৯। শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আবদিল ওয়াহহাব (রাহিমাহুল্লাহ) (খৃস্টীয় ১৭০৪–১৭৯২)
খৃস্টীয় ১৭০৪ সনে শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আবদিল ওয়াহহাব আল আরাবীয়ার উয়াইনা নামক স্থানে জন্ম গ্রহণ করেন।
উয়াইনাতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি আল মদীনা আসেন। অতপর উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য বিভিন্ন দেশের শিক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হতে থাকেন। অবশেষে বহুমুখী অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান নিয়ে তিনি ফিরে আসেন উয়াইনা।
আল কুরআন ও আস সুন্নাহর আলোকে মুসলিম সমাজকে নিরীক্ষণ করে তিনি দারুণভাবে ব্যথিত হন। সর্বত্রই তিনি দেখতে পান ইসলামের প্রতি উদাসীনতা, ইসলাম থেকে বিচ্যুতি এবং শিরক ও বিদ’আতের ছড়াছড়ি। সমাজপতিদের বিরাট অংশ মদপান ও অশ্লীল কর্মকাণ্ডে অভ্যস্ত ছিলো। বিত্তবান ব্যক্তিরা ডুবে ছিলো বিলাসিতায়।
কবরের ওপর সৌধ নির্মাণ, মৃত বুযর্গ ব্যক্তিদের নামে নযর-নিয়ায দেওয়া, এমনকি কবর পূজা মারাত্মক আকার ধারণ করেছিলো।
শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আবদিল ওয়াহহাব ‘কিতাবুত তাওহীদ’ শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। উয়াইনা এসে তিনি আট মাস নিরবে কাটান। অতপর কিতাবুত তাওহীদের দারস দেওয়া শুরু করেন। সত্য সন্ধানী কিছু লোক তাঁর সহযোগী হন। শিরক ও বিদ’আতে নিমজ্জিত লোকেরা বিচলিত হয়ে ওঠে। তারা তাঁর দুশমনে পরিণত হয়। এমনকি আপন ভাই সুলাইমান এবং চাচাতো ভাই আবদুল্লাহ ইবনুল হুসাইন তাঁর নির্ভেজাল ইসলামের উপস্থাপনা সহ্য করতে পারেননি। তাঁরা শায়খের দুশমনদের সাথে হাত মিলান।
বিরুদ্ধবাদীরা তাঁর সাথে দুর্ব্যবহার শুরু করে। তিনি অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে নিজের বাড় ঘর ও সহায়-সম্পত্তি পেছনে ফেলে শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আবদিল ওয়াহহাব ব্যথিত মনে উয়াইনা ত্যাগ করেন। তখন আল আরাবীয়ার বিভিন্ন অঞ্চল আমীরদের দ্বারা শাসিত ছিলো। তিনি বিভিন্ন অঞ্চলের আমীরদের সাথে সাক্ষাত করে তাদের নিকট ইসলমের আসল রূপটি তুলে ধরার চেষ্টা চালাতে থাকেন। স্বার্থপর আমীরগণ তাঁর দা‘ওয়াত কবুল করতে ব্যর্থ হন। বেশ কয়েকটি স্থানে বিফল হয়ে তিনি পৌঁছেন দিরাইয়াহ।
খৃস্টীয় ১৭৪৫ সনে দিরাইয়াহর আমীর মুহাম্মাদ ইবনুস সাউদের সাথে তাঁর সাক্ষাত দীর্ঘ আলাপ হয়। তিনি আমীরের সামনে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য তুলে ধরেন। বিশেষ করে আত্ তাওহীদ সম্পর্কে ধারণা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে আমীরের নিকট উপস্থাপনা করেন। আমীর মুহাম্মাদ ইবনুস সাউদ অনুপ্রাণিত হন এবং প্রকৃত ইসলামের আলোকে তাঁর শাসিত ভূ-খণ্ডটি গড়ে তোলার সংকল্প ব্যক্ত করেন। তিনি মুহাম্মাদ ইবনু আবদিল ওয়াহহাবকে তাঁর উপদেষ্টা হিসেবে গ্রহণ করেন।
দিরাইয়াহতে নির্মিত হয় একটি নতুন মসজিদ। এটি ইসলামী জ্ঞান বিস্তারে কেন্দ্রে পরিণত হয়। শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আবদিল ওয়াহহাব এই মসজিদে নিয়মিত দারস দিতেন। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে একদল নিষ্ঠাবান মুসলিম যাঁদের চিন্তা-চেতনা ছিলো শিরক ও বিদ‘য়াতের ছোঁয়ামুক্ত।
বিদ‘আতপন্থীরা তাঁর বিরুদ্ধে বানোয়াট কাহিনী রটনা করে বড়ো বড়ো আলিমদের তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা চালায়। অপপ্রচার শুনে কাসিম অঞ্চলের বেশ কিছু আলিম তাঁর নিকট বিভিন্ন প্রশ্ন পেশ করেন। একটি দীর্গ চিঠির মাধ্যমে তিনি তাঁদের প্রশ্নের জওয়াব দেন।
তিনি লেখেন, “আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি যে- আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত যেইসব অভিমত পোষণ করেন আমার অভিমতও তা-ই।
আমি আল্লাহ, রাসূর, তাঁর ফেরেশতা, তাঁর কিতাব, পুনরুত্থান ও তাকদীরের ওপর ঈমান রাখি।
আমি আল কুরআন ও আল হাদীছে উল্লেখিত আল্লাহর গুণাবলীকে কষ্টকল্পিত ব্যাখ্যা না করে যেইসব বর্ণিত হয়েছে সেইভাবেই স্বীকার করে থাকি, আল্লাহর নির্গুণ হওয়া স্বীকার করি না বরং তাঁর গুণাবললীকে অনুপম ও সৃষ্টিটর সাথে তুলনা বিহীন বলে জানি। আল কুরআন আল্লাহর বাণী এবং কাদীম অনাদি। আল্লাহ আল কুরআনকে তাঁর রাসূল মুহাম্মাদের (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওপর নাযিল করেছেন। আমি আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্ধারণের বাইরে কিছুই ঘটতে পারে না বলে বিশ্বাস করি। সকল কাজ আল্লাহর ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত হয়, তাঁর তাকদীরের সীমা লংঘন করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম) কর্তৃক শাফা‘আতের ওপর ঈমান রাখি। আমি বিশ্বাস করি যে মুমিনগণ রবের দর্শন লাভে ধন্য হবেন। আমি মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম) কে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী বলে বিশ্বাস করি। যেই ব্যক্তি তা স্বীকার করে না তাঁকে মুমিন বলে স্বীকার করি না। আল্লাহর ওলীগণের কারামাত ও কাশফের কথা স্বীকার করি। কিন্তু তাঁদের কাুকে প্রবুত্বের অধিকারী ও ইবাদাতযোগ্য মানি না।
আমি কোন মুসলিমকে কাফির বলি না ও তাদের কাউকে ইসরামের বহির্ভূত বলে মনে করি না।
আমি ফাসিক নেতার পতাকাতলে সমবেত হয়ে জিহাদ করা এবং তাদের জামায়তে ছালাত আদায় করা জায়েয মনে করি। আমি দাজ্জালের পতন না হওয়া পর্যন্ত তলোয়অরের জিহাদ বিধান বলবৎ ও ফারয মনে করি।
আন্তরিক বিশ্বাস, মৌখিক সাক্ষ্যদান এবং ব্যবহারিক আচরণ- এই তিনটিকে আমি ঈমানের অংশ মনে করি। নেক আমলের দ্বারা ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং বদ আমল দ্বারা ঈমান ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে বিশ্বাস করি।
শরী‘য়াহর নির্দেশ অনুযায়ী ন্যায়ের আদেশ প্রদান এবং অন্যায়ের প্রতিরোধ সকল মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করি।”
[তারীখে নাজদ, পৃষ্ঠা ৫৭-৫৯]
শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আবদিল ওয়াহহাব তখনকার প্রখ্যাত আলিম আবদুর রহমান ইবনু আবদিল্লাহ আল বাগদাদীকে একটি চিঠিতে লেখেন, “আমি লোকদের আত্ তাওহীদের শিক্ষা দিয়েছি। বিপদ-আপদে মৃত বুযুর্গ ব্যক্তি ও ওলীদেরকে ডাকা ও তাঁদের কাছে সাহায্য চাওয়াকে নিষেধ করেছি। তাঁদের কবরে নযর-নিয়ায ও মানত দিতে এবং কবরকে সাজদা করতে বাধা দিয়েছি।…..
আমি আমার অনুসারীদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত জামায়াতের সাথে আদায়, যাকাত আদায় প্রভৃতি ফরয কাজগুলো সম্পন্ন করা, সকল প্রকার পাপ থেকে বিরত থাকা, মাদক দ্রব্যাদি পরিহার করা এবং নিফাককে ঘৃণা করা শিক্ষা দিয়েছি। দেশের বড়ো লোকেরা এই গুলোর বিরুদ্ধে কিছু বলতে না পেরে আমার প্রচারত আত্ তাওহীদের নানা রূপ কদর্থ করতে শুরু করেছে এবং মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আমার দুর্নাম রচাচ্ছে।
যেই ব্যক্তি জেনে বুঝে ইলাম পরিহার করে কিংবা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম) বিরুদ্ধে কটুক্তি করে এবং তাঁর অনুসরণ বাধা দেয়, আমি কেবল তাকেই কাফির বলে থাকি। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে উম্মাহর অধিকাংশ লোকই এমন নয়।”
[তারীখে –নাজদ, পৃষ্ঠা: ৫৪-৫৬]।
আমীল মুহাম্মাদ ইবনুস সাউদ রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। আর শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আবদিল ওয়াহহাব ব্যক্তি গঠনের কাজ করতেন।
খৃস্টীয় ১৭৬৫ সনে আমীর মুহাম্মাদ ইবনুস সাউদ মৃত্যুবরণ করেন। নতুন আমীর হন তাঁর পুত্র আবদুল আযীয ইবনু মুহাম্মাদ ইবনুস সাউদ। নতুন আমীরও মুহাম্মাদ ইবনু আবদিল ওয়াহহাবকে উপদেষ্টা পদে বহাল রাখেন।
খৃস্টীয় ১৭৯২ সনে তাঁর ওফাতের পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল ছিলেন।
খৃস্টীয় ১৮০৩ সনে আমীর আবদুল আযীয ইবনু মুহাম্মাদ ইবনুস সাউদ একজন শিয়া আততায়ীর অতর্কিত হামলায় শাহাদাত বরণ করেন।
খৃস্টীয় ১৮৮৪ সনে হাইল-এর আমীরের হাতে দিরাইয়াহর আমীর আবদুর রহমান ইবনুল ফায়সাল পরাজিত হয়ে কুয়েত পালিয়ে যান।
খৃস্টীয় ১৯০১ সনে আবদুল আজীয ইবনু আবদির রাহমান (দ্বিতীয আবদুল আযীয) ৪০ জন জানবাজ উষ্ট্রারোহী যোদ্ধা নিয়ে অতর্কিত হামলা চালিয়ে রিয়াদ দখল করেন। অতপর তাঁর সুযোগ্য সেনাপতিত্বে আল আরাবীয়ার বিভিন্ন অঞ্চল তাঁর রাষ্ট্রভুক্ত হয়।
খৃস্টীয় ১৯২৬ সনে আবদুল আযীয ইবনু আবদির রাহমান ইবনুল ফায়সাল ইবনুস সাউদ “আল মামলুকাতুল আরাবীয়া আস্ সাউদীয়া” গঠন করেন। এই আমীর আবদুল আযীযই আধুনিক সাউদী আরবের স্থপতি। আগের মতোই আস্ সাউদ বংশের লোকেরা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। অপরদিকে, শিক্ষা ও বিচার বিভাগ পরিচালনা করেন শায়খ মুহাম্মাদ ইবনুল আবদিল ওয়াহহাবের বংশধরেরা।
যদিও সাউদী আরবে “খিলাফাত ‘আলা মিনহাজিন নাবুওয়াত’ কায়েম হয়নি, ইসলামের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রবর্তিত হওয়ায় দেশটি শান্তি ও নিরাপত্তার দেশ হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছে। দীনী পরিবেশ সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে শায়খ মুহাম্মাদ আবদিল ওয়াহহাবের বংশধরেরা এবং তাঁর চিন্তাধারার অনুসারীরা এখনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
১০। শায়খ হাসানুল বান্না (রাহিমাহুল্লাহ) (খৃস্টীয় ১৯০৬–১৯৪৯)
খৃস্টীয় ১৯০৬ সনে মিশরের শাসক আব্বাস হিলমী পাশার শাসনকালে শায়খ হাসানুল বান্না মাহমুদিয়া নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। শায়খ হাসানুল বন্না লক্ষ্য করেন যে ইউরোপীয় চিন্তাধারা মুসলিমদের চিন্তা-চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। তিনি মুসলিমদেরকে ইসলামী জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
তিনি ইসমাঈলিয়াতে কর্মরত ছিলেন।
খৃস্টীয় ১৯২৮ সনে তিনি ছয়জন ইসলামী ব্যক্তিত্বকে তাঁর বাসায় দা’ওয়াত দেন। দীনী বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। শায়খ হাসানুল বান্না তাঁদের সামনে তাঁর চিন্তা-ভাবনা তুলে ধরেন এবং সমাজ অংগনে ইসলামের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখেন। উপস্থিত ব্যক্তিগণ তাঁর সাথে একমত হন। তাঁরা সাত জন মিলে একটি সংগঠন কায়েম করেন। নাম রাখেন, ‘আল ইখওয়ানুল মুসলিমূন।’
প্রতিষ্ঠাতা সদস্যগণ ছিলেন শায়খ হাসানুল বান্না, হাফিয আবদুল হামিদ, আহমাদ আল হাসরী, ফুয়াদ ইবরাহীম, আবদুর রাহমান হাসবুল্লাহ ইসমাঈল ইয্য এবং যাকী আল মাগরিবী।
হাসানুল বান্না ভালো করেই জানতেন যে ইসলামী সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত আল জিহাদের প্রধান কাজ হচ্ছে আদ্ দা’ওয়াতু ইলাল্লাহ। তিনি দা‘ওয়াতী কাজে নেমে পড়েন। অন্যদেকেও এই কাজে নিয়োজিত করেন।
হাসানুল বান্নাহ ইসমাঈলিয়া শহরের বাসায় বাসায় গিয়ে লোকদের সাথে আলাপ করতেন এবং ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখতেন। এইভাবে তিনি তিন বছর কাজ করেন। বেশ কিছু লোক তাঁর আহ্বনে সাড়া দেন।
ইখওয়ান সদস্যগণ বিভিন্ন ব্যক্তির বড়িতে যেতেন, মাসজিদে গিয়ে বক্তব্য রাখতেন, শিল্প এলাকার কফি খানায় গিয়ে শ্রমিকদের উদ্দেশ্যেও বক্তব্য রাখতেন।
দেশের বিভিন্ন স্থানেশাখা কায়েম হতে থাকে। গড়ে ওঠতে থাকে নিজস্ব মাসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
খৃস্টীয় ১৯৩২ সনে শায়খ হাসানুল বান্না কায়রেতে বদলি হন। ইসমাঈলিয়া থেকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় কায়রোতে স্থানান্তরিত হয়।
এবার মহিলা শাখাও গঠিত হয়। নাম রাখা হয় ‘আল আখাওয়াত আল মুসলিমাত।’
খৃস্টীয় ১৯৩৯ সনে শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। ইংল্যাণ্ড চাচ্ছিলো মিসর তার পক্ষে যুদ্ধ নামুক। অথচ ইংল্যাণ্ডের পক্ষে যুদ্ধে নামার অর্থ ছিলো তুর্কীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামা। অর্থাৎ রণাংগনে মুসলিম সৈন্যরা মুসলিম সৈন্যদেরকেই হত্যা করতে হবে। শায়খ হাসানুল বান্না হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন। অবশ্য তখনকার প্রধানমন্ত্রী আলী মাহির পাশা এবং প্রধান সেনাপাতি আযীয় আলী আল মিসরীও ইংরেজদের আবদার রক্ষা করার পক্ষে ছিলেন না।
ইংরেজরা প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। কিং ফারুক ইংরেজদের চাপের নিকট নতি স্বীকার করেন। তিনি প্রধান সেনাপতি আযীয আলী আল মিসরীকে দীর্ঘ ছুটিতে পাঠিয়ে দেন। কিছুকাল পর প্রধানমন্ত্রী আলী মাহির পাশাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন।
খৃস্টীয় ১৯৪০ সনে মিসর ইংরেজদের পক্ষে যুদ্ধে নামে।
শায়খ হাসানুল বান্না এবঙ সেক্রেটারী জেনারেল আবদুল হাকিম আবেদীনকে গ্রেফতার করা হয়। আল ইখওয়ানের পত্রিকাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। অন্য সব পত্রিকায়ও আল ইখওয়ানের খবর ছাপা যাবে না বলে নির্দেশ জারি হয়। মিছিল ও জনসভা নিষিদ্ধ করা হয়।
কিছুকাল পর শায়খ হাসানুল বান্না আবদুল হাকিম আবেদীনকে মুক্তি দেওয়া হয়।
খৃস্টীয় ১৯৪৩ সনের গোড়ার দিকে আল ইখওয়ান থেকে বিচ্যুত হয়ে কতিপয় সদস্য একটি গুপ্ত সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে। এই বাহিনী এখানে ওখানে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আর সরকার সব দোষ চাপায় আল ইখওয়ানের ওপর। এদের সম্পর্কে শায়খ হাসানুল বান্না একটি সার্কুলার লেটারে বলেন, ‘এরা আল ইখওয়ানও নয়, আল মুসলিমূনও নয়।’
খৃস্টীয় ১৯৪৭ সনের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিন বিভক্তকরণ প্রস্তাব গৃহীত হয়। অর্থাৎ ফিলিস্তিনের বুকে ইয়াহুদী রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ফিলিস্তিনের গ্রান্ড মুফতী আমীন আল হুসাইনী ইয়াহুদীদের মুকাবিলার জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের ডাক দেন। এই ডাকে অন্যদের মতো আল ইখওয়ানও সাড়া দেয়। হাসানুল বান্না অবসর প্রাপ্ত সেনা অফিসার মাহমুদ লাবীবকে ফিলিস্তিন পাঠান। তিনি ফিলিস্তিনী মুসলিম যুবকদেরকে ট্রেনিং দেওয়া শুরু করেন। কিন্তু ইংরেজরা তাঁকে ফিলিস্তিন ত্যাগ করতে বাধ্য করে।
খৃস্টীয় ১৯৪৮ সনে ইয়াহুদীরা ফিলিস্তিনে জেঁকে বসে। ইসলামী চিন্তা নায়কগণ জিহাদের ডাক দেন। শায়খ হাসানুল বান্না আহমাদ আবদুল আযীযের নেতৃত্বে একদল স্বেচ্ছাসেবক ফিলিস্তিনে পাঠান। তাঁরা রণাংগনে ইয়াহুদীদের অগ্রগতি থামিয়ে দেন।
তাঁদের সাফল্য ইংরৈজদের তাবেদার কিং ফারুকের প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ ফাহমী আন নুকরাশী পাশার মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়। সরকারের নির্দেশে প্রধান সেনাপতি ফুয়াদ ছাদিক আল ইখওয়ানের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ভেংগে দেন।
খৃস্টীয় ১৯৪৮ সনের ৮ই ডিসেম্বর আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনকে বে-আইনী ঘোষণা করা হয়।
শায়খ হাসানুল বান্না ছাড়া অন্য নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়। সব সম্পদ জব্দ করা হয়। অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। আল ইখওয়ানের সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। চিরুনি অভিযান চালিয়ে সারাদেশ থেকে হাজার হাজার সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। জেলে তাদের ওপর চালানো হয় ভয়ানক নির্যাতন।
শায়খ হাসানুল বান্নাকে গ্রেফতার করা হয়নি। তিনি বলেন, তাঁকে গ্রেফতার না করার অর্থ হচ্ছে তাঁর মৃত্যু পরোয়ানা জরি হয়েছে।
খৃস্টীয় ১৯৪৯ সনের ১২ই ফেব্রুয়ারী। শায়খ হাসানুল বান্না ইয়াং মুসলিম এসোসিয়েশনের একটি মিটিংয়ে বক্তব্য রেখে রাস্তায় নেমে একটি ট্যাকসীতে উঠতে যাচ্ছিলেন। এই সময় আততায়ীর গুলি এসে লাগে তাঁর বুকে। রক্তাক্ত দেহটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কয়েকজন লোক তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আল্লাহর প্রেমিক আল্লাহর একান্ত সান্নিদ্যে পৌঁছে যান।
শায়খ হাসানুল বান্নার লাস বাড়িতে আনা হয়। বাড়ি ঘেরাও করে রাখে সরকারী বাহিনীর লোকেরা। মাত্র কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনকে তাঁর কাফন, জানাযা ও দাফনে অংশ নিতে দেওয়া হয়।
শায়খ হাসানুল বান্নার শাহাদাতের পর আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের মুর্শিদে ‘আম হন হাসান আল হুদাইবি।
খৃস্টীয় ১৯৫০ সনের শুরুতে সাইয়েদ কুত্ব আমেরিকাতে লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরে আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়।
খৃস্টীয় ১৯৫২ সনে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানের পর ধরে মিসরে প্রেসিডেন্ট হন জামাল আবদুর নাসের।
আল ইখওয়ান আশা করছিলো তিনি ইসলামের পক্ষে কাজ করবেন। দুঃখের বিষয়, প্রেসিডেন্ট নামের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও আরব জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা সাজলেন। এতে আল ইখওয়ান তাঁর কড়া সমালোচনা করে।
খৃস্টীয় ১৯৫৪ সনে কে বা কারা প্রেসিডেন্ট নাসেরকে হত্যা করার চেষ্টা করে। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে হাজার হাজার ইখওয়ান কর্মীকে জেলে পুরে নির্যাতিত করা হয়।
সাইয়েদ কুত্ব ও আরো ছয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়।
খৃস্টীয় ১৯৬৫ সনের ২৮শে অগাস্ট সাইয়েদ কুতুব, মুহাম্মাদ হওয়াশ ও আবদুল ফাত্তাহ ইসমাঈলকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শহীদ করা হয়।
এতো কিছুর পরও মানযিলের পর মানযিল অতিক্রম করে ইখওয়ানুল মুসলিমূন সামনে এগুতে থাকে।