জবাবঃ ষস্ঠ প্রশ্ন
একই জাতীয় বস্তুর নগদ নগদ বিনিময়ে অধিক নেয়া হারাম করার উদ্দেশ্যে ইবনে কাইয়েম এবং অন্যান্যগণ যা বলেছেন, তা হচ্ছে আসলে উপায়ের পথ বন্ধ করা। অর্থাৎ আসল হারাম তো ঋণের সুদ। কিন্তু অধিক গ্রহণের মানসিকতা রুদ্ধ করার
জন্যে একই জাতীয় বস্তুর নগদ বিনিময়ের সময় অধিক নেয়াকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এ সত্য কথা যে,একই জাতীয় বস্তু যেমন চাউলের বিনিময় শুধুমাত্র এ অবস্থায় করা যায় যখন একটি উৎকৃষ্ট এবং অন্যটি নিকৃষ্ট হয়। শরীয়ত প্রণেতার উদ্দেশ্যে এই যে,উৎকৃষ্ট ধরনের এক সের চাউলের বিনিময় নিকৃষ্ট ধরনের সোয়াসের চাউলের দ্বারা করা যাবে না। তা উভয়ের বাজার দরের পার্থক্য যেমনই হোক না কেন। বরঞ্চ এক ব্যক্তি তার চাউল টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে অন্য চাউল টাকা দিয়েই খরিদ করবে। সরাসরি চাউলের সাথে আধিক্যসহ চাউলের বিনিময় সুদখুরীর মূল মানসিকতারই পরিপোষণ করে এবং শরীয়ত প্রণেতা (বিধানদাতা) এরই মূলোচ্ছেদ করতে চান। এ প্রসংগে একথা উল্লেখ যে, ফকীহগণের মধ্যে সুদের প্রশ্নে যত মতভেদ হয়েছে, তা শুধু ‘রিবাল ফজলের’ ব্যাপারেই। কারণ তার হারাম হবার হুকুম নবী করীম (স)-এর শেষ সময়ে দিয়েছিলেন এবং কাঁর পবিত্র জীবদ্দশায় এ হুকুমগুলো কার্যকর করার উপায়-পদ্ধতি সুস্পষ্ট হতে পারেনি। কিন্তু ঋণের সুদ সম্পর্কে কথা এই যে, তার অবৈধতা এরা নির্দেশাবলী সম্পর্কে ফকীহগণের মধ্যে পরিপূর্ণ ঐক্যমত ছিল। এ বিষয়টি পরিষ্কার এবং এতে কোনোই জটিলতা নেই।
জবাবঃ সপ্তম প্রশ্ন
ব্যবসায়ে উভয় পক্ষের সম্মতি অপরিহার্য। কিন্তু এ সম্মতি ব্যবসা হালাল হবারও কারণ নয় এবং সম্মতির অভাবে সুদ হারাম তাও নয়। কুরআনে কোথাও একথা বলা হয়নি যে, সুদ এ জন্য হারাম যে, সুদদাতা তা অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেয়, যদিও দুনিয়ার কোথাও কেউ স্বেচ্ছায় ও সন্তুষ্টিচিত্তে সুদ দেয় না। বিনা সুদে ঋণ পাবার সম্ভাবনা থাকলে কেউ ঋণের জন্যে সুদ দিত না। কিন্তু এ বস্তুর হারাম হবার ব্যাপারে সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রশ্নই অবান্তর। কারণ কুরআন নিরুংকুশভাবে ঐ প্রকার ঋণকে হারাম ঘোষণা করে যাতে আসলের অতিরিক্ত আদায় শর্ত শামিল থাকে। এ শর্ত উভয় পক্ষের সম্মতিতে অথবা অন্য যে কোন প্রকারেই ঠিক হোক না কেন,তাতে কিছু আসে যায় না। এখন কথা হচ্ছে এই যে,বলা হচ্ছে সুদী ঋণ হারাম হবার আসল কারণ অত্যাচার বা জুলুম এবং যে ঋণে সুদ আদায় করতে কোন অত্যাচার হয়না,তা হালাল হওয়া উচিত। এ সম্পর্কে আমি বলতে চাই যে,কুরআনের শব্দাবলী থেকে একথা মনে করার কোনো সুযোগই নেই যে,যুলুম আসলে সুদ হারাম হবার কারণ। আর এই যুলুম শব্দের অর্থ আপনি যা খুশী করবেন,তারও উপায় নেই। কুরআন যেখানে এ হারামের কারণ বর্ণনা করছে। সেখানে নিজেই যুলুমের মর্মও সুস্পষ্ট করে দিচ্ছে। তা হচ্ছে এইঃ
(আরবী*********)
“হে ইমানদারগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং ঐ সমস্ত সুদ ছেড়ে দাও যা এখনো লোকের কাছে অবশিষ্ট আছে। যদি তোমরা মুমিন হও——আর যদি তোমার তওবা কর তাহলে শুধু আসল গ্রহণ করার অধিকার তোমাদের আছে। না তোমরা যুলুম কর আর তোমাদের উপর যুলুম করা হয়”-(সূরা বাকারা: ২৭৮-৭৯)
এখানে দুটো যুলুমের কথা বলা হয়েছে। এক যা ঋণ দাতার ঋণগ্রহীতার উপর করে। দুই যা ঋণগ্রহীতা ঋণদাতার উপর করে; আয়াতের পুর্বাপর বক্তব্য থেকে সুস্পষ্টরুপে জানা যায় যে,ঋণদাতার উপর ঋণ গ্রহীতার যুলুম হচ্ছে–
ঋণদাতার প্রদত্ত আসলটুকুও পরিশোধ না করা ঠিক অনুরূপভাবে ঋণগ্রহীতার উপর ঋণদাতার যুলুম হচ্ছে আসলের উপর অতিরিক্ত দাবী করা। এভাবে কুরআন এখানে সেই যুলুমের অর্থ স্বয়ং নির্দিষ্ট করে বলে দিচ্ছে যা ঋণের ব্যাপারে
ঋণদাতা ও গ্রহীতা একে অপরের উপর করে থাকে। এ অর্থের দিক দিয়ে ইনসাফ এই যে,ঋণদাতা গ্রহীতার কাছ থেকে শুধুমাত্র আসল ফেরত নিবে। আর যুলুম হলো আসলের উপরে অতিরিক্ত আদায় করা। কুরআনের এ পুর্বাপর বক্তব্য অর্থের দিক দিয়ে ততই সুস্পষ্ট যে,ইবনে আব্বাস (রা) এবং ইবনে জায়েদ (রা) থেকে আরম্ভ করে বিগত শতাব্দীর শওকানী ও আলুসী পর্জন্ত সকল তাফসীরকারকগণ এ অর্থই গ্রহণ করেছেন। এ সুদীর্ঘ কালের মধ্যে এমন একজন তাফসীরকার ও পাওয়া যাবেনা। যিনি কুরআন থেকে যুলুমকে সুদ হারাম হবার কারন বলে গ্রহণ করেছেন। আর যুলুমের অর্থ বাইরের কোথাও থেকে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। একটি বাক্যে তার পুর্বাপর বক্তব্য থেকে যে অর্থ প্রকাশ পায় তা উপেক্ষা করে নিজের পক্ষ থেকে তাতে কোনো অর্থ যোগ করে দেয়া নীতিগতভাবে সর্ম্পূর্ণ ভুল।
এ প্রশ্ন প্রসংগে দাবী করা হচ্ছে যে, বাণিজ্যিক সুদে কোনো পক্ষের উপরেই যুলুম হয় না। একথা আমরা স্বীকার করি না। একজন তার পুঁজি ঋণ নিয়ে নির্দিষ্ট মুনাফা লাভের নিশ্চয়তা লাভ করবে,কিন্তু যারা ব্যবসার জন্যে সময়, শ্রম এবং মস্তিষ্ক খরচ করবে তাদের জন্যে মুনাফা লাভের আদৌ কোনো নিশ্চয়তা থাকবে না। বরঞ্চ ব্যবসায় ক্ষতি হলেও ঋণদাতাকে সুদসহ আসল পরিশোধ করবে। এটা কি কম যুলুম? সকল বিপদের ঝুঁকি নিবে যারা পরিশ্রম ও কাজ করবে তাদের ঘাড়ে আর মুনাফা লুটবে পুঁজি সরবরাহকারী। এটা কি করে ইনসাফ হতে পারে? এজন্য সুদ সর্বাবস্থায়ই যুলুম,তা সে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে গৃহীত ঋণের উপরে। ইনসাফ এই যে, আপনি যদি ঋণ দেন, তাহলে শুধু আসল ফেরত পাবার নিশ্চয়তা আপনার থাকতে হবে। আর যদি আপনি ব্যবসায় মূলধন বিনিয়োগ করতে চান, তাহলে একজন অংশীদার হিসেবে বিনিয়োগ করুন।
