নৈতিকতার বিপর্যয়
বর্তমান জাহলিয়াতের সবচেয়ে ড় প্রতারণা হচ্ছে, লোকেরা মনে করছে, এই জাহিলিয়াত বুঝি নৈতিকতার বড় ধারক।
কেননা, এই পাশ্চাত্য সুসভ্য ব্যক্তি একজন অতিবড় চরিত্রবান। সে মিথ্যা বলে না, ধোঁকা দেয় না, প্রতারিত করে না কাউকেই। সে যখন কথা বলে, তখন সে বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব সহকারে বলে। তোমার সাথে আর্থিক লেনদেন করলে তা পূর্ণ আমানতদারী বা বিশ্বস্ততা সহকারেই করে। তার কার্জে-কর্মে সে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। দেশের খেদমতে সে লেগে আছে অত্যন্ত আন্তরিকতা সহকারে। …সব ব্যাপারেই সে একজন আদর্শ ব্যক্তি। ..প্রাচ্যেদেশীয় লোকদের মুখে এই ধরনের কথা বেশ শোনা যায়।
….কেউ যৌনতার কথা তুললে চট করে বলা হয়ঃ আরে রাখো তোমার যৌনতা, যৌনতার সাথে যে নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক আছে, এই কথাই ওরা বিশ্বাস করে না, এই দিক দিয়ে ওদের বিচার করা চলে না। …অন্যান্য সবদিক দিয়েই তো ওরা আদর্শ। ….হায়, আমরা যদি ওদের মতো হতে পারতাম; ….ওদের চরিত্রের মতোও যদি হতো আমাদের চরিত্র, তাহলে তো আমরা বর্তে যেতাম!
আমরা এ পর্যায়ে আধুনিক জাহিলিয়াতে নৈতিকতার ইতিহাস আলোচনা করব। বিশ্লেষণ করে দেখব, ওরা ক্রমশ উন্নতির দিকে ছুটে চলছে, না ধ্বংসের দিকে হু হু করে নেমে যাচ্ছে। …আমরা প্রকৃত ও বাস্তব ইতিহাসের আলোকে বিচার করে দেখব, পাশ্চাত্য জগতে নৈতিকতা বলতে কিছু অবশিষ্ট আছে কিনা। এ ক্ষেত্রে আমরা কোনোরূপ কল্পনা, মিথ্যা দোষারূপ বা উড়া কথার প্রশ্রয় নেব না।
কিন্তু মূল ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর উল্লেখের পূর্বে আমাদের বারবার বলা তাৎপর্যের দিকে ইঙ্গিত করা জরুরী মনে করি। তা হচ্ছে এই যে, সম্পূর্ণরূপে নৈতিকতাশূন্য ও চরিত্র বিবর্জিত একটি জাহিলিয়াতও ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। কেননা, নৈতিকতাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা মানবীয় শক্তির সাধ্যায়ত্ত নয়। এমন করাও সম্ভব নয় যে, কোনোরূপ নৈতিকতাই পাওয়া যাবে না। কেননা মানবীয় মনস্তত্ত্ব সামষ্টিকভাবে অন্যায় ও পাপে নিমজ্জিত হতে পারে না। তা যত বিপর্যস্তই হোক না কেন, বিচ্ছিন্নভাবে ও এখানে-ওখানে চড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু-না কিছু ভালো …কিছু না কিছু কল্যাণ অবশ্যই বর্তমান থাকবে। কিন্তু এই বিচ্ছিন্ন ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কল্যাণ –তা যে অবস্থায় বা যে-কোনো ক্ষেত্রেই থাক, জাহিলিয়াতকে মারাত্মক ধরনের বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করতে পারে না।
সেই সাথে বিপদগামিতার নিশ্চিত অনিবার্য কুফল থেকেও পারে না তাকে বাঁচাতে। জাহিলিয়াতের আরব সমাজেও নানা ধরনের ভালো ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গুণ ছিল। তাদের মধ্যে বীরত্ব, সাহসিকতা ও সম্মুখে এগিয়ে যাবার গুণের ধারক ছিল। তারা যে জিনিসের প্রতি বিশ্বাসী হতো যাকে তারা লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করত; তার জন্যে জীবন প্রাণ উৎসর্গ করতেও তারা কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হতো না। তাদের মধ্যে একটা স্বাভাবিক মান-সম্মান ও মর্যাদা বোধ ছিল, ছিল আত্মসম্মান চেতনা ও জুলুমের প্রতি ঘৃণা।
কিন্তু এসব গুণ মিলিতভাবে তার জাহিলিয়াত হওয়াকে বন্ধ করতে পারেনি। তার অনিবার্য গুমরাহীর পরিণাম থেকেও তাকে রক্ষা করা যায়নি। কেনান এসব গুণ-বৈশিষ্ট্য আল্লাহর প্রদর্শিত পথের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না, ছিল না তা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এ কারণে উক্ত গুণাবলী ও সঠিক পথে অগ্রসর হতে পারেনি।
বীরত্ব, সাহসিকতা, অগ্রবর্তিতা ও জীবন-প্রাণ উৎসর্গ করার প্রবণতা রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ ও গুমরাহীর কাজে পরস্পর সাহায্য করায় সীমিত থেকে নিরর্থক ও নিস্ফল হয়ে গেছে। তারা এক অপরের সাহায্যে এগিয়ে গেছে বটে; কিন্তু তা কোনো সত্যের জন্যে করছে না, বাতিলের জন্যে, -ন্যায় পথে না অন্যায় পথে, সে চিন্তা তাদের মনে কখনোই উদিত হয়নি। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলেই তারা রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণে ঝাঁপিয়ে পড়ত। কিন্তু তার পরিণামে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার সংকল্প যেমন থাকত না, তেমনি বাতিলকে নির্মূল করার লক্ষ্যও থাকত না। ফলে বাতিল স্তরে স্তরে জমে উঠত, হতো পুঞ্জীভূত। বদান্যতা ও দানশীলতা নিছক অহংকার ও গৌরব প্রকাশের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত। পশু যবাই করা হতো ও মেহমানদের জন্যে খাবার তৈরী করা হতো, তার মূলে এই উদ্দেশ্যে নিহিত থাকত মেহমানদের জন্যে খাবার তৈরি করা হতো, তার মূলে এই উদ্দেশ্যে নিহিত থাকত যে, মেহমানরা –পথিকরা যেন তাদের অতিথিপরায়ণতার গল্প দেশে-দেশে ছড়িয়ে দেয়। পরিণামে কোনো মেহমান না-ই আসুক। আর তাদের অতিথি পরায়ণতার গল্প না-ই বলা হোক। যদি আল্লাহর ওয়াস্তে দুর্বল ও বঞ্চিতের সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দিত, তখন তাদের মধ্যে কার্পণ্য প্রবল হয়ে উঠত। তখন এক কানাকড়িও ব্যয় করতে তারা রাজি হতো না। আত্মসম্মানবোধও আত্মগৌরবে পরিণত হতো, সত্য অনুসরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াত।
মোটকথা, সত্য অনুসরণ তাদের এই ধরনের কাজে মূল প্রেরণা –উৎস হতো না। আসলে তা হতো আল্লাহদ্রোহী আত্মগৌরব। যদিও এই আত্মগৌরবী আরবরা খুব ভালো করেই জানত যে, তারা যা কিছু করছে, তা নিতান্ত গুমরাহী ছাড়া আর কিছুই নয়।
ইউরোপীয় জাহিলিয়াতও ব্যক্তিগত কাজের পর্যায়ে বহু গুণ-বৈশিষ্ট্যের ধারক ছিল। সততা-সত্যবাদিতা, কাজে নিষ্ঠা, একাগ্রতা, দৃঢ়তা, বিশ্বস্ততা ও পারস্পরিক কাজে নির্মমতা-পরিচ্ছন্নতা …সবই ছিল। কিন্তু তার কোনো একটিও আল্লাহর দেখানো পথের অনুসারী ছিল না বলে তার সহজ-সরল ঋজু পথ থেকে তা ছিল বিভ্রান্ত। একটু পরেই যেমন দেখব, তা সবই ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধারের প্রবণতা-নিঃসৃত। তারা উক্ত পর্যায়ের যে কোনো গুণসম্পন্ন কাজ করত, তা করত এই উদ্দেশ্যে যে, তা সামষ্টিকভাবে তাদের জন্যে বৈষয়িক দিক দিয়ে খুবই সহায়ক ও স্বার্থ আদায়কারী ছিল, জীবনের গাড়ি ধাক্কা না দিয়েই চালানো যেমন অতীব সহজে ওসব নৈতিকতার বৈষয়িক কায়দা পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে পাশ্চাত্যের এই সুসভ্য মানুষ সহসাই এসব নৈতিকতা পরিহার করতে একটুও কুণ্ঠিত হতো না। তখন তাদের দৃষ্টিতে এসব নৈতিকতা একটা অবাস্তব অ-অনুসরণীয় নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই মনে হতো না।
না, খুব একটা তাড়াহুড়া না করেই এক্ষণে আমরা পাশ্চাত্য নৈতিকতা পর্যায়ে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর অধ্যায়নে আত্মনিয়োগ করছি…..
মৌলিকতার দিক দিয়ে পাশ্চাত্য নৈতিকতার উৎস ধর্ম ছাড়া আর কোথাও কিছু ছিল না। মানুষ সত্যের অনুসারী হয়েও আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে চরম বিপথগামিতার মধ্যে পড়ে যেত। ফলে পরিণামে নৈতিকতায়ও দেখা দিত সেই বিপর্যয় ও বিপথগামিতা। তবে নৈতিকতার ক্ষেত্রে এই বিপথগামিতা খুব দ্রুত দেকা দিত না, দেখা দিত খুব ধীরে ধীরে এবং বেশ বিলম্বেই তা চরস সীমায় উপনীত হতো। এটা একটি শতাব্দী কালের মধ্যেও সংগটিত হতো না, এজন্যে কয়েক শতাব্দী সময়ের প্রয়োজন হতো।
এই ক্রমিক ধারায় পাশ্চাত্য নৈতিকতার পতন ঘটার কারণে তার অবশিষ্ট নিদর্শন-দৃষ্টান্তসমূহ জনগণকে এই ধোঁকায় ফেলে দিয়েছে যে, পাশ্চাত্য জাহিলিয়াতও বুঝি নৈতিকতার বড় ধারক, জাহিলিয়াতের প্রেমিকরাও এই ধোঁকার শিকার হয়েছে। মনে করেছে, বাহ্যত আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি দেখা দিলেও নৈতিকতার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ও বিপর্যয় দেখা দেয়নি। পরবর্তীকালে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং তীব্র আকার ধারণ করেছে। এই কারণে প্রথম পর্যায়ে জনগণ মনে করে নিয়েছে যে, আকীদা-বিশ্বাসের সাথে বোধ হয় নৈতিকতার কোনো নিকট সম্পর্ক নেই এবং আকীদা-বিশ্বাসে বিপর্যয় যতই আসুক না কেন, তা সত্ত্বেও নৈতিক চরিত্র অবম্যই রক্ষা পেতে পারে।
কিন্তু আসলে এটা একটা মস্তবড় ধোঁকা ছাড়া আর কিছু নয়। আর তার কারণ হচ্ছে, পতনের দিকে যাওয়ার গতিতে পার্থক্য হওয়া। এই পার্থক্যেরও কারণ হচ্ছে, মানষের মন স্বভাবতঃই এবং ঐতিহ্যগতভাবে তার নৈতিকতার বন্ধনসমূহ শক্ত করে আঁকড়ে থাকে, সহজে তা ছঅড়তে রাজি হয় না। তার আকীদার অংশ ঈমান হারিয়ে ফেললেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার মূল্যবোধটা রক্ষা পেয়ে থাকে। ইউরোপও তার বিশ্বাস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েও দীর্ঘকাল তৎলব্ধ মূল্যবোধটা হারায়নি। কেননা তা এমন একটা জিনিস যার কিছু না কিছু অবশ্যই রক্ষা পেয়ে যায়, অবশিষ্ট থাকতেই হয়। কিন্তু তার শেষ পরিণতি অভিন্ন ও তা নিশ্চিত, অনিবার্য। কেনান আকীদার বিপর্যয় অবশ্যই নৈতিকতার বিপর্যয় সৃষ্টি করবেই। আর নৈতিকতা আকীদা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে একদিন না একদিন তা নিঃশেষ হয়ে যাবেই।
ইউরোপীয় নৈতিকতায় ঠিক এই ব্যাপারই ঘটেছে। ঘটেছে খুব ধীরে ধীরে এবং ক্রমশ আধুনিক জাহিলিয়াতের প্রকৃত নৈতিকতা থেকে বিপর্যস্ত হওয়ার পরও দীর্ঘকাল তার জের চলছিল। তারই ফলে পাশ্চাত্য জাহিলিয়াতকে নৈতিকতার ধারক মনে করে অনেকেই ধোঁকার মধ্যে পড়ে গিয়েছে।
একথা অনস্বীকার্য যে, ইউরোপীয় চরিত্রের সবকিছুই একদা একটা বড় সাহায্যকারীর কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছিল। তা এমন এক সাহায্যকারী, যার ছাড়া নৈতিকতার সাহায্যকার আর কিছু হতে পারে না; আর তা হচ্ছে তাদের ধর্ম।
ইউরোপীয় চরিত্রের দুটি উৎস ছিল। একটি ছিল খ্রিষ্টধর্ম, আর অপরটি ছিল ইসলাম।
সকলেই জানা, ইউরোপে খ্রিষ্ট ধর্ম নিয়ে গিয়েছিল কনস্ট্যান্টাইন। এই ধর্মমত ইউরোপীয় জীবনধারায় একটা নির্দিষ্ট নৈতিকতার প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিল এবং তা দীর্ঘদিন পর্যন্ত জনগণের মনে বদ্ধমূল হয়ে থেকেছেও, যদিও স্বয়ং কনস্ট্যান্টাইনের হাতেই খ্রিষ্টধর্মে নানা প্রকারের বিকৃতি সংঘটিত হয়েছিল।–[অত্র গ্রন্থের ‘ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে’ অধ্যায়ে মার্কিন লেখক ড্রিপারের উক্তি দ্রষ্টব্য।] তা সত্ত্বেও এই ধর্মীয় চরিত্রটা নেতিবাচক রূপ পরিগ্রহ করেছিল, বাস্তব জীবনের সাথে তার কোনো সঙ্গতি ছিল না। হযরত ঈসা (আ) জনগণকে বলতেনঃ যে লোক তোমার ডান গালে একটা থাপপড় মারল, তার সম্মুখে তোমার বাম গালও পেতে দাও। তাঁর এ কথার আসল উদ্দেশ্য ছিল আভ্যন্তরীণ দিক দিয়ে লোদকের আত্মিক সংশোধন। তিনি তো আল্লাহর সত্য নবী ছিলেন, তিনি উক্তরূপ কথা বলে নিশ্চয়ই জনগণের মনে যিল্লতী ও আত্মসম্মান হননের চিন্তা জাগাতে চান নি। কিন্তু মধ্যযুগে খ্রিষ্টীয় নৈতিকতার সাধারণ রূপটা এই প্রকৃতিতেই লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু তা হযরত ঈসা মসীহর উদ্দেশ্য ছিল না, তাতে একবিন্দু সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু তাঁর অনুসারীরা উক্তরূপ ধারণাই পোষণ করছিল তদানীন্তন রোমান সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরীণ পরিবেশে। গোটা পরিবেশেই তো তখন বস্তুবাদী ভাবধারাপূর্ণ, বিপর্যস্ত ও জোর-জবরদস্তিতে ভারাক্রান্ত ছিল।
অতঃপর খ্রিষ্টান জনগণ ইসলামী জগতের সাথে সংঘর্শে লিপ্ত হয়। শুরু হয়ে যায় ক্রুশযুদ্ধ। এই সুযোগে খ্রিষ্টানরা ক্রুশ ধারণ করে মুসলিম জাহানে প্রবেশ করে এবং কিছু কাল পর্যন্ত তথায় অবস্থান করে। তারা সিরীয় এলাকায় নিজস্ব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠিত করে।
খ্রিষ্টনারা ইসলামী জীবনধারার সাথে পরিচিতি লাভ করে গ্রন্থাদির মাধ্যমেও এই পরিচিতির ফলে তারা নানাভাবে উপকৃত হয়। তারা লাভ করে জীবনের জন্যে ইতিবাচক মতাদর্শ নৈতিকতার পূর্ণ সংরক্ষণ সহকারে।
তারা সেসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহে বসবাসকারী মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিল। তারা লক্ষ্য করত, মুয়াযযিনের আযান ধ্বনি শোনামাত্রই তারা তাদের দোকান-অফিস-ঘর সম্পূর্ণ বা প্রায় উন্মুক্ত রেখেই –পাহারাদারীর কোনো ব্যবস্থাই রাখা হতো না। মসজিদের নামাযে হাযির হওয়ার জন্যে তারা বিন্দুমাত্র বিলম্বও সইত না। নামায সমাপ্ত করে তারা নিজ নিজ দোকান-অফিস-ঘরে ফিরে আসত, কিন্তু দেখত, সেখান থেকে কোনো সামান্য জিনিসও চুরি যায়নি। তার কারণ জনগণ ইসলামে ঈমানদার, সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাসী।
তারা দেখত, মুসলিম জনগণ গোষ্ঠীবদ্ধ, পরস্পর গভীর সম্পর্কে সম্পৃক্ত। তাদের সকলের মনে এক অভিন্ন ‘উম্মত’ হওয়ার চেতনা সক্রিয়। অন্তত বিপদকালে তো বটেই। তখন তারা পরস্পর সহযোগিতায় এগিয়ে যেত। পরস্পরের মধ্যে থাকত বন্ধুত্ব, প্রীতি, সহানুভূতি-সহৃদয়তা, সহমর্মিতা, পরস্পরের প্রতি তারা একনিষ্ঠ, নিঃস্বার্থ। অবশ্য শাসক শ্রেণীর সম্পর্কে এ কথা প্রযোজ্য নয়।
তারা মুসলিম কারিগরকে দেখত আদর্শ ব্যক্তিরূপে। যেমন দক্ষ কর্মতৎপর, তেমিন বিশ্বস্ত। তার এই বিশ্বস্ততাই আসলে তার প্রথম ও বড় মূলধন। তার কর্মদক্ষতাই তার বাস্তব অগ্রগতি লাভের বড় হাতিয়ার। ফলে তাদের মধ্যে শিল্প-কর্ম সম্প্রসারিত ও উন্নত হচ্ছিল এবং উৎপাদন বিপুলবাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
এই ধরনের বহু প্রকারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য-বিশেষত্ব তারা মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে লক্ষ্য করত। এ পর্যায়ে বিশেষ উল্লেখ হচ্ছে ওয়াদা পূরণ। মুসলমানদের সাথে পারস্পরিক অর্থনৈতিক ও অন্যান্য কার্যক্রমে খ্রিষ্টানরা এই ওয়াদা পূরণের ব্যাপারটির সাথে প্রত্যক্ষভাবে পরিচিতি হয়েছে। এই ক্ষেত্রে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর কাছ থেকে অনেক বাস্তব ঘটনার নিদর্শন ও প্রমাণ তারা পেয়েছে।
সামষ্টিকভাবে মুসলিম সমাজ এবং বিশেষ করে সামরিক ও আন্দালুসিয়ার মুসলমানদের কাছ থেকে পাওয়া জ্ঞান-বিজ্ঞানলব্ধ অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতিতেই আধুনিক ইউরোপের সর্বক্ষেত্রেই পুনর্জাগরণ সূচিত হয়েছিল।
কিন্তু আমরা যেমন বিস্তারিতভাবে বলেছি –পরিবেশ পরিচিতির কারণে এই পুনর্জাগরণ আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত তা পৌত্তলিকতার জঘন্য পংকিল মলিনতায় আপ্লুত হয়। তা-ও ছিল গ্রীক ও রোমান উত্তরাধিকার, যদিও তখন পর্যন্ত অন্তরের আকীদাটা যথার্থ ও জাজ্বল্যমানই ছিল।
ইউরোপীয় জনমনে নৈতিকতার বিপর্যয় সৃষ্টিকারী যে কারণের সঞ্চার হয়েছিল, তার উৎস ছিল হেলেনীয় সংস্কৃতি সঞ্জাত দর্শন। পূর্বোদ্ধৃত দুটি উৎসের পর এটা ছিল তাদের জন্যে তৃতীয় উৎস। …তা বলতে গেলে হাতীর দাঁতের বোর্জধারী সংস্কৃতি। তার নৈতিক নমুনাসমূহ ছিল শূন্যলোকে ঝুলন্ত।
এই সময় থেকেই পাশ্চাত্য জগতের মধ্যে চারিত্রিক বিপর্যয় সূচিত হয়। কিন্তু নৈতিক বিপর্যয়টা খুব ধীরে ও ক্রমিক গতিতে সংঘটিত ও প্রকাশিত হয় বলে প্রকৃত অবস্থার প্রকাশ ঘটতে কয়েক শতাব্দী লেগে যায়।
পাশ্চাত্য নৈতিকতায় গ্রীক প্রভাবের দরুন এই ধারণা জন্ম নিয়েছিল যে, নৈতিক নিদর্শন হাতী-দাঁতের বুর্জে ও শূন্যলোকের বিশালতায় পাওয়া সম্ভব তখন, যখন বাস্তব জীবন প্রয়োজনানুসারে নৈতিক বাঁধা-বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে থাকবে।
