৪. বিরুদ্ধবাদীদের সাথে রাসূলে খোদার আচরণ
ইসলামের দাওয়াত ও আন্দোলনকে সম্মুখে অগ্রসর কোনো কোনোটি ছিলো বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষ থেকে। কোনোটি ছিলো তাদের বিরোধিতার ফলে নিজেদের কে শীসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায় মযবুত করে গড়ে তুলে আপোসহীনভাবে সম্মুখে অগ্রসর করেন। সবেরর সাথে কার্যসম্পাদন করেন। একথাগুলো খুবই সংক্ষিপ্ত ও মৌলিক। কিন্তু এর কিছু কিছু বিবরণ অবগত হওয়া জরুরী। মন্দের মোকাবেলায় ভালো এবং দয়া ও ক্ষমার মতো মহৎ গুণাবলীও ভিত্তি হচ্ছে সবর। কিন্তু এখন আমাদের দেখতে হবে বিরুদ্ধাবাদীদের পক্ষ থেকে বিরোধিতা এবং তার অবস্তার সেই দিকগুলো কি ছিলো যেগুলো মুকাবিলায় তাঁর সবরের ধরন জানাটা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ক. মৌখিক বিরোধিতা:
দৈহিক অত্যাচার-নির্যাতন বরদাশত করা, তার মুকাবিলায় স্বস্থানে অটল অবিচল হয়ে থাকা এবং অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখা সবরের অনিবার্য দাবী। কিন্তু এক দীর্ঘ অবিরাম প্রাণান্তকর সংগ্রামে সর্বাধিক কষ্টকর, সর্বাধিক বিপদজনক এবং সবচেয়ে ভয়াবহ পরীক্ষা ও মুসীবত হয়ে থাকে সেটা, নাকি মৌখিকভাবে এসে থাকে। কুরআন মজীদ এর ব্যাখ্যা করেছে (তারা যা বলে) শব্দ দ্বারা। কেননা দৈহিক মুসীবত দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কারণ, মানবিক দেহের সহ্যশক্তি তো সীমিত। দৈহিক নির্যাতনের ফলে হয়তো মানষ দুর্বলতার শিকার হয়ে হয়ে তার অবস্থান থেকে কিছুটা সরে যেতে পারে। কিন্তু এতে ধোঁকা ও ষড়যন্ত্রের জালে আবদ্ধ হওয়া নিজেকে সঠিক মনে করা সত্তেও ভ্রান্তপথে অবলম্বন করা, সন্দেহ সংশয়ে নিমজ্জিত হওয়া, আগ্রহ উদ্যমে ভাটাপড়া, নিরাশা ও দুশ্চিন্তার শিকার হওয়া, আন্দোলনের সাথে নি:সম্পর্ক ও নিস্তেজ হয়ে পড়া তার জন্য সম্ভব নয়।
পক্ষান্তরে, মৌখিক বিরোধিতা অন্তরকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়, শিরা উপশিরাকে টুকরা টুকরা করে দেয়, অন্তরকে ভেঙে চুরমার করে দেয়, আর মন মানসিকতাকে নিমজ্জিত করে দেয় দ্বিধাসংশয়ে। এ অবস্থা চলতে থাকে অবিরাম। কারণ কারো গায়েআ হাত উঠানোর চেয়ে বাক্যবানে জর্জরিত করে দেয়াতো অধিকতর সহজ কাজ। ভদ্রতার (?) কাজ। রাসূল (স) এর বিরুদ্ধাবাদীরা একাজটিই করছিলো-হরদম। তাই শুরুতেই কুরআন মজীদ তাঁকে মৌখিক বিরোধিতার মোকাবিলায় ‘সবর’ অবলম্বনের তালীম দিয়েছে। এক তাকীদ পরবর্তীতে ও অব্যাহত রেখেছে।
“আর লোকেরা যেসব কথাবার্তা রচনা করে বেড়াচ্ছে, সে জন্য তুমি ধৈর্যধারণ করো এবং সৌজন্য রক্ষা করে তাদের থেকে সম্পর্কহীন হয়ে যাও।” সূরা আল মুযযাম্মিল: ১০
