নবম অধ্যায়
মুসলমানদের জাতীয়তা
ইসলাম যেদিন থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পর্কে নতুন ধ্যান-ধারণা এবং তা অর্জনের উপায়-পন্থা প্রদর্শন করেছে, সে দিন থেকেই সে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্যেও নতুন পদ্ধতি শিখিয়েছে। দুনিয়ায় ইসলাম এসেছেই মানুষের সাথে তার রবের সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য এবং একথা শেখানোর জন্য যে, গ্রহণ ও বর্জনের মানদণ্ড ও সকল বিষয়ের মূল্যায়ণের নীতি একমাত্র আল্লাহ তাআলার নিকট থেকেই গ্রহণ করতে হবে। অনুরূপভাবে ইসলাম একথাও ঘোষণা করেছে যে, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মূলনীতি আল্লাহ তআলাই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আমরা তারই ইচ্ছায় জন্মলাভ করেছি এবং তাঁর সমীপেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। ইসলাম দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছে যে, আল্লাহ তাআলার দৃষ্টিতে একটি মাত্র বন্ধনই মানুষকে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত করে দেয় এবং এ বন্ধন দৃঢ় হলে রক্তের বন্ধন ও অন্যান্য যোগসুত্র নিশ্চিহ্ণ হয়ে যায়।
——————————————————————————————
“যারা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে তাদের তুমি কখনো আল্লাহর শত্রুদের সাথে ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপন করতে দেখবে না। হোক না তরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই এ নিকট আত্মীয়।” — মুজাদালা: ২২
দুনিয়াতে আল্লাহর দল শুধু একটিই। এ একটি ব্যতীত অপর সকল দলই শয়তান এবং তাগুতের দল।
——————————————————————————————-
“যারা ঈমানদার তারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে। আর যারা কাফের তারা সংগ্রাম করে তাগুতের পথে। সুতরাং শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাও। শয়তানের সকল চক্রান্তই দুর্বল।” — আন নিসা: ৭৬
আল্লাহর দরবারে পৌছার পথ মাত্র একটি। আর এ একটি ছাড়া অপর সকল পথই আল্লাহ থেকে দুরে নিয়ে যায়।
——————————————————————————————-
“এটাই আমার সহজ সরল পথ সুতরাং এ পথ ধরেই চল। অন্য পথ যাবে না। তাহলে তোমরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।” — আল আনআম: ১৫৩
মানুষের জন্য একটি মাত্র জীবন বিধান রয়েছে। আর সেটি হচ্ছে ইসলাম। ইসলাম ব্যতীত যত জীবন বিধান রয়েছে সবগুলোই জাহেলিয়াত।
——————————————————————————————-
“তারা কি তবে জাহেলিয়াতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চায়? প্রকৃতপক্ষে যারা আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপনকারী তাদের জন্য আল্লাহর সিদ্ধান্তের চেয়ে উত্তম অন্য কোন সিদ্ধান্তই নেই।” — আল মায়েদা: ৫০
একটি মাত্র শরীয়াতই মেনে চলার যোগ্য এবং তা হচ্ছে ইসলামী শরীয়াত। আল্লাহ প্রদত্ত এক শরীয়াত ছাড়া আর যত শরীয়াত আছে সবগুলোই নফসের খাহেস থেকে প্রণীত।
——————————————————————————————-
“(হে নবী!) আমি অতপর তোমাকে একটি স্পষ্ট শরীয়াতের উপর কায়েম করেছি তুমি আমার প্রণীত এ শরীয়াত মেনে চল এবং অজ্ঞ লোকদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না।” — জাসিয়া: ১৮
দুনিয়ার একটি মাত্র সত্য পথ রয়েছে এবং তা অবিভাজ্য। আর এ সত্য পথ ছাড়া সকল পথই বিভ্রান্তি বা গুমরাহীর পথ।
——————————————————————————————-
“সত্যের বহির্ভূত গুমরাহী ছাড়া আর কি হতে পারে? তোমরা পথহারা হয়ে কোথায় ঘুরাফেরা করছ?” —
দুনিয়ার মধ্যে একটি মাত্র ভূখণ্ডই দারুল ইসলাম নামে পরিচিত হবার যোগ্য এবং সেটি হচ্ছে এমন একটি ইসলামী রাষ্ট্র যেখানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত, আল্লাহর শরীয়াত প্রতিপালিত এবং মুসলমানদের পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সকল সমষ্টিগত বিষয় পরিচালিত হয়। এ রাষ্ট্র ব্যতীত সকল ভূখণ্ডই দারুল হারব (কুফরী রাষ্ট্র)। মুসলমান দারুল হারবের সাথে দু’ধরনের সম্পর্ক রক্ষা করতে পারে। যুদ্ধ অথবা সুনিদিষ্ট শতাধীনে নিদিষ্ট সময়ের জন্যে কৃত শান্তিচুক্তি। এরূপ চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্র কখনো দারুল ইসলামের পর্যায়ভুক্ত হবে না।
——————————————————————————————
