কার নবী বড়?
এক সভায় পাদ্রীগণ তাদের নবী যীশু খ্রীষ্টানকে বড় বলে দাবী করলো। কারণ স্বরূপ বলা হলো তাদের নবী আসমানে উঠে গেছেন এবং মুসলমানদের নবী জমিনে (কবরে) আছেন।
সভাস্থলে থম থম ভাব, মুনসী সাহেব কি উত্তর দিবেন?
উত্তর দিলেন, ‘পাদ্রী ভাই এর কথায় ঠিক, নইলে উনাদের নবী উপরে উঠবেন কেন?’ এবং তিনি সভার শ্রোতাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আচ্ছা ভাই সকল, আপনারা একসের ও পাঁচসের নিশ্চয় চেনেন?’
সবাই হাত উচু করে সম্মতি জানালো। তিনি একটা দাড়িপাল্লা আনতে বললেন, পাল্লা আনার পর একসের এক পাশে এবং পাঁচসেরটি অন্য পাশে রাখা হলো। যা হবার তাইই হলো। একসের যে পাশে সে পাশ ওপরে উঠে গেলো। আর যে পাশে পাঁচসের ছিলো সেটা স্বাভাবিক ভাবেই নীচে থাকলো। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা বলুন একসের বড় না পাঁচসের? মুসলমানেরা উল্লাসে চিৎকার দিয়ে বললো, পাঁচসের। খ্রীষ্টানেরা আর টু শব্দটি করলো না।
কার নবী দরদী?
পাদ্রীগণ একবার দাবী করলো যে, তাদের নবী তাদের প্রতি বেশী দয়া পোষণকারী। যার কারনেই তিনি আসমানে উঠে গেছেন, যাতে করে তাঁর অনুসারীগণ বেহেস্ত লাভ করতে পারে।
মুনসী মেহেরউল্লা মঞ্চে আরোহন করেই বললেন, সত্যিই পাদ্রী ভাএতর নবী দরদে আপ্লুত। তাই তো দেখি দলবল ছেড়ে স্বার্থপরের মতো আসমানে উঠে বসে আছেন। আচ্ছা ভাইয়েরা, ‘আপনারা মুরগী চেনেন, মুরগী? খেয়াল করলে দেখে থাকবেন, মুরগীর বাচ্চা খাওয়ার জন্য যখন বাজ বা চিল আসে তখন কিছু মুরগী বাচ্চা ছেড়ে কট কট শব্দ করতে করতে নিজে বাঁচার জন্য গাছের মগালে চড়ে বসে। আর কতকগুলো মুরগী আছে যারা এরূপ বিপদের সময় বাচ্চাগুলিকে ডানার মধ্যে নিয়ে সাবধান করে। বুঝতেই পারছেন পাদ্রী ভাইদের নবী কটকটে মুরগীর মতো। যার মনে মায়া মমতা বলতে কিছুই নেই। আর আমাদের নবীর উদাহরণ দ্বিতীয় প্রকার মুরগীর মতো তিনি তার উম্মতকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসেন। তাই এক সাথেই কেয়ামতের দিন কবর থেকে উঠবেন। কি পাদ্রী ভায়েরা সন্তুষ্ট তো?
পায়খানা করবো কোথায়?
