১১। বাদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী (রাহিমাহুল্লাহ) (খৃস্টীয় ১৮৭৭–১৯৬০)
খৃস্টীয় ১৮৭৭ সনে উসমানী খলীফা দ্বিতীয় আবদুল হামিদের শাসনকালে তুর্কীর বিতলিস অঞ্চলের নূরস নামক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন সাঈদ নুরসী।
খৃস্টীয় ১৮৯২ সনে তিনি রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন।
তাঁকে মারদিনে গ্রেফতার করে বিতলিস পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে বিতলিসের গভর্ণর তাঁর জ্ঞানের গভীরতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে তাঁর বাড়িতে মেহমান রূপে রেখে দেন।
কিছুকাল পর তিনি ওয়ান প্রদেশের গভর্ণর তাহির পাশার বাড়িতে অবস্থান করতে থাকেন। এই সময় পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের দিকে তাঁর দৃষ্টিতে আকৃষ্ট হয়। এটি ছিলো বৃটিশ পার্লামেন্টে প্রদত্ত সেক্রেটারী ফর কলোনীজ মিঃ জর্জ গ্লাডস্টোনের ভাষণ সংক্রান্ত রিপোর্ট। ঐ ভাষণে তিনি বলেন, “So Long as the Muslims have the Quran, we shall be ubable to dominate theme. We must either take if from them or make them lose their love of it”
“অর্থাৎ ‘যতোদিন মুসলিমদের হাতে আল কুরআন থাকবে, আমরা তাদেরকে বশ করতে পারবো না। হয় আমাদেরকে তাদের কাছ থেকে এটি ছিনিয়ে নিতে হবে অথবা তারা যেন এর প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে তার ব্যবস্থা করতে হবে।’
এই ভাষণে আলকুরআনের প্রতিটি বৃটিশ সরকাররের মনোভাব এবং অনুসৃতব্য পলিসি সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে
মিঃ গ্লাডস্টোনের এই ভাষণ সাঈদ নুরসীকে আরো বেশি সজাগ করে তোলে। তিনি সংকল্প ব্যক্ত করেন, “I shall prove and demonstrate to the world that the Quran is an undying and indextinguishable sun.”
অর্থাৎ ‘আমি প্রমাণ করবো এবং দুনিয়াকে দেখাবো যে আল কুরআন মৃত্যুহীন এবং নিভিয়ে ফেলা যায় না এমন এক সূর্য।’
এই সময় তুর্কীতে ইউরোপীয় ধ্যান-ধারণায় উজ্জীবিত ‘কমিটি অব ইউনিয়ন এন্ড প্রোগ্রেস’ ক্ষমতায় ছিলো। রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপলে একটি সেনা বিদ্রোহ দেখা দেয়। স্যালোনিকা থেকে সৈন্য এনে এই বিদ্রোহ দমন করা হয়। সরকার ধারণা করে, এই বিদ্রোহের পেছনে ছিলো ইত্তিহাদ-ই-মুহাম্মাদী জমিয়তী। এই সংগঠনের নেতা হাফিয দারবিশসহ প্রায় দুই শত জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন ছিলো সন্দেহে সাঈদ নুরসীকে গ্রেফতার করে মিলিটারি ট্রাইবুনালে হাজির করা হয়। যেই কক্ষে তাঁর বিচার হচ্ছিলো সেই কক্ষের জানালা দিয়ে পনর জনের ঝুলন্ত লাস দেখা যাচ্ছিল।
ট্রাইবুনালের প্রিজাইডিং অফিসার সাঈদ নুরসীকে বলেন, “আপনি শরী’য়া চাচ্ছেন? যারা শরী’য়াহ চায় তারা ঐ লোকগুলোর মতো ফঅঁসিতে ঝুলে।”
সাঈদ নুরসী বলেন, “আমার যদি এক হাজার জীবন থাকতো, আমি শারী’য়ার এক একটি অংশের জন্য আমার জীবনগুলো কুরবান করে দিতাম। কারণ শরী’য়াই হচ্ছে সমৃদ্ধি, কল্যাণ, সুবিচার ও সততার পথ।”
তিনি আরো বলেন, “বীর ব্যক্তিরা অপরাধ করে না। যদি তারা অভিযুক্ত হয় তারা শাস্তিকে ভয় পায় না। আমি যদি অন্যায়ভাবে দণ্ডে দণ্ডিত হই, আমি দুইজন শহীদের পুরস্কার পাব। আমি যদি জেলখানায় থাকি, তবে সম্ভবত জেলখানাই হচ্ছে স্বৈরাচারী শাসকের অধীনে সবচে’ বেশি আরামদায়ক স্থান। যালিম হয়ে বাঁচার চেয়ে মাযলুম মৃত্যুবরণ করা উত্তম।”
বিদ্রোহের সাথে সাঈদ নুরসীর সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়নি বিধায় ট্রাইবুনাল তাঁকে মুক্তি দেয়।
খৃস্টীয় ১৯১৪ সনে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয়। একপক্ষে ছিলো বৃটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া। অপর পক্ষে ছিলো জার্মানী ও তুর্কী। যুদ্ধের এক পর্বে রুশ সৈন্যরা তুর্কীর বিতলিস অঞ্চল আক্রমণ করে। এই নাজুক সময়ে সাঈদ নুরসী সরকারের অনুমতি নিয়ে একটি মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করে রণাংগনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে তিনি রুশ সৈন্যদের হাতে বন্দী হন। দুই বছর বন্দী থাকার পর তিনি বন্দিদশা থেকে পালাতে সক্ষম হন।
