সমাজে নারীদের প্রাধান্যও বিদয়াত
ইসলামী সমাজে নারীর মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত, কুরআন দ্বারা ঘোষিত এবং রাসূলে করীম(স) দ্বারা বাস্তবায়িত। তাতে নারীদের নারী হিসেবে মর্যাদা ও অধিকার পুরোপুরি স্বীকৃত। কিন্তু নারীদের মর্যাদা পুরুষের ওপরে নয়, নীচে-প্রথম নয়, দ্বিতীয়- নিরংকুশ নয়, শর্তাধীন।
এ পর্যায়ে কুরআনের ঘোষণাঃ
الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ وَبِمَا أَنفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ ۚ
–পুরুষগণ নারীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ কতক মানুষকে অপর কতক মানুষের ওপর অধিক মর্যাদা দিয়েছেন এই নিয়মের ভিত্তিতে এবং এজন্যও যে, পুরুষরাই তাদের ধন সম্পদ নারীদের জন্য ব্যয় করে।(আন নিসাঃ৩৪)।
নারীদের তুলনায় পুরুষদের মর্যাদা অধিক হওয়ার একটি কারণ স্বাভাবিক গুণ-বৈশিষ্ট্য-বিশেষত্ত্ব। আর দ্বিতীয়, পরিবার পরিচালনা ও আর্থিক প্রয়োজন পূরণের জন্য নারীদের তুলনায় পুরুষরাই দায়ী-তারাই তা করে থাকে। এটাই পারিবারিক জীবনে ক্ষুদ্র সংকীর্ণ পরিসরে এবং বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সুষ্ঠুতা ও শৃঙ্খলা বিধানের জন্য কার্য্কর নিয়ম। এর ব্যতিক্রম হলে সামাজিক শৃঙ্খলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে বাধ্য। তাই রাসূলে করীম(স) বলেছেনঃ আরবী(********)
-আমার পরে আমার উম্মতের জন্য সর্বাধিক ক্ষতিকর ফিতনা পুরুষদের ওপর আসতে পারে নারীদের প্রাধান্যের কারণে।
নারী প্রাধান্যের কারণেই বহু সমাজ ও রাষ্ট্র বিপর্য্স্ত হয়েছে; ইতিহাসই তার অকাট্য প্রমাণ।
হযরত আবু বকর(রা) নবী করীম(স) এর এ কথাটি বর্ণনা করেছেনঃ যে জনসমষ্টি তাদের সামষ্টিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ও কর্তৃত্ব কোনো নারীকে অর্পণ করবে, তারা কখনোই কোনো কল্যাণ লাভ করতে পারবেনা।
আরও বর্ণিত হয়েছেঃ আরবী(***********)
-পুরুষই যখন নারীদের আনুগত্য করতে থাকে, মনে করো তখনই পুরুষরা ধ্বংসের মধ্যে পড়ে গেছে।
এ কথার সত্যতা যেমন বর্তমান পাশ্চাত্য সমাজের অবস্থা প্রমাণ করে, তেমনি আমাদের এতদ্দেশীয় সমাজ ও পরিবারে অবস্থা থেকেও তার সত্যতা প্রমাণিত হয়। নারীকে যদি নৌকার হাল ধরতে দেয়া হয়, ড্রাইভারকে বসিয়ে যে ড্রাইভিং জানেনা বা যোগ্যতা নেই তাকে মোটর চালনা করতে দিয়ে যে অবস্থা দেখা দেয়, স্বাভাবিক নারী প্রাধান্যের পরিণতিও তা-ই হবে। এটা সুন্নাতে রাসূলের পরিপন্থী। (এটাই সাধারণ সত্য। ব্যতিক্রম থাকা অসম্ভব নয়)।
পোশাক পরিচ্ছদ এর বিদয়াত
আমাদের দেশে বর্তমানে ‘সুন্নাতী লেবাস’ বলে এক ধরনের বিশেষ কাটিং ও বিশেষ পরিমাণের লম্বা কোর্তা পরিধান করা হচ্ছে। প্রচার করা হচ্ছে যে, এই হচ্ছে সুন্নাতী পোষাক। আর এ সুন্নাতী পোষাক যে না পরবে সে ফাসিক বলে বিবেচিত হবে এবং এমন লোক যদি আলিম হয়, তাহলে তার পিছনে নামায পড়া জায়েয হবেনা। এ কারণে সমাজের এক বিশেষ শ্রেণীর লোক-আলিম ও পীরগণ এ ধরনের কোর্তা পরাকেই সুন্নাত মনে করেন, ‘সুন্নাতী পোশাক’ বলেই তারা এর প্রচারও করেন। শুধু নিজেরাই তা পরিধান করেননা, তাঁদের ছাত্র ও মুরীদানকেও অনুরূপ কাটিং ও লম্বা মাপের কল্লিদার কোর্তা পরিধান করতে বাধ্য করে থাকেন।
কিন্তু প্রশ্ন এই যে, সুন্নাতী পোশাক বলতে কি বোঝায়, কোনো বিশেষ কাটিং বা বিশেষ লম্বা মাপের জামা পরা কি সত্যিই সুন্নাত? সে সুন্নাত কোন দলীলের ভিত্তিতে প্রমাণিত হলো? কুরআন থেকে? হাদীস থেকে? কুরআন ও হাদীসের আলোকে আমরা বিষয়টিকে বুঝতে চেষ্টা করবো।
পোশাক কি রকম হতে হবে সে সম্পর্কে কুরআন মজীদে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আয়াত হলো এই।
يَا بَنِي آدَمَ قَدْ أَنزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُوَارِي سَوْآتِكُمْ وَرِيشًا ۖ وَلِبَاسُ التَّقْوَىٰ ذَٰلِكَ خَيْرٌ ۚ ذَٰلِكَ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ [٧:٢٦]
-হে আদম সন্তান! নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের জন্য এমন পোশাক(পরিধানের বিধান)নাযিল করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থানকে ঢেকে রাখবে এবং যা হবে ভূষণ। আর তাকওয়ার পোশাক, তা-ই কল্যাণময়। এ হচ্ছে আল্লাহর আয়াতসমূহের অন্যতম; এবং বলা হচ্ছে এই আশায় যে, তারা নসীহত কবুল করবে।(আল আরাফঃ২৬)
এ আয়াত থেকে কয়েকটি মৌলিক কথা জানতে পারা যায়। প্রথম এই যে, পোশাক মানুষের জন্য আল্লাহ তা‘আলার এক বিশেষ দান। অতএব পোশাক সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সে পোশাক কি রকমের হতে হবে; সে বিষয়ে এ আয়াত থেকে দু’টো কথা জানতে পারা যায়।
