রাঃ) , হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং হযরত যায়িদ ইবনে ছাবিত (রাঃ) । উপরোল্লিখিত ছয়জনের প্রত্যেকের ফতোয়ার ভাণ্ডার ছিল বিশাল। আবু বকর মোহাম্মদ ইবনে মূসা ইবনে ইয়াকুব ইবনুল খলিফা আল মামুন হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) -র ফতোয়াসমূহ বিশ খন্ডে সংগ্রহ ও সংকলন করেছিলেন।
যাঁদের নিকট থেকে অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক ফতোয়া বর্ণিত হয়েছে তাঁরা হলেন, উম্মুল মুমেনীন হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) , হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) , হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) , হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) , হযরত উমান ইবনে আফফান (রাঃ) , হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাঃ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ) , হযরত আবু মুসা আল আশয়ারী (রাঃ) , হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ) , হযরত আবু মূসা আল আশয়ারী (রাঃ) , হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) , হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) , হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ, হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রাঃ) , হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) । এই তেরজন সাহাবী কর্তৃক প্রদত্ত ফতোয়া পৃথক পৃথকভাবে একটি পুস্তকের একেকটি ক্ষুদ্র অংশ হতে পারে।
এই তালিকায় আরো যে কয়েকজন সাহাবীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা যায় তাঁরা হলেন হযরত তালহা (রাঃ) , হযরত যুবায়ের (রাঃ) , আবদুর রহমান ইবনে আওফ, হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ) , হযরত আবু বাকরাহ (রাঃ) , হযরত উবাদা ইবনে সামিত (রাঃ) , এবং হযরত মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রাঃ) । অন্য কয়েকজন সাহাবী খুবই স্বল্পসংখ্যক ফতোয়া প্রদান করেছিলেন, সংখ্যায় একটি বা দুটি, দু একজনের ক্ষেত্রে হয়তো তারও সামান্য বেশি। তাঁদের প্রদত্ত ফতোয়ার সংখ্যা এতই অল্প যে, ব্যাপক অনুসন্ধান করে ছোটখাটো একটি সংকলন তৈরি করা সম্ভব হতে পারে। (দ্র. ইবনে হাযম, আল ইহকাম, ৫খ, পৃ.৯২-৯৩।
সাহাবীগণ তাঁদের সময়ে সংঘটিত নতুন ঘটনাকে কুরআন বা সুন্নাহর সাথে হুবহু মিলে যায় এমন ঘটনার সাথে তুলনা করে তদনুসারে ফতোয়া প্রদান করেছেন। কুরআন বা সুন্নাহর কোন ঘটনা বা বিষয়ের সাথে তুলনা করতে গিয়ে তাঁরা যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন তা হলো, মূল পাঠে ব্যবহৃত শব্দাবলীর পরীক্ষা নিরীক্ষা, এর প্রয়োগ পদ্ধতি এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ের আলোকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের তাৎপর্য ও আইনগত গুরুত্ব বিশ্লেষণ করা।
কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পর তাঁর অন্যদের নিকট ব্যাখ্যা করে বলতেন, কিভাবে যুক্তিসমূহ উপস্থাপিত হয়েছে এবং তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, এগুলো কি কুরআন বা সুন্নাহর শাব্দিক বা বাহ্যিক অর্থ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে, না তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত (দালালাতুন নস) থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। অতঃপর লোকেরা তাঁদের মত গ্রহণ করত। বস্তুত প্রথম যুগের এ সকল ফকীহ কোন সমস্যা দেখা দিলে তার নিশ্চিত ও সন্তোষজনক সমাধানে না পৌছা পর্যন্ত সাধ্যমত তাঁদের গবেষণা চালিয়ে যেতেন।
মহান সাহাবীগণের যুগ
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর পরে শুরু হয় মহান সাহাবীগণ ও খোলাফায়ে রাশেদার যুগ। ১১হিজরী সন থেকে ৪০ হিজরী সন পর্যন্ত উক্ত সময় অতিবাহিত হয়। ফকীহ ও মুফতী (ফতোয়া দানকারী) সাহাবীগণকে সেযুগে বলা হতো কুররা (কুরআন সম্পর্কীয় বিদ্যার বিশেষজ্ঞ) ।
হযরত আবু বকর (রাঃ) এর যুগ
