১. রাসূলের আদর্শ
কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা সবটুকুই সেই মহান সত্তার জন্যে, যিনি নিখিল জগতের রব। যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন। দেখবার, শুনবার, চিন্তা করবার ও বুঝবার মতো নিয়ামত দান করেছেন। ইচ্ছা শক্তির আযাদীর মতো মহান আমানত দান করেছেন। আমাদের হিদায়াতের জন্যে রিসালতের ধারাবাহিকতা কায়েম করেছেন।
সালাম ও আনুগত্যের নজরানা পেশ করছি সেই আখিরী রাসূলের (স) খেদমতে, যিনি আমাদের মালিকের হিদায়াত আমাদের পৌঁছে দিয়েছেন, আল্লাহর দিকে আমাদের আহ্বান করেছেন। সুসংবাদ দিয়েছেন। সাবধান ও সতর্ক করেছেন। জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত আমাদের প্রশিক্ষণ এবং সঠিক পথে জীবনযাপনের নির্দেশনা দান করেছেন।
আদর্শ নেতা ও শিক্ষক
রাসূলে করীম (স) এর জিন্দেগী এক প্রজ্জ্বল প্রদীপ ‘সিরাজাম মুনীর’।
১. কুরআন মাজীদে এ একই ‘সিরাজ’ (প্রদীপ) শব্দ দ্বারা সূর্যেও উপমা পেশ করা হয়েছে।
২. আমাদের উপরের এ সূর্য, তাপ, শক্তি ও জীবনের এমন এক পরিপূর্ণ ভান্ডার, যাকে আল্লাহ তায়ালা গোটা পৃথিবীর সমগ্র সৃষ্টির জন্যে তাপ, শক্তি ও জীবন লাভের উৎস হিসেবে তৈরী করেছেন। তার কিরণ রশ্মি এসব নিয়ামতের ভান্ডার বয়ে নিয়ে পৃথিবীর প্রতিটি বন্দরে একই ভাবে আলোকোদ্ভাসিত হয়। তার একটি আলোক রশ্মিও এমন নেই, যেটাকে অপরটির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া যায়। চিন্তা করলে বুঝা যায়, তার অস্তিত্বকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা কেবল অসম্ভবই নয় ইনসাফেরও খেলাফ।
নবী পাকের পবিত্র জিন্দেগীর অবস্থাও ঠিক এ রকমই। মানবতার প্রকৃত জীবন এবং তাপ অর্জনের উৎস তিনিই। তাঁর পূর্ণাঙ্গ জিন্দেগী এক অবিভাজ্য একক। সূর্যেরই মতো তাঁর জিন্দেগীর প্রতিটি দিক ও বিভাগ থেকে আলোক ও হেদায়াতের পাথেয় সমান ভাবে পাওয়া যায়। এতোটুকু বলে দেয়াই যথেষ্ট তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূল। রাসূলুল্লাহ হিসেবে তিনি পূর্ণাঙ্গভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। আল্লাহর রাসূল হিসেবে তাঁর পূর্ণাঙ্গ আমাদের অনুসরণীয়।
তাঁর জীবনাদর্শে আমাদের চিন্তা-ভাবনার জন্যে রয়েছে জ্ঞান। রূহ ও আত্মার জন্যে রয়েছে শান্তি ও পরিতুষ্টির সামগ্রী। আমল ও কর্মের জন্যে রয়েছে আদর্শ। এ অর্থেই ভান্ডার থেকে আমরা কোন মণি-মুক্তাগুলোকে বাছাই করবো? কোনগুলো দিয়ে আমাদের থলে ভর্তি করবো? এ বাগানের কোন ফুলগুলো দিয়ে আমাদের ফুলদানিকে সৌন্দর্যমন্ডিত করবো। এ সিদ্ধান্তে নেয়া কঠিও বটে আবার সহজ ও বটে। কঠিন এজন্যে যে, ভান্ডার অসীম আর আমাদের অঞ্জলী সীমিত। কিছু তুলে নিলে কিছু যাবে থেকে। যা কিছু থেকে যাবে, সেদিকেও নিবদ্ধ থাকবে আমাদের দৃষ্টি। তৃদয় থাকবে তার সাথে আটকা। কী গ্রহণ করবো, তা কঠিন ব্যাপার নয়। বরঞ্চ কী ত্যাগ করতে হবে সেটাই কঠিন ব্যাপার। আর সহজ এ কারণে যে, আমরা যা কিছুই গ্রহণ করবো সে গুলো কোনো অবস্থাতেই ঐ গুলো থেকে নিকৃষ্ট নয়, যেগুলো গ্রহণ করতে পারবো না।
