ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে
পৃথিবীতে জাহিলিয়াতের একটা ইতিহাস আছে। সে ইতিহাস অতীব প্রাচীন। যেমন প্রাচীনতম ইতিহাস রয়েছে ঈমান ও ইসলামের।
এই দুটোরই সূচনা হয়েছে প্রথম মানুষ আদম থেকে …তাঁর বংশধরদের সময় থেকে। এ দুটোরই মূলে নিহিত রয়েছে মানবীয় প্রকৃতি, মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব। মূলতই মানুষ সমন্বিত সত্তা। তার মধ্যে রয়েছে যেমন হেদায়েদ গ্রহণের প্রবণতা তেমনি রয়েছে গুমরাহীর প্রতি আকর্ষণ, জাহিলিয়াতের প্রতি যেমন ঝোঁক রয়েছে তেমনি উদ্যম ও উৎসাহ রয়েছে পরিরিচতি লাভের জন্যে নির্ভুল ও প্রকৃত জ্ঞান। কুরআন মজীদে তাই বলা হয়েছেঃ
(আরবী************************************************************************************)
কসম নফসের এবং যা তাকে ভারসাম্যপূর্ণ করেছে। অতঃপর তাকে ইলহাম করা হয়েছে (জানিয়ে দেওয়া হয়েছে) তার পাপপ্রবণতা ও আল্লাহ-ভীতিমূলক ভাবধারা। নিঃসন্দেহে সাফল্য ও কল্যাণ লাভ করল সে, যে তাকে পবিত্র –পরিচ্ছন্ন-পরিশুদ্ধ করেছে। আর যে তাকে ধূলিমলিন করে বসিয়ে দিল, সে হলো সম্পূর্ণ ব্যর্থ। (সূরা আল-শামসঃ ৭-১০)
বলেছেনঃ
(আরবী***************************************)
এবং তাকে দুটি উজ্জ্বল স্পষ্ট পথ প্রদর্শন করেছি। (সূরা বালাদঃ ১০)
(আরবী*************************************************************)
আমরা মানুষকে পথ দেখিয়েছি –হয় আল্লাহর আনুগত্য ও শোকর করো না হয় কুফরির পথ। (সূরা আদ-দাহরঃ ৩)
অতএব দুনিয়ায় মানুষের দ্বারা যা কিছু সংঘটিত হবে, যা কিছু ঘটবে মানুষের জন্যে, তা সবই মানব সৃষ্টি সংক্রান্ত আল্লাহর এই নীতি ও নিয়মের ভিত্তিতেই ঘটবে। কেননা তিনিই মানুষকে সমন্বিত প্রকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। তা যেমন হেদায়েত গ্রহণ করতে পারে, তেমনি পারে গুমরাহী গ্রহণ করতেও। মানবতার ইতিহাসে এ থেকে ব্যতিক্রম কিছু –না মানুষের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, না মানুষের জন্যে সংঘটিত হয়েছে। কি অতীতে, কি অদূর-সুদূর ভবিষ্যতে সেরূপ কিছু সংঘটিত হওয়ার সম্ভব ছিল, না কোনো দিন তা সম্ভব হবে।
মানুষের ইতিহাস হেদায়েত বা গুমরাহী এই দুই ধারায় প্রবহমান। এর কোনো একটি পথ থেকে মানুষের বাইরে চলে যাওয়া কখনোই সম্ভব হতে পারে নি, পারবে না কোনো দিন। এই দুটি পথের একটির নাম ইসলাম। আর অপরটিই হচ্ছে জাহিলিয়াত।–[আরবী টীকা**************************************]
এই পৃথিবীর বুকে মানুষের বিকাশ ও বিবর্তন ঘটেছে –বিভিন্ন স্তরে ও পর্যায়ে। তাদের বিবর্তন ঘটেছে প্রকৃত তাৎপর্যগতভাবে, সুদৃঢ় পথে ও ভঙ্গিতে। অর্থাৎ তারা ক্রমবৃদ্ধি লাভ করেছে। পরিপক্ক হয়েছে এবং হয়েছে পূর্ণাঙ্গ, পূর্ণ পরিণত। অথবা তাদের বিবর্তন ঘটেছে বিকৃত, কৃত্রিম বিপর্যস্ত পথের বিপথগামিতায়। অর্থাৎ তারা সরল সোজা ভারসাম্যপূর্ণ পথ থেকে বিভ্রান্ত হয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে চলেছে।–[আরবী টীকা******************************]
এবং প্রতিটি বিবর্তন –এটা বা ওটা –বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করেছে। যে রূপটি পরিবেশ ও বস্তুগত –জ্ঞনগত এবং সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতির আনুকূল্য লাভ করেছে, তা-ই ধারণ করেছে, পরিণত হয়েছে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষের সামগ্রিক বিবর্তনে এবং সে বিবর্তন যে রূপ পরিগ্রহ করেছে সেই রূপে বর্ণিত দুটি অবস্থার কোনো একটি থেকেও বাইরে চলে যায়নি। এখানে তৃতীয় কোনো অবস্থা সৃষ্টি হওয়া আদৌ সম্ভব নয়। হয় হেদায়েতের অবস্থা হবে, নয় হবে গুমরাহীর অবস্থা। হয় ইসলাম হবে, না হয় হবে জাহিলিয়াত।
এই প্রেক্ষিতেই একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায় যে, জাহিলিয়াতের সাথে স্থান ও কালের কোনো সম্পর্ক নেই, জ্ঞান-মনীষার মান, বস্তুগত প্রগতি-অগ্রগতি, সভ্যতা-সংস্কৃতি ও সংগঠন সংবদ্ধতার সাথেও নেই তার এক বিন্দু বন্ধন বা সম্পর্ক।
মূলত হেদায়েত যেমন এক স্বয়ংসম্পূর্ণ মৌল ভাবধারা, তেমনি জাহিলিয়াতও এক স্বতন্ত্র মৌল। অবশ্য এর প্রতিটর বিবর্তিত রূপ ও আকৃতি বিভিন্ন হয়ে থাকে।
‘হেদায়েত’ হচ্ছে আল্লহার মারফত –পরিচিতি লাভ, আল্লাহর হেদায়েত অনুসরণ আর ‘জাহিলিয়াত’ হচ্ছে আল্লাহ সম্পর্কে চরম অজ্ঞতা, অজ্ঞানতা –আল্লাহর হেদায়েত হতে দূরবর্তিতা, তাঁর সাথে নিঃসম্পর্কতা।
পরবর্তীতে ‘হেদায়েত’ ও ‘জাহিলিয়াত’ বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। তা অর্থনীতি সমাজনীতি, রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে –সর্বক্ষেত্রে ঘটে। ঘটে মানবীয় বিবেক-বুদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে তার পরিবেশগত বস্তুপ্রকৃতির সাথে ঘর্ষণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে, সেই সাথে সংগঠন, বিন্যাস এবং জীবনের বিভিন্ন ‘ফ্যাক্টরে’র মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কে লব্ধ অভিজ্ঞতার মাত্রা অনুপাতে।
অর্থনীতি, সামাজিকতা, রাজনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রভৃতির কোনো একটিও তার বিবর্তিত কোনো একটি অবস্থাতেও কথিত দুটি অবস্থার মধ্য থেকে কোনো একটি অবস্থারও বাইরে যেতে পারে না। হয় হবে হেদায়েত, না হয় গুমরাহী, -ভ্রষ্টতা; হয় ইসলাম, না হয় জাহিলিয়াত।
এ আলোচনার আলোটে স্পষ্ট হচ্ছে যে, ‘জাহিলিয়াত’ মানুষের বা ইতিহাসের বিবর্তনের কোনো এক পর্যায়ে বা স্তরের সাথে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত নয় –তা পর্যায়-স্তরের ঊর্ধ্বে।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
এ আলোচনায় অবশ্য আমরা সমগ্র ইতিহাস –ইতিহাসের সবগুলো পৃষ্ঠাই টেনে আনতে পারি না। তা কোনো ক্রমেই সহজ কাজও নয়।
তবে ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে আমরা এমন সব দৃষ্টান্তমূলক ঘটনার উল্লেখ করব, যা সেই মহাসত্যকে উদ্ভাসিত করে তুলবে, আধুনিক জাহিলিয়াত যে মহাসত্যকে ইচ্ছামূলকবাবেই অবহেলা ও উপেক্ষা করে এসেছে। ইচ্ছামূলকভাবে উপেক্ষা করার মূলে উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে আল্লাহ থেকে যেসব জিনিস বাস্তব জীবনে আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক গভীর ও সুদৃঢ় করে সেই সব জিনিস থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া।
বস্তুত আল্লাহর দ্বীন প্রথম দিন থেকেই পূর্ণাঙ্গ জীবনের সংগঠক। মানুষের সামাজিকতা-সামষ্টিকতা, তাদের অর্থনীতি ও রাজনীতি –সব কিছুই তার অন্তর্ভুক্ত। তার অন্তর্ভুক্ত মানুষের অনুভূতি, স্বজ্ঞা ও আকীদা-বিশ্বাস। কিন্তু আধুনিক জাহিলিয়াত এই মহা সত্যকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছে। তা এই ধারণা প্রচার করেছে যে, দ্বীন বা ধর্ম এই অনুভূতি ও আকীদা-বিশ্বাস সংশ্লিষ্ট ব্যাপারই ছিল চিরকাল। মানব জীবনের পূর্ণাঙ্গ বিধান হিসেবে তা কখনোই কোনো ভূমিকা পপালন করেনি। সেরূপ স্বীকৃতও হয়নি কখনো।
আর আকীদা-বিশ্বাস তো একটা স্থিতিশীল জিনিস। তা কখনোই পরিবর্তিত হয় না, পরিবর্তন স্বীকার করে না। আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা –তিনিই উপাস্য-আরাধ্য, মা’বুদ –যদিও আরাধনা-উপাসনা-ইবাদতের রূপ এক-এক ধর্মে এক-এক প্রকারের রয়েছে ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে। তাতে কখনোই কোনো পরিবর্তন আসেনি, আসবার নয়।
তবে শরীয়ত –বাস্তব জীবনের কর্মবিধান মানুষের প্রবৃদ্ধি পরিপক্কতার সাথে সাথে বিবর্তিত হয়েছে। সরল সহজ থেকে জটিল-কঠিনে রূপান্তরিত হয়েছে।
সাধারণ মৌলনীতি থেকে বিস্তারিত খুঁটিনাটিতে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। আর এভাবেই দ্বীন আকীদা ও বিধান উভয় দিক দিয়েই পূর্ণত্ব লাভ করেছে সেইদিন, যেদিন আল্লাহ ঘোষণা করেছেনঃ
(আরবী************************************************************************************)
আজকের দিনে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে এবং সম্পূর্ণ করে দিয়েছি তোমাদের প্রতি আমার এই নেয়ামত। আর তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে ইসলামকে আমি পছন্দ ও মনোনীত করে দিলাম। (সূরা আল-মায়েদাঃ ৩)
ইতিহাসের ধারায় হেদায়েত ও জাহিলিয়াত দুটি পাশাপাশি চলে এসেছে, এসেছে একটির পরই অন্যটি। যখনই রাসূল প্রেরিত হয়েছে, আল্লাহর কাছ থেকে ওহী নাযিল হয়েছে। মানুষ তখন তাদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে হেদায়েতের ওপর দৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। তখন কিছু লোক এই মূল পর্যায়ে বা অন্য কোনো পর্যায়ে ভিন্নতর পথ অবলম্বন করে জাহিলিয়াতের দিকে চলে গেছে সত্য পথ থেকে বিভ্রান্ত হয়ে। ফলে জীবনের যে পর্যায়ে এই দুটি পাশাপাশি দেখা গেছে সেখানেই হেদায়েত ও জাহিলিয়াত প্রতিবারে পরস্পর সমান মানে ও মাত্রায় সুবিন্যস্ত হয়ে রয়েছে। ইতিহাসের একটি অধ্যায়েঃ
(আরবী***************************************************************************)
এবং মাদইয়ানের দিকে পাঠিয়েছি সেখানকার লোকদেরই ভাই শুয়াইবকে। সে বললঃ হে জনগণ! তোমরা দাস হয়ে থাকো একমাত্র আল্লাহর। তিনি ছাড়া তোমাদের মা’বুদ কেউ নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের আল্লাহর কাছ থেকে অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ এসে গেছে। অতএব, তোমরা পাপ ও ওজন পূর্ণ করে দাও, লোকদের জিনিসপত্র কম দিয়ে জুলুম করো না। পৃথিবীর শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন ও সুস্থতা শুদ্ধতার পর তাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। এটাই তোমাদের জন্যে অতীব কল্যাণকর, যদি তোমরা ঈমানদার লোক হয়ে থাকো, তোমরা প্রতিটি পথে বসে থেকে ওয়াদা করতে এবং আল্লাহর প্রতি যে ঈমান এনেছে তাকে আল্লাহর পথ থেকে ফেরাতে চেষ্টা করো না –সে পথে যেতে বাধাগ্রস্ত করো না, সেই পথ বাঁকা করতে চেয়ে। তোমরা স্মরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন তোমরা সংখ্যায় খুব কম ছিলে। পরে আল্লাহই তোমাদের বিপুল সংখ্যক করে দিয়েছেন। আর দেখো বিপর্যয়কারীদের পরিণতি কি হয়েছে!