শরীয়তের বিধান জানার জন্য হযরত আবু বকর (রাঃ) যে পদ্ধতি অনুসরণ করতেন, মায়মুন ইবনে মাহরান তা এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
আবু বকর (রাঃ) র শাসনে কোন বিবাদ উপস্থিত হলে তিনি কুরআন খুলে দেখতেন। যদি তাতে বিবাদমীমাংসার জন্য কিচু পেতেন তবে তার ভিত্তিতে উদ্ভূত বিবাদ মীমাংসা করতেন। যদি কুরআনে এ ব্যাপারে কোন সমাধান না পেতেন তাহলে তিনি রাসূলের সুন্নাহ মোতাবেক সংশ্লিষ্ট বিসয়ের মীমাংসা করতেন। যদি সুন্নাহতেও উল্লেখিত বিষয়ে কোন কিছু না পেতেন তাহলে তিনি মুসলমানদের নিকট গিয়ে বলতেন, অমুক অমুক বিষয় আমার নিকট পেশ করা হয়েছে। তোমাদের কারো এ বিষয়ে রাসূলের (সাঃ) কোন মীমাংসার কথা জনা আছে কি? ঐ বিষয়ে যদি কেউ তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে এবং প্রাসঙ্গিক তথ্য সরবরাহ করতে সক্ষম হতেন তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) বলতেন, আল্লাহর জন্য সমস্ত প্রশংসা যে, তিনি আমাদের মধ্যকার কোন কোন ব্যক্তিকে রাসূলের (সাঃ) নিকট থেকে তাঁরশ্রুত বিষয় স্মরণ রাখার সামর্থ্য দিয়েছেন।
যদি তিনি সুন্নাহ এ কোন সমাধান না পেতেন তাহলে নেতৃস্থানীয় ও উত্তম লোকদের সাথে পরামর্শ করতেন। তাঁরা ঐকমত্যে পৌছলে তার ভিত্তিতে তিনি রায় প্রদান করতেন। (দ্র.ইলামূল মুওয়াকিঈন, ১খ.পৃ.৫১। )
এভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে তিনি সমাধান না পেলে তাঁর ব্যক্তিগত বিচক্ষণতার সাহায্যে নস এর ব্যাখ্যা করে অথবা তার ভাবার্থ থেকে অথবা কেবল ইজতিহাদের ভিত্তিতে তার নিজস্ব মত গঠন করতেন। (কুরআন ও হাদীসের দলীলকে আইনের ভাষায় নস বলে) । যেমন হযরত আবু বকর (রাঃ) কালালাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়ার পর যে জবাব দিয়েছিলেন, সেই সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, কালালাহ সম্পর্কে আমি যা বললাম তা আমার নিজের বুদ্ধির ভিত্তিতে। আমার মতামত যদি সঠিক হয় তবে তা আল্লাহরকাছ থেকে, আর যদি ভুল হয় তবে তা আমার নিজের কাছ তেকে এবং শয়তানের কাছ থেকে। অর্থাৎ সেই ব্যক্তিই কালালাহ যার পিতা মাতাও নেই সন্তানও নেই। (কালালাহ শব্দের অর্থ নিয়ে মতভেদ আছে। কারো কারো মতে, কোন ব্যক্তির সরাসরি উত্তরাধিকারী না থাকা অর্থাৎ সন্তান সন্ততি, পিতা বা পিতামহ জীবিত না থাকা অবস্থায় কেউ মারা গেলে তাকে কালালাহ বলে গণ্য করা হবে। অন্য আরেক দলের মতে, পিতা বা পিতামহ জীবিত থাকুক বা নাই থাকুক, মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান সন্ততি না থাকলে তাকেই কালালাহ বলা হবে। সূরা নিসার ১৭৬ নম্বর আয়াত এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক। এ আয়াতের ভিত্তিতেই হযরত আবু বকর (রাঃ) তাঁর সিদ্ধান্ত প্রদান করেছিলেন। তাঁর মতে কুরআনের উপরোক্ত আয়াতেরমর্মানুসারে কালালার বোন তাঁরঅর্ধাংশ সম্পত্তির ওয়ারিশ হবে, কিন্তু পিতা জীবিত থাকলে সে (বোন) কিছুই পাবেনা। সুতরাং কুরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলেও এটা স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, কালালাহ হলো সেই ব্যক্তি যার কোন দিক থেকে সরাসরি (পূর্বপুরুষ বা উত্তর পুরুষ) কোন উত্তরাধিকারী নেই। (সম্পাদক) । এরূপ আরেকটি উদাহরণ পাওয়া যায় নিম্নোক্ত ঘটনা থেকে, হযরত উমর (রাঃ) বললেন, আমি রাসূল (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, আমি (আল্লাহর পক্ষ থেকে) লোকদের সাথে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি যে পর্যন্ত না তারা বলে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। (হাদিসখানি সহীহ হাদীসসমূহেরঅন্তর্ভুক্ত । বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাযাহ, আহমদ, আত তায়ালিসী ইত্যাদি গ্রন্থে তা উল্লেখ আছে। ) । তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেন, যাকাতও এর অংশ। (হযরত আবু বকর (রাঃ) বলতে চেয়েছেন যে, উল্লিখিত হাদীসকে শুধুমাত্র শাব্দিক অর্থে গ্রহণ করা ঠিক হবে না। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে, আল্লাহ ছাড়া কো ইলাহ নেই এই মৌল প্রত্যয়টিকে ইসলামী আকীদার নির্দেশক হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এ জীবন বিধানকে অনুসরণ করার জন্য যাকাতসহ আকীদার অনেকগুলো দিক ও শাখা প্রশাখা রয়েছে। (সম্পাদক) ।