নিজেদের ধারণ ক্ষমতার সংকীর্ণতা, দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা, সময় ও যুগের প্রয়োজনে এবং আমাদের ফায়দা লাভের সহজতা বিধানের জন্যে। আমরা বাধ্য হয়ে নবী পাকের জিন্দেগীকে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করি। কখনো আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী হিসেবে, কখনো সিপাহ্সালার হিসেবে। মোটকথা, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অধ্যয়ন করে আমরা এ প্রদীপ থেকে রৌশনী লাভের চেষ্টা করি।
আজ আমি আপনাদেরকে আমার সাথে সেই নিয়ামতে শরীক করতে চাই, হেদায়াত হিসেবে যা আমি নবী পাক (স) এর নেতৃত্বে ও শিক্ষকতা জিন্দেগী অধ্যয়ন করে আমার কাছে যেটুকু আছে পরিপূর্ণতার দৃষ্টিতে সময়ে তারও কিছু অংশই মাত্র আপনাদের সামনে পেশ করতে পারবো। কিন্তু আমার এবং আপনাদের মধ্যে ধারণ ক্ষমতা এবং যোগ্যতা ও সামর্থের যে কমতি রয়েছে, তার তুলনায় এটুকুই অনেক। আর আমল করার ইচ্ছা থাকলে তো একটি কথাও যথেষ্ট। ফুলকুঁড়িকে ফুটিয়ে দেবার এবং তাকে রংগীন ও সৌরভময় করার জন্যে একটি সূর্যেও কিরণ রশ্মিও যথেষ্ট হয়ে যায়।
এ কথা খুবই সত্য যে, নবী পাক (স) এর জিন্দেগীকে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করে তাঁর পবিত্র জীবনের সাথে ইনসাফ করা সহজসাধ্য কাজ নয়। আর নেতা এবং শিক্ষক হিসেবে তাঁকে পৃথক ভাবে দেখা তো সম্পূর্ণই অসম্ভব ব্যাপার। কারণ, নবুওয়াতের সূচনা থেকেই তিনি শিক্ষক এবং পথপ্রদর্শক আর শেষ পর্যন্ত ছিলেন তিনি শিক্ষক এবং পথপ্রদর্শক। আর এ শিক্ষা ও হেদায়াতের বাস্তবায়নের জন্যেই ছিলো তাঁর নেতৃত্ব।
মূলত, শিক্ষা দানই রিসালতের বুনিয়াদী দায়িত্ব। শিক্ষা দানের মাধ্যমেই তিনি রিসালাতের দায়িত্ব পালন শুরু করেন। নবুওয়াতী জিন্দেগীর প্রথম মুহুর্ত থেকে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি মানুষকে আল্লাহর আয়াত, তাঁর কিতাব এবং হিকমাহ অনুযায়ী জীবনযাপনের রাজপথে তাদের নেতৃত্বে দিতে থাকেন। সূর্যোদয় হলে মানুষ জেগে উঠে। জীবন কাফেলার পথ চলতে শুরু করে। দেহ ও মনে আন্দোলন সৃষ্টি হয়। মানুষ স্ব স্ব দায়িত্ব ও কর্তব্যেও পরিপূর্ণতা সাধনে তৎপর হয়। নবী পাক (স) এর প্রোজ্জ্বল প্রদীপ এদিক থেকে আমাদের জন্যে কোন নির্দেশনার আলোকপাত করেছে? সেটাই আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয়। আমরাও আজ কনিষ্ঠ হৃদয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, রাসূলে খোদাকে আমরা আমাদের জীবন কাফেলার সেনাপতি বানাবো। তাঁর রেখে যাওয়া সেই রিসালাতী দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে আমরা তৎপর হবো। যার জন্যে তিনি তাঁর গোটা জিন্দেগীকে উৎসর্গ করেছিলেন।