(সূরা আরাফঃ ৮৫-৮৬)
হযরত শুয়াইব (আ) তাঁর জনগণের প্রতি রাসূলরূপে প্রেরিত হয়েছিলেন। তিনি যেমন আকীদা পেশ করেছিলেন, তেমনি দিয়েছিলেন শরীয়ত –জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়ম-নীতি।
সে আকীদা স্থায়ী, অপরিবর্তনীয়। তার মূল কথাঃ (আরবী**********************) –‘তোমরা সকলে আল্লাহর দাস হয়ে জীবন যাপন করো। তিনি ছাড়া তোমাদের ইলাহ আর কেউ হয় –নেই’। আর যে শরীয়ত পেশ করেছিলেন, তা ছিল বিস্তারিত। অর্থনৈতিক নিয়মনীতি ও তার রূপরেখাও তার মধ্যে শামিল ছিল। এ পর্যায়ে তিনি বলেছিলেনঃ
(আরবী**************************************************************************************)
তোমরা পূর্ণ করো পরিমাপ এবং ওজন। আর লোকদের কাছে বিক্রয় করা দ্রব্য সামগ্রীতে কম দিয়ে জুলুম করো না। (সূরা আরাফঃ ৮৫)
সেই সাথে ছিল সামাজিক রাজনৈতিক নিয়ম-বিধানঃ
(আরবী***************************************************************************************)
এবং পৃথিবীতে তার সুস্থ, নির্ঝঞ্ঝাট-নির্বিঘ্ন থাকার পরে তোমরা বিপর্যয় অশান্তির চেষ্টা করো না। ….আর প্রতিটি পথে লোকদেরকে নানা ওয়াদা করা থেকে আল্লাহর প্রতি ঈমানদার ব্যক্তিদেরকে আল্লাহর পথে চলতে বাধাগ্রস্ত করো না। (সূরা আরাফঃ ৫৬ ও ৮৬)
হযরত শুয়াইব প্রদত্ত এসব মৌল বিদান ছিল তখণকার লোকেরা যে সামাজিক-রাজনৈতিক –অর্থনৈতিক স্তরে বসবাস করছিল, তারই পরিপ্রেক্ষিতে, সেই অনুপাতে।
এই স্তরেও বহু লোক তাদের সামষ্টিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক জীবন সংস্থা গড়ে তুলেছিল আল্লাহর দেওয়া শরীয়তের বিধানের ভিত্তিতে। তারা ছিল প্রকৃত মুমিন কিংবা বলা যায় তারা ছিল মুসলিম। ইসলামের সর্বাত্মক রূপতই তাতে প্রতিফলিত। হযরত শুয়াইবের আপন জনগণের মধ্য থেকেই বহু লোক শরীয়তের হেদায়েতের ভিত্তিতে তাদের জীবন গড়ে তুলতে ও পরিচালিত করতে অস্বীকার করেছিল। ফলে তারা জাহিলিয়াতের মধ্যেই নিমজ্জিত ছিল। আর এই ইসলাম ও জাহিলিয়াত সেই মান ও স্তরেই অবস্থিত ছিল যার মধ্যে তখনকার মানুষ জীবন যাপন করত।
অতঃপর হযরত মূসা (আ)-এর আগমন হল। তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হলো তওরাত গ্রন্থ। তাতে যেমন ছিল হেদায়েত, তেমনি আলো। তাতে এমন আকীধা বিধৃত ছিল যা কখনোই পরিবর্তিত হয় না এবং তা-ওঃ
(আরবী*******************************************************************)
তোমরা সকলে এক আল্লাহর বান্দা হও, তিনি ছাড়া তোমাদের ইলাহ আর কেউ নেই। (সূরা আরাফঃ ৬৫)
তাতে যে শরীয়ত বিবৃত হয়েছিল, তা মানবতার বিকাশ ও ক্রমোন্নতির মাধ্যমে একটি সুসংগঠিত সমাজ-সমষ্টিতে একটি রাষ্ট্র ও সরকারে রূপান্তরিত হওয়ার সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যসম্পন্ন ছিল। তাতে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভৃতি জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ বিধান বিধৃত ছিল। তাতে ক্রয়-বিক্রয়ের আইন ছিল। বিয়ে-তালাকের বিধান ছিল, অপরাধ ও তার দণ্ড উল্লেখিত ছিল, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ও নীতি-বিধানেরও উল্লেখ ছিল তাতে।
এই স্তরেও বহু মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনকে আল্লাহর শরীয়তের বিধানের ভিত্তিতে সুসংগঠিত করে নিয়েছিল। ফলে এরা ছিল প্রকৃত মুমিন ও মুসলিম। আর অপর কিছু লোক –হযরত মূসার আপনজনের মধ্য থেকেই –শরীয়তের বিধান অনুযায়ী জীবন গঠন ও পরিচালন করতে অস্বীকার করেছিল। ফলে তারা জাহিলিয়াতের মধ্যেই থেকে গেল। এই ইসলাম ও জাহিলিয়াত উভয়ই সেই সময়কার জনগণের জীবন যাত্রার মান ও স্তরের সাথে সামঞ্জস্যশীল ছিল।
অতঃপর প্রেরিত হলেন হযরত ঈসা (আ)। তিনি নিয়ে এলেন আল্লাহর কিতাব ইনজীল। তা তার পূর্বে অবতীর্ণ তওরাত কিতাবের সত্যতা প্রমাণকারী, সত্যতা প্রমাণকারী, সত্যতা ঘোষণাকারী ছিল। তখনকার লোকদের প্রতি যেসব জিনিস হারাম করে দেওয়া হয়েছিল, তাতেও তা হালাল ঘোষিত হলো। আকীদা ও শরীয়ত উভয় দিক দিয়েই তা ছিল তওরাতের পরিপূরক ও পশ্চাদানুসরণ (Follow up)। তখন কিছু লোক তা গ্রহণ ও অনুসরণ করে। এজন্যে তারাই ছিল তখনকার সময়ের মুমিন ও মুসলিম। অন্যরা তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃত হয়ে জাহিলিয়াতের মধ্যে ডুবে থাকল। এ সময়কার জনগণের জীবন মান ও স্তর অনুপাতেই ইসলাম ও জাহিলিয়াত বিবর্তন-স্তর পরিগ্রহ করেছিল।
এরপর এলো দ্বীন-ইসলামের যুগ। দ্বীন হল পূর্ণাঙ্গ, পূর্ণ পরিণত। বিশ্ব মানবতার প্রতি আল্লাহর এই মহানেয়ামত নাযিল হওয়ার কাজটি সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হলো।
ইসলাম উপস্থাপিত করল আকীদা ও পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান –শরীয়ত। আল্লাহর কাছ থেকে আসা সব দ্বীনই এমনি পূর্ণাঙ্গ ছিল। তাতে যেমন অপরিবর্তনশীল আকীদা-বিশ্বাস ছিলঃ ‘দাস হয়ে থাকো একমাত্র আল্লাহর। তিনি ছাড়া আর কেউ তোমাদের মা’বুদ নেই –নয়’। আর শরীয়ত বিবর্তিত হয়ে সর্বশেষ পূর্ণ পরিণত রূপ পরিগ্রহ করল। বস্তুত আল্লাহ তা’আলাই অনাগত বিশ্ব মানবতার জন্যে এই শরীয়তকে আল্লাহ তা’আলা রচনা করেছেন। তাতে জীবনের গভীর সূক্ষ্ম দূরবর্তী খুঁটিনাটি বিষয়েও পূর্ণাঙ্গ হেদায়েত দেওয়া হয়েছে। তা মানবতার পরবর্তী বিবর্তনের সকল স্তর ও পর্যায়ের সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল ও চাহিদা পরিপূরণে সক্ষম। তা সেই দিন পর্যন্ত মানুষকে পরিচালনা করবে যেদিন ভূ-পৃষ্ঠ থেকে মানুষ নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর আল্লাহই এই পরিত্যক্ত পৃথিবী ও তার উপর অবস্থিত সবকিছুর উত্তরাধিকারী হবেন। (মানব জীবনের স্থিতি ও বিবর্তন পর্যায়ের বিস্তারি আলোচনাও গ্রন্থকার করেছেন তাঁর স্বতন্ত্র একখানি গ্রন্থে এবং ইসলাম কিভাবে উভয় দিকের প্রয়োজন পূরণে সক্ষম তাও তিনি তাতে দেখিয়েছেন। প্রমাণ করেছেন যে, জীবন তার বিবর্তনের কোনো স্তরেই ইসলামী ভাবধারা এই আইন-বিধানের আওতার বাইরে যেতে বাধ্য হয় না। এখানে তা উদ্ধৃত করা শোভন হবে না। তবে এ গ্রন্থেও আমরা যথাস্থানে এই পর্যায়ের আলোচনা তুলব)-[এই গ্রন্থটির নামঃ (আরবী**************************) অধ্যায়ঃ (আরবী******************************) পাঠ করুন।]
এই পর্যায়েও বহু লোক ইষলামের প্রতি ঈমান গ্রহণ করে মুমিন ও মুসলিম হয়েছেন। আর অন্য লোকেরা তা অস্বীকার করে জাহিলিয়াতের মধ্যেই রয়ে গেছে –সেই সময় থেকেই।
বিগত চৌদ্দশ’ বছরে মানুষের জীবন নানাভাবে বিবর্তিত ও পরিবর্তিত হয়েছে ইসলাম আগমনের পর। আর প্রায় সব ভূখণ্ডেই মানুষ দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। তৃতীয় ভাগের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়নি। একভাগে মুসলিম, অপরভাগে জাহিলিয়াতের নিশানবরদার –জাহিল। প্রতিটি জীবনের বিবর্তিত পর্যায়ে অবস্থান করছে। সেই স্তরের মান ও দাবি-দাওয়া অনুপাতেই সব হচ্ছে। কিন্তু যেসব লোক আল্লাহর যথার্থ পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁরা আল্লাহর হেদায়েত গ্রহণ করতে পেরেছেন ও সেইভাবেই চলেছেন। তাঁরাও জীবনের বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি ব্যাপার পর্যন্ত আল্লাহর শরীয়তকে যথাযথভাবে মেনে চলেছেন। এঁরাই প্রকৃতপক্ষে মুসলিম। কিন্তু যারা আল্লাহর পরিচিতি পায়নি যথাযথভাবে, তারা তাঁর উপস্থাপিত হেদায়েতকেও গ্রহণ করেনি। বাস্তব জীবনে তারা তাঁর শরীয়তকে মেনেও চলছে না। একালে ওরাই জাহিল। জাহিলিয়াত পরিবেষ্টিত। তা প্রচলিত ও নিয়মে বা অন্ধ অনুসরণের মাধ্যমে হলেও। আর ওরা নামকা-ওয়াস্তের মুসলিম হলেও কোনো তারতম্য হয় না।
উপরে ইতিহাস থেকেই দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত হয়েছে। আর তা এই সুস্পষ্ট সত্য আমাদের সামনে তুলে ধরে। এ আলোচনা থেকে আমরা নিঃসন্দেহে জানতে ও বুঝতে পারছি যে, মানুষের জীবন দুটি অবস্থার যে কোনো একটির মধ্যে অবশ্যই থাকবেঃ হয় হেদায়েতের পথে, না হয় গুমরাহীর পথে। অন্য কথায়, হয় ইসলাম হবে জীবন ব্যবস্থা, না হয় হবে জাহিলিয়াত। তৃতীয় কিছু হবার নয়।
সমস্ত বিবর্তনই বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। তাতেও আবার এক যুগ থেকে অন্য যুগে পার্থক্য ঘটে। কিন্তু সে বিবর্তনও উল্লিখিত দুটি বেষ্টনীর যে কোনো একটির অভ্যন্তরে সংঘটিত হবে, তৃতীয় কিছুই নেই। হয় হেদায়েত, না হয় গুমরাহী; হয় ইসলাম, না হয় জাহিলিয়াত। কিন্তু এই বিবর্তন স্তর নিজেই নির্ধারণ করে না যে, হেদায়েত হবে, কিংবা জাহিলিয়াত হবে। একটি বিবর্তন স্তর যে পথ ধরে চলে তা-ই তার স্থান নির্দিষ্ট করে যে তা হেদায়েতের বেষ্টনীতে হবে কিংবা হবে জাহিলিয়াতের বেষ্টনীতে আর অপরদিক থেকে হেদায়েত মানব জীবনের কোনো নির্র্দিষ্ট পর্যায় নয়, জাহিলিয়াতও নয় কোনো নির্দিষ্ট পর্যায়। বরং এ দুটির প্রতিটি বিবর্তিত পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে রয়েছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
উপরের ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে যে সব দৃষ্টান্ত আমরা উদ্ধৃত করেছি, এ পর্যায়ের আলোচনায় সেগুলোই আমাদের আসল লক্ষ্য নয়। মূলত আমরা যা বলতে চাই, তা তারই পূর্বাভাস বা ভূমিকা মাত্র। তারই আলোকে আমাদের মূল বক্তব্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে বলেই আমরা সেগুলো উদ্ধৃত করেছি। প্রকৃতপক্ষে আমরা এখানে আধুনিক জাহিলিয়াতের ইতিহাস পেশ করতে চাই। তা কিভাবে সূচিত হল, তা যে ধারায় অগ্রসর হয়েছে সেই ধারায় অগ্রসর হয়ে বিংশ শতাব্দীতে এসে তা এতটা সাংঘাতিক ও ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করল কিবাবে, কোন সব কার্যকারণ তাকে এতটা স্ফীত ও বিরাট করে দিল তা একালের সমস্ত মানুষের সমগ্র বাস্তবতাতে গ্রাস করে ফেলল, আসলে এগুলোই হচ্ছে এ পর্যায়ে আমাদের আলোচ্য।
আজকের ইউরোপ সমগ্র পৃথিবীর ওপর বিজয়ী হয়ে আছে। কোথাও প্রত্যক্ষভাবে ইউরোপের উপস্থিতি না থাকলেও সেখানে তারই ফসল আমেরিকা রয়েছে। সরাসরিভাবে না থাকলেও তারই সভ্যতা ও সংস্কৃতি তারই প্রচারিত ভাবধারা, চিন্তাধারা, আকীদা-বিশ্বাস ও মূল্যমান-মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি সারা পৃথিবীতে বিজয় ও সর্বাধিক প্রভাবশালী হয়ে আছে।
অথচ এই ইউরোপ-আমেরিকার গোটা ইতিহাসই হচ্ছে জাহিলিয়াতের ইতিহাস। যদিও তার শাখা-প্রশাখা রয়েছে অনেক।
ইউরোপের পূর্বে ছিল গ্রীক জাহিলিয়াত এবং তারপরই রোমান জাহিলিয়াত। তারপর ছিল মধ্যযুগীয় বিকৃত ধারণা-বিশ্বাস সম্বলিত জাহিলিয়াত। আর এ শেষকালে ব্যাপক ও সর্বঘ্রাসী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বর্তমানের জাহিলিয়াত। যা প্রকৃতপক্ষে গ্রীক-রোমান জাহিলিয়াতেরই রূপান্তর। এরই পাশাপাশি রয়েছে ডারউইনের নবোদ্ভাবিত জাহিলিয়াত। ইহুদীদের ধ্বংসাত্মক কলা-কুশলতা ও বুদ্ধিবৃত্তি তাকে অত্যন্ত শাণিত ও মারাত্মক বানিয়ে দিয়েছে।
এই গ্রন্থে আমাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় যেহেতু আধুনিক জাহিলিয়াত, এই কারণে আমরা প্রাচীনতম ও মধ্যযুগীয় জাহিলিয়াত পর্যায়ে খুবই সংক্ষিপ্ত উল্লেখ করে সম্মুখের দিকে অগ্রসর হয়ে যাব। সে সংক্ষিপ্ত উল্লেখে অবশ্য আধুনিক জাহিলিয়াত সহজবোধ্য হবে, কেননা আধুনিক জাহিলিয়াত হঠাৎ করে তো আর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি। তার শিকড় ইউরোপীয় মাটি ও ইউরোপীয় ইতিহাসের অনেক গভীর বিস্তৃত।
বস্তুত গ্রীক জাহিলিয়াত ও রোমান জাহিলিয়াতই হচ্ছে বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূল উৎস ও ভিত্তি। স্বয়ং ইউরোপীয় উৎসসমূহ একথা অকপটে স্বীকার করেছে, যদিও তা নিজেকে জাহিলিয়াত বলতে প্রস্তুত নয়। বরং এক নবতর সভ্যতা বলেই বিশ্বসভায় উদাত্ত দাবি জানিয়েছে।
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আধুনিক ইউরোপীয় নব জাগরণের মূলে নিহিত রয়েছে ইসলামী সভ্যতার বিরাট অবদান। ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি থেকে অনেক কিছুই গ্রহণ করেছে। এই কথাও স্বয়ং ইউরোপীয় উৎসসমূহ নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে তা ইসলামের বিশেস ধারায় চলেনি, অগ্রসর হয়নি, ইসলামী সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত সাধারণ রাব্বানী ধারাকে অবলম্বন করেও সম্মুখে চলেনি। বরং নিজেকে সম্পূর্ণ সার্বতোভাবে গ্রীক রোমান রঙে রঞ্জিত করে নিয়েছে এবং তার প্রাথমিককালীন পৌত্তলিকতার দিকে প্রত্যাবর্তিত ও পরিণত হয়েছে। আর তাকে হালকাভাবে আচ্ছন্ন করে নিয়েছে খ্রিষ্টীয় ভাবধারা। প্রথমদিকে তাকে ইউরোপীয় গীর্জা ব্যবস্থার অধীন লালিত হতে হয়েছে এবং ক্রমাগতভাবে এই ভাবধারাই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে গীর্জা ব্যবস্থাকে চূড়ান্তভাবে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়েছে।
তাই এই পর্যায়ে বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াতের রূপরেখা বলার পূর্বে গ্রীক ও রোমান-সভ্যতা-সংস্কৃতির স্বরূপ উদঘাটন জরুরী বলে আমরা মনে করছি।
গ্রীক জাহিলিয়াত ছিল বিভিন্ন শিল্প, দর্শন, রাজনৈতিক মতবাদ এবং বৈজ্ঞানিক মতাদর্শ সমন্বিত।
এক্ষত্রে তার উত্তরাধিকার বিরাট।
আধুনিক ইউরোপ তার উত্থানে-অভ্যুদয়ে গ্রীক উত্তরাধিকারের আতিপাতি করে অনুসন্ধান চালিয়েছে তার প্রতিটি দিকে ও বিভাগে। গ্রীক সভ্যতার অত্যন্ত ব্যাপক ও ফলপ্রসূ অধ্যয়ন করেছে, তার খুঁটিনাটি দিকগুলোও হাতছাড়া করতে প্রস্তুত হয়নি। কেননা ইউরোপের আধুনিককালীন অভ্যুদয়ে তা ছিল একান্তই অপরিহার্য।
এই পর্যায়ে মানবীয় চেষ্টা-সাধনার পক্ষে মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিনিয়োগ যতটা সম্ভব ছিল, তার বিভিন্ন দিক উদঘাটন ও নব দিগন্তের অন্বেষণে বিনিয়োগ করতে একবিন্দু ত্রুটি করেনি।
অবশ্য তাদের জ্ঞান-সাধনার ত্রুটি-বিচ্যুতির অবমূল্যায়ন এবং তাদের চিন্তার মৌলিক ভুল ও বিভ্রান্তি নির্ধারণে আমাদের ওপর বিশেস কোনো দায়িত্ব অর্পিত হয় না। আমরা স্বীকার করব তারা তাদের সর্বশেষ শক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের এমন কোনো শিক্ষাগুরু ছিল না যে, তাদের বিপথগামিতাকে প্রতিরোধ করবে এবং তাদেরকে নির্ভুল পথে পরিচালিত করবে। যদিও তাদের এই বিপথগামিতা রোধ করা ও তাদের বিকৃতি-বিপর্যয় থেকে ফিরিয়ে আনা কারোরই সাধ্যায়তও ছিল না। তাই আমরা কারোর ওপর দায়িত্ব না চাপিয়ে ও বিভ্রান্তি-বিপথগামিতার জন্যে কারোর দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ না করেই গ্রীক উত্তরাধিকারের বিভ্রান্তির দিকগুলোকে পাঠকদের সম্মুখে তুলে ধরতে চাই। গ্রীকদের এই বিভ্রান্তি একটা স্থায়ী জাহিলিয়াতেরই নিদর্শন। তারই আলোকে আমরা আধুনিক জাহিলিয়াতের রূপরেখাসমূহ স্পষ্ট করে তুলতে অনেক সহায়তা ও আনুকূল্য পাচ্ছি। আধুনিক জাহিলিয়াত তো সেই উত্তরাধিকার থেকেই রস ও খাদ্য গ্রহণ করছে প্রতিনিয়ত।
কারোর প্রতি দোষারোপ না করে –সেই প্রাচীনকালীন চিন্তাবিদ দার্শনিকদের বিশেস কাউকে দায়ী না করেই –আমাদের বক্তব্য পেশ করব। আমরা জানি, তাদের চেষ্টার কোনো অন্ত ছিল না সত্য-নির্ভুল পথ লাভ করার জন্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তারা এমন কাউকেই পায়নি যে তাদের নির্ভুল পথের ও লক্ষ্যের সন্ধান দিতে পারত। কিন্তু তাদের এই বিভ্রান্তিকে যারা আকড়ে ধরেছে এবং আধুনিক জাহিলিয়াতে সেগুলোকেই যথাযথ নিয়ে এসছে, বিভ্রান্তি থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্যে কোনো চেষ্টাই করেনি, গ্রহণ করেনি কোনো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা, তাদের আমরা কিছুতেই ছেড়ে দেব না। কেননা গ্রীকদের বিভ্রান্তি যথাযথভাবে গ্রহণ করার মূলে গ্রহণকারীদের মনে বিভ্রান্তির প্রতি তীব্র আসক্তি ছিল বলেই সম্ভব হয়েছিল।
যদিও স্বীকার করতে বাধা নেই, গ্রীক উত্তরাধিকারে বহু মূল্যবান ও কল্যাণকর উপকরণ ছিল। যেমন ছিল প্রাচীন মিশরীয় উত্তরাধিকারে, প্রাচীন আরব উত্তরাধিকারে, প্রাচীন পারসিক উত্তরাধিকারে, প্রাচীন ভারতীয় ও চৈনিক উত্তরাধিকারে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে দুটি ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতাবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা কোনোক্রমেই অস্বীকার করা যায় না।
প্রথম, ইউরোপ আধুনিক জাহিলিয়াত সৃষ্টিতে গ্রীক উত্তরাধিকারকে স্ফীত ও পরিপুষ্ট করে তোলায় খুব বেশী বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। যদিও তা বিদ্বেষী মন-মানসিকতারই ফলশ্রুতি। লোকদের মনে শীর্ষস্থানীয় হওয়ার লোভ এমন অহমিকার সৃষ্টি করেছে, যার ওপর শীর্ষস্থানীয় হওয়া কল্পনাতীত। বরং তা এমন এক শীর্ষস্থানীয় হওয়ার অহমিকায় ডুবে যায়, যা কেবল আল্লাহর প্রেরিত ওহী সম্পর্কেই ধারণা করা চলে, যাকে সত্য বলে মানা যেতে পারে, কিংবা অসথ্য মনে করে অমান্যও করা চলে। বেশির ভাগই অগ্রাহ্য করা হয়। কেননা তা এমন এক সত্যের অপলাপ মাত্র, যার তুলনায় অধিক সত্য কোথাও পাওয়া যেতে পারে না।
দ্বিতীয়, এই উত্তরাধিকারের কোনো কোনো দিক সম্পর্কে আমাদের বিস্ময় ঠিক প্রাচীন মিশরীয়, পারসিক, ভারতীয় বা চৈনিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে আমাদের বিস্ময়ের মতোই। তাই বলে উত্তরাধিকারকে যে নিরংকুশ ও সর্বোচ্চ মূল্য ও মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে, তা মনে করার কোনোই কারণ নেই। প্রত্যেকটি জিনিসকে তার সময়ের মধ্যে রেখে মূল্যায়ণ করতে হয়, তার বাইরে হয়ত তার কোনো মূল্য বা গুরুত্বই স্বীকৃত হবে না। অনুরূপভাবে সেই উত্তরাধিকারকে তার জাহিলিয়াত সঞ্জাত বিভ্রান্তি সহকারে পুনরুজ্জীবিত করতে চাওয়ারও কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না। কেননা সে বিভ্রান্তি তো তার একটা অক্ষমতার ব্যাপারও হতে পারে। আর আমরা যদি জাহিলিয়াত থেকে নিষ্ক্রয় হয়ে আলোকের দিকে এসে যেতে পারে তাহলে তার পুনরুজ্জীবনেও আমাদের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।
এই প্রেক্ষিতেই আমরা এখানে গ্রীক জাহিলিয়াতও বলতে পারি। এই জাহিলিয়াতই মানুষ ও দেবতা (বা দেবতাদের) মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের চিন্তা সূচিত –বরং দৃঢ়মূল করে দিয়েছে।
‘বহু খোদা’ সংক্রান্ত বিশ্বাসই হচ্ছে সর্বাত্মক জাহিলিয়াতের নিদর্শন। তা প্রাচী জাহিলিয়াত হোক, কি নব্য ও আধুনিক। সে ‘খোদাগণ’ বস্তুগত অনুভবযোগ্য হোক; কিংবা হোক ভাবগত এবং সে বিশ্বাস প্রত্যক্ষ ও সরাসরি স্পষ্ট হোক, কি আনুসঙ্গিক ও অস্পষ্ট। বহুত্বের সেই মূল বিতর্ক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়েও বলা যায়, গ্রীক জাহিলিয়াত মানুষ ও সেসব কল্পিত খোদাগণের মধ্যে অত্যন্ত মারাত্মক ও ক্ষতিকর শত্রুতার চিন্তাকে শক্ত করে বসিয়ে দিয়েছে।
তার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত হচ্ছে ‘পবিত্র আগুনের’ চোর প্রোমিথিউসের কল্পকাহিনী।
উপকথার সেই দৃষ্টান্ত হচ্ছে ‘পবিত্র আগুনের’ চোর প্রোমিথিউসের কল্পকাহিনী। সৃষ্টির কাজ করাচ্ছিল। মানুষের প্রতি তার ছিল গভীর সৌহার্দ্য ও সৌহৃদ্য। তাই সে তাদের জন্যে আকাশমার্গ থেকে পবিত্র আগুন চুরি করে তা তাদেরকে দিয়ে দিল। এজন্যে জিউস তাকে কঠিন শাস্তি দিল। সে তাকে কোহকাফ পর্বত শৃংগে শক্ত শৃঙ্খল দিয়ে বেঁধে রাখল। আর তার ওপর একটা শকুন বসিয়ে দিল। শকুনটি সারাদিন তার কলিজা ঠুকরিয়ে ঠুকরিয়ে খাচ্ছিল এবং রাত্রিকালে তা আবার নতুন করে গড়ে উঠছিল। আর তাই দিনের বেলা তাকে নতুন করে শাস্তি ও কষ্টদান সম্ভবপর হতো। এদিকে মানুষের হাতে পবিত্র অগ্নি থাকার অপরাধের প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে জিউস পাণ্ডুরাকে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিল। আর সে-ই ছিল দুনিয়ার বুকে প্রথম নারীসত্তা। তার সঙ্গে ছিল একটি বাক্স এবং তাতে ভর্তি ঝিল প্রজাতি মানব ধ্বংস করার লক্ষ্যে ব্যবহারযোগ্য নানা প্রকারের দুষ্কৃতি। এই পাণ্ডুরাকে বিয়ে করল প্রোমিথিউসের ভ্রাতা এম্পিমিথিউস। সে পাণ্ডুরার হাতে ভগবানের উপঢৌকন বাবদ সেই বাক্সটি গ্রহণ করল। সে সেই বাক্সটি খুললে সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য দুষ্কৃতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল এবং ভূ-পৃষ্ঠকে দুষ্কৃতিতে ভরে দিল। এটাই হল খোদা ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের প্রকৃতি। একদিকে পবিত্র আগুন –যা জ্বালায়, ভস্ম করে –তা হচ্ছে জ্ঞানের আগুন। মানুষ তা খোদাগণের কাছ থেকে চুরি ও অপহরণ করে নিয়ে আয়ত্তাধীন করে রেখেছে। বিশ্ব প্রকৃতি ও জীবনের তত্ত্বজ্ঞান লাভ করাই এর দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য। আর তারপরে তারাই দেবতা হয়ে বসবে। আর দেবতারা তো চরম বর্বরতা, হিংস্রতা ও নৃশংসতা সহকারে তাদের ওপর দিয়ে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে সদা সচেষ্ট। অন্যথায় তাদের শক্তির এককত্ব ও অনন্য ক্ষুণ্ন হয়ে যাবে এবং মানুষ তাদের মোকাবিলায় কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের অধিকারী হয়ে বসবে।–[আরবী টীকা****** দ্রষ্টব্য।]
ইউরোপ আধুনিক ও নব্য জাহিলিয়াত প্রসঙ্গে বিভিন্ন গ্রীক উপকথার ব্যাপক অবতারণা করেছে। বিশেষ করে এই উপখ্যানটির উল্লেখ হয়েছে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে। বলেছে, মানুষ তার নিজ সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে এখান থেকেই দ্বন্দ্ব শুরু করে দিয়েছে। কেননা এর ফলেই তার অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। জীবন তার কর্মতৎপরতার মৌল কারণ এতেই নিহিত। তার সক্রিয়তার যৌক্তিকতাও তারই দরুন স্বীকৃত। আর আল্লাহর নাফরমানী –আল্লাহদ্রোহীতাই হচ্ছে মানবীয় সক্রিয়তা –ইতিবাচকতা ও আত্ম-প্রতিষ্ঠার অকাট্য দলীল।
এ পর্যায়ে আমরা আধুনিক জাহিলিয়াত সম্পর্কে কোনো পর্যালোচনা করছি না। এখানে গ্রীক জাহিলিয়াতের বিভিন্ন রূপ ও রঙের উল্লেখ করছি মাত্র। উত্তরকালে তা ইউরোপীয় চিন্তা-ভাবনায় কিভাবে অনুপ্রবেশ করেছে ও বিষক্রিয়ায় জর্জরিত করে দিয়েছে, তা এই আলোকে অনুধাবন করা সম্ভব হবে।
সত্য কথা, এ এক বীভৎস বিপথগামীতা ও বিপর্যয়। এদিক দিয়ে আমার জানামতে গ্রীক জাহিলিয়াত সম্পূর্ণরূপে একক খোদা থাকার ধারণা গ্রহণ করেছে। সে সবের কতক খোদাকে অত্যন্ত দুষ্ট প্রকৃতির বলে কল্পনা করেছে। দুষ্কৃতি ছাড়া সে সবের আর কোনো কাজই যেন নেই। আর মানুষের ওপর দিয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ এবং নিরর্থক ও উদ্দেশ্যহীনভাবে ধ্বংস ও বিপর্যয় সৃষ্টিই যেন তাদের প্রতিমুহুর্তের ব্যস্ততা। কিন্তু গ্রীক জাহিলিয়াত একক ভাবেই মানুষ ও দেবতাগণের মধ্যে হিংসা ও বিদ্বেষ সৃষ্টির জন্যে এই বিশেষ রূপ ধারণ করেছে মানুষের সক্রিয়তা ও ইতিবাচকতা প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে। ফলে মানুষের ওপর নেমে এসেছে মহা ধ্বংস ও অবিযানের জগদ্দল পাথর। এই বিশ্বাস গ্রহণ ব্যতীত মানুষও যেন তার সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে না। আর তার মন আল্লাহর সাথে সন্ধি করতে কখনোই প্রস্তুত হতে পারছে না। এই কারণে তার মনের অভ্যন্তরে তার স্বভাবগত আত্ম-প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত আগ্রহ এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার স্বভাবগত প্রবণতা ও তাগিদের মধ্যে কখনোই কোনো সামঞ্জস্য স্থাপিত হতে পারছে না।
