মৃত লোকদের নিকট সাহায্য চাওয়া বিদয়াত
যারা মরে গেছে-তাঁরা অলী-ই হোন, আর নবী-ই হউন তাদের নিকট জীবিত লোকদের কোনোরূপ সাহায্য প্রার্থনা করা- বিদয়াতীদের ভাষায় যাদের বলা হয় ইস্তেমদাদে রূহানী-সুস্পষ্ট বিদয়াত।
প্রকৃতপক্ষে সাহায্য বা ক্ষতি কোনো কিছু করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই নেই। এজন্যই কুরআন মজীদে আল্লাহ তা‘আলা কেবল তাঁরই নিকট সাহায্য চাওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন নানাভাবে। সূরায়ে ফাতিহা যা মূলত একটি দোয়ারই সূরা, তাতে বন্দেগী যেমন একমাত্র আল্লাহরই করার কখা বলা হয়েছে, তেমনি সাহায্যও একমাত্র আল্লাহরই কাছে চাইতে শেখান হয়েছে। বলা হয়েছেঃ আরবী(*********)
-হে আল্লাহ! আমরা কেবল তোমারই বন্দেগী করি, কেবল তোমারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি।
এ আয়াত যেমন বন্দেগী, দাসত্ব ও আইন পালনকে কেবলমাত্র আল্লাহর সাথে খাস করে দেয়ার নির্দেশ দেয়, তেমনি যাবতীয় বিষয়ে ও ব্যাপারে সব রকমের সাহায্য প্রার্থনাও কেবল আল্লাহরই নিকট করা যেতে পারে কিংবা করা উচিত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ইমাম রাযীর ভাষায়- হে আল্লাহ, আর কারো নিকটই আমি কোনো প্রকারের সাহায্য চাইনা। কেননা তুমি ছাড়া আর যার কাছেই সাহায্য চাইব, তার পক্ষে আমার কোনোরূপ সাহায্য করা আদৌ সম্ভব নয়-তোমার সাহায্য ছাড়া। তাহলে তোমার সাহায্য ছাড়া অপর কারো পক্ষেই আমার কোনোরূপ সাহায্য করা যখন আদৌ সম্ভব নয়, তখন আমি তোমাকে ছাড়া অপর কারো নিকট সাহায্যই চাইবোই বা কেন? মাঝখানের এই মধ্যস্থতা মেনে নেয়ার এবং তোমাকে বাদ দিয়ে তার নিকট ধর্ণা দেয়ার কিই বা দরকার থাকতে পারে?
তাছাড়া নবী করীম(স) এর বাণী এ পর্যায়ে আমাদের যে পথ নির্দেশ করে তাওতো এই যে, সাহায্য কেবল আল্লাহরই নিকট চাইতে হবে। অন্য কারো নিকট নয়। নবী করীম(স) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রা) কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-
তুমি যদি কোনো প্রার্থনা করতে চাও তো, আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করো। আর যদি তুমি কোনো সাহায্যই চাও, তাহলে সাহায্য চাইবে আল্লাহর নিকট।
আর আসল ব্যাপারই যখন এই, তখন যাবতীয় ব্যাপারে কেবল আল্লাহরই নিকট সাহায্য চাওয়া কর্তব্য। অপর কারো নিকট সাহায্য চাওয়াতো চরম বোকামী; চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতা, নীচতা ও হীনতা।
বিশেষ করে মরে যাওয়া লোকদের নিকট সাহায্য চাওয়াতো আরো বেশি মারাত্মক। দুনিয়ায় জীবিত থাকা অবস্থায় বৈষয়িক বিষয়ে সাহায্য চাওয়ার তো একটা মূল্য আছে। আছে বৈষয়িক তাৎপর্য্, তা নিষিদ্ধও নয়; কিন্তু মরে যাওয়া লোকদের নিকট সাহায্য চাওয়ার কি অর্থ হতে পারে। কবরস্থ লোকেরা কি দুনিয়ার লোকদের ফরিয়াদ শুনতে পায়, শুনতে পেলেও তাদের কিছু করার ক্ষমতা আছে কি? তারা যে শুনতে পায়না, তাতো কুরআনের ঘোষণা থেকেই প্রমাণিত। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে বলেছেনঃ আরবী(******)
-তুমি মরে যাওয়া লোকদের কোনো কথা শোনাতে পারবেনা।
অন্যত্র বলেছেনঃ আরবী(********)
-নিশ্চয়ই তুমি হে নবী! মরে যাওয়া লোকদের কোনো কথা শোনাতে পারবেনা।
মরে যাওয়া লোকদের সম্পর্কে যদি এই ধারণা হয় যে, তারা মরে যাওয়ার পর এতদূর ক্ষমতাশালী থাকে যে, সেখানেও তারা যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে; আর এসব কিছুই করতে পারে অলৌকিকভাবে; তাহলে এতে তাকে আল্লাহর সমতুল্য-আল্লাহর সমান-ক্ষমতাশালী হওয়ার ধারণা করার শামিল। আর এ ধারণা যে শিরক তাতে আর কোনো সন্দেহ থাকতে পারেনা।
ইমাম বগভী লিখেছেনঃ সাহায্য প্রার্থনাতো এক প্রকারের ইবাদত। ইবাদত বলা হয় বিনয় ও হীনতা জ্ঞান সহকারে করাকে। আর বান্দাকে বান্দা বলাই হয় আল্লাহর মুকাবিলায় তার এই বিনয়, বাধ্যতা ও হীনতার কারণে।
-যে লোক নবী রাসূল ও নেককার লোকদের কবর যিয়ারত করতে গিয়ে তাদের কবরে গিয়ে নামায পড়বে এবং সেখানে বসে দো’আ করবে, কবরস্থ লোকদের কাছে নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রার্থনা করবে-মুসলিম আলিমদের মধ্যে কারো মতেই এ কাজ আদৌ জায়েয নয়। কেননা ইবাদত, প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রার্থনা এবং সাহায্য চাওয়া এসব এক আল্লাহরই হক (কেবল তাঁরই নিকট চাওয়া যেতে পারে, অন্য কারো নিকট নয়)।
নবী করীম(স)এর এ পর্যায়েরই এক দীর্ঘ হাদীসের শেষাংশে বলা হয়েছেঃ আরবী(*******)
-জেনে রাখো, সমস্ত মানুষও যদি একত্রিত হয়ে তোমার কোনো উপকার করতে চায়, তবে তারা তা করতে পারবেনা ততটুকু ছাড়া, যা আল্লাহ নির্দিষ্ট করে তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। অনুরূপভাবে সমস্ত মানুষও যদি তোমার একবিন্দু ক্ষতি করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়, তবুও তারা কিছুই করতে পারবেনা কেবল ততটুকুই ছাড়া, যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। বস্তুত কলমতো তুলে নেয়া হয়েছে, কাগজের কালিও শুকিয়ে গেছে।
