৬ষ্ঠ অধ্যায়
ইজতিহাদ সম্পর্কে আলোচনা
ঐতিহ্যগতভাবে উসূল সম্পর্কিত যে কোন গ্রন্থের পূর্ণ এক অধ্যায় জুড়ে থাকে ইজতিহাদ সম্পর্কিত আলোচনা। সে অধ্যায়ে গ্রন্থকার প্রথমত ইজতিহাদের সংজ্ঞা, এর বৈধতা সম্পর্কিত শর্তাবলী এবং বিভিন্ন প্রকারের ইজতিহাদের পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করেন। অতঃপর গ্রন্থকার রাসূল (সাঃ) ইজতিহাদকে এক ধরনের ইবাদত হিসেবে বিবেচনা করতেন কি না কিংবা রাসূল (সাঃ) এর জীবদ্দশায় ইজতিহাদ সাহাবীগণের জন্য ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়েছিল কি না, যে কোন বিষয়ে ইজতিহাদের ফলাফল হিসেবে শুধুমাত্র একটি উত্তরই সঠিক হবে নাকি একাধিক সঠিক উত্তর হতে পারে এবং ইজতিহাদের অনুমতি ছিল কি না ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করে থাকেন। এরপর গবেষকগণ তাকলীদ বিষয়েও একইভাবে আলোচনা করে থাকেন।
অষ্টম হিজরী শতাব্দীতে ইবরাহীম ইবনে মূসা আশ শাতিবী (মৃঃ৭৯০ হিঃ) আল মুআফাকাত (সামঞ্জস্য) নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেন। উক্ত গ্রন্থে তিনি ইজতিহাদকে দুটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেন। এর প্রথম স্তম্ভ হলো আরবী ভাষার ব্যাকরণ ও পদপ্রকরণ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান। তিনি এই বিষয়কে আরবী ভাষাবিদ ও অন্যান্য উসূলের লেখকগণের উপর ছেড়ে দেন। শাতিবীর মতে ইজতিহাদের দ্বিতীয় স্তম্ভ হলো সর্বজ্ঞানী আইনদাতা (আল্লাহ তায়াল) কর্তৃক প্রদত্ত বিধি বিধানের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য সম্পর্কে জ্ঞান।
আশ শাতিবীর পূর্বসূরীগণ উসূলের এ দিকটির প্রতি তত বেশি গুরুত্ব প্রদান করেননি। বরং তাঁদের অনেকেই উল্লেখিত দৃষ্টিকোণ থেকে ইল্লাত (কারণ) এর মূল তত্ত্ব অনুসন্ধানে নিয়োজিত ছিলেন। অপরপক্ষে আশ শাতিবী এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর গ্রন্থ রচনা করেন। বস্তুতঃ মহান আইনদাতা কর্তৃক প্রদত্ত বিধি আল মুহাল্লা। আজও গ্রন্থখানি বিশেষ করে শাফেঈ গবেষকগণের নিকট উসূল সম্পর্কিত গবেষণার ভিত্তি হিসেবে সমাদৃত।
বাদরুদ্দীন আয যারকাশী (মৃঃ ৭৯৮ হিঃ) তাশনীফুল মাসামি (কানকে খুশী করা) নামে একখানা সমালোচনা গ্রন্থ রচনা করেন। উক্ত গ্রন্থের অংশ বিশেষ শায়খ আল মুতীঈ (মৃঃ১৩৫৪ হিঃ) কর্তৃক কায়রো থেকে পাদটীকাসহ মুদ্রিত হয়েছে। ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র তাঁর পি.এইচ.ডি. থিসিসের অংশ হিসেবে উক্ত গ্রন্থের উপর গবেষণা করেছেন এবং অংশবিশেষ সম্পাদনা করেছেন।
আয যারকাশী কর্তৃক আল বাহরুল মুহীত (বিশাল সমুদ্র) নামে আরেকখানা গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এতে তিনি শতাধিক গ্রন্থ থেকে উসূল গবেষকগণের অবদান সংগ্রহ করেছেন। আমাদের তত্ত্বাবধানে একজন ছাত্র তাঁর পি.এইচ.ডি থিসিসের অংশ হিসেবে এ গ্রন্থের উপর গবেষণা ও সম্পাদনার কাজ শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে এর একটি খন্ডের কাজ সমাপ্ত হয়েছে এবং তা প্রকাশের অপেক্ষায় আছে।
হাম্বলী মাযহাবের গবেষকগণের মধ্যে ইবনে কুদামাহ) মঃ৬২০ হিঃ) রচিত রওদাতুন নাযির ওয়া জান্নাতুল মানাযির উল্লেখযোগ্য। উক্ত গ্রন্থে তিনি আল গাযযালী রচিত আল মুস্তাসফা গ্রন্থের সারসংক্ষেপ ছাড়াও যে সকল বিষয়ে হানাবিলাগণ অন্যান্যদের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন সে সকলের উল্লেখসহ কিছু প্রয়োজনীয় বিষয়ও সংযোজন করেন। উক্ত গ্রন্থখানি বহুবার মুদ্রিত হয়েছে এবং হানাবিলাগণ এ গ্রন্থের উপর এতটুকু গুরুত্বারোপ করেন যে, তাঁরা এ বিষয়ে অন্যান্য সকল গ্রন্থকে প্রায়শ উপেক্ষা করেন। সুলায়মান আত তূসী (মৃঃ ৭১৬ হিঃ) গ্রন্থখানিকে সংক্ষেপিত করেন এবং দুখণ্ডে এর উপর মন্তব্য লেখেন।
