চিন্তার বিপর্যয়
আর মানুষের চিন্তা-চেতনার বা মনস্তত্ত্বের যে দেহাবয়ব কেন্দ্রিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তার উদ্ভাবক হচ্ছেন বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষাপন্থী বিজ্ঞানীরা। তাঁরা গোটা জীবনের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন দেহকেন্দ্রিক, যেন মানুষও প্রাণী বা জন্তু-জানোয়ার ছাড়া আর কিছুই নয়।
এই দৃষ্টিকোণে চিন্তা-চেতনা ও ভাবনা-মতবাদ সবই বৈদ্যুতিক, মাংসপেশী কেন্দ্রিক ও রাসায়নিক।
যৌন-ইন্দ্রিয়ই যৌন চেতনার উদগাতা।
মাতৃত্ব ইন্দ্রিয়ই মাতৃপ্রেমের ও মাতৃচেতনা সৃষ্টি করে।
কাজের-ইন্দ্রিয়ের কারণে বীরত্ব কিংবা ভীরুতার সৃষ্টি হয়।
আর চর্মেন্দ্রিয়ের কারণে স্নায়ুবিক ভারসাম্য কিংবা শীতল মেজাজ গড়ে ওঠে। স্যার উইলিয়াম জেমস-[উইলিয়াম জেমস মনস্তত্ত্বের পরীক্ষণ পন্থীদের অগ্রনেতা।] তাঁর ‘ঝোঁক প্রবণতা মতাদর্শ’ গ্রন্থে বলছেনঃ
ঝোঁক প্রবণতা ও বাৎসল্য আকর্ষণ পর্যায়ে লোকেদের সাধারণ মতাদর্শ হচ্ছে,কোনো জিনিসের এমন বুদ্ধিগত উপলব্ধি, যার দরুন সজ্ঞাগত অবস্থার উচ্ছ্বাস-উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু আমার নিজের মত হচ্ছে, কোনো উত্তেজকের উপলব্ধির তাৎক্ষণিক পরবর্তী সময়ে দেহে নানা পরিবর্তন সংঘটিত হয়। আর যে অনুভূতি আমাদের মধ্যে জেগে ওঠে, তা সেই পরিবর্তনসমূহের ফলশ্রুতি আর এরই নাম ঝোঁক প্রবণতা, আকর্ষণ।
কথায় সারনির্যাস হচ্ছে, ‘মন’ দেহেরই ফসল। তা মানবীয় স্বাতন্ত্র্য নির্ধারণ ও রূপায়ণে কোনো মৌলিক ও আণবিক গুরুত্বের অধিকারী নয়। ‘মন’ দেহেরই অনুসারী মাত্র। দেহ থেকৈই মনের উৎপত্তি।
মানবীয় জীবনের এই সব ব্যাখ্যার বহু সমালোচনা ইতিপূর্বে আমার লিখিত আরও কয়েকটি গ্রন্থে পেশ করেছি।–[কয়েকখানি বইয়ের নামঃ (আরবী টীকা*******************************)] এখানে অধিক কিছু আলোচনা-সমালোচনার তেমন প্রয়োজন নেই। মানব জীবনের যে দিকটি এসব ব্যাখ্যার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তা অত্যন্ত বীভৎস এবং বিভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ। অবশ্য পথ উজ্জ্বলকারী কিছু জরুরী বিষয়ের উল্লেখ এখানে করে দিচ্ছি।
বস্তুত মানব জীবনের ওপর উদ্ভব সব কটি ব্যাখ্যাই চরম পূঞ্জিভূত গুমরাহীর শিকার। এই সবগুলোই মানুষের কেবল মাত্র দেহ-সংস্থা কেন্দ্রিক ব্যাখ্যাই দিচ্ছে এবং তা মানব জীবনের সকল দিকের ওপর একটি নিম্নমানের ও নগণ্য দিকই অস্বাভাবিক প্রাধান্য দিয়েছে। মানবতার এই নগণ্য ও হীন দিকটি হচ্ছে মানুষের দেহ ও তার প্রয়োজনাবলী। পরে এই সমস্ত ব্যাখ্যার সম্পর্ক একই মৌলিক মতাদর্শের সাথে মিলিত সম্পৃক্ত। তাতে মানুষকে চূড়ান্তভাবে জন্তু বা পশু মনে করে নেওয়া হয়েছে।
মানবতা সম্পর্কে প্রতিটি আংশিক বা খণ্ড মতাদর্শই ভুল। কেননা সে ব্যাখ্যা অন্য সব দিককে অর্থহীন করে দিয়ে মানুষকে এমন এক বীভৎস চিত্রে উদ্ভাসিত করে যার প্রকৃত বাস্তবতার সাথে দূরতম সম্পর্কও নেই। আর এই আকৃতিটি আরও অধিক কুৎসিত ও বিভৎস হয়ে যায়, যখস সমগ্র মানবাত্মাকে সেই পক্ষপাতদৃষ্ট মতাদর্শকে কেন্দ্র করে আবর্তিত করে দেবতা এবং মানুষকে সেই একই দৃষ্টিতেই বিচার করা হয়।
আরও মজার ব্যাপার এই যে, মানবতার সে দিকটির প্রতি এসব ব্যাখ্যা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কি, আসলে তাই হচ্ছে মানবতার সেই বিরাট দিক, যার জন্যে মানুষ ‘মানুষ’ নামে অভিহিত হয়েছে এবং জন্তু-জানোয়ার থেকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে অর্থাৎ এসব ব্যাখ্যাই রূহকে উপেক্ষা করেছে।
ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা এক মুঠো অন্নের সন্ধানকেই মানবীয় চিন্তা-চেতনার উদ্বোধক ও পথ-প্রদর্শক বানিয়ে দিয়েছে।
