পূর্ববর্তী আলোচনার সংক্ষিপ্তসার
এসব আইগত ব্যাখ্যা সামনে রইলো। এসবের উপর মনোনিবেশ করলে নিম্ন সিদ্ধান্তে পৌছা যায়ঃ
একঃ দারুল হরব যদি সাধারণভাবে দারুল কুফর (FOREIGN TERRITORY) অর্থে গ্রহণ করা হয়, তাহলে তার সম্পদ বৈধ (مباح) (**আরবী**) নয়, বরঞ্চ ‘অরক্ষিত’। রক্ষণহীনতার ফল শুধু এতটুকু যে, ইসলামী রাষ্ট্র সে ভূখন্ডে কোনো জান-মালের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে দায়ী নয়। সেখানে যদি কোনো মুসলমান মুসলমান অথবা অমুসলিমের জান-মালের ক্ষতি করে, কিংবা তার মলিকানা থেকে কোনো কিছু অবৈধ উপায়ে হস্তগত করে তাহলে সেটা হবে তার এবং আল্লাহর মধ্যকার ব্যাপার। ইসলামী রাষ্ট্র এতে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।
দুইঃ দারুল হরব যদি এমন কাফেরদের আবাসভূমি বুঝায় যাদের জান ও মাল বৈধ, তাহলে এ অর্থে প্রত্যেক দারুল কুফর দারুল হরব নয়। বরঞ্চ শুধু মাত্র সেই অঞ্চলই দারুল হরব যার সাথে দারুল ইসলামের প্রত্যক্ষ যুদ্ধ চলছে। এ বিশেষ ধরনের দারুল কুফর ব্যতীত অন্য দারুল কুফরের অধিবাসীর জান-মাল বৈধ নয় যদিও তারা জিম্মী না হয় এবং তাদের জান ও মাল অরক্ষিত হয়।
তিনঃ যে দেশের সাথে মুসলমানদের কার্যত যুদ্ধ চলছে, তাদের জান ও মাল সাধারণভাবে এমন বৈধ নয় যে, প্রত্যেকে সেখানে লুটতরাজ করার ও কাফেরদের সম্পদ দখল করার স্বাধীনতা রাখে। বরঞ্চ তার জন্যে কিছু শর্ত ও বাধা-নিষেধ আছেঃ
(ক) মুসলমানদের নেতা রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে সে দেশকে দারুল হরব বলে অভিহিত করবে এবং
(খ) সেখানে যারা যুদ্ধ করবে তাদের জন্যে ইমামের অনুমতি ও সাহায্য থাকতে হবে।
চারঃ গনীমত সেসব স্থাবর সম্পদকে বলা হয়, যা শুধু সেনাদের সাথে যুদ্ধ করে হস্তগত করা হয়। অন্য কথায়, যা সম্মানজনক পন্থায় অর্জন করা হয় এবং যাতে দীনের মর্যাদা বৃদ্ধি হয়। এ মালের এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহর। অর্থাৎ আল্লাহর পথে ব্যয়িত হবে।
পাঁচঃ ‘ফাই’ ঐসব স্থাবর অবস্থার সম্পদকে বলে যা বিজয় লাভের ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের দখলে আসে। খেরাজ, সন্ধিসূত্রে লব্ধ মাল প্রভৃতিও ফাই-এর অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু এর সবটাই ইসলামী রাষ্ট্রের মালিকানা ভুক্ত সম্পদ এবং কোনো ব্যক্তি বিশেষের মালিকানা অধিকার এতে থাকবে না।
ছয়ঃ ‘ফাই’ এবং গনীমতের মালের উপর বিজয়ীদের পূর্ন মালিকানা অধিকার তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন তা দারুল হরব থেকে দারুল ইসলামে স্থানান্তরিত করা হয়। অথবা দারুল হরবকে দারুল ইসলামে পরিণত করা হয়। এর পূর্বে সেসব মাল ব্যবহার করা ও তা কাজে লাগানো মাকরূহ।
সাতঃ ইসলামী আইন – হরবী কাফেরদের মালের উপর তাদের মালিকানা অধিকার স্বীকার করে। তাদের মালিকানা থেকে মুসলমানদের মালিকানায় বৈধ উপায়ে হস্তান্তর সেভাবে হতে পারে, যেভাবে আল্লাহ ও তাঁর রসূল হালাল করেছেন। অর্থাৎ ক্রয়, সন্ধি অথবা যুদ্ধের মাধ্যমে।
আবাস ভুমির বিভিন্নতার কারণে মুসলমানেদের শ্রেনীর বিভাগ
এসব বিষয়ের সঠিক তত্ত্ব জানার পর এখন একটি দৃষ্টিভংগীও লক্ষ্য করুন যে, ইসলামী আইন অনুযায়ী আবাস ভূমির বিভিন্নতার দিক দিয়ে স্বয়ং মুসলমানদের মধ্যে কি কি বিভিন্নতা দেখা যায়। এ ব্যাপারে সমগ্র আইনের ভিত্তি নিম্ন আয়াত ও হাদীসগুলো উপর প্রতিষ্ঠিতঃ
وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَلَمۡ يُہَاجِرُواْ مَا لَكُم مِّن وَلَـٰيَتِہِم مِّن شَىۡءٍ حَتَّىٰ يُہَاجِرُواْۚ
“যারা ঈমান এনেছে বটে, কিন্তু হিজরত করে দারুল ইসলামে আসেনি, তাদের সাথে তোমাদের বন্ধুত্বের কোনো সম্পর্ক নেই, যতোক্ষণ না দারুল কুফর থেকে দরুল ইসলামে হিজরত করে।”-(সূরা আনফালঃ ৭২)
فَلَا تَتَّخِذُواْ مِنۡہُمۡ أَوۡلِيَآءَ حَتَّىٰ يُہَاجِرُواْ فِى سَبِيلِ
(আরবী********)
“তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না, যতোক্ষণ না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে।”-(সূরা আন-নিসাঃ ৮৯)
وَمَن قَتَلَ مُؤۡمِنًا خَطَـًٔ۬ا فَتَحۡرِيرُ رَقَبَةٍ۬ مُّؤۡمِنَةٍ۬ وَدِيَةٌ۬ مُّسَلَّمَةٌ إِلَىٰٓ أَهۡلِهِۦۤ إِلَّآ أَن يَصَّدَّقُواْۚ فَإِن كَانَ مِن قَوۡمٍ عَدُوٍّ۬ لَّكُمۡ وَهُوَ مُؤۡمِنٌ۬ فَتَحۡرِيرُ رَقَبَةٍ۬ مُّؤۡمِنَةٍ۬ۖ وَإِن ڪَانَ مِن قَوۡمِۭ بَيۡنَڪُمۡ وَبَيۡنَهُم مِّيثَـٰقٌ۬ فَدِيَةٌ۬ مُّسَلَّمَةٌ إِلَىٰٓ أَهۡلِهِۦ وَتَحۡرِيرُ رَقَبَةٍ۬ مُّؤۡمِنَةٍ۬
(আরবী********)
“(১) যে কেউ কোনো মুসলমানকে ভুলবশত হত্যা করে, তাকে একটি মুসলমান ক্রীতদাস মুক্ত করে দিতে হবে এবং নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশগণকে রক্তপণ দিতে হবে। তবে ওয়ারিশগণ যদি সদকা হিসেবে রক্তপণ ছেড়ে দেয়, তাহলে তা দিতে হবে না। (২) এবং যদি নিহত ব্যক্তি এমন দলের হয় যাদের সাথে তোমাদের শত্রুতা আছে এবং যদি সে মুসলমান হয়, তাহলে শুধু একটি মুসলমান ক্রীতদাস মুক্ত করে দিতে হবে। (৩) এবং যদি সে এমন দলের হয়, যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি হয়েছে, তাহলে তার ওয়ারেশদেরকে রক্তপণ দিতে হবে এবং একজন মুসলমান ক্রীতদাস মুক্ত করে দিতে হবে।”-(সূরা আন নিসাঃ ৯২(
قال النبى صلى الله عليه و سلم انا برى‘ من كل مسلم اقام بين اظهر النشكين- وعن النلى صلى الله عليه وسلم ايضا من اقام مع المشركين فقد برءت منه الذمة او قال لاذمة له-
“নবী করীম (সাঃ) বলেন, আমি১ [১. আমি শদ্বটি তিনি রসূল হিসেবে বলেননি, বলেছেন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে। তার অর্থ হলো এই যে, এ ধরনের কোনো মুসলমানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের নয়।] ঐ মুসলমানের দায়িত্ব থেকে মুক্ত, যে মুশরেকদের মধ্যে থাকে। তিনি অন্যভাবেও বলেন, যে মুশরেকদের মধ্যে থাকে তার থেকে আমি দায়িত্বমুক্ত। অথবা তার জন্যে কোনো দায়িত্ব নেই।”
আবু দাউদের কিতাবুল জিহাদ অধ্যায়ে আছে, যখন নবী করীম (স) কাউকে সেনাধক্ষ্য করে পাঠাতেন, তখন তিনি তাকে অন্যান্য উপদেশের সাথে এ উপদেশও দিতেনঃ
ادعهم الى الاسلام بان اجايوك باقبل منهم وكف عنهم- ثم ادعهم الى الرحول من دارهم الى دار المهاجرين واعلمهم انهم ان فعلوا ذالك ان لهم ماللمهاجرين وان عليهم ما على المهاجرين فان ابوا واختاروا دارهم فاعلمهم انهم يكونون كاعراب المسلمين يجرى عليهم حكم الله الذى كان يجرى على المؤمنين ولايكون لهم فى الئ والغنيمة نصيب الا ان يجاهدوا مع المسلمين
“তাদেরকে প্রথমে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেবে। যদি দাওয়াত গ্রহণ করে তাহলে তাদের উপর হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে। তারপর তাদেরকে আপন আবাসভূমি ত্যাগ করে দারুল ইসলামে আসতে বলবে। একথাও বলবে যে, দারুল ইসলামে এলে তাদের সেসব অধিকার মিলবে যা মুহাজেরগণ পেয়ে থাকে। আর যেসব দায়িত্ব মুহাজেরগণের উপরে অর্পিত হয় তা তাদের উপরেও হবে। যদি তারা অস্বীকার করে এবং নিজেদের আবাস ভূমিতেই থাকতে চায়, তাহলে তাদেরকে জনিয়ে দিবে যে তাদের অবস্থা মুসলিম বেদুঈনদের মতোই হবে। মুসলিমদের মতো তাদের উপর আল্লাহর বিধি নিষেধ জারী হবে। কিন্তু ফাই এবং গনিমতের কোনো অংশ তারা পাবে না। তবে পাবে যদি মুসলমানদের সাথে মিলে জিহাদ করে।”
এসব আয়াত ও হদিীস থেকে হানাফী ফকীহগণ যে বিধান বের করেছে তা সংক্ষেপে বর্ণনা করছি।
একঃ দারুল ইসলামের মুসলমান
যে সকল জীবন ও ধন-সম্পদ দারুল ইসলামের গন্ডির ভিতর হবে, ইসলামী রাষ্ট্রের১ [১. প্রাথমিক যুগে যখন সকল মুসলিম অধিকৃত এলাকা একই রাষ্ট্রের অধীন ছিল, তখন দারুল ইসলাম বলতে মুসলিম খলিফার রাষ্ট্রীয় সীমাকেই বুঝাতো। কিন্তু ইসলামী আইনের ভিত্তি যে সব মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত তা এমন যে, যখন দারুল ইসলাম খন্ড-বিখন্ড হয়ে বিভিন্ন মুসলিম রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়লো, তখন আপনা-আপনি রাষ্ট্র মন্ডলের (Commonwealth) ধারণা সৃষ্টি হলো। এ ধারণা অনুযায়ী প্রতিটি মুসলিম অধিকৃত এলাকা, তা সে দুনিয়ার যে কোনো প্রান্তেই হোক আর যে কোনো শাসকের অধীন হোক, সর্বাবস্থায় দারুল ইসলামের অংগ, অংশ। আর প্রত্যেকে মুসলমান, সে যেখানেই জন্মগ্রহণ করুক, দারুল ইসলামে প্রবেশ করার সাথে সাথে তার নাগরিক হয়ে পড়ে। অতপর সে সকল নাগরিক অধিকার (Rights of Citizenship) লাভ করে, এ শর্তে যে সে কোনো দারুল কুফরের সাথে নাগরিকত্বের সম্পর্ক বজায় না রাখে। বর্তমান ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ এ নীতি মেনে চলুক আর নাই চলুক, ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে কোনো মুসলমান কোনো ইসলামী রাষ্টে বিদেশী (Foreigner) নয়। একজন আফগানের অধিকার ও দায়িত্ব তুরস্কে এবং ইরানে তাই হবে, যা স্বয়ং আফগানিস্থানে হয়ে থাকে এবং একজন মুসলমানের এ প্রয়োজন হওয়া উচিত নয় যে, যদি সে একটি ইসলামী রাষ্ট্র থেকে অন্য কোনো ইসলামী রাষ্ট্রে যায়, তাহলে সেখানে নাগরিকত্ব লাভের জন্য তাকে কৃত্রিম পন্থা অবলম্বন করতে হবে। প্রত্যেক মুসলমান দারুল ইসলামের জন্মগত নাগরিক।] দায়িত্ব শুধু তার রক্ষণাবেক্ষন করা। যেসব মুসলমান দারুল ইসলামের নাগরিক হবে, ইসলামের যাবতীয় আইন দীনের দিক দিয়েই নয় বরঞ্চ পার্থিব দিক দিয়েও তাদের উপর প্রযোজ্য হবে এবং তারাই পুরোপুরি বিধানগুলো মেনে চলবে। এ নীতি ইসলামী আইনের মৌল ও প্রধান নীতিগুলোর মধ্যে একটি। এর থেকে অনেক শাখা-প্রশাখা বা ধারা-উপধারা বিস্তার লাভ করেছে।
একঃ এ নীতির ভিত্তিতেই এ বিধান যে জান-মাল-ইজ্জতের রক্ষণ ব্যবস্থা শুধু সেসব মুসলমান ভোগ করবে, যারা দারুল ইসলামের রক্ষণাধীন। তাদের ছাড়া অন্যান্য মুসলমানদের রক্ষণ-ব্যবস্থা শুধুমাত্র দীনি ব্যবস্থা। প্রতিষ্ঠিত রক্ষন-ব্যবস্থা নয়, যার ভিত্তিতে শরীয়তের বিচার অপরিহার্য হয়। ইমাম সারখসী বলেনঃ
العصة المقومة تكون بالاحراز- (المبسوط ج 10 ص 30)
“প্রতিষ্ঠিত রক্ষণ-ব্যবস্থা শাসন কার্যের মাধ্যমে হয়।” -(আল মাবসুত খঃ ১০, পৃঃ ৩০)
والعصمة بالاحراز والاحرذ بالدار لابالدين- (ايضا ص 35)
“রক্ষণ-ব্যবস্থা শাসন-ব্যবস্থার দ্বারা হয়। আর শাসন ব্যবস্থা রাষ্ট্র দ্বারা হয়, দ্বীনের দ্বারা নয়।” -(ঐ পৃঃ৫৩)
দুইঃ এ নীতি অনুযায়ী এ বিধানও নির্ণীত হয় যে, ইসলামী আইন যেসব কাজ হারাম করেছে তার থেকে দীনের দিক দিয়ে ও বিচার-শাসনের দিক দিয়ে দারুল ইসলামের মুসলমানদেরকে বিরত রাখতে হবে। কিন্তু যেসব মুসলমান দারুল ইসলামে নেই, তাদের বিষয়টি তাদের এবং আল্লাহর মধ্যে। অন্তরে দীনের প্রতি মর্যাদাবোধ থাকে তো নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকবে, নতুবা যা খুশী করবে। কারণ তাদের উপর বিধান কার্যকর করার ক্ষমতা ইসলমের নেই।
তিনঃ এ নীতি থেকে এ মাসয়ালাও বের হয় যে, যেসব জান-মাল দারুল ইসলামের রক্ষণাধীন তা সব রক্ষিত, অতএব শরীয়তি বিধান ব্যতীত অন্য কোনো উপায়ে তাদের সাথে শত্রুতা করার অনুমতি দেয়া যাবে না। এ ব্যাপারে মুসলিম অমুসলিমদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। প্রত্যেক ব্যক্তিকে শত্রুতা করা থেকে বিরত রাখা হবে যে ইসলামী বিধানের অনুসারী হয়েছে, সে মুসলিমের সাথে শত্রুতা করুক বা অমুসলিমদের সাথে। প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির জান ও মালের রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে, যে দারুল ইসলামের রক্ষণাধীন তা সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম হোক।
দারুল ইসলামে কোনো মুসলমান মুসলমান থেকে, মুসলমান জিম্মী থেকে, জিম্মী মুসলমান থেকে, জিম্মী জিম্মী থেকে, নিরাপত্তাপ্রাপ্ত হরবী অন্য নিরাপত্তাপ্রাপ্ত থেকে সুদ অথবা কোনো অবৈধ চুক্তিতে কারবার করতে পারবে না; কারণ সকলের সম্পদ লোকের জন্যে রক্ষিত। একমাত্র ইসলামী আইনের বৈধ উপায়ে সে সম্পদ লাভ করা যায়।
(আরবী********)
“হরবী ব্যবসায়ীগণ যদি নিরাপত্তাসহ দারুল ইসলামে প্রবেশ করে এবং সেখানে তাদের কেউ দুই দিরহাম দিয়ে এক দিরহাম খরিদ করে। তাহলে তার অনুমতি দেওয়া হবে না। যা মুসলমানদের মধ্যে বৈধ, শুধু এমন কারবারের অনুমতিই দেয়া হবে। জিম্মীর ব্যপারেও তাই। কারণ তাদের প্রত্যেকের সম্পদ প্রতিষ্ঠিত ও রক্ষিত।“-(আল মাবসুত খঃ ১৪, পৃঃ ৫৮)
এভাবে যদি কোনো কাফের দারুল কুফর থেকে দারুল ইসলামে আসে, অথবা দারুল হরব থেকে কোনো হরবী নিরাপত্তাসহ ইসলামী রাষ্ট্রে প্রবেশ করে। তাহলে তার নিকট থেকে সুদ গ্রহণ করা অথবা কোনো অবৈধ চুক্তিতে কারবার করা জায়েয হবে না। কারণ ইসলামী রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত নিরাপত্তা তার জান ও মাল রক্ষিত করে দিয়েছে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের প্রদত্ত নিরাপত্তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা সকল নাগরিকের কর্তব্য। কিন্তু যদি কোনো হরবী নিরাপত্তা ব্যতিরেকে দারুল ইসলামে আসে তাহলে তাকে আটক করা, তার সম্পদ লুট করা, তাকে হত্যা করা এবং অবৈধ চুক্তিতে তার সাথে কারবার করা সবই ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মদ (র)-এর মতে জায়েয। কারণ তার রক্ত ও সম্পদ বৈধ। কিন্তু ইমাম আবু ইউসুফ তার সাথে কোনো অবৈধ চুক্তিতে কারবার করা জায়েয মনে করেন না। বিস্তারিত আলোচনা সামনে করা হবে।
দুইঃ দারুল কুফর ও দারুল হরবে নিরাপত্তা প্রাপ্ত মুসলমান-
দারুল ইসলামের কোনো নাগরিক যদি নিরাপত্তাসহ সাময়ীকভাবে দারুল কুফর অথবা দারুল হরবে যায়, তাকে ইসলামী পরিভাষায় বলে ‘মুস্তামান’ (নিরাপত্তাপ্রাপ্ত)। এ ব্যক্তি যদিও ইসলামী রাষ্ট্রের আওতার (JURISDICTION) বাইরে যাবার কারণে আমাদের রাষ্ট্রের আইনের ধরা-ছোয়ার বাইরে থাকে। কিন্তু তথাপি কতকটা ইসলামী রাষ্ট্রের রক্ষণাধীন সে থাকে এবং ইস্ললামী আইন পালনের দায়িত্ব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয় না। হেদায়া গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ
(আরবী********)
“দারুল ইসলামের যে রক্ষণ-ব্যবস্থা বা রক্ষাকবচ, তা সাময়ীকভাবে নিরাপত্তাসহ অন্যত্র গমনে বাতিল হয় না।“
-(কিতাবুস সিয়ার মুস্তামান অধ্যায়)।
এ নীতি অনুযায়ী নিন্মলিখিত শরীয়তের মাসয়ালা বের হয়ঃ
একঃ যে দারুল কুফরের সাথে দারুল ইসলামের চুক্তি সম্পাদিত হয়, সেখানে নিরাপত্তাপ্রাপ্ত মুসলমানের জন্য অবৈধ চুক্তিতে কারবার করা জায়েয নয়। কারণ সেখাকার কাফেরদের জীবন ও ধন-সম্পদ বৈধ নয়। আর এ সবের বৈধতার কারণেই যখন অবৈধ চুক্তি বৈধ হয় তখন এ বৈধতা না থাকার কারণে আপনা আপনি সেটার বৈধতাও নষ্ট হয়ে যায়।
দুইঃ যদি কোনো মুসলমান এ ধরণের দারুল কুফরে অবৈধ চুক্তিতে কারবার করে, বিস্বাসঘাতকতা করে অথবা লুটপাট ও চুরি করে কোনো কিছু নিয়ে আসে, তাহলে ইসলামী রাষ্ট্র তার উপর কোনো মামলা দায়ের করবে না কিংবা তাকে ক্ষতিপূরণও (এ শুধু সে অবস্থায় হতে পারে যদি চুক্তিতে এ ধরনের কোনো শর্ত না থাকে। অর্থাৎ ইসলামী আইনের অধীনে মাত্র কার্যের ভিত্তিতে সে মুসলমানকে অভিযুক্ত করা যাবে না। শুধু সন্ধির শর্ত অনুসারেই তাকে অভিযুক্ত করা যেতে পারে অথবা ঐ সবের ভিত্তিতে-যে সম্বন্ধে পূর্বে ইংগিত করা হয়েছে) দিতে হবে না। অবশ্যি দীনের দিক দিয়ে তাকে ঐসব শরীয়ত বিরুদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেয়া হবে।
তিনঃ দারুল হরবে নিরাপত্তাসহ যে ব্যক্তি প্রবেশ করে তার জন্য অবৈধ চুক্তি বাদে অন্যান্য সমুদয় ব্যপারে হানাফী ফেকাহর এসব বিধানই রয়েছে।
(আরবী********)
কোনো ব্যবসায়ী যদি নিরাপত্তাসহ দারুল হরবে যায় এবং সেখান থেকে কোনো দাসী চুরি করে নিয়ে আসে —- তাহলে তার এবং আল্লাহর মধ্যস্থিত সম্পর্কের ভিত্তিতে সে উক্ত দাসীকে ফেরত দেবার জন্যে আদিষ্ট, কিন্তু ইমাম তাকে এরুপ করতে বাধ্য করবে না। -(আল মাবসুত ১ :৬১)
(আরবী********)
যদি কোনো মুসলমান নিরাপত্তাসহ দারুল হরবে প্রবেশ করে, তাদের কাছে ঋণ গ্রহন করে কিংবা সে তাদের মাল লুট করে বা তারাই তার মাল লুট করে, তাহলে দারুল ইসলামে এর কোনো মীমাংসা করা যাবে না —— নিরাপত্তাপ্রাপ্ত ব্যক্তি স্বয়ং তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা না করার দায়িত্ব নিয়েছে। এখন সে যে বিশ্বাসঘাতকতা করলো তা ইমামের চুক্তি অনুযায়ী করেনি, সে নিজস্ব চুক্তিতে বিশ্বাস ভংগ করেছে। সে জন্যে তাকে ফেরত দেবার কথা বলা হবে-কিন্তু বাধ্য করা হবে না। (ঐ পৃঃ ৯৫)
(ইমাম আবু ইউসুফ এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। কারণ তিনি মুসলমানকে সকল ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান পালনে বাধ্য বলে মনে করেন) যদি কোনো নিরাপত্তাপ্রাপ্ত মুসলমান দারুল হরবে কাউকে হত্যা করে, অথবা কারো মালের ক্ষতি করে, তাহলে দারুল ইসলামে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে না। অবশ্যি দীনের দিক দিয়ে তার এরুপ করা নাজায়েয।
(আরবী********)
“দীনের দিকে একজন নিরাপত্তাপ্রাপ্ত মুসলিমের বিশ্বাসভংগ করা অবাঞ্ছিত। কারণ বিশ্বাসভংগ করা হারাম।“-(ঐ পৃঃ ৯৬)
কোনো নিরাপত্তাপ্রাপ্ত মুসলমান দারুল হরব থেকে কোনো কিছু অন্যায়ভাবে অথবা চুরি করে নিয়ে এলে তা মুসলমানদের জন্যে খরিদ করা মাকরুহ। কিন্তু খরিদ করে ফেললে, সে খরিদ বাতিল ঘোষণা হবে না। কারণ আইনত ক্রয়-বিক্রয়ে কোনো দোষ নেই। কিন্তু যেহেতু মূলত এ মাল অন্যায়ভাবে অর্জিত, সে জন্যে দীনের খ্যাতিরে তা ফেরত দিতে সে আদিষ্ট।
চারঃ নিরাপত্তাপ্রাপ্ত মুসলমান দারুল হরবে হরবীদের কাছে সুদ নিতে পারে, জুয়া খেলতে পারে, মদ শূকরের মাংস, মৃত জীব তাদের কাছে বিক্রি করতে পারে এবং হরবীদের সম্মতিতে সকল উপায় তাদের মাল গ্রহন করতে পারে। এ হলো ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মদ (র)-এর অভিমত। ইমাম আবু ইউসুফ (র) এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। ইমাম সারাখসী প্রথমোক্ত ইমামদ্বয়ের যুক্তির যে উদ্ধৃতি দেন তা প্রণিধানযোগ্য।
নিরাপত্তাপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্যে দারুল হরবে সুদের উপর নগদ অথবা ধারে কারাবার করা, মদ, শূকরের মাংস ও মৃত জীব তাদের কাছে বিক্রি করা ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মদ (র)-এর মতে জায়েয। কিন্তু ইমাম আবু ইউসুফ (র) নাজায়েয বলেছেন। তাঁর যুক্তি এই যে, মুসলমান যেখানেই থাক, ইসলামের বিধান মেনে চলতে বাধ্য, আর ইসলামী বিধানই এ ধরনের কাজ হারাম করেছে। লক্ষ্য করার বিষয় যে, নিরাপত্তাপ্রাপ্ত হরবী যদি আমাদের রাষ্ট্রে এমন কাজ করে তা জায়েয হবে না। অতএব এখানে যখন নাজায়েয তখন দারুল হরবেও নাজায়েয হওয়া উচিত। প্রথমোক্ত ইমামদ্বয় বলেন যে, এতো শত্রুর মাল তার সম্মতিতে নেয়া হয়েছে। আর মূলে এই রয়েছে যে, তাদের সম্পদ আমাদের জন্য মুবাহ (বৈধ)। নিরাপত্তাপ্রাপ্ত এতটুকু দায়িত্ব নিয়েছিল যে, সে কোনো আত্মসাৎ করবে না। কিন্তু যখন সে চুক্তির মাধ্যমে তার সম্মতিতে এ মাল লাভ করেছে, তখন সে তো বিশ্বাস ভঙ্গের অপরাধ থেকে বেঁচে গেল এবং অবৈধতা থেকে এমনভাবে রক্ষা পেল যে, এ মাল চুক্তি হিসেবে নয় বরঞ্চ বৈধতার ভিত্তিতে নিয়েছে। এখন রইল দারুল ইসলামে নিরাপত্তাপ্রাপ্ত হরবীর ব্যাপার। এ হলো পৃথক ব্যাপার, কারণ নিরাপত্তার কারণে তার মাল রক্ষিত হয়ে গেছে। এজন্য বৈধতার ভিত্তিতে নেয়া যাবে না। -(আল মাবসুত ১ পৃঃ ৯৫)
ইমাম আবু হানিফা (র) বলেন যে, দারুল হরববাসীদের মাল লুন্ঠন করা বা কেড়ে নেয়া যখন মুসলমানদের জন্যে হালাল, তখন তাদের সম্মতিক্রমে তা নেয়া অনেকগুণে ভাল হওয়া উচিত। অর্থাৎ ইসলামী সেনাবাহিনীর আওতার বাইরে অবস্থানকারীদের জন্যে কোনো নিরাপত্তা নেই। অতএব মুসলমানদের জন্য সকল সম্ভাব্য উপায়ে তাদের সম্পদ হস্তগত করা জায়েয। -(আল মাসবুত খঃ ১, পৃঃ ১৩৮)
ইমাম আবু ইউসুফ (র) বলেন, মুসলমান যেহেতু দারুল ইসলামের অধিবাসী, এজন্যে ইসলামের বিধান অনুযায়ী সকল স্থানেই তাদের জন্যে সুদ গ্রহণ করা নিষিদ্ধ। তার কাজের এ ব্যাখ্যা ঠিক নয় যে, সে কাফেরের মাল তার সম্মতিক্রমে নিচ্ছে। বরঞ্চ সে প্রকৃতপক্ষে সেই মাল ঐ বিশেষ ধরনের কারবারের ভিত্তিতে নিচ্ছে। কারণ সেই বিশেষ ধরনের কারবার (অর্থাৎ অবৈধ চুক্তি) যদি না হয়, তাহলে কাফের অন্য কোনো পদ্ধতিতে তার মাল দিতে রাজী হবে। যদি দারুল হরবে এরূপ করা জায়েয হয়, তাহলে মুসলমানদের মধ্যে দারুল ইসলামেও এ ধরনের কারবার করা জায়েয হবে যে, একজন এক দিরহামের বিনিময়ে দুই দিরহাম নিবে এবং দ্বিতীয় দিরহামটিকে হেবা বলে অভিহিত করবে। -(আল মাসবুত খঃ ১৪, পৃঃ ৫৮)
আমাদের উদ্দেশ্য হলো উভয় মতবাদের বিচার বিশ্লেষণ করা। আমরা শুধু এতটুকু বলতে চাই যে, স্বয়ং ইমাম আবু হানিফা (র)-এর উপরিউক্ত কথা থেকে এবং আমাদের উপরে উদ্ধৃত তাঁর মযহাবের অন্যান্য মাসয়ালাগুলো থেকে পাঁচটি বিষয় সুস্পষ্টরূপে প্রমানিত হয়ঃ
প্রথমতঃ এ কারবার শুধু সেই মুসলমানের অন্য জায়েয যে দারুল ইসলামের নাগরিক এবং নিরাপত্তাসহ দারুল হরবে যায়।
দ্বিতীয়তঃ এ কারবার শুধু হরবী কাফেরদের সাথে করা যেতে পারে, তাদের জীবন ও সম্পদ বৈধ।
তৃতীয়তঃ এভাবে যে মাল নেয়া হবে তা গনিমত হবে না। কারণ তা সদুপায়ে অর্জিত নয়, এতে দীনের কোনো মর্যাদা বৃদ্ধি হয় না এবং এতে এক পঞ্চমাংশ নির্ধারিত হয় না। এ নিছক সম্পদ উপার্জন। এভাবে এটা ‘ফাই’ও হবে না। কারণ ‘ফাই’ হচ্ছে রাষ্ট্রের মালিকানাধীন। এ মাল সে ব্যক্তি নিজে গ্রহণ করে- বাইতুল মালে জমা দেয় না।
চতুর্থতঃ এভাবে কাফেরদের মাল নেয়া শুধু আইনগত অনুমতির পর্যায়ভুক্ত। বরঞ্চ বৈধতার শেষ সীমার উপর প্রতিষ্ঠিত। তার আইনগত দিক শুধু এতটুকু যে, যদি মুসলমান এমন করে তাহলে ইমাম সাহেবের মতে দীনের দিক দিয়ে মাল ফিরিয়ে দেবার ফতোয়া দেয়া যাবে না। পক্ষান্তরে আত্মসাৎ করা মাল যদিও বিচার বিভাগ থেকে ফেরত দিতে বাধ্য করা হবে না, দীনের দিক দিয়ে ফেরত দেবার নির্দেশ দেয়া হবে।
পঞ্চমতঃ নিরাপত্তাপ্রাপ্ত মুসলমান যেভাবে দারুল হরবের কাফেরদের সাথে অবৈধ চুক্তিতে কারবার করতে পারে, তদ্রুপ সে সেখানকার মুসলমানদের সাথেও এরুপ করতে পারে। কারণ তাদের মালও বৈধ। এর প্রমাণ পূর্বে আমরা দিয়েছি। পরেও এ বিষয়ে আলোচনা করবো।
তিনঃ দারুল কুফর এবং দারুল হরবের মুসলমান নাগরিক-
যেসব মুসলমান দারুল কুফরে বাস করে এবং দারুল ইসলামে হিজরত করে না, তারা ইসলামের রক্ষণ ব্যবস্থার বহির্ভূত। যদিও ইসলামের যাবতীয় বিধান এবং হালাল-হারাম মেনে চলা তাদের জন্য ধর্মত অপরিহার্য, কিন্তু ইসলাম তাদের দায়িত্ব থেকে মুক্ত। নবী করীম (স) বলেন, গনিমত এবং ফাই-এ তাদের কোনো অংশ নেই। এ বিষয়ে হাদীসে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। পার্থিব দিক দিয়ে তাদের জান ও মাল অরক্ষিত। কারণ প্রতিষ্ঠিত রক্ষণ-ব্যবস্থা তাদের জন্যে নেই।
যদি এরুপ মুসলমান হরবী সম্প্রদায়ভুক্ত হয়, তাহলে তার জান ও মাল বৈধ হবে। এজন্য তার হত্যাকারীর উপর কিসাস তো দূরের কথা রক্তপণও আরোপিত হবে না। এমন কি কোনো ক্ষেত্রে কাফফারা পর্যন্ত দিতে হবে না। এ ব্যপারে ফকীহগণের কিছু মন্তব্য আমরা হুবহু উদ্ধৃত করছি যাতে করে দারুল হরবের মুসলমান নাগরিকদের আইনগত পজিশন বুঝতে পারা যাবে:
(আরবী********)
“যে মুসলমান হবার পর হিজরত না করে দারুল হরবেই বাস করে, তার খুনের কোনো মূল্য নেই… আমাদের সাথীগণ তাকে হরবীর পর্যায়ভুক্ত করেছে। এজন্য যে, তার মালের ক্ষতি করলে তার কোনো ক্ষতিপূরণ নেই… তার মাল এ দিক দিয়ে হরবীর মালের ন্যায়। এজন্য আবু হানিফা (র) তার সাথে ক্রয়-বিক্রয় সেসব পন্হা জায়েয রেখেছেন যা হরবীদের সাথে জায়েয। অর্থাৎ দারুল হরবে এক দিরহাম দুই দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করা – যার অর্থ সুদ”।
-(আহকামুল কুরআন লিল যাচ্ছাছ ও আল হানাফী খঃ ২, পৃঃ ২৯৭)
(আরবী********)
যে দারুল হরবে থাকে সে যেন দারুল ইসলামবাসীদের জন্য মৃতের ন্যায়”। -(আল মাসবুত খঃ ১০, পৃঃ ৬৪)
(আরবী********)
“যদি হরববাসী মুসলমান শিশুদেরকে ঢাল স্বরূপ ব্যবহার করে তাহলে তাদেরকে তীরের লক্ষ্য বানাতে কোনো দোষ নেই, যদিও তীর নিক্ষেপকারী জানতে পারে যে মুসলমানকেই তার লক্ষ্য বানানো হচ্ছে। এর জন্যে তাকে কাফ্ফারা এবং রক্তপণ কিছুই দিতে হবে না”। – (ঐ পৃঃ ৯৫)
(আরবী********)
“দারুল হরবে কোনো হরবী মুসলমান হবার পর সে দেশ যদি মুসলমানগণ জয় করে, তাহলে তার ধন-সম্পদ, তার ক্রীতদাস এবং তার নাবালেগ শিশুদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে। কিন্তু তার স্থাবর সম্পত্তি মুসলমানদের গণিমত হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এ হচ্ছে ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মদ (র) এর অভিমত। কিন্তু আবু ইউসুফ (র) বলেন, দয়াপরবেশ হয়ে তার অস্থাবর সম্পত্তিও তার অধিকারে থাকতে দেয়া হবে”। – (ঐ পৃঃ ৬৬)
“[ইমাম আবু হানিফা বলেন], দারুল হরবে কোনো ব্যক্তি তার ক্রীতদাসীর সাথে অথবা আপন স্ত্রীর সাথে সহবাস করাকেও আমি মাকরূহ মনে করি, এ আশংকায় যে সেখানে তার কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করবে। কারণ মুসলমানদের জন্যে দারুল হরবকে তার আবাসস্থল বানানো নিষিদ্ধ। কারণ যদি সে তার সন্তানকে ছেড়ে চলে আসে তাহলে তার সন্তান মুশরিকদের আচার আচরণ গ্রহণ করবে”।
এ প্রসংগে শেষ কথা আমি আশংকার সাথে বলতে চাই এবং তা হচ্ছে এই যে, ইমাম আযম (র) এর মতে দারুল হরবের মুসলমান অধিবাসীদের পরস্পরে সুদ খাওয়া মাকরূহ। কিন্তু তারা যদি এমন কাজ করে তাহলে বাধা দেয়া যাবে না। ইমামম মুহাম্মদ (র) এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। তার যুক্তি এই যে, এ দুজন মুসলমানের মাল গ্রহণ দ্বারা মালিকানা থেকে রক্ষিত (অর্থাৎ একজন মুসলমানের মালের উপর আর একজন মুসলমানের শুধু এ কারণে হতে পারে না যে, সে যে কোনো উপায়ে সে মাল তার কাছ থেকে নিয়েছে)। মুসলমান এ দেশ জয় করার পরও যখন তাদের মাল গণিমত বলে অভিহিত করে না, তখন এদুজনের কি অধিকার থাকতে পারে, একে অপরের মাল গণিমত হিসেবে গ্রহণ করার? কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (র) তাঁর মতের স্বপক্ষে যে আইনগত যুক্তি প্রদর্শন করেছেন, তা থেকে জানা যায় যে, বিভিন্ন আইনগত বিষয়ের জটিল ও সূক্ষ পার্থক্য অনুধাবন করতে ইমাম সাহেবের ফেকাহ শাস্ত্রের জ্ঞান কত গভীর এবং ব্যাপক ছিল। আমরা তাঁর বর্ণনা হুবহু উদ্ধৃতি করছি, যার দ্বারা আইনের মূলনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। তিনি বলেনঃ
(আরবী********)
“দারুল ইসলামের রক্ষাণাধীনে আসার পূর্বে নিছক ইসলামের দ্বারা যে রক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, তা শুধু ইমামের অধিকারে, কিন্তু তা বিধানে নেই। দেখছেন না, যদি এ দুজন মুসলমানের মধ্যে একজন অন্যজনের মাল অথবা জান বিনষ্ট করে তাহলে তার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না? অথচ এরূপ করলে সে গোনাহগার হবে? কথা আসলে এই যে, বিধান অনুযায়ী রক্ষণ ব্যবস্থা শুধু দারুল ইসলামের আওতার মধ্যে হলেই প্রমাণিত হয়। আর এ রক্ষণ ব্যবস্থা রাষ্ট্রের কারণে, দ্বীনের কারণে নয়। দ্বীন তো শরীয়তের অধিকারের দিক দিয়ে শুধু তাদেরকেই বাধা দেয় যারা তার উপর বিশ্বাস রাখে। আর যারা বিশ্বাস রাখে না তাদেরকে বাধা দেয় না। পক্ষান্তরে রাষ্ট্র শক্তির মাধ্যমে মানুষের রক্ষা ব্যবস্থা তাদের বিরুদ্ধেও করা হয়, যারা তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং যারা শ্রদ্ধাশীল নয় তাদের বিরুদ্ধেও। অতএব গোনাহ হবার কারণে যে রক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, তার ভিত্তিতে আমরা বলেছিলাম যে, তার গৃহীত সম্পদ ফেরত দেবার নির্দেশ দেয়া হবে না। কারণ এদের মধ্যে প্রত্যেকেই যখন এক অপরের সম্পদ হস্তগত করে তখন শুধু হস্তগত করার কারণেই তার মালিক হয়ে যায়”।
এখানে ইমাম সাহেব ইসলামী আইনের তিনটি বিভাগের প্রতিই ইংগিত করেছেন। বিশ্বাসমূলক আইনের দিক দিয়ে মুসলমানের সম্পদ রক্ষিত, তা সে দারুল ইসলাম, দারুল কুফর অথবা দারুল হরবে হোক না কেন। আর এ রক্ষণ ব্যবস্থার ফল এই যে, এর ভিত্তিতে আল্লাহর নিষিদ্ধ পন্হায় সম্পদ গ্রহণকারী গোনাহগার হবে। শাসনতান্ত্রিক আইন অনুযায়ী দারুল ইসলামে অবস্থানকারী কাফেরের মালের যে রক্ষণ ব্যবস্থা আছে, দারুল কুফরে অবস্থানকারী মুসলমানদের জন্য নেই। এজন্য দারুল কুফরের অন্য কোনো মুসলমান যদি তা অবৈধ উপায়ে গ্রহণ করে আল্লাহর নিকট সে গোনাহগার হবে। কিন্তু দুনিয়ার উপর কোনো ইসলামী বিধান জারী হবে না। বৈদেশিক সম্পর্কের আইনের দৃষ্টিতে কাফেরদের মধ্যে অবস্থানকারী মুসলমান স্বীয় তামাদ্দুনিক অধিকার ও দায়িত্বের দিক দিয়ে সেসব কাফেরদেরই অবস্থার অংশীদার। এজন্য সেও এভাবে শুধু গ্রহণ করার দ্বারাই মালের মালিক হয়ে যাবে। — যেভাবে স্বয়ং কাফের মালিক হয়। অতএব এর ভিত্তিতে যদি দারুল কুফরে মুসলমান মুসলমানের নিকট থেকে সুদ গ্রহণ করে, অথবা মুসলমান কাফের থেকে বা কাফের মুসলমান থেকে সুদ গ্রহণ কর, তাহলে তারা তো এসব মালের মালিক হয়ে যাবে এবং তাদের সে মাল ফেরত দেয়ারও নির্দেশ দেয়া হবে না। কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে, সুদ গ্রহণকারী ও সুদদাতা মুসলমান গোনাহগার হবে না।
শেষ কথা
এ পর্যন্ত আমরা ইসলামী আইনের যে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপিত করলাম, তার দ্বারা মাওলানা মানাযের আহসান গিলানীর যুক্তির বুনিয়াদ একেবারে ধূলিস্মাৎ হয়ে যায়। এর থেকে প্রমাণ হয় যেঃ
একঃ সকল গায়েরে জিম্মী কাফেরের জীবন ও ধন-সম্পদ বৈধ নয়। বৈধ শুধু ঐসব কাফেরের সম্পদ যারা যুদ্ধে লিপ্ত। অতএব সুদ গ্রহণ করা এবং অবৈধ চুক্তিতে কারবার করা যদি জায়েয হয়, তাহলে শুধুমাত্র যুদ্ধরত কাফেরদের সাথে। আর এসব করার অধিকার শুধু সেসব মুসলমানদের যারা দারুল ইসলামের নাগরিক, যাদের নেতা কোনো দারুল কুফরকে দারুল হরব ঘোষণা করেছে এবং যারা নিরাপত্তাসহ ব্যবসা প্রভৃতির জন্যে দারুল হরবে প্রবেশ করেছে।
দুইঃ এক তো দারুল কুফর সর্ববস্থায় দারুল হরব হয় না। আর যদি বিশ্বাসমূলক আইন অনুযায়ী তাকে দারুল হরব মনে করা হয়, তথাপি তার অনেক শ্রেণী বিভাগ আছে এবং প্রত্যেক শ্রেনীর বিধান পৃথক পৃথক। যাবতীয় অনৈসালামী রাষ্ট্রকে একই অর্থে দারুল হরব মনে করা এবং বিশেষ যুদ্ধাবস্থায় যেসব বিধান জারী করা হয়, তা যদি সর্বদা সেখানে জারি করা হয়, তহালে তা শুধু ইসলামী আইনের প্রাণ শক্তিরই পরিপন্হী হবে না, বরঞ্চ তা হবে সুস্পষ্ট নির্দেশনাবলীর পরিপন্হি এবং তার পরিনাম হবে অত্যান্ত ভয়াবহ। জানমালের বৈধতার ভিত্তিতে যেসব খুটিঁনাটি বিধান বের করা হয়, তা শুধু ততক্ষণ পর্যন্তই বলবৎ থাকতে পারে, যতক্ষণ পর্যন্ত দারুল কুফরের সাথে যুদ্ধাবস্থা বলবৎ থাকে। অতএব সমুদয় বিধান স্বয়ং দারুল হরবে মুসলমানদের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, বরঞ্চ এমন দারুল ইসলামের নাগরিকদের সাথে সংশ্লিষ্ট যা দারুল হরবের সাথে যুদ্ধে জড়িত।
তিনঃ ভারত (অবিভক্ত ভারত) সাধারণ অর্থে তখন থেকে দারুল কুফর হয়ে গেছে যখন থেকে এখানে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটেছে। যে সময়ে শাহ আব্দুল আজিজ দেহলভী (র) সুদ জায়েয হওয়ার ফতোয়া দিয়েছিলেন। তখন প্রকৃতপক্ষে এ ভারত ভারতীয় মুসলমানদের জন্য দারুল হরব ছিল। কারণ ইংরেজ জাতি মুসলম শাসন বিলুপ্ত করার জন্য যুদ্ধ করছিল। যখন মুসলিম শাসন পরিপূর্ণরূপে বিলুপ্ত হলো এবং ভারতীয় মুসলমান ইংরেজের গোলামী স্বীকার করে নিল, তখন ইহা তাদের জন্যে আর দারুল হরব রইলো না। এক সময়ে ইহা ছিল আফগানিস্তানের মুসলমানদের জন্য দারুল হরব এবং এক সময়ে তুরস্কের মুসলমানদের জন্যে দারুল হরব। কিন্তু এখন ইহা সমুদয় মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য দারুস সুলেহ (সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ রাষ্ট্র)। এজন্য মুসলমান রাষ্ট্রের নাগরিকের মধ্যে কেউ এখানে সুদ গ্রহণ করার এবং অবৈধ চুক্তিতে কারবার করার অধিকার রাখে না। অবশ্যি সীমান্তের কতিপয় স্বাধীন গোত্র একে দারুল হরব মনে করতে পারে এবং যদি তারা অবৈধ চুক্তিতে কারবার করে তাহলে হানাফী আইন মতে তাদের কাজকে জায়েয বলা যেতে পারে। কিন্তু এ শুধু আইনগত বৈধতা। আল্লাহর দৃষ্টিতে সে মুসলমান কখনো বাঞ্চিত হতে পারে না, যে একদিকে নিজেকে মুসলমানও বলে অপর দিকে সুদ, মদ্যপান, জুয়া, শুকরের মাংস এবং মৃত জীবের ব্যবসাকে ইসলামে বৈধ বলে অন্য জাতির সামনে প্রচার করে বেড়ায়। তার দৃষ্টান্ত এমন – যেমন ধরুন, কোনো ব্যক্তি তার ঋণগ্রস্থ ভাইকে গ্রেফতার করিয়ে জেলে পাঠায় – একথা জানা সত্বেও যে তার হাতে কিছুই নেই এবং ফলে তার সন্তান সন্তুতি অনাহরে মারা যাবে। আপনি বলতে পারেন যে, ঋণদাতার এমন করার অধিকার আছে এবং সে যা কিছু করছে তা সে আইনের আওতার মধ্যেই করেছে। কিন্তু একথা কেউ অস্বীকার করতে পারে না যে, এ হলো আইনগত বৈধতার শেষ সীমা এবং যে মানুষ আইনের শেষ সীমায় অবস্থান করে সে প্রায়ই পশুর চেয়েও অধম হয়ে পড়ে।
চারঃ ভারতীয় মুসলমানদের অবস্থা কখনো এমন নয় যার জন্য ফেকাহ এর ভাষায় ‘নিরাপত্তা প্রাপ্ত’ শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে। নিরাপত্তাপ্রাপ্তের জন্যে প্রথম শর্ত এই যে, তাকে দারুল ইসলামের নাগরিক হতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত হলো, দারুল হরবে তার অবস্থান স্বল্প সময়ের জন্য হতে হবে। হানাফী আইন মতে নিরাপত্তাপ্রপ্ত হরবীর জন্যে দারুল ইসলামে থাকার অনুর্ধ মুদ্দত এক বছর অথবা তার বেশী। এরপর নাগরিকত্ব পরিবর্তন আইন (LAW OF NATURALISATION) অনুযায়ী তাকে জিম্মীতে পরিণত করা হয়। এর থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, নিরাপত্তাপ্রাপ্ত মুসলমানের জন্যে দারুল হরবে অবস্থানের মুদ্দত দু’এক বছরের বেশী হতে পারে না। ইসলামী শরীয়ত মুসলমানদেরকে জিম্মী বানাতে অত্যান্ত আগ্রহান্বিত। ইসলাম কখনো এ অনুমতি দেয় না যে, কোনো ব্যক্তি দারুল হরবকে তার আপন আবাসভুমি বানিয়ে সেখানে বংশানুক্রমে সন্তান-সন্তুতি উৎপাদন করুক এবং নিরাপত্তপ্রাপ্তের ন্যায় জীবন যাপন করুক। এটা যখন কোনো ব্যক্তির পক্ষে জায়েয নয়, কোটি কোটি মুসলিম জনতার জন্যে কি করে জায়েয হতে পারে যে, তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিরাপত্তপ্রাপ্তের জীবনযাপন করবে? যেসব বৈধতার সুযোগ-সুবিধা ‘নিরাপত্তপ্রাপ্তির’ অবস্থার জন্যে সাময়িকভাবে সামরিক প্রয়োজনে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের দেয়া হয়েছিল তা একদিকে গ্রহণ করবে এবং অপরদিকে সেসব বাধা নিষেধ নিজেদের উপর আরোপ করবে যা সাময়িকভাবে নিরাপত্তাপ্রাপ্তক ইসলামী আইনের বাধা নিষেধ থেকে মুক্ত করে কাফেরদের আইন মেনে চলতে বাধ্য করে। এ কি করে হতে পারে?
পাঁচঃ ভারতীয় মুসলমানদের সত্যিকারের আইনানুগ পজিশন এই যে, তারা এমন এক জাতি যাদের উপর কাফেরগণ বিজয়ী হয়েছে। এককালে তাদের যে আবাসভূমি ছিল দারুল ইসলাম তা এখন দারুল কুফর হয়ে পড়েছে। কিন্তু দারুল ইসলামের কিছু নিদর্শন এখনও রয়ে গেছে। তাদের কর্তব্য এই যে, তারা কোনো দারুল ইসলামে স্থানান্তরিত হবে। এ যদি তাদের পক্ষে সম্ভব না হয়, তাহলে এ দেশে কখনো ইসলামের যেসব নিদর্শন অবশিষ্ট আছে, কঠোরতার সাথে তার রক্ষনাবেক্ষন করবে এবং তাদের সম্ভাব্য সকল শক্তি প্রয়োগ করে পুনর্বার এ দেশকে দারুল ইসলাম বানাবার চেষ্টা করবে। কুফরী বিধানের অধীনে তারা যে জীবন যাপন করছে, তার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস একটি গোনাহ। যা কিছু ইসলামী নির্দশনাবলী অবশিষ্ট আছে তা সব মিটিয়ে দিয়ে এ গোনাহকে অধিকতর বর্ধিত করা্ কি তাদের অভিপ্রায়?
তরজামানুল কুরআন, রমযান ১৩৫৫ হিজরী
ডিসেম্বর ১৯৩৬ খৃঃ ও জিলকদ ১৩৫৫ হিজরী
ফেব্রুয়ারী ১৯৩৭ খৃঃ
— সমাপ্ত —-