৫. আন্দোলনের সাথীদের সাথে রাসূল (স) এর আচরণ:
কোনো আকীকাহ বিশ্বাস ও লক্ষ্য উদ্দেশ্যের উপর মানুষকে একত্রে করে নেয়াটা সহজসাধ্য কাজ নয়। কিন্তু তার চেয়েও কষ্টসাধ্য কাজ হচ্ছে এর উপর তাদেরকে একত্র রাখাটা। অর্থ্যাৎ তাদের একজনের সাথে আরেকজনকে মজবুত বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখা। মালার মতো এক সুতায় গেঁথে এককে পরিণত করা। মেজাজে সমতা সৃষ্টি করা। আবেগ ও আকর্ষণকে জীবিত এবং স্থায়ী রাখা। আন্দোলনের চড়াই উতরাইয়ে উদ্দেশ্যের উপর অটল রাখা এবং মনযিলে মাকসাদের দিকে তাদের এগিয়ে নেয়া।
ভাঙন ও বিচ্ছিন্ন প্রতিটি সংগঠিত এককের মধ্য সহজেই প্রবেশ তাকে দুর্বল করে দেয়। একতাবস্থায় একজন যোগ্য ও বিজ্ঞ নেতার কাজ হচ্ছে দাওয়াতে যারা লাব্বায়িক বলেছে তিনি তাদেরকে আন্দোলনে মজবুতভাবে একত্র করে রাখবেন।
দাওয়াতে আন্দোলনের অন্তর্গত সম্মোহন এবং আন্দোনের নেতার চারিত্রিক গুণাবলী ছাড়াও পরিবেশের চাপ, বক্তৃতা, লিখিত প্রচার এবং শ্লোগান ইত্যাদি মানুষকে একত্র করা ও ভীড় জমানোর ব্যাপারে সফল হয়। কিন্তু এ জনতাকে এমন একটি সাংগঠনিক শক্তিতে রূপান্তরিত করা এবং সেই শক্তিকে এমনভাবে কাজে লাগানো যে, তারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভালবাসা ও আন্তরিকতার সাথে নেতার সাথী হয়ে, থাকবে, এটা খুবই কঠিন কাজ।
বস্তুত একাজের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নেতার প্রয়োজন। আর নবী করীম (স) এর সীরাত এরূপ নেতৃত্বের আদর্শ নমুনা।
দুনিয়ার অন্যান্য নেতারও মানুষকে একত্র করে তাদের থাকে কাজ আদায় করেছেন। হক এবং বাতিল উভয় পথের নেতারই একাজ করেছে। কিন্তু সাধারণভাবে তাদের সহকর্মীরা আন্দোলনের কোনো না কোনো অধ্যায়ে পৌঁছে কিছু না কিছু অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। কেবল মাত্র নবী বছর পর পর্যন্ত তাঁর প্রতি এতোটা অনাবিল আসক্ত অনুরক্ত যেমনটি আসক্ত অনুরক্ত ছিলো প্রথম দিন।
রাউফুর রাহীম:
এ বিস্ময়কর অবস্থার সৃষ্টি করেছে কোন জিনিস? এ-ও ছিলো তাঁর চরিত্রেরই অনন্য বৈশিষ্ট্য। তাঁর এ বিস্ময়কর চরিত্র বৈশিষ্ট্যর কয়েকটি দিক আমরা এখানে আলোচনা করবো। তবে আমার বিশ্বাস তার চরিত্রের এ বিস্ময়কর গুণাবলীকে দুটি শব্দের মধ্যে একত্র করা যায়। কুরআনই তাঁর জন্য শব্দ দুটি ব্যবহার করেছে। অর্থ্যাৎ তাঁর সাথীদের প্রতি, মু’মিনদের জামায়াতের প্রতি তিনি ছিলেন “রাউফূর রাহীম” সহকর্মী করুণাসিক্ত।
“লক্ষ্য করো, তোমাদের নিকট একজন রাসূল এসেছেন। তিনি তোমাদেরই মাধ্যেরই একজন। তোমাদের ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া তাঁর পক্ষে দু: সহ কষ্টদায়ক। তোমাদের সার্বিক কল্যাণেরই তিনি কামনাকারী। ঈমানদার লোকদের জন্য তিনি সহানুভূতি সম্পন্ন ও করুণাসিক্ত।” সূরা আত তাওবা: ১২৮
শব্দ দুটি সিফাত হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে এ যেনো আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলের আচরণ ও চরিত্র বৈশিষ্ট্য বর্ণনার জন্যে সেই শব্দদ্বয়কে ব্যবহার করলেন যা তিনি ব্যবহার করেছেন নিজের জন্য। …. প্রকাশ থাকে যে, সমগ্র সৃষ্টি ও মানবজাতির জন্য নবী পাকের অস্তিত্ব, তাঁর রিসালাত ও হেদায়তের ইতিহাস সতর্কীকরণ ও সুসংবাদ দান, ইনসাফের উপর প্রতিষ্টিত থাকা এবং চারিত্রিক মহত্বকে কুরআন মজীদ একটি মাত্র শব্দে প্রকাশ করেছে। আর তা হচ্ছে ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’। আপন সাথীদের সাথে নবী পাক (স) এর সম্পর্ক ও আচরণের যে দিক ইচ্ছে উন্মুক্ত করুন। দেখবেন ছবি একটিই তৈরী হচ্ছে। আপদমস্তক মহব্বত, দয়া ও করুণার প্রতিচ্ছবি।
উক্ত শব্দ দুটির প্রতি আরো প্রশস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দুখুন। সব ধরনের উত্তম গুণ ও চরিত্র বৈশিষ্ট্যই এগুলোর ভাবধারার মধ্যে নিহিত রয়েছে। সহকর্মীদের প্রতি মহব্বত, ভালোবাসা, তাদের মূল্যদান, কল্যাণ কামনা, সেবা, পরিশুদ্ধ করা, শিক্ষাদান করা, তাদের থেকে পরামর্শ গ্রহণ, তাদের প্রতি দয়া ও ক্ষমাশীল হওয়া, এমনকি তাদের আদব শিক্ষাদান এবং শাস্তিদান ও এর অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ যদি তাঁর ইসমে জাত হিসেবে অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার করে থাকেন, তবে তা হচ্ছে রাহমান। এ রাহমান এমন একটি সিফাত, যা প্রায় তাঁর সমস্ত সিফাতকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। আর রাহমানের রাসূল রাউফুর রাহীম হবেন না তো কী হবেন?
কুরআন মজীদের যে আয়াতটিতে নবী করীম (স) এর জন্য এ মৌলিক শব্দ দুটির উল্লেখ হয়েছে, সে আয়াতেই শব্দ দুটির বিশ্লেষণ ও রয়েছে। রাউফুন (সহানুভূতি সম্পূন্ন) এর মধ্যে নেতিবাচক দিক প্রভাবশীল রয়েছে। তাহচ্ছে ক্ষতি ও অনিষ্ট বিদূরিত হওয়া। অর্থাৎ এমন প্রতিটি জিনিস দূর করার কাজে আত্ননিয়োগ করে, যা ক্ষতি, কষ্ট ও অনিষ্টের কারণ হতে পারে। আর রাহমতের মধ্যে ইতিবাচক অর্থ্যাৎ কল্যাণ দানের দিক প্রভাবশীল রয়েছে। অর্থ্যাৎ এমন সহানুভূতি ও কল্যাণ যা উপকার, উন্নতি এবং কামিয়াবী ও কল্যাণের দ্বারসমূহ খূলে দেয়।
কুরআন থেকে একথা স্পষ্ট এবং তাঁর গোটা পবিত্র জীবনেও তা উজ্জ্বল হয়ে আছে যে, প্রথম থেকেই তাঁর দয়া ও সহানুভূতি এতোটা ব্যাপক ছিলো যে, তাঁর সাথীদের জন্য কোনো না কোনো প্রকারে ক্ষতির কারণ হতে পারে এমন জিনিস তাঁকে দারুণ পীড়া দিতো। এ অবস্থায় তাঁর অন্তর ও আচরণের মধ্যে যে অবস্থা সৃষ্টি হতো তার আধিক্য বুঝানোর জন্য কুরআন পাকে (আযীয) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যার অর্থ সর্বব্যাপী প্রভাবশালী। এতে কেবল একাথাই শামিল নেই যে, তাঁর কোনো কথা ও কাজ দ্বারা কখনো কেউ কোনো প্রকার কষ্ট পায়নি। তিনি কাউকেও গালমন্দ করেননি। কাউকেও অপমানিত করেননি। কাউকে অপবাদ দেননি। কারো গীবত করেননি। কারো সম্মান হানি করেননি। কারো গায়ে হাত উঠাননি; বরঞ্চ তাতে একথাও শামিল রয়েছে যে, দীনের দাবী, আন্দোলনের দায়িত্ব এবং শরীয়তের বিধানেও তিনি এমন কিছু দাবী করেননি যা কষ্টসাধ্য। প্রকাশ থাকে যে, এতে সেসব ত্যাগ ও কুরবানীর দাওয়াত অন্তভূক্ত নয়, যা দুনিয়া ও আখেরাতের কামিয়াবীর দ্বার উন্মোচনকারী।
অপরদিক থেকে তাঁর অবস্থার ধরন এমন ছিলো যে, তার ব্যাখ্যা কেবল (লোভ বা আন্তরিক কামনা) শব্দ দ্বারাই করা যেতে পারে। এ শব্দের তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, শুধু ভালো, কল্যাণ ও উন্নতির জন্য প্রতিটি কথা বলা, এজন্যই প্রতিটি কাজ করা। আর এমনটি যাতেই বলা হয়, যতোই করা হয়, মন তৃপ্ত হয় না। না জানি কোনো কিছু বাদ পড়ে যায়। মন চায় অধিক অধিক এমনটি করতে। প্রতিটি মুহুর্তে তা অব্যাহত রাখতে। এ ধ্যান এ চিন্তাই তাঁকে সর্বক্ষণ পেরেশান করে রাখতো! এ-ই ছিলো তাঁর আকাঙ্ক্ষার ধরন। এ-ই ছিলো তাঁর অবস্থা।
তাঁর দিলটাও ছিলো এই মহান দুটি গুনেরই ছাঁচে ঢালা এবং আমলও। তা বিদীর্ণ হয়ে যতো আকৃতিতেই প্রকাশ হয়েছে, যতো পুষ্প পল্বব আর যতো পুষ্প পল্লব আর ও ফলই তা থেকে বের হয়েছে, তা গণনা করে শেষ করা সম্ভব নয়। কি্তু কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আকৃতি থেকে যে আলো বিকীর্ণ হচ্ছে, তা দ্বারা অন্তর ও চলার পথ আলোকিত করে নেয়া উচিত। তাঁর প্রত্যেক সাথীই মূল্যবান ছিলেন। আর তিনিও পৃথিবীর সমস্ত বিলাসী সৌন্দর্য থেকে দৃষ্টি গুটিয়ে এনে তা কেবল নিজ সাথীদের প্রতিই নিবদ্ধ করেছিলেন। প্রতিটি মুহূর্তে তাদের শিক্ষাদীক্ষা ও পরিশুদ্ধির কাজে ব্যস্ত থাকতেন। দয়া, কোমলতা ও স্নেহ মহব্বতের ব্যবহার তাদের সাথে করতেন। প্রত্যেকের সাথে আচরণ করতেন, তার যোগ্যতা ও মানসিক শক্তি-সামর্থের ভিত্তিতে। তাদের পরামর্শে শরীক করতেন। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন তাদের ভুলভ্রান্তি। দয়া ও ক্ষমার প্রতিমূর্তি ছিলেন তিনি।
ক. মর্যাদার অনুভূতি ও নিবীড় সম্পর্ক:
যে ব্যক্তিই আল্লাহর গোলামীর পথে তাঁর সাথী হয়েছে, তাঁর হাতে হাত দিয়ে বায়াত করেছে, সকলকে ত্যাগ করে তাঁর পিছে চলেছে, সে ছিলো তাঁর নিকট সর্বাধিক মূল্যবান পুঁজি। তার আসন ছিলো তাঁর অন্তরে। তার সথে ছিলো মহব্বতের সম্পর্ক। তার সাথে তিনি নিজেকে একাত্ম করে নিয়েছিলেন। এতে না ছিলো কোনো দুনিয়াবী স্বার্থ আর না নফসের আকাঙ্ক্ষা এগুলো থেকে তাঁর দিল অতিশয় পূত-পবিত্র। সাথীরা ছিলেন তাঁর নিকট দুনিয়াবী সবকিছু থেকে অধিক পবিত্র। এমনটি কখনো হয়নি যে, তিনি তাদের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে কিংবা তাদের ত্যাগ করে দুনিয়াবী কোনো চাকচিক্যের প্রতি, কোনো স্বার্থ ও লাভের প্রতি কিংবা কোনো উচ্চপদ ও খ্যাতির প্রতি চোখটি তুলেও তাকিয়েছেন:
আর তোমার দিলকে সেই লোকদের সংস্পর্শে স্থিতিশীল রাখো যারা নিজেদের রবের সন্তোষ লাভের সন্ধানী হয়ে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁকে ডাকে। আর কখনো তাদের থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরাবে না। তুমি কি দুনিয়াবী চাকচিক্য ও জাঁকজমক পছন্দ করো? সূরা আল কাহ্ফ: ২৮
কারণ স্পষ্ট, পরিষ্কার। তদের সাতে সম্পর্ক শুধুমাত্র সেই সত্তার উদ্দেশ্যই ছিলো, যার সন্তুষ্টি ও অনগ্রহ লাভ তুচ্ছ নগন্য। এ সম্পর্কে কোনো সাময়িক প্রয়োজনে ছিলো তুচ্ছ নগণ্য। এ সম্পর্ক কোনো সাময়িক প্রয়োজনে ছিল না যে, যখন ইচ্ছা তা কায়েম করা হলো এবং যখন ইচ্ছা তা ভেঙে দেয়া হলো। যখন ইচ্ছা তা মাথায় তুলে নেয়া হলো আর যখন ইচ্ছা পদতলে পিষ্ট করা হলো এ নিবীড় সম্পর্ক আর এ মর্যাদার অনুভূতি মূলত তাঁর স্নেহজ কোমলতার এক বড় উৎস।
এ সম্পর্কে আল্লাহর উদ্দেশ্যে হবার প্রক্ষিতে তা ছিলো খুবই মূল্যবান। কিন্তু নবী করীম (স) এ একাথাও জানা ছিলো যে, আল্লাহ তাআলার সাহায্য লাবের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো মু’মিনদের সেই জামায়াত যারা ছিলো তাঁর সঙ্গী সাথী। তাঁদের পারষ্পরিক সম্পর্ক হবে যতোটা মজবুত, উদ্দেশ্য হাসিল হবে ততোটাই নিশ্চিত এবং তাদের নেতা তাদের সাথে যতোটা মহব্বতের সম্পর্ক রাখেন, তারই বাস্তব রূপ পরিলক্ষিত হবে। তাদের পারষ্পরিক সম্পর্কের মধ্যে। মু’মিনদের জামায়াতের এ পজিশনও তাঁর জানা ছিল যে, আল্লাহ তাআলা তাদের সাথীত্ব ও সংঘবদ্ধতার কারণেই তাঁকে কামিয়াবী দান করবেন। আর সেই খোদায়ী পুরস্কার যা কেবল তাঁরই মেহেরবানীতে লাভ করা যেতে পারে। তা লাভ করার ক্ষমতা ও এখতিয়ার কোনো মানুষের নেই:
তিনিই নিজের সাহায্য দ্বারা মু’মিনদের দিয়ে তোমার সহায়তা করেছেন এবং মু’মিনদের দিলকে পরষ্পরের সাথে জুড়ে দিয়েছন। তুমি ভূ-পৃষ্ঠের সমস্ত ধন-দৌলতও যদি ব্যয় করে ফেলতে, তবু এই লোকদের দিল পরষ্পরের সাথে জুড়ে দিতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহই তাদের মন পরষ্পরের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তিনি বড়ই শক্তিমান ও সুবিজ্ঞ। হে নবী, তোমার জন্য এবং তোমার অনসারী মু’মিনদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। সূরা আল আনফাল: ৬২-৬৪
এরূপ মিলন ও সম্পর্কের ফরশ্রুতিতেই রাসূল (স) আরবের গোত্রীয় সম্প্রদায়সমূহের বর্ণ-বংশ ও সম্মান-সম্ভ্রমের সমস্ত প্রতিমাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে মানবীয় ইতিহাসে এক বিষ্ময়কর অধ্যায় সংগোজন করতে সক্ষম হয়েছেন। আকীদা ও আমলের বুনিয়াদের উপর ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক এবং উম্মাহর পত্তন করেছেন। এমন ভ্রাত্রত্বের সম্পর্ক গড়ে দিয়েছিলেন যা চৌদ্দশ বছরও মিটিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি।
আর এরি ফলশ্রুতিতে এ মুজিযা সংঘটিত হয়েছে যে, সীমা সংখ্যাহীন যতো মানুষই তাঁর সাথে এসেছে, কেউ তার বিরোধী হয়নি। কেউ তার প্রতি কোনো প্রকার অভিযোগ ও অপবাদ করেনি।
সকলকে তিনি স্বীয় মহব্বতের ছায়ায় এমনভাবে জড়ো করে নেয়। অতপর তাদের হেফাযতে করেছেন। পূর্ণত্ব দান করেছেন। ডানা মেলে উড়বার যোগ্য করেছেন:
এবং ঈমানদার লোকদের মধ্যে যারা তোমার অণুসরণ করে, তাদের প্রতি তোমার ডানা মেলে নাও(অর্থাৎ তাদের সাথে মায়া-মমতা, কোমলতা, নম্রতা ও সদয় সহানুভূতির আচরণ করো)
সুরা আশ শুয়ারা: ২১৫
খ. তালীম ও তাযকিয়া:
নবী করীম (স) এর মৌলিক কার্যাবলীর একটি ছিলো শিক্ষদান। কিন্তু তিনি যেভাবে স্বীয় আন্দোলনের সাথীদের শিক্ষা প্রদান করেন তার তুলনা বিরল। তেলাওয়াতে আয়াতের মাধ্যমে তিনি তাদের চলমান কুরআন বানিয়ে দেন। কিতাবে তালীম এবং হিকমাতের মাধ্যমে তাদের তিনি জ্ঞান, বুদ্ধি ও আনুগত্যের মূর্তপ্রতীক বানিয়ে দেন। তাযকীয়ার মাধ্যমে তাদের অন্তরাত্মাকে সর্বপ্রকার অবিচলতা থেকে পূতপবিত্র করে মানবতার মিরাজে পৌঁছে দেন। মাক্কী জীবন ও সাক্ষী, সাক্ষী মাদানী জিন্দগীও। দাওয়াতী কাজের পরই তাঁর সমস্ত চিন্তা ও লক্ষ্য একাজটির প্রতিই কেন্দ্রীভূত হয়।
কিয়মুল লাইল ও তারতীলে কুরআনে তাঁর সাথীদের একটি দল তাঁর পদাংক অনসরণ করেন। একটি দাল তাঁর সাথেই একাজে শরীক হচ্ছেন:
আর তোমার সংগী-সাথীদের মধ্যে থেকেও কিছুসংখ্যক লোক এ কাজ করে। সূরা মুযাযম্মিল: ২০
এর একটি কেন্দ্র ছিলো দারে আরকাম। এখানে তিনি (গোপনে) অবস্থান করতেন। ভান্ডার থেকে ইলম ও হেদায়াত বিতরণ করতেন। (যেমন কূপ থেকে বালতি ভরে লোকেরা পানি নেয়) তিনি কুরআন শুনাতেন। সাথীরা শিখতো। এছাড়াও সম্ভবত অন্যান্য ব্যবস্থাপনা সেখানে ছিলো। কোনো সীরাত গ্রন্থে এর বিস্তারিত বিবরণ আমরা পাই না ঠিক। কিন্তু কুরআন এর স্পষ্ট ইংগিত করছে। তিনি তেলাওয়াত কুরআনের জন্য দন্ডায়মান হতেন। সাথীদের মধ্যে চলাফেরা করে তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। খবরা খবর অবগত হতেন:
তিনি সেই সময়ও তোমাকে দেখতেন, যখন তুমি দাঁড়[ও। আর সিজদায় অবনত লোকদের মধ্যে তোমার গতিবিধির উপরই তিনি দৃষ্টি রাখেন। সূরা আশ শুআরা: ২১৮-২১৯
কেবল কুরআন শুনিয়ে দেয়া বা পাঠ করে দেয়াই তাঁর কাজ ছিলো না। বরঞ্চ কুরআনকে বুঝিয়ে দেয়া এবং লোকদের চিন্তায় ও আমলে তা একাকার করে দেয়াও ছিলো তাঁর কাজ। এ উদ্দেশ্যে তিনি অল্প অল্প করে কুরআন শিখিয়ে দিতেন। হযতর আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বলেন, আমরা রাসূল (স) থেকে দশ বছরে সূরা আল বাকারা শিখেছি। অপর একজন সাহাবী বলেন, আমরা নবী করীম (স) থেকে কয়েকটি আয়াত শিখে সেগুলো হেফাযত করে নেয়ার পরই আবার শিখতাম। স্বয়ং কুরআনই অল্প অল্প করে অবতীর্ণ হয়েছে। আর তিনি ঠিক এভাবেই সাথীদের পাড়িয়েছেন এবং শিখিয়েছেন। তাঁর শিক্ষাদানের কৌশল খুবই স্পষ্ট: আর এ কুরআনকে আমরা অল্প অল্প করে নাযিল করেছি যাতে তুমি বিরতি দিয়ে দিয়ে তা লোকদের শুনাও এবং এ গ্রন্থকে আমরা (অবস্থামত) ক্রমশ নাযিল করেছি। সূরা বনী ইসরাঈল: ১০৬
অমান্যকারীরা বলে: এ ব্যক্তির উপর সমস্ত কুরআন সেই সময় নাযিল করা হলো না কেন? হ্যাঁ এরূপ এ জন্য করা হয়েছে যে আমরা এটাকে খুব ভালোভাবে তোমার মন-মগজে বদ্ধমূল করেছিলাম আর (এউদ্দেশ্যেই) আমরা এ গ্রন্থকে এক বিশেষ ধারায় আলাদা আলাদা অংশে সজ্জিত করেছি। সূরা আল ফুরকান: ৩২
একদিকে তারতীলের সাথে সাথে জ্ঞানের উৎস কুরআনের তিলাওয়াত বিশেষ করে নিশিরতা জেগে জেগে এ তিলাওয়াত। অপরদিকে ইবাদাতের পাবন্দী, বিশেষ করে নামাযে। যার উপর অচিরেই প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছিল দীন ও রাষ্ট্রের ইমারাত। এ দুটি জিনিসের মাধ্যমে তিনি তাঁর সাথীদের মন-মানসিকতা তৈরী করেছেন। তাদের অন্তরকে পবিত্র করেছেন। নৈতিক চরিত্রকে উন্নত করেছেন এবং তাদের অন্তরকে পবিত্র করেছেন। নৈতিক চরিত্রকে উন্নত করেছেন এবং তাদের কর্মনিপুণ করেছেন। শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত তিনি এ কাজ আঞ্জাম দিতে থাকেন। গোটা জীবন ব্যবস্থার রুদ্ধ্রে রন্ধ্রে আল্লাহর যিকরই একাকার করে দেয়ার কথা আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি।
