তৃতীয় অধ্যায়ঃ ইসলামী আন্দোলনের সাফল্য
আল্লাহর দ্বীনের বিপরীত মতাদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত আন্দোলনের মৌলিক পার্থক্য সর্বত্রই সুস্পষ্ট। এই পার্থক্যের সূচনা হয় উভয় বিধ আন্দোলনের ধারক বাহকদের আকিদা বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে দু’টি বিপরীতমুখী ধারণা ও বিশ্বাস আল্লাহর পথের আন্দোলন ও তাগুত বা গায়রুল্লাহর পথের আন্দোলনকে পরিপূর্ণরূপে দু’টি ভিন্ন খাতে পরিচালিত ও প্রবাহিত করে থাকে। এই পার্থক্য যেমন সূচিত হয় উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারনের ক্ষেত্রে তেমনি পার্থক্য সূচিত হয় কর্মসূচি গ্রহণের ক্ষেত্রেও। পার্থক্য সূচিত হয় কর্মপদ্ধতি ও কর্মকৌশলের ক্ষেত্রেও। এভাবে আন্দোলনের চূড়ান্ত ফলাফল সফলতা ও ব্যর্থতার ক্ষেত্রে ও অনৈসলামিক আন্দোলন ও ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে রয়েছে আকাশ পাতাল পার্থক্য।
ইসলামী আন্দোলন যার জন্যে, যার নির্দেশে, এই সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ণয় করতে হবে তার দেয়া মানদণ্ডেই। ইসলামী আন্দোলন আল্লাহর পথের আন্দোলন, আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের আন্দোলন, আল্লাহর নির্দেশ পালনের আন্দোলন। সুতরাং এর সাফল্যের সংজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে তাঁর কাছ থেকেই। তিনি সূরায়ে সফের মাধ্যমে আল্লাহর পথে মাল দিয়ে জান দিয়ে জিহাদের যে নির্দেশ দিয়েছেন তা তো আখেরাতে আজাবে আলীম থেকে, কষ্টদায়ক শাস্তি থেকে বাঁচার উপায় হিসেবেই দিয়েছেন। অতঃপর এই কাজের দুটো প্রতিদানের কথা উল্লেখ করেছেন।
এক:
يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ [الصف : 12]
আল্লাহ তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন এবং এমন জান্নাতে স্থান দেবেন যার পাদদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হবে। সদা বসন্ত বিরাজমান জান্নাতে উত্তম ঘর তোমাদের দান করা হবে। এটাই হলো সবচেয়ে বড় সাফল্য। (আস সফ:১২)
আল্লাহ পাকের এই ঘোষণা থেকে আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারি, আখেরাতের কামিয়াবী। ইসলামী আন্দোলনের ব্যক্তিদের সামনে এটাই হতে হবে প্রধান ও মুখ্য বিষয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে জাগতিকভাবে কোন একটা স্থানে ইসলামী আন্দোলন সফল হলে বা বিজয়ী হলেও আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যদি আদালতে আখেরাতে আল্লাহর দরবারে সাফল্যের সনদ না পায় তা হলে ঐ ব্যক্তিদের আন্দোলন ব্যর্থ বলেই বিবেচিত হবে। পক্ষান্তরে কোথাও ইসলামী আন্দোলন জাগতিকভাবে সফলতা অর্জন নাও করতে পারে। আর আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিগণ আখেরাতের বিচারে আল্লাহর দরবারে নেককার, আবরার হিসেবে বিবেচিত হয়, আল্লাহর কাছে পুরস্কৃত হয়,তার সন্তোষ লাভে সক্ষম হয়, তাহলে তাদের আন্দোলনকে কামিয়াব বলতে হবে। মনে রাখতে হবে, আল্লাহর ভাষায় এটাই সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ কামিয়াবী।
দুই:
وَأُخْرَى تُحِبُّونَهَا نَصْرٌ مِنَ اللَّهِ وَفَتْحٌ قَرِيبٌ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ [الصف : 13]
আর অপর একটি প্রতিদান যা তোমরা কামনা কর, পছন্দ কর, তাও তোমাদেরকে দেয়া হবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাঙ্খিত সাহায্য ও বিজয় অতি নিকটেই হাসিল হবে। (আস সফ: ১৩)
সূরায়ে নূরে এই দ্বিতীয় পর্যায়ের সাফল্য বা জাগতিক সাফল্যের কথা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে একটা ওয়াদা আকারে এসেছে। অবশ্য সে ওয়াদা শর্তহীন নয়। দুটো বড় রকমের শর্তসাপেক্ষ। বলা হয়েছে:
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ [النور : 55]
তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে এবং আমলে সালেহ করবে এমন লোকদেরন জন্যে আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে, তিনি তাদেরকে সেই ভাবে দুনিয়ার খেলাফত(নেতৃত্ব) দান করবেন, যে ভাবে পূর্ববর্তী লোকদেরকে খেলাফত দান করা হয়েছে। তাদের জন্যে আল্লাহ যে দ্বীনকে পছন্দ করেছেন সেই দ্বীনকে মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন। তাদের বর্তমানের ভয় ও নিরাপত্তাহীন অবস্থা পরিবর্তন করে শান্তি ও নিরাপত্তা দান করবেন। (আন নূর: ৫৫)
উল্লিখিত আয়াতের আলোকে জাগতিক সাফল্যের চূড়ান্ত রূপ হলো আল্লাহর সাহায্যে খোদাদ্রোহী শক্তিকে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসন থেকে অপসারিত করে ঈমানদার ও সৎকর্মশীল লোকদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারা। সেই সাথে তাগুতি শক্তির নেতৃত্ব ও কর্তুত্ব প্রতিষ্ঠা থাকাকালে মানুষের সমাজে যে অরাজকতা ও নৈরাজ্য কায়েম থাকে, মানুষের জানমালও উজ্জত আবরুদ্ধ নিরাপত্তা সব সময় হুমকীর সম্মূখীন থাকে, সেই অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়। আদিসে রাসূলের আলোকে একজন সুন্দরী নারী অঢেল ধন-সম্পদ ও সোনা-রূপার অলংকারসহ একাকিনী দূর-দূরান্তে সফর করতে পারে, তার জীবন যৌবনের উপরও কোন হামলার ভয় থাকে না, তার সম্পদ লুণ্ঠনের কোন আশঙ্কা থাকে না। যারা ইসলামী আন্দোলনে অংশগ্রহন করবে, তাদের সামনে উভয় প্রকারের সাফল্যই থাকতে হবে।তবে আল্লাহ যেটাকে প্রধান ও মুখ্য সাফল্যরূপে সামনে রেখেছেন সেটাকেই মুখ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে আখেরাতের সাফল্যই যাদের চরম ও পরম কাম্য হবে,আল্লাহ তাদেরকে উভয় ধরনের সাফল্য দান করবেন। কিন্তু দুনিয়ার সাফল্য যাদের মুখ্য কাম্য হবে আখেরাতের সাফল্য হবে গৌন ও কম গুরুত্বপূর্ণ, তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা উভয় জগতে ব্যর্থ করবেন। কারণ দুনিয়ার খেলাফত তো একটা কঠিন আমানত, সর্বস্তরের জনমানুষের অধিকার সংরক্ষণের আমানত, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের আমানত,মানুষের জানমাল ইজ্জত আবরুর হেফাজতের আমানত। মানুষের সমাজে সর্বত্র ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠর আমানত। এই আমানতকে তারাই বহন করতে সক্ষম যাদের মন-মগজে দুনিয়ার কোন স্বার্থ চিন্তার স্থান নেই। অবশ্য আখেরাতের এই সাফল্য পাওয়ার পথ দুানয়ায় নিজেকে এবং আল্লাহর অন্যান্য বান্দাকে মানুষের গোলামী থেকে মুক্ত করে আল্লাহর গোলামী করার সুযোগ করে দেওয়ার চুড়ান্ত প্রচেষ্টার উপরই নির্ভরশীল। সুতরাং আখেরাতের সাফল্যকে মুখ্য ধরে নিয়ে আন্দোলনের জাগতিক সাফল্য কামনা করা দূষণীয় নয়।