চিন্তা ও কর্মের পার্থক্য আধুনিক জাহিলিয়াতে সৃষ্টি নিছক পাশ্চাত্য দৃষ্টিকোণ ছাড়া আর কিছুই নয়। তারই ফলে আজ সমগ্র জগতে দ্বৈত নৈতিকতা –নৈতিকতার এই দ্বিমুখিতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ববাসীর জীবনে চরিত্রের সর্বক্ষেত্রেই এই দ্বিমুখিতা প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে লোকেরা নীতিগত নৈতিকতা সম্পর্কে বড় বড় কথা বলছে –অবাস্তব জগতে তার কথা বলে বলে সুখ লাভ করছে, কিন্তু জীবনের ঘটনাবলীতে তার বাস্তব প্রতিফলন একবিন্দুও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আসলে এক্ষেত্রে তাদের গতিবিধি সুযোগ অনুযায়ী হচ্ছে।
ধারণা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিরাজমান এই জাহিলিয়াতের ছত্রছায়ায় ‘ম্যাকিয়াভেলী’র জন্ম সম্ভব হয়েছিল। তার স্বভাবচরিত্রের পাশ্চাত্য প্রভাব প্রবলভাবে পড়েছিল। ইউরোপের সর্বক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যাবে যে, স্বার্থ হাসিলের জন্যে যত খারাপ পন্থাই অবলম্বন করা হোক না কেন, তাতে কোনো দোষ নেই।
এভাবে গোটা পাশ্চাত্য রাজনীতিতে ম্যাকিয়ালেভীর উক্ত কুৎসিৎ নীতি ব্যাপকভাবে চালু হয়ে গেল।
ম্যাকিয়াভেলী রাজনীতির প্রথম রাজনৈতিক দর্শন হচ্ছে মতাদর্শ ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য। যা মতাদর্শ চিন্তা-বিশ্বাস, বাস্তবেও ঠিক তাই রক্ষা করে সেই অনুরূপ কাজ করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই।
এই ইউরোপীয় রাজনীতি সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল এই মৌলনীতির ভিত্তিতে যে, উদ্দেশ্য উপায়কে বৈধ করে। উপায় ও পন্থা যতই জঘন্য ও কলুষমুক্ত হোক না কেন, তদ্দারা যদি উদ্দেশ্য লাভ সম্ভব হয়, লক্ষ্য অর্জন সহজসাধ্য হয়, তাহলে তা গ্রহণ করা শুধু নির্দোষই নয়, অতীব ভালো ও উত্তম।
এই ম্যাকিয়াভেলী চিন্তা ও দর্শন খুব স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপীয় রাজনীতিকে গ্রাস করে ফেলল। এরই ফলে রাজা-বাদশাহ, অভিজাত শ্রেণী ও ধর্মগুরু লোকেরা নিজেদের দখলভুক্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব রক্ষার জন্যে যে কোনো নিকৃষ্টতম উপায়-উপকরণ ব্যবহার করতে একবিন্দু কুণ্ঠিত হয়নি। তার পরে পুঁজিতন্ত্র তার উপযুক্ত উত্তরাধিকারী হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়, তৎপূর্ববর্তীদের কাছ থেকে উপায়-উপকরণসমূহ গ্রহণ করেই ক্ষান্ত থাকেনি, তার মাত্রা ও পরিধি অনেক গুণ বৃদ্ধিও করেছে। তাদের অবৈধ ও অবাঞ্ছিত লক্ষ্য অর্জনের জন্যে উপায়-উপকরণ গ্রহণের যত হীনতা ও নীচতাই অবলম্বন করতে হোক না কেন, তাতে তারা কিছুমাত্র লজ্জাবোধ করেনি। এমনকি আমেরিকান পুঁজিতন্ত্র নিজেদের হীনস্বার্থ রক্ষার জন্যে কেনেডিকে হত্যা করেছে; তাতে তাদের বিবেক বুদ্ধি কিছু মাত্র দংশিত হয়নি।
এসব তো তাদের ঘরোয়া ব্যাপার। বাইরের জগতে তাদের ভূমিকা তার চাইতেও জঘন্য ও অধিক কুৎসিৎ। সাম্রাজ্যবাদ তার সাম্রাজ্য রক্ষা ও জনগণের তাজা-তপ্ত রক্ত শোষণের জন্যে নিকৃষ্টতম উপায় ও পন্থা অবলম্বন করেছে, তাতে তাদের কিছুমাত্র উপায়কে ভালো করে দেয়। কিন্তু সে লক্ষ্যটি ভালো কি মন্দ, উত্তম কি নিকৃষ্ট জঘন্য, সে বিচারের কোনো প্রয়োজনই তারা মনে করেনি। তাই বলতে হয়, ইউরোপীয় নৈতিকতায় পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নতা যদি কিছু থাকেও তবে তা কল্পনার জগতে, বাস্তবতার জগতে তার নাম চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যায় না। ইউরোপে রাজনীতি এভাবেই নৈতিক পবিত্র থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
আর তাদের সাংস্কৃতিক চৈন্তিক প্রভাবে পীড়ে বলতে লাগলঃ হ্যাঁ, ব্যাপার তাই। রাজনীতির সাথে নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক থাকা উচিত নয়।
এ ছিল ইউরোপের বিপথগামিতার সূচনা বিন্দু। তবু তখন পর্যন্ত সর্বাত্মক বিপর্যয় প্রচণ্ড হয়ে দেখা দেয়নি।
তার দরুন লোকেরা প্রতারিত হল। কেননা তখন পর্যন্ত লোকেরা আসল অবস্থা সম্পর্কে কোনো ধারণা করতে পারেনি, পরিণতি কত যে মারাত্মক, তা বোঝা তখন তাদের পক্ষে সম্ভবও ছিল না। তারা বুঝতেই পারেনি যে নৈতিকতা যদি আকীদা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তা হলে না নৈতিক চরিত্র রক্ষা পেতে পারে, না কোনোরূপ প্রতিরোধ সহ্য করতে পারে।
আসল অবস্থা লোকেরা আঁচ করতে পারেনি এজন্যে যে, তারা বাহ্যিকভাবে দেখতে পাচ্ছিল যে, নৈতিকতার অনেক ভালো ভালো নিদর্শন তখন পর্যন্ত বাস্তবে অবশিষ্ট ছিল। তা তখনও পুরা মাত্রায় বিপর্যয়ের শিকার হয়নি। সেইখানে তাদের মনে এই ধারণাও জন্মিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, রাজনীতি নৈতিকতার অধীন নয়, আর সংঘটিত ঘটনাবলী চরিত্রকে কিছুমাত্র ধ্বংস করছে না, করবেও না। বর্তমান অবস্থাকে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গীর ফল ধরে নিতে লাগল। তার ঘটনাবলীর সাথে নৈতিকতার প্রয়োগ হতে হবে, তা কোনো জরুরী কথা নয় বলেও নিজেদেরকে সান্ত্বনা দিল।
কিন্তু আল্লাহর নিয়ম তো কখনোই বদলায় না। আকীদার সাথে চরিত্রের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলে আল্লাহর স্থায়ী নিয়মেই চরিত্র বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকতে পারে না। কেননা আকীদা হচ্ছে চরিত্রের স্বাভাবিক ও জীবনদায়ী উৎস। আকীদাই চরিত্রের একনিষ্ঠতা ও সততা নিয়ে আসে। তাই আকীদাভিত্তিক চরিত্র স্থায়ী হতে পারে। যে চরিত্র আকীদাভিত্তিক নয়, তা কোন সময় নিঃশেষ হয়ে যাবে, তা টেরও পাওয়া যাবে না।
ইউরোপ ধর্মকে বাদ দিয়ে তার বদলে দর্শনকে গ্রহণ করল। সেই দর্শন থেকেই তারা নৈতিকতার নিয়ম-বিধান গ্রহণ করতে শুরু করে দিল। অথবা বলা যায়, ধর্মের প্রতি তাদের মনে জেগে উঠল ঘৃণা ও বিদ্বেষ। আর তাকেই তারা দর্শনের পোশাক পরিয়ে দিল। তারপর যারা চলতি নৈতিকতাকে আঁকড়ে ধরে থাকল, তারা নৈতিকতাকে ধর্মের সাথে সম্পর্কিত করাকে পছন্দ করতে পারল না। এক্ষণে তারা ‘বিবেক’ আর ‘কর্তব্য’ ইত্যাদি পারিভাষিক শব্দগুলোর আশ্রয় নিতে লাগল। কিন্তু ধর্মীয় পরিভাষায় তার ব্যাখ্যা দিতে তারা অস্বীকার করে বসল।–[এই ধারণাটা প্রাচ্যের ইসলামী সামজেও ছড়িয়ে পড়েছে। বলতে শুরু করেছেঃ আমি মদ্য পান করি না। অমনি খুব তাড়াহুড়া করে বলবে, না, না, ধর্মের নিষেধের কারণে নয়, বরং শুধুমাত্র এজন্যে যে, আমি মদ্যপান পছন্দ করি না।]
কিন্তু এ নৈতিকতা তার তাৎপর্য সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলেছে। আর মূল উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন এ নৈতিকতা খুব বেশী দিন টিকেও থাকতে পারে না।
রাজনীতি নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সাথে সাথে অর্থনীতিও নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল স্বাভাবিকভাবেই।
সত্যি কথা হচ্ছে, ইউরোপীয় অর্থ ব্যবস্থা প্রথম দিন থেকেই নৈতিকতা পরিপন্থী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ও গড়ে উঠেছিল। খ্রিষ্ট ধর্ম অবলম্বনের পূর্বে রোমান সাম্রাজ্যবাদের অধীন ভূমিদাস প্রথার ওপর নির্ভর করে সামন্তবাদী অর্থ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তা ছিল চরম জঘন্য, হীন ও নির্মম ব্যবস্থা। সম্রাট কনস্ট্যানটাইন গোটা সাম্রাজ্যের ওপর যে ক্ষয়িষ্ণু খ্রিষ্ট ধর্মমত চাপিয়ে দিয়েছিল, যার ফলে গীর্জা চরম স্বেচ্ছাচারিতার একচ্ছত্র রাজত্ব কায়েম করেছিল। গোটা জনগণের ওপর, তথা খ্রিষ্টীয় গীর্জা গোটা অর্থ ব্যবস্থাকে ধর্মভিত্তিক নৈতিকতার নিয়মাবলীর অধীন ও তার অনুসারী বানাতে বিন্দুমাত্র সক্ষম হয়নি। বরং খোদ গীর্জাই কিছুকালের মধ্যে এক সামসন্তবাদী ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। সাধারণভাবে সামন্তরা জনগণের ওপর যে অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাত, গীর্জা ও তার মালিকানাধীন সমস্ত এলাকায় অনুরূপ নিপীড়ন ও নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছিল ধর্মের নামে।
তা সত্ত্বেও পূর্বে সামন্তবাদী অর্থনীতিতে নৈতিক বিপর্যয়টা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। খ্রিষ্টীয় গীর্জা তা পরিবর্তন করতে একবিন্দু সক্ষম হয়নি। ধর্মীয় শিক্ষায় যত বিবৃতি ও বিপথগামিতাই পৌঁছে গিয়ে থাক না-কেন, সূদী কারবার ব্যবসায় ও লেনদেনকে একটা ঘৃণ্য জঘন্য ব্যাপার রূপে চিহ্নিত করতে ও বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয়নি। যদিও মানুষ কোনোদিনই ইচ্ছা করে বা সাগ্রহে এই কারবারে জড়িত হতে রাজি হয় না। তারা তা বরদাশত করে কেবলমাত্র বাধ্য হয়ে।
