পীর মুরীদী সম্পর্কে আমার চূড়ান্ত কথা
পীর মুরীদী সম্পর্কে আমি উপরে যা কিছুই লিখেছি, পাঠক মহোদয় লক্ষ্য করলে স্বীকার করবেন যে, আমি নিজস্ব মনগড়া কোনো কথা লিখিনি। তা যেমন কুরআন, সুন্নাত ও সর্বজনমান্য মনীষীবৃন্দের কথার দলীলের ভিত্তিতে লিখেছি তেমনি এ পর্যায়ে আমার নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতাও রয়েছে।
কিন্তু সে অভিজ্ঞতা শুধু বিদয়াতী পীর সম্পর্কে বা পীর মুরীদী বিদয়াত হওয়া সম্পর্কেই নয়, এর বিপরীত এ অভিজ্ঞতাও আমার রয়েছে যে, সিলসিলার ও পীরের মৃত্যুর পর গদীনশিন হওয়ার পরও কেউ কেউ এমন আছেন, যিনি পীর মুরীদকে বিদয়াত ও নিছক ব্যবসায়ীর কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকার থেকে টেনে বাইরে নিয়ে এসে তাকে ঠিক ওস্তাদ-শাগরীদ, শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক কার্য্ত স্থাপন করেছেন। মারিফাত চর্চাকে শরীয়তের ভিত্তিতে পুনর্গঠিত করেছেন। শরীয়তের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে মারিফাতের শিক্ষাদানের কাজ করেছেন এবং এই গোটা তৎপরতার সঙ্গে জিহাদের সম্পর্ক স্থাপন করে দ্বীনী বিপ্লবের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন। তা দেখে দিল খুশিতে ভরে গেছে এবং মনে আশা জেগেছে যে, আল্লাহর নাযিল করা ও সর্বশেষ নবী রাসূল হযরত মুহাম্মাদ(স) এর প্রচারিত ও কায়েম করা দ্বীন হয়ত এখানে কায়েম হবে। মূলত খিলাফাতে রাশেদার অবসানের পর প্রথম দিকে দ্বীন কায়েমের যেসব চেষ্টা প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল, তা দ্বীনভিত্তিক মারিফাত ও জিহাদের বিপ্লবী ভাবধারা সমন্বিত ছিল, যাঁর ধ্বংসাবশেষ রূপ বর্তমান ব্যবসামূলক বিদয়াতপন্থী পীর-মুরীদী। বর্তমান অবস্থার আমূল পরিবর্তন করে সেই আসল ও আদর্শবাদভিত্তিক উস্তাদ-শাগরিদমূলক জন-সংগঠনের মাধ্যমে দ্বীন কায়েমের জন্য দ্বীন ও শরীয়তের, মারিফাত ও জিহাদের সমন্বয় নতুন করে কায়েম করাই বর্তমান মরণাপন্ন মুসলিম সমাজকে রক্ষা করা ও দ্বীনের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করার একমাত্র উপায়। ধর্মহীন রাজনীতি, রাজনীতিহীন ধর্ম- উপরন্তু দ্বীনের শুষ্ক তাত্ত্বিকতা দ্বীন কায়েমের পথে বড় বাঁধা। দ্বীন-ইসলামের নির্ভূল তত্ত্বকে হৃদয়ের ঈমানী আবেগে সঞ্জীবিত করে জিহাদী কার্য্ক্রমের মাধ্যমেই পীর-মুরীদীর পুনর্গঠন হওয়া আবশ্যক।
মানত মানায় শিরক এর বিদয়াত
কোনো কিছুর জন্য কোনো কাজ করার বা কোনো কিছু দেয়ার মানত মানার সুযোগ ইসলামে রয়েছে। এ মানতকে আরবী ভাষায় বলা হয় নজর। আর ‘নজর’ এর অর্থ ইমাম রাগেব লিখেছেনঃ
-মানত বলা হয় এরূপ কাজকে যে, কোনো কিছু ঘটবার জন্য তুমি নিজের ওপর এমন কোনো কাজ করার দায়িত্ব গ্রহণ করবে-ওয়াজিব করে নেবে- যা আসলে তোমার ওপর ওয়াজিব নয়। যেমন বলা হয়ঃ আমি আল্লাহর জন্যে একাজ করার মানত করেছি।
ইবনুল আরাবীন মানত এর সংজ্ঞাদান প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ
-কোনো কাজ করার বাধ্যবাধকতা নিজের ওপর নিজের কথার সাহায্যে চাপিয়ে নেয়া, যে কাজ হবে একান্তভাবে আল্লাহর ফরমাবরদারীমূলক এবং যা দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ হতে পারে।