ইসলামী আন্দোলন মূলত নবী রাসূলদের পরিচালিত আন্দোলনেরই উত্তরসূরী। সুতরাং নবীরাসূলদের আন্দোলনের ইতিহাসের আলোকে এর সাফল্য ও ব্যর্থতার মূল্যায়নই যথার্থ মূল্যায়ন। নবী রাসুলগণ সব সময় অহীর মাধ্যমে সরাসরি আল্লাহর দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন। আল্লাহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে যাদেরকে নবুয়তের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, তারা তাদের সময়ে যার যার দেশে সার্বিক বিচারে ছিলেন উত্তম মানুষ, যোগ্যতম নেতা। এর পরও আমরা দেখতে পাই, সব নবীর জীবনে সমাজে নেতৃত্বের পরিবর্তন আসেনি বা দ্বীন বিজয়ী হওয়ার সুযোগ পায়নি। যেমন হযরত নূহ (আঃ) সুদীর্ঘ সাড়ে নয়শ’ বছর তার কওমের কাছে দাওয়াত দিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে দাওয়াত দিয়েছেন, লোকদেরকে একত্রে সমবেত করে দাওয়াত দিয়েছেন,গোপনে দাওয়াত দিয়েছেন, প্রকাশ্যে দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু মুষ্টিমেয় লোক ছাড়া অনেকেই ঈমান আনেনি। তাই বলে হযরত নূহ (আঃ) কিন্তু ব্যর্থ হননি।
সত্যের সংগ্রামে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টিকে থাকাই তো সফলতা। সত্যের এই সংগ্রামে ব্যর্থ হয় তারা যারা জাগতিক সাফল্যের বিলম্ব দেখে এবং আদৌ কোন সম্ভাবনা নেই মনে করে রণে ভঙ্গ দেয়, মাঝ পথে ছিটকে পড়ে। আর ব্যর্থ হয় সেই জাতি বা জনগোষ্ঠী যারা সত্যকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে।যেমন হযরত নূহ (আঃ) শেস মুহূর্ত পর্যন্ত দ্বীনের উপর, দ্বীনের দাওয়াতের উপর অটল অবিচল থেকে তিনি কামিয়াব হয়েছেন। আর তার জাতির লোকেরা দুনিয়ার ধ্বংস হয়েচে, আখেরাতেও রয়েছে তাদের জন্যে কঠিন শাস্তি।
বনী ইসরাঈলের ইতিহাসে দেখা যায় তারা অনেক নবী রাসূলকেই হত্যা করেছে। তাই বলে এই নিহত বা শহীদ নবী রাসূলগণ তো ব্যর্থ হননি। বরং এখানেও ব্যর্থ হয়েছে বনী ইসরাঈল। দুনিয়ায় অনেক বড় মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও, আল্লাহর অসংখ্য নেয়মত পাওয়া সত্ত্বেও তারা আজ অভিশপ্ত, দুনিয়ার সর্বত্র ঘৃণিত।এটাই তাদের ব্যর্থতা। তারা আল্লাহর কাছে অভিশপ্ত, আর মানুষের কাছে ঘৃণিত। পক্ষান্তরে ঐসব শহীদ নবী-রাসূলগণ আল্লাহর কাছে মহা মর্যাদার অধিকারকী আর দুনিয়ার সবর্ত্র সত্যের সংগ্রামীদের পথিকৃত। আবার অনেক নবীই তাদের জীবনেই এই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ)নমরুদী ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে শান্তিও সমাজ গড়তে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত শান্তির নগরী চরম জাহেলী সমাজেও শান্তি নিরাপত্তার স্থান হিসেবে স্বীকৃত ছিল। হযরত ইউসুফ (আঃ) রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে মানুষের সমাজে শান্তি ও ইনসাফ কায়েম করতে সক্ষম হয়েছেন। হযরত দাউদ (আঃ)জালুতের মত জালেম বাদশাহকে পরাভূত করে খেলাফতের অধিকারী হয়েছেন, ইনসাফ প্রতিষ্ঠার নমুনা উপস্থাপন করেছেন। তার সন্তান হিসেবে হযরত সোলাইমান(আঃ) সেই শান্তির সমাজকে আরও সম্প্রসারিত করেছে॥ হযরত মূসা (আঃ)ফেরাউনী শক্তির পতন ঘটিয়ে বনী ইসরাঈলকে তথা সেই সময়ের জনমানুষকে স্বৈরশাসনের কবল থেকে মুক্ত করেছেন। সর্বশেষে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ এই দুয়িায় আসবে, সবার জন্যে জীবন্ত নমুনা হিসেবে শেষ নবীর আন্দোলনের সর্বাঙ্গীন সাফল্যেও রূপ আল্লাহ তায়াল আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। এভাবে জাগতিক সাফল্য আসা না আসার ব্যাপারটা নিরঙ্কুশ ভাবে একমাকত্র আল্লাহরই হাতে। তবে আল্লাহ এই ব্যাপারে একটা নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন।আল্লাহর দেয়া সেই নিয়মের অধীনেই এইরূপ ফলাফল সংঘটিত হয়ে থাকে।
সেই নিয়মটা হলো: এক: আল্লাহর দ্বীনের ভিত্তিতে মানুষের সমাজ পরিচালনার উপযুক্ত একদল লোক তৈরি হতে হবে।
দুই: দেশের, সমাজের মানুষের মধ্যে সেটা সবাই না হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ আল্লাহর দ্বীনকে তাদের জন্যে স্বঃস্ফূর্তভাবেই চাইতে হবে।
শেষ নবী মক্কার ১৩ বছরের সাধনায় লোক তৈরি করেছেন, কিন্তু মক্কার জনগণ তখনও এটা চায়নি তাই মক্কায় তখন তখনই এটা কায়েম হয়নি। মদিনারজনগণের প্রভাবশালী এবং উল্লেখযোগ্য অংশ আল্লাহর দ্বীনকে কবুল করতে রাজী হয়েছে, আল্লাহর রাসূলকে নেতা মেনেছে, তাই সেখানে দ্বীন কায়েম হয়েছে,জাগতিক সাফল্য এসেছে। আল্লাহর ঘোষণা:
إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ [الرعد : 11]
আল্লাহ ততক্ষণ কোন জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যে চেষ্টা করবে। (আর রা’দ: ১১)
এভাবে একটা দেশে পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি নিম্নলিখিত কযেকটি রূপেই হতে পারে:
এক: দেশ,জাতি ও সমাজ পরিচালনা করার মত পর্যাপ্ত পরিমাণে যোগ্য, সৎ, খোদাভীরু লোক তৈরি হওয়ার সাথে সাথে দেশের জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশের বা অধিকাংশের সমর্থন-সহযোগিতার ভিত্তিতে ইসলাম বিজয়ী হবে।
দুই: লোক তৈরি হবে কিন্তু জনগণের উল্লেখযোগ্য অংশের সমর্থন পাবে না। এই সমর্থন না পাওয়ার ফলে আন্দোলনকারীদের সামনে তিনটি অবস্থা আসতে পারে।
১.তাদের সবাইকে না হলেও উল্লেখযোগ্য অংশকে শহীদ করা হবে। যেমন হযরত হোসাইন (রা) ও তার সাথীদের ব্যাপারে ঘটেছে। ২.তারা দেশ থেকে বহিষ্কৃত হবে। অথবা ৩.দেশের মধ্যেই আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা থাকবে।
প্রথম রূপটিকে তো সবাই সাফল্য হিসেবেই বিবেচনা করবে। কিন্তু এই সাফল্য ঝুকিবিহীন নয়, ইসলামী খেলাফতের মর্যাদা রক্ষা করতে পারা না পারার উপরেই এর চুড়ান্ত ফলাফল নির্ভর করে। দ্বিতীয় রূপটি প্রথমটি অর্থাৎ শাহদাত বরণ আপাত দৃষ্টিতে ব্যর্থতা মনে হলেও সবচেয়ে ঝুকিবিহীন সাফল্য। সত্যি সত্যি ঈমানের সাথে কেউ এই পথে শাহাদাত বরণ করে থাকলে তার চেয়ে পরম সাফল্যের অধিকারী আর কেউ নেই, তার চেয়ে বড় ভাগ্যবান আর কেউ নেই। আল্লাহর রাসূলের সুস্পষ্ট ঘোষণা:
موت في طاعة الله خير من حياة في معصية الله
আল্লাহর হুকুম পালনে মৃত্যুবরণ করা, তার নাফরমানীর মধ্যে বেঁচে থাকার চেয়ে উত্তম। (আল হাদিস)
দ্বিতীয় পর্যায়ের দুই এবং তিন নম্বর রূপটির বেশ ঝুঁকিপুর্ণ। দেশ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর সর্বস্ব ত্যাগ করতে বাধ্য হবার পর অথবা দেশের মাঝেই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা থাকার কারণে হাত পা ছেড়ে বসে পড়ে অথবা বাতিল শক্তির সাথ আপোসে চলে যায় বা জাহেলী সমাজ ব্যবস্থার সাথে আপোস করে বসে, তাহলে তাকে বা তাদেরকে অবশ্যই ব্যর্থ বলতে হবে। কিন্তু এরপরও যারা সবর ও ইস্তেকামাতের পরাকাষ্ঠা দেখাতে পারে, তাদের পরাজয় নেই, ব্যর্থতা নেই, বরং তাদেরকে যারা বহিষ্কার করে, কোণঠাসা করে পরিণামে তারাই ব্যর্থ হয়, তারাই পরাজিত হয়।
জাগতিক সাফল্যের কোরআনিক শর্তাবলী
সূরায়ে সফে আল্লাহ তায়ালা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর জাগতিক সাফল্যেও সংবাদ দেওয়ার পরেই ঘোষণা করেছেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا أَنْصَارَ اللَّهِ كَمَا قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ لِلْحَوَارِيِّينَ مَنْ أَنْصَارِي إِلَى اللَّهِ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ نَحْنُ أَنْصَارُ اللَّهِ فَآمَنَتْ طَائِفَةٌ مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَكَفَرَتْ طَائِفَةٌ فَأَيَّدْنَا الَّذِينَ آمَنُوا عَلَى عَدُوِّهِمْ فَأَصْبَحُوا ظَاهِرِينَ [الصف : 14]
তোমরা যারা ইমান এনেছো আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও। যেমন ঈসা (আঃ) হাওয়ারীদেরকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, আল্লাহর পথে কারা আমার সাহায্যকারী হবে? হাওয়ারীগণ উত্তরে বলেছিল, আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী। এই মূহুর্তে বনী ইসরাঈলের একটা অংশ ঈমান আনল। আর একটা অংশ কুফরী করল। তারপর আমি ঈমানদারদেরকে তাদের দুশমনদের মোকাবিলায় সাহায্য করলাম, ফলে তারাই বিজয়ী হলো। (আস সফ: ১৪)
এই বিজয়ে কিভাবে এসেছিল? একটা হাদিসে দেখা যায়, আল্লাহর রাসূল (সঃ) হযরত ঈসা আঃ এর সাথীদের ন্যায় ভূমিকা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। হাদীসের বর্নণা নিম্নরুপ একদা রাসুল সাঃ সাহাবায়ে কিরামদের বলেছিলেন এমন একটা সময় আসবে যখন আমার উম্মতের রাজনৈতিক অবস্থা বিকৃত হয়ে যাবে। এমন লোকেরা ক্ষমতায় থাকবে যদি তাদের অনুসরণ করা হয়, তাহলে গোমরাহ হবে। আর যদি তাদের বিরোধিতা করা হয়,তাহলে গর্দান উড়িয়ে দেয়া হবে। এরপর সাহাবায়ে কেরামগণ বলে উঠলেন-
كيف نصنع يا رسول الله؟
এমন অবস্থায় আমরা কি করব, হে আল্লাহর রাসূল। উত্তরে রাসূল (সঃ) বললেন:
كما صنع اصحاب عيسى ابن مريم عليه السلام هم قتلوا بالمنشار نصبوا على الشنق، موت في طاعة الله خير من حياة في معصية الله
তোমরাই সেই ভূমিকা পালন করবে যে ভুমিকা হযরত ঈসা (আঃ) এর সাথীগণ পালন করেছিলেন। তাদেরকে করাত দিয়ে চিরে হত্যা করা হযেছে। ফাসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয়েছে, (তবূও তারা আপোষ করেনি, নতি স্বীকার করেনি)এভাবে আল্লাহর আনুগত্যের মাঝে মৃত্যু বরং নাফরমানীর মাঝে বেঁচে থাকার চেয়ে উত্তম।
