ভূতদের মিলাদ মাহফিল
একবার ভূতেরা এ সিদ্দান্তে পৌঁছালো যে, তারা এখন থেকে বিভিন্ন পর্ব বা উৎসব উপলক্ষে মুসলমানদের মত মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করবে। এরা একটা প্রকাণ্ড মাঠে বাস করতো। কিন্তু এদের মিলাদ মাহফিল পড়ানোর মত কোন মৌলবী বা মাওলানা ছিল না। এ জন্য তারা নিকটস্থ মুসলমান পাড়ার মৌলবী সাহেব দিয়ে তাদের মিলাদের কাজ সারবে এ মনস্থ করলো এবং কিছু ভূত মৌলবী সাহেব কে দাওয়াত দেয়ার জণ্যতার বাড়িতে গিয়ে হাজির হল।
স্বশরীরে ভূতদেরকে তার বাড়িতে হাজির হতে দেখে মৌলবী সাহেবের চক্ষু তো চড়ক গাছ। মুখ থেকে কথা ফোটে না এ অবস্থ। কোন রকম সাহস করে তাদের আগমনের হেতু জানতে চাইলেন। সব কথা শুনে মৌলবী সাহেবের অবস্থা আরো কাহিল। বুঝি মৃত্যু পরওয়ানা তার সামনে। তবে মৌলবী সাহেব ছিলেন বেশ বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি তাদেরকে বলেন, তোমাদের জাতীয় উন্নতির জন্য, কল্যাণের জন্য মিলাদ মাহফিল করবে এত আনন্দের কথা। এতদিন পরে তোমাদের যে সুমতি হয়েছে এ জন্য রাব্বুল আলামীনের দরবারে লাখো শোকরিয়া। কিন্তু কথা হলো আমি কার দাওয়াতে যাব?
সংগে সংগে সব ভূত একযোগে বলল –আমি! আমি!
মৌলবী সাহেব স্মিত হেসে বললেন –দেখ বাবা সকল, মিলাদ মাহফিল বা ওয়াজ মাহফিল যাই কর না কেন তার একটা সিস্টেম তো আছে? একটা কমিটি থাকবে, তার সভাপতি, সেক্রেটারী থাকবে। অবশ্য তোমরা সবাই ‘আম’ভাবে এ কমিটির সদস্য হতে পার। এখন কথা হল, তোমরা যদি মিলাদ মাহফিল করতে চাও তাহলে এখনই গিয়ে একটা কমিটি কর এবং কে আমাকে দাওয়াত দিতে আসবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নাও। এরপর তিনি এসে দাওয়াত দিলে আমি অবশ্যই মিলাদ মাহফিলে উপস্থিত হব।
ভূতেরা ফিরে গিয়ে সমস্ত ভূতকে মাঠের একদিকে জড়ো করলো এবং মৌলবী সাহেবের সব কথা বলল। সব কথা শোনার পর সভায় হুলস্থুল পড়ে গেল, সবাই সভাপতি অথবা সেক্রেটারী হতে চায়। এমনকি কমিটির সদস্য পর্যন্ত কেউ হতে রাজী নয়। প্রথমে কথা কাটাকাটি, এরপর হাতাহাতি, কিল, চড়, লাথি, দুমাদুম শুরু হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত প্রলয়কাণ্ড ঘটে গেল, রক্তের নদী বয়ে গেল, আশপাশের গাছ-গাছালিগুলোও রেহাই পেলো না। সব পড়লো মুখ থুবড়ে। ভয়াবহ ধ্বংসলীলা বলা যায়। এলাকার ভূতের বংশ ঐ দিনই গেল ধ্বংস হয়ে।
মেহেরউল্লা সাহেব এ গল্পের মাধ্যমে আমাদেরকে বুঝাতে চেয়েছেন, সবাই নেতা হতে চাওয়ার পরিণাত কত ভয়াবহ অর্থাৎ প্রকৃত নেতার অভাব হলে দেশের অবস্থা কি হতে পারে?