মালিকীগণের মধ্যে আল কাররায়ফী (মৃঃ৬৮৪ হিঃ) রচিত তানকীহুল ফুসুল ফী ইখতিসারিল মাহসূল (আল মাহসূল এর সারাংশ প্রণয়নে কিছু পরিশীলিত অধ্যায়) উল্লেখযোগ্য। এছাড়া আল কারাফী আল মাহসূলের উপর বৃহদাকারের একটি সমালোচনা গ্রন্থ রচনা করেছেন। উক্ত গ্রন্থের নাম নাফাইসুল উসূল (উসূলের ভাণ্ডার) , যার অংশবিশেষের উপর আমাদের তত্ত্বাবধানে রিয়াদে গবেষণা ও সম্পাদনার কাজ চলছে। বিধানসমূহ অনুধাবন করার জন্য তথা শরীয়াহ এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক এখনো অসূল গবেষকগণ উক্ত গ্রন্থের প্রতি মনোযোগ প্রদান করেননি। এটা সম্ভবত এভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে, বহু গবেষকের মনে একটি বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত বিধি বিধানসমূহের কারণ খোজার অনুমতি নেই এবং এ বিষয়ে কোনরূপ আন্দাজ অনুমানকে সুশৃঙ্খল করা বা সেগুলোর সুনির্দিষ্ট রূপদান করা যেতে পারে না। (আরেকটি কারণ হতে পারে সর্বশক্তিমান কথাটির প্রায়োগিক তাৎপর্য সম্পর্কে বিকল্প অনুমান করা (সম্পাদক) যখন ব্যাপারটি এরূপ কিংবা বহু গবেষক এভাবে তাঁদের যুক্তি উপস্থাপন করতে থাকেন, তখন এরূপ একটি বিষয়ে গবেষণা করতে যাওয়া নেহায়েত বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসিতা ছাড়া আর কিচু নয়। যাইহোক, আশ শতিবীর উক্ত গ্রন্থখানি সহজলভ্য আমরা আশা করবো, উসূলের শিক্ষকগণ এবং যাঁরা পাঠ্যসূচি প্রণয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত তাঁরা তাঁদের ছাত্রদেরকে বিশেষত যারা কিয়াস, তালীল ও ইজতিহাদ অধ্যয়ন করছেন তাদেরকে এই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণকরবেন। আমাদের সয়ের দুজন মহান গবেষক যথাক্রমে ইবনে আশূর এবং আল্লাল আল ফাসী শরীয়াহর উদ্দেশ্য সম্পর্কে দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন।
ইবনে হুমাম (মৃঃ৮৬১ হিঃ) আত তাহরীর (গ্রন্থ প্রণয়ন) নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর একজন ছাত্র ইবনে আমীর আল হাজ্ব (মৃঃ৮৭৯ হিঃ) উক্ত গ্রন্থের উপরে আত তাকরীর ওয়অত তাহরীর না একখানা সমালোচনা গ্রন্থ রচনা করেন। উভয় গ্রন্থই মুদ্রিতাকারে পাওয়া যায়। আত তাহরীর এমন একখানা গ্রন্থ যা হানাফী ও মুতাকাল্লিমুন এ উভয় চিন্তাধারার সমন্বয়ে প্রণীত হয়েছে। এছাড়া আমীর-বাদশাহ রচিত তায়সীরুত তাহরীর (গ্রন্থ প্রণয়ন সহজীকরণ) নামে একখানা সমালোচনা গ্রন্থ পাওয়া যায়। )
আল কাজী আলাউদ্দীন আল মারদাবী (মৃঃ৮৫৫ হিঃ) ইবনে মুফলিহ (উক্ত গ্রন্থের অংশ বিশেষ জনৈক ছাত্র তার স্নাতকোত্তর থিসিস হিসেবে সম্পাদনা করেছেন এবং পি.এইচ.ডি থিসিসের অংশ হিসেবে বাদবাকি অংশের সম্পাদনা করেছেন। (মৃতঃ৭৬৩ হিঃ) এর প্রসিদ্ধ উসূল গ্রন্থের একখানা সমালোচনা গ্রন্থ রচনা করে। উক্ত গ্রন্থের নাম তাহরীরূল মানকূল ওয়া তাহজীব ইলমিল উসূল। উক্ত গ্রন্থখানি সম্প্রতি গবেষণা এবং সম্পাদনা করা হয়েছে এবং শীঘ্রই তা প্রকাশিত হওয়ার কথা। একই গবেষক উসূল ইবনে মুফলিহ এর উপরও কাজ করছেন। পরবর্তীকালে হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ইবনুন নাজ্জার আল ফুতুহী তাহরীরূল মারদাবী গ্রন্থের সারসংক্ষেপ রচনা করেন এবং উক্ত গ্রন্থের উপর উন্নত মানের টীকা প্রণয়ন করেন। তাঁর প্রণীত এ টীকাগ্রন্থকে উসূল বিষয়ে পরবর্তীকালে রচিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং সবচাইতে গবেষণাধর্মী গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। স্বনামধন্য অধ্যাপক ড. নায়িহ হাম্মাদ এবং ড. মুহাম্মদ আয যুহাইলী কর্তৃক গ্রন্থখানির উপর গবেষণা এবং সম্পাদনা করার পূর্বে এর একটি অসম্পূর্ণসংস্করণ কায়রো থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁদের উক্ত গবেষণাকর্ম মক্কার কলেজ অব শরীয়াহর একাডেমিক রিসার্চ সেন্টার থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
দ্বাদশ হিজরী শতাব্দীতে হানাফী মাযহাবের অনুসারী মুহিব্বুল্লাহ ইবনে আবদুস শাকুর আল বিহারী (মৃঃ১১১৯ হিঃ) তাঁর বিখ্যাত উসূল বিষয়ক গ্রন্থ মুসাল্লামুস ছুবূত রচনা করেন। পরবর্তী যুগে হানাফী গবেষণাধর্মী গবেষকগণ কর্তৃক রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে বস্তুনিষ্ঠ ও গবেষণাধর্মী গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। গ্রন্থখানি ভারতে মূলের সাথে টীকাসহ মুদ্রিত হয়েছে। এছাড়া বিখ্যাত টীকা গ্রন্থ ফাওয়াতিহুর রাহমুত এর পার্শ্বটীকায় ইমাম গাযযালী রচিত আর মুস্তাসফা সহ বেশ কয়েকবার তা মুদ্রিত হয়েছে।
এ সকল গ্রন্থ উপরে বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রণয়ন করা হয়েছে। সকল গ্রন্থের লেখকদের নিজ৭ নিজ মাযহাবকে সমর্থন করে যাবতীয় আলোচনা কেন্দ্রীভূত হয়েছে এবং প্রতিপক্ষের যুক্তি খন্ড করা হয়েছে।