একটি হলো, পোশাক এমন হতে হবে যা অবশ্যই মানুষের লজ্জাস্থানকে আবৃত করে রাখবে। যে পোশাক মানুষের লজ্জাস্থানকে আবৃত করেনা, তা মানুষের পোশাক হতে পারেনা। আর দ্বিতীয় কথা হলো, সে পোশাককে ‘ভূষণ’ হতে হবে।(رِيش শব্দের মানে হলো উজ্জ্বল্য, চাকচিক্য, শোভাবর্ধক। আভিধানিকদের মতে رِيش শব্দের আসল অর্থ হলো পাখির পালক যা চাকচিক্যময় ও শোভাবর্ধক হয়ে থাকে। আর মানুষের পোশাকও যেহেতু পাখির পক্ষ ও পালকের মতোই, এ কারণে মানুষের পোশাক বাহ্যত কেমন হবে তা বোঝাতে رِيش শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।) পোশাক পরলে যেন দেখতে মানুষকে ভালো দেখায়, বদসুরত যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল করতে হবে। বস্তুত পোশাকই মানুষের সৌন্দর্য্ বৃদ্ধি করে, পোশাকের মাধ্যমে মানুষের সৌন্দর্য্ বোধ, ভদ্রতা, শালীনতা ও রুচি-সুস্থতা প্রমাণিত হয়। আর পোশাক যদি সে রকম না হয়, তা হলে আল্লাহর দেয়া এক সুন্দর ব্যবস্থাকে অবজ্ঞা করা হবে, হবে আল্লাহর নাশোকরী।(নতুন পোশাক পরে যে দো‘আটি পড়তে রাসূলে করীম(স) বলেছেন তা হলোঃ ‘প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি আমাকে এমন পোশাক পরিয়েছেন, যা দ্বারা আমি লজ্জাস্থান আবৃত করি এবং আমার জীবনে শোভা ও সৌন্দর্য্ লাভ করি।’ এ দো‘আতে ও সেই ছতার ঢাকা এবং প্রশংসা লাভের লক্ষ্যের কথাই বলা হয়েছে, পোশাক পড়ার মূলে অন্য কোনো উদ্দেশ্য নাই। এ ঠিক কুরআনের আয়াতেরই ব্যাখ্যা যেন।)
এর সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, ভূষণ ও শোভার ব্যাপারে মানুষের রুচি পরিবর্তনশীল এবং স্থান, কাল ও মানসিক অবস্থার দৃষ্টিতে রুচির ক্ষেত্রে অনেক পার্থক্য ও পরিবর্তন সূচিত হতে পারে। অতএব কুরআনের মতে পোশাকের ধরণ ও কাটিং পরিবর্তনশীল। কোনো ধরাবাঁধা কাটিং এর পোশাক ইসলামী পোশাক বলে অভিহিত হতে পারেনা।
এ আয়াতের তৃতীয় কথা হলোঃ তাকওয়ার লেবাস। তাকওয়ার লেবাস কাকে বলে এ বিষয়ে বিভিন্ন মত দেখা যায়। কাতাদাহ বলেছেন, ‘লেবাসুত-তাকওয়া’ বলে এখানে ঈমান বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ পূর্বোক্ত দুটি পরিচয়সহ পোশাক পরতে হবে, কিন্তু এ ব্যাপারে সর্বাধিক কল্যাণময় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ঈমানকে তাজা রাখা, সঠিকরূপে বহাল রাখা। হাসান বসরী এর মানে বলেছেনঃ লজ্জা, লজ্জাশীলতা, শালীনতা। কেননা, এই লজ্জাশীলতা ও শালীনতাই মানুষকে তাকওয়া অবলম্বন করতে উদ্বুদ্ধ করে। ইবনে আব্বাস(রা) বলেছেন- তা হলো, নেক আমল। ওসমান ইবনে আফফান(রা) বলেছেন, তা হলো নৈতিক পবিত্রতা।
আর আয়াতের মানে হলোঃ তাকওয়ার পোশাক ভালো-কল্যাণময়, যদি তা গ্রহণ করা হয় আল্লাহর সৃষ্ট পোশাক ও সৌন্দর্য্ ব্যবস্থা থেকে।
মোটকথা, পোশাককে প্রথমে লজ্জাস্থান আবরণকারী হতে হবে। এজন্যে নারী ও পুরুষের পোশাকে মৌলিকভাবে পার্থক্য হতে বাধ্য এ কারণে যে, পুরুষের লজ্জাস্থান এবং নারীদেহের লজ্জাস্থানের পরিধির দিক দিয়ে পার্থক্য রয়েছে। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, তা অবশ্যই ভূষণ বা শোভাবর্ধক ও সৌন্দর্য্ প্রকাশক হতে হবে। যে পোশাক মানুষের আকার-আকৃতিকে কিম্ভূতকিমাকার বা বীভৎস করে দেয়, চেহারা বিকৃত করে দেয়, সে পোশাক কুরআন সমর্থিত পোশাক নয়, কোনো মুসলমানের পক্ষেই তা ব্যবহারযোগ্য হতে পারেনা।
এই পর্যায়ে কুরআন মজীদ থেকে দ্বিতীয় যে আয়াতটি উদ্ধৃত করা যায় তা হলো এইঃ
قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ
-বলো হে নবী! আল্লাহর সৌন্দর্য্- যা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য বের করেছেন- তা কে হারাম করে দিলো? (আল আরাফঃ৩২)
‘আল্লাহর সৌন্দর্য্’ মানে মানুষের জন্য আল্লাহর সৃষ্টি করে দেয়া সৌন্দর্যের সামগ্রী, আর তা হলো্ পোশাক ও অন্যান্য সৌন্দর্যের উপাদান, সৌন্দর্য্ বৃদ্ধিকারী জিনিসপত্র। অর্থাৎ পোশাক ও সৌন্দর্য্ বৃদ্ধিকারী দ্রব্যাদি তো আল্লাহরই সৃষ্টি এবং তিনি তা সৃষ্টি করেছেন তাঁর বান্দাদের জন্য। তিনি তা ভোগ ব্যবহার করার জন্যই বানিয়েছেন, মূলগতভাবেই তা সকলের জন্য জায়েয। এ জায়েয জিনিসকে কে হারাম করে দিতে পারে? আল্লাহর সৃষ্টি জিনিসকে হারাম করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। আর তিনিই একে হালাল করে দিয়েছেন-শুধু একে হালাল-ই করে দেননি, তা গ্রহণ ও ব্যবহার করার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি এই বলেঃ
আরবী(*******)
-তোমাদের সৌন্দর্য্ বৃদ্ধিকারী জিনিস- পোশাক- তোমরা তা গ্রহণ করো প্রতি নামাযের সময়।
এ আয়াতেও সেই পোশাক গ্রহণের কথাই বলা হয়েছে যা হবে জিনাত, শোভামন্ডিত, সৌন্দর্য্ বৃদ্ধিকারী। অতএব পোশাক গ্রহণের ব্যাপারে কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী মূলগতভাবে তিনটি জিনিসের দিকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবেঃ প্রথমত লজ্জাস্থান আবরণকারী, দ্বিতীয় ভূষণ, শোভাবর্ধনকারী এবং তৃতীয় সে পোশাক শালীনতাপূর্ণ হতে হবে, লজ্জাশীলতার অনুভূতির প্রতীক হতে হবে, নির্লজ্জতাব্যঞ্জক হবে না তা।
কুরআন মজীদে পোশাক সম্পর্কে যে হেদায়াত পাওয়া যায়, তা এই। এছাড়া কুরআন থেকে পোশাক পর্যায়ে আর কিছু জানা যায়না। কুরআন থেকে যা জানা গেল, তাতে কিন্তু পোশাকের কাটিং, ধরন, আকার ও পরিমাণ দৈর্ঘ্য প্রস্থ সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি।
অতঃপর দেখতে হবে, এ বিষয়ে হাদীস থেকে কি জানা যায়। সর্বপ্রথম বুখারী শরীফের ‘কিতাবুল লিবাস’ এ উদ্ধৃত হাদীস লক্ষ্যণীয়। নবী করীম(স) বলেছেনঃ আরবী(********)
-তোমরা খাও, পান করো, পোশাক পরো এবং দান-খয়রাত করো। (আর এসব কাজ করবে দুটো শর্তে) না বেহুদা খরচ করবে, না অহংকারের দরুণ করবে।