একবার হিন্দু ভাইয়েরা ফন্দি আঁটলো মুসলমানদের ঠকানোর জন্য। সে সময় বনগাঁ অঞ্চলের কোন এক জায়গায় সভা ছিলো, যার বক্তা ছিলেন মেহেরউল্লা। তাই হিন্দু ভাইয়েরা ঠিক করলো যে, প্রশ্ন করা হবে পায়খানা করবো কোথায়? উত্তর আসবে নিশ্চয় বাগানের ভেতর। এ ধরনের উত্তর আসলে আমরা (হিন্দুরা) সবাই হো হো করে হেসে উঠবো, যে মুসলমানদের মুখেই তো বাগান অর্থাৎ দাড়ি আছে তা হলে……..।
মুনসী মেহেরউল্লা বক্তৃতা দিতে দিতে প্রশ্নটি শুনলেন। বললেন উত্তর দেবো পরে। অগ্নিঝরা বক্তব্য রাখছেন মেহেরউল্লা। সবাই নিবিষ্ট মনে শুনছেন সে বক্তৃতা। হঠাৎ ছন্দ পতন।
মেহেরউল্লা বললেন, ‘হিন্দু ভাইসব তোমাদের প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, বাগানকে সামনে রেখে পরিস্কার পরিচ্ছন জায়গায় পায়খানা করতে হবে’।
তার্কিক মেহেরউল্লা তাদের কোথায় ডুবালেন অর্থাৎ হিন্দুদের গোঁফকে সামনে রেখে দাড়ি চাছা মুখের উপর পায়খানা করার কথা বললেন। অতএব হিন্দুরা হোতার মুখ ভুতা করে বসে রইল।
বেহেশত, দোযখ
এক ধর্ম সভায় মুনসী মেহেরউল্লার নিকট প্রশ্ন করা হলো, ‘আচ্ছা ভাই আপনারা বলে থাকেন শুধু মাত্র মুসলমানরাই বেহেস্তে যাবে। তাও যারা নাকি মুমীন মুসলমান। আবার বলেন বেহেস্তের সংখ্যা ৮টি এবং দোযখের সংখ্যা ৭টি। কিন্তু কথা হচ্ছে মুমীন মুসলমানের সংখ্যা যা হবে সেই তুলনায় বহু বহুগুণে বেশী হবে দোযখীদের সংখ্যা। তাহলে কি করে ৭টি দোযখে এতগুলো মানুষ ধরবে? আর মাত্র কিছু সংখ্যক বেহেস্তীর জন্যই বা বেহেস্তের সংখ্যা বাড়ানোর কি প্রয়োজন ছিল?
মুনসী সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, ‘আল্লাহই ভাল জানেন। বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে এখন প্রশ্নের উত্তর দেব না। কার ণ এটা আপনারাই বের করে নিতে পারবেন। আমি অন্যভাবে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছি। আপনারা ‘বুনো’দের বাদুড় ধরা দেখেছেন? এর রাত্রিতে গাছে জাল পেতে প্রচুর বাদুড় ধরে। রাখে কিসে জানেন? বাদুড়গুরো বস্তার ভেতর ঠেসে ঠেসে রাখা হয়। এরপর কথা হচ্ছে ময়না পাখিও নিশ্চয়ই চেনেন? আর না চিনলেও নামতো শুনেছেন। এদের কোথায় রাখা হয় জানেন? সুন্দর পরিপাটি বড়সড় খাঁচার ভেতর।
এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আপনারা যারা দোযখীদের খাতায় নাম লেখাতে চান তারা বাদুড় সদৃশ। আর আমরা যারা বেহেস্তীদের খাতায় নাম লেখাতে চায় তাঁরা ময়না সদৃশ। চতুদিকে থেকে ধ্বনিত হল, মারহাবা মারহাবা।
আল্লাহ কি সর্বত্র বিদ্যমান?
তেত্রিশ কোটি দেবতার উপাসনাকার হিন্দু ভায়েরা একবার প্রশ্ন রাখলেন, আল্লা যদি একজন হন তা’হল তিনি কি করে সৃষ্টির সব জায়গায় বিদ্যমান থাকতে পারেন একথা আমাদের বুঝে আসে না-
মুনসী মেহেরউল্লা বললেন, হিন্দু ভাইয়েরা একটা চমৎকার প্রশ্ন করেছেন? এর উত্তর তো একেকবার সোজা। আচ্ছা, আপনারা সূর্য দেখছেন তো? সূর্য কয়টা? নিশ্চয় একটা! এখন যদি আমরা সবাই একটা করে আয়না ধরি সূর্যের দিকে, তা’হলে একটা সূর্য প্রতিটি আয়নার ভেতর দেখা যাবে না? তাই যদি হয় তা’হলে একটা সূর্য কি করে কোটি কোটি আয়নার ভেতর যেতে পারে? এবার বলুন বিশ্ব জগতের সৃষিট্কর্তা, তিনি কি সবজায়গায় বিরাজমান হতে পারেন না? কি মনের ঘোর কাটলো তো?
আল্লাহ কি পবিত্র?