আশ শায়খ মুস্তফা আবদুর রাজ্জাক কর্তৃক গ্রন্থ তামহীদ লিতারীখ আল ফাল সাফা আল ইসলামিয়া (ইসলামী দর্শনের ইতিহাসের ভূমিকা নামক গ্রন্থে প্রদত্ত প্রাসঙ্গিক একটি মন্তব্য প্রদান করা হয়েছে। ৬ষ্ঠ শতাব্দী থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মুসলিম বিচারকগণকে ইজতিহাদ সংক্রান্ত ভুল থেকে রক্ষা করার হাতিয়ার হতে পারে, উসূলে ফিকাহ সংক্রান্ত এরূপ একটি গবেষণা গ্রন্থও পাওয়া যাবে না। আশ শায়খ মুস্তফা আবদুর রাজ্জাকের উক্ত মন্তব্য তাঁর ছাত্র ড. নাশশার রচিত মানহিজ আল বাহছ (গবেষণা পদ্ধতি) গ্রন্থে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। ত্রয়োদশ হিজরী শতাব্দীতে কাযী আশ শাওকানী (মৃঃ১২৫৫ হিঃ) উসূল সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ইরশাদুল ফুহুল (শ্রেষ্ঠজনের পথনির্দেশ) রচনা করেন। তিনি উক্ত গ্রন্থের কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ডে উসূল বিষয়ে বিভিন্ন মত এবং প্রটি মতের প্রবক্তাগণ কর্তৃক প্রদত্ত প্রমাণসমূহ সংক্ষেপে অথচ অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। গ্রন্থকার কোন মতটি পছন্দ করেন তাও তিনি উক্ত গ্রন্থে বর্ণনা করেছন। গ্রন্থখানিবহুবার মুদ্রিত হয়েছে এবং উসূলে ফিকাহ ও আইন শাস্ত্রের তুলনামূলক অধ্যয়নে ছাত্রদের জন্য এটি খুবই সহায়ক। যাই হোক, আমাদের জানামতে গ্রন্থখানি গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কোন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা সূচিতে এটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
মুহাম্মদ ছিদ্দিক খান (মৃঃ১৩০৭ হিঃ) উক্ত গ্রন্থের সারসংক্ষেপের ভিত্তিতে হুসুল আল মামুন মিন ইলমিল উসূল (উসূল বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক উদ্যোগ) নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থখানি মুদ্রণাধীন।
বস্তুত ইরশাদুল ফুহুল কে আল যারকাশী রচিত আল বাহরুল মুহীত গ্রন্থের নির্ভুল সারসংক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া আল মুহাল্লাবী রচিত হাসহীলুল উসূল গ্রন্থকেও ইরশাদুল ফুহুল গ্রন্থের সারসংক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এর পরবর্তী যুগের উসূর সম্পর্কিত গবেষণায় আমরা নিম্নবর্ণিত যে কোন দুইটি ধারার একটিকে অনুসৃত হতে দেখি-
১.গবেষণা সম্পর্কিত নির্দেশিকা, সারসংক্ষেপ ও টীকা টিপ্পনী লিখন। বিভিন্ন শরীয়াহ ও আইন কলেজের অধ্যাপকগণ যখন বুঝলেন যে, তাঁদের ছাত্ররা বিষয়টি ঠিকভাবে বুঝতে পারছে না বা এ বিষয়টি অধ্যয়নে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে তখন তাঁরা তাঁদের উসূলে ফিকাহের ছাত্রদের অধ্যয়নকে সহজতর করার জন্য উল্লেখিত কাজগুলো সম্পাদনা করেন। এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, এ সকল টীকা টিপ্পনী দ্বারা জ্ঞানের সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতি হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো ছিল নিছক আধুনিক ভাষারীতি অনুসারে সহজ পদ্ধতিতে উসূলে ফিকাহর বিভিন্ন বিষয়কে পুনর্বিন্যস্তকরণ মাত্র। নিম্নবর্ণিত গবেষকগণের লেখা গ্রন্থগুলো ছিল মূলতঃ আইন ও শরীয়াহ কলেজে তাঁদের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বক্তৃতা। তাঁরা হলেন আল-মুহাল্লবী, আল-খুদারী, আবদুল ওয়াহব খাল্লাফ, আশ –শিনকীতি, আল – সাইস, মুস্তফা আবদুল খালিক, আবদুল গণি আবদুল খালিক, আবু যাহরাহ, আবুন নূর যুহাইর, মারুফ আদ –দাওয়ালীবী, আবদুল কারীম যায়দান, যাকীউদ-দীন, শাবান, মোহাম্মদ সাল্লাম মাদকুর ও অন্যান্য অনেকে।
২.দ্বিতীয় ধারায় লক্ষ্য করা যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের এই বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে থিসিস লেখা, গবেষণা করা এবং অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপিসমূহ সম্পাদনা করা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এ দুটি ধারাই যথেষ্ট ফলদায়ক হয়েছে এবং এর কোন একটিকে অবমূল্যায়ন করার ইচ্ছা আমার নেই। তবে এর কোনটিকে জ্ঞানের এ ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে বলে বিবেচনা করা যায়না। ফলে উসূলে ফিকাহ ৬ষ্ঠহিজরী শতাব্দীকে আমাদের পূর্বসুরীগণ যে অবস্থায় রেখে গিয়েছিলেন তা ঠিক সেই অবস্থায় রয়ে গেছে। উপরের আলোচনা থেকে আমরা এই উপসংহারে আসতে পারিঃ
ক.রাসূল (সাঃ) বা তাঁর সাহাবীগণের যুগে সুনির্দিষ্ট কতগুলো পরিভাষাসহ আজকের দিনে উসূলে ফিকাহ নামে পরিচিত জ্ঞানের এ শাখাটির উদ্ভব ঘটে নি। এ দুটি যুগে যে সকল বিভিন্ন ইজতিহাদ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশকেই বর্তমান উসূলের নির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। এর কারণ হচ্ছে তাঁরা কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে আইনের মূল উৎসবসমূহের ভিত্তিতে তাঁদের স্বভাবজাত বুদ্ধি বিবেচনা দ্বারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন, ঠিক যেমন সহজাতভাবে আরবী ভাষায় তাঁরা কথা বলতে, তাঁরা সচেতনভাবে বৈয়ারকরণিক নিয়ম কানুন অনুসরণ করতেন না। এ সকল নিয়ম কানুন তখনকার সময়ে ছিল অজ্ঞাত।
খ. উসূলে ফিকাহ (আইনতত্ত্ব) সম্পর্কিত গ্রন্থ সর্বপ্রথম যে গবেষক রচনা করেন তিনি হলেন ইমাম মুহাম্মদ ইবনে উদরীস আশ শাফেঈ (রঃ) (১৫০ – ২০৪ হিঃ) ।
রিসালাহ হলো তুলনামূলক বিশ্লেষণসহ বিস্তৃতভাবে প্রণীত উসূল বিষয়ক সর্বপ্রথম গ্রন্থ। ইমাম আবদুর রহমান ইবনুল মাহদী (১৩৫ -১৯৮ হিঃ) এর অনুরোধে তিনি উক্ত গ্রন্থখানি প্রণয়ন করেন। ইমাম মালিক ইবনে আনাস (রঃ) (৯৩ – ১৭৯ হিঃ) এর নেতৃত্বে আহলে রায় চিন্তাধারা, ফিকাহ শাস্ত্রে এ দুটি বিখ্যাত চিন্তাধারার প্রতিষ্ঠা ও বিস্তৃতি ঘটার পর তিনি উল্লেখিত গ্রন্থখানি প্রণয়ন করেছিলেন।
উল্লেখিত দুটি আইন বিষয়ক চিন্তাধারার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটার ফলে দুটি চিন্তাধারার অনুসারীগণের মধ্যে সমকালীন রাজনৈতিক, ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক মতবিরোধ সৃষ্টি হয় যাকে বলা যেতে পারে ফিকাহ সংক্রান্ত মতবিরোধ। (দেখুন ইবনে খালদুন, আল –মুকাদ্দিমা, ৩খ, ১১৬৩ -৬৪) ।
গ.বিচারকগণের (আল – নাশশার, মানাহিজুল বাহছ, পৃঃ৫৫) নিকট উসূলে ফিকাহ হচ্ছে একটি গবেষণা পদ্ধতি এবং ফিকাহ শাস্ত্রে এর অবস্থান দর্শনশাস্ত্রে তর্কবিদ্যার অবস্থানের সাথে তুলনীয়। (দেখুন মুসাল্লামুস ছুবূত এবং আল গাযযালী রচিত আল –মুস্তাসফা এর পীঅকা, ১খ. ৯ -১০। এই লেখক তর্কবিদ্যা সম্পর্কে এ ধারণার বিরোধিতা করেন। যেমন দাবি করা হয়েছে যে, দর্শন শাস্ত্র এবং উসূলে ফিকাহ এ উভয় ক্ষেত্রে তর্কবিদ্যা সম্পর্কে এ ধারণার বিরোধিতা করেন। যেমন দাবি করা হয়েছে যে, দর্শন এই লেখক তর্কবিদ্যার অবস্থান এক। সম্ভবতঃ তিনি তর্কবিদ্যা সকল বিজ্ঞানের মানদণ্ড – এ ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
সুতরাং এর সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে এভাবেঃ যে শাস্ত্র অধ্যয়ন করলে সামগ্রিকভাবে ফিকাহ শাস্ত্রের সকল শাখা সম্পর্কে এবং তার অনুকূলে প্রদত্ত দলীল প্রাণ, তার (দলীল প্রমাণের) অবস্থা ও তা পেশের পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায় তাকে উসূলে ফিকাহ বলে। (দেখুন এ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়) ।
সুতরাং উসূলে ফিকাহ মুজতাহিদগণকে এমন একটি বিস্তৃত পথ নির্দেশনা দান করে, যা তাদেরকে আইনগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্দেশ্যে প্রাপ্ত উপাদানসমূহের ব্যবহার কালে বিভিন্ন প্রকারে সম্ভাব্য ভুল থেকে রক্ষা করে। (দেখুন আল রাজী, মানাকিব আর শাফেঈ, পৃঃ৯৮ এবং আন নাশশার, প্রাগুক্ত, পৃঃ৫৫। ) যদিও ইমাম শাফেঈ (রঃ) কর্তৃক নতুন ফিকাহ শাস্ত্রে ব্যবহার না করা পর্যন্ত তা উক্তরূপে ব্যবহৃত হয়নি। (ইমাম শাফেঈ মিসরে বসবাস করার পর হতে তাঁর আইন বিষয়ক রচনাবলীকে নতুন ফিকাহ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এটা নিশ্চয়ই মালিকী এবং হানাফী আইন বিষয়ক চিন্তাধারার উপর দীর্ঘকাল অধ্যয়নের ফলে তাঁর পরিণত চিন্তাভাবনাকে প্রতিফলিত করে। )
ঘ. একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হবে যে, উসূল সম্পর্কে কেউ কিছু বলার আগে থেকেই গবেষকগণ ফিকাহ সম্পর্কে অধ্যয়ন করেছেন এবং সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। (ইমাম শাফেঈর নতুন ফিকাহ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম) সুতরাং অন্যরা উসূলে ফিকাহর ক্ষেত্রে যে ভূমিকা পালন করেছেন তাহলো, নেহায়েত কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে আইনগত সিদ্ধান্ত (ফতোয়া) প্রদানের ব্যাপারে যৌক্তিকতা প্রদর্শন করা, প্রদর্শিত যুক্তির সারবস্তু তুলে ধরা এবং নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করা ইত্যাদি। তাঁরা উসূলে ফিকাহকে আইন বিষয়ে পূর্নাঙ্গ নির্দেশিকা হিসেবে দেখেননি এবং সমগ্র আইন ব্যবস্থা পরিস্থিতি বা প্রশ্নের সম্মুখীন হলে সরাসরি পিছনে ফিরে যেতেন অন্য কোন প্রাসঙ্গিক প্রমাণের কাছে, কিন্তু উসূলে ফিকাহর সুনির্দিষ্ট মূলনীতিসমূহের আশ্রয় গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন না।