“যারা ঈমান আনয়ন করেছে, হিজরাত করেছে, আল্লাহর পথে ধন-প্রাণ দিয়ে লড়াই করেছে, যারা হিজরাতকারীদের আশ্রয় দিয়েছে এবং তাদের সাহায্য করেছে তারা সকলেই পরস্পরের পৃষ্টপোষক। আর ঈমান আনয়ন করেছে অথচ হিজরাত করে (দারুল ইসলামে) আসেনি তাদের সাথে তোমাদের বন্ধুত্বের কোন কারণ নেই যতক্ষণ না তারা হিজরাত করে আসে। তবে যদি দ্বীনি বিষয়ে তারা তোমাদের সাহায্য প্রার্থী হয় তাহলে তাদের সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য। আবার যেসব জাতির সাথে তোমাদের শান্তিচুক্তি হয়ে গেছে তাদের বিরুদ্ধ কোন সাহায্য করা যাবে না। তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ তাআলা দেখতে পান। যদি পরস্পরের সহায়তা না কর, তাহলে দুনিয়াতে ফিতনা ও বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়বে। আর যারা ঈমান আনয়ন করেছে, আল্লাহর পথে হিজরাত ও জিহাদ করেছে, আর যারা তাদের আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে তারা সকলেই খাঁটি মু’মিন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও উত্তম রিযক। আর যারা পরবর্তীকালে ঈমান আনয়ন করেছে এবং হিজরাত করে এসে তোমাদের সাথে জিহাদেও অংশ নিয়েছে, তারা তোমাদেরই দলভুক্ত।” — আনফাল: ৭২-৭৫
ইসলাম উপরোক্ত ধরনের পূর্ণ হেদায়াত ও সিদ্ধান্তকারী নির্দেশাবলী নিয়ে দুনিয়ায় এসেছে। মানুষকে ধুলাবালি ও রক্তমাংসের বন্ধন থেকে মুক্ত করে উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করেছে। যে ভূখণ্ডে আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়াত বাস্তবায়িত হয়েছে এবং যে দেশের বাসিন্দাদের পারস্পরিক সম্পর্কের মানদণ্ডের ভিত্তি আল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্কের মানদণ্ডে যাচাই করা হয়ে থাকে, সে দেশই মুসলামানদের স্বদেশ। মুসলমানদের ঈমান ও ঈমানের বন্ধন ব্যতীত অন্য কোন জাতীয়তা নেই। এ ঈমানের বলেই তারা দারুল ইসলামের সদস্য হতে পারে — অন্য কোন যোগ্যতার বিচারে নয়। মুসলমানদের ঈমান ও আকীদার বন্ধন ব্যতীত অন্য কোন আত্মীয়তা বা নৈকট্য নেই। ঈমান-আকীদার ভিত্তিতে গ্রথিত ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর ও দৃঢ় হয়ে গড়ে উঠে। মা, বাপ, ভাই স্ত্রী ও অন্যান্য আত্মীয়গণ আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন ব্যতীত মুসলমানদের স্বজন হিসেবে পরিগণিত হতে পারে না।
——————————————————————————————-
“হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর — যিনি তোমাদেরকে একটি মানুষ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং এ একজন থেকেই তার জোড়া এবং জোড়া থেকে অসংখ্য পুরুষ ও নারী সৃষ্টি করেছেন। যে আল্লাহর দোহাই দিয়ে তোমরা পরস্পরের অধিকার দাবী কর, তাঁকে ভয় কর এবং আত্মীয়-স্বজনের অধিকার সম্পর্কে সতর্ক থাক।” — আন নিসা: ১
উল্লেখ্য যে, আল্লাহর সম্পর্ক মানুষকে ভিন্ন মতাবলন্বী মাতা-পিতার সাথে সদয় ব্যবহার ও সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা করতে নিষেধ করে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা ইমলামী আন্দোলনের শত্রু পক্ষের প্রথম সারিতে স্থান গ্রহণ করে। যদি তারা প্রকাশ্য কুফরী শক্তির পক্ষাবলন্বন করে; তাহলে মুসলমানদের ঐ মাতা-পিতার সাথে আত্মীয়তা ও সহৃদয়তা বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। মুসলমান ইসলামের শত্রুতাকারী মাতা-পিতার সাথে সদয় ব্যবহার করতে বাধ্য নয়। মদীনায় মুনাফিকদে নেতা আবদল্লাহ বিন উবাইর পুত্র হযরত আবদুল্লাহ (রা) আমাদের জন্য অতি উজ্জল নমুনা স্থাপন করে গেছেন।
ইবনে জিয়াদের উদ্ধতি দিয়ে ইবনে জারীর বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর নবী আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর পুত্র হযরত আবদুল্লাহ (রা) –কে ডেকে বলেন— “তুমি কি জান, তোমার পিতা কি কি চলেছে?”
হযরত আবদুল্লাহ বললেন, “আমার পিতা –মাতা আপনার জন্য কুরআন হোক — তিনি কি কি বলেছেন?”
হুজুর (সা) বললেন, “সে বলে, মদীনা ফিরে যাবার পর সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা লাঞ্ছিত ব্যক্তিদেরকে তাড়িয়ে দেবে।”
হযরত আবদুল্লাহ (রা) বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল (স)! আল্লাহর কসম, তিনি যথার্থ কথাই বলেছেন। আল্লাহ সাক্ষী! আপনিই সম্ভ্রন্ত। মদীনাবাসী অবগত আছে যে, আপনি এ শহরে আগমন করার আগে আমি আমার পিতার অত্যন্ত অনুগত ছিলাম। আমরা চেয়ে বেশী অনুগত কেই ছিল না। কিন্তু আজ আমি স্বহস্তে আমার পিতার শিরচ্ছেদ করলে যদি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল (সা) সন্তুষ্ট হন, তাহলে আমি এক্ষুণি তা করতে রাজি আছি।” রাসূল (সা) বলেন, “না, এরূপ করো না।”
মুসলিম সেনাবাহিণী মদীনায় প্রবেশ করার সময় আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর পুত্র হযরত আবদুল্লাহ (রা) উন্মক্ত তরবারি নিয়ে পিতার গতিরোধ করে দাঁড়ালেন এবং বললেন, “তুমি কি বলেছিলে যে, এবার মদীনায় ফিরে যাবার পর সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ লাঞ্ছিতদেরকে তাড়িয়ে দেবে? আল্লাহর কসম! তুমি এক্ষুণি বুঝতে পারবে, তুমি সম্ভ্রান্ত না আল্লাহর রাসূল (স) সকল মানুষের চেয়ে অধিক সম্মানিত। আল্লাহর শপথ করে বলছি — আল্লাহর রাসূল (স) অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত তুমি মদীনায় প্রবেশ করতে পারবে না। আর আমার হাত থেকেও তোমরা রেহাই নেই?”
