দ্বাদশ অধ্যায়
রক্তে রঞ্জিত পথ
——————————————————————————————
“সুদৃঢ় দুর্গময় আকাশ মণ্ডলের শপথ এবং শপথ সে দিনের যার ওয়াদা করা হয়েছে। শপথ দর্শকের এবং দৃষ্ট বিষয়ের।ধ্বংস হয়েছে গর্ত খননকারীগণ। যাদের খনন করা গর্তে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। যখন তারা গর্তের মুখে বসেছিল এবং ঈমানদারদের সাথে যা কিছু করা হচ্ছিল, তার তামাশা দেখছিল। ঈমানদারদের সাথে তাদের শত্রুতার কারণ হচ্ছে এই যে, তারা (ঈমানদারগন) প্রবল পরাক্রান্ত ও সদা প্রশংসিত আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করেছিল। যিনি আকাশ ও সদা ভূমণ্ডলের অধিপতি এবং সে আল্লাহ সবকিছুই দেখেন। যেসব লোক ঈমানদার পুরুষ ও নারীদের প্রতি যুলুম –নির্যাতন চালিয়েছে এবং তারপর ঐ কাজ থেকে তাওবা করে নাই — নিসন্দেহে তাদের জন্যে রয়েছে জাহান্নামের আযাব এবং তাদের জন্যে নিদিষ্ট হয়ে আছে ভস্মকারী আযাব। যারা ঈমান আনয়ন ও নেক আমল করেছে, তাদের জন্যে সুনিশ্চিত পুরস্কার হিসেবে রয়েছে জান্নাতের বাগিচা যার নীচ দিয়ে ঝর্ণা প্রবাহিত। এটাই হচ্ছে সত্যিকার সাফল্য। মূলত তোমরা আল্লাহর পাকড়াও খুবই শক্ত। তিনিই সৃষ্টির সূচনা করেছেন এবং পুনরায় সৃষ্টি করবেন। আর তিনি ক্ষমাশীল, প্রেমময়, আরশের অধিপতি ও মহান। তিনি নিজ ইচ্ছায় সকল কাজ সম্পন্নকারী।” — আল বুরুজ: ১-১৬
কুরআনে বর্ণিত গর্ত খননকারীদের কাহিনী সকল ঈমানদার ব্যক্তির জন্যেই চিন্তা-ভাবনার উদ্রেক করে। যারা দুনিয়াতে দাওয়াতে দ্বীনের কাজ করতে ইচ্ছুক তাদের জন্যে এ সূরা (সুরায়ে বুরুজ) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পবিত্র কুরআন কাহিনীর ভূমিকা, বিবরণ, মন্তব্য ও শিক্ষণীয় বিষয় যেভাবে পেশ করেছে, তার মধ্যে আল্লাহর পথে আহবানকারীদের যাত্রা পথ সম্পর্কে সুস্পষ্ট রূপরেখা ফুটে উঠেছে। দ্বীনি আন্দোলনের প্রকৃতি, মানব গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া ও সুপ্রশস্ত পৃথিবীতে এ দাওয়াত প্রসার কালে যা যা ঘটতে পারে, সে সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা দান করা হয়েছে। কাহিনী বর্ণনার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদের চলার পথে যেসব বাধা বিপত্তি আসতে পারে তা উল্লেখ করেছেন এবং সম্ভাব্য সকল প্রকার বিপদ-আপদ ও দুঃখ-কষ্টকে বরণ করে নেয়ার জন্যে উৎসাহ দিয়েছেন।
কাহিনীটি হচ্ছে একদল ঈমানদারের। তাঁরা তাঁদের পরওয়ারদিগারের প্রতি ঈমান আনয়ন করেছিলেন এবং তাঁদের ঈমানের বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রকাশ্য ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সমাজের অত্যাচারী ও পরাক্রান্ত শত্রুগণ প্রশংসিত ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি ঐ ব্যক্তিদের ঈমান আনয়ন করার অধিকার দান করতে রাযী ছিল না। তাই ঈমানদারগণ চরম নির্যাতনের সম্মুখীন হন। শত্রুদল আল্লাহ প্রদত্ত মর্যাদা হরণ কারে তাদের শাসকগোষ্ঠীর হাতের ক্রীড়ানক বানানোর অপচেষ্টায় নিষ্ঠুর দৈহিক অত্যাচার চালিয়ে বিকৃত রুচিবোধের পরিচয় দেয়।
কিন্তু ঈমানের বলে বলীয়ান পবিত্র হৃদয় ব্যক্তিগণ তাঁদের উপর আপতিত পরীক্ষায় পরিপূর্ণরূপে উত্তীর্ণ হন। তাঁদের নশ্বর দেহের উপর বিজয়ী হয়। তাই তাঁরা অত্যাচারীর ভয়-ভীতি ও সন্ত্রাস সৃষ্টিতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি বরং জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়ে তিলে তিলে মৃত্যু বরণ করেছেন। তবু তাঁরা নিজেদের দ্বীন থেকে চুল পরিমাণ সরে যেতেই রাযী হননি। তাঁরা পার্থিব জীবনের মায়া ও আকর্ষণ থেকে মুক্ত ছিলেন। এ জন্যেই নির্মম পন্থায় তাঁদের পশুর মতো হত্যার উদ্যোগ আয়োজন করা হলেও তা দেখে তাঁরা জীবনের বিনিময়ে আকীদা পরিত্যাগ করতে পারেনি। তাঁরা দুনিয়ার সুখ-সম্পদের মায়া কাটিয়ে নির্ভীক চিত্তে উর্ধজগতে চলে যায়। স্বল্পস্থায়ী জীবনের উপর ঈমানী শক্তির কি অপূর্ব প্রাধান্য।
পূর্ণ ঈমানদার, উন্নত চরিত্র, সৎকর্মশীল ও সদাচারী ব্যক্তিদের বিপক্ষে ছিল আল্লাহদ্রোহী, হঠকারী, অসচ্চরিত্র ও অপরাধ প্রবণ দ্বীন প্রকৃতির মানুষেরা। তারা জ্বলন্ত অগ্নি গহবরের কিনারায় বসে মু’মিনদের যন্ত্রণাকাতর শোচনীয় মৃত্যুর দৃশ্য উপভোগ করছিল। জ্বলন্ত আগুনে কিভাবে জীবন্ত মানুষকে গ্রাস করে এবং জ্বালিয়ে ভস্মে পরিণত করে তা দেখার কৌতুহল নিয়ে তারা গর্তের পাশে জড় হয়েছিল।