অর্থাৎ আল্লাহর বিধান মতো যা হওয়ার তা হবেই এবং শুধু তা-ই হবে, অন্য কিছু হবেনা, হতে পারেনা। কারো তেমন কিছু করার একবিন্দু ক্ষমতা নেই। কাজেই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট-সে মৃত নবী রাসূল আর অলী পীর গাওস কুতুব-ই হোকনা কেন- কোনো কিছু চাওয়ার কোনো অর্থই হতে পারেনা। বরং তা হবে সুস্পষ্ট শিরক-শিরক এর বিদয়াত।
মক্কা শরীফের মুফতী আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ মীর গনী আল হানাফীর নিকট নিম্নোক্ত বিষয়ে ফতোয়া চাওয়া হয়ঃ
মরে যাওয়া লোকদের নিকট মান সম্মান লাভ, রিযিকের প্রাচূর্য্ ও সন্তান লাভেল জন্য জীবিত লোকদের সাহায্য চাওয়া সম্পর্কে আলিম সমাজের কি বক্তব্য? কবরস্থানে গিয়ে এ কথা বলাঃ ‘হে কবরস্থ লোকেরা, তোমরা আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট দো’আ করো; আমাদের গরিবী দূর করার, রিযিকের প্রাচূর্য্, বেশি সন্তান হওয়া, আমাদের রোগীদের নিরাময়তা এবং উভয় জগতে আমাদের কল্যাণ হওয়ার জন্য। কেননা তোমরা ‘সলফে সালেহীন’, তোমাদের দো’আ আল্লাহর নিকট কবুল হয়।” মৃত ব্যক্তিদের নিকট এরূপভাবে সাহায্য চাওয়া কি জায়েয? কুরআন, সুন্নাহ ও মুজতাহিদদের মতের ভিত্তিতে এর জবাব দিন।
জবাবে মুফতি সাহেব যে ফতোয়া দেন, তার সারকথা হলোঃ নবী অলীদের নিকট ফরিয়াদ করা যায়; কিন্তু প্রশ্নের উল্লেখিত বিষয় ও স্থানে তা করা শরীয়তে বিধিবদ্ধ নয়। এই ফতোয়ায় তদানীন্তন বহু সংখ্যক আলেম সম্মতিসূচক স্বাক্ষর দেন।
মাওলানা রশীদ আহমদ গংগুহী(রহ) অপর এক প্রশ্নের জওয়াবে লিখেছেনঃ শায়খ আবদুল কাদের জিলানী(রহ) গায়েব জানেন এবং স্বতন্ত্র ও স্বশক্তিতে দুনিয়ার ওপর তাশাররূফ(ক্ষমতা প্রয়োগ)করতে পারেন বলে বিশ্বাস করলে সুস্পষ্ট শিরক হবে। এ পর্যায়ে তিনি প্রথমত উল্লেখ করেছেন কুরআনের আয়াত। আরবী(******)
-গায়েব জগতের চাবিসমূহ আল্লাহরই হাতে নিবদ্ধ, তা তিনি ছাড়া আর কেউ জানেননা।
পরে বাজ্জাজীয়া প্রভৃতি ফতোয়ার কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেনঃ
মাশায়িখ-তথা পীর বুযুর্গদের রূহ হাযির হয় এবং তারা সব কিছু জানে বলে যে বিশ্বাস করবে সে কাফির হয়ে যাবে।
উক্ত কিতাবে এ কথাও লিখিত হয়েছে-যে ব্যক্তি মনে করে মৃত ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া নিজেই যাবতীয় বিষয়ে ও ব্যাপারে কর্তৃত্ব চালায়, আর এরূপ আকীদা ও বিশ্বাস যার হবে, সে কাফির হয়ে যাবে। (বাহরুর রায়েখ গ্রন্থেও এমন উল্লেখ রয়েছে, মিয়াত মাসায়েল গ্রন্থ)।
মওলানা শাহ মুহাম্মদ ইসহাকের ছাত্র মওলানা নওয়াব কুতুবুদ্দীন খান কবরস্থ লোকদের নিকট সাহায্য চাওয়া জায়েয কিনা এমন এরূপ এক প্রশ্নের জবাবে লিখেছেনঃ
-কবরস্থ লোকদের নিকট সাহায্য চাওয়া, তা যে প্রকারেরই হোকনা কেন জায়েয নয়। শায়খ আবদুল হক মিশকাতের আরবী শরাহ এ লিখেছেনঃ নবী ও আম্বিায়া ছাড়া কবরস্থ অন্য লোকদের নিকট কোনোরূপ সাহায্য চাওয়া-ইস্তেমদাদে রূহানী করা-বহুসংখ্যক ফকীহ নাজায়েয বলেছেন। তাতা বলেছেনঃ মৃতদের জন্য দো’আ করা, তাদের জন্যে আল্লাহর নিকট মাগফেরাত চাওয়া, দো’আ ও কুরআন তিলাওয়াত করে তাদের কোনোরূপ ফায়দা পৌছানো ছাড়া কবর যিয়ারতে আর কোনো কিছুই করণীয় নেই।
এ পর্যায়ে একটি ধোঁকা হচ্ছে এই যে, আল্লাহর নামে আল্লাহর ওয়াস্তে কোনো অলীর রূহের নিকট কিছু প্রার্থনা করাকে জায়েয মনে করা হচ্ছে এবং এতে কোনো দোষ আছে বলে মনে করা হচ্ছেনা। মনে করা হচ্ছে যে, তাকে শুধু অসীলা হিসেবেই গ্রহণ করা হচ্ছে আর এরূপ অসীলা গ্রহণে কোনো দোষ নেই।
কিন্তু এ বাস্তবিকই একটি ধোঁকা যার ফলে অনেক নিষ্ঠাবান তওহীদবাদী মুসলমানও অজ্ঞাতসারে পরিষ্কার শিরক এর মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কোনো কিছু প্রার্থনা করার সময় আল্লাহ ছাড়া আর কারো নাম করা হলে হয় তার অর্থ এই হবে যে, আসলে চাওয়া হচ্ছে অন্য ব্যক্তির নিকট- আল্লাহর নিকট চাইলে আল্লাহ তা দিবেন কিনা কিংবা শুধু আল্লাহর তা দেয়ার ক্ষমতা আছে কিনা। আর এ দু’টো দিক দিয়েই ব্যাপারটি পুরো শিরক এর মধ্যে গণ্য হয়ে যায়।
শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী এ পর্যায়ে লিখেছেনঃ
-শিরক হওয়ার ধারণা হয় যে সব ক্ষেত্রে, তার মধ্যে এ ও একটি যে, লোকেরা আল্লাহ ছাড়া অপরের নিকট রোগীর রোগ সারা ও গরীবকে ধন দেয়া প্রভৃতি প্রয়োজন পূরণের জন্য দো’আ করে, তাদের জন্য মানত মানে, এসব মানত হতে নিজেদের কামনা পূরণ হওয়ার আশা পোষণ করে তাদের নামে তিলাওয়াত করে বরকত লাভের আশায়। এ জন্যে আল্লাহ লোকদের ওপর ওয়াযিব করে দিয়েছেন যে, তারা নামাযে বলবেঃ “হে আল্লাহ! আমরা কেবল তোমারই বন্দেগী করি, কেবল তোমারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি।” আল্লাহ আরো বলেছেনঃ আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেই ডাকবেনা। এ ডাকা নিষিদ্ধ হওয়ার অর্থ শুধু ইবাদত করা থেকে নিষিদ্ধ নয়-যা কোনো কোনো তাফসীরকারক মনে করেন। বরং এর অর্থ হচ্ছে অন্য কারো নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা নিষেধ।
কেননা আল্লাহ অপর আয়াতে বলেছেনঃ “কেবল আল্লাহকেই ডাকবে। ফলে তোমরা যা চাও, তিনি তা তোমাদের জন্য খুলে দিবেন।”