ইলমী রূহানী এবং নৈতিক শিক্ষা ও পরিশুদ্ধির একাজ স্বস্থানে একাকী মোটেই যথেষ্ট হতো না, যদি না নবী পাক (স) এরি সাথে সাথে স্বীয় সাথীদেরকে বাস্তব দাওয়াত এবং ময়দানে জিহাদের কর্মতৎপরতায় লাগিয়ে দিতেন এবং সর্বপ্রকার অগ্নিপরীক্ষায় নিমজ্জিত হয়ে তাঁরা নিখাদ সোনায় পরিণত হতো। বস্তুত ঐরূপ আধ্যাত্মিক ও নৈতিক পরিশুদ্ধ কাম্যও ছিলো না। মিথ্যা খোদাদের চ্যালেঞ্জ করে, বাতিল রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠোর সমালোচনা করে, সার্বভৌমত্ব ও নেতৃত্ব শুধুমাত্র আল্লাহ হবার কথা ঘোষণা করে এবং নিজের প্রতি পূর্ণাংগ আনুগত্যের দাবী করে নবী করীম (স) তাযকিয় ও পরিশুদ্ধির প্রকৃত স্কুল খুলে দেন। প্রতিটি পদক্ষেপে সাথীদের অন্তরে একথার প্রগাঢ় বিশ্বাস জাগ্রত করে দিতে থাকেন। যে এই প্রাণান্তকর মরুভূমির মাঝখান দিয়ে চলে গেছে কামিয়াবীর পথ। ঈমানের দাবীকে অবশ্যি ছেঁকে আলাদা করে নেয়া হবে।
লোকেরা কি মনে করে নিয়েছে যে, আমরা ঈমান এনেছি এটুকু বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে। আর তাদের পরীক্ষা নেওয়া হবে না। অথচ আমরা তো এদের পূর্বে অতিক্রন্ত সকল লোককেই পরীক্ষা করেছি। আল্লাহকে তো অবশি দেখে নিতে হবে কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যাবাদী। সূরা আল আনকাবুত: ২-৩
আল্লাহ মুমিনদের এ অবস্থায় কিছুতেই থাকতে দেবেন না, যে অবস্তায় তোমরা বর্তমানে (দাঁড়িয়ে) আছ। পবিত্র লোকদের অপবতিত্র লোকদের থেকে অবশ্যি পৃথক করবেন। সূরা আলে ইমরান: ১৭৯
কুরআন, নামায, দাওয়াত ও জিহাদের চলমান খানকাসমূহে এবং দৌঁড়ে চলা স্কুলসমূহে শিক্ষা দিয়ে রাসূলে করীম (স) সেই দলটি তৈরী করেন, নিজ রবের সাথে যার সম্পর্ক ছিলো গভীর মহব্বত ও সহানুভূতির। নিজ দাওয়াত ও আন্দোলনের সাথে যার ছিলো অটুটু চিরস্থায়ী সম্পর্ক। যার জন্য দরদ ছিলো অন্তর তলদেশের গভীরতা থেকে উৎসারিত।
এরি সাথে তিনি কথার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন:
এক:
মনোবৃত্তিতে ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত সৃষ্টি করা। অর্থাৎ যা কিছুই করা হোক না কেন, তা করা হবে স্বীয় রবের জন্য। জীবনোদ্দেশ্য হবে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ। প্রতিটি পদক্ষেপ হবে লিওয়াজলিল্লাহ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
দুই:
সম্পদ কুরবানীর প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি করা। কাণ, মানুষের জন্য সম্পদের মোহের চেয়ে বড় কোনো ফিৎনা নেই। এ প্রেক্ষিতে নবী করীম (স) পৃথিবীতে অবস্থান করে অন্তরকে পৃথিবীর মুখাপেক্ষীহীন রাখার শিক্ষা দিয়েছেন। দুনিয়া কামাই ও দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হবার তাৎপতার পরিবর্তে দুনিয়াকে স্বল্প দিনের সামগ্রী এবং অহংকারের সামগ্রী হিসেবে অন্তরে চিত্রিত করার শিক্ষা দেন।
তৃতীয়ত:
জীবনের লক্ষ্য বিন্দুকে আখিরতের পুরষ্কারের উপর নিবদ্ধ করে দেন। একে প্রকৃত সত্যরূপে উপস্থাপন করেন। চলচিত্রের মধ্যে এর নকশা লোকদের চোখের সামনে ভাসতে থাকে। লোকেরা বুঝতে পারে এ-ই হচ্ছে সর্বোত্তম পাওয়ার বস্তু আর এ-ই হচ্ছে চিরস্থায়ী পাওয়া।
এ তিনটি জিনিস বুঝানোর জন্য একদিকে চেইনের মতো কুরআনের বিভিন্ন অংশ নাযিল হতে থাকে। অপর দিকে নবী করীম (স) এর মজলিসেও এ তিনটি জিনিসের আলোচানায় অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে থাকতো।
গ. পর্যবেক্ষণ ও ইহতেসাব:
একজন নেতা ও শিক্ষককে স্বীয় সাথী ও শাগরেদদের দুর্বলতা পদলঙ্খলন এবং ত্রুটি-বিচ্যুতিসমূহেরও সম্মুখীন হতে হয়। বিরাট বিরাট ভ্রান্তি ও অপরাধসমূহের সাথে নবী করীম (স) যেভাবে ক্ষমা ও দয়াশীল আচরণ করেছিলেন, তার আলোচনা তো সম্মুখে আসবে। কিন্তু এ প্রসংগেও তাঁর কোনো কোনো নীতি বড়ই মূল্যবান এবং সাংগঠনিক জীবনও সংশোধনের কাজে পরশ পাথরের ভূমিকা রাখে।
তিনি সাথীদের দুর্বলতা অনুসুন্ধান করে বেড়াতেন না। এ উদ্দেশ্য তিনি কোনো প্রকার গোয়েন্দা ব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠা করেননি। লোকদের দুর্বলতা ও দোষত্রুটি তাঁর দৃষ্টিতে না আসুক এবং লোকেরা নিজেরেই নিজেদের সংশোধন করে নিক, এ পদ্ধতিতেই তিনি যার পর নেই খুশী হতেন। লোকেরা নিজেদের (দীনি) ভাইদের ব্যাপারে তাঁর নিকট শেকায়েত করবে, এটাও তিনি নিষেধ করেছিলেন। তিনি বলে দিয়েছিলেন, কারো দোষত্রুটি যেনো তাঁকে অবহিত করা না হয়। নিজ সাথীধদর ব্যাপারে তিনি কখনো সন্দেহ-সংশয়ে নিমজ্জিত হতেন না। যতোক্ষন না কারো ব্যাপারে কোনো কথা স্পষ্ট প্রকাশ হতো, ততোক্ষণ তিনি তার ব্যাপারে সুধারণাই পোষণ করতেন। তাঁদের পিছনে কোনো মজলিসে তাদের বদনাম করতেন না।
অপরাধ ও ভুল-ভ্রান্তির কারণে কাউকেও তিরষ্কার ও অপমানিত করার তো প্রশ্নই উঠতো না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যই ছিলো মূলকথা। অতপর শুধুমাত্র গুনাহে নিমজ্জিত হতেন না। যতোক্ষণ না কারো ব্যাপারে কোনো কথা স্পষ্টপ্রকাশ হতো। ততোক্ষণ তিনি তার ব্যাপারে সুধারণাই পোষণ করতেন। তাঁদের পিছনে কোনো মজলিসে তাদের বদনাম করতেন না।
অপরাধ ও ভূল-ভ্রান্তির কারণে কাউকেও তিরষ্কার ও অপমানিত করার তো প্রশ্নই উঠতো না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যেই ছিলো মূলকথা। অতপর শুধুমাত্র গুনাহে নিমজ্জিত হবার ফলেই কোনো ব্যক্তিকে নিকৃষ্ট জ্ঞান করা হতো না।
এরপরও কোনো কিছু যদি তাঁর দৃষ্টিগোচর হতো, তার জন্য তিনি প্রয়োজনীয় নসীহত করতেন। পরম মহব্বতের সাথে তা করতেন এমতবস্থায় কোনো কিছুকে উপেক্ষা করলেও চরম বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারতো। সংশোধনের ব্যাপারে একটি মামুলী ঘটনায় তাঁর মহব্বত ও হিকমতের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখা যেতে পারে। একবার একব্যক্তি মসজিদে নববীতে এসে মসজিদে মেঝেতে দাঁড়িয়ে পেশাব করতে আরম্ভ করে। উপস্থিত লোকেরা তাকে বাধা দিয়ে বললেন: এখন প্রথমে তাকে পেশাব করা শেষ করতে দাও। অতপর সে যখন কার্য সম্পাদন করলো, তিনি তাকে কাছে ডেকে এনে বুঝালেন, এ হচ্ছে আল্লাহর ঘর, এটাকে নোংকা করা নিষেধ। অতপর সাহাবায়ে কিরামকে পানি ঢেলে দিয়ে পেশাব পরিষ্কার করার নির্দেশ দেন।
কারো কোনো ভুলত্রুটি জানতে পারলে কোনো মজলিসে তিনি তা আলোচনা করতেন না। তার নাম নিয়ে ঘটনা আলোচনা করতেন না। তাকে লজ্জিত করতেন না। বরঞ্চ সাধারণত এভাবে বলতেন: লোকদের কি হয়ে গেলো যে, তারা এরূপ করে……..।
তাঁর শিক্ষা তিরষ্কার এবং শাস্তি প্রদান যে সংশোধন ও ইহতেসাব থেকে খালি ছিলো, তা নয়। একবার একব্যক্তি উঁচু গম্বুজ তৈরী করে। তিনি তার সালামের জবাব দেয়া থেকে বিরত থাকেন। এমনকি তার সে গম্বুজ ভেঙে চূর্ণ করে দেন। আরেকবার একব্যক্তি আরকান আহকামের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে তড়িঘড়ি নামায পড়ছিলো। তিনি তাকেও সমালোচনার মাধ্যমে সংশোধন করেন। যেখানে দন্ড কার্যকর করা জরুরী ছিলো, তিনি সেখানে দন্ড কার্যকর করেন। তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে তিনজন সাহাবীর বিরুদ্ধে সামাজিক বয়কট কার্যকর করেন। কাফফারার পদ্ধতি চালু করেন। সদকা ও সম্পদ আদায় করার মাধ্যমেও পবিত্রতা পরিশুদ্ধির কাজ করেন।
কিন্তু তাঁর ইহতেসাব কোনো দারোগা কিংবা একনায়ক শাসকের ইহতেসাব ছিলো না। তিনি স্নেহময় পিতা ও শিক্ষকের মতোই সাথীদের দেখাশুনা ও পর্যবেক্ষণ করতেন। তাঁর মূল প্রচেষ্টা ও শিক্ষা সর্বদা এটাই ছিলো যে, লোকেরা যেনো নিজেরাই আত্মসমালোচনা করে। আল্লাহর সম্মুখে জবাবদিহি করতে হবে এ অনুভুতি জাগ্রত রাখে এবং প্রতিনিয়ত ইস্তেগফার করে। লোকেরা যখন তাঁর নিকট এসে নিজেদের ভুল স্বীকার করতো, তখনো তিনি তাদেরকে এদিকে ধাবিত করতেন এবং নিজেও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন:
তারা যদি পন্থা অবলম্বন করতো যে, যখনই তারা নিজেদের উপর যুলুম করে বসতো তখনই তোমার নিকট আসতো এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতো, তবে তারা অবশ্যি আল্লাহকে ক্ষমাশীল-অনুগ্রহকারী রূপে পেতো। সূরা আন নিসা: ৬৪
এভাবে তিনি তাদের ভুলত্রুটি দুর করতেন এবং আখিরাতে তাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা পাবার পথ খুলে দিতেন। কারণ, প্রকৃত পুরস্কার তো আখিরতের পুরস্কার এবং শাস্তি তো সেখানকার শাস্তি।
ঘ. যোগ্যতা ও সামার্থ অনুযায়ী আচরণ
নেতৃত্বদান ও শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে নবী করীম (স) এর দয়া ও মহব্বতের একটা দিন এও ছিলো যে, তিনি প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে তার যোগ্যতা ও সামর্থ অনুযায়ী ব্যবহার করতেন। তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে একাথার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন যে, যে লোকগুলো তাঁর সাথীত্ব গ্রহণ করেছে তারা সকলে একই ও একই প্রকারের লোক নয়। ঈমান ও আনুগত্যের দিক থেকেও তাদের মধ্যে রয়েছে বৈচিত্র। প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা কাজে সফলতা অর্জন করতে পারে। প্রত্যকেই আলাদা আলাদা কাজে সফলতা অর্জন করতে পারে। প্রত্যকের নিকট একই রকম দাবী করা যেতে পারে না। কারো উপর তার শক্তি সামর্থের অধিক বোঝা চাপানো তিনি পছন্দ করতেন না। মানবিক দুর্বলতার জন্য তিনি সাথীদের তিরষ্কার করতেন না। বরঞ্চ এর বাস্তবতাকে মেনে নিতেন।
এক ব্যক্তি তাঁর নিকট এসে জানতে চাইলো, ইসলামের দাবী কী? তিনি বললেন, শাহাদাত (অর্থাৎ তাওহীদ ও রেসালতের সাক্ষ্য প্রদান) এবং একবার হজ্জ করা। লোকটি জিজ্ঞস করলো: এ ছাড়া আর কিছু আছে কি? তিনি বললেন, না, আর কিছু নয়। লোকটি একথা বলতে বলতে চলে গেল: আমি এর চাইতে কমতিও করব না। বৃদ্ধিও করবো না। নবী করীম (স) সাথীদের লক্ষ্য করে বললেন: জান্নাতী মানুষ দেখতে চাইলে এ লোকটিকে দেখে নাও।
কিন্তু প্রত্যকের সাথেই তিনি এমনটি করেননি। কারো কাছ থেকে একথার বায়াত নেয়া হয় যে, তাঁর সাথে ঘরবাড়ী ত্যাগ করবে। কারো থেকে জান ও মাল বাজী রাখার ওয়াদা নেয়া হয়। কারো কাছ থেকে সওয়াল না করার প্রতিশ্রুতি নেয়া হয়। কারো নিকট দাবী করা হয় রাগ ও গোম্বা নিবারণের। কারো সম্পর্কে বলা হয় হিজরত না করলে মুমিনদের মধ্যে গণ্য হবে না। কারো সম্পর্কে বলা হয় যদিও সে নামায পড়ে রোযা রাখে এবং নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করে, কিন্তু কতিপয় অপরাধের জন্য সে আমাদের দলভুক্ত নয়। আবার কোথাও এতোটুকু বলাকেই যথেষ্ট মনে করা হয়েছে, যে ব্যক্তি আমাদের কিবলাকে কিবলা বানালো এবং আমাদের যবেহ করা পশু (গোশত) খেলো, সে আমাদের দলভুক্ত।
এরূপ কর্মপন্থার ফলেই বিভিন্ন ধরনের লোকেরা তাঁর সাথী হয়েছে। তাঁর সাথে চলেছে ঈমান, আমল যোগ্যতা ও সামর্থের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও প্রত্যেকেই সন্তুষ্ট ও আশ্বস্ত ছিলো যে, সে যা কিছু দিচ্ছে, তা কবুল করা হচ্ছে।
ঙ. কোমলতা ও সহজতা
তাঁর কোমলতার একটি উল্লেখযোগ্য দিক এ ছিলো যে, তিনি সাথীদের জন্য পরম হৃদয় অধিকারী ছিলেন। তাঁর পবিত্র হৃদয়ের অবস্থাতো এরূপ ছিলো যে, তাতে সত্য পথের সাথীদের জন্য কঠোরতা ও বল পেয়োগের লেশমাত্র ছিলো না। অপরদিকে তাঁর আচার-আচরণ, ব্যবহার-মুয়ামিলাত, কথাবার্তা এবং কর্মপদ্ধতি ছিলো না কোনো প্রকার কঠোরতা, অভদ্রতা এবং বদমেজাজী। এর ফলশ্রুতিতে যে-ই তাঁর নিকট এসেছে, তাঁর দলে শামিল হয়ে গেছে। তাঁর পদাংক ত্যাগ করেনি। তাঁর ইংগিত জান ও মাল কুরবানী করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। এর চিত্রে এঁকেছে কুরআন এভাবে-
(হে নবী!) এটা আল্লাহর বড় অনুগ্রের বিষয় যে, তুমি এসব লোকের জন্য খুবই নম্র স্বভাবের। অন্যথায় তুমি যদি উগ্রস্বভাব ও পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী হতে, তবে এসব লোক তোমার চারদিক থেকে সরে যেতো। সূরা আলে ইমরান: ১৫৯
রাসূলে করীম (স) এর কোমলতা, সহজতা ও ধীরতার ঘটনাবলী বেশুমার। এর উদাহরণ রয়েছে তাঁর দৈনন্দিন জীবনে, সাংগঠনিক জিন্দগীতে, সংগীন ও সংকটকালে, বন্ধুদের সাথে এবং শত্রুদের সাথেও।
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) বহু বছর তাঁর সান্নিধ্যে থেকে তাঁর খিদমত করেন। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল আমাকে না কখনো ধমক দিয়েছেন আর না তিরস্কার করেছেন। এমনকি এরূপ কেনো করলে এবং এরূপ কেন করলে না? এমনকটিও বলেননি কখনো। যে কোনো সাধারণ মুসলিম এমনকি একজন বৃদ্ধাও তাঁর পথচলা থামিয়ে দিতে পারতো। তিনি দাঁড়িয়ে পূর্ণ মনোযোগের সাথে তাঁর সব কথা শুনতেন। সমাধান করতেন তার সমস্যা। ঋণদাতা এসে গলার চাদর ধরে টানতো। তিনি মুচকি হেসে তাঁর অপরাধ উপেক্ষা করতেন। সাথীরা বাধা দিতে গেলে তিনি বলতেন, তাকে বলতে দাও, করতে দাও। কারণ তার অধিকার আছে।
লোকেরা তাঁর মজলিসে আসতো। সম্বোধন, সালাম এবং কথাবার্তায় ভাষার মারপ্যাঁচে তাঁকে গালি দিতো এবং নিন্দা করতো। কিন্তু তিনি যে শুধু এর জবাবই দিতেন না, তা নয়। বরঞ্চ তিনি এসব পুরোপুরি উপেক্ষা করতেন। যদি জবাব দিতেনও তবে এভাবে দিতেন, কেবল বদনিয়তের লোকরেই নিজেদের আমল দ্বারা অপরকে আঘাত দেয়। তার সাথে এরূপ আচরণ করত ইহুদী সরদার এবং আলেমরা। তারা আসসালামু আলাইকা কে আসসামু আলাইকা (তোমার মৃত্যু হোক) বানিয়ে ফেলতো। এর জবাবে নবী করীম (স) বলতেন, অ-আলাইকুম। হযরত আয়েশা (রা) তাদের এ বাক্যে চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি তাদের লক্ষ্য করে বললেন, মৃত্যু তাদের আসুক। তোদের উপরই পড়ুক আল্লাহর অভিশাপ। নবীপাক (স) বললেন, হে আয়াশা! মুখ খারাপ করা ও খারাপ কথা বলা আল্লাহ পছন্দ করেন না। হযরত আয়েশা (রা) বললেন, ওগো আল্লাহর রাসূল আপনি কি শুনতে পাননি। এ লোকগুলো কি বলেছে? তিনি বলেলেন, আর তুমি কি শুনেননি আমি তাদের কি জবাব দিয়েছি? আমি বলেছি তোমাদের উপরও। ১
তাঁর ধৈর্য ও সহনশীলতা ছিলো বিস্ময়কর। লোকেরা তাঁর মজলিসে তাঁর সাথে সাক্ষাতকালে, কথাবার্তায়, সর্বপ্রকার স্বাধীনতা ভোগ করতো। অশিক্ষিত লোকেরা তো ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের সীমা ছাড়িয়ে যেতো। এতে তিনি দারুণ মনোকষ্ট পেতেন। কিন্তু সব সয়ে যেতেন। ধৈর্যধারণ করতেন। কোনো কঠোর কিংবা অসৌজন্যমূলক কথা তাঁর পবিত্র জবান থেকে বের হতো না। এ ধরনের সকল অবস্থায় আল্লাহর পক্ষ থেকে অহী এসে লোকদের ভদ্রতা, শিষ্টাচার ও সৌজন্য শিক্ষা দিতো। লোকদের খাবার দাওয়াত দিতেন।
কেউ কেউ খাবার শেষ করে বসে থাকতো, গল্পগুজব করতো। এতে যে নবী পাকের কষ্ট হতো সেকাথার পরোয়াই তারা করতো না। এঅবস্থাকেও তিনি নীরবে বরদাশত করতেন। হযরত যয়নব (রা) এর বিবাহে উপলক্ষে অলীমা অনুষ্ঠান সম্পর্কে সহীহ মুসলিমে হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে রাতের বেলায় লোকদের অলীমার দাওয়াত দেয়া হয়। সাধারণ লোকেরা খাবার শেষ করে বিদায় হয়ে যায়। কিন্তু দুই তিন ব্যক্তি বসে বসে কথাবার্তা বলতে থাকে। মানোক্ষুণ্ণ হয়ে রাসূল (স) অন্যান্য বিবিদের হুজরা সমূহের দিক থেকে ঘুরে ফিরে আসেন। ঘুরে এসেও দেখতে পান, তারা বসেই আছে। তিনি ফিরে চলে যান। হযরত আয়েশার কক্ষে গিয়ে বসেন। রাতের বেশ কিছু অংশ অতিবাহিত হবার পর যখন জানতে পারলেন, তারা চলে গেছে, তখন তিনি হযরত যয়নবের কক্ষে তাশরীফ আনেন। (তাফহীমুল কুরআন, ৪র্থ খন্ড পৃ-১২০। মুসলিম, নাসাঈ ও ইবনে জারীর এর সূত্রে উদ্ধৃত) এ ঘটনার প্রেক্ষীতে আসমান থেকে হেদায়াত আসে।
কিন্তু তোমাদের খাওয়া হয়ে গেল চলে যাও। কথায় মশগুল হয়ে বসো না। তোমাদের এ ধরনের আচরণ নবীকে কষ্ট দেয়। কিন্তু সে লজ্জায় কিছুই বলে না। আর আল্লাহ সত্য কথা বলতে লজ্জাবোধ করেন না। সূরা আল আহযাব:৫৩
এমনি করে কোনো কোনো লোক সময় অসময় সাক্ষাতের জন্য এসে হুজুরের হুজরার পাশে গিয়ে তাঁকে ডাকাডাকি করতো। এতে তিনি খুবই কষ্ট পেতেন। কিন্তু মহত ব্যক্তিত্বের কারণে এ আচরণকেও তিনি সহ্য করতেন।
মাওলানা মওদূদী লেখেন:
নবী করীম (স) এর সাহচর্যে থেকে যেসব লোক ইসলামী নিয়মনীতি ও আদব কায়দার প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন, তাঁরা তার সময়ের প্রতি সবসময়ই লক্ষ্য রাখতেন। তিনি আল্লাহ তাআলার দীনের কাজে কতোখানি ব্যস্ত জীবনযাপন করেন, সে বিষয়ে তাঁরা বুঝতেন, রাসূলে করীম (স) কে শ্রন্ত-ক্লান্ত্রকারী এসব কঠিন ব্যস্ততার মধ্যে কিছুটা তাঁর আরাম ও বিশ্রামের জন্যে কিছু সময় তাঁর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যস্ততার জন্য এবং কিছুটা সময় তাঁর পারিবারিক জীবনের কাজকর্ম সম্পাদনের জন্য অতিবাহিত হওয়া আবশ্যক। কিন্তু অনেক সময় এমন সব অভদ্র ও শালীনতাবর্জিত অসামাজিক লোকও তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য এসে উপস্থিত হতো, যাদের ধারণা ছিলো আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়ার ও সমাজ সংস্কারের কাজকর্ম যারা করে তাদের একটু সময় বিশ্রাম গ্রহণেরও প্রয়োজন নেই। অতএব দিনরাত যখন ইচ্ছা তাদের নিকট এসে উপস্থিত হবে, তখনই তাদের সাথে সাক্ষাত দিতে অবশ্যি প্রস্তুত থাকেত হবে। এ মনোভাবের লোকদের মধ্যে সাধারণত এবং আরবের বিভিন্ন দিক থেকে আগত লোকদের মধ্যে বিশেষভাবে কোনো কোনো লোক এতোটা অভদ্র ও অশালীন হতো, যারা রাসূলে করীমের সাথে সাক্ষাতের জন্য এসে কোনো খাদেমের মাধ্যমে ভিতরে খবর পাঠাবার কষ্টটুকু স্বীকার করতেও প্রস্তুত হতো না। বররঞ্চ তারা নবী বেগমদের কক্ষ্যসমূহের চারদিকে ঘোরাঘুরি করে বাইরে থেকেই নবী করীম (স) কে ডাকাডাকি করতে থাকতো।
(হে নবী!) যে সব লোক তোমাকে হুজরার বা্ডিএর থেকে ডাকাডাকি করে, তাদের মধ্যে অধিকাংশই নির্বোধ। তোমার বাইরে আসা পর্যন্ত যদি তারা ধৈর্যধারণ করতো, তবে এটা তাদের জন্যই ভালো ছিলো। আল্লাহ তো ক্ষমাশীল এবং করুণাময়। সূরা আল হুজরাত: ৪-৫
আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ আসলামীর বর্ণনানুযায়ী কোনো কোনো লোক এমন ছিলো যে, নবী করীম (স) এর মজলিসে দীর্ঘক্ষণ ধরে বসে থাকতো। তারা সর্বশেষ সময়টি পর্যন্ত বসে থাকার চেষ্টা করতো। এতে অনেক সময় নবী করীম (স) এর কষ্ট হতো। এতে তাঁর বিশ্রাম এবং কাজ কর্মে ব্যাঘাত ঘটতো।১ কিন্তু নবী করীম (স) এর ব্যক্তিত্ব, সহনশীলতা ও চারিতিক বৈশিষ্ট্য এসব কিছুকে নীরবে সয়ে যেতো। এমনি করে নবী করীম (স) একদিকে তো প্রত্যেক মুসলমানের সাহায্য ও প্রয়োজন পূরণে সর্বক্ষণ উপস্থিত থাকতেন। এমনকি এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য ছিলো, কোনো মুসলমানের সাহায্য ও প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য এক ঘন্টা সময় ব্যয় করা আমার মসজিদে দুইমাস ইতেকাফ কারা চেয়েও আমার নিকট বেশী প্রিয়। অপরদিকে অত্যন্ত মনোযোগের সাথে তিনি প্রত্যেকটি লোকের কথা শ্রবণ করতেন। কেউ তাঁর সাথে একান্তে কথা বলতে ইচ্ছা করলে তার ইচ্ছাও পূর্ণ করতেন। বিন্দুমাত্র বিরক্ত হতেন না। সাধারণত তিনি মুসলমানদের কথায় বিশ্বাস রাখতেন। এরূপ নরম ও সহজ স্বভাবের জন্য মুনাফিকরা তাকে দোষারোপ করতো। তারা বলতো, লোকটি বড় কান কাঁচা। যার ইচ্ছা হয়, তাঁর নিকটই উপস্থিত হয় এবং সে যা ইচ্ছা কথাবার্তা বলে তার কান ভরে দেয় এবং তিনি তার কথা বিশ্বাস করেন।
এদের মধ্যে কিছু লোক আছে, যারা নিজেদের কথাবার্তা দ্বারা নবীকে কষ্ট দেয়। তারা বলে, এই ব্যক্তি বড় কান কথা শুনে। বলো: তিনিতো তোমাদের ভালোর জন্যই এরূপ করেন। আল্লহর প্রতি তিনি ঈমান রাখেন এবং ঈমানদার লোকদের প্রতি বিশ্বাস রাখেন। তিনি তাদের জন্য রহমতের পূর্ণ প্রতীক, যারা তোমাদের মধ্যে ঈমানদার। সূরা আত তাওবা: ৬১
এটাও তাঁর অতিশয় রহমদিল ও অনুগ্রহশীল হবারই ফলশ্রুতি যে, লোকেরা কেউ বড়াই করার জন্য কেউ গুরুত্বহীন প্রয়োজনে, আবার কেউ বাস্তবিকই গুরুত্বপূর্ণ কারণে তাঁর সাথে একান্তে কাথাবার্তা বলতো চাইতো। যায়েদ ইবনে আসলামী বলেন: যে লোকই গোপনে একাকীত্বে নবী করীম (স) এর সাথে কথা বলার আবেদন জানাতো তিনি তাকেই সুযোগ দিতেন। কাউকেও বঞ্চিত করতেন না। ফলে যারই ইচ্ছা হতো এসে বলতো, আমি একটু একান্তে কথা বলতে চাই, তিনি তখনই তার ব্যবস্থা করতেন। এমনকি অনেক লোক এমনসব কথার জন্যও একাকীত্বের দাবী করে তাঁকে কষ্ট দিতো, যে জন্য একাকীত্বের আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিলো না।১ এ অবস্থার প্রেক্ষিতে এক সময় তো আল্লাহ তাআলা নির্দেশই দিয়ে দেন যে, কেউ একাকীত্বে নবীর সাথে কথা বলতে চাইলে প্রথমে নবীকে উপটৌকন দিতে হবে। অবশ্য ও নির্দেশ সহসাই মনসূখ করা যায়। কিন্তু এতে নবী করীম (স) এর পরম কোমলতার ছবি অংকিত হয়ে যায় এবং শিক্ষাদানের কাজও পূর্ণ হয়।
সাধারণ দৈনন্দিন জীবন এবং ব্যক্তিগত সামাজিক যিন্দেগী থেকে অগ্রসর হয়ে আন্দোলনের বিভিন্ন সংকটময় অবস্থা ও কার্যক্রমে এবং তাঁর কোমলতা ও সহজতা সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে নিতো। চাই তা নিষ্ঠাবান সাথীদের দুর্বলতা ও ভুলভ্রান্তি হোক, কিংবা হোক তা মুনাফিকদের তৎপরতা। সূরা আলে ইমরানের যে আয়াতটিতে তাঁর কোমলতাকে রহমত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, তা নাযিল হয়েছিলো উহুদ যুদ্ধের প্রাক্কালে। তখন অবস্থা এরকম ছিলো যে, মুনাফিকদের দল সর্বপ্রথরে তাঁকে এবং তাঁর জামায়াতকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে কোনো প্রকার ত্রুটি করেনি। অপরদিকে মুমিনদের একটি গ্রুপও দুনিয়ার লোভে তাঁর নির্দেশ লংঘন করে বসে। অর্জন করা বিজয় হাতছাড়া হয়ে যায়। এ সময় যদি তিনি মুনাফিকদের সাথে কঠোর আচরণ করতেন, তাদের শাস্তি প্রদান করতেন এবং দোষী মুমিনদের প্রতি কঠোর হতেন, তবে রাজনৈতিক দৃষ্টকোণ থেকে সম্পূর্ণ সঠিক ও যথার্থ হতো সন্দেহ নেই।কিন্তু একটি গ্রুপের অপরাধকে তিনি গুরুত্বই দেননি, বরঞ্চ উপেক্ষা করেন। এতে করে শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যকার বিরাট সংখ্যক লোক নিষ্ঠাবান হয়ে যায়। আরেকটি দলকে তিনি ক্ষমা করে দেন এবং আল্লাহও তাদের ক্ষমা করে দেন। শেষ পর্যন্ত এরা ইসলামের প্রাণোৎসর্গকারী সৈনিক বলে প্রমাণিত হয়। সাজা ও কঠোরতার নীতি অবলম্বন করলে তো তারা দলছুট হয়ে যেতো। বস্তুত তাদের আল্লাহর নাফরমানীর পথে বেরিয়ে যাওয়াও একজন পথপ্রদর্শকের ত্রুটি বলে নগণ্য হতো এবং তাদের বিপথগামী হয়ে যাওয়াটা তাঁর দল ও সংগঠনের জন্যও ক্ষতিকর হতো:
বলতো, আমি একটু একান্তে কথা বলতে চাই,তিনি কখনই তার ব্যবস্থা করতেন। এমনকি অনেক লোক এমনসব কথার জন্যও একাকীত্বের দাবী করে তাঁকে কষ্ট দিতো, যে জন্য একাকীত্বের আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিলো না।১এ অবস্থার প্রেক্ষিতে এক সময় তো আল্লাহ তাআলা নির্দেশই দিয়ে দেন যে, কেউ একাকীত্বের নবীর সাথে কথা বলতে চাইলে মনসূখ করা হয়। কিন্তু এতে নবী করীম (স) এর পরম কোমলতার ছবি অংকিত হয়ে যায় এবং শিক্ষাদানের কাজও পূর্ণ হয়।
সাধারণ দৈনন্দিন জীবন এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক যিন্দেগী থেকে অগ্রসার হয়ে আন্দোলনের বিভিন্ন সংকটময় অবস্থা ও কার্যক্রমে এবং তাঁর কোমলতা ও সহজতা সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে নিতো। চাই তো নিষ্ঠাবান সাথীদের দুর্বলতা ও ভুলভ্রান্তি হোক, কিংবা হোক তা মুনাফিকদের তাৎপরতা। সূরা আলে ইমরানের যে আয়াতটিতে তাঁর কোমলতাকে রহমত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, তা নাযিল হয়েছিলো উহুদ যুদ্ধের প্রাক্কালে। তখন অবস্থা এরকম ছিলো যে, মুনাফিকদের দল সর্বপ্রকারে তাঁকে এবং তাঁর জামায়াতকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে কোনো প্রকার ত্রুটি করেনি। অপরদিকে মুমিনদের একটি গ্রুপও দুনিয়ার লোভে তাঁর নির্দেশ লংঘন করে বসে। অর্জন করা বিজয় হাতাছাড়া হয়ে যায়। এসময় যদি তিনি মুনাফিকদের সাথে কঠোর আচরণ করতেন,তাদের শাস্তি প্রদান করতেন এবং দোষী মুমিনদের প্রতি কঠোর হতেন, তবে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ সঠিক ও যথার্থ হতো সন্দেহ নেই। কিন্তু একটি গ্রুপের অপরাধকে তিনি গুরুত্বেই দেননি, বরঞ্চ উপক্ষে করেন। এতে করে শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যকার বিরাট সংখ্যক লোক নিষ্ঠাবান হয়ে যায়। আরেকটি দলকে তিনি ক্ষমা করে দেন। শেষ পর্যন্ত এরা ইসলামের প্রাণোৎসর্গকারী সৈনিক বলে প্রমাণিত হয়। সাজা ও কঠোরতার নীতি অবলম্বন করলে তো তারা দলছুট হয়ে যেতো। বস্তুত তাদের আল্লাহর নাফরমানীর পথে বেরিয়ে যাওয়াও একজন পথপ্রদর্শকের ত্রুটি বলে নগণ্য হতো এবং তাদের বিপথগামী হয়ে যাওয়াটা তাঁর দল ও সংগঠনের জন্যও ক্ষতিকর হতো:
কিন্তু তোমরা যখন দুর্বলতা প্রদর্শন করলে এবং নিজদের কাজে পরস্পর মতপার্থক্য করলে এবং যখনি আল্লাহ তোমাদের সেই জিনিস দেখালেন যার ভালোবাসায় তোমরা বাঁধা ছিলে (অর্থাৎ গণীমেতরে মাল) তখন তোমরা তোমাদের নেতার আদেশের বিরোধিতা করে বসলে। কেননা তোমাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক লোক ছিলো দুনিয়ার (স্বার্থের) সন্ধানকারী। তখন আল্লাহ তাআলা কাফেরদের মুকাবিলায় তোমাদের পশ্চাদবর্তী করে দিলেন, যাতে করে তিনি তোমাদের যাচাই পরীক্ষা করতে পারেন। আর সত্য কথা হলো, এতোদত্ত্বেও আল্লাহ তোমাদের ক্ষমাই করলেন, কেননা ঈমানদের লোকদের প্রতি আল্লাহ তাআলা বড়ই অনুগ্রহের দৃষ্টি রেখে থাকেন। সূরা আলে ইমরান: ১৫২
তোমাদের মধ্যে যারা মুকাবিলার দিন পিছনে ফিরে গিয়েছিলো, এর কারণ এই ছিলো যে, তাদের কোনো দুর্বলতার সুযোগে শয়তান তাদের পদল্থন ঘটিয়েছিলো। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। বস্তুত আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, ধৈর্যধারণকারী। সূরা আলে ইমরান: ১৫৫
ইসলামী আন্দোলনকে যে নাজুক ও সংকটময় অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো, তার প্রেক্ষিতে একথা আবশীকীয় করে দেয়া হয় যে, দলীয় কাজকর্ম বিশেষ করে জিহাদ থেকে নিজে নিজেই কেউ বসে পড়তে পারবে না। যতোক্ষণ না নবী করীম (স) এর নিকট থেকে অনুমতি গ্রহণ করবে। আর অনুমতি দেয়া বা না দেয়ার এখতিয়ার তাঁকে দিয়ে দেয়া হয়েছিলো:
মুমিন মূলতই তারা, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অন্তর থেকে মেনে নেয়। আর কোনো সামষ্টিক কাজে যখন তারা রাসূলের সাথে একত্রিত হয় তখন তারা তাঁর অনুমতি না নিয়ে চলে যায় না। (হে নবী!) যেসব লোক তোমার নিকট অনুমতি চায়,তারাই আল্লাহ ও রাসূলকে মানে। অতএব তারা যখন নিজেদের কোনো কাজের কারণে অনুমতি চাইবে তখন তুমি যাকে ইচ্ছা অনুমতি দান করো। আর এই ধরনের লোকদের জন্য আল্লাহর নিকট মাগফিরাতের দোয়া করো: সূরা আন নূর: ৬২
কিন্তু তাঁর নীতি এই ছিলো যে, তিনি লোকদের সর্বপ্রকার ওযর কবুল করতেন। সত্যিকার ওযরসমূহ তো স্পষ্টই ছিলো। জিহাদের পূর্বে কিংবা পরে মুনাফিকরা যেসব ওযর পেশ করতো, তিনি সেগুলো কবুল করে নিতেন। অনুপুস্থিত থাকার অনুমতি দিয়ে দিতেন, কিংবা তাদের তৎপরতাকে ক্ষমা বা উপেক্ষা করতেন। কুরআন মজীদ পরম মহব্বত ও স্নেহশীল বাক্যের তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং সাথে সাথে দয়া ও কোমলতার ছবি তুলে দিয়েছে।
(হে নবী!) আল্লাহ তোমায় ক্ষমা করুন। তুমি কেন এই লোকদের বিরত থাকার অনুমতি দিলে? সূরা আত তাওবা: ৪৩
মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহী লিখেছেন, লোকদের দোষত্রুটি উপেক্ষা করা মহৎ ব্যক্তিত্বের এক আবশ্যকীয় দাবী। নবী করীম (স) যেমনিভাবে সর্বপ্রকার শ্রেষ্ঠগুণ বৈশিষ্ট্যর প্রতীক ছিলেন, তেমনি করে লোকদের দোষত্রুটি উপেক্ষা করার গুণটি তাঁর মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বর্তমান ছিলো। মুনাফিকরা তাঁর ব্যক্তিত্বের এ মহত্ব থেকে অবৈধ ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করতো। দীনি কর্তব্য,বিশেষ করে জিহাদের দায়িত্ব থেকে সরে থাকার জন্য তারা তাঁর খেদমতে নানা ধরনের মিথ্যা ওযর পেশ করে ঘরে বসে থাকার অনুমতি প্রার্থনা করতো। নবী করীম (স)এসব মনগড়া ওযর সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত থাকতেন। কিন্তু পরম অনুগ্রহ ও দয়াশীলতার কারণে তিনি তাদের মাফ করে দিতেন এবং অনুমতি প্রদান করতেন।
সতর্কীকরণের ভাষা কতইনা সান্ত্বনাদায়ক। কথার সূচনাই করা হয়েছে ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে অর্থাৎ একথা পরিষ্কার করে দেয়া হচ্ছে যে, তিরস্কার করা উদ্দেশ্য নয়। বরঞ্চ দৃষ্টি আকর্ষণই উদ্দেশ্য।১
কোনো কোনো মুনাফিকের দুশমনি যখন স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছিলো তখনো তিনি তাদের সাথে ধৈর্য, সহশীলতা এবংক্ষমা ও হিকমতের আচরণ করেন। বিশেষ করে মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর সাথে তিনি যে মহৎ ও কোমল আচরণ অবলম্বন করেছিলেন, তাতে নেতৃত্বের ব্যাপারে বহু মূল্যবান শিক্ষা নিহিত রয়েছে।
ঘটনা খুবই দীর্ঘ। কিন্তু বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। সকল প্রকার শত্রুতা-অসততা, ষড়যন্ত্র ও গাদ্দারীর পর ৬ষ্ঠ হিজরীতে বনুল মুস্তালিক যুদ্ধের প্রাক্কালে সে এমন একটি ফিতনা সৃষ্টি করে যা মুসলিমদের সংগঠনকে টুকরো টুকরো করে দিতে পারতো। একদিকে সে আনসার ও মুহাজিরদের সাথে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে যে, মদীনায় পৌঁছে নবী পাকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সে বলে, নিজের কুকুর খাইয়ে পরিয়ে মোটাতাজা করেছ তোমাকেই ছিন্নভিন্ন করার উদ্দেশ্য। এ উপমাটা আমাদের ও এ কুরাইশ কাংগালদের [মুহাম্মদ (স) এর সাহাবীদের] ব্যাপারে হুবহু খেটে যায়। তোমরাই তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করো। হাত গুটিয়ে নাও। তখন এরা ছিন্নমূল হয়ে পড়বে আল্লাহর শপথ! মদীনায় পৌঁছার পর আমাদের সম্মানিত পক্ষহীন লাঞ্চিত পক্ষকে বহিষ্কৃত করবে।
নওজোয়ান আনসার সাহাবী হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম এ ঘটনার রিপোর্ট রাসূলে করীম (স) এর নিকট পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই সুস্পষ্ট ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। হযরত উমার (রা) তার গর্দান দ্বিখন্ডিত করে দেয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু নবীপাক বললেন: না তা করো না। লোকেরা বলবে, মুহাম্মদ নিজেই তার সাথীদের হত্যা করেছে। তাঁর এই কর্মকৌশলের ফলশ্রুতি এই দাঁড়ায় যে, সকল আনসার আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর বিরুদ্ধে গোস্বায় ফেটে পড়ে। এমনকি শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো, কাফেলা যখন মদীনায় প্রবেশ করছিলো, তখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাইরই পুত্র হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই নগ্ন তরবারি উত্তোলিত করে বাবার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলেন, আপনি বলেছিলেন মদীনা পৌঁছে সম্মানিতরা অসম্মানিতদের বহিষ্কৃত করবে। কিন্তু সম্মানিত আপনি, না আল্লাহ ও তাঁর রসূল তা আপনি এখনি জানতে পারবেন। আল্লাহর কসম! আল্লাহর রসূল অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত আপনি মদীনায় প্রবেশ করতে পারবেন না। অতপর রাসূলের অনুমতি পেয়ে হযরত আবদুল্লাহ (রা) তার পথ ছেড়ে দেন এবং তরবারি কোষবদ্ধ করেন। অতপর আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মদীনায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়।
এসময় আল্লাহ তাআলা এ ফরমান নাযিল করেন যে, এ ধরনের মুনাফিকদের জন্য ক্ষমা নেই। অবশ্য নবী করীম (স) তাঁর পরম দয়াশীলতার কারণে এদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।১ অতপর তাবুক যুদ্ধের প্রাক্কালে আল্লাহ তাআলা আরো কঠোরভাবে জানিয়ে দেন যে, হে নবী! আপনি এদের জন্য সত্তরবার ক্ষমা চাইলেও এ ধরনের খোদার দুশমনদের ক্ষমা করা হবে না:
হে নবী! তুমি এই লোকদের জন্য ক্ষমা চাও বা না চাও, এমনকি সত্তর বারও যদি এদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো, তবু আল্লাহ কিছুতেই ওদের ক্ষমা করবেন না। সূরা আত তাওবা: ৮০
মাওলানা আমীন আহসান ইলাহী লিখেছেন:
নবী করীম (স) ছিলেন দয়া, অনুগ্রহ ও করুণার মূর্তপ্র্রতীক এ কারণেই সকল শত্রুরা ষড়যন্ত্র, ফিতনা ফাসাদ করা সত্ত্বেও মুনাফিকদের সংশোধন ও নাজাত তাঁর নিকট এতোটা প্রিয় ছিলো। যেমন গোটা উম্মাতের জন্য প্রতিনিয়ত তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করতেন, তেমনি করে তাদের জন্যও নাজাতের দোয়া করতেন। ২
এমনকি আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর মতো মুনাফিকের যখন মৃত্যু হয় তখনো তার প্রতি তাঁর দয়া ও করুণার সীমা ছিলো না। তার পুত্র হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ছিলেন একজন খাঁটি মুসলিম। তিনি নবী পাকের খেদমতে হাজির হয়ে পিতার কাফনের জন্য তাঁর জামাটি প্রার্থনা করেন। তিনি পরম, উদরতার সাথে তা প্রদান করেন। অতপর হযরত আবদুল্লাহ পিতার জানাযা পড়নোর জন্য তাঁকে অনুরোধ করেন। তিনি জানাযা পড়ানোর জন্য যেতে প্রস্তুত হয়ে যান। হযরত উমার বারবার বলছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি এমন এক ব্যক্তির জানাযা পড়বেন যে এই করছিলো? কিন্তু কথা শুনে নবীপাক (স) মুচকি হাসছিলেন এবং নিজের সে পরম দয়া ও করুণার কারণে যা দোস্ত ও দুশমন সকলেরই জন্য নিবেদিত ছিলো, তিনি এই নিকৃষ্টতম শত্রুর জন্য দোয়া করতে দ্বিধা করেননি।১
অবশেষে তিনি যখন জানাযায় দাঁড়িয়ে যান তখন এই আয়াতটি নাযিল হয়:২
আর ভবিষ্যতে তাদের কোনো লোকের মৃত্যু হলে তার জানাযা তুমি কখনো পড়বে না। আর তার কবরের পাশেও দাঁড়াবে না। কেননা তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কুফরী করেছে এবং ফাসিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। সূরা আত তাওবা: ৮৪
চ. ক্ষমা ও মার্জনা:
বন্ধু ও শত্রু নির্বিশেষে সকলের জন্য তাঁর দয়া ও ক্ষমার আচরণ ছিলো। তাতেও তাঁর অনুগ্রহশীলতাই প্রকাশিত। তাঁর কোমলতার কথা উল্লেখ করার পরপরই এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। স্বভাবের এক বিস্ময়কর দিক হচ্ছে যে, অনেক সময় শত্রুকে ক্ষমা করে দেয়া তার জন্যে সহজ। কিন্তু আপনজ ও পিয়জনকে ক্ষমা করাটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। নবী পাকের এ গুনটিও সকলেরই জন্য ছিলো সমান। শত্রুদের ক্ষমা করে দেয়ার আলোচনা তো আগেই করেছি। আপন লোকেরা নৈতিক ও আইনগত কোনো ভুলত্রুটির জন্য তাঁর আচরণ এর চেয়ে ভিন্নতর ছিলো না।
হযরত হাতিব ইবনে আবু বালতায়ার ঘটনা খুবই মশহুর। কুরাইশের লোকেরা যখন হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি ভংগ করে বসলো, তখন নবী করীম (স) মক্কার উপর আক্রমণ করার প্রস্তুতি শুরু করেন। কিন্তু তিনি কোথায় অভিযান চালাতে চান, তা কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবী ছাড়া আর কাউকে জানানি। ঘটনাবশত সে সময় বনু আবদুল মুত্তালিবের এক দাসী আর্থিক সাহায্যের জন্য মদীনা আসে। সে মক্কায় ফিরে যাবার সময় হযরত হাতিব (রা) তার সাথে সাক্ষাত করেন এবং কতিপয় কাফির সরদারের নামে লিখিত একখানা চিঠি সংগোপনে তার কাছে দেন। আর সে যাতে এ গোপন তথ্য প্রকাশ না করে এবং চুপোচাপে চিঠিটি সংশ্লিষ্ট লোকদের কাছে পৌঁছে দেয়, সেজন্য তাকে দশটি দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) দিয়ে দেন। স্ত্রীলোকটি মদীনা ইবনে আসওয়াদ (রা) কে তার পিছে পাঠিয়ে দেন…..।
(তাঁরা চিঠিটি উদ্ধার করে নিয়ে আসেন) এবং নবী করীম (স) এর খিদমতে তা হাজির করেন। চিঠি খুলে পড়া হলো। দেখা গেলো, তাতে কুরাইশদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, নবী করীম (স) তোমাদের আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। রাসূলে পাক (স) হযরত হাতিবকে জিজ্ঞেস করলেন, হে হাতিব! এ কেমন কাজ? তিনি বললেন, আমার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আপনি তাড়াহুড়া করবেন না। আমি যা কিছু করেছি, তা এজন্যে, তা এজন্যে করিনি যে, আমি কাফির ও মুরতাদ হয়ে গেছি এবং ইসলামকে বাদ দিয়ে এখন কুফরকে পছন্দ করতে শুরু করেছি। আসল ব্যাপার হলো আমার স্ত্রী-পুত্র পরিজন মক্কায় অবস্থান করছে। আমি কুরাইশ বংশের লোক নই। কয়েকজন কুরাইশ বংশীয় লোকের পৃষ্ঠপোষকতায় আমি সেখানে বসবাস করতাম মাত্র। অন্যান্য মুহাজিরদের পরিবার পরিজনও সেখানে আছে বটে, কিন্তু আশা করা যায় তাদের গোত্রের লোকেরাই তাদের রক্ষা করবে। কিন্তু আমার কোনো গোত্র সেখানে নেই। ফলে আমার পরিবার পরিজনের লোকদের রক্ষা করারও কেউ সেখানে নেই। এ কারণে আমি টিঠিটি সেখানে পাঠিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এতে করে কুরাইশদের প্রতি আমার একটা অনুগ্রহ থাকবে এবং এ কারণে তারা আমার লোকজনকে অসুবিধায় ফেলবে না……।
রাসূলে করীম (স) হযরত হাতিবের বক্তব্য শুনে বললেন, হাতিব তোমাদের নিকট সত্য কথাই বলেছে অর্থ্যাৎ এ কাজের প্রকৃতি কারণ এটাই, ইসলাম পরিত্যাগ ও কুফরীর সাহায্য সহযোগিতা মানসে তিনি এমনটি করেনি। হযরত উমর ফারুক দাঁড়িয়ে বললেন, আমাকে অনুমতি দিন, আমি এই মুনাফিকের গর্দান দ্বিখন্ডিত করে দিই। সে আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। নবী করীম (স) বললেন, এই ব্যক্তি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ কারীদের সম্বোধন করে বলে দিয়েছি। ..একথা শুনে উমর (রা) কেঁদে ফেলেন এবং বললেন আল্লাহ এবং রাসূলই সর্বাপেক্ষা বেশী জানেন। ১
মৌলিক কথা ছিলো এই যে, কে নিজের লোক এবং কার কর্ম-তৎপরতার রেকর্ড কি? বুনিয়াদী দিক থেকে যে নিজের লোক আনুগত্যকারী এবং আন্তরিকতা সম্পন্ন, তার জীবন মূলত আনুগত্যের জীবন। সে বড় কোনো ভুল করলেও যা যে কোনো আইনের দিক থেকে গাদ্দারীর সংজ্ঞায় পড়ে, দয়া ও কোমলতা লাভের অধিকারীই থাকে। তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে কিনা তা নির্ভর করবে সাংগঠনিক অবস্থার উপর। কিন্তু শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে ক্ষমা করে দেয়া এবং পাকড়াও করার পরিবর্তে ছেড়ে দেয়া অধিকতর উত্তম ও শাস্তি বিধানের ক্ষেত্রে ছিলেন খুবই কোমল ও দয়ার অধিকারী। আর ক্ষমা করে দেয়ার ব্যাপারে ছিলেন মহান উদার।
ছ. পরামর্শ:
কোমলতা ও ক্ষমার কথা আলোচনার পরপরই কুরআন তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আর একটি দিক উন্মুক্ত করে। আর তা হচ্ছে এই যে তিনি আন্দোলনের সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্র সাথীদের শরীক রাখতেন, তাদের সাথে পরামর্শ করতেন। তাঁর জীবন ছিলো ওয়া শা-বিরহুম ফীল আমর এর বাস্তব সাক্ষ্য। ব্যাপার এমন ছিলো না যে, তিনি পরামর্শ গ্রহণের মুখাপেক্ষী ছিলেন। একদিকে তিনি অহীর মাধ্যমে পথনির্দেশ লাভ করেছিলেন। অপরদিকে তাঁর সীনা সুবারক ছিলো ইলম ও ফায়সালা গ্রহণের সঠিক যোগ্যতা ক্ষমতার (ইলম ও হিকমতের) নূরে পরিপূর্ণ। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, কোনো দল ততোক্ষণ পর্যন্ত শক্তি লাভে সক্ষম হতে পারে না। যতোক্ষণ না তার সদস্যগণ সিন্ধান্ত গ্রহণে শরীক হবে। একথার প্রমাণ হিসেবে তাঁর জীবন থেকে অসংখ্য ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। আমরা এখানে মাত্র কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা উল্লেখ করছি।
মদীনায় তাশরীফ আনার পর বদর যুদ্ধের ঘটনা ছিলো তাঁর প্রথম সংকটজনক ঘটনা। শক্তিতে দুর্বল, সংখ্যায় নগণ্য এবং সওয়ারী না থাকার মতো। মুহাজিরগণ নিজেদের ঘরদোর ত্যাগ করে এখানে আসেন। আনসারদের এ বাইয়াত হয়েছিলো যে, শত্রু হামলা করলে তারা জীবন বাজী রেখে লড়াই করবে। এখন একদিকে ছিলো যে, কুরাইশের বাণিজ্য কাফেলা। অপরদিকে কুরাইশদের সুসজ্জিত সশস্ত্র বাহিনী, দাওয়াত ও আন্দোলনের দীর্ঘ কর্মকৌশলের দাবী তখন এই ছিলো যে, কুরাইশের সশস্ত্র বাহিনীর সাথে লড়াই করে তাদের শক্তি খর্ব করে দেয়া হবে। স্বয়ং আল্লাহর ইচ্ছাও এটাই ছিলো। তিনি যদি নিজের সিদ্ধান্তে জানিয়ে এরূপ নির্দেশ দিতেন, তবু সাহাবায়ে কিরাম তাঁর নির্দেশ পালনে সামান্যতম ত্রুটি করত না। কিন্তু তিনি মুহাজির ও আনসারদের ডেকে একত্র করেন। সমস্যা তাদের সম্মুখে তুলে ধরেন। মুহাজিরদের মধ্যে থেকে হযরত মিকদাদ ইবনে আমর আরয করেন, হে আল্লাহর রাসূল! যেদিকে আপনার রব আপনাকে নির্দেশ দিয়েছেন, আপনি সেদিকে চলুন আমরা আপনার সাথে রয়েছি। আমরা বনী ইসরাঈলের মতো একথা বলব না যাও তুমি আর তোমার রব লড়াই করো, আমরা এখানে বসে থাকবো। বরঞ্চ আমরা বলছি: চলুন, আপনি এবং আপনার রব লড়াই করুন আমরাও আপনার সাথে রয়েছি। আমাদের একজন লোক জীবিত থাকা পর্যন্ত আমরা যুদ্ধে আপনার সাথে শরীক থাকবো। নবী করীম (স) এতেও ফায়সালা ঘোষণা করলেন না।আনসারদের বক্তব্য শুনার অপেক্ষা করলেন।
অতপর আনসারদের মধ্যে থেকে হযরত সাআদ বিন ময়ায (রা) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! যা কিছু আপনার সিদ্ধান্ত তাই করুন। কসম সেই সত্তার যিনি সত্য সহকারে আপনাকে প্রেরণ করেছেন। আপনি যদি আমাদের নিয়ে সম্মুখের সমুদ্র তীরে উপনীত হন এবং তাতে নেমে পড়েন, আমরা অবশ্যি আপনার সাথে থাকবো। আমাদের একজন লোকও পিছে থেকে যাবে না। অতপর রাসূল (স) এর মুখমন্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠে এবং তিনি সশস্ত্র বাহিনীর সাথে মুকাবিলার কথা ঘোষণা করেন।
উহুদের যুদ্ধের (তয় হিজরী) প্রাক্কালে যখন প্রশ্ন দেখা দিলো শহরে অবরুদ্ধ থেকে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা হবে, নাকি শহর থেকে বাইরে গিয়ে মুকাবিলা করা হবে? তখনো নবী করীম (স) এ ফায়সালা সাথীদের সাথে পরামর্শ করেই করেন। একটি বর্নণা থেকে জানা যায়, আবেগ উদ্দীপ্ত নওজোয়ানদের অধিকাংশের মতের ভিত্তিতে তিনি ফায়সালা গ্রহণ করেন যে, তরুণরা কম বয়সের কম বয়সের জন্য বদর যুদ্ধের অংশগ্রহণ করতে পারেনি এবং এখন জীবন বাজী রাখতে ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। এর ফলে মুসলমানদেরকে ক্ষতিগ্রস্থ হতে হয়েছে।
আহযাবের যুদ্ধের (৫ম হিজরী) সময়টা ছিলো খুবই নাজুক। গোটা আরব দুশমনের ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হয়। তাদের হাজার সৈন্যসামন্ত পবিত্র মদীনাকে ঘেরাও করে রাখে। সেখানেও পরামর্শের মাধ্যমেই তিনি প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেন। হযরত সালমান ফারসী (রা) এর পরামর্শ অনুযায়ী খন্দক খনন করেন। পিছেই ছিলো ইহুদীদের কেল্লা ও ঘাটিসমূহ। যে কোনো সময় তাদের থেকে গাদ্দারীর আশাংকা ছিলো। কুরাইশরা তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতো। এমনকি মুসলমানদের সাথে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করতে তারা উদ্যত হয়। অবস্থার নাজুকতা উপলব্ধি করে নবী করীম (স) বনু গাতফানের সাথে সন্ধির কথাবর্তা আরম্ভ করেন। তিনি চাইছিলেন তারা মদিনায় উৎপাদিত এক-তৃতীয়াংশ ফল গ্রহণ করুক এবং কুরাইশদের সঙ্গ ত্যাগ করে মুসলমানদের সাথে সন্ধি-চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে ফিরে আসুক।
কিন্তু এ ব্যাপারটি নিয়েও তিনি তারঁর সাথীদের সাথে পরামর্শ করেন। আনসাদরদের মধ্যে থেকে সাআদ ইবনে উবাদা (রা) এবং সাআদ ইবনে মুয়ায জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (স) এটা কি আপনার নিজের ইচ্ছা না আল্লাহর নির্দেশ? তিনি বললেন, না এটা আমারই ইচ্ছা আমি তোমাদের রক্ষা করতে এবং শত্রুদের শক্তি ভেঙে দিতে চাচ্ছি। উভয় সরদার বললেন: আমরা যখন মুসলমান ছিলাম না, তখনো এসব কবীলা আমাদের থেকে কর আদায় করতে পারেনি। তারা কি এখন আমাদের থেকে কর উসূল করবে? একথা বলে মূলত তারা সেই খসড়া চুক্তিনামাকে ছিন্ন করে দিলেন, যাতে কেবল স্বাক্ষর করা বাকী ছিলো ব্যাপার এ নয় যে, নবী করীম (স) এর মধ্যে কোনো প্রকার দুর্বলতা ছিলো। বরঞ্চ, পরামর্শ নেয়াটা ছিলো হিকমত ও বুদ্ধিমত্তার কাজ। এতে করে সন্ধি করার কল্পনা দূর হয়ে যায় এবং লড়াই-সাংগ্রাম করার সংকল্প জীবিত ও স্থায়ী করার উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যায়। লোকদের মনোবল দৃঢ় হয়ে যায়। এবং তাদের নব শক্তি ও প্ররণা-উদ্দীপনা জাগ্রত হয়।
এসব বিষয়ে একজন একনায়ক ক্ষমতাবান লীডারের মতো নিয়ে সিদ্ধান্তে চাপিয়ে দেবার পরিবর্তে নবী করীম (স) প্রতিটি কাজ ও সিদ্ধান্তে স্বীয় চাপিয়ে দেবার পরিবর্তে নবী করীম (স) প্রতিটি কাজ ও সিদ্ধান্তে স্বীয় সাথীদের শরীক রাখতেন অথচ কোনো লীডারের জন্য নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা চাপিয়ে দেবার অধিকার থেকে থাকলে তা কেবল নবী করীম (স) এরই ছিলো। আর কারো নয়। এমনটি করা হলে মনে প্রাণে যার আনুগত্য করা হতো তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (স) কারণ, তিনি সাধারণ মানুষের ন্যায় কোনো নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূল।
এসব পরামর্শ সভায় অংশ গ্রহণকারীরা পূর্ণ আযাদীর সাথে কথা বলতো। নিজেদের মতামত পেশ করতো। আলোচনা-পর্যালোচনা করতো। দলীল প্রমাণ পেশ করতো। এসব ব্যাপারে কোনো বাধা নিষেধ ছিলো না। মুনাফিকরা এসব সভায় অংশগ্রহণ করতো।এ প্রসঙ্গে কুরআনে যে হেদায়াত এসেছে, তা থেকে অবস্থা অনুমান করা যায় যে, সে সভাগুলোতে কি হতো। কেউ গলাফাটা চিৎকার করে নিজ বক্তব্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতো, সে চাইতো কেবল তার কথাই শুনা হোক, তার কথাই মেনে নেয়া হোক এবং আল্লাহ ও রাসূলের কথার চাইতেও তার কথাকে অগ্রাধিকার দেয়া হোক। এসব অবস্থায় মুখরোচক কথাবার্তা, যুক্ত-প্রমাণের প্রাচুর্য, কসমের আধিক্য, অনর্গল বক্তৃতা, এসব কিছুই হতো। ১
জ. বিনয়:
নবী করীম (স) সম্পর্কে যে কথাটি বলে আমি আমার এ আলোচনা শেষ করতে চাই।তাহচ্ছে এই যে, নবী করীম (স) কখনো কোনো প্রকারে কোনো দিক থেকে নিজেকে বড় ও বিরাট করে রাখেননি। তিনি এরূপ করলে অন্যায় কিছুই হতো না। তিনিই সবার চেয়ে বড় হয়ে থাকার অধিকারী ছিলেন। তাঁর চেয়ে অহংকারী আর কে হতে পারতো? তিনি শুধু মানুষই ছিলেন না। ছিলেন আল্লাহর রাসূল। তাঁর সীনায় অহী নাযিল হতো। তাঁর প্রতি লোকেরা ছিলো পতঙ্গের মতো ফেদা, কিন্তু এসব সত্ত্বেও তিনি সর্বদা বিনয়ের নীতি অবলম্বন করেছেন। সর্বসাধারণ সাথীদের তাদেরই মতো উঠাবসা, চলাফেরা এবং পানাহার করতেন। তাদেরই মতো পোশাক পরিধান করতেন। কোনো দিক থেকে অন্যদের তুলনায় বিশেষত্ব অবলম্বন করেনি। দূর থেকে লোকেরা মজলিসে এসে জিজ্ঞেস করতো মুহাম্মদ কে? নিজের সম্মানার্থে লোকদের দাঁড়াতে তিনি নিষেধ করেছেন। কেউ বলেছিল, তিনি মূসা (আ) থেকে উত্তম। তিনি তাকে বাধা দিয়েছেন। তিনি তাকে একথা বলতে নিষেধ করেন। কোনো একজন বলেছিলেন। যা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল চান। তিনি তাকে এরূপ বলতে বাধা দেন। তাঁর নিজেকে উদ্দেশ্য বানানোর দরজা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়ে তিনি মানুষের প্রকৃত সম্পর্ক ও আসক্তি কেবলমাত্র আল্লাহর সাথে গড়ে তুলতে চেয়েছে।
মুহাম্মদ একজন রাসূল ছাড়া আর কিছুই নয়। তার পূর্বেও অনেক রাসূল গত হয়েছে। এমতবস্থায় সে যদি মরে যায় কিংবা নিহত হয় তবে কি তোমার উল্টা দিকে ফিরে যাবে? সূরা আলে ইমরান: ১৪৪
মনোবাসনা
সর্বশেষ আরয এই যে, এ হচ্চে মুহাম্মদ (স) এর সীরাত। ব্যক্তির ও আখলাকের সেই নূর যা দ্বারা বর্তমান দুনিয়ায় দাওয়াত আন্দোলনের পতাকাবাহীদের প্রদীপ জ্বালানো উচিত আমাদের মধ্যে থেকে কারোই তাঁর সমমানে পৌঁছার স্বপ্ন পর্যন্ত দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু যেহেতু তিনি আন্দোলনের জীবন্ত মডেল, সে কারণে এ নূর দ্বারা যতোটা সম্ভব নৈতিক চরিত্রকে, অন্তরাত্মাকে এবং নিজেদের আমলী জিন্দগীকে রওশন করে নিতে হবে। আমরা যতো বেশী তাঁর নিকবর্তী হতে পারবো, ততোবেশী আমাদের রব আমাদের মহব্বত করবেন। দুর্বলতাসমূহ দূর করে দেবেন। আমাদের ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করে দেবেন এবং দুনিয়া ও আখিরতে আমাদের কামিয়াব করবেন।
(হে নবী!) লোকদের বলে দাও, তোমরা যদি প্রকৃতই আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা পোষণ করো, তবে আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালো বাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও দয়াবান। সূরা আলে ইমরান: ৩১
— সমাপ্ত —