আবদুল্লাহ ইবনে উবাই দু’বার চীৎকার করে বললো, “হে খাজরায় গোত্রের লোকেরা! দেখ আমার পুত্রই আমাকে নিজের বাড়ীতে ফিরে যেতে দিচ্ছে না।” তার চীৎকার সত্ত্বেও হযরত আবদুল্লাহ (রা) বার বার বলতে থাকেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সা) অনুমতি না দেবেন, ততক্ষণ তোমাকে কিছুতেই মদীনায় প্রবেশ করতে দেবো না — আল্লাহর কসম!” কিছু সংখ্যক লোক হযরত আবদুল্লাহকে নিরস্ত করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু হযরত আবদুল্লাহ (রা) একই কথার পুনারাবৃত্তি করতে থাকেন। অবশেষে কিছু সংখ্যক লোক নবী (স)—কে এ বিষয়ে খবর দেন এবং সব কথা শুনে তিনি সংবাদ বাহকদেরকে বলেন, “যাও আবদুল্লাহকে গিয়ে বল, তার পিতাকে যেন ঘরে ফিরে যেতে বাধা না দেয়।” এ খবর আবদুল্লাহর নিকট পৌছে দেয়ার পর তিনি বলেন, “হাঁ যদি আল্লাহর নবী অনুমতি দিয়ে থাকেন তাহলে সে মদীনায় প্রবেশ করতে পারে।”
ঈমানের সন্বন্ধ স্থাপিত হবার পর রক্তের সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও মানুষ পরস্পরের সাথে গভীর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায় এবং এ সম্পর্ক এতদুর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে যে, সকল মুসলমান নিজেদেরকে একই দেহের বিভিন্ন অঙ্গ- প্রত্যঙ্গের সমতুল্য বিবেচনা করে। আল্লাহ তাআলা বলেন —
———————————————-
“সকল মু’মিন পরস্পরের ভা।” — হুজুরাত: ১০
একথা সংক্ষিপ্ত হলেও সম্পর্ক নির্ণয়ের এক স্থায়ী মানদণ্ড দান করেছে। তিনি আরও বলেন—
——————————————————————————————-
“যারা ঈমান আনয়ন করেছে, আল্লাহর পথে বাড়ী-ঘর পরিত্যাগ করেছে এবং জান-মাল দিয়ে জিহাদ করেছে, আর যারা তাদের আশ্রয় ও সাহায্য দান করেছে, তারা পরস্পরের পৃষ্ঠপোষক।” — আনফাল: ৭২
উপরের আয়াতে যে পারস্পরিক পৃষ্ঠপোষকতার উল্লেখ করা হয়েছে তা শুধু সমসায়িক নর-নারী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয় বরং এ সম্পর্কে পরবর্তী বংশধরদের মধ্যেও বহাল থাকা হাঞ্ছনীয়। মোটকথা, মুসলমান উম্মাতের অগ্রবর্তীগণ পরবর্তীদের এবং পরবর্তীদের জন্য মনে মনে ভালবাসা ও আন্তরিক প্রীতির ভাব পোষণ করে।
——————————————————————————————-
“মুহাজিরদের আগমনের আগে থেকেই যারা মদীনার বাসিন্দা ছিল এবং ঈমান আনয়ন করেছিল (অথাৎ আনসার) তারা হিজরাতকারীদেরকে ভালোবাসতেন এবং মুহাজিরদের মধ্যে গনীমতের মাল বন্টন করা হলে তারা নিজেদের মনে এ সম্পদ প্রাপ্তির কোন আকাংখা পোষণ করতো না বরং নিজেরা আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও মুহাজির ভাইদেরকে প্রাধান দান করতো। আরা যারা নিজেদের অন্তরকে কৃপণতা থেকে মুক্ত রেখেছে তারা কল্যাণ লাভ করার অধিকারী। যারা পরবর্তীকালে আসবে তারা বলবে, পরওয়ারদিগার। আমাদের এবং আমাদের আগে যারা ঈমান আনয়ন করেছিল তাদের অপরাধগুলো মাফ করে দাও। আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের প্রতি কোন মন্দ ধারণা জন্মাতে দিও না। হে প্রতিপালক!তুমি অবশ্যই দয়ালু মেহেবান।” — হাশর: ৯-১০
ঈমানই ঐক্যের ভিত্তি
আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র গ্রন্থে মহান পয়গান্বরদের দ্বারা গঠিত পবিত্র দলগুলোর কাহিনী বর্ণনা করে মু’মিনদের জন্যে কতিপয় উদাহারণ তুলে ধরেছেন। এসব আন্বিয়ায়ে কেরাম বিভিন্ন যুগে আগমন করেন এবং নিজ নিজ সময়ে ইসলামী কাফেলার নেতৃত্ব দান করেন। বর্ণিত উদাহারণগুলোতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন যে, প্রত্যেক নবীই ঈমান ও আকীদার সম্পর্ককেই একমাত্র সম্পর্ক বিবেচনা করতেন এবং এ সম্পর্ক পরিত্যাগ করে অন্য কোন ধরনের সম্পর্কই কল্যাণকর ও মঙ্গলজনক হতে পারে না।
——————————————————————————————-
“এবং নূহ তাঁর বরকে বললেন, পরওয়ারদিগার! আমার পুত্র অবশ্যই আমার পরিবারভুক্ত, আর আপনার ওয়াদা সত্য এবং আপনি মহাজ্ঞানী। প্রত্যুত্তরে আল্লাহ বললেন, নূহ, সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়, কারণ তার কার্যকলাপ সৎলোকদের মতো নয়। আর তুমি যে বিষয়ের তাৎপর্য অবগত নও সে বিষয়ে আমার নিকট কোন আবেদন করো না। নূহ বললেন, পরওয়ারদিগার! যে বিষয়ে আমার জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে আবেদন পেশ করা থেকে আপনার দরবারে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। যদি আপনি আমাকে ক্ষমা না করেন এবং আমার প্রতি সদয় না হন তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হবো।”হূদ:৪৫-৪৭
——————————————————————————————-
