মেহেরউল্লার অগ্রযাত্রা
মুনশী জমিরুদ্দীনকে ইসলাম প্রচারে সাথী হিসেবে পেয়ে মেহেরউল্লার গতি যেন ঝড়ের বেগ নিল। তিনি অত্যন্ত উৎসাহের সাথে বিজয়ী মন নিয়ে সভা-সমিতি করে বেড়াতে লাগলেন। এ সময়ে রানঘাট অঞ্চলে পাদ্রীদের ইসলাম বিরোধী প্রচার প্রপাগাণ্ডা ছিল খুব জোরালো। দলে দলে হিন্দু-মুসলমান খ্রীষ্টান হয়ে পড়ছিল। এহেন অবস্থা দেখে ঐ অঞ্চলের মুসলমানগণ প্রমাদ গুণলেন। তারা পাদ্রী দলপতি মনোয়ার বিরুদ্ধে তর্কযুদ্ধ করার জন্য মেহেরউল্লা ও জমিরুদ্দীনকে আহবান জানান। শুনে অবাক হবে। পাদ্রী দলপতি সভায় হাজির হননি। কারণ কিন্তু জানা যায়নি। হয়তবা জুজুর ভয়ে! এখানে যে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘সুধাকর’ পত্রিকার সম্পাদক জনাব মোজাম্মেল হক তার চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন-
“বড়ই বিস্ময় ও ক্ষোভের বিষয়, যিনি মাঠ-ময়দান অতিক্রম করিয়া কষ্ট সহ্য করত; দূরবর্তী কৃষক পল্লীতে যাইয়া খৃষ্টপ্রেম বিতরণ করিতে পারেন তাঁহার এই স্থানে গৃহের সম্মুখে আসা হইল না। সভার চতুর্দিকে বহু পুলিশ প্রহরী এবং বহু হিন্দু ভদ্রলোকের সমাবেশ। পুরোভাগে কতিপয় পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মচারী আসীন। সভার পূর্বপ্রান্তে পশ্চিমাভিমুখী হইয়া বঙ্গ বিখ্যাত ইসলাম প্রচারক বাগ্মী প্রবর মুনসী মহম্মদ মেহেরউল্লা সাহেব ও তেজস্বী বক্তা মুনশী শেখ জমিরুদ্দীন পাঠকরত্ন সাহেব উচ্চাসনে সমাসীন।
মুনসী মহম্মদ মেহেরউল্লা সাহেবের পরিচয় অনেকেই জানেন। প্রথমে মুনশী শেখ জমিরুদ্দীন সাহবে হামদ ও না’য়াত অন্তে বক্তৃতা করেন। ইতি অনর্গল তিন ঘন্টা বক্তৃতা করার পর মুসলমান সমাজের প্রধান বক্তা মুনসী মহম্মদ মেহেরউল্লা সাহেব গাত্রোত্থান করিলেন। ইহার যুক্তিপূর্ণ মধুর বক্তৃতায় শ্রোতাবর্গ অতীব বিমোহিত হইয়াছিল। তাঁহারা কখনো বিস্মিত, ভীত, চমকিত কখনো বা উল্লাসে স্ফীত হইয়া উঠিতে ছিলেন”।
মুনসী মেহেরউল্লা তাঁর অনলবর্ষী বক্তৃতা ও লেখনীর মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর খেদমত করে যাচ্ছিলেন। মেহেরউল্লা ও শেখ জমিরুদ্দীন সাহেব ১৩০৪ সাল থেকে ১৩১৩ সাল পর্যন্ত একত্রে পাবনা, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, চব্বিশপরগণা, যশোর, বরিশাল, নোয়াখালী, ফরিদপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, সিংহল, রাজশাহী, নদীয়া, হুগলী, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি ইত্যাদি জেলা শহর ও মফস্বলের ধর্ম সভায় বক্তৃতা করে বেড়ান।
বক্তৃতা জগতের এই অগ্রদূত মুনসী মেহেরউল্লা জনগণের অন্তরের এত কাছে পৌঁছেছিলেন যে, ১৩০৫ সালের শেষ ভাগে নোয়াখালীর পাদ্রীরা মুসলমানদের কাছে কতকগুলো প্রশ্ন রাখে। জনাব মেহেরউল্লা তাঁর সঠিক উত্তর দেন। এরপর পাদ্রীরা আর এগুতে সাহস পায়নি।
তাঁর নোয়াখালীর সভা-সমিতি সম্বন্ধে জনৈক কবি আবদুর রহিম তাঁর “আখলাকে আহম্মদীয়া” নামক গ্রন্থ মেহেরউল্লার গুণগান গেয়েছেন-