ইমাম আবু হানিফা (রঃ) প্রায় পাঁচ লাখ বিষয়ের উপর ফতোয়া প্রদান করেছেন। (দেখুন মুস্তফা আবদুর রাযযাক, আল ইমাম আশ শাফেঈ, পৃঃ৪৫) তাঁর ছাত্ররা সেগুলো শিখেছেন এবং তাঁরা নিজেরাও সেগুলো দিয়ে কাজ চালিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু যে আইনগত মূলনীতির ভিত্তিতে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) তাঁর ফতোয়াসমূহ প্রদান করেছেন সেগুলো যেন অবিচ্ছিন্ন দলিলের মতো কোনভাবেই তাঁর নিকট থেকে হস্তান্তরিত হয়নি। (দেখুন আল দেহলভী, আল ইনসাফ এবং আবু যাহরাহ, আবু হানিফাহ, পৃঃ২২৩) ব্যতিক্রম হিসেবে স্বল্পসংখ্যক প্রতিবেদনে তিনি তাঁর ইজতিহাদের সূত্র বা ভিত্তি সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। এরূপ প্রতিবেদনে তিনি বলেন, আমি আল্লাহর কিতাব অনুসরণ করি, যদি তাতে কোন সমাধান খুঁজে না পাই, তখন রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাহর অনুসরণ করি। যদি আমি কুরআন অথবা সুন্নাহ এ কোন সমাধান খুঁজে না পাই তাহলে আমি পছন্দ মতো কোন সাহাবীর ফতোয়া অনুসরণ করি এবং আমার ইচ্ছা মতো যে কোনটি বাদ দিই। নির্দিষ্ট কোন বিষয়ে কোন সাহাবীর ফতোয়া থাকলে সে বিষয়ে অন্য কোন গবেষকের মতামত গ্রহণ করি না। কিন্তু যখন আমি দেখতাম যে, শুধুমাত্র ইবরাহীম, শাবী, ইবনে সীরীন, হাসান বসরী, আতা বা সাইদ ইবনুল মুসায়্যাব-এর মতামতের ভিত্তিতে সমাধান বের করা হয়েছে তাহলে আমি তাঁদের মতো ইজতিহাদ করতাম। (দেখুন তা’রীখ বাগদাদ, ৩১শ খণ্ড, পৃ ৩৬৪, আল ইনতিকা, পৃ ১৪২ এবং মাশায়িখ বালখ আল-হানাফিয়াহ, পৃ ১৯০)
কিছু সংখ্যক লোক খলিফা আল-মানসূরকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করলে আবু হানিফা (রাঃ) খলিফার কাছে লিখলেন:
“পরিস্থিতি আপনি যেরূপ শুনেছেন সেরূপ নয়, হে আমীরুল মু’মিনীন! আমি আল্লাহর কিতাব অনুসারে কাজ করি। অত:পর রাসূলের (সাঃ) সুন্নাহ অনুসারে, অতঃপর আবু বকর (রা:) , উমার (রা:) , উসমান (রাঃ) এবং আলী (রাঃ) -এর রায় অনুসারে তারপর অন্যান্য সাহাবিগণের রায় অনুসারে। তারপর যদি তাঁদের ফতোয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য দেখি তাহলে আমি কিয়াসের সাহায্য নিই। আল্লাহর কোন সৃষ্টি জন্মগতভাবে অন্যদের অপেক্ষা বেশি আল্লাহর প্রিয়জন হতে পারে না। ” (দেখুন আল-সামারকান্দী, মীযান আল-উসুল, ১খ ৫২; তকীউদ্দিন আল-গাযনী, আত-তাবাকাতুস সুন্নিয়াহ) , ১খ ৪৩ এবং মাশায়িখ বালখ, পৃ ১৯৩)
একবার কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াত অপেক্ষা কিয়াসকে অগ্রাধিকার প্রদানের জন্য অভিযুক্ত করা হলে তিনি বলেছিলেন:
“আল্লাহর কসম! যারা বলে যে, আমরা নস অপেক্ষা আল কিয়াসকে অগ্রাধিকার প্রদান করি, তারা মিথ্যাবাদী এবং আমাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনাকারী। নস (সুস্পষ্ট আয়াত) থাকার পরও কিয়াসের কোন প্রয়োজন আছে কি? (প্রাগুক্ত)
এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, ইসলামী খিলাফত ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর উমাইয়া যুগের শুরু থেকে উম্মাহর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব এমন লোকের হাতে পড়েছিল যারা ইজতিহাদ করার যোগ্যতা রাখতেন না। অথচ এ সময় ইজতিহাদ করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল আলেমগণের উপর যাদের কোন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছিল না। উমার ইবনে আবদুল আযিয (রঃ) -এর খিলাফতকাল ছাড়া উল্লেখিত অবস্থার ব্যতিক্রম খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর। অথচ এরাই বিভিন্ন আইনগত প্রশ্নে রায় প্রদান করেছেন। উক্ত অবস্থা মুসলমানদের ব্যবহারিক জীবন থেকে ফিকাহ ও উসূলকে পৃথকীকরণের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। ফলে এ বিষয়টি একটি তাত্ত্বিক কল্পনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। (দেখুন মুহাম্মদ ইউসুফ মূসা, তারিখ আল-ফিকাহ, পৃঃ ১১০)
