মেহেরউল্লাহর জন্ম
তোমরা অনেকেই বারোবাজারের নাম শুনে থাকবে। আর এই বারোবাজারেরও তো একটা সুন্দর ইতিহাস আছে। এখানে, যশোরাদ্য দেশের শাসনকর্তা হযরত খাজা খাঁন জাহান আলী আসআনা গাড়েন। তা’ছাড়া গাজী কালু চম্পাবতীর স্মৃতি বিজড়িত এই বারোবাজার। এখানে তাঁদের স্মৃতির নিদর্শন স্বরূপ অনেক কিছুই বর্তমান আছে। তার মধ্যে গোড়া মসজিদ ও একশত ছাব্বিশটি দীঘিই প্রধান।
যশোর জেলার কালিগঞ্জ থানাধীন প্রসিদ্ধ বারোবাজারের নিকটবর্তী ঘোপ গ্রামে এক কনকনে শীতের রাত্রিতে মেহেরউল্লা তাঁর মামা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তারিখটা ছিল বাংলা ১২৬৮ সালের ১০ই পৌষ। ইংরেজী ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দের ২৬শে ডিসেম্বর সোমবার দিবাগত রাতে।
পৈত্রিক সূত্রে তিনি এক ধর্মপরায়ণ ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পারিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যশোর শহর থেকে চার মাইল দূরে অবস্থিত ছাতিয়ানতলা গ্রামে বাস করতেন। তাঁর পূর্ব পুরুষগণ এখানে প্রথম বসতি স্থাপন করেন বলে জানা যায়।
মরহুম মুনসী মহম্মদ মেহেরউল্লা জন্মের ছয়মাস পর মামা বাড়ি থেকে পিতৃগৃহে আসেন।
তিনি যে ভবিষ্যতে একজন সংগ্রামী সংস্কারক হবেন একথা তাঁর জন্মের সময়টায় যেন ঘোষণা করে দিয়েছিল। তীব্র শীতের ভিতর জন্মই তার বাস্তব প্রমাণ।
বংশ তালিকা
[পিডিএফ ৯ পৃষ্ঠায়]
-[এই বংশ তালিকা মুনসী সাহেবের প্রথম পুত্র মনসুর আহমদ-এর স্বহস্তে লেখা তালিকা থেকে তুলে দেয়া হলো।]
বাল্য ও শিক্ষা
জন্মের পর প্রথম পাঁচ বছর পিতা-মাতার অত্যন্ত আদর যত্নেই কাটল তাঁর। তিনি ছিলেন পিতা-মাতার দুই কন্যা সন্তানের পর একমাত্র পুত্র সন্তান। কিন্তু আলালের ঘরের দুলাল করে রাখলেই তো আর চলবে না! তাঁর লেখাপড়া শেখানো চাই, মানুষের মত মানুষ করা চাই। তাই পিতা আদরের পুত্রকে পাঁচ বছর বয়সে গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি করে দিলেন। কৃতিত্বের সাথে বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয় ১ম ও ২য় ভাগ শেষ করে যখন তিনি ‘বোধোদয়’ পড়া আরম্ভ করলেন তখন তাঁর প্রধান সাহায্যকারী পিতা মুনশী মোহাম্মদ ওয়ারেছউদ্দীন ইন্তেকাল করেন। স্বাভাবিক ভাবেই শিক্ষার অগ্রগতিতে বাঁধা আসে। এতে হয়তো বা আল্লাহর কোন মহান উদ্দেশ্য নিহিত ছিল, এই ছেলেকেই ভবিষ্যতে অসাধ্য সাধণ করতে হবে, বহু সংগ্রামের সম্মুখীন হতে হবে। তাই একটু বাস্তব ট্রেনিং শিশুকাল থেকেই দিয়ে নিতে চান মহান রাব্বুল আলামীন। যেমন অন্যান্য মনীষীদের জীবনেও আমরা ঘটতে দেখি।