মুনশী মেহেরুল্লাহ নাম যশোর মোকাম।
জাহান ভরিয়া যাঁর আছে খোশ নাম।।
আবেদ জাহান তিনি বড় গুণাধার।
হেদায়েতের হাদী জানো দ্বীনের হাতিয়ার।।
মুল্লুকে মুল্লুকে ফেরে হেদায়েত লাগিয়া।
হিন্দু খৃষ্টান কত লোক ওয়াজ শুনিয়া।।
মুসলমান হইল সবে কলেমা পড়িয়া।
অসার তাদের দ্বীন দিল যে ছাড়িয়া।
তাঁর সাথে আর এক ছিল নেককার
মুনশী শেখ জমিরুদ্দীন জ্ঞানের ভাণ্ডার।।
সে দোনো জাহেদ মর্দ্দ ফজলে খোদার।
তের শথ পাঁচ সাল ছিল বাংলার।
সেই সালের রমজানের ঈদের সময়েতে এসেছিল নোয়াখালি শহর বিচেতে।।
বুঝতেই পারছো, মুনসী মেহেরউল্লা কিভাবে সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাঁর চেষ্টা তদবিরের ফলে কত পথ ভ্রান্ত মানুষ যে পথের দিশা পেয়েছিলেন, তা সত্যিই অবর্ণনীয়। মুনসী সাহেবের কীর্তি গাঁথা তাই গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ফিরত। আসলেই তিনি মুসলমানদের দুর্দিনে সত্যিকার বন্ধুরূপেই তাদের পাশে দাঁড়াতে পেরেছিলেন।
সজাম সংস্কারক মেহেরউল্লা
সমাজের ভিতর কুসংস্কার একটা ব্যাধিস্বরূপ। মুনসী মেহেরউল্লা উপলব্ধি করেন, মুসলিম সমাজেও এ ব্যাধির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এর সমূলে বিনাশ প্রয়োজন। তিনি বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে এগুলো সকলকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন।
এ সম্পর্কে আসির উদ্দীন প্রধান তাঁর একটি সভার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন –‘সভার প্রথম দিন দুই, তিন সহস্র ও দ্বিতীয় দিন তিন চার সহস্রের ওপর লোক সমবেত হইয়াছিল। তৎপর স্বনামধন্য বক্তা বাগ্মী পতন ও উদ্ধার বৃত্তান্ত, এবাদতের গৌরব, জীবনের কর্তব্য কর্ম-ব্যবসা বাণিজ্য, স্ত্রী শিক্ষা, শিক্ষার উপকারিতা, মোক্তব-মাদ্রাসা, স্কুল স্থাপন, শিল্প শিক্ষা, ধর্মগত প্রাণ গঠন, ব্যায়াম চর্চ্চা, সভা সমিতির উপকারিতা, বায়তুল মাল তহবিল গঠন, বাল্য বিবাহের দোষ, অপব্যয়, সমাজ উন্নতির উপায়, ঘোর স্বজাতি আন্দোলন ইত্যাদি বিষয়ে রাত্রি ১২টা পর্যন্ত বক্তৃতা করেন’।
মেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন তাঁর “কর্মবীর মুনশী মেহেরুল্লাহ” গ্রন্থের ৮৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “মেহেরুল্লাহর নানা দিকে উৎসাহ ছিল। তিনি মুসলমান সমাজে ব্যবসা বাণিজ্য প্রচল করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন, উৎসাহ দিতেন কৃষি কাজ করার জন্য। ‘মুসলমান মিঠাই খাইতে জানে, কিন্তু তৈয়ার করিতে জানেনা। পান খাইয়া অজস্র পয়সা নষ্ট করিতে জানে, কিন্তু পানের বরজ তৈয়ার করা অপমানজনক মনে করে’। মুনসী সাহেব মুসলমানগণের মিঠাইয়ের দোকান করিতে, পানের বরজ তৈয়ার করিতে সর্ব স্থানেই উৎসাহ দিতেন। তাঁর চেষ্টা বহুস্থানেই ফলবতী হইয়াছিল”।