বিভেদের কুফল
গল্পটি হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন তার ‘কর্মবীর মুনশী মেহেরুল্লাহ’ গ্রন্থে মুনসী সাহেবের বলা বলে উল্লেখ করেছেন। এখানে গল্পটি হুবহু হবিবর রহমান সাহেবের ভাষায় উল্লেখ করছি, “একজন ব্রাহ্মণ, একজন নমঃশূদ্র এবং একজন মুসলমান এক মুসলমানের ইক্ষু ক্ষেতে গিয়া ইক্ষু চুরি করিয়া খাইতেছিল। হঠাৎ কৃষক ইহাদিগকে দেখিতে পাইয়া ভাবিল, সে একাকী ইহাদের সহিত পারিয়া উঠিবে না। অতএব ইহারা যাহাতে একতাবদ্ধ হইতে না পারে তজ্জন্য এক কৌশল অবলম্বন করিল। সে বলিতে লাগিল, ব্রাহ্মণ হিন্দু জাতির দেবতা স্বরূপ, তিনি আমার ভূঁইয়ের একখানা ইক্ষু খাইয়াছেন, সে ত আমার সৌভাগ্য। মুসলমান আমার জাত ভাই, তিনি যদি আমার সামান্য ইক্ষু খাইয়া থাকেন, তাহাতেই বা আমার এমন কি ক্ষতি হইয়াছে? কিন্তু বেটা নমঃশূদ্র, ছোট লোক, তুই কেন আমার ইক্ষু খাইলি? এই বলিয়া সে নমঃশূদ্রকে প্রহার করিতে করিতে আধমরা করিয়া ফেলিল।
এতক্ষণ ব্রাহ্মণ ও মুসলমানটি দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া তামাসা দেখিতেছিল। এখন ভূঁই অলা ব্রাহ্মণকে বলিল, বেটা চোর, ছুঁচো, তুই হিন্দুর বামন, আমার কি? ইনি আমার স্বজাতি, ইহাকে নয় ক্ষমা করিতে পারি। তোকে উচিত শিক্ষা না দিয়া ছাড়িব না। এই বলিয়া সে ব্রাহ্মণকে ভীষণভাবে প্রহার করিতে লাগিল। এতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানটি আনন্দে ও গৌরবে হাসিতেছিল।
এখন কৃষক ব্রাহ্মণকে আচ্ছা করিয়া উত্তম-মধ্যম দিয়া সহসা মুসলমানটির গলা ধরিয়া বলিল, বেটা বেঈমান, চোর-বদমাইশ। তুই মুসলমান হইয়া চুরি করিস? এই বলিয়া তাকে পিটাইতে পিটাইতে আধমরা করিয়া ফেলিল”।
এখানে উল্লেখ্য যে, এ কাহিনীর অধিকাংশই কবি হাবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন তাঁর –‘ভূতের বাপের শ্রাব্ধ’ নামক শিশুতোষ কাব্যে মুনসী মেহেরউল্লাহর বলা গল্প বলে উল্লেখ করেছেন।
সাহিত্যিক মেহেরউল্লা
আমাদের দেশে ইসলা প্রচার হয়েছিল মূলত ব্যবসায়ী ও পীর, ওলী, দরবেশদের মাধ্যমে। আরব বংশজাত মুসলমান এদেশে খুব সামান্যই এসেছিলেন। আর সেই উপলক্ষ্যেই ভারত বর্ষে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু সেটা কোনদিনই ইসলামের পূর্ণাঙ্গরূপ নিয়ে প্রচারিত হতে পারেনি। ফলে বিধর্মীদের অনেক রকম রেওয়াজ আমাদের মধ্যে পুরোপুরি ভাবেই প্রচলিত থেকে গেছে। ইংরেজ শাসনের পূর্বে মুসলমানরা এদেশ সাত’শ বছর শাসন করলেও ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রতিভাত হয়নি।
বাংলার স্বাধীনতা সূর্য ডুবে যাওয়ার পর বহুবার বহু আন্দোলন হয়েছে। এর মধ্যে হযরত সাইয়েদ আহম্মদ বেরেলভী, শাহ দেহলভী, হযরত শাহ ইসমাইল, শহীদ শাহ ওয়ালিউল্লাহ, শহীদ তীতুমীর প্রমুখ মুজাহিদগণ এ আন্দোলনের হোতা ছিলেন। তাঁরা চেয়েছিলেন, আল্লাহর যমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা হোক। কিন্তু তা’না হলেও যুগে যুগে এ আন্দোলন মুসলমানদের মনে ধীরে ধীরে জ্বলে ওঠে, এরই বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই ইসলামী রেনেসাঁর অগ্রসেনানী মুনসী মেহেরউল্লার ভেতর।
তিনি সাহিত্য সৃষ্টি করলেও সাহিত্যের জন্যে তিনি তা করেননি। তিনি করেছেন অধঃপতিত মুসলিম সমাজকে তাদের স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য। তাদের ভেতর যে খোদাদ্রোহী শেরকী রসম রেওয়াজ প্রতিষ্ঠিত ছিল, তা দূর করার জন্য। ধর্মের নামে যে সমস্ত অধর্ম ইসলামের ভেতর ঢুকে পড়েছিল, তা’দূর করার জন্য। সব চেয়ে বড় কথা, পাদ্রী ও হিন্দুদের অপপ্রচার থেকে মুসলমানদের রক্ষার জন্যই তিনি সাহিত্য প্রেরণায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করেন। তবুও তাঁরসৃষ্ট সাহিত্যের ঐতিহাসিক ও সামাজিক মূল্য অস্বীকার করার মত নয়।
তাঁর প্রকাশিত পুস্তকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য
