৫ম অধ্যায়
ইমাম শাফেঈ (রঃ) র পরবর্তী যুগের উসুলে ফিকাহ
ইমাম শাফঈ (রঃ) রচিত রিসালাহ (ক্ষুদ্র পুস্তিকা) প্রকাশিত হওয়ার মুহূর্ত থেকে ইসলামী আই সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে তা প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। বস্তুত এর ফলে গবেষকগণ দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। অধিকাংশ আহলে হাদীসের একটি দল গ্রন্থখানিকে গ্রহণ করেন এবং ইমাম শাফেঈর (রঃ) আই বিষয়ক চিন্তাধারার সমর্থনে এটিকে ব্যবহার করেন। অন্য দলটি এ গ্রন্থে বর্ণিত প্রায় সকল বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করেন। জনসাধারণের উপর সম্ভাব্য প্রভাব পড়ার আগেই তাঁরা তাদের নিজস্ব পদ্ধতি ও অনুশীলনের সাথে ইমাম শাফেঈ (রঃ) এর গ্রন্থে বর্ণিত যে কোন বিরোধমূলক বিষয়কে খণ্ডন করার চেষ্টা করেন। এ দলের সদস্যগণ ছিলেন স্পষ্টতই আহলে রায়ের সমর্থক (হানাফিগণ) । তাঁরা ইমাম শাফেঈ (র) যা যা লিখেছিলেন তার প্রায় সকল বিষয়ের সাথে তাঁদের সম্পূর্ণরূপে মতপার্থক্যের কথা উল্লেখ করেন।
ইবনুন নাদীম রিসালাহ গ্রন্থের পরে উসূলে ফিকাহ বিষয়ে লিখিত গ্রন্থসমূহের নাম উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (মৃঃ২৩৩ হিঃ) রচিত আন নাসিখ ওয়াল মানসূখ এবং আস সুন্নাহ গ্রন্থ দুটিও অন্তর্ভুক্ত। আস সুন্নাহ গ্রন্থখানিতে আসলে আইন সম্পর্কিত বিষয়াবলী অপেক্ষা তাওহীদ এবং ইসলামের মৌল বিশ্বাস তথা আকাইদ সম্পর্কিত আলোচনা প্রাধান্য পেয়েছে। উক্ত গ্রন্থের দুটি মুদ্রিত সংস্করণ পাওয়া যায়। বৃহত্তর সংস্করণটি ১৩৪৯ হিজরীতে মক্কায় মুদ্রিত হয়। এর পান্ডুলিপি কপিসমূহ যথাক্রমে মিসর দামেস্কের দারুল কুতুব এবং জাহিরিয়াহ গ্রন্থাগারে পাওয়া যায়। আরেকটি ক্ষুদ্র সংস্করণ কায়রোতে তারিখবিহীনভাবে প্রকাশিত হয়। উক্ত গ্রন্থে নিষ্ঠাবান সুন্নি বা আহলে সুন্নাহর মৌল বিশ্বাসসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
ইমাম আহমাদ তাাতুর রাসূল (রাসূলে আনুগত্য) নামে আরেকখানি গ্রন্থ রচনা করেছেন। ইবনে কাইয়িম তাঁর প্রণীত ইলামুল মুয়াক্বিঈন গ্রন্থে উক্ত গ্রন্থ থেকে বহু উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এতে অনুমান করা যায় যে, তাঁর নিকট উক্ত গ্রন্থের কপি ছিল। আমি বহু স্থানে গ্রন্থখানির কপি অনুসন্ধান করেছি কিন্তু সর্বক্ষেত্রেই তা পেতে ব্যর্থ হয়েছি। ইবনে কাইয়িম এর গ্রন্থের উদ্ধৃতিসমূহ থেকে স্পষ্টরুপে বুঝা যায় যে, বস্তুত আইন ও সুন্নাহ সম্পর্কিত উসূল বিষয়ে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। সম্ভবতঃ ইবনে কাইয়িমের পরবর্তী যুগে গ্রন্থখানি হারিয়ে গেছে অথবা অন্য কোন গ্রন্থের সাথে একত্রে বাঁধাই করা হয়েছে অথবা শিরোনাম পৃষ্ঠা হারিয়ে গেছে, যা অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া যেতে পারে।
বিভিন্ন উৎস থেকে জানা যায় যে, দাউদ জাহিরী (মৃঃ২৭০ হিঃ) কর্তৃক ইজমা (সর্বসম্মত মত) , ইবতালুত তাকলীদ (অনুকরণ বন্ধ করা প্রসঙ্গে) খবর আল ওয়াহিদ (একজনমাত্র বর্ণনাকারী সম্পর্কিত) , খবর আল মুজিব (অবশ্য পালনীয় বর্ণনা সম্পর্কিত) , আল খুসূস ওয়াল উমূম (বিশেষ ও সাধারণ বিষয় সম্পর্কিত) , আল মুফাসসার ওয়াল মুজমাল (সংক্ষিপ্ত ও বিশদ) , আল কাফী ফী মুকাবালতিল মুত্তালিবী (অর্থাৎ ইমাম শাফেঈর মুকাবিলা) মাসালাতান খালাফা ফীহিমা আশ শাফেঈ (যে দুটি বিষয়ে তিনি ইমাম শাফেঈর সাথে মতভেদ করেছিলেন) ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেন।
এ সময় ইমাম আবু হানিফার (র) চিন্তাধারার অনুসারী আলেমগণ শাফেঈ (রঃ) রচিত রিসালাহ দুটি কারণে গভীরভাবে অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। প্রথমতঃ উক্ত গ্রন্থের যে সকল বিষয় সম্পর্কে তাঁরা দ্বিমত পোষণ করেন সে সকল বিষয়কে খণ্ডন করা এবং দ্বিতীয়তঃ উক্ত গ্রন্থের অনুসরণে ইমাম আবু হানিফারফতোয়ার ভিত্তিতে আইন শাস্ত্রের নিজস্ব নীতিমালা (উসূল) প্রণয়ন করা।
এ বিষয়ে হানাফি গবেষকগণ বহু গ্রন্থ রচনা করেন। যেমন ঈসা ইবনে আবান (মৃঃ২২০ হিঃ) কর্তৃক খবর আল ওয়াহিদ, ইসবাতুল কিয়াস (সাদৃশ্যমূলক অবরোহ পদ্ধতি বৈধকরণ) এবং ইজতিহাদুর রায় (আইনগত যুক্তি পদ্ধতির অনুশীলন) ইত্যাদি গ্রন্থ রচিত হয়।
আল বারজাঈ (মৃতঃ৩১৭ হিঃ) রচনা করেছেন মাসাইলুল খিলাফ (মতপার্থক্যের বিষয়সমূহ) নাক গ্রন্থ। তিউনিসের যায়তুনাহ গ্রন্থাগার, ক্রমিক সংখ্যা ১৬১৯। আবু জাফর আত তাহাবী (মৃঃ৩২১ হিঃ) ইখতিলাফুল ফুকাহা (ফকীহগণের মতপার্থক্য) নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেছেন। আবু বকর আল জাসসাস (মৃঃ৩৭০ হিঃ) উক্ত গ্রন্থখানিকে সংক্ষিপ্ত করেন। কায়রোতে এ গ্রন্থের একখানা কপি আছে। বিস্তারিত জানার জন্য মাহাদ আল মাখতুতাত (১/৩২৯) এর ইনডেক্স দেখা যেতে পারে। (পাকিস্তানের ইসলামিক রিসার্চ ইন্সটিটিউট জাসসাসের উক্ত সংক্ষেপিত গ্রন্থের অংশবিশেষ প্রকাশ করেছে। যাইহোক উক্ত খন্ডের সম্পাদক ভূলবশতঃ এটিকে আবু জাফর আত তাহাবীর রচিত গ্রন্থ বলে উল্লেখ করেছেন। (সম্পাদক)
আল কারাবীসী আন নাজাফী (মৃঃ৩২২ হিঃ) লিখেছেন আল ফারুক (পার্থক্যসমূহ) , যার পাণ্ডুলিপিসমূহ ইস্তাম্বুলের তৃতীয় আহমদ এবং ফায়জুল্লাহ গ্রন্থাগারসমূহে পাওয়া যায়।