খৃস্টীয় ১৯১৮ সনে তিনি কনস্ট্যান্টিনোপল পৌঁছেন। তাঁকে বীরোচিত সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। স্বর্ণের তৈরি ওয়ার মেডাল দিয়ে সম্মানিত করা হয়।
প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় উসমানী খলীফা ছিলেন পঞ্চম মুহাম্মাদ মাহমুদ রাশাদ। যুদ্ধ শেষে খলীফা হন ষষ্ঠ মুহাম্মাদ ওয়াহিদউদ্দীন।
খৃস্টীয় ১৯১৯ সনে আনাতোলিয়ায় ইয়াং তুর্কস শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাদেরকে দমন করার জন্য সেনা বাহিনীর জাঁদরেল অফিসার মুস্তাফা কামাল পাশাকে পাঠানো হয়। তিনি বিদ্রোহীদের দলে ভিড়ে যান।
ঐ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ইয়াং তুর্কস একটি নির্বাহী পরিষদ গঠন করে। চেয়ারম্যান হন কামাল পাশা। এই নির্বাহী পরিষদ আংকারাকে রাজধানী করে আনাতোলিয়া শাসন করতে থাকে।
খৃস্টীয় ১৯২২ সনে কনস্ট্যান্টিনোপলে আংকারা সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্টিত হয়। উসমানী খলীফা ষষ্ট মুহাম্মাদ ওয়াহিদউদ্দিন দেশ ত্যাগ তরে বৃটেনে চলে যান।
খৃস্টীয় ১৯২২ সনে মুসতাফা কামাল পাশা রিপাবলিকান পিপলস পর্টি গঠন করেন। ১৯৪৬ সন পর্যন্ত (২৪ বছর) এটিই ছিলো তুর্কীর একমাত্র বৈধ রাজনৈতিক দল।
খৃস্টীয় ১৯২৩ সনে কামাল পাশা তুর্কীকে একটি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেন। তিনি হন তুর্কীর প্রেসিডেন্ট। প্রধামন্ত্রী নিযুক্ত হন ইসমত ইনুনু।
খৃস্টীয় ১৯২৪ সনে মুস্তাফা কামাল পাশা উসমানী খিলাফতের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন।
কামাল পাশা ছিলেন ইসলামের কট্টর দুশমন। যা কিছু ইসলামী আইন তখনো প্রচলিত ছিলোতিনি সেইগুলো বাদ দিয়ে সুইস কোড প্রবর্তন করেন। তিনি পর্দা প্রথার বিলোপ সাধন করেন। সহ-শিক্ষা প্রবর্তন করেন। ইসলামী শিক্ষালয়গুলো বন্ধ করে দেন। আরবীতে আযান দেওয়া নিষিদ্ধ করেন। আরবী বর্ণমালার পরিবর্তে ল্যাটিন বর্ণমালা চালু করেন। পাগড়ি ও ফেজ টুপি পরিধান নিষিদ্ধ করেন। হ্যাট পরিধান বাধ্যতামূলক করেন। সালাম দেওয়া নিষিদ্ধ করেন।
ইসলামের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ সাঈদ নুরসীকে দারুণভাবে ব্যথিত করে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন আল কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব, বলিষ্ঠতা এবং কল্যাণময়তা “রিসালা-ই-নূর” শীর্ষক পুস্তিকা সিরিজের মাধ্যমে অপরাপর মানুষের সামনে তুলে ধরবেন।
তিনি মাউন্টএরেক নামক স্থানে এসে যারনাবাদ নদীর উৎসবে সন্নিকটে একটি ডেরা নির্মাণ করে সেখানে অবস্থান করতে থাকেন। জুমাবার তিনি নুরসিন মাসজিদে এসে আত্ তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত ইত্যদি মৌলিক বিষয়ে প্রাঞ্জ ভাষায় বক্তব্য রাখতেন।
তিনি বলতেন, “আমার লক্ষ্য হচ্ছে ঈমানের বুনিয়াদ মজবুতভাবে গড়ে তোলা। যদি বুনিয়াদ মজবুত হয়, কোন তুফানেই তো ভেংগে পড়বে না।”
খৃস্টীয় ১৯২৫ সনে একদল সৈন্য এসে সাঈদ নুরসীকে তাঁর বাসস্থান থেকে তুলে নিয়ে যায়।
প্রথমে ইজমির, পরে আন্তালিয়া এবং আরো পরে বুরদুর নামক স্থানে তাঁকে নির্বাসিত করা হয়।
খৃস্টীয় ১৯২৬ সনে সরকার সাঈদ নুরসীকে ইসপারটায় পাঠিয়ে দেয়। বিশ দিন পর তাঁকে সেখান থেকে বারলা নামক একটি ছোট পল্লীতে নির্বাসনে পাঠায়।
সরকার তাঁকে এইগ্রামে আট বছর থাকতে দেয়। এই গ্রামে সাঈদ নুরসী গড়ে তোলেন প্রথম নূর মাদ্রাসা। এখানে অবস্থানকালে তিনি রিসালা-ই-নূর শীর্ষক একশত ত্রিশটি পুস্তিকা রচনা করতে সক্ষম হন।
ইসলাম বিদ্বেষী সরকারের শাসনকালে তাঁর পুস্তিকাগুলো মুদ্রণের কোন উপায় ছিলোনা। তিনি মুখে বলতেন, কয়েকজন ছাত্র তা লিখে নিতো। প্রথমে যারা লিখতো তারা কপি করে সেইগুলো আরো কিছু লোকের নিকট পৌছাতো। এইভাবে এক গ্রুপ থেকে আরেক গ্রুপের নিকট এইগুলো হস্তান্তরিত হতো। শেষাবধি এই কপিগুলোর সংখ্যা ছয় লাখ ছারিয়ে যায়। রিসালঅ-ই-নূরের প্রভাব পড়তে থাকে মানুষের ওপর। নিরবে সৃষ্টি হতে থাকে ইসলামী জাগরণ।
