পঞ্চম অধ্যায়
ইসলামী জীবন বিধান
ইসলামী জীবনাদর্শের বুনিয়াদ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। ঘোষণাটি হচ্ছে ইসলামী আকীদার প্রথম স্তম্ভ বা কালেমায়ে শহাদাতের প্রথমাংশ। এ অংশে আল্লাহ ছাড়া বন্দগীর যোগ্য কেহ নেই — একথার স্বীকৃতি রয়েছে। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ — ইসলামী আকীদা বা কালেমায়ে শাহাদাতের দ্বিতীয় অংশ। এ অংশে আল্লাহ তাআলার বন্দগী করার জন্যে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) –এর প্রদর্শিত পন্থাই সঠিক বলে মেনে নেয়া।
এ কালেমা (ঘোষণা) তার উল্লেখিত দু’টো অংশসহ প্রত্যেক মু’মিনের অন্তরেই বদ্ধমূল হয়ে যায়। কারণ, ঈমানের অপরাপর বিষয় ও ইসলামের পরবর্তী স্তম্বগুলো এ ঘোষণারই পরিণতি। স্বাভাবিকভাবেই ফেরেশতা, আসমনী কিতাব, নবীগণ (আ), আখরাতে, তাকদীরের ভাল-মন্দ ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি ঈমান আনয়ন এবং সালাত, সওম, যাকাত, হজ্জ, হালাল ও হারামের পার্থক্য,লেনদেন, আইন-কানুন, উপদেশ— শিক্ষাদান ইত্যাদি সকল কাজকর্মই আল্লাহ তাআলার বন্দগী ও রসূলুল্লাহ (সা) –এর অনুসরণের মাধ্যমে সম্পন্ন হতে পারে।
ইসলামী সমাজ কালেমায়ে শাহাদাত ও তার চাহিদাগুলোর বাস্তব চিত্র পেশ করবে। যে সমাজে কালেমায়ে শাহাদতের রূপ পরিস্ফুট হয় না সে সমাজ ইসলামী সমাজ নয়। তাই কালেমায়ে শাহাদাত একটি পরিপূর্ণ জীবনাদর্শের ভিত্তি এবং এ ভিত্তির উপরেই মুসলিম উম্মাতের বিরাট সৌধ গড়ে উঠে। এ ভিত্তিটি সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত না হলে জীবন যাত্রা প্রণালী রচিত হতেই পারে না। এ ভিত্তির পরিবর্তে অন্য কোন ভিত্তি অবলন্বল অথবা এ ভিত্তিটির সাথে অন্য কোন আদর্শের আংশিক সংমিশ্রণ ঘটিয়ে জীবন বিধান রচনার প্রচেষ্টায় যে সমাজ গড়ে উঠবে তাকে কিছুতেই ইসলামী সমাজ আখ্যা দেয়া যেতে পারে না। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন —
—————————————————————————————-
“আদেশ দেয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। তিনিই আদেশ করেছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারো বন্দেগী করা চলবে না। আর এটাই হচ্ছে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত জীবন বিধান।” — ইউসুফ: ৪০
————————————————–
“যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করে সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই আনুগত্য করে।” — আন নিসা: ৮০
এ সংক্ষিপ্ত অথচ সিদ্ধান্তকারী ঘোষণাই দ্বীনে হক ও তার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পরিচালনার জন্যে কর্মসূচী প্রণয়নে আমাদের পথপ্রদর্শন করে। প্রথমত এ ঘোষণা ইসলামী সমাজের প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়। দ্বিতীয়ত, ইসলামী সমাজ গঠনের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোকপাত করে। তৃতীয়ত, জাহেলী সমাজের পরিবর্তন সাধনের উদ্দেশ্য কি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, তা বলে দেয়। চতুর্থত, মানব সমাজের প্রচলিত বিধি-ব্যবস্থা পরিবর্তনের উপায় বলে দেয়। ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে উল্লেখিত বিষয়গুলোতে সঠিক নির্দেশের প্রয়োজনীয়তা অতীতেও যেমন ছিল, তেমনই রয়েছে ভবিষ্যতেও।
ইসলামী সমাজের বৈশিষ্ট্য
ইসলামী সমাজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, সমাজের সকল বিষয়-আশয়ই একমাত্র আল্লাহ তাআলার বন্দগীর ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। কালেমায়ে শাহাদাত এই বন্দেগীরই স্বীকৃতি দেয় এবং এরই উপায় –পন্থা নিরূপন করে। সমাজের আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদতের সকল অনুষ্ঠান, আইন-কানুন, রীতিনীতি এ বন্দেগীরই বাস্তব নমুণা পেশ করে মাত্র। যে ব্যক্তি আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস স্থাপন করে না সে প্রকৃতপক্ষে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর বন্দগী করতে প্রস্তুত নয়।
