৩. নবী পাক (স) এবং দাওয়াতে দীন
দাওয়াতের ব্যাপারে এ যাবত আমরা রাসূল (স) এর আদর্শের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচনা করলাম। এখান থেকে আরো সম্মুখে অগ্রসর হোন। দেখবেন, দাওয়াতের মার্যাদার সাথে তার মন মানসিকতার সম্পর্ক, এর গুরুদায়িত্ব অনুভূতি, এর জন্য তার অন্তরের ব্যাকুলতা, এর জন্যে তার ইলমী, রূহানী, নৈতিক ও আমলী প্রস্তুতি এবং এ পথে তার মানসিক অবস্থার এক ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু রয়েছে। এ বিষয়ে কুরআন মাজীদে বিস্তরিত আলোকপাত হয়েছে। সেখান থেকে আমরা কয়েকটি মাত্র মনিমুক্ত এখানে আহরণ করলাম।
গুরু দায়িত্ব অনুভূতি এবং সার্বক্ষণিক ধ্যান ও ব্যাকুলতা
দাওয়াত ইল্লাল্লাহ, শাহাদতে হক এবং ইকামাতে দীনের কাজ খুবই জটিল এবং দায়িত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু যিনি কাফেলার অধিনায়ক, তার জন্যে যে এ বিরাট যিম্মাদারীর বোঝা হাজার গুন ভারী ও জটিল, তা বলাই বাহুল্য। কোনো ব্যক্তি যদি চাকুরী বা পেশা হিসেবে, কিংবা পরিস্থিতির চাপ বা মনের সান্ত্বনার জন্যে এ দায়িত্ব নিজ ঘাড়ে চেপে নেয়, তার পক্ষে এর সঠিক হক আদায় করা সম্ভব হতে পারে না। কোনো ব্যক্তির পক্ষে তখনই এ দায়িত্বের সঠিক হক আদায় করা সম্ভব, যখন সে এটাকে তার মালিকের পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব মনে করবে।
কারণ, এ পথ বড় কঠিন। এর দাবীসমূহ খুবই জটিল। আর নেতাকেই সংকট ও জটিলতার মুকাবিলা সবচেয়ে বেশী করতে হয়। এ পথে তাকেই সবচেয়ে বেশী এবং পরিপূর্ণভাবে নিস্বার্থপরতা আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার অধিকারী হতে চায়। চরম উন্নত ও পবিত্র নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হতে হয়। চরম বিরোধিতার মোকাবিলায় সবর অবলম্বন করা তার জন্য অপরিহার্য। অটল অবিচল হয়ে থাকা তার জন্য অপরিহার্য। অটল অবিচল হয়ে থাকা তার জন্য অবশ্য কর্তব্য। সফলতার কোনো সম্ভবনা দেখা না গেলেও পূর্ণোদ্যমে তাকে নিজের কাজে লেগে থাকতে হয়। মন্দের জবাব দিতে হয় ভালো দিয়ে। গালির জবাব দিতে হয় হাসি দিয়ে। কাটা অতিক্রম করতে হয় হাসিমুখে। পাথর খেয়ে দোয়া করতে হয় হেদায়াতের। বিরোধীদের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা এবং তাদেরকে ছোট ও নগন্য মনে করার নীতি অবলম্বন করা যায় না। দুর্বল ও অক্ষম সাথীদের নিয়ে দুর্গম সাথীদের নিয়ে দুর্গম পথের চড়াই উতরাই পাড়ি দেয়ার অসীম সাহসের অধিকারী তাকে হতে হ। নীরব হজম করতে হয় নিজ লোকদের সকল বাড়াবাড়ি। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে কোনো দায়িত্ব পালনে সফলতা অর্জিত হওয়ার সাথে সাথে অহংকার ও আত্মগর্বের যে ফিতনা সৃষ্টি হওয়ার আশাংকা থাকে, তা থেকে তাকে পুরোপুরি আত্মরক্ষা করতে হয়। অর্থ্যাৎ তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট হতে হয় কুরআনেরই বাস্তব রূপায়ণ। রাসূল (স)আরাহণ করেছিলেন এ সকল গুনাবলীর শিরচূড়ায়। আসলে এইতো ছিলো তার মিরাজ। তায়েফের কঠিন ময়দানে সফলতা অর্জন করার পরইতো তার আসমানী মিরাজ সংঘটিত হয়। আরব ও আজমকে তার পদানত করে দেয়া হয়।