“স্মরণ কর, যখন ইবরাহীমকে তাঁর রব কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করেন তখন তিনি সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আল্লাহ বলেন, আমি তোমাকে মানবজাতির জন্যে ইমাম নিযুক্ত করছি। তিনি প্রশ্ন করলেন, আর আমার বংশধরদের মধ্য থেকে? উত্তর দেয়া হলো, যালিমদের প্রতি আমার কোন ওয়াদা বর্তায় না।” — আলা বাকারা: ১২৪
——————————————————————————————-
“আর যখন ইবরাহীম দোয়া করলেন, হে প্রভু! এ শহরকে শান্তির শহরে পরিণত কর আরন এ শহরের বাসীন্দদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহ ও আখেরাতের উপর ঈমান আনয়ন করে তাদের উত্তম শস্য ও ফলমূল দ্বারা রিযক দান কর। তখন আল্লাহ বললেন, আর যারা অমান্যকারী তাদেরও আমি দুনিয়ায় স্বল্প সংখ্যক দিনের জন্য কিছুটা রিযক দান করবো। তবে পরিণামে এদের দোযখে নিক্ষেপ করবো এবং দোযখ অত্যন্ত মন্দ ঠিকানা।” — আল বাকারা: ১২৬
হযরত ইবরাহীম (আ) তাঁর পিতার ও স্বগোত্রীয়দের গুমরাহীল পথে কায়েম থাকার মনোভাব দেখে তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন এবং বলেন —
——————————————————————————————-
“আমি আপনাদেরকে পরিত্যাগ করছি এবং আল্লাহকে ছেড়ে আপনারা যাদেরকে ডাকেন তাদেরকেও পরিত্যাগ করছি। আমি তো আমার রবকেই ডাকতে থাকবো। আশাক করি আমার রবকে ডেকে বিফল হবো না।” — মরিয়ম: ৪৮
আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম (আ) ও তাঁর স্বগোত্রীয়দের কাহিনী বর্ণনাকালে মু’মিনদের সামনে এ বিষয়গুলো বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন। তা অনুধাবন করা উচিত।
——————————————————————————————-
“তোমাদের জন্যে ইবরাহীম ও তার সাথীদের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। তাঁরা যখন তাদের জাতিকে বললেন — তোমাদের এবং তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে যাদের বন্দগী কর তাদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের ঐসব উপাস্যদের মোটেই মানি না এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ণ না করবে।”
আসহাবে কাহাফ নামে পরিচিত যৌবনোদ্দীপ্ত সাহসী ব্যক্তিগণ যখন দেখতে পেলেন যে, তাঁদের দ্বীন ও ঈমানের অমূল্য সম্পদ নিয়ে নিজেদের দেশ, আত্মীয় –স্বজন, গোত্র ও পরিবারে বাস করার কোন অবকাশ নেই, তখন তাঁরা নিজেদের পরিবার –পরিজন ও স্ববংশীয় লোকদের পরিত্যাগ করলেন। তাঁরা নিজেদের জন্মভূমি থেকে হিজরাত করে ঈমানের সম্পদ নিয়ে নিজেদের পরওয়ারদিগারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন যেন ঈমানের দাবী অনুসারে একমাত্র আল্লাহর বান্দা হয়ে কোথাও বাস করার সুযোগ করে নেয়া যায়।
——————————————————————————————-
“তারা ছিল কয়েকজন যুবক। নিজেদের রবের উপর ঈমান এনেছিল তারা। আর আমি তাদেরকে আরও হেদায়াত দান করিছিলাম। তারা সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলো, আকাশ এ পৃথিবীর সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী যিনি তিনিই আমাদের রব। আমরা তাঁকে ছেড়ে অন্য কোন মাবুদকে ডাকবো না। যদি তা করি তাহলে সেটা হবে খুবই অযৌক্তিক ব্যাপার। (তারা) তারপর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, আমাদের স্বজাতি তো বিশ্ব-জগতের প্রতিপালককে ছেড়ে অন্য ইলাহ গ্রহণ করে বসে আছে। তারা তাদের আকীদা-বিশ্বাসের স্বপক্ষে কোন স্পষ্ট প্রমাণ কেন পেশ করছে না? আল্লাহ সম্পর্কে যারা মিথ্যা উক্তি করে, তাদের চেয়ে বড় যালিম আর কে হতে পারে? এখন চল তাদের এবং তাদের ইলাহদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর আমরা পর্বত গুহায় গিয়ে আশ্রয় নেই। তোমাদের রব তোমাদের প্রতি নিজের রহমাতের হাত প্রসারিত করবেন এবং তোমাদের জন্য প্রয়োজনীয় উপায় –উপকরণও সরবরাহ করবেন?” — আল কাহাফ: ১৩-১৬
হযরত নূহ (আ) ও হযরত লূত (আ) –এর বিবিদের কাহিনীও কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ দু’জন মহান নবীর বিবিগণ ভিন্ন আকীদা পোষণ করতেন এবং শির্কে লিপ্ত ছিলেন। সেজন্য উভয় পয়গান্বরই তাঁদের বিবিদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
——————————————————————————————-
“কাফিরদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য আল্লাহ তাআলার নূহ ও লূতের বিবিগণের উদাহারণ পেশ করেছেন। এ দু’জন নারী আমার দু’নেক বান্দার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। কিন্তু তারা খেয়ানত করেছিল। তাই তাদের স্বামীগণও তাদেরকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষা করতে পারেনি। উভয় নারীকে আদেশ দেয়া হয়, যাও অন্যান্যদের সাথে তোমরাও জাহান্নামে প্রবেশ কর।” — আত তাহরীম: ১০
সাথে সাথে মিসরের অত্যাচারী এ আল্লাহদ্রোহী বাদশা ফিরাউনের বিবির কাহিনীও ঈমানদারদের নমুনা হিসেবে পেশ করা হয়েছে।