পরে যখন পুঁজিতান্ত্রিক শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হলো, তখন জনগণ একদিকে আকীদা-বিশ্বাস থেকে, আর অপরদিকে নৈতিকতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেক দূরে সরে গেল। ফলে পুঁজিতন্ত্রের বল্গাহারা অশ্ব অন্ধভাবে ছুটতে লাগল। নৈতিকতার প্রাথমিক নিয়ম-নীতিও এই পাগলা ঘোড়াকে বাঁধতে পারল না।
সুদ –সুদী কায়-কারবার –কিন্তু খ্রিষ্ট ধর্মে এবং তার পূর্বে ইহুদী ধর্মের সম্পূর্ণ হারাম ঘোষিত হয়েছিল। কিন্তু পুঁজিতন্ত্র তো প্রথম দিনই এই সুদের ওপর ভিত্তি রেখে অগ্রসর হতে লাগল। শ্রমিকদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করা সম্পদ অপহরণ করে নিতে লাগল এবং কোনো কষ্ট স্বীকার করা ছাড়াই মানুষের উপার্জনের অংশ কেড়ে নিয়ে নির্লজ্জ ও নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে জীবনের স্বাদ আস্বাদন করতে থাকল। পুঁজিপতিরা নিঞ্ঝাট জীবন যাপনে মগ্ন, আর বসে-বসেই বিপুল অর্থ উপার্জিত হয়ে তাদের মুঠির মধ্যে পুঞ্জীভূত হতে থাকল অতীব সহজে ও কোনোরূপ পরিশ্রম ব্যতীতই।
তা শ্রমিক কর্মচারীদের নিম্নতম প্রয়োজন পরিমাণের ব্যবস্থা করে দিয়েও তাদেরকে প্রাণান্তকর খাটুনী খাটতে বাধ্য করে বিপুল পরিমাণ মুনাফা লুঠতে থাকল। শেষ পর্যন্ত এমন কঠিন সময়ও দেখা দিল, যখন তারা পেট ভরা খাবার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল।
শোষণ চলল বালক বয়সের শ্রমিকদের ওপর। তারা দীর্ঘ সময় ধরে চরম কষ্টদায়ক শ্রম করতে বাধ্য হচ্ছিল। বিনিময়ে তারা পেত মাত্র এক-দুই টাকা, যা দিয়ে তাদের পেট ভরে খাবার খাওয়াও চলত না।
শ্রমিকরা তখন মজুরী বৃদ্ধি ও শ্রমের উন্নত শর্তের দাবি পেশ করল, তখন তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে নারী শ্রমিকদের দাঁড় করাল। উদ্দেশ্য ছিল তাদের দাবিকে দুর্বল করা এবং সাহস-হিম্মতকে ক্ষীণ করে দেওয়া।
পরে নারী শ্রমিকদের উৎসর্গ করা হলো পুরুষদের লালসা-কামনার দাউ দাউ করা আগুনের মুখে। এক মুঠি খাবারের বিনিময়ে তাদের ইজ্জত-আব্রু বিক্রয় করতে তাদেরকে বাধ্য করা হলো।
এ ছিল নৈতিকতার জন্যে মারাত্মক অবস্থা। নৈতিকতা ধ্বংস করে পুঁজিবাদী খেল-তামাসা, আনন্দ-স্ফুর্তি, বিচিত্র স্বাদ-আস্বাদন, রূপ-সুধা পান, অলংকার, সৌন্দর্য বৃদ্ধিকারক বিলাস দ্রব্যাদি, ফ্যাশন ও পোশাক-পরিচ্ছদ ও নিত্য নতুন উদ্ভাবিত ও উৎপন্ন লোভনীয় দ্রব্যাদি বিক্রয় করে বিপুল পরিমাণ মুনাফা লুণ্ঠনই ছিল চরম উদ্দেশ্য।
ঔপনিবেশিক এলাকা থেকে কাঁচামাল লুটে নিয়ে পুঁজিবাদের জন্যে অকল্পনীয় পরিমাণের মুনাফা লুণ্ঠনের সুযোগ করে দেওয়া এবং তার আসল মালিকদেরকে দারিদ্র্য, পশ্চাদপদতা, মূর্খতা-অজ্ঞতা, রোগ ও অক্ষমতার অভিশাপের তলায় চেপে রাখাও ছিল তাদের ইচ্ছা। তাদের চরিত্রকে নষ্ট করে এই পথে পুঁজিবাদী মুনাফা বেশি থেকে বেশি অর্জনের পথ উন্মুক্ত করাও লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে সকল প্রকারের পাপ-পংকিলতার ব্যাপক প্রচার ও মন-বিবেককে কম-সে-কম মূল্যে ক্রয় করার মূলে পুঁজিবাদের স্বার্থ রক্ষা করাও সাম্রাজ্যবাদকে অধিকতর শক্তিশালী করে প্রতিষ্ঠিত করে প্রতিষ্ঠিত রাখাই ছিল চরম লক্ষ্য।
নৈতিকতা অবলম্বন ও নৈতিক মৌল নীতিসমূহের দিকে প্রত্যাবর্তনের আহবান জানাতে আত্মনিয়োগকারী লোকদিগকে পুঁজিবাদীরা নির্লজ্জভাবে অপমানিত করতে শুরু করে দিয়েছিল।
এই সময় নবতর বৈজ্ঞানিক মতাদর্শ আবিস্কৃত হতে লাগল। তা প্রচার করতে শুরু করল অর্থনীতির একটা নিজস্ব নিয়ম-কানুন রয়েছে। সে নিয়ম-কানুনগুলো ছিল নিশ্চিত অনিবার্য। নৈতিক চরিত্রের সাথে তার দূরতম সম্পর্কও নেই। শুধু তা-ই নয়, সাধারণ জনগণের সাথেও তার কোনো সম্পর্ক নেই।
এভাবে অর্থনীতি ণৈতিক চরিত্র থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। লোকেরা কাঁধ উচিয়ে-নাচিয়ে বলতে লাগল, এটাকেই বলে অর্থনীতি! তা নৈতিকতার কাছে পরাজয় মান না বলেই তা টিকে থাকতে পারে!
রাজনীতি ও অর্থনীতির পর যৌনতাও নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এবং তা মানুষের পাশবিক ব্যাখ্যার বিত্তিতেই সম্পন্ন হলো, সমস্ত কাজের যৌনতা ভিত্তি ব্যাখ্যা এবং বিকৃত-বিপর্যস্ত জাহিলিয়াত সৃষ্ট শিল্প বিপ্লব মানুষকে পাগলের ন্যায় যৌন চর্চার অগ্নিকুণ্ডলীর মধ্যে নিক্ষেপ করে দিল।
প্রথম দিকে তো লোকেরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিল যে, এটা নিঃসন্দেহে নৈতিকতার চরম বিপর্যয়। কিন্তু ক্রমশ লোকেরা এই সত্যকে ভুলে গেল কিংবা বলা যায়, শয়তানেরাই তাদেরকে তা ভুলিয়ে দিল।
মার্কস, এঙ্গেলস, ফ্রয়েড, দরখায়েম… এরাই পরস্পরের কানে কানে এই চাকচিক্যময় লোভনীয় আকর্ষণীয় কথা পৌঁছিয়ে দিল …দিল একটা মস্তবড় ধোঁকা।–[(আরবী*******************************************) গ্রন্থের ‘তিন ইহুদী’ শীর্ষক আলোচনা দ্রষ্টব্য।]
মার্কস তাঁর ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার ভিত্তিতে বললেনঃ “যৌন পবিত্রতা গ্রামীন সামন্তবাধী সমাজের অবশিষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বটে। তার যা কিছু মূল্য, তা সেই সময়কার অর্থনৈতিক স্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল”।
মার্কসের এই কথা সম্পূর্ণ ভুল, বরং একটা মস্তবড় প্রতারণা।
কেননা যৌন পবিত্রতার একটা নিজস্ব শাশ্বত মূল্য ও মর্যাদা-মহিমা রয়েছে। অর্থনৈতিক ব্যাপারাদি থেকে আলাদাভাবেও মানুষের উচিত তা রক্ষা করা এবং কোনোভাবে ব্যাহত বিঘ্নিত বা ক্ষুণ্ন হতে না দেওয়া। কেননা যে মানুষ নিজেকে পশু মনে করে না, পশু থেকে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র সৃষ্টি বলে বিশ্বাস করে, এই চারিত্রিক গুণটি তার জন্যে অপরিহার্য।
ফ্রয়েড বলেছেন, যৌন ক্ষুধা নিবৃত্ত করা ছাড়া মানুষ স্বীয় অস্তিত্বকে পর্যন্ত বিকশিত ও বাস্তবায়িত করতে পারে না। ধর্ম, নৈতিকতা, সমাজ বা ঐতিহ্য-এই সব বাঁধা প্রতিবন্ধকতাই বাতিল, মূল্যহীন। তা সবই মানুষের মধ্যে নিহিত শক্তিসামর্থ্যকে বিনষ্ট ও ব্যাহত করে দেয়। এসব বাঁধাকে অবশ্যই নির্মূল করতে হবে।
দরখায়েম বলেছেন, নৈতিকতা বিশারদরা মানুষের নিজের ওপর কর্তব্যসমূহকে নৈতিকতার ভিত্তি বানায়। ধর্মের ব্যাপারও তাই। কেননা লোকেরা মনে করে, ধর্ম সে সব চিন্তা ভাবনার ফসল, যা প্রকৃতিগত শক্তি সৃষ্টি করে কিংবা কতিপয় বিরল বরেণ্য ব্যক্তিত্বের মনে আসে। (রাসূল ও নবীগণকে বোঝাতে চেয়েছে) কিন্তু এ পদ্ধতিটিকে সামষ্টিক প্রপঞ্চের ওপর আরোপ করা সম্ভব নয়। তবে এসব প্রপঞ্চের প্রকৃতিই বদলে দেওয়া হলে ভিন্ন কথা।–[(আরবী****************)]
তিনি আরও বলেছেনঃ পূর্বোক্ত মতকে ভিত্তি করে এখানে একথা বলা সম্ভব যে, আইনগত বা নৈতিক নিয়ম-কানুন বলতে কিছুই কোথাও নেই, এই ব্যাখ্যা যদি সঠিক হয়, এই কারণে যেসব নৈতিক নিয়ম-কানুনের কোনো অস্তিত্বই নেই তা-ই নীতি বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় হবে –এটা সম্ভব নয়।–[(আরবী*********) পৃষ্ঠা ৯-৬০।]
বলেছেনঃ এই পর্যায়ের কথা কোনো কোনো মনীষী মানুষের স্বভাবগত ধর্মীয় স্নেহ-বাৎসল্য আছে বলে মনে করেছে। আর এই শেষ মতটি যৌন চেতনা, পিতামাতার সাথে ভালো আচরণ এবং সন্তানের প্রতি স্নেহ-বাৎসল্য প্রভৃতির সংমিশ্রিত। আবার অনেকে এই ধর্ম, বিয়ে, পরিবার প্রভৃতিরও উদ্ভব হওয়ার ব্যাখ্যা এভাবেই দিতে চেয়েছে। কিন্তু ইতিহাস আমাদের বলছে যে, এই সব ভাবধারা মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে বর্তমান নেই।–[পূর্ব সূত্রঃ পৃ. ১৭৩।]
এ অধ্যায়ের পরবর্তী আলোচনায় দুই লিঙ্গের মধ্যকার সম্পর্কে সৃষ্ট বিপর্যয় সম্বন্ধে আলোচনা করব। এখানে আমরা শুধু ঐতিহাসিক ধারা ও ঘটনার যাচাই পেশ করব।
উপরে উদ্ধৃত ও আলোচিত খারাপ ও ভুল মতবাদের প্রভাবে জনগণ যৌনতার গভীর গহবরে ডুবে গেল। পরে তারা যে নৈতিকতার দিক দিয়ে চরম বিভ্রান্তি-বিপথগামিতার ফাঁদে আটকে গেছে, সে কথা তারা বেমালুম ভুলে বসেছে। তখন তারা খুব আনন্দ ও সন্তুষ্টি সহকারে বলতে লাগল, যৌনতা নিছক একটা দৈহিক কার্যক্রমের ব্যাপার মাত্র। তার সাথে নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন করে পূর্বে বলেছিল, রাজনীতি তো রাজনীতি, তার সাথে নৈতিকতার কি সম্পর্ক থাকতে পারে। আর যখন তারা এই কথা মুখে বলছিল, ঠিক সেই সময়েই তারা ভিতরের দিকে দিয়ে প্রকৃত সত্যকে পরিবর্তন করে দিতে কিংবা নিজেদের ওপর থেকে বিপর্যয় বা বিপর্যয়ের বোঝা দূরে নিক্ষেপ করে দিতে পারবে বলে মনে মনে ধারণা করছিল।
এমনিভাবেই যৌনতা নৈতিকতা থেকে অথবা নৈতিকতা যৌনতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। যেমন করে ইতিপূর্বে রাজনীতি ও অর্থনীতি নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। আর নৈতিকতা তার আসল উৎস ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর চরিত্রের শেষ খুটিটিও ধুলিসাৎ হয়ে গেল।