আইন বিষয়ের বেশ কয়েকটি শিরোনামবিহীন প্রাচীন পান্ডুলিপি ইবনে সামাহ (মৃঃ২৩৩) কর্তৃক রচিত বরে মনে করা হয়ে থাকে। (দেখুন ইবনুন নাদীম, আর ফিহরিস্ত, পৃঃ২৮৪)
আল কানানী (মৃঃ২৮৯ হিঃ) রচনা করেছেন আল হুজ্জাহ ফীর রাদ আলাশ শাফেঈ (ইমাম শাফেঈর জবাবে প্রমাণ সমূহ) ।
আলী ইবনে মূসা আল কুমমী হানাফি (মৃঃ৩০৫) লিখেছেন মা খালাফা ফীহি আশ শাফেঈল ইরাকীইন ফী আহকামিল কুরআন (কুরআনের আইনগত ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে শাফেঈ যে সকল বিষয়ে ইরাকীদের বিরোধিতা করেছেন তাঁর নমুনা) , ইসবাতুল কিয়াস, আল ইজতিহাদ এবং খবর আর ওয়াহিদ ইত্যাদি।
আবুল হাসান আর কারখী (মৃঃ৩৪০ হিঃ) লিখেছেন তাঁরবিখ্যাত গ্রন্থ আল উসূল (উৎসসমূহ) যা কায়রো থেকে অন্য আরো কয়েকটি গ্রন্থসহ একত্রে মুদ্রিত হয় (তারিখবিহীন) ।
ইমামীয়া পন্থী (শীআ) আবু সাহল আন নওবাখতী (মৃঃ৯৩ হিঃ) লিখেছেন, নাকদু রিসালাতিস শাফেঈ (শাফেঈর রিসালাহ গ্রন্থের সমালোচনা) , ইবতালুল কিয়াস (কিয়াস নাকচকরণ) এবং আর রাদ আলা ইবনির রাওয়ানদী ফী বাদ আরাইহী আল উসূলীয়াহ (ইবনে রাওয়ানদীর কয়েকটি আইনগত মতামত খণ্ডন) ইত্যাদি গ্রন্থ। যায়দিয়া দলের অনুসারী ইবনে জুনাইদ (মৃঃ৩৪৭) লিখেছেন আল ফাসখ আলা মান আজাযা আন নাসখ লিমা তাম্মা শারুহু ওয়া জাল্লা নাফউহু (ইতিমধ্যে জারিকৃত এবং উপকারী বরে প্রমাণিত আইনসমূহকে যারা রহিত করার অনুমতি দিয়েছেন তাঁদের মতামত বাতিলকরণ) এবং আইফহাম লি উসূলিল আহকাম (বিচার সম্বন্ধীয় নীতিমালা অনুধাবন) ইত্যাদি গ্রন্থ।
ইমাম শাফঈর (রঃ) চিন্তাধারার অনুসারীগণ কর্তৃক নিম্নবর্ণিত গ্রন্থাবলী প্রণীত হয়ঃ
আবু ছাওর (মৃঃ২৪০ হিঃ) লিখেছেন ইখতিলাফুল ফোকাহ (ফকীহগণের মতপার্থক্য) আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে নাসর আল মারওয়াযীও (মৃঃ২৯৪ হিঃ) একই বিষয়ের উপর গ্রন্থ রচনা করেছেন।
আবু আব্বাস ইবনে সুরাইজ (মৃঃ৩০৫ হিঃ) তাঁর রচিত গ্রন্থে ঈসা ইবনে আবান এবং মুহাম্মদ ইবনে দাউল আল যাহিরী যে সকল বিষয়ে ইমাম শাফেঈর (রঃ) সাথে মতানৈক্য করেছিলেন সে সকল বিষয়কে খণ্ডন করার চেষ্টা করেন।
ইবরাহীম ইবনে আহমদ আল মারওয়াযী (মৃঃ৩৪০) লিখেছেন আল উমূম ওয়াল খুসূস (সাধারণ ও বিশেষ বিষয়) এবং আল ফুসুল ফী মারিফাতিল উসূল (ইবনে নাদীম, প্রাগুক্ত, পৃঃ২৯৯) (আইনতত্ত্ব সম্পর্কিত জ্ঞানের কয়েকটি অধ্যায়) ইত্যাদি গ্রন্থ।
কোন কোন গবেষক এ সময়ে ইমাম শাফঈ (রঃ) রচিত রিসালাহ গ্রন্থের উপর টিকা ও ভাষ্য প্রণয়নের প্রতি মনোনিবেশ করেন। তাঁদের মধ্যে আবু বকর আস সায়রাফী (মৃঃ৩৩০) আবুল ওয়ালিদ আন নিসাবূরী (মৃঃ৩৬৫ বা ৩৬৩) , আবু বকর আল জাওয়াকী (মৃঃ৩৮৮) এবং বিখ্যাত ইমামুল হারামাইনের পিতা, ইমাম গাযযালীর শিক্ষক আবু মুহাম্মদ আল জুয়াইনী উল্লেখযোগ্য।
রিসালাহ গ্রন্থের টিকাকার হিসেবে আরো পাঁচজন গবেষক পরিচিতি লাভ করেছেন। তাঁরা হলেন আবু যায়দ আল জাযূলী, ইউসুফ ইবনে উমার, জালালুদ্দিন আফকাহসী, ইবনুল ফাকিহানী এবং আবুল কাসিম ঈসা ইবনে নাজী। সপ্তম শতাব্দী পরবর্তীকালে এ সকল টিকাকারকে গবেষকগণ আধুনিক যুগের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে উদ্ধৃত করতে শুরু করেন।
শায়খ মুস্তাফা আবদুর রাজ্জাক (দেখুন, আবদুর রাজ্জাক, প্রাগুক্ত) উল্লেখ করেন যে, প্যারিসের পাবলিক লাইব্রেরিতে রিসালাহর উপর জুয়াইনী কর্তৃক টিকা সম্বলিত গ্রন্থের একখানা কপি আছে। তিনি তা থেকে কিছু কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্যারিসে উক্ত পান্ডুলিপিখানা দেখার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পাইনি। হয়তোবা এটি বিভিন্ন শিরোনামযুক্ত অন্যান্য বইয়ের সাথে রাখা হয়েছে, সম্ভবত এটি পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে সবগুলো পান্ডুলিপি এক এক করে খুঁজে দেখা। যাই হোক এরূপ ভীতিকর কাজ হাতে নিতে হলে গবেষককে যথেষ্ট সময় নিয়ে এগুতে হবে।
ইমাম শাফেঈ (রঃ) র পরবর্তী যুগে উসূলে ফিকাহর বিকাশ
উপরোল্লিখিত সময়কে বিকাশকাল বলা কষ্টকর। কেননা মূলতঃ এ সময় অতিবাহিত হয়েছে রিসালাহর সমালোচনা, সমর্থন অথবা টিকা লিখনের মধ্য দিয়ে, বস্তুতঃ এর অধিক কিছু নয়। এ ধারা একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পর হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর প্রারম্ভ কাল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। সে সময়কে একই সাথে উসূলে ফিকাহর গুরুত্বপূর্ণ বিকাশকাল শুরু হওয়ার পর্যায় হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
এ সময় কাজী আল বাকিল্লানী (মৃঃ৪০২ হিঃ) এবং কাজী আবদুল জাব্বার অঅল হামাদানী (মৃঃ৪১৫ হি) শরীয়াহ সম্পর্কিত উসূলের (আইনতত্ত্বের) অনুশীলন ও নীতিমালাসমূহ সামগ্রিকভাবে পুনর্লিখনের কাজ হাতে নেন।
আল যারকাশী তাঁর প্রণীত গ্রন্থ আল বাহর এ লিখেছেন, —- দুজন বিচারক যথাক্রমে আহলে সুন্নাহর কাজী আবু বকর তায়িব্য আল বাকিল্লানী এবং মুতাযিলাদের কাজী আবদুল জাব্বার আত্ন্যপ্রকাশ করলেন তাঁরা আগে যে সকল লেখা ছিল সেগুলোকে আরা সম্প্রসারিত করলেন, আগে যে সকল বিষয়সাধারণ ইঙ্গিতের বেশি কিছু ছিল না সেগুলোর ব্যাখ্যা প্রদান করলেন, সাধারণভাবে বর্ণিত বিষয়সমূহকে আরো বিশদ বর্ণনা করলেন এবং সকল অস্পষ্টতা দূরীভূত করলেন।