মিথ্যা প্রচারের বাতুলতা
কবর পূজা ও রূহানী ইস্তিমদাদে বিশ্বাসী লোকেরা তাদের মতের সমর্থনে একটি কথাকে দলীল হিসেবে পেশ করে। কথাটি এইঃ আরবী(******)
-তোমরা যখন দুনিয়ার কাজ কর্মে খুব কাতর ও দিশেহারা হয়ে পড়বে, তখন তোমরা কবরবাসীদের নিকট সাহায্য চাইবে।
এ কথাটিকে তারা হাদীস হিসেবে চালিয়ে দেয়। আসলে এটা হাদীস নয়, এটাকে হাদীস বলা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। বিশেষজ্ঞগণ এ কথাটি সম্পর্কে লিখেছেনঃ বিশেষজ্ঞগণ সম্পূর্ণ একমত হয়ে বলেছেন যে, এ কথাটি সম্পূর্ণ মনগড়া, মিথ্যা।
আর শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী এ কথাটি সম্পর্কে লিখেছেনঃ হাদীস বলে চালানো এ কথাটি মুজাবির(পেশকার খাদেমদের)নিজেদের মনগড়া কথা। তারা নযর-নিয়াজ লাভের উদ্দেশ্যে নিজেদের এ কথাটি মিথ্যামিথ্যি নবী করীমের নামে চালিয়ে দিয়েছে।
আসলে এ কথাটি কোনো হাদীসই নয়। মুহাদ্দিস এবং মূহাক্কিক সূফীগণও একে মনগড়া ও রচিত কথা বলে ঘোষণা করেছেন। বস্তুত আকীদার ব্যাপারে এ রকম বানানো কথাকে দলীল হিসেবে পেশ করার কারণ হলো চরম অজ্ঞতা ও মূর্খতা।
সূরা আল বাকারার আয়াতঃ فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَندَادًا وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ
এর তাফসীরে শাহ আবদুল আযীয(রহ) বিভিন্ন রকম ও প্রকারের ‘প্রতিদ্বন্ধীর’ উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে চতূর্থ রকম হলো কবর পূজারীদের বানানো প্রতিদ্বন্ধী। তাদের সম্পর্কে এখানে লিখেছেনঃ পীর পুজারী লোকেরা বলেঃ বুযুর্গ লোকেরা খুব বেশি বেশি রিয়াজত ও সাধনা মুজাহিদা করে বলে তাদের দো’আ ও সুপারিশ আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয় বিধায় এ দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর তাদের রূহে অসীম শক্তি ও বিশালতার সৃষ্টি হয়। তাদের শেকেল-সুরতকে যদি বরজাখ বানান্ হয় কিংবা তার বৈঠকখানায় ও কবরস্থানে আজিজী ইনকেসারীর সাথে সেজদা করা হয়, তাহলে তাদের রূহ জ্ঞানের বিশালতার কারণে তা জানতে পারে এবং দুনিয়া আখিরাতে সিজদাকারীর কল্যাণের জন্য তারা সুপারিশ করে। (নাউজুবিল্লাহ)।
এ থেকে বোঝা গেল, এ ধরনের ইস্তিমদাদ ও কবরপূজাকে শাহ আবদুল আজীজ(রহ) সুস্পষ্টরূপে আল্লাহর প্রতিদ্বন্ধী গ্রহণ করা মনে করেন। আর এ গ্রহণ করাই হলো শিরক-যা কুরআনে সুস্পষ্ট নিষিদ্ধ।
আল্লাহ ও বান্দার মাঝে এ ধরনের অসীলা ধরা ও সুপারিশ হাসিল করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে যদি কেউ মনে করেন, তবে সে আল্লাহর সম্পর্কে বদনামী করেছে। আল্লামা ইবনে কাইয়্যেম লিখেছেনঃ যে মনে করবে যে, আল্লাহর সন্তান আছে কিংবা তাঁর কোনো শরীক আছে বা তাঁর অনুমতি ছাড়াই কেউ তাঁর নিকট শাফায়াত করতে পারে অথবা সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে এমন কোনো মাধ্যম রয়েছে, যা সৃষ্টির প্রয়োজনের কথা আল্লাহর নিকট পেশ করে কিংবা আল্লাহ ছাড়া এমন কতক অলী-আল্লাহও রয়েছে, যারা আল্লাহ ও সেই লোকদের মাঝে অসীলা ও নৈকট্যের কাজ করবে এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্যে তাদের নিকট তারা দো’আ করে, তাদের ভয় করে চলে, আর তাদের কাছ থেকে অনেক কিছুর আশা করে- এই যার আকীদা হবে, সে তো আল্লাহ সম্পর্কে অত্যন্ত জঘন্য ও খারাপ ধারণা পোষণ করলো।
কাজী সানাউল্লাহ পানিপত্তী(র) হানাফী মাযহাবের বড় আলিম এবং তাসাউফপন্থী মনীষী ছিলেন। কুরআন-হাদীসে গভীর পান্ডিত্য থাকার কারণে তিনি সর্বমহলেই সম্মানার্হ ও শ্রদ্ধেয় ছিলেন। তিনি কুরআনের আয়াতঃ إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ عِبَادٌ أَمْثَالُكُمْ ۖ
–তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে আর যাদের ডাকো, তারা তো তোমাদের মতোই দাসানুদাস মাত্র।
এ সম্পর্কে লিখেছেন-এ আয়াত বিশেষভাবে কেবলমাত্র মূর্তি পূজারীদের জন্য নয়, বরং
مِن دُونِ اللَّهِ আল্লাহ ছাড়া সাধারণভাবে আর যে কেউ-ই হোকনা কেন, সে-ই এর মধ্যে শামিল এবং তাকে ডাকলেই সুস্পষ্ট শিরক হবে। কেননা ওদের যে ডাকা হচ্ছে, মানুষের কোনো একটি প্রয়োজন পূরণ করার ওদের কি ক্ষমতা আছে? কেউ যদি বলে যে, এ আয়াত কাফিরদের জন্য প্রযোজ্য, কেননা তারাই মূর্তিগুলোকে স্মরণ করে থাকে, তা হলে বলবো
دُونِ اللَّهِ শব্দটি সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত কোনো বিশেষ জিনিস যে বোঝায়না, তা-ই একথা স্বীকৃতব্য নয়।
বস্তুত কুরআন ও হাদীস থেকে মুশরিকী আকীদা ও আমলের অনুকূলে দলীল পেশ করা বড়ই আশ্চর্যের বিষয়। আরও আশ্চর্যের বিষয় যে সব মনীষী আজীবন শিরক বিদয়াতের বিরুদ্ধে কলম চালিয়েছেন, বাস্তবভাবে অভিযান চালিয়েছে, তাঁদেরই কোনো কোনো কথা পূর্বাপর সম্পর্ক ছিন্ন করে শিরক বিদয়াতের সমর্থনে চালিয়ে দিতে চেষ্টা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তাঁদের এই ধোঁকাবাজি অভিজ্ঞ মহলে ধরা পড়ে যেতে পারে- এতটুকু ভয়ও এই বিদয়াতপন্থী ও বিদয়াত প্রচারকদের মনে জাগেনা। মনে হয়, বিদয়াত ছাড়া তাদের মন মগজে আর কিছু নেই। বিদয়াতেই তাদের রুচি, বিদয়াতই তাদের পেশা যেমন এক শ্রেণীর পোকার রুচি কেবল ময়লা ও আবর্জনায়! আল্লাহ এদের হেদায়াত করুন।