নৈতিক পতন স্বভাবতই খুব ধীরে ধীরে ও ক্রমশ সংঘটিত হয়, আর নৈতিকতার পুঁজি সংগ্রহেও শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিবাহিত হয়ে যায়। এই কারণে রাজনীতি, অর্থনীতি ও যৌনতার নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নৈতিকতার কিছু-না-কিছু পুঁজি অবশিষ্ট থেকে গেছে, যা এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে বিকৃত ও বিপর্যস্ত হয়নি বা নিঃশেষ হয়েও যায়নি। তাই দেখে লোকেরা জাহিলিয়াতের মধ্যে অবস্থান অবস্থায়ও মনে করছে যে, নৈতিক চরিত্র আকীদা থেকে বিচ্ছ্নিন হওয়ার পরও তা জীবতি ও সক্রিয় থাকতে পারে। এ দিকে শয়তানেরাও লোকদের মনে-মগজে নানা মতাদর্শ বদ্ধমূল করে দিয়েছে।
এই কারণে তারা মনে করছে যে, রাজনীতি অর্থনীতি ও যৌনতার সাথে নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক আসলেই নেই। বরং রাজনীতি, অর্থনীতি ও যৌনতা নিছক অনৈতিক মূল্যমানের অধীন। রাজনীতি, অর্থনীতি ও যৌনতা থেকে বিচ্ছিন্ন হযে যাওয়ার পরও নৈতিকতা যথারীতি বেঁচে আছে এবং সক্রিয়ভাবেই বর্তমান রয়েছে। এই দিকে দৃষ্টি রেখে যা কিছু ঘটেছে তাকে বিপর্যয় না বলাই বরং ভালো। তার পরিবর্তে তাকে আমাদের বলা উচিত প্রগতি ও নিশ্চিত অনিবার্য প্রয়োজন। আর এই প্রগতি ও নিশ্চিত প্রয়োজন উভয়ই বড় শক্তি। তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যায় না, তা আপত্তিকর ব্যাপারই নয়। অন্যান্য জিনিসের ন্যায় তাকে কোনো মানদণ্ডে ফেলে যাচাই ওজন করা যায় না। ওটা নিজেই একটা মানদণ্ড, তার বাইরের কোনো জিনিসের সাথে তার কোনো তুলনা করা চলে না। করলে তা দেবতাদের প্রতি প্রশ্ন তোলার মতো হবে। কিন্তু দেবতারা কখন কি করে, তার ওপর কার প্রশ্ন করার অধিকার থাকতে পারে? …অতএব তার কাছে নতি স্বীকার করেই তা অকপটে মেনে নেওয়া আমাদের কর্তব্য। না, কুণ্ঠিত মনে নয়, বরং সানন্দ চিত্তেই তা গ্রহণ করা উচিত। নৈতিকতা যথারীতি পতন মুখীই থাকল। আর নৈতিকতার পতন যখন শুরু হয়, তখন তা আর থামে না, যতক্ষণ না মানুষ যিল্লতির গভীর গহবরে পৌঁছে যায়।
ইউরোপে তখন পর্যন্ত নৈতিকতার খুব সামান্য অংশই অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু শুভ মানবীয় চরিত্র সত্যতা, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, দৃঢ় চিত্ততা, নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা-প্রচেষ্টা, সাংগঠনিক যোগ্যতা, উৎপাদনে দৃষ্টিপ্রখরতা, সতর্কতা এবং পরিণতির জন্যে ধৈর্য্য সহিষ্ণুতা এবং জীবনকে সুন্দর নিখুঁত করে গড়ে তোলার জন্যে অবিশ্রান্ত তৎপরতা ও চেষ্টা সাধনা –এই এবং এই ধরনের গুণাবলী ইউরোপ থেকে এখনও চিরবিদায় গ্রহণ করেনি।
আসলে এই সব পূর্বে অর্জিত নৈতিকতার অবশিষ্টাংশ। তা নিশ্চয়ই ইউরোপ তার সাহায্যকারী বন্ধুর কাছ থেকেই পেয়েছিল। তা খ্রিষ্ট ধর্মই হোক কিংবা হোক দ্বীন-ইসলাম। অবশ্য সে নৈতিকতায় যুক্ত হয়েছে প্রাচীন রোমান ভাবধারা। তা রোমান বস্তু জগত ও বস্তুগত উৎপাদনের কাছে দক্ষতার সাথে কর্মব্যস্ত, সব কিছুকেই তারা সাংগঠনিকভাবে ও উত্তম-সুন্দর-নিখুঁতরূপে গড়ে তোলার দিকে তাদের সার্বক্ষণিক চেষ্টা-প্রচেষ্টা নিবদ্ধ।
কিন্তু সেই রোমান ভাবধারাই এই অবশিষ্ট নৈতিকতাটুকুকেও মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে।
ইতিপূর্বে হেলেনীয় (গ্রীক) ভাবধারা যেমন করে নৈতিকতার অবশিষ্টকে বিনষ্ট করে দিয়েছিল এবং আদর্শ বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে এটাকে সঠিক প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে, নৈতিকতার আদর্শ থেকে ত্যাজী বুর্জোয়ার রসাস্বাদন করয় কোনো দোষ নেই। বাস্তব জীবনে তার কোনো প্রতিফলন হোক, আর না-ই হোক। আর এ থেকেই রাজনীতির জগতে ম্যাকিয়াভেলীর দর্শন প্রচলিত হয়েছিল, অনুরূপভাবে রোমান ভাবধারাও পাশ্চাত্য নৈতিকতার অবশিষ্টাংশের ওপর দ্বিমুখী আক্রমণ করে বসেছিল।
রোমান ভাবধারা একদিকে ছিল মুনাফা সন্ধানী আর অপরদিক দিয়ে আত্মম্ভরী ও আত্মগৌরবী।
প্রাচীন রোমান জাহিলিয়াতে এ দুটি বিপর্যয় থেকেই আধুনিক জাহিলিয়াতের অবশিষ্ট নৈতিকতায় বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। ফলে গোটা নৈতিকতাই হয়ে গেছে মুনাফাবাদী, সুবিধাবাদী। প্রতিষ্ঠিত হলো আত্ম-অহংকারিতা।
হ্যাঁ, সততা, সত্যবাদিতা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা, বিশ্বস্ততা ও দৃঢ় মন-মানসিকতা এসবই নৈতিক গুণবিশিষ্ট, সন্দেহ নেই। কিন্তু তার মানদণ্ড বিভিন্ন। কোনো একটিও একক অবস্থায় মাত্রই নয়।
এই সমস্ত চরিত্রবিশিষ্ট মনুষ্যত্বের মান অনুযায়ীও হতে পারে, যেমন হওয়া বাঞ্ছনীয়, আর ধর্মের উৎস যে চরিত্রকে সব সময় সঞ্জীবিত রাখে, তাও এই মানবীয় চরিত্রই।
জাতীয় মান অনুযায়ীও চরিত্র গড়ে ওঠতে পারে। যে চরিত্র জাতীয়তার সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে যার মধ্যে মানুষ জীবন যাপন করে। পরে যখন তা জাতীয়তার সঙ্কীর্ণ সীমার –তা যত প্রশস্তই হোক –বাইরে চলে যায়, চলে যায় সর্বাত্মক মানবীয় বেষ্টনীরও বাইরে, তখন তার অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলে। আর অবশিষ্ট তাকে মুধু দাম্ভিকতা। আর তা চৌর্যবৃত্তি, ছিনতাই, ধোঁকা-প্রতারণা ও অপহরণ সর্বপ্রকারের হীন অপরাধেই জড়িত হয়ে পড়ে ও করে যেতে থাকে। করে যেতে থাকে নির্ভীক, নির্লজ্জভাবে। সে কি করছে, না করছে, তার কোনো হিসেব-নিকেশই থাকে না। সে জন্যে তাদের মনে কোনোরূপ কুণ্ঠাবোধও জাগে না। কেননা তা আসলে কোনো প্রকৃত মানবিকতাকে কেন্দ্র করে দাঁড়ায় না। পরে জাতীয়তার মান অনুযায়ী হয়েও তা এমন কোনো ভিত্তির ওপর স্থির হয় না, যার দরুন মনে করা যাবে যে, তা সাধারণভাবেই মূল্যমানসমৃদ্ধ, তা অবশ্যই মেনে চলা উচিত।
…..তা হয় না, সে নৈতিকতা থেকে নৈতিকতাবাদী অন্য কোনো লোকই কোনো নৈতিকতারই শিক্ষা বা প্রেরণা পেতে পারে না। অতঃপর অবস্থা এই দাঁড়ায় যে, যতটা ফায়দা পাওয়া যাবে বলে মনে করা যাবে, ঠিক ততটাই চরিত্র রক্ষা করে চলা যাবে। এই ফায়দা লাভের সম্ভাবনার বাইরে নৈতিকতার আর কোনো মূল্য বা অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
পাশ্চাত্যের অবশিষ্ট নৈতিকতা শুধু এতটুকুই। তা রোমান জাহিলিয়াতের উভয় বিপর্যয়ের আঘাতে চরমভাবে চূর্ণ-বিচূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে রয়েছে এবং ক্রমাগতভাবে পতনের শেষ সীমায় গিয়ে পৌঁছেছে।
ক্রুসেড যুদ্ধে মুসলমানদের যখন খ্রিষ্টানপন্থীদের সাথে যোগাযোগ ও আদান-প্রদান চলছিল –বিশেষ করে মুসলিম সেনাধ্যক্ষ সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর সময়ে –তখন মুসলমানরা নিজেদের ওয়াদা পূরণ করতে, কৃত কোনো চুক্তি ভঙ্গ করতেই তাঁরা অস্বীকার করত, এমন কি চরম প্রয়োজন পরিবেষ্টিত অবস্থাও। ওপরন্তু সে চুক্তি ভঙ্গ করতেই যখন ফায়দা ও লাভ পরিলক্ষিত হতো, তখনও তারা প্রকৃত নৈতিকতার উচ্চতর নিদর্শন তুলে ধরতেন। কেননা তাঁদের এ চরিত্র ছিল তার প্রকৃত ও আসল রূপে, এবং তা আল্লাহর প্রদর্শিত পথ দ্বীন-ইসলাম থেকেই সরাসরিভাবে গৃহীত ছিল। এ পর্যায়ে কুরআনের বিধান হচ্ছেঃ
(আরবী*****************************************************************)
তুমি যদি কোনো জনগোষ্ঠীর প্রতি বিশ্বাসভঙ্গের কোনো আশংকা বোধ করো –ভয় পাও –তাহলে (তাদের সাথে কৃত চুক্তি) তাদের মুখের ওপর নিক্ষেপ করে দিয়ে সমান অবস্থানে দাঁড়িয়ে যাও। কেননা আল্লাহ বিশ্বাস ভঙ্গকারীদের আদৌ ভালোবাসেন না। (সূরা আনফালঃ ৫৮)
তার অর্থ বিশ্বাসঘাতকতার ভয় থাকলেও চুক্তি বিরোধী কাজ করে বিশ্বাস ভঙ্গ করা বা বিশ্বাস ভঙ্গ করে চুক্তি বিরোধী কাজ করাও ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেননা তা করলে শত্রুপক্ষ ঘোষণা করবে যে, মুসলমানদের বিশ্বাসঘাতকতার ভয় থাকলেও চুক্তি বিরোধী কাজ করে বিশ্বাস ভঙ্গ করা বা বিশ্বাস ভঙ্গ করে চুক্তি বিরোধী কাজ করাও ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেননা তা করলে শত্রুপক্ষ ঘোষণা করবে যে, মুসলমানদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলেই চুক্তি শেষ হয়ে গেছে। তা কোনোক্রমেই বাঞ্ছনীয় নয় বরং উক্তরূপ অবস্থায় মুসলমানদেরই প্রকাশ্য ভাবে ঘোষণা করে দেওয়া উচিত যে, না, কোনো চুক্তিই নেই। শত্রুপক্ষের বিশ্বাসঘাতকতার দরুণই চুক্তি শেষ হয়ে গেছে। এখন উভয় পক্ষের সম্পর্কের একটি মাত্র দিক এবং তা হচ্ছে যুদ্ধ। তাহলে ধোঁকাবাজির কোনো অভিযোগ উঠবে না। …আসলে ইসলামের দুশমনরা তো ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসেরও শত্রু। এ জন্যে মুসলমানদেরকে বড় বেশি মূল্য দিতে হয়।
খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের সাথে কৃত সব চুক্তি যখন ভঙ্গ করছিল এবং সম্পূর্ণ ধোঁকাবাজি করে মুসলমান পুরুষ-নারী-শিশুকে নির্মম জঘন্য হিংস্রভাবে হত্যা করছিল হাজার হাজার সংখ্যায়, তখনকার এই বীভৎস কার্যকলাপ কেবল ইউরোপীয় মন-মানসিকতাই হয়ত বরদাশত করে নিতে পেরেছে। মুসলিমদের কাছে মসজিদ আল্লাহর ঘর, পবিত্র, হারাম ও নিরাপত্তাপূর্ণ। হাজার হাজার মুসলিম তথায় প্রাণভরে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের হাতে না ছিল কোনো অস্ত্র, না ছিল আক্রমণ প্রতিহত করার কোনো প্রস্তুতি। কিন্তু এরূপ অবস্থায়ও খ্রিষ্টানরা মসজিদে প্রবেশ করে মুসলমানদের হত্যা করেছে। তাতে এত বেশি রক্তপাত করেছে যে, আক্রমণকারীদের ঘোড়ার পা গোড়ালী পর্যন্ত রক্তে ডুবে গেছে। কিন্তু পরবর্তীতে অবস্থার মোড় যখন ঘুরে গিয়ে মুসলমানরাই খ্রিষ্টানদের ওপর বিজয়ী হয়ে উঠলেন, তখন তাঁরা কোনোরূপ হিংস্রতারই প্রশ্রয় দিলেন না, তাঁরা বিজিত সেই রক্তপাতকারী খ্রিষ্টানদের সাথে ঠিক মানবীয় মান অনুযায়ী আচরণ গ্রহণ করলেন। অথচ এরাই ছিল একটু পূর্বে মুসলমানদের সাথে চরম অমানুষিক শত্রুতাকারী। মুসলমানরা যখন তাদের সাথে অতীব উন্নতমানের নৈতিকতার নিদর্শন কায়েম করেছিলেন, যা একান্তই মানবতাভিত্তিক। কেননা তাঁরা তো আল্লাহর ওহী ভিত্তিক চরিত্রের অনুসারী ছিলেন, তাঁরা জীবন যাপন করত আল্লাহর দেওয়া বিধান অনুযায়ী।
কিন্তু ইউরোপীয় জাহিলিয়াত আল্লাহর ইবাদত থেকে বিপথগামী, বিকৃত ও বিপর্যস্ত। তাই তারা কোনো দিনই তাদের সমস্ত ইতিহাসের কোনো একটি অধ্যায়েও সেই মানের আচরণ গ্রহণ করতে পারেনি। কেননা তাদের চরিত্রে সেই উন্নত মৌল উৎস থেকে গৃহীত ও তা থেকে শক্তি সমর্থন গ্রহণকারী ছিল না। বিকৃত বিপর্যস্ত জাহিলিয়াতের ভাবধারা তাদের রক্ত মাংসে মিলে-মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল, এই জাহিলিয়াতের প্রভাবই তাদের ওপর ক্রমবর্ধমান মাত্রায় প্রতিফলিত হচ্ছিল। আর তা শক্তি ও প্রেরণা গ্রহণ করছিল গ্রীক জাহিলিয়াত ও রোমান জাহিলিয়াত থেকে। এ দুটি ছিল তাদের ওপর অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তারকারী।
প্রাচীন রোমান ভাবধারা প্রখ্যাত রোমান আইনে পুরামাত্রায়ই প্রতিফলিত ছিল। সে আইন ন্যায়পরতা ও সুবিচার কেবলমাত্র রোমানদেরই প্রাপ্য, সেখানে সুবিচার পাওয়ার কোনো অধিকার রোমান ছাড়া অন্যদের জন্যে ছিল না। আসলে তা-ইহচ্ছে আমিত্ব ভাবধারা, যা আধুনিক জাহিলিয়াতের অধীন ইউরোপীয় নৈতিক চরিত্রের ওপর প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করেছিল। ফলে চরিত্র কেবলমাত্র জাতীয়তার চতুঃসীমার মধ্যেই আচরিত হতো। তার বাইরে তা যেমন কিছুমাত্র অবলম্বিত ও আচরিত হতো না, তেমন তা রক্ষিতও হতো না। সব চারিত্রিক রীতিনীতি তলায় হারিয়ে যেত। তবে এটি মাত্র অবস্থায় তা হয়ত পরিলক্ষিত হতো। তা হলো স্বার্থ ও বৈষয়িক মুনাফা লাভের সুযোগ-সুবিধা। এই সুযোগ-সুবিধা ও স্বার্থের কারণে জাতীয়তার সীমার বাইরেও হয়ত ভালো ভালো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ছিটেফোটা লক্ষ্য করা যেত।
রাজনীতির ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের চরিত্র কি, তা দুনিয়ার কারোরই অজানা নয়। চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, আর যে-মুহুর্তে জাতীয় স্বার্থে কোনো পরিবর্তন সূচিত হয়ে গেল, অমনি সে সব চুক্তিই বাতিল হয়ে গেল। এরূপ অবিশ্বাসসুলভ আচরণ গ্রহণের পরও তাদের মধ্যে কোনো লজ্জা-শরমের উদ্রেক হতে দেখা যায়নি। মনে হয়, যেমন কিছুই হয়নি। কেননা গ্রীক জাহিলিয়াতের দৃষ্টিতে মতাদর্শ ও বাস্তব কাজের অভিন্ন বা পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া কিছুমাত্র জরুরী নয়।
তাদের এরূপ চরিত্র কেবলমাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রেই যে দেখা গেছে, তা নয়; জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাদের অনুরূপ চরিত্র দেখা গেছে। মুসলমানগণ যত দেশই দখল করেছিলেন, যেখানকার অধিবাসীরা ভিন্ন আকীদায় বিশ্বাসী ছিল, তা সত্ত্বেও তাদের পর্ণূ সংরক্ষণ ব্যবস্থার অধীন সে অমুসলিমদের আকীদা পূর্ণ মাত্রায় সংরক্ষিত হয়েছে। কোনো অমুসলিমের ধর্ম পালনে একবিন্দু ব্যঘাত সৃষ্টি করা হয়নি। তাদেরকে মুসলিম বানাবার জন্যে কখনোই কোনো অবৈধ কৌশল অবলম্বন করা হয়নি। কেননা মহান আল্লাহ তা’আলা দ্বীন-ইসলামের মাধ্যমে তাদেরকে এই নীতিই শিক্ষা দিয়েছেন।
কিন্তু পাশ্চাত্য চরিত্রের নিদর্শনাবলী আমাদের সম্মুখে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র পেশ করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ইংলিশ জাহাজ কোম্পানীসমূহে আফ্রিকারই মুসলমানরা কর্মচারী নিযুক্ত ছিল। কিন্তু ইংরেজ কোম্পানী তাদের মুসলিম থাকাকে বরদাশত করতে আদৌ প্রস্তুত ছিল না। কোম্পানী মুসলমান কর্মচারীদের বেতনের একটি অংশ মদের বোতল হিসেবে দিতে শুরু করল। মজুরী ও বেতনদান পর্যায়ে এটা ছিল একটি ভিন্ন প্রকৃতির পারিশ্রমিক দান।
মুসলমানদের ঈমান হচ্ছে, মদ্যপান ও মদ্য ব্যবসায় উভয়ই সম্পূর্ণ হারাম। এই কারণে তারা মদের বোতল ভেঙ্গে ফেলতে ও অবশিষ্ট নগদ প্রাপ্ত অর্থ দ্বারা জীবিক চালাতে বাধ্য ছিল।
জনৈক আইনবিদ এই অসহায় মুসলিমদের উপদেশ দিল যে, মদের বোতলকে বেতনের মধ্যে গণ্য করতে অস্বীকার করা হোক। তা সত্ত্বেও কোম্পানী যদি এইভাবেই বেতন দেওয়ার নীতিতে অবিচল থাকে তা হলে কোম্পানীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে হবে। কিন্তু কোম্পানী টের পেয়ে আগে-ভাগেই এসব মুসলমান কর্মচারীদের চাকুরী খতম করে দিল।
এ-ই হচ্ছে পাশ্চাত্য চরিত্রের অতীব উন্নতমানের প্রদর্শনীঃ ফ্রান্সের লোক অপেক্ষাকৃতভাবে অধিক চতুর –সচেতন ও সভ্য। প্যারিসের অধিবাসীরা যদি খুবই বিনয়, প্রাণোচ্ছলতা ও শালীনতা সহকারে আপনাকে সম্ভাষণ জানায় এবং আপনার প্রতি খুব বেশি সহৃদয়তা ও অনুগ্রহ প্রকাশ করে, তা হলে আপনাকে বুঝতে হবে, এসবের আসল অর্থ, আপনি যেন ফ্রান্সে সাধ্যমত অর্থ ব্যয় করেন।
কিন্তু আপনি যদি অর্থ ব্যয় করতে অসমর্থ হন, তাহলে কি হবে? …শুনুন! একজন মিসরীয় যুবক আমাকে বলেছে –সে কিছুকাল ফ্রান্সে অতিবাহিত করেছে। কিন্তু সে মদ্যপানে ও অবাঞ্ছিত স্থানসমূহে যেতে অভ্যস্ত ছিল না। এমন কি হোটেলে কর্তৃপক্ষ যদি তার কক্ষে যৌনস্পৃহা চরিতার্থ করার ‘সামগ্রী’ পৌঁছাত, তা হলেও সে তা গ্রহণ করতে এবং তা দিয়ে ‘স্বাদ’ আস্বাদন করতে রাজি হতো না। এই কারণে হোটেল পরিচালকরা তার সাধারণ ব্যবহার্য দ্রব্যাদির মূল্য অনেক বেশি করে ধার্য করতে শুরু করল। এ ছাড়াও তাকে নানাভাবে ও উপায়ে উত্যক্ত করতে লাগল। উদ্দেশ্য ছিল, সে যেন হোটেল ত্যাগ করে চলে যায়।
এই প্রেক্ষিতে বলা যায়, বাস্তব অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত যে, জাতীয়তার সীমার বাইরে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের যে অন্যান্য বিশ্বস্ততা সহকারে আচরণ করা হয়, তার মূলে কোনো ঈমানদারী নিহিত নেই, আছে মুনাফা লাভের অত্যধিক লোভ।
কেননা ধোঁকাবাজি করলে তা বাজারই নষ্ট হয়ে যাবে। এ কথা তারা ভালো বুঝে। মুনাফার পরিমাণ কম হোক, এটা তারা চায় না। তার অর্থ বিপুল পরিমাণ মুনাফা লাভের লোভই পারস্পরিক কার্যকলাপ ও লেনদেন ইত্যাদিকে ঈমানদারী দেখাতে তারা বাধ্য হয়। নৈতিকতার এই মুনাফাভিত্তিক ব্যাখ্যা কেবলমাত্র বৈদেশিক ব্যবসায়-বাণিজ্য ও লেন-দেনের ক্ষেত্রেই নয়, ক্রমশ অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে –নিজেদের দেশের ও স্বজাতীয় জনগণের সাথেও পারস্পরিক কার্যাবলীর মূল প্রেরণা ঠিক তাই হয়ে ওঠে। তার অর্থ, নৈতিকতা প্রথম মানবীয় মান থেকে বিচ্যুত হয়ে জাতীয় মানদণ্ডে উত্তরিত হলো। …পরে জাতীয়তার মান থেকে বিচ্যুত হয়ে পারস্পরিক লেন-দেনের মুনাফায় পরিণত হলো।
জাতীয় সংগঠনের সততা খুবই কল্যাণকর প্রমাণিত হয়েছে। আপনি সত্য বললে অন্যদের প্রতিও আশা করতে পারেন যে, তারাও সত্য বলবে, এ কারণে নয় যে, সত্য বলা মূলতই কোনো ভালো কাজ। বরং এ জন্যে যে, সত্য বলে আপনি নিজেও লাভবান হবেন, অন্যরাও লাভবান হবে। সত্য বলে তো আপনি অনেক শ্রম, বিপুল ধন-সম্পদ ও সময় বাঁচাতে পারেন। আর এসব শক্তিকে আপনি আরও অধিক উপার্জনে লাগাতে পারেন।
কিন্তু সততা ও সত্যবাদিতা দিয়ে যদি কিছুই উপার্জন করা না গেল কিংবা সত্যবাদিতা রক্ষা করতে গেরে যদি ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় আর্থিক ও অন্যান্যভাবে, তা হলে সে সত্যবাদিতার কি মূল্য থাকতে পারে? কোন আকর্ষণে বা প্রেরণায় মানুষ সত্য বলবে?
