চিন্তার ক্ষেত্রে সৃষ্ট বিপর্যয়
আধুনিক জাহিলিয়াত চিন্তার ক্ষেত্রে সর্বাত্মক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে, বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়নি এমন একটি ক্ষেত্রও অবশিষ্ট নেই। মানুষের সমস্ত চিন্তা-ভাবনা ও ধারণা-কল্পনা, মন-মানসিকতা ও মূল্যবোধ সর্বক্ষেত্রে চরম মাত্রায় বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে আল্লাহ, বিশ্বলোক, জীবন ও স্বয়ং মানুষ থেকে তার সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছে।
আল্লাহ সম্পর্কিত ধারণার ক্ষেত্রেই সৃষ্টি করেছে প্রধান বিপর্যয়, সব চাইতে বড় রকমের বিপথগামিতা, সেই সাথে আল্লাহর সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ব্যাপারটিও মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে।
বিশ্বলোক সম্পর্কিত ধারণা, তার সাথে আল্লাহর সম্পর্ক, তার সাথে মানুষের সম্পর্ক, মানুষের সাথে তার সম্পর্ক সম্পূর্ণ বিকৃত ও বিপর্যস্ত করে দিয়েছে।
স্বয়ং মানব সত্তা সম্পর্কিত ধারণাও ঠিক থাকতে পারেনি। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক –ব্যক্তিগতভাবে ও সমষ্টিগতভাবে এবং নারী ও পুরুষ এই দুই লিঙ্গের সম্পর্কটিও সম্পূর্ণ নষ্ট করে দিয়েছে।
মোটকথা, বর্তমানের এই বিপর্যয় ও বিপথগামিতা মানুষের গোটা জীবনকেই সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলেছে।
পূর্বে যেমন বলেছি, আধুনিক জাহিলিয়াত প্রাচীন ইউরোপীয় সমস্ত জাহিলিয়াত সারনির্যাস। ওপরন্তু তা গ্রীক, রোমান, মধ্যযুগীয় জাহিলিয়াতের উত্তরাধিকার পেয়েও সমৃদ্ধ হয়েছে। ইহুদী ও তাদের অনুসারী অ-ইহুদী চিন্তাবিদদের চিন্তার ফল ও ফসল তার সাথে যোগ হয়েছে।
বস্তুত ইউরোপ মহান আল্লাহর নিগূঢ় তত্ত্ব ও সত্যতা (Reality) পর্যায়ে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে।
এই বিভ্রান্তি যেমন দর্শনে ঘটেছে, তেমনি বিজ্ঞানে, তেমনি বাস্তব জীবনেও। আল্লাহর মূল সত্তা এবং তাঁকে নিরংকুশ এককত্ব –তওহীদ সম্পর্কিত ইউরোপীয় ধারণার বিকৃতি ও বিপর্যয় সম্পর্কে আমরা খুব বেশি কিছু বলার প্রয়োজন মনে করিনে। কেননা পূর্বে যেমন বলেছি –এ পর্যায়ে আমেরিকান লেখক ক্রিপার রচিত ‘বিজ্ঞান ও ধর্মের দ্বন্দ্ব’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেনঃ
যে কনস্ট্যান্টাইন রোমান সাম্রাজ্যের ওপর খ্রিষ্ট ধর্ম চাপিয়ে দিয়েছিল, সে নিজেই নতুন আকীদার সাথে বিপুল পৌত্তলিক চিন্তা-ভাবনা শামিল করে দিয়েছিল। তার লক্ষ্য ছিল পৌত্তলিকদের সন্তুষ্ট করা। অবশ্য এ করে তার আশা ছিল যে, তারা এই নতুন ধর্মে দলে দলে প্রবেশ করবে।
সত্য কথা হচ্ছে, মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় খ্রিষ্ট ধর্ম এবং আধুনিক নাস্তিক ইউরোপ মস্তবড় ভুল ধারণার মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে। এই ভুল ধারণায় উভয় যুগের খ্রিষ্টানরা সম্পূর্ণ সমান।
আর সে ভুল ধারণা হচ্ছে, ধর্ম হচ্ছে স্রষ্টা ও মানুষের সম্পর্কের ব্যাপার। বাস্তব জীবন ও সমাজের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
তাদের ধারণা হচ্ছেঃ আকীদা যা-ই হোক না কেন, তার স্থান কেবল মানুষের মনের অভ্যন্তরে গভীর অনুভূতি ও স্বজ্ঞায়। বাস্তব জীবন যাত্রার সাথে এই আকীদার বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই। তা চলবে আকীদা থেকে সম্পূর্ণ নিঃসম্পর্ক ও বিচ্ছিন্নভাবে। বাস্তব জীবনের ওপর অন্তরে প্রচ্ছন্ন আকীদার কেননা প্রভাবই প্রতিফলিত হবে না।
কিন্তু এটাই হচ্ছে জাহিলিয়াতের সবচাইতে মারাত্মক ধরনের ভুল ধারণা, একটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন প্রকল্প।
কেননা মূলত আকীদাই হলো জীবন; তা নির্ভুল ও সহীহ হোক, কিংবা তাতেই বিকৃতি প্রবেশ করে থাকুক। আকীদার প্রভাব পড়ে সমগ্র মানব জীবনের ওপর। চেতনার কোনো একদিক বা কোনো একটি কাজও তার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। মানুষের জীবন জগতটা আল্লাহ সম্পর্কিত ধারণা থেকে স্বতন্ত্র হতে পারে না কোনোক্রমেই।
অন্ধকার যুগে ইউরোপীয় মধ্যযুগীয় জাহিলিয়াতে ধর্ম ও বাস্তব জীবন-চেতনা ও কাজ এবং আকীদা ও আইন-বিধানের মধ্যে সৃষ্ট পার্থক্য ছিল এক বড় রকমের নির্বুদ্ধিতার কোনো তুলনাই নেই।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্ম কি বাস্তব জীবন থেকে কার্যতঃ বিচ্ছিন্ন হয়েছে কখনও? না, তা কখনোই হয়নি। কার্যতঃ যা ঘটেছে, যা ঘটা অবশ্যম্ভাবী ছিল, তা হচ্ছে, বিকৃত আকীদা গোটা ইউরোপীয় জীবনকে গ্রাস করে ফেলেছে। ফলে সব কিছুতেই বিকৃতি ও বিপর্যয় সংঘটিত হয়েছে ক্রমাগতভাবে, ধীরে ধীরে। আর শেষ পর্যন্ত গোটা জীবনই বিকৃতি ও বিপর্যয়ে জর্জরিত হয়ে পড়েছে।
অতীব সত্য ও অনস্বীকার্য সত্য কথা হচ্ছে, জীবন কখনোই আকীদা থেকে বিচ্ছিন্ন ও নিঃসম্পর্ক হতে পারে না।
আকীদা কি?
নিছক অন্তরের অনুভূতি বা চেতনা –স্বজ্ঞারই নাম আকীদা নয়।
তা হচ্ছে স্তম্ভ –খুঁটি বিশেষ। জীবন সম্পর্কিত ধারণা তারই ওপর দাঁড়ায়। জীবনের বাস্তব সম্পর্কসমূহ গড়ে ওঠে তারই ভিত্তিতে। আকীদা হচ্ছে মানুষ ও বিশ্বলোকের সম্পর্ক কেন্দ্র। আকীদাই হচ্ছে মানব সত্তার কেন্দ্রবিন্দু, মানবীয় অস্তিত্বের যৌক্তিকতা।
সাদাসিধা মানুষের কাছে ধর্মটা হয়ত মনের একটা অনুভূতি মাত্র। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপার তা নয়। এই সাধারণ মানুষ হয়ত বিবেক বুদ্ধি খাটিয়ে সব ব্যাপার বুঝতে অভ্যস্ত নয়। হয়ত জীবনের গভীরতায় পৌঁছে না সব খুঁটিনাটি ব্যাপার। কিন্তু তারা তাদের ঐকান্তিক নিষ্ঠাপূর্ণ ধর্মীয় অনুভূতির সাহায্যে জীবন সম্পর্কে একটা নির্দিষ্ট ধারণা (বা Stand) গ্রহণ করে। এই কারণেই তারা কিছু গ্রহণ করে, কিছু কিছু করে অগ্রাহ্য, বর্জন –গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। সমস্ত জিনিসের পারস্পরিক সম্পর্কতা নির্ধারণ করে একটা সুনির্দিষ্টরূপে। তাতে এই হৃদয়ানুভূতিই হয় তাদের প্রধান সহায়তা হাতিয়ার।
বস্তুত এই ধর্মই হচ্ছে সাদাসিধা মন-মানসিকতাসম্পন্ন লোকদের জীবন পর্যায়ে গৃহীত একটি নির্দিষ্ট বোধ বা ধারণা। জীবনের একটা সুনির্দিষ্ট ধারণা প্রতিটি মানুষের মনেই জাগরূক রয়েছে।
জাহিলিয়াতের প্রভাবে পড়ে যারা মনে করে, জনগণের জীবন ও বাস্তবতায় ধর্মের প্রভাব অত্যন্ত ক্ষীণ ও নিষপ্রভ, তারা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়েই মনে করে যে, ধর্ম আসলেই বুঝি এরূপ। বাস্তবতার সাথে যার সম্পর্ক না থাকার মতোই। আর জীবনের বাস্তবতা ঝুকি এ রকমই আকীদা থেকে বিচ্ছিন্ন এবং তা স্বতন্ত্র এমন সব কার্যকারণের অধীন অতিবাহিত হচ্ছে, যার সাথে ধর্মের আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই।
আসলে এই ধরনের ধারণাই হচ্ছে জাহিলিয়াতের ফলশ্রুতি। মানব সম্পর্কিত ধারণার বিকৃতির কারণেই এরূপ ধারণার উদ্ভব সম্ভব হয়েছে।
জনজীবনের বাস্তবতায় ধর্মের প্রভাব যদি ক্ষীণ হয়ে পড়ে কখনও, তাহলে বুঝতে হবে, মানব মনে আকীদার বিকৃতি ঘটেছে। অনুরূপভাবে তার এ-ও অর্থ যে, জীবন সামগ্রিকভাবে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে চলছে না। এটা অনিবার্যভাবে কোনো-না-কোনো ধরনের একটা বিকৃতি। কিছু দিন পরই তার অনিবার্য প্রতিক্রিয়া অবশ্যই প্রকাশ হবে। বিরাট ও ব্যাপক হয়ে দেখা দেবে।
জনগণের জীবনে ধর্মের প্রভাব ক্ষীণ হওয়ার আরও একটি অর্থ হলো, মানুষ আল্লাহর দাসত্ব করছে না, তবে ইবাদত ত্যাগ করেছে অথবা আল্লাহর ইবাদত ঠিক যেভাবে হওয়া উচিত সেভাবে –সেই মানে ও ভাবধারায় হচ্ছে না, সে ইবাদত একান্তভাবে এক আল্লাহর জন্যে হচ্ছে না। তাঁর সাথে অন্যান্য ‘খোদাকে’ শরীক করা হচ্ছে। আর তারাই তাদের বাস্তব জীবনের ওপর কর্তৃত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ জীবনের ওপর একমাত্র আল্লাহর কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য হওয়া উচিত ছিল, উচিত ছিল সমগ্র জীবন আল্লাহর নির্ধারিত পথে চলা।
বস্তুত এ-ই হচ্ছে আকীদার ক্ষেত্রে প্রথম বিপর্যয়, বিকৃতি। বহুত্ববাদ সৃষ্টি এই বিপর্যয় ইতিহাসের সকল জাহিলিয়াতেই সমানভাবে বর্তমান। এই বহুত্ববাদী জাহিলিয়াত বা জাহিলিয়াতের এই বহুত্ববাদী লক্ষণের কারণেই বাস্তব জগতের ওপর আকীদার প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়েছে।
এই বহুত্ববাদের কারণেই আকীদায় অভিন্নতা ও পারস্পরিক সামঞ্জস্য থাকতে পারে না। এই কারণে তার দিকও অভিন্ন থাকে না। আর এই বিশেষত্বের কারণে জাহিলিয়াত তার নিশ্চিত ও অনিবার্য ফল প্রকাশ করে। যদিও সে ফল খুব ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়। জনগণ খুব বিলম্বেই তা অনুভব ও হৃদয়ঙ্গম করতে সমর্থ হয়।
বহুত্ববাদের কথিত ধারণা প্রথম পরিণতিতে মানুষের গোটা জীবন দুনিয়ায় দুটি খাতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। দুটি ভিন্ন ভিন্ন সমান্তরাল পথে চলতে থাকে। তার একটি পথ যদি আল্লাহর দিকে চলে, তাহলে অন্যটি চলে আল্লাহর পথের বিপরীত দিকে –বাস্তব জীবনের দিকে। আর তারই ফরে মানব মনে মূল্যবোধের সংঘাত সৃষ্টি হয়ে পড়ে অনিবার্যভাবে। একটি মূল্যবোধ আল্লাহর পথমুখী হওয়ার কারণে অতীব উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন হয়। আর অপরটি বাস্তব জীবনের দিকে নিম্নমুখী এবং আল্লাহ প্রদত্ত পথ থেকে বিপরীতগামী। দ্বিতীয়টি আল্লাহর কাছে নিষিদ্ধ। যদিও বাস্তব জীবনে তা জরুরী। আর প্রথমটি আল্লাহর কাছে অতীব কাম্য, কাঙ্ক্ষিত ও প্রার্থিত। কিন্তু বাস্তব জীবনে তা অকেজো, অব্যবহৃত।
এই দ্বৈত বিভক্তির কারণে মানুষের চেতনা ও মন-মানসিকতা ছিন্নভিন্ন ও দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে, যদিও তা অনুভব করা সম্ভব হয় অনেক কাল পরে।
এরই ফলে বাস্তব জীবন আকীদার আলোকরশ্মি থেকে দূরে সরে যায়। অথবা বলা যায়, এক আল্লাহর পরিবর্তে নবতর বহু খোদা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর তাতে আল্লাহর পথের সাথে একবিন্দু সংযোগ থাকে না। ফলে গোটা পৃথিবীই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
অপরদিকে বাস্তব জীবন খাহেশাত –লালসা-কামনা-বাসনার অধীন চলতে থাকে। এরই দরুন তাগুতের আধিপত্যের অধীনে এবং ফলতঃ কামনা-বাসনা-লালসার অধীন হয়ে পড়ে। লালসার একচ্ছত্র রাজত্ব সর্বগ্রাসী হয়ে দাঁড়ায়। তার ফলে দেখা দেয় বিপর্যয়ের পর বিপর্যয়। আর তার শেষ পরিণতি ঘটে চূড়ান্ত ধ্বংসে। তখন আল্লাহর ইবাদতের স্থান হয়ে পড়ে গৌণ, গুরুত্বহীন। আর অপরাপর ‘খোদা’গণ মানব জীবনের ওপর প্রচণ্ড শক্তিতে সওয়ার হয়ে বসে।
আর এটাই হচ্ছে ইউরোপের ইতিহাস। ইউরোপের বাস্তব চিত্র। ইউরোপের এ দীর্ঘ ইতিহাস বহু শতাব্দী পরিব্যাপ্ত ও বিস্তীর্ণ। এ ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল ধর্মকে বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করা থেকে। এরপর রেনেসাঁর যুগ আসে। তার ফলে ধর্ম ও জীবনের মধ্যকার দূরত্ব অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়ে যায়।
মধ্যযুগের জাহিলিয়াতে ইউরোপ হযরত ঈসা (আ)-এর কথাটি যথাযথ অর্থে বুঝতে পারেনি। তাঁর কথাঃ ‘কাইজারের যা তা কাইজারকে দাও আর আল্লাহর জন্যে যা তা আল্লাহকে দাও’। (ইনজীল-মথি ২২-২১ স্তোত্র) তাঁর সম্পর্কিত এ কথাটিও তারা বুঝতে সম্পূর্ণ অক্ষমই রয়েছে। কুরআন মজীদের ভাষায়ঃ
(আরবী**********************************************************************************)
এবং আমি আমার সম্মুখবর্তী তওরাতের সত্যতা ঘোষনা প্রতিষ্ঠাকারী এবং আমি হালাল ঘোষনা করব তোমদের জন্যে এমন কিছু জিনিস, যা তোমাদের জন্যে হারাম করা হয়েছিল। (সূরা আলে-ইমরানঃ ৫০)
আল্লাহর হেদায়েত থেকে বিভ্রান্ত হওয়ার কতগুলো ঐতিহাসিক কারণ থাকতে পারে। প্রাচ্যবিদ ও নও-মুসলিম লিওপো মুহাম্মদ আসাদ তাঁর Islam at the cross road নামক গ্রন্থে লিখেছেনঃ খ্রিষ্ট ধর্ম রোমান আইনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সেই বিরাট সাম্রাজ্যের ওপর তেমন কোনো প্রতিপত্তির অধিকারী ছিল না। সেখানে ধর্ম শুধু প্রকাশমান বাহ্যিক, অন্তঃসারশূন্য। তৃতীয় শতাব্দীতে কনস্ট্যান্টাইন যখন খ্রিষ্ট ধর্মকে সরকারী বা রাষ্ট্রীয় ধর্মরূপে গ্রহণ করেছিল, তখনও শুধু আকীদা হিসেবেই খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করা হয়েছিল। খ্রিষ্টীয় আইনের কোনো প্রশ্ন ছিল না। বরং অনেক সময় আকীদা ও রোমান মূর্তিপূজার সাথে সংমিশ্রিত হয়ে যেত, খ্রিষ্টীয় আইন জারী হওয়া তো দূরের কথা। এতসব সত্ত্বেও লোকদের মধ্যে নিজেদের আকীদার ব্যাপারে কিছু-না-কিছু প্রীতি ও চেতনা ছিল। তাদের মনে-মগজে একথা বদ্ধমূল হয়ে বসেছিল যে, আল্লাহ কিংবা ইলাহ মানুষের জন্যে কল্যাণকামী নয়। মানুষ তাঁর মারেফাত লাভ করুক, তা-ও তিনি চান না। মানুষকে এই মারেফাত আল্লাহ বা ইলাহর কাছ থেকে জোর করে কেড়ে আনতে হয়।