১। খ্রীষ্টীয় ধর্মের অসারতা (১৮৮৬)
২। মেহেরুল এসলাম বা এসলাম রবি (১৮৯০)
৩। রদ্দে খ্রীষ্টান ও দলিলোল এসলাম (১৮৯৭)
৪। বিধবা গঞ্জনা ও বিষাদ ভাণ্ডার (১৮৯৮)
৫। হিন্দু ধর্ম রহস্য ও দেবলীলা (১৮৯৮)
৬। পান্দনামা (১৯০৮)
৭। সাহেব মুসলমান (অনুবাদ, ১৯০৯)
৮। খ্রীষ্টান মুসলমান তর্কযুদ্ধ (১৯০৮)
৯। বাবু ঈশানচন্দ্র মণ্ডল এবং চার্লস ফ্রেঞ্চের এসলাম গ্রহণ
এবার বইগুলি সম্বন্ধে সামান্য আলোচনার চেষ্টা করবো-১৮৮৬ ঈসায়ী সালে ‘খ্রীষ্টীয় ধর্মের অসারতা’ বইটি প্রকাশিত হয়। মাত্র ১৬ পৃষ্ঠার একটি ছোট বই এটি। এই বইতে খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচারকের তিনি তীব্র নিন্দা করেছেন। ত্রিতত্ববাদের অলীকতা ও বাইবেলের অসারতা তিনি সুন্দরভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। বইটির সাহিত্যিক মূল্য নেই বললেই চলে।
মুনস সাহেবের দ্বিতীয় বইটি হলো মেহেরুল এসলাম, যেটি বহুল প্রচারিত। চৌত্রিশ বছর বয়সের মেহেরউল্লা এ গ্রন্থে হিন্দু ও খ্রীষ্টানদের মূল ধর্ম বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত বলে দেখিয়েছেন।
এই গ্রন্থে মেহেরউল্লা ব্রাহ্ম সমাজ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন-
“হিন্দুদিগের মধ্য হইতে স্বনামখ্যাত রাজা রামমোহন রায় আরবী, ফারসী ভাষা শিক্ষা করিয়া পবিত্র এসলাম ধর্মশাস্ত্র আলোচনা পূর্বক প্রচার করেন। তাঁহার মতাবলম্বী ব্রাহ্ম সম্প্রদায় মুসলমান জাতির অনেকটা কাছাকাছি”।
গ্রন্থের অপর অংশে মুসলমানদের প্রাথমিক মৌলিক দায়িত্ব নামাজ, রোজা, প্রভৃতি সম্বন্ধে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন।
তিনি বাউল ফকির ও কবি গানের গায়কদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা প্রকাশ করেছেন।
তাদের জানাজা পড়া উচিৎ নয় এমন মন্তব্যও করেছেন। তাদের সম্বন্ধে তিনি বলেছেন –‘হে গাইনগণ তোমরা নিজেও ডুবিলে পরকেও ডুবাইলে। তোমাদের নিজের গান মৃত্যুকালে কোন কাজে আসিবেনা’।
এ গ্রন্থে তিনি গায়ক ও সুদ গ্রহণের তীব্র নিন্দা করেছেন।
এই প্রসঙ্গে ডঃ আনিসুজ্জামান বলেছেন-
“এখানে দেখা যায় যে, মেহেরউল্লা ইসলামকে কেবল খৃষ্ট ধর্মবলম্বীর আক্রমন থেকে রক্ষা করতে চাননি, প্রচলিত ধর্ম জীবনের সংস্কারও তাঁর কাম্য ছিল। সৈয়দ আহম্মদ বেরেলভির সংস্কারান্দোলন তাঁকে প্রভাবান্বিত করেছিলো এমন ধারণা করা স্বাভাবিক। সৈয়দ আহমদ পন্থীরা মুসলশানদের প্রচলিত জীবন ধারা থেকে অনেক কুসংস্কার দূর করতে যেমন শিক্ষা দিয়েছিলেন, তেমনি তাঁদের রক্ষণশীলতা আধুনিক জীবন যাত্রার সঙ্গে কোন আপোষ করতে দেয়নি। অনুরূপভাবে মেহেরউল্লা যেমন আমাদের চিন্তাধারা এবং সঙ্গীত প্রভৃতি সুকুমার শিল্পের বিকাশকে প্রশ্রয় দেননি। তা’ছাড়া এ কথাও মনে রাখতে হবে উনিশ শতকে নৃত্য গীতের বিশুদ্ধ চর্চার চাইতে তার আনুষঙ্গিক উচ্ছৃঙ্খলতার চর্চাই আমাদের দেশে বিস্তার লাভ করেছিল”। (মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, পৃ-৩৫০)
“বিধবা গঞ্জনা” মেহেরউল্লার একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ। এ গ্রন্থে মুনসী সাহেব হিন্দু বিধবাদের পূর্ণবিবাহের জন্য সুপারিশ করেছেন। তিনি বিধবা জীবনের দুঃখ কষ্টের কথা অত্যন্ত সহানুভূতির সাথে তুলে ধরেছেন। রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরকে তিনি স্বাগত জানিয়েছেন বিধবা বিবাহের অনুমোদনের জন্য। এই কথা থেকে আমরা অম্লান বদনে বলতে পারি যে, তিনি শুধু নিজের ধর্মেরই সংস্কার সাধন করতে চাননি তিনি অন্যান্য ধর্মের কুসংস্কারও দূর করতে চেষ্টা করেছেন। মেহেরউল্লা নিজেই লিখেছেন ‘আমি বিবিধ উপায়ে বিধবা হৃদয়ের বিষোদোক্তি সমূহ যত দূর অবগত হইতে পারিয়াছি, সরল সহজ এবং সাধারণ ভাষায় প্রকাশ করিতে যথাশক্তি প্রয়োগ পাইলাম। এমন কি স্থান বিশেষে সাধারণ মেয়েলী ভাষা ব্যবহার করিতেও লজ্জা বোধ করি নাই”।