কুরআনের আয়াত দিয়ে ধোঁকাবাজি
আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সাহায্য চাওয়া জায়েয নয়; বরং তা শিরক। পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে তা কুরআন হাদীস ও ফিকাহর অকাট্য দলীলের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এই আলোচনার শেষ ভাগে পীর পোরস্ত আলিমদের তিনটি দলীল সম্পর্কে সংক্ষেপে দুটি কথা না বললে ভুল অপনোদন এবং বাতিলের প্রতিবাদ সম্পূর্ণ হবেনা।
উক্ত আলিম সাহেবদের আল্লাহ ছাড়া অন্য শক্তির নিকট-জীবিত বা মৃত অলী-আল্লাহর নিকট ইস্তেমদাদ ও সাহায্য চাওয়া জায়েয। আর তা প্রমাণের জন্য তারা কুরআন মজীদ থেকে তিনটি আয়াত পেশ করে থাকেন। প্রথম আয়াত হলো সূরা ছফ এর।
مَنْ أَنصَارِي إِلَى اللَّهِ ۖ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ نَحْنُ أَنصَارُ اللَّهِ ۖ
-হযরত ঈসা (আ) বললেনঃ আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে আমার সহায়ক কে হবে? শিষ্যগণ বললো-আমরাই আল্লাহর কাজে আপনার সহায়ক। (আছ ছফঃ১৪)
আর দ্বিতীয় আয়াতটি হলো সূরা আল কাহাফ এর।
قَالَ مَا مَكَّنِّي فِيهِ رَبِّي خَيْرٌ فَأَعِينُونِي بِقُوَّةٍ أَجْعَلْ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ رَدْمًا [١٨:٩٥]
-তোমাদের আর্থিক সাহায্য দেয়ার জরুরত নেই, কেননা আমার প্রভু আমাকে যে ধন সম্পদ দান করেছেন তা-ই যথেষ্ট; তবে তোমরা আমাকে দৈহিক সাহায্য করতে পার। তাহলে আমি তোমাদের ও তাদের মাঝে এক দৃঢ় প্রাচীর নির্মাণ করে দেবো।(আল কাহাফঃ৯৫)
আর তৃতীয় আয়াত হলো সূরা ইউসুফ এর। আয়াতটি এইঃ
اذْكُرْنِي عِندَ رَبِّكَ فَأَنسَاهُ الشَّيْطَانُ ذِكْرَ رَبِّهِ فَلَبِثَ فِي السِّجْنِ بِضْعَ سِنِينَ [١٢:٤٢]
–তোমার প্রভুর(আজিজ মিসর) নিকট আমার কথা উল্লেখ করবে। কিন্তু শয়তান তাকে তার প্রভুর নিকট তার কথার উল্লেখ করতে ভুলিয়ে দিলো। ফলে ইউসুফ(আ)আরও কয়েক বৎসর কারাগারেই রইলো।
এই তিনটি আয়াত পেশ করে পীর-পোরস্ত আলিম নামধারী লোকেরা বলতে চান যে, যেভাবে হযরত ঈসা(আ)হাওয়ারী লোকদের নিকট সাহায্য চেয়েছিলেন, যেভাবে জুলকারনাইন জনগণের কাছে বলেছিলেন বাঁধ বাধার ব্যাপারে তোমরা শক্তি দিয়ে আমাকে সাহায্য করো এবং যেভাবে হযরত ইউসুফ(আ) কারাগার থেকে মুক্তিলাভের জন্য মুক্তিপ্রাপ্ত সাথীকে বাদশাহর নিকট সুপারিশ করতে বলেছিলেন, অনুরূপভাবে কোনো বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে কিংবা বৈষয়িক মুক্তি লাভের আশায় যে কোনো জীবিত বা মৃত অলী আল্লাহর নিকট দো’আ প্রার্থনা করা যায় তা সম্পূর্ণ জায়েয। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে কথাটি প্রমাণ করার জন্য কুরআন মজীদের উক্ত তিনটি আয়াত পেশ করা হয়, তা এর কোনো একটি আয়াত থেকেও প্রমাণিত হয়না। প্রত্যেকটি আয়াতকে ভিত্তি করে বিচার বিবেচনা করলেই আমার এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হবে। মনে রাখা আবশ্যক যে, আলোচনা হচ্ছে ‘ইস্তেমদাদে রূহানী’ ‘আধ্যাত্মিক উপায়ে সাহায্য পাওয়ার জন্য কারো নিকট দো’আ করা’ সম্পর্কে। আহলে সুন্নাত আল জামা’আতের আকীদা হলো এই যে, এ ধরনের সাহায্য প্রার্থনা একমাত্র আল্লাহরই নিকট করা যেতে পারে। কেননা এ ধরনের সাহায্য দানের ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই-থাকতে পারেনা। আর আল্লাহ তা’আলার সুস্পষ্ট নির্দেশ এই যে, এ ধরনের অবস্থায় কেবল আল্লাহর নিকট সাহায্য চাইতে হবে। তওহীদী আকীদাও তাই। অন্য কারো নিকট সাহায্য চাইলে তা আকীদার দিক দিয়ে হবে শিরক এবং তওহীদী আকীদায় তাই হবে বিদয়াত। এ প্রেক্ষিতে আয়াত তিনটি যাচাই করলে দেখা যাবে যে, এর কোনোটিতেই এ পর্যায়ের সাহায্য চাওয়ার কথা নেই। সূরা ছফ এর প্রথমোক্ত আয়াতে হযরত ঈসা(আ) এর যে সাহায্য চাওয়ার কথা বলা হয়েছে ‘আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে আমার সহায়ক কে হবে?’ এ কথা বলে, সে সাহায্য তো কোনো ব্যক্তির বিপদে পড়ে চাওয়া সাহায্য নয়। হযরত ঈসা(আ) কোনো বিপদে পড়ে হাওয়াকারীদের সাহায্য চাননি। সাহায্য চাননি নিজের কোনো কাজের ব্যাপারে। কোনো আধ্যাত্মিক উপায়ে সাহায্য করার জন্যে ফরিয়াদ করা হয়নি এখানে। কুরআনের আয়াত مَنْ أَنصَارِي إِلَى اللَّهِ‘আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে কে আমার সহায়ক হবে’ কথাটিই প্রমাণ করে সে সাহায্য চাওয়ার মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহর দ্বীন প্রচার ও কায়েম করার ব্যাপারে কাজ করার জন্য এগিয়ে আসতে তাদের আহবান জানানো হয়েছে মাত্র। কেননা দ্বীন কায়েমের জন্য চেষ্টা করা কেবলমাত্র ঈসা(আ) এরই দায়িত্ব ছিলনা, অন্য সব মুসলমানেরও দায়িত্ব ছিল। আয়াতটির সূচনাইতো হয়েছে আল্লাহর সাহায্যকারী হওয়ার নির্দেশ দিয়ে।
বলা হয়েছেঃ হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হও।
এখন বাস্তবভাবে আল্লাহর সাহায্য কাজে আহবান করাতো নবীরই দায়িত্ব। হযরত ঈসা(আ) তো সে দায়িত্বই পালন করেছেন এই সাহায্য চেয়ে। এ কারণেই আল্লামা আলূসী সহ সব মু’তাবার তাফসীরেই এই আয়াতের তাফসীর করা হয়েছে এভাবেঃ
