بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
‘সুন্নাত’ ও ‘বিদয়াত’ দুটোই আরবী শব্দ। তা সত্ত্বেও মুসলিম সমাজে এ দুটো শব্দ ব্যাপকভাবে পরিচিত এবং ইসলামের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এ শব্দ দুটো বহুল ব্যবহৃত। কিন্তু যতদূর বোঝা যাচ্ছে, এ দুটো পরিভাষার সঠিক তাৎপর্য অনেকেই অনুধাবন করতে সক্ষম নয়। অথচ ইসলামী সংস্কৃতির যতোগুলো মৌলিক পরিভাষা রয়েছে, যে-সব পরিভাষার উপর ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার সম্যক অনুধাবন নির্ভরশীল, এ দুটো শব্দ তার মধ্যেই গণ্য। অতএব এ দুটো শব্দের সঠিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ এবং এ দুটোর দৃষ্টিতে বর্তমান বিশ্ব-মুসলিম এর আকীদা, আমল ও আখলাক যাচাই ও পরখ করা একান্তই জরুরী, যদিও বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা সাপেক্ষ।
এ বিষয় আলোচনার প্রয়োজনীয়তা আরো অধিক তীব্র হয়ে দেখা দেয়, যখন আমরা দেখতে পাই যে, বর্তমান মুসলিম সমাজে কার্যত সুন্নাত ও বিদয়াতের মাঝে কোন পার্থক্য করা হয়না। শুধু তাই নয়, বহু রকমের সুন্নাত সমর্থিত ও সুন্নাতের দৃষ্টিতে অপরিহার্য-অবশ্য করণীয় কাজ আজ্ও মুসলিম সমাজেই সাধারণভাবে পরিত্যক্ত হয়ে রয়েছে এবং বহু প্রকারের বিদয়াত সুন্নাতের মতই গুরু্ত্ব লাভ করে শক্তভাবে শিকড় গেড়ে এবং শাখা প্রশাখায়, পত্র ও ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে বসে আছে। এখন অবস্থা এই যে, বর্তমান মুসলিম সমাজের চেহারা দেখে, তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক সামগ্রিক কার্যক্রম দেখে এবং জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের বাস্তব ভূমিকা লক্ষ্য করে বুঝবার কোন উপায় নেই যে, কোনটি সুন্নাত আর কোনটি বিদয়াত।আজকের মুসলিম জীবনে সুন্নাতের দিকপ্লাবী নির্মল আলোকচ্ছটা ম্লান হয়ে এসেছে এবং তদস্থলে বিদয়াতের কালো আঁধার সর্বত্র ছেয়ে আছে, গ্রাস করে ফেলেছে সমগ্র মুসলিম জীবনকে। বিদয়াতের এ রাহুগ্রাস হতে মুক্তি পাওয়া না পর্যন্ত সুন্নাতের স্বচ্ছ আলোকধারায় মুসলিম জীবনকে উদ্ভাসিত করে তোলা কিছুতেই সম্ভবপর হবেনা, হতে পারেনা। ঠিক এ উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে-ই আমরা এ আলোচনায় প্রবৃত হয়েছি।
সুন্নাত ও বিদয়াতের ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য
প্রথমে আমরা মৌলিকভাবে এ শব্দ দুটোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেশ করতে চাই, বুঝতে চাই ইসলামী পরিভাষা হিসেবে ‘সুন্নাত’ বলতে কি বুঝায় এবং আহলে সুন্নাতই বা কারা? এবং বিদয়াত কি এবং সে বিদয়াত কতো দিক দিয়ে সচেতন বা অবচেতনভাবে মুসলিম সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে।
‘সুন্নাত’ শব্দের ব্যাখ্যা
‘সুন্নাত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘পথ’।
কুরআন মজীদে এ ‘সুন্নাত’ শব্দটি বহু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে।
একটি আয়াত হলোঃ
سُنَّةَ اللَّهِ الَّتِي قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلُ ۖ وَلَن تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّهِ تَبْدِيلًا [٤٨:٢٣]
আল্লাহর সুন্নাত, যা পূর্ব থেকেই কার্যকর হয়ে রয়েছে। আর আল্লাহর এ সুন্নাতে কোনরূপ পরিবর্তন দেখবেনা কখনো।(আল ফাতহঃ48)
অপর আয়াতে বলা হয়েছেঃ فَلَن تَجِدَ لِسُنَّتِ اللَّهِ تَبْدِيلًا ۖ وَلَن تَجِدَ لِسُنَّتِ اللَّهِ تَحْوِيلًا
-তুমি আল্লাহর সুন্নাতে কোনরূপ পরিবর্তন হতে- কোনো প্রকারের ব্যতিক্রম হতে দেখবেনা।(আল ফাতীরঃ42)
সূরা বনি ইসরাঈলেও ‘সুন্নাত’ শব্দটি একই আয়াতে দুবার ব্যবহৃত হয়েছে।
আয়াতটি- سُنَّةَ مَن قَدْ أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ مِن رُّسُلِنَا ۖ وَلَا تَجِدُ لِسُنَّتِنَا تَحْوِيلًا [١٧:٧٧]
-তোমার পূর্বে যেসব রাসূল পাঠিয়েছি এ হচ্ছে তাদের ব্যাপারে সুন্নাত এবং তুমি আল্লাহর সুন্নাতে কোনোরূপ পরিবর্তন পাবেনা।
এসব আয়াতে ব্যবহৃত ‘সুন্নাত’ শব্দের শাব্দিক ও আভিধানিক অর্থ পথ, পন্থা ও পদ্ধতি। কিন্তু ‘সুন্নাতুল্লাহ’-আল্লাহর সুন্নাতের মানে কি?
