চতুর্থ অধ্যায়
ইমাম শাফেঈ (রঃ)
ইমাম শাফেঈ (রঃ) ১৫০ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। একই বছর ইমাম আবু হানিফা (রঃ) ইন্তেকাল করেন। তিনি প্রথম মক্কায় আহলে হাদীসের কতিপয় চিন্তাবিদের, যেমন মুসলিম ইবনে খালিদ আল যিনজি (মৃঃ১৭৯হি) এবং মুফিয়ান ইবনে উয়াইনাহ (মৃঃ১৯৮হিঃ) নিকট ফিকাহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি মদীনার ইমাম ও আহলে হাদীসের নেতা মালিক ইবনে আনাস (রাঃ) এর নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং তাঁর সংগৃহীত হাদীস ও আইন বিষয়ক মতামতের উপর ভিত্তি করে রচিত গ্রন্থ মুয়াত্তা মুখস্থ করেন। বস্তুত ইমাম শাফেঈ (রঃ) নিজেকে সবসময় ইমাম মালিক (রঃ) এর কাছে ঋণী মনে করতেন। কথিত আচে যে, ইউনুস ইবনে আবদুল আলা (রঃ) এর কথা সকলের চাইতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমি মালিক ইবনে আনাস (রঃ) এর অপেক্ষা আর কোন ব্যক্তির নিকট এতো বেশি উপকৃত হইনি। (ইবনে আবদুল আল-ইনতিকা, পৃঃ২৩। ) ইমাম শাফেঈ (রঃ) ভাষা, কবিতা, সাহিত্য, ইতিহাস এবং কিচু প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও অংক শাস্ত্র সম্পর্কে অধ্যয়নের পর উপরোক্ত মন্তব্য করেছিলেন।
ইমাম শাফেঈ (রঃ) আহলে হাদীস সম্পর্কিত যে সকল গ্রন্থ অধ্যয়ন করেছিলেন তার সবগুলো দ্বারা প্রভাবিত হননি। যেমন তিনি মুনকাতি যে হাদীসের বর্ণনাকারীগণের ধারাবাহিকতায় কোন না কোন পর্যায়ে বিচ্ছিন্নতা এসেছে। ফলে হাদীসখানিকে প্রাথমিক যুগের বর্ণনা তথা রাসূল (সাঃ) এর হাদীস হিসেবে নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নাও হতে পারে। এ ধরনের হাদীস পরবর্তীকালের সকল ফিকাহবিদ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছে (সম্পাদক) ) হাদীস গ্রহণ করায় আহলে হাদীসের সমালোচনা করে বলেন, মুনকাতি আসলে কিছুই না ইমাম শাফেঈ (রঃ) তাঁদের মুরাসল (মুরসাল হাদীস কাকে বলে এবং মুরসাল হাদীসকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিতর্ক সম্পর্কে ৩য় অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। ) শ্রেণীর হাদীস গ্রহণ করায় (যদিও তিনি নিজ সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব বর্ণিত মুরসাল হাদীস গ্রহণ করে ব্যতিক্রম সৃষ্টি করেছেন) এবং বর্ণনাকারীর (যে সকল হাদীস তাঁরা নির্ভরযোগ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে) গ্রহণযোগ্যতার শর্তাবলীর বিষয়ে অতিরিক্ত কড়াকড়ি আরোপ করার জন্য সমালোচনা করেছেন।
ইমাম শাফেঈ (রঃ) আহলে রায় এর শক্তিশালী কেন্দ্র ইরাকে গিয়ে লক্ষ্য করলেন যে, তাঁরা মদীনার লোকদের আইন বিষয়ক মতামত ও পদ্ধতির বিভিন্ন ত্রুটি, বিশেষ করে তাঁর উস্তাদ ইমাম মালিক (রঃ) এর ত্রুটি খুঁজে বের করার ব্যাপারে অতিরিক্ত আগ্রহী। তাই ইমাম শাফেঈ (রঃ) তাঁর উস্তাদের চিন্তাধারা ও পদ্ধতির সমর্থনে বক্তব্য রাখলেন। বর্ণিত আছে যে, একবার তিনি বলেছিলেনঃ মুহাম্মদ ইবনুল হাসান আমাকে বলেছিলেন, আমাদের উস্তাদ (অর্থাৎ ইমাম আবু হানিফা) তোমাদের উস্তাদ অপেক্ষা বেশি জ্ঞানী ছিলেন। তোমাদের উস্তাদের কথা বলা উচিত ছিল না। আর আমাদের উস্তাদ চুপ থেকে ভুল করেছেন।
এ কথায় আমার খুব রাগ হলো এবং আমি তাকে বললাম, আল্লাহর শপথ করে বলুন, মালিক (রঃ) এবং আবু হানিফা (রঃ) এ দুজনের মধ্যে কার রাসূলের (সাঃ) সুন্নাহ সম্পর্কে বেশি জ্ঞান ছিল? তিনি বললেন, মালিক (রঃ) , তবে আমাদের উস্তাদ কিয়াসে (বুদ্ধিবৃত্তিক সমাধানে) অধিক পারদর্শী ছিলেন।
আমি উত্তরে বললাম, হ্যাঁ তবে মালিক (রঃ) কুরআন, কুরআনের নাসিখ মানসূখ (রহিতকারী ও রহিতকৃত আয়াত) সম্পর্কে এবং রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সুন্নাহ সম্পর্কে আবু হানিফা (রঃ) অপেক্ষা অধিকতর জ্ঞানী ছিলেন। কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে যার জ্ঞান বেশি তাঁরই বলার হক আছে। (ইবনে আবদুল বার, প্রাগুক্ত, পৃঃ২৪) ।
ইমাম শাফেঈ (রঃ) মুহাম্মদ ইবনুল হাসান এবং ইরাকের অন্যান্য চিন্তাবিদগণের (এখানে উল্লেখ্য যে, মুহাম্মদ ইবনে হাসান ও ইমাম মালিক (রঃ) এর নিকট অধ্যয়ন করেছিলেন এবং অনেকের মতে তাঁর সংকলিত ইমাম মালিকের (রঃ) মুয়াত্তা বেশি নির্ভরযোগ্য। ইমাম মুহাম্মদ (রঃ) রচিত কিতাবুর রাদ আলা আহলিল মাদীনা গ্রন্থটিতে মালিকী ও হানাফি চিন্তাধারার পদ্ধতিগত পার্থক্য, বিশেষতঃ আহলে রায় এবং সাধারণভাবে আহলে হাদীসের পার্থক্য নির্দেশনার ক্ষেত্রে এক অপূর্ব বাঙময় প্রকাশ ঘটেছে (সম্পাদক) লিখিত পুস্তকাদি অধ্যয়ন করেন। অতঃপর তিনি মুহাম্মদ ইবনুল হাসান (রঃ) এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর মতামত সম্পর্কে আলোচনা করেন, যদিও তিনি সবসময় সুন্নাহ ও আহলে হাদীসের মত সমর্থন করে গেছেন।