খৃস্টীয় ১৯৩৫ সনের ১২ই মে সাঈদ নুরসী ও তাঁর ৩১ জন সহকর্মীকে হ্যান্ডকাফ পরিযে একটি লরীতে তুলে এসকিশেহির জেল খানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
কোর্টে মামলা শুরু হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার জন্র জনগণের ধর্মীয় আবেগ ব্যবহার এবং ধর্মের ভিত্তিতে রাজনৈতিক সংস্থা গড়ে তোলার অভিযোগ আনা হয়।
সাঈদ নুরসীকে এগার মাস ও পনর জন সহকর্মীকে ছয় মাস কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অন্যরা মুক্তি পায়।
জেল খেটে বের হওয়ার পর তাঁকে কাসতামনুতে নির্বাসনে পাঠানো হয়।
খৃস্টীয় ১৯৩৮ সনে মুস্তাফঅ কামাল পাশা মারা যান। প্রেসিডেন্ট হন ইসমত ইনুনু। পূর্বের মতোই ইসলমের বিরোধিতা চলতে থাকে।
খৃস্টীয ১৯৪৩ সনে সাঈদ নুরসীকে গ্রেফতার করে ডেনিযলি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
কোর্টে হাজির করা হয়।
সাঈদ নুরসী আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলিষ্ঠ বক্তব্য রাখেন। কোর্ট তাঁর ও তাঁর সাথী বন্দীদের মুক্তির আদেশ দেয়।
খৃস্টীয় ১৯৪৪ সনে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে তাঁকে আফিত্তনে নির্বাসিত করা হয়। তিন সপ্তাহ পর তাঁকে নির্বাসিত করা হয় আমিরদাগ।
খৃস্টীয় ১৯৪৮ সনের শুরুতে সাঈদ নুরসীকে বারবার রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাখন তাঁর বয়স সত্তরের উর্ধে। এই বৃদ্ধ ব্যকিটিকে একবার চার ঘন্টা দাঁড় কয়ে রেখে অবান্তর প্রশ্ন করা হয়।
ঐ বছরই আফিত্তন কোর্ট তাঁকে বিশ মাসের এবং তাঁর সহকর্মীদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়।
খৃস্টীয় ১৯৪৬ সনে তুর্কীতে বহুদলীয় রাজনীতি চালু হয়।
খৃস্টীয় ১৯৫০ সনের সাধারণ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল পাশার গঠিত এবং ইসমত ইনুনু পরিচালিত রিপাবলিকান পিপলস পার্টির ভরাডুবি হয়। নব গঠিত ডিমেমাক্রেটিক পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সরকার গঠন করে।
খৃস্টীয় ১৯৫৭ সনে আংকারা ও কনস্ট্যান্টিনোপল থেকে প্রিন্টিং প্রেসে মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয় রিসালা-ই-নূর। বিপুল সংখ্যায় রিসালা-ই-নূর জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
খৃস্টীয় ১৯৬০ সনে সাঈদ নুরসী উরফা আসেন। তিনি তখন দারুণ অসুস্থ। রাতে তাঁর শরীরে খুব জ্বর আসে। কথা বলার শক্তিও তিনি হারিয়ে ফেলেন।
২৩শে মার্চ রাত তিনটার দিকে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। উরফাতেই তাঁকে দাফন করা হয়।
১২ই জুলাই কামালিস্ট সেনাবাহিনীর একটি দল উরফা এসে কবরথেকে সাঈদ নুরসীর লাস তুলে নিয়ে যায়।
বাদীউয্যামান সাঈদ নুরসী তুর্কীর স্বাধীনতা রক্ষার জন্য অকুতোভয়ে লড়াই করেন, বন্দি হয়ে রুশ কারাগারে দুই বছর নিদারুণ কষ্ট ভোগ করেন, পালিয়ে কনস্ট্যান্টিনোপল আসার পর তাঁকে বীরোচিত সম্বর্ধনা দেওয়া হয় এবং ওয়ার মেডাল প্রদান করা হয়। এই সাঈদ নুরসীই যখন ইসলমের পতাকা সমুন্নত করার প্রয়াসে অবতীর্ণ হন, তখন কামালিস্টদের দৃষ্টিতে তিনি হয়ে যান সবচে’ বেশি বিপজ্জনক ব্যক্তি। এমনকি তাঁর কবর মুসলিমদের প্রেরণার উৎসে পরিণত হতে পারে এই আশংকায় প্রায় চার মাস পর কবর থেকে তাঁর লাস তুলে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে আবার কবরস্থ করা হয়।
আধুনিক তুর্কীর ইসলামী নব জাগরণের প্রধান পথিকৃত ছিলেন বাদীউয্যামান সাইদ নুরসী।
উল্লেখ্য যে খৃস্টীয় ১৯১৯ সনে গ্রীস তুর্কীর স্মার্না (ইজমির) অঞ্চলে সৈন্য নামিয়ে সামরিক অভিযান শুরু করে। গ্রীস পশ্চিম আনাতোলিয়া দখল করে নিতে চেয়েছিলো, ফলে গ্রীসের সাথে তুর্কীর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুবক আদনান মেন্দারেস সেনা বাহিনীতে যোগদান করে তুর্কীর স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধের পর তাঁকে ওয়ার মেডাল দিয়ে সম্মানিত করা হয়।
খৃস্টীয় ১৯৪৬ সনে তুর্কীতে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু হলে জালাল বায়ার, আদনান মেন্দারেসসহ কয়েকজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ডিমোক্রেটিক পার্টি গঠন করেন।