কাজী আল বাকিল্লানী তাঁর গ্রন্থ আত তাকরীব ওয়াল ইরশাদ (ব্যাখ্যা ও নির্দেশনা) প্রণয়নেরপর শায়খূল উসূলিয়ীন (উসূল গবেষকগণের নেতা) (দেখুন আরবী***** , 1, 1-19। ) উপাধি লাভ করেন। কয়েক শতাব্দীকাল যাবত গ্রন্থখানি পাওয়া যাচ্ছে না, যদিও পান্ডুলিপি সংগ্রহের জন্য একাধিক উদ্যোগের মাধ্যমে এটি খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। যাইহোক উসূলের গবেষকগণ হিজরী নবম শতাব্দী পর্যন্ত এ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন।
কাজী আবদুল জাব্বার তাঁর মতানুসারে আল আহদ (অঙ্গীকারনামা) অথবা আল আমাদ (স্তম্ভসমূহ) শিরোনামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেছিলেন এবং এতে তাঁর নিজস্ব টিকাও লেখেন।
ইমামুল হারামাইন (মৃঃ৪৭৮ হিঃ) আল বাকিল্লানী রচিত আত তাকরীব ওয়াল ইরাশাদ গ্রন্থের সারসংক্ষেপ রচনা করেন। সংক্ষেপিত উক্ত গ্রন্থের নাম ছিল আত তালখীস (সারসংক্ষেপ কিংবা আল মুলাখখাস (সারসংক্ষেপ) , যার কিছু কিছু পৃষ্ঠ কিছু প্রাচীন পান্ডুলিপি সংগ্রহে পাওয়া যায়। পরবর্তী যুগের আইন শাস্ত্রের গবেষকগণ আল বাকিল্লানীর বেশ কিছু ধারণা তাদের নিজস্ব পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেন।
ইমামুল হারামাইনের উসূল (আইনতত্ত্ব) সম্পর্কিত আল বুরহান (প্রমাণ) গ্রন্থটি আল বাকিল্লানী রচিত আত তাকরীব এর উপর ভিত্তি করে রচিত। উক্ত গ্রন্থে আইনতত্ত্বের সকল শাখা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যদিও এতে স্বাধীন পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে। (সম্প্রতি কাতার থেকে আল-বুরহানের একটি সুন্দর সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে) তিনি তাঁর শিক্ষক ইমাম অল আশআরী (রঃ) এবং ইমাম শাফেঈর (রঃ) সাথে বেশ কয়েকটি বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেন। এ কারণে ইমাম শাফেঈ (রঃ) র চিন্তাধারার অনুসারী সমসাময়িক গবেষকগণ আল বুরহানে প্রদত্ত টীকা প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং এর প্রতি প্রয়োজনীয় গুরুত্ব প্রদান করেননি। যদিও তাঁরা তাঁদের নিজেদের পুস্তকে উক্ত পুস্তকের বিভিন্ন অংশ গ্রহণ করেছেন।
দুজন মালিকী গবেষক যথাক্রমে ইমাম আবু আবদুল্লাহ আল – মাআযিরী (মৃঃ৫৩৬ হিঃ) এবং আবুল হাসান আল-আবআরী (মৃঃ৬১৫ হিঃ) আল বুরহান গ্রন্থের উপর টীকা লিখেছেন। তৃতীয় আরেক জন মালিকী গবেষক আবু ইয়াহইয়া উপরোক্ত দুটি টীকা একত্র করে প্রকাশ করেন। উল্লেখিত তিনজন গবেষকেই অত্যন্ত কঠোর ভাষায় অনেকটা অযৌক্তিকভাবে ইমামুল হারামাইনের সমালোচনা করেন। তাঁরা ইমাম আশআরীর মতামতকে ইমামুল হারামাইন কর্তৃক খণ্ডন করার প্রচেষ্টাকে ঔদ্ধত্য বলে বিবেচনা করেন এবং আল মাসালিহ আল –মুরসালাহ প্রশ্নে ইমাম মালিকের মতামত খণ্ডন করার চেষ্টা করেন। ইমাম শাফেঈর গ্রন্থে ইমামুল হারামাইন একটি ভূমিকা সংযোজন করেছেন এবং তাতে এমন কিছু বক্তব্য যোজনা করেছেন যা রিসালাহ এ পাওয়া যায় না। অবশ্য তিনি তাঁর আলোচনা এভাবে শুরু করেছেনঃ কোন ব্যক্তি কোন বিষয়ের তত্ত্বীয় আলোচনায় নিয়োজিত হতে চাইলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন যে, উসূলে ফিকাহ সম্পর্কিত জ্ঞানের উৎস হল ইলমুল কালাম (সূক্ষ ধর্মতত্ত্ব) , আরবী ভাষা এবং ফিকাহ শাস্ত্র। অতঃপর তিনি আইনগত সিদ্ধান্ত গ্রহনের প্রক্রিয়া, এ সম্পর্কে পালনীয় কর্তব্য এবং আইনগত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর প্রয়োজনীয় যোগ্যতা সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি বিভিন্ন বিজ্ঞান সম্পর্কিত বিষয় বিস্তারিতভাবে আলোচনার পাশাপাশি কোন বিষয় যুক্তির সাহায্যে এবং কোন বিষয় ধর্মের ব্যাখ্যার সাহায্যে উপলব্ধি করতে হবে সে সকল বিষয় ব্যাখ্যা করেন। উপরে বর্ণিত সকল বিষয়ের উপর এ আলোচনাকে আল- বায়ান (সুস্পষ্ট ঘোষণা) কথাটির পরবর্তী বিস্তারিত ব্যাখ্যার ভূমিকা হিসেবে তুলে ধরেন। আল বায়ান সম্পর্কিত আলোচনার মাধ্যমেই ইমাম শাফেঈ (রঃ) তাঁর রিসালাহ শুরু করেছিলেন। এটা খুবই স্পষ্ট যে, আল- বায়ান এবং রিসালাহ গ্রন্থে বর্ণিত অন্যান্য পরিভাষা সম্পর্কে ইমামুল হারামাইন যেভাবে আলোচনা করেছেন তাতে দেখা যায় যে, তিনি আল – বায়ানসহ অন্যান্য পরিভাষার সংজ্ঞা ইমাম শাফেঈ অপেক্ষা অধিকতর স্পষ্টরুপে প্রদান করেছেন। তিনি পরিভাষাসমূহের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন, সারমর্ম ব্যাখ্যা করেছেন, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মতপার্থক্যসমূহ উল্লেখ করেছেন এবং এগুলোর বিভিন্ন শ্রেণী নির্দেশ করেছেন। এছাড়া তিনি অন্য একটি বিষয়েও আলোচনা করেছেন যা ইমাম শাফেঈ করেননি। তা হচ্ছে, তাখীরুল বায়ান ইলা ওয়াকতিলহাজাত (প্রয়োজনীয় সময় পর্যন্ত আল বায়ানের অনুবর্তী হওয়া) এবং এ সম্পর্কিত মতপার্থক্যসমূহ। বিভিন্ন প্রকারের আল –বায়ান সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি ইমাম শাফেঈ (রঃ) কর্তৃক উল্লেখিত পাঁচটি শ্রেণীর কথা পুনরুল্লেখ করেন। এ বিষয়ে আবু বকর দাউদ আল-বায়ানের কথা উল্লেখ করেন।