হযরত আবু বকর (রাঃ) যখন যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন কারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলেন তখন হযরত উমর (রাঃ) উক্ত হাদীস পেশ করার মাধ্যমে বললেন, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জায়েয হবে না। কেননা রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যে পর্যন্ত না তারা বলে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। আর যদি তারা এটা বলে, তবে তাদের জানমাল আমার হাত থেকে রক্ষা করল। অবশ্য হকের (ইসলামের) অধিকার এর ব্যতিক্রম (অর্থাৎ ইসলামী শরীয়াহর বিধান অনুযায়ী দন্ড পাওয়ার উপযোগী কোন অপরাধ করলে তাকে তা অবশ্যই ভোগ করতে হবে) । হযরত উমর (রাঃ) এর মতে ইসলামের অধিকার অর্থ সে ব্যক্তি হত্যা ব্যভিচার এবং ধর্মত্যাগের অপরাধ করলে সে মৃত্যুদন্ড ভোগ করবে। কারণ যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারীদের সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) স্পষ্টভাবে কিছু বলেননি। কিন্তু হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেন, যাকাত এর (ইসলামের) অঙ্গ। আল্লাহর কসম যে ব্যক্তি সালাত আদায় করে অথচ যাকাত প্রদান করে না, আমি অবশ্যই তার সাথে যুদ্ধ করব। যদি কেউ সামান্যতম পরিমাণ প্রদানেও অস্বীকৃতি জানায়, যা তারা রাসূল (সাঃ) কে প্রদান করত, তবে আমি এজন্যে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। তাঁর দ্বিতীয় ইজতিহাদের উদারহণঃ তিনি সিদ্ধান্ত প্রদান করলেন যে, মায়ের মা উত্তরাধিকারী হবে কিন্তু পিতার মা উত্তরাধিকারী হবে না। তখন কিচু সংখ্যক আনসার তাঁকে বললেন, আপনি এমন একজন মৃতের উত্তরাধিকার গ্রহণের জন্য এমন একজন স্ত্রীলোককে অনুমতি দিলেন, তদস্থলে ঐ স্ত্রীলোকটি ইন্তেকাল করলে প্রথমোক্ত ব্যক্তি তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না। বিপরীতক্রমে আপনি এমন এক স্ত্রীলোককে সৃতের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করলেন, যে মৃতের স্থলবর্তী হলে প্রথমোক্ত ব্যক্তি তার উত্তরাধিকারী হয়। তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) পুনরায় সিদ্ধান্ত প্রদান করলেন যে, পিতামহী এবং মাতামহী উভয়ের একত্রে মৃতের সম্পত্তির ছয়ভাগের একভাগ প্রাপ্য হবে।
আরেকটি উদাহরণ, হযরত আবু বকর (রাঃ) ঘোষণা করলেন যে, বায়তুল মাল থেকে প্রত্যেকেই সমান অংশীদার । হযরত উমর (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, যে লোক বাধ্য হয়ে অনিচ্ছায় ইসলামে প্রবেশ করেছে এবং যে লোক তার বাড়িঘর ও সহায় সম্পত্তি পিছনে ফেলে রেখে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে হিজরত করেছেন তাদের উভয়কে আপনি সমান বিবেচনা করেন কিভাবে? কিন্তু হযরত আবু বকর (রাঃ) তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থেকে বললেন যে, তাঁরা সকলে আল্লাহর জন্যই ইসলাম গ্রহণ করেছেন এজন্য আল্লাহ তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন, এ দুনিয়ার জীবন কিছুই নয়। হযরত উমর (রাঃ) খলিফা হওয়ার পর বায়তুল মাল থেকে বৃত্তি প্রদানকালে লোকদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করেন। অর্থাৎ কতকাল আগে সে ইসলাম গ্রহণ করেছে, হিজরত করেছে কিনা এবং ইসলামের জন্য কি পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করেছে ইত্যাদি।
হযরত আবু বকর (রাঃ) এর ইজতিহাদ সম্পর্কিত উদাহরণ হচ্ছেঃ তিনি তাঁর পরে খলিফা কে হবেন সে ব্যাপারে সাধারণ বাইয়াত গ্রহণ অপেক্ষা নিজেই তাঁর পরে খলিফা মনোনয়ন দিয়ে যাওয়াকে অধিকতর বাল মনে করলেন। সুতরাং তিনি হযরত উমর (রাঃ) কে পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনয়ন দিলেন এবং সাহাবীগণ তাঁর সাথে একমত হলেন।