ইমাম রাগেব ইসফাহানী লিখেছেনঃ আল্লাহ তা’আলার সুন্নাত বলা হয় তাঁর কর্মকুশলতার বাস্তব পন্থাকে, তাঁর আনুগত্য করার নিয়ম ও পদ্ধতিকে।
এভাবে দেখা যায় যে, ‘সুন্নাত’ শব্দটি একটি মৌলিক বিষয় সম্পর্কিত এবং তা যেমন আল্লাহর ব্যাপারে প্রয়োগ করা হয়েছে, তেমনি করা হয়েছে নবী ও রাসূলদের ক্ষেত্রেও। সাধারণ মানুষের বাস্তব অবস্থান বুঝবার জন্যেও এ শব্দের ব্যবহার দেখা যায় কুরআন মজীদে।
এ হলো ‘সুন্নাত’ শব্দটির শাব্দিক ব্যবহার ও আভিধানিক অর্থ। আমরা এখানে ‘সুন্নাত’ শব্দটির যে বিশ্লেষণ শুরু করেছি, তা এ দৃষ্টিতেই। আমাদের সামনে রয়েছে এর মূল ও নির্গলিত অর্থ ।
ইমাম রাগেবের ভাষায়ঃ নবীর সুন্নাত হচ্ছে সে নিয়ম, পন্থা ও পদ্ধতি, যা তিনি বাস্তব কাজে ও কর্মে অনুসরণ করে চলতেন।
আর আল্লামা মুহাম্মাদ বশীর সাহসোয়ানীর ভাষায় ‘সুন্নাত’ হলোঃ সেই বিশেষ পথ, পন্থা ও পদ্ধতি যা নবী করীম (সাঃ) এর সময় থেকেই দ্বীন ইসলামের ব্যাপারে কোনো কাজ করার বা না করার দিক দিয়ে বাস্তবভাবে অনুসরণ করা হয়-যার উপর দিয়ে চলাচল করা হয়। ‘কিতাবুল মকসূদ’ এর ‘কিতাবুল কাজী’ অধ্যায়ে ‘সুন্নাত’ শব্দের ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবেঃ ‘সুন্নাত’ দ্বীন ইসলামের এমন এক অনুসৃত কর্মপদ্ধতি, যার অনুসরণ সকল অবস্থায়ই ওয়াজিব বা কর্তব্য।
আল্লামা আবদুল আযীয আল হানাফী লিখেছেনঃ ‘সুন্নাত’ শব্দ বোঝায় রাসূল(সাঃ) এর কথা ও কাজ। আর তা রাসূলে করীম(সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের বাস্তব কর্মনীতি বুঝবার জন্যও ব্যবহৃত হয়।
আল্লামা সফীউদ্দীন আল-হাম্বলী লিখেছেনঃ কুরআন ছাড়া রাসূলের যে কথা, যে কাজ বা অনুমোদন বর্ণনার সূত্রে পাওয়া যায় তা-ই সুন্নাত।
মনে রাখতে হবে, এখানে সুন্নাতের সে অর্থ আলোচ্য নয়, যা হাদীস বিজ্ঞানীরা পরিভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছেন; সে অর্থও নয় যা ফিকহ শাস্ত্রে গ্রহণ করা হয়েছে। হাদীস বিজ্ঞানীদের পরিভাষায় ‘সুন্নাত’ হচ্ছে রাসূলে করীম(সাঃ) এর মুখের কথা, কাজ ও সমর্থন অনুমোদনের বর্ণনা- যাকে প্রচলিত কথায় বলা হয় ‘হাদীস’। আর ফিকাহশাস্ত্রে ‘সুন্নাত’ বলা হয় এমন কাজকে, যা ফরজ ও ওয়াজিব নয় বটে; কিন্তু নবী করীম(সাঃ) তা প্রায়ই করেছেন। এ গ্রন্থে এ দুটো সুন্নাতের কোনটি-ই আলোচ্য নয়। এখানে আলোচ্য হচ্ছে ‘সুন্নাত’ তার মূলগত অর্থের দিক দিয়ে যা মৌলিক আদর্শ রীতি-নীতি, পথ, পন্থা ও পদ্ধতি বোঝায়। বস্তুত এ হিসেবে ‘সুন্নাত’ হলো সেই মূল আদর্শ, যা আল্লাহ তা’আলা বিশ্ব মানবের জন্য নাজিল করেছেন, যা রাসূলে করীম(সাঃ) নিজে তাঁর বাস্তব জীবনে দ্বীনি দায়িত্ব পালনের বিশাল ক্ষেত্রে অনুসরণ করেছেন; অনুসরণ করার জন্য পেশ করেছেন দুনিয়ার মানুষের সামনে। মূল ইসলামেরই বিকল্প শব্দ হচ্ছে ‘সুন্নাত’ যা আমরা এখানে আলোচনা করেছি। কেননা নবী করীম(সাঃ) যা বাস্তবভাবে অনুসরণ করেছেন, তার উৎস হচ্ছে ওহী- যা আল্লাহর নিকট হতে তিনি লাভ করেছেন। এ ‘ওহী’ দু’ভাগে বিভক্ত। একটি হচ্ছে আল্লাহর জানিয়ে দেয়া বিধান ও নির্দেশ। রাসূলে করীম (স) এর বাস্তব কর্মজীবন এ দুটোরই সমন্বয়, যেখানে এসবকিছুরই প্রতিফলন ঘটেছে পরিপূর্ণভাবে। রাসূলের বাস্তব জীবন বিশ্লেষণ করলে এ সব কটিরই প্রকটভাবে সন্ধান লাভ করা যাবে। আর তাই হচ্ছে ‘সুন্নাত’, তাই হচ্ছে পরিপূর্ণ দ্বীন ইসলাম। কুরআন মজীদে রাসূলের এ বাস্তব জীবনের সত্যিকার রূপ সুস্পষ্ট করে তুলবার জন্যেই তাঁর জবানীতে বলা হয়েছেঃ আমি কোন আদর্শই অনুসরণ করিনা; করি শুধু তাই যা আমার নিকট ওহীর সূত্রে নাযিল হয়।