মানুষের যাবতীয় কাজ-কর্মের যৌনতাভিত্তিক ব্যাখ্যা মানবতাকে যৌনতার গভীর পংকিল গহবরে নিক্ষেপ করেছে।
চিন্তা-চেতনার দেহকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা দেহকেই মানবীয় মনস্তত্ত্বের উৎস বানিয়ে দিয়েছে। এভাবে সব কয়টি ব্যাখ্যাই রূহকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। মানব জীবনে তাকে কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। গুরুত্ব দেয়নি পৃথিবীর বুকে তার জীবন্ত বাস্তবতাকে এ সব কয়টি ব্যাখ্যাই মানুষকে জন্তু বা পশু পর্যায়ে নিয়ে গেছে। মানুষকে নিতান্ত পশু ছাড়া আর কিছুই মনে করা হয়নি। এ-ও দেখেনি যে, মানুষ ও জন্তু-জানোয়ারের মধ্যে বহু দিক দিয়ে সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে বিরাট ও মৌলিক পার্থক্যও রয়েছে।
জন্তু-জানোয়ার খাওয়ার সন্ধানে ব্যস্ত থাকে।
জন্তু-জানোয়ার যৌন মিলনও সাধন করে।
আর সে সবের এ সব কার্যকলাপের মৌল উৎসও সেই দেহ-ই।
তাহলে মানুষের আকার-আকৃতি জন্তু-জানোয়ার থেকে ভিন্নতর হলো কেন?
এতদুভয়ের জীবন পথই বা কেন ভিন্ন ভিন্ন হলো।
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, এ সকল ব্যাখ্যায় মানুষের প্রকৃত ও পর্যবেক্ষিত অবস্থার বাস্তবতার ওপর কোনো দৃষ্টি রাখা হয়নি, সেই দিকটিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষাই করা হয়েছে।
অথবা বলা যায়, হীন ও জঘন্য শয়তানী প্ররোচনায় পড়ে ইচ্ছা করেই মানুষকে নিকৃষ্ট পশু চরিত্রের চিত্রিত করা হয়েছে, পশু সাব্যস্ত করে দুনিয়ার সামনে পেশ করা হয়েছে।–[(আরবী**********) গ্রন্থে তিন ইয়াহুদি অধ্যায় পাঠ করুন।]
প্রকৃত ব্যাপার যা-ই হোক, এ সব ত্রুটিপূর্ণ ও ভুল-ভ্রান্তিতে ভরা ব্যাখ্যায় ‘মানুষ’-এর সত্যিকার ব্যাখ্যা পেশ করা সম্ভব হয়নি, এটাই হলো আসল কথা। আর সত্যি কথা, মানুষ সম্পর্কে নির্ভুল ব্যাখ্যাদান এ সবের পক্ষে আদৌ সম্ভবও নয়।
মানুষ তার যে কোনো ধরনের তৎপরতায়ই খাদ্য, যৌনতা, বাসস্থান, কিংবা পোশাকের সন্ধানে অত্যধিক ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। যে পথেই এই তৎপরতা শুরু হয়ে থাকুক, শেষ পর্যন্ত তারা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন সংস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। সেই সাথে আকীদা বিশ্বাস ও চিন্তার মৌল নিয়ম বিধানও গড়ে তুলেছে এসব সংগঠন-সংস্থাকে যথাযথভাবে পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তা কেন এবং কিভাবে সম্ভব হলো? ….এ সব কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট মৌল নিয়ম-বিধান বাদ দিয়ে তাদের কর্মতৎপরতা চালাতে তারা অসমর্থ হলো কেন? …তা কি তারা করতে পারত?
মানুষ কেন শুধু পেট ভর খেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না? তাও খাচ্ছে তারা এক অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিতে –তা সঠিক হোক, কি বে-ঠিক। এ এক স্বতন্ত্র ব্যাপার। এভাবেই তাকে তার খাদ্যের অংশ পেতে হয়। আর তার এই ভাভা এবং তা গ্রহণ পদ্ধতির ওপর প্রশাসনিক ও সামাজিক ব্যবস্থা এবং লোকদের পারস্পরিক সম্পর্কের নিশ্চিত প্রতিফলন হয় কেন? কেন এই সব একটা বিশেষ ধরনে ও পদ্ধতিতে চলতে থাকে।
মানুষ তার যৌন ক্ষুধা কেবলমাত্র যৌন আবেগ-উচ্ছ্বাসের অধীন পরিতৃপ্ত ও চরিতার্থ করে না কেন? কেন তা করার জন্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সংস্থা গড়ে তোলার আবশ্যকতা বোধ করে? …তা যথার্থ নীতিভিত্তিক হোক, কি ভুল নীতিমূলক –সে তো স্বতন্ত্র ব্যাপার। এই সংস্থাই তার যাবতীয় প্রয়োজন পরিপূরণের পথ নির্ধারণ ও প্রশস্ত করে দেয়। তার ওপর নিশ্চিত অনিবার্যতার ফলাফলই বা প্রবর্তিত হয় কেন?