একবার হযরত খালিদ ইবনে অলীদ (রাঃ) হযরত আবু বকর (রাঃ) কে চিঠি লিখে বললেন যে, আরব উপসাগরীয় কোন কোন অঞ্চলে তিনি কিছু লোককে সমকামিতায় (homosexual) অভ্যস্ত দেখতে পেয়েছেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাহাবীগণের পরামর্শ গ্রহণ করতে চাইলেন। সাহাবীগণের মধ্যে হযরত আলী (রাঃ) ও ছিলেন এবং তিনি এ ব্যাপারে কঠোরতর মত প্রদান করেন। তিনি বললেন, এই গুনাহে আমাদের জানামতে একটি মাত্র জাতি লিপ্ত হয়েছিল এবং আপনি জানেন আল্লাহ তাদের ব্যাপারে কিরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। আমার পরামর্শ হচ্ছে, এ সকল লোককে আগুনে পুড়িয়ে মারা হোক। হযরত আবু বকর (রাঃ) হযরত খালিদ ইবনে অলীদকে চিঠি লিখে জানালেন যে, তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হোক এবং তাই করা হয়। (ইবনে কাইয়িম, প্রাগুক্ত) ।
ঐ যুগের ফিকাহের বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ
(ক) সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কুরআন সুন্নাহ তেকে সরাসরি কোন নির্দেশ পাওয়া না গেলে কিয়াস পদ্ধতি ব্যাপক ব্যবহার করা হয়। কোন সাহাবী এ ব্যাপারে আপত্তি তোলেননি।
(খ) বিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইজমার ব্যাপক ব্যবহার। বস্তুতপক্ষে এটা সহজ হয়েছিল এ কারণে যে, সাহাবীগণের সংখ্যা ছিল স্বল্প, ফলে কোন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো তাঁদের পক্ষে সহজ ছিল। তাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে ইজমা পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। উদাহরণস্বরূপ খলিফা বা ইমাম মনোনয়নের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এবং তাদেরকে হত্যা করা, কোন ধর্মত্যাগীকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে গ্রহণ করা এবং কুরআনের আয়াতসমূহ সংগ্রহ এবং গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করা ইত্যাদি।
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) র যুগ
প্রধান বিচারপতি শুরায়হ এর যেসব রায় উমর (রাঃ) অনুমোদন করেছেন এবং যা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি, তাতে দেখা যায় যে, তিনি প্রাপ্ত দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। হযরত উমর (রাঃ) কর্তৃক অনুসৃত পদ্ধতির মধ্যে লক্ষণীয় বিষয় ছিল যে, ফায়সালা গ্রহণের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট উপায় উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে তিনি সাহাবীগণের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরামর্শ করতেন, বিতর্কসভা করতেন। বিভিন্ন আইনগত প্রশ্নে তাঁর ভূমিকা ছিল একজন বিচক্ষণ ও সাবধানী রসায়নবিদের মত, যিনি এমন ঔষধ প্রস্তুত করতে চান যা রোগীর উপর কোন বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই রোগ নিরাময় হয়ে যাবে। ফলে হযরত উমর (রাঃ) আমাদের জন্য ইসলামী আইনের এক বিশাল সম্পদ রেখে যেতে সক্ষম হন। ইবরাহীম নাখঈ (মৃঃ৯৭হিজরী) বলেছিলেন যে, উমর (রাঃ) শহীদ হওয়ার সাথে জ্ঞানের দশ ভাগের নয় ভাগ দুনিয়া থেকে তিরোহিত হয়ে গেছে। (শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, ১খ. পৃ.২৭৮) ।
ইবনে মাসউদ (রাঃ) হযরত উমর (রাঃ) সম্পর্কে বলেছেন, আমরা লক্ষ করেছি যে, উর (রাঃ) সহ পথই বেছে নিতেন। (পূর্বোল্লিখিত গ্রন্থ)
হযরত উমর (রাঃ) র বোধশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর এবং তিনি ছিলেন গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী। তাই তিনি খুব দ্রুত কোন সম্পূরক বিষয়কে মূল বিষয়ের সাথে তুলনা করতে পারতেন। মূলনীতিসমূহের আলোকে তিনি যে কোন বিষয়ের সম্পূরক পর্যন্ত অনুসন্ধান করতে পারতেন। রাসূল (সাঃ) এবং হযরত আবু বকর (রাঃ) এর যুগে তিনি এভাবেই ফতোয়া দিতেন এবংয় তিনি খলিফা হওয়ার পরও তাঁর এ নীতির পরিবর্তন করেননি।