‘রেনেসাঁ’র পর মানদণ্ড পরিবর্তিত হয়ে গেল। আকীদার দিকে আকর্ষণ কেন্দ্র ফিরে এলো না। নতুন আন্দোলনে প্রাচীন হেলেনীয়বাদ থেকে চিন্তা ও ধারণা গ্রহণ করতে শুরু করে দিল। আর নতুভাবে ও ধীরে ধীরে তা গোটা জীবনের ওপর প্রভাবশালী হয়ে উঠলো।
এই সময় আকর্ষণ কেন্দ্র আল্লাহর পরিবর্তে হয়ে উঠল অসংখ্য ইলাহ।
তার বড় দুটি কারণ ছিল। একটি চেতনা ও চিন্তার সুস্পষ্ট আর দ্বিতীয়টি প্রচ্ছন্নতার গভীর তলায়।
বাহ্যিক কারণটি প্রতিফলিত হয়েছে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে গীর্জার যুদ্ধের মাধ্যমে। আর আন্দোলন ও বিবর্তনের তাৎপর্যও প্রকাশমান হয়ে পড়ল। তার অন্ধ অনুসরণের আধিপত্যের ওপর ভয় ছিল যে, তা বিজ্ঞানকে তার যথার্থ স্থান থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। তার পরিবর্তে অপর একটি প্রতিনিধি স্থলাভিষিক্ত হবে, যেন গীর্জা তার স্থান থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। অতঃপর যখন বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও বিকাশ শুরু হলো, তা স্বভাবতঃই গীর্জার শত্রু ও প্রতিপক্ষ হয়ে উঠল। অন্ততঃ তার কর্তৃত্বের বিরোধী হয়ে দাঁড়াল। যেমন চিন্তা ও সভ্যতার পুনরুজ্জীবনের ব্যাপারটি সংঘটিত হয়েছিল। কেননা তা যেমন আন্দোলন, তেমনি বিবর্তন। শেষকাল অবধি অবস্থার প্রতিষ্ঠায় গীর্জার ইচ্ছা কংকল্পের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
চিন্তা ও সভ্যতার অভ্যুদয় গোটা বাস্তব জীবনের ওপর প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, এটাই ছিল স্বাভাবিক। কেননা তা স্বাভাবিকভাবেই জমিনের বাস্তবতা ও দৈনন্দিন জীবনের সাথে সংযুক্ত। আর গীর্জা যতদিন থাকবে, এ অভ্যুদয় ততদিন জোরদার হতে পারবে না, তার সাথে সহযোগিতাও করবে না। গীর্জা ছিল ধর্মের প্রতীক। এই কারণে বাস্তব জীবনধারা ও এই ধর্মের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পাওয়া অব্যাহত থাকা এই অবস্থার মধ্যে নিতান্তই অবধারিত ব্যাপার ছিল।
এই সময়টা ছিল গোটা অবস্থাকে ঠিকঠাক করার জন্যে অতীব উপযুক্ত ক্ষণ। আর সর্বাত্মক জাহিলিয়াতের আওতা থেকে বের হয়ে মহান আল্লাহর সত্য সঠিক দ্বীনের দিকে চলে আসারও উপযুক্ত সময় এটাই ছিল। কিন্তু ইউরোপ –পূর্বে যেমন বলেছি –এই উপযুক্ত সময়ের সুযোগ গ্রহণ করতে অস্বীকার করে বসল। ক্রশকেন্দ্রিক বিজয়ী ভাবধারাই ছিল এর প্রধান কারণ। ফলে তারা মুসলমানদের কাছ থেকে তাদরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঞ্চয় গ্রহণ করল, নিয়ে নিল তাদের এ ক্ষেত্রের পরীক্ষা পদ্ধতি এবং তাদের সভ্যতার বাহ্য প্রকাশ। কিন্তু খোদায়ী জীবন পদ্ধতি গ্রহণ করতে অস্বীকার করল। অথচ তারই ওপর নির্ভরশীল গোটা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা। ফলে রেনেসাঁর অভ্যুদয় প্রথম মুহুর্ত থেকেই আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী হয়ে উঠল সম্পূর্ণরূপে। এটাই হচ্ছে বাহ্যিক কারণ।
আর প্রচ্ছন্ন কারণটি হচ্ছে প্রাচীন গ্রীক জাহিলিয়াত থেকে পাওয়া দুঃখজনক উত্তরাধিকার। তা-ই ইউরোপীয় জনগণের মনের গভীরে হেলেনীয় ভাবধারার সৃষ্টি করেছিল। সে হচ্ছে আগুন-চোর প্রোমিথিউস।
আধুনিক ইউরোপের মানুষের এটাই হচ্ছে পরিচিতি ও রূপ। এ কিংবদন্তী বা পৌরাণিক কাহিনী ইউরোপীয় লোকদের মনে ও চরিত্রে তার পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে দিয়েছে। তা-ই তাদের এমন বানিয়ে দিয়েছে যে, তারা জ্ঞান অর্জন করে আর সেই সাথে অনুভব করে আল্লাহর প্রতি তীব্র শত্রুতা ও প্রতিহিংসা।
পৌরাণিক কাহিনী ইউরোপীয় লোকদের মনে ও চরিত্রে তার পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে দিয়েছে। তা-ই তাদের এমন বানিয়ে দিয়েছে যে, তারা জ্ঞান অর্জন করে আর সেই সাথে অনুভব করে আল্লাহর প্রতি তীব্র শত্রুতা ও প্রতিহিংসা।
এই পৌরাণিক কাহিনী এবং অনুরূপ আরও অনেক কিছু তাদের চিন্তা-চেতনায় এই ভাবধারা ঢুকিয়ে বদ্ধমূল করে দিয়েছে যে, আল্লাহ কিংবা খোদাগণ –মানুষের জন্যে কিছুমাত্র কল্যাণ চায় না। আর বিশেষ করে মানুষ জ্ঞান আহরণ করুক, তা আদৌ পছন্দ করে না। মানুষ তো জ্ঞান-বিজ্ঞান আল্লাহ কিংবা খোদাগণের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে অর্জন করছে। আর অসন্তুষ্টি ও শত্রুতার ভিত্তিতেই কল্যাণ বাস্তবায়িত হয়েছে।
জুলিয়ান হাক্সলী তাঁর ‘আধুনিক জগতের মানুষ’ নামক গ্রন্থে যেমন লিখেছেনঃ শুধু মুর্খতা ও অক্ষমতাই মানুষকে আল্লাহর কাছে নত বানায়। তাই মানুষের জ্ঞানের পরিধি ও তার শক্তি বৃদ্ধি পেলে তখন আর আল্লাহকে মেনে নেওয়ার বা তাঁর সম্পর্কে চিন্তা করার কোনোই কারণ অবশিষ্ট থাকে না। ইবাদত করে তাঁর সাথে সম্পর্ক স্থাপন বা রক্ষারও কোনো প্রয়োজন পড়ে না। বরং তখন স্বয়ং মানুষই আল্লাহ হয়ে বসে।
ব্যাপারসমূহ এই অবস্থা পর্যন্ত স্বাভাবিক অবস্থার দরুন হঠাৎ করে পৌঁছতে পারেনি। কেননা মানব প্রকৃতিই এমন যে, তা খুব ধীরে ও বিলম্বেই পরিবর্তিত হয়। বিশেষ করে আকীদার ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনে তো যথেষ্ট বিলম্ব হয়ে থাকে। এজন্যে দীর্ঘ সময় ও যুগের পর যুগের প্রয়োজন হয়।
মধ্যম পর্যায়ে আল্লাহর দাসত্বের পরিবর্তে প্রকৃতির দাসত্ব শুরু হয়। আসলে প্রকৃতি পূজা ছিল গীর্জার খোদার পূজা থেকে বাঁচার একটা উপায় মাত্র। কেননা গীর্জা তো তার নামে মানুষকে দাসানুদাস বানিয়ে রেখেছিল। তাদের ওপর ধার্য করেছিল অনেক প্রকারের কর, শুল্ক ও অর্থদানের দায়-দায়িত্ব এবং গীর্জার জমিতে বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমদানের বাধ্যবাধকতা, চাপিয়ে ছিল গীর্জার সেনাবাহিনীতে কাজ করার অপরিহার্যতা। ধর্মীয় ব্যক্তিদের –পাদ্রী-পুরোহিতদের দাসানুদাস হওয়ার অপমান ও লাঞ্ছনা আর প্রকৃতি ছিল এমন এক খোদা, যার কোনো গীর্জা ছিল না, ছিল না চাপিয়ে দেওয়া দায়-দায়িত্ব ও নানাবিধ বাধ্যবাধকতা। এই নতুন খোদা মানব প্রকৃতির চাহিদারও তৃপ্তিদান করছিল। কেননা কোনো-না-কোনো খোদার সম্মুখে আত্মসমর্পণ তো ছিল মানব প্রকৃতির –একটি অপরিহার্য দাবি ও তাগিদ। আর তা তাদের উদ্দেশ্যের পরিপূরক ছিল। কেননা মানুষ গীর্জার খোদা ও গীর্জায় ধর্মের প্রতিপত্তি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল যা তাদের ওপর দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে চেয়ে বসেছিল।
যে সময়ে প্রকৃতির দেবতাদের পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ে ইউরোপের লোকদের হৃদয়ে আল্লাহ ও মওজুদ ছিলেন। তারা ঐকান্তিক একাকীত্বে ও নিবিড় নিভৃতে তাঁরই দিকে মনোযোগী হতো, গীর্জায় তাঁরই ইবাদত করত। আর কম বেশী নিজেদের ধর্মীয় নৈতিকতা ও ঐতিহ্যের ওপরও দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু এই সবকিছুই ছিল নিতান্ত অভ্যাসবশতঃ ঈমানী শক্তির তাগিদে তা হচ্ছিল না।
এভাবে খোদাদের সংখ্যা বিপুল হয়ে গেল এবং তাদের মধ্যকার সম্পর্কও অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়ল।
গীর্জায় যখন উপাসনা অনুষ্ঠিত হয়, তখন আল্লাহর সত্তাই হতো প্রিয়তর, তাঁকেই ভয় করা হতো। অথবা নামাযের বাইরে জীবনের অপর কোনো মুহুর্তে আল্লাহকেই মালিক মনে করা হতো।
আর যখন শিল্পগত চেতনার ব্যাপার দেখা দিত, তখন প্রকৃতিই হতো প্রিয়তর, ভয় তাকেই করা হতো। কেননা রোমান্টিকতার আন্দোলন প্রকৃতির খুব বেশী গুরুত্ব দিয়েছিল। গোটা কাজ প্রতিভা ও তজ্জনিত অনুষ্ঠানাদি তাকে কেন্দ্র করেই অনুষ্ঠিত হচ্ছিল।
বৈজ্ঞানিক উন্নতি প্রগতিতেও প্রকৃতিই চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিজ্ঞানীরা প্রকৃতির এমন নিয়ম আয়ত্ত করেছিল, যার ভিত্তিতে গোটা বিশ্বলোক আবর্তিত হচ্ছিল। এসব প্রাকৃতিক আইন বা নিয়মে মতপার্থক্যের কোনো অবকাশ ছিল না বিবেক-বুদ্ধির দৃষ্টিতে। বৈজ্ঞানিক যুক্তির দৃষ্টিতেও তাতে কোনো মতবিরোধ ছিল না, যা এসব নিয়ম ও আইন উদঘাটন করেছিল।
এদিকে রাষ্ট্র-সরকার ও তার আইন-কানুন ছিল তৃতীয় খোদা। জনগণ অত্যন্ত আগ্রহ-উৎসাহ সহকারেই অথবা বাধ্যবাধকতা সহকারে যে সব আইন-কানুন মেনে চলছিল, তার আধিপত্য ও কর্তৃত্বের অধীনতার কাছে তারা সবাই আত্মসমর্পণ করছিল ঠিক যেমন আত্মসমর্পণ করতে হয় আল্লাহর কাছে।
এভাবে একই ধর্ম তিন খোদার মদ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। অথচ মধ্যযুগে ছিল দুই খোদা। তাদের একজন আকীদা’র দিক দিয়ে খোদা, অপরজন আইন-বিধান প্রদাতা খোদা। তাতে আকীদা ও শরীয়াতের বিচ্ছিন্নতাই ছিল ভিত্তি এবং প্রতিটিই তার অধীনত্বের ওপর কর্তৃত্ব করত।
অতঃপর ধীরে ধীরে অপর একটি পরিবর্তন সংঘটিত হলো।
আল্লাহ সমগ্র ইউরোপীয় অন্তর থেকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে গেলেন। লোকদের চিন্তা-চেতনা ও আচার-আচরণের ওপর আল্লাহর প্রভাব হ্রাস প্রাপ্ত হল। আল্লাহর স্থান দখল করে নিল স্বয়ং মানুষ। জায়গীরদারী বা সামান্তবাদ খতম হয়ে গেল। অতঃপর যন্ত্র আবিস্কৃত হওয়ার পর শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হলো। সেই সাথে চিন্তা-চেতনা ও ধারণা-বিশ্বাসেও বিপ্লব সূচিত হল।
এ জাহিলিয়াতে শিল্প বিপ্লব ঘটলো যখন, তখন আল্লাহর ইবাদত নিতান্তই বাহ্যিকভাবে হচ্ছিল। এ বিপ্লব জাহিলিয়াতের সমস্ত প্রভাব-প্রতিপত্তি কবুল করেই ক্ষান্ত থাকেনি, তা জাহিলিয়াতকে নতুন পথ দেখাল, শক্তি গতিদান করল।
একদিকে গ্রাম্য জনতার মনের আবেগ আল্লাহর সাথে থাকলেও, তাঁর ইবাদত করলে থাকলেও অন্যান্য খোদাগণের সাথে শিরক করে যাচ্ছিল। কেনো তারা ফসল উৎপাদক, ফল-ফাকড়া প্রদাতা এবং বিপদাপদ ও ধ্বংস থেকে পৃথিবীকে রক্ষাকারী আল্লাহকেই মনে করত।
কিন্তু অপরদিকে নগরবাসী লোকেরা ছিল কল-কারখানার পণ্য উৎপাদনে মশগুল। আর সে কাজটি তো আল্লাহ করত না। তাই সামগ্রিকভাবে জাহিলিয়াত শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে খোদাহীন হয়ে পড়ল। খোদার প্রতি তেমন কোনো সম্পর্কের তাগিত তারা বোধ করত না।
শিল্প বিপ্লবে লোকদের ধারণা ছিল, শিল্পোৎপাদন আল্লাহ করেন না, করে মানুষ নিজেরা। মানুষ নিজেরাই নিজেদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বলে বস্তুর বিশেষত্ব জানতে ও আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছে। মানুষ নিজেরাই যন্ত্র চালনা করে, আবার ইচ্ছামত নিজেরাই তা থামায়, তারাই একদিকে কাঁচামাল ঢেলে দেয় এবং অপাদিক থেকে পূর্ণ গঠিত পণ্য (Finished good) বের করে আনে।
এ কারণে এক্ষণে শিল্পোৎপাদনকারী মানুষেরই ইবাদত উত্তম বিবেচিত হলো, আল্লাহর ইবাদতের কোনো প্রয়োজন আছে বলে তারা মনে করতে পারল না।
আর এই সময় কালেই প্রকৃত তার সমস্ত যাদু-প্রভাব ও খোদায়ী ভাব-গাম্ভীর্য হারিয়ে ফেলল। জনমনে তার কোনো শক্তি মোহ অবশিষ্ট থাকল না। কেননা একদিকে শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে প্রকৃতি চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু থাকল না, রোমান্টিকতার পর্যায়ে যেমন ছিল। এ সময়ে বাস্তব অবস্থান দৃষ্টিকোণে মানুষই হয়ে দাঁড়াল নবতর খোদা।
অপরদিকে প্রকৃতির অনেক গোপন গূঢ় তত্ত্ব-রহস্য উদঘাটিত হলো বৈজ্ঞানিক আবিস্কার উদ্ভাবনের মাধ্যমে। এই সময় তার ওপর মানুষের প্রতিপত্তিও বেড়ে গেল। ফলে মানুষের প্রকৃতির প্রাধান্য তেমন আর থাকল না।
এই কারণে খোদায়ী মর্যাদা আল্লাহ ও প্রকৃতি উভয় থেকে স্থানান্তরিত হয়ে মানুষে এসে কেন্দ্রীভূত হলো।
এই অবকাশে মানুষ বলে উঠল আল্লাহর ইবাদত মানুষের জন্যে লজ্জাজনক।
যে শক্তি অপ্রকাশ্য, প্রচ্ছন্ন, যা ইন্দ্রিয়ানুভূতি নয়, তার ইবাদত করা মানুষের পক্ষে খুবই লজ্জার বিষয়। এই অদৃশ্য গায়েবী শক্তির –যাকে কোনো দিন দেখা যায়নি, কোনো দিনই দেখা যাবে না, দেখা যেতে পারে না -তার কাছ থেকে মানুষ তার নৈতিকতা, চিন্তা, বিশ্বাস, আচরণ ও মান্যতা গ্রহণ করবে, তাও তার জন্যে শোভন হতে পারে না। মানুষের জন্যে আইন বানাবে কোনো পৌরাণিক শক্তি, যার কোনো কোনো আলোচনা বা প্রতিবাদ করারও সুযোগ থাকবে না, তার কোনো সমালোচনা করা যাবে না, তার বিরুদ্ধে সে নিজের মত প্রকাশ করতে পারবে না, শুধু এইজন্যে যে, তা অবতীর্ণ হওয়া বিধান, এক পৌরাণিক জগৎ থেকে তা অবতীর্ণ হয়েছে –এটা কিছুতেই সম্ভব হতে পারে না।
মানুষ এক্ষণে এসব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েছে। আর মুর্খতার যুগে সে যা করত, তা এই জ্ঞান-বিজ্ঞান আলোকোদ্ভাসিত যুগে করা কিছুতেই শোভা পায় না, আগে যে দুর্বল, অক্ষম ছিল, তার চতুষ্পার্শ্বে বিস্তীর্ণ প্রকৃতির কোনো নিগূঢ় তত্ত্বই তাদের জান ছিল না, পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর কর্তৃত্ব করার কোনো ক্ষমতাই তখন তাদের ছিল না। তখন যে খোদার তারা ইবাদত করত, এখনও সেই খোদার ইবাদত করা তাদের জন্যে কিছুতেই শোভা পেতে পারে না। তখন আল্লাহর কালাম শ্রবণ বা আল্লাহর আদেশাবলী পালন করা তার পক্ষে আওয়াজ বুলন্দ করা মানুষের পক্ষে উচিত হতে পারে না।