——————————————————————————————-
“ঈমানদারদের নসিহত করার জন্যে আল্লাহ তাআলা ফিরাউনের স্ত্রীর বিষয় উল্লেখ করেছেন। তিনি দোয়া করেছিলেন, পরওয়ারদিগার! বেহেশতে তোমার নিকটে আমার জন্যে একখানা ঘর তৈরী কর, আমাকে ফিরাউন ও তার সকল অপকর্মের পরিণাম থেকে মুক্তি দাও এবং যালেমদের অনিষ্টকারিতা থেকেও আমাকে নিরাপদ রাখ।”
— আত তাহরীম: ১১
এভাবেই কুরআন সকর ধরনের আত্মীয়তার উদাহারণ পেশ করেছে। হযরত নূহ (আ) –এর কাহিনীতে পিতৃ সম্পর্কের উদাহরণ রয়েছে। আবার হযরত ইবরাহীম (আ) –এর কাহিনীতে পুত্র ও জন্মভূমির সম্পর্কের উদাহারণ পেশ করা হয়েছে। আসহাবে কাহাফের কাহিনীতে আত্মীয়-স্বজন, গোত্র-বংশ, পরিবার –পরিজন, দেশ ও জন্মভূমির পরিপূর্ণ উদাহারণ এক সাথেই পেশ করা হয়েছে। হযরত নূহ (আ), লূত (আ) ও ফিরাউনের কাহিনীতে দাম্পত্য সম্পর্কের উদাহারণ দেয়া হয়েছে। কুরআনের দৃষ্টিতে অতি নিকটাত্মীয়গণও ঈমানের পথ পরিত্যাগ করার পর মু’মিনের আত্মীয় থাকে না।
মধ্যবর্তী উম্মাত
মহান পয়গান্বরগণ এবং তাঁদের সম্পর্ক ও আত্মীয়তার বন্ধন সম্পর্কে আলোচনা করার পর আমরা মধ্যবর্তী উম্মাত আখ্যাপ্রাপ্ত দলের অবস্থা পর্যালোচনা করবো। আমরা ও উম্মাতের মধ্যেও অগণিত দৃষ্টান্ত নমুনার সন্ধান পাই। আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্যে আদিকাল থেকে যে জীবন বিধান নাযিল করেছেন সে পথ ধরেই আমাদের এ মধ্যবর্তী উম্মাত চলা শুরু করেছে। যখনই কোন নিকটত্মীয়ের সাথে ঈমানের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে — অন্য কথায় মানষের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ঐক্য সূত্রই ছিন্ন হয়ে গেছে; এখন একই গোত্র, একই বংশ ও একই পরিবারের লোকেরা ঈমানের দাবী মুতাবিক পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আল্লাহ তাআলা মু’মিনদের পরিচয় বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন —
——————————————————————————————-
“যারা আল্লাহ ও আখেরাতের উপর বিশ্বাসী তাদেরকে তুমি আল্লাহর দুশমনদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে দেখবে না। যদিও ঐসব ব্যক্তি তাদের বাপ, ভাই ও পুত্র অথবা নিকটাত্মীয় হয়। তারাই হচ্ছে ঐসব লোক যাদের অন্তরে আল্লাহ তাআলার ঈমান প্রবিষ্ট করিয়ে দিয়েছেন এবং তাঁর গোপন হস্তে তাদের সাহায্য করেছেন এবং তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যেখানে প্রবাহিত রয়েছে শ্রোতান্বিনী এবং যেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং আল্লাহ তাআলার প্রতি তারাও সন্তষ্ট। তারাই হচ্ছে আল্লাহর দলভুক্ত। আর আল্লাহর দলই কল্যাণ লাভ করবে। — মুজাদিলা: ২২
আমরা দেখতে পেয়েছি হযরত মুহাম্মাদ (সা)—এর সাথে তাঁর চাচা আবু লাহাব এবং তাঁর গোত্রীয় আত্মীয় আমর বিন হিশামের (আবু জাহেল) সাথে রক্তের সকল বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। মক্কা থেকে আগত মুহাজিরগণ তাঁদের নিকটাত্মীয় ও স্বগোত্রীয়দের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন এবং বদরের যুদ্ধে তাঁরাই প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করে যান। অপর দিকে মক্কায় মুহাজির ও মদীনার আনসারগণের মধ্যে ঈমানের ভিত্তিতে মযবুত সম্পর্ক কায়েম হয়ে যায়। তাঁদের সম্পর্ক সহোদয় ভাইয়ের মতই হয়ে যায় এবং রক্ত ও বংশগত আত্মীয়ের চেয়েও বেশী দৃঢ় প্রমাণিত হয়। এ নতুন সম্পর্ক মুসলামনদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলে। আরব অনরাব নির্বিশেষে সকল মুসলমানই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সোহাইব রুমী, বিলাল হাবশী (আবিসিনিয়ার অধিবাসী) ও সালমান ফারসী (পারস্য দেশীয়) নিজেদের জন্মভূমি, মাতৃভাষা এবং গোত্রবর্ণের পার্থক্য ভুলে যান। তাদের গোত্রীয় বিরোধ, বংশ কৌলিন্য, জন্মস্থান ও জাতীয় গৌরবের অনুরাগ শূণ্য বিলীন হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলার প্রিয় নবী (সা) তাদেরকে লক্ষ্য করে বলেন, (এসব পরিত্যাগ করো এগুলো এখন দুর্গন্ধময় লাশে পরিণত হয়েছে)। তিনি আরও এরশাদ করেন —
——————————————————————————————-
“যে ব্যক্তি জাহেলী যুগের বিদ্বেষ ও বিভেদের প্রতি আহবান জানায়; সে আমাদের দলভুক্ত নয়, যে বিদ্বেষ ও বিভেদের ভিত্তিতে সংগ্রাম করে সেও আমাদের দলভুক্ত নয় এবং যে বিদ্বষ ও বিভেদ সৃষ্টির আকীদা-বিশ্বাস নিয়ে মৃত্যুবরণ করে, সেও আমাদের দলভু্ক্ত নয়।”
দারুল ইসলাম ও দারুল হরব
মোদ্দকথা, ইসলামের সংস্পর্শে বিদ্বষ ও বিভেদের সকল শ্লোগান বন্ধ হয়ে যায়। বংশ, গোত্র ও আঞ্চলিক সার্থক্যের ভিত্তিতে সৃষ্ট জাতীয়তা দুর্গন্ধময় লাশ হিসেবে পরিত্যক্ত হয়। দেশ, মাটি, রক্ত ও মাংসের সংকীর্ণতা পরিত্যাগ করে মানুষের দৃষ্টি উর্ধমূখী হয়। যেদিন থেকে মুসলমানদের দৃষ্টিভংগী সংকীর্ণতার গণ্ডী ভেঙ্গে দিয়ে দিগন্ত রেখা প্রসারিত হয়, সে দিনই মুসলমানদের আবাসভূমি নাম ধারণ করে। কারণ সেখানে ঈমানের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়াতের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত লাভ করে। ইসলামের এ সুশীতল ছায়াতলে যারা বসবাস করেন, তাঁরাই এ দেশের নিরপত্তা বিধান করেন। এ দেশের প্রতিরক্ষা ও ইসলামী শাসনাধীন এলাকার সীমানা সম্প্রাসারণের প্রচেষ্টায় যাঁরা প্রাণত্যাগ করেন, তাঁরাই হন শহীদ। যাঁরাই ইসলামী আকীদার রত্নহার নিজেদের গলায় পরিধান এবং ইসলামী শরীয়াতকে তাঁদের জীবনের প্রতিপালনীয় বিধান হিসেবে মেনে নেন, তাঁদের সকলেরই আশ্রয়স্থল হচ্ছে দারুল ইসলাম। এমন কি যারা ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস গ্রহণ না করেও ইসলামী শরীয়াতের শাসন ব্যবস্থা মেনে নেয় তারাও জিম্মি হিসেবে এ রাষ্ট্রের সকল সুখ-সুবিধা ভোগ করতে পারে। কিন্তু যে দেশে ইসলামী শাসনের পতাকা উত্তোলন করা হয়নি এবং যেখানে ইসলামী শরীয়াত বাস্তবায়িত নয়, সে দেশে মুসলিম ও জিম্মি উভয়ের জন্যেই দারুল হরব। মুসলমান সর্বদায়ই দারুল হরবের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত থাকেব। এ দারুল হরব যদি তার জন্মভূমিও হয়, সেখানে যদি তার আত্মীয়-স্বজন বসবাস করে এবং মুসলমানদের ধন, সম্পত্তি বা অন্যবিধ পার্থিব বিষয়ে যদি এ দারুল হরবের সাথে কোন প্রকারের স্বার্থ জড়িত থাকে, তবুও প্রয়োজনবোধে সে দেশের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে মুসলমান কখনো পশ্চাদপদ হবে না। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কাবাসীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। অথচ মক্কা ছিল তাঁর পবিত্র জন্মভূমি। তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও স্ববংশের লোকেরা সেখানেই বসবাস করছিল। তিনি ও তাঁর প্রিয় সহচরগণের বাড়ী –ঘর ও ক্ষেত –খামার মক্কাতেই ছিল। মদীনা অভিমুখে হিজরাত করার সময় তাঁরা এসব বিষয় সম্পত্তি ছেড়ে গিয়েছিলেন। তথাপি ইসলামের সামনে নতি স্বীকার করে আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়াতের শাসন মেনে না নেয়া পর্যন্ত মক্কার মত পার্থিব শহরও দারুল ইসলামে পরিণত হয়নি।
এটাই হচ্ছে ইসলাম। মুখে কিছু শব্দ উচ্চারণ, বিশেষ কিছু অনুষ্ঠান পালন অথবা বিশেষ কোন বংশে বা দেশে জন্ম গ্রহণের নাম ইসলাম নয়।
——————————————————————————————-
“না (হে মুহাম্মাদ!) তোমার রব—এর কসম। তারা কখনো মুমিন হতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেদের সকল বিতর্কমূলক বিষয়ে তোমাকেই একমাত্র মীমাংসাকারী হিসেবে গ্রহণ করে নেয় এবং তোমার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোন দ্বিধা-সংশয় পোষণ না করে বরং সন্তুষ্টচিত্তে তোমার প্রদত্ত রায় গ্রহণ করে নেয়।” — আন নিসা: ৬৫
এ আদর্শেরই নাম ইসলাম এবং এ আদর্শে পরিচালিত রাষ্ট্রই দারুল ইসলাম। কোন দেশের মাটি, কোন বিষেশ গোত্র, কোন বিশেষ বংশ বা পরিবারের নাম ইসলাম বা দারুল ইসলাম নয়।
ইসলাম মানবতাকে সকল শিকলের বন্ধন মুক্ত করে দিয়েছে। এসব শিকল মানুষকে নিম্নমুখী করে বেঁধে রেখেছিল। বন্ধন মুক্তির ফলে সে আকাশের উর্ধে আরোহণ করার ক্ষমতা লাভ করেছে। ইসলাম রক্তের বাঁধন ও পশু প্রবৃত্তির তাড়না থেকে মানবতার মুক্তি দিয়ে তাকে ফেরেশতার চেয়েও উচ্চ মর্যাদার অভিষিক্ত করেছে। ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে যে, মুসলাম যে মাতৃভূমিকে ভালবাসবে এবং যার প্রতিরক্ষার জন্যে জীবন বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত থাকবে — তা নিছক একখণ্ড ভূমি নয়। যে জাতীয়তা মুসলমানের পরিচয় ঘোষণা করবে, তা কোন গভর্নমেন্ট প্রদত্ত সংজ্ঞা মুতাবিক গঠিত জাতি নয়। মুসলমানের আত্মীয়তা ও ঐক্যসূত্র রক্তের সম্পর্কিত ভিত্তিতে গড়ে উঠে না। যে পতাকাকে সমুন্নত রাখার জন্যে মুসলমান জীবন দান করতেও গৌরববোধ করবে; তা কোন নিদিষ্ট দেশের প্রতীক নয়। যে বিজয়ের জন্যে মুসলমান সর্বদা সচেষ্ট থাকবে এবং যা অর্জিত হলে মুসলমান আল্লাহর দরবারে মাথা নত করবে, তা নিছক সাময়িক বিজয় নয় বরং তা হবে মহাসত্যের বিজয়। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন —
——————————————————————————————-
“যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে, তখন তুমি জনগণকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবে। সে সময় নিজের রবের প্রশংসা ও গুণকীর্তন কর এবং তাঁর নিকট ক্ষমাপ্রার্থী হও। নিশ্চয়ই তিনি তাওবা কবুলকারী।” — নাসর