কিন্তু মুনসী সাহেবের মা ছিলেন অত্যণ্ত বিদ্যানুবাগিনী। যার কারণে শত কষ্টের মধ্যেও তিনি পুত্রকে লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করতেন। লেখা পড়ার ব্যাপারে তাঁর মা এমনি অনুপ্রেরণা দিতেন যে, পরবর্তীকালে মেহেরউল্লা তাঁর মায়ের প্রেরণার কথা উল্লেখ করে বলেন, “আমি আমার মাতার যত্ন ও চেষ্টাতে যাহা কিছু শিখিয়াছি”। তাঁর জ্ঞান তৃষ্ণা এতো প্রবল ছিল যে চৌদ্দ বছর বয়সে গৃহ ত্যাগ করে তিনি কয়ালখালী গ্রামের মৌলভী মেসবাহউদ্দীন সাহেবের নিকট তিন বছর এবং করচিয়া গ্রামের জনাব মোহাম্মদ ইসমাইল সাহেবের নিকট তিন বছরকাল আরবী ও ফারসী শিক্ষা লাভ করেন। কোরআন শরীফ, উর্দূ ও ফারসী ভাষায় তিনি যে বুৎপত্তি লাভ করেন, পরবর্তী জীবনে তাঁর গ্রন্থাবলী ও ঘটনা সমূহে তার নজীর পাওয়া যায়।
শুধু তাই নয়। ঐ বয়সেই তিনি শেখ সাদীর গুলিস্তা, বুস্তা ও পান্দনামা মুখস্ত করেন। এমন কি মহীশুর থেকে প্রকাশিত “মুনসুরে মুহাম্মদী” নামক পত্রিকার গ্রাহক ও একনিষ্ঠ পাঠক হন। এ সমস্ত ঘটনা থেকে জানা যায় তিনি জ্ঞান আহরণের জন্য কত তৃষ্ণার্ত ছিলেন। মেহেরউল্লাহর ছাত্র জীবন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। কিন্তু কর্ম জীবনেও আমরা তাকে জ্ঞান আহরণরত দেখতে পাই।
যৌবনে মেহেরউল্লা
পিতৃহীন এই বালক যে অত্যন্ত গরীব ছিলেন সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যৌবনে পদার্পনের পর চাকরীর সন্ধানে তিনি যশোর জেলা বোর্ডের কেরানীর পদের জন্য আবেদন করেন। সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে তিনি যে অবস্থার সম্মুখীন হন তা ছোট বড় সবার জন্য একটি নজীর হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ঘটনাটা শুনলেই বুঝতে পারবে। সাক্ষাৎকার দিতে গিয়েছিলেন মেহেরউল্লা। ছেলেমানুষ হলেও প্রত্যয় দীপ্ত চেহারা। তৎকালীন জেলা বোর্ডের কর্তা ইংরেজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে দেখেই বললেন, তুমি একেবারে ছেলেমানুষ, তোমাকে দিয়ে এ কাজ হবেনা। মুনসী সাহেব কোনভূমিকানা করেই প্রশ্ন ছুড়লেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে লক্ষ্য করে ‘বেয়াদবী মাফ করবেন, আমাকে দিয়ে এ কাজ হবে না কেন স্যার?’ সাহেব বললেন, ‘তুমি ছেলেমানুষ, তোমার কোন অভিজ্ঞতা নেই অতএব তুমি পারবেনা; আমরা একজন অভিজ্ঞ মানুষ চাই’। এরপর মুনসী সাহেব কি জবাব দিয়েছিলেন জান? সাহেব পর্যন্ত চমকে গেলেন। তিনি বললেন, “স্যার! চাকরীতে ঢোকার আগে আপনার কি কোন অভিজ্ঞতা ছিল? তবুও আপনি যখন পেরেছেন আমি কেন পারব না?”