গ্রীক জাহিলিয়াত রূহের পরিবর্তে বিবেক-বুদ্ধিকে অত্যন্ত মহান ও পবিত্র মনে করিয়াছে। আধুনিক জাহিলিয়াত মনে করছে, গ্রীক জাহিলিয়াতই মানব সত্তার বিকাশ, পবিত্রতা, ইতিবাচকতা, উচ্চতর মূল্য ও মর্যাদা, তার প্রাণশক্তির উচ্চমানতা এবং জীবনে তার উচ্চতর মূল্যমান প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ তা-ই মানুষের বহু উচ্চতর ও বিরাটতর দিককে সম্পূর্ণ অর্থহীন ও তাৎপর্যশূন্য করে দিয়েছে। আর তা হচ্ছে মানুষের ‘রূহ’ বা আত্মার দিকটি। তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ মাত্র করা হয়নি, কিছুমাত্র গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বিবেক-বুদ্ধিকে এবং তাকেই বানিয়ে দেওয়া হয়েছে মানুষের শ্রেষ্ঠ প্রভু বা নেতা –চালক।
অস্বীকার করার উপায় নেই, বিবেক-বুদ্ধি অত্যণ্ত গুরুত্বপূর্ণ মানবীয় শক্তি তার পূর্ণমাত্রার যথার্থ ভূমিকার ফলেই মানবীয় সত্তা, মানুষের ক্রিয়াশীলতা এবং এই বিশ্বলোকের ইতিবাচকতা সম্ভবপর। কিন্তু কেবল তারই প্রতি ঈমান স্থাপন এবং ‘রূহে’র পরিবর্তে সব গুরুত্ব কেবল তারই ওপর আরোপ করা কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। শুধু তা-ই নয়, তা এমন এক জাহিলী বিপথগামিতা, যা শেষ পর্যন্ত মানুষের মূল্য ও মর্যাদাকে নগণ্য ও হীন বানিয়ে দেয়। তখন সে এক বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন জন্তু হয়ে দাঁড়ায়। গ্রীক দর্শন মানুষ সম্পর্কে এই ধারণাই দিয়েছে। অথচ সত্য কথা এই যে, মানুষ জন্তু নয়, জীবজন্তুর বাইরে স্বতন্ত্র এক প্রজাতি হচ্ছে এই মানুষ, তার গোটা সত্তাই অত্যন্ত উচ্চতর, মহিমান্বিত। তা কেবল তার বিবেক-বুদ্ধির বদৌলতেই নয়, তার সকল দিক সমভিব্যবহারে, তার পূর্ণত্ব ও সকল যোগাযোগ সম্পর্কশীলতা সহকারেই সে অত্যন্ত উঁচু মর্যাদার সত্তা। আকার-আকৃতিতেও মানুষ একক। তার এ সব বিশেষত্ব কেবল মানুষের মধ্যেই রয়েছে, মানুষ ছাড়া আর কোথাও তা পাওয়া যেতে পারে না।–[(আরবী টীকা*********) দ্রষ্টব্য।]
মানবীয় বিবেক-বুদ্ধিকে ‘রূহ’ বা আত্মার পরিবর্তে অথবা মানুষের স্বজ্ঞার বিনিময়ে অত্যধিক পবিত্র মনে করার ফলেই গ্রীক জাহিলিয়াতে সকল প্রকার বিপথগামিতার উদ্ভব হয়েছে। ফলে বিবেক-বুদ্ধি যা ধারণ করতে অক্ষম হবে, মানুষ তাকে কখনোই গণ্য বা গ্রাহ্য করতে প্রস্তুত হবে না। আর তার বিবেক-বুদ্ধি যতটা ধারণ করতে সক্ষম হবে –স্বয়ং আল্লাহর সত্তাও তার মধ্যে গণ্য –ঠিক ততটাই গ্রহণ করবে। তার বাইরে কোনো কিছু আছে বলে ভাবতেও কখনও প্রস্তুত হতে পারে না।–[অথব আল্লাহ তাঁর নিজ সম্পর্কে বলেছেনঃ (আরবী*************************************) –দৃষ্টিসমূহ তাকে ধারণ করতে পারে না। তিনিই দৃষ্টিসমূহকে আয়ত্তাধীন করেন। তিনি অতীব সূক্ষ্ম, সর্ববিষয়ে অবহিত। বলেছেনঃ (আরবী***********) –তাঁর মতো কেউ নেই, কিছু নেই। খোদায়ী মহাসত্য সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে গ্রীক দর্শন মারাত্মক রকমের ভুল করেছে। নিতান্তই আজে বাজে কথা বলেছে। তা বলেছে অক্ষম মানবীয় বিবেক-বুদ্ধির ধারণ ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার মধ্য থেকে। আর এভাবে জ্ঞানের যে ফসলই ফলানো হবে, তা অর্থহীন, বাতিল হতে বাধ্য। মানুষের জীবনের বাস্তবতার ওপর তা কোনো প্রভাবই ফেলতে পারবে না, তাতো আছেই –আকীদা-বিশ্বাসেও কোনো স্থান হবে না তার। কেননা কোনো মানুষই আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না তার দার্শনিক মানসিক পরীক্ষার ফলস্বরূপ। ইতিহাসে কোনো উন্নত সমাজ বা মুমিন ব্যক্তি গড়ে তুলতে তা কোনো ভূমিকাই পালন করতে পারে না।] মানবীয় আত্মা যে আল্লাহকে ধারণ করে, বিশ্বাস করে, গ্রীক চিন্তার ফসলে তা অত্যন্ত প্রভাবহীন। পরবর্তীতে আধুনিক জাহিলিয়াতেও আত্মার অনুভূত আল্লাহর কোনো স্বীকৃতি নেই।
এই ধরনের বিমূর্ত মানসিক ধারণাসমূহ দ্বারাই গ্রীক দর্শন ভরপুর হয়ে আছে। বিবেক-বুদ্ধিকে অস্বাভাবিক গুরুত্ব দেওয়ার অনিবার্য ফলশ্রুতিই হচ্ছে তাই। ইউরোপের মধ্যযুগীয় জাহিলিয়াতের শক্তি নিঃশেষিত হওয়ার মূলেও রয়েছে বিবেক-বুদ্ধির প্রতি এই বাড়াবাড়িপূর্ণ গুরুত্বারোপ। শেষ পর্যন্ত তাই বাস্তব অভিজ্ঞতাজাত ধর্মমতের সৃষ্টি করেছে, যা এককালে মুসলমানদের কাছ থেকেই গৃহীত হয়েছিল। এ বিসয়ে আমরা পরে আলোচনা করছি।
আর এরই ফলে নৈতিকতা একটা মানসিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। বাস্তব কর্ম জীবনে তাকে কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। একথা সত্য যে, গণতান্ত্রিক গ্রীক তার নাগরিকগণকে সুনির্দিষ্ট সামষ্টিক বিশেষত্ব ও মূল্যমানের ওপর গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তা কেবলমাত্র বিবেক বুদ্ধির জোরে যতটা সম্ভব ছিল ততটাই। ফলে যৌন অরাজকতার ব্যাপারে নৈতিকতার বোধ আয়ত্ত করা তার পক্ষে অসম্ভব রয়ে গেছে। সেজন্যে কোনো নিয়ম-বিধি না দিয়েই তাকে অবাধ ও অপ্রতিরোধ্য করে ছেড়ে দিয়েছে। আর তাই হয়েছে তার চূড়ান্ত ধ্বংসের মৌল কারণ।
গ্রীক জাহিলিয়াতের বিপর্যয় ও বিপথগামীতার এ হচ্ছে অতীব সামান্য নমুনা। আমরা এসবের সংক্ষিপ্ত উল্লেখের মাধ্যমেই দ্রুতাতা সহকারে সম্মুখের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কেননা এ আলোচনায় আমাদের লক্ষ্য নিবদ্ধ নয়, তা আমরা আগেই বলেছি। এ পর্যায়ে আমরা এমন সব সত্যকে তুলে ধরে সামনের দিকে বেরিয়ে যেতে চাই যা আধুনিক জাহিলিয়াতের এবং ইতিহাসের সব কয়টি জাহিলিয়াতের আলোচনায় আমাদের যথেষ্ট সহায়তা ও আনুকূল্য দিতে পারবে।
প্রথম কথা, যে কোনো জাহিলিয়াতে কোনো বিশেষত্ব, বিশেষ কোনো গুণপনা বা উচ্চতর উৎপাদনের অবস্থিতি কোনো বিস্ময়কর বা অসম্ভব ব্যাপার নয়। সম্ভভত কোনো জাহিলিয়াতই এই দিক দিয়ে একান্তভাবে শূন্য হয়ে থাকে না। কিন্তু তা একথা প্রমাণ করে না যে, সে জাহিলিয়াত জীবন্ত ও সুস্থ অবস্থায় রয়েছে।
একথারও দাবি করা চলে না যে, তা সর্বকালে অবশ্যই অনুসরণযোগ্য বা তা থেকেও কিছু গ্রহণীয় থাকতে পারে।
দ্বিতীয়, কোনো জাহিলিয়াতে উক্ত বিশেষত্ব, উত্তম গুণপনা ও উন্নত শুভফল থাকলেই তা জাহিলিয়াত হওয়ার কলংক থেকে মুক্ত হবে এমন কথা বলা চলে না। কেননা তার মধ্যে নিহিত বিকৃতি ও বিপথগামিতাই এসব বিশেষত্ব, শুভ গুণপতা ও উন্নতমানের ফল শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট ও ধ্বংস করে দেবে, তাতে সন্দেহ করার কোনো উপায় নেই।
তৃতীয়, এসব বিকৃতি বিপর্যয় ও বিপথগামিতার প্রধান কারণই হচ্ছে এই যে, এই জাহিলিয়াত সর্ব বিষয়ে স্বীয় খাহেশ-কামনা-বাসনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কিংবা করে সংকীর্ণ মানবীয় জ্ঞানের বলে। …..এ দুটি মূলত এক ও অভিন্ন। কেননা তা আল্লাহর হেদায়েত জানে না, চিনেও না। অথবা বলা যায়, হয়ত চিনে ও কিছু না কিছু জানেও। কিন্তু তা অগ্রাহ্য করে অন্য কিছুর সন্ধানে উন্মুখ হয়ে থাকে।
অতঃপর আমরা গ্রীক জাহিলিয়াতের ন্যায় রোমান জাহিলিয়াত সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করার উদ্যোগ নিচ্ছি।
রোমান জাহিলিয়াতও বস্তুবাদী জাহিলিয়াত। ইন্দ্রিয়নিচয় কেন্দ্রিক জাহিলিয়াত। তবে এ জাহিলিয়াত এমন অনেক জিনিস নতুন উদ্ভাবন করেছে, যা মানুষের জন্যে কল্যাণকর, সন্দেহ নেই। এর পূর্বে গ্রীক জাহিলিয়াতও অনেক কিছু নতুন উদ্ভাবন করেছিল। এ ক্ষেত্রে উভয়ের ভূমিকা অভিন্ন।
বিচিত্র ধরনর সংগঠন –রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক, সামরিক ও নাগরিক সংগঠন রোমান সভ্যতারই উদ্ভাবন।
নাগরিক জীবন –‘নগর সভ্যতা’ তারই উদ্ভাবিত। তার অর্থ বস্তুগত উপায় উপকরণ ও বস্তুনিষ্ট উৎপাদনকে মানুষের কল্যাণে প্রয়োগ ও ব্যবহার। সে সবের দ্বারা জীবন সহজ ও যাপনযোগ্য বানানো। এজন্যেই সড়ক-পুল নির্মাণ, জলধারা, পয়ঃপ্রণালী, বিবাহের ক্ষেত্র ও খেলার মাঠে তৈরী প্রভৃতি এরই সাথে জড়িত।
একটু উপরেই আমরা বলে এসেছি, কোনো জাহিলিয়াতই কিছু না কিছু কল্যাণের দিক নিয়ে থাকে। সেই সাথে একথাও বলেছি যে, এই অপেক্ষাকৃত কল্যাণ জাহিলিয়াতকে বিপর্যয়-বিকৃতি ও বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করে না, রক্ষা করতে পারে না, আর তারই ফলে তার চূড়ান্ত ধ্বংস অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়।
রোমান জাহিলিয়াতের সবচেয়ে বড় ও মারাত্মক বিপর্যয় হচ্ছে তার বস্তুনিষ্টতা। বস্তুর ওপর প্রচণ্ড বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা। ‘রুহ’ বা আত্মা সেখানে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত। সেখানে অস্তিত্ব কেবল ‘বস্তুর’ –বস্তুগত। বস্তুই সব, বস্তুর বাইরে সেখানে কিছুই নেই,। কিছুই স্বীকৃত নয়। বস্তুগত অস্তিত্বও তা যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, তা কিছুই নয়, তার অস্তিত্বই নেই। সামান্য থাকলেও তা ধর্তব্য নয়। এর ফলেই রোমানদের জীবনে আকীদা-বিম্বাসের দিক অত্যন্ত স্থূল ও গভীরতা শূন্য হয়ে পড়েছে।
রোমান জাহিলিয়াতের অত্যন্ত বড় বিপর্যয়ের অনুরূপ একটি দিক হচ্ছে ইন্দ্রিয়গাহ্য জগতের ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ, ইন্দ্রিয়গত স্বাদ আস্বাদন। এ কারণেই রোমানরা লাম্পট্য ও অনৈতিকতার অতল সাগরে এমনভাবে নিমজ্জিত হয়েছিল যে, তার কেননাসীমা-পরিসীমা ছিল না। তারা যৌন স্বাদ-আস্বাদন সামগ্রীর প্রতি সীমাতিরিক্তভাবে লোলুপ হয়ে পড়েছিল। এ ক্ষেত্রে তাদের ঔদার্য ও বাধাহীনতা চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। পাশবিক প্রবৃত্তি চরিতার্থ করে স্বাদ গ্রহণের জন্যে তারা নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে, রক্তের বন্যা প্রবাহিত করেছে, নির্মম নিপীড়ন চালিয়েছে, লাশের দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে বিকৃত করেছে। এ সবই করেছে পাশবিক খেলায় মেতে গিয়ে। আর এই রক্তাক্ত ঘটনা দুই চোখ মেলে আনন্দ লাভ করার জন্যে বিরাট জনসমাবেশ ঘটিয়েছে, আর এরূপ অনুষ্ঠানের জন্যে তারা দুই হাতে উদরভাবে পয়সা খরচ করেছে। আর যাদুমন্ত্রে বিমোহিত যেসব ব্যক্তিকে হত্যা ও মৃত্যুর উৎসবে আত্মহুতি দেওয়ার জন্যে উপস্থিত করা হয়েছিল, তারা তরবারি ও খঞ্জর হাতে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পরস্পরের পেট ছিন্ন করছিল, রগ, নাড়ি-ভুঁড়ি কেটে দিচ্ছিল, পরস্পরের রক্তের লাল বন্যা প্রবাহিত করছিল। আর রোমান সমাজপতিরা নিতান্ত পশু হয়ে এই বীভৎস দৃশ্য দুই চোখ মেলে দেখে দেখে আনন্দ ও সুখ-রস পান করছিল। এই আনন্দ উৎসবের শেষে যখন পাশবিক মৃত্যু-উৎসব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছত, তখন দেখা যেত যে, দুজনের একজন বা দুজনই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, পুঞ্জিত রক্তে প্রাণহীন লাশ ভাসছে।
এই জাহিলিয়াতের আর একটি বড় ধরনের বিকৃতি ও বিপথগামিতা হচ্ছে প্রখ্যাত রোমান ‘সুবিচার’। সে সমাজে ন্যায়বিচার ছিল একান্তভাবে রোমানদের জন্যে। কেবল তারাই ছিল ন্যায় বিচার পাওয়ার একমাত্র অধিকারী। তারাই লাভ করত তার সমস্ত সুফল। তাদের ছাড়া অন্যরা সব ক্রীতদাস –দাসানুদাস মাত্র। বিশাল মহান রোমান সাম্রাজ্যের অধীন রোমানদের ছাড়া আর সবাই অধীন প্রজাসাধারণ, দাসানুদাস মাত্র। তাদের কোনো অধিকার নেই, নেই ন্যায়বিচার পাওয়ার কোনো অধিকার। তাদেরকে শুধু কর্তব্য করে যেতে হবে। শাসকদের পক্ষ থেকে তাদের ওপর যা অবশ্য কর্তব্যরূপে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, চোখ-কান-মুখ বুঁজে তারা শুধু তা-ই করে গেছে।
রোমান জাহিলিয়াতের বিরাট অধ্যায় থেকে এ তো অতি সামান্য –যৎকিঞ্চিত মাত্র। বিশ্ব ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তা স্বর্ণের অক্ষরে (?) লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।