ইমামুল হারামাইন এ মত পোষণ করতেন যে, আল বায়ান অর্থ হচ্ছে সাক্ষ্য প্রমাণ। সাক্ষ্য প্রমাণ দুপ্রকারের। যেমন আকলী (বুদ্ধিবৃত্তিক) এবং সাময়ী (শ্রুত অর্থাৎ ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত) । সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে মাসঈর ভিত্তি হচ্ছে অলৌকিক কুরআন। সুতরাং সাক্ষ্য প্রমাণ কুরআনের সাথে যতবেশি ঘনিষ্ঠ হবে তা তত বেশি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হবে। অতএব সামঈ সাক্ষ্য প্রমাণসমূহের অগ্রাধিকার ভিত্তিক ক্রমবিন্যাস হচ্ছে নিম্নরূপঃ আল কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, খবরে ওয়াহিদ এবং কিয়াস
অতঃপর তিনি ভাষা সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, আইন শাস্ত্রের গবেষকগণ ভাষাতত্ত্বের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করলেও আরবী ভাষী গবেষকগণ আওয়ামির (আদেশসমূহ) নাওয়াহী (নিষেধাজ্ঞাসমূহ) , আল উসুম ওয়া অঅল খুসুম (সাধারণ ও বিশেষ বিষয়সমূহ) ইত্যাদির মতো বিষয়াদি সম্পর্কে আলোচনাকরেননি। কিন্তু ইমাম শাফেঈ উল্লেখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
ভাষাতত্বের এ সকল দিক নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি আরবাকিল্লানীর কিছু কিছু ধারণা সম্পর্কে আলোকপাত করেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন যে, আল বাকিল্লানী ইতিমধ্যেই ইমাম শাফেঈ (রঃ) এর পদ্ধতির সাথে উল্লেখিত বিষয়াদি সংযোজন করেছেন।
ইমাম গাযযালী (রঃ) ইমামুল হারামাইনের ছাত্র বিধায় তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। বস্তুত ইমাম গাযযালী উসূল সম্পর্কে মোট চারখানা গ্রন্থ রচনা করেন। তম্মধ্যে প্রথম গ্রন্থখানির নাম ছিল আল মানুখুর (যাচাই বাছাইকৃত) । মধ্যম আকারের এ গ্রন্থখানি লেখা হয়েছিল উসূলের প্রাথমিক অথবা মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয় গ্রন্থখানি সম্পর্কে শুধুমাত্র আল মুস্তাফা নামক গ্রন্থে উল্লেখ ছাড়া আর কিছুইজানা যায়নি। আরো জানা যায় যে, গ্রন্থখানির নাম ছিল তাহযীবুল উসূল (উসূলের পরিশুদ্ধকরণ) তাঁর লেখো তৃতীয় গ্রন্থের নাম শিফাউল গালীল ফী বায়ানিশ শিবহ ওয়াল মুখাইয়াল ওয়া মাসালিকিত তালীল। গ্রন্থখানি ১৩৯০/১৯৭১ সনে বাগদাদ থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। উসূল সম্পর্কে আল গাযযালীর সর্বশেষ এবং চতুর্থ গ্রন্থ হচ্ছে আল মুস্তাসফা, যা মুলতঃ উসূলে ফিকাহ বিষয়ক বিশ্বকোষ বিশেষ। এটি মিসর ও অন্যান্য স্থান থকে বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। (দেখুন, আল-গাযযালী রচিত আল-মুস্তাসফা, ১খ, ১৮৭, গ্রন্থখানির আকর্ষণীয় ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ডঃ আহমদ যাকী হাম্মাদ। শীঘ্রই তা প্রকাশিত হবে ইনশাআল্লাহ। ) ইমাম গাযযালী (রঃ) তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় এ্যারিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যার প্রায় সকল দিক সম্পর্কে আলোচনা করেন। এ বিষয়ে তাঁর ছিল গভীর আগ্রহ। অতঃপর তিনি হদ্দ (বিধিবদ্ধ শাস্তি) এবং যে সকল শর্ত আবিশ্যকরূপে পূরণ সাপেক্ষে তা কার্যকর করা যায় সে সম্পর্কে এবং আরও বিভিন্ন প্রকারের হদ্দ সম্পর্কে আলোচনা করেন। পরবর্তী পর্যায়ে আলোচিত হয় দলীল (সাক্ষ্য-প্রমাণ) ও এর প্রকারভেদ সম্পর্কে।
এ প্রসঙ্গে আলোচ্য গ্রন্থে তিনি তাঁর বক্তব্যের কাঠামো তুলে ধরেন এবং বিভিন্ন শিরোনামে উসূল সম্পর্কিত সকল বিষয় আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি তাঁর শিক্ষক ইমামূল হারামাইন এবং তাঁর পূর্বসূরি আল বাকিল্লানীকে বিশেষভাবে অনুসরণ করেন। তাঁর শিক্ষক যেমন ইমাম শাফেঈ এবং আল আশআরীর সাথে ভিন্নমত পোষণ করতেন, ইমাম গাযযালীওতেমনি তাঁর পূর্ববর্তীদেরসাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। অনুরূপভাবে ইমাম গাযযালীর সমসাময়িক গবেষকগণের অনেকে তাঁর মতামত গ্রহণ করেছেন আবার অনেকে তাঁর মতামত গ্রহণ করেননি।
এগুলো ছিল উসূলের গবেষণার ক্ষেত্রে ইমাম শাফেঈ (রঃ) এর অনুসারীগণের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
মুতাযিলাপন্থীগণও উসূলের বিকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। কাজী আবদুল জাব্বার কর্তৃক আল – আমাদ/আল আহদ গ্রন্থখানি প্রণয়ন এবং এর উপর পূর্নাঙ্গ টীকা রচনা করার পর তিনি উসূল সম্পর্কে তাঁর রচিত বিশ্বকোষে কিছু মতামত লিপিবদ্ধ করেন। এর অংশবিশেষ আল –মুগনী শিরোনামের অধীন মুদ্রিত ও আলোচিত পাওয়া যাবে। উক্ত বিশ্বকোষের সপ্তদশ খণ্ডটি সম্পূর্ণরূপে নিবেদিত হয়েছে উসূল সম্পর্কিত গবেষণায়। যেহেতু ইমামুল হারামাইন নিজেকে আল – বাকিল্লানী রচিত গ্রন্থের সাথে সম্পৃক্ত করেছিলেন, সেহেতু আবুল হাসান আল বাসরী আল-মুতাযিলীও (মৃঃ৪৩৫ হিঃ) নিজেকে কাজী আবদুল জাব্বারের সাথে সম্পৃক্ত করেন এবং আল আমাদ/ আল আহদ এর উপর টীকা রচনা করেন। তাঁর টীকা ভাষ্য অত্যধিক দীর্ঘ হয়েছে বুঝতে পেরে তিনি আল-মুতামাদ (নির্ভরযোগ্য) নামে আরেকখানা সারসংক্ষেপ গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। গ্রন্থখানি মুদ্রিত হয়েছে এবং তা সহজলভ্য।