——————————————————————————————-
“এবং আল্লাহর দু’জন ইলাহর আনুগত্য করতে নিষেধ করেছেন। ইলাহ মাত্র একজনই। সুতরাং একমাত্র আমাকেই ভয় করে চল। আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে সবই তাঁর মালিকানাধীন এবং একমাত্র তাঁরই দ্বীন কার্যকর রয়েছে। তারপরও কি তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে অন্যদের ভয় করে চলবে?” — আন নাহল: ৫১-৫২
অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি আল্লাহকে ছেড়ে অন্য কোন শক্তির সম্মুখে নতি স্বীকার করে কিংবা সে শক্তিকে আল্লাহর সাথে অংশীদার বিবেচনা করে সে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর বান্দা হতে পারে না।
——————————————————————————————-
“বলুন (হে নবী!) আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও মরণ সবই বিশ্বের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্যে। তাঁর কোন অংশীদার নেই। আমাকে এ বিষয়ে হুকুম দেয়া হয়েছে এবং আমিই সর্বপ্রথম আনুগত্যকারী।” — আল আনআম: ১৬২-১৬৩
পুনরায় যে ব্যক্তি রাসূল (সা) প্রবর্তিত আইন-কানুন পরিত্যাগ করে অন্য কোন উৎস থেকে আইন রচনায় প্রবৃত্ত হয়, সে ব্যক্তিও একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর বন্দেগী থেকে বঞ্চিত।
——————————————————————————————-
“তারা কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহর কর্তৃত্ব অংশীদার সাব্যস্ত করে নিয়েছে? আর ঐ শক্তি কি তাদের জন্যে দ্বীন সমতুল্য কোন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে দিয়েছে, আল্লাহ যে বিষয়ের অনুমতি দান করেননি।” — আশ শুরা:২১
——————————————————–
“রাসূল তোমাদের যা দান করেন তা গ্রহণ কর এবং তিনি যে বিষয়ে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।” — আল হাশর:৭
এটাই হলো ইসলামী সমাজে ক্ষমতার উৎস। সমাজে ব্যক্তির আকীদা-বিশ্বাস ও চালচলনে আল্লাহর বন্দগী রূপায়িত হয়। অনুরূপভাবে তাদের ইবাদাত ও অনুষ্ঠানাদি এবং সমষ্টিগত ব্যবস্থাপনা, আইন-কানুন ও সমাজ নীতির মধ্য দিয়ে আল্লাহ তাআলার বন্দেগী থেকে বঞ্চিত থাকে, তাহলে ঐ সমাজ পরিপূর্ণ ইসলাম থেকেই বঞ্চিত হয়ে যায়। কারণ, এ জাতীয় শূণ্যতার ফলে কালেমায়ে শাহাদাতের ভিত্তিতে সমাজ গড়ে উঠতে পারে না।
একমাত্র এভাবেই একটি সমাজ ইসলামী সমাজে রূপান্তরিত হতে পারে। পরিপূর্ণ নিষ্ঠাসহকারে বন্দগীর মনোভাব গ্রহণ না করা পর্যন্ত কোন দলই ইসলামী দল বা কোন সমাজই ইসলামী সমাজ হিসেবে পরিচিত হতে পারে না। কারণ ইসলামী সমাজের প্রথম বুনিয়াদ কালেমায়ে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ’ সমাজের সকল স্তরে রূপ লাভ না করে ইসলামী সমাজের আত্মপ্রকাশ করার কোন উপায় নেই।
তাই ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণের প্রথম পদক্ষেপই মানুষের অন্তরকে আল্লাহ ছাড়া অপর সকল শক্তির দাসত্ব ও আনুগত্যের প্রবণতা থেকে মুক্ত করতে হবে। যাদের অন্তর অপর শক্তির দাসত্ব মুক্ত হয়ে পবিত্রতা অর্জন করেছে, শুধু এসব লোকই সম্মিলিত হয়ে একটি উম্মাত গঠন করবে। যে উম্মাতের আকীদা-বিশ্বাস, পূজা-উপাসনা, আইন-কানুন প্রভৃতি সকল বিষয় আল্লাহ ছাড়া অপর সকল শক্তির আনুগত্য থেকে পরিপূর্ণরূপে মুক্ত, শুধু তারাই ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার যোগ্য। যারা ইসলামী জীবন যাপন করতে ইচ্ছুক তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই এ সমাজে প্রবশ করবে এবং তাদের আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদাত বন্দেগী এবং রীতিনীতি সকল বিষয়ই অদ্বিতীয় আল্লাহর জন্যে নিদিষ্ট হয়ে যাবে। এক কথায় এ ব্যক্তিদের জীবন কালেমায়ে ‘লা –ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র বাস্তবরূপ ধাবণ করবে।
প্রথম মুসলিম উম্মাত এভাবেই গঠিত হয়েছিল এবং এ উম্মাত গঠনের স্বাভাবিক পরিণতি স্বরূপ ইসলামী সমাজ অস্তিত্ব লাভ করেছিল। মুসলিম উম্মাত গঠন ও ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার এটাই একমাত্র পথ।