যখন কোন ঈমানদার যুবক, যুবতী, শিশু, বৃদ্ধা কিংবা বয়স্ক ব্যক্তিকে আগুনে নিক্ষেপ করা হতো, তখন তাদের আনন্দ উন্মত্ততায় রূপান্তরিত হতো। এবং রক্তের ফিনকি ও জ্বলন্ত মাংস খণ্ড দেখে তারা আনন্দে নৃত্য করতো। এ লোমহর্ষক কাহিনী থেকে বুঝা যায় যে, অত্যাচারী দল সম্পূর্ণরূপে বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট পর্যায়ে নেমে গিয়েছিল। কারণ হিংস্র জন্তু ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য শিকার করে থাকে। তারা আনন্দ উপভোগ করার উদ্দেশ্যে জীব হত্যা করে না।
একই ঘটনা থেকে ঈমানদারদের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে একটা পরিস্কার ধারণা করা যায়। তাঁরা আধ্যাত্মিকতার শীর্ষস্থানে আরোহণ করেছিলেন। আল্লাহর প্রতি তাঁদের অটল নির্ভরশীলতা পূর্ণতা লাভ করেছিল। সকল যুগ ও সকল কালের মানুষের জন্যই ঈমানের এ স্তর পরম কাম্য হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।
স্থুলদৃষ্টিতে দেখা যায় যে, অত্যাচার নির্যাতন ঈমান ও আকীদার উপর জয়যুক্ত হয়েছে। যদিও এ সচ্চরিত্র, ধৈর্যশীল ও আল্লাহভীরু ব্যক্তিদের ঈমানী শক্তি শীর্ষস্থানে পৌছে গিয়েছিল, তথাপি ঘটনার পরিণতি দৃষ্টে মনে হয় যেন বাতিলের সাথে শক্তি পরীক্ষায় তাদের ঈমানী শক্তি ব্যর্থতা অর্জন করেছে। এ জাতীয় জঘন্য অপরাধের দরুণ নূহ (আ), হূদ (আ), ছালেহ (আ), শুয়াইব (আ) ও লূত (আ) –এর জাতিগুলোকে যেভাবে শান্তি দেয়া হয়েছিল, সেরূপ গর্ত খননকারীদেরকেও দেয়া হয়েছিল কিনা, তা কুরআন পাক অথবা অন্য কোন গ্রন্থ থেকে জানা যায় না। অথবা ফিরাউন ও তার লোক-লস্করকে আল্লাহ তাআলা যে কঠেরতার সাথে পাকড়াও করেছিলেন, সেভাবে এদেরও দণ্ডবিধান করেছিলেন কি না তাও জানার কোন উপায় নেই। ফলে বস্তুবাদী দৃষ্টিভংগীর নিরিখে এ ঘটনায় ঈমানদারদের পরিণতি ছিল খুবই মর্মান্তিক।
কিন্তু ব্যাপারটির পরিসমাপ্তি কি এখানেই? ঈমানের উচ্চতর পর্যায়ে যারা পৌছে গিয়েছিলেন, সে আল্লাহ ভীরু ও সচ্চরিত্র দলটি কি অত্যাচার নির্যাতনের আবর্তে গর্তের আগুনে জ্বলে পুড়ে ভস্মে পরিণত হয়েই শেষ হয়ে গেলেন? আর অত্যাচারী পশুসদৃশ মানুষগুলো কি সম্পূর্ণরূপে শান্তি এড়িয়ে গেল। পার্থিব দৃষ্টিতে এ বিষয়টি সম্পর্কে মনে নানাবিধ প্রশ্ন জাগে। কিন্তু কুরআন ঈমানদারদেরকে অন্য ধরনের শিক্ষা দান করে এবং তাদের সামনে অপর একটি রহস্যের দ্বারোদঘাটন করে। কুরআন ভাল মন্দ নির্ণয়ের এক নুতন মানদণ্ড পেশ করে, যে মানদণ্ড হক ও বাতিলের সংঘষে মু’মিনদের চলার পথ নিরূপণে সহায়ক হয়।
দুনিয়ার জীবন, তার আরাম –আয়েশ, ভোগ ও বঞ্চনা ইত্যাদিই মানব জীবনের সিদ্ধান্তকর বিষয় নয়। শুধু এগুলোই লাভ ও লোকশানের হিসেব নিধারক নয়। সাময়িকভাবে প্রাধান্য বিস্তারের নাম বিজয় নয় যদিও বিজয়ের বিভিন্ন উপায় –পন্থার অন্যতম হচ্ছে প্রাধান্য। আল্লাহর মানদণ্ডে একমাত্র ঈমানের ওজনই ভারী। আল্লাহর বাজারে শুধু ঈমানের পণ্যেরই চাহিদা রয়েছে। বিজয়ের উৎকৃষ্ট নমুনা হচ্ছে বস্তুর উপর ঈমানের প্রাধান্য। উল্লেখিত ঘটনা থেকে পরিস্কার বুঝা যায় যে, ঈমানদারদের রূহ, ভয়-ভীতি, দুঃখ –কষ্ট এবং পার্থিব জীবনের আরাম-আয়েশ ও ভোগ লিপ্সার উপর পরিপূর্ণরূপে বিজয়ী হয়। চরম নির্যাতনের মুখে ঈমানদারগণ যে বিজয় ও সম্ভ্রম অর্জন করে গিয়েছেন তা মানব জাতির ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় রচনা করে। আর এ বিজয়ই হচ্ছে সত্যিকার বিজয়।
সকল মানুষই মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু মৃত্যুর উপলক্ষ হয় বিভিন্ন ধরনের। উল্লেখিত ঈমানদার ব্যক্তিদের মত সাফল্য সকলের ভাগ্যে ঘটে না। এমন উচ্চ পর্যায়ের ঈমান অর্জন করাও অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। এ ধরনের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা সকলে ভোগ করতে পারে না। আল্লাহ তাআলাই তাঁর অপার অনুগ্রহে একদল লোকে বাছাই করে নেন যারা সকল মানুষের মত মৃত্যুবরণ করে কিন্তু তাদের উপলক্ষ হয় অত্যন্ত সৌভাগ্যজনক। এ সৌভাগ্য অন্য কেউ অর্জন করতে পারে না। তাঁরা মহান ফেরেশতাদের চেয়েও উচ্চ মর্যাদা এবং সম্মান লাভ করে থাকেন। সম্মান ও ও মর্যাদার উল্লেখিত নিরিখে তাঁরা মানব জাতির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম মর্যাদার অধিকারী হয়ে যান।
