পরিশিষ্টঃ দুই
ইসলামী সংস্কৃতি সংস্থার প্রশ্নমালা ও তার জবাব
(১৯৬০ সালের প্রথম দিকে লাহোরের ইসলামী সংস্কৃতি সংস্থা একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে সুদ সম্পর্কিত কতকগুলো গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন আলোচিত হয়। এ উদ্দেশ্যে সংস্থা একটি প্রশ্নমালা প্রণয়ন করে, যার মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো সন্নিবিশিত ছিল। এ প্রশ্নমালা এবং গ্রন্থকার কর্তৃক প্রদত্ত জবাব এখানে লিপিবদ্ধ করা হলো।)
প্রশ্নমালা
একঃ আরবে নবী (স)- এর যমানায় ঋণের আদান প্রদান কিভাবে হতো?
দুইঃ ‘রিবা’ (আরবী****) শব্দের অর্থ কি?
তিনঃ ‘রিবা’ এবং রাবাহ (লাভ)- এর মধ্যে পার্থক্য।
চারঃ ‘রিবা’তে ঋণদাতা শর্ত নির্ধারিত করে এবং ব্যাংকের সুদে (BANK INTRREST) ঋণগ্রহীতা শর্ত পেস করে।
পাঁচঃ বায়-এ-সালাম (আরবী******) ও ব্যবসায় সংক্রান্ত সুদের ( COMMERCIAL INTEREST) এর মধ্যে পার্থক্য কি? এক ব্যক্তি দশ সের দুগ্ধ প্রদানকারিণী একটি মহিষ অপর এক ব্যক্তিকে দিয়ে বলল, এর দুধের মধ্যে পাঁচ সের করে আমাকে দিতে থাকবে। এ যদি জায়েয হয়, তাহলে এর এবং লাভের উপর টাকা ঋণ দেয়ার মধ্যে পার্থক্য কি?
ছয়ঃ সমশ্রেণীর বস্তুর বিনিময় সমশ্রেণীর আধিক্যসহ কেন নাজায়েয, যখন আধিক্যসহ অসমশ্রেণীর বস্তুর বিনিময় জায়েয?
সাতঃ ব্যবসায়ে উভয় পক্ষের সম্মতি অপরিহার্য কিনা? কারো কারো মতে উভয় পক্ষের সম্মতির অভাবই সুদ সৃষ্টি করে। ক্ষতির কোনো প্রশ্নই ঊঠে না। সুদ হারাম হওয়ার ভিত্তি কি এই যে, এতে এক পক্ষের উপর যুলুম করা হয়? ব্যবসায় সংক্রান্ত সুদে কোনো পক্ষের উপরই যুলুম হয় না। যদি একথা ঠিক হয় যে, কোনো পক্ষের উপরই যুলুম হয় না, তাহলে ব্যাংকের সুদ ‘রিবা’র আওতায় কিভাবে পড়ে?
আটঃ (ক) শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাধারন অংশ
(খ) তাঁর অগ্রগণ্য অংশ (PREFERENCE SHARES)
(গ) ব্যাংকের ফিকস্ট ডিপোজিট।
(ঘ) ব্যাংকের দায়পত্র (LETTER OF CREDIT) খোলা, তার বিভিন্নতা। যদি লেটার অব ক্রেডিটের ভিত্তিতে ব্যবসায়ের জন্যে ঋণ গ্রহণ অবৈধ হয়, তাহলে এর জন্যে বৈধ পন্থা কি হতে পারে, যাতে করে ব্যবসার ব্যবস্থাপনায় কোনো অসুবিধা বা ক্ষতি না হয়?
(ঙ) হাউজ বিল্ডিং, ফিনান্স কর্পোরেশন এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কর্পোরেশন।
(চ) সরকারের ঋণ-আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক, যদি এসব অবৈধ হয় তাহলে দেশের শাসনতন্ত্র পরিচালনার বিকল্প ব্যবস্থা কি হতে পারে?
জবাবঃ প্রথম প্রশ্ন
প্রথম প্রশ্নে কতকগুলো ব্যাখ্যামূলক বিষয় রয়েছে তা নিম্নরূপঃ
একঃ কুরআন নাযিলের সময় ব্যবসা, শিল্প, কৃষি ও রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্যে ঋণের আদান-প্রদান দুনিয়ায় প্রচলিত ছিল কিনা?
দুইঃ এসব ঋণের উপর সুদ গ্রহণ করা হতো কিনা?
তিনঃ এসব উদ্দেশ্যে ঋণের আদান-প্রদান ছিল একথা আরববাসীদের পুরোপুরি জানা ছিল কিনা?
চারঃ এ ধরণের ঋণ আসলের উপর অতিরিক্ত যা কিছু নেয়া হতো তাঁর জন্যে কি ‘রিবা’র পরিভাষা ব্যবহৃত হতো, না তার জন্যে অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার করা হতো?
এ ব্যাখ্যামূলক বিষয়াদির আলোচনা করার পুর্বে প্রাক-ইসলামী যুগের আরবের অর্থনৈতিক ইতিহাস এবং বহির্জগতের সাথে তার সম্পর্ক কি ছিল তা আমাদেরকে দেখতে হবে, যাতে করে এ ভুল ধারণা রয়ে না যায় যে, আরব পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দেশ মাত্র ছিল, যার অধিবাসীবৃন্দ তাদের উপত্যকা ও মরুভূমির বাইরের জগত সম্পর্কে কোনো আভাসই রাখতো না।
প্রাচীন ইতিহাসের যেসব উপাদান বর্তমান বিশ্বে বিদ্যমান আছে, তার থেকে একথা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, সে যুগে চীন, ভারত, প্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর এবং অনুরূপভাবে পুর্ব আফ্রিকার যত ব্যবসা-বাণিজ্য মিসর, সিরিয়া, এশিয়া মাইনর, রোম ও গ্রীসের সাথে চলতো তার সবই আরবের মধ্যস্থতায়ই হতো, এসব ব্যবসা-বাণিজ্যর তিনটি বড় বড় পথ ছিল, একঃ ইরান থেকে স্থল পথে ইরান ও সিরিয়া হয়ে, দুইঃ পারস্য উপসাগর থেকে সমুদ্র পথে। এ পথের সমুদয় পণ্যদ্রব্য আরবের পুর্ব উপকূলে অবতরণ করতো। এবং দুমাতুল জন্দল অথবা তাদমুর (PALMYRA) হয়ে অগ্রসর হতো। তিনঃ তৃতীয় পথ ছিল ভারত মহাসাগর দিয়ে। এ পথে যাতায়াতকারী যাবতীয় পণ্যদ্রব্য হাদারামাওত ও ইয়ামান হয়ে অতিক্রম করতো। এ তিনটি পথেই আরবগণ বসবাস করতো। স্বয়ং আরববাসীগণ এক দিক থেকে পণ্য খরিদ করে অন্যদিকে গিয়ে বিক্রি করতো। পরিবহণের কাজও সমাধা করতো তারাই। উপরন্তু নিজেদের এলাকা দিয়ে অতিক্রমকারী বাণিজ্য বহর বা কাফেলার নিকট থেকে মোটা কর আদায় করে তাদের নিরাপদে যাতায়াতের দায়িত্বও তারা গ্রহণ করতো। এ তিন উপায়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাথে সর্বদা তাদের গভীর সম্পর্ক বিরাজমান ছিল। খৃষ্টপুর্ব ২৭০০ সাল থেকে ইয়ামান ও মিশরের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের সুপষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। খৃষ্টপুর্ব ১৭০০ সালে বণি ঈসরাঈলের বাণিজ্যে বহরের তৎপরতার বিবরণ তওরাতে পাওয়া যায়। উত্তর হেজাজে মাদ্য়ান এবং দেদানের ব্যবসা-বাণিজ্য খৃষ্টের দেড় হাজার বছর পুর্ব থেকে কয়েক শতাব্দী পর পর্যন্ত চলতো বলে জানা যায়। হযরত সুলায়মান (আ) এবং হযরত দাঊদ (আ) এর যমানা (খৃঃ পূঃ ১০০০) থেকে ইয়ামানের সাবায়ী গোত্র এবং তাদের পরে হোমায়রী গোত্র খৃষ্টীয় প্রথম কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত ক্রমাগতভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে আসছিল। হযরত ঈসা (আ) এর নিকটবর্তী সময়কালে ফিলিস্তিনের ইয়াহূদীগণ আরবদেশে এসে ইয়াস্রিব, খয়বর, ওয়াদিউল কুরা (বর্তমান আলউলা), তাইমা এবং তাবুকে বসবাস শুরু করে, তাদের স্থায়ী সম্পর্ক ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক – সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিসরের সাথে অক্ষুন্ন থাকে। সিরিয়া ও মিশর থেকে খাদ্যশস্য এবং মদ আরবে আমদানীর কাজ ইয়াহুদীগণই করতো। পঞ্চম খৃষ্টীয় শতাব্দী থেকে কুরাইশগণ আরবের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিকতর অংশ গ্রহণ শুরু করে এবং নবী (স)-এর যমানা পর্যন্ত একদিকে ইয়ামান ও আবিসিনিয়ার সাথে এবং অপরদিকে ইরাক, মিশর ও সিরিয়ার সাথে তাদের বিরাট আকারে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। পুর্ব আরবে ইরানের যত ব্যবসা-বাণিজ্য ইয়ামানের সাথে চলতো, তার বৃহত্তর অংশ হীরা থেকে ইয়ামামা ( বর্তমান রিয়াদ) এবং অতঃপর বনী তামীমের এলাকা অতিক্রম করে নাজরান এবং ইয়ামামা পর্যন্ত পৌছাতো। শত শত বৎসরের এ ধরণের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকার পর এ কথা মনে করা সম্পুর্ণ অসংগত হবে যে, বহির্বিশ্বের এসব দেশে যে আর্থিক লেনদেন ও বাণিজ্যিক প্রথা প্রচলিত ছিল সে সম্পর্কে আরববাসীগণ অজ্ঞ ছিল।
এসব বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছাড়াও রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও চতুষ্পার্শস্থ সুসভ্য জগতের সাথে আরববাসীদের গভীর সম্পর্ক ছিল। খৃষ্টপুর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে উত্তর হেজাজে তাইমা নামক স্থানটিকে বাবেলের বাদশাহ নেবুনিদুস (NABONIDUS) তার গ্রীষ্মাবাসে পরিণত করেন। এটা কি করে সম্ভব যে, বাবেলে যে অর্থনৈতিক আইন-কানুন ও রীতিনীতি প্রচলিত ছিল, সে সম্পর্কে হেজাজের লোক অবহিত ছিল না? খৃষ্টপুর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে আরম্ভ করে নবী করীম (স)-এর সময়-কাল পর্যন্ত প্রথমত পেট্রার (PETRA)নাবতী রাষ্ট্র, তারপর তাদমুরের সিরীয় রাষ্ট্র এবং পরবর্তীকালে হীরা ও গাস্সানের রাষ্ট্রদয় ইরাক থেকে মিশর সীমান্ত পর্যন্ত এবং হেজাজ ও নজদ সীমান্ত থেকে আলজিরিয়া ও সিরিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত ছিল। এসব রাষ্ট্রের একদিকে গ্রীস ও রোমের সাথে এবং অপরদিকে ইরানের সাথে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক, তামাদ্দুনিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল। তারপর বংশগত সম্পর্কের ভিত্তিতে আরবের অভ্যন্তরীণ গোত্রগুলোও তাদের সাথে ব্যাপক সম্পর্ক রাখতো। মদীনার আনসারগণ এবং গাস্সানের শাসক একই বংশভুক্ত এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল। নবী করীম (স)- এর সময়ে স্বয়ং তাঁর কবি হাসান বিন সাবিত গাস্সানের শাসনকর্তাদের নিকটে যাতায়াত করতেন। হীরার শাসকদের সাথে কুরাইশদের অতি ঘনিষ্ঠতা ছিল। এমন কি কুরাইশদের লোকেরা তাদের কাছেই লেখা-পড়া শিক্ষা করে। হীরা থেকেই তারা আরবী লিখন পদ্ধতি শিক্ষা করেছিল যা পরবর্তীকালে কুফী লিখন পদ্ধতি নামে পরিচিত। এখন কিভাবে এ কথা বিশ্বাস করা যায় যে, এসব সম্পর্ক সম্বন্ধ থাকা সত্ত্বেও এরা গ্রীস, রোম, মিসর, সিরিয়া, ইরাক ও ইরানের আর্থিক ও অর্থনৈতিক বিষযাদির সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল।
উপরন্তু আরবের সকল এলাকায় শায়খ, সম্ভ্রান্ত ও বড় বড় ব্যবসায়ীদের নিকটে বহুসংখ্যক রোমীয়, গ্রীক এবং ইরানী ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী থাকতো। ইরান ও রোমীয়দের মধ্যে যুদ্ধে উভয় পক্ষের যুদ্ধবন্দীকে গোলামে পরিণত করা হতো। এদের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বহুসংখ্যক ক্রীতদাসকে খোলা বাজারে বিক্রি করা হতো এবং আরব এ দাসব্যবসায়ের বিরাট বাজারগুলোর অন্যতম বাজার ছিল। এসব ক্রীতদাসের মধ্যে অনেক উচ্চশিক্ষিত সুসভ্য লোকও থাকতো। তাদের মধ্যে ব্যবসায়ী এবং শিল্প ব্যবসায়ীও থাকতো। আরবের শায়খ এবং ব্যবসায়ীগণ এদের দ্বারা বহু কাজ করিয়ে নিতো। মক্কা, তায়েফ, ইয়াসরিব এবং অন্যান্য কেন্দ্রগুলোতে এ ধরণের বহু ক্রীতদাস বসবাস করতো। তারা কারিগর হিসেবে এবং ব্যবসায় ক্ষেত্রে কর্মী হিসেবে তাদের প্রভুদের সেবা করতো। অতএব এ কি করে সম্ভব যে, এসব অধীন কর্মচারীদের মাহ্যমে আরব ব্যবসায়ীদের কানে একথা কখনো পৌছায়নি যে, পার্শ্ববর্তী দুনিয়ার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে কোনো রীতি-পদ্ধতি প্রচলিত ছিল?
এর সাথে আরবদের অর্থনৈতিক ইতিহাসের আর একটি দিকও লক্ষ্য করা প্রয়োজন। আরব কোনো কালেই খাদ্যর দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পুর্ণ ছিল না এবং সেখানে এমন কোনো শিল্প-কারখানাও গড়ে ওঠেনি, যার দ্বারা সকল প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দেশের মধ্যে থেকেই সংগ্রহ করা যেতো। এ দেশে খাদ্য ও শিল্পজাত দ্রব্যাদি সর্বদা বহির্দেশ থেকে আমদানী করা হতো। এমন কি পরিধাণের বস্ত্রাদি পর্যন্ত বাইরে থেকে আনা হতো। নবী করীম (স)-এর নিকটবর্তী কালে এ আমদানী ব্যবসায় দু শ্রেণির লোকের হাতে ছিল। এক. কুরাইশ ও সাকীফ এবং দুই. ইয়াহুদী। কিন্তু এরা মাল আমদানী করে কেবল মাত্র পাইকারী বিক্রি করতো। দেশের অভ্যন্তরে ছোট ছোট পল্লী ও গোত্রগুলোর মধ্যে খুচরা বিক্রির কাজ তাদের ছিল না। তা সম্ভবও ছিল না। আর গোত্রগুলো কখনোও এটা পছন্দ করতো না যে, ব্যবসায় যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা কেবল তারাই ভোগ করবে এবং তাদের আপন লোকদের এ ব্যবসায় ইজারাদারীতে প্রবেশ করার কোনোই পথ থাকবে না। এজন্য পাইকারী বিক্রেতা হিসেবে তারা দেশের অভ্যন্তরে খুচরা বিক্রেতা ব্যবসায়ীদের কাছে লাখো লাখো টাকার মাল বিক্রি করত। এসবের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ধারেও বিক্রি করা হতো। সম্ভবত দুনিয়ার কোথাও পাইকারি বিক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতার মধ্যে নগদ লেনদেনের প্রথা প্রচলিত ছিল না। এ লেনদেনে ধার দেয়া-নেয়া ছিল একেবারে অপরিহার্য যার থেকে গত্যন্তর ছিল না। যদি এরূপ দাবী করা হয় যে, শুধু আরবেই লেনদেন নগদ নগদ প্রদানের শর্তেই হতো এবং বাকী বা ঋণের কোনো রীতিই ছিল না, তাহলে জ্ঞান-বিবেকের দিক দিয়ে তা গ্রহণযোগ্যে হতে পারে না। ইতিহাসের নিরিখেও তা হবে ভুল, যে বিষয়ে আমি সামনে আলোচনা করব।