এ যুগে শায়খ আবু ইসহাক আশ শিরাযী (মৃঃ৪৬৭ হিঃ) আল –লামউ (উজ্জ্বল আলো) এবং আত- তাবসিরাহ (জ্ঞানালোক) নামে দুটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন এবং দুটি গ্রন্থই মুদ্রিকাকারে পাওয়া যায়। কাজী আবু ইয়াহইয়া আল ফাররা আল হাম্বলী উসূল সম্পর্কে একখানা গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থখানির নাম আল উদ্দাহ ফী উসূলিল ফিকহ (উসূলে ফিকাহর হাতিয়ার সমূহ) ১৪০০/১৯৮০ সনে সৌদি আরব থেকে গ্রন্থখানি সম্পাদিত ও প্রকাশিত হয়। আরেকজন হাম্বলী গবেষক ইবনে আকীল আল- বাগদাদী রচনা করেন আল – ওয়াদিহ ফীল উসূল (উসূল সম্পর্কে স্পষ্ট বিষয়সমূহ) । আবুল-খাত্তাব লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আত –তামহীদ (ভূমিকা) গ্রন্থখানি সম্প্রতি মক্কা থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত হয়েছে।
মালিকী আইন বিষয়ক চিন্তাধারার গবেষকগণ ঐ সময় যে সকল গ্রন্থ প্রণয়ন করেন সেগুলো হচ্ছে ইবনুল কাসসার আল বাগদাদী (মৃঃ৩৯৮ হিঃ) রচিত উয়ুনুল আদিল্লাহ ফী মাসাইল আল – খিলাফ বাইনা ফুকাহাইল আমসার (বিভিন্ন এলাকার ফকীহগনের মধ্যে মতভেদপূ্র্ন বিষয়ে যুক্তি প্রমাণের উৎস) উল্লেখযোগ্য। উক্ত গ্রন্থের একখানা কপি ফেজ এ অবস্থিত কারাবিঈণ বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত আছে। (দেখুন Brockelmann, appendixIIপৃ.৯৬৩, নং৪৯। ) শীরাযীর মতে, মতভেদপূ্র্ন বিষয়ে মালিকী গবেষকগণ কর্তৃক লিখিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে এটি সর্বশ্রেষ্ঠ। ইবনুল কায়সার মুকাদ্দিমাহ ফী উসূলিল ফিকহ (উসূলে ফিকাহ সম্পর্কে ভূমিকা) নামে আরেকখানা গ্রন্থ রচনা করেন। এর একখানা কপি আল- আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত আছে।
শাফেঈ, হাম্বলী, মালিকী এবং মুতাযিলাপন্থী সকল গ্রন্থের অধ্যায়সমূহ একই রীতিতে বিন্যস্ত করা হয়েছে এবং একইরূপে বিষয়বস্তু বর্ণনার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে। ফলে এ রীতি মুতাকাল্লিমূনের পদ্ধতি নামে পরিচিতি লাভ করে।
উসূল প্রণয়ন আবু হানিফা (রঃ) এর অনুসারীগনের ভূমিকা
উসূলে ফিকাহ শাস্ত্রের কোন কোন ইতিহাসবিদ বলেছেন যে, কাজী আবু ইউসুফ এবং মোহাম্মদ ইবনুল হাসান (রঃ) উসূল (আইনতত্ত্ব) সম্পর্কে গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন, কিন্তু তাদের এ দাবি প্রমাণিত হয়নি। (দেখুন আল-মক্কী রচিত মানাকিব আল-ইমাম আবু হানিফা, ২খ, ২৪৫, উসূলুস –সারাখসি গ্রন্থের ভূমিকা, ১খ, ৩, কুতুব যাদেহ, মিফাতাহুস সাআদাহ, ২খ, ৩৭, এবং ইবনুন নাদিম, আল ফিহরিস্ত। যারা এ দাবি করেছেন তারা সকলে ইবনুস নাদিম রচিত মুহাম্মদ ইবনুল হাসান এর জীবনী গ্রন্থের নিম্নোক্ত মন্তব্যের উপর ভিত্তি করেছেনঃ উসূল সম্পর্কিত তাঁর রচিত একখানা গ্রন্থ ছিল, যাতে সালাত, যাকাত ও হজ্জ সম্পর্কে অধ্যায়সমূহ সংযোজিত ছিল।
এতে বুঝা যায় যে, গ্রন্থখানি ছিল উসূলে দীন বিষয়ে। সম্ভবতঃ উক্ত উদ্ধৃতি প্রদান করা হয়েছে মূলতঃ ইমাম মুহাম্মদ ইবনুল হাসান রচিত ফিকাহ সম্পর্কিত গ্রন্থ কিতাবুল আসল সম্পর্কে। গ্রন্থখানি সম্প্রতি পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। আরো উল্লেখ্য যে, আবু ইউসুফ (রঃ) উসূল সম্পর্কে গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন এ কথাটি প্রথম পাওয়া যায় খতিবে বাগদাদ কর্তৃক রচিত তারিখ বাগদাদ গ্রন্থের বর্ণনা থেকে) (সম্পাদক) কাশফুয যুনুন গ্রন্থের রচয়িতা মীযানুল উসূল (উসূলের মানদণ্ড) গ্রন্থ থেকে উক্ত গ্রন্থের রচয়িতা আলাউদ্দীনের আলোচ্য উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। (দেখুন, ১ম খন্ড, পৃঃ১১০-১১১। )
জেনে রাখা আবশ্যক যে, উসূলে ফিকাহ হচ্ছে উসূলে দীনের একটি শাখাবিশেষ এবং যে কোন গ্রন্থ রচনা করতে গেলে অবশ্যই এর বিষয়বস্তু গ্রন্থকারের নিজের ধারণা ও বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হয়। সুতরাং উসূলে ফিকাহ এর অধিকাংশ গ্রন্থকার মুতাযিলাপন্থী, যাদের সাথে আমাদের মৌলিক নীতিগত পার্থক্য রয়েছে, অথবা আহলে হাদীসপন্থী, যাদের সাথে আমাদের ও নীতিগত পার্থক্য না থাকলেও মূল বিষয়ের শাখা প্রশাখায় গিয়ে মতভেদ রয়েছে। বিশদ বর্ণনার প্রশ্নে আহলে হাদীসের সাথে আমাদের মতভেদ রয়েছে, তাই তাদের কারো গ্রন্থের উপর আমরা নির্ভর করতে পারিনা।
আমাদের (হানাফী) গবেষকগণ কর্তৃক প্রণীত গ্রন্থ দুই পর্যায়ের। প্রথম পর্যায়ের গ্রন্থগুলো প্রণীত হয়েছে অত্যন্ত সংক্ষিপ্তাকারে। কারণ গ্রন্থকারগণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মূলনীতি ও প্রয়োগ সম্পর্কে ভালভাবে জানতেন। এ ধরনের গ্রন্থের উদাহরণ হচ্ছেঃ আবু মানসুর আল মাতুরিদী (মৃত৩৩৩ হিঃ) রচিত মাখাজুশ শার (শরীয়ার উৎস) এবং আল জাদাল (যুক্তি) ।