এ গ্রন্থে তিনি সুললিত গদ্য ও স্থানে স্থানে পদ্য ছন্দে বিধবা জীবনের করুণ চিত্র উৎঘাটিত করেছেন।
বঙ্কিম চন্দ্রের ‘মৃণালীনী’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘রাজ সিংহ’ ও ‘কবিতা পুস্তক’, ইশ্বর গুপ্তের ‘কবিতা সংগ্রহ’ দামোদর মুখোপাধ্যয়ের ‘প্রতাপসিংহ’ যজ্ঞেশ্বর মুখোপাধ্যয়ের বঙ্গানুবাদিত ‘রাজস্থান’ দীন বন্ধু মিত্রের ‘জামাই বারিক’ ইত্যাদি ইসলাম বিদ্বেষী গ্রন্থের প্রতিবাদে মুনসী মেহেরউল্লা তাঁর ‘হিন্দু ধর্ম রহস্য ও দেবলীলা’ বইটি লেখেন। বইটিতে কিছু অশ্লীল কিদ (যা হিন্দুদের ভেতর প্রচলিত) থাকার কারণে সরকার কর্তৃক এর প্রচার নিষিদ্ধ হয়। আসলে তিনি হাভারত, পদ্ম পুরাণ ও ব্রহ্মা কৈবর্ত পুরাণ থেকে হিন্দু দেবদেবীদের রঙ্গরস সম্বন্ধে নীতিহীনতার উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, যে সমাজ চন্দ্র সূর্য ও ধর্ম উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, যে সমাজ চন্দ্র সূর্য ও ধর্ম এবং কুন্তী গঙ্গা ও তুলসীর মতো দেব-দেবীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল তারা আর যাই হোক নীতি জ্ঞানের ক্ষেত্রে যে একেবারে ডাস্টবিনে অবস্থান করছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।
উক্ত গ্রন্থখানি তৎকালীন হিন্দু সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও সমালোচিত হয়। পত্র পত্রিকায় মেহেরউল্লাকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করা হয়। পুস্তকের (৬ষ্ঠ সংস্করণে) উপক্রমণিকাতে মেহেরউল্লা এই আক্রমণের জবাব দিয়েছেন, ‘হিন্দুদের উচ্চ হইতে নিম্ন শ্রেণীর গ্রন্থ লেখকগণ শতাধিক বৎসর পর্যন্ত পবিত্র এসলাম ধর্ম ও সমাজকে যত প্রকার কলুষিত চিত্রে চিত্রিত ও পৈশাচিক বিশেষণে বিশেষিত করিয়া আসিতেছেন, কে তাহার ইয়াত্তা করিতে সক্ষম হইবেন। তাহার সম্পূর্ণ অন্যায় বিদ্বেষ বুদ্ধি পরিচালিত হইয়া অকারণে মুসলমানদিগকে যবন, ম্লেচ্ছ, পাষণ্ড, পাতকী, পাপিষ্ট, পাপাত্মা, দুর্দান্ত, দুরালয়, নরাধম, নরপিশাচ, বানর, নেড়ে, দেড়ে, ধেড়ে, এড়ে, অজ্ঞান এবং অকৃতজ্ঞ ইত্যাদি অসংখ্য কদর্য আখ্যায় আখ্যায়িত পূর্বক অসীম আনন্দ ভোগ ও আত্মযোগ সমাধা করিয়া থাকেন; কিন্তু কৈ কোন মুসলমান কবে তাহাদের তাদৃশ ভোগের বাধা জন্মাইয়া চরকরীর ন্যায় ফর ফর করিয়াছেন? …..ন্যায়ের সাক্ষাৎ মূর্তি মাতা ভিক্টোরিয়ার রাজ্যে বাস করিয়া, ঈদৃশ মিথ্যা ও অন্যায়বাদিগণকে কোনও ন্যায় বিচারে পতিত হন নাই ইহাই আক্ষেপের বিষয়’। (মুস্তফা নুরুল ইসলাম কর্তৃক উদ্ধৃত মুনসী মহম্মদ মেহেরুল্লাহ পৃ-১৮)
উক্ত পুস্তকের ষষ্ট সংস্করণের উপক্রমণিকাতে লেখক বলেছেন, ‘জগতে হিন্দুর ন্যায় কল্পনা প্রিয় জাতি অতি বিরল, তাহারা সনাতন অনাদি অনন্ত পবিত্রময় খোদা তায়ালাকে বিস্মৃত হইয়া নানাবিধ অসার ও কাল্পনিক দেব-দেবীর, মাঠ-ঘাট, প্রস্তর, বৃক্ষ, পশু-পক্ষী এবং শিব লিঙ্গ ইত্যাদির পূজা উপাসনা করিয়া দুর্লভ মানব জীবনটির অপব্যয় করিতেছেন। আমরা তাহাদিগেরই জানিত, মানত ধর্ম গ্রন্থ সকল হইতে দেব ও দেবী কাহিনী এবং বিভিন্ন বিষয় সংগ্রহ করতঃ প্রকাশ করিলাম। যদি ইহা দ্বারা একটিমাত্র জড় বা নর পূজাকর মনও সেই সত্যময় খোদাতায়ালার দিকে আকৃষ্ট হয়, তাহা হইলেও আমাদের প্রমত্ত জীবন সার্থক হইবে’।
আসলে কি জান? বাগ্মী কুলতীলক ইসলাম প্রচারক মুনসী মহম্মদ মেহেরউল্লার মনের একান্ত ইচ্ছা ছিল-
কর কর কর সবে সত্য ধর্ম অন্বেষন
অসার অলীক ধর্ম দাও দাও বিসর্জন।