সাহেব ডাগর চোখে বিস্ময় প্রকাশ করলেন। কিন্তু বিরক্ত হলেননা। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমিই পারবে’। অতএব চাকরী হয়ে গেল। কিন্তু যারা সারা জীবন স্বাধীনতার পূঁজারী, যারা স্বাধীন জীবন ভালবাসেন তারা কি বাধাধরা নিয়মের ভিতর জীবন যাপন করতে পারেন? তাইতো একদিন মেহেরউল্লাকে দেখা গেল খোজারহাট এক দর্জির দোকানে। চাকরী ছেড়ে ধরলে দর্জির কাজ। অবসর পেলে তিনি মোটেই সময় নষ্ট করতেন না, মুনশী তাজ মাহমুদ নামে জনৈক ব্যক্তির নিকট উর্দু ও ফারসী সাহিত্য পাঠ করতেন। এরপর তিনি ঘড়চী গ্রামের জাহাবখশ মৃধা নামে একজন নামকরা সাহেব বাড়ির দর্জির নিকট উন্নতমানের দর্জির কাজ শিখতে আরম্ভ করেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাংলা সাহিত্য ও ব্যাকরণেও বুৎপত্তি লাভ করেন। ৫/৬ বছর তিনি সাহেব বাড়িতেই কৃতিত্বের সাথে কাজ করেন।
সাহেব বাড়ির কাজ শেষে তিনি যশোর বড়াটানায় অত্যাধুনিক একটা দর্জির দোকান খোলেন। তাঁর ব্যবহার এত মধুর ছিল যে, যশোরের শিক্ষিত ব্যক্তিরা তাঁর খরিদ্দারে পরিণত হন। তা’ছাড়া তাঁর তৈরী পোশাক ছিল রুচি সম্মত। এমন কি তৎকালীন ইংরেজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত তাঁর নিকট থেকে পোষাক তৈরী করতেন। তাঁর বিজ্ঞানোচিত কথা বার্তায় আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই তাঁর দোকানে আসতেন, আলোচনার জন্য। বলা যায় পরবর্তীতে দোকানটা মোটামুটি একটা জ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এই দোকান থেকেই তিনি শুরু করেন পাদ্রীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
খ্রীষ্ট ধর্মের খপ্পরে মেহেরউল্লা
খ্রীষ্টান পাদ্রীরা যখন উঠে পড়ে তাদের ধর্ম প্রচার করতে লাগল, বিশেষ করে যশোরের আশে পাশে তারা ব্যাপকভাবে কাজ চালাতে শুরু করল তখন তাদের কাজ কারবারে মুনসী মোহম্মদ মেহেরউল্লা কিছুটা মুগ্ধ হয়ে পড়েন। এমনকি তাদের প্রচার প্রচারণায় অনেক লোকই ঐ সময় খ্রীষ্টান ধর্মগ্রহণ করেন। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে মুনসী সাহেবের মনে প্রশ্ন দেখা দিলো। এ প্রসংগে তাঁর ঘনিষ্ট সহকর্মী ও বিশিষ্ট বন্ধু মুনশী শেখ জমিরুদ্দীন বলেছেন, “পাদ্রী আনন্দ বাবুর প্রচার শুনিয়া বাইবেল ও খ্রীষ্টান ধর্ম সংক্রান্ত পুস্তকাদি পাঠ করিয়া ইসলাম ধর্মে তাঁহার অবিশ্বাস ও খ্রীষ্টান ধর্মে তাঁহার আস্থা জন্মে”।
বুঝতেই পারছো তার জীবনে এ সময়টাকেমন সংকটময় ছিল। এই সময় খ্রীষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়া তার পক্ষে অসম্ভব ছিলনা। কিন্তু আল্লাহ যাকে কল্যাণ দান করবেন,যাকে দিয়ে মুসলিম কওমের খেদমত করাবেন তিনি কি এতটুকুতে ভেঙ্গে পড়তে পারেন? দেখা গেল প্রথম ধকলটা তিনি সামলে নিয়েছেন। তৎকালীন প্রসিদ্ধ বক্তা ও ইসলাম প্রচারক হাফজ নিয়ামতুল্লাহর ‘খ্রীষ্টান ধর্মের ভ্রষ্টতা, নামে বইটি তাঁর হাতে এসে পৌঁছল। তাছাড়া প্রথম জীবনে খৃষ্ট ধর্ম প্রচারক ও পরবর্তী জীবনে ইসলাম ধর্ম প্রচারক ইশান চন্দ্র মণ্ডল ওরফে মুনশী মুহম্মদ এহছানউল্লাহ সাহেব কৃত “ইঞ্জিলে হযরত মুহম্মদের খবর আছে” নামক পুস্তক খানিও তিনি পেয়ে যান।
ব্যাস! এই দু’খানি বই তাঁর জীবনে পরশ পাথর বুলিয়ে দিলো। তিনি ইসলামের একজন অনন্য খাদেমে পরিণত হলেন।
দার্জিলিং-এ মেহেরউল্লা
সাহেব বাড়িতে কাজ করার সময় মেহেরউল্লা মাঝে মাঝে দার্জিলিং যেতেন। এবার কিন্তু দার্জিলিং-এ গিয়ে তিনি দোকান খুলে বসলেন। এ ব্যাপারে যশোরের ইংরেজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। অর্থাৎ তিনি যখন দার্জিলিং বদলী হন তখন মুনসী মেহেরউল্লাকে সাথে করে নিয়ে যান। দার্জিলিং এসে অনেক ভদ্র লোকের সাথে তাঁর ওঠা-বসা হয় এবং এই সময়ই তিনি একজন ভদ্র লোকের পরামর্শে মনসুরে মুহাম্মদীর গ্রাহক হন। এখানে তিনি খ্রীষ্টান পাদ্রীদের কাজ কারবার দেখে ব্যথিত হন। তাই তিনি আবার নতুন করে পড়াশুনা আরম্ভ করেন। এবার কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের পড়াশুনা আরম্ভ করলেন।তিনি বুঝলেন তুলনামূলকভাবে যদি সমস্ত ধর্ম জ্ঞান না থাকে তা’হলে জনসাধারণকে বুঝান মুশকিল। তাই তিনি খ্রীষ্টান ধর্মের বিরুদ্ধে লেখা কয়েকটি উর্দু গ্রন্থসহ বেদ, উপনিষদ, গীতা, বাইবেল, ত্রিপিটক, গ্রন্থসাহেব প্রভৃতি ধর্মের গ্রন্থগুলি একান্ত মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করেন। “তোহফাতুল মুকতাদী” নামে উর্দু গ্রন্থ থেকে তিনি বিভিন্ন ধর্মের ত্রুটিগুলি পুংখানুপুংখরূপে জেনে নিলেন। এছাড়া সোলায়মান ওয়ার্সী লিখিত “কেন আমি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হয়েছিলাম” এবং “প্রকৃত সত্য কোথায়”, এই তিন খানা বই তিনি পাঠ করেছিলেন। এরপর তিনি নতুন পরিকল্পনা নিয়ে যশোর ফিরে এলেন।
সংগ্রামী মেহেরউল্লা
দার্জিলিং থেকে ফিরে তিনি দেশের যে করুণ অবস্তা দেখলেন তাতে তাঁর মন হু হু করে কেঁদে উঠল। কোথায় গেল দোকান, কোথায় কি-তিনি নেমে পড়লেন পাদ্রীদের অনুকরণে হাটে-মাঠে, গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে। চলতে লাগলো বাদ প্রতিবাদ। একদিকে খ্রীস্টান পাদ্রীদের বক্তৃতা অন্যদিকে মেহেরউল্লাহর বক্তৃতা। এ ব্যাপারে সব সময় মুনসী সাহেবের সাথে যারা ছায়া মত ঘুরতেন তাঁরা হলেন ঘুরুলিয়া গ্রামের মুনশী মুহম্মদ কাশেম এবং যশোর শহরের ঘোপ গ্রামের মুনশী গোলাম রব্বানী, জানা যায় অনেক সময় তাঁরাও বাক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতেন।
এসময় মুসলমানদের অবস্থা এরূপ ছিল যে, ইংরেজ বেনিয়া শাসক গোষ্ঠীর সাথে অসযোগিতা করতে গিয়ে তাঁরা দারুণভাবে পিছিয়ে পড়েছিল। একথা অবশ্য আগেই উল্লেখ করেছি। ওহাবী আন্দেলন হয় ব্যর্থ। আলেম সমাজের মধ্যে দেখা দেয় অনৈক্য। দারুল হারব, দারুল আমান, দারুল ইসলাম নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে তখন হানাফী ও মুহাম্মদীর মধ্যে তীব্র আকারে। এমনিতর অবস্থার মধ্যদিয়ে পাদ্রীদের অপপ্রচারে ও প্রলোভনে দলে দলে হিন্দু মুসলমান খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করতে লাগলো। বাদশার জাত মুসলমানরা রাজ্য হারিয়ে যখন হিন্দু ও খ্রীস্টানদের যাতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছিল তখন তাদের সম্বল ছিল একটু ক্ষীণ ঈমান। কিন্তু তাও যখন চলে যেতে থাকলো তখন মুনসী মেহেরউল্লা আর স্থির থাকতে পারলেন না। তুলে ধরলেন দুর্দশাগ্রস্থ মুসলিম জাতির সামনে জ্ঞানের প্রজ্বলিত মশাল।
তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন সর্ব প্রকারের অত্যাচার, অনাচার, কদাচার, অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। প্রয়োজন তাঁকে কলকাতায় টেনে নিয়ে গেল। তিনি “সুধাকর” পত্রিকার সম্পাদক শেখ আবদুর রহীম ও ‘মিহির’ পত্রিকার সম্পাদক মুনশী রিয়াজ উদ্দীন মাশহাদী প্রমুখ আলেম ও সমাজ সচেতন ব্যক্তিবর্গের সাথে দুর্দশাগ্রস্থ মুসলিম সমাজ নিয়ে আলাপ কররেন। ফলশ্রুতিতে খান বাহাদুর বদরুদ্দীন হায়দার, খান বাহাদুর নুর মুহম্মদ জাকারিয়া প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রীটের, “নাখোদা” মসজিদে সমবেত হলেন। তাঁরা, “নিখিল ভারত ইসলাম প্রচার সমিতি” নামে একটি সমিতি গঠন করলেন। সমিতির সদস্যবৃন্দ মুনসী মেহেরউল্লার উপর বাংলা ও আসামে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব অর্পণ করলেন। এক বর্ণনায় জানা যায় এই কঠিন দায়িত্ব পালনে তিনি ফুরফুরা শরীফের পীর আবুবকর সিদ্দিক (রা) সাহেবের কাছ থেকে যথেষ্ট প্রেরণা লাভ করেন।
দায়িত্ব পাওয়ার পর দায়িত্বশীল মুনসী মেহেরউল্লা আর এক মুহুর্তও বসে থাকেন নি। তিন ইসলাম প্রচারের মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বাংলা আসামের হাটে-মাটে, শহর-গঞ্জের জনসভায়, ব্যর্থ করতে চেষ্টা করলেন বেনিয়া শ্বেত-ভল্লুক ইংরেজদের অপপ্রচারকে।
খ্রীষ্টানদের সাথে তর্ক করতে করতে মেহেরউল্লাহ তর্কবাগীশ হয়ে উঠলেন। ক্রমে ক্রমে তাঁর তর্কশক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকলো, ইসলাম ও খ্রীষ্টান ধর্ম শাস্ত্রে তিনি জ্ঞানী হয়ে উঠলেন। এ প্রসংগে শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন তাঁর “কর্মবীর মুনশী মেহেরুল্লাহ” গ্রন্থের ২০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “ইসলামের দীপ্ত প্রভাবে সে দর্জি মেহেরুল্লাহ বঙ্গ বিখ্যাত বাগ্মী কুলতিলক, অদ্বিতীয় সমাজ সংস্কারক মুনশী মোহম্মদ মেহেরুল্লাহই পরিণত হইলেন”।
মুনশী জমিরুদ্দীন খ্রীষ্টান হলেন
মুনশী মুহম্মদ জমির উদ্দীন সাহেব খ্রীষ্টানদের প্ররোচনায় প্রভাবিত হন এবং খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে জন জমিরুদ্দীন পরিণত হন। জন জমিরুদ্দীনের জন্মস্থান ছিল তখনকার নদীয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার গাড়াডোব গ্রামে। জন জমিরুদ্দীন ধর্ম প্রচারে উঠে পড়ে লাগেন। ১৮৯২ ঈসায়ী সালে জন জমিরুদ্দীন “খ্রীষ্টীয় বান্ধব” নামে একটি মাসিক পত্রিকায় “আসল কোরআন সর্বত্র” এই শিরোনামে “সুধাকর” পত্রিকয় একটি সারগর্ভ প্রবন্ধ লেখেন।
এই যখন অবস্থা তখন বরিশারের পিরোজপুর মহকুমার খ্রীষ্টান পাদ্রীগণ ভয়ানক বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এমনকি তারা প্রকাশ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মুসলমানদেরকে আহবান করে বসলো। প্রশ্ন দেখা দিলো কে তাদের সাথে তর্ক যুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন? শেষ-মেষ মিহির ও সুধাকর-এর সম্পাদক মুনশী শেখ রেয়াজউদ্দীন আহম্মেদ পাদ্রীদের বিরুদ্ধে তর্ক যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য মুনসী মেহেরউল্লাকে আহবান জানান।
