চতুর্থ অধ্যায়ঃ ইসলামী সংগঠন
সংগঠনের অর্থ ও সংজ্ঞা
সংগঠন শব্দটির ইংরেজী প্রতিশব্দ Organisationযার শাব্দিক অর্থ বিভিন্ন Organ কে একত্রিত করণ, গ্রন্থায়ন ও একীভূতকরণ বা আত্নীকরণ। মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকেও এক একটি Organ বলা হয়। মানবদেহের এই ভিন্ন ভিন্ন Organ গুলোর গ্রন্থায়ন ও একীভূতকরণের রূপটাই সংগঠন বা Organisation এর একটা জীবন্ত রূপ। মানবদেহের প্রতিটি সেল, প্রতিটি অনু পরমাণু একটা নিয়মের অধীনে সুশৃঙ্খল ভাবে যার যার কাজ সম্পাদন করে যাচেছ। মানুষের দৈহিক অবয়বগুলোর বিভিন্নমুখী কার্যক্রমের প্রতি লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাব,এখানে একটি কেন্দ্রীয় নিয়ণ্ত্রন আছে। আবার কাজের সুসম বন্টনের ব্যবস্থা আছে, পরস্পরের সাথে অদ্ভূত রকমের সহযোগিতা আছে। মন মগজের চিন্তা ভাবনা কল্পনা ও সিদ্বান্তের প্রতি দেহের বিভিন্ন Organ দ্রুত সমর্থন-সহযোগিতা প্রদর্শন করে। তেমনি দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের অভাব অভিযোগ, অসুবিধা ইত্যাদির ব্যাপারে দেহরূপ এই সংগঠনের কেন্দ্র অর্থ্যাৎ মন ও মগজ দ্রুত অবহিত হয়।
মানব দেহের বিভিন্নঅঙ্গ-প্রতঙ্গের এই একীভূত রূপের অনুকরনে কিছু সংখ্যক মানুষের নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে এক দেহএক প্রাণ রূপে কাজ কারার সামষ্টিক কাঠামো কেই বলা হয় সংগঠন বা Organisation .
মুসলিম জনগোষ্টী মূলক একটি সংগঠন, জামায়ত বা Organisation। এই জন্যেই হাদিসে রাসূলে এই জনসমষ্টিকে একটি দেহের সাথে তুলনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে:
عن النعمان بن بشير قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : مثل المؤمنين في توادهم وتراحمهم و وتعاطفهم كمثل الجسد إذا اشتكى منه عضو تداعى له سائر الجسد بالسهر والحمى.
হযরত নূমান বিন বশীর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসুল (সঃ) এরশাদ করেছেন- মুমিনদের পারস্পারিক ভালবাসা, দয়া ও সহানুভূতি মানবদেহ সদৃশ। তার কোন অংশ রোগাক্রান্ত হলে সমগ্র দেহ নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে দুর্বল হয়ে পড়ে। (বুখারী ও মুসলীম)
এখানে মুমিনের পরস্পরের সাথে সম্পর্ক, সংযোগ ও অনুভূতি প্রবণাতার বাঞ্ছিত রূপটা কি হওয়া উচিত,এটা বুঝানোর জন্যেই মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ- প্রত্যঙ্গরপারস্পারিক সম্পর্কের, সংযোগের এবং সহানুভূতির ও সহযোগিতার বাস্তব রূপটি উদাহরণ স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে। এভাবে মানুষের বিভিন্ন Organ কে বিচ্ছিন্ন করে রাখলে যেমন মানব দেহ বেকার ও অচল হওয়ার সাথে সাথে ঐ সব Organ গুলো ও বেকার হয়ে যায়, তেমনি এটা সত্য সমাজবদ্ধ জীব মানুষের বেলায়ও। এই সমাজ একটা দেহ এবং ব্যক্তি মানুষগুলো এই সমাজ দেহের একএকটা Organ। মানব দেহের Organ গুলো পরস্পর বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন হলে যেমন দেহ ও Organ সবটাই বেকার হয়ে যায়, তেমনি সমাজ দেহের Organ গুলো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লে ব্যক্তি মানুষগুলো ও মানুষের মর্যাদায় থাকতে পারে না এবং এই ব্যক্তিদের সামস্টিক যে রূপটা সমাজ নামে পরিচিত, সেটাও মানুষের সমাজ নামে অভিহিত হওয়ার যোগ্য থাকে না। সুতরাং সংগঠন মানুষের জন্যে, মানুষের ব্যক্তি ও সামষ্টিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে একটা একান্ত স্বাভাবিক ও অনির্বায প্রয়োজন।
মানুষের এই সংগঠনের আদর্শ রূপ হবে মানব দেহেরই অনুরূপ।অর্থাৎ দেহের যেমন একটা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ আছে যার মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নিদের্শ দেওয়া হয়, সিদ্ধান্ত জানানো হয়, প্রয়োজন পুরন করা হয়, অভাব অভিযোগ দ্রুত শোনা হয়, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। অঙ্গ- প্রত্যঙ্গগুলো যেমন সুন্দরভাবে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ মেনে চলে আবার যার যার জায়গায় স্বাধীনও বটে, আবার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের পরস্পরের মধ্যে ও একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে, সুন্দর আদান প্রদান মানে Spirit আছে। তেমনি মানুষের সমাজ পরিচালনার জন্যে একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থা থাকতে হবে। যার কাজ হবে সমাজের, সমষ্টির ও ব্যক্তির স্বার্থ সংরক্ষণ করা। এমন ভাবে যেন সমষ্টির স্বার্থ সংরক্ষণ ব্যক্তির স্বার্র্থ ও স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত নাকরে। আবার ব্যক্তির স্বার্থ ও স্বাধীনতা যেন সমষ্টির এবং অন্য ব্যক্তির স্বার্থ ও স্বাধীনতার পরিপন্থী না হয়। এখানে সমাজ ব্যক্তিদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবে। ব্যক্তিরা যুগপৎভাবে সমাজের প্রতি এবং পরস্পর একে অপরের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবে।
মানুষের সমাজের এই রূপটাই আদর্শ রূপ। মানবতা ও মনুষ্যত্বের বিকাশ এমনি একটা পরিবেশ,এমনি একটা সামাজিক কাঠামোতেই সম্ভব হতে পারে। মানুষেরএই সহজাত এবং স্বাভাবিক প্রয়োজনের তাকিদেই মানুষ কোন না কোন প্রক্রিয়ায় সমাজবদ্ধ জীবন যাপনের প্রয়াস চালিয়ে আসছে। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক কোন না কোন একটাসমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, মেনে চলারও চেষ্টা করছে। কিন্তু মানুষের সমাজে বিভিন্ন প্রকৃতির, বিভিন্ন শ্রেণীর, বিভিন্ন বর্ণের, বিভিন্ন গোত্রের, দেশের ও ভাষার মানুষকে এক দেহ, এক প্রাণ হিসেবে গ্রন্থায়নে, আত্নীকরণে- মানুষের মনগড়া কোন প্রচেষ্টাই আজ পর্যন্ত সফল হয়নি, হতে পারছে না। মানুষের তৈরি সমাজ কাঠামো সংগঠন, সংস্থা ভারসাম্যমূলক কোন ব্যবস্থাই মানবজাতিকে উপহার দিতে পারেনি। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। কখনও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তির স্বার্থ ও স্বাধীনতা এতটাই খর্ব করেছে যে, তার প্রতিক্রিয়া সমাজকেও প্রভাবিত করেছে। কারণ সমাজ তো ব্যক্তিরই সমষ্টি। আবার কখনও অবাধ ব্যক্তি স্বাধীনতা, সামাজিক স্বার্থ ও সমাজের ব্যক্তিদের পারস্পারিক স্বার্থ ও স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করেছে। ফলে কোথাও মনুষ্যত্ব ও মানবতার বিকাশ সাধনের সুযোগ হয়নি। বরং মানুষের সমাজে পাশবিকতা, পৈশাচিকতা ও বর্বরতাকেই লালন করা হয়েছে এবং হচ্ছে।
পক্ষান্তরে মানবজাতি ইতিহাসের ফাঁকে ফাঁকে সমাজের আদর্শরূপও দেখেছে। যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নবী-রাসূলদের মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত নীতি-পদ্ধতির ভিত্তিতে। সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (স.) প্রতিষ্ঠিত সমাজ এবং খোলাফায়ে রাশেদীন পরিচালিত সমাজই সর্বকালের সর্বযুগের জন্য আদর্শ সমাজ ও সংগঠন, যেখানে বিভিন্ন গোত্রের,বিভিন্ন বর্ণেও, বিভিন্ন ভাষার মানুষকে এক দেহ এক প্রাণরূপে গড়ে তোলা হয়েছে। ব্যক্তি স্বার্থ ও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করেও সামাজিক শান্তি, নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা ও ইনসাফ সার্থকরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। উল্লিখিত আদর্শ সমাজ সংগঠনের আওতায় মানুষের জীবনে শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নবী রাসূলগণ সবাই একই ধরনের মৌলিক নীতি ও পদ্বতি অবলম্বন করেছেন। অবশ্য পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে কর্মকৌশল ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে। অজকের বিশ্বের মানবজাতিকে যদি আমরা এক দেহ এক প্রাণরূপে সংগঠিত করতে চাই তাহলে (এবং করতে হবে) ঐ সব মৌলিক নীতি-পদ্ধতি এবং শেষ নবী (স.) গৃহীত কর্মকৌশল অবলম্বন করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। শেষ নবী (স.) -এর ভবিষ্যদ্বানী অনুযায়ী সারা বিশ্বের মানুষ আবার খেলাফত আলা মিনহাজিন্নাবুয়াতের সাথে সাক্ষাৎ পাবে এবং নবী রাসূলের গৃহীত সেই নিয়ম পদ্ধতি ভিত্তিতে গোটা বিশ্বের মানুষ আবার এক দেহ-মন –প্রাণ হবে। নিখিল বিশ্বে গোটা মানব সমাজের এই বৃহত্তর সমাজ সংগঠনের মূল লক্ষ্য। আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনসমূহ মূলত এই বৃহত্তর লক্ষ্য পানেই ধাপে ধাপে ও পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হচ্ছে।
ইসলামের সঠিক আকিদা বিশ্বাসের ভিত্তিতে দুনিয়ার শান্তি ও আখেরাতে মুক্তির উদ্দেশ্যে আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত কিছু সংখ্যক লোকের সম্মিলিত ও সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার নাম ইসলামী আন্দোলন, আর এর সামষ্টিক রূপ ও কাঠামোর প্রক্রিয়ার নাম ইসলামী সংগঠন।
ইসলামের সাথে আন্দোলন যেমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত,ইসলাম ও আন্দোলন যেমন সম্পূর্ণরূপে এক ও অভিন্ন, ইসলামের সাথে সংগঠনের সম্পর্কও তেমনই। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হওয়ার কারণে সমাজ ও সংগঠন ছাড়া তার গত্যন্তর নেই। ইসলাম এই মানুষের জন্য,মানুষের সমাজের জন্যই। সুতরাং সমাজ সংগঠন ছাড়া, জামায়াতবদ্ধ জীবন ছাড়া ইসলামের অস্তিত্ব কল্পণা করাই সম্ভব নয়। ইসলামী আদর্শের প্রথম ও প্রধান উৎস এবং আল কোরআনের শিক্ষা আলোচনা করলে কোথাও ব্যক্তিগতভাবে ইসলামী জীবন যাপনের সুযোগ দেখা যায় না। আল কোরআনের আহবান হয় গোটা মানব জাতির জন্যে, আর না হয় মানুষের মধ্য থেকে যারা ঈমান এনেছে তাদের সকলের জন্যে। কেবলমাত্র আখেরাতের জবাবদিহির ব্যাপারটা ব্যাক্তিগতভাবে হবে। কিন্তু সেই জবাবদিহিতে বাঁচতে হলেও এই দুনিয়ায় সামষ্টিকভাবে দ্বীন মেনে চলার ও দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন আছে। এক্ষেত্রে নিন্মলিখিত আয়াতগুলো বিশেষভাবে প্রণিধাযোগ্য: ***
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
হে মানব জাতি! তোমাদের রবের ইবাদত কর, যিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে করে তোমরা মুক্তিলাভে সক্ষম হও। (আল বাকারাহ: ২১)
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا
হে মানবজাতি! তোমরা ভয় কর তোমাদের সেই রবকে যিনি তোমাদেরকে একটি নফসথেকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃএব তা থেকে জোড়া সৃষ্টি করেছেন। অতঃএব তাদের দু’জন হতে অসংখ্য নারীপুরুষ ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহকে ভয় কর এবং আত্নীয়-স্বজনদের ব্যাপারেও ভয় কর, এসব ব্যাপারে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে। আল্লাহ তোমাদের উপর প্রহরীরূপে আছেন। (আন নিসা: ১)
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
হে মানবজাতি! আমি তোমাদের একজন একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃএব তোমাদেরকে বিভিন্ন গোত্রের ও বংশের অন্তর্ভূক্ত করেছি, যাতে করে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। তোমাদের মধ্যে যারা বেশী খোদাভীরু তারাই আল্লাহর কাছে বেশী মর্যাদাবান। অবশ্যই আল্লাহ জ্ঞানী এবং ওয়াকিবহাল। (আল হুজুরাত: ১৩)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর, সুদ যা এখন চালু আছে-বর্জন কর যদি হও সত্যিই ঈমানদার। (আল বাকারা: ২৭৮)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا الرِّبَا أَضْعَافًا مُضَاعَفَةً وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