ধর্মের নামে যারা ব্যবসা করে তাদেরতিনি মোটেই সহ্য করতে পারতেন না। এই জন্যেই তাঁর বাড়ির কাছাকাছি এক ফকির এসে আস্তানা গাড়লে তিনি তার বিরুদ্ধে ছোট একটা বই লিখে তাকে উঠিয়ে দেন।
শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব
মুনসী মহম্মদ মেহেরউল্লা নিজেই সারাজীবন শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁর জ্ঞান তৃষ্ণা এত প্রবল ছিল যে, তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে বাংলা আসামের অলিতে গলিতে। তার লেখা ও বক্তৃতা থেকেই জানা যায়, ‘বোধোদয়’ পর্যন্ত পড়া মেহেরউল্লা কত বেশী পড়াশুনা করেছিলেন। এই জ্ঞান সাধক কিন্তু নিজে জ্ঞান আহরণ করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি সমাজের মানুষকেও আহবান জানান, “শিক্ষা ব্যতীত জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। যে জাতি শিক্সার প্রতি গুরুত্ব দেয় না আর যাই হোক, সে জাতি সমাজে মাথা উচু’ করে টিকে থাকতে পারে না”। তাই তো দেখি মুনসী সাহেব নিজ গ্রামের পাশেই চুড়ামনকাটিতে একটি মাদরাসা স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে, একজন প্রভাবশালী হিন্দুর বিরোধিতার ফলে তা সম্ভব হয়নি। তোমরা হয়তো মনে করছো মেহেরউল্লা ভেঙ্গে পড়েছিলেন! আসলে মোটেও তা নয়। তিনি তার পাশেই বর্তমানে ক্যান্টনমেন্টের এ্যায়ারফোর্স এলাকার ভেতর মনোহরপুর নাকম স্থানে ১৩০৭ সালে পীর মাওলানা কারামত আলীর নাম অনুসারে “মাদ্রাসায়ে কারামাতিয়া” নামে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। এই মাদ্রাসা স্থাপন করতে গিয়ে মুনসী সাহেবের দারুণ বেগ পেতে হয়। দ্বারে দ্বারে ঘুরে মাত্র ৮৩টি টাকা তিনি সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। অথচ মাদ্রাসা স্থাপবের খরচ হয়েছিল দুইশত টাকারও ওপরে! তিনি ছিলেন মাদ্রাসা কমিটির সেক্রেটারী। বাকী টাকা তিনিই দিয়েছিলেন। প্রতিমাসে এই মাদ্রাসার পিছনে ৪০টাকা খরচ হত। এ টাকাও আজীবন মুনসী সাহেবই দিতেন।
মুসলমানদের দরদী নেতা যখন দেখলেন এ জেলায় হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশী। অথচ মুসলমান শিক্ষিতের সংক্যা শতকরা পাঁচজন হবে না। তখন তার মন কেঁদে উঠলো। তাই তো তিনি স্থাপন করলেন “মাদ্রাসায়ে কারামতিয়া!” ছাত্র সংগ্রহের জন্য তিনি নিজেই ছুটে বেড়াতে লাগলেন বাড়ি বাড়ি। সাধারণ মানুষকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন শিক্ষার গুরুত্ব। তা ছাড়া তাদের লজিংয়েরও ব্যবস্থা করলেন। নিজের বাড়িতেই একাধিক ছেলের থাকার ব্যবস্থা করলেন।
তিনি ছেলেদের পিতাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। মুসলমানেরা অশিক্ষিত হওয়ার কারণে ধূর্ত মহাজন, বরকন্দাজ, নায়েব গোমস্তা, জমিদারগণ তাদের সহজে ঠকাতে পারে। তারা যদি শিক্ষার আলো পাই তাহলে মুসলিম জাতি এই অবস্থা থেকে ইনশাল্লাহ রেহাই পাবে।