এখন তো মানুসের কর্তব্য হচ্ছে প্রতিটি জিনিসের যাচাই পরখ করা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো মানুষের বিবেক-বুদ্ধির মানদণ্ডে। এর ফলে যা তার বিবেক-বুদ্ধিসম্মত প্রমাণিত হবে, তাকে সত্য ও সঠিক বলে গ্রহণ করা, তাকে কার্যকর করা কর্তব্য। আর যা তার বিপরীত হবে তাকে বাতিল বলে গ্রহণ করা, তাকে কার্যকর করা কর্তব্য। আর যা তার বিপরীত হবে তাকে বাতিল ও পৌরাণিক কিসসা কাহিনী মনে করে প্রত্যাখ্যান করাই তার জন্যে বাঞ্ছনীয়।
এক্ষণে মানুষের নিজেরই হওয়া উচিত নিজের জন্যে আইন বিধানের রচয়িতা। সে নিজেই নিজের জন্যে আইন প্রণয়ন করবে। সে নিজের প্রয়োজন ও তার বিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পর্কে মধ্যযুগীয় খোদার তুলনায় অনেক বেশি অবহিত। কেননা সে ‘খোদার’ কাছে অবস্থা পূর্ববতই রয়েছে। নিতান্তই অপরিবর্তিত হয়ে।
বাঞ্ছনীয় হচ্ছে মানুষ নিজেই নিজের জীবনকে গড়বে। এ ব্যাপারে অন্য কাউকেই তার সাথে শরীক না করা।–[সমকালীন আমেরিকান গ্রন্থকার জর্দান তুশায়েলদ লিখিত বই Man Makes himself দ্রষ্টব্য।]
অতঃপর বিকৃতি ও বিপর্যয় আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়ে গেল। সেই সাথে খোদা মানুষের দাসত্ব ও পূজার ব্যাপারটিও অন্তহিত ও বিলীন হয়ে গেল।
বর্তমান জাহিলয়াতের শীর্ষে অবস্থিত এই সর্বশেষ পর্যায় সংক্রান্ত আলোচনা শুরু করার পূর্বে এসব জাহিলিয়াতের অবশিষ্ট নির্দেশাবলী চিহ্নিত করা আবশ্যক, যার দরুন খোদায়ী নিগুঢ় তত্ত্ব পর্যায়ে ধারণা, বিশ্বাস এই ব্যাপক বিস্তৃতি ও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
গ্রীক জাহিলিয়াতের নিদর্শন হচ্ছে তা মানুষ ও আল্লাহর মধ্যে ঘৃণ্য ও বিদ্বেষের উচ্চ প্রাচীর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আজও তা অবশিষ্ট রয়েছে।
রোমান জাহিলিয়াতের নিদর্শন হচ্ছে, কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুতে বিশ্বাস স্থাপন এবং ইন্দ্রিয় অগ্রাহ্য জিনিসকে অস্তিত্বহীন মনে করা। আল্লাহ যেহেতু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন, এ কারণে তাঁর প্রতি ঈমানের কোনো প্রয়োজন নেই, তার প্রতি ঈমান না আনাই উত্তম ও জরুরী।
গ্রীক জাহিলিয়াত নতুন বেশে আবার সম্মুখে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। তা আজও বিবেক-বুদ্ধিকে পবিত্রতার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপ করে রেখেছে। যেন তা সেই আল্লাহ হয়ে বসতে পারে যিনি ওহীর ভিত্তিতে হুকুমত করেন। বরং সেই বিবেক-বুদ্ধি নিজেই ইলাহ হতে পারে যখন তা ইচ্ছা করবে।
এই গ্রীক জাহিলিয়াত পুনরায় মানুষ ও আল্লাহ –এই দুয়ের মধ্যে চরম দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামের সৃষ্টি করেছে।
রেনেসাঁর প্রাথমিক পর্যায়ে আল্লাহই মা’বুদ ছিলেন, তখন মানুষ ও আল্লাহর মধ্যে প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম ছিল। মানুষ যদিও মূর্খতা ও দুর্বলতার কারণে আল্লাহর অনুগত হতো। পরে সে যখন জ্ঞান-বিজ্ঞান দক্ষতা অর্জন করল এবং শক্তি সম্পন্ন হয়ে উঠল, তার নিজের দৃষ্টিতে সে উচ্চ মর্যাদার উন্নীত হল। আর তার ধারণায় খোদার মর্যাদা অনেক নীচু ও হীন হয়ে গেল। আবার জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রবৃদ্ধি লাভে সে-ও উচ্চে ওঠে গেল। আর খোদার নিম্নগামিতা বৃদ্ধি পেল।
শেষ পর্যণ্ত বর্তমান সময়ে মানুষ নিজেই ‘জীবন’ সৃষ্টি করে। ফলে সে-ই ‘আল্লাহ’ হয়ে গেছে।
বিশ্ব প্রকৃতি যখন আল্লাহর সাথে সাথে মা’বুদ হয়েছিল, তখন দ্বন্দ্বটা ছিল মানুষ ও বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে। মানুষ প্রকৃতির ক্রোধ-আক্রোশের মোকাবিলা করত। প্রকৃতি নিহিত বিপুল তত্ত্ব ও শক্তি আয়ত্ত করে নিত। যেমন প্রাচীন প্রোমিথিউস করেছিল।
অতঃপর মানুষই যখন মা’বুদ হয়ে বসল, তখন এই দুঃখজনক দ্বন্দ্বটা মানুষ ও মানুষের মধ্যে পারস্পরিকভাবে দাঁড়িয়ে গেল। একদিকে পূজাকারী মানুষ আর অপরদিকে পূজা ও পূজিত মানুষ। এ সময়ে মানুষে মানুষে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলো, তা ব্যক্তির সাথে সমষ্টির এবং ব্যক্তির সাথে রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের সমতূল্য। ব্যক্তির সাথে দ্বন্দ্ব তার সমাজ সমষ্টিতে বিজয়ী ও প্রভাবশালী মূল্যমানের সাথে। এ দ্বন্দ্ব ব্যক্তির সাথে স্বয়ং তার ব্যক্তিগত শক্তিসমূহের সাথে এবং তা মানুষের নিজের বেষ্টনীর অভ্যন্তরেই অবস্থিত।
এই সর্বশেষ দ্বন্দ্ব মানুষে মানুষে পারস্পরিক, তা-ই মানুষের পূজা-উপাসনা বা দাসত্বের অবসান ঘটিয়েছে।
মানুষ সব সময়ই তার সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে অহংকারে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও এবং তার আনুগত্য না করার ওপর শক্ত হয়ে থাকা সত্ত্বেও সে আবিস্কার করল যে, এই পৃথিবীতে প্রকৃত খোদা বলতে কেউ নেই। বরং এখানে আছে অন্যান্য অনেক খোদা। মানুষের ইতিহাসে মানুষের সাথে মানুষের দ্বন্দ্ব ধারা পর্যায়ের বেজ্ঞানিক গবেষণায় মানুষই এই তত্ত্ব আবিস্কার করল যে, এখানে রয়েছে অসংখ্য নিশ্চিত ব্যাপারাধি, কতগুলো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। আর তা হচ্ছে, অর্থনৈতিক চূড়ান্ততা, সামাজিক সামষ্টিক চূড়ান্ততা, ঐতিহাসিক নিশ্চয়তা। এই সব কয়টি নিশ্চয়তাই মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছে।
এগুলো সুনিশ্চিত মূল্যমান, তা প্রত্যাহার বা প্রতিরোধ করা যায় না। এ মূল্যমান সবসময়ই মানুষের জীবনের ওপর প্রভাবশালী হয়ে থাকে। মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা এর ওপর খাটে না।
কার্ল মার্কস বলেনঃ “সামষ্টিক ফলাফল যা মানুষ ভোগ করতে বাধ্য হয়, তা খুবই সীমিত সম্পর্ক বিশেষ। তা মানুষের জন্যে অপরিহার্য। তাতে মানুষের ইচ্ছারও কোনো দখল নেই। তাই মানুসের বস্তুগত জীবনে উৎপাদন পদ্ধতিই হচ্ছে এমন শক্তি যা জীবনের সামাজিক, সামষ্টিক, রাজনৈতিক ও ভাবগত দিকগুলোকে রূপায়িত করে। মানুষের নিজস্ব চেতনা এগুলোর অস্তিত্ব নির্দিষ্ট করে না বরং এগুলোর অস্তিত্বই মানুষের চিন্তা-চেতনা নির্ধারণ করে”।
এ্যাঞ্জেলস বলেনঃ বস্তুগত মতাদর্শের সূচনা এখান থেকে হয় যে, উৎপাদন সকল সামষ্টিক জীবনের ভিত্তি। অর্থাৎ মৌলিক পরিবর্তন যাই হবে, উৎপাদন পদ্ধতিই হবে তার কারণ। লোকদের বিবেক-বুদ্ধি বা সত্য ও ন্যায়পরতার অনুসন্ধান।
মানুষের বিবেক-বুদ্ধির পক্ষে তা আলোচ্য বা বিবেচ্য নয়। এই পর্যায়ে তাদের চেষ্টা-প্রচেষ্টার কোনো অবকাশ নেই। উৎপাদন কাজ এবং উৎপাদন দ্রব্যের বিনিময়ই আসল নিয়ামক।
এমনিভাবে নিশ্চিন্ততার এই দেবতার মানুষের চিন্তা-চেতনা এবং সত্য ও ন্যায়পরতার প্রতি দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার তাদের স্বভাবগত যোগ্যতার প্রতি কোনো দৃষ্টি না দিয়েই জনগণের জীবনকে নিজস্ব রঙ্গে রঙ্গিন করে দেয়। এগুলো এমন দেবতা যা মানুষের মনের ডাকে কোনোই সাড়া দেয় না, তাদের মনের সাথে আনুকূল্য স্থাপন করেও চলে না। যেমন করে আল্লাহ মানুষের চেতনায় সাড়া দেন, তাদের মন রক্ষা করে কাজ করেন। প্রাথমিক জাহিলিয়াতের দেবতাগুলো এ জাহিলিয়াতসমূহের বিপথগামিতা ও মানুষের সাথে তার পাশবিক দ্বন্দ্ব ঝগড়া থাকা সত্ত্বেও সেদিকে অনেকটা লক্ষ্য রেখে চলত।
কিন্তু বর্তমান জাহিলিয়াতের দেবতা স্বীয় স্বৈর বন্ধনে মানুষকে যন্ত্রের একটা নিষ্প্রাণ অংশের ন্যায় শক্ত করে বেঁধে রাখে। ফলে সে এই সমাজ যন্ত্রের গতির সাথে একটি অংশের ন্যায় তাল রেখে চলতে একান্তভাবে বাধ্য হয়।
এভাবে মানুষ স্বীয় ইবাদতে চরম অধঃপতনের নিম্নতম পংকের দিকে নেমে গেল। প্রথমে যদি অন্যান্য খোদাগণের সাতে শিরক সহকারে এক আল্লাহর ইবাদত হতো, এখন তা প্রকৃতির দাসত্ব ও পূজার দিকে চলে এলো। পরে এই প্রকৃতি পূজা থেকে নেমে এলো তার নিজের পূজা ও দাসত্বের দিকে। মানুষ মানুষের পূজা ও দাসত্ব করেছে। আর তার ফলে ধ্বংসাত্মক দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামের সৃষ্টি হয়। ফলে মানুষ সেই সব দেবতার পূজা ও উপাসনা করতে বাধ্য হয় যারা জালিম, নিষ্প্রাণ ও মানুষকে চরমভাবে লাঞ্ছিত করেছে। এদের হাতে নিশ্চয়তা বা নিয়তির কঠোরতা ও অপমান ছাড়া আর কিছুই নেই।
এই হচ্ছে বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াত এবং এর মতো খারাপ ও মারাত্মক জিনিস আর কিছুই হয় না।
এই সব পতনের পিছনে কোনো যুক্তি নেই, নেই দূরদৃষ্টি, নেই কোনো সনদ। কেননা আল্লাহর সাথে শিরক-এর বিপর্যয় যখন শুরু হল, তখনও তার কোনো মুক্তি ছিল না, কোনো সনদও ছিল না।
বস্তুত যে লোক যথার্থ ও নির্ভুলভাবে আল্লাহকে জানতে ও চিনতে পারে, তার পক্ষে তাঁর সাথে কোনো ধরনের শিরক চিন্তা করা কখনোই সম্ভব হতে পারে না। কিন্তু ইউরোপ যেহেতু রোমান পৌত্তলিকতা মিশ্রিত আকীদা গ্রহণ করেছিল কনস্টান্টাইন সম্রাটের কাছ থেকে, এই কারণে তারা আল্লাহকে যথার্থ উচ্চতর মর্যাদার দৃষ্টিতে চিনতে ও জানতে পারেনি। তারা জাহিলিয়াতের মধ্যেই নিমজ্জিত হয়ে থাকল এবং এ জাহিলিয়াতের গ্রাস ক্রমবর্ধমান হল।
জনৈক ঐতিহাসিক মত প্রকাশ করেছেন যে, হযরত মূসা (আ) ও হযরত ঈসা (আ)-এর ওপর অবতীর্ণ শরীয়ত যেহেতু রোমান সাম্রাজ্যের সংক্ষিপ্ত-ক্ষুদ্র অংশে প্রকাশমান হয়েছিল, এই কারণে ইউরোপের এত বিশাল বড় সাম্রাজ্যে তা কার্যখর করা সম্ভবপর ছিল না।
এই মত থেকে মূল ব্যাপারের বহু কয়টি দিকের মধ্যে একটি মাত্র দিক উদ্ভাসিত হয়। কিন্তু অপর এক মহাসত্যকে আচ্ছন্ন করেই রাখে। আর সে সত্য হচ্ছে, স্বয়ং সেই খ্রিষ্টানদের বিশ্বাসের ক্ষেত্রে মূল আকীদা যথাযথ ও নির্ভুলভাবে স্থান পায়নি। যদি তা বাস্তবিকই নির্ভুল ও নির্দোষ থাকত, তাহলে রোমান আধিপত্য তার পথ রোধ করতে পারত না। যেমন করে আরব উপদ্বীপ ও তার বাইরের জাহিলিয়াতের শক্তিসমূহ ইসলামী শক্তির সম্মুখে মুহুর্তের তরেও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এই বাইরের শক্তিসমূহের মধ্যে ছিল সমগ্র রোমান সামাজ্র, পার্শ্ববর্তী পারসিক সাম্রাজ্য। সে যা-ই হোক। এই সমস্ত কারণ অবস্থার একটা ব্যাখ্যা তো দেয় বটে, কিন্তু তার পক্ষ সমর্থন করে না। দুনিয়ার কোনো জিনিসই আল্লাহ থেকে বিপথগামিতাকে সমর্থন দিতে পারে না।
মূলত এই মৌলিক বিকৃতিই সকল প্রকার বিপর্যয়ের অগ্রবর্তীর কারণ। মনে যদি শিরক গ্রহণের অবকাশ থেকে থাকে, তাহলে সে শিরক গ্রহণের পর সব কিছুই সহজ হয়ে যায়। আর এই বিপর্যয়ও যখন শুরু হয়ে যায়, তখন সেই পথটাই নিয়ে আসে পতনের পর পতন এবং অধিকতর বিপর্যয়।
ইউরোপের সূচনাটাই হয়েছে অত্যন্ত ভুলভাবে। পরে ক্রমশই তা আল্লাহর হেদায়েত থেকে দূরে –বহুদূরে সরে যেতে থাকে অব্যাহতভাবে। কালের অগ্রগতির সাথে সাথে সে দূরত্ব অনেক দীর্ঘ হতেও দীর্ঘতর হতে থাকল।
গীর্জা যখন নিজের নির্বুদ্ধিতার কারণে সমস্ত খারাবি ও বিপর্যয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দিল (যে বিষয়ে পূর্ব কিছুটা আলোচনা করে এসেছি), তখন ইউরোপের লোকদের আকীদায় এক নতুন বিকৃতি সৃষ্টির কারণ হয়ে দেখা দিল। আর তাই ক্রমাগতভাবে দীর্ঘ পরিক্রমার পরিণতিতে বর্তমান বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াত পর্যন্ত এসে ঠেকিয়ে যোগ করে দিল।
এটাও এক ধরনের ব্যাখ্যা বটে! কিন্তু তা-ও তাকে কোনো সমর্থন দিচ্ছে না। কেননা ইউরোপীয়রা আগে থেকেই মনে করত যে, গীর্জা যাই পেশ করে, তা প্রকৃত ধর্ম নয়। তা পাদ্রী-পুরোহিতদের নিজেদের মনগড়া কথাবার্তা, তাদের নিজেদের সৃষ্টধর্ম। তাতে এমন আকীদা রয়েছে যা তাদের বোধগম্য নয়, যা গ্রহণ করতে তাদের বিবেক-বুদ্ধি অস্বীকার করে, কেননা এখন তাদের বিবেক-বুদ্ধি নতুন আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।
কিন্তু ইউরোপীয় গীর্জা যে বিকৃত ধর্ম পেশ করছিল, তাকে প্রত্যাখ্যান ও প্রত্যাহারকরে নবী-রাসূলগণের প্রতি আল্লাহর নাযিল করা পরিচ্ছন্ন ও পরম সত্য আকীদা ভিত্তিক ধর্ম গ্রহণ অগ্রাহ্য করে বসল। বলতে লাগলঃ সব ধর্মই কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও পৌরাণিক কাহিনিমূলক।
কিন্তু সে যা-ই হোক, ইউরোপ যতই ইউরোপ যতই পেশ করুক, কোনো কিছু থেকেই ইউরোপ বাঁচতে পারে না।
মধ্যযুগে প্রকৃতি পূজার ব্যবস্থায় ইউরোপ যে কঠিন শিরক-এ নিমজ্জিত হয়েছিল, তার সমর্থনে কোনো যুক্তিই পেশ করা যেতে পারে না। ইউরোপের নতুন আলোকপ্রাপ্ত লোকেরা যে নতুন রূপে শিরক গ্রহণ করেছিল, তার কোনোই তাৎপর্য নেই। আমরা আগেই বলেছি, প্রকৃতি পূজা মূলত গীর্জার স্বৈরতান্ত্রিক কর্তৃত্ব থেকে বাঁচার একটা পন্থা হিসেবেই অবলম্বিত হয়েছিল। কিন্তু খোদা প্রকৃতি জিনিসটি কি?
বিরোধী হেলেনীয় আদর্শের আলোকে এই বুদ্ধিবাদের যুগে একজন সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষ ডারউইনের এক কথাকে কি করে যুক্তিসঙ্গত ও বিবেকসম্মত বলে মানতে প্রস্তুত হতে পারে যে, প্রকৃতিই সব জিনিসের সৃষ্টিকর্তা? আর প্রকৃতির শক্তির কোনো সীমা-শেষ নেই। এই নিষ্প্রাণ-বুদ্ধিহীন প্রকৃতি বুদ্ধিমান, জ্ঞঅনবান, চিন্তাশীল সত্তা কিংবা অ-বুদ্ধিমান-[ডারউইন তাঁর পূর্ব কথার বিপরীত বলেছেঃ প্রকৃতি তার বিবর্তনে দিশেহারা অনিয়মিতভাবে কাজ করেছে।] সত্তা সৃষ্টি করেছে যা গোটা প্রকৃতির ওপর কর্তৃত্ব করেছে ও তার ভাগ্য নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করছে। একথাকে সত্য বলে বিশ্বাস করা কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব?
সেসব আলোকপ্রাপ্ত লোকেরা নিজেদেরকে এ প্রশ্ন না করে পারল কি করে যে, তারা সুনির্দিষ্ট ও নিশ্চিতভাবে যে প্রকৃতির দাসত্ব করছে, সে প্রকৃতিটি কি? তা সৃষ্ট না অ-সৃষ্ট? বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন, না বিবেক-বুদ্ধিহীন? সে জিনিকে নিজে কি করে সৃষ্টি করল? কেমন করে বানাল সেসব নিয়ম, যা বিশ্বলোককে নিয়ন্ত্রিত করছে? এসব নিয়মের এমনকি কর্তৃত্ব ক্ষমতা রয়েছে যার বলে এ বিশ্বলোককে সেসব নিয়ম অনুযায়ী চালাতে সক্ষম হচ্ছে, তা এই নিশ্চয়তা ও অনিবার্যতা কোত্থেকে পেল, যা তা গোটা বিশ্বলোকের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে এবং বিশ্বলোক সেই অনুযায়ী চলতে শুরু করে দিল?
তা ছাড়া এ নবতর মাবুদ যাকে সরল প্রকার শক্তি-ক্ষমতা, সৃজনশীলতা ও বিশ্বলোকের ওপর এই নিরংকুশ সংরক্ষণতার একমাত্র উৎস বলে মনে করা হচ্ছে, আর আল্লাহ এই দুইয়ের মধ্যে প্রকৃত পার্থক্যটা কি (যে আল্লাহকে তারা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং নিতান্ত অযৌক্তিক ও অবাধ্যভাবে যাঁর ইবাদত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে)?
অদৃশ্য গায়েমী শক্তিকে মেনে নিতে তো অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তাহলে তারা এই প্রকৃতি সম্পর্কে নিজেদেরকে এ প্রশ্ন না করে চুপ থাকতে পারল কি করে? তা কি গায়েবী নয়? না, প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণীয়? তার প্রপঞ্চ ও প্রকাশমান যদি পৃথিবী ও আকাশমণ্ডলে লক্ষণীয় হয়ে থাকে, বস্তু ও আলোকোচ্ছটাই যদি হয় তার বাহ্য প্রকাশ, তাহলে তার নিদূঢ়ত্ব ও প্রকৃত সত্যটা কি? তা কি তাই, যা আকাশকে আকাশ বানিয়েছে আর পৃথিবীকে পৃথিবী? বস্তুটি শুধু বস্তু? …….তাকি গায়ব নয়? নয় এমন প্রচ্ছন্ন যে, ইন্দ্রিয় নিয়ে তা আয়ত্ত করতে পারে না।
আল্লাহও কি এ ছাড়া অন্য কিছু? তিনিও তো গায়ব, ইন্দ্রিয়নিচয় তাঁকেও আয়ত্ত করতে পারে না। কিন্তু তাঁর মহাশক্তির প্রকাশমানতার প্রতীক হয়েছে এই বিস্তীর্ণ বিশাল আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী। …এই বস্তু ও আলোকোচ্ছটা।
এই প্রেক্ষিতে তো অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, ইউরোপীয় সেসব আলোকমণ্ডিতরা এক মহা নির্বুদ্ধিতার আবর্তে পড়ে গিয়েছিল।
অতঃপর প্রকৃতি পূজার অবসান ঘটে। মানুষ নিজেই নিজের পূজা করতে শুরু করে। কিন্তু মানুষ পূজার একান্ত কি? কেন ঘটল? কিভাবে ঘটল? কি এ তাৎপর্য ও যৌক্তিকতা?
তাকি এ জন্যে যে, মানুষ বিদ্যা অর্জন করেছে এবং তার শক্তি বেড়ে গেছে?
স্রষ্টা অস্বীকারকারী এই ঘৃণ্য জাহিলিয়াতকে খানিকটা সময়ের জন্যে চোখের আড়ালে সরিয়ে রাখুন। কেননা এ জাহিলিয়াত এতই হীন ও নিকৃষ্ট যে, তা তার সেই স্রষ্টাকে চিনতে পারে না, যে তাকে এই জ্ঞান ও বিদ্যা দান করল। মহাদানকারী, নিয়ামতদাতা আল্লাহ তা’আলার এই মহাদানের বিনিময়ে তাঁর শোকর আদায় করার পরিবর্তে মানুষ নিজেই সে মহাদানকে তাঁর প্রতি কুফর ও না শুকরির কারণ বানিয়ে নিয়েছে।
এ জাহিলিয়াত তো প্রাচীন গ্রীক জাহিলিয়াতের প্রাণশক্তিকেও বিষাক্ত জর্জরিত করে ফেলেছে মানুষ ও দেবতাগণের মধ্যে দুঃখজনক দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম সৃষ্টি করে দিয়ে। যখন তা দেবতাগণের কাছ থেকে কিছু পরিমাণ জ্ঞান ও বিদ্যা কেড়ে নিয়েছে, তখনই তার বিদ্রোহের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে শুধু এই কারণে যে, তার হাতে একটা কর্তৃত্ব এসে গেছে।
কিছু সময়ের জন্যে এ সবই দূরে সরিয়ে রাখুন। তারপরে আমাদের বিবেচনা করে দেখতে হবে, মানুষ কি বিজ্ঞানটা অর্জন করে বসেছে যে, মহাদাতা নিয়ামতদানকারী আল্লাহ তা’আলাকে সে চিনতে পারছে না, অস্বীকার করতে প্রস্তুত হয়ে গেল?
আমেরিকান বিজ্ঞানী মারেট স্টেনলে কোংগডট তাঁর ‘গোলাপ বাহার অধ্যয়ন’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেনঃ
“বিজ্ঞান যদিও পর্যবেক্ষণীয় (বা পর্যবেক্ষিত) মহাসত্যের নাম, কিন্তু তা সত্ত্বেও মানবীয় কল্পনা অধ্যয়ন ও ফুল গ্রহণের বিভিন্ন পদ্ধতি দ্বারা অবশ্যই প্রভাবিত হয়। এই পরিসীমার মধ্যে বৈজ্ঞানিক চিন্তা-গবেষণার ফলাফল গ্রহণীয় বটে। কিন্তু পরিমিতির ক্ষেত্রে এটা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। তার শুরুও শুধু সম্ভাবনা, আর শেষ ও সম্ভাবনা ছাড়া আর কিছুই নয়। কোনো পর্যায়েই দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। বরং সব বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও চিন্তা গবেষণা ফল ভ্রান্ত হওয়াই সম্ভব ধারণা, অনুমান, পারস্পরিক তুলনা ইত্যাদির দিক দিয়ে। তাছাড়া তা যে কোনো সময় পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত, সংশোধিত, বর্জনকৃতও হতে পারে। কোনো চূড়ান্ত কথাই নেই তাতে”।–[‘আল্লাহ বিজ্ঞান যুগে প্রতিভাত’ গ্রন্থের আরবী অনুবাদ –ডঃ দমরাশ আবদুল মজীদ মারহান।]
এ উক্তিটি কোনো ধার্মিক বা ধর্মবাদী ব্যক্তির উক্তি নয়।
এতে কোনোই সন্দেহ নেই যে, মানবীয় বিদ্যা সম্ভাব্যতা পরিপূর্ণ (এ হতে পারে, ও হতে পারে –ইত্যাকার কথাবার্তাই হচ্ছে বিজ্ঞান।) সেখানে দৃঢ় নিশ্চিত প্রত্যয়ের কোনো অস্তিত্ব নেই। তা যত সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির সাহায্যে যত সূক্ষ্ম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই করা হোক না কেন।
আর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রটাও একবার দেখুন!
দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞান বাধ্য হয়েছে বস্তুর আসল সত্যতা ও তার নিগূঢ় তত্ত্ব জানতে চেষ্টা করার পরিবর্তে তার শুধু বাহ্যিক দিক ও রূপরেখা সম্পর্কিত জ্ঞানঅর্জন করাকে যথেষ্ট মনে করত। কেননা তা জানতে পেরেছে যে, ইন্দ্রিয় অগম্য প্রচ্ছন্ন নিগূঢ় তত্ত্ব জানতে পারা কোনো ক্ষমতাই তার আয়ত্তে নেই। শুধু বাহ্যিক অধ্যয়ন ছাড়া তার কোনো গত্যন্তর নেই। আর এই বাহ্য বিষয় অধ্যয়ন সম্পর্কেই উপরোক্ত বিজ্ঞানী বলেছেন যে, এই জ্ঞান বা বিজ্ঞান কোনো নিশ্চিত, নিঃসন্দেহ ও দৃঢ় প্রত্যয়মূলক জিনিস নয়। বরং তা সূচিত হয় সম্ভাবনা থেকে এবং পরিসমাপ্তও হয় এই সম্ভাবনা নিয়ে।
তাহলে প্রকৃত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমষ্টির মধ্যে এহেন বিজ্ঞান বা জ্ঞানের অবস্থাটা কি? কি তার মূল্য ও গুরুত্ব? এই বিজ্ঞানের কারণে আকজের মানুষ কোন কঠিন ধোঁকায় নিপতিত হয়েছে?
তাছাড়া মানুষ বাস্তবিকই যা জানতে আগ্রহী, সে তুলনায় তার অর্জিত এই বিজ্ঞানের পরিমাণ বা মাত্রাই বা কি?
সে গায়বী বিদ্যা কোথায়, যার সন্ধানে মানুষ প্রথম সৃষ্টি মুহুর্ত থেকে এবং হাজার হাজার বছর থেমে মানুষ আকুল আগ্রহী হয়ে আছে?
মানুষ গায়ব-এর কতটা জানে? স্থান ও কালের দৃষ্টিতে দূরবর্তী জ্ঞানের কথা তো অনেক দূরে, সম্মুখবর্তী মুহুর্তকাল জ্ঞানও কি মানুষের আছে? চলমান মুহুর্ত –যা সর্বদিক দিয়ে তার সম্মুখে উপস্থিত, সেই মুহুর্তের জ্ঞানও কি মানুষ আয়ত্ত করতে পেরেছে? তার ও এই জ্ঞানের মাঝে কি লক্ষ আবরণ ও অন্তরাল প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়নি?
এই তো হচ্ছে মানুষের জ্ঞানের দৌড়।
শক্তির কথা? হ্যাঁ মানুষের শক্তি আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, তা সত্য। মানুষ তার পরিবেশের ওপর ….প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করেছে, সন্দেহ নেই। বিন্দু ও অণুকে মানুষ চূর্ণ করে পরমাণুর উদ্ভাবন করেছে। আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, রকেট ছেড়েছে। চাঁদের বুকেও পদ সঞ্চারিত হয়েছে, বিজয় পতাকা পতপত করে উড়ছে সেখানে। ..এ সবই সত্য।
কিন্তু….. মানুষ যে শক্তি অর্জন করতে আগ্রহী, তা কি সে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে?
মৃত্যুকে প্রতিরোধ করার শক্তি কি মানুষ অর্জন করেছে? চিরন্তন জীবন লাভের শক্তি কি আয়ত্তাধীন হয়েছে মানুষের? ….স্বভাবগত সেই আগ্রহের কারণেই শয়তান আদমকে পদস্খলিত করতে সুযোগ পেয়েছিল। আদমের সন্তানরা আজও সেই কামনা নিয়ে বসে আছে, কেয়ামত পর্যন্তই থাকবে তার এই বাসনা! শয়তান আদম ও হাওয়াকে সম্বোধন করে এই কথাই তো বলেছিলঃ
(আরবী****************************************************************)
তোমাদের রব্ব তোমাদের দুইজনকে এই বৃক্ষটি সম্পর্কে যে নিষেধ বাণী দিয়েছেন, তা অন্য কোনো কারণে নয়, শুধু এই জন্যে যে, (গাছটি থেকে কিছু আহার করলে) তোমরা দুজনই ফেরেশতা হয়ে যাবে অথবা তোমরা দুজনই চিরতরে জান্নাতবাসী হয়ে যাবে ….ফলে সে দুজনকে প্রতারিত করে ফেলল। (সূরা-আরাফঃ ২০-২২)
অন্তত রোগ প্রতিরোধ ….রোগজীবাণু ধ্বংস করা কি সম্ভব হয়েছে মানুষের দ্বারা? আজও অনুবীক্ষীয় রোগ জীবাণু বড় বড় চিকিৎসা অযোগ্য রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মূর্খতা ও অক্ষমতাই নাকি আল্লাহর ইবাদতে মনোযোগী হওয়ার কারণ, ইলিয়ান হাক্সলী তার বুকের ওপর চড়ে বসা বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াতের কারণেই এইরূপ বলেছিলেন।
তা হলে তা-ই হওয়া উচিত ছিল কিন্তু বিজ্ঞান ও শক্তি কিংবা মূর্খতা ও অজ্ঞমতা পর্যায়ে বাস্তবে কি ঘটেছে? আল্লাহর ইবাদত পরিহার করার প্রবণতা মানুষের কিছু মাত্র কমেছে কি?
আমরা আবার সেই জাহিলিয়াতের প্রসঙ্গটা তুলছি, যার সব কিছুই ওলটপালট হয়ে গেছে।
আল্লাহ তা’আলা মানুষকে জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জনের এবং কোনো কোনো প্রাকৃতিক শক্তির আয়ত্তাধীন বানানোর শক্তি কি এ জন্যে দিয়েছিলেন যে, মানুষ অহংকার-অহমিকায় দিশেহারা হয়ে যাবে এবং আল্লাহর আনুগত্য পরিত্যাগ করবে?
মূলত এ একটি মারাত্মক অভিশাপ। আগুন চোর প্রোমিথিউস সংক্রান্ত পৌরাণিক কাহিনীই ইউরোপীয় চিন্তা বিজ্ঞানের ওপর টেনে নিয়ে এসেছে।
অহংকারী দাম্ভিক মানুষের ব্যাপারটাই দেখুন। সে বলছেঃ আমি আল্লাহর কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
আল্লাহর আনুগত্য পরিহার করে সে কোনো অপরাধ করা বাদ দিয়েছে?