দ্বিতীয় পর্যায়ে গ্রন্থসমূহ প্রণীত হয়েছে খুব যত্নের সাথে শাব্দিক তাৎপর্যের ভিত্তিতে এবং এগুলো বিন্যস্ত করা হয়েছে অত্যন্ত সুন্দরভাবে। গ্রন্থকারগণ তাঁদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে সংশ্লিষ্ট বিবরণের বাহ্যিক তাৎপর্যের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা প্রদান এবং সমাধানে পৌছার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁরা নিরঙ্কুশ যুক্তি প্রদর্শনে কিংবা উসূলের সূক্ষ্মতম দিকসমূহ আলোচনায় তেমন একটা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি। ফলে দ্বিতীয় পর্যায়ের গ্রন্থকারগণ কোন কোন ক্ষেত্রে এমন মতামত প্রদান করেছেন, যেগুলোর সাথে আমরা একমত হতে পারিনা। যদিও প্রথম পর্যায়ের গ্রন্থসমূহ তাঁদের গুরুত্ব হারিয়েছে হয় দুর্বোধ্যতার কারণে অথবা এরূপ কাজে এগিয়ে আসার ব্যাপার গবেষকগণের মধ্যে দৃঢ়চিত্ততার অভাবের কারণে।
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, উসূল সম্পর্কিত গবেষণা সম্পর্কে উপরোক্ত বিবরণ একজন হানাফী বিশেষজ্ঞ কর্তৃক প্রদত্ত হওয়া সত্বেও কত নিখুঁত। এ বিবরণ থেকে উসূলে ফিকাহ এর বিকাশের ক্ষেত্রে হানাফীগণের । ভূমিকা সম্পর্কে অনেকটা বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। প্রাথমিক যুগে, এমনকি ইমাম মাতুরিদীর পূর্বেও এসকল গবেষক তাঁদের যাবতীয় গবেষণা কর্মকে ইমাম শাফেঈ কর্তৃক তাঁর রিসালাহ গ্রন্থে উত্থাপিত বিষয়ের পুনরালোচনা করতে কেন্দ্রীভূত রেখেছিলেন। ঈসা ইবনে আবান এবং অন্যান্য অনেকে একই পথ অনুসরণ করেছেন।
পরবর্তী যুগে উসূল বিষয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লেখক ছিলেন আবুল হাসান আল কারখী (মৃঃ৩৪০ হিঃ) স্বল্পসংখ্যক পৃষ্ঠা সম্বলিত তাঁর লেখা গ্রন্থখানি আবু যায়দ আদ দাবুসী প্রণীত তাসীসুন নাযার (মতামতের প্রতিষ্ঠা) গ্রন্থের সাথে একত্রে মুদ্রিত হয়। কায়রো থেকে উক্ত গ্রন্থের বেশ কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।
আবু বকর আল-জাসসাস (মৃঃ৩৭০ হিঃ) আল ফুসূল ফীন উসূল নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেন। মূলতঃ আহকামুল কুরআন (কুরআনের বিধান) গ্রন্থের ভূমিকা হিসেবে এটি রচিত হয়। (আল- জাসসাসের প্রধান গবেষণা কর্ম আহকামুল কুরআন গ্রন্থটি এ সম্পাদকের থিসিসের বিষয়বস্তু হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং এটি ততকর্তৃক ইংরেজি ভাষায় বিস্তারিত টীকাসহ অনুবাদ করা হয়েছে। (সম্পাদক) একটি পি.এইচ.ডি. থিসিসের বিষয় হিসেবে আল –ফুসূলের উপর গবেষণা ও সম্পাদনার পর সম্প্রতি তা কুয়েত থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
ইমাম আবু যায়দ আদ –দাবূসীর (মঃ৩৪০ হিঃ) লেখার মাধ্যমেই উসূল বিষয়ে হানাফী সাহিত্যের প্রকৃত বিকাশ শুরু হয়। তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন, তার একটি হল তাকবীমুল আদিল্লাহ। এর সম্পূর্ণ অথবা কিছু অংশ সম্পর্কে গবেষণা ও সম্পাদনা করা হলেও এগুলো এখনো মুদ্রিত হয়নি। অপর গ্রন্থটির নাম তাসীসুন নাযার। (তাকবীমূল –আদিল্লাহ দশ খন্ডে সম্পাদনার কাজ সমাপ্ত হয়েছে, ইনশাআল্লাহ শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। (সম্পাদক) আবু যায়দ উসূল সম্পর্কিত তাঁররচনাবলীতে তাঁর পূর্বসূরিগণের, বিশেষত আল কারখী এবং আল জাসসাস এর রচনাবলী থেকে সাহায্য গ্রহণ করেন। তবে পার্থক্য এই যে, তিনি এই বিষয়ের পরিধিকে আরও বিস্তৃত করেন এবং বিস্তৃত পরিসরে ব্যাখ্যা করেন। তিনি হানাফী মতাবলম্বীগণ উসূলের যে কল বিষয়ে একমত অথবা ভিন্নমত পোষণ করেন সেগুলো সম্পর্কেওসংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করেন।
আবু যায়দকে অনুসরণ করে ফখরুল ইসলাম আল –বাযদাবী (মৃঃ৪৮২ হিঃ) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ কানযুল উসূল ইলা মারিফাতিল উসূল (উসূলের জ্ঞানের ভাণ্ডার) রচনা করেন। উক্ত গ্রন্থে তিনি উসূল সম্পর্কিত বিষয়াদি সাধারণভাবে আলোচনা করেন। অতঃপর হানাফী গবেষকগণ এই গ্রন্থটির ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং এর অনেকগুলো সমালোচনা গ্রন্থ রচনা করেন। তম্মধ্যে আব্দুল আযিয আল – বুখারী (মৃঃ ৮৩০ হিঃ) রচিত কাশফুল আসরার (গোপন রহস্যভেদ) এ সম্পর্কিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। ইস্তাম্বুল এবং মিসরে এ সমালোচনা গ্রন্থের বেশ কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। অনুরূপভাবে শাসমুল আইম্মাহ আস – সারাখসী (মৃঃ৪২৩ হিঃ) রচিত উসূলুস সারাখসী গ্রন্থটি মিসর থেকে দুটি খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থটিকে বিভিন্ন দিক থেকে আদ দাবূসীর রচিত তাকবীমুল আদিল্লাহ গ্রন্থের বিকল্প পাঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উসূলের হানাফী গবেষকগণ আল – বাযদাবী এবং আল সারাখসী রচিত গ্রন্থাবলীর ব্যাপারে সবিশেষ আগ্রহী ছিলেন এবং এগুলোর শিক্ষাদান এবং এগুলোর পর্যালোচনা দীর্ঘকাল যাবত চলতে থাকে।
উপরের আলোচনা থেকে এটা নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়েছে যে, জ্ঞানের একটি বিশেষ শাখা হিসেবে উসূলে ফিকাহর বিকাশ পঞ্চম হিজরী শতাব্দীতে সম্পূর্ণতা লাভ করে এবং এ বিয়ে পরিধি নির্ণয় ও তাত্ত্বিক পরিভাষাসমূহের সংজ্ঞা প্রদানের কাজ সম্পন্ন হয়। বস্তুত ঐ শতাব্দীর মধ্যে প্রায় সকল আইন বিষয়ের চিন্তাধারার গবেষকগণ উসূলে ফিকাহ সম্পর্কে তাঁদের নিজ নিজ ব্যাখ্যা ও উপলব্ধিসমূহের লিপিবদ্ধ রূপ দিতে সক্ষম হন।