উভয় বিষয়ই অবশ্যম্ভাবী রূপে হয়ে ওঠে মুসলমানদের জীবন কেমন হওয়া উচিত তাঁর বর্ণনা; আসলে কেমন ছিল কিংবা হতে হবে তাঁর বর্ণনা নয়।
চ. লেখক এবং ঐতিহাসিকগণ এ উসূলে ফিকাহকে পরম্পরাক্রমে প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত শরীয়াহ সংক্রান্ত উসুলসমূহের শ্রেণীভুক্ত করেছেন। (দেখুন আল –খাওয়ারিযমী, মাফাতিহ আল-উলূম, ৬ষ্ঠ খণ্ড এবং ইবনে খালদুন, আল-মুকাদ্দিমা, ৩খ, ১১২৫-১১২৮, ১১৬১-১১৬৬) । যদিও কোন কোন লেখক বলেছেন যে, উসূলের মূলনীতিসমূহ গ্রহণ করা হয়েছে আরবী ভাষায়, বিভিন্ন যুক্তিবাদী বিজ্ঞান এবং নির্দিষ্ট আরো কতগুলো ইসলামী জ্ঞান শাস্ত্র থেকে (দেখুন মিফতাহুল-সাআদাহ) । এ বিষয়ে একজন বিখ্যাত লেখক ইমাম গায্যালী লিখেছেন: “মহত্তম জ্ঞান (ইলম) হচ্ছে সেগুলো যেখানে যুক্তি (আকল) এবং শ্রুতিকে (সামা) একীভূত করা হয়েছে এবং যেখানে ওহীর সূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান ও যুক্তির সমন্বিত জ্ঞান। তা নির্ভেজাল প্রত্যাদিষ্ট জ্ঞান এবং সর্বোত্তম যুক্তি- এ উভয়ের অনুসরণ করে। এ জ্ঞান প্রত্যাদিষ্ট আইনের কাছে গ্রহণীয় নয় এমন কোন নিরেট যুক্তির উপর নির্ভর করে না, আমার যুক্তির সমর্থনহীন যে কোন কিছুকে নিছক অন্ধভাবে গ্রহণ করে নেয়ার উপরও এ জ্ঞান প্রতিষ্ঠিত নয়। (দেখুন আল-গায্যালী, আল-মুস্তাসফা, খণ্ড ১, পৃঃ ৩ আল-মানখূল, শিফা আল-গালিল ফি বায়ান আল শিবহ ওয়া আল-মাখিল, মাসালিহ আল-তালিল এবং তাহজীব আল-উসূল, উল্লিখিত সবগুলো উসূল সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিতাব)
ইমাম গায্যালী এবং অন্যাণ্য লেখকগণ কর্তৃক উসূল সম্পর্কে প্রদত্ত বক্তব্যের ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি যে, ফিকাহ-এর তিনটি উৎস রয়েছেঃ
(ক) ওহী বা প্রত্যাদেশঃ এর মধ্যে রয়েছে ওহী মাতলু (অনুপম কুরআন) এবং ওহী গায়রে মাতলু (সুন্নাহ) এ উভয় প্রকারের প্রত্যাদেশ।
(খ) আকল বা যুক্তিঃ কুরআনের আয়াতে নির্দেশ কিভাবে প্রয়োগ করা যাবে এবং সংশ্লিষ্ট অংশটি কিভাবে সমগ্র বিষয়ের সাথে সমন্বিত হবে তা অনুসন্ধান করা, কোন আইন জারী করার কারণ বাহ্যিকভাবে চিহ্নিত করা গেলেও এর অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে দেখা, যে বিষয়ে কুরআনে আইনদাতা (আল্লাহ) কোন স্পষ্ট সিদ্ধান্ত প্রদান করেননি সে বিষয়ে আইন প্রণয়ন করা এবং অনুরূপ অন্যান্য বিষয়সমূহ যেগুলোর সংজ্ঞা প্রদান করা ও এর ব্যাখ্যা প্রদান করা যায়। এসব ক্ষেত্রে বুদ্ধি ও যুক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
(গ) অভিজ্ঞতা, প্রথা এবং জনস্বার্থঃ সকল প্রকার উসূল যেগুলো সম্পর্কে গবেষকগণের মধ্যে মতৈক্য আছে এবং যেগুলো সম্পর্কে মতানৈক্য রয়েছে এ উভয় প্রকার উসূলকে নিম্নোক্ত শিরোনামে বিন্যস্ত করা যায়ঃ
কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াস, যে সকল বিষয় মূলতঃ উপকারী সেগুলোর অনুমোদন এবং যে সকল বিষয় মূলতঃ ক্ষতিকারক সেগুলো নিষিদ্ধকরণ বিষয়ক ধারণা (আল-ইসতিসহাব এবং আল-ইসতিহসান) । এ ছাড়াও রয়েছে সাহাবীগণের ফতোয়া যা তাঁদের নিজেদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল এবং তাঁদের মধ্যে কেউ সে বিষয়ে আপত্তি করেননি। সব সময় অপেক্ষাকৃত কম কষ্টকর বিকল্প গ্রহণ করার নীতি, তুলনা করার জন্য স্বল্পসংখ্যক প্রাপ্তব্য নমুনার ভিত্তিতে গবেষণা করা, সর্বসাধারণের স্বার্থ এবং প্রথাসমূহ যেগুলো সম্পর্কে ইসলামে কোনা আদেশ-নিষেধ নেই, যে বিষয়ে আইন সম্পর্কিত কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায় না, যে বিষয়ে কোন আইন নেই –এরূপ উপসংহারে আসা, ইসলাম-পূর্ব অন্যান্য জাতিসমূহের আইন এবং সেগুলোর যৌক্তিকতা প্রদর্শনের পথরূদ্ধ করা ইত্যাদি।
ছ. আমাদের ইতিহাসে এমন কিছু সুনির্দিষ্ট কার্যকারণ বিদ্যমান ছিল, যার কিছু কিছু ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, যা আমাদেরকে বিভিন্নভাবে নিরুৎসাহিত করেছে এবং আমাদের উপর বহু প্রতিবন্ধকতা আরোপ করেছে। ফলে আমাদের ইসলামী মানসিকতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক মনোযোগ নিবদ্ধ হয়েছিল ছোটখাটো বিষয়ের প্রতি এবং আমরা বিষয়াবলীকে সামগ্রিকভাবে চিন্তা না করে ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে বিভ্রান্ত হচ্ছিলাম। ইসলামী চিন্তার এই অবস্থাকে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। এ অবস্থা আমাদের ফিকাহ চর্চা এবং যে সকল সমাধান আমরা খুঁজে বের করেছি তার উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে।