হে ঈমানদারগণ! সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুদ খাবে না-আল্লাহকে ভয় কর যাতে করে সাফল্যমন্ডিত হতে পার। (আলেইমরান:১৩০)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ
হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের মাল ভক্ষণ করবে না হ্যাঁ,যদি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে যৌথ ব্যবসা হয়, সেটা ভিন্ন কথা। (আন নিসা: ২৯)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنْجِيكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ (10) تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ
হে ঈমানদারগণ! তোমাদেরকে এমন একটা ব্যবসার কথা বলব কি যা তোমাদেরকে কঠিন আযাব থেকে মুক্তি দেবে? ঈমান আন আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি। আর জিহাদ কর আল্লাহর পথে জান ও মাল দিয়ে। তোমরা প্রকৃত জ্ঞানী হলে বুঝবেএটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর (আস সফ:১০-১১)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا أَنْصَارَ اللَّه
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হও। (আস সফ: ১৪)
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
তোমরা সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর, বিচ্ছিন্ন হবে না। (আল ইমরান: ১০৩)
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল অবশ্যই থাকতে হবে যারা মানব জাতিকে কল্যাণের পথে আহ্বান জানাবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে, অসৎ কাজে বাধা দেবে, তারাই সফলকাম। (আল ইমরান:১০৪)
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
ঈমানদার নারী পুরুষ পরস্পর সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক। তাদের সম্মিলিত দায়িত্ব হলো সৎ কাজের আদেশ দান ও অসৎ কাজে বাধা দান। তারা নামায় কায়েম করবে, জাকাত আদায় করবে এবং আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে। তাদের প্রতি সত্বর আল্লাহ অনুগ্রহ করবেন। আল্লাহ পরাক্রমাশালী ও মহাবিজ্ঞ। (আত তাওবা:৭১)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা শাসন ক্ষমতায় অধিকারী তাদের। (আন নিসা: ৫৯)
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ
তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং সৎকর্মশীল হবেন, তাদের প্রতি আল্লাহর ওয়াদা তাদেরকে দুনিয়ার খেলাফত দান করা হবে যেমন তার পূর্ববর্তীদেরকে দান করা হয়েছে। (আন নূর: ৫৫)
ইসলামী আদর্শের দ্বিতীয় উৎস সুন্নাতে রাসূল বা হাদিসে রাসূল। সেখানেও জামায়াতী জিন্দেগীর বাইরে ইসলামের কোন ধারণা খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং এখানে তো বলা হয়েছে মাত্র দু’জন কোথাও ভ্রমণ করলেও তার একজনকে আমীর করে নিয়ে জামায়াতী শৃঙ্খলা রক্ষাকরে চলবে।
আল্লাহর রাসূল জামায়াতী জিন্দেগীর ব্যাপারে আরো সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন নিন্মোক্ত হাদীসটির মাধ্যমে:
عن الْحَارِثُ الأَشْعَرِيُّ قال وقال رسول الله صلى الله عليه و سلم انا آمركم بخمس الله أمرني بهن بالجماعة وبالسمع والطاعة والهجرة والجهاد في سبيل الله
হযরত হারেস আল আশয়ারী থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, রাসূল (স.) বলেন, আমি পাঁচটি জিনিসের ব্যাপারে তোমাদের আদেশ করছি (অন্য রেওয়ায়েতে আছে, আর আমার আল্লাহ আমাকে পাঁচটি বিষয়ে নিদের্শ দিয়েছেন) (১) জামায়াতবদ্ধ হবে (২) নেতার আদেশ মন দিয়ে শুনবে (৩) নেতার আদেশ মেনে চলবে (৪) আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ বর্জন করবে (৫) আর আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। (আহমদ ও তিরমিজী)
উক্ত হাদিসে একই সাথে ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনে উপাদান,কাঠামো ও কার্যক্রমের মৌলিক কথাগুলো সংক্ষেপে অথচ সুন্দরভাবে বলা হয়েছে।
আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ বাস্তবায়নের অন্যতম সার্থক ও সফল রূপকার হযরত ওমর ফারুক (রা.) কোরআন ও সুন্নাহর স্পিরিটকে সামনে রেখে ইসলামের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তাতেও ইসলামের সংজ্ঞার পাশাপাশি ইসলমী জামায়াত বা সংগঠনের উপাদান এবং কাঠামো এসে গেছে। তিনি বলেছেন:
لا إسلام الا بجماعة ولا جماعة الا بإمارة ولا إمارة إلا بطاعة
জামায়াত ছাড়া ইসলামের কোন অস্তিত্ব নেই। আর নেতৃত্ব ছাড়া জামায়াতের কোন ধারণা করা যায় না। তেমনিভাবে আনুগত্য ছাড়া নেতৃত্বও অর্থহীন। অন্য এক হাদিসে বলা হয়েছে:
يد الله مع الجماعة ومن شذ شذ إلى النار
জামায়াতের প্রতি আল্লাহর রহমতের হাত প্রসারিত থাকে। যে জামায়াত ছাড়া একা চলে, সে তো একাকী দোযখের পথেই ধাবিতহয়। (তিরমিজী)
مَنْ خَرَجَ مِنَ الطَّاعَةِ وَفَارَقَ الْجَمَاعَةَ فَمَاتَ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً
যে ব্যক্তি আনুগত্য পরিত্যাগ করে এবং জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তার মৃত্যু হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু। (মুসলিম)
সুতরং আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কেরামের ইজমার ভিত্তিতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, দ্বীন ইসলামে জামায়াতবিহীন জীবনের কোন ধারণা নেই। জামায়াতবিহীন মৃত্যুকে তো জাহেলিয়াতের মৃত্যু হিসাবেই উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব জামায়াতবদ্ধ হওয়া, জামায়াতবদ্ধ হয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো ফরজ। আমরা ইতঃপূর্বে আলোচনা করে এসেছি, দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করা ফরজ আর আন্দোলনের জন্য সংগঠন অপরিহার্য। কাজেই সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হওয়া অনিবার্য কারণেই ফরজ হতে বাধ্য।
সংগঠনের উপাদান
মানুষের সমাজে কিছু কাজ করার জন্যে যে সব সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, মোটামুটি তার কিছু উপাদান থাকে। যেমন (১) আদর্শ, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতি (২) নেতৃত্ব (৩) কর্মীবাহিনী (৪) কর্মক্ষেত্র।
ইসলামী আন্দোলনের প্রয়োজনে গড়ে ওঠা সংগঠনে ও উল্লিখিত উপাদানগুলো পূর্ণাঙ্গরূপে বিদ্যমান থাকে।
ইসলামী সংগঠন সঠিক আকিদা বিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সংগঠন বিধায় সে একমাত্র কোরআন সুন্নাহর আদর্শকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহন করে এবং মুমিন জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যা হওয়া উচিত তাকেই সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহন করে। আদর্শ যেমন কোরআন ও সুন্নাহ থেকেই নেয়, তেমনি সে আদর্শ প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি এবং কর্মপদ্ধতি ও কোরআন ও সুন্নাহ থেকেই গ্রহন করে সংগঠনের দ্বিতীয় উপাদান নেতৃত্বের ব্যাপারে। এই সংগঠন রাসূলে খোদার আদর্শ অনুযায়ী নেতৃত্ব গড়ে তোলাকে অন্যতম সাংগঠনিক দায়িত্ব হিসেবে গ্রহন করে। এই সংগঠনের যাত্রাই শুরু হয় নেতৃত্বের মাধ্যমে। এই সংগঠনের নেতৃত্ব নায়েবে রাসূলের মর্যাদাসম্পন্ন হওয়ার কারণে এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আনুগত্য গ্রহনের প্রশ্ন একান্ত স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। সুতরাং ইসলামী সংগঠনের উপাদানসমূহের কথা আমরা এভাবে সাজাতে পারি।
১.কোরআন ও সুন্নাহভিত্তিক আদর্শ, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, কর্মসূচি এবং কর্মপদ্ধতি।
২.কোরআন ও সুন্নাহর অনুযায়ী আনুগত্য।
৩. কোরআন ও সুন্নাহর বাঞ্ছিত মানের আনুগত্য।
৪.এর সাধারণ এবং বৃহত্তম কর্মক্ষেত্রে সমগ্র দুনিয়া, সমগ্র দুনিয়ার মানুষ। কিন্তু প্রাথমিক কর্মক্ষেত্র, যারা যে দেশে জন্মেছে, যে দেশে বসবাস করছে সেই দেশ এবং সেই দেশের জনগণ।
উল্লিখিত উপাদানগুলোর সাথে আরো দুটো উপাদান ইসলামী সংগঠনের প্রাণশক্তির ভূমিকা পালন করে আর আন্দোলনকে করে তোলে গতিশীল। তার একটা হলো পরামর্শের ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা আর দ্বিতীয়টি হলো সংশোধনের উদ্দেশ্যে সমালোচনার ব্যবস্থা চালু থাকা। আমরা এই পুস্তিকার শেষ অংশে নেতৃত্ব,আনুগত্য,পরামর্শ এবং সমালোচনা এই চার বিষয় পৃথক পৃথকভাবে আলোচনার চেষ্টা করব।
ইসলামী সংগঠনের প্রকৃত মডেল
শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) প্রতিষ্ঠিত ইসলামই ‘জামায়াতে ইসলামী ’ সংগঠনের প্রকৃত মডেল। একইভাবে মুহাম্মদ (স.) এর নেতৃত্বই ইসলামী নেতৃত্বের একমাত্র মডেল। মুহাম্মদ (স.) -এর পরবর্তী মডেল হলো খোলাফায়ে রাশেদীন পরিচালিত ইসলামী জামায়াত। এরপর আর কোন মডেল নেই। আল্লাহর রাসূলের নির্দেশ:
عليكم بسنتي وسنة الخلقاء الراشدين المهديين
তোমাদেরকে আমার খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অবশ্য অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।
রাসূল (স.) প্রতিষ্ঠিত এবং খোলাফায়ে রাশেদীন পরিচালিত ইসলামী জামায়াত, আল জামায়াত। এই মডেল অনুকরণে ও অনুসরণে গড়ে ওঠা জামায়তের প্রকৃত লক্ষ্য হলো কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ ও ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা। এইরূপ রাষ্ট্র ব্যাস্থার মাধ্যমেই প্রকৃত জামায়াতী জিন্দেগীর চাহিদা পূরণ হওয়া সম্ভব। আমরা বর্তমানে এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত আছি- অথচ হাদিসের আলোচনায় বুঝা যায়, ইসলামী জামায়াতের অন্তর্ভূক্ত হয়ে ইসলামী নেতৃত্বের বাইয়াত গ্রহন ছাড়া মৃত্যু জাহেলিয়াতের মৃত্যু। এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় কি? জাহেলিয়াতের মৃত্যু থেকে বাচাঁর উপায় কি?
এই অবস্থায় আমাদের বাঁচার একমাত্র উপায় হলো, একমাত্র করণীয় কাজ হলো আল্লাহর রাসূল ও খোলাফায়ে রাশেদীনের মডেল বা সুন্নাতকে সামনে রেখে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা খেলাফত আলা মিনহাজিন্নবুয়ত প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করতে একমত- এমন লোকদের সমন্বয়ে জামায়াত কায়েম করা। এই জামায়াত হবে ইসলামী রাষ্ট্রের বিকল্প। আর এই জামায়তের নেতৃত্ব হবে ইসলামী রাষ্ট্র প্রধানের বিকল্প। এভাবে একটা অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা করে জামায়াতী জিন্দেগীর চাহিদা পূরণ করা এবং জাহেলিয়াতের মৃত্যু থেকে বাঁচা সম্ভব। কিন্তু এই জামায়াতকে প্রকৃত জামায়াত গড়ার সবধহং রূপে ব্যবহার করতে হবে। এটাকে বহফ ভাবা ঠিক হবে না বা বহফ ভাবলে এর মাধ্যমে যে বৃহত্তর কাজ, মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার কথা তা দেয়া সম্ভব হবে না। পরিণামে এটা একটা ফেরকায় রূপ নেয়ার আশঙ্কভ থেকে যাবে তোমাদেরকে আমার খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অবশ্য অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।
রাসূল (স.) প্রতিষ্ঠিত এবং খোলাফায়ে রাশেদীন পরিচালিত ইসলামী জামায়াত, আল জামায়াত। এই মডেল অনুকরণে ও অনুসরণে গড়ে ওঠা জামায়তের প্রকৃত লক্ষ্য হলো কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ ও ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা। এইরূপ রাষ্ট্রব্যাস্থার মাধ্যমেই প্রকৃত জামায়াতী জিন্দেগীর চাহিদা পূরণ হওয়া সম্ভব। আমরা বর্তমানে এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত আছি- অথচ হাদিসের আলোচনায় বুঝা যায়, ইসলামী জামায়াতের অন্তর্ভূক্ত হয়ে ইসলামী নেতৃত্বের বাইয়াত গ্রহণ ছাড়া মৃত্যু জাহেলিয়াতের মৃত্যু। এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় কি? জাহেলিয়াতের মৃত্যু থেকে বাচাঁর উপায় কি?