উমর (রাঃ) রাসূল (সাঃ) এর নিকট থেকে অনেক কিছু শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, রাসূল (সাঃ) মাঝে মাঝে লোকদেরকে কোন বাল কাজের ব্যাপারে নির্দেশ দিতে বিরত থাকতেন, যদিও তিনি চাইতেন যে, লোকেরা কাজটি করুক, কিন্তু তা তাদের জন্য কষ্টকর হতে পারে বেবে নির্দেশ দিতেন না। তিনি প্রায়ই বলতেন, যদি আমার উম্মতের জন্য কষ্টকর হবে বলে আশঙ্কা না করতাম তাহলে আমি তাদেরকে নির্দেশ দিতাম যেন তারা সংশ্লিষ্ট কাজটি করে, ইত্যাদি। (সম্ভবত সালাতের পূর্বে দাঁত পরিষ্কার করা সম্পর্কিত বহুল প্রচলিত হাদিসখানি এ আঙ্গিকেই বর্ণিত হয়েছে) (সম্পাদক)
কোন কোন সময়ে তিনি লোকদের কোন কাজ করতে নিষেধ করতেন কিন্তু যখন দেখতেন যে কারণে কাজটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সে কারণ এখন আর বর্তমান নেই তখন ঐ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিতেন। আবার কখনো তিনি হয়তো কোন বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে যাচ্ছেন, এমন সময় যদি তাঁকে বলা হতো যে, এরূপ নিষেধাজ্ঞা লোকদের অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়াবে তখন তিনি তাদেরকে অসুবিধা থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে উক্ত নিষেধাজ্ঞা জারি করা থেকে বিরত থাকতেন।
উমর (রাঃ) দেখেছেন, রাসূল (সাঃ) এর সামনে যখন দুটি বিষয়ের মধ্যে কোন একটি অবলম্বনের প্রসঙ্গ আসত তখন তিনি সবসময় দুটির মধ্যে সহজতরটি অবলম্বন করতেন। বস্তুত এসকল বিষয় হযরত উমর (রাঃ) কে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। তিনি ভালভাবেই বুঝতেন যে, শরীয়াহর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে এবং সেগুলোকে বিবেচনায় আনতে হবে। তিনি মনে করতেন যে, কুরআন ও সুন্নাহে প্রদত্ত নির্দেশাবলীর কোনটি স্পষ্ট এবং কোনটি শুধুমাত্র ইঙ্গিতের কারণ খুঁজে বের করা আলেমগণের কর্তব্য। তাহলে নতুন বিষয়ে ও নতুন আঙ্গিকে আইনের সিদ্ধান্ত সমূহ প্রয়োগ করা সম্ভব হবে, সব কিছুই আল্লাহর ফায়সালার আওতায় এসে যাবে। ফলে মানুষ আল্লাহর আইনবহির্ভূত কোন কিছুর কাছে সমাধান কিংবা আইনগত সিদ্ধান্ত চাইতে অভ্যস্ত হবে না।
সুতরাং হযরত উমর (রাঃ) এর ইজতিহাদের অনুশীলনের প্রতি নজর দিলে আমরা দেখব যে, তিনি সিদ্ধান্তে পৌছার জন্য সুস্পষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। তাঁর প্রদত্ত ফতোয়া অনুসরণ করতে গেলে প্রথমেই দেখা যাবে যে, ভুল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সাবধানতা হিসেবে অথবা দুর্নীতি প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে এবং আইনের আওতায় সহজতর ও সবচেয়ে বেশি উপযোগী পন্থা হিসেবে জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করে সকল ফতোয়া প্রদান করেছেন। যেমন হযরত উমর (রাঃ) কিছু কিছু ফতোয়া বাতিল বলে ঘোষণা করেছিলেন। কারণ এগুলোর কোন কোনটি যে কারণে জারি করা হয়েছিল সে কারণ তখন আর বর্তমান ছিল না এবং যে অবস্থার প্রেক্ষিতে সেগুলো জারি করা হয়েছিল সে অবস্থাও তখন তখন আর অব্যাহত ছিল না। এরূপ কয়েকটি সিদ্ধান্ত হলোঃ
(ক) বদর যুদ্ধের বন্দিদের হত্যা করার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি তাঁর অনুরোধ,
(খ) হিযাবের ব্যাপারে তাঁর পরামর্শ,
(গ) যে কেউ লা ইলাহ ইল্লাল্লাহু বলবে সে বেহেশতে প্রবেশ করবে, একথা যেন রাসূল (সাঃ) লোকদের কাছে না বলেন, কেনা তাহলে লোকেরা এর উপর ভরসা করে বসে থাকবে আর কোন আমল করবে না।
(ঘ) হযরত আবু বকর (রাঃ) কে পরামর্শ প্রদান করা যে, তিনি যেন যারা সম্প্রতি ইসলাম গ্রহণ করেছে তাদেরকে বায়তুল মাল থেকে কোন অতিরিক্ত সুযোগ প্রদান না করেন।
(ঙ) বিজিত দেশকে সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করে না দেয়ার ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি।
হযরত উসমান ইবনে আফফান (রাঃ) এর যুগ
হযরত উসমান (রাঃ) কে এই শর্তে খলিফা নির্বাচন করা হয়েছিল যে, তিনি আল্লাহর কিতাব, রাসূলে (সাঃ) সুন্নাহ এবং পূর্ববর্তী দুজন খলিফা কর্তৃক অনুসৃত নীতি অনুসারে কাজ করবেন। তিনি এই সকল শর্ত মেনে চলার অঙ্গীকার করলেন। কিন্তু হযরত আলী (রাঃ) বলেছিলেন যে, তিনি খলিফানির্বাচিত হলে আল্লাহর কিতাব, রাসূলুল্লাহর সুন্নাহ অনুসারে এবং যথাসাধ্য তাঁর নিজস্ব জ্ঞান ও সামর্থ্য অনুসারে কাজ করবেন। হযরত উসমান (রাঃ) পূর্ববর্তী দুজন খলিফা কর্তৃক অনুসৃত নীতি অনুসারে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় হযরত আবদুর রহমান (রাঃ) তাঁর নিজস্ব অতিরিক্ত ভোট (Casting Vote) হযরত উসমানের (রাঃ) অনুকূলে প্রদান করেন এবং হযরত উসমান (রাঃ) খলিফা নির্বাচিত হন। এভাবে পূর্ববর্তী দুজন খলিফা কর্তৃক অনুসৃত নীতি আইনের তৃতীয় উৎস হিসেবে তৃতীয় খলিফার যুগে প্রবর্তিত এবং অনুমোদিত হয়।