জ. এটা সবার জানা যে, প্রতিটি বিজ্ঞানে এবং মানুষের জীবন যাপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন কিছু বিষয় আছে যা স্বাভাবিকভাবেই বিকশিত হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সকল সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণতা দানের উদ্দেশ্যও এই বিকাশের প্রয়োজন হয়ে থাকে। তারপরও কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলো স্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয়। ইসলামী যুক্তিবিদ্যা অনুসারে এ উভয় দিকের অবশ্যই সমন্বয় ঘটাতে হবে। তদ্রূপ উসূলে ফিকাহর কিছু স্থায়ী নিয়ম আছে যেগুলো পরিবর্তন করা যায় না। আবার কিছু কিছু বিষয়কে অনবরত বিকাশ ও নবায়নের উপর নির্ভর করতে হয়। ইজতিহাদ সম্পর্কিত আলোচনা থেকে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়েছে।
অতএব আমরা সকল মুসলিম চিন্তাবিদগণকে শূন্যতা শুরু না করার জন্য অনুরোধ জানাই। তাঁরা যেন তাঁদের পূর্ববর্তী গবেষকগণের যুক্তি ও ইজতিহাদ থেকে সাহায্য গ্রহণ করেন। আমরা এ কথা স্বীকার করি যে, যে সকল বিষয়ে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত চিন্তাপ্রসূত যুক্তির ভিত্তিতে ফতোয়া প্রদান করা হয়েছে, সে সকল বিষয়ে কোন মুজতাহিদকে অনুকরণ করা বাধ্যতামূলক নয়। আমরা অবশ্য বলতে পারি যে, তাঁর ফতোয়া হচ্ছে একটি ব্যক্তিগত অভিমত বিশেষ এবং তাঁর মতের সাথে শরীক হওয়া যায়। (খলীফা উমর ইবনুল খাত্তাব রাঃ) -এর প্রতি আরোপিত একটি বহুল প্রচলিত অভিমত)
ঝ. প্রাথমিক যুগের মনীষীদের (সালাফ) অনুসৃত পদ্ধতি পর্যালোচনা করলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মাণ হয় যে, শুধুমাত্র আইন প্রণয়ন এবং ফতোয়া প্রদান করাই তাঁদের লক্ষ্য ছিল না, বরং সর্বদা তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর আইন প্রয়োগ করে তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠা করা। এর অর্থ স্পষ্টত এই দাঁড়ায় যে, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট শর্তাবলী থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। উপরে বর্ণিত বিষয়াবলী অনুধাবন করে আমরা যদি উসূলে ফিকাহকে ইসলামী জ্ঞানসমূহের সাথে যথাযোগ্য স্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই এবং এ বিজ্ঞানকে শরীয়াহর দলীল বের করার একটি গবেষণা পদ্ধতি হিসাবে রূপান্তর করে তা থেকে সমকালীন সমস্যার সমাধান ও সিদ্ধান্ত পেতে চাই (শরীয়াহর সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে) তবে আমাদেরকে অবশ্যই নিম্নবর্ণিত কাজগুলো করতে হবে।
(১) উসূলে ফিকাহতে আলোচিত বিষয়সূচি পর্যালোচনা করা এবং যে সকল বিষয়ের সাথে আধুনিক উসূলবিদগণের সম্পৃক্ততা নেই সেগুলো বাদ দেয়া। বাদ দেয়া বিষয়গুলোর মধ্যে হুক্মুল-আশয়া কাবলাশ শার (শরীয়াহ-পূর্ববর্তী বিধিবিধান) , শুকরুল মুনইম (সর্বশক্তিমান নিয়ামতদাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা) , মাবাহিছ হাকিমিয়্যাতিশ শার (শরীয়াহর সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত অধ্যয়ন) এবং বিভিন্ন সংজ্ঞার বিষয়ে অত্যধিক গুরুত্বারোপ করা ইত্যাদি বিষয় অবশ্যই তালিকাভুক্ত করতে হবে। আমাদেরকে অবশ্যই কুরআনের অনুমোদিত পাঠ (কিরাআত শাজ্জাহ) এবং সমগ্র কুরআনের আরবী ভাষাগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত বিতর্কসমূহ পরিষ্কার করতে হবে। অনুরূপভাবে একজনমাত্র রাবী (বর্ণনাকারী) কর্তৃক বর্ণিত হাদীস সম্পর্কিত দীর্ঘদিনের বিদ্যমান মতানৈক্যর এভাবে সমাপ্তি টানতে হবে যে, যদি ঐরূপ বর্ণনা সহীহ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলী পূরণ করতে সক্ষম হয় তবে তা গ্রহণযোগ্য হবে এবং তা থেকে আইন প্রণয়ন করা যাবে।