এই অবস্থায় আমাদের বাঁচার একমাত্র উপায় হলো, একমাত্র করণীয় কাজ হলো আল্লাহর রাসূল ও খোলাফায়ে রাশেদীনের মডেল বা সুন্নাতকে সামনে রেখে ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা বা খেলাফত আলা মিনহাজিন্নবুয়ত প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করতে একমত- এমন লোকদের সমন্বয়ে জামায়াত কায়েম করা। এই জামায়াত হবে ইসলামী রাষ্ট্রের বিকল্প। আর এইজামায়তের নেতৃত্ব হবে ইসলামী রাষ্ট্র প্রধানের বিকল্প। এভাবে একটা অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা করে জামায়াতী জিন্দেগীর চাহিদা পূরণ করা এবং জাহেলিয়াতের মৃত্যু থেকে বাঁচা সম্ভব। কিন্তু এই জামায়াতকে প্রকৃত জামায়াত গড়ার সবধহং রূপে ব্যবহার করতে হবে। এটাকে বহফ ভাবা ঠিক হবে না বা বহফ ভাবলে এর মাধ্যমে যে বৃহত্তর কাজ, মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার কথা তা দেয়া সম্ভব হবে না। পরিণামে এটা একটা ফেরকায় রূপ নেয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে।
ইসলামী সংগঠনের কার্যক্রম ও শরয়ী মর্যাদা
ইসলামী আন্দোলনের আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা যে পাঁচটি পরিভাষা যেমন: ১. দাওয়াত ২. শাহাদাত ৩. কিতাল ৪. একামাতে দ্বীন ৫. আমর বিল মা’রূফ ওয়া নেহী আনিল মুনকার -এর সামগ্রিক রূপটিই ইসলামী আন্দোলন বলে বুঝে থাকি। আর ইসলামী সংগঠন তো ইসলামী আন্দোলনের জন্যেই। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই ইসলামী সংগঠনের অন্তর্ভূক্ত জনশক্তিকে ইসলামী সংগঠন পরিকল্পিতভাবে উল্লিখিত কার্যক্রমগুলো আঞ্জাম দেয়ার জন্যেই ব্যবহার করবে। অর্থাৎ ইসলামী সংগঠন দাওয়াত ইলাল্লাহ ও শাহাদাতে হকের দায়িত্ব পালনে যথার্থ ভূমিকা পালন করবে। তার জনশক্তিকে পরিকল্পিতভাবে এর যোগ্য করে গড়ে তুলবে। বিরোধী শক্তির যথার্থ মূল্যায়ন করে তার মোকাবিলার উপায় উদ্ভাবন করে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহন করবে। এভাবে দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে ধাপে ধাপে অগ্রসর হবে। বিজয়ী হলে তো গোটা জনমানুষের মধ্যে আমর বিল মা’রূফ ও নেহী আনিল মুনকারের দায়িত্ব আঞ্জাম দেবে। কিন্তু বিজয়ী হওয়ার আগে একদিকে সংগঠনের অভ্যন্তরে এর বাস্তবায়ন হতে হবে। সেই সাথে যেখানে যতটা সম্ভব সুযোগ সৃষ্টি করে নিয়ে এই দায়িত্ব পালনে প্রয়াস চালাতে হবে।
ইসলামী সংগঠনের নেতৃত্বের শরয়ী মর্যাদা
এরূপ সংগঠনের শরয়ী মর্যাদা প্রসঙ্গে এতটা বলা যায় যে, জাহেলিয়াতের মৃত্যু থেকে বাঁচার জন্যে ও ঈমানের দাবী পূরণের জন্যে এটাই একমাত্র অবলম্বন। এটাই ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিকল্প এবং রাসূল (স.) প্রতিষ্ঠিত ও খোলাফায়ে রাশেদা পরিচালিত জামায়াতের উত্তরসূরী হিসেবে তার প্রতিনিধিত্বের মর্যাদার অধিকারী। দ্বীনের একটা ফরজ কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্যে মসজিদ কায়েম করা হয়। সেই মসজিদকে আমরা কত বড় মর্যাদা দিয়ে থাকি, আর তা আমরা দিতে বাধ্য। ইসলামী সংগঠন বা জামায়ত কায়েম হয় গোট দ্বীন কায়েমের জন্যে, যে দ্বীন কায়েম না হলে ঐ মসজিদের নামাজও সঠিক অর্থে কায়েম হতে পারে না। এই আলোকেই আমরা বুঝে নিতে পারি, ইসলামী সংগঠনের শরয়ী মর্যাদা কি?
ইসলামী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ইসলামী রাষ্ট্র প্রধানের বিকল্প। হাদিসে রাসূলের আলোকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রধানের আনুগত্য রাসূলের আনুগত্যেরই শামিল। এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নায়েবে রাসূলের মর্যাদার অধিকারী। অধস্তন সংগঠনের নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব প্রতিনিধি হওয়ার কারণে সর্বপর্যায়ের নেতৃত্বই পরোক্ষভাবে নায়েবে রাসূলের মর্যাদা রাখে।
ইসলামী সংগঠনের সিদ্ধান্ত সমূহের শরয়ী মর্যাদা
ইসলামী সংগঠন যেহেতু কোরআন ও সুন্নাহর আদর্শকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে এবং এই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্যেই যাবতীয় কার্যক্রম ও পদক্ষেপ গ্রহন করে এবং সে সব ক্ষেত্রেই কোরআন ও সুন্নাহর নিয়ম নীতি Sprit কে সামনে রাখার সাধ্যমত চেষ্টা করে, সুতরাং কোন সিদ্ধান্ত কারও জানামতে কোরআন ও সুন্নাহর আদর্শের পরিপন্থী বলে মনে না হলে সেই সিদ্ধান্তকে কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশেরই মর্যাদা দিতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশের মর্যাদা দিতে হবে। রাসূল (স.) বলেছেন:
من أطاعني فقد أطاع الله ومن اطاع الأمير فقد أطاعني
যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে আমীরের আনুগত্য করল, সে প্রকৃত পক্ষে আমারই আনুগত্য করল। (আল হাদিস)
সুতরাং সংগঠনের কোন সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগতভাবে কারও কাছে পছন্দ না হলে বা কারও মনমত না হলেও সে সিদ্ধান্ত দ্বিধাহীনচিত্তে মেনে নিতে হবে। এই সম্পর্কে কোন বিরূপ মন্তব্য করা বা অসন্তোষ প্রকাশ করার কোন সুযোগ নেই। এইরূপ করাটা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর রাসুলের নির্দেশ অমান্যের শামিল হবে।
আদর্শভিত্তিক ও গণমুখী নেতৃত্বের গুরুত্ব
ইসলামী আন্দোলন সঠিক অর্থে আদর্শভিত্তিক আন্দোলন, কারণ এখানে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষমতা লক্ষ্য নয়। লক্ষ্য একটাই- আদর্শের বিজয়, দ্বীন ইসলামের বিজয়। সেই সাথে এই আন্দোলন গণমুখীও। কারণ এর জাগতিক লক্ষ্য তো দুনিয়ার সর্বস্তরের জনমানুষের কল্যান প্রতিষ্ঠা। সর্বস্তরের জনমানুষকে মানুষের প্রভুত্বের যাঁতাকল থেকে মুক্ত করে আল্লাহর প্রভুত্বের বিশাল ছায়াতলে আশ্রয় দেয়া। কাজেই মুষ্টিমেয় সুবিধভোগী ব্যক্তি ছাড়া সবার আকর্ষণ থাকবে- আপনত্বের অনুভূতি থাকবে এই আন্দোলনের প্রতি, এটাই স্বাভাবিক। আপাততঃ এটা প্রকাশ পায় না সুবিধাভোগী, খোদাদ্রোহী শ্রেণীর প্রভাব প্রতিপত্তি ও দাপটের কারণে। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে এই দাপটের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। আল্লাহর সাহায্যে যখন বিজয়ের মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে তখন বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত মানুষ সমর্থন দিতে থাকে এই আন্দোলনকে।
এই আন্দোলনের মাধ্যমে যে সংগঠন তা হবে প্রধানতঃ আদর্শভিত্তিক। নেতৃত্ব সৃষ্টি, কর্মীসংগ্রহ ও গঠন, সংগঠনের বিস্তৃতি ও দৃঢ়করণ, গণসংযোগ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ,নীতি নির্ধারণ যাবতীয় ক্ষেত্রে আদর্শই হবে এর Guiding force । এই ব্যাপারে সামন্যতম আপোষের কোন অবকাশ নেই। কিন্তু এভাবে আদর্শের প্রাধান্যের কারণে আন্দোলন ও সংগঠন জনগণ থেকে বিচিছন্ন হবে না এবং গণমুখী চরিত্র হারাবে না। কারণ ইসলামী আদর্শ স্বয়ং একটি গণমুখী আদর্শ। ইসলামী আন্দোলনের বক্তব্য মজলুম ও ভুক্তভোগী জনমানুষের সুপ্ত ও অব্যক্ত ব্যথা বেদনারই অভিব্যক্তি। দা’য়ী (আহ্বানকারী) তার বক্তব্য সার্থকভাবে আপোষহীনভাবে উপস্থাপন করতে পারলে, শাহাদাতে হকের বাস্তব নমুনা তুলে ধরতে সক্ষম হলে, জনমানুষের মনের সুপ্ত ও অব্যক্ত কামনা- বাসনা, ব্যথা- বেদনা একদিন প্রচন্ড বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের রূপ নিয়ে দা’য়ীর পাশে দাঁড়াবে।
এভাবে ইসলামী আন্দোলনের সর্বস্তরের কর্মীবাহিনী তাদের আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা ও আদর্শের দাবী অনুযায়ী জনমানুষের প্রতি দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে কমসংখ্যক লোক নিয়েও আন্দোলনে গণমুখী ধারা সৃষ্টি করতে পারে। একটা সংগঠনের গণমুখী হওয়ার জন্যে পাইকারীভাবে সর্বস্তরের মানুষের সংগঠনভুক্ত হওয়া জরুরী নয়। বরং জরুরী হলো সর্বস্তরের মানুষকে সাথে নিয়ে চলতে পারে, সর্বস্তরের মানুষের কাছে আন্দোলন ও সংগঠনের বক্তব্য নিয়ে যেতে পারে, সার্থক প্রতিনিধিত্ব করতে পারে কথা ও কাজের মাধ্যমে, এমন মুষ্টিমেয় লোক। কোরআন বলে:
كَمْ مِنْ فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللَّهِ
কত ছোট ছোট দল বিরাট বিরাট দলকে আল্লাহর সাহায্যে পরাভূত করেছে। (আল বাকারা: ২৪৯)
এই ছোট ছোট দল আকারে, সংখ্যা – শক্তির বিচারে ক্ষুদ্র হলেও সমাজের সজাগ-সক্রিয় জনশক্তি হওয়ার কারণে, সেই সাথে জনমানুষের উপর নৈতিক ও আদর্শিক প্রভাব প্রতিষ্ঠা হওয়ার কারণে, সর্বস্তরের জনমানুষকে সাথে নিয়ে চলা বা সংখ্যাগরিষ্ঠ শক্তির উপর বিজয় লাভ করা সম্ভব হয়েছে। রাসূল (স.)-এর সংগঠনের সূচনালগ্নে মাত্র চারজন সাথী নিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেছেন, সংখ্যার বিচারে এরা চারজন। কিন্তু গুণগত বিচারে সেই সময়ের মক্কার জনজীবনের সাথে এদের ছিল নাড়ির সম্পর্ক। চারজনই গোটা জনপদের সর্বশ্রেণীর জনমানুষের প্রতিনিধিস্থানীয়। হযরত আবু বকর (রা.) সার্বিক বিচারে সেই সমাজের বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাশীল তথা সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন। হযরত খাদিজা (রা.) সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী সমাজের সবার প্রতিনিধিত্ব করার মত যোগ্যতা রাখতেন। বরং তার সুনাম খ্যাতি ও প্রভাব-প্রতিপত্তি নারী পুরুষ উভয়ের মধ্যে ছিল উল্লেখযোগ্য। হযরত আলী (রা.) একজন কিশোর,শুধু ব্যক্তি মাত্র নয়। সমাজের যুবক ও কিশোরদের প্রতিনিধিত্ব করার ও তাদেরকে সাথে নিয়ে চলার সার্বিক যোগ্যতা তার ছিল। এভাবে হযরত যায়েদ নিছক একজন ব্যক্তি নন। একজন ক্রীতদাস মানে সেই সময়ের মজলুম ও মেহনতী মানুষের প্রতিনিধিস্থানীয়। মাত্র এই পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কাফেলাটিকেও [ যার নেতৃত্বে রাসূলে পাক (স.) ] আমার সার্বিক বিচারে আদর্শের প্রশ্নে আপোষহীন একটি গণমুখী সংগঠন বলতে পারি। রাসূলে পাক (স.)এর আন্দোলনের প্রাথমিক স্তরের এই সাংগঠনিক রূপটাই ইসলামী সংগঠনের মডেল। এই ভাবেই একটা আন্দোলন পরিপূর্ণ আদর্শবাদী চরিত্র নিয়ে চলার সাথে সাথে গণমূখী ভূমিকাও পালন করতে পারে।
নেতৃত্বের গুরুত্ব
যে কোন আন্দোলন ও সংগঠনের নেতৃত্ব প্রধান factor হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকে। ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনের ও নেতৃত্বের ভূমিকা এই পর্যায়েরই। বরং আরও অনেক বেশী গুরুত্বের দাবীদার কারণ ইসলামী আদর্শ বা জীবন ব্যবস্থাটা মূলত নেতাকেন্দ্রিক। এর যাবতীয় কার্যক্রমে নেতৃত্বের ভূমিকা প্রধান। আল্লাহর ও রাসূলের আনুগত্যের যে কাঠামো আল কোরআন ঘোষণা করেছে তাতেও নেতৃত্বকে প্রধান ভূমিকায় রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে:
أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ
আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং সেই সব লোকেরও যারা তোমাদের মধ্যে শাসনের দায়িত্বসম্পন্ন। (আন নিসা:৫৯)
লক্ষণীয় আল্লাহর এতায়াত ও রাসূলের এতায়াত আমরা কি সরাসরি সব ক্ষেএে করতে পারি? আমাদের ব্যবহারিক জীবনের সর্বত্রই আল্লাহ ও রাসূলের এতায়াত উলিল আমরের ্এতায়াতের মাধ্যমেই করা সম্ভব। এই জন্যেই রাসূল (স:) বলেছেন, যারা আমার আনুগত্য করে, তারা আল্লাহর আনুগত্য করে। আর যারা আমিরের আনুগত্য করে, তারা আমার আনুগত্য করে। আনুগত্যের অধ্যায়ে বিষয়টি আরও বিস্তারিত আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাল্লাহ।
নেতৃত্বের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূল (স:) বলেন:
إِنَّمَا الإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ وَيُتَّقَى بِهِ
ইমাম বা নেতা ঢালস্বরূপ, যাকে সামনে রেখে লড়াই করা যায় এবং আত্মরক্ষা করা যায়। (আল হাদিস)
মাত্র দু’জন কোথাও ভ্রমণে বের হলেও একজনকে নেতা মানার নির্দেশ থেকে আমরা বুঝতে পারি, মুসলমান নেতাবিহীন জীবন যাপন করতেই পারে না। আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আকায়েদের কিতাবসমূহে নেতৃত্ব বা ইমামতকে ইসলামের মৌলিক বিষয় হিসেবেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ঐ সব কিতাবে ইমাম নিয়োগ (نصب الامام) ও ইমামের মর্যাদা বিষয়ে একটা স্বতন্ত্র অধ্যায় স্থান পেয়েছে। এখানে দলিলের ভিত্তিতে ইমাম নিয়োগকে উম্মতের জন্যে ওয়াজিব বলা হয়েছে অবশ্য এই ওয়াজিব ও ফরযের মধ্যে মানগত ও গুণগত কোন পার্থক্য নেই। প্রথম দলিল হাদিসে রাসূল থেকে বলা হয়েছে:
مَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِي عُنُقِهِ بَيْعَةٌ مَاتَ مَيْتَةً جَاهِلِيَّةً
যে ব্যক্তি ইমামের বাইয়াত গ্রহণ ব্যতীত মারা যায়, তার মৃত্যু হবে জাহেলিয়াতের মৃত্যু। (মুসলিম)
দ্বিতীয় দলিল হিসাবে পেশ করা হয় সাহাবায়ে কেরামগণের (রা.) ইজমা। রাসূলে পাক (স.) ইন্তেকালের পর তার কাফন, জানাযা ও দাফনের কাজ সমাধা করার আগেই উম্মতে মুসলিমার জন্য ইমাম নিযুক্ত করাকে তারা সর্বসম্মতভাবে জরুরী মনে করেছেন।
মানব প্রকৃতির এটা একটা স্বাভাবিক প্রবণতা যে, সে তার চেয়ে বড়, উন্নত বা উত্তম কারও অনুসরণ করতে চায়। ইসলাম মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটা আদর্শ, তাই মানবজাতিকে ইসলামের পথে চলার জন্যে অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য কিছু ব্যক্তি সৃষ্টিকেই ইসলাম প্রাধান্য দিয়েছে।
لِيَكُونَ الرَّسُولُ شَهِيدًا عَلَيْكُمْ وَتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ
যেন রাসূল তোমাদের জন্যে সাক্ষী হয়, আর তোমরা সাক্ষী হও সব লোকের জন্য। (আল হাজ্জ: ৭৮)
এই বক্তব্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এটাই।
ইসলামী নেতৃত্বের সংজ্ঞা
ইসলামী নেতৃত্ব তিনটি শব্দের মর্মার্থের ধারক-বাহক। ১.খলীফা ২.ইমাম ৩. আমীর।
এক: খলিফা অর্থ প্রতিনিধি। মানুষ মাত্রই আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা। এরপর ও নেতাকে খলিফা বলা হয় কেন? অন্য কথায় খোলাফায়ে রাশেদীন কোন অর্থে খলিফা ছিলেন। একটু চিন্তা করলে এবং তাদের বাস্তব কাজের সাথে মিলিয়ে একে বিচার করলে দেখা যায় তারা তিন অর্থে খলিফা ছিলেন। ১.আল্লাহর খলিফা হিসেবে আল্লাহর দ্বীন জারি করা ও আল্লাহর হুকুম আহকাম জারি করার দায়িত্ব পালন করেছেন। ২. খলিফাতুর রাসূল,রাসূল (সঃ) এর অর্বতমানে তারাই কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন্ মুসলমানদের মূল নেতা রাসূল (সঃ) তারা মুসলমানদের পরিচালনা করেছেন কেবলমাত্র তারই প্রতিনিধি হিসেবে। ৩. খলিফাতুল মুসলেমীন বা মুসলমানদের প্রতিনিধি। আমরা একটু আগেই উল্লেখ করেছি মানুষ মাত্রই আল্লাহর খলিফা। কিন্তু মানুষের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনে, ইসলাম কবুল করে তারাই প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালন করে। মুসলমানদের খলিফা বা প্রতিনিধিত্বের কাজ এই ক্ষেত্রে ইজতেমায়ীভাবে খিলাফতের দায়িত্ব পালনের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা, তদারক করা ও নিয়ন্ত্রণ করা। খোলাফায়ে রাশেদীন এই তিন অর্থেই খলিফা ছিলেন। আজকেও ইসলামী নেতৃত্বকে উল্লিখিত তিন অর্থেই খলীফার ভূমিকা পালন করতে হবে।
দুই: যে সামনে চলে তাকেই ইমাম বলা হয়। নামাজের ইমামতি যিনি করেন তিনি সামনে থাকেন। শুধু সামনে থাকেন তাই নয়, তিনি তার পেছনের লোকদের যে নির্দেশ দেন, সে নির্দেশ তিনি নিজে সবার আগে পালন করেন। রুকুর নির্দেশ দিয়ে তিনি বসে থাকেন বা দাঁড়িয়ে থাকেন, অন্যরা রুকু করে বা তিনি সেজদার নির্দেশ দিয়ে নিজে তামাশা দেখেন, অন্যরা নির্দেশ পালন করেন এমনটি কখনো হয় না। বরং ঐসব নির্দেশের উপর তিনি আগে আমল করেন। তিনি রুকু যান অন্যরা তাকে অনুসরণ করেন। তিনি সেজদায় যান তাকে দেখে অন্যরা সেজদা করেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) ত্যাগ ও কোরবানীর নজিরবিহীন উদাহরণ স্থাপনে সক্ষম হওয়ার পর তাকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেন: اني جاعلك للناس اماما
আমি তোমাকে মানবজাতির জন্যে ইমাম বানাতে চাই। এখানে ইমাম অর্থ যেমন নেতা তেমনি অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য ব্যক্তিত্বও। ত্যাগ, কোরবানীর ক্ষেত্রে, ঈমানের অগ্নি পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হওয়ার ক্ষেত্রে এবং আল্লাহর নির্দেশ মাথা পেতে মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি সারা দুনিয়ার মানুষের ইমাম বা অনুসরণীয়।
হাদিসে রাসূলের শিক্ষা অনুযায়ী নেতৃত্ব কামনা করার বা চাওয়ার এবং এই জন্যে চেষ্টা করার কোন সুযোগ নেই। সুতরাং ইমাম অর্থ যদি শুধু নেতা হয়, তাহলে আল্লাহ তায়ালার শেখানো দোয়া واجعلنا للمتقين اماما আমাদেরকে (আমার পরিবারকে) মুত্তাকিদের ইমাম বানাও এর সাথে হাদিসে রাসূলের ঐ কথার Contradiction হয়।কিন্তু যদি এখানে ইমাম অর্থ আদর্শ বা অনুসরণযোগ্য বা অগ্রণী বা অগ্রগামী অর্থ নেয়া হয় তাহলে আর কোন অসুবিধা থাকে না। প্রত্যেক মুসলমান এই কামনা করতে পারে,চেষ্টা সাধনাও করতে পারে যে তাকে অন্যান্যদের জন্যে অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য আদর্শস্থানীয় হতে হবে এবং নমুনা পেশ করতে হবে। ইসলামী নেতৃত্বের মধ্যে ইমামতের এই মর্ম ও তাৎপর্যের বাস্তব প্রতিফলন থাকতে হবে।
তিন: আমীর আদেশদাতাকে বলা হয়। আমর যার পক্ষ থেকে আসে সে-ই আমীর বা উলিল আমর। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে আসল আদেশদাতা, হুকুমদাতা একমাত্র আল্লাহ। الا الله الحكم ان হুকুম দেওয়ার আধিকার তো একমাত্র আল্লাহর।
الا له الخلق والامر তোমরা ভাল করে জেনে নাও, গোটা সৃষ্টিও আল্লাহর এবং সৃষ্টির সর্বত্র হুকুম ও চলবে একমাত্র তাঁরই। তাহলে আমীরের কাজটা এখানে কি? আমীরের কাজ হবে আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন। আল্লাহ ও রাসূলের আদেশ -নিষেধের ভিত্তিতে মুসলিম উম্মতকে পরিচালনা করা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ইসলামী নেতৃত্ব রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যে চারটি কাজ করবে। যেমন: (১)নামাজ কায়েম করবে (২) জাকাত আদায় করবে (৩)সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং (৪) অসৎ কাজে বাধা দেবে। এই চারটি কাজের সবটাই আল্লাহর আদেশ। এখানে আমীরের দায়িত্ব শুধু আল্লাহর এই আদেশ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহন করা। ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রের নাগকিদের জন্যে নামাজ বাধ্যতামূলক করবে। বাধ্যতামূলক জাকাত আদায় করবে। কিন্তু এটা তার নিজের নির্দেশ নয়, আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ মাত্র যেখানে কোরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট আদেশ বা নিষেধ পাওয়া যায় না, এমন ক্ষেএে নির্দেশ দেওয়ার ব্যাপারে তাকে নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করতে হবে। কোরআন সুন্নাহর মূলনীতি ও spirit এর সাথে পরিপূর্ণ সঙ্গতি রেখেই যেন নির্দেশ দিতে পারেন। ব্যক্তিগত খাহেশপ্রসূত ইজতিহাদের ভিত্তিতে কোন আদেশ নিষেধ জারী করার অধিকার ও এখতিয়ার তার নেই।
ইসলামী নেতৃত্বে প্রক্রিয়া
খোলাফায়ে রাশেদীনের নেতৃত্ব লাভের বিষয়টা গভীরভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করলে দেখা যাবে, রাসুল (সা.)-এর সাথীদের মধ্যে যারা তাঁর অনুসরণে সবচেয়ে অগ্রণী ছিলেন ইমানের দৃষ্টিতে, তাকওয়ার দৃষ্টিতে, ত্যাগ-কোরবানির দৃষ্টিতে, মাঠে ময়দানে সামগ্রিক কার্যক্রমের দৃষ্টিতে – পর্যায়ক্রমে তাদের হাতেই মুসলিম জাহানের নেতৃত্ব চলে এসেছে। আর নেতৃত্ব এসেছে মুসলিম উম্মাহর স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের ভিত্তিতে। কারও পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্যে কোন অভিযান চালাতে হয়নি। কাজেই আমরা এখানে নেতৃত্ব নির্বাচনের দুটো মানদন্ড পাচ্ছি। একটা আদর্শের মানে বেশী অগ্রসর। দ্বিতীয়ত: এই অগ্রণী ভূমিকা স্বাভাবিক এবং স্বতঃস্ফূত স্বীকৃতি, এই প্রক্রিয়াই ইসলামী সংগঠনের অনুসরণীয়। এখানে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন সংগঠনের জনশক্তির সেই অংশের প্রতি যারা নিজেদেরকে সংগঠনের কাছে পরিপূর্ণরূপে সঁপে দিয়েছে এবং সংগঠনও যাদের প্রতি পূর্ণ আস্থা পোষণ করেছে।
খেলাফত, ইমামত ও ইমামতের অর্থ ও তাৎপর্য বহনকারী নেতৃত্বই যেহেতু ইসলামী সংগঠনের কাম্য, সুতরাং সংগঠনের নেতৃত্ব হবে আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। তাকে সংগঠনের স্বীকৃত ক্যাডারের আস্থাভাজন হতে হবে এবং ক্যাডাদের স্বতঃস্ফূর্ত পছন্দের ভিত্তিতে নির্বাচিত হতে হবে। ইসলামী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বই যেহেতু আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিত্ব, এই কারণে অধস্তন সংগঠনের নেতৃত্ব হবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতিনিধি। ইসলামে পরামর্শভিত্তিক কাজের গুরুত্ব আছে বিধায় অধস্তন সংগঠন ক্যাডারভুক্ত লোকদের আস্থা যাচাইয়ের জন্যে তাদের পরামর্শ অবশ্য অবশ্যই নিতে হয়। কিন্তু মূলত এসব নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতিনিধি হিসেবেই দায়িত্ব পালন করবে। এটাই রাসূলে করিম (স.) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের যামানার ঐতিহ্য।