খৃস্টীয় ১৯৫০ সনের নির্বাচন ডিমোক্রেটিক পার্টি সংখ্যাদগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং আদনান মোন্দারেস প্রধানমন্ত্রী হন।
খৃস্টীয় ১৯৫৪৩ ও ১৯৫৭ সনের নির্বাচনেও এই দলটি বিজয়ী হয়। জালাল বায়ার প্রেসিডেন্ট এবং আদনান মেন্দারেস প্রধানমন্ত্রী হন। আদনান মেন্দারেস সরকার তুর্কী ভাষার স্থলে আরবী ভাষায় আযান প্রদানের অনুমতি দেয়। তালাবদ্ধ কয়েক হাজার মাসজিদ ছালাতের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। একবার এক ভাষণে আদনান মেন্দারেস বলেন, পার্লামেন্ট সদস্যগণ চাইলে দেশে শারী‘য়া প্রবর্তিত হতে পারে। ইসলামের প্রতি তাঁর এই নমনীয়তা তাঁর জন্য বিপদ ডেকে আনে।
খৃস্টীয় ১৯৬০ সনে জেনারেল জামাল গুরসেলের নেতৃত্বের ‘কামালিস্ট’ সামরিক বাহিনী িএকটি অভ্যত্থান ঘটায়।
সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদা’ রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত। আদনান মেন্দারেস সরকারের ইসলামর দিকে ঝুঁকে সংবিধান বিরোধী কাজ করেছে- অভিযোগ এনে মিলিটারী ট্রাইবুনালে প্রধান কয়েকজন ব্যক্তির বিচার শুরু হয়।
মিলিটারী ট্রাইবুনাল প্রেসিডেন্ট জালাল বায়াকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্দারেস, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফাতিন রুস্তু জুরলু এবং অর্থমন্ত্রী হাসান পোলাতকানকে মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত করে।
খৃস্টীয় ১৯৬১ সনের ১৭ই সেপ্টেম্বর আদনান মেন্দারেস ও অপর দুইজন মন্ত্রীকে ইমরালি জেলে ফঅঁসিতে ঝুলিয়ে শহীদ করা হয়।
এতো কিছু করেও ইসলাম-বিদ্বেষীরা তুর্কীর গণ-মানুষের অন্তরের গভীরে প্রোথিত ইসলামের শিকড় উপড়ে ফেলতে পারেনি।
১২। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রাহিমাহুল্লাহ) (খৃস্টীয় ১৯০৩–১৯৭৯)
খৃস্টীয় ১৯০৩ সনে বৃটিশ শাসিত ভারতের হায়দারাবাদ রাজ্যের (বর্তমান অন্ধ্র প্রদেশ) আওরঙ্গাবাদ শহরে একাদশ ভাইসরয় লর্ড কার্জনের শাসনকালে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী জন্ম গ্রহণ করেন।
খৃস্টীয় ১০৭৯ সনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল মুহাম্মাদ জিয়াউল হকের শাসনকালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
খৃস্টীয় ১৯১৮ সনে পনর বছর বয়সে বিজনৌর থেকে প্রকাশিত আল মাদীনা পত্রিকার সম্পাদকীয় স্টাফের একজন সদস্য হিসেবে তাঁর কর্ম জীবন শুরু হয়।
অতপর সাপ্তাহিক তাজ পত্রিকার সম্পাদক ও মুসলিম পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি কর্বত্য পালন করেন।
খৃস্টীয় ১৯২৫ সনে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ (১৯১৯ সনে গঠিত) জমিয়ত আল একটি পত্রিকা প্রকাশনা শুরু করে। সম্পাদক নিযুক্ত হন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী।
খৃস্টীয় ১৯২৫ সনে ‘আর্য সমাজ’ নামক একটি গোঁড়া হিন্দু সংগঠনের অন্যতম নেতা স্বামী শ্রদ্ধানন্দ ‘শুদ্ধি আন্দোলন’ নামে একটি আন্দোলন শুরু কনে। তাঁর বক্তব্য ছিলো: উপমহাদেশের মুসলিমদের পূর্ব পুরুষগণ ছিলো হিন্দু। মুসলিম শাসকদের চাপে পড়ে তারা হিন্দুত্ব ত্যাগ করে মুসলিম হয়। এখন মুসলিমদের উচিত হিন্দুত্বে ফিরে আসা।
এই আন্দোলন ছিলো মুসলিমদের জন্য বেদনাদায়ক। স্বামী শ্রদ্ধানন্দের প্রচারনায় উত্তেজিত হয়ে একজন মুসলিম ১৯২৬ সনে তাঁকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। এতে গোটা ভারতে মুসলিমবিরোধী দাংগা শুরু হয়। হিন্দু নেতারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে, আল কুরআনের বিরুদ্ধে, আল কুরআনের অন্যতম মৌলিক পরিভাষা আল-জিহাদ-এর বিরুদ্ধে বিষেদগার করতে থাকেন।
খৃস্টীয় ১৯২৬ এবং ১৯২৭ সনে মোট চব্বিশ সংখ্যায় সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী আল জমিয়ত পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ‘আল-জিহাদ ফিল ইসলাম’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশ করে আল জিহাদের প্রকৃত রূপ তুলে ধরেন।