ওহীর সূত্রে নাযিল হওয়া আদর্শই রাসূল করীম(স) বাস্তব কাজে ও কর্মে অনুসরণ করেছেন, তা-ই হচ্ছে আমাদের আলোচ্য ‘সুন্নাত’। এই সুন্নাতেরই অপর নাম ইসলাম।
কুরআন মজীদে এ সুন্নাতকেই ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। রাসূলের জবানীতে কুরআন মজীদে ঘোষণা করা হয়েছেঃ
নিশ্চয়ই এ হচ্চে আমার সঠিক সরল দৃঢ় পথ। অতএব তোমরা এ পথই অনসরণ করে চলবে, এ ছাড়া অন্যান্য পথের অনুসরণ তোমরা করবেনা। তা করলে তা তোমাদের এ পথ হতে বিচ্ছিন্ন করে দূরে নিয়ে যাবে। আল্লাহ তোমাদের এরূপ-ই নির্দেশ দিয়েছেন যেন তোমরা ভয় করে চলো।
এ আয়াতে ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ বলতে সে জিনিসকেই বুঝানো হয়েছে, যা বোঝায় ‘সুন্নাত’ শব্দ হতে। ইমাম শাতেবী ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ এর পরিচয় সম্পর্কে লিখেছেনঃ ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ হচে্ছ আল্লাহর সেই পথ, যা অনুসরণের জন্য তিনি দাওয়াত দিয়েছেন। আর তা-ই সুন্নাত; আর অন্যান্য পথ বলতে বোঝানো হয়েছে বিরোধ ও বিভেদপন্থীদের পথ, যা মানুষকে ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ হতে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। আর তারাই হচ্ছে বিদয়াতপন্থী লোক। আরও মনে রাখতে হবে, সুন্নাত হচ্ছে তা-ই , যা বিদয়াতের বিপরীত অর্থে ব্যবহৃত হয়। কেননা এ সুন্নাতের বিপরীতই হচ্ছে বিদয়াত।
‘বিদয়াত’ শব্দের ব্যাখ্যা
ইমাম রাগেব ‘বিদয়াত’ শব্দের অর্থ লিখেছেনঃ
কোনরূপ পূর্ব নমুনা না দেখে এবং অন্য কোন কিছুর অনুকরণ অনুসরণ না করেই কোনো কাজ নতুনভাবে সৃষ্টি করা।
আর দ্বীনের ক্ষেত্রে যে বিদয়াত তার সংজ্ঞা হিসেবে লিখেছেনঃ আরবী(*********)
দ্বীনের ক্ষেত্রে বিদয়াত হচ্ছে এমন কোনো কথা উপস্থাপন করা, যার প্রতি বিশ্বাসী ও যার অনুসারী লোক কোন শরীয়ত প্রবর্তক বা প্রচারকের আদর্শে আদর্শবান নয়, শরীয়তের মৌলনীতি ও সুষ্ঠু পরিচ্ছন্ন আদর্শের সাথেও যার কোন মিল নেই।
অর্থাৎ শরীয়ত প্রবর্তক যে কথা বলেননি সে কথা বলা এবং তিনি যা করেননি এমন কাজকে আদর্শরূপে গ্রহণ করা তা-ই হচ্ছে বিদয়াত।
ইমাম নবয়ী বিদয়াত শব্দের অর্থ লিখেছেনঃ আরবী(*********)
-এমন সব কাজ করা বিদয়াত, যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই।
আর আল্লামা মুল্লা-আলী আল কারী লিখেছেনঃ আরবী(*********)
-রাসূলের যুগে ছিলনা এমন নীতি ও পথকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে প্রবর্তন করা।
ইমাম শাতেবী লিখেছেনঃ আরবী(*********)
-আরবী ভাষায় বলা হয় অমুক লোক বিদয়াত করেছেন। আর এর মানে বোঝা হয়ঃ অমুক লোক নতুন পন্থার উদ্ভাবন করেছে, যা ইতিপূর্বে কারো দ্বারাই অনুসৃত হয়নি।