ইমাম শাফেঈ (রঃ) কিছুকালের জন্য বাগদাদ ত্যাগ করেন। পরে ১৯৫ হিজরী সনে যখন পুনরায় বাগদাদে ফিরে আসেন তখন বাগদাদের বড় মসজিদে নিয়মিতভাবে প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশটি পাঠচক্র বসতো। ইমাম শাফেঈ (রঃ) এক এক করে সবকটি পাঠচক্রে গিয়ে আল্লাহ এবং রাসূলের (সাঃ) কথা বর্ণনা করতেন, যদিও তখন অন্যান্য উস্তাদগণ বলতেন কেবল তাঁদের উস্তাদের কথা। ফলে কালক্রমে মসজিদে ইমাম শাফেঈ (রঃ) এর পাঠচক্রটি ছাড়া আর কোন পাঠচক্র রইল না।
আবু ছাওর, আল জাফারানী ও আল কারাবীসীসহ আহলে রায়ের আরো অন্যান্য মহান চিন্তাবিদগণ ইমাম শাফেঈর (রঃ) পাঠচক্রে হাজির হতেন। এ সময় অনেকে আহলে রায়ের মত পরিত্যাগ করে ইমাম শাফেঈ (রঃ) কে অনুসরণ করতে শুরু করলেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এ পাঠচক্রে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছিলেন, কালির দোয়াত বহনকারী যে কোন হাদীস বর্ণনাকারী কোন না কোনভাবে ইমাম শাফেঈ (রঃ) থেকে উপকৃত হয়েছেন।
ইমাম আহমদকে (রঃ) বিষয়টি জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আহলে রায়ের লোকরা আহলে হাদীসের লোকদেরকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতো ইমাম শাফেঈর (রঃ) শিক্ষা ও যুক্তি দ্বারা এই প্রবণতা প্রতিহত করা হয়। (ইবনে আবদুল বার, প্রাগুক্ত, পৃঃ৮৬)
এছাড়া আহলে হাদীসের সমর্থকগণের অনুরোধের প্রেক্ষিতে বাগদাদে আহলে রায় কর্তৃক তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত যুক্তিসমূহ খণ্ডন করে ইমাম শাফেঈ (রঃ) তাঁর আল হুজ্জাত (যুক্তিমালা) গ্রন্থখানি প্রণয়ন করেন। (ইবনে আবদুল বার, প্রাগুক্ত) ।
এরপর ইমাম শাফেঈ (রঃ) মিসরে গমন করেন। সেখানে তিনি দেখতে পান যে, লোকেরা অত্যন্ত কড়াকড়িভাবে এবং কোনরূপ যাচাই বাছাই না করে মালিক (রঃ) এর মতামত অনুসরণ করে থাকেন। এ প্রেক্ষিতে ইমাম শাফেঈ (রঃ) মালিক (রঃ) এর আইন বিষয়ক মতামতসমূহের সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ করতে শুরু করলেন এবং তিনি দেখলেন যে, মালিক (রঃ) ঘটনা বিশেষকে গুরুত্ব না দিয়ে সাধারণ নীতিমালার ভিত্তিতে তাঁর মতামত প্রণয়ন করেছেন, আবার অন্য সময়ে সাধারণ নীতিমালাকে গুরুত্ব না দিয়ে ঘটনা বিশেষের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন।
ইমাম শাফেঈ (রঃ) আরো লক্ষ্য করলেন যে, মালিক (রঃ) কোন একজন সাহাবী বা তাবেঈ প্রদত্ত বিবরণের উপর ভিত্তি করে কিংবা তাঁর নিজস্ব যুক্তিকে অগ্রাধিকার প্রদান করতে গিয়ে অন্য আরেকটি নিখুঁত হাদীসকে অগ্রাহ্য করেছেন। ইমাম শাফেঈ (রঃ) আবিষ্কার করলেন যে, মালিক (রঃ) কোন একজন তাবেঈ প্রদত্ত বিবরণের কিংবা তাঁর ব্যক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে কোন একজন সাহাবীর বিবরণকে অগ্রাহ্য করেছেন এবং তিনি তা করেছেন পৃথক পৃথক ঘটনা হিসেবে। আইনের ব্যাপকতা বিশ্লেষণ এবং কোন সাধারণ নীতিমালার আওতায় তা করতেন না। এছাড়া মালিক (রঃ) কোন কোন ঘটনার ব্যাপারে ইজমার দাবি করলেও বাস্তবে দেখা গেছে যে, সে ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে।
ইমাম শাফেঈ (রঃ) আরো লক্ষ্য করলেন যে, মালিক (রঃ) এর মতামত অর্থাৎ মদীনার লোকদের ইজমা তেমন জোরালো কিছু নয়, এগুলোকে বরং সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। তিনি আল ইখতিলাফ মাআ মালিক (মালিক এর সাথে মতভেদ) শিরোনামে রচিত তাঁর একখানা গ্রন্থে উপরোল্লিখিত সকল বিষয়ে আলোচনা করেন। (দেখুন ফখরুদ্দীন আল রাজী, মানাকিব আল শাফেঈ, পৃঃ২৬)
ইমাম শাফেঈর (রঃ) মতে ইমাম মালিক (রঃ) পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ মজুত থাকা সত্বেও তাঁর নিজস্ব নীতি মাসালিহ মুরসালাহ (বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থ) প্রয়োগ করতে গিয়ে যথাযথ সীমা অতিক্রম করেছেন। আবু হানিফা (রঃ) সম্পর্কে তাঁর মত এই যে, অনেক ক্ষেত্রে তিনি ছোটখাটো বিষয় ও বিশেষ কোন বিষয়ের ব্যাপারে তাঁর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছেন, সেগুলোর বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন কিন্তু মূলনীতির প্রতি গুরুত্ব দেননি। (ইমামুল হারামাইন, আবদুল মালিক জুয়ায়নী মুগহীছ আল খালক। )
উল্লেখিত বিষয়গুলো মনে রেখে ইমাম শাফেঈ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে আইন প্রণয়নের নীতিমালার সংগ্রহ, সেগুলোর প্রয়োগের জন্য বুনিয়াদী নিয়ম নীতি সুসংবদ্ধকরণ ও উসূলে ফিকাহ এর বিকাশ ঘটানোর প্রতি, যাতে এগুলোর সাহায্যে যথার্থ সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বিভিন্ন ফিকাহ সম্পর্কিত প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। ফিকাহকে হতে হবে উসূলে ফিকাহর বাস্তব প্রতিফলন যা আহলে রায় ও আহলে হাদীস এই দুটি চিন্তাধারার বিকল্প হিসেবে নতুন ফিকাহ শাস্ত্রের আবির্ভাব ঘটাবে।
এ উদ্দেশ্যেই ইমাম শাফেঈ (রঃ) আল রিসালাহ গ্রন্থ প্রণয়ন করেন এবং এ গ্রন্থে তিনি কয়েকটি নীতিমালার ভিত্তিতে তাঁর ফিকাহ শাস্ত্র ও তাঁর মাযহাব গড়ে তোলেন।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বলেছেন, ইমাম শাফেঈ (রঃ) এর আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত আমরা সাধারণ এবং বিশেষ (আল উমুম ওয়াল খুসূস) এ দুটি রূপের চিন্তা করতে পারিনি। (আর যারকানী, আল বাহর আল মুহিত, MS)
ইমাম শাফেঈ (রঃ) প্রায়ই ইমাম আহমদ (রঃ) কে বলতেন, হাদীস ও হাদীসের বর্ণনাকারীগণ সম্পর্কে আমার অপেক্ষা আপনার জ্ঞান বেশি। সুতরাং কোন প্রামাণ্য হাদীস পেলে আমাকে বলবেন। যদি তা প্রামাণ্য হয়, কুফা, বসরা, দামেস্কের (ঐ অঞ্চলসমূহের বর্ণনাকারী হতে) হলেও আমি তা গ্রহণ করব। (ইবনে আবদুল বার, প্রাগুক্ত, পৃঃ২৫) । এ বিবরণ থেকে স্পষ্টরুপে বুঝা যায় যে, ইমাম শাফেঈ (রঃ) ছোটখাটো বিষয় এবং বিশদ বিশ্লেষণ অপেক্ষা নীতিমালা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিলেন। উসূলে ফিকাহ এর ইতিহাস প্রণেতাগণ সকলে একবাক্যে স্বীকার করেন যে, এ বিষয়ের প্রথম লেখক ছিলেন ইমাম শাফেঈ (রঃ) এবং এবিষয়ে সর্বপ্রথম লিখিত গ্রন্থ হলো তাঁর আর রিসালাহ। (এ বিষয়ে কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে, প্রাথমিক যুগের আইন বিষয়ক চিন্তাধারাসমূহের কতিপয় অনুসারী যাঁরা তাঁদের দাবির সমর্থনে কিছু দুর্বল সাক্ষ্য প্রমাণ পেশ করে বলেন যে, ইমাম শাফেঈর (রঃ) পূর্বে ইমাম আবু ইউসুফের মত হানাফি চিন্তাবিদগণ শরীয়াহ বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। (সম্পাদক)
আয যারকাশী (মৃঃ৭৯৪ হিঃ) তাঁর রচিত আল বাহরুল মুহীত গ্রন্থে এ বিষয়ে একটি অধ্যায় রচনা করেছেন সেখানে তিনি বলেছেনঃ ইমাম শাফেঈ (রঃ) ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি উসূলে ফিকাহ সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি নিম্নবর্ণিত গ্রন্থসমূহ রচনা করেছেনঃ (১) রিসালাহ, (২) আহকামুল কুরআন, (আল কুরআনের আইনগত ব্যাখ্যা) , (৩) ইখতিলাফুল হাদীস (পরস্পর বিরোধী হাদীস) (৪) ইবতালুল ইসতিহসান (আইনগত অগ্রাধিকারের অবৈধতা) , (৫) জিমাউল ইমল (সুসমন্বিত জ্ঞান) এবং (৬) আল কিয়াস (সাদৃশ্যমূলক যুক্তিবাদ) । এ শেষোক্ত গ্রন্থে তিনি মুতাযিলাপন্থীদের ত্রুটিসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পর্কে তাঁর মত প্রত্যাহার করেন। অতঃপর অন্যান্য চিন্তাবিদগণ উসূল সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনায় তাঁকে অনুসরণ করেন।
রিসালাহ সম্পর্কিত ভাষ্য গ্রন্থে জুয়াইনী লিখেছেনঃ
ইমাম শাফেঈর (রঃ) পূর্বে আর কেউ উসূর সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা করেননি কিংবা এ বিষয়ে তাঁর মতো এতো বেশি জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন না। এটা প্রাসঙ্গিক যে, ইবনে আব্বাস (রঃ) সাধারণ বিষয় (আম) থেকে বিশেষীকরণ সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করেছেন। প্রাথমিক যুগের অন্যান্য গবেষকগণ কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন ফতোয়াসমূহ থেকে ধারণা করা যায় যে, তাঁরা এ সম্পর্কিত নীতিমালাসমূহ অনুধাবন করতেন। কিন্তু তাঁদের পরে যারা এসেছেন তাঁরা উসূল সম্পর্কে কিছুই বলেননি এবং এ ব্যাপারে তাঁরা কোন অবদান রাখেননি। আমরা তাবেঈগণ ও তৎপরবর্তী যুগের লেখকগণের গ্রন্থাদি পাঠ করেছি কিন্তু তাঁদের মদ্যে কেউই উসূল সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা করেননি। (দেখুন আবদুর রাজ্জাক, প্রাগুক্ত, পৃঃ২৩৪)
আর রিসালাহ গ্রন্থে ইমাম শাফেঈর অনুসৃত পদ্ধতি
রাসূল (সাঃ) এর নবুয়ত লাভকালে মানবজাতির অবস্থা বর্ণনার মাধ্যমে ইমাম শাফেঈ (রঃ) তাঁর গ্রন্থের সূচনা করেন। তিনি মানবজাতিকে দুভাগে ভাগ করেনঃ
১। আহলে কিতাবঃ কিতাবের অনুসারী বা পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের অনুসারীগণ যারা তাদের কিতাবের পরিবর্তন করেছে এবং এগুলোর বিধান বিকৃত করেছে। তারা কুফরীতে লিপ্ত হয়ে আল্লাহর নাযিলকৃত সত্যের সাথে মিথ্যার মিশ্রণ ঘটিয়েছে।
২। মুশরিক ও কাফিরগণ, যারা আল্লাহর পরিবর্তে মূর্তিপূজা করত। অতঃপর ইমাম শাফেঈ (রঃ) বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তায়ালা সর্বশেষ রাসূল প্রেরণ করেন এবং তাঁর নিকট কিতাব নাযিল করে মানবজাতিকে রক্ষা করেছেন, যাতে তারা এর সাহায্যে অবিশ্বাসের অন্ধত্ব থেকে আলোর পথ খুঁজে পেতে পারে।
সাবধান যারা তাদের নিকট কুরআন আসার পর তা প্রত্যাখ্যান করে তাদেরকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে, এ অবশ্যই এক মাহিমাময় গ্রন্থ। কোন মিথ্যা এতে অনুপ্রবেশ করবেনা পূর্বেও নয় পরেও নয়। এটা প্রজ্ঞাময় চির প্রশংসিত আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ (৪১:৪১-৪২)
এরপর ইমাম শাফেঈ (রঃ) ইসলামে কুরআনের মর্যাদা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং আল্লাহ কি কি বিষয়ে অনুমতি প্রদান করেছেন এবং কি কি বিষয়ে নিষেধ করেছেন, কিভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে, যারা আল্লাহকে মান্য করে তাদের জন্য কি পুরস্কার এবং যারা অমান্য করে তাদের জন্য কি শাস্তি রাখা হয়েছে এবং তিনি কিভাবে তাদের পূর্ববর্তীদের ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে সতর্কীকরণ করেছেন ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করেছেন।
অতঃপর ইমাম শাফেঈ (রঃ) বর্ণনা করেন যে, ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানানুসন্ধিৎসু ব্যক্তিগণকে কুরআনও এ সম্পর্কিত জ্ঞান যত বেশি সম্ভব অর্জন করতে হবে এবং তাদের নিয়ত (সংকল্প) শুদ্ধ করতে হবে যাতে তাঁরা কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করতে ও এর যথার্থ তাৎপর্য বের করতে সক্ষম হন।
রিসালাহ গ্রন্থের ভূমিকার শেষাংশে ইমাম শাফেঈ (রঃ) বলেছেন, আল্লাহর দীনের অনুসারীদের নিকট এমন কোন সমস্যা আসতে পারেনা, যে ব্যাপারে আল্লাহ তাঁর কিতাবে সত্য পথের ইঙ্গিত প্রদান করেননি। যেহেতু অতি পবিত্র ও মহান আল্লাহ বলেছেনঃ ***** আরবী ***** আলিফ লাম রা। এ কিতাব তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি যাতে মানব জাতিকে তাদের প্রতিপালকেরনির্দেশক্রমে বের করে আনতে পার অন্ধকার হতে আলোতে, তাঁর পথে যিনি পরাক্রমশালী প্রশংসিত। (১৪:১) (*****আরবী ******) প্রেরণ করেছিলাম স্পষ্ট নিদর্শন ও কিতাবসহ এবং তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছিল, যাতে তারা চিন্তা করে। (১৬:৪৪) ***** আরবী ****)
আমি আত্মসমর্পণকারীদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ পথনির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদস্বরূপ তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করলাম। (১৬:৮৯) আরবী*********)
এভাবে আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি রুহ তথা আমার নির্দেশ। তুমি তো জানতে না কিতাব কি এবং ঈমান কি? পক্ষান্তরে আমি একে করেছি আলো যা দ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথনির্দেশ করি। তুমি অবশ্যই প্রদর্শন করবে কেবল সরল পথ। (৪২:৫২)
উক্ত গ্রন্থে আল বায়ান (অধ্যাপক মজিদ খাদ্দুরী তৎকর্তৃক অনুদিত রিসালাহ এর ভুমিকায় আল বায়ান শব্দের তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এবং প্রাচীন আইনবিদগণ কর্তৃক প্রদত্ত সংজ্ঞাসমূহ উল্লেখ করেছেন। অধ্যাপক খাদ্দুরী লিখেছেনঃ কেউ কেউ বলেন যে, এটা কোন নির্দিষ্ট আইন সমষ্টির নিছক একটি ঘোষণাকেই বুঝানো হয়েছে। অন্যান্যরা যুক্তি পেশ করেন যে, এটা দ্বারা শুধুমাত্র ঘোষণা করা হয় না, এ দ্বারা এমনকি স্পষ্টীকরণও হয়ে থাকে। যাইহোক শাফেঈ (রঃ) সম্ভবত আইন সমষ্টির বিষয়বস্তুর উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ ব্যাপারে তাঁর যুক্তি হচ্ছে যে, কুরআনের কল বক্তব্যই স্পষ্ট, যদিও কিছু কিছু বক্তব্য অন্যগুলো অপেক্ষা অধিকতর জোরালোভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং যারা আরবী ভাষা শব্দটির সম্পর্কে অজ্ঞ তাদের নিকট কোন কোন বক্তব্য অন্যদের তুলনায় কম স্পষ্ট সে অনুসারে অধ্যাপক খাদ্দুরী অল বায়ান অনুবাদ করেছেন, সুস্পষ্ট ঘোষণা (Perspicuous declaration) দেখুন, খাদ্দুরী, Islamic Jurisprudence, The Johns Hopnins, পৃঃ৩২-৩৩। শিরোনামে একটি অধ্যায় রয়েছে, যেখানে আল বায়ান শব্দটিকে একটি আইনগতপরিভাষা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অতঃপর কুরআনের যে সকল ঘোষণার আইনগত গুরুত্ব সম্বলিত ইঙ্গিত রয়েছে সেগুলোর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে প্রকারভেদে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। অনুরূপ পাঁচটি প্রকারভেদ নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
১। যে সকল আয়াতদ্বারা আল্লাহ সুনির্দিষ্ট আইন ব্যবস্থার কথা প্রকাশ করেছেন, সেগুলোর শাব্দিক অর্থ ব্যতিরেকে অন্য কোনরূপ ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। এ প্রকারের আল বায়ানের ক্ষেত্রে কুরআনের নিজস্ব ব্যাখ্যা ছাড়া কোন ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়।
২। কুরআনে উল্লেখিত যে সকল বিষয় বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে এবং যেগুলোর প্রকৃত তাৎপর্য সম্পর্কে সুন্নাহর মাধ্যমে ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
৩। যে সকল বিষয় স্পষ্টভাবে ফরজ ঘোষণা করা হয়েছে এবং রাসূল (সাঃ) কিভাবে, কেন, কাদের উপর, কখন সে সকল আইন প্রযোজ্য হবে অথবা হবে না তা ব্যাখ্যা করেছেন।
৪। যে বিষয় সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন কিন্তু সে ব্যাপারে কুরআনে কোন উল্লেখ নেই। আল্লাহ সোবহানুহু ওয়া তায়ালা কুরআনে আদেশ দিয়েছেন যে, রাসূল (সাঃ) কে মান্য করতে হবে এবং তাঁর দেয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সুতরাং রাসূল (সাঃ) নিজ এখতিয়ারে যা বলেছেন তা আল্লাহর এখতিয়ারে বলা হয়েছে।
৫। যে সম্পর্কে আল্লাহ চান যে, তাঁর বান্দাহগণ ইজতিহাদের মাধ্যমে অনুসন্ধান করুক, একে বলা যায় কিয়াস। ইমাম শাফেঈর (রঃ) মতে কিয়াস হচ্ছেঃ কুরআন ও সুন্নাহর বক্তব্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে কোন আইনগত সিদ্ধান্তে পৌছার পদ্ধতি।
ইমাম শাফেঈ (রঃ) এ পাঁচ প্রকারের আল বায়ান সম্পর্কে পাঁচটি পৃথক অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন এবং প্রতি প্রকারের উদাহরণ ও সাক্ষ্য প্রমাণ পেশ করেছেন। রিসালাহ গ্রন্থে সংযোজিত পরবর্তী অধ্যায়সমূহ নিম্নরূপঃ
১। কুরআনে নাযিলকৃত সাধারণ ঘোষণাসমূহকে সাধারণ ও ব্যাপকার্থে (আম) গ্রহণ করতে হবে। তবে এগুলোর মধ্যে বিশেষ বিশেষ (খাস) বিষয়াদিও অন্তর্ভুক্ত আছে।
২। কুরআনে বাহ্যিকভাবে যে সকল সাধারণ ঘোষণা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে সাধার ও বিশেষ বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত আছে।
৩। কুরআনের যে সকল ঘোষণা বাহ্যিকভাবে সাধারণ (ব্যাপকার্থক) মনে হয় ঐগুলো দ্বারা বিশেষ ঘোষণা বুঝানো হয়েছে।
৪। কুরআনে ঐ শ্রেণীর বর্ণনা যার তাৎপর্য কুরআনের আয়াতের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হয়।
৫। কুরআনের ঐ শ্রেণীর বর্ণনা যেগুলোতে ব্যবহৃত শব্দ বাহ্যিক অর্থ অপেক্ষা গূঢ়ার্থ বহন করে।
৬। কুরআনের সে অংশ যা ব্যাপকার্থে নাযিল হয়েছে কিন্তু সুন্নাহ দ্বারা সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এগুলো বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হবে।
উপরে বর্ণিত অধ্যায়সমূহে ইমাম শাফেঈ (রঃ) সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে সুন্নাহর বৈধতা এবং দীন ইসলামে এর মর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এ কারণে তিনি গ্রন্থটিতে নিম্নবর্ণিত অধ্যায়সমূহ সংযোজন করেছেন।
রাসূলের (সাঃ) আনুগত্য করার জন্য (বান্দার প্রতি) আল্লাহর আদেশ এবং এই আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্যের সাথে সুসম্বন্ধ।
যে সকল বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা (তাঁর বান্দাগণকে) রাসূলের (সাঃ) আনুগত্য করার নির্দেশ প্রদান করেছেন।
আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলের (সাঃ) প্রতি যা অবতীর্ণ করেছেন এবং আল্লাহ তাঁকে যা যা নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি সেগুলো অনুসরণ ও মান্য করতে বাধ্য ছিলেন এবং যে কেউ তাঁকে অনুসরণ করবে আল্লাহ তাকে পথনির্দেশ দান করবেন এই বিষয়টি আল্লাহ সেভাবে পরিষ্কার করে বর্ণনা করেছেন।