‘হিন্দু ধর্ম রহস্য ও দেব লীলা’ বইটি সপ্তম সংস্করণ বের হলে হিন্দুদের গায়ে জ্বালা চড়ে যায়। তারা এই বইটি ও ‘বিধবা গঞ্জনা’ বইটি বাজেয়াপ্ত করার জন্য এবং প্রকাশককে শাস্তি প্রদান করার জন্য মোকদ্দমা দায়ের করেন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে ঐ সশয় যশোর কোর্টে কোন মুসলিম উকিল ছিলেন না। বইটিতে গ্রন্থকারের নাম দেওয়া হয় আবূ আল মুনসুর এম এম ইউ (মুনসী মেহেরুল্লাহ)। বিচারক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট শ্রীমন্ত কুমার দাস গুপ্তের অধীনে মুনসী মেহেরউল্লাহর জ্যেষ্ঠ পুত্র মনসুর আহমদ তাঁর পক্ষে উকিল নিযুক্ত করেন বাবু কেশব লাল রায় চৌধুরীকে। সরকারের পক্ষে উকিল ছিলের রায় বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার। ২৪শে মে ১৯০৯ সাল বিচারের রায় বের হয়। রায়ে মনসুর আহমেদের দু’শ টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের জেলের আদেশ হয়। তিনি জজ কোর্টে আপীল করেন। আপীল বাতিল হয় ২৮শে জুলাই ১৯০৯ সালে। বিচারক রায় বহাল তো রাখেনই উপরন্তু এরূপ মন্তব্য করতেও কুণ্ঠিত হলেন না যে, তাঁর আরো কঠোর সাজা হওয়া উচিতৎ ছিলো। অতএব বই দু’খানি বাজেয়াপ্ত হয়। বন্ধুগণ বুঝতেই পারছো মুসলমানদের দুর্দশার কথা। জজ সাহেবের রায়ের হুবহু বঙ্গানুবাদ নিম্নে দেওয়া হলো-
আপীল গ্রহণকারী আদালত কর্তৃক রায়ের শুনানী দায়রা আদালত আপীলের আওতাধীন। ২৮শে জুলাই ১৯০৯সাল।
যশোর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বাবু শ্রীমন্ত কুমার দাস গুপ্তের ২৪শে মে ১৯০৯ সালের আদেশের উপর আপীলের প্রার্থনা। মনসুর আহমেদ আপীলকারী দণ্ডাদেশ টাকা ২০০ (দুইশত টাকা) জরিমানা অনাদায়ে ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৩ ধারানুসারে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ফৌজদারী কার্য বিধির ৫২১ ধারানুসারে আসামীর দখলে রক্ষিত “বিধবা গঞ্জনা” এবং “হিন্দু ধর্ম রহস্য” পুস্তকের আপীলকারীর পক্ষে উকিল। রায় বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার বাহাদুর, সরকারী পক্ষের উকিল। বিচারের রায়-
আপীলকারীকে ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৩ ধারানুসারে “হিন্দু ধর্ম রহস্য ও দেব লীলা” এবং “বিধবা গঞ্জনা ও বিষাদ ভাণ্ডার” নামক দু’খানি বই এর জন্য বিচার করা হয়েছে এবং দু’শ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
আপীলকারীর পক্ষের উকিল ঐ পুস্তকদ্বয় অশ্লীল কিনা তা আমাকে বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করেছেন। এই অনুরোধে অবশ্য আমি বিস্মিত হয়েছি। যে কোন ব্যক্তি বই দু’খানি পড়া মাত্রই বুঝতে পারে যে, কি জঘন্য ভাবে অশ্লীল ঐ বই দুখানি বিশেষ করে ‘বিধবা গঞ্জনা’ নামক বই খানি। যুক্তি দেখানো হয়েছে যে, ‘হিন্দু ধর্ম রহস্য’ নামক বই খানি ধর্মীয় বিতর্কের বই এবং তাতে কেবল মাত্র হিন্দু ধর্ম গ্রন্থে যে সকল ঘটনার উল্লেখ্য আছে তাহাই উদ্বৃত করা হইয়াছে। একমাত্র ভূমিকা থেকেই বোঝা যায় যে, বইখানি ধর্মীয় বিতর্কের বইনয় বরং প্রতীয়মান হয় যে, কিছু হিন্দু লেখক মুসলমানদেরকে অপমানিত করেছেন মনে করে নিয়ে লেখকের হিন্দুদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করার ইচ্ছা প্রবল ছিল। সে যা হোক, যে বইতে ভিন্ন ধর্মের ধর্ম গ্রন্থ থেকে কতকগুলো অশ্লীল অংশ সংকলন করে ধর্মীয় বিরোধ প্রমাণ করা হয়েছে তা স্পষ্টতঃ একটি অশ্লীল প্রকাশনা। ‘বিধবা গঞ্জনা’ নামক অপর বইখানি সম্বন্ধে বলতে হয় যে, এই বইখানিতে যে সমস্ত সাংঘাতিক রকমের অশ্লীলতা দেখা যায়, তাঁর সাথে প্রতিপাদ্য বিষয়ের অর্থাৎ বিধবাদের পূনঃ বিবাহের বাঞ্ছনীয়তার সামান্যতম বা কোন সংযোগ নেই।
নিম্ন কোর্টের সুযোগ্য বিচারকের বিচারে সমস্ত বিষয়টি সম্পূর্ণ রূপে আলোচিত হয়েছে এবং তাতে আমার কিছু যোগ করার নেই।
আসামীর কাছে যে ঐ পুস্তকগুলি বিক্রয়ের জন্য আছ তা স্বীকৃত সত্য। তবুও যুক্তি দেখানো হয়েছে যে, আসামী বয়সে তরুণ এবং সে তার পিতার লিখিত এবং বিক্রয়ের জন্য রক্ষিত পুস্তক বিক্রয় করছিল মাত্র। কিন্তু আমি দেখছি দু’খানি পুস্তকের মধ্যে একখানি মাত্র তার পিতার লিখিত এবং আসামী উভয় পুস্তকই প্রকাশ করেছে (উভয় পুস্তকের প্রচ্ছদ দ্রষ্টব্য)। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি যে, আসামীকে কোন রূপ শাস্তি না দিয়ে বরং লঘু শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