উল্লেখিত মু’মিনদের ঈমান পরিত্যাগ করে জীবন বাঁচানোর সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এরূপ করার ফলে তারা নিজেরা এবং সমগ্র মানবগোষ্ঠী কি পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হতো? ‘ঈমান বিহীন জীবনের এক কানাকড়ির মূল্যও নেই’— এ মহান সত্যকে যদি জীবন রক্ষার খাতিরে বর্জন করে দেয়া হতো তাহলে মানবজাতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতো। আকীদা-বিশ্বাসের স্বাধীনতা হারানোর পর মানুষ হয়ে যায় নিঃস্ব। যালিম শাসক গোষ্ঠী যদি দেহের উপর নির্যাতন চালিয়ে আত্মার উপরও শাসনদণ্ড কায়েম করতে সক্ষম হয়, তাহলে মানব সত্তা চরমভাবে অধপতিত হয়। উল্লেখিত ঈমানদারগণ ঈমানের যে পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিলেন, তার ফলে তাঁদের জীবন্তদেহে আগুনের দাহিকা শক্তি কার্যকর হবার সময়ও তারা মহাসত্য ও পবিত্রতার উপর অটল ছিলেন। তাদের নশ্বর দেহ যে সময় আগুনে জ্বলছিল, সে সময় তাঁদের মহান ও সুউচ্চ আদর্শ সফলতার সোপান বেয়ে উর্ধে আরোহণ করছিল। বরং আগুন তাদের আদর্শ পরায়ণতাকে আরও ঔজ্জল্য দান করেছিল।
সত্য ও মিথ্যার (হক ও বাতিলের) এ লড়াই পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। আর শুধু পার্থিব জীবনই পরিপূর্ণ মানব জীবন নয়। সংগ্রমামে শুধু সমসাময়িক যুগের মানুষই অংশ গ্রহণ করে না। বাতিলের বিরুদ্ধে হকের যুদ্ধ ফেরেশতাগণও শরীক হন, লড়াইয়ের গতিধারা পর্যবেক্ষণ করেন এবং যা কিছু হয়, তা প্রত্যক্ষ করেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা ঘটনাবলীকে তুলাদণ্ডে ওজন করেন। এ তুলাদণ্ড সকল যুগ ও সকল ধরনের মানবীয় তুলাদণ্ড থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বরং সমগ্র মানব গোষ্ঠীর তুলাদণ্ড থেকেও ফেরেশতাদের তুলাদণ্ড স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ফেরশতাগণ আল্লাহর মহান সৃষ্টি। এক সময় সমগ্র দুনিয়ায় যত সংখ্যক মানুষ বাস করে, ফেরেশতাদের সংখ্যা তাদের চেয়েও কয়েকগুণ বেশী। তাই নিসন্দেহে বলা যায় যে, হকপন্থীদের উদ্দেশ্যে ফেরেশতাদের প্রশংসা ও শ্রদ্ধা দুনিয়ার অধিবাসীদের শ্রদ্ধা ও প্রশংসার তুলনায় অনেক বিশী মূল্যবান।
এ সকল স্তরের পরে হচ্ছে আখেরাত। আর সেটাই হচ্ছে ফলাফল প্রকাশের প্রকৃত স্থান। দুনিয়ার এ মঞ্চটি আখেরাতের সাথে সংযুক্ত — বিচ্ছিন্ন নয়। এটাই প্রকৃত সত্য এবং মু’মিনের অবিচল ঈমানও তাই। হক ও বাতিলের লড়াই দুনিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রেই সমাপ্ত হয়ে যায় না। প্রকৃত সমাপ্তির স্তর তো এখানো আসেনি। দুনিয়ার মঞ্চে লড়াইয়ের যে অংশটুকু সংঘটিত হয়েছে, সেটুকুর উপর ভিত্তি করে কোন সিদ্ধান্তে পৌছা সঠিক ও ন্যায়সংগত হতে পারে না। কারণ তাহলে এ সিদ্ধান্ত যুদ্ধের কয়েকটি সাধারণ ঘাত-প্রতিঘাত পর্যন্তই সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে।
যারা পার্থিব জীবনকেই একমাত্র জীবন মনে করে,তাদের দৃষ্টিভংগী খু্বই সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ। চঞ্চলমনা ব্যক্তিগণই এ ধরনের দৃষ্টিভংগী পোষণ করে। দ্বিতীয় ধরনের দুষ্টিভংগী (অথাৎ আখেরাতে দৃষ্টিভংগী) সুদূর প্রসারী। বাস্তব ও ব্যাপক। কুরআন ঈমানদারদের মনে দ্বিতীয় ধরনের দৃষ্টিভংগী গড়ে তোলে। আর এটিই হচ্ছে বাস্তবমুখী দৃষ্টিভংগী। এ দৃষ্টিভংগীর উপরই প্রতিষ্ঠিত হয় ঈমান ভিত্তিক চিন্তাধারার বিশাল ইমারত। আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদের জন্যে ঈমান ও আনুগত্যের দৃঢ়তা এবং ঈমানের অগ্নিপরীক্ষায় অটল ধৈর্য ধারণের প্রতিদানে যে পুরস্কারের ওয়াদা করেছেন, তা হচ্ছে অন্তরের প্রশান্তি। এরশাদ হচ্ছে —
——————————————————————————————-
“যারা ঈমান আনয়ন করেছে তাদের অন্তর আল্লাহর যিকিরের ফলে প্রশান্তি অর্জন করেছে। জেনে রাখ, আল্লাহর যিকিরই অন্তরে প্রশান্তি এনে দেয়।” —আলে রাআদ:২৮
আর এর সাথেই শামিল রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও প্রেম ভালোভাসার ওয়াদা।
————————————————-
“নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনয়ন করেছে এবং নেক আমল করে জীবন কাটিয়েছে, তাদের জন্য আল্লাহ তাআলা (মানুষের) অন্তরে মুহাব্বত পয়দা করে দেবেন।” — মরিয়াম: ৯৬
তাছাড়া উর্ধজগতে তাদের সম্পর্কে আলাপ আলোচনার ওয়াদাও রয়েছে।
রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, “যখন আল্লাহর কোন বান্দার সন্তান মারা যায়, তখন আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের ডেকে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি আমার অমুক বান্দার সন্তানের রূহ হরণ করেছ?
ফেরেশতাগণ বলেন, ‘জি, হ্যা’!
আল্লাহ তাআলা পুনরায় জিজ্ঞেস করেন, “তোমরা কি আমার বান্দার কলিজার টুকরো হরণ করেছো?”
তাঁরা বলেন, “জি হ্যাঁ, পরওয়ারদিগার!”
আল্লাহ বলেন, “আমার বান্দা সে সময় কি বলেছে?”