বিরুদ্ধাবাদীরা তাঁর সেই সব কথার সত্যতাকে অস্বীকার করছিলো। যা তাঁর নিকট ছিলো। চোগলখুরি করে বেড়াচ্ছিল। অপবাদ দিচ্ছিল। বাক্যবান ছাড়াও ইশারা। তাঁর নিয়ত ও নিষ্ঠার উপর সন্দেহ করছিলো। তাঁর কথাগুলো বিকৃত করছিলো। বিকৃত করছিলো সেগুলোর অর্থ। জিদ ও হঠকারীতাকে নিয়ন্ত্রণকে রেখেছেন। কথাবার্তাকে আয়ত্তে রেখেছেন। মন্দের জবাব মন্দ দ্বারা দেয়া থেকে জবানকে রক্ষা করেছেন। স্বীয় গন্তব্যপথে অটল অবিচল হয়ে থেকেছেন।
স্বীয় ঈমান ও একীনের উপর অটল থাকা এবং নিজ দায়িত্ব পালনের কাজে লেগে থাকা ছাড়াও তিনি পুঁতির মালার মতো ক্রমাগত পরীক্ষা-সমূহের মুকাবিলায় পূর্ণ সবরের নীতি অবলম্বন করেন। এ সবরের ধরন ছিলো বিচিত্র।
এক প্রকার সবর ছিলো এই যে, তিনি বিরুদ্ধবাদীদের এসব কথার জবাব দিতেন না। তাদের সাথে তর্ক ও জগড়া বিবাদে লিপ্ত হতেন না। ফিরে আসতেন। কারণ তাদের সাথে তর্ক-বিতর্ক লিপ্ত হলেও তারা সত্য কবুল করতো না। করতো না। কেবল তারই সময় নষ্ট হতো। তাছাড়া এসব ঠাট্টা-ইবদ্রুপের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করাটা তো ছিলো তাঁর দীন এবং তাঁর নিজের জন্য ক্ষতিকর।
দ্বতীয়ত, এ লোকেরা সাথে বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসারতো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু তিনি যখন তাদের থেকে পৃথক হতেন, তখন শত্রুতা, হিংসা এবং ঝগড়া বিবাদ করে পৃথক হতেন না। মানবিক সহর্মিতার আচরণ অব্যাহত রাখতেন। দাওয়াতের কাজও জারি রাখতেন। এ জিনিসটাকেই কুরআন মাজীদ (সৌজন্য রক্ষা করে সম্পর্কহীন হওয়া) দ্বারা বিশ্লেষিত করেছে। আয়াতাংশেও চিত্রই অংকিত হয়েছে বলা হয়েছে। অনুরূপ নির্দেশই দেওয়া হয়েছে (তাদের সাথে বসো না) দ্বারা। বলা হয়েছে:
“আর জাহেল লোকেরা তাদের সাথে কথা বলতে এলে বলে দেয়: তোমাদের সালাম: সূরা আল ফুরকান: ৬৩”
“এবং জাহেল লোকদের থেকে বিরত থাক।” সূরা আল আরাফ: ১৯৯
“তোমরা যেখানেই আল্লাহর আয়াতের বিরুদ্ধে কুফরীর কথা বলতে এবং এর সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে শুনবে, সেখানে তোমরা আদৌ বসবে না, যতক্ষোণ না তারা কোনো কথায় লিপ্ত হয়। তোমরা যদি তা করো, তবে তোমারাও তাদেরই মতো হবে।” সূরা আন নিসা: ১৪০
“তুমি যখন দেখবে, লোকেরা আমার আয়াতসমূহের দোষ সন্ধান করছে, তখন তাদের নিকট থেকে সরে যাও।”সূরা আনয়াম: ৬৮
তাঁর এর চেয়েও মহান মর্যদা এ ছিলো যে, তিনি তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। গালির জবাবে গালি না দিয়ে দোয়া করেছেন। মন্দের জবাব দিয়েছেন ভালো দিয়ে। এ বিষয়ে আমরা সম্মুখে আলোচনা করবো।
