সপ্তম অধ্যায়ঃ সমালোচনা ও আত্ম-সমালোচনা
ব্যক্তি গঠনের জন্যে আত্ম-সমালোচনা এবং সাংগঠনিক সুস্থতা, সংশোধন ও গতিশীলতার জন্যে গঠনমুলক সমালোচনার সুযোগ থাকা ”অপরিহার্য। এই আত্ম-সমালোচনা ও সমালোচনা ইসলামের একটা পরিভাষা হিসেবে ইহতেসাব এবং মুহাসাবা নামে পরিচিত । এহতেসাব ও মুহাসাবা দুটোরই অর্থ হিসাব নেয়া। ইহতেসাব- হিসাব আদয় করা। মুহাসাব- পরস্পরে একে অপরে হিসাব নেয়া। এই হিসাব নেয়া বা আদায়টা প্রকৃতপক্ষে আখেরাতে আল্লাহর কাছে যে হিসাব দিতে হবে, তার পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমাদের ব্যক্তিগতভাবে সবাইকে আল্লাহর কাছে এই দুনিয়ার যাবতীয় কার্যক্রম, যাবতীয় দায়দায়িত্ব সম্পর্কে হিসাব দিতে হবে। সংঘবদ্ধ জীবন যাপন করতে গিয়ে আমাদের পরস্পরের প্রতিও দায়িত্ব রয়েছে। অপর ভাইকেও সেই হিসাবের ব্যাপারে এই দুুনিয়ায় থাকতেই সাহায্য সহযোগীতা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সেই সাথে আমাদের সামষ্ঠিক কার্যক্রমের ভালমন্দের দায়-দায়িত্বও আমাদের বহন করতে হয়- সুতারাং ইহতেসাব ও মুহাসাবা আমাদের করতে হয় তিনটি পর্যায়ে:
১. ব্যক্তিগত ইহতেসাব বা আত্বসমালোচনা ২. সাথী ও বন্ধুদের একে অপরের মুহাসাবা ৩. সামষ্টিক কার্যক্রমের মুহাসাবা বা পর্যালোচনা।
আমাদের তিন পর্যায়ের মুহাসাবা পদ্ধতি আলোচনার আগে আখেরাতের হিসাবের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও রাসূলের ঘোষণার সাথে একবার পরিচিত হওয়া যাক। কোরআন ঘোষনা করছে:
اقْتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمْ وَهُمْ فِي غَفْلَةٍ مُعْرِضُونَ.
মানুষের হিসাব অতি নিকটে ঘনিয়ে আসছে অথচ তারা গাফলতির মধ্যে বিমুখ হয়ে পড়ে রয়েছে। (আল আম্বিয়া: ১)
إِنَّ إِلَيْنَا إِيَابَهُمْ – ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا حِسَابَهُمْ.
সন্দেহ নেই তাদেরকে আমাদের কাছেই ফিরে আসতে হবে। অতঃপর আমাকে তাদের হিসাব নিতে হবে। (আল গাশিয়াহ: ২৫)
إِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ.
নিশ্চিত জেনো, আল্লাহ অতি দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। (আলে ইমরান: ১৯৯)
فَلَنَسْأَلَنَّ الَّذِينَ أُرْسِلَ إِلَيْهِمْ وَلَنَسْأَلَنَّ الْمُرْسَلِينَ.
যাদের প্রতি রাসূল পাঠানো হয়েছিল আমি তাদের অবশ্য অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করে ছাড়ব। আর ঐ সব নবী-রাসূলগণকেও জিজ্ঞাসাবাদ করবো। (আল আরাফ: ৬)
وَإِنَّهُ لَذِكْرٌ لَكَ وَلِقَوْمِكَ وَسَوْفَ تُسْأَلُونَ.
অবশ্যই এই কিতাব আপনার জন্যে এবং আপনার কাওমের জন্যে একটি স্মারক, আর আপনারা সবাই অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হবেন। (আয যুখরুফ: ৪৪)
وَلَتُسْأَلُنَّ عَمَّا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ.