যেহেতু হযরত আলী (রাঃ) এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করতেন সেহেতু তিনি খলিফা হওয়ার পর পূর্ববর্তী খলিফাগণের কোন বিষয়ে ইজতিহাদ প্রসূত রায় বিদ্যমান থাকা সত্বেও তিনি নতুন করে ইজতিহাদ করেন। যেমন হযরত আলী (রাঃ) কোন দাসী তার মনিবের ঔরসজাত সন্তান প্রসব করলে তাঁকে বিক্রয় করা যাবে কিনা তা পুনর্বিবেচনা করেন।
হযরত উসমান (রাঃ) ছিলেন সেই সকল সাহাবীর একজন যিনি খুব বেশি সংখ্যক ফতোয়া প্রদান করেননি। এর কারণ সম্ভবত এটাই যে, তিনি যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন সেগুলো ইতিপূর্বে হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং হযরত উমর (রাঃ) মোকাবেলা করেছিলেন এবং উসমান (রাঃ) তাদের মতামত অনুসারে কাজ করাকে অগ্রাধিকার প্রদান করেছিলেন। তবে তাঁর পূর্বসূরিগণের মতো তাকেও কোন কোন ক্ষেত্রে ইজতিহাদ করতে হয়েছিল। উসমান (রাঃ) খলিফা হওয়ার পূর্বে একবার হযরত উমর (রাঃ) তাঁকে আইনের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আপনি যদি নিজের মতানুসারে করতে চান তাহলে ঠিক আছে। আর যদি আপনার পূর্ববর্তী খলিফাকে (অর্থাৎ আবু বকরকে) অনুসরণ করেন তা হবে উত্তম। কেননা তিন ফায়সালা প্রদানে কতিই যে ভাল ছিলেন।
হজ্জের সময় তিনি নিজেও ইজতিহাদ করেছিলেন। মিনায় সালাত সংক্ষিপ্ত করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট অনুমতি থাকা সত্বেও তিনি তা করেননি। এর সম্ভাব্য দুটি কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ হয়তো এই যে, তিনি মক্কায় বিবাহ করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন যে, মক্কার লোকদের মিনায় সালাত সংক্ষিপ্ত করার অনুমতি নেই। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, তাঁকে এরূপ করতে দেখলে কিছু কিছু বেদুইন ভুল বুঝতে পারে, তাই তিনি তা করেননি। হযরত উসমান (রাঃ) ফতোয়া প্রদান করেছিলেন যে, যায়দ ইবনে সাবিত (রাঃ) যে পদ্ধতিতে কুরআন তেলাওয়াত করেন সকলের সেই পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। কারণ তিনি মনে করেছিলেন যে, ঐ পদ্ধতি সবচেয়ে ভাল এবং এ ব্যাপারে কারো আপত্তি করার সম্ভাবনা তেমন নেই বললেই চলে।
হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রাঃ) এর যুগ
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) এর মতো হযরত আলী (রাঃ) ও একই পদ্ধতিতে কুরআনের বাণীকে উপলব্ধি করতেন এবং তা প্রয়োগ করতেন। গভীর চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে সাধান নীতিমালার আলোকে কোন বিশেষ ঘটনাকে বিশ্লেষণ করতেন। খলিফার দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত তিনি মদিনায় একজন শ্রেষ্ঠ বিচারক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
হযরত আলী (রাঃ) কে ইয়েমেনের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দান কালে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর নিকট এই বলে দোয়া করেছিলেন, হে আল্লাহ তার জিহবাকে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখ এবং তার অন্তরকে পরিচালিত করো বাস্তবেও আলী (রাঃ) নিজেকে একজন উত্তম বিচারক হিসেবে প্রমাণ করেন এবং বহু কঠিন সমস্যার সমাধান করেন।