উপরের ঐতিহাসিক আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা মধ্যযুগে পৌঁছে গেছি। এখানে এসে আমরা এক অভিনব ধরন ও প্রকৃতির জাহিলিয়াতের সম্মুখীন হই। তা হচ্ছে ভিত্তিহীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন আকীদা-বিশ্বাসের জাহিলিয়াত। আমেরিকান গ্রন্থকার ড্রীপার তাঁর ‘ধর্ম ও বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব’ নামের গ্রন্থে লিখেছেনঃ
খ্রিষ্ট ধর্মে শিরক ও পৌত্তলিকতা অনুপ্রবেশ করল সে সব মুনাফিকের প্রভাবে, যারা রোমান রাষ্ট্রের উচ্চতর পদে আসীন হয়ে মোটা বেতন গ্রহণের মহা সুযোগ লাভ করেছিল। তারা বাহ্যত নিজেদের খ্রিষ্টান বলে পরিচয় দিত বটে; কিন্তু আসলে ধর্ম-কর্মে তাদের কোনোই অংশ ছিল না। সেজন্যে একটি দিনও তারা একান্তভাবে ব্যয় করেনি। কনস্ট্যানটাইনও এদেরই একজন ছিল। সে তার গোটা জীবনই অতিবাহিত করেছে অত্যাচার নিপীড়ন ও যৌন-উচ্ছৃঙ্খলতার মধ্য দিয়ে। গীর্জার ধর্মীয় দায়িত্ব সে কখনোই পালন করেনি। তবে শেষ জীবন অতি সামান্য কিছু (৩৩৭ পৃঃ)।
খ্রিষ্টান সমাজ যদিও তখন ততটা শক্তিশালী হয়ে ওঠেছিল যে, তারা কনস্ট্যানটাইনকে বাদশাহ বানাতে সক্ষম হয়েছিল; কিন্তু সে পৌত্তলিকতার লেজুড় কাটতে ও তার জীবাণু ধ্বংস করতে সক্ষম হয়নি। তার সম্মুখীন হওয়ার কারণে খ্রিষ্ট ধর্মের মৌলনীতিতেই পৌত্তলিকতা সংমিশ্রিত হয়ে গেল। ফলে একটা নবতর ধর্মমত গড়ে উঠল। তাতে খ্রিষ্টবাদের পাশাপাশি সমান মাত্রায় রয়েছে পৌত্তলিকতা। দ্বীন-ইসলাম এখান থেকেই খ্রিষ্টবাদ থেকে ভিন্নতর হয়ে গেছে। ইসলাম পৌত্তলিকতাকে নির্মূল করেছে এবং কোনোরূপ অস্পষ্টতা ও সংমিশ্রণতা ব্যতিরেকেই উজ্জ্বল খালেস তওহীদী আকীদা পেশ করেছে।
এই সাম্রাজ্যবাদটি ছিল মূলত দুনিয়ার দাস। তার ধর্মীয় আকীদা বিশ্বাস একবিন্দু সুবিন্যস্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ ছিল না। তা তার ব্যক্তিগত কল্যাণ এবং খ্রিষ্টীয় ও পৌত্তলিকত –এই দুই পরস্পর সাংঘর্ষিক আকীদা-সম্পন্ন জনসমষ্টির কল্যাণে এই দুটিকে একত্রিত করা এবং এ দুটির মধ্যে পূর্ণ মিল সৃষ্টি করা জরুরী মনে করেছিল। এমন কি দৃঢ় আকীদাসম্পন্ন খ্রিষ্টানরাও এই চেষ্টাকে অস্বীকার বা প্রতিরোধ করার প্রয়োজন মনে করল না। সম্ভবত তারা মনে করছিল যে, এই নতুন ধর্ম যদি প্রাচীন পৌত্তলিক মতে সমৃদ্ধ হয় তা হলে খুক আকর্ষণীয়, উন্নত মানের এবং অত্যন্ত ফলপ্রসূ কাজ হবে এবং খ্রিষ্ট ধর্ম শেষ পর্যন্ত পৌত্তলিকতার মলিনতা ও কলংক থেকে মুক্ত হয়ে যাবে।–[সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী লিখিত (আরবী**************) দ্রষ্টব্য।]
উপরে পাশ্চাত্য খ্রিষ্টান লেখকের যে সাক্ষ্য উদ্ধৃত হয়েছে, আমাদের জন্য তা-ই যথেষ্ট একথা প্রমাণের জন্য যে, ইউরোপের সহীহ আকীদায় মারাত্মক রকমের বিকৃতি ও বিপথগামিতা সংঘটিত হয়েছিল। অতঃপর বিস্তারিত কিছু তালাস করে বেড়ানোর কোনো প্রয়োজনই পড়ে না। মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় জাহিলিয়াত জীবনের বাস্তবতার যে ব্যাপক বিপর্যয় ও বিকৃতি সংঘটিত হয়েছিল এবং বাহ্যত যদিও তারা ধর্মের শীতল ছায়ায় জীবন যাপন করত, কিন্তু কার্যত তা ছির অন্তঃসারশূন্য, তা দেখাবার জন্যে উক্ত উদ্ধৃতিই যথেষ্ট।
বস্তুত খ্রিষ্টীয় ধর্ম আল্লাহর কাছ থেকে অবতীর্ণ অন্যান্য ধর্মের ন্যায় আকীদা ও শরীয়ত বাস্তব জীবনের বিধান সমন্বিত ছিল। যদিও তা বিস্তারিত ও খুঁটিনাটিসহ কোনো বিধান নিয়ে আসেনি। তারও কারণ এই যে, খ্রিষ্ট ধর্মের শরীয়ত মূলত ছিল ‘তাওরাত’ ভিত্তিক, তওরাতের ভিত্তিতেই তার শরীয়ত গড়ে উঠেছিল। যদিও তাতে কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছিল, যা ঈসার প্রতি নাযিল হয়েছিল ইনজীল গ্রন্থে। এই ইনজীল তার পূর্ববর্তী ‘তওরাত’ নিহিত বিধানেরই সত্যতা প্রমাণকারী –সত্যতা ঘোষণাকারী গ্রন্থ ছিল। তার কারণস্বরূপ উল্লেখ করা হয়েছেঃ
(আরবী****************************************************************************)
যেন আমি হালাল করে দেই এমন কতক জিনিস যা ইতিপূর্বে তোমাদের প্রতি হারাম করা হয়েছিল। (সূরা আলে-ইমরানঃ ৫০)
ফলে খ্রিষ্ট ধর্ম সম্পর্কে স্বাভাবিক ধারণা এই ছিল যে, তওরাতে অবতীর্ণ আল্লাহর শরীয়ত অনুযায়ীই বিচার-ফয়সালা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। সেই সাথে অবশ্য রক্ষিত হবে সে সব ব্যতিক্রমধর্মী বিধান, যা ইনজিল গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে।
কিন্তু কার্যত তা ঘটেনি। মধ্যযুগে ইউরোপে গীর্জা প্রভাব বিস্তার করার জন্য যত চেষ্টাই করে থাকুক, সেখানে ব্যক্তিগত পর্যায়ের আইনের বাইরে খোদায়ী শরীয়ত বাস্তবায়িত হয়নি এবং বাস্তব জীবনের বিরাট অংশের ওপর খোদায়ী শরীয়তের কোনো প্রভাব ছিল না। তার পরিবর্তে রোমান আইনই ছিল কার্যকর। অন্য কথায় বললে বলা যায়, প্রাচীন রোমান জাহিলিয়াতই অত্যধিক প্রভাবশালী হয়েছিল তখনকার মানুষের ওপর।
ফলে ধর্ম ও বাস্তব জীবনের মধ্যে বিরাট পার্থক্যের সৃষ্টি হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের ধ্যান-ধারণায় বিজয়ী ধর্ম অনুপ্রবেশ লাভ করলেও ইউরোপের মধ্যযুগীয় জাহিলিয়াতে একটা বিপদের লক্ষণ প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছিল। অবশ্য তাও মারাত্মক কিছু ছিল না।
একদিকে গীর্জা জনগণের মন-মানসিতকা ও আচার-আচরণের ওপর প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তার করেছিল। কিন্তু তা বাস্তব জীবনে রোমান আইন তার স্থান দখল করার মতো শক্তি পায়নি কখনোই। গীর্জা এই আধিপত্যের সূত্রে এতদূর বিস্তার লাভ করে যে, তা সকল যুক্তিসঙ্গত সীমাকে অতিক্রম করে যায়। পাদ্রী-পুরোহিতরা নিজেদের জন্যে আকাশমণ্ডলীয় কর্তৃত্ব আয়ত্ত ও একান্ত করে নিয়েছিল। আর তা বিন্দু বিন্দু করে সঞ্চিত ও মওজুদ করছিল। তাতে এমন কাউকেই তারা প্রবেশাধিকার দিত না; যাদের প্রতি তারা সন্তুষ্ট ছিল না। তাদের মনোনীত ব্যক্তিরাই তাতে প্রবেশ করার অধিকার বা অনুমতি পেত। যারা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট ছিল, তারাও। এদের বাইরের সব লোকই তাদের সন্তুষ্টি থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়েই ছিল।
অন্যদিকে গীর্জা জনগণের ওপর নানাবিধ কর ধার্য করে যাচ্ছিল। তা যেমন অর্থনৈতিক ছিল, তেমনি ছিল বিবেক-বুদ্ধিগত ও নিদারুণ চাপ সৃষ্টিকারী আধ্যাত্মিকও। ব্যবসায়ী কর, মালিকত্বের কর (Royalty) এবং গীর্জার মালিকানাধীন ভূমিতে বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমদান এবং বিদ্রোহী রাজা-বাদশাহদের শিক্ষাদানমূলক যুদ্ধে সৈন্য হিসেবে ভর্তি গ্রহণের কাজ করতে জনগণ একান্তভাবেই বাধ্য ছিল। আর এ-ই ছিল গীর্জার কল্পিত কর্তৃত্ব ও আধিপত্য দাস জনগণের ওপর। তাতে ধর্মীয় পদাধিকারী ব্যক্তিদের সম্মুখে অপমানকর বিনয় গ্রহণ ছিল অপরিহার্য। মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে সিজদা করতে হতো যে কোনো পাদ্রী ব্যক্তির গমনাগমন কালে। এ এক ভিন্ন ধরনের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য। যে সব বিলুপ্তপ্রায় পচা-গলা জ্ঞানগত চিন্তা বিশ্বাস গ্রহণের জন্যে গীর্জা জনগণকে নির্দেশ করত, তাও গ্রহণ করতে হতো তাদের। কেউ তা মেনে নিতে অস্বীকৃতি হলে তার ওপর সবকিছু থেকে বঞ্চিত থাকার শাস্তি কার্যকর করা হতো। অথবা এমন দৈহিক নিপীড়ন চালানো হতো, যার ফলে নির্ঘাৎ মৃত্যুবরণ করতে হতো। এই অত্যাচারী স্বৈরতান্ত্রিক আধিপত্যের এ ছিল তৃতীয় রূপ। কিন্তু উত্তরকালে চারদানভ –ব্রোনো, কোপারনিকাস ও গ্যালিলিওর দার্শনিক ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যখন গীর্জা প্রচারিত ভ্রান্ত-ভিত্তিহীন মতবাদসমূহ বাতিল প্রমাণ করেছিল, তখন গীর্জা তাদের ওপর অমানুষিক আযাত ও নির্যাতনের চরম পরাকাষ্ঠা দেখাতে লাগল। যার দরুন তারা হয় মৃত্যুবরণ করল, না হয় গীর্জা বিরোধী মত পরিহার করতে বাধ্য হলো।
প্রতিষ্ঠিত জাহিলিয়াত ধর্মের নামে এসব করেই ক্ষান্ত থাকেনি। তা আরও অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে এবং তা ঘটল তখন যখন ‘রাহবানিয়াত’ –বৈরাগ্যবাদ সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে উপাসনা আরাধনায় আত্মনিয়োগ করাকে একান্তভাবে গ্রহণ করল। শুরুতে তা তাদের জন্যে বিধান থাকলেও তা ছিল ইচ্ছামূলক, কর্তব্য ছিল না। যেমন কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ
(আরবী***************************************************************************************)
এবং বৈরাগ্যবাদ, তারা নিজেরাই তা উদ্ভাবিত করেছে। আমরা তা তাদের জন্যে ফরয করে দেইনি। (সূরা হাদীদঃ ২৭)
এ বৈরাগ্যবাদ এমন পতনের দিকে বিবর্তিত হলো যে, তাতে সর্বপ্রকারের নৈতিক অপরাধ করাও অবাধে চলতে লাগল। পুরুষ বৈরাগী ও মেয়ে বৈরাগীর (?) একত্রিত জীবন কলুষতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখাল। এই পর্যায়ে কুরআনের উক্ত আয়াতের পরবর্তী কথা স্মরণীয়ঃ
(আরবী***************************************************)
তাদের জন্যে ফরয করা বিধান ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি সন্ধান। তারা তা যথাযথভাবে বহাল রাখতে পারেনি। (সূরা হাদীদঃ ২৭)
এরপরই তারা ইতিহাসখ্যাত ‘ক্ষমার সনদ’ বিক্রয় করতে শুরু করে, যা ছিল অত্যন্ত হাস্যকর। ফলে ধর্মের ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে হাসি ও ঠাট্টা-বিদ্রুপের পাত্রে পরিণত হলো। তার মাহাত্ম্যও কিচু থাকল না, থাকল না কোনো সত্যতা। নিছক খেল-তামাসার ব্যাপার, প্রতারণা, ধোঁকাবাজি ও বাটপারিই মুখ্য হয়ে দাঁড়াল।
এ হচ্ছে ইউরোপের মধ্যযুগে প্রতিষ্ঠিত জাহিলিয়াত সমষ্টিরই সারনির্যাস। তা-ই শেষ নয়, তারপরও বহু কিছু আছে-
আমরা এই গ্রন্থের পরবর্তী অধ্যায়ে আধুনিক জাহিলিয়াত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপন করব, ধ্যান-ধারণার দিকটিও উপস্থিত হবে, তুলে ধরা হবে তার বাস্তব রূপরেখা। এ পর্যায়েও আমরা ইতিহাসের ধারাকেই অবলম্বন করে অগ্রসর হব।
আধুনিক ইউরোপের অভ্যুদয় ঘটেছিল ধর্মের সাথে সম্পর্কহীনভাবে, ধর্মের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে, তা থেকে অনেক দূরে থেকেই ধর্মের প্রতি শত্রুতা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, এতটা অবশ্য আমরা বলতে চাইনে।
আর তদানীন্তন ইউরোপীয় পরিবেশ পরিপ্রেক্ষিতে তা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। যদিও অবস্থার দিক দিয়ে তাই যথার্থ ও কাম্য ছিল না।
এই মধ্যযুগেই খ্রিষ্টবাদ ও ইসলামের মধ্যে ক্রুশ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।
তখনকার ইউরোপ যদিও প্রকৃতপক্ষে খ্রিষ্টবাদী –খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারী ছিল না। পূর্বোদ্ধৃত আলোচনায়ই আমরা তা দেখতে পেয়েছি। কিন্তু এই খ্রিষ্টবাদের নামে আত্মম্ভরিতা ও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে ঐক্যবদ্ধতা তখন কিছুমাত্র নিষিদ্ধ ছিল না। সে যুদ্ধ অনেক ক্ষেত্রে হীন পাশবিকতার সীমাও ছড়িয়ে গিয়েছিল। আর হিংসা-বিদ্বেষ ছিল ক্ষয়িষ্ণু ধার্মিক মনের অনিবার্য প্রতিক্রিয়া। কেননা প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তি কখনোই হিংসুক বা বিদ্বেষী হয় না; সাধারণত আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া যে কোনো হেদায়েত গ্রহণে তার কোনা কুণ্ঠা বা দ্বিধা থাকতে পারে না। কিন্তু তখনকার খ্রিষ্ট ধর্ম আসলে প্রকৃত কোনো ধর্মই ছিল না।
ব্যাপার যাই থাক না কেন, আল্লাহর দ্বীন গ্রহণ ও তাঁর পদ্ধতি অবলম্বনের বিরাট সুযোগ ইউরোপকে দেওয়া হলেও তা করতে তারা অস্বীকার করেছিল। তারা তাদের উদ্ভাবিত জাহিলিয়াতের মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকার ওপরই অবিচল হয়ে থাকল।
কিন্তু ব্যাপার এ পর্যন্ত এসেই থেমে গেল না। তথায় এমন অনেক কার্যকারণই ছিল, যা খুব দ্রুত সামনের দিকে যাওয়ার জন্যে শক্তভাবে ধাক্কা দিচ্ছিল। কিন্তু সে সম্মুখে কোনো পথে?