ইংরেজদের প্রতি বিদ্বেষের ফল স্বরূপ অল্প শিক্ষিত মৌলবীর ইংরেজী ভাষাতো শিখতেই চাইতো না, সেই সাথে বাংলাকেও অবহেলা করতো। বিজ্ঞ মেহেরউল্লা দেখলেন এটর মোটেই ভাল লক্ষণ নয়। তাই তিনি সাধারণ মানুষকে এব্যাপারে বুঝানোর জন্য জেরা চেষ্টা চালালেন। মুনসী সাহেব তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘মাতৃভাষা বাংলা চালালেন। মুনসী সাহেব তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘মাতৃভাষা বাংলা লেখা পড়ায় তাদের এত ঘৃণা যে, তাহারা তাহা মুখে উচ্চারণ করাই অপমান জনক মনে করেন। এই অদূরদর্শিতার পরিণাম কি সর্বনাশা তাহা ভাবিলে শরীর শিহরিয়া ওঠে। যে দেশের বায়ু, জল, অন্ন, ফল, মৎস, মাংস, দুগ্ধ, ঘৃত খাইয়া তাহাদের শরীর পরিপুষ্ট সে দেশের ভাষার প্রতি অনাদর করিয়া তাঁহারা যে কি দৃশ সর্বণাশের পথ উন্মুক্ত করিতেছে তাহা ভাবিলেও প্রাণে এক ভীষণ আতঙ্ক উপস্থিত হয়”।
তিনি ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে কোন ভাষাকেই ঘৃণা করতেন না। তার প্রমাণ ‘বোধোদয়’ পর্যন্ত পড়া মেহেরউল্লা আরবী, ফারসী, উর্দু, এমনকি ইংরেজীতেও বুৎপত্তি লাভ করেন। কিন্তু বাংলাকে তিনি সমধিক গুরুত্ব দিতেন। কারণ তিনি জানতেন, মাতৃভাষায় কোন জিনিস বোঝা যত সহজ, ভিন্ন ভাষায় তত সহজ নয়। তাই তিনি বাংলায় মিলাদের প্রবর্তন করেন। তাঁর ‘মেহেরুল এসলামে’ লিখিত নবী প্রশস্তি নায়াতে রসূলুল্লাহ, নায়াতে মোস্তফা আলায়হেচ্ছালাম যখন তার সুলোলিত কণ্ঠে উচ্চারিত হতো তখন সবাই ঐ কণ্ঠে কণ্ঠে মিশিয়ে গেয়ে উঠত।
গাওরে মোসলেমগণ নবীগুণ গাওরে
পরাণ ভরিয়া সবে ছল্লে আলা গাওরে
আপনা কালামে নবীর সালামে তাকিদ করেন বারী
কালেবেতে জান কহিতে জবান যে তক থাকে গো-জারী
যে বেশে যে ভেসে যে দেশেতে যাওরে
গাও গাও গাও সবে ছল্লে আলা গাওরে।
হযরত আদম, গোনাতে যে দম বেদম কাঁদিয়াছিল
পাইল রেহাই মোস্তফা দোহাই যে দমে দিয়াছিল
তাই বলি পাপ যদি পাপ ক্ষমা চাওরে
ত্বরা করি প্রাণ ভরি ছল্লে আলা গাওরে।
নূহ পয়গম্বর, হুকুমে আল্লাহর জাহাজ বানান যবে
উপরে তাহার, নাম মোস্তফার নিখিলে ভাসিল তবে
ভব পার যেতে কার বাসনা সে আওরে
হৃদয় জাহাজে লিখে নবী গুণ গাওরে।
খলিলের পেশানীতে নবী নূর, নেশানীতে আলোকিত ছিল হায়।
আহা সেই নূর বলে নমরূদের মহানলে খলিলুল্লাহ মুক্তি পায়।
ওহে ভাই, জাহান্নামে যেতে যে না চাওরে
আজীবন মনে প্রাণে নবীগুণ গাওরে
ফেরেস্তা সইস হয়ে, যাঁহার বোরাক লয়ে আসিল এ দুনিয়ায়
তিনি যে কেমন জন, ভাব হে ভাবুকগণ, তাঁহার মিছিল দিব কায়
বোরাকে ছেরাতে পার যাইতে যে চাওরে
বদম ভরিয়া সেই ছল্লে আলা গাওরে।
কী আনন্দে যে লাফিয়ে উঠলে? আরে হ্যাঁ হ্যাঁ এই তো সেই গজল যে গজল তোমরা, আমরা সবাই বিভিন্ন গজলের বই থেকে সুর করে পড়েছি।
তিনি কিন্তু মিলাদেরও প্রবর্তক ছিলেন। তাহলে তাঁর কণ্ঠেই শোন-
“কোথায় আরব ভূমি, কোথা বা আমি, কোথা তুমি
পাব কি তোমার আমি
মুহম্মদ ইয়া রাসূলুল্লাহ।
সমস্ত জগত মাঝে, তব ডঙ্কা জোরে বাজে
মুহম্মদ ইয়া রসুলুল্লাহ”।