সে বলেছে, আমিই আমার জন্যে আইন প্রণয়ন করব। …..কেননা সে এখন গোলামী থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে।
বলেছে, আমার আকীদা ও আনুগত্য বিধান আমি নিজেই রচনা করব।
বলেছে, আল্লাহর হেদায়েতকে পাশ কাটিয়ে আমার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আমি নিজেই গড়ে তুলব।
কিন্তু পেরেছে….?
আসলে এ সবই ছিল শয়তানের ধোঁকা।
এটাই যদি শয়তানের কৃত না হয়ে থাকে, তা শয়তানের কীর্তি আর কি-ই বা হতে পারে! ….মানুষ একা এই কাজ কি করে করতে পারে!
সমগ্র পৃথিবী অন্যায়, পাপ ও দুষ্কৃতিতে ভরপুর করে দেওয়ার এ সাধ্য মানুষ কোথায় পেল? সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া এই জুলুম শয়তানের সহায়তা ছাড়া মানুষের পক্ষে করা কি করে সম্ভবপর হলো? পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য এই অপমানকর দাসত্ব মানুষের ললাট লিখন কি করে হতে পারল?
এ দাসত্ব বিচিত্র ধরনের।…..
মূলধনের দাসত্ব…..
রাষ্ট্রের দাসত্ব……..
মহান ব্যক্তিদের দাসত্ব ….মৃত অলী-আল্লাহগণের দাসত্ব
সর্বধ্বংসী লালসা-কামনার দাসত্ব।
এ সব নিতান্তই দাসত্ব –অপমানকর –লাঞ্ছনাকারী।
পৃথিবীর সর্বত্র বিস্তীর্ণ এই পাপ মানুষ কি করে করতে পারল, যা পৃথিবীর চেহারাটাই বদলে বিকৃত করে দিয়েছে, পাপের এই গভীর পংক কি আল্লাহই করল যার মধ্যে যুবক-যুবতীরা পরপর নিপতিত হচ্ছে?
সভ্য দুনিয়ার হাসপাতাল ও গারতসমূহ যে পাগলের দ্বারা ভর্তি হয়ে আছে, এমনভাবে যে কোথাও তিলমাত্র স্থান খালি নেই?
পাগলামী তো এমন রকমারি যে, সরকারীভাবে তা গণতায় আসেনা, কিন্তু তা যে রোগ, অনিয়মতা, অসুস্থতা, প্রকৃতপক্ষে তা পাগলামী না হয়ে যায় না।
…এ হচ্ছে বন্ধুত্বের পাগলামী, সিনেমা থিয়েটারের পাগলামী, টেলিভিশনের ফ্যাসন-শোর নৃত্য-গীতের পাগলামী, ছিনতাইয়ের পাগলামী ….এই ধরনের অন্যান্য বহু প্রকারের বিকৃতি, বিপথগামিতা ও বিপর্যয়। আল্লাহার ইবাদত করাকে অহংকারবশত ঘৃণাকারী আল্লাহর দ্বারা এই সব বিপর্যয় হওয়া তো কোনো প্রকারের শোভা পায় না।
কখখন-ই না।
মানুষ যখন নিজকে ‘খোদা’ মনে করে বসেছিল, ধারণা করেছিল যে, দাসত্বের শৃঙ্খল বুঝি ছিন্ন হয়ে গেছে। আল্লাহর হেদায়েত গ্রহণে আর কোনো প্রয়োজনই নেই, তখন মানুষ জঘন্যতার কোন চরমেই না পৌঁছে গিয়েছিল।
ইহুদী চিন্তা উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে কল্পিত খোদার জন্ম দিয়েছিল এবং সেই সময় থেকেই উম্মীদের চিন্তা সেই চিন্তার দ্বারা বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। সেগুলো ছিল অর্থনৈতিক, সামাজিক-সামষ্টিক ঐতিহাসিক দৃঢ় সংকল্পবদ্ধতা (determinism)। আর এসবই ইতিহাসের বস্তুগত ব্যাখ্যার ফলশ্রুতি।
কথিত ও ঘোষিত এসব দৃঢ় সংকল্পবদ্ধতা আসলে কি?
প্রথমত, ইতিহাসের বস্তুনিষ্ট ব্যাখ্যা বলছে, মানুষের ইতিহাস হচ্ছে খাদ্যের আলোচনার ইতিহাস। ইতিহাসে তাই হচ্ছে অর্থনৈতিক দৃঢ় সংকল্পবদ্ধতা।
খাদ্য সংক্রান্ত আলোচনাকালেই যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন ও উৎপাদনের প্রয়োজন দেখা দেয়।আর এই সব যন্ত্রপাতিই তার জীবনকে ইতিহাসের দীর্ঘ অগ্রগতিতে স্তরে স্তরে অগ্রসর করে নিয়ে এসেছে।
প্রাথমিক অবস্থায় ছিল প্রাথমিক কমিউনিজম। তথায় কারোরই ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। অতঃপর কৃষিকাজ উদ্ভাবিত হয়। তারপরই মালিকানার প্রশ্ন দেখা দেয়। তা জমির মালিকানা ও উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা। তখব ভূমি দখলের উদ্দেশ্যে এক জাতির অপর জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার দরুন দাসত্ব প্রথার জন্ম হয়। পরে এক এক জাতিকে দাস বানিয়ে তাদেরকে ভূমি চাষে নিযুক্ত করে ভূমিদাস বানিয়ে দেওয়া হয়। তারপরই জায়গীরদাবী বা সামস্তপ্রথার উদ্ভব ঘটে। এক নিশ্চিত অনিবার্যতা বা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধতার ফলশ্রুতি স্বরূপ। এরপর যন্ত্রপাতি উদ্ভাবিত হয়। তারই ফলশ্রুতিতে পুঁজিবাদের জন্ম। এও এক সুনিশ্চিত অনিবার্যতা। এখন জায়গীরদারী খতম হয়ে যায় এক নিশ্চিত অনিবার্যতার ফলস্বরূপ। অতঃপর মূলধন ও শ্রমিকদের মধ্যে এক সুনিশ্চিত অনিবার্যতার ন্যায়ই চরম দ্বন্দ্বও সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। যন্ত্রপাতির মালিকানা ও উৎপডন্ন পণ্যের মালিকানা ও উৎপন্ন পণ্যের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলতে থাকে এক সুনিশ্চিত অনিবার্যতাস্বরূপ। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে বরং সর্বশেষ পর্যায়ে দ্বিতীয় কমিউনিজম জন্মগ্রহণ করে। তার জন্মের এটাই হচ্ছে পথ। তথায় ব্যক্তিগত মালিকানা থাকবে না কোনো একজন ব্যক্তির জন্যেও।
নিশ্চিত অনিবার্যতা ভিত্তিক মানবীয় ইতিহাসের এটাই হচ্ছে সারনির্যাস। এই ধারায় চিন্তা করা কেবল জাহিলিয়াতের পক্ষেই সম্ভভ বলে ধারণা করা যায়।
ইতিহাসের এ ব্যাখ্যা আল্লাহকে ভুলে গেছে, ভুলে গেছে বিশ্বলোক জীবন ও মানুষের জন্যে তাঁর কৃত যাবতীয় কল্যাণকর ব্যবস্থাপনা। কিন্তু প্রশ্ন হলো এরূপ ব্যাখ্যা দ্বারা ইতিহাস কোনো মোক্ষম লাভ করল? কোথায় পৌঁছল, এ তো এমন ব্যাখ্যা যা আজকের আলোকমণ্ডিত ও আজকের জাহিলি জ্ঞান-বিজ্ঞান পারদর্শী ব্যক্তিবর্গ ও সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করতে পারে না।
জীবনের এই সমস্ত বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যাকে যদি সঠিক মেনেও নেওয়া হয় যদিও এখনই ভালোভাবে জানা যাবে যে, এ ব্যাখ্যা কোনোক্রমেই যথার্থ নয়, তবু মানুষের ইচ্ছা ও অবস্থার সাথে তার কোনোরূপ অসঙ্গতি সম্পর্ক হওয়া তো উচিত হতে পারে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষই কি জমি ও উৎপাদনযন্ত্রের মালিক হয়ে বসেনি অথচ পূর্বে তারা তার মালিক ছিল না? জমির ওপর মালিকানা কি জমি নিজেই চাপিয়ে দিয়েছে? জমি কি মানুষকে ডেকে বলেছিল যে, তোমরা শিগগীর আমার মালিক হয়ে যাও? জমিই কি মানুষের গলা চেপে ধরে বলেছিল যে, জমির মালিক হওয়া ছাড়া মানুষের আর কোনো গত্যন্তর নেই? কিংবা মানুষই জমির মালিক হয়েছিল এ জন্যে যে, মালিকানা লাভ মানষের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা?
মানুষ নিজেরাই কি ইচ্ছা করে যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন করেনি? কিংবা যন্ত্রপাতিই মানুষের গলা চেপে ধরে বলেছিল যে, আমাকে নির্মাণ কর? তার উন্নতমানের ও নিখুঁত নির্মাণের জনে মানুষ নিজেই কি আগ্রহী হয় নি? –এবং এ আগ্রহও তার স্বভাবের মধ্যে প্রচ্ছন্ন রয়েছে? ….সেই তো যন্ত্র উৎপাদন প্রক্রিয়া শিক্ষা লাভ করেছিল, তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেছিল এবং শেস পর্যন্ত তা নির্মাণে সক্ষম হয়েছিল।
এক্ষণে এ কথা যদি ধরেও নিই যে, এসব যন্ত্রপাতিই মানবতার ইতিহাস লিখছে, তাহলেও কি বলতে হবে যে, তাতে মানুষের ইচ্ছা শামিল নেই? ….তাহলে বিবর্তন মানুষের ইচ্ছার বাইরে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও নিঃসম্পর্কভাবে কি করে সম্ভবপর হলো?
অতঃপর যখন পুঁজিতন্ত্র চালু হয়ে গেল, তখন কি মালিক হয়ে বসার জন্যে মানুষ নিজেরাই আগ্রহী হয়ে ওঠেনি? নিজেরাই কি স্বভাবের তাড়নায় চায়নি যে, তাদের মালিকানা সম্পকের পরিমাণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হোক। মানুষের মধ্যে তো এই স্বাভাবিক তাড়না রয়েছে যে, সে যখন বিপথগামী হয়, তখন বিদ্রোহ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়।
তারপর যখন কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন কি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাকেই সত্য ও ন্যায়পর পথ মনে করেনি? ফ্রেডারিক এঞ্জেলস তো তারই ওপর বিদ্রূপ করে বলেছিলঃ
‘মানুষ বৈষয়িক ব্যাপারাদিতে হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকারই রাখে না’। এটা হলো প্রথম কথা। ….উল্লিখিত নিশ্চিত অনিবার্যতা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দৃষ্টিতে এটা একটা খুবই নিকটবর্তী কথা!
আর দ্বিতীয় যে কথাটি চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গের জন্যে প্রকৃত সত্যের অধিকতর নিকটবর্তী, তা হচ্ছে, এসব নিশ্চিত অনিবার্যতাকে সত্য বলে ধরে নিলেও প্রশ্ন থাকে যে এসব কার নির্ধারিত নিশ্চিত অনিবার্যতা?
মানব প্রজাতির অগ্রগতির পথে এসব নিশ্চিত অনিবার্যতা কে ধার্য করেছে, কে অপরিহার্য বানিয়ে দিয়েছে?
তা-ই কি জীবনের জন্যে একটি মাত্র উপায়?
মানুষের পক্ষে কি প্রাথমিক পর্যায়ের কমিউনিজম স্তরে চিরদিনের তরে চিহ্নিত হয়ে থাকা সম্ভবপর ছিল না?
দাস প্রথার যুগে চিরদিন দাঁড়িয়ে থাকাও কি অসম্ভব ছিল? ….সামন্তবাদী যুগে? কিংবা পুঁজিবাদী স্তরে স্থায়ীভাবে? যন্ত্র উৎপাদন মানুষের জীবনকে একটা নতুন দিকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। খুলে দিয়েছিল এক নবতর দিগন্ত।
হ্যাঁ, যন্ত্র উৎপাদনও কি মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কোনো নিশ্চিত অনিবার্যতা? ….কে তা চাপিয়ে দিল?
আল্লাহর কথা স্মরণের ও তার বিধান পালনের ব্যাপারে কি আল্লাহর কোনো অংশ নেই? …অন্ততঃ একটা পক্ষও কি তিনি নন? তিনি-তো শিরককারীদের কথা থেকে অনেক ঊর্ধ্বে, পরম পবিত্র।
তিনিই কি মানুষকে সৃষ্টি করেন কি? ….মানুষকে যন্ত্র উৎপাদনের বুদ্ধি ও ক্ষমতা কি তিনি-ই দেন নি?
মানুষকে তাঁর এই শক্তি ও বুদ্ধি দান করাও কি নিশ্চিত অনিবার্য ছিল? মহাবিশ্বের পৃথিবী নামের গ্রহটির অস্তিত্বের কি নিশ্চিত অনিবার্য ছিল? না, তারও ওপরে গিয়ে বলো, এই গোটা বিশ্বলোকের অস্তিত্বটাও কি নিশ্চিত অনিবার্য ও অবধারিত ছিল? …সে নিশ্চিত অনিবার্যথা কার নির্ধারিত, কে করেছে তাকে নিশ্চিত অনিবার্য অবধারিত?
মহান আল্লাহর বিধান পালনের প্রতি এই অনীহা কেন?
মানুষের অন্তদৃষ্টি মহাসত্যের ওপর উন্মিলিত ও নিবদ্ধ হওয়া উচিত নয় কি?
আবার জিজ্ঞেস করছি, আল্লাহই কি এই বিশ্বলোককে সৃষ্টি করেন নি? যদিও তিনি তা করতে কোনোক্রমেই একবিন্দু বাধ্য ছিলেন না। …কে পারে তাকে বাধ্য করতে? …তিনি তো তা থেকে সর্বতোভাবে পবিত্র।
তিনিই কি পৃথিবী সৃষ্টি করেন নি? …মানুষকে সৃষ্টি করেন নি? …..অথচ তিনি তা সৃষ্টি না করেও পারতেন। সৃষ্টি না করলে তাঁর কিছুই ক্ষতি বা লাভ হতো না? …তিনি তার ঊর্ধ্বে। কিংবা জীবন ও মানুষের আত্মপ্রকাশের অনুকূল কোনো পরিস্থিতি এখানে আদপেই হতো না, তা-ও হতে পারত।
….এ সবই যখন আল্লাহ নির্ধারিত….. তিনিই তো সৃষ্টিকর্তা। ….তাহলে আমরা কোনো এক নির্দিষ্ট পর্যায়ে দাঁড়িয়ে বলতে পারি যে, না, না, তুমি নও হে খোদা! সে নির্ধারক হচ্ছে ঐতিহাসিক কিংবা অর্থনৈতিক অথবা সামাজিক-সামষ্টিক নিশ্চিত অনিবার্যতা। …কিংবা বানানো দেবতাগণই হচ্ছে তার নির্ধারণ?
ইউরোপীয় চিন্তা তার জাহিলিয়াতের তুঙ্গে ওঠে যে সব ‘খোদা’ বা ‘দেবতা’ উদ্ভাবন করেছে, তারা সবই অত্যন্ত নির্মম, অন্তঃসারশূন্য ও রুঢ় –বে-রহম। ওরা মানুষের ইচ্ছার কোনো অধিকারই স্বীকার করে না, দিন-রাত মানুষ যে ফরিয়াদ আর্তনাদ করে, তা-ও তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না, মর্ম স্পর্শ করে না। কোনো ডাকেরই এক বিন্দু সাড়া দেয় না।
এই দেবতাগুলো নিজেদের উদ্ভাবিত নির্বুদ্ধিতা মূল নিশ্চিত অনিবার্যতার দরুন মানুষকে অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে উপেক্ষা করে গেছে। মানুষের চিন্তা-ভাবনা ও কাজের সাথে সেগুলোর কোনো সম্পর্কই নেই। …মানুষের কাজ সঠিক কিংবা ভুল, তা নিয়েও তাদের কোনো ভাবনা বা দায়-দায়িত্ব নেই। মানুষের সত্যিকারভাবে উন্নতি হলো; কিন্তু লাঞ্ছনা-ব্যর্থতার অতল গর্ভে ডুবে গেল, তারা ঈমান আনল কি কুফরী অবলম্বন করল, সে বিষয়েও ওদের কোনো জবাবদিহি নেই। মানুষের সাথে এসব দেবতার আচরণ এমন, যেন মানুষ কোনো প্রাণহীন সত্তা, তারা তাদের পরাক্রমশালী নিশ্চিত অপরিহার্যতার সম্মুখে অত্যন্ত হীন ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। অথবা তাদের সাথে সেগুলোর আচরণ এমন যে, তারা যেন মানুষ পদবাচ্য নয়, তারা যেন ছাগল-ভেড়ার পাল। তাদেরকে এক অজানা পথে তাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে, সে পথ সম্পর্কে কোনো ধারণা করারও যেন কোনো শক্তি নেই তাদের।
বস্তুত এ ছিল মানবতার পক্ষে অত্যন্ত অপমানকর, চরম লাঞ্ছনার ব্যাপার। মানুষের চিন্তা-চেতনা ও কার্যাবলী –যা মানবীয় মহাসত্য সম্বলিত মূল্যমান, তার পক্ষে এর চাইতে অপমানকর ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না।
মানুষ আল্লাহর হেদায়েত থেকে দূরে সরে গিয়ে কি এই মর্যাদা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষী হয়েছিল? এখানে তারা তো নিকৃষ্টতম দাস হয়ে বসেছে নির্দয় ও তাদের অবস্থার প্রতি ভ্রূক্ষেপহীন দেবতাকুলের।
বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াতে মানুষের কি চরম ও মর্মান্তিক অবস্থাই না হয়েছে।
মানুষের এ জাহিলিয়াতে দুর্গতি ও লাঞ্ছনার এই সীমা পর্যন্ত এসেও থেমে যায়নি। থেমে যাওয়া সম্ভবও ছিল না। আল্লাহ সম্পর্কিত ধারণায় যদি বিপথগামিতা ও বিপর্যয় শুরু হয়ে যায়, তাহলে মানুষের সকল প্রকারের ও পর্যায়ের ধারণায় এবং বাহ্যিক আচার-আচরণে চরম গুমরাহীর মধ্যে পড়ে যাওয়া অবধারিত হয়ে পড়ে। কেননা শুরুতেই যাত্রা লক্ষ্য ভুল নির্ধারণ করা হয়েছে। এই কারণে পথের প্রতি পদক্ষেপই ভুল দিকে ছুটে চলছে।
আধুনিক ইউরোপীয় জাহিলিয়াতে মানুষ বিশ্বলোক সংক্রান্ত ধারণায় তার সাথে স্রষ্টার সম্পর্ক এবং তার সাথে মানুষের সম্পর্ক নির্ধারণেও মারাত্মক ভুল করা হয়েছে। ফলে তারা সর্বাত্মক ও সর্বব্যাপী গুমরাহীর মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছে।
মানুষ কখনও প্রাকৃতিক নিয়ম-বিধানের নিশ্চিত অনিবার্যতার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে আল্লাহর বিস্ময়কর ও অস্বাভাবিক ঘটনা সংঘটনের কুদরতকেই অস্বীকার করে বসেছে। আবার কখনও বলছে, সমগ্র সৃষ্টিলোক স্বতঃই উদ্ভুত, বিকশিত। কোনো তার জীবন রয়েছে। ফলে তারা বিশ্বলোক ও জীবনের স্রষ্টা মা’বুদকেই অস্বীকার করেছে।
কখনও তারা বলছে, বিশ্বলোকের স্বাভাবিক অবস্থা জীবনের উপযোগী জীবনোদগমের অনুকূলে ছিল না। এখানে জীবনের উদগম সম্ভব হয়েছে একটি সংঘর্ষের ফলে। আর এই সংঘর্ষের শেষ পরিণতিতে মানুষের অস্তিত্ব ও আত্মপ্রকাশ সম্ভবপর হয়েছে।
কখনও বলেছে, এই বিশ্বলোক এবং মানুষ নিতান্তই উদ্দেশ্যহীনভাবে অস্তিত্ব লাভ করেছে।
এভাবে কত ধরনের কত প্রকারের গুমরাহীর মধ্যে আজকের মানুষ নিমজ্জিত, তা বলে শেস করা যায় না। আর সে গুমরাহীর প্রত্যক্ষ প্রভাব প্রতিফলিত হচ্ছে মানুষের চিন্তা-বিশ্বাস-মূল্যবোধের ওপর, মানুষের আচার আচরণের ওপর। কোনা তা মূলত উদ্ভুতই হয়েছে আল্লাহ সম্পর্কিত ধারণার বিভ্রান্তি ও বিপথগামিতা থেকে।
নিশ্চিত অনিবার্যতা সম্পর্কে আগেই বলে এসেছি। যে নিশ্চিত অনিবার্যতার নাম দেওয়া হয়েছে প্রাকৃতিক আইন, তা অন্যান্য নিশ্চিত অনিবার্যথা থেকে কিছুমাত্র ভিন্নতর জিনিস নয়। তা সবই এই বিশ্বলোকে অবস্থিত একক মহাসত্য ভিত্তিক নিশ্চিত অনিবাযতা থেকে বিভ্রান্ত ও গুমরাহ। সে একক মহাসত্য ভিত্তিক নিশ্চিত অনিবার্যতা হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছা।
আল্লাহর ইচ্ছা এক নিরংকুশ ও অপ্রতিরোধ্য ব্যাপার। তাকে কোনো বন্ধনেই বন্দী করা বা আটকানো যায় না। আল্লাহর ইচ্ছার পথে যে কোনা বাধারই কল্পনা করা হবে, তা অবশ্যই বাতিল মনে করতে হবে। এমন কে কোথায় আছে বা থাকতে পারে, যে নিজ ইচ্ছাকে আল্লাহর ওপর চাপিয়ে দিতে পারে! তিনি নিজে সবকিছুর স্রষ্টা, উদ্ভাবক, অমোঘ ইচ্ছার মালিক। সর্বপ্রকার দুর্বলতা অক্ষমতা থেকে তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র।
বিভ্রান্তির উদ্ভব হওয়ার কারণ হচ্ছে আল্লাহর সুন্নাতকে (নিয়ম বিধান) বিশ্বলোকের জন্যে অপরিবর্তনীয় ও স্থায়ী মনে করে নেওয়া হয়েছে। অথচ আল্লাহর ইচ্ছা যে স্থিতি এই বিশ্বলোকের জন্যে নির্ধারণ করেছে, তা সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সকল বাধা-প্রতিবন্ধকতামূলক। তা ছিল রহমতস্বরূপ এই বিশ্বলোকের জন্যে যেমন, তেমনি মানুষের জন্যেও। তা আল্লাহর ইচ্ছাকে বন্দী ও বাধাগ্রস্ত করতে পারে না, একথা সুস্পষ্ট, মহান আল্লাহকে কেউ-ই কোনো শক্তিই অক্ষম করতে পারে না, একথা সুস্পষ্ট, মহান আল্লাহকে কেউ-ই কোনো শক্তিই অক্ষম করতে পারে না, বিরত রাখতে পারে না বিশ্বলোকে নিজ ইচ্ছামতো হস্তক্ষেপ করা থেকে।
তা সম্ভবই বা কি করে হতে পারে!…তিনি নিজেই তো সবকিছুর স্রষ্টা, স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী তিনি। মহান আল্লাহ মুক্ত স্বাধীন ইচ্ছা ফয়সালা করেছে যে, বিশ্বলোকের ওপর একটা স্থায়ী নিয়ম চালু হয়ে থাকবে। আধুনিক জাহিলিয়াত তারই নামকরণ করেছে প্রাকৃতিক নিয়ম। মনে হচ্ছে তার প্রকৃত নাম সুন্নাতুল্লাহ বা ‘আল্লাহর নিয়ম’ রাখতে প্রস্তুত ছিল না।
কিন্তু সেই আল্লাহই যদি এই স্থায়ী নিয়মের বিরোধিতা করতে ইচ্ছা করে, তাহলে কার অধিকার থাকতে পারে একথা বলার যে, না, না, প্রাকৃতিক নিয়ম কখনোই বদলানো যেতে পারে না?
এখানেও মুজিযার প্রশ্ন। বাহ্যিকভাবে স্থায়ী নিয়মের ব্যতিক্রমকেই তো মুজিযা বলা হয়। এটাও তো সেই আল্লাহর সুন্নাত, যা এই বিশ্বলোকে একমাত্র ‘নিশ্চিত অনিবার্য’ হিসেবে চেপে বসেছে, স্থায়ী হয়ে আছে।
জাহিলিয়াতের ধ্বজাধারীরা মনে করেছে, তারা স্থায়ী প্রাকৃতিক নিয়ম সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করেছে। কিন্তু ‘সুন্নাতুল্লাহ’ সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ জাহিল অথচ ‘মুজিযা’ বিশ্বাস করলে প্রাকৃতিক নিয়ম সংক্রান্ত জ্ঞান লাভের পথে কোনোই বাধার সৃষ্টি হয় না। সে বিশ্বাস ও আকীদার অধীন জ্ঞান অর্জনও কিছুমাত্র বাধার সম্মুখীন হতে পারে না, বাধাগ্রস্ত হতে পারে না প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্রবর্তিতা ও প্রগতি লাভ। কোনো প্রাকৃতিক নিয়ম ও সুন্নাতুল্লাহ এই দুটির মধ্যে কোনোই বৈপরীত্য নেই।
ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান এক মহামূল্য ও বিরাট উত্তরাধিকার। তা মুসলমানের বিস্ময়কর প্রতিভা ও শক্তি সামর্থ্যের উজ্জ্বল সাক্ষী। সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভাবেই তো ইউরোপের আধুনিক পুনর্জাগরণের সব কয়টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। বিশেষ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। আধুনিক কালের সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান তারই ফলশ্রুতি, তারই ওপর স্থাপিত। মূলত সে বিজ্ঞানের জন্ম হয়েছিল আকীদার ছত্রছায়ায়। মুজিযার প্রতি ঈমানের আশ্রয়ে। তখন মুসলিমদের হৃদয়ে ও চিন্তায় বিশ্বলোকে আল্লাহর সুন্নাতের স্থায়িত্ব এবং মুজিযার প্রতি ঈমান থাকা সত্ত্বেও বৈজ্ঞানিক চিন্তা পর্যালোচনা গবেষণা এবং লব্ধ ফল গ্রহণে অনুসন্ধিৎসা পুরোপুরি সম্ভবপর হয়েছিল। কোনো এটা যেমন, ওটাও তেমনি সত্য। আর চিরন্তন সত্য কথা হচ্ছে, প্রকৃত সত্য যা, তার একাংশের সাথে অপরাংশের কোনো বৈপরীত্য থাকতে পারে না। তবে যে সব সংকীর্ণ, বিবেক বুদ্ধি দুটির মধ্যে সমন্বয় সাধনে অক্ষম, তাদের কথা আলাদা।
ইউরোপের সংকীর্ণ মন-মানসিকতার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এই ধারণা যে, কোনো সময় ‘মুজিযা’ সত্য হয়ে দেখা দিলে গোটা বিশ্বব্যবস্থাই বিপর্যস্ত হয়ে যাবে। কোনো গোটা বিশ্বলোক এক স্থায়ী নিয়মে বন্দী, পরস্পর গভীরভাবে জড়িত। এজন্যে তাদের মতে প্রত্যেক ঘটনার সুনির্দিষ্ট ফল হওয়া অনিবার্য।
কিন্তু এই নিয়মগুলোকে কে পরস্পর সংযুক্ত করে দিয়েছে? …এগুলোর সৃষ্টিকর্তা নিজেই তা করেছেন। তাই তিনি নিজেই চান, কোনো মুহুর্তে নির্দিষ্ট ফলের বিপরীত ফল প্রকাশিত হোক। সেই ফল বাস্তবায়িত হওয়া এক বিশেষ উদ্দেশ্যে, তাহলে সেই সৃষ্টিকর্তাকে তা করা থেকে কে বাধাগ্রস্ত করতে পারে? কে পারে তাকে ইচ্ছামতো কাজ করার ব্যাপারে বাধাগ্রস্ত করতে? কোনো সেই বিশেষ উদ্দেশ্য, ব্যতিক্রমধর্মী ফল বের করার পর তা তো সেই স্থায়ী নিয়মেই চলতে থাকবে। তখন আর তাতে কোনো ব্যতিক্রম লক্ষ করা যাবে না।
তা সত্ত্বেও প্রাকৃতিক নিয়মের নিশ্চিত অনিবার্যথা সংক্রান্ত সব জ্ঞানই আনুমানিক সবই সম্ভাব্যতার পর্যায়ভুক্ত।–[মার্কিন বিজ্ঞানী ম্যারিয়ট স্টানলী কুঞ্জদন-এর সাক্ষ্য দেখুন। তা এ অধ্যায়েই উদ্ধৃত হয়েছে।]
স্যার জেমস্ জীনস্ প্রকৃতি বিজ্ঞান ও অংকশাস্ত্রের একজন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী মনীষী। শুরু জীবনে তিনি নাস্তিক সংশয়বাদী ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি এই মত গ্রহণে বৈজ্ঞানিকভাবেই বাধ্য হলেন যে, বিজ্ঞানের সমস্যাবলীর সমাধানের জন্যে আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করা ছাড়া উপায়ান্তর নেই। তিনি বলেছেনঃ
প্রাচীন বিজ্ঞান সুদৃঢ়ভাবে মনে করত যে, প্রকৃতি একটি মাত্র পথেই চলতে পারে। সে পথ ছাড়া অন্য পথে হলো তার পক্ষে সম্ভব নয়। আর সে পথ তাই, যা বহু পূর্বেই স্থায়ীভাবে চালু করা হয়েছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হলোর জন্যে। কার্য ও কারণের ধারাবাহিকতা রক্ষায়। আর তা হচ্ছে ‘ক’-এর পর সব সময়ই ‘খ’ আসবে নিশ্চিত অনিবার্যথার কারণে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান আজও বলছে, ‘ক’ অবস্থার পর ‘খ’ অবস্থা যেমন আসা অসম্ভব, তেমনি সম্ভব গ, ঘ, ঙ ও চ অবস্থার সৃষ্টি হওয়া। এমনি আরও কোনো অবস্থা। ফলে তা নিশ্চিত অনিবার্যতাকেই ভুল প্রমাণ করে। তবে হ্যাঁ, একথা বলা যায় যে, ‘ক’ অবস্থার পর ‘খ’ অবস্থার সৃষ্টি হওয়া অধিক সম্ভব গ, ঘ, ঙ, চ ইত্যাদি অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার তুলনায়। আর গ অবস্থার সৃষ্টি হওয়া অধিক সম্ভভ ‘ঙ’ অবস্থার তুলনায়। সেই সাথে খ, গ ও ঙ এই তিনটি অবস্থারই সম্ভাব্যথা সুনির্দিষ্ট করা যায়। কিন্তু নিশ্চয় করে বলা কিছুতেই সম্ভব নয় যে, কোন অবস্থাটা কোন অবস্থার পর নিশ্চিতভাবে সৃষ্টি হবে। কেননা আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তিতেই হচ্ছে সম্ভাব্যতার ওপর। তবে কোনটা হওয়া জরুরী, এই কথাটি তকদীর বা নিয়তির ব্যাপার –সে নিয়তির মূল সত্য যা-ই হোক-না-কেন।
ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সূচনায় আধুনিক জাহিলিয়াতের সমস্ত জাহিলিয়াতের মধ্যে একটা বিস্ময়কর জাহিলিয়াত হচ্ছে এই ধারণা যে, এই বিশ্বলোক আপনা-আপনি অস্তিত্ব লাভ করেছে।
চার্লস ডারউইন জীবনের বিভিন্ন স্তরের পর্যবেক্ষণ অধ্যয়ন করে জীবনের সূচনাকালীন ও বর্তমানকালীন আকার আকৃতির মধ্যবর্তী স্তরসমূহকে পরস্পর সংযোজিত করেছে। কিন্তু সে গীর্জার ‘খোদা’কে মানতে প্রস্তুত ছিল না। কোনো গীর্জার সাথে তার দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ চলে আসছিল। আর গীর্জাও সেই ‘খোদা’র নামে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল। ডারউইন জিদের বশবর্তী হয়েই আল্লাহ-ই যে সৃষ্টিকর্তা এই সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল সত্যকে মেনে নিতে রাজি হয়নি। আর তার ফলেই বিশ্বলোকের স্বতঃই অস্তিত্বমান হওয়ার জাহিলী পৌরাণিক কিংবদন্তির উদ্ভব ঘটেছে। অথচ এই ধারণাটি আদপেই এমন নয়, যা নিয়ে কিছুমাত্র আলোচনা করা যেতে পারে।
বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানীগণ নিজেরাই এহেন দুর্বল যুক্তিহীন পৌরাণিক অবিশ্বাস্য ধারণার অগ্রহণযোগ্যতা সম্পর্ক চেতনা লাভ করেছিল এবং তারা স্বতঃস্ফুর্তভাবেই তা সম্পূর্ণ পরিহার করেছে।
জার্মানীর ফ্রাঙ্কফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক রাসেল চার্সস আর্নস্ট বলেছেনঃ ‘নিষ্প্রাণ প্রস্তর থেকে জীবনের উদগম হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন তত্ত্ব ও মতবাদ পেশ করা হয়েছে। কোনো কোনো গবেষক বলেছেন, প্রোটোচিন বা ফিয়োম কিংবা বড় বড় প্রোটিনী অংশর সংমিশ্রণ থেকে জীবন উদ্ভুত হয়েছে। লোকেরা মনে করে এসব মতবাদ ও তত্ত্ব বুঝি জীবন জগত ও প্রস্তুর জগতের মধ্যকার শূন্যতা ভরে দিয়েছে। কিন্তু যে সত্য মেনে নিতে আমরা বাধ্য হচ্ছি, তা হচ্ছে এই যে, জীবন্ত বস্তুকে অ-জীবন্ত বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন করার সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। তাছাড়া যারা আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করে, তাদের কাছেও এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, বিন্দু বা অণু ও অংশসমূহের হঠাৎ করে একত্রিভূত হয়ে যাওয়ার ফলে স্বতঃই জীবনের উদগম হতে পারে ও জীবন্ত কোষের রূপ ধারণ করতে পারে। প্রত্যেক ব্যক্তিই সর্বতোভাবে স্বাধীন। কেউ ইচ্ছা করলে জীবনের এই ব্যাখ্যা সহজেই গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই মতবাদ গ্রহণ করলে বিবেক-বুদ্ধি এতসব কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়ে যে, খোদ আল্লাহকে স্বীকার করে নিলে কোনো সমস্যাই দেখা দেয় না।
আমি মনে করি, জীবন্ত কোষসমূহের প্রতিটি কোষই এতই জটিল যে, তা অনুধাবন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। আর পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ্য কোটি কোষ তো সেই আল্লাহরই অতুলনীয় শক্তির সাক্ষ্য দান করে। সে সাক্ষ্য বিবেক-বুদ্ধি ও যুক্তিভিত্তিক। এই কারণে আমি সেই আল্লাহর প্রকৃত সুদৃঢ় ঈমান গ্রহণ করছ।
আর বিশ্বলোক একটি দুর্ঘটনা (by chance) স্বরূপ অস্তিত্ব রাভ করেছে বলে যে মতটি প্রকাশিত হয়েছে, তার অযৌক্তিকতা, অন্তঃসারশূন্যতা স্পষ্ট করে তোলার জন্যেও ওপরে উদ্ধৃত কথাটিই যথেষ্ট হতে পারে। কোনো তা একজন বিজ্ঞানীরই উক্তি।
তা সত্ত্বেও জ্ঞান-বিজ্ঞানকে এক পাশে রেখে দিয়ে শুধু খোলা চোখে এবং দূর সূক্ষ্ম দৃষ্টি সম্পন্ন হৃদয় দিয়ে চিন্তা করি, তা হলেও অতি সহজেই বুঝতে পারা যায় যে, গগনমন্ডলির আবর্তন এবং বিশ্বলোকের প্রতিটি জিনিসের অত্যন্ত সূক্ষ্ম জটিল ব্যবস্থা-শৃঙ্খলা হঠাৎ করে বা কোনো দুর্ঘটনার কারণে অস্তিত্ব পাওয়া কখনোই সম্ভবপর হতে পারে না। অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, এই সব কিছু একজন মহাবুদ্ধিমান ব্যবস্থাপক প্রকৌশলীরই সৃষ্টি হতে পারে, অন্য কিছু নয়।
আকস্মিকভাবে কিংবা দুর্ঘটনাবশত অস্তিত্ব লাভের মতটি মূলতই সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। তাছাড়া কোনো দুর্ঘটনাই যে এমন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কোনো জিনিসকে কখখনই অস্তিত্ব দিতে পারে না, যার কোটি কোটি বছর কাল ধরে অব্যাহত ধারায় ও নির্বিঘ্ন গতিতে চলছে, তবু তাতে কোথাও এক বিন্দু ত্রুটি বিচ্যুতি ধরা পড়ছে না। এত কোটি বছর ধরে চলছে যে তা মানুষের গণনায়ও আসতে পারে না।
বিশ্বলোক দুর্ঘটনার ফলেও আকস্মিকভাবে অস্তিত্ব লাভ করেছে এই মতটির বিভ্রান্তির দরুন আরও বহু প্রকারের বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, বিশ্বলোক উদ্দেশ্যবিহীনভাবে সৃষ্টি লাভ করে এবং এখানে বসবাসকারী মানুষের জীবনেরও কোনো উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নেই। এ-ও সেই অতিবড় বিভ্রান্তকর ফলশ্রুতি। সে বিভ্রান্তি হচ্ছে আল্লাহর হেদায়েত বিবর্জিত হওয়া, আল্লাহর বিধানের ভিত্তিতে চিন্তা ও বিশ্বাস গ্রহণ না করা। কোনো আল্লাহর স্বাধীন ইচ্ছাকারী উদ্ভাবনকারী সৃষ্টিকারী কুদরতের প্রতি যার ঈমান রয়েছে, তার মনে মগজে এই চিন্তা কখনোই স্থান পেতে পারে না।
বিশ্বলোকের নির্মাণ কৌশল স্বতঃই অত্যন্ত বিস্ময়কর যেমন, তেমনই অতিশয় সূক্ষ্ম ও জটিল। তা কখনোই নিরর্থক ও উদ্দেশ্যহীন হতে পারে না। তা স্বতঃই প্রমাণ করে যে, এই বিশ্বলোক উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টি এবং এর একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অবশ্যই থাকবে। অস্তিত্বেই অস্তিত্বের উদ্দেশ্যের আবশ্যকতা প্রমাণ করে।
কিন্তু মানুষ নিজস্বভাবে সেই উদ্দেশ্য অনুধাবন করতে –জানতে ও বুঝতে পারে না। কোনো মানুষ নিজে এই বিশাল বিশ্বলোকেরই একটা অংশ। অংশ কখনোই সমগ্রকে পুরামাত্রায় আয়ত্ত করতে পারে না। এটা বৈজ্ঞানিক সত্য। গোটা সৃষ্টিলোকের লক্ষ্য উপলব্ধি করতে মানুষের অক্ষম হওয়া কিছুমাত্র অযৌক্তিক নয়। কিন্তু এই অক্ষমতা সত্ত্বেও মানুষ যদি তার দৃষ্টিকে উন্মুক্ত রাখে, তাহলে সে নিঃসন্দেহে বুঝতে পারবে যে, বিশ্বলোকের একটা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে। অন্যথায় এই বিস্ময়কর সূক্ষ্ম সৃষ্টির কোনো অর্থ হয় না। তা এতই সূক্ষ্ম যে তা পুরোপুরি আয়ত্ত করা মানুষের পক্ষে কখনোই সম্ভব হয় না।
‘বিশ্বলোক ও মানুষ উদ্দেশ্যহীন’ এই ধারণার বিভ্রান্তি জীবন সম্পর্কিত ধারণা, জীবনের লক্ষ্য ও কাজ সম্পর্কেও বিরাট বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। সর্বত্র ব্যাপক বিপথগামিতা সূচিত হয়েছে।
কোনো যে জীবন আকস্মিকভাবে কোনো স্রষ্টা ব্যবস্থাপক যৌক্তিকতা ছাড়াই অস্তিত্ব লাভ করেছে, মানুষও আকস্মিক সৃষ্টি বলে মত প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে সে জীবনে কোনো ভারসাম্য রক্ষা পাওয়া, সামঞ্জস্য থাকা বা তার কোনো লক্ষ্য হওয়া আদৌ সম্ভবপর হতে পারে না।
ডারউইন বলেছেন, জীবন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্যহয়ে বিবর্তিত হয়েছে। তা যেন অন্ধের ষষ্ঠি। এই অবস্থায়ই মানুষের উদ্ভব, মানুষের বিবর্তন।
এই ধারণা থেকেই বিপথগামিতা মানুষের মনে মগজে ও তার জীবনের উদ্দেশ্যের ওপর অত্যন্ত খারাপ প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে।
বস্তুত এ একটি বিরাট ক্ষতি, সন্দেহ নেই।
এ অত্যন্ত পীড়াদায়ক দুর্ভাগ্য। তা কোনো সীমায় এসে থেমে যায় না।
এ হতাশা ও ব্যর্থতার যন্ত্রণা ছাড়া আর কি! এটা এক ধরনের স্বাদ-আস্বাদনের ছটফটানি।
তা এক নিরাশ হতাশ ব্যক্তির অন্তদ্বর্ন্দ্ব। কোনো সমর্থনই তার পেছনে নেই। অপার করুণাময় আল্লাহর অনুগ্রহ থেকেও সে বঞ্চিত হয়েছে। এই কারণে এ দ্বন্দ্ব পাশবিক ও পাগলপাড়া রূপে পরিগ্রহ করেছে।
এ ধারণা মানুষ ও তার কর্মের ওপর যে নিদর্শন রেখেছে, পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা সে বিষয়ে আলোচনা করব। সে মানুষ ব্যক্তি হোক, গোষ্ঠীবদ্ধ বা জাতি, সমষ্টি আমরা তাদের চিন্তা ও চেতনার ক্ষেত্রে সৃষ্ট-বিপর্যয়-কুকৃতি ও বিপথগামিতার বিবরণ পেশ করব।
কোনো মানুষ যখনই আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, তার ও তাঁর মধ্যে কোনো সম্পর্কও যখন অবশিষ্ট থাকেনি, তখন মানুষ ভূপৃষ্ঠে দিশেহারা হয়ে হাতড়িয়ে বেড়াতে লাগল। তাকে পথ নির্দেশ করার কেউ কোথাও ছিল না।
মানুষ দিশেহারা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঘুরে মরতে লাগল। সে তা নিজের জীবনের কোনো লক্ষ্যের কথাই জানতে পারল না। আল্লাহর কাছে তার যে বড় সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে তা জানাও তার পক্ষে সম্ভব হলো না। এই বিশ্বলোকে তাকে কি ভূমিকা পালন করতে হবে, তা জানাও তার পক্ষে অসম্ভব থেকে গেল। ফলে সে আল্লাহর বিরুদ্ধে নিজেকেই পৃথিবীর ‘খোদা’ বানিয়ে নিল। পাগলের ন্যায় চিৎকার করে বলতে লাগল, সে মানুষ, এই বিশ্বলোকের সেরা এবং এখানকার যাবতীয় কর্তৃত্ব তার মুঠির মধ্যে, সেই সবকিছুর নিরংকুশ ব্যবস্থাপক ও কর্তৃত্বাধিকারী।
তারই সৃষ্টিকর্তার বিপরীতে সে উক্তরূপ অর্থহীন প্রলাপ চালিয়ে যাচ্ছিল বটে, কিন্তু সে যখনই আল্লাহর প্রভাববলয় ও তার হেদায়েতের আওতার বাইরে বেরিয়ে এলো, অমনি নিশ্চিত অনিবার্যতার শয়তানেরা তাকে পাকড়াও করল, ঘিরে ফেলল কল্পিত খোদার দেবতারা। আর তারা মানুষের নাক মাটির সাথে ঘষে ঘষে তাকে এতটা অপমানিত ও লাঞ্ছিত করে ছাড়ল যে, মানুষ অসহায় অবস্থায় তাদেরই সম্মুখে সিজদায় পড়ে গেল।
মানুষ তার নিজের মধ্যে নিহিত মহাসত্যের পরিচয় পেল না, জানতে পারল না তার অস্তিত্বের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
ডারউইনের মতে মানুষ নিতান্তই জীব বা জন্তু মাত্র, যেমন দুনিয়ার অন্যান্য জীব-জন্তু। এই কারণে মানসুঝের জীবন ও তার উন্নততর মর্যাদা পর্যায়ে তার মতের কোনো গুরুত্ব বা মূল্যই স্বীকৃত হতে পারে না। কেননা তার মতে এই মহাবিশ্বলোকে মানুষের স্থান হীন নগণ্য কীট পতঙ্গের তুলনায়ও বেশি কিছু নয়। বেঁচে থাকাই মূলত বিবর্তনবাদী দর্শনে সাফল্যের এক মানদণ্ড। তাই বিশ্বলোকে বেঁচে থাকা বর্তমান সব প্রাণী-জীব ও জন্তু সর্বতোভাবে অভিন্ন মূল্য ও মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী! অগ্রসর হওয়ার ধারণা কেবলমাত্র মানবীয় কল্পনা। অথচ একথা সর্বজনস্বীকৃত যে, বর্তমানে মানুষই হচ্ছে সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে সেরা ও শীর্ষস্থানীয়। কিন্তু ক্রমবিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে একটি পিপিলিকা বা বিড়াল ইঁদুর ও এই স্থান ও মর্যাদা পেতে পারে।–[জুলিয়ান হাক্সলী লিখিত ‘আধুনিক জগতের মানুষ’ শীর্ষক গ্রন্থ, আরবী অনুবাদের পৃঃ ২।]
এ থেকেই মানুষ নিজকে জন্তু-জানোয়ার ধারণা ও তার অস্তিত্বের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে লক্ষ্যহারা হয়ে পড়েছে এবং কার্যতও তারা পিপিলিকা ও বিড়ালের পর্যায়ে এসে গেছে।
মানুষ এ-ও জানতে বুঝতে পারেনি যে ভূপৃষ্ঠের এই সীমিত অবকাশটুকু নিঃশেষ হওয়ার সাথে সাথেই জীবনেরও অবসান হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
জীবন এ পর্যন্ত এসেই যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে তা হবে ছবির এক অপূর্ণাঙ্গ দিক। জীবন ও তার এতসব দ্বন্দ্ব বৈপরীত্য ও অসীম জুলুম নিপীড়নের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ ব্যর্থ ও অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। যদি এখানেই শুরু ও এখানেই সবকিছু নিঃশেষ হয়ে যায়। কোনো এখানকার এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে প্রকৃত সত্য কি এবং বাতিল কি তা পূর্ণমাত্রায় প্রতিভাত হতে পারে না। তাহলে মানুষের জীবন এতই নিরর্থক হয়ে দাঁড়ায় যে, চিন্তাশীল মানুষ নিজের জন্যে সেরূপ জীবন কল্পনাও করতে পারে না। আর আল্লাহর পক্ষে মানুষের জন্যে এত সীমাবদ্ধ জীবনের ব্যবস্থা হওয়াটা সম্পূর্ণ অকল্পনীয়।
তাদের অন্তর যখন আল্লাহ থেকে সম্পূর্ণ নিঃসম্পর্ক হয়ে গেল, ছবি পূর্ণতা লাভের পূর্বেই কেটে ফেলা হলো, যখন তারা এই দুনিয়ার সীমাবদ্ধ বেষ্টনীর মধ্যেই নিজেদের দৃষ্টিকে সীমিত করে নিল, তখন বৈষয়িক জীবনটা তাদের সম্মুখে কুৎসিত হয়ে দেখা দিল। এর যে কোনো অর্থ থাকতে পারে, থাকতে পারে কোনো তাৎপর্য –তা তাদের বোধগম্য হলো না। তখন তারা দেখতে পেল যে, এই জীবনটা নিরর্থক ব্যর্থ, তাৎপর্যশূন্য, অস্থিরতা ও অশান্তিতে ভরপুর, তখন তারা সম্ভাব্য দ্রব্য সামগ্রীর স্বাদ আস্বাদনে পাগলের মতো ছুটে গেল। কোনো তাদের কাছে ছিল এক বিলীয়মান মহাসুযোগ। এই সুযোগ হারিয়ে ফেললে তা আর কোন দিনই ফিরে পাওয়া যাবে না। এই জীবনের পর আরও কোনো জীবন আছে তা তাদের ধারণায় আসছিল না।
ঠিক জন্তু জানোয়ারদের মতোই তারা যে দিকে ইচ্ছা দ্রুত দৌড়ে গেল। ছিল না কোনো উদ্দেশ্য, কোনো লক্ষ্য। যৌক্তিকতার কথা চিন্তা করারও সাধ্য ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা পাচ্ছিল না কোনো স্বস্তি, দেখছিল না সৌভাগ্যের মুখ, পাচ্ছিল না সত্যিকার আরাম বলতে কোনো কিছু। তখনকার এ দ্বন্দ্ব ও টানা-হেঁচড়া ঠিক পাগলের মতোই।
আল্লাহ থেকে সম্পর্কহীন হয়ে পড়ার যে মৌল গুমরাহী তাদের ব্যাপকভাবে পরিবেষ্টিত করে ফেলেছে, তা হলো মানব প্রকৃতি ও মানুষের মন সম্পর্কে আধুনিক জাহিলিয়াতের ধারণা এবং মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক। ব্যক্তিগতভাবে, দলবদ্ধভাবে –নারী ও পুরুষ এবং গোত্র ও জাতিগতভাবে।
মানুষ তার সর্বপ্রকারের গুমরাহী, সর্বপ্রকারের মুর্খতার প্রভাবে পড়েও ধারণা করতে লাগল যে, সে মানুষ। যদিও শেষ পর্যন্ত ডারউইন এসে সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক যুক্তি-প্রমাণ সহকারে বলতে লাগলেন, মানুষ মানুষ নয়, নিতান্তই জন্তু-জানোয়ার মাত্র।
অথচ এই পৃথিবীতে মানুষের বসতি শুরু হওয়ার সময় থেকেই আল্লাহ তা’আলা মানবতার জন্যে নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন। তাঁরা সকলে এবং সর্বশেষ নবী ও রাসূল (সা)-ও একইভাবে অত্যন্ত তাগিদ সহকারে জানিয়ে দিয়েছেন যে, মানুষ মানুষই, মানুষ ছাড়া আর কিছু নয়। আর তাঁরা মানুষের সম্মান ও মর্যাদা ঠিক ততদূর উন্নত করার জন্যে জিহাদ করেছেন, যতদূর উন্নীত হওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব। তাঁরা মানুষকে এই মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যেই দুনিয়ায় প্রেরিত হয়েছিলেন, তাঁরা তাদের জন্যে পথ উদ্ভাসিত করে তুলেছিলেন, যেন তারা আল্লাহর হেদায়েত অনুযায়ী জীবন পথে অগ্রসর হতে পারে। এ জন্যে তাঁরা আল্লাহর অনুমতিক্রমে অনেক মুজিযাও দেখিয়েছেন।
কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের নবী (?) এসে প্রচার করতে লাগল, না মানুষ মানুষ নয়, জন্তু মাত্র। মনে হচ্ছে, বিজ্ঞানের এ নবী শয়তানের নবীর কাজ করেছে এবং না বুঝে-শুনেই এ ধরনের ভিত্তিহীন ও হাস্যকর কথা বলছে।
মানুষ জীব বা জন্তু মাত্র। আর জন্তুর কাছ থেকে মানুষ কি-ই বা পেতে পারে, কি-ই বা পেতে চাইতে পারে?