আপীলের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হল।
তারিখ-২৮.৭.০৯ ঈসায়ী
স্বাঃ/এল পালিত
দায়রা জজ।
(মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ –শাহাদাত আলী আনসারী পৃঃ স-২৩)
বন্ধুরা বুঝতেই পারচো মুসলমানদের অবস্থা সে সময় কেমন নাজুক ছিল।
মুনসী মেহেরউল্লার ‘পান্দনামা’ বইটি হলো বিশ্ববিখ্যাত পারস্য কবি শেখ সা’দীর ফারসী কাব্যগ্রন্থ ‘পান্দনামা’র বঙ্গানুবাদ। এই বইটিতে ফারসী ও বাংলা অক্ষরের মূল কাব্যের সঙ্গে পদ্যের অনুবাদ আছে। এটি ১৯০৮ সালে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
সংস্কৃতিতে লিখিত একেশ্বরবাদ সম্পর্কে “শ্লোকমালা” গ্রন্থটি শ্লোক সমূহের সংকলন। ১৯১০ সালে এ গ্রন্থটি প্রকাশ পায়। “খ্রীষ্টান মুসলমান তর্কযুদ্ধ” মুনসীজির অন্য একটি গ্রন্থ। পাদ্রীদের প্রচারের বিরুদ্ধে এই এই এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি তর্ক করতে পারতেন প্রচণ্ড বিক্রমে। তিনি কখনো যুক্তি তর্কে হেরেছেন এমন নজীর আমাদের জানা নেই।
“রদ্দে খ্রীষ্টান ও দলিলোল এসলাম” তাঁর অপর একটি গ্রন্থ কিন্তু এই বইটি পুরোপুরি তিনি জীবিত অবস্থায় ছাপার অক্ষরে দেখে যেতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর পর এটি প্রকাশিত হয়।
“বাবু ঈশান চন্দ্র মণ্ডর এবং চার্লস ফ্রেঞ্চের এসলাম গ্রহণ” তার লিখিত আরও এককানি গ্রন্থ। তাছাড়া ‘আসল বাঙালা গজল’ নামক একটি বাংলা গজলের বই ১৯০৮ সালে মুনশী মুহম্মদ জমির উদ্দীন প্রকাশ করেন। এতে মুনস মহম্মদ মেহেরউল্লা লিখিত দু’টি গজল ছিল।
এই ছিল আজকের আলোচ্য সৈনিক মুনসী মহম্মদ মেহেরউল্লার সাহিত্য কর্ম।
সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা
মুনশী মেহেরউল্লা তাঁর প্রতিভাকে নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি। তিনি ছিলেন বাংলার অন্যতম সমাজ সেবক। তাইতো নিজে সাহিত্য অনুরাগী ও সাহিত্য সেবক হওয়ার সাথে সাথে আরও তরুণ সাহিত্যিক সৃষ্টির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। যে সময়কার কথা বলছি মুসলমানরা সে সময় প্রচণ্ড অবজ্ঞার পাত্র ছিল। মুসলমানদের ভেতর সাহিত্যিক খুঁজে পাওয়া একটা কষ্ট সাধ্য ব্যাপার ছিল। ঠিক সেই সময়ই বাংলার অদ্বিতীয় বক্তা মুনসী মহম্মদ মেহেরউল্লা এগিয়ে এলেন। যখন মুসলমানদের মধ্যে কবি সাহিত্যিক একদম বিরল ছিল সেই সময় তাঁরই উৎসাহ উদ্দীপনায় মৌলানা মুহম্মদ আকরাম খাঁ, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, শেখ ফজলল করীম, শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন সাহিত্য ক্ষেত্রে আগমন করলেন। তার ফলশ্রুতিতে পেলাম দৈনিক আজাদের মত পত্রিকা, মোস্তফা চরিত, অনল প্রবাহ, পরিত্রাণ –এরমত গ্রন্থ। আজাদ এখনো জাতীয় জীবনে বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছে। জানা যায়, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ‘অনল প্রবাহ’ ও ফজলল করীমের ‘পরিত্রাণ’ এবং শেখ মোহাম্মদ জমিরুদ্দীনের ‘আমার জীবনী ও ইসলাম গ্রহণ বৃত্তান্ত গ্রন্থ তিনটি তাঁরই খরচে প্রকাশিত হয়।
বুঝতেই পারছো, তরুণ সাহিত্যিকদের তিনি কিভাবে উৎসাহিত করতেন।
তাঁর স্বল্পকালীন জীবনে তিনি প্রতিটি মুহুর্ত ব্যয় করে গেছেন নির্যাতিত নিষ্পেষিত মুসলমানদের জন্য। তিনি যা করে গেছেন আজকের সমাজ তাঁর সে কাজের স্বীকৃতি দিচ্ছে। সাহিত্যে অবদানের জন্য তাঁকে সাহিত্যিকের মর্যাদা দিচ্ছে। আসলে, তিনি নিজেই তাঁর অধিকার আদায় করে নিয়েছেন।
সংগঠক মেহেরউল্লা