যখন লোকেরা কান্ডজ্ঞানহীন ভাবে অস্বীকার করতে থাকে, সত্যের আহ্বান শুনেও না, অহংকার ও আত্মম্ভরিতায় মেতে ওঠে, সত্যের আহ্বানকারীকে তুচ্ছ ও নগন্য জ্ঞান করে। মানব স্বভাবের এ এক অনিবার্যতা যে, তখন দু:খ বেদনায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। নবী করীম (স) এরও এ অবস্থা সৃষ্টি হয়। কিন্তু কুরআনের সাহায্যে তিনি তা উৎরে উঠতেন। এ অবস্থার উপর বিজয়ী হতেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষক আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সান্তনা পাওয়ার পর তিনি পূর্ণ উদ্যেমে স্বীয় দায়িত্ব পালনে লেগে যেতেন।
“কাজেই এ লোকেরা যে সব কথা বলে তা যনো তোমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও দু:খিত না করে। তাদের প্রকাশ্য ও গোপন সব কথাই আমরা জানি।” সূরা ইয়াসীন:৭৬
“অতপর যে কুফরী করে, তার কুফরী যেনো তোমাকে চিন্তান্বিত না করে। তাদেরকে তো আমার নিকট ফিরে আসতেই হবে। তখন আমি তাদেরকে বলে দেব তারা কি সব করে এসেছে।” সূরা লুকমান: ২৩
একনি করে বিরুদ্ধাবাদীদের ষড়যন্ত্রও হঠকারিতা, ইসলামী দাওয়াতকে ব্যর্থ করার জন্য তাদের তাৎপরতা দাওয়াতপ্রাপ্ত কিছু লোকদের কুফরের সাথে মেলামেশা এবং কাফেরদের সাথে যোগসজাগ তাঁকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করতো। তাঁর মনকে ছোট করে দিতো। এ অবস্থার মুকাবিলাও তিনি কুরআনের সাহায্যেই করতেন।
“এ লোকদের কার্যকলাপ তুমি দু:খিত হয়ো না আর তাদের অবলম্বিত ষড়যন্ত্রের দরুন দিল ভারাক্রন্ত করো না।” সূরা আন নাহল: ১২৭
“হে নবী! সেইসব লোক যারা খুব দ্রুতগতিতে কুফরীর পথে অগ্রসর হচ্ছে, যেনো তোমার দু:শ্চিন্তার কারণ হয়ে না হয়। যদিও তারা সেই লোকা যারা মুখে বলে, আমরা ঈমান এনেছি। আসলে তাদের দিল ঈমান আনেনি। কিংবা এরা সেইসব লোক হলেও যারা হহুদী হয়ে গেছে।” সূরা আল মায়দা: ৪১
ত্বরিত পাওয়ার ইচ্ছা ও ফল লাভের বাসনা মানব মনের এক শাশ্বত বৈশিষ্ট্য। এর মুকাবিলা করার জন্যও প্রয়োজন বিরাট সবরের। বরঞ্চ কেউ কেউ তো বলেন, তাড়াহুড়া না করার অপর নামই সবর। নবী পাকের এ সবরের ধরন ছিলো বিভিন্নমুখী। একটা দিক ও ছিলো, যখন তাঁর চরম প্রচেষ্টা পরম আন্তরিকতা সত্বেও লোকেরা তাঁর দাওয়াত কবুল করতো না, তখন স্বাভাবিকভাভেই তাঁর মন চাইতো এ লোকেরা যা কিছু দাবী করছে কিংবা যা কিছু শর্তারোপ করছে, তন্মধ্যে কোনো দাবী বা শর্ত পূর্ণ হয়ে থাক, যাতে করে তারা বাস্তব প্রমাণ ও নিদর্শন পেয়ে যায় এবং দাওয়াত কবুল করতো না, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মন চাইতো এ লোকেরা যা কিছু দায়ী করছে কিংবা যা কিছু শর্তারোপ করছে, তন্মধ্যে কোনো দাবী বা শর্ত পূরণ হয় যাক, যাতে করে তারা বাস্তব প্রমাণ ও নিদর্শন পেয়ে যায় এবং দাওয়াত কবুল করে নেয়। আরেকটা দিক ছিলো এই যে, তাদেরকে ধ্বংসের যে ওয়াদা করা হয়েছে, তার কিছু অংশ তাদের প্রত্যক্ষ করানো হোক। এমন একটা খেয়াল ও তাঁর মনে জাগতো যে, এই হক ও সত্য পথের কাফেলা অতি দ্রুত মনযিলে মাকসাদে পৌঁছে যাক।
এ সকল অবস্থায় তিনি কুরআনী হেদায়াতের ভিত্তিতে ধৈর্য ও সবরের নীতি অবলম্বন করতেন। যুক্তিহীন দাবী পূর্ণ করা কিংবা আল্লাহর আযাব সংঘটিত হওয়া না হওয়া বা মনযিলে মাকসাদে পৌঁছার যাবতীয় বিষয়ে সরাসরি আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে তিনি স্বীয় কর্মব্যস্ততায় লেগে যেতেন। আর আল্লাহ তাআলা তাঁকে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন প্রাণান্তকর সংগ্রাম ও পরীক্ষার পথ পরিহার করে কামিয়াবীর দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।
“(হে নবী!) আমি জানি, এরা যে সব কথাবার্তা বলে বেড়াচ্ছে তাতে তোমার বড় মনোকষ্ট হয়। কিন্তু এরা কেবল তোমাকেই অমান্য করছে না। এ যালেমরা মূলত আল্লাহর বানী ও নিদর্শনসমূহেকই অস্বীকার করছে। তোমার পূর্বেও অনেক রাসূল কে অমান্য করা হয়েছে। কিন্তু এ অস্বীকার এবং তাদের প্রতি আরোপিত জ্বালাতন নির্যাতন তারা বরদাশত করে নিয়েছিলো। অবশেষে তাদের নিকট আমার সাহায্য পৌঁছে। আল্লাহর বাণী পরিবর্তন করার ক্ষমতা কারো নেই। পূর্ববর্তী নবীদের খবরদারি তো তোমার নিকট এসে পৌঁছেছে। তা সত্বেও তাদের অনাগ্রহ ও উপেক্ষা সহ্য করা যদি তোমার পক্ষে কঠিন হয় তাহলে তোমার শক্তি থাকলে যমীনে কোনো সুড়ঙ্গ তালাশ করো অথবা আকাশে সিঁড়ি লাগিয়ে নাও এবং তাদের সম্মুখে কোনো নিদর্শন পেশ করতে চেষ্টা করো। আল্লাহ যদি চাইতেন তবে এসব লোককে তিনি হেদায়াতের উপর একত্র করতে পারতেন। অতএব তুমি অজ্ঞ-মূর্খের মতো হয়ো না।” সূরা আল আনআম: ৩৩-৩৫
“অতএব (হে নবী!) সবর অবলম্বন করো, যেভাবে উচ্চসংকল্প সম্পন্ন রাসূলগণ ধৈর্যধারণ করেছিলেন। আর এ লোকদের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করো না।” সূরা আল আহকাফ: ৩৫
“অতএব (হে নবীঁ) তুমি সেই পথনির্দেশের অনুসরণ করো, যা অহীর মাধ্যমে তোমার নিকট প্রেরিত হয়েছে। আর আল্লাহর ফায়সালা আসা পর্যন্ত ধৈর্যধারণ করো।” সূরা ইউনুস: ১০৯
খ. মোকাবিলা এবং জিহাদ
যে লোকগুলো বিরোধিতা করার জন্য আদাজ্জল খেয়ে লেগেছে, কথায় ও কাজে চরম শত্রুতা করেছে, এমনকি একথা প্রমাণ হয়ে গেছে যে, তারা আর সত্যকে মেনে নেবে না। তারা উন্মুক্ত তলোয়ার নিয়ে বিরিয়ে এসেছ। রাসূল (স) এর দাওয়াত ও আন্দোলনকে নির্মূল করার চেষ্টা করেছে। ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছে। আর যেসব লোকা ঈমান আনার দাবী করা সত্ত্বেও কাফিরদের সহযোগিতা করেছে এবং আন্দোলনের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করার চেষ্ঠা করেছে। এ সকলের সাথে নবী পাক (স) কঠোরতা অবলম্বন করেন। তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন। এরূপ না করাটা ছিলো সেই মহান উদ্দেশ্যর জন্য খুবই ক্ষতিকর, যা তাঁর উপর ন্যাস্ত ছিলো। অবশ্য একাজে তিনি বিন্দুমাত্র বাড়াবাড়ী করেননি। সীমাতিক্রম করেননি। তালোয়ার উত্তোলন করেছেন বটে, কিন্তু ইনসাফ ও নৈতিকতার সকল সীমা হেফাজত করেছেন:
“(হে নবী!) কখনো কাফিরদের আনুগত্য করো না। আর এ কুরআনকে সাথে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মহা জিহাদে অবতীর্ণ হও।” সূরা আল ফুরকান: ৫২
“(হে নবী!) কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করো এবং তাদের সাথে কঠোরতা অবলম্কন করো।” সূরা আত তাওবা: ৭৩ সূরা আত তাহরীম: ৯
“আর তোমরা আল্লাহর পথে সেই সব লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করো, যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। কিন্তু সীমালংঘন করো না। আল্লাহ সীমা লংঘনকারীদের পছন্দ করেন না।” সূরা আল বাকারা: ১৯০
“কোনো বিশেষ দলের শত্রুতা যেনো তোমাদের এতোদূর উত্তেজিত না দেয় যে, তার ফলে তোমরা ইনসাফ ত্যাগ করে বসবে। ইনসাফ করো। বস্তুত খোদাপরস্তির সাথে এর গভীর সামঞ্জস্য রয়েছে।” সূরা আল মায়দা: ৮
যে সব বিরুদ্ধবাদীদের বিরোধিতা শত্রুতা, লড়াই এবং ষড়যন্ত্র পর্যন্ত পৌঁছায়নি, কিংবা যারা হেদায়াতের পথে ফিরে আসবে না একথা সুপ্রমাণিত হয়নি, নবী করীম (স) তাদের বিরুদ্ধে উপরোক্ত নীতি অবলম্বন করেননি।
গ. উত্তম নৈতিকতা:
কিন্তু উক্ত দুই ধরনের লোকদের সাথে আচরণের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় কথা যেটা, তা হচ্ছে তিনি কখনো তাদের গালি দেননি। বিদ্রুপ করেননি। ঠাট্টা করেননি। অপমানিত করেননি। নিকৃষ্ট ধরনের আচরণ করেননি। কাউকেও পরিহাস করেননি। হিংষা বিদ্বেষের বশবর্তী হননি। এমনকি কখনো কোনো অভদ্র শব্দ পর্যন্ত ব্যবহার করেননি। তাদের মূর্তি ও মিথ্যা খোদাদের পর্যন্ত গালাগাল করেননি। অথচ এদের পূর্ণ সমালোচনা করেছেন। আর আলেম ও ইহুদীদের প্রতি সমালোচনার যে ভাষা কুরআনে ব্যবহার করা হয়েছে, তা ঐ সমালোচনার ভাষার তুলনায় অনেক কোমল, যা বাইবেলে ইসরাঈলী পয়গম্বর হযরত ইয়াসা’আ, হযরত ইয়ারমিয়াহ এবং হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ব্যবহার করেছেন। এমন করে তিনি কখনো কোনো প্রশ্নকারীর প্রতি রুষ্ট হননি। ধমক দেননি কখনো। কারো সাথে হীন আচরণ করেননি। অগ্নিশর্মা হননি কারো প্রতি। গাল ফুলদানি কখনো। করেননি কখনো ভ্রুকুঞ্চিত। এ ব্যাপারেও তাঁর আচরণ ছিলো কুরআনেরই পূর্ণাঙ্গ নমুনা:
“(হে ঈমানদার লোকেরা!) না পুরুষ ব্যক্তি অপর পরুষ ব্যক্তিদের বিদ্রুপ করবে। হতে পারে যে, তারা তাদের তুলনায় ভালো হবে। আর না নারীরা অন্যান্য নারীদের ঠাট্টা করবে। হতে পারে ওরা তাদের থেকে উত্তম হবে। নিজেদের মধ্যে একজন আরেকজনকে দোষারোপ করোনা, আর না একজন অপর লোকদের খারাপ উপমাসহ স্মরণ করবে।” সূরা আল হুজুরাত: ১১
“আর লোকদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কথা বলো না। যমীনের উপর অহংকারের সাথে চলাফেরা করো না। আল্লাহর কোনো আত্ম-অহংকারী দাম্ভিক মানুষকে পছন্দ করেন না।” সূরা লুকমান: ১৮
“আর প্রার্থীকে ধিক্কার তিরষ্কার করবে না এবং তোমার রবের নিয়ামতাকে প্রকাশ করতে থাকো।” সূরা আদ দোহা: ১০-১১
“(হে ঈমানদার লোকেরা!) এই লোকেরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের ইবাদাতই করে, তাদের তোমরা গালাগালি দিও না।” সূরা আল আনআম: ১০৮
ঘ. মন্দের জবাব ভালো দিয়ে:
প্রকৃতপক্ষে, বিরুদ্ধবাদীদের সাথে আচরণের ক্ষেত্র নবী করীম (স) এর চেয়েও উচ্চমর্যদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ছিলেন, রাহমাতুল্লিল আলামীন। ছিলেন অনুগ্রহ ও কোমলতার মূর্তপ্রতীক। তাঁর সাথে যে বাড়াবাড়ি করতো, তাকে তিনি ক্ষমা করে দিতেন। যারা তাঁর সাথে নিকৃষ্ট আচরণ করতো, তিনি তার সাথে উৎকৃষ্ট আচরণ করতেন। এদিক থেকেও তাঁর সীরাতে পাক ছিলো কুরআনেই নমুনা:
“(হে নবী!) নম্রতা ও ক্ষমাশীল নীতি অবলম্বন করো।” সূরা আল আ’রাফ: ১৯৯
“আর মন্দের বদলা ঐ রকম মন্দ। যে কেউ ক্ষমা করে দেবে ও সংশোধন করে নেবে, তার পুরুষ্কার আল্লাহর যিম্মার।” সূরা আশ শূরা: ৪০
“আর (হে নবী!) ভালো ও মন্দ সমান নয়। তুমি অন্যায় ও মন্দকে দূরা করো সেই ভালো দ্বারা যা অতি উত্তম। তুমি দেখতে পাবে তোমার সাথে যার শত্রুতা ছিলো, সে প্রাণের বন্ধু হয়ে গেছে।” সূরা হা-মীম আস-সাজদা: ৩৪
তায়িফের ঘটনা:
এ সুযোগে সীরাতে পাকের একটি ঘটনা সম্মুখে আনা উচিত। তা হচ্ছে, তাঁর তায়িফ সফরের ঘটনা। মক্কায় যখন অধিকাংশ লোক তাঁর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলো এবং এ শহরকে ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি বানানোর কোনো সম্ভবনা থাকলো না, তখন তিনি তায়িফ গমন করেন। আশা করছিলেন, তায়িফবাসী সে কেন্দ্র উপহার দেবে। আশা করছিলেন এখানে তাঁর ও তাঁর আন্দোলনের জন্য ভূ-খন্ড পাওয়া যাবে। একটি উম্মাত এখানে থেকে উখ্থিত হবে। কায়েম হবে আল্লাহর দীন।
তায়িফের তিনজন সরদারই অতি নিকৃষ্ট পন্থায় তাঁর সম্বর্ধনা করেছে। একজন বলেছে, আল্লাহ তোমাকে ছাড়া আর কাউকেও পাননি তাঁর রাসূল বানানোর জন্য? দ্বিতীয় জন বলছে, তোমার মতো ব্যক্তিকে রাসূল বানানো দ্বারা কা’বার পর্দা ফেটে যাননি। তৃতীয় জন বলেছে, যদি তুমি সত্য নবী নও তবে তোমার সাথে কথা বলার উপযুক্ত আমি নই, আর তুমি যদি মিথ্যা হও তবে আমাদের সাথে কথা বলার উপযুক্ত আমি নই, আর তুমি যদি মিথ্যা হও তবে আমাদের সাথে কথা বলার উপযুক্ত তুমি নও। তিরস্কার করে তাড়িয়ে দেবার পর তিনজন সরদারই তাঁর বিরুদ্ধে উচ্ছৃংখল বালকদের লেলিয়ে দয়। তারা তাঁকে গালাগালি করে এবং পাথর মারতে শুরু করে। তাঁর দেহ থেক রক্ত ঝরে জুতোয় জমে যায়। অবশেষে তিনি এক বাগানে আশ্রয় নেন। এসময় তাঁর নিকট জিবলাঈল আমীন আগমন করেন। সাথে এসেছেন পাহাড়ের ফেরশতারা। জিবলাঈল বললেন, পাহাড়ের ফেরেশতারা আমার সাথে এসেছেন, আপনার নির্দেশ পেলেই তায়িফবাসীদের দুই পাহাড়ের মাঝখানে পিষে ফেলতে পারি। আল্লাহর পথে আহ্বানকারী আল্লাহর রাসূল বললেন, না আমি এ ব্যাপারে নিরাশ নই যে, এ জাতির মধ্যে আল্লাহর বন্দেগী করার লোক পয়দা হবে।
বস্তুত এই ছিলো তাঁর মহান নৈতিক চরিত্র। এরি ফলে মানুষ পতংগের মতো তাঁর দিকে আকৃষ্ট হয়েছে। তাঁর চার পাশে একত্র হয়েছে। তাঁর এ চরিত্রই বিরুদ্ধাবাদীদের অন্তর জয় করেছে। উহুদ যুদ্ধে যারা তাঁর রক্ত ঝরিয়েছে, মক্কায় দীর্ঘদিন যারা তাকে অবর্ণীয় কষ্ট দিয়েছে, যারা তাঁর প্রিয়তম স্ত্রীর প্রতি অপবাদ আরোপ করেছে, এসকলের প্রতি তার ক্ষমা ও করুনাই বিজয়ী হয়েছে।
যারা তাঁর আহ্বানে লাব্বায়িক বলেছে, এদের মধ্যে এক দল লোকতো ছিলো তারা, যারা তাঁর আহ্বান শুনুছে-কুরআনের বাণী তাদের কানে পৌঁছেছে। আমার সীমিত জ্ঞানে এদের সংখ্যা ছিলো খুবই কম। আরেক দল ছিলেন তারা, যারা স্বচক্ষে তাঁকে দেখেছেন, তাঁর চরিত্র দেখেছেন, সীরাত দেখেছেন, চেহারা মুবারক দেখেছেন। দেখে বলেছেন, এ চেহারা মিথ্যাবাদীর চেহারা হতে পারে না। তাঁর উদরতা ও মাহনুভবতা দেখে তারা আকৃষ্ট হয়েছেন এবং ঈমান এনেছেন। এদেরই সংখ্যা ছিলো অধিক। ইসলামী আন্দোলন আশিখরনখ আত্মোৎসর্গকারী যে একদল লোক পেয়েছে, মূলত এদেরকে তার আহ্বানকারীকে মহান ব্যক্তিত্বের চুম্বকই একত্রে করেছে।