ইসলামী সমাজ গঠনের উপায়
ব্যক্তি ও সমষ্টি একযোগে আল্লাহ ব্যতীত সকল শক্তির দাসত্ব সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করার পরই ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। অপরাপর শক্তির পূর্ণ আনুগত্য হোক অথবা আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের সাথে সংমিশ্রিত আনুগত্য হোক — উভয় প্রকারের অধীনতা থেকেই মুক্ত হতে হবে। কেননা, আল্লাহ তাআলার কোন অংশীদার নেই। আল্লাহ তাআলার নিকট এভাবে আত্মসমর্পণের ভিত্তিতে পরিচালিত করতে সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। এ সংকল্প থেকেই একটি নতুন উম্মাত জন্মলাভ করবে। জাহেলিয়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন সমাজের বুকে এক নতুন সমাজ আত্মপ্রকাশ করে, নতুন আকীদা-বিশ্বাস, নতুন মতবাদ এ নতুন ধরনের জীবনযাত্রা প্রণালীর মাধ্যমে এ নব সমাজ কালেমায়ে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র পূর্ণরূপ ধারণ করে। জাহেলিয়াতের প্রাচীন সমাজ এ নতুন সমাজের মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে পারে কিংবা এ সমাজের সাথে একটা আপোষ রফা করতে অথবা এর বিরুদ্ধে লড়াইও করতে পারে। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, জাহলী সমাজ ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোগেই আন্দোলনের সূচনাকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সূচনায় স্বল্প সংখ্যক লোক এ আন্দোলনের ডাকে সাড়া প্রদানের সাথে সাথেই জাহেলিয়াতের পক্ষ থেকে লড়াই শুরু হয়। আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে তাদের লড়াই প্রবল হয়ে উঠে। এমন কি ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার পরও জাহেলিয়াতের পতাকাবাহী দল লড়াই অব্যাহত রাখে। হযরত নুহ (আ) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মাদ (সা) পর্যন্ত প্রত্যেক নবীর আহবানের জবাবে বাতিল সমাজ একই পন্থা অবলন্বন করেছে।
তাই একথা সুস্পষ্ট যে, জাহিলয়াতের আক্রমণ প্রতিরোধ করার উপযোগী শক্তি অর্জন না করা পর্যন্ত মুসলিম উম্মাত গঠিত হতে পারে না। আর যদি তা গঠিত হয় তাহলে কিছুতেই টিকে থাকতে পারবে না। সর্বক্ষেত্রেই শক্তি অর্জনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ঈমান ও আকীদার শক্তি, প্রশক্ষণ ও নৈতিক শক্তি, একটি উম্মাতের সংগঠন ও তাকে টিকিয়ে রাখার শক্তি এবং বাতিলের উপর প্রাধান্য বিস্তার করার জন্যে না হলেও বাতিল শক্তির আক্রমণ প্রতিহত করার উপযোগী শক্তি অর্জন করা খুবই জরুরী।
জাহেলিয়াত এবং তার প্রতিকার
এবার দেখা যাক জাহেলিয়াত ভিত্তিক সমাজ বলতে আমরা কি বুঝি এবং ইসলাম কিভাবে এ সমাজের মুকাবিলা করতে চায়ঃ
ইসলামী সমাজ বহির্ভূত সকল প্রকারের সমাজ ব্যবস্থাই জাহেলিয়াত ভিত্তিক সমাজ। আরও স্পষ্ট ভাষায় এ সমাজের সংজ্ঞা দান করতে হলে বলতে হয় যে সমাজের আকীদা-বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, ইবাদাত-বন্দেগী ও রীতিনীতি এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর সমীপে আত্মসমর্পণের ভিত্তিতে রচিত নয় সে সমাজই জাহেলিয়াতের সমাজ।
এ সংজ্ঞানুসারে বর্তমান বিশ্বে যত সমাজ রয়েছে, সবগুলোই জাহেলিয়াতের সমাজ।
কম্যুনিষ্ট সমাজ এসব জাহেলী সমাজগুলোর অন্যতম। আমাদের এ উক্তির প্রথম প্রমাণ এই যে, এ সমাজ আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব অস্বীকার করে এবং বিশ্বাস করে যে, মানুষের সকল ক্রিয়াকলাপ ও তার ইতিহাস নিয়ন্ত্রিত হয় অর্থনীতি অথবা উৎপাদনের উপায় উপাদানের দ্বারা। দ্বিতীয়ত এ সমাজের সকল রীতিনীতি কম্যুনিষ্ট পার্টির সমীপে আত্মসমর্পণের ভিত্তিতে রচিত— আল্লাহর সমীপে নয়। দুনিয়ার সকল কম্যুনিষ্ট দেশেই সম্যুনিষ্ট পার্টির হাতে থাকে দেশের পূর্ণনিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্ব। তাছাড়া এ সমাজ ব্যবস্থার