ফেরেশতা বলেন, “তিনি আপনার প্রশংসা কীর্তন করেছেন” এবং ————————————– “আমরা নিশ্চয়ই আল্লাহর জন্যে এবং তাঁর দিকেই আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে — একথা বলেছে।”
আল্লাহ তাআলা তখন আদেশ দেন, “আমার ঐ বান্দার জন্যে বেহেশতে একটি প্রাসাদ তৈরী কর এবং তার নাম দাও বায়তুল হামদ (প্রশংসার ঘর)”। -(তিরমিযী )
হযরত নবী করীম (সা) থেকে আরও বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তাআলা বলে, “আমার বান্দা আমার সম্পর্কে যেরূপ ধারণা পোষণ করে, আমি হুবহু সেরূপ। সে যখন আমাকে স্মরণ করে তখন আমি তার সাথেই থাকি। সে যদি আমাকে মনে মনে স্মরণ করে, তাহলে আমিও তাকে মনে মনে স্মরণ করি। যদি সে লোকের সামনে আমাকে স্মরণ করে তাহলে আমি তাকে আরও বড় মজলিসে স্মরণ করি। যদি সে আমার দিকে এক বিঘত এগিয়ে আসে, তাহলে আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে আসি। যদি সে আমার দিকে এক হাত এগিয়ে আসে, তাহলে আমি তার দিকে কয়েক হাত এগিয়ে যাই। যদি সে আমার দিকে হেঁটে আসে তাহলে আমি তার দিকে দৌঁড় যাই।” — (বুখারী ও মুসলিম)
আরও ওয়াদা রয়েছে যে, উর্ধজগতে ঈমানদেরগণের জন্যে দোয়া করা হয় এবং তাদের জন্য সেখানে গভীর প্রেম ও সহানুভুতি রয়েছে।
——————————————————————————————–
“যেসব ফেরেশতা আরশ বহন করে এবং যাঁরা আল্লাহর চার পাশে থাকেন, সকলেই নিজেদের রবের প্রশংসা সহ তাসবীহ পাঠ করেন এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখেন। আর তাঁরা ঈমানদারদের জন্যে আল্লাহর দরবারে মাগফিরাত কামনা করে বলেন, ‘প্রভু! পরওয়ারদিগার! তোমার রহমাত এ জ্ঞান সর্বত্র পরিবেষ্টন করে আছে। সুতরাং যারা তওবা করে এবং তোমার প্রদর্শিত পথে জীবন যাপন করে, তাদের ত্রুটি মাফ করে দাও এবং তাদেরকে দোযখের আগুন থেকে রেহাই দাও।” — (আল মুমিন: ৭)
শহীদনের জন্যে আল্লাহ তাআলা শাশ্বত জীবনের ওয়াদা করেছেন —
——————————————————————————————-
“যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে মৃত বলোনা বরং তারা জীবিত এবং তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে রিয্ক দেয়া হয়। আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করে তাদেরকে যাকিছু দিয়েছেন, তা পেয়ে তারা খুবই প্রীত ও সন্তুষ্ট। এ বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত যে, ঈমানদারদের মধ্যে যারা এখনো দুনিয়ায় রয়েছেন এবং এখনো পরপারে পৌছাননি, তাদের জন্যেও কোনো ভয় বা দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আল্লাহর দেয়া পুরস্কার ও অনুগ্রহ লাভ করে তারা পরিতৃপ্ত এবং তারা বুঝতে পেরেছে যে, আল্লাহ মুমিনদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না।” — (সূরা আলে ইমরান: ১৬৯-১৭১)
অনুরূপভাবেই মিথ্যা প্রতিপন্নকারী, যালিম ও অপরাধীদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার সতর্কবাণী রয়েছে। তিনি বলেন যে, পার্থিব জীবনে কিছুকাল তাদের রশি ঢিলা করে দিয়ে কিছুটা সুযোগ দান করেন এবং আখেরাতে তাদের বিচার হবে। অবশ্য কোনো কোনো সময় আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতেও পাকড়াও করে থাকেন। তবু প্রকৃত শাস্তির জন্যে আখরাতেই নিদিষ্ট।
——————————————————————————————–
“দেশের ভিতরে আল্লাহদ্রোহীদের তৎপরতা দেখে তোমরা যেন প্রতারিত না হও। এসব তো স্বল্পকালীন জীবনের অস্থায়ী সম্পদ মাত্র। পরিণামে তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম এবং সেটা অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্থান।”
——————————————————————————————-
“যালিমরা যা কিছু করছে, সে সম্পর্কে আল্লাহ তাআলাকে গাফির মনে করো না। আল্লাহ তাদেরকে সময় দান করছেন এমন এক দিনের জন্যে যেদিন তাদের চোখ বিস্ফারিত হয়ে যাবে এবং তারা মাথা সোজা করে দৌড়াতে থাকবে। সেদিন তাদের দৃষ্টি থাকবে উপরের দিকে আর প্রাণপাখী উড়ে যাবার জন্যে ছটফট করবে।” — ইবরাহীম: ৪২-৪৩
——————————————————————————————–
“তাদেরকে বাজে কথাবার্তা ও খেলা-ধুলায় মত্ত থাকতে দাও, যে পর্যন্ত না ওয়াদাকৃত দিন এসে যায়। সে দিন তারা কবর থেকে বের হয়ে আসবে এবং দৌড়াতে শুরু করবে যেন কোন গন্তব্য স্থালের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের দৃষ্টি হবে অবনত এবং মুখমণ্ডলে লাঞ্ছনা ও অপমানের চিহ্ণ ফুটে উঠবে। এটিই তো ওয়াদাকৃত দিন।।”
— আল মাআরিজ: ৪২-৪৪
এভাবেই মানব জীবন ফেরেশতাদের জীবনের সাথে এবং দুনিয়ার জীবন আখেরাতের সাথে সম্পর্কযুক্ত। হক ও বাতিল, ভাল ও মন্দ এবং ঈমান ও আল্লাহদ্রোহিতার লড়াই দুনিয়ার অস্থায়ী মঞ্চেই সমাপ্ত হয়ে যায় না এবং তার ফলাফলএ এখানে প্রকাশ পায় না। পার্থিব জীবনের আরাম-আয়েশ ও দুঃখ-কষ্ট, ভোগ ও বঞ্চনা আল্লাহর মানদণ্ডে সিদ্ধান্তকরী বিষয় নয়। এ দিক দিয়ে ভাল ও মন্দের শক্তি পরীক্ষার ময়দান বহুদুর বিস্তৃত এবং দীর্ঘস্থায়ী। আর সফলতা ও ব্যর্থতার মাপকাঠি এবং এদের পরিধি অনেক সম্প্রসারিত। এ আকাংখা অনেক উচ্চে। তাই এ পৃথিবী এবং তার সাজ-সরঞ্জাম, এ জীবন ও তার প্রয়োজনীয় দ্রব্য –সামগ্রী মু’মিনের নিকট তু্চ্ছ বিবেচিত হয়। তার দৃষ্টি ও মতামত প্রসারের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে তার জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য উচ্চ থেকে উচ্চতর হতে থাকে। এ ধরনের উদার ও মহান হৃদয় এবং খাঁটি ঈমান সৃষ্টির জন্যে গর্ত খননকারীদের কাহিনী খুবই সহায়ক।