অর্থাৎ আল্লাহর সাহায্যের উদ্দেশ্য নিয়ে কে আমার সৈন্য হতে রাজি আছে? এতো কোনো আধ্যাত্মিক উপায়ে সাহায্য করতে বলার কথা নয়। এ তো হচ্ছে নবীর নব্যুয়তী দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে সাহায্য করার আহবান। এ কাজ নবীর নিজের কোনো কাজ নয়। এ হচ্ছে সোজাসুজি ও সরাসরি আল্লাহর সাহায্যের কাজ। এর বড় প্রমাণ রয়েছে খোদ কুরআনের এ সূরাতেই উল্লিখিত তাদের জবাবে।তারা অগ্রসর হয়ে এসেছে ঈসা(আ) এর সাহায্যে নয়, আল্লাহর সাহায্য করার কাজে। তাই তারা বলেছেন- نَحْنُ أَنصَارُ اللَّهِ–আমরাই আল্লাহর সাহায্যকারী।আল্লামা আলুসী এখানেই লিখেছেনঃ আমার সাহায্য বলার মানে দুই শরীকের কাজকে একজনের পক্ষে অপরজনের কাজ বলা। আর যখন, এরা দুপক্ষই সমানভাবে আল্লাহর সাহায্য কাজে শরীক হয়েছে, তখন উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হলো এবং এ কথা বলাকে সহীহ সাব্যস্ত করে দিলো।
অতএব স্পষ্ট হয়ে গেল যে, হযরত ঈসা(আ) কোনো অলৌকিক কাজ করার ব্যাপারে কোনো মৃত ব্যক্তির নিকট সাহায্য চাননি। তাঁর কথার সার হলোঃ বাঁধ বাঁধতে হবে, টাকা পয়সা আমার আছে। তোমরা বাস্তবভাবে সাহায্য করে আমার এ কাজে সাহায্য করো। এ হচ্ছে বৈষয়িক কাজে নিতান্ত বাস্তবভাবে কাজের সহযোগিতা করতে বলা। আর এ জগততো বাস্তব কার্য্কারণের জগত। এ জগতে এ ধরনের পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতা চাওয়া বা পাওয়া কিছুতেই কোনো আধ্যাত্মিক সাহায্যের ব্যাপার নয়।এ হলো মানুষের সামাজিক জীবনের জন্য অপরিহার্য্ ব্যাপার, যা সম্পূর্ণ জায়েয। তাই ইমাম ইবনে কাসীর এ আয়াতের তাফসীরে লিখেছেনঃ
-“অর্থাৎ আল্লাহ আমাকে রাজত্ব ও আধিপত্য যা দিয়েছেন, তা তোমাদের জন্য সব কিছুই থেকে উত্তম। কিন্তু তোমরা আমাকে শক্তি দিয়ে সাহায্য করো অর্থাৎ কাজ করে ও নির্মাণ কাজের জিনিসপত্র দিয়ে।”
আর তৃতীয় আয়াতটিও একটি বৈষয়িক তদবীর সংক্রান্ত ব্যাপার। হযরত ইউসুফ(আ) দীর্ঘদিন বিনাবিচারে আটক হয়ে পড়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, বাদশাহ হয়তো তাঁর কথা ভুলেই গেছে। অতএব তিনি সহবন্দীর রেহাই পেয়ে জেল থেকে চলে যাওয়ার সময় বলে দিলেন যে, আমার কথা তোমার প্রভুর নিকট বলবে। এও যদি কোনো আধ্যাত্মিক সাহায্য চাওয়ার পর্যায়ের কাজ হয়ে থাকে তা হলে তো বলতে হবে যে, নবীও অ-নবীর নিকট অলৌকিক উপায়ে সাহায্য চাইতে পারেন। কিন্তু তা যে একজন নবীর পক্ষে কতখানি অপমানকর তা বলাই বাহুল্য।(এই পর্যায়ে ইমাম ইবনে কাসীর একটি হাদীস উদ্ধৃতি করেছিলেন। হাদীসটি এইঃ নবী করীম(স) বলেছেনঃ হযরত ইউসুফ(আ) এই যে কথাটি বলেছিলেন, অর্থাৎ তিনি যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট মুক্তি কামনা করেছিলেন, তা না করলে তিনি যতদিন জেলে ছিলেন ততদিন থাকতেননা। পরে ইবনে কাসীর লিখেছেন- এ হাদীসটি সাংঘাতিকভাবে যয়ীফ, অগ্রহণযোগ্য।) সবচেয়ে বড় কথা, একজন নবী অলৌকিক বা আধ্যাত্মিক উপায়ে(?) সাহায্য চাইলেন, আর শয়তান তা ভুলিয়ে দিলো, তার মুক্তির প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিলো! এরূপ কথা পীর-পোরস্তারাই বিশ্বাস করতে পারে, কোনো তওহীদবাদী আহলে সুন্নাত ব্যক্তি এরূপ বিশ্বাসকে মনের দূরতম কোণেও স্থান দিতে প্রস্তুত হতে পারেনা।
মোটকথা, এ কয়টি আয়াত দিয়ে পীর-পোরস্তরা যা প্রমাণ করতে চাইছে তা আদৌ প্রমাণিত হয়না। হয় শুধু ধোঁকাবাজি করা।
এই পর্যায়ে কুরআনের নিম্নোদ্ধৃত আয়াতটি আমাদের অবশ্যই সবসময় স্মরণে রাখতে হবে।
আরবী(********)
-আল্লাহ ছাড়া আর যারা যারা আছে তারা তো তোমাদের কোনো উপকারও করতে পারেনা, ক্ষতিও না-তাই তাকে আদৌ ডাকবেনা। যদি ডাকো তাহলে তুমি জালিমদের মধ্যে গণ্য হয়ে যাবে।
মানুষ কাউকে ডাকে তাঁর কাছ হতে উপকার পাওয়ার আশায় অথবা কোনো ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য। আর উপকার ও ক্ষতি যে করতে পারেনা তাকে ডেকে কি লাভ হবে। তা করার নিরংকুশ ক্ষমতা তো একমাত্র আল্লাহর, অতএব ডাকতে হবে সর্বাবস্থায়, সব কিছুর জন্য একমাত্র তাঁকেই। পানাহ বা আশ্রয় চাওয়া কেবল তাঁরই নিকট সম্ভব। কেননা পানাহ বা আশ্রয় দেয়ার একবিন্দু ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই নেই। তাই আল্লাহ নিজেই নির্দেশ দিয়েছেন-পানাহ বা আশ্রয় চাও কেবল সেই এক আল্লাহর নিকট।
কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বিদেশ সফর
কবর যিয়ারত করা জায়েয কিন্তু তা করতে হবে শরীয়তসম্মতভাবে। কবরস্থানে গিয়ে যেমন শরীয়তবিরোধী কোনো কাজ করা যাবেনা, কোনো অবাঞ্চিত কথাও বলা যাবেনা; তেমনি কোনো নবী বা অলী বা কোনো নেককার লোকের কবর যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে বিদেশ সফরও জায়েয নয়। এ পর্যায়ে সর্বপ্রথম দলীল হচ্ছে নবী করীম(স) এর তীব্র ও জোরদার নিষেধ বাণী।
তিনি ইরশাদ করেছেনঃ আরবী(******)
– আল্লাহর নৈকট্য লাভ মূলক সফর কেবল তিনটি মসজিদ যিয়ারতের জন্য করা যাবে, তা হলো মসজিদে হারাম(কাবা ঘর), মসজিদে নববী, এবং মসজিদে আকসা। এছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে অপর কোনো স্থানের জন্য সফর করা যাবেনা।