এ বিজয় শুধু ঈমানের পতাকা তলেই অর্জিত হয়। অপরাপর পতাকার বিদ্বেষাত্মক শ্লোগান এখানে ব্যবহৃত হয় না। আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠা ও তাঁরই শরীয়াতের বাস্তবায়নের জন্য এখানে জিহাদ অনুষ্ঠিত হয়। অন্য কোন স্বার্থ বা উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে নয়। উপরে যে দারুল ইসলামের পরিচয় পেশ করা হয়েছে তারই প্রতিরক্ষার জন্যে জিহাদের প্রয়োজন — জন্মভূমি বা জাতির মর্যাদা রক্ষা করার মনোভাব নিয়ে নয়। বিজয়ের পর বিজয়ী সেনাবিহীনী শুধু গনিমতের সম্পদ হস্তগত করণের জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে না।
পার্থিব খ্যাতি অর্জন বা বীরত্ব প্রদর্শনও এ বিজয়ের উদ্দেশ্য নয়। বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভই মু’মিনের পরম কাম্য। এ জন্যে, বিজয়ী বাহিনী তাসবীহ ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে পরম করুণাময় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে অতিমাত্রায় ব্যগ্র হয়ে উঠে। দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবোধ জিহাদের প্রেরণা জাগ্রত করে না। পরিবার-পরিজন ও সন্তানাদির নিরাপত্তা বিধানও জিহাদের লক্ষ্য নয়। তবে দেশ, জাতি, পরিবার ও সন্তানদেরকে বাতিল আদর্শের আক্রমণ থেকে মুক্ত করা এবং তাদের দ্বীন ও ঈমানের নিরাপত্তা বিধানের জন্যে জিহাদ অবশ্যই প্রয়োজনীয়।
হযরত আবু সূসা আশয়ারী (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা)—কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “এক ব্যক্তি বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য লড়াই করে, অপর এক ব্যক্তি মর্যাদা লাভের জন্যে। আবার কেহবা লোক দেখানোর জন্য। বলুন তো, এদের মধ্যে কে আল্লাহর পথে লড়ছে?” উত্তরে তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর কালেমাকে উচ্চমর্যদার প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে লড়াই করে, একমাত্র সে-ই আল্লাহর পথে লড়ছে।”
শুধু আল্লাহর পথে লড়াই করার মাধ্যমেই শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করা যেতে পারে। অন্য কোন উদ্দেশ্যে লড়াই করে এ মর্যাদা হাসিল করা যায় না।
যে দেশ মুসলামনদের ঈমান-আকীদার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যায়, দ্বীনি আদেশ নিষেধ প্রতিপালনে বাধা দেয় এবং যে দেশে আল্লাহর শরীয়াত পরিত্যক্ত হয়েছে, সে দেশ দারুল হরব।
এ দেশে যদি মুসলমানদের আত্মীয়-স্বজন, পরিবার ও বংশের লোকজন বাস করে, সেখানে যদি মুসলমানদের ব্যবসা-বাণিজ্য অথবা জায়গা-জমি থাকে এবং এ দেশের নিরাপত্তার সাথে যদি মুসলমানদের আর্থিক স্বার্থের প্রশ্নও জড়িত থাকে তথাপি তার দারুল হরবের চরিত্র পরিবর্তন করা যাবে না। পক্ষান্তরে যে দেশে মুসলমানদের ঈমান-আকীদা সর্বপ্রকার চাপমুক্ত ও তার প্রাধান্য স্বীকৃত এবং যে দেশে ইসলামী শরীয়াত বাস্তবে রূপ লাভ করে, সে দেশ দারুল ইসলাম আখ্যা লাভ করবে। সে দেশে মুসলমানগণ তাদের পরিবার-পরিজনসহ বসবাস না করুক, তাদের বংশ ও গোত্রের লোক সেখানে না থাকুক এবং সে দেশের সাথে মুসলমানদের ব্যবসা বাণিজ্য বা অন্য কোন অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন জড়িত না থাকুক, তবুও সে দেশ দারুল ইসলাম।
যে দেশে ইসলামী আকীদার শাসন চলে, ইসলামই যে দেশে জীবন বিধানরূপে স্বীকৃত লাভ করে এবং আল্লাহর শরীয়াত যে দেশে কার্যকর হয়, সে দেশই মুসলমানদের স্বদেশ। স্বদেশের এ অর্থই মানবতার সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জ্যশীল। অনুরূপভাবে আকীদা-বিশ্বাস এবং জীবন বিধানের ভিত্তিতেই ইসলামী জাতীয়তা গড়ে উঠে এবং মানুষের মুনষ্যত্বকেই সেখানে বিকশিত করে তোলে হয়।
পরিবার, গোত্র, জাতি, বংশ, বর্ণ ও ভৌগলিক অঞ্চলের ভিত্তিতে ঐক্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা ছিল অন্ধকার যুগের চিন্তাধারা। যে সময় মানুষের আধ্যাত্মিকতা অত্যন্ত নিম্নস্তরে ছিল, তখন তারা এসব বিষয়কে ঐক্য সূত্র হিসেবে বিবেচনা করেছিল। রাসূলুল্লঅহ (সা) এগুলোকে দুর্গন্ধময় গলিত লাশ আখ্যা দিয়েছেন। ইয়াহুদী সম্প্রদায় নিজেদের বংশগত জাতীয়তার ভিত্তিতে আল্লাহর অত্যন্ত প্রিয় হবার দাবী পেশ করেছিল। আল্লাহ তাআলা তাদের এ দাবী প্রত্যাখ্যান করে তাদের মুখের উপরই নিক্ষেপ করেন এবং বলেন যে, সকল যুগ, সকল বংশ, সকল গোত্র এবং সকল স্থানের জন্যেই আল্লাহ তাআলার নৈকট্য, মর্যাদা ও সম্ভ্রম লাভ করার একটি মাত্র মানদণ্ড রয়েছে এবং তা হচ্ছে ঈমান বিল্লাহ। এরশাদ হচ্ছে ——————————————————————————————-
