সূদ ও আধুনিক ব্যাংকিং
সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী
ভূমিকা
সুদ সম্পর্কিত ইসলামী আইন ও বিধি-নির্দেশাবলী অনুধাবন করার ব্যাপারে আধুনিক যুগের মানুষ ব্যাপক বিভ্রান্তির শিকারে পরিনত হচ্ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, ইসলাম যে অর্থব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল আজকের যুগে তার কাঠামো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তার মূলনীতি, আদর্শ ও বৈশিষ্ট্যগুলো মন থেকে উবে গেছে। এ সঙ্গে আমাদের চতুস্পার্শ্বের চলমান বিশ্বের সমগ্র এলাকা জুড়ে ‘পুঁজিবাদী’ নীতির ভিত্তিতে একটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী অর্থব্যবস্থার ভিত গড়ে উঠেছে। এ পুজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা কার্যত আমাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে এবং তার নীতি, আদর্শ ও বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের মন-মস্তিষ্ককে প্রবল ভাবে প্রভাবিত করেছে। তাই কোনো অর্থনৈতিক বিষয় আলোচনা করতে গেলেই আমরা পুজিবাদী দৃষ্টিকোন থেকেই তার বিভিন্ন দিক যাচাই-পর্যালোচনা করি। আমাদের আলোচনা ও অনুসন্ধানের সুচনা এমনভাবে হয় যার ফলে আমরা প্রথমেই অর্থব্যবস্থা সম্পর্কিত পুঁজিবাদী নীতি ও আদর্শগুলো মেনে নেই, তারপরে কোনো অর্থনৈতিক পদ্ধতির বৈধতা ও অবৈধতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করি। কিন্তু অনুসন্ধানের এ পদ্ধতি মূলত যে ত্রুটিপূর্ণ, তা একটু চিন্তা-ভাবনা করলে তা সহজে অনুধাবন করা যায়। আদর্শ ও মূলনীতির দিক দিয়ে ইসলামী অর্থব্যবস্থা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ন ভিন্নধর্মী। উভয়ের উদ্দেশ্য, প্রাণসত্তা ও পদ্ধতি একেবারে আলাদা, এ ক্ষেত্রে কোনো বিষয় সম্পর্কিত পুঁজিবাদী নীতি ও আদর্শকে স্বীকার করে নেয়ার পর যদি ইসলামী অর্থনীতির কোনো একটি বিধানের প্রতি দৃষ্টিপাত করা যায় তাহলে নিঃসন্দেহে তা ত্রুটিপূর্ণ মনে হবে অথবা তা এমন ভাবে সংশোধন করে দেয়া হবে যার ফলে তা ইসলামী আইনের নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে সম্পূর্ণরূপে পুঁজিবাদী ছাঁচে ঢালাই হয়ে যাবে। পরিণামে তার ইসলামী প্রাণসত্তা বিলুপ্ত হবে। তার সাহায্যে ইসলামী আইনের উদ্দেশ্য হাসিল করা সম্ভব হবে না। এমনকি চেহারা, চরিত্র ও নীতিগতভাবে তা নিজেকে একটি ইসলামী বিধান হিসেবে পরিচয় দান করার সমস্ত বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলবে।
এ মৌলিক ত্রুটির কারনে আমাদের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও চিন্তাবিদগণ সুদ সম্পর্কিত ইসলামী বিধান সমূহ অনুধাবন করতে অক্ষম হয়েছেন এবং সেগুলোর উদ্দেশ্য ও কারণ উপলব্ধির ক্ষেত্রে পদে পদে ভুল করে চলেছেন। তাঁরা আদতে জানেনই না কোন্ নীতির ভিত্তিতে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? কি তার উদ্দেশ্য ও প্রাণসত্তা? সুদকে কেন হারাম গণ্য করা হয়েছে? সুদের লেনদেনের বিভিন্ন পর্যায়ে তার হারাম হওয়ার কি কি কারণ নিহিত রয়েছে? যেসব লেনদেনের ক্ষেত্রে ঐ কারণগুলো বিরাজ করে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ঐ ধরনের লেনদেনের অনুপ্রবেশ ঘটানোর কুফল ও পরিণাম কি? এসব মৌলিক বিষয় উপেক্ষা করে যখন তাঁরা পুরোপুরি পুঁজিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সুদ সম্পর্কিত ইসলামী বিধান সমূহ নিরীক্ষণ করতে থাকে তখন সুদ হারাম হওয়ার স্বপক্ষে কোনো যুক্তি তাঁরা খুঁজে পান না। কারণ সুদ হচ্ছে পুঁজিবাদের প্রাণ। তার শিরা-উপশিরায় এরই প্রবাহ সঞ্চারমান। এ প্রাণ প্রবাহ ছাড়া পুঁজিবাদের সমস্ত কাজ-কারবারই অচল। পুঁজিবাদী নীতির ভিত্তিতে গড়ে উঠা কোনো অর্থব্যবস্থা সুদ বিহীন হবার কথা কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এ চিন্তাবিদগণ তাত্ত্বিক ও প্রয়োগগত দিক থেকে ইসলামকে বর্জন করলেও আকিদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এখনো ইসলামের অনুগামী। তাঁরা স্বেচ্ছায় ইসলামের শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতেও রাজি নন। আকিদা- বিশ্বাসের নিগড়ে আস্টেপৃষ্ঠে বাঁধা থাকার কারনে সুদ হারাম হওয়ার ব্যাপারটি তাঁরা অস্বীকার করতে পারেন না। কিন্তু তাদের জ্ঞান ও কর্ম সুদ সম্পর্কিত ইসলামী বিধানের নিগড় ছিন্ন করতে তাঁদেরকে বাধ্য করে।
দীর্ঘকাল হতে মন ও মস্তিষ্কের এ দ্বন্দ্ব চলছে। তবে বর্তমানে এর মধ্যে আপোষ করার একটা সহজ উপায় বের করা হয়েছে। তা হচ্ছে এ যে, ইসলামী আইনের এমন একটি ব্যাখ্যা দিতে হবে যার ফলে সুদের বিষয়গুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত না হবার কারনে তা যথারীতি সাধারণভাবে হারাম থাকবে। কিন্তু অন্য দিকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সুদের যতগুলো খাত আছে তার প্রায় সবগুলোই বৈধ বলে গণ্য হবে। বড়জোর পুঁজিবাদী নীতির ভিত্তিতে যার বিরুদ্ধে কোনো যুক্তি পাওয়া যায় তাকে মহাজনী সুদ বা চড়া সুদে ঋণদান (USURY) হিসেবে গণ্য করা হবে। কিন্তু তাকেও পুরোপুরি বিলুপ্ত করে দেয়ার কোনো কারণ তাঁরা খুঁজে পাচ্ছে না। তাঁদের মতে যুগের প্রয়োজনে ঐ সুদটি নতুনভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে মাত্র। তাঁদের এ কথা বলার অর্থ হচ্ছে এ যে, সুদের হার যেন কখনো এমন পর্যায়ে পৌঁছে না যায় যার ফলে ঋণগ্রহীতার পক্ষে তা আদায় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং কোনো অবস্থায় যেন তা চক্রবৃদ্ধি হারে নির্ধারিত সুদের পর্যায়ে না পৌঁছে যায়।
এ চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞগণ না জেনে বা বুঝেই এ প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন। একই সঙ্গে দুটো বিপরীতমুখি জলযানে আরোহণ করা কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তির পক্ষে শোভা পায় না। যদি অজ্ঞতার কারনে, ভুলক্রমে সে এ কাজ করে থাকে তাহলে আসল ব্যাপার সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সাথে সাথেই তাকে নিজের ভুল সংশোধনে এগিয়ে আসতে হবে। দুটো জলযানের মধ্য থেকে একটিকে বাছাই করে নিয়ে অন্যটি থেকে তাকে পা টেনে নিতে হবে। এটিই হবে তার জন্য যথার্থ বুদ্ধিমানের কাজ। সুদ হারাম কি হারাম নয় এবং তার সীমানা চিহ্নিত করার আলোচনা অনেক পরবর্তী পর্যায়ের কথা, সর্বপ্রথম ইসলামিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যকার নীতিগত ও তাৎপর্যিক পার্থক্যটুকু যথাযথ ভাবে উপলব্ধি করতে হবে। অতঃপর যেসব নীতি ও বিধি-বিধানের ভিত্তিতে পুঁজিবাদ ও কম্যুনিজমের দুই প্রান্তিক ব্যবস্থার মাঝামাঝি ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছে, কুরআন ও হাদিসের বিধানসমূহ বিশ্লেষণ করে ঐ নীতি ও বিধানসমূহ সম্পর্কে অবহিত হতে হবে। এ আলোচনা থেকে এ কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ইসলাম যে পদ্ধতিতে মানুষের বিষয়াদির সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা করে তাতে সুদের কোনো স্থান নেই। বরং যেসব মতবাদ, আদর্শ, মানসিকতা ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারনে সুদি লেন-দেনের বিভিন্ন অবস্থার সৃষ্টি হয়, ইসলাম সেগুলার মূলোৎপাটন করে। এরপর দুটো পথের মধ্য থেকে যে কোনো একটির নির্বাচন অপরিহার্য হয়ে পড়বে। একটি পথ হচ্ছে, ইসলামের অর্থনৈতিক বিধানসমূহ প্রত্যাখ্যান করে পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক বিধানের প্রতি আস্থা ও প্রত্যয় স্থাপন করা। এ অবস্থায় ইসলামের নীতি ও বিধানসমূহ সংশোধন করার জন্য কষ্ট স্বীকার করতে হবে না। বরং ইসলামী বিধানের আনুগত্য অস্বীকার করাই হবে সহজ ও সোজা পথ। দ্বিতীয় পথটি হচ্ছে, ইসলামের অর্থনীতির বিধানসমূহকে নির্ভুল মনে করা সকল প্রকার সুদকে স্বজ্ঞানে হারাম বলে বিশ্বাস করা। তবে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার উদরে অবস্থান করার কারণে অবশ্যই নিজেকে ঐ হারাম ব্যবস্থা থেকে সংরক্ষিত রাখতে অক্ষম হওয়া স্বাভাবিক। এ অবস্থায় কেউ সুদী লেন-দেন করতে চাইলে করতে পারে। কারণ তাকে অবশ্যি যে কোনো গুনাহ করার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু মুসলমান হওয়ার কারণেই কোনো ব্যক্তি সুদকে বৈধ ঘোষণা করে সুদী লেন-দেন করতে পারে না। হারাম খাওয়ার গুনাহকে হালকা করে নিজের বিবেকের দংশন থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্যে সে এমন বস্তুকে পবিত্র গণ্য করার চেষ্টা করতে পারে না, যাকে খোদা ও তাঁর রাসুল অপবিত্র ঘোষণা করেছেন। কোনো ব্যক্তি ইসলামী আইন প্রত্যাখ্যান করে যে কোনো অনৈসলামিক আইনের আনুগত্য করার অবশ্যি অধিকার রাখে। এমনকি শেষ পর্যায়ে এসে ইসলামী আইনের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নিয়ে অনৈসলামিক আইনের আওতাধীনে একজন গুনাহগার নাগরিক হিসেবে বাস করার স্বাধীনতাও তাঁর আছে অথবা অবস্থার চাপে পড়ে সে এমনটি করতে বাধ্যও হতে পারে। কিন্তু কোনো অবস্থাতে ইসলামী আইনকে সুবিধামত যে কোনো অনৈসলামি আইনে রূপান্তরিত করে পরিবর্তিত আইনকে ইসলামী আইন বলে দাবী করার অধিকার কারো নাই।।