নিজের জ্ঞান সম্পর্কে হযরত আলী (রাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম কুরআনের এমন কোন আয়াত নেই যা কি বিষয়ে, কোথায় এবং কেন নাযিল হয়েছিল তা আম জানতাম না। আমার আল্লাহ আমাকে বোধশক্তি সম্পন্ন অন্তঃকরণ দিয়েছেন এবং দিয়েছেন স্পষ্ট জবান। হযরত আলী (রাঃ) এর নিকট কোন বিষয় বিচারের জন্য উপস্থিত হলে তিনি কোনরূপ ইতস্তত না করে তার ফায়সালা করতেন এবং তাকে কোন বিষয়ে ফতোয়া দিতে বলা হলে তিনি আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নাহ তেকে উদ্ধৃতিসহ ফতোয়া দিতেন। বস্তুত কোরআন এবং সুন্নাহ সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের কথা সর্বজনবিদিত। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সুন্নাহ সম্পর্কে আলী (রাঃ) অন্য সকলের অপেক্ষা বেশি জ্ঞানী ছিলেন।
হযরত আলী (রাঃ) সাধারণত তাঁর নিজের মতামত দিতে গিয়ে আল কিয়াস, আল ইসতিসহাব (আল ইসতিসহাবঃ আইনগত যুক্তি উত্থাপনকালে সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতি বিবেচনা করা) । আল ইসতিহসান (আল ইসতিহসানঃ বিচারকার্যে কোন বাহ্যিকভাবে সাদৃশ্য প্রমাণ অপেক্ষা কিয়াসকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করা। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ইসতিহসান শব্দটিকে কখনো কখনো বিচার সম্পর্কীয় অগ্রাধিকার (justice preference) রূপে অনুবাদ করা হয়ে থাকে। এবং আল ইসতিসলাহ (আল ইসতিসলাহঃ আইনের বিবেচনায় ব্যক্তি এবং সামগ্রিকভাবে সমাজ এই উভয়ের কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রাখা) । এর ভিত্তিতে ইজতিহাদ করতেন। শরীয়াহর বৃহত্তর লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি তাঁর মতামত প্রদান করতেন। এক মদ্যপানকারী দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর তার শাস্তি যথাসম্ভব বাড়িয়ে দেয়ার পরামর্শ আসে। তিনি মিথ্যা অপবাদ (কাযাফ) এর উপর কিয়াস করে মদ্যপায়ীর শাস্তি নির্ধারণ করেন।
হযরত উমর (রাঃ) এর খিলাফতকালে যৌথভাবে হত্যা পরিকল্পনার সাথে জড়িত একদল লোককে কিভাবে শাস্তি দেয়া যায় সে ব্যাপারে তিনি হযরত আলী (রাঃ) মতামত চাইলেন। হযরত আলী (রাঃ) বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন যদি একদল লোক চুরি করার জন্য একত্র হয় তবে আপনি কি তাদের প্রত্যেকের একটি করে হাত কেটে দেবেন না ?হযরত উমর হ্যাঁ সূচক জবাব দিলে আলী (রাঃ) বললেন, তবে এ ক্ষেত্রেও অনুরূপ ব্যবস্থা প্রযোজ্য হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে হযরত উমর (রাঃ) তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেনঃ যদি সানার সকল নাগরিক একত্রে একজন লোককে হত্যা করতে হবে আমি এই অপরাধে তাদের সকলকে হত্যা করতাম।
এখানে হত্যা এবং রাহাজানির মধ্যে কিয়াস করা হয়েছে। কারণ উভয় ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারীদের সকলের অপরাধ সংঘটনের মোটিভ একই। এ কারণে ভর্ৎসনা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।
এছাড়া আলী (রাঃ) অতি ঈর্ষাপরায়ণ মুরতাদ ও ধর্মদ্রোহীদের যারা তাঁর উপর দেবত্ব আরোপ করতে চেয়েছিল তাদেরকে তিনি জীবন্তবস্থায় পুড়িয়ে মারার পক্ষপাতী ছিলেন। যদিও তিনি ভালোভাবেই জানতেন যে, সুন্নাহ অনুসারে অবিশ্বাসী ও মুরতাদদেরকে শুধুমাত্র হত্যা করার নির্দেশ রয়েছে। তাঁর দৃষ্টিতে এটি একটি মারাত্মক অপরাধ। সুতরাং তিনি এ কাজের জন্য কঠোরতম শাস্তি আরোপ করলেন যাতে লোকেরা এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকে। এছাড়া এর উপর গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে তিনি তাৎক্ষনিকভাবে কবিতার নিম্নোক্ত দুটি চারণ আবৃত্তি করেছিলেনঃ
যখন দেখলাম আমি ব্যাপারটি খুব ভয়ঙ্কর,
আগুন জ্বালিয়ে আমি ডাকলাম খাদেম কাম্বর।
একবার হযরত উমর (রাঃ) খবর পেলেন যে, একটি স্ত্রীলোকের বাড়িতে, যার স্বামী সামরিক অভিযানে গমন করেছিলেন, অপরিচিত লোকদের আগমন ঘটে থাকে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, দূত মারফত উক্ত মহিলাকে নিষেধ করবেন যাতে সে স্বামীর অনুপস্থিতিতে কোন অপরিচিত লোককে তার ঘরে আসতে না দেয়। যখন উক্ত স্ত্রীলোক শুনল যে, খলিফা তার সাথে কথা বলতে চান, তখন সে খুব ভীত হয়ে পড়ল। সে ছিল গর্ভবতী, উমর (রাঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসার পথে তার গর্ভপাত হয়ে যায়।