শাফেঈগণ অথবা মুতাকাল্লিমূন এবং হানাফীগণের অনুসৃত পদ্ধতি
উসূল সম্পর্কিত যে কোন রচনায় সাধারণতঃ নিম্নোক্ত দুটি পদ্ধতির য কোন একটি অনুসরণ করা হয়। প্রথমটি হচ্ছে শাফেঈ পদ্ধতি বা মুতাকাল্লিমূনের পদ্ধতি। এই পদ্ধতিটি শাফেঈ, মালিকী, হাম্বলী এবং মুতাযিলীগণ কর্তৃক অনুসৃত হয়েছে। (এ সকল ভিন্ন ভিন্ন দলের গবেষকগণ তাঁদের গ্রন্থে কিচু না কিছু সংযোজন করেছেন, যদিও তাঁরা লিখেছেন এই ধাঁচে এবং সাক্ষ্য প্রমাণ ও যুক্তিসমূহ উপস্থাপন করেছেন একই পদ্ধতিতে। ) এ পদ্ধতি মুতাকাল্লিমুন পদ্ধতি নামে পরিচিত। কারণ এই পদ্ধতির অনুসারী লেখকগণ তাঁদের গ্রন্থে ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের বিভিন্ন বিষয়ের পণ্ডিত হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যেমন তাঁদের আলোচ্য বিষয় ছিল হাসান এবং কাবীহ (ভাল এবং নিন্দনীয়) , হুকমুল আশয়া কাবলাশ শার (শরীয়াহ নাযিল হওয়ার পূর্ববর্তী বিষয়সমূহের আইনগত মর্যাদা) , শোকরুল মুনইম (নিয়ামত দানকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা) এবং আল হাকীম (সার্বভৌমত্বের মালিক) ইত্যাদি। উক্ত পদ্ধতি মুতাকাল্লিমুন হিসেবে পরিচিতি লাভের আর একটি কারণ এই যে, তাঁরাউসূলের আইনতত্ত্বেরনীতিমালাসমূহের সংজ্ঞা প্রদানকালে অবরোহ পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন এবং এ সকল নীতিমালার বৈধতা নিশ্চিত করেছেনও বিপক্ষের মতামত খণ্ডন করেছেন। তাঁরা এ সকল নীতিমালা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ও তৎপ্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ের প্রতি তেমন মনোযোগ দেননি।
হানাফীগণের উসূল সম্পর্কিত পদ্ধতি
হানাফী পদ্ধতির রচনাসমূহ আইনগত বিষয়ের বিশদ বিবরণ থেকে উসূলের মূলনীতিসমূহের সংজ্ঞা প্রদানে ব্যাপৃত হয়। তাদের পূর্বসূরি গবেষকগণও একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। মূলতঃ ইতোপূর্বে নিস্পত্তিকৃত আইনগত বিষয়ের বিশদ বিবরণীর উপর ভিত্তি করে তাঁদের গবেষণাসমূহ সম্পাদিত হয়েছে, এর বাইরে নয়। অতএব এ পদ্ধতিতে যদি কেউ উসূলে ফিকাহ সম্পর্কে গবেষণা করতে চান তাহলে তিনি এমন সব বিষয়ে বিস্তারিতভাবে সংগ্রহ করবেন যে সম্পর্কে হানাফী ইমামগণ ইতোমধ্যেই ফতোয়া প্রদান করেছেন। অতঃপর সংগৃহীত তথ্যাদি বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হবে যে, কিসের ভিত্তিতে এ সকল ফতোয়া প্রদান করা হয়েছিল। শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (রঃ) মন্তব্য করেছেন, আমি দেখেছি তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দাবি করেন যে, আল বাযদাবী রচিত গ্রন্থ এবং অন্যত্র তাঁরা উসূলের ব্যাপারে আবু হানিফা ও শাফেঈ (রঃ) এর মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ সকল উসূল উদ্ভূত হয়েছে আইনগত বিষয়ে ইমামগণের মতপার্থক্য থেকে। এ বিষয়ে আমার অভিমত হলোঃ উসূলের এরূপ মূলনীতি যেগুলোতে বিশেষ বিশেষ (খাস) বিষয়গুলো সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে (মুবাইয়্যান) এবং যার ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই, অতিরিক্ত কিছু যুক্ত করা হলে তা রহিত (নাসখ) হয়ে যায়। ব্যাপকার্থে বর্ণিত সাধারণ বিষয়াদি (আম) বিশেষ (খাস) বিষয়াদির মত চূড়ান্ত (কাতিঈ) , নিছক বর্ণনার আধিক্য একটি মত থেকে অন্য মতের অগ্রাধিকার (তারজীহ) নির্ণায়ক হতে পারে না, যুক্তির আশ্রয় নেয়ার কোন সুযোগ না থাকলে ফকীহ নন এমন কোন লোকের বর্ণিতহাদীস গ্রহণের আবশ্যকতা নেই, কোন পূর্বশর্ত বা বর্ণনা (ওয়াসফ) থেকে আইনগত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার ধারণার কোন বৈধতা নেই, মূল বিবরণের যে কোন অনুজ্ঞা (আমর) আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক (উজূব) , ইত্যাদি মূলনীতির উদাহরণগুলো গঠিত হয়েছে ইমামগণ প্রদত্ত রায় থেকে।
বস্তুত এমন কোন স্পষ্ট বিবরণ পাওয়া যায়নি যার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে যে, আবু হানিফা (রঃ) বা তাঁর দুজন অনুসারী যথাক্রমে ইমাম মুহাম্মদ ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ) উসূলের উপরোক্ত কোন মূলনীতি অনুসরণ করেছেন। তাহলে কি এ সকল মূলনীতি সংরক্ষণ করা বা এগুলোর পক্ষাবলম্বন করার আর কোন প্রয়োজন নেই, আল – বাযদাবী এবং অন্যান্যরা যেমন করেছেন?তাহলে তো এর বিপরীত নীতিমালাগুলোই কার্যকর হয়। (দেখুন, দেহলভী প্রাগুক্ত ১খ, ৩৩৬ -৩৪১, আরো দেখুন দেহলভী রচিত আল – ইনসাফ ফী বায়ান আসবাব আল- ইখতিলাফ (সালাফিয়াহ, কায়রো) , পৃঃ৩৮-৪০)
ষষ্ঠ হিজরী শতাব্দী ও তৎপরর্তী কালের উসূলে ফিকাহ