কুরআন ও সীরাতে রাসূলের সম্পর্ক
আরেকটি কথা স্পষ্ট করে দিতে চাই। তাহলো, এখানে আমি শুধু রাসূলে খোদার জীবনের সেসব দিকের উপরেই আলোচনা সীমিত রাখবো, যেসব দিকের উপর কুরআন থেকে আলো বিকীর্ণ হয়েছে। দুটি কারণে এরূপ করবো। একটি কারণ হলো, যেহেতু আলোচনা সংক্ষিপ্ত করতে চাই। দ্বিতীয় কারণ হলো, কুরআন এবং সীরাত পাকের মাঝে যে নিবীড় সম্পর্ক বিদ্যমান তা সম্মুখে নিয়ে আসতে চাই।
আমরা সাধারণত এ দুটোকে আলাদা জিনিস মনে করি। এর কারণ হলো, সীরাত গ্রন্থাবলীতে আমরা রাবীদের মাধ্যমেই সমগ্র বর্ণনা পাই। আর কুরআন যাবতীয় ঐতিহাসিক ও স্থান-কাল-পাত্রের বিস্তারিত আলোচনা থেকে প্রায় শূন্য। সাধারণত সীরাত রচয়িতাগণ কুরআন থেকে খুব কমই দলিল প্রমাণ গ্রহণ করেছেন। অপরদিকে মুফাসসিরগণ কুরআনের আলোকে তাঁর বাহকের সীরাতকে শোভামন্ডিত করার ব্যাপারে যথেষ্ট দৃষ্টি দেন না। ক্ষুদ্র জ্ঞানের ভিত্তিতে আমি দৃঢ় বিশ্বাস রাখি যে, সর্বোত্তম সীরাত গ্রন্থ হচ্ছে, কুরআন মাজীদ। আর কুরআন মাজীদের সর্বোত্তম তাফসীর হচ্ছে নবী পাকের সীরাত। কুরআন হচ্ছে সীরাতের নিখুঁত বর্ণনা, আর সীরাত হচ্ছে কুরআন পাকের জীবন্ত মডেল।
এজন্যে আমি মনে করি, যে ব্যক্তি কুরআনের বিশুদ্ধতম তাফসীর পড়তে চায়, দেখতে চায় জীবন্ত কুরআন আর কুরআনকে পড়তে চায় শব্দের পরিবর্তে আমলী যবানে তার উচিত ইবনে কাসীর, কাশ্শাফ, আর রাযী প্রভৃতির চাইতে অনেক বেশী করে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স) কে অধ্যয়ন করা। সেই যিন্দেগীকে অধ্যয়ন করা যার সূচনা হয়েছিলো ‘ইকরা’ (পড়) দিয়ে আর পরিণাম দাঁড়িয়েছিলো।
সে যেনো রাসূলে খোদার জিন্দেগীর প্রতিটি মুহুর্তেকে নিজের মধ্যে একাকার করে নেয়। তবেই তার জন্যে সম্ভব হবে কুরআনকে উপলদ্ধি করা।
একইভাবে যে ব্যক্তি দেখতে চায় রাসূল মুহাম্মাদ (স) কে, সে যেনো ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম, ইবনে সাআদ পড়ার আগে কুরআন অধ্যয়ন করে। স্থা-কাল ও ঘটনাপঞ্জীর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ না কর সে যেনো এ মহাগ্রন্থ থেকে তাঁর প্রকৃত স্বরূপ-গুন-বৈশিষ্ট্য নীতি ও আচরণ নৈতিক চরিত্র লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং জীবনাদার্শকে চয়নব করে। বিশেষ করে সে যেনো অহীর শিক্ষক এবং ইসলামী আন্দোনের নেতা হিসেবে তাঁর মহান সীরারকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করে। কারণ কুরআন মজীদের প্রতিটি আয়াত এবং প্রতিটি শব্দই তো তাঁর এসব মর্যাদার সাথে অর্ঘ্যফুলের মতো সুগ্রন্থিত।
কুরআনে সীরাতে অধ্যয়নের পন্থা
কুরআন কোনো দিক থেকেই সাধারণ গ্রন্থাবলীর ন্যায় কোনো গ্রন্থ নয়। সাধারণ ও প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী এটি কোনো সীরাতের গ্রন্থও নয়। এতে বিষয়ভিত্তিক আলোচনার অবতারণা করা হয়নি। অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ দেয়া হয়নি। শিরোনাম দিয়ে দিয়ে আলোচ্য বিষয় বর্ণনা করা হয়নি। প্যারা-প্যারাগ্রাফেও সাজানো হয়নি। এবং কোনো ইনডেক্সও দেয়া হয়নি যাতে করে লোকেরা খুঁজে বের করতে পারতো যে, শিক্ষক ও নেতা হিসেবে তাঁর গুণ বৈশিষ্ট এবং নীতি ও আদর্শ কি? এ কারণে কুরআনের বর্ণনাভঙ্গি সম্পর্কে জ্ঞাত থাকা আবশ্যক।
কুরআন থেকে সীরাত অধ্যয়ন এবং তথ্য সংগ্রহের জন্যে আমি যে পন্থা ( ) অবলম্বন করি, তার দুটি মূলনীতি রয়েছে:
প্রথমত, কুরআন মজীদে যে সব হেদায়াত এবং হুকুম বিধান দেয়া হয়েছে, তন্মেদ্ধে স্বয়ং নবী পাক (স) এবং তাঁর সাথী মুমিনদের জামায়াতকে সম্বোধন করে যে গুলো দেয়া হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে সেগুলো তাঁর জীবনে জারি ও রূপায়িত ছিলো। (যেমন ইয়া আইয়্যুহার রাসূল, ইয়া আইয়্যূহান নাবী,ইয়া আয়্যূহাল লাযীনা আ-মানু)।
এগুলো অনুযায়ীই তাঁর আমলী জিন্দেগী পরিচালিত ছিলো। তাঁর সীরাত ছিলো এগুলোর বাস্তব সাক্ষ্য। সীরাতের গ্রন্থাবলী থেকে ঘটনাবলীর উদ্ধৃতি দিয়েও একথা প্রমাণ করা যায়। কিন্তু এর দলিল প্রমাণ স্বয়ং কুরআনেও রয়েছে।
যেমন
(১) তিনি ছিলেন প্রথম সুমলিম প্রথম মু’মিন এবং সর্বাগ্রে সর্বাধিক আমলকারী ও মান্যকারী।
(২) তার কথা ও কাজে কোনো প্রকার বিরোধ ও অসামঞ্জস্য ছিল না। তাঁর যবান দিয়ে যে কথা বের হতো তাঁর রবের নির্দেশ অমান্য করেননি।
(৩) তাঁকে কেবল দ্বীনের প্রচারের নির্দেশই দেয়া হয় নি, বরঞ্চ তার উপর সাক্ষ্য হওয়ার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিলো।
এভাবে আমি মনে করি, তাঁকে যদি যিকর বা তাসবীহ করার কিংবা তাকবীর বা ক্কিয়ামুল লাইলের নির্দেশ দেয়া হয়ে থাকে, তবে আমরা এটাকে এভাবে বলতে পারি যে, তিনি তাঁর দৈনন্দিন জীবনে অবশ্যি যিকর, তাসবীহ, তাকবীর এবং ক্কিয়ামূল লাইল করতেন। এমনি করে তাঁকে যদি জিহাদের নির্দেশ দেয়া হয়ে থাকে, তবে এর তরতীব হচ্ছে এই যে, তিনি জিহাদ করেছেন। তাঁকে যদি পরামর্শ করার, কোমল আচরণের দয়া ও ক্ষমা এবং জাহিলদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত না হওয়ার তালীম দেয়া হয়ে থাকে, তবে মূলতই তার সীরাতে এ বৈশিষ্ট্যগুলো অবশ্যি মওজুদ ছিলো। হেদায়াত ও হুকুম আহকামের অলংকারের মধ্যে যেনো সীরাত পাকের সৌন্দর্যই শোভামন্ডিত। আর স্বয়ং কুরআনই যেখানে তাঁর গুনাবলী বর্ণনা করেছে, তাতো সূর্যালোকের মতোই প্রজ্জ্বোল।
দ্বিতীয়ত, কুরআনে হাকীমে যেসব স্থানে ঘটনাবলীর বর্ণনা, আলোচনা ও পর্যালোচনা হয়েছে এবং নবী পাক (স) এর প্রতি সান্তনা ও সহানুভূতির বাক্য উচ্চারিত হয়েছে, এসব স্থানে মূলত প্রেক্ষিতের প্রেক্ষাপটে তাঁর মহান সীরাতের বিভিন্ন দিকই তুলে ধরা হয়েছে। যেমন কুরআন বলছে: “তাদের (বিরোধীদের) কথাও বক্তব্য যেনো তোমাকে চিন্তিত না করে”। এ সান্তনাবাক্য দ্বারা বুঝা যায়, বিরোধিতা ও প্রোপাগান্ডার ঝড় উঠেলিলো। চর্তুদিক থেকে ঠাট্টা বিদ্রুপ চলছিলো। মানুষ হিসেবে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। অতপর খোদায়ী হেদায়াতের সান্ত্বনা লাভ করে সকল দুশ্চিন্তা দূরে নিক্ষেপ করে তিনি দাওয়াত ও তালীমের কাজে মনোনিবেশ করেন। এ অবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা কুরআনে দেয়া হয়নি। কিন্তু সংক্ষিপ্ত বর্ণনা অন্তরালে এ পূর্ণাঙ্গ চিত্র পরিষ্ফুট। আর এ চিত্র উপলদ্ধি না করলে কুরআন অনুধাবনই অপূর্ণাঙ্গ থেকে যাবে এবং সীরাতে পাক সম্পর্কে থেকে যাবে অজ্ঞতা।
এখন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই। কিছু লোক মনে করে, রাসূলে খোদ (স) দায়ী হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, নেতা হিসেবে, এক কথায় রাসূল গ্রহণ করেছেন, যে সব কর্মপন্থা অবলম্বন করেছেন, সবই আল্লাহ তাআলা তৈরী করেছেন এবং যেসব কর্মপন্থা অবলম্বন করেছেন, সবই আল্লাহ তাআলা অহীর মাধ্যমে পূর্বেই তাঁকে শিখিয়ে দিয়েছেন। পূর্ব থেকেই তাঁকে বলে দেয়া হতো, এখন এটা করো, এখন ওটা করো। রিসালাতের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যখন তিনি কোনো বাস্তব সমস্যার সম্মুখীন হতেন, যখন কোনো পলিসি তৈরী করতে হতো, এসব ক্ষেত্রে পূর্ব থেকেই তাঁর কোনো প্রকার পেরেশানী হতো না, কোনো প্রকার দ্বিধা সংকোচ হতো না, কোন প্রকার চিন্তা করতে হতো না এবং জ্ঞান বুদ্ধিও খাটাতে হতো না।
উপরোক্ত ধারণা থেকে আমার ধারণা ভিন্নতর। সঠিক বিষয়ে আল্লাহই সর্বাধিক জানেন। আমার ধারণা যদি ভুলও হয়, আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা আশা পোষণ করি। আমি আরো আশা করি, তিনি আমার জন্যে অন্তত ইজতিহাদেও পুরুস্কার সংরক্ষিত রাখবেন। আমার মতে উপরোক্ত ধারণা কুরআন এবং ঐতিহাসিক দলিল প্রমাণেরও খেলাপ। তাছাড়া এরূপ ধারণা নবী পাক (স) এর মহান ব্যক্তিত্বেও সাথে বেইনসাফীও বটে। তিনিতো কোনো নির্জিব বস্তু ছিলেন না। তিনি ছিলেন সর্বোত্তম মানুষ। সর্বাধিক জ্ঞান, বুদ্ধি ও কর্মকৌশলের অধিকারী।
সর্বোত্তম নৈতিক চরিত্রের অধিকারী এবং মানবতা বাগানে সর্বোত্তম ফুল। আমি দৃড় বিশ্বাস রাখি, তিনি কুরআনকে শাব্দিক অর্থেও দিক থেকে পরিপূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করেছেন এবং তা হুবহু মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু যে মহান হৃদয় এ ব্যক্তিত্বেও অধিকারীকে কুরআনের মতো বিরাট জিনিস প্রদানের জন্যে মনোনীত করা হয়েছে, যে কুরআন পাহাড়ের প্রতি নাযিল করা হলে পাহাড় টুকরো টুকরো হয়ে যেতো, সেই ব্যক্তি কতো বিরাট ও মহান হৃদয় ও ব্যক্তিত্বেও অধিকারী।