এ সম্বন্ধে শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন তাঁর লিখিত “কর্মবীর মুনশী মেহেরুল্লাহ”র ৩৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘বোধোদয়’ পর্যন্ত পড়া মেহেরুল্লাহ ১২৯৮ সালের ২১, ২২ ও ২৩ শে আশ্বিন তুমুল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাদ্রীদের পরাজিত করলেন”।
এখানে যে তর্কযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় তা “খ্রীষ্টান মুসলমানে তর্কযুদ্ধ” প্রবন্ধে বিস্তৃত তুলে ধরা হয়। পরে এটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়।
জন জমিরুদ্দীনের ইসলাম গ্রহণ
তোমরা শুনলে নিশ্চয়ই খুশি হব। বাক যুদ্ধেও জন জমিরুউদ্দীন, মেহেরউল্লার কাছে পরাস্ত হন। ক্রমে ক্রমে ইসলাম ধর্মের প্রতি জমিরউদ্দীন দুর্বল হয়ে পড়েন। ফলে কোন এক শুভক্ষণে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
জমিরুদ্দীন নিজে লিখেছেন-
‘একদিন আমি মধুগাড়ী নামক পল্লীতে তাম্বুর মধ্যে শয়ন করিয়া কোরান শরীফের বাঙ্গালা অনুবাদ পাঠ করিতেছি, এমন সময় সূরা সফ-এর ৫ আয়াতে (৬১শ সূরা) উপস্থিত হইলাম। তথায় লেখা আছে যে, ‘ইসা বলিলেন, …..আমার পরে যে প্রেরিত পুরুষ, যাঁহার নাম আহমদ আগমন করিবেন। উপরিউক্ত বাক্যটি পাঠ করিতে করিতে কে যেন আমার কর্ণে বলিয়া দিল যে, উক্ত বাক্যটি পূর্বে বাইবেলে ছিল, কিন্তু দুষ্ট খ্রীষ্টানেরা উহা বাইবেল হইতে বিয়োগ করিয়া দিয়াছে। যাহা হউক বাইবেল যে পরিবর্তিত ও বিকৃত হইয়াছে তাহা বিশেষরূপে আলোচনা করিতে লাগিলাম এবং …..জানিতে পারিলাম যে, বর্তমান সময়ে কোথাও আসল বাইবেল নাই, খ্রীষ্টানেরা উহা বিকৃত ও পরিবর্তিত করিয়া দিয়াছেন’।
(আমার জীবনী ও ইসলাম গ্রহণ বৃত্তান্ত –শেখ জমিরুদ্দীন, পৃ. ৬-৭)
এরপর জমিরুদ্দীন নতুন করে সত্য-ধর্ম অন্বেষণে নেমে পড়েন। তিনি খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করার কারণে আত্মীয় স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। অথচ সেই খ্রীষ্টান ধর্মের প্রতি তাঁর মনে পুনরায় অনাস্থা জন্ম নিল। তিনি নিজে লিখেছেন-
‘খ্রীষ্টান ধর্ম যে মিথ্যা হইবে ইহা পূর্বে স্বপ্নেও ভাবি নাই। অনেক চিন্তা ও বিবেচনা করিয়া হৃদয় খুলিয়া ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিয়া, বিশেষ চিন্তা ও বিবেচনা সহকারে বাইবেল পাঠ করিতে লাগিলাম। এই সময়ে আমি যতই বাইবেল পাঠ করি ততই যেন বাইবেলের ভ্রষ্টতা দেখিতে পাই’। (ঐ; পৃ. ১০_
এ সময়ে মুনশী জমিরুদ্দীনের মত এতই চঞ্চল হয়ে ওঠে যে তিনি ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি লিখেছেন
‘মনে মনে স্থির করিলাম যে, খ্রীষ্ট সমাজে আর না থাকিয়া কলিকাতায় যাইয়া ব্রাহ্ম মত ভাল করিয়া অবগত হইয়া ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হইব। ব্রাহ্ম ভ্রাতাদিগের সহিত মিশিলাম; কলিকাতায় ব্রাহ্ম ভ্রাতাদের আদেশানুসারে মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়, বাবু কেশব চন্দ্র সেন মহাশয়দ্বয়ের লিখিত পুস্তকাদি পাঠ করিতে লাগিলাম, ব্রাহ্ম মত ভাল লাগিল। (ঐ; পৃ. ১৫)