খ্রীষ্টান ভাইয়েরা এক সভায় প্রশ্ন করলেন, ‘প্রিয় মুসলমান ভাইগণ, আপনারা বলে থাকেন, আল্লাহ সবজায়গায় বিদ্যমান। তাই যদি হয় তা’হলে তিনি তো প্রস্রাব পায়খানার মধ্যেও বিদ্যমান। তা’হলে কি তিনি অপবিত্র নন?
প্রশ্ন শুনে মুনসী মেহেরউল্লা সভামঞ্চ ত্যাগ করলেন। মুসলমান হাহুতাস করে উঠলো, হায়! জাত বুঝি এবারই গেল। কিন্তু না খানিকক্ষণ পরেই মুনসী সাহেব ফিরে এলেন। তবে অবস্থাটা দেখে সবাই তাজ্জব বনে গেলেন, মুনসী সাহেব একটা হাড়ি হাতে করে মঞ্চে আরোহন করলেন। কৌতুহুলী দর্শকবৃন্দ ঘটনার ফলাফল জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। মুনসী সাহেব পাদ্রী দলপতিকে আহবান করলেন এবং হাড়ির ভেতর কি আছে দেখার জন্য অনুরোধ জানালেন। পাদ্রী দলপতি হাড়ির মুখ খুলে তাতে পানির মত কিছু দেখতে পেলেন-
মুনসী সাহেব প্রশ্ন করলেন কিছু কি দেখলেন?
পাদ্রী- দেখলাম পানির মত কিছু
মুনসী- আর কিছু?
পাদ্রী –কই না তো?
মুনসী –ভাল করে দেখুন।
পাদ্রী –হ্যাঁ আমারছবি দেখতে পাচ্ছি।
মুনসী মেহেরউল্লা এবার হো হো করে হেসে উঠলেন এবং বললেন, ‘মিস্টার নামুন নামুন। আপনি অপবিত্র হয়ে গেছেন। হাড়িতে কি আছে জানেন? এই কেবল মাত্র পেশাব করে তাই নিয়ে এলাম। আর সেই পেশাবের ভেতর আপনার ছবি দেখা গেছে অতএব আপনি অপবিত্র হয়ে গেছেন। খ্রীস্টানগণ বুঝলো কোথায় গা দিলেন মেহেরউল্লা সাহেব!
গালে চড়
একবার এক সভায় পাদ্রী দলপতি মুসলমানদের গুণ্ডা বলে আখ্যায়িত করলেন। কারণ মুসলমানরা খুনের বদলা খুন দিয়েই নিয়ে থাকে। চড়ের বদলা চড় দিয়েই । পক্ষান্তরে খৃষ্টানরা সহানুভূতিশীল। তাদের ধর্মে বলে একগালে চড় দিলে অপর গাল পেতে দাও।
মেহেরউল্লা মঞ্চেই ছিলেন পাদ্রী দলপতির এই সুন্দর বাক্যটি শুনার পর তিনি মুহুর্ত মাত্র দেরী না করে পাদ্রী দলপতির গালে একটা আড়ই মন ওজনের চড় বসিয়ে দিলেন এবং আর একটা অন্য গালে দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন –কিন্তু সে সুযোগ আর হল না, সভায় গণ্ডগোল দেখা দিল। পাদ্রী দলপতি গোস্বায় জ্বলতে লাগলেন। অবস্থা আয়ত্তে আসলে মেহেরউল্লা বললেন, ‘আপনাদের ধর্মেরই বিধান কার্যকরী করার চেষ্টা করছিলাম। আর এতেই চটে গেলেন?’
চেহারা ছুরাত
একদিন এক পাদী সাহেব মুনসী সাহেবকে ঠকানোর জন্য বললেন –আচ্ছা মুনসী সাহেব আপনি হয়তো খেয়াল করে থাকবেন আমাদের চেহারা শরীরের গঠন কত সুন্দর। সবাই প্রায় এক ধরনের অথচ মুসলমানদের বিশেষ করে বাঙালী মুসলমানদের চেহারা কারো সুন্দর, কারো কালো, কারো নাক বুচা, কারো থ্যাবড়া, কেউ বেঁটে, কেউ লম্বা, এরকম কেন?