এজন্যে আমি মনে করি, রাসূল (স) কুরআনের প্রচার, প্রতিষ্ঠা ও ব্যাখ্যা নির্ধারণ এবং দীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পরিচালনা, এসব কাজই তিনি তাঁর ইজতেহাদ, হিকমাহ, পূর্ণতার জ্ঞান বুদ্ধি এবং নিজ সাথীদের সাথে পরামর্শ করে সম্পাদন করতেন। হ্যাঁ একথাতে অবশ্যি কোনো সন্দেহ নেই যে, তিনি প্রতিটি মুহুর্তেই আল্লাহর তত্ত্ববধান ও হিফাযতে ছিলেন। তাঁর সন্তুষ্টি আল্লাহর সাথে ছিলো একাকার। আমাদের সাধারণ মানুষের মতো তাঁর অবস্থা এরূপ ছিলো না যে, তাঁর কোনো সিদ্ধান্ত আল্লাহর মর্জিও বিপরীত হবে। কোনো কোনো ব্যাপারে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে বা পরে অহী গায়রে মাতলুব মাধ্যমেও হেদায়ত পেয়ে যেতেন। কিন্তু এসব কিছুর সাথে সাথে তিনি একজন মানুষও ছিলেন। মানুষেরই মতো ঘটনা প্রবাহ নিয়ে তিনি চিন্তা-ভাবনা করতেন, সিদ্ধান্ত নিতেন, কখনো পেরেশানী বোধ করতেন, কখনো চিন্তাগ্রস্থ হতেন। এমনি করে মানুব হিসেবে এরূপ যাবতীয় বৈশিষ্ট্য তাঁর জীবন প্রবাহের সাথেও ছিলো অবিচ্ছেদ্য। কুরআনী হেদায়াত এবং তাঁর অন্তর্নিহিত আল্লঅহ প্রদত্ত হিকমাহ কাজে লাগিয়ে এবং নিজ সাথীদের সাথে পরামর্শ করে গোটা আন্দোলনী জীবনে তিনি বিরাট বিরাট ফায়সালা গ্রহণ করেছেন। আন্দোলনের পথ নির্ধারণ করেছেন, সম্মুখে অগ্রসর হয়েছেন।
বিষয়টা এজন্যে গুরুত্বপূর্ণ যে, এর অনুধাবন ছাড়া কুরআন সুন্নাহর আলোকে বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়। হালাল দিবালোকের মতো সুষ্পষ্ট, হারামও পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করা আছে। কিন্তু এতদোভয়ের মাঝে রয়েছে এক বিস্তীর্ণ ময়দান। যে ময়দানে হালাল ও হারামকে জ্ঞানবুদ্ধিকেই কাজে লাগাতে হবে। আমার এ মতের পক্ষে আমার নিকট দুটি ভিত্তি রয়েছে।
প্রথমত,
কুরআন মজীদে তাঁর আন্দোলনী জীবনের অধিকাংশ সিদ্ধান্তের উপর বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করা হয়েছে এবং তা করা হয়েছে পরে। এসব সিদ্ধান্ত ছিলো খ্বুই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। অত্যন্ত সংকটজনক পরিস্থিতিতে তিনি আন্দোলনের গতিপথ নিধারণ করেছেন। একথা খুবই পরিষ্কার, পূর্ব থেকে হেদায়াত অনুযায়ী যদি প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন, তবে অতীতে এর পর্যালোচনা হতো অর্থহীন।
বদর যুদ্ধেও প্রাক্কালে সেনা ফৌজের সাথে যুদ্ধ করবেন, নাকি বাণিজ্য কাফেলার সাথে? বদরের যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে কি ফায়সালা করবেন? ওহুদ যুদ্ধেও প্রাক্কালে মদীনার ভিতরে থেকে যুদ্ধ করবেন, নাকি মদীনার বাইরে গিয়ে এবং মুনাফিকদের ওযর কবুল করবেন কি করবেন না, এসব ব্যাপারে আগে থেকেই সুষ্পষ্ট হেদায়াত দিয়ে দেয়া আল্লাহর জন্যে পরামর্শেও ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়। এমন কি তাঁর পর খলীফা কে হবেন, সে বিষয়টা পর্যন্ত মুসলমানদের রায়ের উপর ছেড়ে দেয়া হয়। নবী পাকের চিন্তা ফিকির এবং জ্ঞান বুদ্ধি প্রমাণের জন্যে এর চেয়ে বড় পরীক্ষা আর কি হতে পারে? তাঁর দায়িত্ববোধ এবং ইখতিয়ারের চেয়ে বড় প্রমাণ কি হতে পারতো।
তাছাড়া কোনো বিষয়ে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যদি পূর্ব থেকেই হেদায়ত এসে থাকে, তবে তা পরিস্কারভাবে সবাইকে জানিয়ে দেয়া হতো। যেমন আহযাব যুদ্ধেও পরই বনি কুরাইযার প্রতি অভিযান চালানো এ বিষয়ে তিনি পরিস্কার জানিয়ে দেন যে, জিবরাঈল এসে আমাকে বলে গেছেন। কিংবা হুদাইবিয়ার সন্ধির ঘটনা। বড় বড় সাহাবীগণ পর্যন্ত এ সন্ধিতে আশ্বস্ত হতে পারেননি। অতপর তিনি জানিয়ে দেন যে, এরূপ করা ছিলো আল্লাহর নির্দেশ।
দ্বিতীয়ত,
রাসূল (স) এর আদর্শ ও জীবন চরিতে আমাদের জন্যে যাবতীয় পথনির্দেশ বর্তমান রয়েছে। অনুসরণ করার জন্যে তাঁর আদর্শই আমাদের জন্যে যথোপোযুক্ত। কারণ তিনি ছিলেন একজন মানুষ। একজন মানুষের মতোই তিনি তাঁর আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। বিরোধীরা যখন অভিযোগ করলোঃ আল্লাহ তাআলা কোনো ফেরেশতাকে কেনো তাঁর রাসূল বানিয়ে পাঠালেন না? তখন কুরআনে এর জবাবে বলা হয়েছে: পৃথিবীতে যদি ফেরেশতা বিচরণ করতো, তবেইতো তাদের হেদায়াতের জন্যে ফেরেশতা আসতো। যেহেতু এখানে বসবাস করে মানুষ সে কারণে একজন মানুষকেই রাসূল বানিয়ে পাঠানো হয়েছে। যিনি তাদেরই মতো, পানাহার করেন বাজারে যান। মানুষের জন্যে তার মতো মানুষেরই অনুসরণ করা সম্ভব, কিংবা তার অনুসরণের চিন্তা সে করতে পারে এবং তার মতো হবার আশা পোষণ করতে পারে। মানুষ দেখে ভীত শংকিতই হতে পারে।
আমরা যদি এরূপ মনে করি যে, গোটা আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিলো মেশিন কিংবা রবোটের মতো, যার নিজের কোনো ইখতিয়ার কিংবা মতামতের বিন্দুমাত্র অধিকারও সেখানে ছিলো না, কিংবা তাঁর অন্তরালে ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ এবং মূলত তিনি নিজেই আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। এরূপ ধারণার ফলশ্রুতিতে আমরা এটাও মনে করে বসবো যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার কোনো আন্দোলন আর এখন চলতে পারবে না। কেননা এখন তো কোনো রাসূল আসবেন না। যিনি সকল বিষয়ে আল্লাহ তাআলা থেকে জেনে বুঝে ফায়সালা করবেন।
পক্ষান্তরে আমরা যদি মনে করি যে, তিনি গোটা আন্দোলন সাধারণত ইজতেহাদ এবং পরামর্শেও ভিত্তিতে পরিচালনা করেছেন। তবে আমরা যদিও তাঁর পদধূলির সমান পর্যন্ত হবার চিন্তা করতে পারি না, আর না তাঁর সাহাবীগণের মর্যাদার কথা কল্পনা করতে পারি, কিন্তু আল্লাহর গোলামী এবং আন্দোলনের সীমার মধ্যে তো আমরা তাঁর মতো হওয়ার প্রচেষ্টায় আতœনিয়োগ করতে পারি। এ প্রচেষ্টায় আমরা তাঁর একশত ভাগের একভাগও যদি লাভ করতে না পারি, হাজারো-লাখো অংশের এক অংশও যদি লাভ করতে না পারি, তার চেয়েও ক্ষুদ্রতম কোনো পর্যায়ে পৌঁছার তামান্নাতো আমরা করতে পারি। এর স্বপ্ন তো আমরা দেখতে পারি।
এ বাসনা, এ তামান্নাই আমাদেরকে রাসূলে খোদার দ্বারে উপনীত করেছে, যাতে করে আমরা তাঁর শিক্ষা, নেতৃত্ব, কর্মপন্থা ও কর্মপদ্ধতি দ্বারা আমাদের জন্যে পথনির্দেশ লাভ করতে পারি।