তিনি যখন ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য তাদের সভা সমাবেশে যেতে লাগলেন, এমনি একদিন কলকাতার এলবার্ট হলে নগেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘মোহাম্মদ ও তাঁর ধর্ম’ শিরোনামে একটি আলোচনা শোনেন। মিত্র মহাশয় ব্রাহ্ম ধর্মানুসারী ছিলেন। তিনি তাঁর আলোচনায় মুসলমানদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) কে আল্লাহ মনোনীত ও প্রেরিত পুরুষ বলে আখ্যায়িত করেন।
এ আলোচনা শোনার পর জমিরুদ্দীনের চিন্তা আবার নতুন দিকে মোড় নেয়। তিনি লিখেছেন –‘উপরোক্ত বাক্যগুলি আমি শ্রবণ করিয়া পবিত্র মুসলমান ধর্মের বিষয় বিশেষরূপে অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। পরে বিশেষরূপে অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। পরে বিশেষ বিশেষ মুসলমান ধর্ম পণ্ডিতদিগের নিকট গমন করিয়া, তাঁহাদের তিনটে সত্য সনাতন দীন ইসলামের উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণ করি। তাহার পরে অনেক অনেক গ্রন্থ পাঠে, বিশেষ আমার পরম ভক্তিভাজন মুনসী মহম্মদ মেহেরউল্লা সাহেবকৃত “রদ্দে খ্রীষ্টিয়ান ও দলিলোল ইসলাম” ও শ্রীযুক্ত মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহমদ ও শেখ আবদুর রহীম সাহেবকৃত “ইসলামতত্ব” ১ম ও ২য় খণ্ড পাঠ করনান্তর পবিত্র মুসলমান ধর্মে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়”। (ঐ; পৃ. ১৭)
এরপর জমিরুদ্দীন সাহেব আর কালবিলম্ব না করে পুনরায় ইসলাম কবুল করেন। এ প্রসংগে তিনি লিখেছেন-
‘আমি যখন খ্রীষ্টান ধর্ম মানিনা, তখন আর সমাজে থাকিব না বলিয়া মিশনারী কার্য পরিত্যাগ ও নিজ বাড়িতে আগমনপূর্বক প্রিয় আত্মীয়-স্বজন সমক্ষে মৌলবী রেয়াজ-উল হক সাহেক কর্তৃক মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হই’। (ঐ; পৃ. ১৯)
এরপর তিনি মেহেরউল্লার সাথে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। শুধু কি তাই! এই সময়ে নিকোলাস পাদ্রী অঘোরনাথ বিশ্বাস রেভারেণ্ড আলেকজাণ্ডার প্রমুখ খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচারকগণ মুনসী মেহেরউল্লার সাথে তর্ক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। জমিরুদ্দীনের পুনরায় ইসলাম গ্রহণের ফলে মেহেরউল্লা একজন বলিষ্ঠ সঙ্গী পেলেন। জানা যায় এই জমিরুদ্দীন সাহেব ইসলাম প্রচারের জন্য ১০৮ খানা পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন। এবং তেরো শতের অধিক খ্রীষ্টান তাঁর প্রচেষ্টায় ইসলাম গ্রহণ করেন। মূলতঃ এ সাফল্যের জন্য বাহবা মুনসী মেহেরুল্লারই প্রাপ্য। কারণ, তাঁরই চেষ্টায় পথভ্রষ্ট জন জমিরুদ্দীন পুনরায় ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে মুনশী মুহম্মদ জমিরুদ্দীনের পরিণত হয়েছিল।
এ ব্যাপারে জমিরুদ্দীনের নিজে লিখেছেন –‘এই সময়ে আমি “রদ্দে খ্রীষ্টিয়ান” পুস্তক ও শ্রীযুক্ত মুনসী মহমম্দ মেহেরউল্লা সাহেব সদৃশ প্রচারক পাইতাম, তাহা হইলে নিশ্চয় খ্রীষ্টান হইতাম না’। (ঐ; পৃ.৩)