এভাবে মানুষের যাবতীয় তৎপরতাই সুম্পন্ন হয়ে থাকে। মানুষ ইচ্ছা করুক আর না-ই করুক, তার সে সব তৎপরতা সুম্পন্ন করার জন্যে কতিপয় সংগঠন ও সংস্থা গড়ে উঠবেই এবং সে জন্যে কিছু মূল্যমান, চিন্তা-বিবেচনা ও আকীদা-বিশ্বাস, তা ভুল হোক নির্ভুল –ভিত্তি হিসেবে অবশ্যই স্বীকার করে নেওয়া হবে। কিন্তু কেন? কি ভাবে?
এ সবই মূলত এক মহাসত্যের ফলশ্রুতি আর তা হলো, মানুষ দেহ ও রূপ এই দুটির সমন্বয়। এ দুটি এমনভাবে পরস্পর সম্পৃক্ত যে, কখনোই একটি অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। উক্ত ব্যাখ্যাসমূহে যেভাবে ধারণা দেওয়া হয়েছে, তা কোনো দিনই সম্ভব হবে না।
মূলত এ সব ব্যাখ্যই ভুল, ভিত্তিহীন ও তাৎপর্যশূন্য। এ সবই হচ্ছে জাহিলিয়াত। আর আল্লাহর হেদায়েত থেকে সম্পর্কছিন্ন করার ফলে সৃষ্ট জাহিলিয়াতেরই উৎপন্ন ফসল। আল্লাহ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে ও দূরে সরে থেকে জীবনের যে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, তারই ফলে এসব ভ্রান্ত ধারণা ও জাহিলিয়াতের উৎপত্তি সম্ভব হয়েছে।
মানব মনস্তত্ত্ব অনুধাবনে আধুনিক জাহিলিয়াত কেবল এই একটি ভুল বা বিপথগামিতারই সৃষ্টি করেনি। মানুষের দেহ ও রূহ-এর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও দ্বৈততা সৃষ্টির বিপথগামিতা বর্তমান সময় পর্যন্ত অব্যাহতভাবে চলছে। শুধু তাই নয়, তাতে ‘রূহ’কে কোণঠাসা করে দেহকেই অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোনো ‘রূহ’ তো সরাসরি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে। অথচ জাহিলিয়াত আল্লাহ থেকে পালিয়ে দূরে সরে যেতে প্রতিনিয়তই সচেষ্ট। আল্লাহর সুউজ্জ্বল আয়াতসমূহ থেকে পাশ কাটিয়ে চলারই এই জাহিলিয়াতের স্থায়ী নীতি। তার কাছে মানুষের দৈহিক চাহিদা-কামনা-বাসনা লালসারই গুরুত্ব সর্বাধিক। আর এই কারণে মান জীবনের গোটা ব্যাখ্যাই এই দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেকা হয়েছে। যদিও এরূপ পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত অবস্থায় মানুষের কোনো অস্তিত্বই এই দুনিয়ায় নেই।
কিন্তু এ বিপথগামিতা এখানে এসেও শেষ হয়নি, থেমে যায়নি।
জাহিলিয়াত যখনই আল্লাহর হেদায়েত –পথ ও পন্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে তখন তার সমস্ত ধারণাই ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে। সে ভারসাম্য তো কেবলমাত্র আল্লাহর পদ্ধতি গ্রহণ করলেই এবং আল্লাহর দেওয়া হেদায়েতের ভিত্তিতে মানব জীবনের ও বিশ্ব প্রকৃতির ব্যাখ্যা হলেই রক্ষা পেতে পারে।
এ ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার কারণে সব মানদণ্ডই অকেজো ও ত্রুটিপূর্ণ হয়ে গেছে, এক্ষণে মানব সত্তার ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের বাহ্যিক অবস্থার ওপরই বর্তমান জাহিলিয়াত দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। কোনো কোনো জাহিল চিন্তাবিদ মানুষের ব্যক্তিসত্তার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। আর কিছু সংখ্যক জাহিলিয়াতপন্থী দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে মানুষের সামাজিক সামষ্টিক রূপের ওপর। প্রথমটি মানুষের সামষ্টিক দিকটিকে অস্বীকার করেছে, আর দ্বিতীয়টি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেছে মানুষের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যকে। কেউ একটিকে অধিক মূল্য ও গুরুত্ব দিয়েছে, আবার কেউ অপরটিকে। ফলে বিপর্যয়, বিকৃতি ও বিপথগামিতা সর্বাত্মক সর্বগ্রাসী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যক্তির স্বাতন্ত্র যেখানে সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত, যেখানে সমাজ সমষ্টি একটি বিদ্রোহী সীমালংঘনকারী জলিম শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ব্যক্তিসত্তাকে তথায় কোণঠাসা করে চূর্ণ-বিচূর্ণ ও বিলীন করে দিতে সচেষ্ট।
পক্ষান্তরে সামাজিক সামষ্টিকতা যেখানে সত্য হয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তথায় ব্যক্তিরা জালিম, সমাজ বিরোধী নীতিতে অগ্রসর এবং শোষণ নির্যাতনে দক্ষ হস্ত। ব্যক্তি তার নিজ ব্যক্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে সমাজ সমষ্টিকে করে ছিন্নভিন্ন। সেজন্যে সমাজ-সমষ্টির ওপর মরণাঘাত হানতেও দ্বিধা করে না। সমষ্টির নামে ব্যক্তি জাতীয় ধন-সম্পদ লুটে পুটে নিয়ে যায়। সম্পূর্ণ হারাম কামাই রোজগারে নিজেকে ধনশালী বানায়।
আধুনিক জাহিলিয়াতের ধারণায় এই উভয় দিক কখনোই ভারসাম্যপূর্ণভাবে একত্রিত হতে পারে না। এই দুটির মধ্যে সমন্বয় সাধনের কোনো পন্থা জাহিলিয়াতের জানা নেই।
পরে এই দুটি বিকৃত বিপথগামী ধারণার উৎস থেকেই সংস্থাসমূহ গড়ে ওঠে রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে ও সমাজ সমষ্টিতে।
কিন্তু কেন?