তিনি আরো লিখেছেনঃ আরবী(*********)
-বিদয়াত তখনই বলা হবে যখন বিদয়াতী কোনো কাজকে শরীয়ত মোতাবিক কাজ বলে মনে করবে অথচ তা মূলত শরীয়ত মোতাবিক নয়। এছাড়া আর অন্য কোনো অর্থ নেই।
তার মানে, শরীয়ত মোতাবিক নয়- এমন কাজকে শরীয়ত মোতাবিক বলে আকীদা হিসেবে বিশ্বাস করে নেয়াই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে বিদয়াত। অন্যত্র লিখেছেনঃ আরবী(*********)
-এজন্যই এমন কাজকেও ‘বিদয়াত’ নাম দেয়া হয়েছে, যে কাজের সমর্থনে শরীয়তের কোনো দলীল নেই।
মোটকথা দাঁড়াল এই যে, বিদয়াত বলা হয় দ্বীন-ইসলামের এমন কর্মনীতি বা কর্মপন্থা চালু করাকে, যা শরীয়তের বিপরীত এবং যা করে আল্লাহর বন্দেগীর ব্যাপারে আতিশয্য ও বাড়াবাড়ি করাই হয় লক্ষ্য।
আবার প্রকৃত বিদয়াত ও আপেক্ষিক বিদয়াত এর পার্থক্য প্রদর্শন প্রসঙ্গে ইমাম শাতেবী লিখেছেনঃ আরবী(*********)
-প্রকৃত ও সত্যিকারের বিদয়াত তাই, যার স্বপক্ষে ও সমর্থনে শরীয়তের কোনো দলীলই নেই। না আল্লাহর কিতাব, না রাসূলের হাদীস, না ইজমার কোনো দলীল, না এমন কোনো দলীল পেশ করা যায় যা বিজ্ঞজনের নিকট গ্রহণযোগ্য। না মোটামোটিভাবে, না বিস্তারিত ও খুঁটিনাটিভাবে। এজন্য এর নাম দেয়া হয়েছে বিদয়াত। কেননা তা মনগড়া, স্ব-কল্পিত, শরীয়তে যার কোনো পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই।
প্রখ্যাত হাদীসবিদ ইমাম খা্ত্তাবী বিদয়াতের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবেঃআরবী(*********)
-যে মত বা নীতি দ্বীনের মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, নয় কোনো দৃষ্টান্ত কিংবা কিয়াস সমর্থিত- এমন যা নবোদ্ভাবিত করা হবে, তাই বিদয়াত। কিন্তু যা দ্বীনের মূলনীতি মোতাবিক, তারই ভিত্তিতে গঠিত, তা বিদয়াতও নয়, গোমরাহীও নয়।
হাফেজ ইবনে রজবও এ কথাই লিখেছেনঃ আরবী(*********)
‘বিদয়াত’ বলতে বোঝায় তা, যা নবোদ্ভাবিত, বোঝার মতো কোনো দলীল বা প্রমাণ শরীয়তে যার নেই।
কুরআন ও হাদীসে ‘বিদয়াত’ শব্দের উল্লেখ
কুরআন মজীদে ‘বিদয়াত’ শব্দটি তিনটি ক্ষেত্রে তিনভাবে উল্লেখিত হয়েছে।
একঃ আল্লাহ সম্পর্কে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে দুটি আয়াতে। একটি আয়াতঃ
بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ وَإِذَا قَضَىٰ أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُن فَيَكُونُ [٢:١١٧]
– আসমান জমিনের সম্পূর্ণ নবোদ্ভাবনকারী, নতুন সৃষ্টিকারী। তিনি যখন কোনো কাজের ফায়সালা করেন, তখন তাকে শুধু বলেনঃ হও। অমনি তা হয়ে যায়।(আল বাকারাহঃ117)
অপর আয়াতটি
بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ أَنَّىٰ يَكُونُ لَهُ وَلَدٌ وَلَمْ تَكُن لَّهُ صَاحِبَةٌ ۖ وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ ۖ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ [٦:١٠١
– তিনি তো আসমান জমিনের নব সৃষ্টিকারী। তাঁর সন্তান হবে কোথ্থেকে, কেমন করে হবে তাঁর স্ত্রী? তিনি-ই তো সব জিনিস সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি সর্ব বিষয়েই অবহিত।(আল আনআমঃ101)