বাস্তব পরিণতি দাঁড়ায় এই যে, মানুষের মৌলিক প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে জীবজন্তুর প্রয়োজনীয়তার সমপর্যায়ে বিবেচনা করা হয়। খাদ্য,পানীয়, বস্ত্র, আশ্রয় এবং যৌন প্রবৃত্তির প্রয়োজনীয়তার উর্ধ্বে মানুষের অন্য কোন প্রয়োজনীয়তার বিষয় এ সমাজে চিন্তা করা হয় না। সম্যুনিষ্ট ব্যবস্থা মানুষের আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের বিষয়টিকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেছে। অথচ মানুষ ও জন্তু-জানোয়ারের পার্থক্য সূচিত হয় এখান থেকেই। আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের প্রথম ধাপই হচ্ছে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন এবং এ বিশ্বাস সম্পর্কে প্রকাশ্য ঘোষণা করার স্বাধীনতা। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, এ সমাজ ব্যবস্থা মানুষের শক্তি সত্তা বিকশিত করার স্বাধীনতা হরণ করে। মানুষের ব্যক্তি সত্তা নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলোর মধ্য দিয়ে বিকাশ লাভ করে।
এক: ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা।
দুই: পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা।
তিন: যে কোন পেশায় বিশেষ দক্ষতা অর্জনের অধিকার ও সুযোগ।
চার: বিভিন্ন শিল্প কলার ভিতর দিয়ে নিজের মনোভাব প্রকাশ করার অধিকার।
উপরোক্ত বিষয়গুলোর ভিতর দিয়েই মানুষ পশু যন্ত্রের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। কিন্তু কম্যুনিষ্ট ব্যবস্থা মানুষকে এসব বিষয় থেকে বঞ্চিত করার দরুণ তারা জন্তু-জানোয়ার এবং যন্ত্রের পর্যায়ে নেমে যেতে বাধ্য হয়।
পৌত্তলিক সমাজেও জাহেলিয়াতের একই রূপ। ভারত, জাপান, ফিলিপাইন ও আফ্রিকাতে এ ধরনের সমাজ রয়েছে। পৌত্তলিকতাবাদী জাহেলিয়াতের পরিচয় নিম্নরূপ:
এক: তারা আল্লাহর সাথে অন্য কাল্পনিক খোদার বন্দেগী করে— কোন কোন ক্ষেত্রে আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য খোদা গ্রহণ করে নেয়।
দুই: তারা নানাবিধ দেব-দেবীর পূজা-উপাসনা করার জন্যে বিস্তারিত নিয়ম-পদ্ধতি রচনা করে রেখেছে।
অনুরূপভাবে তাদের আইন-কানুন ও রীতিনীতি অর্থাৎ তাদের জীবনযাত্রা প্রণালী আল্লাহ তাআলার দেয়া শরীয়ত পরিত্যাগ করে অন্যান্য উৎস থেকে রচিত। এসব উৎসের মধ্যে রয়েছে ধর্মযাজক, জ্যোতিষী, যাদুকর, সমাজের নেতা এবং আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়াতের প্রতি বিন্দুমাত্র গুরুত্ব আরোপ না করে জাতি, দল অথবা অন্য কোন বিষয়ের নামে আইন রচনা করার পূর্ণ কর্তৃত্ব গ্রহণকারী সংস্থা। অথচ আইন রচনার নিরম্কুশ ক্ষমতা আল্লাহ তাআলার এবং একমাত্র আল্লাহর রাসূল (সা) –এর অনুসৃত পন্থায়ই এ আইন কার্যকরী করা যেতে পারে।
ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের দ্বারা গঠিত সকল সমাজই জাহেলিয়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত। তারা তাদের মূল আকীদা-বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এবং আল্লাহর গুণাবলী থেকে কিছু অন্যান্য শক্তির উপর আরোপ করেছে। তারা আল্লাহর সাথে মানুষের বিচিত্র ধরনের সম্পর্ক কল্পনা করে থাকে। কোন কোন ব্যক্তিকে তারা আল্লাহর পুত্র বলে বিশ্বাস করে। পুনরায় এক আল্লাহকে তারা তিন ভাগে বিভক্ত করে ত্রিত্ববাদ সৃষ্টি করেছে। কোন কোন সময় তারা অদ্ভুতভাবে আল্লাহর পরিচয় ব্যক্ত করে, যদিও এ পরিচয় আল্লাহর আসল পরিচয় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
——————————————————————————————-
“ইয়াহুদীরা বলে ওযায়ের আল্লাহর পুত্র। আর খৃস্টানরা বলে ঈসা আল্লাহর পুত্র।তাদের পূর্ববর্তী অনুকরণ করে এরা এসব ভিত্তিহীন কথা বলাবলি করে। আল্লাহ তাদের ধ্বংস করবেন — কিভাবে তারা বিভ্রান্ত হচ্ছে। —আত তওবা: ৩০
——————————————————————————————-
“যারা আল্লাহকে তিন জনের অন্যতম বলে, তারা অবশ্যই কুফরী করে। কারণ এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন মানুদ নেই।তারা যদি এসব উক্তি থেকে বিরত না হয়, তাহলে তাদের মধ্য থেকে যারা কুফরী করছে তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেয়া হবে।” — আল মায়েদা: ৭৩
——————————————————————————————-
“ইয়াহুদীরা বলে আল্লাহর হাত বাঁধা রয়েছে, প্রকৃতপক্ষে তাদেরই হাত বাঁধা এবং তাদের অশোভন উক্তি ও কার্যকলাপের জন্যে তারা অভিশপ্ত। আল্লাহর হাত মুক্ত এবং তিনি যেভাবে ইচ্ছা খরচ করেন।”
— আল মায়েদা: ৬৪
——————————————————————————————-
“ইয়াহুদী ও নাছারাগণ বলে থাকে যে, তারা আল্লাহর সন্তান ও প্রিয়পাত্র। তাদের জিজ্ঞেস কর, যদি তা-ই হয় তাহলে তোমাদের গুনাহের জন্যে তোমাদের শান্তি দেয়া হয় কেন? প্রকৃতপক্ষে তোমরাও আল্লাহর সৃষ্টি অন্যান্য বান্দাদেরই মানুষ মাত্র।”
— আল মায়েদা:১৮
এসব সমাজের পূজা-উপাসনার পদ্ধতি, রীতিনীত, আচার-ব্যবহার সব কিছুই তাদের ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস থেকে রচিত এবং এ জন্যেই এ সমাজ জাহেলী সমাজ। এগুলো এ জন্যেও জাহেলী সমাজ যে, তাদের সকল সংস্থা ও আইন-কানুন এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর সমীপে নতি স্বীকারের ভিত্তিতে রচিত হয়নি। তারা আল্লাহর আইন মানে না এবং আল্লাহর নির্দশাবলীকে আইনের উৎস হিসেবে স্বীকার করতেও প্রস্তুত নয়। পক্ষন্তরে তারা মানুষের সমন্বয়ে গঠিত আইন পরিষদকে বিধান প্রণয়ণের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রদান করেছে। অথচ এ ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর জন্যে সুনিদিষ্ট। কুরআন নাযিলের যুগে যারা তাদের ধর্মযাজক ও পুরোহিতদের বিধান প্রণয়নের ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছিল, কুরআন তাদেরকে মুশরিক আখ্যা দান করেছে।
———————————————————————————–
“তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের ওলামা ও পুরোহিতদের ‘রব’ বানিয়ে নিয়েছে এবং মরিয়ামের পুত্র মসীহকেও। অথচ এক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো বন্দেগী করতে তাদেরকে আদেশ দেয়া হয়নি। তিনি ব্যতীত বন্দেগীর যোগ্য কেউ নেই। তাদের মুশরিক সুলভ রীতিনীতি থেকে আল্লাহ তাআলা সম্পূর্ণ পবিত্র।” — আত তওবা: ৩১
এসব লোকেরা তাদের ওলামা ও পুরোহিতদের খোদাও মনে করতো না এবং তাদের উপাসনাও করতো না। তবে তারা ঐ সব ধর্মযাজক ও পুরোহিতদের বিধান মেনে চলতো। অথচ আল্লাহ তাআলা এরূপ করার অনুমতি দেননি। তাই কুরআন সে যুগে ইয়াহুদী ও খৃস্টানদের মুশরিক আখ্যা দান করেছে। আজও একই অবস্থা, পার্থক্য শুধু এটুকু যে আইন রচনার অধিকার ধর্মযাজক ও পুরোহিতদের হাতে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নির্বাচিত আইন-পরিষদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। বরাবহুল্য, আইন পরিষদের সদস্যগণও ধর্মযাজকদেরই মত মানুষ মাত্র।
সর্বশেষে এটাও উল্লেখযোগ্য যে, বর্তমান যুগের তথাকথিত মুসলিম সমাজগুলোও জাহেলী সমাজ। তারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন দেবদেবীর প্রতি ঈমান আনয়ন বা তাদের উপাসনায় লিপ্ত হয়নি। তথাপিও তাদের সমাজ জাহেলী সমাজ। কারণ তারা এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর সমীপে আত্মসমর্পণের ভিত্তিতে তাদের জীবনযাত্রা প্রণালী নির্ধারণ করেনি। তারা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলার আইন –বিধান রচনা ও প্রবতর্নের অধিকারটিকে তাদেরই মত মানুষের হাতে অর্পণ করেছে এবং মানুষের রচিত রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার, আইন-কানুন ও জীবনের মূল্যবোধ ইত্যাদি মেনে নিয়ে জীবনের প্রায় সকল দিক ও বিভাগে মানুষেরই কর্তৃত্ব স্বীকার করে নিয়েছে।
শাসন ও আইন রচনা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন —
———————————————————–
“যারা আল্লাহর দেয়া বিধান মুতাবিক বিচার ফায়সালা করে না তারা কাফের।”
— আল মায়েদা: ৪৪
——————————————————————————————