এছাড়া প্রাথমিক যুগের ইমামগণ সমকালীন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে যে সকল শর্ত নির্ণয় করেছিলেন, সেগুলো পুনঃপরীক্ষা করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে এ শর্তগুলোর কথা বলা যেতে পারে যে, কোন হাদীস তাঁদের নিরূপিত সাধারণ নীতিমালার পরিপন্থী হতে পারবে না, ফকীহ ভিন্ন অন্য কারো বর্ণিত হতে পারবে না এবং কিয়াসের সাথে সাংঘর্ষিক বা মদীনাবাসীদের ঐতিহ্য বিরোধী হতে পারবে না, অথবা কুরআনের বাহ্যিক (জাহির) অর্থের পরিপন্থী হতে পারবে না ইত্যাদি। আরেকটি শর্ত, যেমন সাধারণভাবে প্রযোজ্য কোন বিষয় অথবা কষ্টকর বা পীড়াদায়ক বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন হাদীস ব্যাপকভাবে পরিচিত হতে হবে। এসব শর্ত বাতিল করতে হবে। অনুরূপভাবে যে সকল শর্ত এখনো বিতর্কিত, যে সকল শর্ত মুসলমানগণের মধ্যে মতানৈক্যর উৎস হয়ে আছে এবং এখনো চিন্তাবিদগণের সময়ক্ষেপণ করছে সেসব শর্ত পরিহার করতে হবে।
(২) ফিকাহর সা- সম্পর্কিত ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণা করতে হবে। গবেষণার মাধ্যমে রাসূল (সাঃ) -এর সময় আরবদের প্রকাশভঙ্গী পরীক্ষা করে দেখতে হবে, প্রকাশভঙ্গীর বিভিন্ন পর্যায়ক্রমিক বিকাশ এবং পরবর্তীকালে সেগুলোর অবলুপ্তি সম্পর্কিত ধারাবাহিকতা তুলে ধরতে হবে। শব্দের বিভিন্ন প্রকার তাৎপর্য এবং চলতি ব্যবহার সমূহ চিহ্নিত করতে হবে।
(৩) কিয়াস, ইসতিহসান, মাসলাহাহ ও ইজতিহাদের অন্যান্য পদ্ধতি ও মূলনীতিসমূহের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। মুজতাহিদগণ কোন অবস্থার প্রেক্ষিতে ফতোয়া প্রদান করেছিলেন, সে সকল বিষয়কে বিবেচনায় এনে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সেগুলোকে পর্যালোচনা করতে হবে। আমাদেরকে চেষ্টা করতে হবে, যারা ফিকাহ এবং উসূল সম্পর্কে গবেষণা করছেন, তাঁদের মধ্যে যেন ফকীহ সুলভ অনুভূতি গড়ে ওঠে।
(৪) এ কথা অনুধাবন করতে হবে যে, বর্তমান সময়ে মুজতাহিদ মুতলাক (নিরঙ্কুশ) হওয়া অথবা কোন ব্যক্তির নিজ যোগ্যতাবলে আইন বিষয়ে (অর্থাৎ আইনের উৎস ব্যাখ্যা করার ব্যাপারে) সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য রায় প্রদান করা প্রায় অসম্ভব। এ অবস্থা যতদিন চলতে থাকবে ততদিন একটি একাডেমিক কাউন্সিলকে মুজতাহিদ মুতলাকের সর্বোত্তম বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
উম্মাহর আইন বিষয়ক চাহিদা পূরণে এ কাউন্সিল যাতে সক্ষম হয় সে জন্যে কাউন্সিল মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞ দ্বারা গঠিত হবে। যাতে তারা উদ্ভূত যে কোন সমস্যা অনুধাবন করতে পারেন। এছাড়া ইসলামী শরীয়ার সাধারণ নিয়ম ও মূলনীতি সম্পর্কে তাঁদের পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে। এরূপ কাউন্সিলের উসূলে শরীয়াহ এবং অন্যান্য বিষয়ের উসূল সম্পর্কে অভিজ্ঞ উচ্চ পর্যায়ের ফকীহগণকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমদের একজন বিখ্যাত ফকীহ তাঁর একটি অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। এক ব্যক্তি রমজান মাসে রোযাভঙ্গ করার ব্যাপারে অনুমতি চাইলে তিনি লোকটিকে বলেছিলেন একজন বিশ্বস্ত মুসলমান ডাক্তারের পরামর্শ নিতে। যদি ডাক্তার তাঁর স্বাস্থ্যের জন্য রোযা থাকা ক্ষতিকর বলে বিবেচনা করেন, তবেই কেবল তিনি রোযা থেকে বিরত থাকতে পারেন।
(৫) অন্যান্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ উসূলে শরীয়ার যে জ্ঞান অর্জন করার প্রয়োজন অনুভব করেন, তাঁদের জন্য বিষয়টিকে সহজতর করে দিতে হবে।
(৬) সাহাবী এবং তাবেয়ীগণের ফিকাহ সম্পর্কে, বিশেষ করে তাঁরা যে নীতিমালার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছিলেন, সেগুলো সম্পর্কে ভালভাবে অবহিত হতে হবে। বিশেষত খুলাফায়ে রাশেদা ও তাঁদের সমসাময়িক সাহাবীগণের ফিকাহ সম্পর্কে গভীরভাবে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। অতঃপর বর্তমান মুসলিম সমাজের সমকালীন চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে এ জ্ঞানকে আইন প্রণেতা ও ফকীহগণের হাতে তুলে দিতে হবে।
(৭) শরীয়ার লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের জানার আগ্রহ থাকা প্রয়োজন এবং এ বিষয়ে জ্ঞানের বিকাশ ঘটানো লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নিয়ম ও নির্দেশিকা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দিন।
— সমাপ্ত —