পাশ্চাত্যের গোটা চিন্তার সমগ্র ক্ষেত্রেই ডারউইনীয় চিন্তাধারার বিষাক্ত প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, দর্শন, মনস্তত্ব, নীতিবিজ্ঞান ও শিল্প সাহিত্য –কোনোটিই তার বিষাক্ত প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। জীবনের কোনো একটা দিকও এমন নেই যাকে বিকৃত ও বিষাক্ত করে দেয়নি।
তাই মানুষ নিজেকে যতদিন জন্তু-জানোয়ারমনে করতে থাকবে, ততদিন উপরোক্ত নিশ্চিত অনিবার্যতার কুফল ফলতেই থাকবে।
আর এ বিকৃত –অজ্ঞ মুর্খ ধারণার নিশ্চিত অনিবার্যতার ফল শুধু এ-ই হবে যে, মানুষ ও তার চরিত্র, ভাবধারা, চিন্তা-চেতনা সংযোজনা সবকিছুরই তাৎপর্য পাশবিকতার দিকেই চলতে থাকবে। শেষ পর্যন্ত মানুষ সত্যিকারভাবে পশুতে পরিণত হবে, পাকাপোক্তা পশু হওয়াই হবে তাদের পরিণতি। কোনো তাদের চিন্তাবিদের কাছ থেকে মানুষের পাশবিক ব্যাখ্যাকেই পরম সত্য ব্যাখ্যারূপে পেয়েছে ও গ্রহণ করেছে।
ডারউইন যখন মানবদেহের আঙ্গিক সংস্থার অধ্যয়ন করে মনে করলেন, মানুষ ও পশুর দেহ-সংস্থার মধ্যে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে, তখন তিনি প্রতারিত হয়ে বিশ্বাস করতে লাগলেন যে, মানুষ আসলেও মূলের দিক দিয়ে পশু ছাড়া আর কিছুই নয়।
কিন্তু ডারউইন জেনে হোক না জেনে হোক কোনো বৈজ্ঞানিক সত্য বলতে পারেন নি। ডারউইন –পরবর্তী বিজ্ঞান নতুন ডারউইনবাদ (New Darwinism) বিবর্তনে বিশ্বাসী হয়েও ডারউইনবাদকে অবৈজ্ঞাকি ও অসত্য বলে ঘোষণা দিয়েছে। জুলিয়ান হাক্সলী’র মতো পূর্ণ মাত্রায় নাস্তিক বিজ্ঞানী বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী হয়েও মানুষের স্বাতন্ত্র্যের কথা বলেছেন, মানুষের জন্তু হওয়ার কথা নয়। ডারউইনীয় মতাদর্শের পর মানুষ তার জন্তু হওয়ার কথা অস্বীকার তো করতে পারেনি, তা সত্ত্বেও বুঝতে বাধ্য হয়েছেন যে, মানুষ জন্তু বটে তবে এক স্বতন্ত্র ধরনের জন্তু। অনেক দিক দিয়ে মানুষ যে স্বতন্ত্র সত্তা, তা-ও বোঝা যায়। অথচ মানুষের জীবতাত্ত্বিক গবেষণা তখন পর্যন্তও অসম্পূর্ণ।–[নতুন যুগের মানুষ, জুলিয়ান হাক্সলী, পৃ. ৩।]
যে জীবজন্তু সাদৃশ্যের কারণে ডারউইন মনে করেছিলেন যে, মানুষ জন্তু এবং তারই ভিত্তিতে মানুষের জন্তু ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, এক্ষণে সেই নৃতাত্ত্বিক তথ্যই স্বীয় সাংগঠনিকতার ও সংস্থার দিক দিয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রতিভাত হয়েছে।
হাক্সলী বলেছেন, সমস্ত জীবের মগজে দুই ধরনের স্নায়ু এসে মিলিত হয়েছে। একটা হচ্ছে ধারণকারী স্নায়ু মণ্ডলী আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে উন্মুক্তকারী স্নায়ুমণ্ডলী। একটি সময়ে একটি জন্তু একই ধরনের স্নায়ুমণ্ডলীকে নির্দেশ দিতে পারে। হয় প্রথমোক্ত স্নায়ুমণ্ডলীকে নির্দেশ দিবে, না হয় দ্বিতীয় ধরনের স্নায়ুমণ্ডলীকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, কুকুর হয় দৌড়াবে, না হয় মড়ক ছিন্ন ভিন্ন করে খাবে। একই মুহুর্তে দুটো কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। গোটা সৃষ্টিলোকে মানুষই হচ্ছে এমন সত্তা, যা একই সময় পরস্পর বিরোদী কাজ করতে সক্ষম। কোনো মানুষ পরস্পর বিরোধী ব্যাপারাদিকে একই সময় বিন্যস্ত ও সমন্বিত করতে পারে।–[নতুন যুগের মানুষ, জুলিয়ান হাক্সলী, পৃ. ৩।]
হাক্সলী মানুষের জীবতাত্ত্বিক বিশেষত্ব বিশ্লেষণ পর্যায়ে বলেছেনঃ “মানুষের সবচেয়ে বড় ও সর্বোত্তম বিশেষত্ব হচ্ছে, প্রতীকী চিন্তার ক্ষমতা রাখে। পারিভাষিকভাবে বললে বলা যায়, মানুষ সুস্পষ্ট কথা বলতে সক্ষম”।
মানুষের এই বিশেষত্বের দরুনই বহুবিদ সুফল ফলেছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ক্রমবর্ধমান রসম-রেওয়াজ ও ঐতিহ্যের সৃষ্টি। আর এই রসম-রেওয়াজ বা ঐতিহ্যের প্রবৃদ্ধির দরুন মানুষের আরাম-আয়েশের দ্রব্য সরঞ্জামে সৌন্দর্য ও বিশেষত্ব জেগে উঠেছে। আর তারই দরুন মানুষ এই বিশ্বলোকে বিশিষ্ট স্থান লাভ করতে পেরেছে। বর্তমান সময়ে এই জীবতাত্ত্বিক বিশেষত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব মানুষের একক বিশেষত্বসমূহের মধ্যে অন্যতম। মানুষ যে তাতে বিপুল অগ্রগতি লাভ করেছে তা-ই নয়, বরং বিবর্তিত হয়েছে, তার প্রভাব বিস্তৃত ও সম্প্রসারিত হয়েছে। আর জীবনে তার চলোমান পথের বৈচিত্রও অনেক বেড়ে গেছে।
মোটকথা, দুনিয়ার সমস্ত ধর্মমতই মানুষকে সেরা সৃষ্টি বলে মর্যাদা দিয়েছে। এমনিভাবে জীববিদ্যা মানুষকে অপরূপ এক কেন্দ্রবিন্দুতে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যার দরুন তার পক্ষে সেরা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভব বানিয়ে দিয়েছে।
বাকশক্ত, রসম-রেওয়াজ ও ঐতিহ্য এবং সংখ্যাগত বিপুলতা মানুষের এমন কিছু বিশেষত্বের সৃষ্টি করেছে যা অন্যান্য সৃষ্টিকুলের মধ্যে কোথাও পরিলক্ষিত হয় না।
তন্মধ্যে বড় বড় বিশেষত্বসমূহ খুবই পরিচিত ও সুস্পষ্ট। এ কারণে আমি তার উল্লেখের প্রয়োজন মনে করছি না। বরং বহু সংখ্যক অপরিচিত বিশেষত্ব সম্পর্কে কথা বলা উত্তম মনে করছি। কেননা মানব জাতি তার খালেস জীবতাত্ত্বিক গুণের দিক দিয়ে এক বিরল প্রজাতি বিশেষ। সেসব গুণের প্রতি যথোপযুক্ত গুরুত্ব কখনোই আরোপ করা হয়নি। তা প্রাণীবিদ্যার দৃষ্টিকোণ দিয়েই হোক কিংবা সমাজবিদ্যার দৃষ্টিকোণ দিয়ে।
….শেষ কথা, বিবর্তনের পথে অগ্রসরমান প্রাণীগুলোর মধ্যে মানুষের কোনো প্রতিরূপ নেই। নেই তার কোনো দৃষ্টান্ত।
নব্য ডারউইনবাদ মানুষের এই স্বতন্ত্র বিশেষত্ব কিংবা বিশেষত্বের এই স্বাতন্ত্র্য ও এককত্বের কথা অকপটে ঘোষনা করেছে আল্লাহর প্রতি ঈমানের দিক দিয়ে নয়। কেননা হাক্সলী তো কট্টর নাস্তিক, সে তার নাস্তিকতারকথা প্রকাশ্যভাবে ঘোষনাও করেছে। তা সত্ত্বেও মানুষ সম্পর্কে উক্ত রূপ কথা নিছক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাগত ও গবেষণাকেন্দ্রিক বা প্রয়োগশালায় প্রাপ্ত তত্ত্ব হিসেবেই বলা হয়েছে।
কিন্তু ডারউইন কোনোরূপ বৈজ্ঞানিক সনদ ছাড়াই খুব তাড়াহুড়া করেই মানুষের পশু হওয়ার কথাটি ঘোষণা করে দিয়েছেন। কেননা তাঁর সম্মুখে তো অসম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ছিল। আর তা-ই তাঁকে মানুষের এক জন্তুর বা পাশবিক ব্যাখ্যা জনিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাঁর এই তাড়াহুড়া করা উচিত হয়নি, বরং ধৈর্য ধারণা করা উচিত ছিল, যতক্ষণ না প্রকৃত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিস্কৃত হয়, যেমন করে নব্য ডারউইনবাদের সম্মুখে তা উদঘাটিত হয়েছে এবং তা মানুষকে মানুষ বলেই ঘোষণা দিয়েছে।
মানুষের এই পাশবিক ব্যাখ্যা যখন বিতাড়িত শয়তানের মতই মানুষের চিন্তার ও চেতনায় ও আকীদার ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করে ফেলল, তখন তা এমন এক সাংঘাতিক বিপর্যয় ঘটালো, যা ইতিহাসের কোনো জাহিলিয়াতই ঘটাতে সক্ষম হয়নি। তা মানুষের গোটা জীবনকে বিকৃতি করে দিয়েছে। তাকে জন্তু-জানোয়ারের স্তর থেকেও নিম্নে ফেলে দিয়েছে। মানুষ হয়েছে পশুর চাইতেও অধিক বিভ্রান্ত। ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা তৈরী হয়েছে।
মানুষের চরিত্র ও আচার-আচরণের ক্ষেত্রে যৌন ব্যাখ্যা পেশ করা হয়েছে। চিন্তা চেতনার দেহকেন্দ্রিক ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। মোটকথা, মানব জীবনের মানবীয় ব্যাখ্যা ছাড়া আর সব ধরনেরই ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করা হয়েছে।
ইতিহাসের বস্তুগত ব্যাখ্যার উপস্থাপক হচ্ছে কার্ল মার্কস। তা মানব জীবনের সম্পূর্ণটার ব্যাখ্যা দিয়েছে পশুত্বের দিক দিয়ে। এই ব্যাখ্যানুযায়ী মানবীয় ইতিহাসের মৌল বিষয়বস্তু হচ্ছে খাদ্যালোচনার ইতিহাস। অর্থাৎ বলা হয়েছে যে, মানব জীবনের ওপর সবচেয়ে প্রভাবশালী পরাক্রমশালী প্রয়োচন হয়েছে খাদ্য।
আর বস্তুগত উৎপাদন হচ্ছে তা-ই, যা মানুষের অস্তিত্ব ও তাদের চিন্তা চেতনার সাহায্যকারী অর্থাৎ মানুষের ভাষাগত মর্যাদা ও মূল্যমান এক অস্থায়ী বিলীয়মান জিনিস, তাতে অক্ষয় মৌল পদার্থ কিছু নেই। জীবন ও মানুষের জন্যে তার বস্তুগত দেহ কাঠামোই হচ্ছে একমাত্র স্থায়ী বিশেষজ্ঞ।
তাছাড়া এই ব্যাখ্যা ডারউইনীয় তত্ত্ব থেকেই বিবর্তনবাদী চিন্তাটা গ্রহণ করেছে। আর তা সমস্ত মূল্যবোধ মূল্যমান এবং এ পর্যন্ত চলে আসা সকল হিসাব-নিকাশই চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে।
ভাবগত মূল্যমান বস্তুগত মূল্যমানের তুলনায় ক্ষণস্থায়ী। আর তাই বিবর্তনশীল। কোনো একটি অবস্থাই স্থিতিশীল হয়ে নেই। তাতে কোনো চিরন্তন ও শাশ্বত সত্য বা ন্যায়পরতা বলতে কিছুই স্বীকৃতব্য নয়। বস্তুত মূল্যমান মূল্যবোধই চিরন্তন ও অব্যাহতভাবে পরিবর্তনশীল। সমস্ত ভালো ও শুভই হচ্ছে অর্থনৈতিক, বস্তুগত ও সুনির্দিষ্ট বিবর্তনের ফলশ্রুতি। ফলে আজ যা ভাল ও শুভ, কালই তা অত্যন্ত হীন, নিকৃষ্ট ও মন্দ। কোনো অর্থনৈতিক, বস্তুগত ও উৎপাদনগত স্তর পরিবর্তিত হলে সবকিছুই বদলে যায় স্বতঃস্ফুর্তভাবে। আর এটা শুধু ধরে নেওয়া বা কল্পিত কথা নয়। এটাই নাকি মহাসত্য ও পরম তত্ত্ব!
এ দৃষ্টিতে জায়গীরদারী সমস্ত সমাজের ধর্ম পালন একটা বিশেষত্ব বা শুভ কাজ রূপে বিবেচিত। কিন্তু শিল্পস্তরে সেই ধার্মিকতাই হবে পশ্চাদপদতা, স্থবিরতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা। নাস্তিকতাও একটা বিশেষ গুণ বৈশিষ্ট্য। আর নৈতিক পবিত্রতা, সতীত্ব ও যৌন রক্ষণশীলতার জাগীরদারী সামন্তবাদী সমাজে যথেষ্ট মূল্য স্বীকৃত হলেও বিবর্তনশীল শিল্পোন্নত সমাজে তা খুবই হাস্যকর ও কৌতুকবহ। কেননা এই সমাজে নারী অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বাধীন হয়ে আছে। পুরুষরা তাদের জন্যে অর্থব্যয় করার সুযোগ লাভে তাদেরকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করার এবং তাদের আচার আচরণে বিশ্বাসী পবিত্রতা রক্ষার দাবি জানানোর কোনো অবকাশই এখানে পেতে পারে না। পুরুষরা পবিত্রতা রক্ষার দাবি জানানোর কোনো অবকাশই এখানে পেতে পারে না। পুরুষরা নারীদের প্রতি উক্তরূপ দাবি রাখলেও তারা নেজরা কিন্তু সকল বাধা বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকে। তারা নিজেরা নিজেদের চিন্তা চেতনায় ও বাস্তব কাজে কর্মে পবিত্র থাকার কোনো বাধ্যবাধকতাই মেনে চলে না। কোনো নতুন খোদা –তা পাশ্চাত্যের মূলধন হোক, কি প্রাচ্যের রাষ্ট্রই হোক –কাউকেই এরূপ করতে বলে না। মানুষ পবিত্র চরিত্র থাকুক, কি নৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতায় নিমজ্জিত হোক সে জন্যে সেই নতুন খোদার দিক থেকে যেমন তাগিদ বা দাবি কিছু নেই, তেমনি সে জন্যে তো সাহায্য-সহযোগিতাও করছে না। বরং সে নব খোদা মানুষকে শেষোক্ত অবস্থার জন্যেই অধিক সহায়তা-সহযোগিতা দিয়ে থাকে।
এ ব্যাখ্যা মানুষের কেবল বস্তুগত ও পাশবিক জীবনকেই সম্মুখে রাখে। রূহকে ঠাট্টা ও বিদ্রূপবাণে করে অপমানিত। কোনো বর্তমান জাহিলিয়াত আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী নয়, মানুষের দেহ কাঠামোর মধ্যে যে আল্লাহ ‘রূহ’ অধিষ্ঠিত, তার প্রতিও তার ঈমান নেই।
মানুষের যৌনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার ভয়াবহ গুমরাহী ও বিপথগামিতার বড় প্রবর্তক হচ্ছে ফ্রয়ড। ফ্রয়ড মানুষকে শুধু পশু বা জন্তু জানিয়েই ক্ষান্ত থাকেন নি, এক বীভৎস আকার-আকৃতি সম্পন্ন পশু বানিয়ে ছেড়েছেন। তিনি বলেছেন মানুষের সমস্ত কাজের মৌল উৎস হচ্ছে যৌনতা।
পশুরা যখন খাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করে, তখন খায়। আবার পিপাসা লাগলে পান করে। দৌড়াবার ইচ্ছা হলে দৌড়াতে শুরু করে, আবার যখন যৌনতার তাড়না অনুভব করে তখন যৌনতৃপ্তি লাভের কাজে নিমগ্ন হয়। ….কিন্তু ফ্রয়ড চিত্রিত বিভৎস জঘন্য মানুষ! সে যখন মা’র স্তন চোষে, তখন তা যৌন সুড়সুড়ি লাভের জন্যে। ফ্রয়ড মানুষকে বিকৃত চেহারার জন্তুই বানিয়ে ছেড়েছেন। তাই মানব শিশু তার বৃদ্ধাঙ্গুলি চোষে সেই যৌনসুখ লাভের জন্যে। প্রস্রাব-পায়খানা করে যৌন সুখ পায় বলে, তার গ্রন্থিসমূহ নাড়ার এই যৌন সুখের আশায়। যৌন সুখের তাড়নায়ই সে তার মা’র প্রতি প্রেম বোধ করে। কিন্তু ফ্রয়ড চিত্রিত মানুষ-পশুর শিশু এখানে পৌঁছেও থাকে না। তার গোটা ভাবগত সত্তা, তার ধর্মপালন, নৈতিকতা ও ঐতিহ্যানুসরণ সবকিছুই যেন দাউ দাউ করে জ্বালানো যৌন-অগ্নির তাপে ও ধাক্কায়ই অনুষ্ঠিত হয়।