“(হে নবী!) তুমি কি ঐসব লোকদেরকে দেখেছ যারা যুগে যুগে দাবী করে যে, তোমার প্রতি ও তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে, তা সবই সত্য বলে বিশ্বাস করে। কিন্তু তারা তাদের মামলা মোকাদ্দমা ও বিষয়াদি মীমাংসার জন্য তাগুতের নিকট পেশ করে। অথচ তাগুতকে অস্বীকার করার নির্দেশই তাদের প্রতি দেয়া হয়েছিল। — আন নিসা: ৬০
ইতিপূর্বে আল্লাহ তাআলা ইয়াহুদী ও নাসারাদের এ অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং শির্ক ও কুফরের মাধ্যমে আল্লাহর বন্দেগী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার এবং ধর্মযাজক ও পুরোহিতদের খোদায়ী অধিকার প্রদানের অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। আজ ইসলামের দাবীদারগণ এসব অধিকার তাদেরই মত কিছু সংখ্যক মানষের হাতে অর্পণ করে রেখেছে। ইয়াহুদী ও খৃস্টানদের মরিয়াম পুত্র ঈসা (আ) –কে ‘রব’ ও ‘ইলাহ’ বানিয়ে তাঁর বন্দেগী করাকে আল্লাহ তাআলা যেভাবে শিরক আখ্যা দিয়েছেন ঠিক সেভাবেই ধর্মযাজক ও পুরোহিতদের আইন ও বিধান রচনার অধিকার দানকেই শিরক বলেছেন। এ উভয় ধরনের শিরকের মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি। উভয় ধরনের কাজই এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ তাআলার বন্দেগী পরিত্যাগ, আল্লাহর দ্বীন থেকে বিচ্যুতি এবং ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ র সাক্ষ্য দানের পরিপন্থী।
মুসলমানদের মধ্যেও অনেকে প্রকাশ্যেই ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে। দ্বীনের সাথে তাদের সম্পর্কে মোটেই নেই। আবার অনেকে দ্বীনের প্রতি বিশ্বাসী বলে মৌখিক স্বীকারোক্তি করার পর বাস্তব কর্মক্ষেত্রে দ্বীনকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করে। তারা বলে যে, তারা অদৃশ্য বিষয় বিশ্বাস করে না।তারা নাকি বিজ্ঞানের ভিত্তিতে তাদের সমাজ জীবনরচনা করতে চায়। তাদের বিবেচনায় বিজ্ঞান ও অদৃশ্য বিষয়াবলী পরস্পর বিরোধী। বলাবাহুল্য, এসব উক্তির কারণ হচ্চে অজ্ঞতা। একমাত্র অজ্ঞ ব্যক্তিরাই এ ধরনের উক্তি করতে পারে। কোন কোন সমাজ আইন –বিধান রচনার অধিকার আল্লাহ ছাড়া অন্যদের হাতে তুলে দিয়েছে। ঐসব আইন প্রণেতাগণ নিজেদের খেয়াল খুশী মতাবিক আইন রচনা করে এবং বলে, “এটাই আল্লাহর শরীয়াত।” এসব সমাজ বিভিন্ন ধরনের হলেও একটি বিষয়ে তাদের মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। আর সে বিষয়টি হচ্ছে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ না করা।
উপরের আলোচনায় সকল ধরনের জাহেলী সমাজ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভংগী পরিস্কার হয়ে উঠেছে। এক কথায় ইসলাম এসব সমাজকে অনৈসলামিক সমাজ বিবেচনা করে। উল্লিখিত সমাজগুলোর বাহ্যিক নামফলক যাই হোক না কেন, এ বিষয়ে তাদের সকলেরই আভ্যন্তরীণরূপ অভিন্ন। অর্থাৎ তারা এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ তাআলার সমীপে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের ভিত্তিতে জীবন বিধান রচনা করেনি। এদিক থেকে তারা জাহেলী সমাজের রীতি অনুযায়ী কুফরীর পথাবলন্বী।
এবার আমরা সর্বশেষ প্রশ্নটির সম্মুখীন হচ্ছি। এ অধ্যায়ের সূচনাতেই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশ্নটি হচ্ছে, ইসলাম মানবীয় তৎপরতা ও কার্যকলাপকে কি উপায় পরিশুদ্ধ করে থাকে। অতীতে কিভাবে করেছে এবং নিকট ও সুদুর ভবিষ্যতে এজন্যে কি উপায় অবলন্বন করবে?‘মুসলিম সমাজের প্রকৃতি’ শীর্ষক আলোচনায় আমরা এ বিষয়ে আলোকপাত করেছি যে, এ সমাজ আল্লাহ তাআলার সমীপে পূর্ণ আত্মসমর্পণের ভিত্তিতেই সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
মুসলিম সমাজের বৈশিষ্ট্য স্থির করার পর আমাদের পক্ষে নিম্নের প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে নেয়া সহজ হয়ে যায়। প্রশ্নটি হচ্ছে, মানুষের জীবন যাত্রা প্রণালী কোন ভিত্তির উপর রচিত হবে? আল্লাহ তাআলার দেয়া দ্বীন ও জীবন বিধান মানুষের জন্যে কার্যোপযোগী হবে, না মানব রচিত ব্যবস্থা?
ইসলাম এ প্রশ্নের জবাবে অত্যন্ত স্পষ্ট ও জোরালো ভাষায় আমাদের জানিয়ে দেয় যে, একমাত্র আল্লাহর দ্বীন এবং তা থেকে উদ্ভুত জীবন বিধানই মানুষের জন্যে কার্যকরী ব্যবস্থা। এ দ্বীনকে গ্রহণ না করে কখনো ইসলামের প্রথম স্তম্ভ ‘লা –ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ কায়েম হতে পারে না। এবং জীবেনর কোন ক্ষেত্রেই কালেমার কোন প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। দ্বিধাহীন চিত্তে এ নীতি অবলন্বন করা এবং বিশ্বস্ততার সাথে তা মেনে চলা ব্যতীত নবীর শিক্ষা অনুযায়ী আল্লাহ তাআলার সমীপে পূর্ণ আত্মসমর্পণ হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন:
——————————————————
“রাসূল তোমাদের যা দেন তা গ্রহণ কর এবং তিনি যে বিষয়ে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।” — আল হাশর: ৭
অধিকন্তু ইসলাম মানুষের নিকট এ প্রশ্নও তুলে ধরেছে —
—————- “তোমরা বেশী জানো, না আল্লাহ বেশী জানেন? তারপর তিনি নিজেই ঐ প্রশ্নের জবাব দান প্রসঙ্গে বলেন —
———————————————————-
অর্থাৎ “তোমাদেরকে অতি সামান্য মাত্রই জ্ঞান দান করা হয়েছে।” অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে হয় যে, জ্ঞানের ভাণ্ডার যাঁর হাতে, তিনি সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক, তিনিই মানুষের শাসনকর্তা এবং একমাত্র তারই দেয়া জীবন বিধান মানব জাতির জন্যে সঠিক জীবন বিধান হতে পারে। তাঁর নির্দেশেই হবে আইন-বিধানের উৎস। মানব রচিত জীবন বিধান ও আইন-কানুন থেকেই ভাঙ্গন ও বিপর্যয়ের সৃষ্টি। কারণ অসম্পূর্ণ জ্ঞানও কোন কোন ক্ষেত্রে অজ্ঞতা নিয়ে মানুষ আইন রচনা করে। তাই ঐ আইন কিছুকাল পরেই অসামঞ্জস্য ও অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তাছাড়া, অজ্ঞতা ও অসম্পূর্ণ জ্ঞান নানাবিধ জটিলতার জন্ম দেয়।
আল্লাহর দ্বীন অস্থায়ী দোদুল্যমান নীতিমালার সমষ্টি নয়। কালেমার শেষার্ধ ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ (সা) বাক্যাংশের দ্বারা ইসলামী জীবন বিধানের মুলনীতিগুলোকে সুনিদিষ্ট ও অপরিবর্তনীয় করে দেয়া হয়েছে। মুহাম্মাদ (সা) ইসলামের যে চিত্র ও মূলনীতি বির্ধারণ করেছেন, তা চিরস্থায়ী। যে বিষয়ে কুরআন অথবা রাসূল (সা) স্পষ্ট ভায়ায় যে নীতি ঘোষণা করেছেন, সে বিষয়ে ঐ বর্ণিত নীতিই হবে সিদ্ধান্তের ভিত্তি। যদি কোন বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশ না পাওয়া যায়, তাহলেই ইজতেহাদ (চিন্তা-গবেষণা) করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তবে স্মরণ রাখতে হবে যে, আল্লাহ তাআলা ও তাঁর প্রিয় রাসূল (সা) –এর দেয়া মূলনীতিগুলোর চতুসীমার ভিতরেই ইজতেহাদ করতে হবে। নিজের মর্জি মুতাবিক কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না।
——————————————————————————————
“যদি কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়, তাহলে বিষয়টিকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও।” — আন নিসা: ৫৯
ইজতেহাদ করা এবং একটি বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যশীল অপর বিষয়ে আন্দায-অনুমান করে সিদ্ধান্ত নেয়ার নিয়ম-কানুনও ঠিক করে দেয়া হয়েছে। এসব নিয়ম-কানুন অত্যন্ত স্পষ্ট ও সর্বজনবিদিত। কিন্তু নিজেদের রচিত আইন-কানুনকে আল্লাহর শরীয়াত বলে ঘোষণা করার অধিকার কারো নেই। অবশ্য আল্লাহ তাআলার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে যদি তাকেই আল্লাহর আইন ও বিধান রচনার সঙ্গত অধিকারী বলে মেনে নেয়া হয় এবং কোন জাতি, দল বা ব্যক্তিকে ঐ মর্যাদার আসনে বসানোর পরিবর্তে নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (সা) –এর সুন্নাহ মুতাবিক আইন রচিত হয়; তাহলে ঐ আইন বিধানকে সঙ্গতভাবেই আল্লাহর শরীয়াত বলে মান্য করতে হবে। কিন্তু ইউরোপীয় গীজার মত আল্লাহর নাম ব্যবহার করে নিজেদের ইচ্ছা মাফিক আইন রচনার অধিকার কারো নেই। ইসলামের গীর্জবাদ নেই। আল্লাহর রাসূল (সা) ব্যতীত আর কোন মানুষই আল্লাহর পক্ষ থেকে বিধান জারী করার ক্ষমতা প্রাপ্ত নয়।
ইসলাম ইজতেহাদের জন্যে কতিপয় শর্ত আরোপ করে সীমা নিদিষ্ট করে দিয়েছে। এ সীমা লংঘন করার ক্ষমতা কারোর নেই।
“জীবনের জন্যই জীবন বিধান” কথাটিকে অনেক সময়ই অত্যন্ত ভূল অর্থে ব্যাখ্যা এবং খুবই অসঙ্গত পন্থায় ব্যবহার করা হয়। অবশ্য ইসলাম মানুষের জীবন যাপনের পথ সূগম করার জন্যে রচিত। কিন্তু কোন ধরনের জীবন যাপন? ইসলামের নিজস্ব মূলনীতির ভিত্তিতে রচিত জীবন বিধান ও রীতি অনুযায়ী মানুষের জীবন যাপনের উদ্দেশ্যেই ইসলামী জীবনাদর্শ রচিত। এ জীবনাদর্শ মানব প্রকৃতির সাথে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যশীল এবং মানুষের সকল চাহিদা পূরণে সক্ষম। কেননা মানুষের সৃষ্টিকর্তাই তাঁর সৃষ্টির চাহিদা সম্পর্কে উত্তমরূপে অবগত।
——————————————————–
“যিনি সৃষ্টিকর্তা তিনি কি সৃষ্টি সম্পর্কে অবগত নন? তিনি সূক্ষ্মদর্শী ও সকল বিষয়ে উত্তমরূপে অবহিত।” — আল মুলক: ১৪
মানুষ নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন যাপন করবে এবং ইসলাম তার ভাল মন্দ সকল কাজকেই সমর্থন যুগিয়ে যাবে; এটা দ্বীনের কাজ নয়। দ্বীন ভাল মন্দের মানদণ্ড। এ মানদণ্ডের নিরিখে যা ভাল প্রমাণিত হয় তা গ্রহণযোগ্য এবং যা মন্দ প্রমাণিত হয় তা বর্জনীয়। যদি প্রতিষ্ঠিত সমাজের সম্পূর্ণ কাঠামোটিই দ্বীনের বিপরীত মতাদর্শভিত্তিক হয়, তাহলে পুরো সমাজ কাঠামো পরিবর্তন করে নতুন সমাজ গঠন করাই ইসলামের লক্ষ্য। “জীবনের জন্যই জীবন বিধান” কথাটির সঠিক ব্যাখ্যা তাই। অর্থাৎ জীবনকে জীবন বিধান মুতাবিক গড়ে তোলাই দ্বীন বা জীবন বিধানের উদ্দেশ্য।
এখানে প্রশ্ন করা যেতে পারে মানুষের কল্যাণ সাধনই কি সমস্যা সমাধানের উত্তম মানদণ্ড নয়? আমরা এ প্রশ্নের জবাবে পুনারায় ইসলামের উত্থাপিত প্রশ্ন এবং ইসলামের দেয়া জবাব উদ্ধৃত করছি। প্রশ্নটি হচ্ছে —
—————————————–
“তোমরা বেশী জ্ঞানের অধিকারী, না আল্লাহ? জবাবটি হলো
—————————————————-
“আল্লাহই প্রকৃত জ্ঞানের অধিকারী এবং তোমরা অজ্ঞ।” — আলে ইমরান: ৬৬
আল্লাহ তাআলা যে শরীয়াত রচনা করে দিয়েছেন এবং রসূল (সা) যা আমাদের নিকট পৌছিয়েছেন তা মানবীয় চাহিদা পূরণ করার জন্যেই প্রণয়ন করা হয়েছে। যদি কেউ মনে করে যে, আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান মেনে চলার মধ্যে মানুষের কল্যান নেই বরং অবাধ্যাচরণের মধ্যে কল্যাণ নিহিত, তাহলে প্রথমত সে ব্যক্তি ভ্রান্ত ধারণার নিমজ্জিত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাদের সম্পর্কে বলেছেন —
—————————————————————————————–
“তারা আন্দায-অনুমান ও আপন প্রবৃত্তি অনুসরণ করে চলে।এদিকে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তাদের নিকট জীবন বিধান এসেছে।মানুষের যা ইচ্ছা তা-ই কি তারা করবে? অথচ দুনিয়া ও আখেরাতের সকল কল্যাণ তাঁরই হাতে।”—আন নাজম:২৩-২৫
দ্বিতীয়ত সে ব্যক্তির বুঝা উচিৎ যে, আল্লাহর শরীয়াত সম্পর্কে সে যে মনোভাব গ্রহণ করেছে তা কুফরীরই নামান্তর মাত্র। এক ব্যক্তি শরীয়াতের বিধি-নিষেধ অমান্য করার মধ্যে মানুষের মঙ্গল ও কল্যাণ নিহিত বলে ঘোষণা করার পর কি করে দ্বীনের অনুসরণকারী হিসেবে পরিচিত হতে পারে? শরীয়াত লংঘন করার পর কারো পক্ষেই দ্বীনদার হিসেবে পরিগণিত হবার কোন উপায় নেই।