এ দুটো আয়াতেই আল্লাহ তা’আলাকে ‘আসমান জমিনের বদীউন’- ‘পূর্ব দৃষ্টান্ত, পূর্ব উপাদান ও পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই সৃষ্টিকার’ বলা হয়েছে।
দ্বিতীয়, রাসূলে করীম(স) এর জবানীতে তাঁর নিজের সম্পর্কে বলা একটি আয়াতে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এভাবেঃ
قُلْ مَا كُنتُ بِدْعًا مِّنَ الرُّسُلِ وَمَا أَدْرِي مَا يُفْعَلُ بِي وَلَا بِكُمْ ۖ
-বলো হে নবী! আমি কোনো অভিনব প্রেৃরিত ও নতুন কথার প্রচারক রাসূল হয়ে আসিনি। আমি নিজেই জানিনে আমার সাথে কিরূপ ব্যবহার করা হবে, তোমাদের সাথে কি করা হবে, তাও আমার অজ্ঞাত। (আল আহকাফঃ9)
আর তৃতীয়, এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে বনী ইসরাঈলের এক অংশের লোকদের বিশেষ ধরণের আমলের কথা বলতে গিয়ে।
আয়াতটি এইঃ وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلَّا ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ
-এবং অত্যধিক ভয়ের কারণে গৃহীত কৃচ্ছসাধনা ও বৈরাগ্যনীতি তারা নিজেরাই রচনা করে নিয়েছে। আমরা তাদের উপর এই নীতি লিখে ফরজ করে দিইনি। বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি সন্ধানকেই তাদের জন্য লিপিবদ্ধ করে দিয়েছিলাম।(আল হাদীদঃ 27)
এখানে ‘রাহবানিয়াত’ কে বিদয়াত বলা হয়েছে, যা আল্লাহ তা’আলা ব্যবস্থা করে দেননি, লোকেরা নিজেদের তরফ থেকে রচনা করে নিয়েছে। এখানে যে ‘বিদয়াত’ এর কথা বলা হয়েছে, সুন্নাত এর বিপরীত শব্দ হিসেবে, এ গ্রন্থে তা-ই আমাদের আলোচ্য বিষয়। এ আয়াত হতে যে কথাটি স্পষ্ট হয়ে উঠে তা হলোঃ আল্লাহ বান্দাদের জন্য যে বিধি ও বিধান দেননি-বান্দারা নিজেদের ইচ্চেমতো যা রচনা করে নিয়েছে, তা-ই ‘বিদয়াত’। পক্ষান্তরে আল্লাহ যা কিছু লিখে দিয়েছেন, বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন, যা করতে আদেশ করেছেন, তা করা ‘বিদয়াত’ নয়। এখান হতেই ‘বিদয়াত’ সংক্রান্ত মূল সংজ্ঞা ও ভাবধারার স্পষ্ট আভাস পাওয়া গেল।
সূরা ‘আল কাহাফ’ এর এক আয়াতে ‘বিদয়াত’ শব্দের এই অর্থের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষায়।
আয়াতটি এইঃ قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُم بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا [١٨:١٠٣]
الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا [١٨:١٠٤]
-বলো হে নবী! আমলের দিক দিয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের কথা কি তোমাদের বলবো? তারা হচ্চে এমন লোক যাদের যাবতীয় চেষ্টা সাধনাই দুনিয়ার জীবনে বিভ্রান্ত হয়ে গেছে। আর তারাই মনে মনে ধারণা করে যে তারা খুবই ভালো কাজ করেছে। (আল কাহাফঃ102-103)।