মুসলিম জাহানের সাথে ক্রুশধারীদের প্রচণ্ড সংঘর্ষ ইউরোপীয় জীবনের মূলের ওপর কঠিন আঘাত হানছিল এবং সমূলে উৎপাটিত করে ফেলার উপক্রম হচ্ছিল। অবশ্য পাশ্চাত্যে –আন্দালুসিয়ায় –ইসলামের সাথে ইউরোপের মিলন ঘটাটা আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ব্রিফল্ট তাঁর Making of Humanity গ্রন্থে লিখেছেনঃ
‘আধুনিক জগতে আরব ইসলামী সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল জ্ঞান বিজ্ঞান’।–[ইতিহাস আরবের ইসলামী সভ্যতা ছাড়া অপর কোনো বিশিষ্ট সভ্যতার সাথে পরিচিত নয়। আর ইসলামী সভ্যতা আরব সভ্যতা ছিল না। আরবে যে সভ্যতার উদ্ভব হয়, তা সরাসরি ইসলামের ফসল। সে সভ্যতার সব উপাদানই ইসলাম প্রদত্ত। তা ইসলামী প্রকৃতির ধারক ছিল, আরব প্রকৃতির নয়। এ সভ্যতা যে বহু সংখ্যক উপাদানে গড়ে উঠেছিল, ইসলামই হচ্ছে তার একমাত্র উপাদান।] কিন্তু তার ফল অনেক বিলম্বে পেকেছিল। যে মেধা ও প্রতিভা স্পেনে আরব সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল, তা তার কৈশোরেই প্রবল হয়ে উঠতে পারেনি। তাতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়েছিল। অন্ধকারের মেঘের আড়ালে সে সভ্যতার প্রচ্ছন্ন হয়ে পড়তেও অনেক সময় লেগেছিল। ইউরোপকে জীবনদানকালী কেবল জ্ঞান-বিজ্ঞানই একমাত্র উপকরণ ছিল না। ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিপুল প্রভাবও পড়েছিল। তার বিদ্যুৎচ্ছটা ইউরোপের একটি মাত্র দ্কি আলোকোদ্ভাসিত হয়ে ওঠেনি, তার মর্মমূলকে সুনিশ্চিতভাবে ইসলামী সংস্কৃতির প্রভাবের দিকে ফিরিয়ে নেওয়াও সম্ভবপর হয়ে উঠেছিল। সে সব প্রভাব যতটা সম্ভব ততটাই প্রকট হয়ে আছে। আর তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেই শক্তির উদ্বোধন, যা আধুনিক জগতকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট ও স্থায়ী শক্তিতে বলীয়ান করে দিয়েছে। আর দিয়েছে আধুনিক বিম্বকে উদ্ভাসিত করার শক্তি উৎস। আর তা প্রকৃতি বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক আলোচনা-গবেষণার প্রাণচাঞ্চল্য।
সেই সংঘর্ষ ও এই অবদান, এ দুটিই তো আধুনিক ইউরোপের উত্থান ও অভ্যুদয়কে সম্ভব করে দিয়েছে। অবশ্য তার বদলে এ অভ্যুদয় আল্লাহ প্রদত্ত জীবন পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেনি। অথচ তা-ই ইসলামী অভ্যুদয়কে বাস্তব করেছিল, কিন্তু ইউরোপ তা থেকেই আলো গ্রহণ করেও আল্লাহ প্রদত্ত জীবন পদ্ধতি থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেছে। তা একদিকে ইসলামের ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাসের সাথে প্রচণ্ড দ্বন্দ্বে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
তবে ইসলামের সাথে ইউরোপের বিবাদ-সংঘাত নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা প্রসূত হিংসা ও বিদ্বেষের ফল। যার চরম পর্যায়ে অত্যন্ত ক্ষতিকর ক্রুশ যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল।
আর তার নিজের ধর্ম ও ধর্মীয় আকীদার সাথে সংঘাত, তা ইউরোপীয় জনগণের মনে জাগিয়ে দিয়েছিল গীর্জার নির্বুদ্ধিতা ও তার উত্তেজনা সৃষ্টিকারী স্বৈরাচার।
গীর্জা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। কেননা মুর্খতাই ছিল জনগণের ওপর তার প্রভাব-প্রতিপত্তি স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত রাখার ও তার সংরক্ষণের সবচেয়ে বড় সনদ। জনগণ যেদিন মূর্খতা পরিহার করে শিক্ষিত হয়ে উঠবে, যেদিন তারা জানতে পারবে যে, গীর্জা তাদের যা কিছু শেখাচ্ছে, তা অপ্রমাণ্য পৌরাণিত কল্প-কাহিণীর স্তূপ ছাড়া আর কিছুই নয়, সেদিন এই জনগণ আর গীর্জার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব সহজে মেনে নিতে কিছুতেই রাজি হবে না। কেননা তার কর্তৃত্ব কেবল মূর্খতা ও অন্ধকারের মধ্যেই টিকে থাকতে পারে।
গীর্জা ছিল স্বাধীনতার দুশমন। কেননা স্বাধীনতা অত্যাচারী প্রভুত্ব আধিপত্যের জন্যে অত্যন্ত বিপজ্জনক। যেদিন জনগণ স্বাধীনতার স্বাদ পাবে ও তা আস্বাদন করবে, সেদিন তারা দাসত্ব করতে আর প্রস্তুত হবে না যদিও সে দাসত্ব ধর্মের নামে চলছে, ধর্মীয় কর্তৃত্বের দোহাই দিয়ে দাসত্ব করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
গীর্জার অভ্যন্তরে চলছিল পৈশাচিক চরিত্রহীনতা, যৌনতার পরাকাষ্ঠা। আর তা-ই জনগণের ওপর তাকওয়া-পরহেযগারীর বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে। উপদেশ দিচ্ছে উত্তম চরিত্র গ্রহণের জন্যে! কিন্তু তা কেন মানা হবে?
তা ছিল ব্যবসায়ী কর ও মালিকানা স্বত্ব বাবদ আদায়কৃত কর-এর ওপর চাপানো কর্তব্য। কৃষককুলকে যে গীর্জা-মালিকাতাধীন জমিতে বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিতে বাধ্য করা হতো, অথচ তারা দারিদ্র্য ও বঞ্চনার আঘাতে ছিল জর্জরিত। এসব সত্ত্বেও তাদের ওপর ছিল নৈতিকতার বাধ্যবাধকতা!
এরূপ অবস্থায় যখনই –যে মুহুর্তে গণজাগরণ সৃষ্টি হবে, তখন যে তা এই মিথ্যা ধার্মিকতার সব বেড়াজাল ছিন্ন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, তা আর বিচিত্র কি! চরম শত্রুতা ও আক্রোশের ঝাণ্ডা না-ই বা তুলল।
কার্যত তথায় তা-ই ঘটেছে।
তথায় যে গনজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল, তা এই কারণেই ধর্মীয় প্রভাব বিমুক্ত (Secular) ছিল। তা এমন কেন্দ্রবিন্দুতে সুসংবদ্ধ হয়ে উঠেছিল বা বিন্দু বিন্দু করে ধর্ম ও ধর্মীয় আকীদা বিশ্বাস থেকে অনেক দূরে নিয়ে গিয়েছিল গোটা ইউরোপীয় সমাজকে গণ-অনুভূতি ও আচার-আচরণও হয়ে গিয়েছিল ধর্মীয় প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
ইউরোপ এক্ষণে তার সেই প্রাথমিক উৎস মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল যেখানে তা ছিল খ্রিষ্ট ধর্ম অবলম্বনের পূর্বে। তা হল প্রাচীন গ্রীক ও রোমান উত্তরাধিকার। অন্য কথায় সেই পূর্বতন জাহিলিয়াতের মধ্যেই নিমজ্জিত হয়ে পড়ল। এ দুটি তো প্রধান জাহিলিয়াতই ছিল, মধ্যযুগে কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়েছিল। অত্যাচারী গীর্জার অপমানকর প্রভুত্ব আধিপত্যের সম্মুখে বিনীত হওয়ার লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত হয়েছিল তাদের মন ও মগজ। মানুষের জন্যে এই দাসত্ব হয়ে উঠেছিল চরম ঘৃণ্য। সবদিক দিয়েই তারা স্বাধীনতার উন্মুক্ত ময়দানের দিকে সম্প্রসারিত হয়েছিল।
কিন্তু তারা সেই ‘নূর’ কে তার স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত মৌলনীতির ওপর ধারণ করে রাখতে পারেনি। তারা নির্ভুল হেদায়েত অনুযায়ী পারেনি নিজেদের চালিত করতে। যে ইসলাম থেকে তারা এই ‘নূর’ গ্রহণ করেছিল, সেই ইসলামের শাশ্বত বিধান ও পদ্ধতির ওপর তারা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে পারেনি অথচ এই ইসলাম তো আল্লাহরই দেওয়া দ্বীন।
তাঁর প্রতি তারা চরম মাত্রায় ঘৃণা পোষণ করেছিল, চরম শত্রুতা শুরু করে দিয়েছিল তাদের এই উস্তাদদের সাথে, যাদের কাছ থেকে তারা জ্ঞানের আলো গ্রহণ করে আলোকমণ্ডিত হয়েছিল। তারা প্রখ্যাত অনুসন্ধানের বর্বরতায় মেতে উঠেছিল। তারা বিতাড়িত করেছিল মুসলমানদের আন্দালুসিয়া থেকে। তারই অনিবার্য পরিণতিতে তারা সেই অত্যাচারী প্রভুত্ব কর্তৃত্বের দিকেই ফিরিয়ে নিয়ে গেল সেই দেশকে।
তারা মুসলমানদের কাছ থেকেই জ্ঞান শিক্ষালাভ করেছিল, শিখেছিল সভ্যতা, পেয়েছিল স্বাধীনতার স্বাদ।
বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা পদ্ধতিও তারা মুসলমানদের কাছ থেকেই জানতে পেরেছিল। এই পরীক্ষা পদ্ধতিই তো আধুনিক বিজ্ঞানের চরমোন্নতির মূল ভিত্তি।
গোষ্ঠীগতভাবে একত্রি হওয়ার পদ্ধতিও তারা মুসলমানদের কাছ থেকে পেয়েছিল। তার পূর্বে তারা ছিল খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত। আর আঞ্চলিক স্বৈরতন্ত্রীই তাদের ওপর চালাত একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ভিত্তিক শাসন ও শোষণ। তখন এক-একজন শাসক বিধান রচনা, বিচারকার্য ও প্রশাসন পরিচালনা করত। সবই ছিল সেই এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক। আর সে ভূখণ্ডের জনতা ছিল তার হুকুম পালনকারী দাসানুদাস।
মানবাধিকার সম্পর্কে তারা জ্ঞান পেয়েছিল মুসলমানদের কাছে, তারপর তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল মানব প্রজাতির মুক্তির দাবি উত্থাপন করা। যে দাসত্ব শৃঙ্খল তাদের মন ও চিন্তার ওপর জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসে প্রতি মুহুর্তে তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে দিচ্ছিল, তা থেকে নিষ্কৃতির উপায় জানতে পেরেছিল তারা মুসলমানদের কাছ থেকে।
কিন্তু এতদসত্ত্বেও তারা জাহিলিয়াতের মধ্যেই নিমগ্ন হয়ে থাকল। এসব ক্ষেত্রে আল্লাহ প্রদত্ত পদ্ধতিকে অবলম্বন ও অনুসরণ করতে তারা অস্বীকার করে বসেছিল। আর মুসলিম জাহান থেকে সংগৃহীত সেই ‘নূর’ পেয়েও তারা তাদের সেই প্রাচীন জাহিলিয়াতের উত্তরাধিকারের দিকেই প্রত্যাবর্তন করেছিল। সে উত্তরাধিকার ছিল গ্রীকদের, রোমানদের।
মুক্তির উন্মুক্ত মহাসড়ক সম্মুখে উপস্থিত পেয়েও তারা এই সুযোগ হারিয়ে ফেলল। তারা শিখেছিল, সভ্যতার সন্ধান পেয়েছিল, মুক্ত এবং স্বাধীনও হয়েছিল। আর এক সুউচ্চ সুপুষ্ট সভ্যতাও শক্ত করে গড়ে তুলেছিল। কিন্তু তা তারা প্রতিষ্ঠিত করেছিল ভাঙ্গনমুখী নদীর তীরে।
পূর্বেই একথা বলে এসেছি যে জাহিলিয়াত জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা নাগরিকত্ব ও বস্তুগত উৎপাদদের অগ্রগতির বিপরীত অর্থ জ্ঞাপক কোনো শব্দ বা পরিভাষা নয়। জাহিলিয়াতেরও এই সব কথা ও পুরো মাত্রায় পাওয়া খুবই সম্ভব। কিন্তু তা সত্ত্বেও জনগণের অন্ধ জাহিলিয়াতের মধ্যে নিমজ্জিত থাকাও একান্তভাবে সম্ভব।
একথা বলতেও বাকী রাখিনি যে, জাহিলিয়াতে মানব কল্যাণকর কোনো উপাদান থাকবে না, এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু তাতে আনুপাতিক ভাবে যে কল্যাণটুকু থাকে, তা জাহিলিয়াতের অকল্যাণ ও অসম্মান থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে কিছু মাত্র সক্ষম নয়। জাহিলিয়াতের চূড়ান্ত পর্যায়ের নিশ্চিত অধোগতি প্রতিরোধ করবে, এমন সাধ্য তার হয় না।
আমরা আসরে খুব তাড়াহুড়া করে কথা বলতে চাইনে। ইতিহাসের ধীরে অগ্রগতির সাথে তাল রেখেই আমরা সম্মুখের দিকে অগ্রসর হতে চাই।
ধর্ম ও দ্বীন ব্যবস্থা থেকে ইউরোপের উপরিউক্ত দূরবর্তিতা হঠাৎ করে ঘটেনি। আকস্মিকভাবে বা এক সাথেও সংঘটিত হয়নি তা। কেননা মানব প্রকৃতিই এই আকস্মিকতার পক্ষপাতী নয়।
মানুষের মনে এক একটি বিষয় ক্রমাগতভাবে ও খুব ধীর গতিতে জেগে ওঠে। এ ধীরতা অবশ্যম্ভাবী। আর এই ধীর গতিতে প্রত্যেক ব্যক্তির মনে যখন কোনো ভাবধারা স্থান করে নেয় ঠিক তখনই গোটা সমাজ তা গ্রহণ করে না। সামষ্টিকভাবে সেই ভাবধারা গৃহীত হওয়ার ব্যাপারটি বাস্তবায়িত হয় আরও পরে এবং অত্যন্ত ধীর নিয়মে। সমাজ সমষ্টি এলোমেলোভাবে বিষয়গুলো স্তূপীকৃত করে এবং খুব দ্রুত প্রবাহিত হয়ে যাওয়া থেকে চিন্তা চেতনা ও আচার-আচরণকে রক্ষা করে। তা প্রত্যেক নাবাগতের জন্যে এক ধরনের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা গড়ে তোলা। প্রতিষ্ঠিত সংস্থা কল্যাণসমৃদ্ধ হোক, কি অকল্যাণের ধারক, উভয় অবস্থাই এ ক্ষেত্রে সমাজ। নবাগত বিষয় সম্পর্কেও এই কথা।
এই কারণে ইউরোপ বহু শতাব্দীকাল পর্যন্ত এক সংমিশ্রিত ব্যক্তিত্ব নিয়ে জীবন যাপন করেছে। একই সময় খ্রিষ্টবাদ ও পৌত্তলিকতার সংমিশ্রি রূপই হচ্ছে তার আসল অবস্থা।
নবজাগরণ –অভ্যুদয় তার নিজস্ব পথেই অগ্রসর হয়। তা একই সাথে শক্তি আহরণ করতে থাকে গ্রীক ও রোমান পৌত্তলিকতা থেকে আর প্রতি পদক্ষেপেই তা ইসলামী সভ্যতা ও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে দূরে –বহু দূরে সরে গিয়ে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় গভীর শিকড় বিস্তীর্ণকারী উক্ত জাহিলিয়াত দুটির সাথে ক্রমাগত ঘনিষ্ঠ হতেও ঘনিষ্ঠতর হচ্ছিল।
আকীদা-বিশ্বাস মানব মনে স্থির থেকে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে যতটা সম্ভব লোকদের ব্যক্তিগত আচার-আচরণে এবং তাদের জীবনবোধে। কিন্তু এই জীবনটা যদি ধীরে ধীরে দ্বীন বা ধর্মীয় চিন্তা-বিশ্বাসে সমৃদ্ধ না হয় বা দ্বীনের সাথে সাংঘর্ষিক এমন পথে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে তা দ্বীনের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যাবে, তাতে কি কোনো সন্দেহ থাকতে পারে!