আর একজন মিসরীয় আমাকে বলেছে যে, সে আমেরিকায় বহুদিন অবস্থান করেছে।
বলেছে, আমি এক রবিবাসরীয় স্কুরে একজন শিক্ষয়িত্রীর কাছে ইংরেজী ভাষা শিখছিলাম। যখন আমাদের মধ্যে পরিচিতি ঘনীভূত হলো এবং শিক্ষয়িত্রী জানতে পারল যে, আমি একজন দ্বীন-অনুসরণকারী মুসলমান, তখন সে বলতে লাগল, আমি ইসলাম সম্পর্কে এমন কিছু কথা জানি যে, সেই ইসলামের কারণে লোকেরা তোমার প্রতি ঘৃণাবোধ করবে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলল, তোমাদের নবী মুহাম্মদ একবার মদ্য পান করল, নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ল এমনভাবে যে, নিজেকে সে সামলিয়ে রাখতে পারল না। ফলে সে পড়ে গেল। এই সশয় একটি শুকুর এসে তাকে কামড়ায় (নাউজুবিল্লাহ)। এই কারণে সে শুকর ও মদ্যপান হারাম করে দিয়েছে।
আমি বললাম, এখন তো আপনি প্রকৃত সত্য কথা জেনে গেছেন। এখনও কি আপনি ছাত্র-ছাত্রীদের এসব মিথ্যা কথা পড়াবেন?
সে বলল, সেটা একটা স্বতন্ত্র ব্যাপার। আসলে এসব কথা শিক্ষাদানের জন্যেই তো আমাকে বেতন দিয়ে রাখা হয়েছে। আর এই আয় দিয়েই তো আমার খাওয়া-পরা চলে।
নৈতিকতা যেহেতু তার আসল উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এবং গ্রীক ও রোমান জাহিলিয়াতের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নবতর জাহিলিয়াতে এসে তার সমস্ত সঞ্চয় সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছে, তাই এক্ষণে কোনোরূপ আঘাত বরদাশত করা সে নৈতিকতার পক্ষে সম্ভব থাকেনি।
পাশ্চাত্য নৈতিকতার দ্বারা দুনিয়ার মানুষ নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছে। কেননা তারা দেখতে পায়, রাজনীতি, অর্থনীতি ও যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও নৈতিকতা স্বস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু লোকেরা এই নৈতিকতায় নিহিত মুনাফা লোভ ও আত্মঅহংকারকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। বলতে গেলে তা তাদের অগোচলেই রয়ে গেছে। তাই তারা মনে করে নিয়েছে যে, নৈতিকতা তার মূল ধর্মীয় উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েও বাস্তব জগতে জীবন্ত ও সক্রিয় হয়ে থাকতে পারে। আর যে সব ব্যাপার নৈতিকতা থেকে সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছে, তা মূলতই তার সাথে সম্পর্কিত ছিল না। সেগুলো এমনিভাবে চিরকাল থেকে যাবে। রাজনীতি অর্থনীতি ও যৌনতা যতই বিপর্যস্ত হোক-ন-কেন অথবা বলা যায়, যতই বিবর্তিত কিংবা স্বতঃসিদ্ধের অধীন হয়ে থাক-না-কেন আর বস্তুবাদী ও মুনাফা লোভ সংক্রান্ত ভাবধারা জনগণকে যতই আয়ত্তাধীন করে নিক-না-কেন।
আসলে সমস্ত বিপদ নিহিত –প্রচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে নৈতিকতার ধীর গতিতে ও ক্রমশ অধপতনগামী হওয়ার মধ্যে। তারই কারণে লোকেরা মনে করে বসে যে, না, নৈতিকতার ক্ষেত্রে কোনো পতন বা অধোগতিই হচ্ছে না।
এ পর্যায়ে আমরা যে সব দৃষ্টান্ত উল্লেখ করব, তা ফ্রান্স থেকেই শুরু করছি। ফ্রান্সে যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে নৈতিকতার বিপর্যয় এমনভাবে সংক্রমিত হচ্ছিল যে, মনে হচ্ছিল কোনো পাকা অস্থির ভিতরকার মজ্জা খেয়ে ফেলছে। শেষ পর্যন্ত যখন যুদ্ধ হল, তখন সমগ্র ফ্রান্স যৌনতার পংকিলতার গহবরে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিল। তারই ফলে ফ্রান্স মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই যুদ্ধের পরাজয় বরণ করে নিতে বাধ্য হলো। ফ্রান্সের কাছে অস্ত্র ছিল না, সে কারণে এই পরাজয় বরণ করা হয়নি। বরং অত্যাধুনিক ও মারাত্মক ধ্বংসাত্মক অস্ত্র-শস্ত্র তো ফ্রান্সের কাছেই ছিল। ম্যাজিনো লাইনের দুর্গ অবরোধ একটি বিখ্যাত ব্যাপার ছিল। কিন্তু ফ্রান্সের জনগণের মধ্যে যদ্ধ করার উদ্বোধনী শক্তি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, তার এমন কোনো মর্যাদাও ছিল না, যা রক্ষার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করার তাগিদ তাদের মনে জেগে উঠবে; বরং ফ্রান্স থর থর করে কাঁপছিল এই ভয়ে যে, জার্মানীর বোমা বর্ষণের ফলে প্যারিসের নৈশ ক্লাব ও নৃত্যালয়সমূহ ধ্বংস হয়ে না যায়! এই কারণেই দুই সপ্তাহ সময় অতিবাহিত হওয়ার আগেই ফ্রান্স পরাজয় বরণ ও অস্ত্র সংবরণ করতে বাধ্য হলো। তখন লোকেরা বলতে লাগল, এ তো অবস্থার অনিবার্য পরিণতি। এর সাথে নৈতিকতার দূরতম সম্পর্কও নেই।
অতঃপর আমেরিকার দৃষ্টান্ত দিচ্ছিঃ জর্জ কেনেডী ১৯৬২ সনে এক গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতিতে বলেছিল, আমেরিকার ভবিষ্যৎ বিপদাপন্ন, কেননা নব্য যুবকরা যৌন-চর্চার, পংকিলতায় এত বেশী নিমজ্জিত যে, তারা নিজেদের দায়িত্বের বোঝা বহন করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে। সামরিক বাহিনীতে যোগদান করার জন্যে আসা প্রতি সাতজন যুবকের মধ্যে ছয় জনই ব্যর্থকাম হয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায়। কেননা যৌন লালসা-কামনা তাদের দৈহিক স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থাকে সাংঘাতিকভাবে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে।
এতদাপেক্ষা ও অধিক ভয়াবহ ও নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত হচ্ছেঃ আমেরিকার বৈদেশিক মন্ত্রণালয় তার ৩৩ জন কর্মচারীকে বহিষ্কৃতি করেছে শুধু এজন্যে যে, তারা যৌনতার ক্ষেত্রে চরমবাবে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েছিল। আর এই কারণে সরকারী গোপনীয়তার সংরক্ষণের দিক দিয়ে তারা নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হচ্ছিল না।
ইংল্যাণ্ডের দৃষ্টান্ত দেখুন! ইংল্যাণ্ডের যুদ্ধমন্ত্রী প্রুফেমো একটি বেশ্যার সাথে যৌন সম্ভোগে লিপ্ত হওয়ার কারণে সরকারের যুদ্ধ সংক্রান্ত গোপন তত্ত্বকে বিপদাপন্ন করে দিয়েছিল।
রাশিয়ার কথা…..?
ক্রুশ্চেভও কেনেডীর মতোই ১৯৬২ সনে বিবৃতি দিয়ে বলেছিল, রাশিয়ার ভবিষ্যৎ বিপদাপন্ন। কেননা রাশিয়ার যুবকের ভবিষ্যতের ওপর কোনো আস্থা স্থাপন করা যায় না। আর তার কারণ হচ্ছে, তারা যৌন স্বাদ-আস্বাদনে গভীরভাবে নিমগ্ন হয়ে আছে।
পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহের অবস্থাও ভিন্নতর কিছু নয়। যদিও দেশগুলো অধিকতর উন্নত এবং আধুনিক জাহিলিয়াতের দিক দিয়ে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক অগ্রসর।
এ সব দেশের যুবকরা বিভ্রান্ত, দিশেহারা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যহীন। চরস ও আফিম পান করে বুঁদ হয়ে থাকাই অভ্যাস। পাগলামী করেই নিজেদের সকল শক্তি ক্ষয় করছে। লুটপাট, নরহত্যা ও নারীহরণকারী দলে সংগঠিত। এসব দেশে সরকার ও সমাজ-বিদ্যায় পারদর্শীদের উদ্বেগের শেষ নেই।
এই সবকিছু কেবলমাত্র যৌন উচ্ছৃঙ্খলতার কারণেই। আর এ পর্যন্তই সমস্যা সীমিত নয়। শংকট যেন নিম্নমুখী পিচ্ছিল পথে তরতর করে নেমে যাচ্ছে।
আমেরিকার বড় বড় সুসভ্য (?) লোকদের সমিতি সংগঠন রয়েছে। আইনজীবী, চিকিৎসাবিদ, লেখক ও আইন পারদর্শী ব্যক্তিবর্গ এসব সমিতিতে শামিল রয়েছে। এসব সমিতি কি কাজে লিপ্ত?