এখন আমি পুর্বের উল্লিখিত ব্যাখ্যায় আসছি।
একথা ইতিহাস থেকে প্রমাণিত আছে যে, প্রাচীন কালে ঋণ শুধু ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই নেয়া হতো না। বরঞ্চ ব্যবসা, শিল্প ও কৃষির উদ্দেশ্যেও এ ঋণের প্রথা প্রচলিত ছিল। রাষ্ট্রগুলোও তাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ঋণ গ্রহণ করতো। এ দাবি ভিত্তিহীন যে, প্রাচীন জগতে ঋণের লেনদেন শুধুমাত্র ব্যাক্তিগত প্রয়োজনেই হতো। একথাও প্রমাণিত আছে যে, ঋণের উপরে আসল থেকে অতিরিক্ত একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ অথবা মাল গ্রহণের প্রথাও ছিল। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে অথবা ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে গৃহীত ঋণের মধ্যে কোনো তারতম্য না করে এ অতিরিক্ত গ্রহণের প্রথা সকল ব্যাপারে প্রচলিত ছিল।
ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকার (১৯৪৬) ‘ব্যাংক’ প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে, বাবেল এবং মিসরের মন্দিরগুলো শুধুমাত্র উপাসনালয়ই ছিল না, ব্যাংকও ছিল। বাবেলের পুরাতাত্ত্বিক কীর্তির মধ্যে যেসব মাটির তক্তি বা টাইল পাওয়া গেছে, তার থেকে জানা যায় যে, জমির মালিক তার চাষের পুর্বে কৃষি কাজের জন্য এসব মন্দির থেকে টাকা ঋণ নিতো এবং ফসল কাটার পর সুদসহ এ ঋণ পরিশোধ করতো। এ মহাজনী সুদী ব্যবস্থা খৃস্টপুর্ব ২০০০ সালেও বিদ্যমান ছিল। খৃস্টপুর্ব ৫৭৫ সালে বাবেলে ইজিবি (IGIBI)নামক ব্যাংকের অস্তিত্ব ছিল জানা যায়। এ ব্যাংক জমির মালিকদের কৃষির উদ্দেশ্যে ঋণ দান করতো। এ ব্যাংক লোকের কাছ থেকে টাকা জমা রেখে তার সুদ দিত। মনে রাখতে হবে এ সে সময়ের কথা যখন হেজাজের তাইমা শহর বাবেল সরকারের গ্রীষ্মবাস ছিল। দ্যল্ দুরান্ত তার (A HISTORY OF CIVILIZATION ) গ্রন্থে বাবেল সম্পর্কে বলেন, “দেশের আইন অনুযায়ী নগদ টাকার ঋণের উপরে শতকরা বিশ টাকা হারে এবং শতকরা ৩৩ ভাগ বার্ষিক দ্রব্য হিসেবে ঋণের সুদ নির্ধারিত ছিল। কোনো কোনো শক্তিশালী বংশ বংশানুক্রমে সুদী মহাজনী কারবার করতো। তারা শিল্পজীবী লোকদেরকেও সুদে ঋণ দিত। তাছাড়া মন্দিরের পুরোহিতগণ ফসল প্রস্তুতির জন্যে জমির মালিকদের ঋণ দিত।”
এ গ্রন্থকার আরও বলেনঃ
“একটি মহামারির মতো বিস্তারলাভকারী সুদখোরী ব্যবস্থা আমাদের শিল্পের মতো, বাবেলের শিল্প প্রতিষ্ঠানকেও জটিল ঋণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পুষ্টি সাধনের পরিবর্তে নিঃশেষিত করে ফেলতো। বাবেলের সভ্যতা ছিল আসলে একটি বাণিজ্যিক সভ্যতা। সেসব প্রাচীন কীর্তিসমূহ থেকে যত প্রকার তথ্য বর্তমানে পাওয়া গেছে তার অধিকাংশই ছিল ব্যবসা সংক্রান্ত ধরনের যথা, বিক্রি, ঋণ, ঠিকা, অংশিদারী, দালালী, বিনিময়, একরার নামা, তমসুক এবং এ জাতীয় আরও অনেক কিছু।”১[ ১ম খন্ড, পৃঃ ২২৮-২২৯]
আসিরিয়ার অবস্থাও ভিন্নতর ছিল না। খৃষ্টপুর্ব ৭ম শতাব্দীতে সিনাকারীবের সময়ের অবস্থা বর্ণনা করে দ্যল দুরান্ত বলেনঃ “ব্যক্তিগত কারবারকারী মহাজনগণ শিল্প ও ব্যবসায়কে কিছু পরিমাণ পুঁজি সংগ্রহ করে দিত এবং এর জন্যে বার্ষিক শতকরা ২৫ টাকা হারে সুদ আদায় করতো।”২[প্রথম খন্ড পৃঃ ২৭৪]
গ্রীস সম্পর্কে ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকার ব্যাংক শীর্ষক প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে, খৃষ্টপুর্ব ৪র্থ শতাব্দী থেকে যেখানে ব্যাংক প্রথার যথারীতি ব্যবস্থাপনা চালু ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ব্যবস্থাপনায় এমনও এক ধরণের ব্যাংক ছিল যা লোকের কাছ থেকে আমানত স্বরূপ সম্পদ গচ্ছিত রাখতো এবং তার জন্যে সুদ প্রদান করতো।
দ্যল্ দুরান্ত বলেন যে, খৃষ্টপুর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ডেলফির অ্যাপোলো মন্দির সমগ্র গ্রীক সাম্রাজ্যের আন্তর্জাতিক ব্যাংক ছিল। তার থেকে লোকজন এবং রাষ্ট্রসমূহ একটা পরিমিত হারে সুদসহ ঋণ গ্রহণ করতো। এভাবে বেসরকারী পোদ্দার শতকরা বার থেকে ত্রিশ পর্যন্ত হারে সুদে ব্যবসায়ীদেরকে ঋণ দিতো। গ্রীকগণ এ প্রথা নিকট প্রাচ্যের (বাবেল, মিশর ও ইরাক) নিকট থেকে শিক্ষা করে এবং পরবর্তীকালে গ্রীস থেকে রোম এ প্রথা শিক্ষা করে। পঞ্চম শতাব্দীর শেষ ভাগে কতকগুলো বড় বড় বেসরকারী ব্যাংক গ্রীসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তার মাধ্যমে এথেন্সের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার লাভ করে।১[ঐ পৃঃ ২৬২-২৬৩]
তারপর রোমীয় যুগ শুরু হয়। দ্যল্ দুরান্ত বলেনঃ
“খৃষ্টপুর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী রোমের ব্যাংক ব্যবস্থা উন্নতির শীর্ষস্থানে উপনীত হয়েছিল। মহাজন লোকের আমানত গ্রহণ করতো এবং তার জন্যে সুদ দিত। কারবারে নিজের মূল্ধনের সাথে অন্যর মূলধনও বিনিয়োগ করা হতো ২.[তৃতীয় খন্ড পৃঃ ৮৮]। খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রোম সাম্রাজ্যর প্রত্যেক অংশে ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যাংকিং- এর অন্যান্য কাজের সাথে লোকের আমানত রেখে সুদ দেয়া হতো এবং অর্থ ঋণ দিয়ে সুদ আদায় করা হতো। এ কারবার অধিকাংশ গ্রীক এবং সিরিয়দের হাতে ছিল। গলে (GALL) তো সিরিয়াবাসী ও মহাজন সমার্থবোধক শব্দ হয়ে পড়েছিল। সে সময়ে সরকারী ধনাগারও জমির মালিকদেরকে ফসল জামিনের উপরে সুদে ঋণ দিত। আগষ্টাসের সময় সুদের হার শতকরা চার টাকা হারে নেমে আসে। তার মৃত্যুর পর সুদের হার শতকরা চয় টাকা এবং কনষ্ট্যানটাইনের সময় শতকরা বার টাকা পর্যন্ত বর্ধিত হয়।”৩.[তৃতীয় খন্ড পৃঃ ২৩১-২৩৬]। এ প্রথম শতাব্দী সম্পর্কে ব্যারন (BARON) তার A RELIGIOUS AND SOCIAL HISTORY OF THE JEWS নামক গ্রন্থে বলেন যে, আলেকজান্দ্রিয়ার ইয়াহুদী ব্যাংক মালিক আলেকজান্ডার এবং ডিমষ্ট্রীউস ইয়াহুদীয়ার বাদশাহ প্রথম এগ্রিপাকে দু লাখ দিরহাম (প্রায় ত্রিশ হাজার ডলার) ঋণ দিয়াছিল।৪.[ব্যারণ ১ম খন্ড পৃঃ ২৬১]