ইমাম নববী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ এ হাদীস উক্ত তিনটি মসজিদের এবং সে মসজিদ ত্রয়ের জন্য সফর করার ফযীলত প্রমাণ করেছে। কেননা সর্বশ্রেণীর আলিমের মতে এর মানে হচ্ছে এই যে, মসজিদত্রয় ছাড়া অন্য কোনো মসজিদের জন্য সফর করার কোনো ফযীলত নেই।
ইমাম নববী হাদীসের ব্যাখ্যায় অন্যত্র লিখেছেনঃ এ তিনটি হচ্ছে নবীগণের মসজিদ। এতে নামায পড়ার ফযীলত অনেক বেশি অন্যান্য মসজিদের তুলনায়।
অতএব তাতে নামায পড়া ও ইবাদত করার নিয়্যতেই সফর করা যাবে। তাতে আল্লাহ ছাড়া অপর কারো ইবাদতের জন্য সফর করা যাবেনা। কেননা মসজিদে হারামের দিকে সফর করা মানত করা হলে তার হ্জ্জ বা উমরা করার উদ্দেশ্যে তা পূরণ করা কর্তব্য। আর শেষোক্ত মসজিদদ্বয়ের সফর মানত করা হলে ইমাম শাফেয়ীর একটি কথা হচ্ছে এই যে, এ দুয়ের নিয়্যতে সফর করা মুস্তাহাব; ওয়াজিব নয়। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, সে মানত পূরণ করা ওয়াজিব হবে। আর অনেক আলিমই এই মত পোষণ করেন। অতঃপর তিনি লিখেছেনঃ
-এ তিনটি মসজিদ ছাড়া অপর কোনো মসজিদের জন্য সফর মানত করা হলে তা পূরণ করা ওয়াজিব নয় এবং মানতই শুদ্ধ হবেনা। এ মত আমাদের এবং সমগ্র আলিমদের। অবশ্য মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম মালিকী ভিন্নমত পোষণ করেন।
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেঃ হাদীসের শব্দ ‘শাদ্দুর রীহাল’ মানে বিদেশ সফর করা। অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্য লাভের নিয়্যত ও উদ্দেশ্যে এ তিনটি মসজিদ ছাড়া অপর কোনো স্থানের জন্যে সফর করবেনা। কেননা এ তিনটি মসজিদিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সম্মানার্হ্ এ কারণে যে, এ ছাড়া অপর সব মসজিদই মর্যাদায় সমান। অতএব যে কোনো মসজিদেই নামায পড়া হোকনা কেন, সবখানেই একই রকম সওয়াব পাওয়া যাবে। কিন্তু এ তিনটি মসজিদের সম্মান ভিন্ন রকম। এ হাদীসের অর্থ হলো, কোনো বিশেষ জায়গার নিয়্যত করে সেজন্যে সফর করবেনা। কিন্তু সেখানে যদি লেখাপড়া শেখা ইত্যাদির কোনো প্রয়োজন থাকে, তাহলে সে কথা স্বতন্ত্র। হাদীসের বাহ্যিক অর্থ তো এই যে, এই তিনটি স্থান ছাড়া অপর কোনো জায়গায় সফরই করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেউ বলেছেন এ তিনটি মসজিদ ছাড়া অপর কোনো স্থানে সফরের মানত করা হলে তা পূরণ করা ওয়াজিব হবেনা। এ মানতই মানত বলে গণ্য হবেনা, তা পূরণ করাও ওয়াজিব হবেনা। এ মানতই মানত বলে গণ্য হবেনা, তা পূরণ করা জরুরী হবেনা। আর ‘অলী’ ও নেককার লোকদের বা পবিত্র স্থানসমূহ সফর করা সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হারাম।
মনে রাখতে হবে, এখানে শুধু যিয়ারত করতে নিষেধ করা হয়নি, তা আলোচ্যও নয় এখানে। বরং এ নিষেধ হচ্ছে শুধু এ উদ্দেশ্যে বিদেশ সফর করা সম্পর্কে। রাসূলের এ হাদীসই হচ্ছে সুন্নাত এবং এই সুন্নাত অনুযায়ীই আমল করেছেন সাহাবায়ে কিরাম। এমন কি, কোনো কোনো বর্ণনামতে শুধু রাসূলের কবর যিয়ারতের জন্য সফর করার কাজও তাঁরা করেননি এবং তা তাঁরা করা পছন্দও করেননি। এ পর্যায়ে প্রমাণ হিসেবে নিম্নোক্ত কথা দুটি উল্লেখ করা যেতে পারেঃ
সব সাহাবী- যেমন মুয়ায, আবু ওবায়দা, উবাদা ইবনে সামিত এবং আবুদ দারদা প্রমুখ-এঁদের কেউ দুনিয়ার একটি কবরগাহেরও যিয়ারত করবার উদ্দেশ্যে সফর করেছেন বলে জানা যায়নি।
এমন কি, সাহাবায়ে কিরাম(রা)শুধু কোনো নবীর মাযার যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে সফর করেছেন বলেও প্রমাণ পাওয়া যায়না। বলা হয়েছেঃ হযরত আবু বকর, উমর, উসমান, আলী(রা) এবং তাঁদের পরবর্তী লোকদের যুগ শেষ হওয়া পর্য্ন্ত কোনো সাহাবীই কোনো নবী বা নেক ব্যক্তির কবর যিয়ারতের জন্য সফর করে বিদেশ যাননি।
এই পর্যায়ে সর্বজনমান্য ভারতীয় মনীষী শাহওয়ারী মুহাদ্দিসে দিহলভী যা কিছু লিখেছেন, তা উল্লেখ করে আমাদের এ সম্পর্কিত বক্তব্য শেষ করছি। মুয়াত্তা ইমাম মালিক গ্রন্থে এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়; হযরত আবু হুরায়রা(রা)বলেনঃ আমি বুসরা ইবনে আবূ গিফারীর সঙ্গে সাক্ষাত করলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ কোথ্থেকে এসেছ? বললামঃ ‘তুর’ থেকে। তিনি বললেন-তুরের দিকে যাওয়ার পূর্বে যদি তোমার সাথে আমার একবার সাক্ষাত হতো, তাহলে তোমার আর যাওয়া হতোনা। কেননা, নবী করীম(স) কে আমি বলতে শুনেছিঃ তোমরা মসজিদে হারাম, আমার মসজিদ এবং মসজিদে ইলীয়া বা বায়তুল মুকাদ্দাস- এই তিনটি মসজিদ ছাড়া আর কোনো মসজিদের জন্য সফরের আয়োজন করবেনা।
শাহ ওয়ালী উল্লাহ(রা) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, এ তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোনো জায়গার জন্য আল্লাহর নৈকট্য (বা সওয়াব) লাভের নিয়্যতে সফর করা এবং কোনো জায়গাকে এ জন্যে নির্দিষ্ট করে নেয়া নিষিদ্ধ।
এর কারণ বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেনঃ সম্ভবত এ নিষেধের মূল লক্ষ্য হলো লোকদেরকে সে কাজ হতে বিরত রাখা, যা জাহিলিয়াতের জামানার লোকেরা করতো। যেমন-তারা নিজেদের ইচ্ছেমত এক একটি তাজীমের স্থান আবিষ্কার ও নির্দিষ্ট করে নিত।
তিনি এ হাদীসের ভিত্তিতে আরো লিখেছেনঃ আমি বলবো জাহিলিয়াতের যুগের লোকেরা বিভিন্ন কল্পনার ভিত্তিতে বিভিন্ন জায়গাকে তাজীমের জায়গা বলে মনে করতো, তার যিয়ারত করতো, তা থেকে বরকত হাসিল করতো। তাতে করে মূল দ্বীন-ই বিকৃত হয়ে যেত, আর হতো নানা বিপর্য্য়। এ কারণে আলোচ্য হাদীস দ্বারা নবী করীম(স) এ বিপর্য্য়ের পথ বন্ধ করে দিলেন, যেন ইসলামী সুন্নাতী আদর্শ ও নিদর্শনাদি গায়র ইসলামী আদর্শের সাথে মিলে মিশে একাকার না হয়ে যায় এবং তা গায়রুল্লাহর ইবাদতের পন্থা উদ্ভাবনের কারণ রূপে গৃহীত না হয়। আমার মতে হক কথা হলো এই যে কবর, কোনো অলী আল্লাহর ইবাদতের জায়গা ও ‘তুর’-এ সবাই সমানভাবে এই নিষেধের মধ্যে গণ্য।
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা কস্তলানী লিখেছেনঃ
-এ তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য সব জায়গায় যাওয়ার জন্য সফর করা-যেমন নেককার লোকদের জীবিত থাকা বা মরে যাওয়ার পর তাদের জিয়ারতের জন্য যাওয়া, সেখানে ইবাদত করা বা সেখান থেকে বরকত লাভের উদ্দেশ্যে যাওয়া- এ সম্পর্কে আবু মুহাম্মদ জুয়েনী বলেন যে, বাহ্যত হাদীস অনুযায়ী আমল করা হলে এসব হারাম হবে। কাযী হুসাইন, কাযী ইয়াজ ও অন্যান্য মনীষীও এই মত-ই গ্রহণ করেছেন। তবে শাফেয়ী মাজহাবের ঈমামুল হারামইন প্রমুখের মতে এ কাজ জায়েয।(বলাবাহুল্য, একদিকে জায়েয অপরদিকে হারাম)। হারাম থেকে বাঁচার জন্য এ জায়েয মত গ্রহণ করা যেতে পারেনা।
মুল্লা আলী আল কারী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ কোনো কোনো আলিম এ হাদীসের দলীল দিয়ে বলেছেন যে, বরকতের জায়গা এবং আলিম ও নেককার লোক (অলী-পীর-দরবেশ) এর কবর যিয়ারতের জন্য সফর করা নিষিদ্ধ।
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দিহলভী(রহ) লিখেছেনঃ হজ্জের সফরের সমান কিংবা তার চাইতেও ভাল ও উত্তম সফর মনে করে, হজ্জের ইহরাম বাঁধার মত জেনে শুনে বা না জেনে ইহরাম বাঁধে- এ কাজ কিছুতেই করা উচিত নয়।
সহীহ হাদীস, উহার ব্যাখ্যা এবং ইসলামের বিশেষজ্ঞ সলফে সালেহীনের পূর্বোদ্ধৃত মূল্যবান বাণীসমূহের ভিত্তিতে এ কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, কবর বা নির্দিষ্ট কোনো স্থানকে নিজেদের ইচ্ছেমতো পবিত্র বরকতওয়ালা বা শরীফ ইত্যাদি মনে করা, তা যিয়ারত করার জন্য এবং কবরস্থ অলী পীর দরবেশ এর নিকট প্রার্থনা করা বা তাকে অসীলা করার জন্য বিদেশ সফর করা এবং সেখান থেকে বরকত হাসীল করতে চাওয়া- এ সবই জাহিলিয়াতের জমানার মুশরিক লোকদের কাজ, এ কাজ দ্বীন-ইসলামের সম্পূর্ণ খেলাফ। এতে যেমন আকীদার খারাবী দেয়া দেয়, তেমনি আমলেরও। এ কারণে নবী করীম(স) এ ধরনের কাজ করতে এ হাদীস মারফত চিরদিনের জন্য নিষেধ করে দিয়েছেন। অতএব বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় স্বকপোল কল্পিত মনগড়া পীর বা অলী দরবেশের কবরকে কেন্দ্র করে যা কিছু করা হচ্ছে, আজমীর শরীফে, বাগদাদ শরীফ, দাতাগঞ্জবখশ, শর্ষিণা শরীফ, মাইজভান্ডার আর সুরেশ্বর শরীফ প্রভৃতি স্থানে যে ওরস ও অন্যান্য অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় এবং দলে দলে মূর্খ মুরীদরা একত্রিত হয় মরা পীরের কবর হতে ফায়েজ নেয়ার উদ্দেশ্যে- তা সবই রাসূলের নির্দেশের সম্পূর্ণ খেলাফ, সুন্নাতের বিপরীত- এক স্পষ্ট বিদয়াত। আর পীর ভক্তির তীব্রতা ও আতিশয্যের কারণে অনেক ক্ষেত্রে তা-ই শিরক এ পরিণত হয়।
এমন কি, মক্কায় কাবা ঘরের হজ্জ করতে গিয়ে মদীনায় যাওয়া যারা বাধ্যতামূলক মনে করেন, তাদের উচিত মসজিদে নববীতে নামায পড়ার নিয়্যতে সফর করবে, শুধু রাসূলে করীমের কবরে সালাম করার উদ্দেশ্যে সফর করা উচিত নয়।
এ সব অকাট্য দলীলের মুকাবিলায় বিদয়াতীদের কথাবার্তা পেশ করে পীর-মুরীদী মহাশূণ্যে মিলিয়ে যেতে দেরী নেই মোটেও।
আল্লাহ এই বিদয়াতীদের হেদায়াত করুন।
ইস্তিমদাদে রূহানী
কবর যিয়ারত সম্পর্কে উপরোক্ত বিস্তারিত আলোচনা পাঠ করার পর কারো মনেই সন্দেহ থাকতে পারেনা যে, কবরস্থানে গিয়ে তাদের জন্য দো’আ করা ছাড়া আর কোনো কাজ করা। কবরস্থ লোকদের নিকট নিজেদের কোনো মনোবেদনা জানাতে চেষ্টা করা, কোনো প্রয়োজন পূরণের জন্য তাদের সাহায্য প্রার্থনা করা কিংবা তাদের কাছ হতে রূহানী ফায়েয হাসিল করতে চেষ্টা করা সম্পূর্ণ শিরক। মূলত এ সেই কাজ, যা মূলত মুশরিকরা করে তাদের মনগড়া দেব-দেবী ও মাবুদদের নিকট। এ পর্যায়ে তাফসীর জামেউত তাফসীর এর সূরা ফাতির এর তাফসীর থেকে একটা ঘটনা উল্লেখ করা একান্তই জরুরী। ঘটনাটি হযরত শাহ ইসহাক দেহলভী ইমাম আবু হানীফা(রহ) থেকে বর্ণনা করেছেন।
ঘটনাটি এরূপঃ ইমাম আবু হানীফা দেখলেন, এক ব্যক্তি নেক লোকদের কবরস্থানে উপস্থিত হয়ে সালাম করছে, তাদের সম্বোধন করে বলছেঃ হে কবরবাসীরা! তোমাদের কি কোনো খবর আছে? তোমাদের আছে কোনো ক্ষমতা? আমি তো তোমাদের কাছে কয়েক মাস ধরে আসছি, তোমাদের ডাকাডাকি করছি। তোমাদের নিকট আমার জন্য কোনো প্রার্থনা ছিলনা, ছিল শুধু দো’আর প্রার্থনা। কিন্তু তোমরা কি কিছু টের পেয়েছ, না একেবারে গাফিল হয়ে পড়ছো?