খৃস্টীয় ১৯২৮ সনে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ অল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কংগ্রেসের (১৮৮৫ সনে গঠিত) ‘এক জাতি তত্বের’ প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ-এর এই ভূমিকা সঠিক বলে মেনে নিতে পারেন নি। ফলে আল জমিয়ত পত্রিকার সম্পাদক পদে ইস্তফা দেন।
খৃস্টীয় ১৯৩২ সনে হায়দারাবাদ থেকে আবু মুহাম্মাদ মুছলিহ “মাসিক তারজুমানুল কুরআন” নামে একটি ইসলামী পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। সম্পাদক নিযুক্ত হন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী।
এক বছর পর এই পত্রিকার মালিকানাও তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়।
তারজুমানুল কুরআনের প্রথম সম্পাদকীয় নিবন্ধে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী লেখেন, “এই পত্রিকার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর বাণীকে বুলন্দ করা ও মানুষকে আল্লাতর পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবার জন্য আহ্বান জানানো। বিশেষ উদ্দেশ্য হচ্ছে আল কুরআনের নিরিখে দুনিয়ায় বিস্তারশীল চিন্তা-চেতনা, সভ্যতা-সংস্কৃতির নীতিমালার ওপর মন্তব্য করা, বর্তমান দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজতত্বের প্রেক্ষাপটে আল কুরআন ও আস্ সুন্নাহর বিধানগুলোর প্রয়োগ পদ্ধতি নির্দেশ করা। এই পত্রিকা মুসলিমদেরকে এক নতুন জীবনের দিকে আহ্বান জানাচ্ছে।”
প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে এই পত্রিকা বিভিন্ন বিষয়ে উপ-মহাদেশের মুসলিমদেরকে গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা দিয়ে উপকৃত করেছে।
খৃস্টীয় ১৯৪০ সনের ২২, ২৩ ও ২৪ মার্চ লাহোরের মিন্টু পার্কে অনুষ্ঠিত হয় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের (১৯০ সনে গঠিত) সম্মেলন। এই সম্মেলনে মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলকে নিয়ে মুসলিমদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। এই প্রস্তাবই লাহোর প্রস্তাব বা পাকিস্তান প্রস্তাব নামে পরিচিত।
মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ মুসলিম জনগোষ্ঠীকৈ এই ধারণা দিচ্ছিলেন যে পাকিস্তান হবে একটি ইসলামী রাষ্ট্র। কিন্তু মুসলিম লীগ ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয় উপাদান ইসলামী ব্যক্তি গঠনের কর্মসূচি হাতে নেয় নি। এই বিষয়ে সাইদেয়দ আবুল আ’লা মওদূদী নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কিন্তু তাঁরা তাঁর কথায় কান দেন নি।
খৃস্টীয় ১৯৪০ সনের ১২ই সেপ্টেম্বর “আনজুমানে তারীখ ওয়া তামাদ্দুন” নামক সংস্থার উদ্যোগে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাচি হলে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এক দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন।
বিষয় ছিলো, “ইসলামী হুকুমাত কিস্ সারাহ কায়েম হুতি হায়।” এই ভাষণেরই বাংলা অনুবাদ “ইসলামী বিপ্লবের পথ।” এই ভাষণের একাংশে তিনি বলেন, “এই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজন এমন সব লোকের যাদের অন্তরে রয়েছে আল্লাহর ভয়। যারা নিজেদের দায়িত্ব পালন সম্পর্কে আল্লাহর নিকট জওয়াবদিহি করতে হবে বলে অনুভূতি রাখে। যারা দুনিয়ার ওপর আখিরাতকে অগ্রাধিকার দেয়। যাদের দৃষ্টিতে নৈতিক লাভ-ক্ষতি পার্থিব লাভ-ক্ষতির চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। যারা সর্বাবস্থায় সেই সব আইন কানুন, বিধি-বিধান ও কর্ম-পদ্ধতি অনুসরণ করে যা তাদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি হয়েছে। যাদের চেষ্টা-সাধনার একমাত্র লক্ষ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। ব্যক্তিগত ও জাতিগত স্বার্থের দাসত্ব ও কামনা বাসনার গোলামীর জিঞ্জির থেকে যাদের গর্দান সম্পূর্ণ মুক্ত। হিংসা-বিদ্বেষ ও দৃষ্টিতে সংকীর্ণতা থেকে যাদের মন-মানসিকতা সম্পূর্ণ পবিত্র। ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার নেশায় যারা উন্মাদ হবার নয়। ধন-সম্পদের লালসা আর ক্ষমতার লিপ্সায় যারা কাতর নয়। এই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এমন নৈতিক বলিষ্ঠতার অধিকারী একদল লোক প্রয়োজন পৃথিবীর ধন-ভাণ্ডার হাতে এলেও যারা নিখাদ আমানতদার প্রমাণিত হবে। ক্ষমতা হস্তগত হলে জনগণের কল্যাণ চিন্তায় যারা না ঘুমিয়ে রাত কাটাবে। আর জনগণ যাদের সুতীব্র দায়িত্বানুভূতিপূর্ণ তত্বাবধানে নিজেদের জান-মাল-ইয্যতের যাবতীয় বিষয়ে থাকবে নিরাপদ ও নিরুদ্বিগ্ন। ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজন এমন একদল লোকের যারা কোন দেশে বিজয়ী বেশে প্রবেশ করলে সেখানকার লোকেরা গণহত্যা, জনপদ ধ্বংস সাধন, যুলম-নির্যাতন, গুণ্ডামী-বদমায়েসী ও ব্যভিচারের ভয়ে ভীত হবে না। বরং বিজিত দেশের মানুষেরা এদের প্রতিটি সিপাহীকে পাবে তাদের জান-মাল-ইয্যতের ও নারীদের সতীত্বের হিফাযতকারী রূপে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তারা এতোটা সুখ্যাতি ও মর্যাদার অধিকারী হবে যে তাদের সততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, নৈতিক-চারিত্রিক উৎকর্ষ ও ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালনে গোটা দুনিয়া হবে তাদের প্রতি আস্থাশীল। এই ধরনের, কেবলমাত্র এই ধরনের লোকদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে ইসলামী রাষ্ট্র।’
আর এই ধরনের লোক তৈরির অভিপ্রায়ে একটি সংগঠন কায়েম করার জন্য সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী মাসিক তারজুমানুল কুরআনে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে খৃস্টীয় ১৯৪১ সনের ২৫ ও ২৬ অগাস্ট একটি সম্মেলন আহ্বান করেন। প্রায় দেড় শতের মতো লোক এসেছিলেন। আলাপ-আলোচনার পর টিকে থাকেন ৭৫ জন। এই ৭৫ জন লোক নিয়েই ২৬ অগাস্ট জামায়াতে ইসলামী গঠিত হয়।
তিনি একটি গঠনতন্ত্রের খসড়া পেশ করেন। তা অনুমোদিত হয়। এর ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী আমীর নির্বাচিত হন।
প্রথম সদস্য সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণের একাংশে তিনি বলেন, “জামায়তে ইসলামী যাঁরা যোগদান করবেন তাঁদেরকে এই কথা ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে, জামায়াতে ইসলামীর সামনে যেই কাজ রয়েছে তা কোন সাধারণ কাজ নয়। দুনিয়ার গোটা ব্যবস্থা তাদেরকে পাল্টে দিতে হবে।
দুনিয়ার নীতি-নৈতিকতা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সভ্যতা-সংস্কৃতি প্রতিটি কিছু পরিবর্তন করে দিতে হবে। দুনিয়ায় আল্লাহদ্রোহিতার ওপর যেই ব্যবস্থা কায়েম রয়েছে তা বদলিয়ে আল্লাহর আনুগত্যের ওপর কায়েম করতে হবে। সকল শইতানী শক্তির বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রাম।”
পঁচাত্তর জন সদস্যের সামনে দাঁড়িয়ে “দুনিয়ার গোটা ব্যবস্থা পাল্টে দেবার” সংকল্প ব্যক্ত করা প্রমাণ করে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী একজন সূক্ষ্মদর্শী ও দূরদর্শী ব্যক্তি ছিলেন।
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী তারজুমানুল কুরআনের মাধ্যমে, একের পর এক গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে ইসলামের সঠিক রূপটি মানুষের সামনে তুলে ধরছিলেন। তাঁর অবদান বহু ব্যাপক। তবে তিনটি অবদান অতি বড়ো।
প্রথমটি হচ্ছে- খৃস্টীয় ১৯৪১ সনের ২৬শে অগাস্ট জামায়াতে ইসলামী গঠন।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে- খৃস্টীয় ১৯৪২ সনে তাফসীর তাফহীমুল কুরআন রচনা শুরু করা যা খৃস্টীয় ১৯৭২ সনে সমাপ্ত হয়।
তৃতীয়টি হচ্ছে- খৃস্টীয় ১৯৪৬ সনে ছাত্র অগনে ইসলামের দা’ওয়াত সম্প্রসারণের জন্য স্বতন্ত্র ছাত্র সংগঠন কায়েমের সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
খৃস্টীয় ১৯৪৭ সনের ১৪ই অগাস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
খৃস্টীয় ১৯৪৭ সনের ২৩শে ডিসেম্বর ইসলামী জমিয়তে তালাবা নামে একটি ছাত্র সংগঠন গঠিত হয়।
উপ-মহাদেশ ভাগ হয়ে পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার সময় জামায়াতে ইসলামীর রুকন সংখ্যা ছিলো ৬২৫ জন। দেশ ভাগ হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীকে জামায়অতে ইসলামী হিন্দ ও জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান নামে দুইটি সংগঠনে বিভক্ত করা হয়।
জামায়অতে ইসলামী হিন্দ ২৪০ জন রুকন এবং জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান ৩৮৫ জন রুকন নিয়ে কাজ শুরু করে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলাকালে নেতৃবৃন্দ ওয়াদা করেছিলেন যে তাঁরা পাকিস্তানকে একটি ইসলামী রাষ্ট্র রূপে গড়ে তুলবেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাঁরা তাঁদের ওয়াদা বেমালুম ভুলে গেলেন। তাঁরা বৃটিশ অথবা আমেরিকান মডেলের সংবিধান রচনার চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন।
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী এ প্রয়াস রুখে দাঁড়ান।
খৃস্টীয় ১৯৪৮ সনের মার্চ মাসে করাচীর সাহাংগীর পার্কে জামায়াতে ইসলামীর প্রথম রাজনৈতিক জনসভায় সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ঘোষণা করলেন যে সংবিধান রচনার দায়িত্ব প্রাপ্ত গণ-পরিষদকে ঘোষণা করতে হবে-
১। সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর। আর সরকার আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দেশ শাসন করবে।
২। ইসলামী শারী’য়া হবে দেশের মৌলিক আইন।
৩। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক আইনগুলোকে পরিবর্তন করে ইসলামের সাথে সংগতিশীল করা হবে।
৪। ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে রাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই শারী’য়ার সীমা লংঘন করবে না।
এইভাবে সূচিত হয় ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন।
উল্লেখ্য যে খৃস্টীয় ১৯৪৮ সনে রফী আহমাদ ইন্দোরী, কারী জলিল আশরাফ নদবী, খুরশিদ আহমাদ বাট এবং মাওলানা আবদুর রহীমকে নিয়ে ঢাকাতে জামায়াতে ইসলামীর শাখা গঠিত হয়।
খৃস্টীয় ১৯৪৮ সনের ১১ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের স্থপতি নিঃ মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ মৃত্যু বরণ করেন।
খৃস্টীয় ১০৪৮ সনের ৪ঠা অকটোবর জন নিরাপত্তা আইনে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ও আরো কয়েকজন কেন্ত্র নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।
লক্ষ্য ছিলো ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের আওয়াজকে স্তব্ধ করে দেওয়া।
বিশ মাস জেলে থাকার পর তিনি ও তাঁর সাথীরা মুক্তি পান।
খৃস্টীয় ১৯৫১ সনের ২১শে জানুয়ারী সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর প্রচেষ্টায় করাচীতে দেশের আলিমদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তৈরি হয় ইসলামী শাসনতন্ত্রের ২২ দফা মূলনীতি নামে একটি মূল্যবান দলীল।
খৃস্টীয় ১৯৫৩ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে কাদিয়ানীদের বিষয়ে আলোচনা করার জন্য করাচীতে সর্বদলীয় একটি মিটিং হয়। মিটিংয়ে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে ডাইরেকট এ্যাকশন চালানোর রহস্যজনক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জামায়াতে ইসলামী গোড়া থেকেই শান্তিপূর্ণ কার্যক্রমে বিশ্বাসী ছিলো। অতএব জামায়াতে ইসলামী সর্বদলীয় কমিটির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এদিকে স্থানে স্থানে দাংগা-হাংগামা শুরু হয়ে যায়।
খৃস্টীয় ১৯৫৩ সনের ৬ই মার্চ লাহোরে সামরিক শাসন জারি করা হয়। কয়েক ঘন্টার মধ্যে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায়।
২৮শে মার্চ উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, মিঞা তুফাইল মুহাম্মাদ, মালিক নাসরুল্লাহ খান আযীয, চৌদুরী মুহাম্মাদ আকবার এবং সাইয়েদ নকী আলীকে গ্রেফতার করা হয়।
সামরিক ট্রাইবুনালে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর বিচার শুরু হয়। ৮ই মে অর্থাৎ গ্রেফতারীর দশ দিনের মাথায় সামরিক ট্রাইবুনাল তাঁকে ফঅঁসির হুকুম দেয়।
কনডেমনড সেলে ক্রন্দররত ছেলের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘বাচ্চা, রোতা হয় কেঁও। হায়াত আওর মাউতকা ফায়সলা হোতা হায় আসমান মে যমীন মে নেহি।’ (ছেলে, কাঁদছো কেন? জীবন মৃত্যুর সিদ্ধান্ত হয় আসমানে, যমীনে নয়।)