মুনসী সাহেব একজন দক্ষ সংগঠকও ছিলেন। পিছিয়ে পড়া মুসলিম জাতিকে পুনরায় তাদের স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনতে হলে বিভিন্ন সংগঠন, সমিতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি যে অপরিহার্য তা তাঁর উর্বর মস্তিষ্কে ঠিকই ঢুকেছিল। তিনি বুঝেছিলেন সভা-সমাবেশের বক্তৃতা ও পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, পুস্তক-পুস্কিতা প্রকাশের পাশাপাশি সংগঠন, সমিতি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা একান্ত প্রয়োজন। আর তা’হলেই তাঁর এ সংস্কার আন্দোলন ও ইসলাম প্রচারের কাজ সঠিক অর্থে হালে পানি পাবে।
এসলাম ধর্মোত্তেজিকা
ইসরামের প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি যশোরে ‘এসলাম ধর্মোত্তেজিকা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের এক বিশেষ অধিবেশনে কলিকাতা থেকে শেখ আবদুর রহিম, মৌলভী মেয়রাজ উদ্দীন আহমদ, মুনসী মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দিন আহমদ প্রমুখ মনীষীগণ যোগদান করেন।
নিখিল ভারত ইসলাম প্রচার সমিতি
১৮৯৯ সনে ‘মহামেডান এডুকেশন কনফারেন্স’-এর ১৩তম অধিবেশনে ‘বঙ্গীয় মুসলমান শিক্ষা সমিতি’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ ব্যাপারে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম লিখেছেন, ‘বর্তমান শতকের প্রারম্ভে ‘বঙ্গীয় মুসলমান শিক্ষা সমিতি’ ছিল মুসলমানদের একটি অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। বলা যেতে পারে এই প্রতিষ্ঠানটি তখন বাংলার মুসলমানদের প্রধান মুখপাত্র স্বরূপ ছিল। মুনসী মেহেরউল্লা শিক্ষা সমিতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিলেন। সমিতির আন্দোলনে এবং বিভিন্ন বার্ষিক অধিবেশনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৩১০ সালে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে এবং ১৩১২ সালে কুমিল্লার পশ্চিম গাঁয়ে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে এবং ১৩১২ সলে কুমিল্লার পাশ্চিম গাঁয়ে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে তিনি কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেন। এর পরের বৎসর ১৩১৩ সালে ঢাকায় ‘নিখিল ভারত শিক্ষা সমিতি’র যে ঐতিহাসিক অধিবেশন বসে, মেহেরউল্লা সে অনুষ্ঠানেও সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন’। উল্লেখ্য যে এই সম্মেলনের শেষেই ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগে’র জন্ম হয়। সারা ভারতের হিন্দুরা বঙ্গ-ভঙ্গ রদের আন্দোলন চালাচ্ছিল। মুনসী মেহেরউল্লা সর্বশক্তি দিয়ে এ আন্দোলনের বিরোধিতা করেন বলে জানা যায়।
আঞ্জুমানে নুরুল ইসলাম
১৮৯৯ সনে ডাক্তার মাহতাব উদ্দীন-সাহেব যশোর মনোহরপুরে ‘শুভকরী’ নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। ‘শুভকরী’ জন্মলগ্ন থেকেই শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। ঐ সনেই যশোরের ডিস্ট্রিক্ট সেসান জজ সৈয়দ নূরুল হুদার নামে ‘শুভকরী’ নাম পরিবর্তন করে সমিতির নাম রাখা হয় ‘আঞ্জুমানে নূরুল ইসলাম’। এ সমিতির সাথে মুনসী মেহেরউল্লা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।
মাদরাসায়ে কারামতিয়া
আজকের যশোর ক্যান্টনমেন্টের মতিউর রহমান ঘাটি এলাকাটা ছিল তখনকার মনোহরপুর গ্রাম। এই গ্রামেই ১৩০৭ সনে মুনসী মেহেরউল্লা পীর মাওলানা কারামত আলীরনাম অনুসারে ‘মাদরাসায়ে কারামতিয়া’ প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলমানদের ইংরেজী শিক্ষা করা জরুরী ভেবে পরবর্তীতে এ মাদরাসার সাথে মধ্য ইংরেজী চালু করেন।
তিনি একজন সংগ্রামী সংস্কারক হওয়া সত্ত্বেও সমকালীন রাজনীতিরসাথে একমত হতে পারেন নি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন শুরু হলে তিনি এর তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি কংগ্রেসী আন্দোলনের সাথে কখনো একমত হননি। এমন কি স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করানোর জন্য হিন্দু নেতারা অন্যায় পথে পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। এ সম্বন্ধে ৮ম বর্ষ ৫ম সংখ্যা ‘ইসলাম প্রচারক’ লিখেছে, ‘বিকৃত স্বদেশী আন্দোলন উপলক্ষে হিন্দু নেতাগণ তাঁহাকে সহস্র সহস্র টাকার প্রলোভন দেখাইয়াও স্বদলভুক্ত করিতে পারেন নাই।