খাওয়া, পান করা, পোশাক পর এবং দান খয়রাত করা সম্পর্কে রাসূলে করীমের এ নির্দেশ। এ কাজ অবাধ ও উন্মুক্ত-কেবলমাত্র দুটো শর্তের অধীন। একটি হলো, এর কোনোটিই বেহুদা বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘনকারী হবেনা। আর দ্বিতীয় হচ্ছে অহংকারের বশবর্তী হয়ে একাজগুলো করবেনা। বাঞ্চনীয় নয় এমন এমন পরিমাণ অতিরিক্ত ব্যয় করাই হলো ‘ইসরাফ’। আর অহংকার করা, খুব বেশী দামী পোশাক এবং বাহদুরী ও বড়মানুষী প্রকাশ হয় যে পোশাকে তা নিষিদ্ধ। আর পোশাক পর্যায়ে আমাদের জন্য হেদায়াত এই যে, প্রথম বেহুদা খরচ হয় যে পোশাকে, যে ধরনের যে পরিমাপের পোশাক, তা পরিধান করা সুন্নাতের খেলাফ। পোশাককে অবশ্যই এ থেকে মুক্ত হতে হবে। আর দ্বিতীয়ত গৌরব অহংকারবশত কোনো পোশাক পরা এবং যে ধরনের, যে আকারের ও যে পরিমাপের পোশাক পরলে গৌরব-অহংকার, বড় মানুষী ও বাহাদুরী প্রকাশ পায়, যা মানুষকে সাধারণ মানুষ থেকে স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট করে দেয়, তা পরা যাবেনা। তা পরলে হবে সুন্নাতের বিপরীত কাজ। অতএব ব্যয় বাহুল্য ও অহংকার বিবর্জিত যে কোনো আকারের, প্রকারের ধরনের, কাটিং এর এবং পরিমাপের পোশাকই সুন্নাত অনুমোদিত পোশাক। সুন্নাতী লেবাস তাই, যা হবে এরূপ। হযরত ইবনে আব্বাস(রা) বলেছেনঃ আরবী(*****)
-তুমি খাও, যা-ই চাও, তুমি পরো যাই তোমার ইচ্ছা, যতক্ষণ পর্য্ন্ত দুটো জিনিস থেকে তুমি ভুলে থাকবেঃ ব্যয় বাহুল্য বেহুদা খরচ ও গর্ব অহংকার প্রকাশক বস্ত্র।
অর্থাৎ এ দুটো বিকার থেকে মুক্ত যে কোনো পোশাকই হাদীস মোতাবিক পোশাক এবং তা পরা সম্পূর্ণ জায়েয। আকার, ধরন, কাটিং ও লম্বা খাটোর ব্যাপারে হাদীস কোনো বিশেষ নির্দেশ দেয়নি, আরোপ করেনি কোনো বাধ্যবাধকতা।
বুখারী শরীফেই এরপর যে হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে, তা হলো এইঃ
আরবী(*********)
-নবী করীম(স) বলেছেনঃ আল্লাহ এমন কোনো ব্যক্তির দিকে রহমতের দৃষ্টি দিবেননা, সে আল্লাহর রহমত থেকে হবে বঞ্চিত।
মনে রাখতে হবে, এ হাদীস থেকে জামা কাপড়ের আকার, কাটিং বা দৈর্ঘ্য সম্পর্কে কোনো হেদায়াত পাওয়া যাচ্ছেনা। শুধু মানসিক ব্যাপারেই নির্দেশ করা হয়েছে। কাপড় পরার বাহ্যিক ধরণ কি হবে, কি না হবে তা-ই বলা হয়েছে। আর অহংকারের ভাব নিয়ে যাই করা হবে, যেভাবেই অহংকার প্রকাশ পাবে, তা-ই নিষিদ্ধ হবে।
অতঃপর বুখারী শরীফের সব কয়টি হাদীসই আপনি পড়ে যান, কোনো একটি হাদীসেও পোশাক সম্পর্কে বিশেষ কোনো কাটিং বা পরিমাপ গ্রহণের নির্দেশ পাবেননা। তবে হাদীস থেকে এ কথা জানা যায় যে, নবী করীমের কোর্তার আস্তিন বা হাত ছিল খুবই সংকীর্ণ। তা থেকে এখানকার চুরিদার আস্তিনের জামা পরা জায়েয প্রমাণিত হয়। নবী করীম(স) যে কামীস পরতেন তা কতখানি লম্বা ছিল? একটি হাদীস থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, তা খুব লম্বা ছিলনা। হাদীসটির ভাষা এইঃ আরবী(*********)
-নবী করীমের কামীস সাধারণত সূতীর কাপড় দিয়ে তৈরী হতো এবং তার ঝুল খুব কম হতো ও আস্তিন চুরিদার হতো।
এ থেকে অকাট্যভাবে জানা গেল যে, যারা বলে বেড়ায় যে, নবী করীম(স) অর্ধেক নলা পর্য্ন্ত ঝুল কোর্তা পরেছেন, তারা বানানো মিথ্যা কথা বলেছেন। সত্য কথা হলো তিনি লুংগী পরলে খাটো কোর্তা পরিধান করতেন।
তিরমিযী শরীফে পোশাক পর্যায়ে যে হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে, তার মধ্যে ও প্রথম হাদীস হলো এইঃ
আরবী(*******)
-নবী করীম(স)বলেছেনঃ আমার উম্মতের পুরুষ লোকদের জন্য রেশমের পোশাক ও স্বর্ণ হারাম করা হয়েছে, আর মেয়েদের জন্য হালাল করা হয়েছে।
অর্থাৎ পুরুষদের জন্য রেশমী পোশাক হারাম।
এছাড়া মুসনাদে আহমদ এর একটি হাদীস থেকে পরিধেয় বস্ত্রের ঝুল কতখানি হওয়া উচিত সে বিষয়ে একটা সুস্পষ্ট ধারণা মেলে। হযরত আবু হুরায়রা(রা) বর্ণনা করেনঃ আরবী(*********)
-ঈমানদার লোকদের ইজার পায়ের দুই নলার মাঝ বরাবর ঝুলতে পারে। এর নীচে যেতে পারে পায়ের গিরা ওপর পর্য্ন্ত। এর নীচে গেলে তা হবে জাহান্নামে যাওয়ার কাজ।
হাদীসে ইজার শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর মানে পরিধেয় বস্ত্র, যা কোমরের নীচের দিক ঢাকার জন্য ব্যবহৃত হয়। তা লুঙ্গি হতে পারে, পাজামা হতে পারে, হতে পারে আজকালকার পোশাক প্যান্ট বা অন্য কিছু। এগুলো ঝুল হাঁটু হতে গিরা পর্য্ন্তকার মাঝ বরাবর ‘নিসফে সাক’ পর্য্ন্ত হতে পারে। ‘নিসফে সাক’ এর নীচে পায়ের গীরা পর্য্ন্ত ও ঝুলতে পারে; কিন্তু এর নীচে গেলে তা জায়েয হতে পারেনা।
নবী করীম(স) এর এ পর্যায়ের হাদীসসমূহকে ভিত্তি করে হযরত ইবনে উমর(রা) বলেনঃ আরবী(*******)
-রাসূলে করীম(স) ইজারকে পায়ের গীরার নীচে ঝুলবার ব্যাপারে যে আযাবের কথা বলেছেন, তা-ই তিনি বলেছেন কামীস এর ব্যাপারেও।