দেশে-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সরকার মত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।
খৃস্টীয় ১৯৫৫ সনের ২৯মে এপ্রিল দুই বছর একমাস কারাবাসের পর সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী মুক্তি লাভ করেন।
খৃস্টীয় ১৯৬১ সনে কিং আসসাউদের আমন্ত্রণে তিনি রিয়াদ পৌঁছেন। কিং- এর অনুরোধে তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লান তৈরি করেন। কিছুটা পরিবর্তন করে সেই প্লান গৃহীত হয়। এর ভিত্তিতেই স্থাপিত হয় মাদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
খৃস্টীয় ১৯৬৩ সনের ২৫, ২৬ ও ২৭শে অকটোবর সরকারের নানাবিধ অসহযোগিতা সত্ত্বেও লাহোরে অনুষ্ঠিত হয় জামায়াতে ইসলামীর সম্মেলন। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী উদ্বোধনী ভাষণ পেশ করাকালে সরকারের লেলিয়ে দেওয়া গুণ্ডা বাহিনী সেই সম্মেলনে হামলা চালায়। শামিয়ানায় আগুন লাগিয়ে দেয়। ইসলামী বইয়ের দোকানগুলো তছনছ করে ফেলে। গুলি চালায়। মহিলাদের ক্যাম্পের দিকে বোতল নিক্ষেপ করে। গুলিতে আল্লাহ বকস নামে জামায়অতের একজন কর্মী শাহাদত বরণ করেন।
খৃস্টীয় ১৯৬৪ সনের ৬ই জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট আইউব খানের নির্দেশে জামায়াতে ইসলামীকে বে-আইনী ঘোষণা করা হয়। সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীসহ ৬০ জন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। এবার তাঁদেরকে জেলে থাকতে হয় ৯ মাস। অতপর আল্লাহর মেহেরবানীতে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে তাঁরা মুক্তি লাভ করেন।
খৃস্টীয় ১৯৬৭ সনের ১১ই জানুয়ারী ছিলো ২৯শে রামাদান। কোথাও চাঁদ দেখা যায় নি। কিন্তু রাতে রেডিওর মাধ্যমে সরকার ঘোষণা করলো: আগামী কাল ঈদ।
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ও আরো কয়েকজন প্রখ্যাত আলিম এই ভিত্তিহীন ঘোষণার প্রতিবাদ করেন। ফলে ঈদ হয় দুই দিন। এতে প্রেসিডেন্ট আইউব খান খুব রেগে যান।
খৃস্টীয় ১৯৬৭ সনের ২৯শে জানুয়ারী সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ও আরো কয়েকজন বিশিষ্ট আলিমকে গ্রেফতার করা হয়। তবে ১৫ই মার্চ তাঁদেরকে মুক্তি দেওয়া হয়।
বেশ কয়েক বছর ধরেই সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী বেশ কিছু জটিল রোগে ভুগছিলেন।
খৃস্টীয় ১৯৭৯ সনের মধ্যভাগ তাঁর বড়ো ছেলে ডা. উমার ফঅরুক মওদূদী তাঁকে চিকিৎসার জন্য আমেরিকা নিয়ে যান।
খৃস্টীয় ১৯৭৯ সনের ২২শে সেপ্টেম্বর বাফেলো সিটিতে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী মৃত্যু বরণ করেন।
দেশে আনার পথে বিভিন্ন স্থানে তাঁর জানাযা নামায অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ জানাযা নামায অনুষ্ঠিত হয় লাহোরের গাদ্দাফী স্টেডিয়ামে। প্রায় তিন লাখ লোক এতে শরীক হন।
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামী দক্ষিণ এশিয়া উপ-মহাদেশের কয়েকটি দেশে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার মুকাবিলা করে, মানযিলের পর মানযিল অতিক্রম করে, সামনে এগিয়ে চলছে।
শেষের কথা
এইসব সত্যনিষ্ঠ আপোসহীন ব্যক্তিত্ব আল কুরআন ও আস্ সুন্নাহর অনাবিল শিক্ষাকে মানুষের সামনে তুলে ধরে চিন্তার বিশুদ্ধি সাধনের প্রয়াস চালিয়েছেন। আল কুরআন ও আস্ সুন্নাহর শিক্ষাকেই তাকে সমাজ অংগনের মূল ধারায় পরিণত করার জন্য অপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। তাঁরা নিখাদ সোনার সাথে এতোটুকু খাদ মেশাতে রাজি হন নি। কোন বিচ্যুতি ও বিকৃতিকে তাঁরা বরদাশত করেন নি। ব্যক্তি জীবনে ও সমাজ জীবনে ইসলামের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হোক, এটা ছিলো তাঁদের কামনা। তাঁরা খিলাফাত ‘আলা মিনহাজিন্ নামওয়াতের স্বপ্ন দেখতেন। এই লক্ষ্য হাছিলের জন্য এগুতে গিয়ে প্রতিকূলতার প্রচণ্ড আঘাত খেয়েও তাঁরা দৃঢ়পদ থেকেছেন। তাঁরা জানতেন, ইসলামী আন্দোলনের পথ ফুল বিছানো নয়। তাঁদের জীবন কথা যুগের পর যুগ ইসলাম প্রতিষ্ঠাকামীদেরকে প্রেরণা যোগাতে থাকবে।