রাসূল (স) যে দায়িত্ব করছিলেন, যে পথে পাড়ি জমাচ্ছিলেন, তা যে আল্লাহরই পক্ষ থেকে অর্পিত, সে বিষয়ে তার অন্তরে বিন্দুমাত্র সংশয় ছিলো না। এ বিষয়ে তার একীন ছিলো সমস্ত মানুষের ঊর্দ্ধে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধরনের। আমার মনে হয় সেরকম একীনের কাছাকাছিও কোনো মানুষ পে……তে পারে না। কেননা স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তার সাথে কথা বলছিলেন। জিবরাইল আমীন (আ) তার নিকট আগমন করছিলেন। তার হৃদয় মুবারকের উপর অহী নাযিল হচ্ছিলো।
আমাদের উম্মতদের অংশতো শুধু এতোটুকু, যা আমরা কুরআনের এ বাক্যগুলোর প্রতি একীনের ধরন থেকে লাভ করি। এই আমাদের যথেষ্ঠ, আমরা যদি তা হুবহু লাভ করতে পারি।
আর এভাবেই আমরা তোমাদেরে (মুসলমানদের) কে একটি মাধ্যম পন্থানুযায়ী উম্মত বানিয়েছি, যেনো তোমরা দুনিয়ার লোকদের জন্য সাক্ষী হও। সূরা আল বাকারা-১৪৩
হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা আল্লাহর সহায্যকারী হয়ে যাও। সূরা আস সফ-১৪
তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে আল্লাহকে ‘করযে হাসানা’ দিতে প্রস্তুত? তাহলে আল্লাহ তাকে কয়েকগুণ বেশী ফিরিয়ে দেবেন’। সূরা আলা বাকারা-২৪৫
কুরআন মজীদে যেসব স্থানে নবী (স) কে সম্ভোধন করে (তুমি সন্দেহ পোষণকারী হয়ো না) বলা হয়েছে, যে সব স্থানে সম্ভোধনের অন্তরালে বিরুদ্ধবাদীদের প্রতিই রাগ ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা হয়েছে।
ক. আল্লাহর কাজ মনে করার ধরন
নবী পাক (স) তার সকল কজ এ অনুভূতি ও আস্থার সাথেই আঞ্জাম দিয়েছেন যে, এ হচ্ছে আল্লাহর কাজ। কুরআন যখন অবতীর্ণ হতো তখন এ আস্থাকে আরো গভীর ভাবে দৃঢ়তার করার জন্য ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পেশ করো হতো। তার মধ্যে স্বচ্ছ বুঝ সৃষ্টি করে দেয়া হতো যে, এ অহী আল্লহর নিকট থেকেই নাযিল হচ্ছে। আপনি সত্য এবং সিরাতুল মুস্তাকিমের উপর রয়েছেন। অবশ্যি আপনি রসূলদের অন্তভূক্ত। এভাবে তার সাথে সাথে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে আস্থা-একীন বৃদ্ধি পেতো। প্রকৃতপক্ষে, প্রতিটি মুহূর্তেই এ জিনিসটি স্মরণ করিয়ে দেয়া হতো। কারণ এ অনুভূতির মধ্যে দুর্বলতা দেখা দিলেইতো বিকৃতি মাথাচড়া দিয়ে উঠতো। বস্তুত যখনই এ অনুভূতিতে দুর্বলতা দেখা দেয়, তখন বিকৃতি অবশ্যি মাথাচড়া দিয়ে উঠে। কেউ যদি নবী পাকের চরিত্র বৈশিষ্ট্যকে এক শব্দে প্রকাশ করতে চায়, তবে সে শব্দটি হলো সবর। সংকীর্ণ অর্থ নয় বরং ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ হিসেবেই আমি তার জন্যে এ শব্দটি ব্যবহার করতে চাই। আর তাঁর সমস্ত সবর ছিলো তার রবেরই উদ্দেশ্য ব্যবহার করতে চাই। আর তাঁর সমস্ত সবর ছিলো তার রবের উদ্দেশ্য যেহেতু তাঁর সমস্ত কর্মতৎপরতাও তাঁর রবেরই উদ্দেশ্য নিবদিতো।