‘কামীস’ হলো গাত্রাবরণ, শরীরের ঊর্ধ্বভাগ ঢাকার জন্য যাই পরিধান করা হয়, তাই কামীস তার কাটিং বা ধরন যাই হোকনা কেন। তা এখনকার পাঞ্জাবী, শার্ট, কোর্ট বা কল্লিদার জামা-যে কোনোটাই হতে পারে। তার কাটিং কি হবে, সে বিষয়ে হাদীস কিছুই বলছেনা। বলছে শুধু এ কথা যে, তা যেনো এতদূর লম্বা না হয় যে, তদ্দারা পায়ের গিরাও ঢেকে যায়। হযরত ইবনে উমরের কথা থেকে স্পষ্ট জানা গেল যে, পায়ের গিরার নিচে ইজার বা কামীস যাই ঝুলবে, তাই হারাম হবে। মনে রাখতে হবে যে, তদানীন্তন আরব সমাজে সাধারণত একখানা কাপড় দিয়ে শরীরের ওপরভাগ হতে হাটুর নীচের ভাগ পর্য্ন্ত ঢেকে ফেলত। এমনকি বর্তমানেও আরবদের পোশাক এরকমই। নীচে ছোটো-খাটো একটা পরে, আর তার ওপর দিয়ে পায়ের গিরা পর্য্ন্ত লম্বা একটা জামা পরে-এই হলো এখনকার আরবদের সাধারণ পোশাক। এর কোনোটিকেই যে নীচের দিকে ঝুলিয়ে দিয়ে পায়ের গিরা ঢেকে ফেলা যাবেনা তাই বলা হচ্ছে এইসব হাদীসে। বস্তুত ‘নিসফে সাক’ বলতে কোনো কিছুর উল্লেখ বা থাকলে তা হলো এই।
কিন্তু একটা লুঙ্গি বা পাজামা পরা সত্ত্বেও ‘নিসফে সাক’-নলার মাঝ বরাবর পর্য্ন্ত একটি কোর্তাও ওপর থেকে ঝুলে পড়তে হবে এবং এরূপ কোর্তা পরা সুন্নাত হবে-একথা কোথ্থেকে জানা গেল? কুরআন থেকে নয়, হাদীস থেকেও নয়। আর কুরআনও হাদীস থেকে যা প্রমাণিত নয়, তা ফিকাহর কিতাব থেকেও প্রমাণিত হতে পারেনা। বর্তমান আরবদের রেওয়াজ থেকেও তা প্রমাণিত নয়। অতএব বর্তমানে এক শ্রেণীর আলিম ও পীর সাহেবানদের ‘সুন্নাতি লেবাস’ বলে চালিয়ে দেয়া ‘নলার অর্ধেক পর্য্ন্ত’ লম্বা কল্লিদার কোর্তা শরীয়তের মূল দলীল থেকে প্রমাণিত জিনিস নয়। এ হলো সম্পূর্ণ মনগড়া এক জিনিস। আর শরীয়তের সুন্নাত রূপে প্রমাণিত নয়- এমন একটি পোশাককে ‘সুন্নাতি লেবাস’ বলে চালিয়ে দেয়া এক অতি বড় বিদয়াত(এ দেশের এক শ্রেণীর আলিম ও পীর সাহেবান যে পাজামা বা লুঙ্গির ওপর কল্লিদার নিসফে সাফ কোর্তা পরেন, তাকে ‘সুন্নাতী লেবাস’ বলা একটা মনগড়া কথা। এ পোশাককে বড়জোর এতদ্দেশীয় পরহেযগার আলিম ও পীর সাহেবানদের পছন্দনীয় পোশাক-লিবালুস ওলামা-বলা যেতে পারে মাত্র)। তা বিদয়াত এজন্যেও যে, তাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ হয়। আর বেহুদা খরচ থেকে দূরে থাকা পোশাকের ব্যাপারে প্রথম শর্ত। বর্তমানে এই বিদয়াত চালু হয়ে রয়েছে সমাজের একশ্রেণীর জনগণের মাঝে। তারা মনে করছে ‘সুন্নাতী পোশাক পরছি আমরা; রাসূলের পায়বরী করছি আমরা, সে কথা এই লোকদের খেয়ালেই আসেনা। বস্তুত এ চরম অন্ধত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমার এ দলীলভিত্তিক আলোচনায় এ পোশাকের প্রতি কোনো বিদ্বেষ প্রচার করা হয়নি, তা পরতে নিষেধও করা হয়নি। আমার বক্তব্য শুধু এতটুকু যে, শুধুমাত্র এ ধরনের পোশাককেই ‘সুন্নাতী পোশাক’ বলাটাই বিদয়াত। এ পোশাক শুধু পরাকে আমি বিদয়াত বলিনি- বিদয়াত বলতেও চাইনা।
স্বপ্নের ফয়সালা মেনে নেয়ার বিদয়াত
পীর সাহেবদের দরবারের সবচাইতে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, এখানে সব সময় স্বপ্নের রাজত্ব কায়েম হয়ে থাকে। কে কত বেশি এবং ভালো স্বপ্ন দেখতে পারে, মুরীদ-মুসাহিবদের মাঝে তা নিয়ে প্রবল প্রতিযোগিতা চলে। ফলে তাদের কেউ কেউ যে বানানো স্বপ্নও না বলে, এমন কথা জোর করে বলা যায়না। কেননা যে যত ভালো স্বপ্ন দেখবে এবং স্বপ্নযোগে হুজুর কিবলার বেলায়েত ও উচ্চ মর্যাদা প্রমাণ করতে পারবে, হুজুরের দোয়া ফায়েজ এবং স্নেহাশীষ সেই পাবে সবচাইতে বেশি। কাজেই এ দরবারে স্বপ্ন দেখতেই হবে;-স্বপ্ন না দেখে কোনো উপায় আছে? এ দরবারের লোকেরা চোখ বুঝলেই স্বপ্ন দেখতে পায়, স্বপ্ন যেন এদের জন্য এমন পাগল হয়ে বসে থাকে যে, যে কোনো সময়ই তা এদের চোখের সামনে ভেসে ওঠার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। তারা জেগে জেগেও স্বপ্ন দেখে অনেক সময় এবং তা হুজুর কিবলাকে খুশি করার জন্য সুন্দরভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে দরবারে পেশ করে। শুধু তা-ই নয়, শরীয়তের দৃষ্টিতে ভালো-মন্দ জায়েয নাজায়েয সম্পর্কেও এখানে স্বপ্ন দ্বারাই ফয়সালা গ্রহণ করা হয়। একজন হয়তো বললোঃ আমি অমুক হুজুরকে স্বপ্নে দেখেছি, তিনি এই কাজটি করতে নিষেধ করেছেন; অমনি সে কাজটি পরিত্যাগ করা হলো। কিংবা তিনি অমুক কাজ করতে বলেছেন। অতএব সঙ্গে সঙ্গে সে কাজ করতে শুরু করা হলো।
কেউ বললোঃ আমি নবী করীম(স)কে স্বপ্নে দেখেছি, তিনি আমাকে এ কাজটি করতে আদেশ করেছেন, আর অমনি সে কাজ করতে শুরু করে দেয়া হলো। কিংবা কোনো কাজ করতে নিষেধ করেছেন বলে তা বন্ধ করা হলো। এ ব্যাপারে শরীয়তের ফয়সালা যে কি, সে দিকে আদৌ তাকিয়েও দেখা হয়না; শরীয়ত কি বলে সে কথা জিজ্ঞেস করার কোনো প্রয়োজন তারা বোধ করেনা।
এভাবে স্বপ্নের ওপর নির্ভরতা, স্বপ্ন দ্বারা পরিচালিত হওয়া, স্বপ্নের ভিত্তিতে কোনো কাজ করা বা না করা পীর-পূজকদের নীতি, কোনো শরীয়তপন্থীর এ নীতি নয়। কেননা সাধারণ মানুষের স্বপ্ন-সত্যিকারভাবে যদি কেউ দেখেই –কোনো শরীয়তের বিধান হতে পারেনা। স্বপ্ন সত্য হতে পারে। কোনো স্বপ্ন যদি কেউ সত্যিই দেখে থাকে তবে তা থেকে সে নিজে কোনো আগাম সুখবর লাভ করবে, না হয় কোনো বিষয়ে সতর্কাবলম্বনের ইঙ্গিত পাবে। সে জন্যে তার উচিত আল্লাহর শোকর করা। কিন্তু এ স্বপ্ন দ্বারা ফরয-ওয়াজিব, হালাল হারাম ও জায়েয নাজায়েয কিংবা করণীয় কি, না করণীয় কি, তা প্রমাণিত হতে পারেনা। স্বপ্ন থেকে শরীয়তের অনুকূল কোনো কথা জানতে পারলে সে তো ভালোই; কিন্তু শরীয়তের বিপরীতে যদি কিছু জানা যায় তবে তা কিছুতেই অনুসরণ করা যাবেনা। করা যাবেনা এজন্য যে, শরীয়তের বিপরীত কারো কোনো হুকুম দেয়ার অধিকার নেই, স্বপ্নের কি দাম থাকতে পারে শরীয়তের মুকাবিলায়?