এ অধ্যায় ইমাম শাফেঈ (রঃ) রাসূলের (সাঃ) সকল সুন্নাহ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন যেগুলোর সমর্থনে কুরআনের আয়াত বিদ্যমান ছিল এবং যে সকল সুন্নাহ সম্পর্কে কুরআনে সরাসরি সমর্থনকারী কোন প্রাসঙ্গিক আয়াত নেই।
ইমাম শাফেঈ (রঃ) আরো দেখিয়েছেন যে, এমন বিষয় সম্পর্কিত সুন্নাহর অস্তিত্বও আছে যে বিষয় সম্পর্কে কুরআন নীরব। এ ব্যাপারে তাঁর সাথে দ্বিমতপোষণকারীদের যুক্তি খণ্ডন করে তিনি সাক্ষ্য প্রমাণ উদ্ধৃত করে বলেন, আমি সুন্নাহ সম্পর্কে ইতিপূর্বে যা যা বলেছি অর্থাৎ কান সুন্নাহ কুরআন কর্তৃক সমর্থিত না কি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অতিরিক্ত বিধান হিসেব বিবেচ্য হবে সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করব এবং ইনশাআল্লাহ উপরে যে বিষয়ে আমি আলোচনা করেছি সে সকল বিষয়ের বিশ্লেষণ করবো। আমি প্রথমে আল্লাহর কিতাব ভিত্তিক সুন্নাহ সম্পর্কে বলব। অবরোহ পদ্ধতিতে যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে রহিতকরণ (আল নাসিখ) সম্পর্কিত সুন্নাহসমূহ এবং আল -কুরআনেররহিতকৃত (আর মানসুখ) অংশসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করব। অতঃপর আমি কুরআনে বর্ণিত সুনির্দিষ্ট ফরজ কর্তব্যসমূহ এবং সে সম্পর্কিত সুন্নাহসমূহ তুলে ধরব। যে সকল ফরজ কর্তব্য নাযিল হয়েছে ব্যাপকার্থে কিন্তু রাসূল (সাঃ) যেগুলো কখন কিভাবে প্রয়োগ করতে হবে সে ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করে বিশেষীকরণ করেছেন, যে সকল ব্যাপকার্থবোধক আয়াতকে ব্যাপকার্থবোধক বলে মনে হলেও বিশেষ অর্থে বুঝতে হবে এবং সবশেষে রাসূলের (সাঃ) সে সকল সুন্নাহ, যেগুলো আল্লাহর কিতাবে নাযিলকৃত কোন আয়াতের ভিত্তিতে হয়নি।
রহিতকারী আয়াত এবং রহিতকৃত আয়াত শিরোনামে একটি অধ্যায় রয়েছে। উক্ত অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে যে, শরিয়াহকে সহজতর এবং অধিকতর নমনীয় করার উদ্দেশ্যেই আল্লাহ সোবহানুহু তায়ালা কুরআনের কোন কোন আয়াত রহিত করেছেন। এ অধ্যায়ে আরেকটি বিষয় সুস্পষ্ট করা হয়েছে যে, শুধুমাত্র কুরআনের একটি আয়াত দ্বারা আরেকটি আয়াতকে এবং কোন একটি সুন্নাহকে অপর একটি সুন্নাহ দ্বারা রহিত করা যায়।
এরপর তিনি কুরআন ও সুন্নাহর নাসিখ ও মানসুখ এর প্রক্রিয়া সম্পর্কে পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা করেন।
অতঃপর এসেছে ফরজ সালাত সম্পর্কে আলোচনা এবং কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে সালাত আদায় করার ব্যাপারে যাদেরকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে এবং যে ধরনের অবাধ্যতামূলক কাজ করলে সালাত কবুল হবে না সে সম্পর্কিত ব্যাখ্যা। পরবর্তী পর্যায়ে ইমাম শাফেঈ (রঃ) সুন্নাহ ও ইজমা অনুসারে কুরআনের যে সকল আয়াত এবং সুন্নাহ রহিত হওয়া বা রহিত করার ইঙ্গিত পাওয়া যায় সে সম্পর্কে নিম্নরূপভাবে বর্ণনা করেছেনঃ ফরজ কর্তব্যসমূহের মধ্য হতে যেগুলো আল্লাহ তায়ালা কুরআনে উল্লেখ করেছেন।
সে সকল ফরজ কর্তব্যসমূহ, যেগুলো সম্পর্কে কুরআন এবং রাসূলের (সাঃ) সুন্নাহ পৃথক পৃথকভাবে নির্দেশ প্রদান করে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের বিষয়টি রাসূলের (সাঃ) প্রতি আনুগত্যের সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।
সে সকল ফরজ কর্তব্যসমূহ, যেগুলো সম্পর্কে কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে, তবে এগুলো বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োগের ব্যাপারে (সাঃ) সুন্নাহ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
সাধারণভাবে সে সকল ফরজ কর্তব্যসমূহ যেগুলোকে স্পষ্টভাবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং কিভাবে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে সে ব্যাপারে রাসূল (সাঃ) ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। যেমনঃ সালাত, হজ্জ, যাকাত, স্ত্রীদের সংখ্যা, যে স্ত্রীলোকদেরকে বিবাহের অনুমতি দেয়া হয়নি এবং খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞাসমূহ।