এই দ্বৈত ভাবধারা সমৃদ্ধ অবস্থায় সেই ঘটনা সংঘটিত হলো, ইতিহাসে যা সংশোধন (Reformation) নামে খ্যাত। তা ছিল ধর্মের সংশোধন। ধর্মকে পরিচ্ছন্ন করার জন্যে সূচিত এই আন্দোলনসমূহ একই সময় বিস্তৃর্ণ বিশাল জীবন ক্ষেত্রের ওপর তার প্রভাব বিস্তৃত করার জন্যেও চেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্তু কার্যত তা অসম্ভভই থেকে গেল। অন্তত এতটুকু বলা যায়, বাস্তবে তা ঘটতে পারল না। তার কারণও সুস্পষ্ট। এই সংশোধনকামীদের নিজেদের মনেও দ্বীন বা ধর্ম সম্পর্কিত ধারণা তা-ই ছিল ধারণ করে আসছিল সেই জাহিলী প্রকৃত থাকার সময় থেকে। আর তা হচ্ছে ধর্মীয় বিশ্বাস ও বাস্তব জীবন-বিধান শরীয়তের বিচ্ছিন্নতা ও দ্বৈততা। আল্লাহর শরীয়তকে বাদ দিয়ে বাস্তব জীবনে ভিন্নতর কোনো শরীয়তকে চালু করা। ফলে আকীদা-বিশ্বাসের মানে বাস্তব জীবনে ভিন্নতর কোনো শরীয়তকে চালু করা। ফলে আকীদা-বিম্বাসের মানে বাস্তব জীবনের কোনো সঙ্গতি থাকবে না। ফলে সব ধর্মীয় সংশোধনীই নিছক মানসিক খুঁত-খুতানি প্রতিকার হওয়ার জন্যে, বাস্তব জীবন-ক্ষেত্রে তার একবিন্দু প্রভাব প্রতিফলিত হতে পারল না।
এর মূলেও বড় বড় কারণ নিহিত ছিল। উক্ত আন্দোলন সমূহের মূলে প্রচ্ছন্ন কারণ ছিল নিছক ‘জাতীয়তা’ বা জাতিত্ব চেতনা, ধর্মীয় কারণ ছিল না মোটেই। জাতিসমূহ শুধু নিজেদের জাতিত্ব বা জাতি সত্তাকেই প্রকাশমান করতে চেয়েছিল তাদের গীর্জাকে রোমান গীর্জার প্রভাব ও কর্তৃত্ব প্রাধান্য থেকে মুক্ত করার মাধ্যমে। কিন্তু সাধারণত মানুষ যে আকীদা-বিশ্বাসের ভিত্তিতে একত্রিত ও ঐক্যবদ্ধ হয় আল্লাহর দিকে চলার লক্ষ্যে, তা কখনোই উক্ত বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতার সমর্থক হতে পারে না। তাদের জাতীয়তা বা ভূমির যে খণ্ডে তারা বসবাস করে তার আঞ্চলিকতার ভিত্তিতেও একই ঐক্যবদ্ধতা সম্ভব হতে পারে না। ফলে তাদের জাতিত্ব চেতনা ছিল ধর্মীয় আকীদার প্রকৃতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
বস্তুত মানবীয় সত্তা অভিন্ন একক। তাকে অনুভূতি বা স্বজ্ঞা ও বাস্তবতা –এই দুয়ের মধ্যে বিভক্ত করা যেতে পারে না।
মানবীয় জীবন অবিভাজ্য একক। তাকে বিশ্বাস ও বাস্তব আচার-আচরণ এই দুটি বিভাগে বিভক্ত করা চলে না।
আল্লাহর কাছ থেকে অবতীর্ণ দ্বীনও অনুরূপ এক, অবিভাজ্য। তাতে আকীদা ও বাস্তব বিধান –এই দুয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। স্বজ্ঞা ও বাস্তব জীবনের মধ্যে পার্থক্য করাও অসম্ভব।
ঠিক যে সময়ে ইউরোপে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছিল, তখন নবোদ্ভুত পুঁজিতন্ত্র ভূ-পৃষ্ঠকে ওলট-পালট করে দিচ্ছিল। এই পুঁজিতন্ত্র এক সম্পূর্ণ অ-ধর্মীয় ভিত্তিতে গড়ে ওঠা মতাদর্শ। তাতে সুদ, অপহরণ, ছল-চাতুরী, ঠকবাজি, মূল্য বৃদ্ধি, অপকৌশল ইত্যাদিই হচ্ছে পুঁজিবাদের অবিচ্ছিন্ন গুণপনা। শ্রমজীবীদের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন এবং তাদের লালতপ্ত রক্ত চুষে নেওয়া। আর ওদিকে ধর্মীয় সংস্কারবাদীরা লোকদের অন্ত চেতনার সংশোধন-সংস্কারে ব্যতিব্যস্ত। মোটকথা, ইউরোপীয় সমাজের লোকদের ব্যক্তিসত্তার দ্বৈত অবস্থার টানা পোড়নে চলতে থাকে কয়েক শতাব্দীকাল ধরে।
কিন্তু চক্ষুস্মানের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল ইতিহাসের গতিধারার দিকে। ঘটনাবলীর ঝোঁক প্রবণতা লক্ষ্য করতে একটুও ভ্যুল করেনি। স্পষ্ট লক্ষ্য করা যাচ্ছিল যে, ঘটনাবলীর প্রবণতা নিঃসন্দেহে ধর্মহীনতার (Secularism) দিকে জীবনের সকল পর্যায়ে ও বাঁকে এবং তা ক্রমাগতভাবে দ্বীন ও ধর্মের পথ থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে।
যদিও বাস্তব কার্যক্রম ক্রমিক ও ধীর গতিতে চলছিল। এভাবে ঊনবিংশ শতাব্দী এসে উপস্থিত হলো। আর ইউরোপীয় ইতিহাসে এই শতাব্দীই হচ্ছে বড় বড় ঘটনাবলী সংঘটিত হওয়ার শতাব্দী। এই শতকে এমন দুটি বড় ঘটনা সংঘটিত হয়, যা ইতিহাসের ধারাকে কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রিত ও ভিন্নতর একটি পথে পরিচালিত করে।
প্রথম ঘটনা, ডারউইনীয় বিবর্তনবাদে আত্মপ্রকাশ।
আর দ্বিতীয় ঘটনা, শিল্প বিপ্লব।
এ দুটি যেন যথাসময়ে সংঘটিত হলো। মধ্যযুগীয় ভাবধারার শেষ রেশটুকুকেও চিরতরে বিলীন ও ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যে এ দুটি ঘটনা যথাসময়ে ঘটে গেল।
এই সময় নবতর এক জাহিলিয়াতের বিরাট উঁচু চোখ ঝলসানো চাকচিক্যময় প্রাসাদ নির্মাণের লক্ষ্যে মধ্যযুগীয় জাহিলিয়াতের অবশিষ্টের নাম চিহ্ন পর্যন্ত মুছে ফেলল। আর তা-ই হলো এ যুগের জাহিলিয়াত।
ডারউইনীয় বিবর্তনবাদ চিন্তা ও মতবাদের জগতে আকীদা-বিশ্বাসের ওপর কঠিন প্রলয়ংকর আঘাত হানল। শিল্প বিপ্লবেও তা প্রয়োগীয় অবকাঠামোয় মৌলিক পরিবর্তন সূচিত করে।
ডারউইনের জন্ম ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর গ্রন্থ ‘প্রজাতিসমূহের মূল’ (Original of Species) প্রকাশিত হয়। আর ১৮৭১ সনে প্রকাশিত হয় ‘মানুষের মূল্য’ সম্পর্কীয় গ্রন্থটি।
অতঃপর আকীদা-বিশ্বাস ও চিন্তার ক্ষেত্রে ভয়াবহ তোলপাড় ও ঘটনাবলীর তরঙ্গমালা ঘটতে থাকে অব্যাহত ধারায়।
বোতলবদ্ধ ভূত বোতল ভেঙে বেরিয়ে গেছে। তাকে ফিরিয়ে আনার আর কোনো উপায় –কোনো পন্থাই থাকল না। এ ভূত হচ্ছে ‘বিবর্তনবাদ’। এ ভূত মহা অত্যাচারী। তার সম্মুখে যা কিছুই আসে, সবই ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়ে যায়। পথে স্থিতিশীল ও প্রতিষ্ঠিত যা কিছুই আছে, তা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে না দিয়ে সে এক মুহুর্তও থেকে থাকতে পারে না।
আকীদা-বিশ্বাস ও ইউরোপীয় চিন্তা সবকিছুর ওপর ডারউইনীয় বিবর্তনবাদ কি কঠিন সর্বধ্বংসী আঘাত হেনেছে, তার বিস্তারিত আলোচনা আমি ইতিপূর্বে পেশ করেছি ‘বিবর্তন ও স্থিতি’ নামক এবং অন্য একটি গ্রন্থে। সেই সব কথাই এখানে পুনরাবৃত্তি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে যেমন আমরা আমাদের সংশ্লিষ্ট পরবর্তী আলোচনার দিকে ফিরে যেতে পারি। পরবর্তী অধ্যায়সমূহে এই প্রসঙ্গটি পুনরায় আসবে।
ডারউইন গবেষণাগারে বসে যে বিবর্তনবাদ রচনা করেছেন, পরবর্তীকালে তা আর গবেষণা ক্ষেত্রের ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকেনি। তার সীমিত বেষ্টনীর মধ্যে তাকে সীমিত করে রাখাও কোনোক্রমেই সম্ভব ছিল না। সময়ের চিন্তাবিদ মনীষী, বিশেষজ্ঞ ও জনগণ তা হাতে হাতে তুলে নিল। তাদের সকলেরই মাথা ঘুরে গেল। অতঃপর তারা অস্তিত্বের জগতে কোনো কিছুই স্থিতিশীল দেখতে পেল না। এমন কি আকীদা-বিশ্বাস আল্লাহর চিন্তায় পর্যন্ত এই বিবর্তনবাদের প্রয়োগ হতে শুরু হয়ে গেল।
ফলে গীর্জা ও ডারউইনের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হল। গীর্জা তাকে ‘নাস্তিক’ নামে আখ্যায়িত করল। আর ডারউইন গীর্জাকে মূর্খতা ও কুসংস্কারের লীলাকেন্দ্র বলে অভিযুক্ত করল। জনগণ প্রথম দিকে গীর্জার পক্ষে ছিল। গীর্জা তার বিশ্বাসকে জোরদার করে প্রচার করল। আর ডারউইন মানুষকে নিম্নমানের জীব-জন্তুর আকৃতিতে ভূষিত করলেন। শেষ পর্যন্ত জনগণ গীর্জার পক্ষ ত্যাগ করে ডারউইন সমর্থকদের কাতারে জমায়েত হয়ে গেল। কেননা ডারউইনীয় মতবাদের হাতিয়ার দ্বারা তারা অত্যাচারী ও দাসত্ব শৃঙ্খলে বন্দী করে মানুষকে লাঞ্ছিতকারী গীর্জার প্রভাব প্রতিপত্তি খতম করার এক মহান সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল।
এ যুগ্ঘে শেষ পর্যন্ত ‘ধর্ম’ পরাজিত হলো। আর বোতল ভেঙে বের হয়ে আসা ভূত বিজয়ী হয়ে দাঁড়াল। তার পথে আর কোনো বাঁধাই থাকল না।
অপরদিকে এই সময়ই শিল্প পৃথিবীকে কঠিন ধাক্কায় কাঁপিয়ে দিল। পুরাতন সমাজ ব্যবস্থার রূপটাকেই আমূল বদলে দিল এবং নতুন সমাজ গড়ার একটা ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল।
কিন্তু এ নতুন সমাজ ব্যবস্থার সাথে আকীদা-বিশ্বাসের কোনোই সম্পর্ক থাকল না। তা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গড়ে উঠল নতুন সমাজ কাঠামো।
এ সমাজের প্রতিটি জিনিসই ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক, যুধ্যমান, ধর্মকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলার প্রবণতাসম্পন্ন।
সীমা লংঘনকারী পুঁজিতন্ত্র ধর্মীয় আদেশ-উপদেশসমূহকে অপমানিত করার ক্ষেত্রে কোন সীমা পর্যন্ত এসে থেকে থাকল না। তা চুরি করতে লাগল জনগণের সম্পদ, লুটে পুটে নিতে লাগল সবকিছু। নিরীহ মানুসকে নির্দ্ধিধায় হত্যা করতে লাগল, নিরপরাধ রক্ত বন্যা পানির মতো প্রবাহিত হতে লাগল। তা মানুষকে প্ররোচিত করল আবহমান কালের সহজ-সরল জীবন ধারা থেকে বের হয়ে এসে বিলাস ও সৌন্দর্যের দ্রব্যাদি বিক্রয় করে বেশি বেশি মুনাফা অর্জনের জন্যে। তারা অবস্থার স্বাভাবিক পরিণতিতে বিপুল মুনাফা অর্জনের মহা সুযোগও পেয়ে গেল। এলো সামাজিক ক্ষেত্রে মহাবিপর্যয়।
তা নারী সমাজকে তাদের শান্তির নীড় ঘর-সংসার থেকে টেনে বের করে নিয়ে শিল্প-কারখানায় উপস্থিত করে দিল। যেন এখানে শ্রম করেই তারা মুঠোমুঠো খাবার যোগাড় করতে পারে। ক্রমশ তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হলো, যেন পুরুষ শ্রমিকদের ব্যবস্থাপনা বিরোধী আন্দোলনসমূহকে খতম করে দেওয়া যায়। কেননা এই পুরুষ শ্রমিকরাই পুঁজিতন্ত্রের বেশি বেশি আয়ের ওপর বাধার সৃষ্টি করছিল। মেয়েরা স্বল্প পরিমাণ মজুরী পেয়ে নিজেদের রক্ত পানি করতে ও শক্তি ক্ষয় করতে প্রস্তুত হলো। এমনিভাবে তারা একমুঠো খাবার পাওয়ার বিনিময়ে নিজেদের নৈতিকতা বিসর্জন দিতে বাধ্য হলো।
পুঁজিবাদ সৃষ্ট শিল্প-কারখানায় সমাজের যুবক শ্রমিকদের একত্রিত করল। তারা বাধ্য হলো স্ত্রী পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে। যৌবনকালীন এই নিঃসঙ্গ ও স্ত্রী বর্জিত জীবনে তাদের মধ্যে নৈতিক চরিত্রের চরম বিপর্যয় ঘটে গেল। ব্যভিচারের পথেই তারা তাদের এই সমস্যার সমাধান করতে বাধ্য হলো।
এভাবে, হ্যাঁ এভাবেই আকীদা-বিশ্বাস ও নৈতিকতার শক্ত বাঁধন ক্রমাগত ঢিলে ও আলগা হয়ে যেতে থাকল। চরিত্রের প্রাসাদটি ভেঙে পড়ল।
না, ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে ডারউইনীয় চিন্তা-মতবাদ ও শিল্প বিপ্লব পর্যন্তই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকল না।
শয়তানেরও কোনো অভাব থাকল না এই ময়দানে।
বিশ্ব ইহুদীবাদ তার এক মহাস্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্যে ওঁৎ পেতে বসেছিল। সে স্বপ্ন হচ্ছে বিশ্ব মানবের ওপর নিজস্ব নিরংকুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। আর কুরআনের ভাষায় তা হচ্ছে ‘উম্মী’ গণের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন।–[এ হচ্ছে কুরআনের ব্যাখ্যা বলেছেঃ (আরবী**********************************) ‘তা এভাবে যে, তারা বলেছে আমাদের উম্মী লোকদের কোনো দাবী-দাওয়া নেই; আমরা এখানে ‘উম্মিয়ীন’ শব্দটির ওপর জোর দিচ্ছি। যার অনুবাদ করা হয়েছে Gentiles বলা। অর্থাৎ ইহা ইহুদীদের ছাড়া অন্যান্য সব জনগোষ্ঠী।]