অবশ্য স্বপ্ন ইসলামের দৃষ্টিতে একেবারে ফেলবার বিষয় নয়- এ কথা ঠিক। স্বপ্নযোগে নবী করীম(স) এর দর্শন লাভ করা যায়, তাও হাদীস থেকে প্রমাণিত। কিন্তু প্রথম কথা হলো, স্বপ্নযোগে শয়তান যদি নবী করীমের নিজের বেশ নয়- যে কোনো একটি বেশ ধারণ করে তাকেই ‘নবী করীম’ বলে জাহির করে, তবে স্বপ্ন দ্রষ্টা কি করে বুঝতে পারবে যে এ প্রকৃত রাসূল নয়?
এ পর্যায়ে রাসূলে(স) এর হাদীসের ভাষা ও তাতে ব্যবহৃত শব্দগুলো লক্ষণীয়। হযরত আবদুল্লাহ(রা) নবী করীম(স) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেনঃ আরবী(*******)
-যে লোক স্বপ্নযোগে আমাকে দেখলো, সে ঠিক আমাকেই দেখলো। কেননা শয়তান আমার রূপ ও প্রতিকৃতি ধারণ করতে পারেনা। (তিরমিযী)।
শয়তান রাসূলের রূপ ও প্রতিকৃতি ধারণ করতে পারবেনা-বলে যদি কেউ স্বপ্নযোগে রাসূলে করীম(স)কে দেখল, তবে বিশ্বাস করতে হবে যে, সে ঠিক রাসূলকেই দেখেছে, অন্য কাউকে নয়-হাদীসের শব্দ ও ভাষা থেকে একথাই স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। কিন্তু এ শব্দ ও ভাষার ভিত্তিতেই দু’টো দিক এমন থেকে যায়-যার স্পষ্ট মীমাংসা হওয়ার প্রয়োজন। একটি হলো রাসূলে করীম(স) বলেছেনঃ যে লোক আমাকে দেখল, সে আমাকেই দেখল, কিন্তু যদি কেউ অন্য কাউকে দেখে এবং তার মনে ভ্রম হয় শয়তান ভ্রম জাগিয়ে দেয় যে, ইনি রাসূল(স) তাহলে কি হবে? এরূপ হওয়ার অবকাশ কি এ হাদীসের ভাষা থেকে বের হয়না?
দ্বিতীয় রাসূলে করীম(স) বলেছেনঃ শয়তান আমার রূপ ও প্রতিকৃতি ধারণ করতে পারেনা, কিন্তু শয়তান যদি অন্য কারো রূপ প্রতিকৃতি ধারণ করে স্বপ্ন দ্রষ্টার মনে এই ভ্রম জাগিয়ে দেয় যে, ইনি রাসূলে করীম তাহলে কি হবে?
এরূপ হওয়া সম্ভব কিনা এ হাদীসের স্পষ্ট ভাষার পরিপ্রেক্ষিতে? আমার মনে হয়, হাদীসে এই দুটো সম্ভাবনার পথ বন্ধ করে দেয়নি। এখানে এ সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই কথা বলা হচ্ছে। আল মাজেরী ও কাযী ইয়াজ প্রমুখ হাদীস বিশারদ এ হাদীসের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। (তিরমিযীর শরাহ‘তুহফাতুল আল ওয়াযী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৫৫৫ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)।
কাজেই স্বপ্ন দেখলেই তদনুযায়ী কাজ করতে হবে, ইসলামে এমন কথা অচল। আর দ্বিতীয় কথা হলো, নবী করীম(স) এর যা কিছু বলবার ছিল তা তো তাঁর জীবিত থাকাকালে সম্পূর্ণই বলে দিয়ে গেছেন, তাঁর জীবদ্দশয়াইতো দ্বীন পূর্ণতা লাভ করেছে। এখন নতুন করে তাঁর কিছুই বলবার থাকতে পারেনা। হালাল-হারাম, জায়েয-নাজায়েয বলে দেয়া নবীর দায়িত্ব। আর নবীর এ দায়িত্ব নবীর জীবন পর্য্ন্তই সীমাবদ্ধ। নবীর জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার পর এ পর্যায়ের কোনো দায়িত্বই থাকতে পারেনা তাঁর ওপর। আর শেষ নবীতো তাঁর জীবদ্দশাতেই ‘খাতামুন্নাবীয়ীন’ ছিলেন। নবীর জীবন শেষ হয়ে গেছে, তার পূর্বেই নব্যুয়তের দায়িত্ব পূর্ণরূপে পালিত হয়ে গেছে। অতঃপর স্বপ্নযোগে শরীয়তের কোনো নতুন বিধান দেয়ার প্রয়োজনই নেই। তাই স্বপ্নযোগে নবী করীম(স) কে দেখলেও এবং তার নিকট হতে কোনো নির্দেশ পেলেও তা পালন করার কোনো দায়িত্ব স্বপ্নদ্রষ্টারও নেই, নেই উম্মতের কোনো লোকেরও। দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণ। এখন বিশ্ব মানবের জন্য তা-ই একমাত্র চূড়ান্ত বিধান। সবকিছু তা থেকেই জানতে হবে, তা থেকেই গ্রহণ করতে হবে, চলতে হবে তাকে অনুসরণ করেই।
শরীয়তে স্বপ্নের যে মর্যাদা দেয়া হয়েছে, তা নিম্নোক্ত হাদীস থেকেই প্রমাণিত। এ পর্যায়ে দুটো হাদীস উল্লেখ করা যেতে পারে। একটি হযরত আবু হুরায়রা(রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আরবী(********)
-নবী করীম(স) বলেছেন, নব্যুয়তের কোনো কিছুই বাকী নেই- সবই শেষ হয়ে গেছে। এখন আছে শুধু-‘সুসংবাদ দাতাসমূহ’। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন-সুসংবাদ দাতাসমূহ বলতে কি বোঝায়? নবী করীম (স) বললেনঃ তা হলো ভালো স্বপ্ন।
দ্বিতীয় হাদীস হলো হযরত আনাস(রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আরবী(********)
-ভালো স্বপ্ন নব্যুয়তের ছিচল্লিশ ভাগের একভাগ মাত্র।
প্রথম হাদীস থেকে এতটুকু জানা যায় যে, ভালো স্বপ্ন বান্দার জন্য সুসংবাদ লাভের একটি মাধ্যম মাত্র। আর দ্বিতীয় হাদীস থেকে জানা যায় যে, নব্যুয়তের ছিচল্লিশ ভাগের এক ভাগ মর্যাদার অধিকারী হলো এই ‘শুভ স্বপ্ন’। তা হলে বাকি পঁয়তাল্লিশ ভাগ কি? তা হলো নব্যুয়তের মাধ্যমে লব্ধ কুরআন ও সুন্নাত।[এ হাদীসে শুভ স্বপ্নকে নব্যুয়তের ছিচল্লিশ ভাগের এক ভাগ বলা হয়েছে। মুসলিম শরীফে হযরত আবু হুরায়রা(রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেঃ ‘শুভ স্বপ্ন’ নব্যুয়তের পঁয়তাল্লিশ ভাগের এক ভাগ, ইবনে আমর বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে সত্তর ভাগের এক ভাগ। কাজেই এসব কথা কোনো নির্দিষ্ট জিনিস নয়। দ্বিতীয়, শুভ স্বপ্নকে নব্যুয়তের অংশ বলার মানে এ নয় যে, শুভ স্বপ্নও বুঝি ঠিক নব্যুয়তের মতোই নির্ভূল বিধানকারী জিনিস। এখানে নব্যুয়তের সঙ্গে শুভ স্বপ্নের শুধু সাদৃশ্য দেখানোর জন্যই এ কথা বলা হয়েছে। অন্যথায় শুভ স্বপ্ন কখনো নব্যুয়তের সমান হতে পারেনা।(জুরকানী লিখিত মুয়াত্তার শরাহ, চতূর্থ খন্ড. ৩৫১ পৃ.)]
