সপ্তম অধ্যায়
ইসলামই সত্যিকার সভ্যতা
ইসলামী সমাজ ও জাহেলী সমাজের মৌলিক পার্থক্য
ইসলাম মাত্র দু’ধরনের সমাজ স্বীকার করে। একটি হচ্ছে ইসলামী সমাজ ও অপরটি জাহেলী সমাজ। যে সমাজের সার্বিক কর্তৃত্ব ইসলামের হাতে এবং মানুষের আকীদা-বিশ্বাস, পূজা-উপাসনা, আইন-কানুন, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা, নৈতিক চরিত্র, পারস্পরিক লেন-দেন ইত্যাদি সকল বিষয়ে ইসলামের প্রাধান্য বিদ্যমান সে সমাজই ইসলামী সমাজ। অপর দিকে যে সমাজের আকীদা-কানুন ও রীতিনীতি, ইসলামী নৈতিকতা ও আদান-প্রদান নীতির শ্রেষ্টত্ব স্বীকৃতি লাভ করেনি,সে সমাজই জাহেলী সমাজ।
যে সমাজ ‘মুসলিম’ নামধারী ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত হওয়া সত্ত্বেও ইসলামী শরীয়াতকে আইনগত মর্যাদা দান করেছে, সে সমাজ ইসলামী সমাজ নয়। সালাত, সওম, হজ্জ ও যাকাতের ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও সে সমাজ ইসলামী সমাজ হতে পারে না। বরং সে সমাজের কর্ণধারগণ রাসূল (সা) –এর দেয়া আইন –কানুন পালন থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের খেয়াল –খুশী মতো ইসলামের এক নতুন সংস্করণ আবিস্কার করে নিয়েছে এবং এর নাম দিয়েছে ‘প্রগতিশীল ইসলাম’।
জাহেলী সমাজ বিভিন্ন রূপ ধারণ করে থাকে। তবে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত থাকাটাই তার আসল রূপ। কোন কোন সময় সে আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বই অস্বীকার করে বসে এবং মানব জাতির ইতিহাসকে দ্বান্দিক বস্তুবাদ রূপে ব্যাখ্যা করে। এ মতবাদের ভিত্তিতে গঠিত সমাজ ব্যবস্থার নাম দেয়া হয় ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’। কোন সময় জাহিলী সমাজ অন্যরূপ ধারণ করে। তারা আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করে না। তবে, তাঁর কর্তৃত্ব ও প্রভুত্বকে আকাশ ও উর্ধ জগতে সীমিত রেখে ধুলির ধরা থেকে তাঁর দেয়া আদেশ-নিষেধগুলো নির্বাসিত করে। এ সমাজ আল্লাহর শরীয়াত কার্যকরী হয় না। মানব জীবনের জন্যে স্বয়ং আল্লাহ তাআলার যেসব শাশ্বত ও চিরন্তর মূল্যবোধ নির্ধারিত করে দিয়েছেন সেগুলোও এ সমাজে সমাদৃত হয় না। এ সমাজের কর্মকর্তাগণ মানুষকে মসজিদ, মন্দির ও গীর্জার চার দেয়ালের অভ্যন্তরে আল্লাহ তাআলার পূজা উপাসনা করার অনুমতি দেয়। কিন্তু মানুষের ব্যবহারিক জীবনে আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়াতের প্রাধান্য স্বীকার করতে তারা প্রস্তুত নয়। এদিক দিয়ে তারা ধুলির ধরায় আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিরোধী। কারণ তারা বাস্তব কর্মজীবনে আল্লাহর শরীয়াতকে বর্জন করে চলে। অথচ আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন —
—————————————————-
“তিনি আল্লাহ, যিনি আসমানের সার্বভৌম প্রভু এবং পৃথিবীরও।” আল্লাহ তাআলা নিম্নের আয়াতে যে সমাজকে ‘দ্বীনে কাইয়্যেম’ আখ্যা দিয়েছেন, উপরোল্লিখিত সমাজ সে পবিত্র সমাজ নয়।
———————————————————
“আদেশ দান ও আইন জারী করার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, একমাত্র তিনি ব্যতীত অন্য কারো দাসত্ব করা চলবে না। আর এটাই হচ্ছে ‘দ্বীনে কাইয়্যেম’ (সুসামঞ্জস্য ও সুদৃঢ় জীবন বিধান)।” —ইউসুফ: ৪০
এ শ্রেণীর সমাজ আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করার বিষয় সহস্রবার ঘোষণা করা সত্ত্বেও এবং মানুষকে মসজিদ, মন্দির ও গীর্জায় গিয়ে পূজা –উপাসনা করার অবাধ অধিকার দান করা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলার নির্দেশাবলী বাস্তব কর্মজীবনে বর্জন করার দরুন জাহেলী সমাজ হিসেবেই গণ্য হবে।
একমাত্র ইসলামী সমাজই সুসভ্য সমাজ
এ অধ্যায়ের শুরুতে আমরা ইসলামী সমাজের যে সংজ্ঞা উল্লেখ করেছি তার পরিপ্রক্ষিতে একথা বলা অসাংগত হবে না যে, ইসলামী সমাজই প্রকৃত সভ্য সমাজ। জাহেলী সমাজ যে রূপই ধারণ করুক না কেন, তা মৌলিক চিন্তাধারার দিক থেকেই পশ্চাদমুখি ও সভ্যতা বর্জিত।
একদা আমি স্বরচিত একটি গ্রন্থ প্রকাশনার উদ্দেশ্যে প্রেসে দেয়ার সময় গ্রন্থটির ‘সুসভ্য ইসলামী সমাজ’ নাম ঘোষণা করি। কিন্তু পরবর্তী ঘোষনায় ‘সুসভ্য ‘শব্দটি বাদ দেই এবং প্রন্থখানির শুধু ‘ইসলামী সমাজ’ নামকরণ করি। ফরাসী ভাষায় জনৈক আলজিরীয় লেখক আমার বইয়ের এ নাম পরিবর্তন লক্ষ্য করেন এবং মন্তব্য করেন যে, ইসলামের স্বপক্ষে কলম ধারণকালে আত্মরক্ষামূলক মনোভাবের বশবর্তী হয়েই নাকি এ ধরণের পরিবর্তন করা হয়েছে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন — ইসলাম সম্পর্কে আমার চিন্তাধারা অপরিপক্ক থাকার দরুনই আমি বাস্তবের সম্মুখীন হতে অক্ষম। আমি উক্ত আলজিরীয় গ্রন্থকারকে ক্ষমার যোগ্য বিবেচনা করি। আমিও পূর্বে তারই মত মনোভাব পোষণ করতাম এবং প্রথম যে সময় এ বিষয়ে লিখতে শুরু করি তখন তিনি আজ যেভাবে চিন্তা করছেন, আমিও তা-ই করতাম। তিনি আজ যে জটিলতার সম্মুখীন আমি ঐ সময় এ ধরনের জটিলতাই অনুভব করছিলাম। প্রশ্ন হচ্ছে, সভ্যতার সংজ্ঞা কি? সে সময় পর্যন্ত আমি ইসলামী আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া সত্ত্বেও মন-মস্তিষ্ক থেকে ভ্রান্ত কৃষ্টির প্রভাব দুর করতে সক্ষম হইনি। পাশ্চাত্য লেখকদের সাহিত্য ও চিন্তাধারা আমার ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের বিপরীতমুখী হওয়া সত্ত্বেও আমার মন-মগজকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। সভ্যতার পাশ্চাত্য সংজ্ঞাই আমার নিকট বিচারের মানদণ্ড ছিল। ফলে, আমি সুষ্ঠ ও সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে সকল বিষয়কে যাচাই করে দেখতে পারিনি।
পরবর্তীকালে আমার দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়ে আসে এবং আমি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করি যে, ‘ইসলামী সমাজ’ অর্থই হচ্ছে সভ্য সমাজ। তাই আলোচ্য পুস্তকটির নামকরণ বিষয়ে পুনর্বিবেচনাকালে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, ঐ নামের মধ্যে সুসভ্য শব্দটি প্রয়োজনাতিরিক্ত। বরং ঐ শব্দটি ব্যবহার করার ফলে পাঠকগবর্গের চিন্তাধারাও পূর্ববর্তী চিন্তাধারার মত বিভ্রান্তির কবলে পতিত হবে। এখন দেখা যাক সভ্যতা শব্দটির অর্থ কি?
কোন সমাজে যদি সার্বভৌমত্ব শুধু আল্লাহরই নিকটে অর্পিত হয় এবং এর বাস্তব প্রমাণ স্বরূপ সমাজের সকল স্তরে আল্লাহর শরীয়াতের প্রাধান্য স্বীকৃত লাভ করে, তাহলে একমাত্র সে সমাজেই মানুষ মানুষের দাসত্ব থেকে প্রকৃত ও পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করে। এ প্রকৃত ও পূর্ণ স্বাধীনতারই অপর নাম ‘মানব সভ্যতা’। কেননা মানব সভ্যতা একটি মানদণ্ড দাবী করে, যার আওতাধীনে প্রতিটি মানুষ পরিপূর্ণরূপে সত্যিকার আযাদী উপভোগ করতে পারে এবং বিনা বাধায় সকল মানবীয় অধিকার অর্জন করতে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে যে সমাজ কিছুসংখ্যক লোক ‘রব’ ও ‘শরীয়াত রচনাকারী’র আসন দখল করে থাকে এবং অবিশিষ্ট সকল মানুষই তাদের অনুগত থাকে না এবং তারা সকল মানবীয় মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আইন প্রণয়নের বিষয়টি শুধু আইন রচনা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। আজকাল অনেকেই শরীয়াত সম্পর্কে এ ধরনের সংকীর্ণ ধারণা পোষণ করেন। প্রকৃতপক্ষে ধ্যান-ধারণা জীবন যাত্রা প্রণালী, জীবনের মূল্যমান, গ্রহণ ও বর্জনের মানদণ্ড, অভ্যাস ও রীতিনীতি সব কিছুই আইনের দ্বারা প্রভাবিত হয়। যদি একটি বিশেষ গোষ্ঠী এসব বিষয়কে আল্লাহ তাআলার নির্দেশাবলী থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজেদের রচিত আচার ব্যবহারের শৃংখলা সমাজের মানুষকে বন্দী করে দেয়, তাহলে এ সমাজকে স্বাধীন সমাজ বলা যেতে পারে না। এ ধরনের সমাজে তো কিছু সংখ্যক মানুষ রবুবিয়াত বা সার্বভৌমত্ব প্রভুর আসনে সমাসীন থাকে এবং অবশিষ্ট সকল মানুষ তাদের বন্দেগী বা দাসত্ব করতে বাধ্য হয়। এ জন্যে এ সমাজকে পশ্চাতপদ সমাজ হিসাবে গণ্য করা হবে এবং ইসলামী পরিভাষা মুতাবিক এ সমাজই হচ্ছে প্রকৃত জাহেলী সমাজ।
একমাত্র ইসলামী সমাজেই আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মানুষ নিজেদের সমগোত্রীয়দের গোলামী শিকল ছিন্ন করে আল্লাহর গোলামীতে নিয়োজিত হয়। আর এ পথেই মানুষ সত্যিকার আযাদীর স্বাদ গ্রহণ করে এবং আল্লাহ প্রদত্ত মর্যাদা ও সম্মান লাভ করে। সে দুনিয়াতে আল্লাহর খলিফার পদে অভিষিক্ত হয়ে ফেরেশতাদের চাইতেও অধিক গৌরব অর্জন করে।
ইসলাম ও জাহিলী সমাজের মৌলিক পার্থক্য
যে সমাজের ধ্যান-ধারণা, আকীদা-বিশ্বাস ও জীবনযাত্রা ইত্যাদি সব বিষয়ই এক আল্লাহ তাআলার সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে রচিত হয়, সে সমাজে মানুষ সর্বোচ্চ মর্যাদা ও গৌরব লাভ করে। কারণ সেখানে কোন মানুষ অপর মানুষের দাস থাকে না এবং ঐ সমাজের ধ্যান-ধারণা, আকীদা-বিশ্বাস, জীবনাযাত্রা এক বা একাধিক প্রভুত্বের দাবীদার মানুষের মন-মস্তিষ্ক প্রসূত নয়। এ ধরনের সমাজেই মানুষের সত্তা ও চিন্তার লুক্কায়িত যোগ্যতা ও গুণাবলী পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হয়। পক্ষান্তরে, যে সমাজে বর্ণ, বংশ, ভাষা ও ভৌগোলিক এলাকা পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে হিসেবে গৃহীত হয়, সে সমাজেরন উল্লিখিত ঐক্যসুত্রগুলো মানবতার পায়ে নানাবিধ বিধি-নিষেধের শিকল পরিয়ে দেয় এবং এর ফলে মানুষের উচ্চতার গুণাবলী বিকাশ লাভ করার সুযোগই পায় না। বর্ণ, ভাষা ও এলাকার গণ্ডী থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ জীবন যাপন করতে পারে। আত্মা ও ও চিন্তার বিকাশ অবরুদ্ধ হয়ে গেলে মানুষ মাববীয় মর্যাদায় বহাল থাকে না। একজন মানুষ স্বেচ্ছায় তার ধ্যান-ধারণা, আকীদা-বিশ্বাস ও জীবনযাত্রা পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু বর্ণ, বংশ, রক্ত এবং ভৌগলিক জাতিয়তা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। মানুষ স্বেচ্ছায় বিশেষ বংশে বা এলাকায় জন্মগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপারগ। সুতরাং যে সমাজের স্বাধীন বিবেক-বুদ্ধির সাহায্যে মত ও পথ গ্রহণের অধিকার স্বীকৃত সে সমাজ সভ্য সমাজ এবং সে সমাজে বিবেক-বুদ্ধির সাহায্যে যাচাই –বাছাই করে সত্য পথ গ্রহণ-বর্জনের অবকাশ থাকে না, সে সমাজ পাশ্চাতপদ ও সভ্যতা বর্জিত। ইসলামী পরিভাষায় এ সামজকে জাহেলী সমাজ বলা হয়।
একমাত্র ইসলামী সমাজই আকীদা-বিশ্বাসের ভিত্তিতে মানুষকে পরস্পরের সাথে অটুট ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে এবং ঐ আকীদা-বিশ্বাসের সূত্র ধরেই কালো ও সাদা, আরব ও গ্রীক, পারসী ও নিগ্রো এবং পৃথিবীতে বিদ্যমান শতধা বিভক্ত জাতিগুলোকে একই সারিতে দাঁড় করিয়ে একই উম্মাতে শামিল করে নেয়। এ সমাজের সর্বময় কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহর এবং মানুষ শুধু তাঁরই সমীপে মাথা নত করে, অন্য কারো নিকট নয়। যে ব্যক্তির চরিত্র যত উন্নত এ সমাজে তার মর্যাদা ততই উচ্চ। আল্লাহ প্রদত্ত আইনের চোখে সমাজের সকল মানুষই সমান।
যে সমাজে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দেয়া হয় এবং যেখানে মানুষের চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনই প্রাধান্য লাভ করে বস্তুবাদ। অবশ্য বস্তুবাদ বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। উদাহারণ স্বরূপ ইতিহাসের মার্কসীয় ব্যাখ্যা অনুসারে বস্তুকে সর্বোচ্চ মর্যদাদানের উল্লেখ করা যেতে পারে অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও অন্যান্য সমাজের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেখানে বস্তু-সামগ্রীর বধ্যভূমিতে মানবতাকে যবেহ করা হয়। এ ধরনের সমাজ অবশ্যই পশ্চাতমুখী সমাজ এবং ইসলামী পরিভাষায় জাহেলী সমাজ।
সভ্য সমাজ তথা ইসলামী সমাজ বস্তু –সামগ্রীকে তুচ্ছ জ্ঞান করে না। ইসলাম বস্তুর যথাযোগ্য মূল্যদান করতে কার্পণ্যও করে না। ব্স্তু-সামগ্রীর উৎপাদনের গুরুত্বও অস্বীকার করে না। বরং ইসলাম একথা স্বীকার করে যে, আমরা যে জগতে বাস করি যার দ্বারা আমাদের জীবন প্রভাবিত হয় এবং আমরাও যার উপর অনেক বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করে থাকি; সে জগত বস্তু সমন্বয়ে গঠিত। ইসলাম একথাও স্বীকার করে যে, বস্তু –সামগ্রীর উৎপাদন আল্লাহর পার্থিব খিলাফতের মেরুদণ্ড স্বরূপ। পার্থক্য শুধু এই যে, ইসলামী সমাজ মানুষের স্বাধীনতা ও মানবীয় মর্যাদা, পারস্পরিক রীতিনীতি,নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ইত্যাদি মানবীয় বৈশিষ্ট্যগুলোকে বস্তুগত আরাম-আয়েসের বিনিময়ে বর্জন করে বস্তু –সামগ্রীকে পূজা করার পক্ষপাতি নয়। পক্ষান্তরে জাহিলী সমাজ বস্তু-সামগ্রীর প্রাচুর্য অর্জনের খাতিরে মানবীয় মূল্যবাধ ও মান-মর্যাদা ধুলিস্মাৎ কণ্ঠিত হয় না।
যে সমাজে মানবীয় মূল্যবাধ ও উন্নত মানব চরিত্রের প্রাধান্য থাকে,সে সমাজ সভ্য সমাজ। মানবীয় মূল্যবাধ ও উন্নত মানব চরিত্র অপ্রকাশ্য অথবা ব্যাখ্যার অযোগ্য বিষয় নয়। ইতিহাসের বস্তুতান্ত্রিক ব্যাখ্যাদানকারী অথবা তথাকথিক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদীদের দাবী মুতাবিক মানবীয় মূল্যবোধ ও উন্নত চরিত্র উৎপাদনের উপকরণাদির সাথে সাথে পরিবর্তনশীল অথবা কোন কেন্দ্রবিন্দুর সাথে সংযোগবিহীন আদর্শ নয়। প্রকৃতপক্ষে ইসলামে মূল্যবোধ ও পশুর মধ্যে, পার্থক্যের সীমারেখা টেনে দেয়। ফলে মানুষ পশুর স্তর থেকে অগ্রসর হয়ে মানবতার স্তরে উপনীত হয়। জাহেলী সমাজের মত এ সমাজের মূল্যবাধ ও চারিত্রিক মান মানুষকে পশুর পর্যায়ে নামিয়ে দেয় না।
সভ্যতার প্রকৃত মানদণ্ড
আমরা যদি এ দৃষ্টিভংগীতে বিষয়টিক বিচার করি, তাহলে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের মধ্যস্থলে একটি সুস্পষ্ট সীমারেখা ফুটে উঠে এবং তথাকথিত প্রগতিবাদী ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদীদের অবিরাম অপচেষ্টা সত্ত্বেও নৈতিক মুল্যবোধের গুরুত্ব বিন্দুমাত্র হ্রাস পায় না। ইসলামী দৃষ্টিভংগী হচ্ছে এই যে, পরিবেশ ও পরিবর্তনশীল অবস্থা নৈতিক মূল্যবোধ পরিবর্তন করতে পারে না। বরং কাল ও পরিবেশের সকল পরিবর্তন অগ্রাহ্য করে নৈতিক মূল্যবোধ চিরস্থায়ী হয়ে থাকে। তাই নৈতিকতাকে কৃষিভিত্তিক, শৈল্পিক, পুঁজিবাদী, সমাজতন্ত্রী, বুর্জোয়া ও প্রলিটারিয়েট নৈতিকতার নামে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিভক্ত করার কোন যৌক্তিকতা নেই। প্রকৃতপক্ষে নৈতিক মূল্যবোধ পরিবেশ, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সমাজ উন্নয়নের স্তর ইত্যাদির প্রভাব থেকে সম্পূর্ণরূপে মু্ক্ত। এসব পরিবর্তন খুবই অস্থায়ী ও কৃত্রিম। অপরপক্ষে আমরা অত্যন্ত বাস্তবমুখি বিশ্লষণের মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত উপনীত হতে পারি যে, মূল্যবোধ ও চারিত্রক মান মাত্র দু’ভাগে বিভক্ত। একটি হচ্ছে মানবীয় মূল্যবোধ ও চারিত্রিক মান মাত্র দু’ভাগে বিভক্ত। একটি হচ্ছে মানবীয় মূল্যবোধ ও মানবসুলভ চারিত্রিক মান এবং অপরটি হচ্ছে পশুসুলভ মুল্যবোধ ও চারিত্রিক মান। ইসলামী পরিভাষায় আমরা এ দু’টিকে “ইসলামী মূল্যবোধ” ও “চারিত্রিক মান” এবং “জাহেলী মূল্যবোধ” ও “জাহেলী চারিত্রিক মান” আখ্যা দিতে পারি।
ইসলাম অবশ্যই মানবীয় মূল্যবোধ ও চারিত্রিক মানের উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে মানুষকে পশুত্ব থেকে উচ্চতর মর্যাদায় পৌছে দেয়। যে সমাজেই ইসলামী জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা লাভ করে, সেখানেই সে নৈতিক মান ও মূল্যবোধ জাগ্রত করে তার উন্নতি বিধান ও শক্তি বৃদ্ধির জন্যে যত্ন নেয়। এ সমাজ কৃষক, শ্রমিক, বেদুইন, পশুপালনকারী, শহর ও গ্রামবাসী, ধনী ও দরিদ্র, শিল্পপতি ও পুঁজিপতি নির্বিশেষে সকল ধরনের সমাজে একই চারিত্রিক মান ও মানবীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করে এবং সকল অবস্থায় ও সকল পরিবেশে মানুষের মানবসুলভ বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীকে বিকশিত করে তোলে, যেন কখনো মানুষের মধ্যে পশুসুলভ চরিত্রের উন্মেষ না হয়। আমরা উপরে যে মানবীয় মুল্যবাধ ও নৈতিক চরিত্রের উল্লেখ করেছি,তা মানুষকে পশুর স্তর থেকে উপরের দিকে উন্নীত করে এবং এ মূল্যবোধ ও চারিত্রিক মানদণ্ডের এ সীমারেখা মুছে গেলে মানুষের পতন শুরু হয় এবং মানবতার স্তর থেকে অধপতিত এ সমাজের সামগ্রীর প্রাচুর্য ও উন্নতি থাকা সত্ত্বেও তাকে সভ্যতা বলা যায় না। বরং এটা পতনশীল এ পশ্চাদমূখী অথবা জাহেলী সমাজ হিসেবেই পরিগণিত হবে।
সভ্যতার বিকাশে পারিবারিক ব্যবহারের গুরুত্ব
যদি পরিবারকে সমাজের ভিত্তি বিবেচনা করা হয়, জন্মগত বৈশষ্ট্য ও স্বাভাবিক যোগ্যতানুসারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক দায়িত্ব বন্টন করা হয় এবং সন্তান –সন্ততির লালন –পালন ও প্রশিক্ষণ পরিবারের লক্ষ্য হয়, তাহলে এ সমাজকে নিসন্দেহে সভ্য সমাজ গণ্য করা হবে। ইসলামী জীবন ব্যবস্থার উল্লেখিত ধরনের পারিবারিক পরিবেশ পরবর্তী বংশধরের মধ্যে মানবীয় মূল্যবোধ ও উন্নত মানের চরিত্র সৃষ্টির কোন ক্ষেত্র নেই। পক্ষান্তরে অবাধ যৌনমিলন ও অবৈধ সন্তানই যদি সমাজের ভিত্তি রচনা করে এবং দৈহিক চাহিদা, যৌনক্ষুধা এবং পশুসুলভ উত্তেজনাই যদি নর-নারীর সম্পর্ক নির্ধারণ করে, যদি জন্মগত বৈশিষ্ট্য ও স্বাভাবিক যোগ্যতার নিরিখে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক দায়িত্ব বন্টন করা না হয়, যৌন আবেদন সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য নিজেকে পর পুরুষের নিকট আকর্ষণীয় করে তোলাই যদি নারী জাতির ভুমিকা হয়, নারী জাতি যদি সন্তান লালন – পালনের দায়িত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে এবং স্বেচ্ছায় অথবা সামাজিক পরিবেশের প্রভাবে যদি নারী বিমানবালা, জাহাজের সেবিকা ও হোটেলের পরিচারিকা রূপে বস্তু সম্পদ বৃদ্ধির কাজে নিজের যোগ্যতা নিয়োজিত করে এবং মানুষের বংশ বৃদ্ধির তুলনায় সম্পদ বৃদ্ধিকেই অধিকতর লাভ ও সম্মানজনক বিবেচনা করে, তাহলে সে সমাজ জাহেলী সমাজ।
পারিবারিক প্রথা ও দাম্পত্য সম্পর্কের প্রকৃতি থেকেই বিশেষ কোন সমাজ সত্য কিনা, তা নির্ণয় করা যায়। সে সমাজে এ সম্পর্কে নিছক দৈহিক চাহিদা ও পশু প্রকৃতির দাবী পূরণ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করে রাখা হয় সে সমাজ শিল্প ও বিজ্ঞানে যতই উন্নতি সাধন করুক না কেন সভ্য সমাজ বলে বিবেচিত হতে পারে না। যেকোন সমাজের সামগ্রিক উন্নতি ও অবনতি বিচার করার জন্যে সে সমাজের পারিবারিক নির্ভূল চিত্র পেশ করে।
পাশ্চাত্য সভ্যতার নমুনা
বর্তমান যুগের সকল জাহেলী সমাজেই মানুষ এ পশুর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকরী নৈতিক গুণাবলী পরিত্যাগ করা হয়েছে। এসব সমাজে অবৈধ ও যৌন সম্পর্ক এমন কি সম মৈথুনকেও চরিত্রহীনতা বিবেচনা করা হয় না। নৈতিকতাকে অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। কারণ এ দু’টি ক্ষেত্রে সরকারী স্বার্থে নৈতিকতা প্রয়োজনীয় বিবেচিত হয়। উদাহারণ স্বরূপ ক্রীশ্চিয়ান কিলার ও বৃটিশ মন্ত্রী প্রফুমোর যৌন কেলেংকারীর বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। বৃটিশ সমাজ যৌন অপরাধ হিসেবে বিষয়টিকে লজ্জাষ্কর বিবেচনা করেনি। ক্রীশ্চিয়ান কিলার বৃটিশ মন্ত্রী প্রফুমো ছাড়াও রুশীয় দূতাবাসের জনৈক নৌবাহিনীর কর্মকর্তার সাথে একই সময় যৌন সম্পর্ক স্থাপন করায় রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকেই নিন্দনীয় বিবেচনা করা হয়। যৌন কেলেংকারী বিষয়টিকে মোটেও অপরাধ সাব্যস্ত করা হয়নি। সব চাইতে জঘন্য ব্যাপার এই যে, মন্ত্রীমহোদয় বৃটিশ পার্লামেন্টে মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছিলেন এবং পরে তার ঐ মিথ্যা উক্তি প্রকাশ হয়ে যায়। আমেরিকান নাগরিকদের মধ্য থেকে যারা উল্লেখিত ধরনের গুপ্তচর বৃত্তি সম্পর্কিত কেলেংকারীর সাথে জড়িয়ে পড়ে; তারা রাশিয়াতে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করে। সেখানেও যৌন অপরাধে লিপ্ত ব্যক্তিদের আশ্রয় দানে কোন আপত্তি উত্থাপিত হয় না।
নিকট ও দূরের সকল জাহেলী সমাজের লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গল্প লেখক অবিবাহিত হোক কিংবা বিবাহিত সকলেই প্রকাশ্য অবাধে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের পরামর্শ দেয় এবং এ বিষয়টিকে নৈতিক অপরাধ নয় বলে অভিমত প্রকাশ করে। হ্যাঁ, তাদের বিবেচনায় যদি কোন যুবক বা যুবতী সত্যিকার আন্তরিক ভালবাসা ছাড়াই পরস্পরের সাথে মিলিত হয়, তবে তা অপরাধ। কোন স্ত্রীর অন্তরে স্বামীর জন্যে কোন ভালবাসা না থাকা সত্ত্বেও যদি সে নিজের সম্ভ্রম ও সতীত্বের হেফাযত করতে থাকে, তাহলে সে সমাজে এ মহিলা নিন্দনীয়। বরং এ অবস্থায় অন্য কোন প্রেমিক খুঁজে নেয়ারই প্রশংসনীয়। এ পন্থা অবলন্বনের পক্ষে ডজন গল্প লেখা হয়। সংবাদপত্রে সম্পাদকীয় প্রবন্ধ, সাধারণ প্রবদ্ধ, ভাবগম্ভীর ও হালকা ফিচার এবং কার্টুনাদির মাধ্যমে নোংরা ও নির্লজ্জ জীবন যাত্রার প্রতি আহবান জানানো হয়।
মানবীয় দৃষ্টিভংগীর বিচারে এবং মানবতার ক্রমবিকাশের মানদণ্ড অনুসারে উল্লেখিত ধরণের সমাজ পশ্চদমুখী এবং সভ্যতা বিবর্জতি সমাজ।
মানুষের উন্নিতর ধারা পশু প্রবৃত্তির পর্যায়ে থেকে উর্ধগামী হয়ে উচ্চ মূল্যবোধের দিকে পরিচালিত হয়। মানুষের স্বভাবে যে পশু প্রবৃত্তি রয়েছে, তার আকাংখা নিবৃত্ত করার জন্য উন্নয়নশীল সমাজ পারিবারিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। এ ব্যবস্থার ফলে দেহের জৈবিক চাহিদা পূরণের সাথে সাথে ভবিষ্যত বংশধরদের লালন-পালন ও পূর্ণ মানবসূলভ বৈশিষ্ট্য সহকারে তাদের গড়ে তোলার জন্যে প্রশিক্ষণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে। মানব সভ্যতা এভাবেই টিকে থাকতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই যে সমাজ মানুষের পশু প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সাথে মানবীয় বৈশিষ্ট্যগুলোকে বিকাশ লাভ করার পূর্ণ সুযোগ –সুবিধা দানে আগ্রহী সে সমাজকে পারিবারিক পবিত্রতা ও শান্তি-শৃংখলা রক্ষার জন্যে উপযুক্ত পরিমাণে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পরিবারকে দৈহিক উত্তেজনার প্রভাব মুক্ত হয়ে তার মৌলিক কর্তব্য পালনের সুযোগ দান করার জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। অপরপক্ষ যে সমাজে নৈতিকতা বিরোধী শিক্ষা ও বিষাক্ত পারিপাশ্বিক পরিবেশ বিরাজমান এবং যেখানে যৌণ উচ্ছৃংখলতাকে নৈতিক মূল্যবোধের বহির্ভূত বিবেচনা করা হয়, সে সমাজে মনুষ্যত্ব গড়ে উঠার সুযোগ কোথায়?
তাই একমাত্র ইসলামী মূল্যবোধ ও নৈতিকতা, ইসলামী শিক্ষা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই মানব সমাজের জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা। মানব সমাজের উন্নয়নের জন্য গৃহীত স্থায়ী, অপরিবর্তনীয় ও সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এ সত্য স্বীকৃতি লাভ করে যে, ইসলামী সভ্যতাই প্রকৃত সভ্যতা এবং ইসলামী সমাজই হচ্ছে সত্যিকার সভ্য সমাজ।
আল্লাহ পোরস্ত সভ্যতা ও বৈষয়িক উন্নতি
মানুষ যখন পৃথিবীতে আল্লাহর খিলাফত কায়েম করে তখন খিলাফতেরই দাবী অনুসারে নিজেকে একমাত্র আল্লাহর দাসত্বে উৎসর্গ করে দেয় এবং আল্লাহ ছাড়া অপর সকল শক্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত করে নেয়। সে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান বাস্তবায়িত এবং মানব রচিত সকল জীবনাদর্শকে পরিত্যাগ করে আল্লাহর শরীয়াত মেনে চলে এবং অপর সকল প্রকারের আইন পরিত্যাগ করে। আল্লাহর নির্ধারিত মূল্যবোধ ও চারিত্রিক মানদণ্ড গ্রহণ এবং অপর সকল মানদণ্ড মেনে নিতে অস্বীকার করে। খিলাফতে –ইলাহীয়া প্রতিষ্ঠার ফলে একদিকে মানুষের চালচলনের উপরোক্ত ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়। অপর দিকে সে সৃষ্টি জগতে নিয়ন্ত্রণকারী আইন-বিধানগুলোর রসহস্যোদঘাটনের জন্যে চিন্তা-গবেষণায় নিয়োজিত হয়। এ গবেষণালব্ধ ফলাফলগুলোকে সে আল্লাহ তাআলারই দেয়া বিধি-নিষেধের আওতায় রেখে মানব জাতির কল্যাণে নিয়োজিত করে। আল্লাহর খলীফা হিসেবে সে সৃষ্টি থেকে খাদ্য সম্ভার ও শিল্প-কারখানার জন্যে কাঁচামাল সংগ্রহ করে এবং তার কারিগরী ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান প্রয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়ন কাজে অগ্রসর হয়। মানুষ যখন বৈষয়িক উন্নতির জন্যে প্রয়োজনীয় সকল কাজই আল্লাহভীরু অন্তর নিয়ে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে সম্পন্ন করে এবং যখন সে নৈতিক ও বৈষয়িক সকল কাজেই আল্লাহ তাআলার বিধি-নিষেধ সম্পর্কে সজাগ থাকে, তখনই মানুষ পরিপূর্ণরূপে সভ্য হয়। তাদের সমাজ সভ্যতার উচ্চতম শিখরে পৌছে যায়। ইসলামী নিছক বৈষয়িক উন্নতিকে সভ্যতা বিবেচনা করে না। কারণ জাহেলী সমাজও বৈষয়িক উন্নতি লাভ করে থাকে। কুরআনের বহু স্থানে এ ধরনের সমাজকে বৈষয়িক উন্নতি সত্ত্বেও জাহেলী সমাজ আখ্যা দান করা হয়েছে।
——————————————————————————————
“তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা প্রত্যেক উঁচু স্থানে নিছক স্মৃতির নিদর্শনস্বরূপ বড় বড় অট্টালিকা নির্মাণ কর। তোমাদের নির্মিত বিশাল প্রাসাদ দেখে মনে হয় তোমরা দুনিয়ায় চিরকাল থাকবে। যখনই কারো উপর হস্ত প্রসারিত কর, অত্যাচারী হয়েই হস্তক্ষেপ কর। আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। যিনি তোমাদের জ্ঞাতসূত্রেই অনেক কিছু দান করেছেন। তাঁকে ভয় করে জীবন যাপন কর। তিনি তোমাদের পশুপালন, সন্তান-সন্ততি, বাগ-বাগিচা ও প্রস্রবণ দান করেছেন। আমি তোমাদের উপর এক ভয়ানক দিনের আযাবের আশংকা করছি।”
——————————————————————————————-
“তোমরা কি কি পার্থিব দ্রব্য –সামগ্রী নিয়ে চিরকাল সুখে বসবাস করতে পারবে বলে মনে কর, এসব বাগান ও প্রস্রবণে? এসব ফসলের জমি ও রস ভরা খেজুর বাগানে? তোমরা পাহাড় খোদাই করে অহংকারের প্রতীক বিশালাকৃতির বাড়ি –ঘর তৈরী কর। আল্লাহকে ভয় কর এবং আনুগত্য কর। যারা পৃথিবীতে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং শান্তি ও শৃংখলা স্থাপন করে না, তাদের অনুগত হয়ে জীবন যাপন করো না।”
“তাদের যেসব নসিহত করা হয়েছিল, তা যখন তারা ভুলে গেল, তখন আমি তাদের জন্যে স্বাচ্ছন্দ্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলাম। তারা যখন আমার দেয়া পার্থিব প্রাচুর্যের আনন্দে বিভোর ছিল, তখন হঠাৎ তাদের পাকড়াও করি। তারা তখন সকল বিষয়ে নিরাশ হয়ে গেল। এভাবে আমরা অত্যাচারী জাতির মূলোৎপাটন করেছিলাম। সমস্ত প্রশংসা বিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলারই প্রাপ্য।” — আনআম: ৪৪-৪৫
——————————————————————————————-
“যে সময় পৃথিবী ফুলে –ফলে সুশোভিত ও চাষের জমি শস্য ভারাক্রান্ত ছিল এবং জমির মালিকগণ ঐ শস্য থেকে লাভবান হবে বলে বিশ্বাস পোষণ করছিল, ঠিক স সময় অতর্কিত রাত্রিকালে অথবা দিনমানে আমার নির্দেশ পৌছে গেল। আমি তাদের এমনভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিলাম যে, তাদের অস্তিত্বের কোন নিদর্শনই বাকী রইল না।” — ইউনুস: ২৪
আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি ইসলাম বৈষয়িক উন্নতি ও দ্রব্য সামগ্রীর আবিস্কার ও সংগ্রহের বিরোধী নয় বরং আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধানের অধীনে বৈষয়িক উন্নতি সাধনকে আল্লাহর নেয়ামত বলা হয়েছে। আর আল্লাহ তাআলাই তাঁর আনুগত্য ও ফরমাবরদারীর পুরস্কারস্বরূপ মানুষকে ঐ নেয়ামতের শুভ সংবাদও প্রদান করেন।
——————————————————————————————-
“(হযরত নুহ বললেন,) আমি আমার জাতিকে বললাম, এস পরওয়ারদিগারের নিকট ক্ষমা চাও — নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্যে মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে তোমাদের শক্তি বৃদ্ধি করবেন। তিনি তোমাদেরকে বাগ-বাগিচা দান করবেন এবং তোমাদের জন্য স্রোতস্বিনী প্রবাহিত করবেন।” — নূহ:১০-১২
——————————————————————————————
“যদি জনপদের অধিবাসীগণ ঈমান আনয়ন করতো এবং আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে চলতো, তাহলে আমরা তাদের জন্যে আকাশমণ্ডল এ পৃথিবীতে সকল কল্যাণের পথ খুলে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো। তাই আমি তাদের অপকর্মের শাস্তিস্বরূপ তাদেরকে পাকড়াও করলাম।” আরাফ: ৯৬
শুধু বৈষয়িক উন্নতি মানব সমাজের মান নির্ণয়ক নয়। যেসব ধ্যান-ধারণাকে ভিত্তি করে বৈষয়িক ও শৈল্পিক উন্নয়নের বিশাল প্রাসাদ নির্মিত হয়, জীবনের যেসব মূল্যবোধ সমাজকে গ্রথিত করে রাখে এবং সামগ্রিকভাবে গোটা সমাজের চাল-চলন ও রীতিনীতির ভিতর দিয়ে মানব সভ্যতার যে ছাপ পরিস্ফুট হয়ে উঠে, সেগুলোই প্রকৃতপক্ষে সমাজের মান নির্ধারণ করে থাকে।
ইসলামী সমাজের ক্রমবিকাশ
একটি আন্দোলনের মাধ্যমে ইসলামী সমাজের অস্তিত্ব লাভ এবং একটি উত্তম জীবন বিধানের রূপ ধারণের ফলে এ সমাজ নজীরবিহীন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়। তাই জাহিলী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে যে দৃষ্টিভংগী, মনোভাব ও কর্মসূচীর প্রয়োজন হয়, ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তা কিছুতেই ফলপ্রদ হতে পারে না। দীর্ঘকাল ব্যাপী প্রাণান্তকর সংগ্রামের ফলে ইসলামী সমাজের জন্ম হয়। এ সংগ্রাম পরিচালনার রীতিনীতিও ইসলামেরই সীমারেখার দ্বারা পরিবষ্টিত। এ সংগ্রামী আন্দোলনই সমাজে প্রতিটি ব্যক্তির মূল্য ও মর্যাদা নিরূপণ করে এবং তার যথার্থ মূল্যায়ণের পর সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য স্থির করে দেয়। যে আন্দোলনের গর্ভ থেকে ইসলামী সমাজ জন্মলাভ করে, সে আন্দোলনের ভাবধারা ও কর্মসূচী পার্থিব জগত বর্হিভূত ও মানবীয় শক্তি সীমার উর্ধে অবস্থানরত উৎস থেকে রচিত হয়। এ সংগ্রামী আন্দোলনের উৎস হচ্ছে মানুষের প্রতি আল্লাহর নিকট থেকে অবতীর্ণ ঈমান বা বিশ্বাস। এ ঈমান সৃষ্ট জগত মানব জীবন, মানুষের ইতিহাস, জীবনের মূল্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি বিশেষ ধারণা জন্মায় এবং এ ধারণা মুতাবিক জীবন যাপনের উপযোগী জীবন ব্যবস্থাও প্রদান করে। মোদ্দাকথা মানুষের মন-মগয অথবা বস্তু জগত ইসলামী আন্দোলনের উৎসমূল মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি ও বস্তু জগতের উর্ধে। ইসলামী সমাজ গঠনের প্রধান বৈশিষ্টই হচ্ছে ঊর্ধ জগত থেকে অবতীর্ণ ঈমান।
উর্ধজগত থেকে অবতীর্ণ আকীদা-বিশ্বাস মানুষের চিন্তা-গবেষণা অথবা চেষ্টা-তদবিরের ফলে আসে না। ঐশী বাণী থেকে প্রাপ্ত ঈমান ইসলামী আন্দোলনের বীজ বপন করে এবং সাথে সাথে সংগ্রাম পরিচালনার জন্যে মানুষ তৈরী করে। ঈমানের ঐশী বাণী যার নিকটে পৌছে যায় এবং যিনি এ বাণীকে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ বলে বিশ্বাস করেন, তার মাধ্যমেই বীজ বপনের কাজ শুরু হয়ে যায়। এ ব্যক্তি তাঁর ঈমান অন্তরে চেপে নিষ্ক্রিয় বসে থাকেন না। বরং যে বাণীর প্রতি তিনি ঈমান আনয়ন করেছেন তা অন্যের নিকট পৌছানোর জন্যে চেষ্টা –তদবির শুরু করেন। ঈমানের প্রকৃতিই এরূপ। একটি বলিষ্ঠ ও সক্রিয় আন্দোলনের প্রকৃতিই গতিশীল। উর্ধজগত থেকে যে শক্তিমান সত্তা মানুষের অন্তরে ঈমানের আলো জ্বালিয়ে দেন, তিনি ভালভাবেই জানেন যে, ঈমানের আলো অন্তরের গণ্ডীতে আবদ্ধ হয়ে থাকেনা বরং তা বিশাল পৃথিবীর সর্বত্র আলোক রশ্মি ছড়িয়ে দেয়।
ঈমানদারদের সংখ্যা যখন তিনজন হয়ে যায় তখন এ ঈমানই তাদের বলে, “এখন তোমরা একটি সমাজে পরিণত হয়েছ এবং এ সমাজ একটি বৈশিষ্ট্যময় ইসলামী সমাজ। প্রচলিত জাহেলী সমাজ থেকে তোমাদের সমাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। কারণ জাহেলী সমাজ তোমাদের ঈমান মুতাবিক পরিচালিত হচ্ছে না।” তিনজন ঈমানদার সংগঠিত হয়ে যাবার পর ইসলামী সমাজের একটি বাস্তব নমুনা পরিস্ফুট হয়ে উঠে।
তিনজন থেকে ঈমানদারদের সংখ্যা দশজনে, দশজন থেকে একশতে, একশত থেকে হাজারে এবং হাজার থেকে কয়েক হাজারে পৌছে যায় এবং এভাবেই ইসলামী সমাজ ক্রমশ সম্প্রসারিত ও শক্তিশালী হয়ে উঠে।
ইতিমধ্যেই জাহেলী সমাজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়। বিবদমান পক্ষ দু’টোর মধ্যে একদিকে থাকে নবগঠিত ইসলামী সংগঠন। ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, সভ্যতার মানদণ্ড, সাংগঠনিক কাঠামো ইত্যাদি সহকারে একটি ছোট্ট সদ্যজাত সমাজ জাহেলী সমাজ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। অপরপক্ষে জাহেলী সমাজ এ নবজাত সমাজের পথ রোধ করে দাঁড়ায় এবং উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ সংঘর্ষ চলাকালে জাহেলী সমাজ থেকে একজন দু’জন করে লোক ইসলামী সমাজে যোগদান করে। আন্দোলনের সূচনা থেকে শুরু করে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ইসলামী সমাজ তার প্রতিটি ব্যক্তিকে যাচাই করে নেয় এবং পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে ইসলামী মানদণ্ড যে ব্যক্তি যে মর্যাদা ও দায়িত্ব বহনের যোগ্য, তাকে সে মর্যাদা ও দায়িত্ব দান করে। ইসলামী সমাজ প্রয়োজনের তাকিদেই মানুষের যোগ্যতা, কর্মশক্তি, মর্যাদা ইত্যাদি যাচাই করে নেয়। কোন ব্যক্তির পক্ষেই অগ্রসর হয়ে নিজের যোগ্যতা ও মর্যাদার দাবী পেশ করার প্রয়োজন হয় না। বরং ব্যক্তির আকীদা-বিশ্বাস ও মূল্যবোধ তাকে সমাজের সন্ধানী দৃষ্টি থেকে আত্মগোপন করে থাকতে বাধ্য করে। কারণ তার সমাজ সর্বদা দায়িত্ব অর্পণের জন্যে যোগ্য লোক অনুসন্ধান করে। ওদিকে ব্যক্তি নিজেকে অপরের তুলনায় যোগ্যতর বিবেচনা করে না। তাই লুকিয়ে থাকাই পছন্দ করে।
কিন্তু ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে যে সমাজের জন্ম, সে সমাজে কারো পক্ষে নিজের যোগ্যতা গোপন করে রাখা সম্ভব নয়। এ সমাজের প্রতিটি সদস্যকে সক্রিয় হতে হবে। তার আকীদা-বিশ্বাসে উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা যাবে। তার শরীরের রক্ত হবে উত্তপ্ত। তাই ইসলামী সমাজ কর্মপ্রেরণায় সর্বদা কর্মতৎপরতার দ্বারপ্রান্তে পৌছার জন্য প্রতিটি ব্যক্তি নিজের যথাসর্বস্ব সংগ্রামের পথে ঢেলে দেবে। ইসলামী সংগঠনের চারিদিকে বিরাজমান জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে জারীকৃত সংগ্রাম পূর্ণ গতিতে এগিয়ে যাবে। এ সংগ্রামের বিরাম নেই. বিশ্রাম নেই, নেই বাতিলের সাথে কোন আপোষ রফা। তাই আল্লাহর রাসূল (সা) এরশাদ করেছেন, “জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে।”
উত্থান পতনের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলার পথে প্রতিটি ব্যক্তির মর্যাদা নিরুপতি হয়ে যায় এবং সংগ্রাম চলাকালে প্রত্যেকের নিজ নিজ যোগ্যতানুসারে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের ভিতর দিয়েই আন্দোলন সফলতা অর্জন করে। ইসলামী সমাজের দু’টো বৈশিষ্ট্য, যথা আন্দোলনের সূচনা ও সংগঠন পদ্ধতি, এ সমাজের গঠন, আকৃতি-প্রকৃতি, রীতিনীতি ও কর্মসূচীকে অন্যান্য সকল অনৈসলামিক সমাজ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মর্যাদায় পৌছ দেয়। তাই অন্যান্য মতবাদের সৃষ্টিভংগীতে যাচাই করে যেমন ইসলামী সমাজের বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করা যাবে না, তেমনি অনৈসলামিক আন্দোলনের রীতিনীতি ধার করে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছুই নয়।
ইসলামী সভ্যতা সমগ্র মানবতার সম্পদ
আমরা উপরে ইসলামী সভ্যতার যে সংজ্ঞা উল্লেখ করেছি, সে সংজ্ঞানুসারে ইসলাম অতীত ইতিহাসের পৃষ্ঠায় লিখিত একটি বিশেষ যুগের মতবাদ নয়। বরং ইসলামী সভ্যতা আধুনিক যুগের দাবী ও ভবিষ্যতের জন্য আশার আলো। এ আদর্শ সকল যুগের জন্যেই এসেছে। মানুষ আজও যেমন ইসলামী আদর্শের সংস্পর্শে অশেষ কল্যাণ লাভ করতে পারে, তেমনি ভবিষ্যতেও পারবে। আর আজকের দনিয়াকে শুধু ইসলামী আদর্শই জাহেলিয়াতের নিরেট অন্ধকার গুহা থেকে উদ্ধার করতে পারে। শিল্প-বিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক ক্ষেতে উন্নত জাতিগুলো যেমন ইসলামী আদর্শ থেকে কল্যাণ লাভ করতে পারে, তেমনি পারে দুর্বল ও দরিদ্র জাতিগুলো।
উপরে আমরা যে মূল্যবোধের উল্লেখ করেছি তা একমাত্র ইসলামী সভ্যতার যুগেই মানব সমাজে রূপ লাভ করেছিল। তাছাড়া আর কোন কালেই হয়নি। যে সভ্যতায় মানবীয় মূল্যবোধ পূর্ণরূপে বিকাশ লাভ করে, আমরা সে সভ্যতাকেই ইসলামী সভ্যতা বলে জানি। কিন্তু যে সভ্যতায় শুধু শিল্প- বিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক উন্নতির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং মানবীয় মূল্যবোধ হ্রাস পায় সে সভ্যতাকে ইসলামী সভ্যতা আখ্যা দেয়া যেতে পারে না। ইসলামী মূল্যবোধ কাল্পনিক বিষয় নয় বরং অত্যন্ত বাস্তব। মানুষ যখনই ইসলামী শিক্ষার আলোকে মূল্যবোধ অর্জন করার জন্যে সঠিকভাবে চেষ্টা করবে; শুধু তখনই এ সম্পদ লাভ করবে। পরিবেশ যাই হোক না কেন এবং শিল্প ও বিজ্ঞানে উন্নতিশীল সমাজ উন্নতির যে স্তরই অবস্থান করুক না কেন, উল্লেখিত মূল্যবোধ অর্জনের প্রচেষ্টা তার উন্নয়নের গতি বিন্দমাত্র হ্রাস করে না। কারণ মানবীয় মূল্যবোধ উন্নয়নের বিরোধী নয়। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম বৈষয়িক উন্নতি ও বৈজ্ঞানিক চিন্তা-গবেষণার প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করে। কারণ বৈষয়িক উন্নতি খিলাফতের দায়িত্ব পালনে সহায়ক।
অনুরূপভাবে যেসব দেশ শিল্প ও বিজ্ঞানে অনগ্রসর সেসব দেশে উল্লেখিত মূল্যবোধ মানুষের নিশ্চেষ্ট বসে থাকা পসন্দ করে না বরং শিল্প ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উন্নতি সাধনের উদ্দেশ্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর জন্যে তাদেরকে উৎসাহিত করে। মানবীয় মূল্যবোধ সহকারে ইসলামী সভ্যতা সকল প্রকারের অর্থনৈতিক পরিবেশেই বাস্তবে রূপ লাভ করতে পারে।
ইসলামী সমাজের জীবন যাত্রা প্রণালী ও বাণিজ্যিক আকার –আকৃতি যুগ ও পরিবেশ অনুসারে পরিবর্তিত হয়। কিন্তু ইসলামী সভ্যতার গোড়ায় যে মূল্যবোধ রয়েছে তা স্থায়ী, অটল, অপরিবর্তনীয় ও ঐতিহাসিক বাস্তবতার উপর প্রতিষ্ঠিত। আমরা যখন মূল্যবোধকে ‘ঐতিহাসিক বাস্তবতা’ আখ্যা দেই তখন তার অর্থ দাড়ায়, ইতিহাসের এমন একটি অধ্যায় যে অধ্যায়ে ইসলামী মূল্যবোধ সম্পর্কে অবগত। এ মূল্যবোধ ইতিহাসের সৃষ্টি নয় বরং ইতিহাস এ মূল্যবোধের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছে। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে, ইসলামী মূল্যবোধ প্রকৃতিগত কারণেই কোন বিশেষ যুগ বা পরিবেশ সীমিত হতে পারে না। এ মূল্যমান ও মূল্যবোধ মানুষের মন-মস্তিষ্ক অথবা প্রাকৃতিক জগতে রচিত হয়নি। বরং সকল যুগ ও সকল পরিবেশে মানুষের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে উর্ধজগত থেকে রচিত।
ইসলামী সভ্যতা বৈষয়িক ও সাংগঠনিক কাঠামোর দিক থেকে বিভিন্ন বাহ্যিক রূপ ধারণ করতে পারে। কিন্তু তার মূলনীতি ও মূল্যমান শাশ্বত ও চিরন্তন। এগুলো হচ্ছে আল্লাহর বন্দগী, তৌহিদের ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন, বস্তুসামগ্রীর উপর মানবতার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা, মানবীয় মূল্যবোধের বিকাশ সাধনের মাধ্যমে পশুত্ব দমন, পারিবারিক ব্যবস্থার যথাযোগ্য মর্যাদা দান। আল্লাহ তাআলারই নির্দেশ মুতাবিক পৃথিবীতে আল্লাহর খিলাফত প্রতিষ্ঠা এবং তারই শরীয়াত মুতাবিক খিলাফতের সকল কার্য পরিচালনা করা।
উপরেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইসলামী সভ্যতা বৈজ্ঞানিক সংগঠিনের জন্যে যোগ্যতা ও কর্মশক্তিকে ব্যবহার করে। তাই স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় মূল্যমান বহাল রাখার পরও ইসলামী সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত সমাজের শিল্প, বিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক পরিবেশের সাথে সঙ্গতি রক্ষার জন্যে ইসলামী সভ্যতার বাহ্যিক ধরন-ধারণে কিছুটা রদবদল হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। এ পরিবর্তনশীলতাও ইসলামের আভ্যন্তরীণ প্রকৃতির মধ্যেই নিহিত। বাইরের কোন মতাদর্শ থেকে তা ধার করা হয়নি। কিন্তু সভ্যতার বাহ্যিক ধরন-ধারণে সময়োপযোগী পরিবর্তনের অর্থ আকীদা-বিশ্বাসে অথবা মূল্যবোধের পরিবর্তন নয়। বাহ্যিক রদবদলকে আভ্যন্তরীণ নীতি পরিবর্তনের সাথে মিশ্রিত করে নেয়ার কোনই অবকাশ নেই।
ইসলাম মধ্য আফ্রিকায় প্রবেশ করে উলংগ মানুষের সমাজে সভ্যতার বীজ বপন করেছে এবং সেখানে যেখান ইসলামী প্রভাব বিস্তার লাভ করেছে, সেখানের মানুষই উলংগ দেহ কাপড় দিয়ে ঢেকেছে এবং দিগন্বর চলাফেরার অভ্যস্ত মানুষ লেবাছ-পোশাক পরিধান করে সভ্যতার সীমারেখায় প্রবেশ করেছে। ইসলামী শিক্ষার প্রভাবেই তারা মানব সমাজ থেকে বিছিন্ন তাদের পূর্ববর্তী জীবন পরিত্যাগ করেছে এবং ইসলামের প্রেরণায় উদ্বদ্ধ হয়েই সভ্যতা বর্জিত মানুষেরা প্রকৃতির গুপ্ত সম্পদ খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে কায়িক পরিশ্রম করার শিক্ষা লাভ করেছে। ইসলামই তাদের সংকীর্ণ গোত্রীয় গণ্ডি থেকে টেনে বের করে বিশাল ইসলামী সমাজের জনসমুদ্রে নিক্ষেপ করেছে এবং পর্বত গুহার ভিতর বসে নানাবিধ কাল্পনিক দেব-দেবীর পূজা করার পরিবর্তে বিশ্ব-জগতের স্রষ্টা ও প্রতিপালক এক আল্লাহর বন্দেগীর শিক্ষা দিয়েছে। এ বিরাট পরিবর্তন যদি সভ্যতা না হয়, তাহলে সভ্যতার সংজ্ঞা কি? এটা ছিল এক বিশেষ পরিবেশের সভ্যতা এবং এ পরিবেশে যে সে উপকরণ বিদ্যমান ছিল তা-ই তখন ব্যবহার করা হয়েছে। অনুরূপভাবেই ইসলাম যদি অন্য কোন পরিবেশে প্রবেশ করে তাহলে তার কার্যক্রম সে পরিবেশের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করেই রচিত হবে এবং সে সমাজের অবস্থা মুতাবিকই সভ্যতার রূপ প্রকাশিত হবে। তাই ইসলামের শেখানো পদ্ধতি অনুসারে ইসলামী সভ্যতা বিকাশ লাভ করার জন্য শিল্প বিজ্ঞান ও অর্থনীতির বিশেষ কোন স্তর নির্দিষ্ট নেই। ইসলামী সভ্যতা যেখানেই প্রবেশ করবে সে স্থানে যেসব বস্তুর উপাদান থাকবে সেগুলোকে ব্যবহার করবে এবং সেগুলোকে অধিকতর মার্জিত রূপ দান করবে। যদি কোন সমাজে এসব বস্তু উপাদান না থাকে, তাহলে সেগুলো অর্জন করার পন্থা শিখিয়ে দিয়ে সমাজটিকে উন্নতির পথে অগ্রসর করে দেবে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, ইসলাম তার শাশ্বত ও চিরন্তন মূলনীতির উপরই প্রতিষ্ঠিত হবে এবং যেখানে যখনই তা প্রতিষ্ঠিত হবে, সেখানেই তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। তাকে কায়েম করা ও কায়েম রাখার জন্য বিশেষ সংগঠনও গড়ে উঠবে এবং স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও সংগঠন কাঠামো নিয়ে ইসলামী সভ্যতা জাহেলী সামজ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করবে।
—————————————————–
“আল্লাহর রঙে নিজেকে রঙীন কর। আল্লাহর দেয়া রঙের চাইতে উৎকৃষ্ট রঙ আর কি হতে পারে? — আল বাকারা: ১৩৮