তোমাদের কার্যক্রম সম্প্রর্ক তোমাদেরকে অবশ্য অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (আন নাহল: ৯৩)
হাদিসে বলা হয়েছে:
كلكم راع و كلكم مسئول عن رعيته فالأمير الذي على الناس راع و هو مسئول عنهم و الرجل راع إلى أهل بيته و هو مسئول عنهم و امرأة الرجل راعيته على بيت بعلها و ولده و هي مسئولة عنهم و عبد الرجل راع على مال سيده و هو مسئول عنهم فكلكم راع وكلكم مسئول عن رعيته
তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই যার যার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হবে। দেশের শাসক একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি, তাকে তার দেশবাসীর প্রতি দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন পুরুষ সংসারের দায়িত্বশীল, এই দায়িত্ব সম্পর্কে তাকে জবাবদিহী করতে হবে। স্ত্রী স্বামীর সংসারে সন্তানাদি দেখাশুনার জন্যে দায়িত্বশীলা- তাকে তার ঐ দায়িত্বের জন্যে জবাবদিহি করতে হবে। জেনে রাখ, তোমরা সবাই যার যার জায়গায় দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই এইজন্যে জবাবদিহি করতে হবে। (বুখারি ও মুসলিম)
এক: ব্যক্তিগত ইহতেসাব বা আত্মসমালোচনা
যে বা যারা ব্যক্তিগতভাবে ইহতেসাব বা আত্মসমালোচনা করে অভ্যস্ত নয় সে বা তারা অন্য ভাইয়ের ভুল সংশোধনের উদ্দেশ্যে বা সামষ্টিক কার্যক্রমের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ইনসাফপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে না। এই পর্যায়ের ইহতেসাবের ফলশ্রুতিতে ব্যক্তি নিজের ভুল-ত্রুটিকে বড় করে দেখতে অভ্যস্ত হয় এবং অপরের ভুল ত্রুটিকে সে তুলনায় অনেক নগন্য মনে করে। পক্ষান্তরে নিজের ভাল কাজগুলোর পরিবর্তে অপরে ভাল কাজগুলোকে বড় করে দেখার মন মানসিকতার অধিকারী হয়। এভাবে অন্যে হেয় প্রতিপন্ন করার বা ছোট করে দেখার মানসিক ব্যধি থেকে সে বা তারা নিজেদেরকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়।
ব্যক্তিগত ইহতেসাবের পদ্ধতি
এই ব্যক্তিগত পর্যায়ের ইহতেসাবও আমরা তিন ভাবে করতে পারি: (১) আনুষ্ঠানিকভাবে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ব্যক্তিগত রিপোর্ট সংরক্ষণ ও পরিচালনার মুহূর্তটা সর্বোত্তম মুহূর্ত। দিনান্তরের এই মুহূর্তটিতেই আমাদের কার্যক্রমের চিত্রটি বলে দেয়- আমরা কি করেছি, আর কি করতে পারিনি এর অনিবার্য দাবী হলো যা কিছু করতে পারিনি, করা সম্ভব হয়নি, সে জন্যে অনুতপ্ত হওয়া অনুশোচনা করা এবং আল্লাহর কাছে খালেস দিলে তওবা করে ভবিষ্যতের জন্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া। আর যা কিছু করতে পেরেছি তার জন্যেও আল্লাহ তায়ালার কাছে শুকরিয়া আদায় করে তার পছন্দনীয় কাজে আরও বেশী বেশী তৈৗফিক কামনা করা।
২. স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেরআন এবং হাদীছ পড়ার মুহূর্তে, আত্মসমালোচনা বা আত্মজিজ্ঞাসার অভ্যাস গড়ে তোলা। সেই সাথে ইসলামী সাহিত্য পাঠের মুহূর্তে দায়িত্বশীলদের হেদায়েতপূর্ণ ভাষণসমূহের মুহূর্তেও ঐভাবে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে ব্যক্তির কি আছে কি নেই এর যথার্থ মূল্যায়ন করে নিজের জন্যে একটা কঠোর সংকল্পজনিত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কোরআন হাদীছ ও ইসলামী সাহিত্য প্রকৃতপক্ষেআমাদের দায়িত্ব কর্তব্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। আন্দোলন ও সংগঠনের আয়োজনে আমাদের যা কিছুই পড়াশোনা করতে হয় তাতে অবশ্য অবশ্যই কিছু বিষয় গ্রহণ করার এবং কিছু বিষয় বর্জন করার তাকিদ থাকে। যা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে তার কতটা আমি গ্রহণ করতে পেরেছি আর যা বর্জন করতে বলা হয়েছে তার কতটা আমি বর্জন করতে পেরেছি, এই জিজ্ঞাসাই আত্ম-জিজ্ঞাসা, এবং আত্মশুদ্ধি ও আত্মগঠনের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এজন আন্দোলনের কর্মী যখন পড়বে:
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ. الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ. وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ. وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَ. وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ. إِلَّا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ. فَمَنِ ابْتَغَى وَرَاءَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْعَادُونَ. وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ. وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ.
নিশ্চয়ই কল্যাণ লাভ করেছে ইমানগ্রহণকারী লোকেরা যারা নিজেদের নামাযেজ ভীতি ও বিনয় অবলম্বন করে, যারা বেহুদা কাজ থেকে দূরে থাকে, যারা জাকাতের পন্থায় কর্মতৎপর হয়, যারা নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে, নিজেদের স্ত্রীদের ছাড়া এবং সেই সকল মেয়েলোকদের ছাড়া যারা তাদের দক্ষিন হস্তের মালিকানাধীন আছে। এই ক্ষেত্রে (হেফাযত না করা হলে) তারা ভৎসনাযোগ্য নয়। অবশ্য এদের ছাড়া অণ্য কিছু চাইলে তারাই সীমালংঘনকারী হবে। যারা তাদের আমানত ও তাদের ওয়াদা-চুক্তি রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং নিজেদের নামাজসমূহের পূর্ণ হেফাযত করে। (আল মুমিনুন: ১-৯)
তখন তার মন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এই প্রশ্ন করতে থাকবে, আমি কি সেই সাফল্যমণ্ডিতদের অন্তর্ভূক্ত? আমি কি নামাজে এভাবে বিনয়ী হয়ে থাকি? বেহুদা কাজ কারবার থেকে আমি কি এভাবে নিজেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম? আমি কি আত্মশুদ্ধির কাজে এভাবে নিয়োজিত? আমি কি এভবে নিজের লজ্জাস্থানের হেফাযতে সক্ষম? আমি কি আমানত ও ওয়াদা রক্ষার ক্ষেত্রে বাঞ্ছিত মানে আছি? নামাজ সমূহের দাবী সংরক্ষণে আমি কি যতœবান? এমনিভাবে যখন পড়বে:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ.
হে ঈমানদার লোকেরা! খুব বেশী ধারণা পোষণ হতে বিরত থাক, কেননা কোন কোন ধারণা পাপ হয়ে তাকে। তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় খোঁজাখুঁজি করো না। আর তোমাদের কেহ যেন কারও গীবত না করে। তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? তোমরা নিজেরাইতো এর প্রতি ঘৃণা পোষণ করে থাক। (আল হুজুরাত: ১২)
তখন পাঠকের মন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বলে উঠবে এই আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে কথা বলা ও সিদ্ধান্ত নেয়ার রোগ ব্যধি থেকে আমি কি মুক্ত? পরে ছিদ্রান্বেষণের প্রবণতা থেকে আমার মন-মগজ কি মুক্ত? অপরের নিন্দা চর্চার সর্বনাশা মানসিক ব্যধি থেকে আমি কি আমান মন-মগজকে সুস্থ রাখতে সক্ষম?
এভাবে হাদীসে রাসূল পড়াকালে যখন তার সামনে আসবে মুমিনের গুঃণাবলীর বর্ণনা। কবিরা গুণাহ সমূহের আলোচনা, মুনাফিকের আলামত প্রভৃতি যখন তার মনকে সে জিজ্ঞাসা করবে, মুমিনের বঞ্ছিত গুণাবলী থেকে তুমি কতটা দূরে অবস্থান করছ- কবিরা গুণাহের কোন কোনটা এখনও তোমার কাছ থেকে বিদায় নেয়নি, মুনাফিকের কোন কোন আলামত এখনও তোমার মাঝে বিদ্যমান? এইভাবে কোরআন ও হাদীছ চর্চার মূহূর্তে নিজের খতিয়ান নেয়াকেই আমরা স্বতঃস্ফূর্ত ইহতেসাব বলতে পারি। এই ধরণের মনোভাব নফল নামায, বিশেষ করে তাহাজ্জুদের নামাজের মুহূর্তেও সৃষ্টি হতে পারে। শেষ রাতের নীরব নিস্তব্ধমুহূর্তে নিজের কানকে শুনাবার মত নিয়ন্ত্রিত আওয়াজ তারতিলের সাথে কোরআন এবং হাদীছে রাসূলে উল্লেখিত ভাষায় দোয়া ও মুনাজাত আল্লাহর বান্দাকে তার সান্নিধ্যে নিয়ে যায়, সত্যিকারের তওবা ও আত্মোপলব্ধির এটাই সর্বোত্তম মুহূর্ত যা কেবল হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা যেতে পারে- ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।
৩. বাস্তব কর্মক্ষেত্রে কোথাও কোন ভুলত্র“টি হয়ে গেলে সাথে সাথে তা শুধরানোর উদ্যোগ নেয়া। যারা নিয়মিত আত্মসমালোচনা করে অভ্যস্ত তাদের কাজে কর্মে কোন ভুল ত্রটি হলে তা সাথে সাথেই ধরা পড়বে। তখন এই ভুল চাপা না দিয়ে বা নির্ধারিত সময়ের আত্মসমালোচনার জন্যে রেখে না দিয়ে সাথে সাথে সংশোধনের প্রয়াস পাওয়া দরকার। এই ভুল কাজ-কর্মে হতে পারে, হতে পারে সহকর্মীদের সাথে কোন দুর্ব্যবহার হয়ে গেলে। এজন্যে অন্য কারো চাপে ত্র“টি স্বীকারের চেয়ে মনের তাকিদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেই নিজের ভুলের জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।
দুই: পারস্পরিক মুহাসাবা
এক মুমিন আর এক মুমিনের ভাই, তারা পরস্পরে একে অপরের শক্তি যোগায়। দ্বীনের আসল দাবী শুভ কামনা- আল্লাহ ও রাসূলের মহব্বতের দাবীকে সামনে রেখে মুসলমানাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের এবং সর্বসাধারণের শুভকামনা করা। এই স্পিরিটকে সামনে রেখেই পরস্পরের ভুলত্রুটি শোধরানোর আন্তরিক প্রচেষ্টাই পারস্পরিক মুহাসাবা নামে অভিহিত। এখানে সংশোধন কামনা, নিজের ভাইকে দুনিয়া, আখেরাতের ক্ষতি থেকে রক্ষা করা, উন্নতি ও কল্যাণের পথে চলতে সাহায্য করাই মুখ্য। যার অনিবার্য দাবী হল, নিজের মনকে সবার কল্যাণ কামনায় ভরপুর রাখতে হবে। মনে সবার জন্যে অকৃত্রিম দরদের অনুভূতি থাকতে হবে। সবার উন্নতি অগ্রগতির কামনা করে মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া ও মুনাজাতের অভ্যাস থাকতে হবে। ভাইদের সামগ্রিক তৎপরতা ও চরিত্রের ভাল ভাল দিকগুলোর যথার্থ স্বীকৃতি থাকতে হবে। এই কারণে তারা যতটা যতটা শ্রদ্ধাবোধের দাবী রাখে নিজের মনে ততটা শ্রদ্ধাবোধ অবশ্যই রাখতে হবে। তাহলেই মুহাসাবা করার মুহূর্তে ইনসাফ করা এবং সীমা লঙ্ঘনের মত দুর্বলতা থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। এই পারস্পরিক মুহাসাবাকেও আমরা তিনভাগে ভাগ করতে পারি। (১) দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে কমীদের বা অধস্তন দায়িত্বশীলদের মুহাসাবা। (২) কর্মীদের বা অধস্তন দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে কর্মীদের বা অধস্তন দায়িত্বশীলদে মুহাসবা। (৩) কর্মীদের বা অধস্তন দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে উর্ধ্বতন দায়িত্বশীলদের বা অধস্তন দায়িত্বশীলদরে মুহাসাবা। (৪) কর্মদের পরস্পরে এক অপরের মুহাসাবা।
যেহেতু সব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভাইয়ের সংশোধনই প্রকৃত লক্ষ্য, সুতরাং নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি অবশ্যই খোয়াল রাখতে হবে।
১. এই ধরণের মুহাসাবার জন্যে একটা অন্তরঙ্গ পরিবেশ প্রয়োজন। সর্বাগ্রে সেই পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়াস পেতে হবে।
২. ভাইয়ের বা সাথী-সহকর্মীর যেসব ত্রুটি বিচ্যুতির মুহাসাবা করতে চাই সেগুলো তার মধ্যে আছেই এমন ভাষায় ব্যক্ত করা ঠিক হবে না। বরং আমার কাছে এমন মনে হচ্ছে, হতে পারে আমি ভুল বুঝেছি, আসল ব্যাপারটা আপনার কাছ থেকে জেনে আমি আমার মনকে পরিস্কার রাখতে চাই- এই ধরণের ভাষায়ই কথাগুলো উপস্থাপন করা উচিত। এটা নিছক একটা অভিনয় নয়। বাস্তবেও এমনি হতে পারে। কাজেই প্রথমে ব্যক্তির কাছ থেকে প্রকৃত অবস্থা জানাটাই অপরিহার্য। এভাবে ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে তার নিজস্ব বক্তব্য শুনার পর যদি সত্যি সত্যি মনে হয় যে, আমার ধারণা ঠিক ছিল না তাহলে আর অগ্রসর না হয়ে নিজের মনকে ভাই সম্পর্কে পরিস্কার করে নেয়া দরকার।
আর যদি তার বক্তব্যের পরও এই ধারণা থেকেই যায় যে, তার মধ্যে ত্র“টি-বিচ্যুতি বাস্তবেই বিরাজমান, তাহলে দরদপূর্ণ ভাষায় তাকে নছিহত করতে হবে। যদি এই নছিহত গ্রহণের জন্যে এই মুহূর্তে তাকে প্রস্তুত মনে না হয়, তাহলে উপযুযক্ত কোন সময়ের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। ইতোমধ্যে তার জন্যে আল্লাহর কাছে বেশী বেশী দোয়া করতে হবে। অন্যদিকে উপযুক্ত সময় সৃষ্টি করে নেয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে।
অপরদিকে যার মুহাসাবা করা হয়, তাকে ভাইয়ের দরদপূর্ণ উদ্যোগকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। নিজের দোষ-ত্রুটি অনেক সময়ই নিজের চোখে ধরা পড়ে না। তাই ভাইয়ের এই পদক্ষেপকে নিজের জন্যে কল্যাণকর মন করে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হবে এবং ভাষার জোরে, যুক্তির জোরে নিজেকে দোষমুক্ত প্রমাণ করার সিদ্ধান্ত নেবে এবং এই ব্যাপারে ভাইয়ের আন্তরিক সহযোগিতা ও দোয়া কামনা করবে। এই ব্যাপারে মুহাসাবাকারী ও মুহাসাবাকৃত ব্যক্তি যার যার জায়গায় বাঞ্ছিত ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হলে সত্যি এক জান্নাতী পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে মানুষের সংগঠনের অভ্যন্তরে।
মুহাসাবা বা সমালোচনা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তদায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে সাধারণ কর্মীদের জন্যে শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয় উদাহরণ সৃষ্টি হওয়ার প্রয়োজন আছে। কারণ তাত্বিক আলোচনায় এটাকে আমরা যত সহজভাবে পেশ করতে পারি, বাস্তবে কিন্তু এটা তত সহজ ব্যাপার নয়। সমালোচনা সহ্য করার মত, নিজের ভুল ত্র“টি স্বীকার করাম মত সৎ সাহসী লোকের আসলে অভাব আছে। এই অভাব দূর করতে হলে কিছু ব্যক্তিকে নমুনা হিসেবে সামনে আসার প্রয়োজন আছে। আর এই নমুনা পেশ করতে হবে বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরকেই। ঐসব দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা খক্ষই ভাগ্যবান, যাদের সাথী-বন্ধুরা নিঃসংজোচে নির্দ্বিধায় তাদের দায়িত্বশীলদের ভুলত্র“টি শোধরানোর প্রয়াস পায়। আন্তরিকতার ও নিষ্ঠার সাথে তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সংশোধন ও উন্নতি কামা করে এবং বাস্তবে তা কার্যকর করার সুযোগ পায়। পক্ষান্তরে চরম দুর্ভাগ্য ঐসব নেতা ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণের, যাদের সাথী ও সহকর্মীগণ তাদের মধ্যে অনেক ত্র“টি বিচ্যুতি লক্ষ্য করে, মনে মনে বিক্ষুব্দ হয়ে থাকে, তাদের মনের ক্ষোভ ভেতরে ভেতরে গুমরে মরে, অথচ তো বা দায়িত্বশীলদের আচরণের কারণে তারা তা প্রকাশ করতে সাহস পায় না বা প্রকাশ করতে চায় না। এমন পরিবেশ ইসলামী আন্দোলনের জন্যে একান্তই অবাঞ্চিত।
এভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে, অন্তরঙ্গ পরিবেশে আলাপ আলোচনা চালালে শতকরা ৯৫% ভাগ ক্ষেত্রেই সুফল পাওয়া যাবে। সুতরাং ব্যাপারটা অন্যত্র নেয়ার কোন প্রয়োজনই দেখা দেয় না। কিন্তু যদি এউ উদ্যোগ ব্যর্থ হয় তাহলে পর্যায়ক্রমে যথাযথভাবে দায়িত্বশীল ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তির অনুমতিক্রমে কোন সামষ্টিক পরিবেশেও এটা উপস্থাপন করা যেতে পারে যাতে করে অন্যান্য ভাইদের নছিহতপূর্ণ সামষ্টিক বক্তব্যে তার মনে কোন পরিবর্তণ এসে যেতে পারে মনে রাখাতে হবে, এর বাইরে কোন ভাইদের বাস্তব দোষত্রুটির আলোচনাও শরীয়তের দৃষ্টিতে গীবত। যা থেকে বাঁচার চেষ্টা করা ব্যক্তির আখেরাতের স্বার্থে, আন্দোলন ও সংগঠনের স্বার্থে একান্তই অপরিহার্য। পারস্পরিক মুহাসাবার ক্ষেত্রে হাদীছে রাসূলের উপমাটি প্রণিধানযোগ্য। হাদীছে এক মুমিনকে অপর মুমিনের জন্যে আয়নাস্বরূপ বলা হয়েছে। আয়নার ভূমিকা কি? (১) আমার চেহারায় কোথায় কি আছে আমি দেখেতে পাই না, আয়না আমাকে দেখিয়ে দেয়। (২) এই দেখবার ক্ষেত্রে আয়না তার নিজের দিক থেকে কিছুই বাড়িয়ে বা অতিরঞ্জিত করে দেখায় না। আবার কমও দেখায় না। (৩) আমি যতক্ষণ আয়নার সামনে থাকি ততক্ষণই সে আমার দোষত্রুটি আমাকে দেখায়। আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে সে এটা দেখায় না বা বলাবলি করে না। অনুরূপভাবে আমার নিজের ত্রুটি বিচ্যুতি জানবার জন্যে অন্য ভাইকে একটা উত্তম অবলম্বন মনে করবে। এই ত্র“টি দেখাতে গিয়ে আমরা বাড়াবাড়ি করব না। সর্বত্র এই নিয়ম-নীতির অনুসলণের মাধ্যমেই আমরা সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যের সুদৃঢ় বন্ধন গড়ে তুলে আল্লাহর ভালবাসার পাত্র হতে পারি।
তিন: সাংগঠনিক কাজের মুহাসাবা
সাংগঠনিক কাজে গতিশীলতা আনার জন্যে, সুস্থতার সাথে সংগঠন পরিচালনার জন্যে যেমন সর্বস্তরের জনশক্তির পরামর্শেল প্রয়োজন আছে, তেমনি সবার মুহাসাবাহার সুযোগও বাঞ্চনীয়। পরামর্শ যেমন যত্রতত্র, যেনতেন প্রকারের দেয়া ঠিক নয়। মুহাসাবাও তেমনি যত্রতত্র যেভাবে সেভাবে হতে পারে না। গঠনমূলক সমালোচনা যেমন আন্দোলকে জীবনীশক্তি দান করে থাকে- লাগমছাড়া সমালোচনা আবর তেমনই একটা সংগঠনের জন্যে আত্মঘাতী প্রমাণিত হয়ে থাকে।
সাংগঠনিক মুহাসাবার উপায়
স্থানীয় সংগঠনের মুহাসাবা একদিকে উর্ধ্বতন সংগঠনের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। অপরদিকে এর সাথে সংশ্লিষ্ট জনশক্তির পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। সংশ্লিষ্ট জনশক্তির অন্তর্ভূক্ত ব্যক্তিগণ হয় ব্যক্তিগত আলোচনার মাধ্যমের অথবা লিখিতভাবে দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে সাংগঠনিক কায্যক্রমের ব্যাপারে তার পর্যালোচনা পৌছাবে অথবা পর্যালোচনা বা মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে আয়োজিত কোন অনুষ্ঠানে তার বক্তব্য পেশ করবে। কিন্তু নিজের মূল্যায়ন বা পর্যালোচনাকেই সে একমাত্র নির্ভূল বা সঠিক পর্যালোচনা বা মূল্যায়ন মনে করবে না। সামষ্টিক পর্যালোচনা ও মূল্যায়নকে দ্বিধাহীন চিত্তে গহেণ করার জন্যে তাকে সর্বাবস্থায় প্রস্তুত থাকতে হবে।
ঊর্ধ্বতন সংগঠনের কার্যক্রম প্রসঙ্গে নিজের মনোভাব বা মূল্যায়ন সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দকে নিজ নিজ এলাকার প্রতিনিধির মাধ্যমের ওয়েকাফহাল করার চেষ্টাই সর্বোত্তম পন্থা। কেউ চাইলে সরাসরি ওয়াকেফহাল করতে পারে। উর্ধ্বতন সংগঠনের কার্যক্রম পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের যথার্থ ফোরাম কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরা এবং সদস্য সম্মেলন জনশক্তির বাকি অংশের মতামত এদের মাধ্যমে জানতে হবে এবং এদের ফোরামে গৃহীত পর্যালোচনা, মূল্যায়ন ও মতামতকেই দ্বিধাহীণ চিত্তে গ্রহণ করার জন্যে মন-মেজাজকে সদা উন্মুক্ত রাখতে হবে। এর ব্যাতিক্রম আচরণ পরিবেশকে দূষিত করে। আন্দোলণ ও সংগঠনের সর্বস্তরের জনশক্তিকে এই ব্যাপারে সজাগ-সচেতন অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করতে হবে।
— সমাপ্ত —-