“ইয়াহুদী ও নাসারা সম্প্রদায় বলে, ইয়াহুদী অথবা নাসারা হয়ে যাও তাহলে সুপথ লাভ করবে। তাদের বল, না, সব কিছু ছেড়ে ইবরাহীমের বিল্লাতভূক্ত হয়ে যাও। আর ইবরাহীম মুশরিক ছিলেন না। বল,আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করেছি আর তার পক্ষ থেকে আমাদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে এবং হযরত ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাঁদের বংশধরদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে এবং মূসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীদের যা যা দেয়া হয়েছে সেসব বিষয়ের প্রতিও ঈমান আনয়ন করেছি। আমরা তাদের কোন একজনের মধ্যেও কোন পার্থক্য করি না— আমরা আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পিত। তারপর তারা যদি এসব বিষয়ের প্রতি তোমাদেরই মত ঈমান আনয়ন করে, তাহলে হেদায়াত লাভ করবে। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তারা হঠধর্মী হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আল্লাহ-ই তোমাদের জন্য যথেষ্ট। তিনি সবকিছুই জানেন ও শুনেন। আল্লাহর রঙে নিজেকে রঞ্জিত কর। তাঁর রঙের চেয়ে উত্তম রঙ আর কি হতে পারে? আর আমরা তাঁরই বন্দগী করে থাকি।”
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হচ্ছে মুসলিম উম্মাত। কারণ তারা গোত্র বর্ণ, জাতি ও ভৌগলিক এলাকার পার্থক্য ভুলে গিয়ে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর পতাকাকলে সমবেত হয়েছে।
“তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মাত। মানবজাতির পথ প্রদর্শনের ও নেতৃত্বদানের জন্যে তোমাদের গঠন করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের ও নেকীর আদেশ দাও এবং মন্দ ও গুনাহের কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখ এবং নিজেরা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখ।” — আল ইমরান: ১১০
আল্লাহর বান্দাদের নিয়ে গঠিত এ বিপ্লবী বাহিনীর প্রথম সারিতে আরবের সম্ভ্রন্ত বংশজাত হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) রয়েছেন, ইথিওপিয়ার হযরত বেলাল (রা), রোমের হযরত সোহাইব (রা) এবং পরস্যের হযরত সালমান (রা) সকলেই সমান মর্যাদা এ অধিকারের ভিত্তিতে এ দলের সদস্য হিসেবে শামিল রয়েছেন। পরবর্তীকালেও এ উম্মাত বংশ, গোত্র, বর্ণ ও অঞ্চল নির্বিশেষে এক আশ্চর্যজনক ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। তাঁদের জাতীয়তা ছিল তাওহীদ। তাদের মাতৃভূমি ছিল দারুল ইসলাম। আল্লাহর সার্বভৌমত্বই ছিল তাদের দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য এবং কুরআন ছিল তাদের শাসনতন্ত্র।
দেশ ও জাতিবিদ্বেষ তাওহীদের পরিপন্থী
মাতৃভূমি, জাতীয়তা এবং পারস্পরিক সম্পর্কের উপরোক্ত ধারণা-বিশ্বাসনয়ায় ইসলামের দিকে আহবানকারীদের মস্তিকে অংকিত হয়ে যাওয়া খুবই প্রয়োজন।
তাদের নিজেদের অন্তর থেকে জাহেলিয়াতের সকল প্রভাব মুছে ফেলতে হবে। মহাসত্যের অনুসারী দলের সদস্যদের মন-মস্তিষ্ক জাহেলিয়াতের সকল প্রকার প্রভাব এবং বর্তমান দুনিয়ার জাতি পূজা, মাতৃভূমির পূজা, পার্থিব স্বার্থের পূজা ইত্যাদির আকারে প্রচলিত সকল প্রকারের শিরক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে হবে। শিরকের সকল উল্লেখযোগ্য নমুনাগুলোকে আল্লাহ তাআলা কুরআন শরীফের একই আয়াতে একত্রিত করে দিয়েছেন এবং এগুলোকে পাল্লার একদিকে রেখে অপরদিকে ঈমান ও ঈমানের দাবীগুলোকে রেখেছেন এবং মানুষকে এ দুয়ের মধ্যে যেকোন একটি বাছাই করে নেয়ার স্বাধীনতা দান করেছেন।
——————————————————————————————-
“হে নবী! বলে দাও, তোমাদের পিতা, পুত্র, ভাই,স্ত্রী ও আত্মীয়-স্বজন এবং সঞ্চিত ধন-সম্পদ, ব্যবসা –বানিজ্য এবং সুখের বাসভবনটি কি তোমাদের নিকট আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদের তুলনায় অধিকতার প্রিয়? যদি তাই হয় তাহলে আল্লাহর সিদ্ধান্তের অপেক্ষা কর। আল্লাহ পথভ্রষ্টদেরকে হেদায়াত দান করেন না।”
কাজেই দ্বীনের প্রতি আহবানকারীদের অন্তরে ইসলাম ও জাহেলিয়াত এবং দারুল ইসলাম ও দারুল হরবের প্রকৃতি ও পরিচয় সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সংশয় থাকা উচিত নয়। কারণ সন্দেহের পথ ধরেই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। যে দেশে ইসলামের প্রধাণ্য নেই, যেখানে ইসলামী শরীয়াত বাস্তবায়িত হয়নি এবং যে ভূখণ্ডের আইন-কানুন ইসলাম নয়। ঈমানের বহির্ভূত যা কিছু আছে তাই কুফর এবং ইসলামের বাইরে যা আছে তা শুধুই জাহেলিয়াত এবং সত্যের বিপরীত সবকিছুই মিথ্যা ছাড়া কিছুই নয়।