এভাবে একদল নিবেদিত প্রাণ মর্দে মুমিন, মর্দে মুজাহিদের চূড়ান্ত ত্যাগ কোরবানীর রক্ত পিচ্ছিল পথ বেয়েই এই সাফল্য অতীতে এসেছে এখনও আসতে পারে, আগামীতেও আসবে ইনশাআল্লাহ।
সূরায়ে আন নূরের যে স্থানে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার খেলাফত দানের ওয়াদা করেছেন, সেখানেই এই খেলাফত যারা পেতে চায় তাদেরকে কতিপয় নির্দেশ দেয়া হয়েছে যা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে প্রণিধানযোগ্য।
يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ (55) وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ (56) لَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا مُعْجِزِينَ فِي الْأَرْضِ وَمَأْوَاهُمُ النَّارُ وَلَبِئْسَ الْمَصِيرُ [النور : 55 – 57]
অতএব তারা একমাত্র আমারই ইবাদত করবে এবং আমার সাথে আর কাউকে শরীক করবে না। আর যারা এরপরেও না শুকরী করবে তারা তো ফাসেক। নামজ কায়েম কর, জাকাত আদায় কর এবং রাসূলের এতায়াত কর। আশা করা যায় তোমাদের প্রাতি অনূগ্রহ করা হবে। যারা কুফরী করছে তাদের ব্যাপার এমন ভুল ধারণা পোষণ করবে না যে, তারা আল্লাহকে অপারগ করে ফেলবে। তাদের শেষ ঠিকানা জাহান্নাম আর কতই না জঘন্য সেই বাসস্থান। (আন নূর: ৫৫-৫৭)
এখানে একদিকে নির্ভেজাল তাওহীদের অনুসরণ, সর্বপ্রকারের মিরক বর্জন,আল্লাহর প্রতি যথার্থ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের, অকৃজ্ঞতা থেকে বেছে থাকার এবং নামাজ কায়েম ও জাকাত আদায়োর নির্দেশের পাশে মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতির জন্যে কুফরী শক্তির অসারতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পোষণের তাকিদ করা হয়েছে। তাদের শক্তি আপাত দৃষ্টিতে যত বেশীই মনে হোক না কেন তবুও তারা দুর্জয় শক্তির অধিকারী নয়। এই কথাটি আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র ব্যক্ত করেছেন:
وَمَنْ لَا يُجِبْ دَاعِيَ اللَّهِ فَلَيْسَ بِمُعْجِزٍ فِي الْأَرْضِ [الأحقاف : 32]
যারা আল্লাহর পথে আহবানকারীর আহবানে সাড়া দেয় না তারা এই দুনিয়ার কোন দুর্জয় শক্তির অধিকারী নয়। (আলআহকাফ:৩২)
যারা সারকথা, দায়ী আন্দোলনকারী নিছক জাগতিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে লাভ ক্ষতির হিসেব কষবে না বরং আল্লাহর শক্তির উপর ভরসা করে, তার ওয়দার প্রতি একিন রেখে বিজয়ের পথে পা বাড়াবে।
সূরায়ে মুজাদালায় আল্লাহ তায়াল হিজবুশশায়তানের ব্যর্থতার নিশ্চিত ঘোষণাও ঈমাননদারদের বিজয়ের দ্ব্যর্থহীন আশ্বাস দিয়েছেন:
كَتَبَ اللَّهُ لَأَغْلِبَنَّ أَنَا وَرُسُلِي إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ أُولَئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْإِيمَانَ وَأَيَّدَهُمْ بِرُوحٍ مِنْهُ وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ أُولَئِكَ حِزْبُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ.
