সুন্নাত ও বিদয়াত
মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম (র.)
প্রাথমিক কথা
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যে আদর্শ দুনিয়ার মানুষের সামনে উপস্থাপিত করেছেন, এক কথায় তা-ই সুন্নাত এবং তার বিপরীত যা কিছু তা বিদয়াত এর পর্যায়ে গণ্য। নবী করীম (সাঃ) এর তেইশ বছরের অবিশ্রান্ত সাধনা ও সংগ্রামের মাধ্যমে যে সমাজ গড়ে তুলেছিলেন, তাকে তিনি মুক্ত করেছিলেন সকলপ্রকার বিদয়াত ও জাহিলিয়াতের অক্টোপাশ থেকে এবং প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সুন্নাতের আলোকোদ্ভাসিত মহান আদর্শের উপর। বিশ্ব মানবতার পক্ষে এ ছিল মহা সৌভাগ্যের ব্যাপার।
উত্তরকালে নানা কারণে মুসলিম সমাজ সুন্নাতের আদর্শ হতে বিচ্যূত হয়ে পড়ে, তাদের আকীদা ও আমলে প্রবেশ করে অসংখ্য বিদয়াত। এমন দিনও দেখা যায়, যখন মুসলমানরা সুন্নাত ও বিদয়াতের সংমিশ্রণে এক জগাখিচুড়ী বিধানকেই ইসলামী আদর্শ বলে মনে করতে ও অনুসরণ করতে শুরু করে। ফলে তাদের জীবনে আসে সার্বিক ভাঙন ও বিপর্যয়। বর্তমান সময় সে বিপর্যস্ত পরিবেশ ও পরিস্থিতিই গ্রাস করেছে সমগ্র বিশ্বমুসলিমকে।
কিন্তু এ অবস্থা বাঞ্চনীয় নয় মুসলমানদের জন্য। কারো পক্ষেই কাম্য হতে পারেনা এ আদর্শের বিচ্যূতি। এজন্য আজ নতুন করে লোকদের সামনে ইসলামী আদর্শবাদের ব্যাপক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ অপরিহার্য্য, যেন মুসলমানদের মনে চেতনা জেগে উঠে, উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে তাদের অবস্থার পরিবর্তনের পুনর্জাগরণের এবং নতুন করে আদর্শবাদী হয়ে উঠার এক উদগ্র বাসনা। এ পর্যায়ে আমার ক্ষুদ্র লেখনী-শক্তি যতোটুকু কাজ করেছে, তার মধ্যে বর্তমান গ্রন্থ একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সুন্নাত ও বিদয়াতের মৌলিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ এবং আকীদা বিশ্বাসে, জীবনে ও সমাজে কোথায় কোথায় সুন্নাত থেকে বিচ্যূতি আর বিদয়াতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে তা স্পষ্ট করে তুলে ধরাই আমার এ গ্রন্থ রচনার মূলে একমাত্র উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্য কতখানি সফল হয়েছে কিংবা আদৌ তা সাফল্যের দাবি করতে পারি কিনা পাঠকবর্গ-ই তা বিবেচনা করবেন। আমার বক্তব্য শুধু এতটুকু যে, যা কিছু লিখেছি গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করে বুঝে শুনে লিখেছি, সঠিক কথা সুস্পষ্টভাবে পেশ করার জন্যই লিখেছি, লিখেছি কুরআন-হাদীস, ফিকাহ ও সর্বজনমান্য মনীষীদের মতামতের ভিত্তিতে। এ বইয়ে আলোচিত মতামতের জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি-ই দায়ী এবং যদি কাউকে দায়ী করতে হয় সেজন্য কেবল আমাকেই দায়ী করা যেতে পারে, অন্য কাউকে নয়। এ আলোচনায় আমি কোন ভুল করে থাকলে, কারো দোহাই দিয়ে নয়, কুরআন-হাদীসের ভিত্তিতেই আমার ভুল ধরিয়ে দেয়া যেতে পারে। এ ধরণের যে কোনো ভুলের সংশোধন করে নিতে আমি সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত।
এতদসত্ত্বেও আমার এ প্রচেষ্টা যদি আদর্শকে সমুজ্জল করে তোলবার এবং বিদয়াতের অন্ধকার বিদূরণে সামান্য কাজও করতে সক্ষম হয় তাহলে আমার শ্রম সার্থক মনে করবো এবং তাকে পরকালে আল্লাহর নিকট মুক্তিলাভের অসীলারূপে মনে করে তাঁর শোকরিয়া আদায় করবো।