এ কথা ইমাম আবু হানীফা(রহ) শুনতে পেলেন। তিনি লোকটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেনঃ কবরস্থ লোকেরা কি তোমার ডাকের কোনো জবাব দিল? লোকটি বললঃ না, কোনো জবাবই পাইনি। তখন ইমাম আবু হানীফা(রহ) বললেনঃ বড় দুঃখ, বড় লজ্জার বিষয়! তোমার দুটো হাতই ধ্বংস হয়ে যাক। তুমি এমন সব দেহকে লক্ষ্য করে কথা বলছো যারা কোনো জবাবই দিতে পারেনা, যাদের কোনো কিছুই করার ক্ষমতা নেই, (এমন কি) কোনো আওয়াজও তারা শুনতে পায়না। অতঃপর তিনি পড়লেন সূরা ফাতির এর 22 নং আয়াত।–তুমি শোনাতে পারবেনা তাদের, যারা কবরে রয়েছে।
ইমাম আবু হানীফার(রহ) এই উক্তি প্রমাণ করে যে, তিনি এই মত পোষণ করতেন যে, অলী ও নেক লোকদের কবরে গিয়ে তাদের সম্বোধন করে কথা বলা বা কিছুর জন্য প্রার্থনা করা সম্পূর্ণ নাজায়েয। দ্বিতীয়-মৃত ব্যক্তি শুনেওনা, জবাবও দিতে পারেনা। ভক্তদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করা, নিঃসন্তানকে সন্তান দান করা বা চাকুরী-ব্যবসা ইত্যাদিতে উন্নতি দান করার কোনো সাধ্যই তাদের নেই- থাকতে পারেনা। ইমামা আবু হানীফা(রহ) এর এই মতে কুরআনের ঘোষণার যথার্থ প্রতিফলন ঘটেছে। ইয়াহুদি খ্রীস্টান মুশরিকার হযরত ঈসা, হযরত উজাইর ও ফেরেশতাদের ডাকতো। তাদের নিকট সাহায্য চাইতো বিপদ হতে উদ্ধার পাওয়ার জন্য। এই প্রেক্ষিতেই আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করলেনঃ আরবী(*********)
-না, ওরা তোমাদের বিপদ দূর করতে এবং তোমাদের জন্য আসা বিপদকে অন্য দিকে সরিয়ে দিতে কস্মিনকালেও পারবেনা।
এই পর্যায়ে কুরআন মজীদের একটি আয়াত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ
وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّن يَدْعُو مِن دُونِ اللَّهِ مَن لَّا يَسْتَجِيبُ لَهُ إِلَىٰ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَن دُعَائِهِمْ غَافِلُونَ [٤٦:٥]
– যে লোক আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকবে সে কিয়ামত পর্য্ন্তও তার ডাকের জবাব দিবেনা, তার চাইতে অধিক গুমরাহ আর কে হতে পারে? ওরা তো তাদের দো’আ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনবহিত। (আহকাফঃ5)
এ পর্যায়ে সঠিক মাসআলা জানার জন্য সর্বপ্রথম দেখতে হবে কুরআন মজীদে স্বয়ং নবী করীম(স) এর কি মর্যাদা ঘোষিত হয়েছে। নবী করীমের যে মর্যাদা কুরআনে ঘোষিত হয়েছে- এ পর্যায়ে আকীদা ঠিক রাখার জন্য সুন্নাতের সঠিক জ্ঞান অর্জনের জন্য- তাই হবে ভিত্তি। কুরআনের পাঠক মাত্রই জানেন, কুরআন মজীদে স্বয়ং রাসূলের জবানীতে তাঁর নিজের মর্যাদা নানা স্থানে ঘোষিত হয়েছে। এ পর্যায়ের একটি আয়াত হচ্ছে এইঃ
قُل لَّا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ ۚ وَلَوْ كُنتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ ۚ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ [٧:١٨٨]
-বলো হে নবী! আমি আমার নিজের জন্য কোনো কল্যাণের ওপর কর্তৃত্বশালী নই, না কোনো ক্ষতির ওপর। তবে শুধু তা-ই এর বাইরে, যা আল্লাহ চাইবেন। আর আমি যদি গায়েব জানতাম, তাহলে আমি নিশ্চয়ই অনেক বেশি বেশি কল্যাণ লাভ করে নিতাম এবং আমাকে কোনো দুঃখ বা কষ্টই স্পর্শ করতে পারতোনা। আমি তো শুধু ভয় প্রদর্শনকারী, শুধু সংবাদদাতা ঈমানদার লোকদের জন্য।(আল আরাফঃ188)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা আলুসী লিখেছেনঃ এ আয়াত থেকে বোঝা গেল যে, নবী করীম(স) সে গায়েবের জ্ঞান জানেননা, যা ফায়দা লাভ ও ক্ষতির প্রতিরোধের জন্য অনুকূল। কেননা তার সাথে এবং দ্বীনী হুকুম আহকাম ও শরীয়তের বিধানের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। এ জন্যে এ ধরনের গায়েবী জ্ঞান নবী করীম(স) জানেননা। আর এ জ্ঞান না জানা তাঁর নব্যুয়তের মহান মর্যাদার পক্ষে কিছুমাত্র ক্ষতিকর বা দোষের নয়।
এ পর্যায়ে গায়েবী ইলম যে রাসূলের নেই, তা একটি বাস্তব ঘটনা থেকেও প্রমাণিত হয়। হযরত আয়েশা(রা) বলেনঃ লোকেরা খেজুর গাছের স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে মিলন ঘটাত। নবী করীম(স) বলেনঃ এ কাজ যদি তোমরা না কর তবে ভালোই হয়। কিন্তু পরবর্তী ফসল কালে তারা এ কাজ না করার দরুণ খেজুরের ফসল ভালো হলোনা। এ কথা শুনে নবী করীম(স) বললেনঃ ‘তোমাদের এসব বৈষয়িক ব্যাপার তোমরাই ভালো জানো।’ অপর বর্ণনায় কথাটি এভাবে বলা হয়েছেঃ ‘দেখ, ব্যাপার যদি তোমাদের বৈষয়িক সংক্রান্ত হয়, তবে তা তোমাদের ব্যাপার। আর যদি দ্বীন সংক্রান্ত হয়, তাহলে তা আমার আওতাভুক্ত।’
হানাফী মাযহাব সমর্থিত আকীদায় স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, নবী করীম(স) গায়েব জানতেন-এরূপ আকীদা যদি কেউ পোষণ করে, তবে সে হবে স্পষ্ট কাফির। কেননা এরূপ আকীদা কুরআনের(পূর্বোক্ত এবং) এ আয়াতের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আয়াতটি হলোঃ
قُل لَّا يَعْلَمُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ ۚ
–বলো, আসমান-জমিনের কেউ-ই গায়েব জানেনা এক আল্লাহ ছাড়া।
অর্থাৎ যা কিছু মানুষের অনুভূতি আর জ্ঞানের আওতার মধ্যের ব্যাপার নয় তা আসমান-জমিনের সমস্ত সৃষ্টিলোকের মধ্যে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ-ই জানেনা, জানতে পারেনা।
হযরত আয়েশা(রা) বলেনঃ আরবী(********)
-যে লোক ধারণা করবে যে, মুহাম্মদ(স) লোকদের সে সব বৈষয়িক বিষয়ে জানেন বা খবর দেন, যা কাল ঘটবে, তবে সে আল্লাহর প্রতি একটি অতি বড় মিথ্যা আরোপ করে দিলো।
গায়েব জানা সম্পর্কিত এ সব অকাট্য ও সুস্পষ্ট দলীলসমূহের ভিত্তিতে বলা যায়, নবী করীম(স)-ই যখন গায়েব জানতেননা, তখন কোনো পীর-অলী-দরবেশ এর পক্ষে গায়েব জানার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারেনা। যদি কেউ তা মনে করে, তবে তা হবে আকীদার ক্ষেত্রে এক মহা শিরক, কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট ঘোষণাবলীর সম্পূর্ণ খেলাফ এবং সুন্নাতী আকীদার বিপরীত এক সুস্পষ্ট বিদয়াত।