নবী মুহাম্মদ (স)- এর নিকটতম সময়ে অর্থাৎ তার জন্মের পাঁচ বছর পুর্বে, রোম সম্রাট জাষ্টিনিয়ানের মৃত্যু হয়। এ সম্রাটের রাজত্বকালে সমগ্র বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে আইন করে জমির মালিক ও কৃষকদের গৃহীত ঋণে শতকরা চার, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে গৃহীত ঋণে ছয়, ব্যবসা ও শিল্প সংক্রান্ত ঋণে আট এবং সামুদ্রিক বাণিজ্য সংক্রান্ত ঋণে বারো টাকা হারে সুদ নির্ধারিত করা হয়। এ আইন জাষ্টিনিয়ানের মৃত্যুর পরও কিছুকাল পর্যন্ত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে বলবৎ ছিল। ১.[দ্যল্ দুরান্ত ৪র্থ খন্ড পৃঃ ১২০, ৩৩৬, গীবন DECLINE AND FALL OF THE RO-MAN EMPIRE ২য় খন্ড পৃঃ ৭১৬]। এ কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, যে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে এ সুদ প্রথা চালু ছিল, তার সীমান্ত উত্তর হেজাজের সাথে মিলিত হয়েছিল। সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিসরের সমগ্র এলাকা ছিল এ সাম্রাজ্যের অধীন। কুরাইশ বণিকগণ সেসব এলাকার ব্যবসা কেন্দ্রে সর্বদা আনাগোনা করতো। স্বয়ং নবী মুহাম্মদ (স) বাল্যকাল থেকে নবুয়াত পর্যন্ত সময়-কাল বাণিজ্যিক কাফেলার সাথে এসব ব্যবসা কেন্দ্রে যাতায়াত করতেন। একথা কি করে মনে করা যেতে পারে যে, কুরাইশ বণিকগণ এবং স্বয়ং নবী মুহাম্মদ (স) এসব বাজারের সাথে বাণিজ্যিক লেনদেন করা কালে কিছুতেই জানতে পারেননি যে, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে ব্যবসা, কৃষি এবং শিল্পের জন্যে ঋণ আদান-প্রদানের প্রথা প্রচলিত আছে এবং আইনগতভাবে তার জন্যে সুদের হার নির্ধারিত আছে।২.[হেজাজ থেকে কুরাইশের যে কাফেলা ফিলিস্তিন ও সিরিয়ায় যেতো তাদের জারীজুরী ও জাকজমকের ধরণ এর থেকে বুঝা যায় যে, বদর যুদ্ধের সময় আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে যে কাফেলা সিরিয়া থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করছিল, তার সাথেই আড়াই হাজার উট ছিল। মনে রাখতে হবে যে, এত বড় কাফেলা নিয়ে যারা গিয়েছিল তাদের সংখ্যা অন্ততপক্ষে দু’আড়াই হাজারের কম হতে পারে না। এখন এ কি ধারণা করা যেতে পারে যে, যেখানে একটি শহরের এত সংখ্যক লোক অন্য দেশে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য গমন করে তারা এ বিষয়ে মোটেই ওয়াকিবহাল থাকবে না যে, সে দেশে অর্থনৈতিক লেনদেনের কি নিয়ম-নীতি প্রচলিত ছিল?]
ঠিক নবী মুহাম্মদ (স) এর সময়ে রোম এবং ইরানের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছিল, যার উল্লেখ কুরআন মাজীদে সূরা রোমে রয়েছে। এ যুদ্ধে যখন হিরাক্লিয়াস খসরু পারভেজের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অভিযান চালান, তখন তার সামরিক প্রয়োজনের জন্যে তাকে গীর্জাসমূহের সঞ্চিত অর্থ সুদে ঋণ নিতে হয়েছিল। ৩.[Cambridge Economic History of Europe-Vol, 2,P.90(Gibbon Decline and Fall of the Roman Empire Vol. 2, P.791]. যে মহাযুদ্ধ ইরাক থেকে মিসর পর্যন্ত আরবের সমগ্র উত্তরাঞ্চল লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল, যাতে ইরানের জয়-জয়কার চারদিকে আলোচনার বস্তু হয়ে পড়েছিল এবং যে যুদ্ধে রোমের পতনোন্মুখ প্রাসাদকে ধ্বংসের মুখ থেকে রক্ষা করার পর রোম সম্রাট হঠাৎ খসরুর বিরুদ্ধে বিস্ময়কর অভিযান পরিচালনা করেন। যার ফলে সাসানীর রাজধানী মাদায়েন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল, সে যুদ্ধের কথা আরববাসীদের কাছে গোপন থাকবে এবং রোম সম্রাট যে গীর্জাসমূহের কাছ থেকে পুঁজি সংগ্রহ করেছিলেন, তাও তাদের অজানা থাকবে — এ কথা কি করে বিশ্বাস করা যায়? অগ্নি উপাসকদের হাত থেকে খৃষ্টধর্মকে রক্ষা করার জন্যে এবং শুধু বায়তুল মাকদাসই নয়, পবিত্র ক্রুশকে মুশরিকদের খপ্পর থেকে উদ্ধার করার জন্যে যুদ্ধ করতে হবে; আর গীর্জার পাদ্রীগণ এ মহৎ কাজের জন্যে সুদে অর্থ ঋণ দেবে, এমন অদ্ভুত ঘটনা লোকের অগোচরে কি করে থাতে পারে? অথচ তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে ছিল দুটো সাম্রাজ্যের যুদ্ধের ফলাফলের উপর। বিশেষ করে কুরাইশগণ তো এ ব্যাপারে অনবহিত থাকতেই পারে না। কারণ সূরা আর রূম নাযিল হবার পর এ রোম-ইরান যুদ্ধের ব্যাপারে হযরত আবু বকর ও কুরাইশ সরদারদের মধ্যে বাজী ধরা হয়েছিল।
এ পর্যন্ত আমি যা কিছু বলেছি তার থেকে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, মধ্য প্রাচ্যের অর্থনৈতিক, তামাদ্দুনিক ও রাজনৈতিক জীবনের সাথে অতি প্রাচীনকাল থেকে আরববাসীদের ঘণিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এ ভুখন্ডে আড়াই হাজার বছর থেকে ব্যবসা, শিল্প, কৃষি ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যে ঋণের লেনদেন এবং তার জন্যে সুদ আদায় করার যে রীতি প্রচলিত ছিল, এ সম্পর্কে আরববাসীদের অনবহিত থাকা এবং কোনোরূপ প্রভাবিত না হবার ধারনাই করা যেতে পারে না।
এখন নবী (স)- এর সময়ের অর্থনৈতিক কারবারের প্রতি লক্ষ্য করুন। আমি পুর্বে বলেছি যে, আরব দেশে খাদ্য এবং মদ প্রধানত ইয়াহুদীগণ আমদানী করতো। অন্যান্য দ্রব্যাদির অধিকাংশ মক্কা ও তায়েফের ব্যবসায়ীগণ বহির্দেশ থেকে আমদানী করতো। আমি এ কথাও বলেছি যে, কুরাইশ সাকিফ এবং ইয়াহুদদের ব্যবসা ছিল পাইকারী। দেশের অভ্যন্তরে খুচরা ব্যবসা করতো অন্য লোক। তারা পাইকারী বিক্রেতাদের কাছ থেকে মাল খরিদ করে নিয়ে যেতো। আমি এ কথাও বলেছি যে, পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে নগদ মূল্যে ক্রয়-বিক্রয় দুনিয়ার কোথাও ছিল না। আরবেও তা ছিল না। তারপর নবী করীম (স) এর নিকটবর্তী সময়ে তফসীরকারগণ ‘রিবার’ আয়াতের যে তফসীর করেছেন, তার প্রতিও লক্ষ্য করুন।