উমর (রাঃ) উক্ত ঘটনায় খুবই বিব্রত বোধ করলেন এবং এই ব্যাপারে সাহাবীগণের নিকট পরামর্শ চাইলেন। উসমান ইবনে আফফান (রাঃ) এবং আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) সহ কয়েকজন সাহাবী তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন যে, আপনি কোন ভুল করেননি।
এরপর উমর (রাঃ) হযরত আলী (রাঃ) র মতামত জানতে চাইলেন। আলী (রাঃ) বললেন, এ লোকেরা যা বলেছে তা যদি তাদের সাধ্যানুসারে সর্বোত্তম মত হয়ে থাকে তবে যথেষ্ট নিরপেক্ষ মত দেয়া হয়েছে। আর যদি তারা আপনাকে খুশি করার জন্য বলে থাকে তবে তারা আপনাকে প্রতারিত করেছে। আমি আশা করি আল্লাহ আপনার এ গুনাহ মাফ করবেন। যেহেতু তিনি জানেন আপনার উদ্দেশ্য ছিল ভাল। কিন্তু আল্লাহর কসম। আপনি উক্ত গর্ভস্থলনের জন্য ক্ষতিপূরণ দান করুন।
উমর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম। আপনি আমার সাথে অকপটে কথা বলেছেন। আমি শপথ করছি আপনি এ অর্থ আপনার লোকদের মাঝে বিতরণ না করা পর্যন্ত আসন গ্রহণ করবেন না।
সাহাবী ও তাবেঈগণের মধ্যে যাঁরা ফকীহ ছিলেন
৪০হিজরীতে খোলাফায়ে রাশেদার যুগের সমাপ্তির সাথে সাথে তাবেঈদের যুগের শুরু হিসেবে ধরা হয়। সাহাবী এবং প্রবীণ তাবেঈগণের মধ্য হতে আবির্ভূত হন কয়েকজন ফকিহ এবং সূচনা হয় নতুন যুগের । এ পর্যায়ের আইন ব্যবস্থাপনা তৎপূর্ববর্তী যুগের আইন ব্যবস্থাপনার প্রায় অনুরূপ ছিল বলা চলে। যেহেতু এ সময়েও কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা এবং কিয়াসকে পূর্বের মতোই আইনের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, তথাপি এ সময়ের আইন ব্যবস্থাপনায় পূর্বেকার সময়ের চাইতে বেশকিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কিছু ব্যতিক্রম ছিল নিম্নরূপঃ
১। আলেমগণ কুরআন এবং সুন্নাহর বাহ্যিক অর্থ অপেক্ষা অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুসন্ধানে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েন।
২। হাদীস চর্চায় পদ্ধতির ক্ষেত্রেও তাঁরা ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেন। প্রকৃতপক্ষে এ সকল পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে। একই সাথে সেময়ে শুরু হয়েছিল শিয়া এবং খারিজিসহ বিভিন্ন ধরনের দার্শনিক ও সম্প্রদায়গত দলাদলি, যারা সুন্নাহ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করত। শিয়াগণ যে সকল হাদীস তাদের মতানুসারীদের দ্বারা বর্ণিত হয়নি সে সকল হাদীসকে গ্রহণযোগ্য মনে করতো না। আবার খারিজীগণ হাদীসের বর্ণনাকারীগণের ধারাবাহিকতায় একাধিক বর্ণনাকারী না থাকলে সে হাদীস গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। (এ সকল হাদীসকে বলা হয় খবর আল ওয়াহিদ বা একজন মাত্র ব্যক্তি কর্তৃক বর্ণিত হাদীস। এ ধরনের হাদীসের মর্যাদা সম্পর্কে গ্রন্থের পরবর্তী অধ্যায়সমূহে আলোচনা করা হয়েছে) । যে সকল হাদীস কুরআন দ্বারা সমর্থিত হয়নি খারিজীগণ সে সকল হাদীসকেও বাতিল বলে ঘোষণা করে।
৩। এভাবে বিভিন্ন দলে বিভক্তির কারণে এ সময় ইজমার আর কোন সুযোগ থাকল না। প্রতিটি দলের আলেমগণ অন্য সকল দলের আলেমগণের প্রতি অবিশ্বাস পোষণ করতেন এবং কোন বিষয়ে একে অপরের সাথে একমত বা দ্বিমত যাই পোষণ করুন না কেন তারা কেউ কারো মতামত গ্রহণ করতেন না। উপরন্তু সাহাবীগণের মধ্যে যাঁরা ফকিহ ছিলেন, তাঁরা দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিলেন বিধায় একত্র হয়ে কোন বিষয়ে আলোচনা করাও সম্ভব ছিল না।
৪। এছাড়া এ যুগে যে কেউ হাদীস এবং সুন্নাহর বর্ণনা করতেন অথচ পূর্ববর্তী যুগে এরূপ হতো না।
৫। সর্বজনবিদিত বহু কারণে এ সময় ভুয়া হাদীসের বর্ণনা যথেষ্ট ব্যাপকতা লাভ করে। সে সকল কারণ আমরা এখানে আপাতত আলোচনা করছি ন। ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, হাদীসের ব্যাপারে কোনরূপ আশঙ্কা ছাড়াই আমরা সাধারণত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নামে বিভিন্ন হাদীস বর্ণনা করতাম। কিন্তু যখন লোকেরা দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে রাসূলের (সাঃ) নামে বিভিন্ন হাদীস বর্ণনা করা শুরু করল তখন আমরা হাদীস বর্ণনা করা বন্ধ করে দিলাম।