জাহিলিয়াত বাস্তব ও প্রকৃত সত্যকে কেন দেখতে পায় না? …কেন বুঝতে পারে না –বুঝতে রাজি হয় না যে, মানুষ উক্ত উভয় দিকের সমন্বয়ই ভারসাম্যপূর্ণ জীবন লাভ করতে পারে? মানুষ স্বতন্ত্র এক ব্যক্তি, একথা সত্য; কিন্তু সেই সাথে এ-ও সত্য যে, ঠিক সেই একই সময়ের মানুষ সমাজেরও অঙ্গ বা অংশ। ব্যক্তি সচেষ্ট। কিন্তু সেই সাথে সে সমাজ-সমষ্টির সদস্য হিসেবে অন্যান্যদের সাথে মিলেমিশে একান্ত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে চায়। তাদের সংস্পর্শে থাকার জন্যে হয় সদা আগ্রহী। এই মানুষগুলো পরস্পরের সাথে গভীর প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকে।
বস্তুত ব্যক্তি ও সমষ্টি বা সমাজ। -এ দুয়ের মধ্যে বিরাট দ্বন্দ্ব নিহিত। কিন্তু তাতে একথা প্রমাণিত হয় না যে, সে দুটির অস্তিত্ব একসাথে মনের অভ্যন্তরে ও বাইরের বাস্তবতায় বর্তমান নেই। সেই সাথে এ দুটির মধ্যকার দ্বন্দ্ব অনেকটা প্রশমিত করে ও তার তেজ কমিয়ে এ দু’টির মধ্যে সামঞ্জস্য ও সমন্বয় সৃষ্টি করাও যে সম্ভব, তা কোনোক্রমেই অস্বীকার করা যায় না। কোনো আল্লাহ প্রদত্ত পন্থায় ব্যক্তি ও সমষ্টির জীবন সুন্দরভাবে ভারসাম্যপূর্ণ করা খুবই সম্ভব, তাতে সন্দেহ নেই।
কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, জাহিলিয়াত কখনোই সঠিক সুস্থ ও নির্ভুল পথ অবলম্বন করতে প্রস্তুত হয় না। কোনো সে পথ সেতো আল্লাহর দেখানো পথ।
উক্ত জাহিলিয়াতের কারণেই মানুষের ধারণা ও জীবনাচরণ অসংখ্য প্রকারের বিপর্যয়, বিকৃতি ও বিপথগামিতার সৃষ্টি হয়েছে।
আমরা অবশ্যই এই অধ্যায়ে কেবল ধারণা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সৃষ্ট বিপর্যয়ের কথা আলোচনা করতেই আত্মনিয়োগ করেছি। আমরা সর্ব ক্ষেত্রেই আঁতিপাতি করে খুঁজে দেখব।
এক কতায় মানব জীবনে সৃষ্ট সকল বিপর্যয়ের মৌল উৎসই হলো আল্লাহ থেকে দূরত্ব, আল্লাহর ইবাদত অস্বীকার করা। আর তা থেকেই উৎসারিত হয়েছে মানবীয় মনস্তত্ত্বের ধারণা জাহিলিয়াত। সেই কারণেই মানুষের পরস্পরে ব্যক্তি সমষ্টি দুই বিপরীত লিংগ, গোষ্ঠী ও জাতি হিসেবে পরস্পরের মধ্যে অবস্থিত সম্পর্কের ধারণা সম্পর্কে ভুল ধারণার সৃষ্টি।
ব্যক্তির নিজেরই দুটি দিক; সে নিজে এবং তার মন। বলা হয়েছে যে, এই দুটির পরস্পরের মধ্যে এত অসংখ্য দ্বন্দ্ব যা গুণে শেষ করা যায় না। তা সম্ভভও নয়। জাহিলিয়াত এই দ্বন্দ্বকে আরও বৃদ্ধি করেছে। ফলে এই দ্বন্দ্ব কোনো সময় এত সাংঘাতিক হয়ে পড়ে যে, পৃথিবীতে তার বদৌলতেই অগ্রতি, উন্নতি ও ইতিবাচক কার্যখ্রমের একমাত্র উন্নত উপায় বলে ধারণা করা হয়। আর মনস্তাত্ত্বিক স্বস্তি, শান্তি নির্লিপ্ততা, নেতিবাচক, রোগাক্রান্ত। মানুষের উচিত তারও ঊর্ধ্বে ওঠে যাওয়া। তাদের উপরোদ্ধৃত ব্যাখ্যাসমূহে বলা হয়েছে যে, মনের অস্থিরতা অতীব পবিত্র। তার দরুনই জীবন সম্মুখের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। আমরা দেখছি, তাদের মনের এই বত্রি অশান্তি ও অস্থিরতা তাদেরকে সম্মুখের দিকে ঠেলে নিয়েছে। কিন্তু তা শান্তি-স্বস্তি-সমৃদ্ধির দিকে নয়। ঠেলে নিয়েছে চরম অস্থিরতা, উদ্বেগ, কাতরতা, পাগলামী, শ্বাসরুদ্ধতা এবং স্নায়ুবিক-মনস্তাত্ত্বিক বিকৃতি ও বিপর্যয়ের দিকে। এমন কি শেষ পর্যন্ত তাদের মনস্তাত্ত্বিক ও বিবেক-বুদ্ধিগত রোগের হাসপাতালসমূহে এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের ভীড়ে তিল ধারণেরও স্থান বাকী নেই। পাগলামীকে তারা নাগরিক জীবনের রোগ মনে করেছে এবং স্নায়বিক বিকলাঙ্গতাকে তারা ধরে নিয়েছে সভ্যতা-সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ।