আল্লাহ লিখে দিয়েছেন যে, আমি এবং আমার রাসূলই বিজয়ী হব। বাস্তবিকই আল্লাহ তায়ালা পরম পরাক্রমশালী। তোমরা কখনই এমনটি পাবে না যে, যারা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান এনেছে, তারা এমন লোকদের সাথে মহব্বতের সম্পর্ক রাখে, যারা আল্লাহ ও রাসূলের বিরোধিতা করে। হোক না তারা তাদের বাপ বেটা, ভাই অথবা তাদের বংশের কেউ। এরা তো এমন ভাগ্যবান লোক যাদের দিলে আল্লাহ তায়ালা সুদৃঢ় ঈমান দান করেছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে একটা রূহ দ্বারা তাকে শক্তি দান করেছেন- আল্লাহ তাদেরকে এমন জান্নাতে স্থান দেবেন যার পাদদেশ দিয়ে ঝরণাধারা প্রবাহিত হবে, সেখানে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস করবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট আর তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তোমরা ভাল করে জেনে রাখ, আল্লাহর দলই সাফল্যমণ্ডিত হবে। (আল মুজাদালা:২১-২২)
আল্লাহ তায়ালার এই ঘোষণার মধ্যে দিয়ে আমরা ছয়টি জিনিস পাই, যার মাধ্যমে প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর দল হওয়া যায় এবং সকল বাধা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে, সকল প্রকারের পরীক্ষা নিরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়ে আন্দোলনকে বিজয়ের দ্বার প্রান্তে পৌছান যায় আল্লাহর সাহায্যে।
এক আল্লাহ এবং তার রাসূলই বিজয়ী হবেন, শয়তানী শক্তিকে পরিনামে পর্যুদস্ত ও বিপর্যস্ত হতেই হবে। আল্লাহর এ ওয়াদার প্রতি, আল্লাহর এই ঘোষনার প্রতি পাকাপোক্ত একীন পোষন করতে হবে।
দুই: আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের দুশমনী করে এমন লোক পরম আপনজন, নিকটাত্মীয় হলে ও তাদের সাথে ভালবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখা যাবে না।
তিন: নিছক ঈমানের দাবী নয়- এমন ঈমান যা আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বীকৃত, আল্লাহর বিশেষ তৌফিকের ফলেলব্ধ এমন ঈমানের অধিকারী হতে হবে।
চার: আল্লাহ প্রদত্ত রূহানী শক্তির বলে বলীয়ন হতে হবে।
পাঁচঃ আল্লাহর রেজামন্দী লাভে সক্ষম হতে হবে।
ছয়: আল্লাহর যাবতীয় ফয়সালা খুশিমনে ও দ্বিধাহীন চিত্তে গ্রহণ করার মত মন মানসিকতার অধিকারী হতে হবে। জাগতিক প্রস্তুতি গ্রহণ ও শক্তি অর্জনের পাশাপাশি কোরআনিক এই শর্তগুলো পূরন অবশ্যই পূরণ করতে হবে। তাহলেই ইসলামী আন্দোলনের জাগতিক সাফল্য আশা করা যেতে পারে।