কী হতবাক কেন? তিনি এভাবেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা মুহম্মদুর রসুলুল্লাহ (স) সে ভালবেসেছিলেন এবং নায়েবে রসুল হিসাবে আজন্ম কাজ করে গেছেন।
মেহেরউল্লার ব্যক্তিজীবন
সাদা সিদে সরলমনা একজন মানুষ ছিলেন মুনসী মহম্মদ মেহেরউল্লা। আজকালকার বক্তাদের মত তিনি বাহারে পোষাক কখনই পরতেন না। বলা চলে একেবারে অনাড়ম্বর জীবন যাত্রার বিষয়টা বেছে নিয়েছিলেন। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারেও ছিলেন সাধারণ। বেশী খরচ করাকে তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। অতিথি আপ্যায়নের ব্যাপারে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কিন্তু তিনি কোথাও অতিথি হলে মোটেই বেশী খরচ করতে দিতেন না। বলতেন, ‘আলুর ছানাই যথেষ্ট’।
জীবনে তিনি প্রচুর টাকা পয়সা আয় করেছেন। কিন্তু কৃপণদের মত তা আগলে রাখেননি। সব কিছুই জনহিতকর কাজে লাগিয়েছেন। তোমরা শুনে আশ্চর্য হবে, তাঁর বংশধরদের জন্যেও তিনি কিছুই রেখে যাননি। এ সম্বন্ধে মুনশী শেখ জমিরুদ্দীন “মেহের চরিত” গ্রন্থের ১৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘অপব্যয় কাহাকে বলে তিনি তাহা জানিতেন না। সামান্য পোষাক পরিধান করিতে তিনি বড়ই ভাল বাসিতেন এবং সামান্য আহার করিতেন। দুঃখীদের আর্তনাদ তিনি কখনও সহ্য করিতে পারিতেন না। কেহ কখনও তাঁহার নিকটেকোন বিষয়ে প্রার্থী হইয়া বিফল মনোরথ হয় নাই”।
জানা যায়, জামায়াতে ইমামতীর জন্য তিনি নিজে কখনো এগিয়ে যেতেন না। যদি মনের ভেতর কোন অহংকার এসে যায়, এই ভয়ে। তিনি সব সময় চিন্তা করতেন কিভাবে সমাজের মানুষের মঙ্গল হবে? কিভাবে তারা ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি পাবে?
মোহাম্মদ আছির উদ্দীন প্রধান এ প্রসংগে একটি অত্যন্ত সত্য কথাই বলেছেন।
“সমাজ ও ধর্মোন্ততির মঙ্গল ও সুনাম কামনায় সতত সচেষ্ট থাকিয়া ভাষণ একাগ্রতার দুরুহ দুরুহ বিপদ মস্তকে বহন করিয়া বঙ্গীয় ইসলাম বর্গকে সর্বাঙ্গীন রূপে গৌরবান্বিত করিতে বিশেষ যত্নশীল ছিলেন; শিক্ষা ব্যবস্থা বাণিজ্য, শিল্প ইত্যাদি শিক্ষা করা আমাদের কতদূর যে প্রয়োজনীয় এবং এ দ্বারা কিরূপ মঙ্গল সাধিত হইতে পারে তাহা সভাস্থলে উপস্থিত সভ্যমণ্ডলীকে মর্মে মর্মে বিশেষ রূপে বুঝাইয়া দিয়া তাহার পদানুসরণে দুর্লভ যশ প্রভাব আলোকিত হইতে অশেষ উৎসাহ প্রদান করিতেন। যখন তিনি মুসলমান সমাজের দুর্দশার বিষয় ক্ষোভোদ্দীপক ভাষায় অতিশয় অনুতাপের সহিত ব্যক্ত করিতেন, তখন সভার মধ্যে যেন শোক মহামারী মূর্তিতে সকলের হৃদয়ই অভিভূত হইয়া পড়িত এবং যাহাকে এরূপ পাপ রাক্ষসের কবলে পতিত হইতে না হয় তদ্বিষয়ে বিশেষ সাবধানতাসহ পদক্ষেপ করিতেন”।