অর্থাৎ যাবতীয় কাজ কর্ম ভুলের ভিত্তিতে সম্পাদিত হওয়া সত্ত্বেও যারা নিজেদের কাজকে খুবই ভালো, খুবই ন্যায়সঙ্গত, খুবই সওয়াবের কাজ বলে মনে করে, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত লোক। বিদয়াতপন্থীরাও ঠিক এমনি। তারা যেসব কাজ করে, আসলে তা আল্লাহর দেয়া নীতির ভিত্তিতে নয়। তা সত্ত্বেও এই হচ্ছে বিদয়াতের সঠিক পরিচয়। সূরা আল-কাহাফের উপরোক্ত আয়াতের তাফসীরে আল্লামা ইবনে কাসীর লিখেছেনঃ এ আয়াত সাধারণভাবে এমন সব লোকের বেলায়ই প্রযোজ্য , যারা আল্লাহর ইবাদত করে আল্লাহর পছন্দনীয় পন্থার বিপরীত পন্থা ও পদ্ধতিতে। তারা যদিও মনে করছে যে, তারা ঠিক কাজই করেছে এবং আশা করছে যে, তাদের আমল আল্লাহর নিকট স্বীকৃত ও গৃহীত হবে। অথচ প্রকৃতপক্ষে তারা ভুল নীতির অনুসারী এবং এ পর্যায়ে তাদের আমল আল্লাহর নিকট প্রত্যাখ্যাত।
অর্থাৎ ইবাদত-বন্দেগীর কাজ-যা করলে সওয়াব হবে এবং যা না করলে গুনাহ হবে বলে মনে করা হবে-এমন সব কাজই হতে হবে আল্লাহর সন্তোষমূলক পন্থা ও পদ্ধতিতে। এই হচ্ছে সুন্নাত। আর তার বিপরীত রীতি ও নিয়মে হলে তা হবে সুস্পষ্ট বিদয়াত। কেননা তা সুন্নাত বিরোধী। ইমাম কুরতবী তাই বিদয়াত বলেছেন এমন সব জিনিসকে যাঃ যা আল্লাহর কিতাব বা রাসূলের সুন্নাত অথবা সাহাবাদের আমলের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও তার অনুরূপ নয়।
এ সম্পর্কে অধিক সুস্পষ্ট কথা বিবৃত হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতটিতেঃ আয়াতটি এইঃ
وَمَن يُشَاقِقِ
الرَّسُولَ مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَىٰ وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ ۖ وَسَاءَتْ مَصِيرًا [٤:١١٥
-যে ব্যক্তি সঠিক হেদায়াতের পথ স্পষ্ট উজ্জ্বল হয়ে উঠার পরও রাসূলে করীমের বিরুদ্ধাচরণ করবে এবং মুমিন সমাজের সুন্নতী আদর্শকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো পথ ও আদর্শের অনুসরণ করবে, আমরা তাদের সে পথেই চলতে দিবো। আর কিয়ামতের দিন তাদের পৌছে দিবো জাহান্নামে। বস্তুত জাহান্নাম অত্যন্ত খারাপ জায়গা। (আন নিসাঃ115)
এ আয়াতটি সুন্নাতের কুরআনী দলীল সমূহের অন্যতম। যে হেদায়াতের সুস্পষ্ট প্রতিভাত হয়ে উঠার কথা এখানে বলা হয়েছে মূলত তা-ই ‘সুন্নাত’। এ সুন্নাতই হেদায়াতের একমাত্র রাজপথ। কেননা আল্লাহর কালাম ও আল্লাহর অস্পষ্ট ওহী (ওহীয়ে খফী) অনুযায়ীই তাঁর কথা ও কাজের মাধ্যমে সুন্নাতের এ আদর্শকেই তিনি উদ্ভাসিত করে তুলেছিলেন। রাসূলের তৈরি সমাজের মুমিনগণ এই পথ অনুসরণ করেই চলতেন। এখন যদি কউ রাসূলের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে, রাসূলের আদর্শ অনুসরণ করে চলতে প্রস্তুত না হয়, আর এ জন্যে মুমিন সমাজের অনুসৃত আদর্শকে বাদ দিয়ে অপর কোনো আদর্শকে অনুসরণ করে চলে, তবে তার পরিণাম জাহান্নাম ছাড়া আর কিছু নয়। অতএব রাসূলের ‘সুন্নাত’কে অনুসরণ করে চলাই কল্যাণ ও মুক্তিলাভের একমাত্র উপায়।
হাদীসে নবী করীমের ভাষায় ‘সুন্নাত’ কেই বলা হয়েছে ‘আল-আমর’। হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর বর্ণিত একটি হাদীসে বলা হয়েছে, নবী-করীম (স) ঘোষণা করেছেনঃ
আরবী(*********)
যে লোক আমার এই জিনিসে এমন কোনো জিনিস নতুন শামিল বা উদ্ভাবন করবে, যা মূলত এই জিনিসের অন্তর্ভূক্ত নয়, তা-ই প্রত্যাহৃত হবে।
এই হাদীসে ‘আমর’(অমর) বলে বুঝিয়েছেন মূল দ্বীন ইসলামকে, যা নবী করীম (স) দুনিয়ায় উপস্থাপিত করেছেন। কেননাঃ এই দ্বীন-ইসলামই তাঁর কর্মনীতি এবং তাঁর মান-মর্যাদা ও অবস্থার সাথে পূর্ণ সম্পৃক্ত।