স্বদেশী আন্দোলনে যোগদানের জন্য মুনসী মেহেরউল্লাকে আহবান জানালে তিনি মন্তব্য করেন, ‘একখানি ভগ্ন ও একখানি সচল পদ লইয়া পথ চলা যেমন দুষ্কর সেইরূপ শিক্ষা-দীক্ষায় যতদিন মুসলমান হিন্দুর সমকক্ষ হইতে না পারিবে ততদিন রাজনীতি ক্ষেত্রে হিন্দুর অনুকরণ করিতে যাওয়া মুসলমানের পক্ষে বিড়ম্বনা মাত্র। অবশ্য ১৯০৬ সালে যখন ঢাকায় ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠা হয় তখন সে সম্মেলনে তিনি উপস্থিত ছিলেন। এ কথা আগেই বলেছি।
পরপারের পথে মেহেরউল্লা
তদানীন্তন বাংলার সর্বত্র ভ্রমণ করে বেড়াতেন তিনি। তাঁর তেজস্বী বক্তৃতা সহজেই মানুষের মনে স্থান করে নিতো। তারা মুগ্ধ হতো। অনুপ্রাণিত হতো। প্রভাবান্বিত হতো। ফলে, শত শত বিধর্মী অসাড় অলীক ধর্ম ত্যাগ করে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিতো।
অতিরিক্ত ছুটোছুটি তাঁর সইলো না। কর্মব্যস্ততা তাঁকে এত ক্লান্তির সম্মুখীন করলো যে, শেষ পর্যন্ত শরীর ভেঙ্গে পড়লো। সাংঘাতিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। উত্তর বঙ্গের তিনটি সভায় একদিনে বক্তৃতা দেওয়ার পর তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। রংপুর থেকে বাড়ি ফিরলেন। কিন্তু দেওয়ারপর তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। রংপুর থেকে বাড়ি ফিরলেন। কিন্তু জ্বর তখন নিউমোনিয়ায় রূপ নিয়েছে। সুরেন বাবু নামে যশোর শহরের এক হিন্দু ডাক্তার তার চিকিৎসা করছিলেন। কিন্তু জ্বর কমলো না। বরং দিন দিন বাড়তে থাকল। মুনসী জমিরুদ্দীন প্রিয় বন্ধুর রোগ মুক্তির জন্যে কলকাতা ছুটলেন। একজন ভাল ডাক্তার আনার প্রয়োজন।কিন্তু সবশেষে হয়ে গেল। ১৩১৪ সালের ২৪শে জ্যৈষ্ঠ ১৯০৭ ঈসায়ী সালের শুক্রবার মাত্র ৪৫ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করলেন।
মুনসী মেহেরউল্লা অকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। রেখে গেলেন বৃদ্ধা মাতা, দুই স্ত্রী, তিন পুত্র, তিন কন্যা ও বাংলার অসংখ্য গুণগ্রাহী। বাংলার আকাশে বাতাসে সেদিন রোনাজারি উঠেছিল। ঝরেছিল কত পাতা সে দুঃখে।
তার মৃত্যুর মাত্র চার বছর পর তার মাতা ইহলোক ত্যাগ করেন। মুনসীজীর মৃত্যুতে বাংলার মুসলমান যে, কি শোকাভিভুত হয়েছিল তা তাঁর দু’জব কবি শিষ্যের উদ্ধৃতি তুলে ধরলে সহজেই অনুমান করা যাবে।
মুনসী মহম্মদ মেহেরউল্লার মৃত্যুতে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী তার ‘শোকোচ্ছাস’ কবিতায় লিখেছিলেন-
যাঁর সাধনায় প্রতিভা প্রভায় নতুন জীবন ঊষা
উদিল গগনে মধুর লগনে পরিয়া কুসুম ভূষা
গেল যে রতন হায় কি কখন মিলিবে সমাজে আর?
মধ্যাহ্ন তপন হইল মগন, বিশ্ব অন্ধকার”
শেখ ফজলল করীম ‘সোলতান’ পত্রিকায় লিখেছিলেন-
“তোমারি বিপুল স্নেহ আকুল আহবানে
হতভাগ্য এই কবি লভি নব বল
অবতীর্ণ হয়েছিল সাহিত্য সংসারে
আজ তুমি দেখিছ না হায় তার বুকে
কি ভীষণ চিতানল জ্বলে ধিকি ধিকি”।
সোনা বন্ধুরা, তোমরাই বলো, মুনসী মোহম্মদ মেহেরউল্লার যারা ভক্ত এবং কবি, তারা না হয় কবিতার ভাষায় তাদের মনের আকুতি প্রকাশ করলেন কিন্তু বাংলার অগণিত মুসলমান! তারা তো চোখের পানি নিরবেই ফেলে তাদের বুকটা হালকা করতে চাইল। তোমরা যদি মুসলিম রেনেসার এই অগ্রসেনানীর পিতৃভূমি ছাতিয়ানতলা গ্রামে যাও, তা হলে দেখতে পাবে –তার কবর সংলগ্ন প্রস্তর ফলকে লেখা আছে শোক গাঁথা এক পংক্তিমালা-
“ভেঙ্গেছিল নিদ ঘুমন্ত জাতির যাহার প্রচার বাগ্মীতায়
কর্মবীর সেই আল্লার মেহের চির বিশ্রাম লভিছে হেথায়
নায়েবে নবী দ্বীনের হাদী বাগ্মী কুল তিলক
ইসলাম প্রচারক, স্বদেশ প্রেমিক, সমাজ সেবক”।
মরহুম মুনসী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ।
জন্ম-১০ই পৌষ, ১২৬৮
ওফাৎ-২৪শে জ্যেষ্ঠ ১৩১৪