জবাবঃ অষ্টম প্রশ্ন
এ প্রশ্নের জবাব আমি আমার গ্রন্থ ‘সুদের সংস্কারের কার্যকরী পন্থা’ শীর্ষক অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে দিয়েছি। এখানে সংক্ষেপে জবাব দিচ্ছিঃ
(ক) শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর সাধারণ অংশ সম্পূর্ণ জায়েয কিন্তু শর্ত এই যে, সে সবের ব্যবসা হারাম ধরনের না হয়।
(খ) প্রাধান্যমূলক অংশে (PREFERENCE SHARES) নির্দিষ্ট মুনাফার নিশ্চয়তা থাকে বলে তা সুদের সংজ্ঞায় পড়ে এবং তা নাজায়েয।
(গ) ব্যাংকের নির্দিষ্ট আমানত (FIXED DEPOSITE) সম্পর্কে দু রকম পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। যারা শুধু নিরাপত্তার জন্যে তাদের টাকা জমা রাখতে চায় এবং নিজের টাকা কোনো কারবারে লাগাতে ইচ্ছুক নয়,তাদের টাকা ব্যাংক আমানত রাখার পরিবর্তে ঋণ হিসেবে গ্রহণ করবে,ব্যবসায় খাটিয়ে মুনাফা লাভ করবে এবং আসল টাকা নির্দিষ্ট সময়ে ফেরত দেয়ার নিশ্চয়তা দিবে।
যারা তাদের টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যবসায় লাগাতে চায়,তাদের টাকা আমানত রাখার পরিবর্তে ব্যাংক তাদের সাথে একটা সাধারণ অংশীদারিত্বের চুক্তি করবে। এ ধরনের সমস্ত টাকা ব্যাংকের আওতায় পড়ে এমন বিভিন্ন প্রকারের ব্যবসা, শিল্প, কুষি এবং অন্যান্য কাজে বিনিয়োগ করবে। অতপর এ সামগ্রিক কারবারে যা মুনাফা হবে,তা একটি নির্ধারিত অনুপাতে ঐসব লোকের মধ্যে এমনভাবে ভাগ করে দেবে ব্যাংকের অংশীদারদের মধ্যে যেমনভাবে ভাগ করা হয়।
(ঘ)ব্যাংকের ঋণপত্র (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার বিভিন্ন উপায় আছে। শরীয়ত অনুযায়ী তাদের অবস্থাও আলাদা ধরনের। যেখানে ব্যাংকের শুধু একটি সার্টিফিকেট দেয়া দরকার যে,অমুক ব্যক্তি নির্ভরযোগ্য,সেখানে ব্যাংক বৈধভাবেই তার অফিস খরচ বাবদ গ্রহণ করবে,সেখানে সুদ আরোপ তার উচিত হবে না। তার পরিবর্তে বিভিন্ন বৈধ পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ব্যাংকের চলতি হিসেবে (CURRENT ACCOUNT)ব্যবসায়ীদের যে টাকা থাকে,তার কোনো সুদ দেয়া উচিত হবেনা। বরঞ্চ হিসেব রাখার জন্যে পারিশ্রমিক নেয়া যাবে এবং এসব টাকা স্বল্প মেয়াদী ঋণের আকারে বিনা সুদে ব্যবসায়ীদেরকে দেয়া উচিত। এ ধরনের ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে ব্যাংক কোনো সুদ গ্রহণ করবে না। অবশ্যি অফিস খরচের জন্যে তাদের কাছ থেকে ফিস নিতে পারে।
(ঙ) সরকার স্বয়ং অথবা তার প্রভাবাধীন যত প্রতিষ্ঠান কায়েম করবে তার থেকে সুদ উপাদার দূরীভূত হওয়া উচিত। এর পরিবর্তে সামান্য মনোযোগ দিয়ে এবং চিন্তা-গবেষণা করে অন্য পন্থা আবিষ্কার করা যেতে পারে যা বৈধ এবং লাভজনক হয়। এ ধরনের যাবতীয় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে একটি সার্বিক আলোচনা এখানে কয়েকটি কথায় সম্ভব নয়। প্রথমত, প্রয়োজন হচ্ছে হারাম বস্তুকে হারাম বলে স্বীকার করা। তার থেকে বেঁচে থাকার ইচ্ছা থাকা চাই। তারপর প্রতিটি কর্পোরেশনের জন্যে একটি করে কমিটি গঠন করতে হবে যে,কর্পোরেশনের সকল কাজের উপর দৃষ্টি রাখবে এবং দেখবে যে,কোথায় কোথায় তার বিভিন্ন কাজ-কর্ম হারাম পন্থায় কলুষিত হচ্ছে। আর এটাও দেখবে যে,তার বিকল্প কি হতে পারে যা ইসলামের দৃষ্টিতে জায়েয,কার্যকর এবং লাভজনক হয়। পাশ্চাত্যের প্রতিষ্ঠিত পথে আমরা যে চলতে অভ্যস্ত হয়ে এসেছি,সেই পথেই চক্ষু বন্ধ করে চলতে চাই এবং সকল প্রচেষ্টা এ ব্যাপারে নিয়োজিত করেছি যে,কোনো প্রকারে এ পথ আমাদের জন্যে বৈধ করে দেয়া হোক। সর্বপ্রথম আমাদের এ মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাদের আরাম প্রিয়তা আমাদেরকে অনুমতি দেয় না যে, আমরা চিন্তাভাবনা ও পরিশ্রম করে কোনো নতুন পথ আবিষ্কার করি। দুর্ভাগ্যের বিষয় অন্ধ অনুকরণের ব্যাধি গোটাজাতিকে সংক্রমিত করে রেখেছে। এ ব্যাধি থেকে কি জুব্বাধারী আর কি সুটবুট পরিধানকারী কেউই আরোগ্য লাভ করছে না।
(চ) দেশের অভ্যণ্তর থেকে গৃহীত সরকারী ঋণের সুদ দেয়া যাবে না। এর পরিবর্তে সরকারের যেসব পরিকল্পনার অধীন ঋণের মূলধন খাটানো হয়,সেগুলোকে একটি মূলনীতির উপর সংগঠিত করতে হবে এবং তার যে মুনাফা হবে,তার থেকে একটা নির্ধারিত অনুপাতে মুনাফা ঐসব লোকের মধ্যে বন্টন করতে হবে যাদের পুঁজি ব্যবহার করা হচ্ছে। তারপর যে সময়ের জন্যে তাদের টাকা নেয়া হয়েছিল তার মেয়াদ শেষ হবার পর আসল টাকা ফেরত দিলে,মুনাফা লাভে তাদের অংশীদারিত্ব আপনা আপনি শেষ হয়ে যাবে। এ অবস্থার প্রকৃতপক্ষে কোনো বিরাট পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে না। নির্দিষ্ট হারে সুদে যে ঋণ গ্রহণ করা হয়, তা পরিবর্তন করে শুধু লাভের অনুপাতের অংশীদারিত্বের রৃপ দিতে হবে।
বিদেশ থেকে যে ঋণ গ্রহণ করা হয়,সে বিষয়টি বেশ জটিল। যতক্ষণ পর্যন্ত এসব ঋণের যাঁচাই-পর্যালোচনা বিশদভাবে করা না হয়েছে,ততক্ষণ এদের ধরন কি হবে এবং এসব ব্যাপারে অবৈধতা থেকে বাঁচার জন্যে কতদূর কি করা যেতে পারে,তা বলা যায় না। অবশ্যি নীতিগত দিক দেয় যে কথা আমি বলতে পারি তা এই যে,আমাদের সকল মনোযোগ ও প্রচেষ্টা দেশের অভ্যন্তর থেকে সুদ দুর করার কাজে নিয়োজিত করতে হবে। আর বাইরের দেশগুলোর সাথে সূদী লেনদেন থেকে বাঁচার কোনো উপায় যতদিন না থাকবে,ততদিন এ বিপদ বরদাশত করতে হবে। আমাদের ক্ষমতার সীমা যতটুকু পর্যন্ত,ততটুকু পর্যন্তই খোদার কাছে দায়ী। সে সীমা পর্যন্ত যদি আমরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারি,তাহলে বাধ্যতামূলকভাবে কিছু করলে তার জন্যে ক্ষমা পাবার আশা করতে পারি।–(তর্জমানুল কুরআন মে-জুন-১৯৬০)
———