তাফসীরে আবুস সউদে লিখিত হয়েছেঃ
-মানত হচ্ছে মনকে কোনো কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করা এবং তাকে বাধ্যতামূলকভাবে সম্পন্ন করা।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ
-আমাদের মতের লোকেরা বলেছেনঃ ইবাদত বা দান খয়রাতের কিছু নিজের ওপর অতিরিক্তভাবে জায়েয করে নেয়াকেই মানত বলা হয়। কুরআন মজীদে এ মানত মানার কথা বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা আল বাকারার ২৭০ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ
وَمَا أَنفَقْتُم مِّن نَّفَقَةٍ أَوْ نَذَرْتُم مِّن نَّذْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُهُ ۗ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ [٢:٢٧٠]
-তোমরা যা কিছু খরচ করো বা মানত মানো, আল্লাহ তার সবকিছুই জানেন। আর জালিমদের জন্য সাহায্যকারী নেই। (আল বাকারাঃ২৭০)।
তাসীরে মাজহারীতে এ আয়াতে ব্যাখ্যা লিখা হয়েছে এভাবেঃ মানত হচ্ছে এই যে, তোমরা আল্লাহর জন্য করবে বলে কোনো কাজ নিজের জন্য বাধ্যতামূলক করে নিবে শর্তাধীন কিংবা বিনাশর্তে।
এ আয়াত ও তাফসীরের উদ্ধৃতি স্পষ্ট বলে দেয় যে, মানত হতে হবে কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য। যে মানত হবে কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যে, কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী কেবল তাই জায়েয; যে মানত খালিসভাবে আল্লাহর জন্য নয়, তা কুরআনের দৃষ্টিতে কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়। কুরআনের যে ধরনের মানত সমর্থিত, তাঁর দৃষ্টান্ত হচ্ছে ইমরান-স্ত্রীর মানত।
সূরা আল ইমরানে ৩৫ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ
إِذْ قَالَتِ امْرَأَتُ عِمْرَانَ رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِي بَطْنِي مُحَرَّرًا فَتَقَبَّلْ مِنِّي ۖ
–ইমরান স্ত্রী বললেনঃ হে আল্লাহ! আমার গর্ভে যে সন্তান রয়েছে তা আমি তোমারই জন্য মানত করলাম, তাকে দুনিয়ার ঝামেলা থেকে মুক্ত করবে, অতএব তুমি আমার এ মানত কবুল করো। (আল ইমরানঃ৩৫)।
ইমরান স্ত্রীর মানত ছিল একান্তভাবেই আল্লাহরই জন্য। সে মানতে এ দুনিয়ার কোনো স্বার্থলাভ লক্ষ্য ছিলনা, তাতে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করা হয়নি। মানত যে কেবল আল্লাহর জন্যই মানতে হয়-এ আয়াতে তার স্পষ্ট পথ নির্দেশ রয়েছে। ইমরান-স্ত্রীর কথা ‘তোমারই জন্য মানত করেছি’ তা স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে। আর একটি দৃষ্টান্ত হলো সূরা মরীয়মের ২৬নং আয়াত। আল্লাহ তা‘আলা নিজেই মরিয়মকে লক্ষ্য করে বলেছেনঃ
فَقُولِي إِنِّي نَذَرْتُ لِلرَّحْمَٰنِ صَوْمًا
–অতএব তুমি বলো আমি আল্লাহর জন্যই রোযা মানত করলাম। (মরিয়মঃ ২৬)
আল্লাহ নিজেই শিক্ষা দিলেন এ আয়াতের মাধ্যমে যে, মানত কেবল আল্লাহর জন্যই মানতে হবে, অন্য কারো জন্য অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়।
এ পর্যায়ে কুরআন থেকে আরো দুটো আয়াতাংশ উদ্ধৃত করা যাচ্ছে। একটি হলোঃ তারা যেন তাদের মানতসমূহ পুরো করে।