অতএব এই কুরআন ও সুন্নাহই হলো দ্বীনের আসল ও মূল ভিত্তি। তা-ই বাস্তব জিনিস, তার মুকাবিলায় স্বপ্নকে পেশ করা কল্পনা বিলাসী লোকদেরই কাজ। যারা বাস্তব জীবনের ব্যাপারগুলোকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে ইচ্ছুক, তাদের কর্তব্য হলো স্বপ্নের পেছনে না ছুটে কুরআন ও সুন্নাহকে ভিত্তি ধরে অগ্রসর হওয়া। যারা কুরআন-হাদীসের বাস্তব বিধানকে ভিত্তি করে কাজ করেনা, তা থেকে গ্রহণ করেনা জীবন পথের নির্দেশ ও ফয়সালা; বরং যারা স্বপ্নের ভিত্তিতেই সব বিষয়ে ফয়সালা গ্রহণ করে, তারা আসলেই ঈমানদার নয়, ঈমানদার নয় আল্লাহর কুরআন ও রাসূলের সুন্নাতের প্রতি। অতএব তারা বিদয়াতপন্থী, বিদয়াতী লোক।
বিদয়াত প্রতিরোধ ও সুন্নাতের প্রতিষ্ঠা
সুন্নাত ও বিদয়াতের এ দীর্ঘ আলোচনা থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের পূর্ণাঙ্গ আদর্শই হচ্ছে এবং এরই বিপরীতকে বলা হয় বিদয়াত। সুন্নাত হচ্ছে ‘উসওয়ায়ে হাসান’-নিখুঁত, উৎকৃষ্টতম ও উন্নততর আদর্শ; যা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার প্রত্যেকটি মানুষের জন্যিই একান্তভাবে অনুসরণীয়। বস্তুত ইসলামী আদর্শবাদী যে, সে এই আদর্শকে মনে মগজে ও কাজে কর্মে পুরোপুরিভাবে গ্রহণ ও অনুসরণ করে চলে। আর সেই হচ্ছে প্রকৃত মুসলিম।
পক্ষান্তরে ইসলামের বিপরীত চিন্তা-বিশ্বাস ও বাস্তব রীতিনীতি যাই গ্রহণ করা হবে, তাই বিদয়াত। তাই সে জাহিলিয়াত, যা খতম করার জন্য দুনিয়ায় এসেছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ(স)। তিনি নিজে তাঁর নব্যুয়তের জীবন-ব্যাপি অবিশ্রান্ত সাধনার ফলে একদিকে যেমন জাহিলিয়াতের বুনিয়াদ চূর্ণ করেছিলেন এবং বিদয়াতের পথ রুদ্ধ করেছেন চিরতরে অপরদিকে তেমনি করেছেন সুন্নাতের পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠা। সাহাবীদের সমাজকেও তিনি এ আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তুলেছিলেন পুরো মাত্রায়। তিনি নিজে এ পর্যায়ে এত অসংখ্য ও মহামূল্য হেদায়েত দিয়ে গেছেন, যার বর্ণনা করে শেষ করা সম্ভব নয়। তিনি একান্তভাবে কামনা করেছিলেন তাঁর তৈরী সমাজ যেন কোনো অবস্থায় বিদয়াতের প্রশ্রয় না দেয়, বিচ্যূত না হয় সুন্নাতের আলোকো্জ্জ্বল আদর্শ রাজপথ থেকে। শুধু তাই নয়, তাঁর তৈরি সমাজ যেন প্রতিনিয়ত বিদয়াতের প্রতিরোধে এবং সুন্নাতের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে ব্যতিব্যস্ত ও আত্মনিয়োজিত থাকে- এই ছিল তাঁর ঐকান্তিক কামনা। তাঁর এ পর্যায়ের বাণীসমূহের মধ্য থেকে কিছু কথা আমরা এখানে উল্লেখ করছি।
নবী করীম(স) হযরত বিলাল ইবনে হারীস(রা) কে লক্ষ্য করে ইরশাদ করেছিলেনঃ আরবী(*****)
-জেনে রেখো, যে লোক আমার পরে আমার কোনো সুন্নাতকে যা মরে গেছে তা পুনরুজ্জীবিত করবে, তার জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে সেই পরিমাণ সওয়াব ও প্রতিফল, যা পাবে সে, যে তদনুযায়ী আমল করেছে। কিন্তু যারা তদনুযায়ী আমল করবে তাদের প্রতিফল থেকে বিন্দুমাত্র সওয়াব হ্রাসপ্রাপ্ত হবেনা। পক্ষান্তরে যে লোক কোনো গোমরাহীপূর্ণ বিদয়াতের উদ্ভাবন ও প্রচলন করবে, যার প্রতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কিছুমাত্র রাজি নন-তার গুনাহ হবে সেই পরিমাণ, যতখানি গুনাহ হবে তার, যে তদনুযায়ী আমল করবে।কিন্তু তাদের গোনাহ হতে কিছুমাত্র হ্রাস করা হবেনা।
এ পর্যায়ে তাঁর আর একটি হাদীস হলো এই। হযরত আনাস (রা) কে লক্ষ্য করে তিনি বলেছিলেনঃ আরবী(*********)
-হে প্রিয় পুত্র! তুমি যদি পারো সকাল সন্ধ্যা সর্বক্ষণই কারো প্রতি মনে কোনো ক্লেদ রাখিবেনা, তবে অবশ্যই তা করবে। হে প্রিয় পুত্র! এ হচ্ছে আমার উপস্থাপিত সুন্নাতের অন্যতম। আর যে লোক আমার সুন্নাতকে পুনরুজ্জীবিত করলো, সে আমাকে ভালোবাসল, আর যে আমাকে ভালোবাসল, সে পরকালে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে।
প্রথমোক্ত হাদীস থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, রাসূলে করীমের উপস্থাপিত ও প্রতিষ্ঠিত সুন্নাতও কোনো এক সময় মরে যেতে পারে, পরিত্যক্ত হতে পারে মুসলিম সমাজ কর্তৃক, তা তিনি ভালো করেই জানতেন এবং বুঝতেন। কিন্তু সে সুন্নাত চিরদিনের তরেই মৃত হয়ে থাকবে ও মিটে যাবে, কোনোদিনই তা পুনরুজ্জীবিত ও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেনা- তা তিনি ভাবতেও পারেননি। এই কারণেই তিনি তাঁর তৈরি করা উম্মাতকে মরে যাওয়া সুন্নাতের পুনরুজ্জীবন সাধনের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন এ হাদীসসমূহের মাধ্যমে। অনুরূপ কোনো সুন্নাতও যখন মরে যেতে পারে, তখন অবশ্যই তাঁর গড়া উম্মাতের মাঝে বিদয়াতের উদ্ভাবন ও অনুপ্রবেশও ঘটতে পারে, এ কথাও তিনি বুঝতেন স্পষ্টভাবে। এ কারণেই তিনি বিদয়াত উদ্ভাবন ও প্রচলন করার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করে গেছেন তাঁর উম্মতকে।
শেষোক্ত হাদীসে প্রথমে নবী করীম(স) এর একটি বিশেষ সুন্নাতের বিশ্লেষণ দেয়া হয়েছে। সুন্নাতটি হলো মুসলিম সমাজের কোনো লোকের মনেই অপর লোকের বিরুদ্ধে কোনোরূপ হিংসা বা বিদ্বেষের স্থান না দেয়া। এ হিংসা বিদ্বেষ যে বড় মারাত্মক ঈমান ও আমলের পক্ষে এবং পারস্পরিক সম্পর্ক ও সামাজিক শান্তি শৃঙ্খলার দৃষ্টিতে, এ হাদীসাংশ থেকে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নবী করীম(স) বলেছেন যে, এরূপ পরিচ্ছন্ন মন নিয়ে কাল যাপন করাই আমার আদর্শ, আমার সুন্নাত। কোনো সময় যদি সমাজ, সমাজের ব্যক্তিগণ-এ অতি উন্নত সুন্নাত পালনের গুণ হারিয়ে ফেলে, তাহলে তা হবে সামগ্রিকভাবে জাতির লোকদের আদর্শ বিচ্যূতি। আর মুসলমানদের আদর্শ বিচ্যূতি রাসূল(স) এর নিকট কিছুতেই মনোঃপুত হতে পারেনা। তাই তিনি ছোট্ট ধরনের এ সুন্নাতকে উপলক্ষ করে সমগ্র মুসলিম উম্মাতকে এক মহামূল্য নীতি বাণী শুনিয়েছেন। তা হলো এই যে, যে আমার কোনো সুন্নাতকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলবে, অ-চালু সুন্নাতকে চালু করবে, সে-ই রাসূলকে ভালোবাসল। অন্য কথায়, যে লোক রাসূলকে ভালোবাসে তার পক্ষেই রাসূলের সুন্নাতকে পুনরুজ্জীবিত করা-পুনরুজ্জীবনের চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করা সম্ভব হতে পারে, অন্য কারো পক্ষে নয়। শুধু তাই নয়, রাসূলের প্রতি ভালোবাসা পোষণের অকৃত্রিমতা ও নিষ্ঠা সে-ই প্রমাণ করতে পারল। যে লোক তার সুন্নাতকে পুনরুজ্জীবিত করার কোনো চেষ্টা করলোনা, তার মনে রাসূলের প্রতি একবিন্দু পরিমাণ ভালোবাসা যে আছে, তার কোনো প্রমাণ-ই থাকতে পারেনা। তা দাবি করারও তার কোনো অধিকার নেই। অথচ রাসূলের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা পোষণ করা ঈমানের মৌল শর্ত। অতএব যারাই রাসূলের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করে, তারাই ভালোবাসে রাসূলের সুন্নাতকে এবং যারাই রাসূলের সুন্নাতকে ভালোবাসে তারা যেমন তাঁর সুন্নাতকে উপক্ষা করতে পারেনা, পারেনা সে সুন্নাতের মরে যাওয়া মিটে যাওয়াকে বরদাশত করতে, পারেনা তার মিটে যাওয়ার পর নির্বাক, নিশ্চুপ এবং নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকতে। রাসূলের প্রতি ঈমান ও ভালোবাসাই তাকে সুন্নাত প্রতিষ্ঠার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য এবং বিদয়াতকে প্রতিরোধ করার জন্য পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করবে, নিশ্চিন্তে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকতে দেবেনা এক বিন্দু সময়ের তরেও। নবীর প্রতি এরূপ গভীর ভালোবাসা এবং নবীর সুন্নাতের এরূপ অকৃত্রিম মমত্ব বোধ মুমিন মাত্রেরই দিলে বর্তমান থাকা একান্ত প্রয়োজন। আরো প্রয়োজন এ মুমিনদের সমন্বয়ে গড়া এক জনসমষ্টির, যারা ঈমানী শক্তিতে হবে বলীয়ান, সুন্নাতের ব্যাপারে হবে ক্ষমাহীন এবং বিদয়াত প্রতিরোধে অনমনীয়। নবী করীম(স) এমনি এক সুসংবদ্ধ জনসমষ্টি গড়ে গিয়েছিলেন। যতদিন এ জনসমষ্টি দুনিয়ায় ছিল ততোদিন পর্য্ন্ত মুসলিম সমাজে কোনো বিদয়াত প্রবেশ করতে পারেনি, পারেনি কোনো সুন্নাত পরিত্যক্ত হতে। কিন্তু উত্তরকালে ইতিহাসে এমন এক অধ্যায় আসে, যখন মুসলিম সমাজে বিদয়াত প্রবেশ করে এবং সুন্নাত হয় পরিত্যক্ত। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনো পর্যায়েই এমন দেখা যায়নি, যখন মুসলিম সমাজে বিদয়াতের প্রতিবাদ এবং সুন্নাত প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টানুবর্তী লোকের অভাব ঘটেছে। অতীতে সুন্নাত ও বিদয়াতের মাঝে প্রচন্ড দ্বন্দ্ব ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করছে। কখনো বিদয়াতপন্থীরা বাহ্যত জয়ী হয়েছে, আর কখনো প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে সুন্নাত প্রতিষ্ঠাকামীরা। এ জয় পরাজয়ও এক শাশ্বত সত্য। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম সমাজে বিদয়াতের প্রভাব প্রচন্ডরূপে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, বিদয়াতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে এখানে অবাধে। প্রতিবাদ হচ্ছেনা তা নয়; কিন্তু বিদয়াত যে প্রচন্ড শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আসছে, প্রতিবাদ হচ্ছে তার তুলনায় অত্যন্ত ক্ষীণ কন্ঠে, অসংবদ্ধভাবে প্রায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে। অথচ প্রয়োজন সুসংবদ্ধ এক প্রবল প্রতিরোধের। শুধু নেতিবাচক প্রতিরোধই নয়, প্রয়োজন হচ্ছে ইতিবাচকভাবে সুন্নাত প্রতিষ্ঠার এক সামগ্রিক ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টার। এরূপ এক সর্বাত্মক ও পূর্ণাঙ্গ প্রচেষ্টাই এখন মুসলিম সমাজকে রক্ষা করতে পারে বিদয়াতের এ সয়লাবের স্রোত থেকে। অন্যথায় এ সমাজ বিদয়াতের স্রোতে ভেসে যেতে পারে রসাতলে। তাই আজ ‘সুন্নাত ও বিদয়াত’ পর্যায়ে এ দীর্ঘ আলোচনা সমাজের সামনে উপস্থাপিত করা হলো। বিদয়াত প্রতিরুদ্ধ হোক, প্রতিরুদ্ধ হোক কেবল আংশিক বিদয়াত নয়, বিদয়াতের কতকগুলো ছোটোখাট অনুষ্ঠান নয়, প্রতিরুদ্ধ হোক সম্পূর্ণরূপে সর্বাত্মকভাবে, মূলোৎপাটিত হোক বিদয়াতের এ সর্বগ্রাসী বিষবৃক্ষ। আর সে সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হোক সুন্নাত। কেবল পোশাকী সুন্নাত নয়, প্রকৃত সুন্নাত, সম্পূর্ণ সুন্নাত। সেই সুন্নাত, যা দুনিয়ায় রেখে গেছেন সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ(স) চিরদিনের তরে। বিশ্বমানবতার জন্য এই হচ্ছে আমার একমাত্র কামনা, অন্তরের একান্ত বাসনা। এ দাওয়াতই আমি আজ পেশ করছি সাধারণভাবে সব মুসলমানের সামনে, বিশেষ করে আলিম সমাজের সামনে এবং আরো বিশেষভাবে ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী যু্ব সমাজের সামনে।
সুন্নাত ও বিদয়াত সম্পর্কে এ দীর্ঘ আলোচনায় দলীল ও প্রমাণের ভিত্তিতে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, কুরআন ও সুন্নাহ বহির্ভূত কোনো কাজ বা বিষয়, ব্যাপার, নিয়ম-প্রথা ও পদ্ধতিকে ধর্মের নামে নেক আমল ও সওয়াবের কাজ বলে চালিয়ে দেয়াই হলো বিদয়াত- যে সম্পর্কে কুরআন ও সুন্নাত থেকে কোনো সনদ পেশ করা যাবেনা, যার কোনো নজীর পাওয়া যাবেনা খোলাফায়ে রাশেদীন এর আমলে।
বস্তুত নিজস্বভাবে শরীয়ত রচনা এবং আল্লাহর কুদরত ও উলুহিয়াতে অন্যকে শরীক মনে করা, ও শরীক বলে মেনে নেয়াই হচ্ছে বিদয়াত। আর আল্লাহর শরীক বানানো বা শরীক আছে মনে করা যে কত বড় গুনাহ তা কারোই অজানা নয়। এ পর্যায়ে কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি উল্লেখযোগ্য। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেনঃ
আরবী(*****)
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُم مِّنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَن بِهِ اللَّهُ ۚ وَلَوْلَا كَلِمَةُ الْفَصْلِ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ ۗ وَإِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ [٤٢:٢١]
– তাদের এমন শরীক আছে নাকি, যারা তাদের জন্য দ্বীনের শরীয়ত রচনা করে এমন সব বিষয়ে যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? চূড়ান্ত ফয়সালার কথা যদি আগেই সিদ্ধান্ত করে না নেয়া হতো, তাহলে আজই তাদের ব্যাপারে চূড়ান্ত করে দেয়া হতো। আর জালিমদের জন্য কঠিন পীড়াদায়ক আযাব রয়েছে। (আশ শূরাঃ২১)।
এ আয়াতের অর্থ হলোঃ আল্লাহর শরীয়তকে যারা যথেষ্ট মনে করেনা, অন্যদের রচিত আইন ও শরীয়ত মনে করা যারা জরুরী মনে করে এবং আল্লাহর দেয়া শরীয়তের বাইরে-তার বিপরীত-মানুষের মনগড়া শরীয়ত ও আইনকে যারা আল্লাহর অনুমোদিত সওয়াবের কাজ বলে বিশ্বাস করে তারা জালিম। আর এ জালিমদের জন্যই কঠিন আযাব নির্দিষ্ট।
আল্লাহর শরীয়তের বাইরে মানুষের মনগড়া শরীয়ত ও আইন পালন করাই হলো বিদয়াত। আর এ আয়াতের ঘোষণা অনুযায়ী এ বিদয়াত হলো শিরক। কেননা আসলে তো আল্লাহর শরীক কেউ নেই, কিছু নেই। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বানানো শরীয়ত বা আইন পালন করতে মানুষ বাধ্য নয়। অতএব আল্লাহর শরীয়তের দলীল ছাড়া যারাই ফতোয়া দেয়, মাসআলা বানায়, রসম ও তরীকার প্রচলন করে, তারাই বিদয়াতের শিরকে নিমজ্জিত হয়।
বিদয়াত পালনে শুধু আল্লাহরই সাথে শিরক করা হয়না, রাসূলে করীম(স) এর রিসালাতেও শিরক করা হয়। কেননা আল্লাহর নাযিল করা শরীয়ত রাসূলই পেশ করে গেছেন পুরোমাত্রায়-রাসূল পাঠাবার উদ্দেশ্যও তাই। আল্লাহর দ্বীন কি, তা আল্লাহর অনুমতিক্রমে রাসূলেই নির্দেশ করে গেছেন।
রাসূলের দ্বারাই আদেশ-নিষেধ, হালাল-হারাম, জায়েয-নাজায়েয, সওয়াব-আয়াবের সীমা নির্ধারিত হয়েছে। এরূপ অবস্থায় অপর কেউ যদি রাসূলের শরীয়তের বাইরে কোনো জিনিসকে শরীয়তের জিনিস বলে পেশ করে এবং যে তা মেনে নেয়, সে যুগপৎভাবে আল্লাহর সাথেও শিরক করে, শিরক বানায় রাসূলের সাথেও। সে তো রাসূলের দায়িত্ব ও মর্যাদা নিজের দখলে করে নিতে চায় কিংবা রাসূল ছাড়া এ মর্যাদা অন্য কাউকে দিতে চায়। ইসলামের পূর্ণাঙ্গ দ্বীনে সে নতুন আচার রীতি প্রবেশ করিয়ে দিয়ে নিজেই নবীর স্থান দখল করে, যদিও মুখে তারা দাবি করেনা। আর রাসূলে করীম হযরত মুহাম্মদ(স) এর পর আর কেউ নবী হবেনা, হতে পারেনা, এ কথা তো ইসলামের বুনিয়াদী আকীদারই অন্তর্ভূক্ত।
সহীহ মুসলিম ও মুসনাদে আহমদ বর্ণিত একটি হাদীসের কথা এখানে উল্লেখ করতে হচ্ছেঃ
-হাশরের ময়দানে রাসূলে করীম(স) তাঁর উম্মতকে পেয়ালা ভরে ভরে ‘হাওযে কাওসার’ এর পানি পান করাবেন। লোকেরা একদিক থেকে আসতে থাকবে ও পানি পান করে পরিতৃপ্ত হয়ে অপর দিকে সরে যেতে থাকবে। তখন নবী বলেনঃ আমার ও তাদের মাঝে এক প্রতিবন্ধক দাঁড় করিয়ে দেয়া হবে। তারা আমার নিকট পোঁছতে পারবেনা। আমি আল্লাহর নিকট দাবি করে বলবো-হে আল্লাহ! এরা তো আমার উম্মত, এদের আসতে বাঁধা দেয়া হলো কেন? তখন আল্লাহ তা‘আলা জবাব দেবেনঃ এই লোকেরা তোমার মৃত্যুর পর কি কি বিদয়াত উদ্ভাবন করছে তা তুমি জাননা। বলা হবেঃ এরা তো তোমার পেশ করা দ্বীনকে বদলে দিয়েছে, বিকৃত করেছে। (এজন্য বিদয়াতীরা-‘হাউযে কাওসার’ এ কখনো হাযির হতে পারবেনা)। নবী করীম(স) বলেনঃ তখন আমি তাদের লক্ষ্য করে বলবো-দূর হয়ে যাও, দূর হয়ে যাও। আমার চোখের সামনে থেকে সরে যাও।
বিদয়াত ও বিদয়াতপন্থীদের মর্মান্তিক পরিণতির কথা এ সহীহ হাদীস থেকে স্পষ্টভাবে জানা গেল। এমতাবস্থায় বিদয়াতকে সর্বতোভাবে পরিহার করে চলা এবং সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে একে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার জন্য চেষ্টা করা যে ঈমানদার মুসলমানদের কত বড় কর্তব্য তা বলাই বাহুল্য। আর এজন্য সঠিক কর্মনীতি হচ্ছে এই যে, বিদয়াত মুক্ত ইসলামের পূর্ণাঙ্গ আদর্শ প্রচার করে জনমত গঠন করতে হবে এবং জনমতের জোরে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে। অতঃপর এই ইসলামী রাষ্ট্র শক্তিকে পুরোপুরি প্র্রয়োগ করতে হবে জীবনে ও সমাজে অবশিষ্ট বিদয়াতের শেষ চিহ্নকেও মুছে ফেলবার কাজে। এ পন্থায় কাজ করলে বিদয়াতও মিটবে এবং সুন্নাত ও প্রতিষ্ঠিত হবে। বস্তুত এই হচ্ছে ইসলামের কর্মনীতি।
সর্বশেষ আমি ইমাম গাযযালীর একটা কথা এখানে উদ্ধৃত করে এ গ্রন্থের সমাপ্তি ঘোষণা করতে চাই। তিনি বলেছেনঃ আরবী(*******)
-বিদয়াত যত রকমেরই হোক, সবগুলোরই দ্বার রুদ্ধ করতে হবে আর বিদয়াতীদের মুখের ওপর নিক্ষেপ করতে হবে তাদের বিদয়াতসমূহ-তারা তাকে যতোই বরহক বলে বিশ্বাস করুকনা কেন!
— সমাপ্ত —