পরবর্তী অধ্যায়ে তিনি হাদীসের বিভিন্ন ত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এবং ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন যে, কিছু কিছু হাদীসের মধ্যে পরস্পর বিরোধের অনেকগুলো কারণ চিহ্নিত করা যায়। তিনি তন্মধ্যে কিছু সংখ্যক কারণ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ কোন একটি হাদীস আরেকটি হাদীস দ্বারা রহিত হওয়ার কারণে অথবা সংশ্লিষ্ট হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ভুলের কারণে মতবিরোধ দেখা দিতে পারে। কি ধরনের ভুলের কারণে মতবিরোধ দেখা দিতে পারে এবং মতবিরোধের অন্যান্য অনেক কারণ সম্পর্কে তিনি ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। এরপর তিনি বিভিন্ন প্রকারের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে আলোচনা করে দেখান যে, কিছু কিছু হাদীস আছে যেগুলো অন্য হাদীসের ব্যাখ্যা প্রদান করে।
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) আলোচ্য গ্রন্থে জ্ঞান সম্পর্কিত একটি অধ্যায় সংযোজন করেন। তিনি বলেন, দুপ্রকারের জ্ঞান আছে। প্রথম প্রকারের জ্ঞান হলো সাধারণ জ্ঞান। যে কোন বিবেকবান পরিণত ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এ জ্ঞানের অধিকারী হয়ে থাকে। এ ধরনের সকল জ্ঞান সম্পর্কে কুরআনে উল্লেখ পাওয়া যায়। সকল মুসলমান এ প্রকারের জ্ঞান সম্পর্কে কুরআনে উল্লেখ পাওয়া যায়। সকল মুসলমান এ প্রকারের জ্ঞান সম্পর্কে অবিহিত। কেননা রাসূল (সাঃ) এর মাধ্যমে পরবর্তী সকল লোকদের নিকট এ জ্ঞান পৌঁছেছে। এগুলো যে প্রামাণ্য জ্ঞান এ সম্পর্কে কারা দ্বিমত নেই এবং সকলেই একমত যে, এগুলো বাধ্যতামূলক। বস্তুত এ সকল জ্ঞানের প্রকৃতি এমন যে, এগুলো একজনের নিকট থেকে আরেক জনের নিকট পৌছানো এবং এগুলো ব্যাখ্যা প্রদানের ক্ষেত্রে কোনরূপ ভুল থাকতে পারে না।
দ্বিতীয় প্রকারের জ্ঞানসমূহ হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার দায়িত্ব তৎসম্পর্কিত নির্দিষ্ট আইনসমূহ থেকে উদ্ভূত। এগুলো সম্পর্কে মূল কুরআনে কোন উল্লেখ নেই। একজন কর্তৃক বর্ণিত সুন্নাহ (আহাদ) ব্যতীত এগুলোর বেশির ভাগ জ্ঞান সম্পর্কে সুন্নাহর মূল বিবরণেও কোন উল্লেখ নেই।
সুতরাং এভাবেই ইমাম শাফেঈ (রঃ) একজন মাত্র রাবী কর্তৃক বর্ণিত (খবর আল-ওয়াহি) হাদীসের এক নতুন বিষয়ের আলোচনার অবতারণা করেন। এ বিশেষ পরিভাষার ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে তিনি কোন কোন শর্তের ভিত্তিতে খবর আল ওয়াহিদ গ্রহণযোগ্য হবে অথবা হবে না সে সম্পর্কে আলোচনা করেন। এ প্রসঙ্গে সাক্ষ্য প্রদান, প্রতিবেদন অর্থাৎ শাহাদা ও রিওয়অত এর মধ্যে পার্থক্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। অর্থাৎ এ সকল বিষয়ে একজন মাত্র রাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদীস গ্রহণযোগ্য হবে কি না এবং এ সকল বিষয়ে শুধুমাত্র খবর আল ওয়অহিদ যথেষ্ট কিনা সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
ইমাম শাফেঈ (রঃ) খবর আল ওয়াহিদ এর বৈধতা সম্পর্কে এবং এ ধরনের হাদীস সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনযোগ্য কিনা সে ব্যাপারেও আলোচনা করেন। উপসংহারে তিনি অত্যন্ত সুন্দর যুক্তি সহকারে বলেছেন যে, বাস্তবিকপক্ষে এসব হাদীস দলীল প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এভাবে ইমাম শাফেঈ (রঃ) তাঁর প্রতিপক্ষ কর্তৃক উত্থাপিত সকল সংশয় খণ্ডনে কামিয়াব হন।
এছাড়া নিম্নবর্ণিত অধ্যায়সমূহ উক্ত গ্রন্থে সংযোজিত হয়েছেঃ
আল ইজমাঃ এর সংজ্ঞা এবং আইনগত বৈধতা।
আল কিয়াসঃ তাৎপর্য, প্রকৃতি, প্রয়োজনীয়তা, বিভিন্ন প্রকারের কিয়াস এবং এর প্রয়োগে কে উপযুক্ত এবং কে উপযুক্ত নয়।
ইজতিহাদঃ কিভাবেইজতিহাদ প্রথমত কুরআন এবং অতঃপর সুন্নাহর উপর প্রতিষ্ঠিত, কিভাবে নির্ভুল এবং ভুল ইজতিহাদ করা হয়ে থাকে।
ইসতিহসান, আইনগত অগ্রাধিকারঃ ইমাম শাফেঈ (রঃ) এ ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন যে, কোন মুসলমানকে হাদীসের বিরোধিতা করার জন্য ইসতিহসান করার অনুমতি দেয়া যায় না। কিংবা ইসতিহসান এমন কোন আইনগত সিদ্ধান্ত প্রদানের অনুমতি দেয় না যা কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা বা কিয়াস এর উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। তিনি কিয়াস এবং ইসতিহসান এর মধ্যে পার্থক্য বিশ্লেষণআলেমগণের মতপার্থক্য সম্পর্কে ইমাম শাফেঈ (রঃ) তাঁর ব্যাখ্যায় বলেন যে, এ সকল মতপার্থক্য দুপ্রকারের। নিষিদ্ধ বিষয়ে মতপার্থক্য করার অনুমতি নেই সেগুলো হচ্ছে এমন সব বিষয় যে সম্পর্কে কুরআন ও সুন্নাহে স্পষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ মজুদ আছে। যে সকল বিষয়ে মতপার্থক্য করার অনুমতি আছে সেগুলো হচ্ছে এমন সব বিষয় যেগুলোকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এবং যেসব বিষয় সম্পর্কে প্রত্যেক আলেম তাঁর নিজস্ব যুক্তি প্রয়োগ করে থাকেন। ইমাম শাফেঈ (রঃ) উভয় প্রকার মতপার্থক্যের উদাহরণ পেশ করেছেন এবং এগুলোর কারণও উল্লেখ করেছেন। সাহাবীগণ যে সকল বিষয়ে মতপার্থক্য করেছিলেন তিনি সে সকল উদাহরণ তুলে ধরেন। যেমন ইদ্দত, শপথ এবং উত্তরাধিকার। আলোচ্য অধ্যায় ইমাম শাফেঈ (রঃ) সাহাবীগণের মধ্যে যে বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল সেগুলোর মধ্যে অগ্রাধিকার প্রদানের পদ্ধতি সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করেছেন।
ইমাম শাফেঈ (রঃ) এর উপরোক্ত মতামতের সমর্থনে বিভিন্ন শ্রেণীর সাক্ষ্য প্রমাণ শিরোনাম রচিত একটি অধ্যায়ের মাধ্যমে আর রিসালাহ গ্রন্থখানি সমাপ্ত হয়েছেঃ
আমরা সিদ্ধান্ত প্রদান করি প্রধানতঃ কুরআন ও সর্বসম্মত সুন্নাহর ভিত্তিতে, যে সুন্নাহর ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই এবং বলি, কুরআন ও সুন্নাহর মূল উৎসের বাহ্যিক ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য পর্যালোচনা করে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। যদি আমরা অল্প কয়েকজনের নিকট থেকে বর্ণিত হাদীসের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে উপনীত হই, যে হাদীসের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তাহলে আমরা বলি, আমরা হাদীসখানি যেভাবে আছে সেভাবে গ্রহণ করলাম, কিন্তু আমরা সচেতন আছি যে, এর বর্ণনাকারীগণের ব্যাপারে অজানা কোন ত্রুটি থাকতে পারে, এরপর আমরা ইজমা এবং তারপর কিয়াসের কথা বলব। কিয়াস ইজমা অপেক্ষা দুর্বল। কিয়াস শুধুমাত্র প্রয়োজনের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে, কারণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোন সরাসরি বিবরণ (হাদীস) থাকলে সে ক্ষেত্রে কিয়াস ব্যবহার করা আইনসম্মত নয়।
ইমাম শাফেঈর (রঃ) গ্রন্থাবলী থেকে আমরা জানতে পারি ইসলামী আইনের কোন কোন উৎসের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ঐ সময়ে কি কি কারণে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছিল। যে সকল উৎসের ব্যাপারে মতৈক্য ছিল তা হলো সামগ্রিকভাবে সুন্নাহ এবং বিশেষভাবে (যাকে ইমাম শাফেঈ খাসসাহ নামে অভিহিত করেছেন) খবর আল ওয়াহিদ (কোন পর্যায়ে হাদীসের রাবীর সংখ্যা একজন হলে উক্ত হাদীসকে খবর আল ওয়াহিদ বলে) বর্ণনাসমূহ। তবে ইমাম শাফেঈর (রহঃ) এ ব্যাপারে অবদান এই যে, তিনি দুটি বিষয়ে তাঁর রচিত রিসালাহ এবং জিমাউল ইলম গ্রন্থে স্বয়ংসম্পূর্ণ আলোচনা করেছেন।
অন্যান্য যে সকল বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল সেগুলো হচ্ছেঃ
১.ইজমাঃ দলীল প্রমাণ হিসেবে ইজমার বৈধতা, ইজমার প্রকারভেদ, কার ইজমা প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে, কোন বিষয়ের ইজমাকে সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যাবে, কিভাবে জনসাধারণকে অবহিত করা যাবে যে, কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ইজমা রয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল।
২.কিয়াস ও ইসতিহসানঃ এর পরিভাষাগত তাৎপর্য, তাদের প্রকৃতি, প্রমাণ হিসেবে এর বৈধতা, সম্ভাব্যতা এবং প্রয়োগের পদ্ধতি এবং সাহাবীগণের কাজকে কিয়াস বা ইসতিহসান হিসেবে বিবেচনা করা যাবে কি না ইত্যাদি ব্যাপারে মতপার্থক্য ছিল।
৩.কুরআনের আদেশ নিষেধের গুরুত্বঃ এ সকল আদেশ নিষেধের তাৎপর্য এবং অন্যান্য আইনগত ও ফিকাহ বিষয়ক সিদ্ধান্তের উপর এগুলোর প্রভাব সম্পর্কে প্রকাশ্য মতপার্থক্য ছিল। লক্ষণীয় যে, এ যুগে চারজন সুন্নি ইমাম আত তাহরীম (নিষেধাজ্ঞা) ও আল ইজাব (বৈধতা) ইত্যাদি পরিভাষার সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা ব্যবহার করেন নি এবং তাঁদের ব্যবহৃত বাক্যে এগুলো সাধারণভাবে ব্যবহৃতও হয়নি। বরং ইবনে কাইয়িমের (ইবনে কাইয়িম, প্রাগুক্ত, ১খ, ৩২) বিবরণ অনুযায়ী এ ধরনের আইনগত পরিভাষা পরবর্তীকালে উদ্ভূত হয়েছে।
৪.ইসলামী আইনের অন্যান্য যে সকল উৎসের ব্যাপারে মতপার্থক্য ছিল, সেগুলো সাধারণত প্রাথমিক যুগের বিচারকগণ আলোচনা করেননি। যেমন উরফ (প্রথা) , আদাহ (অভ্যাস) এবং ইসতিসহাব ইত্যাদি পরিভাষা তখনকার সময়ে ব্যবহৃত শব্দাবলীতে লক্ষ্য করা যায়নি।