আর রাসূলের সাহাবীদের প্রশংসা করে কুরআনে বলা হয়েছেঃ তারা মানত পুরা করে।
এ ছাড়া আরো বহু আয়াত রয়েছে কুরআনে, যাতে আল্লাহর সাথে করা ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি পূরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর মানত যেহেতু আল্লাহর সাথেই করা এক বিশেষ ধরনের ওয়াদা, সে জন্যে মানত অবশ্যই পূরণ করতে হবে।
কুরআন, হাদীস ও ফিকাহ এর দৃষ্টিতে মানত মানার ব্যাপারে বুনিয়াদী শর্ত হলো এই যে, তা মানতে হবে একান্তভাবে আল্লাহর জন্যে, আল্লাহর সন্তোষ বিধানের জন্য। যে মানত আল্লাহর সন্তোষ বিধানের জন্য করা হয়নি, তা মূলতই মানত নয়। তা পূরণ করাও ওয়াজিব নয়। উপরন্তু সে মানত হবে এমন কাজ করার, যে কাজ আল্লাহর আনুগত্যমূলক, যা আল্লাহর নাফরমানীর কোনো কাজ নয়।
হাদীসে এ কথা স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। আবু দাউদের কিতাবে উদ্ধৃত হয়েছে-হযরত ইবনে আমর বর্ণনা করেছেনঃ আমি রাসূল(স)কে বলতে শুনেছিঃ আরবী (*********)
-যে মানত দ্বারা আল্লাহর সন্তোষ লাভ করতে চাওয়া হয়নি, তা মূলতই মানত নয়।
অথবা এর তরজমা হবে, ‘মানত শুধু তাই যা থেকে আল্লাহর সন্তোষ লাভ করতে চাওয়া হয়েছে।’
ইমাম আহমদ মুসনাদে এবং তিবরানী বর্ণনা করেছেনঃ
নবী করীম(স) এক কঠিন গরমের দিনে লোকদের সামনে ভাষণ দিচ্ছিলেন। এ সময় একটি লোককে (সম্ভবত কোনো মরুবাসীকে) রোদের খরতাপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন- কি ব্যাপার; তোমাকে রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি কেন? লোকটি বললো, ‘আমি মানত করেছি আপনার ভাষণ শেষ না হওয়া পর্য্ন্ত রোদে দাঁড়িয়ে থাকবো।’ তখন নবী করীম(স) বললেন-আরবী (******)
-তুমি বসো, এটাতো কোনো মানত হলোনা। মানত তো শুধু তাই, যা করে আল্লাহর সন্তোষ হাসিল করা উদ্দেশ্য হবে।
এ মর্মের বহু সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সে সবগুলো থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, মানত এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তোষ লাভ; ব্যক্তির কোনো বৈষয়িক স্বার্থের লাভ নয়, নয় আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সন্তোষ লাভ, আর যে মানত সেরূপ হবেনা, তা মানতই নয়, তা আদায় করাও কর্তব্য নয়।
মানত কেবল আল্লাহর সন্তোষ লাভ করার উদ্দেশ্যেই হলে চলবেনা, তা হতে হবে এমন কাজের মানত, যে কাজ মূলতই আল্লাহর আনুগত্যমূলক। যে কাজ আল্লাহর আনুগত্যমূলক নয়, তা করার মানত করা হলেও তা মানত বলে গণ্য হবেনা, তা পূরণ করাও হবেনা ওয়াজিব। হাদীসে তার ভুঁড়ি ভুঁড়ি প্রমাণ রয়েছে। হযরত ইমরান ইবনে হুসায়েন(রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে-নবী করীম(স) বলেছেনঃ
-মানত দু’প্রকারের হয়। যে মানত আল্লাহর আনুগত্যের কোনো কাজের হবে, তা আল্লাহর জন্য বটে এবং তাই পূরণ করতে হবে। আর যে মানত আল্লাহর নাফরমানীমূলক কাজের মাধ্যমে হবে, তা হবে শয়তানের উদ্দেশ্যে। তা পূরণ করার কোনো দায়িত্ব নেই। কর্তব্যও নয়।
বুখারী শরীফে এমন কিছু হাদীসের উল্লেখ রয়েছে, যা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, ইসলামে এই মানত মানার কাজের কিছুমাত্র উৎসাহ দেয়া হয়নি। কথায় কথায় মানত মানার যে রোগ দেখা যায় অশিক্ষিত লোকদের মধ্যে এবং যে মানত মানার ইসলামী পদ্ধতি জানা না থাকার কারণে লোকেরা এক্ষেত্রে নানা প্রকার শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়ে, রাসূলে করীম(স) একে কিছুমাত্র উৎসাহিত করেননি, এবং তিনি একে সম্পূর্ণ অর্থহীন কাজ বলে ঘোষণা করেছেন। হযরত ইবনে উমর(রা) বলেনঃ
-তোমরা কি লোকদেরকে মানত মানা থেকে নিষেধ করোনা? অথচ নবী করীম(স) বলেছেনঃ মানত মানায় না কিছু আসে, না কিছু যায়(বা মানত কিছু এগিয়েও দেয়না, কিছু পিছিয়েও দেয়না)। এতে বরং শুধু এতটুকু কাজ হয় যে, এর ফলে কৃপণের কিছু ধন খরচ হয়ে যায় মাত্র।
হযরত আবু হুরায়রা(রা) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম(স) ইরশাদ করেছেনঃ মানত মানব সন্তানকে কোনো ফায়দাই দেয়না। দেয় শুধু তাই, যা তার তকদীরে লিখিত হয়েছে। বরং মানত মানুষকে তার তকদীরের দিকেই নিয়ে যায়। অতঃপর কৃপণ ব্যক্তির হাত থেকে আল্লাহ কিছু খরচ করান। তার ফলে সে আমাকে(আল্লাহকে)এমন কিছু দেয়, যা এর পূর্বে সে কখনো দেয়নি।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমরের যে হাদীসটি মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, তাতে মানত মানা থেকে রাসূল করীম(স) স্পষ্ট বাণী উচ্চারণ করেছেন।
ইরশাদ হয়েছেঃ আরবী(******)
-একদিন নবী করীম (স) আমাদের মানত মানা থেকে নিষেধ করেছিলেন। বলছিলেন, মানত কোনো কিছু থেকেই ফিরাতে পারেনা, তাতে শুধু কৃপণের কিছু অর্থ ব্যয় হয় মাত্র।
অপর এক হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছেঃ মানত মানা থেকে রাসূলে করীম(স) নিষেধ করেছেন। অপর বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ তোমরা মানত মানবেনা। কেননা এ মানত এক বিন্দু তকদীর বদলাতে বা ফিরাতে পারেনা।
এই হাদীস কয়টি থেকে বোঝা যায়, ইসলামে মানত মানার রীতি পছন্দনীয় নয়, বরং তা রাসূলের সুন্নাতের সম্পূর্ণ বিপরীত এক বিশেষ ধরনের বিদয়াত। আরো স্পষ্ট বলা যায়, টাকা পয়সা বা ধন সম্পদের মানত করা সম্পূর্ণ হারাম, তা যে কোনো উদ্দেশ্যেই করা হোকনা কেন? ইমাম মুহাম্মদ ইসমাইল আল-কাহলানী আস সানয়ানী লিখেছেন তাই লিখেছেনঃ
-মানত মানাকে হারাম বলা, এ কথাতো হাদীস থেকেই প্রমাণিত। এ হারাম হওয়ার কথা আরো শক্ত হয় এজন্য যে, মানত মানা থেকে নিষেধ করতে গিয়ে তার কারণ দর্শানো হয়েছে এই যে, এতে কোনো কল্যাণই আসেনা। তাতে যে অর্থ ব্যয় হয়, তা তো অযথা বিনষ্ট করা হয়। আর অর্থ বিনষ্ট করা হারাম। অতএব ধন মাল দেয়ার মানত মানাও হারাম।
অধিকাংশ শাফেয়ী ও মালেকী মাযহাবের লোকের বিশ্বাস, মানত মানা মাকরূহ। হাম্বলী মাযহাবেও একে মাকরূহ তাহরীম মনে করা হয়েছে। এর কারণ বলা হয়েছে এই যে, মানত কখনো আল্লাহর জন্য খালেস হয়না। তাতে ‘কোনো না কোনো বিনিময়’ লাভ লক্ষ্যভূত থাকে। অনেক সময় মানত মানা হয়; কিন্তু তা পূরণ করা কঠিন হয় বলে তা অপূরণীয়ই থেকে যায়। আল্লামা কাযী ইয়াজ বলেছেনঃ “মানত তাকদীরের ওপর জয়ী হতে চায় আর জাহিল লোকেরা মনে করে যে, মানত করলে তাকদীর ফিরে যাবে।” ইমাম তিরমিযী এবং কোনো কোনো সাহাবীও মানত মানাকে মাকরূহ মনে করতেন বলে উল্লেখ করেছেন। আর আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক লিখেছেনঃ মানত –তা আল্লাহর হুকুমবরদারীরই হোক কি নাফরমানীর- উভয় ক্ষেত্রে অবশ্য মাকরূহ হবে।