হ্যাঁ, এটাই জাহিলিয়াত। জীবস্ত সুস্থ মানুষের তৎপরতা ও মনের অশান্তি-অস্থিরতা ভিন্ন ভিন্ন জিনিস, কখনোই এক জিনিস নয়, তা এই জাহিলিয়াতের পক্ষে বোধগম্যও হচ্ছে না।
প্রাথমিক কালের মুসলমানরা ছিলেন সর্বাধিক কর্মতৎপর ও কর্মব্যস্ত জনগোষ্ঠী। ইতিহাসে এ ধরনের একনিষ্ঠ কর্মব্যস্ত জনগোষ্ঠী আর কখনোই দেখা যায়নি। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত তাঁরা অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিলেন ইসলামের বিজয় পতাকা হাতে নিয়ে। তাঁদের জ্ঞান বিজ্ঞান ভিত্তিক আন্দোলন ছিল সর্বব্যাপক ও বিজয়ী। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাসমূহ তাঁদের হস্তেই গড়ে উঠেছিল। আল্লাহর কিতাবের ব্যাখ্যায় চিন্তাভিত্তিক মতাদর্শ এবং সমাজ-সমষ্টির ক্ষেত্রে তার বাস্তবায়ন ছিল তাদের দায়িত্ববোধের উৎস। বিভিন্ন বিষয়গত ফিকহী মতের শিক্ষালয়সমূহ তাঁদের হাতেই গঠিত, কর্মতৎপর ও গতিশীল হয়ে উঠেছিল। এই সব কিছুই এত অল্প সময়ের মধ্যে সম্পাদিত হয়েছিল যে, তার চাইতেও কম সময় এরূপ ঘটনা সংঘটিত হওয়া ছিল সম্পূর্ণ অকল্পনীয়। মানুষ ছিল জীবন্ত, গতিশীল, অনলস-অবিশ্রান্ত পরিশ্রমী। কিন্তু অত্যন্ত শান্ত-শ্লিষ্ট সুস্থ ও স্বস্তিপূর্ণ মন-মানসিকতা সহকারেই তারা এই বিরাট ও তুলনাহীন কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। কোনো তাঁরা তাঁদের এই সব জ্ঞানগত কাজ ও বাস্তব কর্মতৎপরতা দ্বারা মানুষকে আল্লাহর দিকে ডেকে নিচ্ছিলেন। ফলে আল্লাহর যিকির ও স্মরণেই তাঁদের হৃদয় ছিল সদা শান্ত-প্রশান্ত, নিস্তব্ধ ও নিস্তরঙ্গ ও নিরুদ্বিগ্ন।
ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যকার সম্পর্কটিও এক চিরন্তন দ্বন্দ্বরূপে চিত্রিত করা হয়েছে বর্তমা জাহিলিয়াতে। এ দুয়ের মধ্যে তা এত কঠিন সংঘর্ষের কারণ ঘটিয়েছে ও সংঘর্ষের সৃষ্টি করেছে যে, তা গণতা করাও যায় না, সংযত করাও সম্ভব নয়। এরই ভিত্তিতে বর্তমান জাহিলিয়াত জীবন ও মানুষের ব্যাখ্যা পেশ করেছে। আর তা হচ্ছে, অত্যন্ত কঠিন নির্মম ও ন্যাংটা জাহিলিয়াতের দেওয়া ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যাই ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে কঠিন সংঘর্ষের সৃষ্টি করেছে নিশ্চিত অনিবার্যতা সহকারে। তা থেকে নিষ্কৃতির কোনো পথই খোলা নেই। এতদুভয়ের মধ্যে মধুর মিষ্টি প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন-কোনো দিনই সম্ভব হতে পারে না।
কিন্তু এই দ্বন্দ্ব সত্য ও মিথ্যার –‘হক’ ও বাতিলের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নয়। অথচ আল্লাহ যে মানুষকে সর্বাধিক সম্মানিত ও মর্যাদাবান বানিয়েছেন, তাদের মধ্যে এরূপ দ্বন্দ্ব আদৌ কাম্য হতে পারে না। কাম্য হতে পারে শুধু সত্য ও মিথ্যা নিয়ে দ্বন্দ্ব মাত্র।
কিন্তু আধুনিক জাহিলিয়াত ‘হক’ ও ‘বাতিল’ চিনে না। হক-সত্য, ন্যায়পরায়ণতা ও চিরন্তন সুবিচারকে তা অসহ্য অশ্রাব্য ভাষায় বিদ্রূপ করে। তার কাছে কাম্য হচ্ছে এক শ্রেণীর স্বার্থ ও অন্য শ্রেণীর স্বার্থের মধ্যকার চিরন্তন দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ। কিন্তু তা নৈতিকতার মানদন্ডে কখনোই যাচাই বা ওজন করা চলে না। এবং একটিকে ‘হক’ ও অপরটিকে ‘বাতিল’ মনে করা যায় না। কোনো একটি শ্রেণী ‘হক’-কে অতিক্রম করলে কিংবা মানুষের