মুতাকাল্লিমূন পদ্ধতি অনুসারে জ্ঞানের এ বিশেষ শাখার আলোচ্য বিষয়সমূহ চারটি প্রধান গ্রন্থে একটি সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করে। উক্ত চারখানি গ্রন্থের নাম হলো আল –আহদ, আল –মুতামাদ, আল – বুরহান এবং আল – মুস্তাসফা। দুজন মহান মুতাকাল্লিম গবেষক উক্ত চারটি গ্রন্থের সারসংক্ষেপ গ্রন্থ রচনা করেন। প্রথমজন হলেন ইমাম ফখরুদ্ধী রাযী (মৃঃ৬০৬ হিঃ) । তিনি উল্লেখিত গ্রন্থ চতুষ্টয়ের সারসংক্ষেপ নিয়ে আল –মাহসূল (সারসংক্ষেপ) গ্রন্থখানি রচনা করেন। আমার উক্ত গ্রন্থখানিসম্পাদনা এবং এর উপর গবেষণা করার সৌভাগ্য হয়েছে, যা ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সাউদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ছয় খন্ডে মুদ্রিত হয়েছে এবং বর্তমানে তা পুনর্মুদ্রণের কাজ চলছে।
দ্বিতীয়জন হলেন ইমাম সাইফুদ্দিন আর –আমিদী (মৃঃ৬৩১ হিঃ) তিনি উক্ত চারখানি গ্রন্থের তুলনায় সহজবোধ্য। এই দুটির মধ্যে আল মাহসূল লেখা হয়েছে সহজতর ভাষায় এবং বেশ বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই দুটি গ্রন্থে বহু টীকা ও মন্তব্য লেখা হয়েছে। তাজুদ্দীন আল – আরমারবী (মৃঃ৬৫৬ হি) আল – মাহসূল গ্রন্থের সারসংক্ষেপ করেন তাঁর আল =- হাসিল (ফলাফল) গ্রন্থখানিতে। তা আল – আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের পি.এই.ডি থিসিস হিসেবে গবেষণা করা হয়েছে এবং সম্পাদনা করা হয়েছে। অবশ্য তা এখনো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি।
ইমাম আল রাযী (রঃ) নিজেও আল মুনতাখাব (নির্বাচিত) নামক একখানা গ্রন্থে আর মাহসূলের সারসংক্ষেপ করেছেন, যার উপর জনৈক গবেষক কর্তৃক গবেষণা ও সম্পাদনা কার্য সম্পন্ন হয়েছে।
কাযী আল বাযদাবী (মৃঃ৬৮৫ হিঃ) আল হাসিল গ্রন্থের সারসংক্ষেপ করেন মিনহাযুল ওয়অসুল ইলা ইলমিল উসূল (উসূল শাস্ত্রের উপর কর্তৃত্ব করার উপায়) নামক গ্রন্থে। কিন্তু তাঁর রচিত সারসংক্ষেপ এতোই সংক্ষিপ্ত হয়েছে যে, এটাকে অনেকটা হেঁয়ালি বলে মনে হয় এবং বুঝা খুবই কষ্টকর। তাই বহু গবেষক এই গ্রন্থের উপরে সমালোচনা লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এরূপ সমালোচনা গ্রন্থের মধ্যে আল ইসনাবীর (মৃঃ৭৭২ হিঃ) গ্রন্থখানিকে শ্রেষ্ঠ বলা যায়। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম নিহায়াতুসসুউল (প্রশ্নের সমাপ্তি) । এই গ্রন্থখানি দীর্ঘকাল যাবত উসূল গবেষকগণের মনোযোগ আকৃষ্ট করে রাখে এবং আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে শরীয়াহ গবেষকগণ এখনও এই গ্রন্থের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
আল – আমিদী রচিত আল – ইহকাম (বিশুদ্ধিকরণ) গ্রন্থের সারসংক্ষেপের ভিত্তিতে মালিকী মাযহাবের অনুসারী ইবনুল হাজিব (মৃঃ৬৪৬ হিঃ) মুনতাহাস সুউল ওয়াল আমাল ফী ইলমিল উসূল ওয়াল জাদাল (আইনতত্ত্ব ও যুক্তিবিদ্যার চূড়ান্ত কথা) নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেন। ইমাম মালিক (রঃ) এর অনুসারীগণের নিকট এই গ্রন্থখানি অত্যন্ত প্রসিদ্ধ।
এই গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে রচিত যে সকল সমালোচনা গ্রন্থ পাওয়া যায় তন্মধ্যে আদুদুদ্দীন (মৃঃ৭৫৬ হিঃ) রচিত গ্রন্থ শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত, যাতে বেশ কিছু টীকা ও মন্তব্য লিখিত হয়েছে।
উপরে উল্লেখিত সব কয়টি গ্রন্থ মুতাকাল্লিমূনের পদ্ধতি অনুসরণে লিখিত হয়েছিল মূলনীতিসমূহের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছিল, যুক্তি প্রমাণ দাঁড় করানো হয়েছিল এবং যারা ভিন্নমত পোষণ করতঃ তাদের যুক্তি খণ্ডন করার চেষ্টা করা হয়েছে ঐ গুলোরই ভিত্তিতে। এ প্রক্রিয়া দুটি দলের একটির পরাজয় না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে। উসূলের হানাফী গবেষকগণ অনুরূপভাবে আল বাযদাবী এবং আস-সারাখসী রচিত গ্রন্থসমূহের উপর গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন।
৬ষ্ঠ হিজরী শতাব্দীর শেষে এবং সপ্তম হিজরী শতাব্দীর সূচনাকালে উসূলের গবেষকগণ কর্তৃক নতুন পদ্ধতির সূচনা না হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে। এই নতুন পদ্ধতিতে মুতাকাল্লিমুন এবং হানাফী পণ্ডিতদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এমন গ্রন্থ রচনা করা যাতে উভয় দলের উসূল সমন্বিত হয়। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে মযাফফারুদ দীন আস – সাআতী (মৃঃ৬৯৪ হিঃ) কর্তৃক বাদীউন নিযামিল জামি বাইনা কিতাবায় আল বাযদাবী ওয়া ইহকাম গ্রন্থখানি রচিত হয়। ইহা একখানি মুদ্রিত ও সহজলভ্য গ্রন্থ। সদরুশ শরীয়াহ (মৃঃ ৭৪৭ হিঃ) তাঁর তানকীহুল উসূর (আইনতত্ত্বের পরিমার্জন) গ্রন্থে বাযদাবীর আল মাহসূল এবং ইবনুল হাজিবের মুখতাসার গ্রন্থদ্বয়ের সারসংক্ষেপ পেশ করেন। অতঃপর তিনি তাঁর গ্রন্থের উপর আত তাওদীহ (ব্যাখ্যা) নামে একখানা ভাষ্যগ্রন্থ রচনা করেন। আত তাফতানী (মৃঃ ৭৯২ হিঃ) আত তালবীহ নামে উক্ত গ্রন্থের পার্শ্বটীকা রচনা করেন। উপরোক্ত তিনটি গ্রন্থই সহজলভ্য।
শাফেঈ মাযহাবের অনুসারী গবেষকগণের মধ্যে তাজুদ্দীন আস সুবকী রচিত জুমউল জাওয়ামি (সংকলনসমূহের সংকলন) গ্রন্থখানি বিখ্যাত। উক্ত গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি উল্লেখ করেছেন যে, প্রায় শ খানেক উসূল বিষয়ক গ্রন্থ থেকে সংকলিত করে তিনি এই গ্রন্থখানি রচনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুল ব্যবহৃত সমালোচনা গ্রন্থ হচ্ছে শারহুল জালাল।