লোকদেরকে ব্যভিচার কাজে সহযোগিতা করাই এ সব সমিতির কাজ! কেননা ক্যাথলিকপন্থী রাজ্যগুলোতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ততক্ষণ পর্যন্ত তালাক সংঘটিত হতে পারে না, যতক্ষন না উভয়ের মধ্যে কোনো একজন ব্যভিচারে লিপ্ত হচ্ছে, কেবল তখনই অপর জন তালাক চাইতে পারে।
এই উদ্দেশ্যে যে তালাক চাইবে –স্বামী বা স্ত্রী –সে এসব সমিতির সহযোগিতা গ্রহণ করে। এসব সমিতি কোনো না কোনোভাবে স্বামী বা স্ত্রীকে ব্যভিচারের কাজে লিপ্ত করে। আর সেই অবস্থায় তার কাছ থেকে তালাক লওয়ার সমস্ত জরুরী কাগজপত্র তৈরি করে দেয় এবং এ কাজের জন্যে নির্দিষ্ট ফি আদায় করে নেয়।
এই আমেরিকাতেই যুবতী মেয়ে বিক্রয়ের ব্যবস্থাকারী বহু সংগঠন কাজ করছে। এ সব দলের লোকেরা মেয়েদের ধরে নিয়ে ইউরোপের অপরাপর দেশে ক্রয়-ইচ্ছুক ধনশালী ব্যক্তিদের কাছে বিক্রয় করে দেয়। সেখানে তারা ক্রয়কারীদের লালসার অগ্নিকুণ্ডে আত্মহুতি দিতে বাধ্য হয়। ওসব সংগঠন এভাবে বিপুল অর্থ লাভ করে থাকে।
এসব সংগঠনই আবার গণতান্ত্রিক নির্বাচনসমূহে বিরোধী পক্ষের লোকদেরকে প্রকাশ্যভাবে হুমকি দেয়। প্রয়োজন হলে হত্যা কাণ্ড ঘটাতেও পিছ-পা হয় না। এ কাজের বিনিময়েও তারা বিরাট অংক অর্জন করে থাকে।
অধঃপতনের সীমা এখানে এসেই শেষ হয়ে যায়নি…..।
ইউরোপের নতুন বংশের যুবকরা যৌনতার ক্ষেত্রে পরম উদারনৈতিকতার নীতি গ্রহণ করেও অধঃপতনের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। লুটপাট, ছিনতাই ও নারী হরণের কাজে লিপ্ত অসংখ্য সমিতি সংগঠিত হয়ে আছে ও অবাধে কাজ করে যাচ্ছে।
বালকদল চলমান রেলগাড়ীর দরজা-জানালার ওপর পাথর নিক্ষেপ করে। আরও রয়েছে চরস, ভাঙ ও আফিম সংগ্রহকারীদের দল। যানবাহনে চড়ে তারা ভাড়া না দেওয়ার কাজেও তারা কম পটু নয়।
এক কথায়, খারাবীর যত নিকৃষ্টতম ব্যাপার মানুষ কল্পনা করতে পারে, তা আজকের সমগ্র পাশ্চাত্য জগতের সর্বত্র ব্যাপক হয়ে রয়েছে।
তবু বলতে হয়, বিপর্যয় গোটা নৈতিকতাকে এখনও সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করতে পারেনি। ..এখনও কিছু না কিছু ভালো দিক অবশিষ্ট আছে …এসবের ওপর নির্ভর করে –আল্লাহর ইচ্ছা হলে –সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ার পূর্বে ইউরোপ নবতর জাহিলিয়াতের অধীন আরও দু-একটি বংশ-কাল হয়ত অতিবাহিত করতে পারবে। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, ইউরোপ কোন দিকে যাচ্ছে! ….উন্নতির দিকে, না অধঃপতনের দিকে? ….মঙ্গলের দিকে, না চরম ধ্বংসের দিকে?…
প্রথম দিকে তো লোকেরা এসব আগত বিপদকে তেমন আমল দেয়নি। এ সব গুরুত্ব স্বীকার করতেই রাজি হয়নি। হাসি-ঠাট্টা করতে করতে নিজেদের মাথা বালুর স্তুপের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বড় গলায় বলেছে, দুনিয়া শনৈঃ শনৈঃ উন্নতির দিকে যাচ্ছে।
আর এদিকে বুদ্ধি-বিবেচনা ও জ্ঞানসংস্কৃতির প্রদর্শকরা ও উন্নতির মানদণ্ডে উত্তীর্ণ লোকেরা বলতে শুরু করেছেঃ
পূর্ববর্তী বংশের তুলনায় এখনকার নতুন বংশ অনেকটা উত্তম। এখনকার বংশ সাহসী, খোলা মনের ধারক, প্রগতিশীল এবং সমসাময়িক বিবেকের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে চলছে। এ উন্নয়নশীল বংশের লোকদের প্রসঙ্গে পশ্চাতবর্তী বংশের বুদ্ধি বিবেক দ্বারা কোনো সিদ্ধান্তই গ্রহণ করা যেতে পারে না। আমাদের নৈতিকতার জীবনের নবতর অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। কিন্তু নতুন বংশ নিজেদের নিত্য নতুন পরিবর্তিত অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিজেরাই নিজেদের চরিত্র রচনা করে চলেছে। যারা তা দেখে চিৎকার করছে, ভয়-ভীতির কথা বলছে, তারা নিজেদের নিষ্ক্রিয়তা, স্থবিরতা ও পশ্চাদপদতার কারণে অবস্থাকে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে পারে না।
কিন্তু এর পরও আধুনিক সভ্যতার হর্তাকর্তা ইউরোপ-আমেরিকা থেকেই সংবাদ পাওয়া গেছেঃ
ইউরোপ-আমেরিকা সে সব গোলামের মুখে যেন লাগাম লাগিয়ে দেয়, যারা বিবেক-বুদ্ধি, সংস্কৃতি ও উন্নতির মান সম্পর্কে বড় গলায় বলে বেড়ায়ঃ ওসব দেশে নব্য যুবকদের চারিত্রিক বিপর্যয় সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার জন্যে বেশ কতগুলো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাতে পূর্ণ নির্ভরতা ও সত্যবাদিতার ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরী হয়েছে যে, অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। নব্য বংশের ছেলে-মেয়েরা বিপর্যয় ও অধঃপতনের করাল গ্রাসের মুখে পড়ে গেছে। ভবিষ্যতে তারা জাতিকে নেতৃত্ব দিতে পারবে –তাদের প্রতি সে ভরসা কিছুতেই করা যায় না। পাশ্চাত্য জগত আজ ব্যাপক ধ্বংসের মধ্যে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
অ-মানবীয় চিন্তা বাদ দিলেও (অমানবীয় এ জন্যে যে, তাতে মানবতার সম্মুখবর্তী বিপদ সম্পর্কে চিন্তাই করা হয়নি, কেবল জাতীয়তার গতির মধ্যে থেকেই চিন্তা করা হয়েছে) –নবতর জাহিলিয়াতের নৈতিক বিপর্যয়ের কথা সম্পূর্ণ বাদ দিলেও –আমরা বলব, নৈতিকতার এতটা অধঃপতন গোটা মানবতারই সম্পূর্ণ ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আগাম নিদর্শন ছাড়া আর কিছুই নয়।
সমগ্র মানবতার ধ্বংস এজন্যে যে, পাশ্চাত্যের আধুনিক জাহিলিয়াতের তথাকথিত নৈতিকতার সংক্রামক ব্যাধির মতো সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। কেননা নৈতিকতা যখন তার আসল উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, আল্লাহর প্রতি প্রকৃত বিশ্বাসের সাথে যখন তার কোনোই সম্পর্ক অবশিষ্ট থাকল না এবং আকীদা-বিশ্বাসের বিকৃতি যখন নৈতিকতার ক্ষেত্রে পূর্ণ মাত্রায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, তখন না নৈতিকতা টিকতে পারল, না বেঁচে থাকতে পারল, না এরূপ অবস্থায় তার পক্ষে বেঁচে থাকা কোনোক্রমেই সম্ভবপর হতে পারে। ইউরোপীয় চরিত্রের যে ইমারতটি কয়েক শতাব্দী কাল ধরে নির্মিত হয়েছিল, তা মাত্র বিগত দুটি শতাব্দীতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে।
বর্তমানের নবতর জাহিলিয়াতের দুই চারটি সৌন্দর্য বা ভালো দিক তার জীবনের শেষ শ্বাস-প্রশ্বাসের সহায়ক হয়ে আছে মাত্র। এই দু-চারটি সৌন্দর্যও ক্রমশঃ বিলীয়মান। নতুন বংশ পূর্বের বংশাবলীর তুলনায় অনেক বেশী বিপর্যস্ত। এ বংশের চারিত্রিক বন্ধনহীনতা অনেক বেশি উদারনৈতিক। তার অর্থ, বর্তমানের তুলনায় ভবিষ্যৎ অধিক ভয়াবহ হয়ে দেখা দেবে। নৈতিকতার গাড়ি অধঃপতনের নিম্নগামী সড়কে দ্রুতগতিতে রসাতলের দিকে চলে যাবে।
ইতিমধ্যেই তার লক্ষসমূহ প্রকটতর হয়ে উঠেছে। এখন যদি বলাও হয় যে, অমুক অমুক ব্যাপারের সাথে নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক নেই, তবু তাতে কোনো লাভ নেই।
রাজনীতি নৈতিকতাবিহীন হয়ে গেছে, অর্থনীতির কোনো সম্পর্ক অবশিষ্ট নেই নৈতিকতার সাথে। আর যৌনতা যে নৈতিকতার সাথে সম্পর্কিত কোনো ব্যাপার, তা আদৌ স্বীকৃতই হচ্ছে না। নৈতিকতার দেউলিয়াত্বের এ ছিল সূচনা কাল।
অতঃপর নৈতিকতার বাহনটি যে ক্রমাগতভাবে ও দ্রুততা সহকারে অধঃপতনের দিকে নেমে গেছে …তার পতনমুখী গতি যে তীব্র থেকেও তীব্রতর হচ্ছে, তাকে ঠেকাবার আর কেউ কোথাও নেই।
আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী হওয়া আধুনিক জাহিলিয়াতের চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যাওয়ার এটাই হচ্ছে আসল কারণ।
মনুষ্যত্বের দেহ কাঠামোতে লেগে থাকা খুন অস্থিমজ্জা সবই খেয়ে ফেলেছে নীরবে, সকল লোক চক্ষুর অন্তরালে বাইরে থেকে দেহকে সুস্থ-সবলই দেখাচ্ছিল, ভেতরে ঘুন ধরেছে, তা বোঝার কোনো উপায়ই ছিল না গোটা দেহকে খেয়ে জীর্ণশীর্ণ করে দিয়েছে, এক ফোঁটা রক্তও অবশিষ্ট নেই। ফলে গোটা দেহই এখন ধুলিসাৎ হওয়ার উপক্রম। কিন্তু এতদসত্ত্বেও জাহিলিয়াত বিশ্বজনতার মনে এই প্রত্যয় সঞ্চার করতে চায় যে, জাহিলিয়াতের সৌন্দর্য মাহাত্ম্যের কোনো শেষ নেই, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অক্ষয় ..এক শ্রেণীর বোকা লোক বুঝে শুনে কিংবা না বুঝে শুনেই তা বিশ্বাস করে যাচ্ছে।