জন্যে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা কেউ লংঘন করলেও বলা যাবে না যে, এই শ্রেণী বা গোষ্ঠী কিংবা ব্যক্তি অন্যায় বাড়াবাড়ি করেছে ও ন্যায়পরায়ণতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। কেননা বর্তমান জাহিলিয়াতের দেওয়া ধারণানুযায়ী প্রতিটি শ্রেণীই স্বীয় স্বার্থের দিক দিয়ে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তবে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে অনিবার্যভাবে তা অতীব কল্যাণকর এবং তা অবশ্যই ও নিশ্চিত অনিবার্যতার ভিত্তিতেই হতে হবে, তাহলে-ই না তাদের স্বার্থ বিনষ্টকারী বা অপহরণকারী সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। এ দ্বন্দ্ব মানবতার কল্যাণে নয়, নয় সত্যের জন্যে চিরন্তনের সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতার জন্যে। বরং তা যে শ্রেণীটি নবতর অর্থনৈতিক বিপ্লব সৃষ্টি করেছে, তা তারই জন্যে।
হ্যাঁ, আজকের জাহিলিয়াতে কার্যত এরূপই ঘটেছে। এখানে প্রত্যেকের কল্যাণবোধ বা স্বার্থচিন্তা ভিন্ন ভিন্ন এবং তা পরস্পর সংঘর্ষশীল। এতে বিজয়ী হওয়া অবধারিত তার পক্ষে, যার হাতে কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বের ক্ষমতা নিবদ্ধ। আর মার্কসীয় জাহিলিয়াতের ধারণায় প্রোলেটারিয়েট শ্রেণীই শেষমেশ বিজয়ী হবে এবং তার ফলে সমস্ত শ্রেণীই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আর তখনই হবে সমস্ত বিশ্বলোকের পরিসমাপ্তি –চূড়ান্ত ধ্বংস ও বিলয়।
নারী ও পুরুষ –এই দুই লিঙ্গের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বর্তমান জাহিলিয়াতের মধ্যে যে বিপর্যয় ও বিকৃত ঘটেছে, তা হচ্ছে বীভৎসতম ও কলুষতম বিপর্যয়। বর্তমান জাহিলিয়াতের দৃষ্টিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপন নিছকই একটা জৈবিক ও দৈহিক কার্যক্রম মাত্র। তার সাথে নৈতিকতার আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। যৌনক্রিয়া পরিহার সম্পর্কের আওতার মধ্যে সীমিত থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। যৌনক্রিয়াই হচ্ছে মানব সত্তার পূর্ণাঙ্গ ও যথার্থ বাস্তবায়নের প্রধান উপায়। যৌন আবেগকই হচ্ছে সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রকাশ ও উৎকর্ষ সাধনের বড় মাধ্যম। উন্মুক্ত ও বাধা নিষেধ বিমুক্ত যৌন চর্চাই হচ্ছে প্রকৃত স্বাধীনতা।
যৌনতা নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাতে ভারসাম্য রক্ষিত হওয়া বা বিঘ্নিত হওয়ার কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না। কেউ যদি তাতে ভারসাম্য রক্ষা করে চলে, তাহলে চলতে পারে আর যদি কেউ তা বিঘ্নিত করে, তা করাও তার ইচ্ছাধীন।
জাহিলিয়াতের এ ধরনের কথাবার্তা বা মতাদর্শের কোনো সীমা সংখ্যা নেই। আর এ সবই যৌনতার ব্যাপারে মানুষের স্বাভাবিক ও ভারসাম্যপূর্ণ আচার সব কয়টি জাহিলিয়াতই সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছে। আর তার পরিণতিতে যৌনতার ক্ষেত্রে চরম উচ্ছৃঙ্খলতা ও অরাজকতার সৃষ্টি করেছে ব্যাপকভাবে। মানবতার ইতিহাসে তার কোনো দৃষ্টান্তই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আল্লাহর পদ্ধতি থেকে বিভ্রান্ত জাহিলিয়াতে নিমজ্জিত জাতি-জনগোষ্ঠীসমূহ পরস্পরের ওপর ঠিক হিংস্র জন্তুর মত ঝাপিয়ে পড়ার ও জয় বা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করার সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এদের পরস্পর দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ ছাড়া আর কোনো সম্পর্কই যেন কল্পনা করা যায় না। যখনই তারা পরস্পরের মুখোমুখী হয়, হয় জাতীয়তার সীমারেখার মধ্যে, ঠিক যেমন জন্তু চারণভূমিতে একত্রিত হয় কিংবা মিলিত হয় যৌনতার সীমার মধ্যে অথবা পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে। কিন্তু আল্লাহ সৃষ্ট মানবতাবাদের ভিত্তিতে মানবীয় রীতিনীতি অনুযায়ী তারা কখনোই একত্রিত হতে পারে না।
এ-ই হচ্ছে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাহিলী ধারণার বাস্তব রূপ। এবং এ পর্যায়ের মাত্র কয়েকটি দিকেরই উল্লেখ করা হলো এখানে।
এক্ষণে মানব মনস্তত্ত্ব ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক তত্ত্বের চরম মূর্খতা ও জাহিলিয়াতের আলোচনা শেষে আলেক্সেস ক্যারেল লিখিত Man The un-known গ্রন্থ থেকে কিছু উদ্ধৃত তুলে ধরা খুবই উত্তম বরে মনে করছি।
আলেক্সিস ক্যারেল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ –ওহীর মাধ্যমে পাওয়া ধর্মের আলোকে নয় –লিখেছেনঃ
সত্য কথা হলো মানুষ নিজেকে বুঝবার জন্যে প্রানান্তকরভাবে চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং প্রত্যেক যুগেই বিশিষ্ট মনীষী, দার্শনিক, কবি-সাহিত্যিক ও আধ্যাত্মিক নেতৃবৃন্দ অসংখ্য চিন্তা-ভাবনা পেশ করেছে। কিন্তু এত সব সত্ত্বেও আমরা আমাদের সত্তা ও অস্তিত্ত্বের মাত্র কয়টি দিকই বুঝতে পেরেছি। আমরা আসলে মানুষকে পূর্ণাঙ্গ ও যথার্থভাবে জানি না। শুধু এতটুকু জানি যে, মানুষ বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণ। আর সে উপাদানসমূহও আমাদের মনের উৎপাদন মাত্র। অর্থাৎ পত্যেক ব্যক্তিই কতগুলো ছায়ার পশ্চাতে দৌড়াচ্ছে, আর এ সব ছায়ার পিছনে এমন সত্য হয়ত আছে, যা চির অজ্ঞাত।
আরও সত্য কথা এই যে, আমাদের অজ্ঞতা পুঞ্জীভূত। কোনো মানব জাতি অধ্যয়নরত ব্যক্তিতের সম্মুখে যেসব প্রশ্ন তীব্র হয়ে দেখা দেয় তার বেশির ভাগেরই কোনো জবাব দেওয়া হয়নি। আর আমাদের আভ্যন্তরীণ জগতের অনেকগুলো দিকই তখন পর্যন্ত জানা যায়নি।
“সে যা-ই হোক, একথা স্পষ্ট যে, মনীষী পণ্ডিৎ ব্যক্তিরা মানব অধ্যয়ন পর্যায়ে যত গবেষণার ফলশ্রুতিই পেশ করেছে, তা একোবরেই অযথেষ্ট এবং অধিকাংশই আমাদের নিজেদের সম্পর্কে জ্ঞান-লাভের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে পড়ে রয়েছে”।
পরে বিজ্ঞানী মানব-তত্ত্ব পর্যায়ে পুঞ্জীভূত অজ্ঞতার যে প্রভাব পড়েছে মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সভ্যতার ওপর তার ব্যাখ্যাদান পর্যায়ে লিখেছেনঃ
আধুনিক সভ্যতা-সংস্কৃতি নিজেকে এক কঠিন অবস্থার মধ্যে আটক পাচ্ছে। কেননা তা আমাদরে জন্যে অনুকূল নয় মাত্রই। তা আমাদের প্রকৃতি নিহিত নিগূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞানও না থাকার দরুন উদ্ভূত হয়েছে। সেগুলো বৈজ্ঞানিক আবিস্কার উদ্ভাবনজনিত চিন্তা-বিশ্বাসের ফলশ্রুতি মাত্র। মানুষের লালসা-কামনা, ভিত্তিহীন ধারণা, মতাদর্শ ও আগ্রহের আতিশয্যে সেগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বর্তমান সভ্যতা আমাদেরই চেষ্টা সাধনার ফলে গড়ে উঠলেও তা এই মানুষের পক্ষেই মারাত্মকবাবে অকল্যাণকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের আকৃতি ও দৈহিক সংগঠনের সাথে তার কোনো মিল নেই।