(আরবী********)- এ আয়াতের তফসীরে যাহ্হাক বলেনঃ
-(আরবী*************)
এটা ছিল সেই সুদ যার মাধ্যমে লোক জাহেলিয়াতের যুগে কেনা-বেচা করতো। কাতাদা বলেনঃ
(আরবী***************)
“জাহেলিয়াতের যুগে সুদ এই ছিল যে, একজন অন্য জনের কাছে মাত্র বিক্রি করতো এবং মূল্য পরিশোধের একটি তারিখ নির্ধারিত করতো। সময় অতিক্রম করলো কিন্তু ক্রেতার মূল্য পরিশোধ করার মতো টাকা হলো না। তখন বিক্রেতা তার উপরে অতিরিক্ত টাকা চাপিয়ে দিত এবং সময় আরও বাড়িয়ে দিত।”১
[এর থেকে একথাও জানতে পারা যায় যে, মূল্য আদায়ের প্রথম যে অবকাশ দেয়া হয় তার জন্যে কোনো সুদ আরোপ করা হতো না। অবশ্যই প্রথম মেয়াদ শেষ হবার পর মূল্য পরিশোধ না করলে দ্বিতীয়বার অবকাশ দিয়ে মূল্যের উপর সুদ চাপিয়ে দেয়া হতো। সমাজে সাধারণত বড় ব্যবসায়ী ছোট ব্যবসায়ীদেরকে তার গ্রাহক করে রাখার উদ্দেশ্যে এ ধরণের সুযোগ দিয়ে থাকতো। ক্ষুধার্ত খরিদদারকে এ ধরণের সুযোগ-সুবিধা কোথাও দেয়া হতো না।] –ইবনে জারীর
সুদ্দী বলেনঃ
(আরবী*************)
এ আয়াতটি আব্বাস বিন আবদুল মুত্তালিব এবং বনী মুগীরার জনৈক ব্যক্তি সম্পর্কে নাযিল হয়েছিল। এরা উভয়ে জাহেলিয়াতের যিগে ব্যবসার অংশীদার ছিলেন। তারা সাকীফ গোত্রের বনী আমরের লোকের মধ্যে সুদী ঋণে মাল দিয়ে রেখেছিলেন। ইসলাম গ্রহণের সময় তাদের বিরাট পুঁজি সুদে লাগানো ছিল।২.[ইবনে জারীর পৃঃ ৭১]
এসব বর্ণণা থেকে জানতে পারা যায় যে,খুচরা বিক্রেতাদেরকে মাল ধারে বিক্রি করে তার উপর সুদ আরোপ করা হতো। আরও জানা যায় যে,এ বাণিজ্যিক সুদের জন্যে ‘রিবার’ পরিভাষাই ব্যবহার করা হতো এবং ‘রিবা’ শুধুমাত্র সেই ঋণের সুদের জন্যে ব্যবহৃত হতো,যা নিরেট ব্যক্তিগত প্রয়োজনের জন্যে নেয়া হতো।
অতপর বুখারীতে সাতটি স্থানে১.[বুখারী-কিতাবুয যাকাত, কিতাবুশ শুরুত, কিতাবুল ইস্তিকরায, কিতাবুল কিফালা, কিতাবুল লুকতা, কিতাবুল ইস্তিযান এবং কিতাবুল বুযু।] এবং নাসায়ীর২.[নাসায়ী- কিতাবুল লুকতা] এক স্থানে নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ বর্ণণা লিপিবদ্ধ আছে যে,নবী(স)বলেনঃ বনী ইসরাইলের এক ব্যক্তি অন্য এক ব্যক্তির নিকট থেকে ব্যবসার জন্যে এক হাজার দীনার ঋণ গ্রহণ করে।৩.[এখানে প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, রেওয়াতে ‘ব্যবসার জন্যে’ কথাটি নেই। কিন্তু এ প্রশ্নটি কয়েকটি কারণে ভুল। প্রথম কথা এই যে, রেওয়ায়েতে ঋণের জন্যে (আরবী****)ক্রিয়া শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ হচ্ছে টাকা অগ্রিম দাদনের সম অর্থবোধক। এ অর্থ অধিকাংশই ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যপারের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। তারপর ঋণ সে এক হাজার দীনার (প্রায় দশ হাজার টাকা) নিয়েছিল। এটা সত্য কথা যে, এত টাকা অনাহার দূর করার জন্যে নেয়া হয়নি। অথবা কাফনের অভাবে মুর্দা দাফন করা হচ্ছে না। অতএব তার জন্যে এক হাজার দীনার ঋণ নেয়া হচ্ছে, ব্যাপার তাও না। তাছাড়া এ টাকা নিয়ে সে সমুদ্র যাত্রা করেছিল। সেখানে সে এত টাকা রোজগার করলো যে, কাঠের মধ্যে ছিদ্র করে এক হাজার দীনার ঋণদাতার উদ্দেশ্যে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলো। অতপর বাড়ী পৌছে অতিরিক্ত এক হাজার দীনার নিয়ে ঋণদাতার কাছে উপস্থিত হলো। এর থেকে একথাই কি প্রমাণিত হয় না যে, সে বিলাসিতার জন্যে নয়, বরঞ্চ ব্যবসার জন্যেই ঋণ গ্রহণ করেছিল?] তারপর বলে আমার ও তোমার মধ্যে আল্লাহ্ সাক্ষী এবং তিনিই জামিন।
অতপর সে সমুদ্র যাত্রাই বেরিয়ে পড়লো। সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য শেষ করার পর জাহাজের অভাবে প্রত্যাবর্তন করতে পারে না এবং ঋণ পরিশোধের মুদ্দত শেষ হয়ে যায়। তখন সে এক খন্ড কাঠের মধ্যে একটা ছিদ্র করে তার মধ্যে এক হাজার দীনার রাখলো। ঋণদাতার নামে একখানি পত্র লিখে কাষ্ঠখন্ডের মধ্যে দিয়ে মুখ বন্ধ করলো। তারপর তা সমুদ্রে নিক্ষেপ করে এই বলে খোদার কাছে দোয়া করলোঃ হে খোদা আমি তোমাকেই সাক্ষী এবং জামিন রেখে সেই ব্যক্তির নিকট থেকে দীনার ঋণ নিয়েছিলাম। তুমিই এখন এ অর্থ তার কাছে পৌঁছিয়ে দাও।
আল্লাহ্র কুদরত এই ছিল যে,একদিন ঋণদাতা সমুদ্র তীরে দণ্ডায়মান অবস্থায় এক খন্ড কাষ্ঠ তার কাছে আসতে দেখলো। সে তা উঠিয়ে তার জন্যে ঋণ গ্রহীতার পত্র এবং এক হাজার দীনার পেয়ে গেল।
পরে ঋণগ্রহীতা বাড়ী পৌছে আবার এক হাজার দীনার নিয়ে ঋণদাতার নিকট উপস্থিত হলো। কিন্তু ঋণদাতা সে এক হাজার দীনার নিতে অস্বীকার করে বললো— আমার পাওনা আমি পেয়ে গেছি।
এ বর্ণণা একথারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ যে,ব্যবসার জন্যে ঋণ গ্রহণের ধারণা সে সময়ে আরববাসীদের কাছে অপরিজ্ঞাত ছিল না।
ইবনে মাজাহ১.[আবওয়াবু ত্তিজারাত, বাবু হুসনিল কাযা।] এবং নাসায়ীতে২.[কিতাবুল বুযু বাবু ইস্তিকরায।] বর্ণিত আছে যে, হুনাইন যুদ্ধের সময় নবী (স) আবদুল্লাহ বিন রাবিয়া মাখযুমীর নিকট থেকে ত্রিশ অথবা চল্লিশ হাজার দিরহাম ঋণ নিয়েছিলেন এবং যুদ্ধের পর সে ঋণ পরিশধ করেন। রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ঋণ গ্রহণের এ এক প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
জনৈক বন্ধু আরও দুটো ঘটনার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তার নিকট আমি কৃতজ্ঞ। প্রথম ঘটনা এই যে, হিন্দ বিন ওতবা একবার হযরত ওমর (রা)-এর নিকট থেকে বায়তুলমালের চার হাজার টাকা (সম্ভবত দিরহাম) ব্যবসার জন্যে ঋণ নিয়েছিলেন।৩.[তারিখে তাবারী-হি ২৩ সনের ঘটনা। শিরোনাম-“তার চরিত্র সম্পর্কে পুর্বে বলা হয়নি এমন কতকগুলো ঘটনা।”]
দ্বিতীয় ঘটনাটিও হযরত ওমর (রা)-এর খেলাফত কালের। তা হচ্ছে এই যে, বসরার গভর্নর হযরত আবু মূসা আশয়ারী হযরত ওমর (রা)-এর দু পুত্র আবদুল্লাহ এবং ওবায়দুল্লাহ ব্যবসা করার জন্যে বায়তুলমাল থেকে টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। অতপর হযরত ওমর (রা) তা জানতে পেরে এটাকে আপত্তিজনক বলে ঘোষনা করেন এবং আসলসহ গোটা মুনাফা ছেলেদের নিকট দাবী করেন। অবশেষে লোকের পরামর্শে এ ঋণকে ঋণের পরিবর্তে কিরাজ (অংশিদারিত্ত) ঘোষনা করে মুনাফার অর্ধেক আদায় করা হয়। ৪.[ঘটনাটি বিবৃত হয়েছে মুয়াত্তায় কিতাবুল খিরাজে ওমর বিন খাত্তাবের চরিত্র শীর্ষক অধ্যায়ে।]
এ দুটো ঘটনাই জাহেলিয়াতের যুগের অতি নিকটবর্তী সময়ের। আরবে নবম হিজরী পর্যন্ত সুদী কারবার চালু ছিল। সুদ বন্ধ হবার দশ বারো বছর পরের এ ঘটনাগুলো। এটা ঠিক যে এত অল্প সময়ের মধ্যে ধারণা বদলে যেতে পারে না। অতএব এসব ঘটনা থেকে এ কথাই প্রমানিত হয় যে, ঋণের মাধ্যমে পুঁজি সংগ্রহ করে ব্যবসা করার ধারণা জাহেলিয়াতের যুগেও বিদ্যমান ছিল। ৫.[এ সম্পর্কে একথা বলা যেতে পারে না, “এমন অনেক ধারনা আছে যা ইসলামের আগমনের পর সৃষ্টি হয়েছে এবং তা জাহেলিয়াতের সময় বিদ্যমান ছিল না। এভাবে এ নতুন ধারনাটিও ইসলামের পরবর্তী কালের।” যদি এমন কথা কেউ বলে, তাহলে আমরা তাকে বলবো, বেশ ভালো কথা। এটা ইসলামোত্তর কালেরই সৃষ্টি। তর্কের স্থলে এ কথা মেনে নিলাম। কিন্তু এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঋণের দ্বারা পুঁজি সংগ্রহ করে ব্যবসা করার প্রথা হযরত ওমর (রা) এর সময়ে শুরু হয়েছিল এবং তারপর, যেমন আমি আগে বলেছি, হযরত ইমাম আবু হানিফার সময় পর্যন্ত অবস্থা এতদুর গড়ালো যে, একমাত্র ইমাম সাহেবের ব্যবসাতেই পাঁচ কোটি টাকার পুঁজি ঋণ করে বিনিয়োগ করা ছিল। এখন প্রশ্ন এই যে, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, আয়েম্মামায়ে মুজতাহেদীন(মুজতাহিদ ইমামগণ) মোট কথা কারো মাথায় একথা কেন এলো না যে, কুরআনের উদ্দেশ্য তো শুধু ব্যক্তিগত প্রয়োজনে গৃহীত ঋণের উপর সুদ হারাম করা— লাভজনক কাজে গৃহীত ঋণের উপর সুদ হারাম নয়?]
এখন প্রশ্ন এই যে, ইসলামী যুগের ঐতিহাসিকগণ, মুহাদ্দিস ও তাফসীরকারকগণ ব্যক্তিগত প্রয়োজন ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনে গৃহীত ঋণের পৃথক পৃথক সুস্পষ্ট বর্ণনা কেন করেননি। পরিষ্কার কথা এই যে, তাদের নিকটে ঋণ যে কোন উদ্দেশ্যেই গৃহীত হোক না কেন, তাকে ঋণ বলেই বিবেচনা করা হতো। এবং এর উপর গৃহীত সুদের পজিশনও তাদের দৃষ্টিতে ছিল অভিন্ন। তাঁরা এরূপ কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজনই বোধ করেননি যে, অনাহারক্লিষ্ট মানুষ তার ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্যে ঋণ গ্রহণ করতো। আর না বিশেষ করে এরূপ কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন বোধ করেছেন যে, ব্যবসার জন্যে লোক ঋণ করতো। এসব ব্যাপারে চুলচেরা বিশদ বর্ণনা খুব কমই পাওয়া যায়, যার প্রকৃত অবস্থা জানার জন্যে তৎকালীন দুনিয়ার অবস্থা সামনে রেখেই আরবের অবস্থা দেখা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বিভিন্ন ঋণের মধ্যে তাদের উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে পার্থক্য নির্ণয় করে এক উদ্দেশ্যে গৃহীত ঋণের উপর সুদ জায়েয এবং অন্য উদ্দেশ্যে গৃহীত ঋণের সুদ নাজায়েজ হবার ধারণা সম্ভবত চতুর্দশ শতাব্দীর পুর্বে দুনিয়ার কোথাও বিদ্যমান ছিল।১.[ Henry Pirene Economic And Social History of Medieval Europe) (English Translation) IV, Edition Butler, London 1949, P.140]। সে সময় পর্যন্ত ইয়াহূদী ধর্ম, খৃষ্টান ধর্ম এবং ইসলামের সকল ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিগণ এবং অনুরূপভাবে নৈতিকতার নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে একমত ছিলেন যে, প্রত্যেক প্রকার ঋণের উপর সুদ হারাম।
এরূপ বলা হয়ে থাকে যে, ইসলামপুর্ব যুগে এটা সম্ভবই ছিল না যে, মানুষ ঋণ করা পুঁজি দিয়ে ব্যবসা করতে পারতো। কারণ দেশে নিয়মতান্ত্রিক কোনো সরকারই ছিল না। চারিদিকে নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করতো। বাণিজ্যিক বহরগুলোকে মোটামোটা ট্যাক্স দিয়ে বিভিন্ন গোত্রের এলাকা অতিক্রম করতে হতো এরূপ সংকটপূর্ণ অবস্থার জন্যে সুদের হার শতকরা তিন চারশত টাকায় পৌছেছিল। এমতাবস্থায় ঋণ করে পুঁজি ব্যবসায় বিনিয়োগ করা কিছুতেই লাভজনক হতে পারতো না। কিন্তু ঐতিহাসিক অবস্থার সাথে এ অবাস্তব কল্পনার কোনো মিল নেই। এ নিছক একটি কল্পনা মাত্র যা ইতিহাসকে উপেক্ষা করে— এ ধারণার বশবর্তী হয়ে করা হয়েছে যে, আরবে যখন কোনো নিয়মতান্ত্রিক সরকার বা শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল না এবং চারিদিকে অরাজকতা ছড়িয়ে ছিল, তখন নিশ্চয় তার পরিমাণ তাই হবে। অথচ ঐতিহাসিক ঘটনাপুঞ্জ থেকে এ কথা জানা যায় যে, ইসলামের নিকটবর্তী সময়ে ইরান ও রোমের ক্রমাগত যুদ্ধ-বিগ্রহাদি ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফলে চীন, ইন্দোনেশিয়া, ভারত এবং পুর্ব আফ্রিকার সাথে রোম সাম্রাজ্যের যত প্রকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল, তার মধ্যস্থতা করতো আরব বণিকগণ। বিশেষ করে ইয়ামানের উপরে ইরানের আধিপত্য বিস্তারের পর রোমীয়দের জন্যে প্রাচ্যের ব্যবসা-বাণিজ্যের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় প্রাচ্যের সমুদয় পণ্যদ্রব্য পারস্য উপসাগর এবং আরব সাগরে অবস্থিত আরবদের বন্দরসমূহে গিয়ে পৌঁছতো। সেখান থেকে মক্কা হয়ে রোম সাম্রাজ্যে পৌঁছত। এমনি ভাবে রোম সাম্রাজ্যের যাবতীয় পণ্যদ্রব্য কুরাইশদেরই কাফেলা মক্কায় নিয়ে আসতো; অতপর ঐসব বন্দরে পৌছিয়ে দিত, যেখানে প্রাচ্যের বণিকগণ খরিদ করতে আসতো। O’LEARY বলেন যে, সে সময়ে মক্কা ব্যাংকিং কার্যের কেন্দ্র হয়ে পড়েছিল। সেখানে দূরবর্তী দেশের জন্যে টাকা আদান-প্রদান হতো। বলতে গেলে মক্কা আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের বাজার হয়ে পড়েছিল।
Mecca had become a Banking centre where payments could be made to many distant lands, and a clearing house of international commerce.১.[Arabia before Mohammod, P.182.]
অবস্থা যদি তাই হতো, যা ধারণা করা হয়েছে, তাহলে এ সমৃদ্ধিশালী ব্যবসা-বাণিজ্য কিভাবে চলতো। অর্থনৈতিক রীতিনীতির মোটামোটি জ্ঞান একথা বুঝবার জন্যে যথেষ্ট যে, যেখানে নিরাপত্তার অভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য এতটা ব্যয়বহুল ও শংকাপুর্ণ। যার ফলে বাণিজ্যিক সুদের হার শতকরা তিন চারশ টাকায় পৌছে যায়, সেখানে অবশ্যই পণ্যদ্রব্যের ক্রয়মূল্য এতটা বেড়ে যাওয়া উচিত যে, বৈদেশিক বাজারে তা নিয়ে গিয়ে মুনাফাসহ বিক্রি করা কিছুতেই সম্ভব হতো না। তাহলে এত বর্ধিত মূল্যে খরিদ করা মাল মিসর, সিরিয়ার বাজারে কিভাবে বিক্রি হতো? যেসব অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা আরবে তৎকালে বিদ্যমান ছিল বলে বলা হয়, সেসব থাকা সত্ত্বেও ব্যাপক আকারে ব্যবসা-বাণিজ্য সেসব গোত্রই করতো, যারা স্বয়ং ছিল শক্তিশালী। বড় বড় গোত্রের সাথে যারা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেছিল, সুদে লাখো লাখো টাকার মালপত্র গোত্রসমূহের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে বহুসংখ্যক লোককে যারা ব্যবসাসূত্রে বেঁধে রেখেছিল এবং গোত্রীয় সরদারগণকে সব রকমের বিলাস দ্রব্যাদি সরবরাহ করে যারা তাদের বিরাট প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। তাছাড়া স্বয়ং গোত্রগুলোর আপন আপন স্বার্থেও এটা দাবী করতো যে, বহির্দেশ থেকে আমদানীকৃত জীবন-যাপনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যথা— খাদ্যশস্য, কাপড় প্রভৃতি তাদের নিকটে পৌঁছুক। এজন্য এসব শক্তিশালী গোত্রসমূহ যখন দু আড়াই হাজার উটসহ তাদের বাণিজ্য বহর নিয়ে আরবের পথ দিয়ে চলতো, তখন তাদেরকে তেমন মোটা ট্যাক্স দিতে হতো না। অথবা বিপদাপদ থেকে রক্ষার জন্যে এতটা অধিক ব্যয়ও করতে হতো না যে, পণ্যদ্রব্যের মূল্য লোকের ক্রয় ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করতো। বৈদেশিক বাণিজ্য ছাড়াও, আরব দেশের বিভিন্ন অংশে প্রতিবছর বিশটি কেন্দ্রীয় স্থানে নিয়মিত মেলা বসতো। এ সবের বিবরণ ইতিহাসে পাওয়া যায়। আরবের প্রত্যেক স্থান থেকে বহু কাফেলা এসে এসব মেলায় বেচা-কেনা করতো। এসব কাফেলার কোনো কোনোটিতে রোম, ইরান, চীন ও ভারতের ব্যবসায়ীও থাকতো। ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে গণকদের এই যে ক্রমাগত যাতায়াত তা কি করে সম্ভব হতো, যদি আরবের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অতটা খারাপ হতো, যতোটা ধারণা করা হয়েছে। ঐতিহাসিকগণ কুরাইশদের ব্যবসা সম্পর্কে সুস্পষ্ট করে বলেছেন যে, তারা শতকরা একশত ভাগই লাভ করতো। এ ধরণের লাভজনক ব্যবসার জন্যে সুদী ঋণে পুঁজি না পাওয়া এবং সুদের হার শতকরা তিন চার শত হওয়া এক অবোধগম্য ব্যাপার। এ দাবীর অনুকূলে এমন কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণও নেই যে, সত্যি সত্যিই আরবে সুদের হার এতটা বেড়ে গিয়েছিল।
জবাবঃ দ্বিতীয় প্রশ্ন
‘রিবা’ (আরবী******) শব্দের অর্থ আরবী ভাষায় আধিক্য, অতিরক্ত, বাড়তি প্রভৃতি। কিন্তু ‘রিবা’ দ্বারা পারিভাষিক দিক দিয়ে যা বুঝায় তা কুরআনেরই নিম্ন শব্দগুলির দ্বারা সুস্পষ্ট হয়ঃ
(আরবী**********)
“সুদের যতটুকু অবশিষ্ট আছে তা ছেড়ে দাও — যদি তুমি তওবা কর, তাহলে তুমি মূলধন পাবার হকদার হবে ——আর যদি (ঋণগ্রহণকারী) অভাবগ্রস্ত অপারগ হয়, তাহলে তার সচ্ছল হওয়া পর্যন্ত তাকে অবকাশ দাও।”-(সুরা আল বাকারাঃ ২৭৮ -৮০)
একথাগুলোর দ্বারা বুঝা যায় যে, রিবার এ বিধান ঋণের সাথে সংশ্লিষ্ট আর ঋণে আসলের অতিরক্ত যা কিছু দাবী করা হবে তা হবে ‘রিবা’ সুদ যা ছেড়ে দেবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া কুরআন একথা বলেও রিবার মর্ম সুস্পষ্ট করে দিচ্ছে (আরবী********) আল্লাহ্ ব্যবসা(বেচা-কেনা) হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। এর দ্বারা সুস্পষ্ট হয় যে, সুদে মূলধন ঋণ দিয়ে যা কিছু তার চেয়ে বেশী গ্রহণ করা হয়, তা ঐ মুনাফা থেকে পৃথক যা ব্যবসা ক্ষেত্রে ক্রয়মূল্য থেকে বেশী লাভ করা যায়। অন্য কথায় রিবা হচ্ছে মালের সেই আধিক্য যা ব্যবসার পদ্ধতিতে লাভ করা হয় না। এর উপর ভিত্তি করে মুহাদ্দিশগণ, ফকীহ ও তফসীরকারকগণ এ বিষয়ে একমত যে, কুরআনে সেই রিবাকে হারাম করা হয়েছে, যা ঋণের ব্যাপারে আসলের অতিরক্ত দাবী করা হয়।
প্রথম প্রশ্নের জবাবে ইতিহাস থেকে প্রমাণ করা হয়েছে যে, কুরআন নাযিলের সময় আরববাসী এ বিষয়ে সম্পুর্ণ অবগত ছিল যে, ঋণের আদান-প্রদান শুধু ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই হয় না, বরঞ্চ ব্যবসার উদ্দেশ্যে এবং জাতীয় উদ্দেশ্যেও হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও কুরআন রিবা হারাম করার নির্দেশ দিতে গিয়ে এমন কোনো ইংগিত করেনি যার থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় যে, উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে ঋণসমূহের মধ্যে পার্থক্য আছে এবং সুদ হারাম করার নির্দেশ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত প্রয়োজনে গৃহীত ঋণের জন্যে নির্দিষ্ট। আর লাভজনক কাজের উদ্দেশ্যে যে ঋণ দেয়া যায় তার উপর সুদ হালাল। ইসলামের ফকীহগণ প্রথম হিজরী শতাব্দী থেকে আজ পর্যন্ত এ মূল নীতির উপর একমত এ (আরবী************) “যে ঋণের সাথে মুনাফা লাভ করা হয়, তাহলো ‘রিবা’ সুদ।” কিছুদুন পুর্ব পর্যন্ত ফকীহগণের এ সর্বসম্মত রায়ের সাথে মতবিরোধ করার কোনো একটি দৃষ্টান্তও ফেকাহর ইতিহাস থেকে প্রমাণ করা যাবে না।
জবাবঃ তৃতীয় প্রশ্ন
আরবী****(সুদ) এবং আরবী ***(লাভ) শব্দদ্বয়ের মধ্যে পার্থক্য এই যে, ঋণে মাল দিয়ে আসল থেকে অতিরিক্ত গ্রহণ করার নাম হলো রিবা (**)। পক্ষান্তরে আরবী***(রাবাহ) শব্দের অর্থ হলো ব্যবসায়ে নিয়োজিত পুঁজি বা ক্রয়মূল্যর অধিক মূল্যে বিক্রয়ের মাধ্যমে লাভ করা। এর বিপরীত, ক্রয় মূল্য থেকে কমে কোনো পণ্য বিক্রি করাকে ক্ষতি বলা হয়। লিসানুল আরবে (আরবী****) শব্দের অর্থ বলা হয়েছে নিম্নরূপঃ
(আরবী*********)
ব্যবসায়ে লব্ধ অতিরক্ত সম্পদ যা অর্থকে (আরবী******) ও (আরবী*****) বলা হয়। ব্যবসায়ী ব্যবসার লাভ করলে আরববাসী বলে (আরবী********) (তার ব্যবসা লাভযুক্ত হয়েছে) অর্থাৎ সে লাভবান হয়েছে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ (আরবী*********) (তারা ব্যবসায় লাভবান হয়নি)।
ইমাম রাগেব (র)-এর মুফরাদাত গ্রন্থে আছেঃ
(আরবী**********)
ক্রয়-বিক্রয়ের যে আধিক্য লাভ হয় তাহলো (আরবী***)(লাভ)।
স্বয়ং কুরআন মাজীদ ‘রিবা’ (সুদ) এবং ব্যবসার মুনাফার মধ্যে পার্থক্য বর্ণনা করেছে। আরবের কাফেরগণ সুদ হারাম হবার বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করে বলতোঃ (আরবী*********) (ব্যবসা তো সুদের মতোই) অর্থাৎ ব্যবসায়ে আসল ক্রয়মূল্য থেকে অধিক যে বিক্রয় মূল্য আদায় করা হয়, সেতো ঋণ দিয়ে আসল মূলধন থেকে অধিক টাকা নেয়ার মতোই। কুরআন এর জবাবে বলে দিয়েছেঃ (আরবী**********) (আল্লাহ্ কেনা-বেচা হালাল করেছেন এবং সুদ করেছেন হারাম)। অর্থাৎ ক্রয়-বিক্রয়ের আকারে সম্পদে যে আধিক্য হয়, তা এক বস্তু এবং ঋণের আকারে আধিক্য আর এক বস্তু। একটিকে আল্লাহ হালাল করেছেন এবং অন্যটিকে হারাম করেছেন। কেউ মুনাফা করতে চাইলে নিজে ব্যবসা করে অথবা অন্য কারো সাথে ব্যবসায় অংশীদার হয়ে মুনাফা করার পথ তার জন্যে উন্মুক্ত আছে। কিন্তু ঋণ দিয়ে মুনাফা অর্জন করার পথ বন্ধ।
জবাবঃ চতুর্থ প্রশ্ন
‘রিবার’ (সুদ) সংজ্ঞা এইঃ ঋণের ব্যাপারে আসল থেকে অতিরিক্ত যাকিছু আদান প্রদানের শর্ত হিসেবে আদায় করা হবে তাকেই বলে ‘রিবা’ বা সুদ। এ সংজ্ঞায় এ প্রশ্ন অবান্তর যে, এ ‘রিবা’ ঋণদাতা দাবী করেছে অথবা ঋণগ্রহীতা স্বেচ্ছায় দিতে চেয়েছে। এ প্রশ্ন সুদের আইনসংগত সংজ্ঞার উপর কোনো ক্রিয়া করে না এবং কুরআন অথবা নির্ভরযোগ্য হাদীস থেকে এ বিষয়ে এমন কোনো ইংগিতও পাওয়া যাবে না যে, ঋণগ্রহীতার পক্ষ থেকে সুদ দিতে চাইলে তা সুদে পরিণত হওয়া এবং হারাম হবার ব্যাপারে কোনো পার্থক্য সূচিত হবে। তাছাড়া দুনিয়ার এমন কোনো বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি নেই এবং ছিলও না যে, বিনা সুদে ঋণ লাভ করার সুযোগ পেয়েও স্বেচ্ছায় সুদ প্রদানের শর্ত পেশ করবে। ঋণগ্রহীতার পক্ষ থেকে এ ধরণের শর্ত একমাত্র তখনই উপস্থাপিত হতে পারে, যদি কোথাও তার বিনা সুদে ঋণ লাভের আশা না থাকে। সে জন্যে সুদের সংজ্ঞায় এ প্রশ্নের প্রভাব না থাকাই বাঞ্ছনীয়। উপরন্তু প্রাচীনকালে এবং আজও ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমানত রক্ষার হিসেবে রক্ষিত টাকার সুদ এজন্য পেশ করা হয় যাতে করে লোকে এ সুদের প্রলোভনে তাদের সঞ্চিত টাকা ব্যাংকে জমা দিতে পারে, অতপর ব্যাংকে যাতে কম হারে সুদে গৃহীত টাকা উচ্চ হারে ঋণ দিয়ে লাভবান হতে পারে। এভাবে সুদ প্রদানের আগ্রহ যদি সুদ প্রদানকারীর পক্ষ থেকেই হয় তাহলে সুদ হারাম হবার প্রশ্নে তা বিবেচনাযোগ্য হবার কি সংগত কারণ থাকতে পারে? আমানতী টাকার উপর সুদ দেয়া হয়। তা প্রকৃতপক্ষে এই যে, তা সেই সুদেরই একটা অংশ যা সেই আমানতী টাকা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে, ব্যবসার উদ্দেশ্যে এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ঋণ দিয়ে আদায় করা হয়। এটা তো ঐ ধরনের অংশ যেমন কোনো ব্যক্তি কারো নিকট থেকে সিঁদ কাটা অস্ত্রপাতি সংগ্রহ করলো তার একটা অংশ ঐ ব্যাক্তিকে দিল, যার কাছ থেকে সে সিঁদ অস্ত্রপাতি নিয়েছিল। এ অংশ এ যুক্তির বলে জায়েয হতে পারে না যে, অংশ প্রদানকারী স্বেচ্ছায় তা দিয়েছে এবং গ্রহণকারী বলপুর্বক তা আদায় করেনি।
জবাবঃ পঞ্চম প্রশ্ন
আরবী****** (বায়-এ-সালাম) এমন এক ধরণের ব্যবসা যা অগ্রিম সওদা করার একটি পদ্ধতি। অর্থাৎ এক ব্যক্তি অন্য এক জনের নিকট থেকে আজ এক বস্তু খরিদ করে তার মূল্য দিয়ে দিল। তারপর একটি সময় নির্ধারিত করে দিল যে, নির্ধারিত সময়ে বিক্রেতা তাকে সে মাল দিবে। যেমন ধরুন, আমি একজনের কাছ থেকে আজ একশ’ থান কাপড় খরিদ করছি এবং তার মূল্যও পরিশোধ করছি। এ শর্তে যে, চার মাস পর সেই থান আমি নিব। এ ক্রয়-বিক্রয়ে চারটি জিনিস অপরিহার্য। একঃ মালের মূল্য সওদা করার আগেই দিতে হবে। দুইঃ মালের গুণাগুণ(QUALITY) সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট করা যেন ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা না থাকে, যা পরে বিতর্কের সূত্রপাত করতে পারে। তিনঃ মালের পরিমাণ ওজন, মাপ অথবা সংখ্যা ইত্যাদি যেন সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করা হয়। চারঃ মাল ক্রেতার নিকট হস্তান্তর করার সময় নির্ধারিত থাকবে। এর মধ্যেও যেন কোনো অস্পষ্টতা না থাকে, যা পরে বিতর্কমূলক হয়ে দাঁড়ায়। এ সওদার জন্যে যে অগ্রিম মূল্য দেয়া হয়, তাকে কখনো ঋণের পর্যায়ভুক্ত করা যাবে না। বরঞ্চ তা ঠিক সেই রকম যেমন কোনো ক্রেতা লেনদেনে নগদ মূল্য প্রদান করে। ফিকাহ্ শাস্ত্রে তার নাম (আরবী***) বা মূল্য, ঋণ নয়। নির্ধারিত সময়ে মাল হস্তান্তর না করা বা অন্য কোনো কারণে এ সওদা বাতিল হলে ক্রেতাকে শুধু আসল মূল্যই ফেরত দেয়া হয়। অতিরিক্ত কোনো কিছুর হকদার সে হয় না। এতে এবং সাধারণ কেনা-বেচায় এ ছাড়া আর কোনো পার্থক্য নেই যে, সাধারণ ক্রয়-বিক্রয়ে ক্রেতা বিক্রেতার নিকট থেকে মাল সঙ্গে সঙ্গেই নিয়ে নেয়। আর (আরবী*****) (বায়-এ-সালামে) এ মাল হস্তগত করার জন্যে ভবিষ্যতে একটি দিন-তারিখ নির্ধারিত করে দেয়। এ ব্যাপারটিকে ঋণ এবং সুদের সংগে জড়িত করার কোনোই সংগত কারণ আমি বুঝতে পারলাম না।
প্রশ্নে মহিষের যে দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে তা হয়েছে তা বায়- এ- সালামের নয় বরঞ্চ অংশীদারিত্বের একটা দিক বা পদ্ধতি। অর্থাৎ মহিষ এক ব্যক্তির,অন্য ব্যক্তি তা নিয়ে কাজ করে এবং দুধ উভয়ের মধ্যে ভাগ করা হয়।