আর তোমার রবেরই উদ্দেশ্য, সবর অবলম্বন করো।
খ. মালিকের তত্ত্বাধানে
এ এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাসূল (স) তাঁর সমস্ত কাজ সেই মালিকের সম্মুখে এবং তত্ত্ববধানেই সম্পাদন করছিলেন, যিনি তাঁকে এ দায়িত্বে পালনের নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি ছিলেন তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তিনি সবকিছু শুনছিলেন, দেখছিলেন, যা কিছু বিরোধিতা বলছিলো এবং করছিলো। যা কিছু তাঁর সঙ্গী-সাথীরা বলেছিলো এবং করছিলো। আর যা কিছু স্বয়ং তিনি করছিলেন এবং বলছিলেন।
(হে নবী) তোমার রবের চূড়ান্ত ফায়সালা আসা পর্যন্ত তুমি সবর করো। তুমিতো আমরাই দৃষ্টি পথে রয়েছো। সূরা আত তূর: ৪৮
আমি তোমাদের সাথে রয়েছি। সবকিছু শুনছি এবং দেখছি। সূরা তোয়াহা: ৪৬
তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তিনি তোমাদের সাথে রয়েছেন। সূরা আল হাদীদ:৪
তোমরা তার গলার শিরা থেকেও অধিক নিকটবর্তী। সূরা ক্বাফ: ১৬
ভীত হয়ো না আল্লাহ সাথে রয়েছেন। সূরা তাওবা: ৪০
তিনজনের মাধ্যে কোনো পরামর্শ হলে আল্লাহ থাকেন তাদের চতুর্থ জন। সূরা আল মুজাদালা: ৭
আলোচ্য আয়াতগুলো থেকে আমাদের সামনে যে অবস্থা প্রতিভাত হচ্ছে, তার দুটি দিক রয়েছে। একদিকে রয়েছে রয়েছে সান্ত্বনা, প্রশান্তি, আস্থা, তাওয়াক্কুল, সাহস, নির্ভয়,যোগ-আবেগ এবং প্রতি মুহূর্তে নব উদ্দীপনা লাভের অসীম ভান্ডার। এর এক সোনালী উপমা হচ্ছে সওর গুহার ঘটনা। বস্তুত নবীপাকের গোটা জিন্দেগীই এসব ঘটনায় ভরপুর। তেইশ বছেরের নবুওয়াতী গোটা জিন্দেগীতে একটি মুহূর্ত এরূপ ছিলো না, যখন তাঁর মধ্যে মানসিক স্থবিরতা এসেছে। যখন আবেগ উদ্দীপনায় জড়তা এসেছে। কিংবা তিনি হিম্মত হারা হয়েছেন।
আর দ্বিতীয় দিকটি হচ্ছে দায়িত্বের মর্যদা এবং নাজুকতা উপলব্ধির ভান্ডার। কার কাজ করা হচ্ছে? এ চিন্তা কাজের মর্যাদা সম্পর্কে সজাগ করে তোলে। কেউ যখন উপলব্ধি করে, সে যে কাজ করছে, স্বয়ং আল্লাহ তা দেখছেন। তখন তার মনমানিসকতা যিম্মাদারীর তীব্র চেতনা থেকে কী করে মুক্ত থাকতে পারে? আসলে সে মালিকের শ্রেষ্ঠত্বকে যতো বেশী বড় করে উপলদ্ধি করতে পারবে। তাঁর কাজকেও তাতোই শ্রেষ্ঠ ও মর্যদাব্যাঞ্জক বলে অনুভব করতে সক্ষম হবে।
গ. মর্যদাও যিম্মাদারীর অনুভূতি
নিজ কাজের মর্যাদা এবং যিম্মাদারীর ওজন ও নাজুকতা সম্পর্কে নবী পাক (স) সবসময়ই সজাগ ছিলেন। অহী দেহেও। অহী নাযিল হলে হযরত খাদীজা (রা) এর নিকট এলেন। এসেই বললেন আমাকে চাদর আচ্ছাদিত করো। বলে কুরআন অন্যান্য অবস্থার সাথে সাথে তাঁর এ অবস্থাটির প্রতিও এখানে ইংগিত করেছে।
সম্মুখে তাঁর এক অতিবিরাট কাজ, মহান দায়িত্ব।এর ভয় মনকে আচ্ছন্ন করে আছে। ঘনকালো অন্ধকারে নূরের একটি আভা। একে আলোকময় করতে হবে। কয়েকটি শব্দের একটি আহবান। এদিকে জাগিয়ে তুলতে হবে সমস্ত শ্রোতাকে। ছোট একটি বীজ। একে বপন করে এমন এক গাছে রূপান্তরিত করতে হবে। যার শিকড় মাটিকে গভীরভাবে আঁকড়ে ধরেছে আর শাখা প্রশাখা উম্মেলিত হয়েছে ঊর্ধাকাশে। যে সবসময় ফলদান করে। যার ফলে এবং ছাড়া দ্বারা উপকৃত হয় কাফেলার পর কাফেলা। সুতরাং মনে যে অশ্বস্তি ছিলো, দিলের যে হতাশা ছিলো, দায়িত্বের যে পাহাড় নযরে আসছিলো, চাদর আচ্ছাদিত হবার অবস্থা দ্বারা কুরআন এসব কিছুর পরিবর্তন করে দিয়েছে।
সাথে সাথে তিনি একথাও অনুধাবন করে নিয়েছিলেন, দাওয়াতে হকের অর্থ এবং নেতৃত্বের দায়িত্ব মানে হচ্ছে, পা ছড়িয়ে শোবার দিন বিগত হয়েছে। এখন কোমর বেঁধে নিজেকে তৈরী করতে হবে। একাজ অবিরতভাবে করতে হবে। ময়দানে দাঁড়িয়ে বীরত্বেরসাথে গোটা দুনিয়াকে সাবধান ও সতর্ক করার কাজ এবং আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার প্রাণবন্তকর সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে হবে। লেগে থাকতে হবে।
ঘ. দুর্বহ কালাম
রাসূল (স) এর প্রতি ইকরার যে পয়গাম এসেছিলো, তাতো কেবল জ্ঞান রাজ্যে পরিভ্রমেণের আহ্বানই ছিলো না, বরঞ্চ তা ছিলো এক দুর্বহ কালাম। দাওয়াত এবং হিজরত ও জিহাদের কঠিন স্তরসমূহ পাড়ি দেয়ার নিদেশ ছিলো এ দুর্বহ কালামের অন্তর্ভূক্ত। কেবল তিলাওয়াত এবং সাওয়াব হাসিল করার জন্যে অহী নাযিল হয়নি। বরঞ্চ এ ছিলো দায়িত্বের এক দুর্বহ বোঝা। এটা কেবল ভাব ও অন্তর্গত বোঝাই ছিলো মুবরকে ফোটা ফোটা ঘাম জমা হয়ে উঠতো।
এ সময় তিনি সাওয়ারীতে উপবিষ্ট থাকলে সওয়ারী দুর্বহ চাপে বসে পড়তো। কুরআন পাকে একথাই স্পষ্ট ভাবে বলে দেয়া হয়েছে।
আমরা তোমার প্রতি এক দুর্বহ কালাম নাযিল করতে যাচ্ছি। সূরা আল মুযযাম্মিল:৫
তাঁর জন্য এটা কোনো খেল তামাশার কালাম ছিলো না, বরঞ্চ এ ছিলো এমন এক মিশন যা গোটা জিন্দেগীর সাথে এমনভাবে সম্পর্কিত ছিলো যে, তা তাঁর কোমর ভেংগে দিচ্ছিল। যে বোঝা কেবল পরম করুণাময়ের অনুগ্রহে কিছুটা হালকা হতে যাচ্ছিলো।
আর আমি তোমার উপর থেকে সেই দুর্বহ বোঝা নামিয়ে দিয়েছি যা তোমার কোমর ভেংগে দিচ্ছিল। যে বোঝা কেবল পরম করুণাময়ের অনুগ্রহে কিছুটা হালকা হতে যাচ্ছিলো।
আর আমি তোমার উপর থেকে সেই দুর্বহ বোঝা নামিয়ে দিয়েছি যা তোমার কোমর ভেংগে দিচ্ছিল। সূরা আলাম নাশরাহ: ২-৩
শাহাদতে হকের দায়িত্বনুভূতি এক দুর্বহ বোঝার মতো সবসময় তাঁর হৃদয় মুবারকের উপর চেপে থাকতো। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (র) এর র্বণনা অনুযায়ী একবার নবী পাক (স) তাকে কুরআন তিলাওয়াত করতে নির্দেশ দেন। প্রথমে তিনি এ ভেবে অনেকটা ঘাবড়ে যান যে, যার প্রতি অহী নাযিল হয়েছে, তাঁকে আমি কুরআন তেলওয়াত করে শুনাবো? অতপর নবী (স) পুনরায় নির্দেশ দিলে তিনি সূরা আন নিসার কয়েকটি আয়াত তিলাওয়াত করে শুনান। তিলাওয়াত করতে করতে তখন তিনি-
অতপর চিন্তা করো, আমি যখন প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন করে সাক্ষী হাজির করবো এবং এ সমস্ত সম্পর্কে সাক্ষী হিসেবে পেশ করবো, তখন তারা কি করবে। সূরা আন নিসা: ৪১
এ আয়াত পর্যন্ত পৌঁছলেন, তখন আওয়ায এলো আবদুল্লাহ থামো! হযরত আবদুল্লাহ বলেন, আমি তখন মাথা উঠিয়ে দেখি তাঁর দুচোখ থেকে অশ্রু বিগলিত হচ্ছে।
ঙ. সার্বক্ষণিক ধ্যান ও পেরেশানী:
অর্পিত কাজের বিরাটত্ব এবং গুরুদায়িত্বের তীব্র চেতনা ও অনুভূতির ফলশ্রুতির এই ছিলো যে, দাওয়াত ও আন্দোলনের পজিশনকে তিনি একটি জুব্বার মতো মনে করতে পারছিলেন না, যা পরিধান করে সানন্দে চলা ফেরা করা যায়। বরঞ্চ এ কাজ তাঁর সার্বক্ষণিক ধ্যান ও পেরেশানীর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। একাজ অন্তরের নিভৃত ঘরে স্থান করে নিয়েছিলো। হৃদয়ের গভীরতায় শিকড়ের জাল বিস্তার করে নিয়েছিলো। প্রতিটি মুহূর্তে এ ধ্যান তাঁর হৃদয় মনকে পেরেশান করে রাখছিলো। সকাল সন্ধ্যা এই ছিলো তাঁর যিকির। এছিলো ফিকির। এ ছিলো বিজনেস। একাজের প্রতিটি দাবীর জন্য তাঁর কামনা ছিলো, সকল মানুষ হিদায়াতের নূরে উদ্ভাসিত হোক। তারা সত্য উপলব্ধি করুক। সঠিক পথের অনুসারী হোকা। তাঁর হৃদয়ের এ ধ্যান, এ পেরেশানী, এ উদ্বেলিত কামনা, এ বেদনা ও অশ্বস্তির চিত্র কুরআন মজীদ এভাবে অংকন করেছে।
(হে নবী) এ লোকেরা ঈমান আনছে না, এ চিন্তায় তুমি হয়তো তোমার প্রাণটাই বিনষ্ট করবে। সূরা আশ শোয়ারা: ৩
এ চিন্তা, এ ধ্যান, এ পেরেশানীতে তিনি নিজের জীবনকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছিলেন। মানুষের হেদায়াতের জন্যে এমন ব্যাকুলতা ছাড়া কোনো অবস্থাতেই ইসলামী আন্দোলন চলতে পারে না।
নবী পাকের এ ব্যাকুলতার জন্যে কুরআন মজীদকে বারংবার তাঁর আস্তীন টেনে ধরতে হয়েছে। তাঁকে বুঝাতে হয়েছে, প্রতিটি মানুষকে ঈমানের আলোতে উদ্ভাসিত করা আপনার দায়িত্বেরন অন্তর্ভূক্ত নয়। আপনাকে দারোগা, উকিল এবং ফিল্ড মার্শাল বানিয়ে পাঠানো হয়নি। দাওয়াত পৌঁছে দেয়াই হচ্ছে আপনার মৌলিক দায়িত্ব। মানা বা না মানা প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের ব্যাপার। জীবনপথ বেছে নেয়ার স্বাধীনতা প্রত্যেক ব্যক্তিকে দেয়া হয়েছে। কুরআনের এ ধরণের আয়াতসমূহ মূলত নবী (স) এর পেরেশানী এবং ব্যাকুলতার অবস্থাও প্রকাশ করছে। দায়ীয়ে হকের পজিশনও নির্দেশ করছে এবং ও শিক্ষক হিসেবে তাঁর কাজের পরিধির প্রতিও ইংগিত করছে।
(হে বী!)তুমি কি এমন বধির লোকদের শুনাবে? কিংবা অন্ধও তবে আল্লাহ যাকে গোমরাহ করে দেন তাকে তিনি আর হেদায়াত দেন না। সূরা আন নহল: ৩৭
তোমার জাতি এক অস্বীকার করছে অথচ এ হচ্ছে প্রকৃত সত্য। তাদের বলো আমি তোমাদের উপর হাবিলদার নিযুক্ত হয়ে আসিনি। সূরা আল আনয়াম: ৬৬
স্বীয় প্রস্তুতি:
নবী পাক (স) প্রথম দিন থেকে যখন কালামে পাকের তাবলীগ, দাওয়াত ও আন্দোলনের কাজ আরম্ভ করেন, সে মুহূর্তে থেকেই স্বীয় প্রস্ততির কাজও তিনি আরম্ভ করেন। এ ছিলো এক সার্বিক ও পূর্ণাংগ প্রস্তুতি। এ প্রস্তুতির কয়েকটি দিক আমরা এখানে আলোচনা করছি।
ক. কুরআনের সাথে নিবিড় সম্পর্ক:
এ সার্বিক প্রস্তুতির শিরোমণি ছিলো কুরআন মজীদ। এ কালাম তাঁরই প্রতি নাযিল হচ্ছিল। তিনি তা লাভ করছিলেন। তা অনুধাবন করছিলেন। তা নিয়ে গভীর চিন্তা গবেষণা করছিলেন। তার মধ্যকার ইলমের ভান্ডার তিনি অর্জন করছিলেন। এ পূর্ণাঙ্গ কালামকে তিনি হৃদয়ের মধ্যে ধরে রাখছিলেন। প্রাণের চেয়ে ভালো বাসছিলেন। তার ম্যেধ আত্মা নিমগ্ন করছিলেন এবং তার ছাঁচে নিজেকে ঢেলে গড়ছিলেন।
এ দিকে তাঁর ইলমী, রূহানী এবং নৈতিক প্রস্তুতির পজন্যে এ ছিলো এক অপরিহার্য কাজ। অপরদিকে রিসালাত, দাওয়াত ও আন্দোলনের দায়িত্ব পালনে কেন্দ্রবিন্দু ছিলো এ কুরআনই। এর আয়াতের তিলাওয়াত, এর শিক্ষা প্রদান, হিকমতের প্রশিক্ষণ এবং মানুষের তাযকিয়া করাইতো ছিলো তাঁর মৌলিক কাজ।
আমি তোমাদের মধে থেকেই তোমাদের নিকট একজন রাসূল পাঠিয়েছি। যিনি আমার আয়াত তিলাওয়াত করে তোমাদের শুনান। তোমাদের পরিশুদ্ধ করেন। আল-কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা প্রদান করেন এবং সে সব জিনিসের তালীম দেন যা তোমরা জানতে না। সূরা আল বাকারা: ১৫১
আমি তোমাদের মধ্যে থেকেই একজন রাসূল পাঠিয়েছি। যিনি আমার আয়াত তিলাওয়াত করে তোমাদের শুনান। তোমাদের পরিশুদ্ধ করেন। আল-কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা প্রদান করেন এবং সে সব জিনিসের তালীম দেন যা তোমরা জানতে না। সূরা আল বাকারা: ১৫১
কুরআন মজীদের সাথে তাঁর সম্পর্ক জোর-জবরদস্তির সম্পর্ক ছিলো না। বরঞ্চ এ ছিলো প্রবল আকর্ষণ ও মহব্বতের সম্পর্ক। কারণ এখান থেকেই তাঁর যাবতীয় তাৎপরতার রস সিঞ্চিত হতো। কুরআনের প্রতি তাঁর মহব্বত ও প্রবল আকর্ষণের বিষয়ে অহীর বক্তব্য হচ্ছে:
(হে নবী!) এ অহীকে খুব তাড়াতাড়ি মুখস্ত করার জন্য নিজের জিহ্বাকে আন্দোলিত করো না। সূরা আল কিয়ামা: ১৬
এ আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহী লিখেছেন:
এ সময়ে নবী করীম (স) এর মধ্যে মহব্বত ও আকর্ষণের যে উত্তাল তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিলো তার চিত্র ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। অহী অবতীর্ণের দীর্ঘ বিরতীকালের অস্থির অপেক্ষার পর বিরুদ্ধাবদীদের চরম হঠকারিতার তুফানের মধ্যে যখন হযরত জিবরাঈল (আ) আরশের মালিকের পয়গাম নিয়ে হাজির হতেন, তখন তার মনের মধ্যে মহব্বত ও আকর্ষণের যে ভাব সৃষ্টি হতো তা কি ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব? এ যেনো ক্ষুধা, তৃষ্ণায় অস্থির এক শিশু। তার মা তাকে বুকে নিয়ে স্তনের বোঁটায় মুখ লাগাতেই মায়ের বুকের সমস্ত দুধ সে যেনো এক নি:শ্বাসেই পান করতে চায়। ক্ষরাতপ্ত মরুপথের কোনো মুসাফির ছাতি ফাটা তৃষ্ণার দীর্ঘপথ পেরিয়ে ঠান্ডা মিষ্টি পানির কলসী যদি হাতের কাছে পেয়ে যায়, তার যেমন ইচ্ছে করে কলসের সমস্ত পানিটুকুই এক নি:শ্বাসে পান করে নেয়ার। তেমনি দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর যদি নিজ মাহবুবের (প্রিয়তমের) পত্র লাভ করে, তখন তার ব্যাকুল প্রাণের আকুল আকর্ষণী দৃষ্টির একই পলকে যেনো পত্রের সবগুলো কথা পড়ে নিতে চায়।
খ. জ্ঞানলাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা:
আল্লাহর নির্দেশ আসার পর অহী মুখস্তের জন্যে ত্বরিত জিহ্বা সঞ্চালন তো নিয়ন্ত্রণ হয়ে যায় বটে। কিন্তু মনের আকর্ষণ আর ব্যাকুলতা তো থেকে যায় অদম্য। এ আকর্ষণ আর ব্যাকুলতার প্রকাশ ও পূর্ণতার জন্যে পবিত্র জবানীতে গভীরতা লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা উদ্ভাসিত হয়ে উঠে:
“আর দোয়া করো: পরওয়ারদেগার! আমাকে অধিক ইলম দান করো।” সূরা ত্ব-হা: ১৪৪
দাওয়াতে দীনের সম্মুখে রয়েছে যে মনযিল, অহীর শিক্ষায়তনে জ্ঞানার্জন ছাড়া তা লাভ করা যেতে পারে না। জ্ঞান ও ইলমের প্রাচুর্য ছাড়া একাজ হতে পারে না। এজন্যে প্রয়োজন মান-মানসিকতা ও চিন্তা ভাবনার ব্যাপক যোগ্যতা। প্রয়োজন হিকমতের পূর্ণ ভান্ডার। রাসূল (স) এ ইলম ও হিতমত কুরআন মজীদ থেকেই লাভ করেছেন। এরি ভিত্তিতে তিনি মানুষের জন্য তৈরী করেছেন জীবন ব্যবস্থার বুনিয়াদ। একজন নেতার মধ্যে ইলমের প্রতি যে পরিমাণ আকর্ষণ ও ব্যাকুলতা থাকা প্রয়োজন, তার মধ্যে তাই ছিলো না, বরঞ্চ এ ব্যাপারে তিনি প্রর্ত্যাবর্তন করেছেন আরশের দিকে। তাঁরই নিকট দোয়া প্রার্থনা করেছেন। তাঁরই প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। নির্ভর করেছেন তাঁরই উপর। কারণ, জ্ঞান ও হিকমাতের উৎসতো তিনিই।
অতপর কুরআনের যে অংশ যখনই তিনি করতেন, সাথে সাথে সেটাকে তিনি নিজ রূহের খোরাক বানিয়ে নিতেন। বস্তুত কুরআন ধীরে ধীরে অল্প অল্প নাযিল হবার মধ্যে এটাই ছিলো হিকমত। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই ছিলো তাঁর এ কুরআনের সাথে সম্পৃক্ত।
গ. কিয়ামুল লাইল ও তারতীলুল কুরআন:
এর পন্থা কি ছিলো? প্রথম প্রথম বিছনার আরাম ছেড়ে রাতের অধিকাংশ সময় তিন হাত বেঁধে কুরআনের মনযিলের সামনে দাঁড়িয়ে যেতেন। এমনটা করতেন তিনি কখনো অর্ধেক রাত। কখনো তার চেয়ে বেশী। কখনো তার চেয়ে কম। কখনো এক তৃতীয়াংশ। কখনো ঘনিষ্টতায়। কুরআনকে আত্মস্থ করার, আপন সত্ত্বায় একাকার করার চেয়ে কার্যকর কোনো পন্থা হতে পারে না।
রাতে নামাযে দাঁড়িয়ে থাকো কিন্তু কম। অর্ধেক রাত কিংবা তা থেকে তিনি বিরত থকেননি। এমনকি শেষ বয়সে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার পা ফুলে যেতো। এছাড়াও তিনি সবসময় কুরআন তিলওয়াতে মগ্ন থাকতেন। রমযান মুবারকে গোটা কুরআন শরীফ খতম করতেন। সাধারণত ফজর নামযে দীর্ঘ কিরাত পড়তেন।
(হে নবী!) তিলাওয়াত করো সেই কিতাব যা অহীর মাধ্যমে তোমার নিকট পাঠানো হয়েছে আর সালাত কায়েম করো। সূরা আল আনকাবুত: ৪৫
নামায কায়েম করো সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ার সময় থেকে রাতের অন্ধকার আচ্ছন্ন হবার সময় পর্যন্ত। আর ফজরের কুরআন পাঠের স্থায়ী নীতি অবলম্বন করো। কেননা ফজরের কুরআনে উপস্থিত থাকা হয়। আর রাতের বেলা তাহাজ্জুদ পড়ো। এটা তোমার জন্য অতিরিক্ত। অসম্ভব নয় যে, তোমার রব তোমাকে মাকামে মাহমুদে সুপ্রতিষ্ঠিত করে দেবেন। সূরা বনী ইসরাঈল: ৭৮-৭৯
ঘ. যিকরে ইলাহী:
কুরআনের সাথে নামাযের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ দুয়ের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।তাই একথা বলবো, নামাযই ছিলো নবী পাকের সবচেয়ে বড় আশ্রয়। এরি মাধ্যমে সাহায্য লাভ করতেন। কোনো কিছু যখন তাঁকে চিন্তায় নিক্ষেপ করতো, তিনি নামায পড়তে আরম্ভ করতেন।
তিলাওয়াত কুরআন এবং সালাত আদায় ছাড়াও তিনি অধিক অধিক আল্লাহর যিকর করতেন। তার হামদ করতেন এবং শোকর গুজারী করতেন। রাত দিন, সকাল সন্ধ্যা এবং প্রতিটি মুহূর্ত ও প্রতিটি কার্যোপলক্ষ্যে ছোট ছোট বাক্য তিনি এ অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতেন। এসব যিকিরের জন্যে আবার সংখ্যা নির্ধারণ করেছেন। সময় নির্ধারণ করেছেন। নিজে এ নিয়মের অনুসরণ করতেন। সাথীদের এরূপ করতে তাকীদ করতেন। এমনিভাবে জামায়াতী জিন্দেগীতে আল্লাহর সাথে সম্পর্কের প্রকাশকে জীব্ন প্রবাহের সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন। একইভাবে তিনি সর্বাবস্থায় প্রতিটি সুযোগ ও প্রয়োজনে ব্যাপক ভাবের অধিকারী মর্মস্পর্শী আবেগময় দোয়াসমূহ নির্ধারণ করে সেগুলোর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। বিশেষভাবে তিনি নিয়মিত ইস্তেগফার করতেন। আল্লাহর ইবাদাত এবং তার নিকট দোয়া করার সাথে সাথে ইস্তগফার কেও তিনি দাওয়াতের বুনিয়াদী অংশে পরিণত করে নিয়েছিলেন। তিনি নিজে অধিক অধিক ইস্তেগফার করতেন। এমনভাবে করতেন যে, তাঁর সাথীরা জানতো, তিনি ইস্তেগফার করছেন। প্রতিটি কাজের পরিসম্পপ্তিতে প্রতিটি সভা বৈঠকের প্রাক্কালে তিনি ইস্তেগফার করতেন। তাঁর কোনো সাথী তাঁকে দৈনিক সত্তর বছরেরও অধিক ক্ষমা প্রার্থনা করতে দেখেছেন। তাঁর সাথীরাও তাঁর অনুসরণ করে চলতেন।
ঙ. সবর:
আপন রবের সাথে ইবাদাত, ইখলাস, মহ্ববত, শোকর এবং তাওয়াক্কুলের মতো গুণাবলীর পূর্ণাঙ্গ মডেল ছিলেন নবী করীম (স) রবের আনুগত্যের ব্যাপারেও তিনি ছিলেন নবী করীম (স) রবের আনুগত্যের ব্যাপারে ও তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ মর্যাদায়। তাঁর পথে নিজের কুরবানী করতেন, সবকিছু বিলিয়ে দিতে তিনি ছিলেন সকলের আগে। এসবগুলো দিকের বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। অবশ্য তার নিকট সবরের আকারের নৈতিক চরিত্রের যে বিরাট ভান্ডার ছিলো, তাঁর দুয়েকটি দিক সম্পর্কের আলোচনা জরুরী মনে করছি। অবশ্য তাঁর পূর্ণাঙ্গ চরিত্র তো এমন এক অথই সমুদ্র, ডুব দিয়ে যার অসীম গীহনতায় পৌঁছা অসম্ভব। কেবলমাত্র সবেররই এতো ব্যাপক বিস্তৃত দিক রয়েছে, যার সংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন।