জ্ঞান ইসলামীকরণঃ স্বরূপ ও প্রয়োগ
ড. মুহাম্মদ আব্দুর রহমান আনওয়ারী
স্ক্যান কপি ডাউনলোড
প্রথম পরিচ্ছেদ
জ্ঞান ইসলামীকরণের স্বরূপ
ইসলামী জ্ঞান তত্ত্বের আলোকে জ্ঞানের বিভিন্ন উৎস রয়েছে। ওহী ভিত্তিক জ্ঞান (Revealed Knowledge ও মানব অর্জিত জ্ঞান (Acquired Knowledge) । মানব জ্ঞান আল্লাহ তা’য়ালার মহা দান। তাঁর প্রদত্ত জ্ঞান তথা ওহী ও ইলহামের মাধ্যমে জ্ঞান মানব সমাজ ও সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে অবদান রাখছে। কিন্তু যুগে যুগে মানব সমাজে এমন অনেক কিছু জ্ঞান হিসেবে প্রচলিত হয়েছে, যা সত্যিকার অর্থে জ্ঞান নয় কিংবা বিকৃত জ্ঞান।১ অপরদিকে ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গীতে পশ্চিমা জগতের পণ্ডিতবর্গ জ্ঞানের বিন্যাস ও আহরণ প্রক্রিয়াকে ইসলামী ধ্যান-ধারণা থেকে দূরে নিয়ে স্থাপন করেছেন। এসব কিছু ইসলামী চিন্তা চেতনার আলোকে পুনরায় সাজাতে হবে। এর মাঝেই জ্ঞানের ইসলামীকরণ ধারণাটি নিহিত।
অন্যভাবে বলতে গেলে ‘ইসলামী জ্ঞান তত্বের (Epistemology) আলোকে জ্ঞান হলো সেই সুনির্দিষ্ট ধারণা বা বোধ ও প্রত্যয়, যার মাধ্যমে আল্লাহ সম্পর্কে এবং তাঁর লক্ষ্য উদ্দেশ্যে ও নির্দেশনা সম্পর্কে দায়িত্বশীলতা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও দায়িত্ব পালনের বাস্তবতা সৃষ্টি হয়। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ এবং উভয়ের নির্দেশনাকে বুঝার ও সেই বুঝার ভিত্তিতে চলার সচেতনতা, অভিজ্ঞতার বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াই জ্ঞান। তাই এ দৃষ্টিকোণ থেকে ইহ-পারত্রিক, পারত্রিক ও সামাজিক জ্ঞান বিজ্ঞানকে ইসলামী ভাবধারায় বিন্যাস, বিচার-বিশ্লেষণ এবং গ্রহণ-বর্জন করার প্রক্রিয়া Process কে জ্ঞানের ইসলামীকরণ বুঝায়।
অবশ্য জ্ঞান ইসলামীকরণ বিষয়টিকে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও চিন্তাবিদ বিভিন্নভাবে বুঝাতে চেষ্ঠা করেছেন। নিম্নে কটি মন্তব্য উল্লেখ্য:
ড. ইসমাইল রাজী আল ফারুকী বলেন, জ্ঞান ইসলামীকরণ মানে জ্ঞানের নতুন সংজ্ঞা দিতে হবে এবং তথ্যাদিকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। তথ্যাদির কার্যকারণ ও সম্পর্ক নিয়ে পুনর্বার চিন্তাভাবনা করতে হবে, উপসংহারগুলোর পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে, উদ্দেশ্যের পুনর্বিন্যাস করতে হবে এবং তা এমনভাবে করতে হবে যাতে বিষয়গুলোর দর্শনকে সমৃদ্ধ করে এবং ইসলামের উদ্দেশ্য সাধিত হয়। এই লক্ষ্যে ইসলামের পদ্ধতিকরণ ক্যাটেগরিগুলোকে যথা-সত্যের ঐক্য, জ্ঞানের ঐক্য, মানবতার ঐক্য, জীবনের ঐক্য এবং সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য-মানুষের প্রতি সৃষ্টির আনুগত্য এবং সর্বোপরি আল্লাহর প্রতি মানুষের আনুগত্য-এ চিন্তাধারার আলোকে পাশ্চাত্য ধারণাগুলোকে অবশ্যই সংশোধন করতে হবে এবং বাস্তবতাকে উপলদ্ধি ও বিন্যস্ত করার সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। তদ্রুপ, পাশ্চাত্য মূল্যবোধের স্থলে ইসলামী মূল্যবোধকে পুন:স্থাপন করা উচিত এবং তদনুযায়ী প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদ্যার্জনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে।
ড. ইমাদুদ্দীন খলীল বলেন, The term `Islamization of knowledge’ means ( i.e. Discovering, compiling, piecing together, communicating and publishing) intellectual activity based on the islamic concept of the universe, life and man.
তিনি অন্য স্থানে আরো বলেন,
The Islamization of knowledge means involvement in intellectual pursuits, by examination, summarization, correlation, and publication, from the perspective of an Islamic outlook on life, humanity, and the Universe.4
ড. ত্বাহা জাবির আলওয়ানী জ্ঞান ইসলামীকরণের স্বরূপ সম্পর্কে অনেকগুলো মন্তব্য করেন। যেমন এক স্থানে তিনি বলেন, The Islamization of knowledge may be understood as a cultural and intellectual project aspiring to correct the processes of thinking within the Muslim mind so that it can produce islamic, social, and humanistic knowledge based on the two sources Muslims accept as the established source for knowing the truth: wahy ( divine revelation) and wujud (existence). In this endeavor, we shall use reason and the senses to help us acquire such knowledge that cannot be established on revelation and existence.
তিনি আরো বলেন, বস্তুত জ্ঞানের ইসলামীকরণ বলতে এক ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তা চেতনাগত পদ্ধতিভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে পরিচালিত কার্যক্রমের নাম। এটি মূলত একাধিক কার্যক্রমের সমষ্টি বিশেষ। যাতে জ্ঞানের ইসলামী উৎসের মূল্যায়নের আবেদন উপস্থাপন করা, জ্ঞানের বিন্যাস ও বিভাজনে ইসলামী ভাবধারা তথা তাওহীদ ভিত্তিক চেতনার প্রতিফলন করা, অমুসলিম সমাজে প্রচলিত উপকারী জ্ঞানের সাথে কুরআন সুন্নাহ কেন্দ্রিক জ্ঞানের সমন্বয়, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ইসলামের তত্ত্ব ও তথ্য সংযোজন করা, ইসলামী চিন্তাধারার আলোকে চিন্তনপদ্ধতি অনুসরণ করা, সমসাময়িক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ইসলামের আবেদন তুলে ধরা, নতুন নতুন সমস্যায় ইজতিহাদ করা ইত্যাদি কার্যসম্পাদন অন্তর্ভূক্ত থাকে।
এটি প্রাতিষ্ঠানিক বা শিক্ষা কারিকুলামের ক্ষেত্রে হতে পারে, আবার অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে জীবন চলার পথে বিভিন্ন দিকে গৃহীত চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রেও হতে পারে। এটি কোন বিলাসিতা নয় কিংবা কোন অসার সৌন্দর্যবর্ধক তথা কসমেটিক সংযোজন Cosmic Addition) নয় যে, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কিত এক দুটি কুরআনের আয়াত বা হাদীছ সংযোজন বা ইসলামী পরিভাষা ব্যবহার করলেই ইসলামী করণ হয়ে গেল! বরং জ্ঞানের ইসলামীকরণ বলতে প্রচলিত জ্ঞানতত্বের আমূল পরিবর্তন বুঝায়। জ্ঞানকে ইসলামের আলোকে নতুন করে বিন্যাস ও বিভাজন করতে হবে। যে সব কথার উপর তত্ত্ব ও বা সিদ্ধান্ত ও অনুসিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তা পুনর্মুল্যায়ন করতে হবে। মানব সমাজে অনুপ্রবেশকারী ভ্রান্ত জ্ঞানকে নিরূপিত করে সেখানে সত্য জ্ঞান তথা ইসলামী ভাবধারা প্রতিস্থাপন করতে হবে।