মুহাম্মাদ আবদুর রহীম
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা
আমার লিখিত ‘সুন্নাত ও বিদয়াত’ গ্রন্থখানি ১৯৬৭ সনের সেপ্টেম্বর মাসে সর্ব প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। অতঃপর অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর সমস্ত কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। গ্রন্থখানি যে বিদগ্ধ সমাজের নিকট সমাদৃত হয়েছে এবং চিন্তার জগতে তা যে বিশেষ আলোড়নের সৃষ্টি করেছে, তা তখনই স্পষ্ট বুঝতে পারা গিয়েছিল। বস্তুত আমাদের সমাজে যুগ যুগ ধরে সিঞ্চিত ও পুঞ্জীভূত বিদয়াতের উপর এ গ্রন্থখানি এক প্রচন্ড আঘাত হেনেছিল এবং বিদয়াতের পূজীরী ও বিদয়াত আশ্রিত গোষ্ঠী এ আঘাতে হতচকিত ও ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়েছিল। চারদিকে ‘গেল গেল’ রব ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল। চলমান বিদয়াতের এটা ছিল আমার একটা চ্যালেঞ্জ।স্বভাবতই আমি আশা করেছিলাম, বিদয়াত পন্থীদের পক্ষ হতে এর প্রতিবাদ হয়তো আসবে।
কিন্তু কার্যত দেখা গেল, এ গ্রন্থের অকাট্য শাণিত ও অমোঘ আঘাতের জবাবে বিদয়াত পন্থীদের নিকট বলার মতো কোন কথা নেই। যদিও তারা আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করতে ত্রুটি করেনি। অতঃপর সংশ্লিষ্ট মহলসমূহ নীরবতা অবলম্বন ছাড়া আর কোন পথ খুঁজে পায়নি। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছি এ দেখে যে, আমি পর্বত সমান বিদয়াতের বিরুদ্ধে যে কথা বলেছি, কোন অকাট্য দলীল দ্বারা তা রদ করার সাধ্য কোন মহলেরই নেই। আমি মহান আল্লাহর শোকর আদায় করছি এ জন্য যে, এ কালের পুঞ্জীভূত বিদয়াতের বিরুদ্ধে হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর সুন্নাত আদায় করা এবং ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও মুজাদ্দিদে আলফেসানী (র)-র আদর্শ অনুসরণের কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভবপর হয়েছে তা যত সামান্য ও যত ক্ষুদ্রই হোকনা কেন।
এই প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আমি পীর-মুরীদী ব্যবস্থাকে ‘সুন্নাত’ বিরোধী ও বিদয়াত প্রমাণ করেছি, কিন্তু এদেশে আলিম ও পীরসাহেবান আবহমানকাল ধরে ইসলামের যে বিরাট খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন, এ দেশে এখনো যে দ্বীন ইসলামের নাম নিশানা রয়েছে তার পেছনে তাঁদের যে অপরিসীম অবদান রয়েছে, আমি তা অবশ্যই স্বীকার করেছি।
বিগত প্রায় দশটি বছর যাবত গ্রন্থটি পূর্ণমুদ্রণ সম্ভবপর হয়নি কোনো দুঃসাহসী প্রকাশক পাওয়া যায়নি বলে। বর্তমানে জনাব মোঃ আতাউর রহমান কর্তৃক তা নতুনভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এতে অনেক কয়টি নতুন বিষয় সংযোজিত হয়েছে এবং প্রথম সংস্করণের অনেক কথা অধিকতর বলিষ্ঠ ও যুক্তিসহ পুনর্লিখিত হয়েছে। তত্ত্ব ও তথ্যের তুলনায় পূর্বের তুলনায় যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়েছে এ সংস্করণটি।
তাই সহজেই আশা করতে পারি, প্রথম সংস্করণের তুলনায় এই সংস্করণ বিদগ্ধ পাঠক সমাজের নিকট অনেক বেশি সমাদৃত হবে। নতুন করে গ্রন্থখানি পাঠক সমাজের নিকট উপস্থাপিত করতে পারলাম দেখে মহান আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি।
মুহাম্মদ আবদুর রহীম