আল্লামা কাজী ইয়াজ এ হাদীসের অর্থ বলেছেন এ ভাষায়ঃ
যে লোক ইসলামে এমন কোনো মত বা রায় প্রবেশ করাবে-ইসলামী বলে চালিয়ে দেবে, যার অনুকুলে কুরআন ও হাদীসে কোনো স্পষ্ট প্রকাশ্য বা প্রচ্ছন্ন কিংবা প্রকাশযোগ্য কোনো সনদ বর্তমান নেই, তাই প্রত্যাহারযোগ্য। আর এ জিনিসেরই অপর নাম ‘ বিদয়াত’। উপরোক্ত হাদীসে রাসূলে করীম (স) ‘আমার এই ব্যাপারে’ বলে ইসলামকেই বুঝিয়েছেন। এতে প্রমাণিত হলো যে, রাসূলের দৃষ্টিতে এ দ্বীন এক পরিপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ ও পূর্ণ পরিমত দ্বীন এবং তা সর্বজন পরিচিত, ব্যাপক প্রচারিত ও অনুভবযোগ্য মাত্রায় সর্বদিকে প্রকাশিত। এ দ্বীন বা দ্বীনের কোনো মৌলিক খুঁটিনাটি দিকও কোনো দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তির নিকট অজ্ঞাত, অপরিচিত বা লুকায়িত নেই। এখন কেউ যদি এতে দ্বীন বহির্ভূত কোনো বিষয় বৃদ্ধি করতে চায়, কোনো অ-দ্বীনি ব্যাপার বা কাজকে ‘দ্বীনি’ বলে চালিয়ে দিতে চায়, তাহলে সেতো গোটা দ্বীনকেই বিনষ্ট করে দিবে। কেননা সে তো মূল দ্বীনকেই আদৌ চিনতে বা বুঝতে পারেনি। এ জন্য বিদয়াতের পরিচয় দান করতে গিয়ে আল্লামা কান্দেলভী লিখেছেনঃ বিদয়াত বলতে বোঝায় এমন জিনিস, যা দ্বীনের ক্ষেত্রে অভিনব, শরীয়তে যার কোনো ভিত্তি নেই, মৌলিক সমর্থন নেই। শরীয়তের পরিভাষায় তারই নাম হচ্ছে বিদয়াত।
‘বিদয়াত’ এর এ সংজ্ঞা হতে স্পষ্ট জানা গেল যে, ব্যবহারিক জীবনের কাজে কর্মে ও বৈষয়িক জীবন যাপনের নিত্য নতুন উপায় উদ্ভাবন এবং নবাবিষ্কৃত যন্ত্রপাতি নির্মাণের সঙ্গে শরীয়তী বিদয়াতের কোনো সম্পর্ক নেই। কেননা তার কোনোটিই ইবাদত হিসেবে ও আল্লাহর কাছে সওয়াব পাওয়ার আশায় করা হয়না। অবশ্য এ পর্যায়েও শর্ত এই যে, তার কোনোটিই শরীয়তের মূল আদর্শের বিপরীত হতে পারবেনা। অনুরূপভাবে যেসব ইবাদত নবী করীম(স) কিংবা সাহাবায়ে কিরাম(রা) হতে কথার কিংবা কাজের বিবরণ এর মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে ও ইশারা ইঙ্গিতে প্রমাণিত, তাও বিদয়াত নয়। এই সঙ্গে এ কথাও জানা গেল যে, নবী করীম(স) এর জমানায় যে কাজ করার প্রয়োজন হয়নি; কিন্তু পরবর্তীকালে কোনো দ্বীনি কাজের জন্য দ্বীনি লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যেই তা করার প্রয়োজন দেখা দিবে, তা করাও বিদয়াত পর্যায়ে গণ্য হতে পারেনা। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, প্রচলিত নিয়মে মাদ্রাসা শিক্ষা ও প্রচারমূলক সংস্থা ও দ্বীনি প্রচার বিভাগ কায়েম করা, কুরআন হাদীস বুঝাবার জন্যে আরবী ব্যাকরণ রচনা বা ইসলাম বিরোধীদের জবাব দেবার জন্য যুক্তিবিজ্ঞান ও দর্শন রচনা, জিহাদের জন্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, যন্ত্রপাতি ও আধুনিক যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষাদান, দ্রুতগামী ও সুবিধাজনক যানবাহন ব্যবহার এসব জিনিস এক হিসেবে ইবাদতও বটে যদিও এগুলো রাসূলে করীম(স) এবং সাহাবায়ে কিরামের যুগে বর্তমান রূপে প্রচলিত হয়নি। তা সত্ত্বেও এগুলোকে বিদয়াত বলা যাবেনা। কেননা এসবের এভাবে ব্যবস্থা করার কোনো প্রয়োজন সেকালে দেখা দেয়নি। কিন্তু পরবর্তীকালে এর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে বলেই তা করা হয়েছে এবং তা দ্বীনের জন্যই জরুরী। আর সত্য কথা এই যে, এসবই সেকালে ছিল সেকালের উপযোগী ও প্রয়োজনীয় রূপে ও ধরনে। তাই আজ এর কোনোটিই ‘বিদয়াত’ নয়।
এসব সম্পর্কে এ কথাও বলা চলে যে, এগুলো মূলত কোনো ইবাদত নয়। এগুলো করলে সওয়াব হয়, সে নিয়তেও তা কউ করেনা। এগুলো হলো ইবাদতের উপায়, মাধ্যম বা ইবাদতের পূর্বশর্ত। তার মানে এগুলো এমন নয়, যাকে বলা যায় ‘দ্বীনের মধ্যে নতুন জিনিসের উদ্ভাবন।’ এবং এগুলো হচ্ছে –‘দ্বীনি পালন ও কার্যকরকরণের উদ্দেশ্যে নবোদ্ভাবিত জিনিস।’ আল কুরআন ও হাদীসের নিষিদ্ধ হলো দ্বীনের ভিতর দ্বীনরূপে নতুন জিনিস উদ্ভাবন করা। দ্বীনের বাস্তবায়নের জন্য নতুন জিনিস উদ্ভাবনতো নিষিদ্ধ নয় আদৌ। কাজেই এ জিনিসকে না বিদয়াত বলা যাবে, না তা অবশ্যই অপরিহার্য বলে বিবেচিত হবে।
কুরআনের আয়াত- আরবী(*********)
-যারা নিজেদের দ্বীনের মূলকে নানাভাগে ভাগ করে নানা দিকে যাওয়ার পথ বের করেছে এবং নানা দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, তাদের সাথে আপনার-হে নবী –কোনোই সম্পর্ক নেই।
এ আয়াতের তাফসীরে আল্লামা খাজেন লিখেছেন, হযরত আবু হুরায়রার বর্ণনা অনুযায়ী এখানে বলা হয়েছে, এ উম্মতে মুসলিমার গোমরাহ লোকদের কথা। আর অপর এক হাদীস অনুযায়ী নবী করীম(স) বলেছেন, এ আয়াতে মুসলিম উম্মতের বিদয়াতপন্থী, সংশয়বাদী ও পথভ্রষ্ট লোকদের কথাই বলা হয়েছে।
এ আলোচনার ফলে প্রমাণিত হয় যে, নবী করীম(স) যে দ্বীন আল্লাহর নিকট হতে লাভ করেছেন, যা তিনি নিজে বাস্তব জীবনে অনুসরণ করে চলেছেন এবং যা তিনি জনগণের সামনে উপস্থাপিত করেছেন ও অনুসরণ করে চলতে বলেছেন, এক কথায় একটি পরিভাষা হিসেবে তা-ই হচ্ছে সুন্নাত। আর তার বিপরীত যা কিছু-আকীদা, বিশ্বাস, আমল ও চরিত্র তা যে কোনো ক্ষেত্রেই হোক তা-ই হলো ‘বিদয়াত’। এ দৃষ্টিতে ‘সুন্নাত’ ও ‘বিদয়াত’ দুটি পরস্পর বিপরীত, পরস্পর বিরোধী মতাদর্শ, সম্পূর্ণ বিপরীতমূখী চিন্তা-বিশ্বাস, জীবনধারা ও জীবন ব্যবস্থা। এ দুটো সরলরেখার মতো পরস্পর বিপরীতদিকে ধাবিত। যা সুন্নাত তা বিদয়াত নয়; যা বিদয়াত তা সুন্নাত নয়। অনুরূপভাবে সুন্নাত কখনো বিদয়াত হতে পারেনা এবং বিদয়াত কোনোরূপেই এবং কারো কথাতেই সুন্নাতরূপে গৃহীত হতে পারেনা।
কুরআনে সুন্নাতের প্রমাণ
কুরআন মজীদে রাসূলে করীম(স) সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছেঃ
يَأْمُرُهُم بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنكَرِ
-তিনি ‘মারুফ’ কাজের আদেশ করেন এবং ‘মুনকার’ কাজের নিষেধ করেন।
(আল আরাফঃ157)
এই ‘মারুফ’ ও ‘মুনকার’ বলতে কি বোঝায়, সে বিষয়ে তাফসীরকারকগণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এক ব্যাখ্যা অনুযায়ী ‘মারুফ’ বলতে ‘সুন্নাত’ ও ‘মুনকার’ বলতে ‘বিদয়াত’কে বোঝানো হয়েছে। আল্লামা হাদ্দাদী তাঁর তাফসীরে লিখেছেনঃ ‘মারুফ’ হচ্ছে ‘সুন্নাত’ আর ‘মুনকার’ হচ্ছে ‘বিদয়াত’।