মুনসী সাবে হেসে উত্তর দিলেন –এইটুকু বুঝলেন না, আপনারা বানরের বংশধর আর আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আদমের বংশধর মানুষের চেহারা তো আর এক ধরনের নয়, এক এক জনের এক এক রকম এই আর কি?’ উত্তর শুনে পাদ্রী তো বিস্ময়ে হতবাক।
দেবতার তেজ
এবার তোমাদেরকে একটা সুন্দর আনন্দদায়ক ঘটনা বলছি –একবার এক পাদ্রী এক সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে দেখে কি এক হিন্দু ব্রাহ্মণ তাদের দেবতা তুলশী গাছকে প্রণাম করে সভামঞ্চে আরোহণ করলেন –ঘটনায় পাদ্রী কৌতুক অনুভব করলেন এবং ঠাট্টার ছলে গিয়ে তুলশী গাছটি ছিড়ে নিজের সর্বাঙ্গে ডলাডলি করার পর হাসতে বললেন, হিন্দু দেবতার তেজ দেখছিলাম। মুনসী মেহেরউল্লা ব্যাপারটা অত্যন্ত মনোযোগের সাথে দেখলেন। পরে একদিন হয়েছে কি, ঐ পাদ্রীর সাথে মুনসী সাহেবের একই সভায় দাওয়াত, যথা সময়ে দুইজন এসে উপস্থিত হলেন। কিন্তু মুনসী মেহেরউল্লা পার্শ্ববর্তী একটা বিচুটি (চুতরা) গাছের চতুর্দিক বার তিনেক পাক দিয়ে একটা সেজদা করে মঞ্চে আরোহণ করলেন। হিন্দু দেবতার তেজ পরীক্ষার পর পাদ্রী সাহেবের সাহস বেড়ে গিয়েছিল। তাই তিনি মুসলমান দেবতার তেজ পরীক্ষার জন্য বিচুটি গাছটি তুলে সর্বাঙ্গে ডলাডলি করলেন। কিন্তু মুসলমানের দেবতা (?) পাদ্রী সাহেবকে মোটেও খাতির করলো না –কয়েক সেকেণ্ড পরই পাদ্রী সাহেব দুচারবার ওপরের দিকে লাফ দিয়েই ধরাশায়ী হলেন। চিৎগড় উপুড় গড় দিতে দিতে চিৎকার করে বলতে লাগলেন –মুসলমানদের দেবতার কি তেজরে বাবা? এদিকে সভার দর্শক মণ্ডলী তো হেসে কুটি কুটি।
জুতা চুরি
উপস্থিত বুদ্ধির পর্বটা মুনসী সাহেবের বন্ধু শেখ ফজলুল করীম সাহেবের নিজের জীবনের একটা ঘটনা দিয়েই শেষ করছি শেখ ফজলুল করীম নিজেই বলেছেন।
“কাকিনার সভায় ঘটনাক্রমে আমার নূতন বিলাতী জুতা জোড়া হারাইয়া যায়। আমি জনৈক বন্ধুর জুতা পায়ে দিয়া পথে আসিতে আসিতে মুনসী সাহেবকে রহস্যচ্ছলে বলিলাম, যান আপনার বক্তৃতায় আজ কিছু হয় নাই। চুরি সম্বন্ধে এত নীতি কথা শুনিয়াও যখন চোরে আমার জুতা জোড়া লইয়া গেল, তখন কি করিয়া বুঝিব যে আপনার কথায় কাজ হইয়াছে?