ক্যাডারদের পতিনিধি স্থানীয় এবং আহলে রায় লোকদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা পরামর্শ সভা বা মজলিসে শুরা নেতৃত্বকে সংগঠন পরিচালনায়, নীতি নির্ধারণে, কোরআন সুন্নাহর Spirit অনুসরণে সহযোগিতা দান করবে।
নীতিগত ভাবে ইসলামের যৌথ নেতৃত্বের কোন ধারণা নেই। কিন্তু ইসলামের শূরায়ী নেজাম অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে- অনৈসলামিক পরিবেশে একক নেতৃত্বের যেসব খারাপ দিক যথা- স্বেচ্ছাচারিতা, একনায়কত্বের প্রবণতা ইত্যাদির প্রকাশ ঘটে থাকে, এখানে সেগুলোর কোন অবকাশ থাকে না। ইসলামী নেতৃত্বের পাশে শূরায়ী নেজাম থাকার ফলে নেতৃত্বের এই System আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞানুযায়ী প্রেসিডেন্সিয়াল ও পার্লামেন্টারী System এর খারাপ দিকগুলো থেকে মুক্ত। অথচ উভয় System এর ভাল দিকগুলো ধারণ করে।
আমাদের মূল নেতা মুহাম্মদ (স.) তাঁর অবর্তমানে ইসলামী রাষ্ট্রের নেতৃত্বই হোক আর ইসলামী সংগঠনের নেতৃত্বই হোক তাকে রাসূলের প্রতিনিধিস্থানীয় হতে হবে। শেষ নবীর পর তাঁর উম্মতের নেতৃত্বের জন্যে কোন বিশেষ বংশের,গোত্রের বা শ্র্রেণীর জন্যে স্থান নির্ধারিত নেই। সুতরাং উম্মতের নেতৃত্ব উম্মতের মধ্য থেকেই আসতে হবে এবং সেটা আসবে নবীর উসওয়ায়ে হাসানার অনুসরনের মানদন্ডেই। নবী (স.) এর উসওয়ায়ে হাসানা নেতা কর্মী সবার জন্যেই। সুতরাং সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে এই উসওয়ায়ে হাসানা অনুসরণে যত অগ্রসর হবে, যত বেশী তৎপর হবে, নেতৃত্বের মান ততই বৃদ্ধি পেতে থাকবে। কারণ এই নেতৃত্ব আসবে কর্মীদের মধ্য থেকে।
আমরা ইসলামী নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্যময় গুণাবলীর ক্ষেত্রে আল কোরআন হযরত ইব্রাহীম (আ.), মূসা (আ.) ও শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর প্রসঙ্গে যেসব কথা উল্লেখ করেছে তার সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়াস পাব।
হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা অনেক অনেক কথাই উল্লেখ করেছেন, যার সারমর্ম দাঁড়ায়, তিনি ছিলেন ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক, আল্লাহর প্রতি নিবেদিত প্রাণ। ঈমানের প্রতিটি পরীক্ষায় অত্যন্ত সাফল্যজনকভাবে উর্ত্তীণ হয়েছেন তিনি। এর পরেই আল্লাহর ঘোষণা এসেছে:
اني جاعلك للناس اماما
হে ইব্রাহীম (আ.)! আমি তোমাকে বিশ্বের সমস্ত মানুষের নেতা বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর সংগ্রামী জীবন থেকে আমাদেরকে শিক্ষা গ্রহণের তাকিদ দিয়েছেন। তার জীবন থেকে আমরা নিম্নলিখিত শিক্ষাগুলো পেয়ে থাকি।
১.তাওহীদেও প্রশ্নে আপোষহীন, প্রয়োজনে সর্বস্ব ত্যাগে প্রস্তুত। মা-বাপ, আত্নীয়-স্বজন ছাড়তে প্রস্তুত।তাঁর ঘোষণা, হে আমার কওম ! তোমরা যেসব শিরকের মধ্যে নিমজ্জিত আমি তা থেকে নিজেকে মুক্ত বলে ঘোষণা করছি। আমি তো সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে ধাবিত হচ্ছি সেই মহান সত্তার প্রতি যিনি আসমান ও যমীনের স্র্রষ্টা। আর আমি মুশরীকদের অন্তর্ভূক্ত নই।
২.আল্লাহর প্রতি নিবেদিত প্রাণ, আল্লাহর যে কোন হুকুমের কাছে বিনা দ্বিধায় আত্মসমর্পনকারী । তখন তাকে বলা হয় اسلم আত্মসমর্পণ কর। তিনি বলেন:
اسلمت لرب العالمين
আমি রাব্বুল আলামীনের কাছে আত্মসমর্পণ করলাম।
৩.ইমানের প্রতিটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। আল্লাহ তাকে মানুষের নেতা হিসেবে ঘোষণা দেয়ার আগে তাকে সনদ দিলেন এই ভাষায়: وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ
আর ইব্রাহীম (আ.) কে অনেকেগুলো ব্যাপারে পরীক্ষা নেয়া হলো। তিনি সে সবগুলো পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হলেন। (আল বারাকা: ১২৪)
নমরুদের অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়া তিনি পছন্দ করলেন। কিন্তু নমরুদের কাছে মাথা নত করলেন না, তৌহীদের আদর্শ থেকে বিন্দু বিসর্গ এদিক ওদিক হলেন না, বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রী ও কোলের শিশু সন্তানকে জন-প্রাণহীন একস্থানে নির্বাসন দেয়ার নির্দেশ অবলীলাক্রমে পালন করলেন। অবশেষে ঐ পুত্র সন্তান একটু বড় হওয়ার পর, তাঁর বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করতে পারে, এমন পর্যায়ে আসার পর তাকে নিজ হাতে কোরবানী করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাঁর পরিবারকেই একটা মহা পরীক্ষায় ফেললেন। তাঁরা সবাই মিলে এই পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হলেন।
আল্লাহর কাছে মকবুল হওয়ার জন্যে ইসলামী নেতৃত্বকে উল্লিখিত তিনটি গুণের অধিকারী অবশ্যই হতে হবে। মনে রাখতে হবে, ঈমানের অগ্নি পরীক্ষায় ব্যর্থ ব্যক্তিরা কখনই এত বড় কাজের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হতে পারে না।
হযরত মূসা (আ.) এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে দুটো বিশেষ গুণের উল্লেখ হয়েছে, একটা (قوي) অর্থাৎ শক্তিশালী,অপরটি (امين) অর্থাৎ বিশ্বস্ত এবং আমানতদার। আর এই শক্তিশালী ও আমানতদার ব্যক্তিটি নবুয়তের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ পেয়ে, ফেরাউনের দরবারে দাওয়াত নিয়ে যাবার নির্দেশ পেয়েই আল্লাহর কাছে বিশেষ কয়টি বিষয়ের জন্যে দোয়া করলেন, তৌফিক চাইলেন, সেই বিষয়গুলো সর্বকালের সর্বযুগের ইসলামী নেতৃত্বের জন্যেই পথ-পাথেয়।
قَالَ رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِيز وَيَسِّرْ لِي أَمْرِيز وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِنْ لِسَانِي يَفْقَهُوا قَوْلِي وَاجْعَلْ لِي وَزِيرًا مِنْ أَهْلِي هَارُونَ أَخِي اشْدُدْ بِهِ أَزْرِي وَأَشْرِكْهُ فِي أَمْرِي كَيْ نُسَبِّحَكَ كَثِيرًا وَنَذْكُرَكَ كَثِيرًا إِنَّكَ كُنْتَ بِنَا بَصِيرًا
মূসা (আ) নিবেদন করল:হে খোদা! আমার বুক খুলে দাও, আমার কাজকে আমার জন্য সহজ করে দাও এবং আমার মুখের গিরা ঢিলা করে দাও, যেন লোকেরা আমার কথা বুঝতে পারে। আর আমার জন্যে আমার নিজের পরিবারের মধ্য হতে একজন সহকর্মী নির্দিষ্ট করে দাও। হারূন যে আমার ভাই,তাঁর সাহায্যে আমার হাত মজবুত কর এবং তাঁকে আমার কাজে শরীক বানিয়ে দাও, যেন আমরা খুব বেশী করে তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করি,তোমার কথা খুব বেশী মাত্রায় চর্চা,আলোচনা ও স্মরণ করি। তুমি তো সব সময়ই আমাদের অবস্থার প্রতি দৃষ্টিবান থেকেছ।(ত্ব-হা:২৫-৩৫)
হযরত মূসা (আ) এর এই দোয়া আল্লাহ তায়ালা সূরায়ে ত্ব-হার মধ্যে উল্লেখ করেছেন। উক্ত দোয়ায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো আমরা পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। এক . শরহে ছদর। যার শাব্দিক অর্থ বক্ষ সম্প্রসারণ। আর ভাব অর্থ হলো নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট ধারণা। নিজের আদর্শ ও অর্পিত দায়িত্ব পালনে মনে কোন প্রকারের দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, কোন রকমের সংকীর্ণতা না থাকা। রাষ্ট্রশক্তির অধিকারী, চরম স্বৈরাচারী এক শাসক। তার ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি সেই সময় সর্বজনবিদিত। তার ধনবল, জনবল, ক্ষমতা, প্রতিপত্তির মোকাবিলায় হযরত মূসা (আ.)-এর ন্যায় একজন সহায় সম্বলহীন ব্যক্তিকে তার দরবারে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এই নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্যে মূসা (আ.)এই সামনে দুটো বিষয় সন্দেহাতীতভাবে পরিস্কার হওয়া দরকার ছিল।
১. নিজে হকের উপর আছেন -এই ব্যাপারে কোন প্রকার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা অস্পষ্টতা না থাকা এবং এই হক প্রতিষ্টা কিভাবে করতে হবে এই সম্পর্কে স্বচ্ছ, সুস্পষ্ট ধারনা থাকা।
২. ফেরাউনী শক্তি যে বাতিল শক্তি, আপাতদৃষ্টিতে সে যতই শক্তিধর হোক না কেন, পরিণামে তাকে ধ্বংস হতেই হবে এই সম্পর্কেও মনে সুদৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি হওয়া।
দুই. তাইছিরে আমর বা কাজকে যথাসাধ্য সহজভাবে আঞ্জাম দিতে প্রয়াস পাওয়া। দা’য়ী বা ইসলামী নেতৃত্ব যে কোন সময় যে কোন প্রকারের ঝুঁকি নেয়ার জন্যে প্রস্তত থাকবে। ঝুঁকি বা বিপদ-আপদকে আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করবে। কিন্তু কৃত্রিম উপায়ে ঝুঁকি, পরীক্ষা বা বিপদ-মুছিবত কামনা করবে না। বরং নিজের দিক থেকে যথাসাধ্য সহজভাবে, সহজ উপায়ে কাজ সমাধানের প্রয়াস চালাবে এবং সেই প্রয়াসে আল্লাহর সাহায্য কামনা করবে। সূরা বাকারায় আল্লাহ এর সম অর্থবোধক দোয়া শিখিয়েছেন:
رَبَّنَا وَلَا تَحْمِلْ عَلَيْنَا إِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِنَا رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِ وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا أَنْتَ مَوْلَانَا فَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ
হে আল্লাহর রব! আমাদের উপর এমন বোঝা চাপিও না যেরূপ বোঝা তুমি পূর্ববর্তী লোকদের উপর চাপিয়েছ। হে আমাদের রব! আমাদের উপর এমন বোঝা চাপিও না যা বহনের ক্ষমতা আমদের নেই। তুমি মাফ কর, রহম কর। তুমিই আমাদের মাওলা, অতএব কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে তুমি আমাদেরকে বিজয় দান কর। (আল বাকারা:২৮৬)
হাদিসে রাসূলে বলা হয়েছে:
لا تشددوا على انفسكم فيشدد الله عليكم
তোমরা নিজেদের উপর কৃত্রিমভাবে কোন কড়াকড়ি আরোপ করো না, তাহলে আল্লাহ তোমাদের উপর কড়াকড়ি আরোপ করে বসবেন।
يسروا ولا تعسروا بشروا ولا تنفروا
দ্বীনের কাজকে মানুষের জন্যে যথাসাধ্য সহজ করে পেশ কর। কঠিন কর না।লোকদের সুসংবাদ শুনার। তাদেরকে বীতশ্রদ্ধ করে ফেল না।(জামউল ফাওয়াএদ)
তিন. হল্লে আকদ। ভাষা জনগণের বুঝার উপযোগী হতে হবে। অবশ্যই দা‘য়ী তার আদর্শের কথা বলবেন।
স্থান-কাল-পাত্র ভেদে তিনি নীতি বদলাবেন না, কিছু রেখে ঢেকেও বলবেন না। কিন্তু বলবেন এমনভাবে যাতে করে যাদেরকে বলা হয় তারা সঠিকভাবে বুঝতে সক্ষম হয়।নেতাকে জনগনের উদ্দেশ্যেও কথা বলতে হয়,সেক্ষেত্রে কথা জনগণের বুঝবার উপযোগী হয়ে আসতে হবে। কর্মীদের পরিচালনা করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নমুখী হেদায়াত দিতে হয়। তাও তাদের মত হয়ে আসতে হবে।
চার. বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য ও অন্তরঙ্গ সাথী-সহকারী কামনা। এভাবে নিজের দায়িত্ব মজবুত ও সুদৃঢ়ভাবে আঞ্জাম দেয়ার মত উপায় উপকরণ বের করা এবং তাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা। অনুরূপ বিশ্বস্ত ও নির্ভযোগ্য সাথী হিসেবে হযরত ঈসা (আ.) পেয়েছিলেন হাওয়ারীদেরকে। শেষ নবী (স.) পেয়েছিলেন হযরত আবু বকর, ওমর,ওসমান ও আলীর ন্যায় মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে থেকে তাদের অসংখ্য নিবেদিত প্রাণ সাহাবায়ে কেরাম (রা.) দেরকে।
পাঁচ. এই বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সাথী-সহকর্মী কামনা এবং এই জন্যে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ, নিছক নিজের নেতৃত্ব মজবুত করা বা নিজের প্রতি কিছু লোককে বশংবাদ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য হবে না, বরং নেতা ও সহকর্মী সবার লক্ষ্য হবে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বেশী বেশী করে আল্লাহর তাসবীহ পাঠ, জিকির করা যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের যাবতীয় কাযক্রমের আঞ্জাম দেয়া সম্ভব হয়।
শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) -এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই আমাদের জন্যে প্রত্যক্ষ অনুসরণীয় আদর্শ। তাঁর এই বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে গেলে তো গোটা কোরআনকেই আলোচনা করতে হয়। কারণ গোটা কোরআনই ছিল তাঁর আদর্শ। তিনি হলেন বাস্তব ও জীবন্ত কোরআন, আন্দোলনের মূল নেতা হিসেবে আল্লাহ তায়ালা তার নবীর যে গুণাবলী বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, তার কিছু অংশ আমার আলোচনা করবো। সূরায়ে আল আহযাবে আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيرًا وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ بِأَنَّ لَهُمْ مِنَ اللَّهِ فَضْلًا كَبِيرًا وَلَا تُطِعِ الْكَافِرِينَ وَالْمُنَافِقِينَ وَدَعْ أَذَاهُمْ وَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ وَكَفَى بِاللَّهِ وَكِيلًا
হে নবী! আমরা তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীস্বরূপ, সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে এবং খোদার অনুমতিক্রমে তার প্রতি আহ্বানকারী ও উজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে। (তোমার প্রতি) ঈমান গ্রহণকারী লোকদেরকে সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্যে খোদার তরফ হতে বিরাট অনুগ্রহ রয়েছে এবং কাফের ও মুনাফিকদের সম্মুখে আদৌ দমে যেও না, তাদের নিপীড়নকে মাত্রই পরোয়া করো না, খোদার উপর ভরসা কর, আল্লাহই যথেষ্ট যে, মানুষ সমস্ত ব্যাপার তাঁরই উপর সোর্পদ করে দিক। (আল আহযাব: ৪৫-৪৮)
উল্লিখিত আয়াত ক’টিতে মানুষের নেতা হিসেবে সর্বকালের সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ নেতার যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে, তা থেকে নিম্নোক্ত জিনিসগুলো আমরা অনুধাবন করতে পারি।
এক. তিনি শাহেদ। সত্যের সাক্ষদাতা। বাস্তবে নমুনা পেশ করে সাথী-সঙ্গীদের দ্বীনের পথে পরিচালনা করেন। দ্বীনের তালিম দেন। কেবল মুখের নছিহত বা নির্দেশের মাধ্যমে নয়।
দুই. তিনি মুবাশশির। শুভ সংবাদদাতা। আল্লাহর দ্বীন কবুল করে, অনুসরণ করে দুনিয়ায় ও আখেরাতে কি কি কল্যাণ পাবে এই ব্যাপারে মানুষকে অবহিত করা তার দায়িত্ব। এই দায়িত্ব তিনি কঠোরভাবে পালন না করে দরদপূর্ণভাবে উপস্থাপন করেন। ফলে মানুষ, তার সাথী-সঙ্গীগণ জযবা, উৎসাহ- উদ্দীপনা ও স্বতঃস্ফূর্ত পেরণা অনুভব করে।
তিন. তিনি নাজির। আল্লাহর দ্বীন বর্জন ও অমান্য করার পরিণামে দুনিয়ায় কি কি অসুবিধা আছে, আখেরাতে কি কি কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে, এই ব্যাপারে মানুষকে সর্তক বা সাবধান করা তাঁর অন্যতম কাজ। এভাবে শুভ সংবাদ দান ও সতর্কীকরণের মতো দুটো কাজ একত্রে করার ফলশ্র“তিতে গড়ে উঠা অদ্ভুত এবং নজীরবিহীন ভারসাম্যপূর্ণ চরিত্র। মানুষের সমাজ পরিচালনার জন্যে যা একান্ত অপরিহার্য।
চার. তিনি দা’য়ী ইলাল্লাহ। তাঁর আন্দোলন-সংগঠন, তাঁর পরিচালনা – পরিবেশন সব কিছুর সারকথা মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা। সূরায়ে ইউসুফে তো এটাকেই একমাত্র কাজ বা প্রধানতম কাজ বলে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে:
قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ
বল, এটাই আমার পথ যে, আমি আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাই।
উল্লিখিত চারটি বৈশিষ্ট্যময় গুণের বর্ণনা আসছে- নবীর পরিচয়, তার কাজের পরিচয় হিসেবেই। দ্বিতীয় গুণের প্রয়োগের জন্যে নির্দেশ আসছে-মুমিনদেরকে এই মর্মে সুসংবাদ দিন যে, তাদের জন্য আল্লাহ্র পক্ষ থেকে বড় ধরনের অনুগ্রহ অপেক্ষা করছে। আর প্রথমগুলোর প্রয়োগ হিসেবে নির্দেশ আসছে। কাফের এবং মুনাফিকদের কাছে কখনও নতি স্বীকার করবে না, তাদের জুলুম নির্যাতনের কোনই পরোয়া করবে না। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল কর। এভাবে আল্লাহর উপর ভরসা করাই যথেষ্ট।
সূরায়ে আত-তাওবায় শেষ দু’টি আয়াতে বলা হয়েছে:
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ (128) فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُلْ حَسْبِيَ اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ
দেখ, তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্যে একজন রাসূল এসেছেন, তোমাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া তার জন্যে খুবই কষ্টদায়ক। তোমাদের কল্যাণের ব্যাপারে তিনি খুবই আগ্রহী (তোমাদের কল্যাণ তার কাছে খুবই লোভনীয়)। ঈমানদারদের জন্যে তিনি বড়ই সংবেদনশীল ও দয়ালু। এখন যদি এরা আপনার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে হে নবী, আপনি তাদের বলে দিন, আল্লাহই আমার জন্যে যথেষ্ট। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তাঁর উপরই আমি ভরসা করছি। তিনি তো আরশে আজিমের মালিক। (আত তাওবা:১২৮-১২৯)
সূরায়ে আলে ইমরানে আল্লাহর রাসূলকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে:
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ
হে নবী! এটা আল্লাহ তায়ালার বড় মেহেরবানী যে, আপনি তাদের জন্যে খুবই নরম দিলের পরিচয় দিতে পারছেন। এই না হয়ে যদি আপনি কড়া মেজাজের মানুষ হতেন, আর আপনার দিল পাষাণ হতো, তাহলে এরা সব আপনার নিকট থেকে দূরে সরে যেত। তাদের ভুল – ত্রুটি মাফ করে দিন, আল্লাহর কাছেও তাদের জন্যে ক্ষমা চেয়ে দোয়া করুন এবং দ্বীনের কাজে তাদের সাথেও পরামর্শ করুন। যদি কোন ব্যাপারে আপনি স্থির সিদ্ধান্তে পৌছতে সক্ষম হন, তাহলে সে ব্যাপারে আল্লাহর উপর ভরসা করুন। আল্লাহ তো সেই সব লোকদেরকেই পছন্দ করেন, যারা তাঁরই উপর ভরসা রাখে। তাঁরই উপর ভরসা করে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা ও সমাধা করে। (আলে ইমরান: ১৫৯)
সূরা তাওবার শেষ আয়াতটির আলোকে রাসূলের পরিচয়
(১)মানুষের দুঃখ-কষ্ট তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন। শুধু তাই নয়, কিসে কষ্ট লাঘব হতে পারে, কষ্ট দূও হতে পারে, সেই চিন্তা নিয়ে তিনি পেরেশান ও ব্যস্ত থাকেন। (২) কিসে মানুষের কল্যাণ হতে পারে, কিসে মানুষের জীবন ইহকাল ও পরকালে সুখ-শান্তি ও কল্যাণকর হতে পারে সদা সেই চিন্তা ও ভাবনা পোষণ করেন। মানুষের কল্যাণই তাঁর বড় আগ্রহের ব্যাপার, কারণ তিনি রহমাতুল্লিল আলামীন। (৩) মুমিনের প্রতি বিশেষভাবে তিনি দয়াপরবশ এবং দরদী মনের অধিকারী। (৪) এভাবে দরদী মনের মানুষ সাধারণতঃ দুর্বলচেতা হয়ে থাকে। কিন্তু আল্লাহর রাসূল এবং রাসূলের মাধ্যমে তাঁর উম্মত ও উম্মতের মধ্য থেকে নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা একটা বেপরোয়া মনোভাবের সৃষ্টি করে দেয়। ফলে এই দরদী মনের লোকেরাও প্রয়োজনে গোটা দুনিয়ার সমস্ত শক্তির বিরোধিতাকেও পরোয়া করে না। সারা দুনিয়া একদিকে হলেও তাদের মনের দৃঢ়তায় কোন ভাটা পড়ে না।
সূরা আলে ইমরানের বর্ণনাতে ও এর কাছাকাছি বক্তব্যই এসেছে। (১) দিল অত্যন্ত নরম ও কোমলতার পরিপূর্ণ, (২) তার হৃদয় পাষাণ নয়, মেজাজ কড়া বা রুক্ষ নয়, (৩) সাথীদের প্রতি নিজেও ক্ষমা প্রদর্শন করবে, আল্লাহর কাছেও তাদের জন্যে ক্ষমা চাইবে, (৪)তাদের সাথে পরামর্শ করবে, (৫) কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে, দৃঢ় মনোবলের পরিচয় দেবে। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের ফলে এক অনড়-অবিচল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হবে।
সূরায়ে ফাতহের শেষ দিকে আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ (স.) এবং তাঁর সাথীদের অর্থাৎ নেতা ও কর্মীদের কয়েকটি বিশেষ গুণের বর্ণনা এক সাথেই করেছেন এবং দ্বীন বিজয়ী হবেই এমন একটি
ঘোষণার সাথে সাথেই এই গুণগুলোর বর্ণনা করেছেন বলা হয়েছেঃ
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى
وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَكَفَى بِاللَّهِ شَهِيدًا حَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُودِ
তিনি তো আল্লাহই যিনি রাসূল পাঠিয়েছেন হেদায়াত ও দ্বীনে হক সহকারে যাতে তাকে সমস্ত দ্বীনসমূহের উপর বিজয়ী করতে পারে। এই ব্যাপারে আল্লাহর সাক্ষ্য যথেষ্ট। মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর সাথী-সঙ্গীগণ কাফেরদের মোকাবিলায় কঠোর এবং পরস্পরের প্রতি রহমদিল। যখনই তাদের দেখতে পাবে তারা হয় রুকু, সেজদা বা আল্লাহর ফজল এবং রেজামন্দি তালাশে নিয়োজিত আছে। তাদের চেহারায় সেজদার ছাপ বিদ্যমান যা দ্বারা তাদের সহজেই চেনা যায়। (আল ফাতহ: ২৮-২৯)
এখানে কঠোর কোমলের অদ্ভুত সমাবেশ। এমন দু’টি বিপরীতমুখী গুণের সফল প্রয়োগ সীমা লঙ্ঘন না করা, ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব একমাত্র আল্লাহর সাহায্যেই। তাইতো এই গুণের অধিকারী নেতা কর্মী সবাই আল্লাহর সমীপে সেজদায় অবনত হয়ে অনবরত তাঁর ফজল সন্তুষ্টির কামনায় ব্যস্ত ও নিয়োজিত থাকে।
আল কোরআন উপরের যে সব গুণের কথা আলোচনা করেছে মুহাম্মদ (স.) ইসলামী কাফেলার নেতা হিসেবে ঐ সবের মূর্ত প্রতীক ছিলেন। ইসলামী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাধ্যমত এই উসওয়ায়ে হাসানার সফল অনুসরণের প্রয়াস পেতে হবে।
হাদিসে রাসূলের আলোকে নেতৃত্বের গুণাবলী
عَنْ عَوْفِ بْنِ مَالِكٍ رضي الله تعالى عنه قال سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَقُول خِيَارُ أَئِمَّتِكُمُ الَّذِينَ تُحِبُّونَهُمْ وَيُحِبُّونَكُمْ وَتصَلُّونَ عَلَيْهِمْ وَيُصَلُّونَ عَلَيْكُمْ وَشِرَارُ أَئِمَّتِكُمُ الَّذِينَ تُبْغِضُونَهُمْ وَيُبْغِضُونَكُمْ وَتَلْعَنُونَهُمْ وَيَلْعَنُونَكُمْ .قالَ قلنا يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلاَ نُنَابِذُهُمْ قَالَ لاَ مَا أَقَامُوا فِيكُمُ الصَّلاَة لاَ مَا أَقَامُوا فِيكُمُ الصَّلاَةَ
হযরত আওফ ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (স.) কে বলতে শুনেছি তোমাদের ঐসব নেতারাই উত্তম নেতা যাদেরকে তোমরা ভালবাসা এবং তারা তোমাদেরকে ভালবাসেন। তোমরা তাদের জন্যে দোয়া কর আর তারা তোমাদের জন্য দোয়া করে। আর তোমাদের ঐসব নেতারাই নিকৃষ্ট নেতা যাদের প্রতি তোমরা বিক্ষুব্ধ এবং তারাও তোমাদের প্রতি বিক্ষুব্ধ। হযরত আওফ বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা:) তাদেরকে কি আমারা পদচ্যুত করতে পারবো না? রাসূলুল্লাহ (স): বললেন, না, যতক্ষণতারা তোমাদের মাঝে নামাজ কায়েম করবে।
إذا أراد الله بقوم خيرا ولى عليهم حُلماءَهم وقضى بينهم علماؤهم وجعل المال فى سمحائهم وإذا أراد بقوم شرًّا ولى عليهم سفهاءَهم وقضى بينهم جُهَّالُهم وجعل المال فى بخلائهم
আল্লাহ যখন কোন জাতির কল্যান চান, তখন তাদের উপর সহনশীল লোকদের নেতৃত্ব দান করেন,তাদের মধ্যকার বিচার-ব্যবস্থা, দায়িত্ব জ্ঞানী লোকদের উপর অর্পন করেন এবং অর্থ-সম্পদ দান করেন দানশীল লোকদেরকে। আর যখন কোন জাতির অকল্যান চান তখন তাদের উপর নির্বোধ লোকদের নেতৃত্ব চাপিয়ে দেন।তাদের মধ্যে বিচার ফয়সালার দায়িত্ব অজ্ঞ লোকদের উপর অর্পন করেন এবং ধন-সম্পদ দান করেন কৃপণ লোকদের হাতে। (দায়লামী)
عن عَائِذَ بْنَ عَمْرٍو انه دَخَلَ عَلَى عُبَيْدِ اللَّهِ بْنِ زِيَادٍ مَالِكٍ رضي الله تعالى عنه فَقَالَ َيْابُنَيَّ إِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ إِنَّ شَرَّ الرِّعَاءِ الْحُطَمَةُ فَإِيَّاكَ أَنْ تَكُونَ مِنْهُمْ
হযরত আয়েজ ইবনে আমের রা: থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, একদিন হযরত উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ আমার কাছে এসে বলেন, বাপু হে শোন! আমি রাসূলুল্লাহকে বলতে শুনছি, নিকৃষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তি হলো রাগী বদমেজাজী ব্যক্তি (অর্থাৎ পাষাণ দিলের মানুষ, যে তার অধীনস্থ লোকদের উপর শুধু জুলুম করে, তাদের সাথে কখনো নরম ব্যবহার করে না, দরদ দেখায় না।) খবরদার! আমি তোমাকে সাবধান করছি- তুমি যেন তাদের অন্তর্ভক্ত না হও। (বুখারী ও মুসলিম)
عن عائشة رضي الله تعالى عنها قالت سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول في بيتي هذا “اللهم من ولي من أمر أمتي شيئا فشق عليهم فاشقق عليه ومن ولي من أمر أمتي شيئا فرفق بهم فارفق به
হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি আমার ঘরে আল্লাহর রাসূলকে বলতে শুনেছি (তিনি এই বলে দোয়া করেছেন), হে আল্লাহ! আমার উম্মতের কোন সামষ্টিক কার্যক্রমের কোন বিষয় যদি কেউ দায়িত্বশীল নিযুক্ত হয়, অতঃএব তাদের প্রতি কঠোর আচরণ করতে থাকে- তাহলে তুমি তার প্রতি কঠোর আচরণ করবে। আর যদি কেউ আমার উম্মতের কোন বিষয়ের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদের সাথে নরম ব্যবহার করে, তাহলে তুমিও তাদের সাথে নরম ব্যবহার করবে। (মুসলিম)
عن عائشة رضي الله تعالى عنها قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم إن الله يحب الرفق في الأمر كله
আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ নরম আচরণকারী এবং যাবতীয় কার্যক্রমে তিনি নরম আচরণই পছন্দ করেন। (বুখারী ও মুসলিম)
وعنها ان النبي صلى الله عليه وسلم إِنَّ اللَّهَ رَفِيقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ وَيُعْطِى عَلَى الرِّفْقِ مَا لاَ يُعْطِى عَلَى الْعُنْفِ وَمَا لاَ يُعْطِى عَلَى مَا سِوَاهُ
হযরত আয়েশা আরো বলেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, আল্লাহ দরদী- তিনি দরদপূর্ণ আচরণই পছন্দ করেন। তিনি দরদপূর্ণ আচরণের বিনিময়ে এমন কিছু দিয়ে থাকেন যা রাগী বদমেজাজী লোকদের কখনও দেন না। এমন কি আল্লাহ তার ঐ বিশেষ দান, বিশেষ অনুগ্রহ আর কোন কিছুর বিনিময়েই দেন না। (বুখারী ও মুসলিম)
عن جَرِيرَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ رضي الله تعالى عنه قَالَ سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يَقُولُ مَنْ يُحْرَمِ الرِّفْقَ يُحْرَمِ الْخَيْرَ كُلَّهُ
হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি নরম ব্যবহার বা দরদপূর্ণ ব্যবহার থেকে বঞ্জিত সে প্রকৃতপক্ষে যাবতীয় কল্যাণ থেকেই বঞ্জিত। (মুসলিম)
عن عائشة عائشة رضي الله تعالى عنها قالت :ما خير رسول الله صلى الله عليه و سلم بين أمرين قط الا أخذ أيسرهما ما لم يكن إثما فإن كان اثما كان ابعد الناس منه وما انتقم رسول الله صلى الله عليه و سلم لنفسه الا ان تنتهك حرمة الله فينتقم لله به
হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর নিকট কোন দু’টি কাজের মধ্যে একটি বাছাই করার এখতিয়ার যদি দেয়া হতো তাহলে তিনি অপেক্ষাকৃত সহজটাই গ্রহণ করতেন, যদি না সেটা কোন গুণাহের কাজ হতো। যদি কোন গুণাহের কাজ হতো তাহলে তিনি ছিলেন তা থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থান গ্রহণকারী। রাসূলুল্লাহ (স.) কখনও ব্যক্তিগত স্বার্থে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। হ্যাঁ, যদি কখনও আল্লাহপাকের নিষিদ্ধকৃত কোন ব্যাপারে কেউ জড়িয়ে পড়েছে, আল্লাহ প্রদত্ত সীমা লঙ্ঘনের প্রয়াস পেয়েছে- তখন তিনি নিছক আল্লাহর জন্যেই প্রতিশোধ নিয়েছেন। (বুখারী ও মুসলিম)
عن انس رضي الله تعالى عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال بَشِّرُوا وَلاَ تُنَفِّرُوا وَيَسِّرُوا وَلاَ تُعَسِّرُوا
হযরত আনাস (র.) বলেন, রাসূল (স.)বলেছেন, সহজ কর, কঠিন করো না, সুসংবাদ দাও… বীতশ্রদ্ধ করো না। (বুখারী ও মুসলিম)
عن أبي هريرة ، رضي الله عنه ، أن رجلا قال للنبي صلى الله عليه وسلم أوصني قال : لا تغضب فردد مرارا قال : لا تغضب
হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল (স.) কে বলল, আমাকে কিছু উপদেশ দিন। উত্তরে রাসূল (সা.) বললেন, রাগ করবে না, একথা কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করে বললেন, রাগান্বিত হবে না। (বুখারী)
لا ينبغي للرجل ان يأمر بالمعروف وينهى عن المنكرحتى يكون فيه ثلاث خصال رفيق بما يأمر، عالم بما ينهى، عادل فيما ينهي
তিনটি গুণের অধিকারী না হয়ে কোন ব্যক্তির আমর বিল মা’রূফ এবং নেহী আনিল মুনকারের কাজে আত্বনিয়োগ করা উচিত নয়। গুন তিনটি এই: (১) যাকে হুকুম দেবে বা নিষেধ করবে, তার প্রতি দরদী, সংবেদনশীল হতে হবে। (২) যে ব্যাপারে নিষেধ করবে সে বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী হবে। (৩) যে ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করবে, সেক্ষেত্রে পরিপূর্ণ ইনসাফ করতে সক্ষম হতে হবে। (দায়লামী, মিনহাজুস সালেহীন)
اذا اراد الله بعبد خيرا جعل له واعظا من نفسه يأمر وينهاه
যখন আল্লাহ তার কোন বান্দার কল্যাণের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তার মনকে তার জন্যে নছিহতকারী বানিয়ে দেন, মনই তাকে ভাল কাজে উদ্বুদ্ধ করে আর খারাপ কাজে বাধা দান করে। অথবা এর অর্থ এও হতে পারে যে, সে ভাল কজের উপর আমল করে খারাপ কাজ বর্জন করে নমুনা পেশ করে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়। (দায়লামী, মিনহাজুস সালেহীন)
রাসূল পাক (স.) থেকে অনুরূপ আরও বহু নছিহতপূর্ণ হাদিস রয়েছে। আল্লাহর কোরআনে তাঁর যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে, তিনি বাস্তব জীবনে নিজে এর চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন এবং তাঁর সাথী-সঙ্গীদের মাধ্যমে যুগ-যুগান্তরের মানুষের জন্যে সেই উত্তম আখলাকের কথা পৌছাবার, এর উপর আমল করা তাকিদ করেছেন। আমাদের সমাজে একটা ভুল ধারণা কাজ করছে যে, নেতৃস্থানীয় লোকদের ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতিই হয় না একটু মেজাজ না দেখালে। তাই সাধারণত: ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকদেকে বদমেজাজী দেখা যায় অথবা বদমেজাজী লোকদেরকে ভুলে আমরা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হিসেবে গণ্য করে আসছি। রাসূলের (সা.) চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের পরিচয় কারও জানা আছে কি? কেবল দ্বীনি বিচারেই নয়, দুনিয়ার যে কোন মানদণ্ডেও তো তিনি সর্বকালের সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। এই তো মাত্র সেদিন আমেরিকার জনৈক লেখক দুনিয়ার সেরা একশত ব্যক্তিত্বের উপর গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে রহমতুল্লিল আলামীন মুহাম্মদ (সা.) কেই শীর্ষস্থান দিতে বাধ্য হয়েছেন।
ইসলামী হুকুমাতের নেতা বা কোন দায়িত্বশীল হোক বা ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনের দায়িত্বশীলই হোক তাকে রহমাতুল্লিল আলামীনের প্রতিনিধিত্ব মানতে হবে। সুতরাং তার সামনে ব্যক্তিত্বের মডেল হিটলার, মুসোলিনী তো হতেই পারে না-রহমতের প্রতীক,দয়া মায়ার মূর্ত প্রতীক মুহাম্মদ (সা.) ই হতে হবে। তাঁর শ্রেষ্ঠ সাথী মুসলিম জাহানের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা.) – এর সম্পর্কে আমরা কি মূল্যায়ন করব। স্বয়ং মুহাম্মদ (সা.) -এর ভাষায়:
ارحم امتي ابو بكر
আমার উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে বেশী দয়াশীল হলো আবু বকর (রা.)।
নবী রাসূলগণের পরে এই শ্রেষ্ঠ মানুষটি রহমদিল। সবচেয়ে বেশী রহমদিল হওয়া সত্ত্বে ও তাঁর ব্যত্তিত্বের প্রভাব কোথাও ক্ষুন্ন হয়েছে কি? রাসূল (সা.)- এর ওফাতের পরবর্তী পরিস্থিতিতে তিনি কি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের পরিচয় দেননি? ভণ্ড নবীদের দমন করার ব্যাপারে, জাকাত অস্বীকারকারীদের সমুচিত শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারে তিনি কি বলিষ্ঠতার পরিচয় দেননি?
হ্যাঁ, হযরত ওমর (রা.) অপেক্ষাকৃত শক্ত মনের ছিলেন। কিন্তু তিনি শক্ত ছিলেন আল্লাহর আদেশ- নিষেধের ব্যাপারেই- اشدهم في امر الله
তবুও এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, তার খেলাফতের প্রস্তাবের সময় এই কঠোরতার জন্যে আপত্তি উঠেছিল। হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেছিলেন, দায়িত্ব আসলে টিক হয়ে যাবে। দায়িত্ব পেয়েই তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করতে গিয়ে কাতর কণ্ঠে বলেছিলেন- আল্লাহ আমার দিলকে নরম করে দাও। খেলাফতের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ইতিহাসের এই কঠোর ব্যক্তিত্বও জনসাধারণের প্রতি আচরণে দরদী মনের পরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন।
ঐ বাঞ্ছিত গুণাবলী অর্জনের উপায়
আল কোরআনে স্বয়ং আল্লাহর রাসূলের যেসব গুণের কথা বলা হয়েছে, হাদিসে রাসূলের তাকিদ অনুযায়ী- তার উম্মতের বিভিন্নমুখী কার্যক্রম পরিচালনা যারা করবে, তাদের মাঝে গুণ সৃষ্টির তাকিদ আল্লাহর রাসূল দিয়েছেন- সেই গুণ সৃষ্টি করার উপায় কি? এই সম্পর্কে সংক্ষেপে বলতে হয়, আল্লাহ স্বয়ং তার রাসূল (সঃ) কে রিসালাতের দায়িত্ব পালনের জন্যে যোগ্যতা অর্জন করার প্রস্তুতি গ্রহণ করার যে হেদায়েত দান করেছিলেন, তার অনুসরণই উত্তম বরং একমাত্র উপায়। আল্লাহ তায়ালার এই হেদায়াত আমরা পাই সূরায়ে মুদ্দাসসিরের প্রথম সাত আয়াতে এবং সূরায়ে মুযাম্মিলের প্রথম রুকুতে। মুদ্দ্সসিরের প্রথম সাত আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো-১.দ্বিধা সংকোচ ও জড়তা কাটিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে মাঠে ময়দানে দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত হতে হবে। ২.মানব জাতিকে খোদাহীন সমাজ, ব্যবস্থা, সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিণাম ও পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক-সাবধান করার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। ৩.আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে বর্তমান অবস্থা পরিবর্তনের আহবান জানাতে হবে। ৪.এই কঠিন দায়িত্ব পালনের জন্যে দা’য়ীর ব্যক্তিত্ব আকর্ষণীয় হতে হবে। আর সেই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব গড়ার উপায় হিসেবে বাহ্যিক ও আত্মিক উভয় দিক দিয়ে পাক-পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্জন করতে হবে। শারীরিক দিক দিয়ে পোশাক- পরিচ্ছদের দিক দিয়ে এবং আচার ব্যবহার,আমল আখলাকের দিক দিয়েও পূত পবিত্রতার অধিকারী হতে হবে। ৫. আল্লাহর আজাবের কারণ ঘটায় এমন সব কাজ বর্জন করে চলতে হবে। এই ব্যাপারে সদা সতর্ক, সাবধান থাকতে হবে। ৬. সৃষ্টি জগতে কারও কাছে কোনদিন কোন প্রতিদানের আশায় কোন কাজ করা যাবে না। রবের জন্যে ধৈর্য ধারণ করবে।
সূরায়ে মুযাম্মিলের প্রথম রুকুর শিক্ষণীয় দিক গুলো নিম্নরূপ: ১.আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে রাত্রের কিছু অংশ (এক তৃতীয় অংশ, অর্ধেক বা তার কিছু কম বেশী) জাগার অভ্যস গড়ে তুলবে। ২. আল্লহর কিতাবের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর জন্যে বুঝে বুঝে ধীরে ধীরে কোরআন অধ্যায়ন বা তেলাওয়াত করবে। এই তেলওয়াত নামাজের মাধ্যমেও হতে পারে নামাজের বাইরেও হতে পারে। ৩. দিনের ব্যস্ততার মধ্যেও আল্লাহর জিকির করবে। ৪. দুনিয়র সবকিছু থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে একমাত্র আল্লাহর দিকে রুজু হওয়ার প্রয়াস চালাবে। ৫. যেহেতু আল্লাহ মাশরিক ও মাগরিবের রব, তিনি ছাড়া কোন ইলহ নেই। অতএব একমাত্র তার উপর ভরসা করবে, একমাত্র তাকেই অভিভাবক বানাবে। ৬.প্রতিপক্ষের,বিরুদ্ধবাদীদের বিরোধিতা, সমালোচনার মোকাবিলয় ধৈর্য ধারণ করবে। ৭. উত্তম আখলকের মাধ্যমে তাদেরকে এড়িয়ে চলবে। ৮. বিরোধিতার নায়ক দেরকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করবে।
নেতৃত্বের মৌলিক দায়িত্ব
ইসলমী নেতৃত্ব যেহেতু রাসূলের প্রতিনিধিস্থানীয় মর্যাদার অধিকারী, সুতরাং তার মৌলিক দায়িত্ব সেটাই যা আল্লাহর রাসূলকে আঞ্জাম দিতে হয়েছে। আল্লাহর রাসূলের মৌলিক কাজ কোরআন মাজীদের তিনটি জায়গায় একই ভাষায় এসেছে। সূরা আল বাকারায় হযরত ইব্রাহীম (আঃ)এর দোয়া হিসেবে:
رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
(البقرة : 129)
হে খোদা! এদের প্রতি এদের জাতির মধ্য হতে এমন একজন রাসূল প্রেরণ কর, যিনি তাদেরকে তোমার আয়াত সমূহ পাঠ করে শুনাবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দান করবেন এবং তাদের বাস্তব জীবনকে পরিশুদ্ধ ও সুষ্ঠুরূপে গড়বেন। তুমি নিশ্চয়ই বড় শক্তিমান ও বিজ্ঞ। (আল বাকারা:১২৯)
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ (الجمعة : 2)
তিনিই যিনি উম্মীদের মধ্যে একজন রাসূল স্বয়ং তাদেরই মধ্য হতে দাঁড় করিয়েছেন যিনি তাদেরকে তার আয়াত শোনান তাদের জীবন পরিশদ্ধ ও সুগঠিত করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন। (সূরা জুমআ:২)
উক্ত আয়াতগুলোর আলোকে রাসূলের মৌলিক কাজ হিসেবে আল্লাহ চারটি কাজের কথা উল্লেখ করেছেন ১.তেলাওয়াত আয়াত ২. আল্লাহর কিতাবের তালিম ৩. হিকমতের তালিম ৪. তাজকিয়ায়ে নফস।
আজকের দিনে নায়েবে রাসূলের দায়িত্ব পালন যারা করতে চান, তাদেরকে ও রাসূল (সঃ) এর পক্ষ থেকে ঐ দায়িত্ব সমূহ আঞ্জাম দিতে হবে। যত পরিকল্পনা, যত কর্মসূচি, যত কর্মকৌশলই গ্রহণ করা হোক না কেন, তা এই মৌলিক কাজ সম্পাদনের জন্যেই করতে হবে যার স্বভাবিক দাবী সংগঠনের আওতাভুক্ত লোকদের ঈমানের তরক্কির ব্যবস্থা করা, কোরআন সুন্নাহর শিক্ষাসমুহের বাস্তবপদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের ব্যবস্থা করা, সর্বোপরি আদের আমল আখলাক উন্নত করার, আত্মশুদ্ধি ও আত্মিক উন্নতি লাভের ব্যবস্থা করা। এভাবে আল কোরআনের বাঞ্ছিত মান অনুযায়ী লোক তৈরি করতে পারাই একজন সংগঠকের প্রকৃত সফলতা।
নেতা ও কর্মীর সম্পর্ক
ইসলামী সংগঠনের নেতা ও কর্মীর সম্পর্ক বস্ ও সাবোর্ডিনেটের সম্পর্ক নয়, বা অফিসার ও কর্মচারীদের সম্পর্ক নয়। এই সম্পর্ক ভ্রাতৃত্বের। নেতা ও কর্মীকে ভ্রাতৃত্বের দাবী নিয়ে, দরদ নিয়ে, আবেগ অনুভূতি নিয়ে পরিচালনা করবে। কর্মী নেতাকে ভ্রাতৃতুল্য ভক্তি শ্রদ্ধাসহ গ্রহন করবে। আমরা বস্ ও নেতাদের মধ্যে কথা-কাজে, আচার-আচরণে নিম্নোক্ত পার্থক্য দেখতে পাই:
১. বস্ সাধারণত মেজাজ দেখিয়ে লোকদেরকে দূরে সরিয়ে রাখে, আর নেতা তাদেরকে নম্র ব্যবহারের মাধ্যমে কাছে টানে।
২. বস্ সাধারণত আইনের ও কর্তৃত্বের উপর নির্ভরশীল থাকে, আর নেতা নির্ভর করে তার প্রতি কর্মী ও সাথী-সঙ্গীদের শুভেচ্ছা ও শুভ ধারণার উপর।
৩.বস্ তার অধীনস্থদের মনে তার সম্পর্কে এক ধরনের ভীতির ভাব সৃষ্টি করে তাদেরকে সন্ত্রস্ত করে রাখে- কিন্তু নেতা তার সহকর্মী ও সাথী-সঙ্গীদের মনে উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি করে।
৪. বসের মধ্যে আমিত্বের প্রাধান্য থাকে এবং তার কথা-বার্তায় আমি আমি শব্দ বেশী বেশী উচ্চারিত হয়। নেতা সকলকে সাথে নিয়ে কথা বলেন, কাজ করেন, তাই তার কথায় আমির পরিবর্তে আমরা উচ্চারিত হয়ে থাকে।
৫. বস্ তার অধীনস্থদের যেখানে সময়মত আসার নির্দেশ দেয়, সেখানে নেতা সময়ের আগে উপস্থিত হয়।
৬. বস্ অধীনস্থদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে থাকে। আর নেতা অভিযোগ না এনে অচলাবস্থা নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
৭. বস্ কাজটা কিভাবে করতে হবে বলে দিয়েই দায়িত্ব শেষ মনে করে। আর নেতা কাজটা কিভাবে করতে হয় বাস্তবে তা দেখিয়ে দেয়।
৮. বস্ সাধারণত কাজের ব্যাপারে একঘেয়েমি সৃষ্টি করে থাকে, যার ফলে সহজ কাজও অনেক ক্ষেত্রে কঠিন মনে হয়। আর নেতা কঠিন কাজকে সহজ করে ফেলে সহকর্মীদের মনের আবেগ অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে।
৯. কাজ শেষে বিদায়ের মুহূর্তে বস্ যেখানে বলবে, তোমরা বা আপনারা চলে যান, সেখানে নেতা বলবে, চলুন আমরা যাই বা এবা আমরা যেতে পারি।