‘তালমুদ’ গ্রন্থে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ উম্মী লোকেরা হচ্ছে গর্দভ। ওদেরকে আল্লাহ সৃষ্টিই করেছেন এই জন্যে যে, ওদের পিঠে সওয়ার হবে আল্লাহর বার্ছাইকরা জনগোষ্ঠী।
আর তাদের গোপন শিক্ষা তাদেরকে (ইহুদীদের) বলেছেঃ
‘তোমরা অপেক্ষায় থাকো। শেষ পর্যন্ত তোমরা পেয়ে যাবে ওদের এমন এক অসতর্কতার সময়, যখন তোমরা গাধার পিঠের ওপর শক্ত হয়ে বসতে পারবে’। ইউরোপীয় পুনর্জাগরণ যে ধর্মহীনতার ভিত্তিতে সংঘটিত হয়েছে এজন্যে অন্যরা যা-ই মনে করুক, বিশ্ব ইহুদীবাদ অত্যন্ত সন্তুষ্টিবোধ করেছে। ইউরোপের পুরাতন আকীদাকে খতম করার জন্যে এই ধর্মহীনতার দ্বারা অর্ধেক পথ এগিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর বিম্ব ইহুদীবাদের পক্ষে দুশমন হচ্ছে এই আকীদা যা অত্যন্ত শক্ত ভিত্তির ওপর স্থাপিত, যা শয়তানের সমস্ত ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার জালকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়। আর এই আকীদাই যদি অশক্ত ও ঢিলেঢালা হয়ে যায়, তাহলেই শয়তানদের পক্ষে গাধার পিঠে সওয়ার হয়ে বসা খুবই সহজসাধ্য হয়ে যায়।
আল্লাহ তা’আলা শয়তানের চ্যালেঞ্জের জবাবে বলেছিলেনঃ
(আরবী****************************************************************)
শয়তানের কোনো কর্তৃত্ব-আধিপত্য নেই সেই লোকদের ওপর যারা প্রকৃতভাবে ঈমান এনেছে এবং তাদের আল্লাহর ওপর পূর্ণ নির্ভরতা অবলম্বন করে থাকে। (সূরা-নহলঃ ৯৯)
অপর আয়াতে বলেছেনঃ
(আরবী***********************************************************************************)
শয়তানের আধিপত্য কর্তৃত্ব কেবল তাদের ওপরই প্রতিষ্ঠিত যারা তাকেই বন্ধু-পৃষ্ঠপোষক বানায়। আর যারা তার সাথে শিরক করে মুশরিক হয়ে আছে। (সূরা-নহলঃ ১০০)
বস্তুত শয়তান তার বড় বন্ধু ও সাহায্যকারী পেয়ে গেছে বিশ্ব-ইহুদীবাদী শয়তানদের মধ্য থেকে। তারা প্রতীক্ষায় থেকে শেষ পর্যণ্ত পেয়ে গেছে মহা অনুকূল সুযোগ ও ক্ষেত্র। এই বিরাট ঘটনা দ্বারা বলা যায়, এই দুটি ঐতিহাসিক ঘটনার মাধ্যমে! তার একটি ডারউইনবাদ আর অপরটি শিল্প বিপ্লব।
স্বীকার করছি, হতে পারে ডারউইন হয়ত শয়তান ছিল না। সে হয়ত বিশ্ব মানবতার কোনো অনিষ্ট করার চিন্তাই করেনি তার মতবাদের মাধ্যমে।
কিন্তু এ-ও অনস্বীকার্য যে, অনেক মনীষীই এক একটি বিশ্বাসের কথা এই মনে করে প্রকাশ ও প্রচার করে যে, তা সত্য হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে যে ভুল করে তাঁর মতবাদ রচনায় –ডারউইনীয় চিন্তার মৌলনীতিসমূহের প্রতি বিশ্বাস রেখেও স্বয়ং নব ডারউইনবাদ (Neo-Darwinism) যে কথা অকপটে স্বীকার করেছে, -তার মাশুল গোটা মানবতাও হয়ত আদায় করে দিতে পারে না। কেননা ডারউউনের বিশ্বাস ছিল যে, মানুষ হচ্ছে পশু –জীব-জন্তু বিশেষ। কিন্তু উত্তরকালে তাঁর মত বিজ্ঞানের কাছে গৃহীত হয়নি। বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, মানুষ এক স্বতন্ত্র সৃষ্টি। তার মহো দেহাবয়বসম্পন্ন সত্তাও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্ট হয়েছে, তার মনমানসিকতা, বিবেক-বুদ্ধি ও রূহ-এর স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্ট হওয়া তো একান্তভাবেই অবধারিত। কিন্তু ডারউইনের মতবাদে এই মারাত্মক ভুলটি রয়ে গেছে। তাই বলতে হচ্ছে, সে তার মতবাদ হয়ত খারাপ উদ্দেশ্যে পেশ করেনি, যদিও সে তার এই মতবাদটিকে ধর্মীয় আকীদা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে উপস্থাপিত করেছে। সে নিজেই বলেছেঃ ‘আল্লাহ স্বীকৃতির ভিত্তিতে জীবনের ব্যাখ্যাদান ব্যাপারটি ঠিক এ রকম, যেমন নিছক একটি যন্ত্রের মধ্যে তার প্রকৃতি পরিপন্থী কোনো উপকরণ প্রবেশ করিয়ে দেয়। সে এ-ও বলেছেঃ প্রকৃতি সব জিনিসই সৃষ্টি করেছে। তার সৃষ্টি ক্ষশতার কোনো সীমা নেই।
কিন্তু ইহুদী শয়তানেরা অত্যন্ত খারাপ উদ্দেশ্যে এই মতবাদটির মধ্যে অনেক খারাপ ধারণা শামিল করে দিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্যে মানবসত্তাকেই ধ্বংস করা।
ইহুদীবাদের প্রোটোকল-এ বলা হয়েছেঃ ডারউইন ইহুদী নয়। কিন্তু আমরা জানি, কি করে তার মতবাদটিকে ব্যাপক ক্ষেত্রে প্রচার করে দেওয়া যায়। আমরা এটিকে ধর্মের ভিত্তিকে ধ্বংস করার কাজে প্রয়োগ করব।
উক্ত বইতে এ-ও বলা হয়েছেঃ আমরা ডারউইন, মার্কস ও নিটশের সাফল্য সৃষ্টি করব তাদের মতবাদের ব্যাপক প্রচার ও প্রচলন করে। অ-ইহুদী চিন্তায় তাদের বৈজ্ঞানিক মতবাদ নৈতিকতার জন্যে যে ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া রয়েছে, তা তাদের সম্মুখে সর্বতোভাবে সুস্পষ্ট ও প্রকট।
সন্দেহ নেই, বিশ্ব ইহুদীবাদ ডারউইনের চিন্তাধারা ও ক্রমবিকাশবাদকে খুব বেশী বড় করে তুলেছে, বীভৎস রূপ দিয়েছে ইউরোপীয় জাহিলিয়াতের অবশিষ্ট সকল ভালো মূল্যবোধকে সম্পূর্ণ খতম করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এই কাজে তারা তিনজন প্রধান চিন্তানায়কের চিন্তাধারাকে ব্যবহার করেছে। তারা হচ্ছেঃ মার্কস, ফ্রয়েড ও দরখায়েম। এ তিনজন চিন্তাবিদই ধর্ম সম্পর্কে কথা বলতে গেয় খুব তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও হীনতা দেখিয়েছে। জনগণের মনে ধর্মকে জঘন্য রূপে চিত্রিত করতে চেষ্টা করেছে।–[(আরবী******************) গ্রন্থের (আরবী****************) ‘তিন ইহুদী’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।]
দরখায়েম লিখেছেঃ ধর্ম প্রকৃতি সম্মত নয়।
মার্কস বলেছেঃ ধর্ম জনগণের জন্যে আফিম। তা এমন সব উপকথার সমষ্টি, যা সামন্তবাদী ও পুঁজি মালিকেরা রচনা করেছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রমজীবী জনতাকে চেতনাহীন করে দেওয়া এবং পরকালীন নিয়ামনের লোভ দেখিয়ে দুনিয়ার জীবনে বঞ্চিত থাকতে রাজি করা।
ফ্রয়েড বলেছেঃ ধর্ম সৃষ্ট হয়েছে মানুষের বঞ্চনা ও ব্যর্থতার ফলশ্রুতি হিসেবে তা উৎসারিত হয়েছে যৌন কামনা থেকে, যা পুত্র সন্তান তার মার প্রতি বোধ করে। পুত্র যে তার পিতাকে হত্যা করার আগ্রহী হয় তা থেকে।
এ তিনজনই মানুষের নৈতিকতাকে ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। দরখায়েম বলেছেনঃ অপরাধ নিতান্তই কাল্পনিক জিনিস। বিয়ে স্বভাবসম্মত নয়; নৈতিকতার সম্পর্কে সেভাবে কথা বলা যায় না যেন তা স্থিতিশীল সত্তা। তা সবই সামষ্টিক বিবেক-বুদ্ধির সৃষ্টি, যা একই অবস্থায় স্থায়ী হয়ে থাকে না। তা এক ‘অপোজিট’ থেকে অপর ‘অপোজিট’ –এর দিকে পরিবর্তিত হতে থাকে। কার্ল মার্কস বলেছেনঃ চরিত্র হচ্ছে বিবর্তনশীল অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতিফলন, যা সব সময়ই পরিবর্তন সাপেক্ষ, তা কোনো স্থায়ী মূল্যমান নয়।
ফ্রয়েড বলেছেনঃ চরিত্র জুলুমের চিহ্ন, মানবতার পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর।
ধর্মের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র এখানে এসেই থেমে যায়নি। এই ষড়যন্ত্র নারী জাতিকেও গর থেকে বাইরে টেনে এনেছে। তাকে নামিয়ে দিয়েছে রাস্তায়।
মার্কস বলেছেনঃ নারীকেও অবশ্যই শ্রম করতে হবে।
দরখায়েম বলেছেনঃ নারীর বিয়ে করা তার স্বাভাবিক দাবি নয়।
ফ্রয়েড যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে তাকে বলছেন, নারীর যৌন সত্তা অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত হতে হবে সকল প্রকার বাঁধা-বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েই।
বিশ্ব ইহুদীবাদ কেবল মতাদর্শের ক্ষেত্রে বিপর্যয় সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হয়নি, বাস্তবতার ক্ষেত্রেও পদচারণা করেছে।
বস্তুত তারা ডারউইনীয় মতাদর্শকে এমন কুৎসিতভাবে কাজে লাগিয়েছে, যা ডারউইনের কল্পনায় হয়তো আসেনি। শিল্প বিপ্লবকেও তারা সামাজিক ভাঙন ও বিপর্যয় সৃষ্টির হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করেছে।
সন্দেহ নেই, পুঁজিবাদ ইহুদী উদ্ভাবিত। ইহুদী সুদখোরেরা এই সুযোগে দুই হাতে জনগণের রক্ত পানি করা অর্থ কামিয়েছে। তাদের শয়তানী সুদী কারবারই এজন্যে অমোঘ হাতিয়ার।
পুঁজিবাদ কেবল ‘মুনাফাদাতা নিজেই’ জিনিসই নিয়ে আসেনি, মানুষকে পাগল করার উপায় ‘সিনেমা’ ও তাদেরই অবদান। তা দিয়ে তারা সন্তান-সন্ততিদের নৈতিক ধ্বংসের অতল গহবরে ফেলে দেওয়ার কাজ নিচ্ছে। সিনেমায় প্রধানত যৌনতার পংকিল দৃশ্যাবলীই দেখানো হয়। সাজঘর ও রূপচর্চাকেন্দ্রও তারা বানিয়েছে মেয়েদেরকে পুরুষদের নৈতিক পতন সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে। তাতে সুবিধাই পেয়ে গেছে। কেননা মার্কস আগেই তাদের ঘরের বাইরে নিয়ে এসেছেন। লোকদের মন-মানসকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছে, ফেতনা ও নৈতিক পদস্খলনের কারণ ঘটিয়েছে। আর আকীদা বিশ্বাসের ভিত্তিটিকেই এর দ্বারা নাড়িয়ে দিয়েছে –নড়বড়ে করে দিয়েছে।
যেন গোটা জগৎ জিনা-ব্যভিচারের এমন আড্ডাখানায় পরিণত করা যায়, যেন তথায় সমাজের নারী ও পুরুষরা সমানভাবে নাক পর্যণ্ত ডুবে যেতে পারে।
আর তাহলেই তো ইহুদীরা গাধার পিঠে টপ করে লাফিয়ে উঠে সওয়ার হতে পারবে। তখনই তো তারা তাদের শয়তানী স্বপ্নকে বাস্তব করে তুলতে পারবে। তাদের পবিত্র গ্রন্থাবলী তো এ ধরনের স্বপ্নে রঙীন দৃশ্যাবলী দিয়ে ভরপুর হয়ে আছে।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
এরই পরিণতিতে শেস পর্যন্ত সারাটি জগতের ওপর জাহিলিয়াত বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল।
যে ইউরোপে এই জাহিলিয়াত গভীর ঐতিহাসিক ভিত্তিসমূহের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলো, তাই বর্তমানে সমগ্র জগতের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করছে ও শাসন চালাচ্ছে। সেই জাহিলী চিন্তাধারা ও ভাবধারা সারা পৃথিবীতে প্রভাবশালী হয়ে আছে।
গ্রীক জাহিলিয়াত, রোমান জাহিলিয়াত, মধ্যযুগের বিকৃত আকীদার জাহিলিয়াত, ডারউইনীয় মতবাদ ছত্রছায়ায় ধর্ম থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জাহিলিয়াত এবং শিল্প-বিপ্লব –এই সবই আধুনিক জাহিলিয়াতের মধ্যে কেন্দ্রীভূত ও পরিণত। আর তা-ই হচ্ছে বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াত।
এ জাহিলিয়াত কেবল ইউরোপেই রয়েছে তা নয়। তা শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি, কেননা ইউরোপ তার বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে এই জাহিলিয়াতকে পৃথিবীর প্রতিটি কোণায় কোণায় পৌঁছিয়ে দিয়েছে। আর সর্বত্রই সেই জাহিলিয়াতই বিজয়ী, কর্তৃত্বসম্পন্ন ও প্রভাবশালী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এভাবে আলোচনার মাধ্যমে আমরা আধুনিক জাহিলিয়াতের ইতিহাস বর্ণনা শেষ করলাম। এক্ষণে আমরা আধুনিক জাহিলিয়াতের নিদর্শনাবলীর বর্ণনা পেশ করব।