মুনসী সাহেব তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেনঃ ভাই ওটি আমার দোষ নয়, আপনার কর্মের ফল। এই মাত্র আপনি বিলাসিতার বিরুদ্ধে কথা বলিয়া আসিলেন, আর আপনার নিজের পায়ে দামী বিলাতী জুতা। এই চোর উহা চুরি করিয়া আপনাকে এই উপদেশ দিয়া গেল যে, আগে নিজে বিলাসিতা ছাড়, তারপর অন্যকে ছাড়িতে উপদেশ দিও”।
গাল্পিক মেহেরউল্লা
ইসলামের সঠিক রূপ মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য মুনসী মেহেরউল্লা বাংলা আসামের বিভিন্ন জায়গায় ছুটে বেড়িয়েছেন। বিভিন্ন জলসায় অত্যন্ত দক্ষতার সাথে আলোচনার করেছেন, এই আলোচনাকালে শ্রোতাদেরকে বুঝানোর জন্য তিনি অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের গল্প শুনাতেন। মুনশী মেহেরুল্লাহ অসাধারণ রসিক ছিলেন। তিনি নিজস্ব ঢংয়ে রসিয়ে রসিয়ে গল্প বলতে পারতেন। শ্রোতা সাধারণ তাঁর উপস্থাতি গল্পগুলো গোগ্রাসে গিলতেন। তবে, তিনি শুধুমাত্র আনন্দদানের জন্যে গল্প বলতেন না। তিনি এ গল্পের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করে তোলার প্রয়াস পেতেন। গল্পগুলোর কিছু এখনো দক্ষিণ বঙ্গের গ্রামে গঞ্জে প্রচলিত আছে। এখানে তার দু’একটি উপস্থাপন করার চেষ্টা করব।
সবুরে মেওয়া ফলে
কোন এক রাজবাড়ী। রাজবাড়ীর অন্দরে চলছে গানের জলসা। কিন্তু গায়করা গানের আসরকে ঠিক জমাতে পারছেন না। ফলে তেমন পুরস্কার আসছে না। ওদিকে আসর না জমলে, গান পছন্দ না হলে পুরস্কার তো দূরের কথা শাস্তি অবধারিত। এখন উপায় কি? গায়কদের মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে, এমাবস্থায় প্রধান গায়ক একটা গান ধরলেন। গানটির মর্মার্থ হল –পাণপণ চেষ্টা করে গেলে অর্থাৎ ধৈর্য ধরে কাজ করে গেলে সাফল্য আসবে। উপদেশমূলক এ গানটি শেষ হলে চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। রাজকন্যা গায়ককে দিলেন তাঁর গলার মূল্যবান হার। রাজপুত্র দিলেন প্রচুর টাকা। অপরদিকে কোটালপুত্র ঘটালেন অন্য কাণ্ড, তিনি তার পিতার মুখে চপেটাঘাত করলেন। আর কোটাল মহাশয় এই পুত্ররত্নকে নিয়ে ধেই ধেই করে নাচতে লাগলেন। এ সমস্ত দুর্ঘটনা দেখে রাজবাড়ির লোকজনের তো চোখ ছানাবড়া। খোদ রাজা মহাশয় গেলেন ক্ষেপে, তিনি অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টেনে ঘোষনা দিলেন, প্রকাশ্য রাজদরবারে আজকের কাণ্ড-কারখানার বিচার করা হবে।
বিচার সভা চলছে। রাজকন্যা, রাজপুত্র, কোটালপুত্র, কোটালসহ অনেকেই সেখানে উপস্থিত। গুরুগম্ভীর কণ্ঠে রাজা রাজকন্যাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি রাজকন্যা, তা ছাড়া অবিবাহিতা, তুমি যে কাণ্ডটি করেছ তার শাস্তি কি হওয়া উচিত তা কি চিন্তা করে দেখেছ? তুমি কি একজন গায়কের গলায় তোমার গলার হার পরিয়ে দিয়ে অপমানের একশেষ করোনি?
রাজকন্যা চোড় হাতে সবিনয়ে বললেন, অভয় দিলেঃ এর রহস্য খুলে বলতে পারি। রাজা অভয় দিয়ে বললেন, বলতে পার। অভয় পেয়ে রাজকন্যা শুরু করলেন, আপনার জানা আছে যে, আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। বিগত যৌবনা না হলেও যায় যায় অবস্থা। অথচ আপনি এখনো আমার বিয়ের কোন ব্যবস্থা করেননি। এ জন্যে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম- আজ রাতেই কারো হাত ধরে আপনার মুখে চুনকালি দিয়ে রাজপুরী থেকে বেরে হয়ে যাব। কিন্তু যখন গায়ক প্রবর তার গানের মধ্যে সবুরে মেওয়া ফলার উপদেশ দিলেন তখন আমার গৃহীত সিদ্ধান্ত ত্যাগ করলাম। ভাবলাম, দেখিই না আর একটু সবুর করে, পিতা হয়ত শিগগিরই পাত্র সন্ধান করবেন। তা ছাড়া যৌবন তো এখনো বিদায় নেয়নি। তাই সন্তুষ্ট করেছি? অনুতপ্ত রাজা তার ভুল স্বীকার করে বললেন, অন্যায় আমারই হয়েছে মা। দ্রুত তোমার বিয়ের ব্যবস্থা হওয়া উচিত।
এবার রাজা রাজপুত্রের দিকে মুখ ঘুরালেন এবং বললেন, কেন তুমি প্রচুর পরিমাণ টাকা গায়ককে উপহার দিলে?
রাজপুত্র বললেন, আপনি জানেন, আমি পরিণত বয়সে এসে পৌঁছেছি। জনগণের খেদমত করার বয়স এটা। অথচ আপনি বৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও রাজ্যের গুরুভার বয়ে বেড়াচ্ছেন, আমার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন। সে জন্য আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলাম যে, আজ রাতে আপনাকে বন্দী অথবা হত্যা করে ক্ষমতা গ্রহণ করবো। কিন্তু গায়কের উপদেশমূলক গানটি শুনে মনে করলাম, করি না আরেকটু সবুর, হয়ত তাড়াতাড়িই মেওয়া ফলবে। এখন বলুন, গায়ককে উপহার দিয়ে আমি কি কোন অন্যায় করেছি।
রাজা বললেন, না বাবা! তুমি কোন অন্যায় করোনি। ক্ষমতার লোভ আমাকে অন্ধ করে রেখেছিল। তাই ক্ষমতা উপযুক্ত পাত্রের হাতে তুলে না দিয়ে নিজে আঁকড়ে আছি। অন্যায় মূলত আমিই করেছি।
রাজা কোটালপুত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কি খবর?
কোটালপুত্র সবিনয়ে বললেন, রাজা মহাশয়, আমার পিতা আমাকে লেখাপড়া শেখাননি। ফলে অনেক কিছু থেকে আমি বঞ্চিত হই। যেমন গত রাতে রাজকন্যা ও রাজপুত্র সন্তুষ্ট হয়ে তাকে উপহার দিল। কিন্তু অশিক্ষিত হওয়ার কারণে আমি গানের মর্মার্থ বুঝতে পারিনি। এজন্য গায়ককে উপহারও দিতে পারিনি। আর এই না পারাটাই আমাকে রাজকন্যা ও রাজপুত্রের কাছে ছোট করে দিয়েছে। এ জন্য আমি আমার পিতাকে চপেটাঘাত করেছি। এখন বরুল, আমি কোন অন্যায় করেছি কি না।
সর্বশেষে রাজা কোটালের দিকে তাকালেন, কোটাল জোড় হাতে বললেন, মহারাজ, আমার মূর্খ পুত্র আমাকে যে খুন করেনি বরং শুধুমাত্র চপোঘাত করেই ক্ষান্ত হয়েছে এ জন্যই আমি তাকে কোলে নিয়ে ধেই ধেই করে নেচেছি। এখন দেখুন, যদি এটা কোন অন্যায় হয়ে থাকে, তবে এই বান্দা হাজির। যে কোন শাস্তি মাথা পেতে নিতে রাজি আছি।
এ গল্প থেকে এ শিক্ষাই আমাদের নেয়া উচিত, স্ব-স্ব দায়িত্ব সঠিক সময়ে পালন করা একান্ত প্রয়োজন। আর শিক্ষার্জন ফরজ।
আজব পাখি