মুনসী মেহেরউল্লা পরের দুছখের প্রতি এত কাতর ছিলেন যে একটা ঘটনা থেকেই তাঁর প্রমাণ মেলে। এক অন্ধ ভিখারী কোন এক পথের ধারে সন্ধ্যার পর বাতি জ্বালিয়ে ভিক্ষা করছিলেন কিন্ত কোন দুষ্ট ছেলে এই বাতিটি চুরি করে নিয়ে যায়, ভিখারী এ খবর জানতো না। টের পেল তখনই, যখন পথিক তাঁর শরীরের ওপর চড়াও হলো। ভিখারী ব্যথায় কাঁকিয়ে উঠলো। এমন সময় মুনসী মেহেরউল্লা ঐ পথ দিয়ে চলছিলেন। এহেন দুঃখজনক ঘটনার তিনি নিজেই কেঁদে ফেললেন। তৎক্ষণাত তিনি একটি বাতি সংগ্রহ করে আনলেন। কিন্তু সলিতা পাবেন কোথায়? অগত্যা কোন পথ না পেয়ে নিজের লুঙ্গির খানিকটা ছিঁড়ে সলিতা তৈরী করলেন এবং অন্ধের সামনে আলো জ্বেলে অন্ধকার তাড়ালেন।
এ প্রসংগে আর একটা ঘটনার উল্লেখ করছি এ জন্যেই যে, দুঃখীর দুঃখ তিনি মোটেই সহ্য করতে পারতেন না। মোট কথা তিনি দুঃখীর বন্ধু ছিলেন –একদিন নিজ গ্রাম ছাতিয়ানতলার একটি বালক কূপের ভেতর পড়ে যায়। এ দৃশ্য দেখে মানব দরদী মুনসী সাহেব তাকে বাঁচানোর জন্য কূপের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়েন। অতিকষ্টে বালকটি উদ্ধার করেন এবং অন্যের সাহায্যে নিজেও উদ্ধার পান।
বুঝতেই পারছো মেহেরউল্লা কেমন দরদী ছিলেন, তোমরা বড় হলে এমন অনেক ভাল কাজ করবে নিশ্চয়?
ব্যক্তি জীবনে তিনি একনিষ্ঠ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু বিদ্বেষী বা বিধর্মী বিদ্বেষী ছিলেন না। তাঁর সমস্ত সভাসমিতিতে অগণিত হিন্দু খৃষ্টানের সমাগত হত। এ প্রসংগে হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন বলেছেন, “১৩০৮ সালের ২৮শে মাঘ তারিখে রংপুর টাউনে একটি বিরাট সভার অধিবেশন হইয়াছিল। ঐ সভায় হিন্দু মুসলমান সহস্র সহস্র ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। মুনসী সাহেব মরহুম ঐ সভায় গো হত্যা সম্বন্ধে একটি সুন্দর বক্তৃতা করেন। বক্তৃতা শুনিয়া উপস্থিত হিন্দুর পর্যন্ত মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার বক্তৃতা অন্তে স্থানীয় পণ্ডিত মহামহোপাধ্যয় শ্রীযুক্ত যাধবেশ্বর তর্করত্ন মহাশয় গলায় গলা মিলাইয়া তাঁহার শত শত প্রশংসা করিয়াছিলেন”।
মেহেরউল্লার উপস্থিত বুদ্ধি
সদা কৌতুকপ্রিয় মুনসী মোহম্মদ মেহেরউল্লা অনেক পাদ্রী এবং হ্নিদুদের প্রশ্নের এমনি জবাব দিতেন যে এক পক্ষ উল্লাসে ফেটে পড়তো আর অপর পক্ষ মাথা নীচু করে বসে থাকত। কোন স্তানে সভা হবে এবং সেখানে মুনসী মোহম্মদ মেহেরউল্লা আসবেন এমন সংবাদ পেলে হিন্দু, মুসলমান এবং খ্রীষ্টানগণ সেখানে দলে দলে যোগদান করতেন। যেমন বর্তমানে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন কোন বক্তা আসলে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়ে থাকে। এমনি ধরনের সভাগুলোতে অনেক সময় মুনসী সাহেবের নিকট উদ্ভট প্রশ্নের বাণ ছোড়া হতো। মুনসী মেহেরউল্লার কনিষ্ঠপুত্র আলহাজ্ব মুনসী মোখলেসুর রহমানের ভাষায় এ প্রশ্নগুলো ছিল “মেঠো প্রশ্ন”। আর উত্তরও অনেক সময় সেই রকমই হতো। বর্তমানে এ প্রশ্ন-উত্তরগুলো যশোর জেলার পল্লীতে গল্পের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারই দু’একটা তোমাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব।