কিয়াস ও ইজতিহাস কি বিদয়াত?
ইসলামী শরীয়তের মূল উৎস হচ্ছে কুরআন ও হাদীস। এ দুটোকে ভিত্তি করেই ইসলামী জিন্দেগীর নিত্য নতুন প্রয়োজনীয় বিষয়ে শরীয়তের রায় জানতে হবে, দিতে হবে নিত্য নতুন উদ্ভূত সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান। তাই ইসলামী শরীয়তে কিয়াস ও ইজতিহাদ শরীয়তের অন্যতম উৎসরূপে পরিগণিত, এ দুয়ের সাহায্যেই ইসলাম সকল কালের, সকল মানুষের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হওয়ার সামর্থ্য ও যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়ে থাকে, দিতে পারে মুসলিম জীবন বিধানের সকল পর্যায়ে ও সকল প্রকার অবস্থায় নির্ভূল পথ-নির্দেশ। তা-ই এ দুটো বিদয়াত নয়। বিদয়াত নয় এ জন্য যে, এ দুটো ইসলামী ব্যবস্থায় কিছুমাত্র নতুন জিনিস নয়। স্বয়ং রাসূলে করীম(স) ও খুলাফায়ে রাশেদীন কর্তৃক এ দুটো পূর্ণমাত্রায় ব্যবহৃত হয়েছে ইসলামী আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে।
আল্লামা আলুসী লিখেছেনঃ কিয়াস ও ইজতিহাস দ্বীন পূর্ণ হওয়ার কিছুমাত্র বিপরীত নয়। কেননা দ্বীন পূর্ণ হওয়ার অর্থ হচ্ছেঃ দ্বীন নিজস্ব দিক দিয়ে এবং তার আনুষঙ্গিক জরুরী বিষয়ে পূর্ণ পরিণত ও চূড়ান্ত। এখন তা হতেই প্রয়োজনীয় আইন কানুন ও নিয়মনীতি বের করা হবে। আকায়েদের মূলনীতি নির্ধারণ করা হবে, শরীয়তের মূলনীতি ও ইজতিহাদের কায়দা কানুন উদ্ভাবিত হবে। তার কোনোটাই কুরআন তথা দ্বীনের পূর্ণ হওয়ার বিপরীত হবেনা।
মুজাদ্দেদী আলফেসানী শায়খ আহমদ সরহিন্দী বলেছেনঃ কিয়াস ও ইজতিহাদকে কোনো দিক দিয়েই বিদয়াত মনে করা যেতে পারেনা। কেননা এ দুটো মূল কুরআন হাদীসের দলীলই প্রকাশ করে, কোনো নতুন অতিরিক্ত জিনিস দ্বীনের ভিতরে প্রমাণ করেনা।
বস্তুত কিয়াস ও ইজতিহাদ রূপায়িত হয় ইজমার মাধ্যমে। ইজমাও দ্বীন ইসলামের নবোদ্ভাবিত কোনো জিনিস নয় এবং তদ্দারা কোনো নতুন ইসলামের মূল বিধানের সাথে সামঞ্জস্যহীন কোনো মতও প্রমাণিত হয়না। তাই ইজমাও বিদয়াত নয়-ইজমা দ্বারা প্রমাণিত কোনো ফায়সালাও বিদয়াত বলে গণ্য হতে পারেনা। ইজমার ভিত্তি স্পষ্টভাবে হাদীসেই স্বীকৃত।
হযরত ইবনে মাসউদ(রা) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম(স) ইরশাদ করেছেনঃ
– আরবী (*******)
– মুসলিম সমাজ সামগ্রিকভাবে শরীয়তের দৃষ্টিতে যে সিদ্ধান্ত করবে তা আল্লাহর নিকটও ভালোও উত্তমরূপে গৃহীত হবে এবং সে মুসলিমরাই যাকে খারাপ ও জঘন্য মনে করবে, তাই খারাপ ও জঘন্য বলে গণ্য হবে আল্লাহর নিকট। (ইবনে নযীম এ হাদীসটিকে ইবনে মাসউদের কথা বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তবুও ইজমার সমর্থনে এ একটি দলীলরূপে গণ্য। কেননা সাহাবীর কথাও শরীয়তের দলীল)।
আহলে সুন্নাত ও আহলে বিদয়াত
সুন্নাত ও বিদয়াত সম্পর্কে এ আলোচনার পর বিবেচ্য বিষয় হলো, কে আহলে সুন্নাত আর কে আহলে বিদয়াত?
আহলে সুন্নাত কে- মানে, সুন্নাতের অনুসারী কারা? কারা সুন্নাতকে অবলম্বন করে চলছে এবং জীবনধারাকে সুন্নাতের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখছে। আর আহলে বিদয়াত কে-মানে কারা সুন্নাতের অনুসারী নয়, কারা বিদয়াতপন্থী? কারা বিদয়াতী?
এ প্রশ্নেরও আলোচনা আবশ্যক। কেননা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বেশ কিছু লোক চরম বিদয়াতী কাজ করেও জীবনের বিভিন্ন দিকে সুন্নাতের বরখেলাপ কাজ করেও একমাত্র নিজেদেরকেই ‘আহলে সুন্নাত’ বলে দাবি করছে। আর তাদের বিদয়াতসমূহকে যারা সমর্থন করেনা, যারা শক্তভাবে সুন্নাতের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে চাচ্ছে, সুন্নাতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে জীবনে ও সমাজে তাদেরকে তারা বিদয়াতী (ফিতরাতপন্থী) বলে ফতোয়া দিচ্ছে। কাজেই দলীল ভিত্তিক বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠা দরকার যে, সত্যিকারভাবে কুরআন হাদীসের দৃষ্টিতে কে আহলে সুন্নাত আর কে আহলে বিদয়াত এবং সেই সঙ্গে আহলে সুন্নাতেরই বা স্থান কোথায় এবং কোথায় স্থান আহলে বিদয়াতের।
আহলে সুন্নাত কারা, এ কথার জবাবে আল্লামা আবদুর রহমান ইবনুল জাওজীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, নবী করীম(স) ও তাঁর সাহাবায়ে কিরামের আদর্শে অনুসারীরাই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে আহলে সুন্নাত। কেননা তাঁরাই সুন্নাতের আদর্শকে বাস্তবভাবে অনুসরণ করে চলেছে, যে সুন্নাতে কোনরূপ নতুন জিনিস উদ্ভাবিত হয়নি। এ জন্যে যে, নতুন জিনিস উদ্ভাবিত হয়েছে-বিদয়াত সৃষ্টি হয়েছেতো রাসূলে করীম(স) ও সাহাবায়ে কিরামের পরবর্তীযুগে।
তিনি আরো বলেছেনঃ পূর্বোক্ত আলোচনা হতে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, আহলে সুন্নাত হলো সুন্নাতের অনুসারী লোকেরা। আর আহলে বিদয়াত হলো তারা, যারা এমন কিছু জিনিস বের করেছে, যা পূর্বে ছিলনা এবং যার কোন সনদও নেই।
অর্থাৎ সুন্নাত যারা কার্যত পালন করে, তাতে কোনোরূপ হ্রাস করেনা, বৃদ্ধিও করেনা, যেমন রাসূল ও সাহাবায়ে কিরাম করেছেন, বলেছেন ও চলেছেন হুবহু তেমন-ই পালন করে, তারাইতো অভিহিত হতে পারে আহলে সুন্নাত বলে। আর যারা তাতে কোনোরূপ হ্রাস-বৃদ্ধি করে, মনগড়া অনেক কিছু ধর্মের মধ্যে শামিল করে নেয়, ধর্মীয় কাজ বলে চালিয়ে দেয়, তারা ‘আহলে সুন্নাত’ হতে পারেনা। তারাতো সম্পূর্ণরূপে ‘আহলে বিদয়াত’-বিদয়াতপন্থী।
বস্তুত সাহাবায়ে কিরামের যুগে কোনো বিদয়াত ছিলনা। তাঁরাতো খালেস সুন্নাতের উপর আমল করেছেন; আমল করেছেন ব্যক্তি জীবনে, অনুসরণ করে চলেছেন সমষ্টিগত জীবনের সকল ক্ষেত্রে। শুধু তা-ই নয়, কোথাও কোনো বিদয়াত দেখা দিলে তাঁরা পূর্ণ শক্তিতে সে বিদয়াতের প্রতিরোধ করেছেন। তাঁরা নবী করীম(স) এর ঘোষণার উপর খাঁটি বলে উত্তীর্ণ হয়েছেন। নবী করীম(স) বলেছেনঃ
আরবী (************)
-আমার সাহাবীগণ আমার উম্মতের উপর আমানতদার। আর আমার সাহাবীরা যখন চলে যাবে, তখন আমার উম্মতের উপর সেই অবস্থা ফিরে আসবে, যার ওয়াদা তাদের জন্য করা হয়েছে।
সুন্নাত প্রতিষ্ঠা ও বিদয়াত প্রতিরোধের দায়িত্ব
এ ছিল রাসূলে করীম(স) এর আগাম সাবধান বাণী। তাঁর উম্মতের উপর যেসব আদর্শিক বিপদ ও সংঘাত আসতে পারে বলে রাসূলে করীম(স)মনে করেছেন, সেগুলোর উল্লেখ করে তিনি আগেই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন যেন উম্মতের জনগণ সে বিষয়ে হুঁশিয়ার হয়ে থাকে এবং নিজেদের ঈমান-আকীদায় এবং আমলে ও আখলাকে সে ধরনের কোনো জিনিস-ই প্রবেশ করতে না পারে। এ পর্যায়ের আর একটি হাদীস হচ্ছে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা) কর্তৃক বর্ণিত।
রাসূলে করীম(স) বলেছেনঃ আরবী (*********)
– আমার পূর্বে প্রেরিত প্রত্যেক নবীর-ই তাঁর উম্মতের মধ্য থেকে হাওয়ারীগণ হয়েছে এবং এমন সব সঙ্গী সাথী ও হয়েছে, যারা সে নবীর সুন্নাত গ্রহণ ও ধারণ করেছেন। আর তাঁর আদেশ ও নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করেছেন। পরে সে উম্মতের অধিকারী হয়েছে এমন সব লোক, যারা বলতো এমন সব কথা যা তারা করতোনা এবং করতো এমন সব কাজ, যা করতে তাদের আদৌ আদেশ করা হয়নি। এরূপ অবস্থায় এ লোকদের বিরুদ্ধে যারা জিহাদ করবে নিজেদের শক্তি দ্বারা, তারা মুমিন আর যারা জিহাদ করবে নিজেদের মুখের ভাষা ও সাহিত্য দ্বারা তারাও মুমিন; আর যারা জিহাদ করবে দিল দ্বারা তারাও মুমিন। কিন্তু অতঃপর একবিন্দু ঈমাণের অস্তিত্ব আছে বলে মনে করা যেতে পারেনা।
এ দীর্ঘ হাদীসে পরবর্তীকালে যেসব উত্তরাধিকারী সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে, তারাই হচ্ছে আহলে বিদয়াত। কেননা তাদের কাজ ও কথায় মিলন নেই এবং করে এমন কাজ, যা করতে তাদের বলা হয়নি। অথচ ইসলামী শরীয়তে এমন কাজকে দ্বীন কাজ হিসেবে করার কাউকে-ই অনুমতি দেয়া যেতে পারেনা। তাহলে রাসূলের সুন্নাতের কোনো মূল্যই থাকবেনা কারো কাছে, থাকবেনা কোনো গুরুত্ব। এ জন্যে এদের বিরুদ্ধেই জিহাদ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অতএব বিদয়াতীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তিরই কর্তব্য। যে তা করবেনা, এ হাদীস অনুযায়ী তার মধ্যে ঈমানের লেশমাত্র নেই।
ইসলামের জিহাদ ঘোষণার নির্দেশ মূলত কূফর ও শিরকের বিরুদ্ধে। কিন্তু এখানে যে বিদয়াতের বিরুদ্ধে জিহাদ করার গুরুত্ব এত জোরালো ভাষায় বলা হলো, তার কারণ এই যে, বিদয়াত সুস্পষ্ট কুফর ও প্রকাশ্য শিরক না হলেও তা যে কুফর ও শিরক এ সূচনা, কুফর ও শিরক এর উৎসে বীজ, তাতে সন্দেহ নেই।
ইসলামী সমাজে একবার বিদয়াত দেখা দিলে ও ক্ষেত্র তৈরি করে নিতে পারলে অনতিবিলম্বে তা-ই যে আসল শিরক ও কুফর-এর দিকে টেনে নিয়ে যাবে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। এ কারণেই ইসলামী সমাজে কুফর ও শির্ক এর এই বীজকে অংকুরেই বিনষ্ট করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং এ জন্যেই বিদয়াত ও বিদয়াতপন্থীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করার ওপর ঈমানের নির্ভরশীর হওয়ার কথা বলা হয়েছে। বস্তুত দ্বীন ইসলামে যে কাজ করতে বলা হয়নি সে কাজকে দ্বীনি কাজ মনে করে করাই হচ্ছে এক প্রকার কুফরী এবং এতেই নিহীত রয়েছে শিরক এর ভাবধারা। এ পর্যায়ে নিম্নোক্ত হাদীস কয়টিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
নবী করীম(স) ইরশাদ করেছেনঃ
আরবী (********)
– যে লোক আমার পরে মরে যাওয়া কোনো সুন্নাতকে পুনরুজ্জীবিত করবে, তার জন্যে সে পরিমাণ সওয়াব রয়েছে যে পরিমাণ সওয়াব সে সুন্নাত অনুযায়ী আমল করে পাও্য়া যাবে; কিন্তু আমলকারীর সওয়াবে বিন্দুমাত্র কম করা হবেনা। পক্ষান্তরে যে লোক কোনো গোমরাহীর বিদয়াতকে চালু করবে-যে বিদয়াতে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল মোটেই রাজি নহেন-তার গুনাহ হবে সে পরিমাণ, যে পরিমাণ গুনাহ তদনুযায়ী আমল করলে হবে; কিন্তু আমলকারীর গুনাহ হতে এক বিন্দু কম করা হবেনা।
এখানে মরে যাওয়া সুন্নাতকে পুণরায় চালু করার সওয়াব ও গোমরাহীর বিদয়াত প্রবর্তন করার গুনাহ সম্বন্ধে যা কিছু বলা হয়েছে, তা থেকে মুসলিম সমাজকে সুরক্ষিত রাখা এবং সমাজে সুন্নাতকে চালু ও প্রতিষ্ঠিত করা- তাকে মরে যেতে না দেয়া ও বিদয়াতকে কোনোক্রমেই চালু হতে না দেয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করাই এ হাদীসের মূল লক্ষ্য।
নবী করীম(স) বলেছেনঃ
আরবী (**********)
– দ্বীন ইসলাম শুরুতে যেমন অপরিচিত ও প্রভাবহীন ছিল, তেমনি অবস্থা পরেও দেখা যাবে। এই সময়কার এই অপরিচিত লোকদের জন্য সুসংবাদ। আর এই অপরিচিত লোক হচ্ছে তারা, যারা আমার পরে আমার সুন্নাতকে বিপর্যস্ত করার যাবতীয় কাজকে নির্মূল করে সুন্নাতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টিত হবে। (তিরমিযী)।
মুসলিম সমাজে যদি সাধারণভাবে সুন্নাত প্রতিষ্ঠিত না থাকে, বিদয়াত যদি মুসলিম সমাজকে গ্রাস করে ফেলে তাহলে প্রকৃত দ্বীন ইসলাম সেখানে এক অপরিচিত জিনিসে পরিণত হবে এবং প্রকৃত ইসলাম পালনকারী লোকগণ-যাও বা অবশিষ্ট থাকে- তারা সমাজে সম্পূর্ণ অপরিচিত ও প্রভাবহীন হয়ে পড়ে। সমাজের উপর মাতব্বরী ও কর্তৃত্ব হয় বিদয়াতী ও বিদয়াতপন্থী লোকদের। এরূপ অবস্থায় যারাই সুন্নাতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে দ্বীনের দৃষ্টিতে সমাজকে সুস্থ করে গড়ে তুলতে চেষ্টিত হয়, তাদের জন্য আল্লাহ ও আল্লাহ্র রাসূলের তরফ হতে সুসংবাদ শুনান হয়েছে। কেননা তারা বাস্তবিক মজবুত ঈমানের ধারক।
বস্তুত সুন্নাত যখন সমাজে ম্লান ও স্তিমিত হয়ে আসে এবং বিদয়াতের জুলমাত পুঞ্জীভূত হয়ে গ্রাস করে ফেলে সমস্ত সমাজকে, তখন ঈমানদার লোকদের একমাত্র কাজ হলো বিদয়াতকে মিটিয়ে সুন্নাতকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সংগ্রাম করা। কিন্তু তখনও যারা বিদয়াত ও বিদয়াতপন্থীদের সম্মান দেখায়, তারা ইসলামের সাথে করে চরম দুশমনি।
রাসূলে করীম(স) ইরশাদ করেছেনঃ
আরবী (********)
– যে লোক কোনো বিদয়াতী বা বিদয়াতপন্থীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলো, সে তো ইসলামকে ধ্বংস করায় সাহায্য করলো।
কেননা বিদয়াত পন্থী ব্যক্তির ভূমিকা ইসলামের বিপরীত। সে তো ইসলামকে নির্মূল করার ব্রতেই লেগে আছে নিরন্তর। আর এরূপ অবস্থায় তার প্রতি সম্মান দেখানো বা শ্রদ্ধা প্রকাশ করার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, সে লোক বিদয়াতীর কাজকে সমর্থন করে এবং বিদয়াতকে পছন্দ করে। এতে করে বিদয়াতী ও বিদয়াতপন্থী ব্যক্তির মনে ইসলামকে ধ্বংস করার ব্যাপারে অধিক সাহস ও হিম্মত হবে, সে হবে নির্ভীক, দুঃসাহসী। আর এ জন্যেই এ কাজ ইসলামকে ধ্বংস করার ব্যাপারে সাহায্য করে বলে রাসূলে করীম(স)ঘোষণা করেছেন।
হযরত ইবনে আব্বাস(রা) বলেন, নবী করীম(স) ইরশাদ করেছেনঃ
আরবী (********)
– আল্লাহর নিকট তিন শ্রেণীর লোক অত্যধিক ঘৃণ্য। এক. যারা হারাম শরীফে শরীয়তবিরোধী কাজ করে, দুই. ইসলামী আদর্শে যারা জাহিলিয়াতের নিয়ম-নীতি প্রথাকে চালু করতে ইচ্ছুক এবং তিন. যারা কোনো কারণ ব্যতীত-ই মুসলমানের রক্তপাত করতে উদ্ধত হয়। (বুখারী)।
হাদীসে বলা হয়েছে জাহিলিয়াতের সুন্নাত, নিয়ম-নীতি ও প্রথা। অর্থাৎ জাহিলিয়াতের সুন্নাত। আর তা সম্যকভাবেই ‘সুন্নাতে রাসূল’ এর বিপরীত জিনিস। এখন যে লোক ইসলামের সুন্নাতের মাঝে জাহিলিয়াতের সুন্নাত বা নিয়ম-নীতি প্রথাকে চালু করতে চায় ইসলামের অন্তর্ভূক্ত সুন্নাত হিসেবে, সে যে আল্লাহ্র নিকট অত্যন্ত ঘৃণ্য হবে, হবে আল্লাহ্র নিকট অত্যন্ত অভিশপ্ত তাতে আর কি সন্দেহ থাকতে পারে।
এ পর্যায়ে হযরত হাসান বসরী(র) বলেছেনঃ যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই তাঁর নামে শপথ করে বলছি, অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ও মাত্রা হ্রাস করার দুই সীমাতিরিক্ত প্রান্তিক নীতির মধ্যবর্তী নীতিই হচ্ছে তোমাদের সুন্নাতের নীতি, অতএব তোমরা তারই উপর ধৈর্য্ সহকারে অবিচল হয়ে থাক, আল্লাহ তোমাদের প্রতি রহম করবেন। কেননা আহলে সুন্নাত-সুন্নাত অনুসারী লোকদের সংখ্যা চিরকালই কম ছিল অতীতে, পরবর্তীকালেও তাই থাকবে। এরা হচ্ছে তারা যারা কখনো বাড়াবাড়িকারীদের সঙ্গে যোগদান করেনি। বিদয়াতপন্থীদেরও সঙ্গী হয়নি তারা তাদের বিদয়াতের ব্যাপারে। বরং তারা সুন্নাতের উপর অটল হয়েই দাঁড়িয়ে রয়েছে, যদ্দিন না আল্লাহ্র সাক্ষাতের জন্য তারা মৃত্যুবরণ করেছে। আল্লাহ চাইলে তোমরাও এমনিই হবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেছেনঃ
লোকেরা যখনই কোনো বিদয়াতকে উদ্ভাবন করেছে, তখনই তারা এক একটি সুন্নাতকে মেরেছে। এভাবেই বিদয়াত জাগ্রত ও প্রচন্ড হয়ে পড়েছে, আর সুন্নাত মিটে গেছে।
এসব কয়টি হাদীসই মুসলমানদের সামনে একটা সুস্পষ্ট কর্মসূচী পেশ করেছে এবং তা হচ্ছে এই যে, মুসলমানরা যে দেশ ও যে অবস্থাতেই থাকুকনা কেন, তারা বিদয়াত ও বিদয়াতপন্থীদের বিরুদ্ধে দূর্ভেদ্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এবং সুন্নাতকে তার আসল রূপে ও ভাবধারায় প্রতিষ্ঠিত করতে এবং রাখতে চেষ্টিত হবে। ‘সুন্নাত’ যদি বিলীন হয়ে যায় আর বিদয়াত যদি প্রবল হয়ে দাঁড়াতে পারে, তাহলে মুমিন ও মুসলিমের অস্তিত্বই অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়।
সাহাবীদের জামা‘আতই আদর্শ
দুনিয়া ইসলামের এ সুন্নাতের আদর্শ লাভ করেছে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ(স) এর কাছ থেকে। মুহাম্মদ(স)-ই এ সুন্নাতকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এবং তাঁর সাহাবীরাও এ সুন্নাতেরই উপর অটল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সাহাবীদের পরে তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনের যুগেও সুন্নাতই সমাজের ওপর জয়ী ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে মুসলিম মিল্লাতের নানাবিধ দূর্বলতা দেখা দেয়, দেখা দেয় নব নব বিদয়াত। সমাজের সাধারণ অবস্থা প্রচন্ডভাবে বদলে যায়। বিদয়াত জয়ী ও প্রকট হয়ে পড়ে এবং সুন্নাত হয় দূর্বল ও পরাজিত বরং লোকেরা বিদয়াতকেই সুন্নাত হিসেবে গ্রহণ করে এবং সুন্নাতকে বিদয়াতের ন্যায় পরিহার করে। সে আজ প্রায় বার তেরশ’ বছর আগের কথা। তারপর মুসলিম জীবন সুন্নাতের আদর্শ থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে পড়তে থাকে এবং সুন্নাতের আদর্শের পরিবর্তে শিকড় গাড়তে থাকে বিদয়াত। আজকের মুসলমান তো এ দৃষ্টিতে বিদয়াত-অজগরের একেবারে উদর গহবরে আটকে গেছে। কিন্তু আজও তাদের সামনে আদর্শ ও অনুকরণীয় ও অনুসরণযোগ্য হচ্ছে রাসূলে করীম(স) ও তাঁর সাহাবায়ে কিরাম। তাঁদেরই অনুসরণ করে চলা উচিত সকল মুসলমানের। রাসূল ও সাহাবদের যুগে সুন্নাত বিশ্ব মুসলিমের নিকট চিরকালের তরে আঁধার সমুদ্রের আলোকস্তম্ভ। আজো সেখান থেকেই আলো গ্রহণ করতে হবে, পেতে হবে পথ-নির্দেশ। রাসূলে করীম(স) এমনি এক ভবিষ্যদ্বাণী করে বিভ্রান্ত মুসলিমের জন্য পথ-নির্দেশ করে গেছেন।
রাসূলের একটি হাদীসের শেষাংশ হচ্ছে এইঃ
আরবী (************)
-বনী-ইসরাঈলীরা বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল আর আমার উম্মত তিহাত্তর ফির্কায় বিভক্ত হবে। তাদের মধ্যে একটি ফির্কা ছাড়া আর সব ফির্কা-ই জাহান্নামী হবে। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেনঃ সে একটি ফির্কা কারা হে রাসূল (স)? তিনি বললেন, “তারা হচ্ছে সেই লোক যারা অনুসরণ করবে আমার ও আমার আসহাবদের আদর্শ”।
এ হাদীসকে ভিত্তি ধরে ইমাম তিরমিযী এবং ইমাম ইবনুল জাওজী যে কথাটি বলেছেন, তার মর্ম হলো এইঃ এ হাদীসে প্রমাণ রয়েছে যে, ‘এক জামা‘আত’ বলতে সাহাবাদের জামা‘আতকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ বিশেষ কোনো একজন সাহাবী নন, নবী করীম(স) এবং সামগ্রিকভাবে সাহাবীদের জামা‘আত যে সুন্নাতকে পালন করে গেছেন, পরিবর্তিত অবস্থায় এবং পতন যুগেও যারা সেই সুন্নাতকে অনুসরণ করবে, তারাই জান্নাতে যাওয়ার অধিকারী হবে। তারা হবে সেই লোক যারা আকীদা, কথা ও বাহ্যিক আমলের রীতি-নীতি সব-ই সাহাবীদের ইজমা থেকে গ্রহণ করবে।
আবুল আলীয় তাবেয়ী বলেছেনঃ মুসলিম সমাজ ফির্কায় ফির্কায় বিভক্ত হওয়ার পূর্বে যে অবস্থায় ছিল, তোমরা সেই অবস্থাকে শক্ত করে বজায় রাখতে ও বহাল করতে চেষ্টা করবে।
এ কথাটিতেও ঠিক সাহাবাদের যুগের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। কেননা সাহাবীদের যুগই ছিল এমন যুগ-যখন মুসলিম সমাজ ছিল ঐক্যবদ্ধ, অবিভক্ত।
আসেম বলেন, আবুল আলীয়ার এ নসীহতের কথা হাসানুল বসরীকে বলায় তিনি বলেনঃ আল্লাহ্র কসম, তোমাকে ঠিকই উপদেশ দিয়েছে এবং তোমাকে একান্তই সত্য কথা বলেছে।
ইমাম আওয়াজী বলেছেনঃ তোমরা নিজেকে সুন্নাতের ওপর অবিচল রাখো সুন্নাতে ধারক লোকেরা যেখানে দাঁড়িয়েছেন অর্থাৎ যে নীতি গ্রহণ করেছেন, তুমিও সে নীতিই গ্রহণ করো, তাঁরা যা বলেছেন, তুমি তাই বলবে, যা থেকে তাঁরা বিরত রয়েছেন, তুমিও তা থেকে বিরত থাকবে। আর তোমার পূর্ববর্তী নেককার লোক যে পথ ধরে চলে গেছেন, তুমিও সেই পথেই চলবেন। তাহলে তাঁরা যা করেছেন, তা-ই করার তওফীক তুমিও পাবে।
মনে রাখতে হবে, ইমাম আওজায়ী একজন তাবেয়ী এবং তিনি সলফে সালেহ বলতে বুঝিয়েছেন সাহাবীদের জামা‘আতকে। অতএব রাসূলের পরে সুন্নাতের আদর্শ সমাজ যেমন ছিলেন সাহাবায়ে কিরাম, তেমনি রাসূলের পরে সাহাবায়ে কিরামই হতে পারেন সকল কালের, সকল মুসলিমের আদর্শ ও অনুসরণীয়। সলফে সালেহীন বলতে দুনিয়ার মুসলমানের নিকট তাঁরাই বরণীয়। কেননা তাঁদের আদর্শবাদিতা ও রাসূলের অনুসরণ গুণের কথা স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা সাক্ষ্য দিয়েছেন কুরআন হাদীসে সাক্ষ্য দিয়েছেন স্বয়ং নবী করীম(স)। রাসূলের সত্য মাপকাঠিতে পুরোপুরিভাবে তাঁরাই উত্তীর্ণ হয়েছেন।
বস্তুত রাসূল(স) এর পরে সাহাবায়ে কিরাম ছাড়া মুসলমানদের নিকট আর কোনো ব্যক্তি কোনো কালের, কোনো দেশের কোনো বুযুর্গ ও(?) আদর্শ ও অনুসরণীয়রূপে গণ্য হতে পারে না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা) কোনো ব্যক্তিকে আদর্শরূপে গ্রহণ করা সম্পর্কে বলেছেনঃ কারো যদি সুন্নাতকে ধারণ করতেই হয়, তাহলে তার উচিত এমন ব্যক্তির সুন্নাত ধারণ করা, যে মরে গেছে। কেননা যে লোক এখনো জীবিত সে যে ভবিষ্যতে ফিতনায় পড়বেনা, তার কোনো নিশ্চয়তাই নেই। আর মরে যাওয়া লোক হচ্ছেন মুহাম্মদ(স) এর সাহাবীগণ, যারা ছিলেন এ উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম লোক, যাঁদের দিল ছিল সর্বাধিক পূণ্যময়, গভীরতম জ্ঞানসম্পন্ন। কৃত্রিমতা ছিলনা তাঁদের মধ্যে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের বাছাই করে নিয়েছিলেন তাঁর নবীর সাহাবী হওয়ার জন্যে এবং তাঁর দ্বীন কায়েম করবার জন্যে। অতএব তোমরা তাদের সঠিক মর্যাদা অনুধাবন করো-স্বীকার করো। তাঁদের পদাংক অনুসরণ করো। আর তাঁদের চরিত্র ও স্বভাবের যতদূর সম্ভব তোমরা ধারণ ও গ্রহণ করো। কেননা তাঁরা ছিলেন সঠিক ও সুদৃঢ় হেদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা) এর মতো একজন সাহাবীরও এ এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ। এর তাৎপর্য্ এই যে, সাহাবায়ে কিরামই সর্বকালের লোকদের জন্য পরিপূর্ণ ও নিখুঁত নির্ভরযোগ্য আদর্শ। আকীদা-বিশ্বাস, আমল-আখলাকের দৃষ্টিতে তাঁরা সর্বোন্নত পর্যায়ে উন্নীত ও সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। কিন্তু এখানে বিশেষ কোনো ব্যক্তি সাহাবীর কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে সমষ্ঠিগতভাবে সাহাবীদের জামা‘আতের কথা। এই সাহাবীদের জামা‘আতই মুসলিমের নিকট অনুসরণীয়।
এ থেকে বোঝা গেল যে, রাসূলে করীম(স) ছাড়া মানব সমাজের কোনো এক ব্যক্তিকে-ই একান্তভাবে অনুসরণীয়রূপে গ্রহণ করা কিছুতেই কল্যাণকর হতে পারেনা, ইসলাম সে নির্দেশ দেয়নি কাউকেই-সে যে যুগের এবং যত বড় বুযুর্গ ও অলী-আল্লাহ্ই হোকনা কেন। শুধু তাই নয়, ইসলামে সে বিষয়ে স্পষ্ট নিষেধ বাণীও উচ্চারিত হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা) হতে বর্ণিত হয়েছেঃ কেউ যেন নিজের দ্বীনকে কোনো ব্যক্তির সাথে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে না দেয় যে, সে ঈমান আনলে সেও ঈমান আনবে আর সে কুফরী করলে সেও কুফরী করবে। যদি তোমরা কারো অনুসরণ করতে বাধ্য হও-ই, তাহলে তোমরা অনুসরণ করবে মরে যাওয়া লোকদের। কেননা জীবিত মানুষ জীবিত থাকা অবস্থায় ফিতনা হতে মুক্ত হতে পারেনা।
এখানেও মরে যাওয়া লোক বলতে বোঝায়, সাহাবীদের জামা‘আত, কোনো বিশেষ ব্যক্তি-সাহাবী নয়। একমাত্র রাসূলে করীম(স) ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির অন্ধ অনুসরণ ইসলামে আদৌ সমর্থিত নয়। এ হচ্ছে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের মতো একজন জলীলুল কদর সাহাবার কথা। তিনি যেমন ছিলেন প্রথম যুগের সাহাবী, তেমনি রাসূলের বিশেষ খাদেম। কাজেই সাধারণভাবে মুসলমানদের জন্য সঠিক নির্ভরযোগ্য কর্মনীতি এ-ই হতে পারে যে, তারা মেনে চলবে শুধু আল্লা্হকে, আল্লাহ্র রাসূলকে-কুরআন এবং হাদীসকে; আর এক কথায় সুন্নাতকে। এ ছাড়া কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত মতকে ব্যক্তিগত চাল-চলন, স্বভাব চরিত্র ও আচার ব্যবহারকে কখনোই একমাত্র আদর্শরূপে আঁকড়ে ধরবেনা। কোনো জীবিত বা মৃত মানুষের বিনা শর্তে আনুগত্য স্বীকার করবেনা। বিনা শর্তে আনুগত্য মানব সমাজে কেবলমাত্র রাসূলে করীম(স) কে করা যেতে পারে, করতে হবে, অন্য কারো নয়।
এ পর্যায়ে একটি বড় বিভ্রান্তির অপনোদন করা একান্তই আবশ্যক। বিভ্রান্তিটি হচ্ছে একটি প্রখ্যাত হাদীসকে কেন্দ্র করে।
হাদীসটি হলো এইঃ আরবী(**********)
-আমার সাহাবীগণ নক্ষত্রপুঞ্জের মতোই উজ্জ্বল। এদের মধ্যে যার-ই তোমরা অনুসরণ করবে, হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে।
এই হাদীসের ভিত্তিতে কেউ কেউ বলতে চান যে, নিজেদের ইচ্ছেমতো যে কোনো একজন সাহাবীর অনুসরণ করলেই হেদায়াতের পথে চলা সম্ভব হবে। কিন্তু কয়েকটি কারণে এই হাদীসকে দলীল হিসেবে পেশ করা যুক্তিযুক্ত হতে পারেনা। প্রথম কারণটি এই যে, এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে। একটি সূত্র হলোঃ আ‘মাশ থেকে আবু সুফিয়ান হতে, জাবির(রা) হতে। আর একটি হলো সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব হতে, ইবনে আমর থেকে। আর তৃতীয় হলো হামযা আল-জজী থেকে, নাফে থেকে, ইবনে উমর থেকে। কিন্তু মুহাদ্দিসদের বিচারে এ সব সূত্রে কোনো হাদীস প্রমাণিত নয়। ইবনে আবদুল বার্র এর উদ্বৃতি দিয়ে আল্লামা ইবনুল কায়্যিম লিখেছেনঃ আমাদের নিকট সাঈদের পুত্র ইবরাহীম, তাঁর পুত্র মুহাম্মদ হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, তাদের নিকট হামদ ইবনে আইয়ূব আস সামূত বর্ণনা করেছেন যে, আমাদের নিকট বাজ্জার বলেছেন যে, “আমার সাহাবীরা নক্ষত্রপুঞ্জের মতো, তাদের মধ্যে যার-ই তোমরা অনুসরণ করবে, হেদায়াত পাবে”। এই অর্থের যে হাদীসটি বর্ণনা করা হয় তা এমন একটি কথা, যা নবী করীম(স) হতেই সহীহ বলে প্রমাণিত হয়নি। (খতীব আল বাগদাদীর উদ্ধৃত হযরত ইবনুল খাত্তাব (রা) এর বর্ণনা থেকে এর বিপরীত কথা জানা যায়।)
হাদীস বিচারে সনদের গুরুত্ব হলো মৌলিক। আর সনদের বিচারে যে হাদীস সহীহ বলে প্রমাণিত নয়, তাকে শরীয়তের দলীল হিসেবে পেশ করার কোনো অধিকার কারোই থাকতে পারেনা।
সুন্নাত- কঠিন ও সহজ
আমরা যারা আহলি সুন্নাত হওয়ার দাবি করছি এবং মনে বেশ অহমিকা বোধ করছি এই ভেবে যে, আমরা কোনো গোমরাহ ফির্কার লোক নই; বরং নবী করীম(স)-এর প্রতিষ্ঠিত ও সুন্নাত অনুসরণকারী সমাজের লোক। কিন্তু আমাদের এই ধারণা কতখানি যথার্থ, তা আমাদের অবশ্যই গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার।
আমরা আহলি সুন্নাত অর্থাৎ সুন্নাতের অনুসরণকারী। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা রাসূলে করীম(স) এর কোন সুন্নাতের অনুসরণকারী? কঠিন ও কষ্টের সুন্নাতের, নাকি সহজ, নরম ও মিষ্টি মিষ্টি সুন্নাতের।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, রাসূলে করীম(স) এর জীবনে ও চরিত্রে এ উভয় ধরনের সুন্নাতেরই সমাবেশ ঘটেছে। তিনি একজন মানুষ ছিলেন। তাই মানুষ হিসেবেই তাঁকে এমন অনেক কাজই করতে হয়েছে, যা এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকার জন্য দরকার। যেমন খাওয়া, পরা, দাম্পত্য ও সাংসারিক জীবন যাপন। এ ক্ষেত্রে তিনি যে যে কাজ করেছেন শরীয়তের বিধান অনুযায়ী তা-ও সুন্নাত বটে। তবে তা খুবই সহজ, নরম ও মিষ্টি সুন্নাত। তা করতে কষ্টতো হয়-ই না; বরং অনেক আরাম ও সুখ পাওয়া যায়। যেমন, কদুর তরকারী খাওয়া, মিষ্টি খাওয়া, পরিচ্ছন্ন পোষাক পরিধান করা, মিস্ওয়াক করা, আতর-সুগন্ধী ব্যবহার করা, বিয়ে করা, একাধিক স্ত্রী গ্রহণ, লম্বা জামা-পাগড়ী বাঁধা, দাঁড়ি রাখা ইত্যাদি।
কিন্তু রাসূলে করীম(স) এর জীবনে আসল সুন্নাত সেইসব কঠিন ও কষ্টসাধ্য কাজ, যা তাঁকে সেই মুশরিক আল্লাহদ্রোহী সমাজে তওহীদি দাওয়াত প্রচার ও দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা-প্রচেষ্টার সাথে করতে হয়েছে। এই পর্যায়ে তাঁকে ক্ষুধায় কাতর হতে, পেটে পাথর বাঁধতে ও দিন-রাত অবিশ্রান্তভাবে শারীরিক খাটুনী খাটতে হয়েছে। শত্রুদের জালা-যন্ত্রণা ভোগ করতে, পায়ে কাঁটা লাগাতে এবং তায়েফে গিয়ে গুন্ডাদের নিক্ষিপ্ত পাথরে দেহ মুবারককে ক্ষত-বিক্ষত করে রক্তের ধারা প্রবাহে পরনের কাপড় সিক্ত করতে ও ক্লান্ত শ্রান্ত অবসন্ন হয়ে রাস্তার ধারে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেতে হয়েছে। এক সময় বনু হাশিম গোত্রের সাথে মক্কাবাসীদের নিঃসম্পর্ক ও বয়কট হয়ে আবু তালিব গুহায় ক্রমাগত তিনটি বছর অবস্থান করতে হয়েছে। সর্বশেষে পৈতৃক ঘর-বাড়ি ত্যাগ করে মদীনায় হিজরত করতে হয়েছে। কাফির শত্রু বাহিনীর মোকাবিলায় মোজাহিদদের সঙ্গে নিয়ে পূর্ণ পরাক্রম সহকারে যুদ্ধ করতে, দন্ত মুবারক শহীদ করতে ও খন্দক খুদতে হয়েছে।
রাসূলে করীম(স) এর এসব কাজও সুন্নাত এবং সে সুন্নাত অনুসরণ করাও উম্মতের জন্য একান্ত কর্তব্য। তবে এ সুন্নাত অত্যন্ত কঠিন, দুঃসাধ্য ও প্রাণান্তকর চেষ্টার সুন্নাত।
সহজেই প্রশ্ন জাগে, আমরা কি এই সুন্নাত পালন করছি? যদি না করে থাকি-করছি না যে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়- তাহলে রাসূলের সুন্নাত অনুসরণের যে দাবি আমরা করছি, তা কি সত্য বলে মনে করা যায়? বড়জোর এতটুকুই বলা চলে যে, হ্যাঁ, আমরা রাসূলের সুন্নাত অনুসরণ করছি বটে, তবে তা মিষ্টি, সহজ ও নরম নরম সুন্নাত। কিন্তু কঠিন, কষ্ট, প্রাণে ও ধন-সম্পদে আঘাত লাগে এমন কোনো সুন্নাত পালনের দিকে আমাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, তাও যে আমাদেরকে অবশ্য পালন করতে হবে, না করলে কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট কঠিন জবাবদিহি করতে হবে, সেকথা স্মরণ করতেও যেন আমরা ভয় পাই।