কোন এক জায়গায় এক গাছে বসে একটা পাখি মনের সুখে গান করছিল। এমন সময় ঐ পথ দিয়ে ‘বদরক’ শহরের একজন লোক যাচ্ছিলেন। হঠাৎ পাখির গানে থেমে গেলেন। তিনি শুনতে পেলেন –পাখি বলছে, আজব শহর বদরক। অর্থাৎ বদরক শহরটি এক আশ্চর্য জায়গা। দীর্ঘদিনের প্রবাসী পথিক আপন শহরের গুণগান পাখির মুখে শুনে ঐ কথাগুলোই মনের অজান্তে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করছিলেন। ঐ সময় ঐ পথ দিয়ে এক ফেরিওয়ালা যাচ্ছিলেন, তিনি এই বিদেশী পথিককে স্বগোক্তি করতে দেখে বললেন, কি হচ্ছে এখানে দাঁড়িয়ে? তখন পথিক ফেরিওয়ালাকে সব খুলে বললো। সব শুনে ফেরিওয়ালা পাখিটির কথা শুনার চেষ্টা করলেন, তারপর বললেন, কই? পাখিতো বলছে, ‘পেয়াজ, লহছন, আদরক’ অর্থাৎ পেয়াজ, রসুন ও আদা।
ফেরিওয়ালার বক্তব্যে পথিক ক্ষেপে যেয়ে শক্তভাবে প্রতিবাদ করলো। এভাবে দু’জনের ভেতর যখন হাতাহাতি শুরু হয়েছে, সে সময়ে একজন দরবেশের হস্তক্ষেপে তা থেকে গেল। দরবেশ দু’জনের গণ্ডগোলের কারণ জানতে চাইলেন। উভয়ে মূল ঘটনা খুলে বললেন। এবার দরবেশ পাখির দিকে তার কান খাড়া করলেন। কিছুক্ষণ পর হেসে বললেন, তোমরা যা বলছ, পাখি তার কোনটাই বলছে না। পাখি বলছে, “আজব খোদাকি কুদরত” অর্থাৎ আশ্চর্য খোদার মহিমা। এরপর দরবেশ সেখান থেকে দ্রুত সরে গেলেন।
মুনশী মেহেরুল্লাহ এ গল্পের মাধ্যমে আমাদের বুঝাতে চেয়েছেন, যে যে প্রকৃতির মানুষ তার চিন্তা ভাবনাও সেই রকমই হয়ে থাকে। অন্যদিকে কোন জিনিস থেকে ভালোটা বেছে নেয়াই বুদ্ধিমানের লক্ষণ।
খাল পার করা
দাদার সাথে নাতি গেছে এক জলসায় ওয়াজ শুনতে। মাওলানা সাহেব মাসলা-মাসায়েল থেকে শুরুকরে আত্মিক উন্নতি, পারিবারিক উন্নতি, সামাজিক উন্নতির কথা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। ওয়াজ শেষ হতে অনেক রাত হল।
ওয়াজ শেষে দাদা নাতি বাড়ির পথ ধরলো। নাতিটির মাওলানা সাহেবের ওয়াজ খুব ভাল লেগেছিল। এজন্য সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, মাওলানার প্রতিটি কথা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। পথে এক জায়গায় একটা ছোট খাল পার হতে হয়।
অবশ্য খালটি (নালাটি) তেমন গভীর ছিল না, হেঁটে পার হওয়া সম্ভব ছিল। দাদা অভিজ্ঞ মানুষ, তিনি কোন ইতস্তত না করেই খালে নেমে পড়লেন এবং পার হলেন। কিন্তু গোল বাঁধলো নাতিকে নিয়ে, দাদা ওপারে গিয়ে দেখেন নাতিটি ঠায় দাঁড়িয়ে। তিনি রাগতস্বরে বললেন- কিরে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি হচ্ছে? বাড়ি যেতে হবে তো, না কি?