গর্ত খননকারীদের কাহিনী ও সূরায়ে বুরুজের আলোচনা থেকে দাওয়াতে দ্বীনের প্রকৃতি ও এ পথের সম্ভব্য প্রতিক্রিয়ার মুখে আহবায়কদের ভূমিকা সম্পর্কে অপর একটি দিকেও আলোকপাত করা হয়েছে। দাওয়াতে দ্বীনের আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যান্য আন্দোলনের বিরুদ্ধে পরিচালিত সংগ্রমাম পরিসমাপ্তি ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রত্যক্ষ করেছে।
এ আন্দোলন হযরত নূহ (আ), হযরত হুদ (আ), হযরত শুয়াইব (আ) এবং হযরত লূত (আ) –এর নিজ নিজ জাতির ধ্বংস এবং অল্প সংখ্যক ঈমানদারদের রক্ষা প্রাপ্তির দৃশ্য দেখতে পেয়েছে। কিন্তু যারা ধ্বংস থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন তারা পরবর্তীকালে কি ভূমিকা পালন করেছেন, তা কুরআন আমাদেরকে বলেনি। এসব দৃষ্টান্ত থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহদ্রোহীদের বাড়াবাড়ির প্রতিকারার্থে আল্লাহ তাআলা কোন কোন সময় দুনিয়ার জীবনেই তাদেরকে আংশিক আযাবের স্বাদ গ্রহণ করিয়ে দেন। পরিপূর্ণ বিচার শেষে যথোপযুক্ত আযাব তো আখেরাতেই দেয়া হবে।
ইসলামী দাওয়াতের আন্দোলন, সৈন্য-সামন্ত সহকারে ফিরাউনের ধ্বংস, অনুচরসহ হযরত মুসা (আ) –এর উদ্ধার প্রাপ্তি এবং পরবর্তীকালে তাঁর রাজ্য লাভ প্রত্যক্ষ করেছে। সে যুগের ইতিহাসে বনী ইসরাঈলরা ছিল উত্তম চরিত্রের অধিকারী। যদিও তাঁরা কখনো পরিপূর্ণ দৃঢ়তা দেখাতে পারেননি এবং দুনিয়াতে আল্লাহর দ্বীনকে তাঁরা পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবে কখনো কায়েম করেননি, তবু পূর্ববর্তীদের তুলনায় তাঁদের দৃষ্টান্ত ছিল ভিন্ন ধরনের। যারা নবী মুহাম্মাদ (সা) –এর প্রতি ঈমান আনয়ন করেনি এবং তাঁর আনীত জীবন বিধান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, ইতিহাস সেসব মুশরিকদের লাশের স্তুপও দেখতে পেয়েছে। ইতিহাস আরও দেখতে পেয়েছে কিভাবে ঈমানদারদের অন্তরে পরিপূণরূপে ঈমানের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর আল্লাহর সাহায্য এসে তাদের গলায় সাফল্যের মালা পরিয়ে দিয়েছিল। আর দুনিয়া সর্বপ্রথম মানব জীবনের উপর পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর ব্যবস্থা বাস্তবায়নের নমুনা দেখতে পেল। এ সময়ের আগে বা পরে কখনও এরূপ দেখা যায়নি।
ইতিহাস গর্ত খননকারীদের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে। তাও আমরা দেখেছি। এ ছাড়াও ইতিহাস অনেক প্রাচীন ও নতুন ঘটনা ঘটতে দেখেছে। অবশ্য এগুলো ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেনি। আর আজকালও ইতিহাস অসংখ্য ঘটনা দেখতে পাচ্ছে, যেগুলো ইসলামী ইতিহাসের শত শত বছরের প্রাচীন ঘটনাবলীর সাথে কোন না কোন দিক থেকে সাদৃশ্যপূর্ণ।
অন্যান্য ঘটনাবলীর পর্যালোচনা করা অবশ্যই জরুরী। তবে গর্ত খননকারীদের ঘটনাটি বিশেষভাবে উল্লেখ্য। কারণ এ ঘটনায় ঈমানের অগ্নি পরীক্ষার এক উজ্জল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।এ পরীক্ষায় হকপন্থীদের পক্ষে কোন পার্থিব সাহায্য এগিয়ে আসেনি এবং বাতিলপন্থীদেরও পার্থিব জীবনে কোন শাস্তি দেয়া হয়নি। ঈমানদার ও আল্লাহর পথে আহবানকারীদের মনে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল করার জন্য তাদের বাঞ্ছিত পথে এগিয়ে যাবার ফলে এরূপ ঘটনার পূনারাবৃত্তি হতে পারে। এ জাতিয় ঘটনায় তাদের পক্ষে কোনই শক্তি এগিয়ে আসবে না। তাদের এবং তাদের ঈমানের বিষয়াবলী সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। এ অবস্থায় ঈমানদারদের দায়িত্ব হচ্ছে কর্তব্য কাজে অটল থেকে দুনিয়া হতে বিদায় গ্রহণ করা। তাদের কর্তব্য হচ্ছে একমাত্র আল্লাহকেই পরম ও চরম কাম্য হিসেবে গ্রহণ করা,আকীদা-বিশ্বাসকে জীবনের চেয়েও অধিক মূল্যবান মনে করা এবং অগ্নি পরীক্ষায় নিক্ষিপ্ত হলে ঈমানী শক্তিকে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। ঈমানদারগণ এরূপ অবস্থায় অন্তর, মুখ ও আমলের দ্বারা আল্লাহর দ্বীনের সত্যতার সাক্ষ্যদান করবে। আর দ্বীনের দুশমনদের পরিণাম কিরূপ হবে এবং দাওয়াতে দ্বীনের কাজ কিভাবে অগ্রসর হবে, এসব বিষয় আল্লাহ তাআলার উপর ছেড়ে দেয়াই উত্তম। ইসলামের অতীত ইতিহাসে যেসব পরিণামের নযীর রয়েছে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সে ধরনের পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারেন অথবা দ্বীনে হকের পতাকাবাহী ও বাতিলপন্থীদের জন্যে কোন নতুন পরিণামও বির্ধারণ করতে পারেন।
হকপন্থীগণ আল্লাহর দ্বীনের কর্মী। আল্লাহ তাদেরকে দিয়ে যে ধরনের জাক করাতে চান; যখন যে স্থানে ও যে পদ্ধতিতে কাজ করিয়ে নেন, ঠিক সেভাবেই কর্তব্য সম্পন্ন করে নিদিষ্ট পুরস্কার গ্রহণই মু’মিনদের দায়িত্ব। ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যত তাদের নিজেদের হাতে নেই এবং এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতাও তাদের নেই। এটা একমাত্র প্রকৃত মালিক যিনি, তাঁরই কাজ। কর্মীদের এ বিষয়ে মাথা ঘামানোর কোনই প্রয়োজন নেই।
ঈমানদারগণ তাদের কৃতকর্মের পুরস্কারের প্রথম কিস্তি তো দুনিয়াতেই হাসিল করেন। আর এ পুরস্কার হচ্ছে অন্তরের প্রশান্তি, চিন্তা ও উপলব্ধির উচ্চমান, উৎকৃষ্ট ধ্যান-ধারণা, পার্থিব লোভ-লালসা, ভয় –ভীতি ও দুঃখ –কষ্টের অনুভুতি থেকে মুক্তি লাভ। দ্বিতীয় কিস্তিও তাঁরা এ পৃথিবী থেকেই আদায় করে নেন। সে পুরস্কার হচ্ছে, ফেরেশতা মহলে তাঁদের সম্মান বৃদ্ধি ও তাঁদের সম্পর্কে আলোচনা। পৃথিবীর গুণগ্রাহী লোকেরা তো তাদের প্রশংসা করেই থাকে। ফেরেশতা মহলে আলোচনা-উর্ধজগতে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধিরই পরিচায়ক। পুরস্কারের সবচেয়ে বড় কিস্তিটি আখেরাতেই দেয়া হবে। সেখানে তাঁদের সহজ ও মামুলী ধরনের হিসেব-নিকেশ হবে এবং তাঁরা অপরিমিত লাভ করবেন। আর এসব কিস্তির মাধ্যমে দেয় সকল পুরস্কারের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার হচ্ছে সকল কিস্তিতেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। তাঁর অশেষ মেহেরবাণীতে তিনি মু’মিনদেরকে তাঁর কাজের জন্যে বাছাই করে নিয়েছেন এবং দুনিয়ায় আল্লাহর সৈনিক হিসেবে তাঁরই ইচ্ছানুসারে সকল কাজে ব্যবহার করার জন্য তাঁদেরকে মনোনীত করেছেন। এটাও পরম সৌভাগ্যের বিষয়।
কুরআন প্রদত্ত শিক্ষার ফলে ইসলামী আন্দোলনের প্রথম মহান কাফেলাটির মধ্যে উল্লেখিত ধরনের চরিত্র উচ্চতর মান অর্জন করেছিল। তাঁরা আল্লাহর সৈনিক হিসেবে কাজ করার প্রেরণায় নিজেদের সত্তা ও ব্যক্তিত্ব ভুলে গিয়েছিলেন এবং সকল অবস্থায় ও সকল সময়ই তাঁরা আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট ছিলেন।
কুরআনের পাশাপাশি নবী করিম (সা) –এর প্রশিক্ষণের ফলে জান্নাতের দিকে তাঁদের দৃষ্টি নিবন্ধ হয় এবং আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে কোন মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত অটল দৃঢ়তার সাথে নিজেদের দায়িত্ব পালন করার মনোভাবও গড়ে উঠে। আল্লাহর মীমাংসাই দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের জন্যে তাঁদের নিকট পরম ও চরম কাম্য ছিল। হযরত আম্মার (রা) ও তাঁর মাতা-পিতাকে যখন মক্কার যালিমরা চরম দৈহিক নির্যাতনের শিকারে পরিণত করেছিল তখন নবী (সা) স্বচক্ষে তাদের অবস্থা দেখেন এবং মাত্র এ কথা কয়টি উচ্চারণ করেন:
———————————————-
“ইয়াসিরের লোকজন, তোমরা ধৈর্য ধারণ কর, তোমাদের জন্যে জান্নাতের ওয়াদা পাকপোক্ত হয়ে গেছে।”
খাত্তাব বিন আরাত (রা) বলেন, “আমরা নবী (সা) –এর খেদমতে অভিযোগ করেছিলাম, তিনি তখন কাবা ঘরের দেয়ালের ছায়ায় বিশ্রাম করছিলেন। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কেন আল্লাহর দরবারে সাহায্যের আবেদন করছেন না? কেনই বা আমাদের জন্যে দোয়া করছেন না? তিনি জবাবে বলেন, তোমাদের পূর্ববর্তীদের সময় মানুষকে ধরে জীবন্ত প্রোথিত করা হতো। এ ছাড়াও করাত দিয়ে তাদেরকে জীবন্ত চিরে ফেলা হতো। কিন্তু তবু তাদেরকে দ্বীনে হক থেকে ফিরানো সম্ভব হয়নি। আল্লাহর কসম! তিনি তাঁর দ্বীনকে পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত করবেন। এমন সময় আসবে, যখন একজন আরোহী সানয়া থেকে হাযরামাওত পর্যন্ত একাকী ভ্রমণ করবে এবং পথিমধ্যে তাকে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করতে হবে না। আর তার মেষ পালের উপর নেকড়ে বাঘের সম্ভাব্য আক্রমণ ছাড়া অন্য কোন বিপদের আশাংকা থাকবে না। কিন্তু তোমরা খুবই অধৈয্য হয়ে পড়বে।”
আল্লাহ প্রতিটি কাজেই কল্যাণকর উদ্দেশ্য লুকিয়ে থাকে। তিনি সমগ্র সৃষ্টি জগত পরিচালনা করেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গোটা সৃষ্টির খবরা –খবর সম্পর্কে তিনি সর্বদা অবহিত থাকেন। দুনিয়াতে যা কিছু ঘটে তাঁরই ব্যবস্থাপনায় তা ঘটে। অদৃশ্য জগতে যে কল্যাণকারিতা লুকিয়ে আছে তা শুধু তিনিই অবগত আছেন। লুকানো কল্যাণ আল্লাহ তাআলার ইচ্ছাধীনেই ইতিহাস রচনা করে এবং তাঁরই মরযী মাফিক ঘটনাবলীর রহস্য এক সময় প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
কোন কোন সময় কয়েক শতাব্দী পর অতীত ঘটনাবলীর অর্ন্তনিহিত রহস্য উদঘাটিত হয়। অথচ ঘটনাবলীর সমাকালীন যুগের মানুষ সে সবের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারেনি। তারা তাদের যুগে কেবলই প্রশ্ন করেছে, ‘এসব কি? হে পরওয়ারদিগার! এসব কি ঘটছে এবং কেন ঘটছে? ইত্যাদি। এ ধরনের প্রশ্ন অজ্ঞতারই পরিচায়ক। তাই মু’মিন এসব প্রশ্নও উত্থাপন করে না। কারণ তারা ভালভাবেই বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তাআলার সকল কাজেই হিকমত এ কল্যাণ নিহিত আছে। মু’মিনের ধ্যান-ধারণার ব্যাপকতা, স্থান, কাল ও পাত্রের মূল্যবোধ ও দূরদৃষ্টি তাকে এ ধরনের চিন্তা থেকে দূরে রাখে। সে পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তি ও আনুগত্যের মনোভাব নিয়ে আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত পথে দ্বীনি কাফেলার সাতে অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলে।
কুরআন পৃথিবীতে আল্লাহর খিলাফতের দায়িত্ব বহন করার যোগ্য অন্তর তৈরী করছিল। এ জন্য এমন অন্তরের প্রয়োজন, যেগুলো হবে বলিষ্ঠ, পবিত্র এবং নিষ্ঠাবান। দ্বীনের পথে অগ্রসর হতে গিয়ে এসব অন্তর সবকিছু কুরবানী দিতে প্রস্তুত। সাহসিকতার সাথে প্রতিটি পরীক্ষার সম্মখীন হতে উৎসাহী। অপরদিকে পার্থিব ধন-সম্পদের পরিবর্তে আখেরাতের সুখ-সমৃদ্ধির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধকারী এবং শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভেই সে হৃদয়ের পরম কাম্য। অর্থাৎ এমন অন্তর তৈরী হবে যে, আমরণ দারিদ্র, দুঃখ কষ্ট ও দৈহিক নির্যাতনের মুকাবিলায় ত্যাগ ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করবে। এবং অতি দ্রুত সুফল প্রাপ্তির কোন আশা করবে না। এমন কি দাওয়াতে দ্বীনের প্রসার, ইসলামের বিজয়, মুসলমানদের ক্ষমতা ও প্রাধান্য লাভ অথবা পূর্ববর্তী কালে আল্লাহ তাআলা দ্বীনের দুশমনদের যেভাবে পাকড়াও ও ধ্বংস করেছেন ঠিক সেভাবে সমসাময়িক যালিম এবং আল্লাহদ্রোহী দলের ধ্বংস ও পরাজয় ত্বরান্বিত করার জন্যেও উৎকণ্ঠিত হবে না।
যখন উল্লেখিত ধরনের অন্তর তৈরী হয়ে যায় এবং তা পার্থিব জীবনে প্রতিদানর আশা ব্যতীতই দ্বীনের দায়িত্ব পালন করে যেতে থাকে, আখেরাতকেই হক ও বাতিলের প্রকৃত মীমাংসার ক্ষেত্র বিবেচনা করে আর যখন আল্লাহ তাআলা তাদের আন্তরিকতা, দৃঢ়তা, ত্যাগ ও ঐকান্তিকতায় সন্তুষ্ট হন তখন তিনি দুনিয়াতেই তাদের সাহায্য করেন। পৃথিবীতে খেলাফল পরিচালনার পবিত্র আমানত তাদের হাতে সোপর্দ করেন। মু’মিনদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে নয় বরং দ্বীনে হকের স্বার্থেই তাদেরকে এ আমানত অর্পন করা হয়।
এ মহান দায়িত্ব বহনের যোগ্যতা ও অধিকার তারা সে দিনই অর্জন করেছে, যেদিন দুনিয়ায় সম্ভ্রাব্য প্রতিদানের কোন প্রতিশ্রুতি ব্যতিরেকেই তারা এ পথে অগ্রসর হয়েছে এবং তাদের দৃষ্টি পার্থিব স্বার্থের পরিবর্তে পরকালীন স্বার্থের দিকে নিবন্ধ হয়েছে। তারা যেদিন আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অপর সকল প্রতিদানের আকাংখা পরিত্যাগ করেছিল, সে দিন থেকেই তারা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ভাজন বান্দাদের মধ্যে শামিল হয়েছে।
পবিত্র কুরআনের যেসব আয়াতে মু’মিনদের প্রতি আল্লাহর সাহায্যের ওয়াদা করা হয়েছে গনীমাতের ধন-সম্পদ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে, দুনিয়াতেই কাফেরদের ধ্বংস করার সতর্কবাণী শুনানো হয়েছে, সেসব আয়াতই মদীনায় নাযিল হয়েছে।
মু’মিনদের অন্তর থেকে পার্থিব স্বার্থের সকল কামনা বিদুরিত হবার পর আল্লাহ তাআলা স্বয়ং অগ্রসর হয়ে তাদেরকে সাহায্য দানের সুসংবাদ প্রদান করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র দ্বীনকে মানব সমাজের জীবন বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যেই ঐরূপ সাহায্য দানের ওয়াদা করেন। মু’মিনদের কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ ও সাহসিকতার পুরস্কার স্বরূপ তাদের প্রতি পার্থিব জীবনে সাহায্য নাযিল হয়নি বরং এটা আল্লাহ তাআলার নিজেরই সিদ্ধান্ত ছিল। আর এ সিদ্ধান্তের অন্তর্নিহিত কল্যাণকারিতা আমরা আজ উললব্ধি করতে পারছি।
দাওয়াতে দ্বীনের কাজে আগ্রহী সকল দেশ, জাতি ও বংশের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এ বিষয়টি সম্পর্কে ভালো করে চিন্তা করা প্রয়োজন। এ সূক্ষ্ম বিষয়টিই দাওয়াতে দ্বীনের সমগ্র পথ ও তার প্রতিটি মনযিল ও মোড় সুস্পষ্ট করে তুলে ধরে এবং যারা পরিণাম ফলের তোয়াক্কা না করেই পথের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পৌছাতে দৃঢ়সংকল্প, তাদের অন্তরে অটল ধৈর্যশক্তি দান করে। তারা মনে করে, আল্লাহ তাআলা দাওয়াতে দ্বীন ও এ পথের আহবায়কদের যে পরিণামই নির্ধারণ করে রেখেছেন, তা যথার্থ। তারা সহকর্মীদের মৃতদেহের উপর দিয়ে — চরম বিপদ সংকুল খনরাঙ্গা পথ ধরে এগিয়ে যাবার সময় আশু বিজয় লাভের আশায় উদগ্রীব হবে না। অবশ্য স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই যদি দাওয়াতে দ্বীনের আন্দোলনকে পূর্ণত্ব প্রদান করে তার দ্বীনকে মু’মিনদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তাহলে সে তো ভালো কথা। অবশ্য যদি এরূপ সিদ্ধান্ত হয় তবে তা নিছক আল্লাহ তাআলারই মরযী বলতে হবে— মু’মিনদের কষ্টসহিষ্ণুতা ও ত্যাগের পুরস্কার স্বরূপ নয়। কারণ, এ পৃথিবী কর্মফল প্রাপ্তির ক্ষেত্র নয়।
গর্ত খননকারীদের কাহিনীর উপর মন্তব্য প্রসংগে কুরআন অপর একটি তথ্যের প্রতিও ইঙ্গিত করেছ। আমাদের প্রত্যেককেই সে বিষয়ে মনোযোগ দেয়া উচিত। কুরআন বল—
————————————————————
“এবং এ ঈমানদার লোকদের সাথে তাদের শত্রুতার একমাত্র কারণ ছিল এই যে, তারা প্রবল পরাক্রান্ত ও সপ্রশংসিত আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করেছে।” — বরুজ:৮
সকল যুগের ও সকল বংশের লোকদেরই গভীর মনোযোগ সহকারে আয়াতে বর্ণিত তথ্য সম্পর্কে চিন্তা করা উচিত। ঈমানদার ও বিরোধী দলের মধ্যে লড়াই অনুষ্ঠিত হয় শুধু মাত্র ঈমান –আকীদা ও চিন্তাধারা পার্থক্যের দরুন। অন্য কোন পার্থিব স্বার্থের কারণে নয়। বিরোধী পক্ষ মু’মিনদের ঈমানকে সহ্য করতে পারে না। তাদের সকল ক্রোধ ও শত্রুতার মূল কারণ হচ্ছে মু’মিনদের আকীদা-বিশ্বাস। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, অর্থনৈতিক স্বার্থ অথবা বংশীয় শ্রেষ্টত্ব অর্জন, এ লড়াইয়ের লক্ষ্য কখনই নয়। এ জাতীয় বিরোধ তো সহজেই মিটানো অথবা নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব। কিন্তু এখানে তো নির্ভেজাল আদর্শের লড়াই চলছে। বিরোধের বিষয়বস্তু হচ্ছে, “কুফরী ব্যবস্থা চলবে, না ঈমান? জাহেলিয়াত থাকবে, না ইসলাম?”
