২. রাসূল (স) এর দাওয়াত ও দাওয়াতের উদ্দেশ্য
একটি দাওয়াত ও একটি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থাকতে হবে স্বচ্ছ সুস্পষ্ট। আর লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে থাকা চাই সঠিক ধারণা। সুস্পষ্ট বুঝ। লক্ষ্য উদ্দেশ্য হওয়া চাই স্থায়ী। ক্ষণস্থায়ী নয়। রদবদল করার মতো নয়। পরিবেশ পরিস্থিতির চাপ এবং কালের আবর্তনে বিকৃত হবার নয়। উদ্দেশ্য যদি হয় একাধিক তবে সে গুলোর মধ্যে চাই সামঞ্জস্য পূর্ণ নয়। উদ্দেশ্য যদি হয় একাধিক তবে সেগুলোর মধ্যে চাই সামঞ্জস্য পূর্ণ বিন্যাস। এ বিন্যাস যেনো ওলট পালট না হয়। শাখা প্রশাখা যেনো মূলের স্থান দখল করে না বসে এবং মূল যেনো গুরুত্বহীন হয়ে না পড়ে।
কারণ,দাওয়াতে দ্বীনের এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ মূলকাজ ছিলো কুরআনের। তাই নবী পাক (স) যেনো তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলন এবং তাঁর শিক্ষাদান কাজে একথাগুলো গুরুত্বেও সাথে মেনে চলেন, কুরআন তার পয়গামের মাধ্যমে সে ব্যবস্থা করেছে।
দাওয়াতের সম্পর্ক আল্লাহর সাথে
রাসূল (স) প্রথম দিন থেকে মানুষকে যেদিকে আহ্বান করেছেন,যা কিছু তাদের শুনিয়েছেন এবং যা কিছু তাদের নিকট পৌঁছিয়েছেন, সেগুলোর সম্পর্ক কায়েম করেছেন তিনি নিজের রবের সাথে। মহান আল্লাহর সাথে। তিনি পরিস্কার করে বলে দিয়েছেন ইসলামী দাওয়াতের মূলকথা এই যে, মানুষের গোটা জিন্দেগীতে জ্ঞানের একমাত্র উৎস হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা। সঠিক পথের দিশা (হেদায়াত) কেবল তিনিই দিতে পারেন।১ যদিও কুরআনের প্রতিটি শব্দ তিনি তাঁর নিজ মুখ দিয়েই শুনিয়েছিলেন। যদিও এমন কনো প্রাকৃতিক সাক্ষ্য প্রমাণ ছিলো না যে, এসব বাণী তাঁর নিজের কথা নয় এবং দাওয়াত তাঁর নিজের দাওয়াত নয়, কিন্তু তিনি পুনঃ পুনঃ এবং অবিরামভাবে এ একই কথা বলে যাচ্ছিলেন যে, এ দাওয়াতের সম্পর্ক আমার নিজের সাথে নয়, বরঞ্চ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে। এতে এ দাওয়াত তার দা’য়ীর নামের সাথে সম্পৃক্ত থেকে যাবে এ ভয় কেটে যায়। ভবিষ্যতের দাওয়াতদান কারীরাও আর এ ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হবে না যে, আমরা কোন ব্যক্তির ধ্যন-ধারণা ও খেয়াল খুশীর প্রতি মানুষকে আহ্বান করছি।
এক আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব
সমস্ত মিথ্যা খোদার শ্রেষ্ঠত্ব খতম করে কেবল এক লা-শারীক আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বেও ঘোষনা ও প্রতিষ্ঠাই ছিলো নবী পাক (স) এর দাওয়াত ও আন্দোলনের বুনিয়াদী মাকসাদ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ একই উদ্দেশ্য তিনি কাজ করেছেন। মুহুর্তের জন্যে এ উদ্দেশ্যকে তিনি ভুলে যাননি। তাঁর রবই তাঁকে এ নির্দেশ দিয়েছেন।
“আর তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর”।
এখানে একথাটি মনে রাখতে হবে যে, ইসলামী দাওয়াতের জন্যে তিনি প্রাথমিক ও বুনিয়াদী এ দুটি বিষয়ের যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। সাথে সাথে তিনি এদিকেও পুরোমাত্রায় লক্ষ্য রেখেছিলেন। যেনো এগুলো কেবল মতবাদই থেকে না যায়। বরঞ্চ এগুলো যেনো প্রতিটি মুহুর্তে লোকদের ধ্যান-ধারণা, মন-মগজ, কথাবার্তা এবং যাবতীয় কর্মকান্ডে চালু হয়ে যায় এবং তরতাজা হয়ে থাকে। তখনকার একেকজন মু’মিনের জিন্দেগীতে ছিলো রাসূল (স) এর এককেজন অনুগত মুজাহিদের জিন্দেগী। তিনি তাঁর একেকজন মুজাহিদের জিন্দেগীর সাথে “বিসমিল্লাহ” এবং “আল্লাহ আকবার” কে যেভাবে একাকার করে দিয়েছিলেন তা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতি কতোটা প্রভাবশালী এবং সুদূও প্রসারী ছিলো। তেমনি তিনি এদিকে খুব সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন, যাতে করে দাওয়াতের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বুনিয়াদ এবং শিক্ষাগুলোও যেনো তাদের জীবনে মজবুত হয়ে যায় এবং প্রতি মুহূর্তে তাদের সম্মুখে তরতাজা হয়ে থাকে। আবার এসব বিষয়ের মধ্যে তাওহীদ, রিসালাত এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্কেও বিষয়টা ছিলো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বেও ঘোষণা ও প্রতিষ্ঠান এ পথে রাসূল (স) কয়েকটি বিষয়ের প্রতি অথ্যাধিক গুরুত্বারোপ করেন। সেগুলো হচ্ছে:
ক. আল্লাহর বন্দেগীর প্রাধান্য
এর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ছিলো এই যে, তিনি মানুষকে শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলারই দাসত্ব ও আনুগত্য করা এবং কেবলমাত্র তাঁরই হুকুম মেনে চলার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মুহুর্তেও জন্যে তিনি এ বিষয়টি থেকে গাফিল হননি। অথচ এর পরে সকল প্রকার অধ্যায়েরই আগমন ঘটেছে। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হয়েছে। সমাজিক সংশোধনের কাজ করা হয়েছে। তরবারি উত্তোলন করা হয়েছে। গণীমতের মাল সংগ্রহ করা হয়েছে। কাফিরদের সাথে সন্ধি হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে, চুক্তি হয়েছে। কিন্তু সর্ব মুহূর্তে সেই বুনিয়াদী দাওয়াতই ছিলো সম্মুখে ভাস্বর:
“এই হচ্ছে আল্লাহ, তোমাদের রব। তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। সকল কিছুর তিনি সৃষ্টিকর্তা। সুতরাং তোমরা তাঁরই দাসত্ব ও বন্দেগী করো” সূরা আল আনআম: ১০৩
কখনো পরম প্রাণাকর্ষী ভংগিতে একথাটিই বলেন:
“অতএব তোমরা দৌড়ে এসো আল্লাহর দিকে।” সূরা যারিয়াত: ৫০
রাজা বাদশাহর নিকট যখন চিঠি লিখতেন তখন এটাই থাকতো মুখ্য দাওয়াত। ইহুদীদের নিকট এ জিনিসেরই তিনি দাবী করেছেন। নাজরানের খৃষ্টানরা এলে সকল প্রাসংগিক কথা বাদ দিয়ে তিনি এ মূল দাওয়াতই তাদের দিয়েছেন।
“এমন একটি কথার দিকে এসো,যেটি আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সম্পূর্ণ সমান। কথাটি হচ্ছে এই যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো বন্দেগী করবো না। তার সাথে কাউকেও শরীক করবো না। আর আমাদের কেউ আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে নিজেদের রব হিসেবে গ্রহণ করবো না।” সূরা আলে ইমরান: ৬৪
মুসলমানরা একটি উম্মাহ এবং মজবুত সংগঠিত শক্তির রূপ লাভ করার পর তাদের উপর জিহাদ এবং শাহাদাতে হকের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এ দায়িত্বেও ফরমানও জারি করা হয় এভাবেঃ
“হে ঈমানদার লোকেরা! রুকু, কারো সিজদা করো এবং নিজেদের রবের বন্দেগী করো………..আল্লাহর পথে জিহাদ করো যেমন জিহাদ করা উচিত ………এবং তোমরা যেনো সমস্ত মানুষের উপর সাক্ষ্য চিত হও। সূরা আল হজ্জঃ ৭৭-৭৮।
একারণেই কুরআন নবী করীম (স) এর দায়িত্ব ও পদমর্যদাকে দায়ী ইলাল্লাহ বলে আখ্যায়িত করেছে।
খ. মিথ্যা খোদাদের বিরুদ্ধে জিহাদঃ
দ্বিতীয় বিষয়টি ছিলো এই যে, প্রতি মুহুর্তে আল্লাহর দিকে আহবানের কাজ প্রাধান্য পেয়েছে। আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে মানুষ খোদা বানিয়ে নিয়েছিলো কিংবা যেসব লোক নিজেরাই খোদা হয়ে বসেছিলো এবং যেসব শক্তি এবং প্রতিষ্ঠান আল্লাহর প্রতি বিদ্রোহের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, এসকেলরই সমালোচনা করেছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হয়েছেন। এদের কারো কাজে তিনি অংশও নেননি এবং কারো সাথে সমঝোতাও করেননি। এদের কাউকে তিনি বৈধ বলেও সীমার মধ্যে অবস্থান করে। কিন্তু এর কোনো একটি কাজের মধ্যে সামান্যতম অবহেলাও করা হয়নি। তাদের সাথে তিনি সর্বপ্রকার উন্নত নৈতিক আদর্শের সীমার মধ্যে অবস্থান করে। কিন্তু এর কোনো একটি কাজের মধ্যে সামন্যতম অবহেলাও করা হয়নি। কিন্তু সহ অবস্থান (Co-Existence) এ রাজী হননি। কারণ …….(আল্লাহর বন্দেগী করো) এর সাথে….(তাগুতদের থেকে সম্পর্কহীন হয়ে দূরে অবস্থান করো) এর দাওয়াতও ছিলো। এর উপর তিনি পুরো মাত্রায় আমল করেছেন।
কুরআন এবং সীরাতের পৃষ্ঠায় এর অসংখ্যা প্রমাণ রয়েছে। তার দাওয়াতের এটাই ছিলো কর্মপন্থা। তার বিরুদ্ধবাদীরা এজন্যে হন্তদন্ত হয়ে তার বিরোধিতায় কোমর বেধে লেগে যায়। তার তার বিরোধিতায় সংগঠিত হয়ে নিজেদের সমস্ত শক্তি তার শত্রুতায় নিয়োজিত করে। কারণ এখানে কেবল তাদের পাথরের তৈরী মূর্তির প্রশ্নই জড়িত ছিলো না। কোথাও ছিলো বাপ দাদার নাম এবং তাদের ইযযতের প্রশ্ন, কোথাও সোসাইটি এবং কালচারের ভূত। কোথাও ছিলো বংশ বর্ণের প্রশ্ন। কোথাও ছিলো জাতীয়তাবাদী ঝগড়া বিবাদের প্রশ্ন। কোথাও জড়িত ছিলো নেতৃত্বে আর কোথাও ছিলো জ্ঞান ও তাকওয়ার প্রশ্ন, মূর্তিপূজার (Idolatry) ধরণ যা কিছুই ছিলো না কেন, নবী পাক (স) তার প্রতিটির উপর আঘাত হেনেছেন। আর একারণেই তারা সকলে মিলে তার বিরুদ্ধে কোমর বেধে লেগে যায়
“সে কি সমস্ত খোদার পরিবর্তে একজন মাত্র খোদা বানিয়ে নিয়েছেন? এতো বড়ই অদ্ভুদ ব্যাপার! আর জাতির সর্দররা একথা বলতে বলতে বের হয়ে গেলো চলো, নিজেদের মাবুদদের উপসানলয় অবিচল হয়ে থাকি। একথাটি অন্য কোনো উদ্দেশ্যেই বলা হচ্ছে।” সূরা সোয়াদ ৫-৬।
গ. দাওয়াতের হেফাযত
তৃতীয় বিষয়টি ছিলো এই যে, নবী পাক (স) কখনো নিজ দাওয়াত ও মাকসাদের মধ্যে কোনো প্রকার রদবদল ঘটাননি। কোনো প্রকার কমতি করেননি। কোনো প্রকার বৃদ্ধি করেননি। তার দাওয়াত ও মাকসাদের আত্নরত্মায় কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। রূপ আকৃতি বিকৃত হয়নি। এ ব্যাপারে তার উপর বাইরের চাপ এসেছে। ভিতরের চাপ এসেছে। বহির্মূখী চাপের ইংগিত পাওয়া যায় আবু তালিবের ঘটনায়। আবু তালিবের মাধ্যমে যখন এ দাবী করা হলো যে, আপনি অবশ্যি আপনার এক খোদার ইবাদাত করবেন। কিন্তু আপনার বিরোধীদের মা’বুদদের বিরুদ্ধে দাওয়াত ও জিহাদের কাজ পরিত্যাগ করবেন। সাধারণভাবে তারা এ দাবী করতো যে, আমাদের মূর্তিগুলোকে মন্দ বলা পরিত্যাগ করবেন। সাধারণভাবে তারা এ দাবী করতো যে, আমাদের মূর্তিগুলোকে মন্দ বলা পরিত্যাগ করুন। কিন্তু এটা সবারই জানা কথা, নবী পাক (স) এর পবিত্র যবান দিয়ে কখনো কোনো গালি বের হয়নি। মূলত তাদের ‘মন্দ বলা পরিত্যাগ করুন’ কথার অন্তরালে সহ-অবস্থানের (Co-Existance) দাবীই নিহিত ছিলো। তারা যেনো বলছিলো- আপনি প্রাণ খুলে নিজ খোদার বন্দেগী করুন। অন্যদের খোদয়ীতে আঘাত হানবেন না। ঐ ঘটনায়ও বহির্মূখী চাপের ইংগিত পাওয়া যায়, যাতে তাকে অঢেল ধনসম্পদ, সুন্দরতম নারী এবং বাদশাহী প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছিলো। তিনি তাদের প্রস্তাব স্পষ্ট ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেন। কুরআন মজীদে পরিষ্কারভাবে তাকে উপর ন্যস্ত দাওয়াতের মধ্যে কোনো প্রকার রদবদল করার অধিকার তার নেই।
যারা আমার সাথে সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না, তারা বলে এটার পরিবর্তে অপর কোনো কুরআন নিয়ে এসো। কিংবা এতোই কোনোরূপ পরিবর্তন সূচিত করো। (হে মুহাম্মদ) তাদের বলো- এটা আমার কাজ নয় যে, আমার পক্ষ থেকে তাতে কোনরূপ রদবদল কর নেবো। আমিতো শুধু সেই অহীরই অনুসারী, যা আমার নিকট পাঠানো হয়। সূরা ইউনুস-১৫
আদর্শ ও নীতির উপর তিনি ছিলেন হিমালয়ের মতো অটল অবিচল। উদ্দেশ্য হাসিল এ পথে যতোই কঠিন ছিলো না কেন, তিনি কিন্তু নিজ দাওয়াত ও পয়গামের মধ্যে সামান্যতম রদবদল করতেও প্রস্তুত ছিলেন না। এক আল্লাহর সাথে সাথে অন্যান্য খোদাদের দাসত্ব-আনুগত্য বৈধ বলে মেনে নিতে তিনি এক মুহূর্তের জন্যেও প্রস্তুত হননি। এক নেতার স্থলে অন্যান্যদের নেতৃত্বের স্বীকৃতি তিনি প্রদান করেননি। যেসব ধর্মীয় নেতা, ব্যবসায়ী এবং গোত্রপতি জাতির খোদা হয়ে বসেছিলো, নেতৃত্বে তিনি তাদের কারো কোনো অংশীদারিত্ব স্বীকার করেননি। মূলত এ পলিসি ছিলো কুরআনের দুটি ছিলো যে, তাকে যে পয়গাম ও রিসালাত দেয়া হয়েছে তিনি তা হুবহু পেৌছায়ে দেবেন। আর দ্বিতীয় নির্দেশটি ছিলো এই যে, তিনি দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করবেন। পরিপূর্ণতা দান করবেন এবং এ পথ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেনা না।
হে রাসূল! তোমার আল্লাহর নিকট থেকে তোমার প্রতি যা কিছু নাযিল করা হয়েছে, তা লোকদের পর্যন্ত পৌছায়ে দাও। তুমি যদি তা না করো, তবে পৌছেছে দেয়ার হক তুমি আদায় কললে না। সূরা আল মায়েদা-৬৭
এ দীনকে তোমরা কায়েম করো এবং এতে ছিন্নভিন্ন এবং পৃথক পৃথক হয়ে যেয়ো না। এ মুশরিকদের জন্যে একথা বড় কঠিন ও দু:সহ হয়েছে যার দিকে (হে নবী) তুমি তাদের দাওয়াত দিচ্ছো। সূরা আশ শুরা-১৩।
ঘ. দাওয়াতের সকল অঙ্গের প্রতি লক্ষ্যারোপ
দাওয়াতের সকল অঙ্গ ও দিক বিভাগের প্রতি যথাযথ দৃষ্টি রাখতেন। প্রতিটি অংগকে তিনি জীবন্ত ও তরতাজা রাখতেন। আমি এখানে বিশেষভাবে তার দাওয়াতের তিনটি দিকের কথা আলোচনা করবো। এক, ইনযার। অর্থাৎ সতর্ক ও সাবধান করা। দুই. ক্ষমা চাওয়ার আহবান। অথ্যাৎ তওবা করা ও আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের দাওয়াত। তিনি, সুসংবাদ দান। সুসংবাদ দানকারী এবং সাবধানকারী হবার আলোচনা সূরা আহযাবের যে স্থানে করা হয়েছে, সেখানে রাসূল হিসেবে তার আদর্শের বিভিন্ন দিক, তার বিভিন্ন প্রকার মর্যাদা কিংবা তার দায়িত্ব কর্তব্য এবং কার্যাবলীর গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহ আলোচনা করা হয়েছে। একথা সুস্পষ্ট যে, সুসংবাদ তাওবা এবং এস্তেগফারেরই সাথে সম্পর্কিত। এ তত্ত্ব কুরআনের অসংখ্যা স্থানে আলোচিত হয়েছে।
১. সতর্কীকরণ
সতর্ককরণের কাজ তিনি একেবারে প্রাথমিক অবস্থা থেকেই আরম্ভ করেন। সূরা মুদ্দাসসিরেই তার উপর অর্পণ করা হয় বলে। তারপর গোটা কুরআনের অসংখ্যা স্থানে একই কথার উল্লেখ হয়েছে। তার এ কাজের অন্তর্ভূক্ত ছিলো খোদায়ী হেদায়াত বিমুখীতা, খোদাদ্রোহিতা, অহংকার এবং অহংকারীদের অনুসরণের পরিমাণ সম্পর্কে সতর্কীকরণ। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে এই যে, প্রথমত তিনি এ সব পরিমাণ পরিণতির কথা বলতে গিয়ে পার্থিব এবং পারলেকিক উভয় ধরণের পরিণামের কথাই বলেছেন। উভয়টার প্রতিই গুরুত্ব প্রদান করেছেন। সাথে সাথে মানুষের মনোযোগ ও চিন্তাকে পরকালীন পরিণামের উপর কেন্দ্রীভূত করে দিয়েছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, এটাই আসল এবং চিরস্থায়ী পরিণাম। দ্বিতীয়ত, একাজ কেবল ধমক প্রদান এবং ভয় দেখানো পর্যন্তই সীমিত ছিলো না বরঞ্চ আধুনিকালের পরিভাষা অনুযায়ী বললে কথাটা এভাবেই বলতে পারি যে, সতর্কীকরণের কাজে তিনি Critique এবং তার Empirical ও Theoretical উভয় প্রকার দলিল প্রমাই প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখানে এর বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই।
২. ক্ষমা চাওয়ার আহবান
তওবা এবং ইস্তেগফারের দাওয়াতেও তার দাওয়াতী কাজের বুনিয়াদী অংগ ছিলো। এ দুটো জিনিসের উপর যতোটা গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, যতোটা Stress দেয়া হয়েছে এবং এগুলোর জন্যে যে বিরাট সাফল্য ও সুসংবাদের ওয়াদা করা হয়েছে। এ থেকে একথারই প্রমাণ মেলে যে, এটা কেবল আস্তাগফিরুল্লাহ তাসবীহ পড়ার দাওয়াত ছিলো না। বরঞ্চ এ ছিলো এক বিরাট উদ্দেশ্য হাসিলের দরখাস্ত।
নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক কর্মতৎপরতার পর্যালোনা একথার স্বীকৃতি দান যে, আমরা বিশ্বজাহানের মালিকের নিকট জবাবাদিহি করতে বাধ্য। তিনি জ্ঞান, শক্তি ও ইযযতের মালিক। তিনি হিসাব গ্রহণ করবেন। তিনি ইনসাফ করবেন। ইস্তেগফারের অর্থ এটাও যে, পরকালীন পরিণামফলই প্রকৃত পরিণামফল। কুরআন এবং হাদীসে এসবগুলোর দিক স্পষ্টভাবে আলোচিত হয়েছে। নবী পাক (স) তার শিক্ষাদান ও দাওয়াতী কাজে এসবগুলো দিকের গুরুত্বরোপ করেছিলেন।
৩. সুসংবাদ দান
সুসংবাদ দান ছিলো তার দাওয়াতী কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংগ। এ সুসংবাদ দুনিয়া এবং পরকাল উভয়েরই সংগে সস্পর্কিত ছিলো। কিন্তু পরকালের পুরস্কারই যে, প্রকৃত ও স্থায়ী পুরুস্কার সে কথাও সাথে সাথে বলে দেয়া হয়েছে, সত্যিকার ঈমানদার হলে একদিকে দুনিয়ায় তোমরা বিজয়ী হবে। তোমাদেরকে দুনিয়ার খেলাফত দানের ওয়াদা রয়েছে। আসমান ও যমীনের বরকতের দরজা তোমাদের জন্যে খুলে দেয়া হবে। অপরদিকে সে জান্নাত লাভ করবে যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীনের প্রশ্ততার মতো। লাভ করবে ক্ষমা, রহমত, চিরস্থায়ী নিয়ামত শাশ্বত জীবন, খোদার সন্তোষ। এ ছাড়াও তোমরা যা চাইবে, তা-ই পাবে এবং আল্লাহর ভান্ডারে আরো অনেক অনেক নিয়ামত রয়েছে, যা তিনি তোমাদের দান করবেন।১ এক্ষেত্রে বিশেষ লক্ষণীয় হচ্ছে এই যে, তিনি তার সাথীদের যাবতীয় কার্যক্রম ও কর্মতৎপরতাকে মজবুত, আবেগময় ও সজীব কাচের মধ্যে ঢেলে প্রতিটি মুহূর্তে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন, যাতে করে এ জিনিকগুলো কেবল স্বীকৃত (Under stood) বিষয় হয়েই না পারে। বরঞ্চ এগুলো যেনো তাদের মন মগজকে আচ্ছন্ন করে রাখে। প্রতিনিয়ত আলোচ্য বিষয় হয়ে দাড়ায়। এর জন্যে পর্যালোচনা ও আত্মসমালোচনা হয় এবং এসব প্রতিশ্রুতির প্রতি তারা পূর্ণ আস্থাবান করে, সেই তরবারি উত্তোলনের কাজ হোক, দন্ডবিধান হোক কিংবা অর্থদানের দাবী হোক। মোটকথা, এসব নিয়ামত লাভের আকাঙ্খা যেনো তাদের ধান্ধায় পরিণত হয়ে যায়।
ঙ. বিন্যাস
পঞ্চম বিষয়টি ছিলো এই যে, নবী পাক (স) দাওয়াতের বিভিন্ন অংশ ও অঙ্গকে সুবিন্যস্ত করেছেন। প্রতিটি অঙ্গকে তার গুরুত্ব ও মেজায অনুযায়ী পূর্বাপর সাজিয়েছেন। এ বিন্যাসের মধ্যে কোথাও ছিলো বীজ ও ফলের সম্পর্ক। আবার কোথাও ছিলো ভিত, পিলার এবং অট্টালিকার কাঠামো। কোনো অঙ্গ ভিতের মর্যাদা পেয়েছে। কোনো অঙ্গ পেয়েছে সাজ সেৌন্দর্যের মর্যাদা। কেননা দার্শনিকের মতো ধ্যান ধারণা পেশ করে দেয়া, একজন ওয়ায়েযের মতো উপদেশ দিয়ে এবং একজন আহবায়কের মতো আহবান করে যাওয়াই শুধু তার কাজ ছিলো না। বরঞ্চ তার কাজ তো ছিলো একটি সুসংগঠিত সুশৃংখল উম্মাহ গঠন করে তৈরী করা। এজন্য তিনি প্রতিষ্ঠানাদি নির্মাণ, সামাজিক সংগঠন তৈরী এবং খানকা কায়েমের কাজে আত্ননিয়োগ করেননি। তিনি সবসময় দীনি কাজে উদ্দেশ্য এবং আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যে সুষ্পষ্ট পার্থক্য বিন্যাস এবং প্রতিটি স্তরের পারষ্পরিক সম্পর্কের প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি রেখেছেন। তিনি দৃষ্টি রেখেছেন, প্রতিষ্ঠানাদি এবং আনুষ্ঠানিকতা যেনো উদ্দেশ্যের স্থান দখল না করে। এ সম্পর্কে কুরআনে অনেক আয়াত বহু হাদীস রয়েছে। এ সম্পর্কে কুরআনের একটি আয়াত উল্লেখ করাই, যাতে বলা হয়েছে অথ্যাৎ তোমরা যদি সত্যিকার মুমিন হও। কুরআনের সেসব আয়াতও সকলের অধ্যয়ন করা উচিত, যেসব আয়াতে আলোচিত হয়েছে, কারা মুমিন আর কারা মুমিন নয়। এ সংক্রন্ত হাদীসগুলো সকলের অধ্যয়ন করা উচিত। যথার্থ বিন্যাসের গুরুত্ব সম্পর্কে এখানে কুরআনের একটি আয়াত উদ্ধৃত করে দিচ্ছি-
তোমরা কি হাজীদের পনিপান করানো এবং মসজিদে হারামের সেবা ও রক্ষণাবেক্ষণকে সেই ব্যক্তির কাজের সমান হবে মনে করে নিয়োছো, যে ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি এবং প্রাণপণ জিহাদ করেছে আল্লাহর পথে? আল্লাহর নিকট এই দুই শ্রেণীর লোক এক ও সমান নয়। সূরা আত তাওবা-১৯