নাতিটি এবার কেঁদে ফেলে বললো, দাদা! ছতর যে আলগা হয়ে যায়। মাওলানা সাহেব তো বললেন, ছতর আলগা হলে ফরজ তরকের গুণাহ হয়।
দাদা ততোধিক রাগতস্বরে বললেন, রাখ তোর গুণাহ। পথে-ঘাটে খাল পার হতে গেলে একটু-আধটু ছতর আলগা হয়েই থাকে।
নাতিও নাছোড়বান্দা। সে বললো, হুজুর তো খুব করে পালনের কথা বললেন, আর এ গুলো পালন না করলে তো দোজকের আগুনে ঠিকই জ্বলতে হবে।
দাদার ধৈর্যের বাঁধ এবার খান খান হয়ে গেল, তিনি চিৎকার দিয়ে বললেন, ওরে আমার ফুটো মৌলবীরে, সারা জীবন ওয়াজ শুনলাম এখনো খাল পার করতে পারলাম না। আর উনি কিনা এক দিনে খাল পার করতে চায়। আয় আয়! কাপড় তুলে পার হয়ে আয়।
কালুর মায়ের স্বামী ভক্তি
গ্রামের বউ “কালুর মা” ওয়াজ শুনতে গেছে। সবে এক ছেলের মা, তাই তাকে আদর করে কালুর মা বলে সবে ডাকে। কালুর মা-ও ছেলের বাপকে ‘কালুর বাপ’ বলে ডাকে।
স্বামীর নাম ধরে তো আর ডাকা যায় না। কালুর মা-ও তাই সাবধান হয়ে যায়।
কিন্তু ওয়াজ শুনে কালুর মা’র মন গেল বিগড়ে। মুনশী সাহেব ওয়াজে বলেছেন, স্বামীর সেবা করা ছাড়া স্ত্রীর আর কোন কাজ নেই।
স্বামীর সেবা? ‘সেবা’ জিনিসটি কি, কালুর মা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
মুনশী সাহেব বলেছেন, আল্লাহ নাকি বলেছেন, “আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সিজদা করতে বলা হ’ত, তাহলে স্ত্রীকে বলা হ’ত স্বামীকে সিজদা করতে”। বাপরে বাপ। আল্লাহর সেবার পর স্বামী সেবা! আল্লাহর সেবা তো নামাজ পড়া, রোজা রাখা ইত্যাদি।
আর স্বামীর সেবা?
কালুর মা মুশকিলে পড়ে যায়।
কালুর মা প্রতিজ্ঞা করেছে, স্বামীকে সেবার মত সেবা করবে। এত বড় মর্তবা যার, স্বয়ং খোদাতায়ালা পরে যার স্থান, তার সেবা কি আর সহজ! আজ ভোর থেকে কালুর মা নতুন করে স্বামীর সেবায় লেগেছে। ফজরের নামাজ শেষ করে কালুর মা তসবীহ তেলাওয়াত করে থাকে।
কালুর মা লেখাপড়া জানে না। তেলাওয়াতের মর্মও সে বোঝে না।
গ্রামের আখুঞ্জী সাহেব বলেছেন, নামাজের পর ‘আল্লাহ’, ‘আল্লাহ’ বলে তসবীহ ঘোরালেই হবে। আল্লাহর নাম করলেই আল্লাহর সেবা হবে। কালুর মা’র মাথায় এক নতুন বুদ্ধি খেলে যায়। সে আজ কালুর বাপের নাম জপ করবে, আল্লহা নাম জপের পরে।
কালুর মা নাম জপতে বসে যায়।
‘কালুর বাপ’, ‘কালুর বাপ’, ‘কালুর বাপ’……..।
এদিকে বেচারা কালুর বাপ লাঙল নিয়ে মাঠে যাবে। সকাল বেলার ‘জাউ (নাশতা) রাঁধা নয়নি। কালুর তাই তাগিদ দিচ্ছে। কালুর মা বিরক্ত হয়ে বলে “সকাল বেলায় চেঁচামেচি করো না দেখি, তোমার নাম জপটা শেষ করে নি”।
কালুর বাপের নাম জপ? সে আবার কি?
কালুর বাপ এর মানে বোঝে না।
কালুর বাপ তেড়ে ওঠে, ওসব রেখো, আমার নাশতা কই?
কালুর মা-ও তেড়ে ওঠে, -এখন থামো, তেলাওয়াতটা শেষ করে নি।
দু-জনে বেঁধে যায় তুমুল ঝগড়া। এর মীমাংসা কি হবে? মুনশী সাহেবকে ডাকা হয়। তিনি দেবেন এর ফয়সালা। কালুর মা স্বামীর ঘর-কন্নার কাজ বাদ দিয়ে কালুর বাপের নাম জপ করলে স্বামীর সেবা হবে কি না”।
এ গল্পের মাধ্যমে মুনশী সাহেব বুঝাতে চেয়েছেন যে, না বুঝে এবাদত করলে অর্থাৎ মূর্খের এবাদত কোন কাজেই আসে না।
(মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহঃ দেশ কাল সমাজ-৯০-৯১ পৃঃ)