মক্কায় মুশরিকগণ নবী (সা) –এর নিকটে ধন-সম্পদ, শাসন ক্ষমতা ও অপরাপর পার্থিব সুযোগ সুবিধা দানের প্রস্তাব পেশ করেছিল। তাদের শর্ত ছিল মাত্র একটি। আর সেটি হলো, নবী করিম (সা)যেন আকীদা-বিশ্বাসের দ্বন্দ-কলহ বন্ধ করে তার বিনিময়ে তাদের নিকট থেকে অন্য সুযোগ-সুবিধা ও স্বার্থ আদায় করে নেন। নবী (সা) যদি তাদের ইচ্ছা পূরণে সম্মত হতেন, তাহলে তা মুশরিকদের সাথে তাঁর কোন বিবাদই থাকতো না। তাহলে বুঝা গেল যে, ঝগড়ার মূল বিষয়টি সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। কেননা, শত্রু দলের শত্রুতা ও ক্রোধের কারণ হচ্ছে এই যে, মু’মিনগণ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে এবং তারা একমাত্র আল্লাহ তাআলারই আনুগত্য করে — শুধু তাঁরই সামনে মাথা নত করে থাকে।
শত্রুপক্ষ মু’মিনদেরকে লড়াইয়ের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে বিভ্রান্ত করা এবং তাদের অন্তরের প্রজ্জলিত ঈমানের অগ্নিশিখাকে নিভিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে আকীদা-বিশ্বাসের লড়াইকে রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক অথবা গোত্রীয় বিবাদের রূপ দেয়ার অপচেষ্টা চালাতে পারে। তাই মু’মিনদের কখনো প্রতারিত হলে চলবে না। তাদের বুঝতে হবে যে, পরিকল্পিত উপায়ে ষড়যন্ত্র মারফত তাদের পদচ্যুত করার চেষ্টা করে হচ্ছে। এ যুদ্ধে যারা এ জাতীয় ধুঁয়া তোলে, তারা প্রকৃতপক্ষে মু’মিনদেরকে চুড়ান্ত বিজয়ের অমূল্য হাতিয়ার থেকে বঞ্চিত করতে আগ্রহী। এ বিজয় আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্ব, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, গর্তে বিক্ষিপ্ত ঈমানদারদের মত অটল মানোন্নয়ন জনিত পার্থিব লাভের আকৃতিতেও অর্জিত হতে পারে।
আজকের দুনিয়াতে, বিশেষ করে, খৃস্টন ধর্মবলন্বীদের প্রতারণামূলক প্রচার ও ইতিহাস বিকৃতকরণ প্রচেষ্টার মধ্যে আমরা বিভ্রান্তির অপচেষ্টা প্রত্যক্ষ করছি। তারা বলে বেড়াচ্ছে যে, ক্রুশ যুদ্ধের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল সাম্রজ্য লাভ। তাদের এ উক্তি একেবারেই মিথ্যা! সত্যি কথা এই যে, ক্রুশ যুদ্ধের অনেক পরে ক্রুশ পন্থীদল সাম্রাজ্যবাদের মুখোশ ধারণ করে। কারণ, ক্রুশীয় আকীদা-বিশ্বাসের পক্ষে মধ্যযুগে যেরূপ আত্মপ্রকাশ করা সম্ভবপর ছিল ঠিক সেরূপ আজ পুনরায় ময়দানে আসা সম্ভব নয়।
এ জন্যে তাদেরকে নতুন মুখোশ ধারণ করতে হয়েছে। কারণ ক্রুশের আকীদা বংশ-বর্ণ –গত্রো নির্বিশেষে সকল মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে রচিত গলিত ধাতু নির্মিত প্রাচীরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। উল্লেখিত মুসলমানগণের মধ্যে কুর্দ গোত্রের সালাহুদ্দীন, মামলুক গোত্রের তুরান শাহ প্রমুখ ব্যক্তিগণ নিজেদের গোত্রীয় ও বংশীয় পার্থক্য ভুলে গিয়ে শুধু ঈমানী শক্তিকে অবলন্বন হিসেবে গ্রহণ করেন এবং একমাত্র ইসলামের পতাকা হস্তে বিজয় লাভ করেন।
——————————————————
“ঈমানদারদের সাথে তাদের শত্রুতার একমাত্র কারণ হচ্ছে এটা যে, তারা (ঈমানদারেরা) প্রবল পরাক্রান্ত ও সদা প্রশংসিত আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করেছিলেন।” — বরুজ: ৮
আল্লাহ তাআলার বাণী বর্ণে বর্ণে সত্য এবং প্রবঞ্চক, ভোজবাজ ও অত্যাচারী দল মিথ্যাবাদী এ পথভ্রষ্ট।
— সমাপ্ত —-