“একালের মতাদর্শ পূজারীরা মানবতার কল্যাণের জন্যে নানা সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেছে। কিন্তু এই সব সভ্যতায়ই মানুষের একটা কুৎসিত ও অসম্পূর্ণ ছবিকে সম্মুখে রাখছে। অথচ প্রতিটি ব্যাপার পরিমাপের মানদণ্ড হওয়া উচিত ছিল স্বয়ং মানুষ। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তার সম্পূর্ণ বিপরীত। মানুষ তো তার নিজের গড়া এই জগতে নিজেই অপরিচিত সাব্যস্ত হচ্ছে। এখন মানুষ নিজের এই জগতের সংগঠন নিজে থেকে করতে পারছে না। কোনো মানব প্রকৃতি সম্পর্কে কোনো বাস্তব জ্ঞান-ই তার জানা নেই। এই কারণেই, জীব-বিজ্ঞান-এর বিপরীতে ‘প্রস্তর-বিজ্ঞানের’ উন্নতি একটি ভয়াবহ বিপদ হয়ে মানুষের সম্মুখে সমুপস্থিত। আসলে আমরা বড়ই হতভাগ্য। কেননা আমরা বিবেক-বুদ্ধি ও নৈতিকতা-উভয় কি দিয়েই ক্ষয়িষ্ণু ও বিলয়মুখী। যেসব জাতি বর্তশানে বস্তুনিষ্ঠ সভ্যতার শীর্ষস্থানে পৌঁছে গেছে, একটু সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখলে তাদেরকে দুর্বলতার শিকার দেখা যাবে। বরং দুনিয়ার সমগ্র জাতির মধ্যে এই চরমোন্নত জাতিগুলোই পুনরায় বর্বরতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা অবলম্বন করে বসবে”।
মানব সংক্রান্ত ধারণায় আধুনিক জাহিলিয়াতের সৃষ্ট সর্বাত্মক বিপর্যয়ের সারনির্যাসই উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে বিধৃত।
আধুনিক জাহিলিয়াত বিকৃতি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করেনি এমন একটি ক্ষেত্রও অবশিষ্ট নেই। আর এই সব কিছুই সেই মহা বিপথগামিতারই ফলশ্রুতি, যা সূচিত হয়েছে আল্লাহর দাসত্ব অস্বীকৃতি থেকে।
আধুনিক জাহিলিয়াত
আধুনিক জাহিলিয়াত অতীত জাহিলিয়াতসমূহের চাইতেও অনেক বেশী করে মনে করে নিয়েছে যে, দ্বীন বা ধর্ম নিতান্তই একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। বাস্তব জীবনের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো ধর্ম হচ্ছে একান্তভাবে ব্যক্তি ও তার আল্লাহর মধ্যকার বিষয়। এটাই হচ্ছে ধারণা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে জাহিলিয়াতের মৌল বিপর্যয়। কিন্তু ইউরোপের বাস্তবতা এবং ইউরোপীয় অধিকৃত সমস্ত জগতের অবস্থা সাক্ষ্য দিয়েছে যে, আকীদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সৃষ্ট বিপর্যয় এবং আল্লাহর দাসত্ব অস্বীকৃতির বিপথগামিতা ব্যক্তির যতই অভ্যন্তরে মন-মানসিকতার ক্ষেত্রেই বিপর্যয় সৃষ্টি করে না –বীভৎস করে তুলে না, জাহিলিয়াতের এই ধারণা ভুল –বরং তার ছায়াপাত ঘটে মানব জীবনের সমগ্র ক্ষেত্রে। তাই দেখা যাচ্ছে, জীবনের কোনো একটি দিকও আজ বিকৃত ও বিপর্যয়ের প্রচণ্ড আঘাত থেকে এক বিন্দু রক্ষা পায়নি।
এ সত্য ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে, আকীদা-বিশ্বাসের বিকৃতি সমগ্র জীবনকেই বিপর্যস্ত করে। কোনো বিশ্বাস ও আকীদা কেবলমাত্র ব্যক্তি ও তার আল্লাহর মধ্যকার এমন কোনো ব্যাপার নয়, যার সাথে বাস্তব জীবনের কোনোই সম্পর্ক নেই। আসলেই তা-ই হচ্ছে জীবনের পরিচালনক –চালিকা শক্তি। তাই আকীদা যখন শুরু থেকেই বিপর্যয়ের পথে মানুষকে চালাবে, তখন মানুষের সব কিছুই সেই বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যাবে অনিবার্যভাবে। আর গোটা জীবনই অন্ধকারাচ্ছন্ন গহবরের অতল গর্ভে নিপতিত হবে।
মানুষের আকীদার বিপথগামিতা কিভাবে সমগ্র জীবনকে বিপর্যস্ত করে তা আমরা ইতিপূর্বে বিস্তারিতভাবে দেখেছি। কিন্তু তা শুধু বিশ্বাসের বিপর্যয়ের ব্যাপার নয়, তা নিশ্চিতভাবে যেমন ধারণা বিশ্বাসের বিপর্যয়, তেমনি বাস্তব জীবন ও আচার-আচরণের বিপর্যয়।