আর মাকরূহ মানে এসব ক্ষেত্রে মাকরূহ তাহরীম। ইবনুল আরাবী লিখেছেন-‘মানত মানা দো’আর সাদৃশ্য, তাতে তাকদীর ফিরে যায়না।” এ-ই হচ্ছে তকদীর। অথচ দো’আ করাকে পছন্দ করা হয়েছে, কিন্তু মানত মানতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা মানত উপস্থিত ইবাদত। তাতে সোজাসুজি বান্দার মন মগজ আল্লাহর দিকেই ঝুঁকে পড়ে। তা হয় বিনয়া্বনত, কাতর, উৎসর্গীত আল্লাহরই সমীপে। কিন্তু মানত মানায় উপস্থিত কোনো ইবাদত দেখা যায়না; বরং তাতে সরাসরি আল্লাহর পরিবর্তে সেই মানতের ওপরই নির্ভরতা দেখা দেয়। আর তা-ই শিরক পর্য্ন্ত পৌছায়।
এই প্রেক্ষিতে দেখা যায় যে, বর্তমানে সাধারণভাবে জনগণের মাঝে এবং এক শ্রেণীর জাহিল পীরের মুরীদরেদ মধ্যে কথায় কথায় মানত মানার যে হিড়িক পড়ে গেছে এবং ওয়ায-নসীহতে মানত মানার যে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে, তা আর যা-ই হোক ইসলামের আদর্শ নয়, নয় রাসূলের প্রতিষ্ঠিত সুন্নাত বরং তা স্পষ্টভাবে বিদয়াত। এ বিদয়াত-ই কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিরক এ পরিণত হয়ে যায়। শিরক হয় তখন, যখন মানত মানা হয় কোনো মরা পীরের কবরের নামে। কেননা এসব ক্ষেত্রে ‘আল্লাহর ওয়াস্তে’ যতই মানত মানা হোকনা কেন, আসলে তা ‘আল্লাহর ওয়াস্তে’ থাকেনা। তার সামনে পীর, মাদ্রাসা ইত্যাদি-ই থাকে প্রবল হয়ে এবং মনে করা হয়, এদরে এমন কিছু বিশেষত্ব আছে, আছে এমন কিছু অলৌকিক ক্ষমতা, যার কারণে সে এ মানতের দরুন উপস্থিত বিপদ থেকে উদ্ধার লাভ করতে পারবে; কিংবা তা বাঞ্চিত কোনো সুবিধা লাভ করিয়ে দিতে পারবে। আর ইসলামের দৃষ্টিতে এ-ই হচ্ছে সুস্পষ্ট শিরক। এ ধরনের মানত মানায় আল্লাহকে রাখা হয় পেছনে, আর যার নামে মানত করা হয়, সেই হয় মুখ্য। মনে ঐকান্তিক সম্পর্ক তারই সাথে স্থাপিত হয়, তাকে খুশি করাই হয় আসল লক্ষ্য। কাজেই এই জিনিস আল্লাহর নিষেধ এবং তা আল্লাহর বাণীঃ
فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَندَاد ا
–‘কাউকেই আল্লাহর সমতুল্য ও প্রতিদ্বন্ধী বানিওনা’(আল বাকারাঃ২২) এর বিপরীত হয়ে যায়।
এ ধরনের মানত মানা যে হারাম তাতে কোনো মুসলমানেরই কি এক বিন্দু সন্দেহ থাকতে পারে?
পূর্বোক্ত হাদীস হতে অবশ্য এ কথাও জানা যায় যে, মানত যদি খালেসভাবে কেবল মাত্র আল্লাহর জন্যেই হয়, তবে তা পূরণ করতে হবে এবং তা জায়েয। কিন্তু দুঃখের বিষয়, জায়েয নিয়মে খালেসভাবে মানত মানা খুব কম লোকের পক্ষেই সম্ভব হয়ে থাকে। তাই টাকা পয়সা খরচ করার বা কোনো মাল দেয়ার মানত মানা না মানাই তওহীদবাদী লোকদের জন্য নিরাপদ পথ। যদি মানত মানতেই হয়, তবে যেন নামায রোযা, আল্লাহর ঘরের হ্জ্জ ইত্যাদি ধরনের কোনো কাজের মানত মানা হয়। কেননা তাতে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ-ই বান্দার সামনে আসেনা- আসার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ধন-মালের যে মানত মানা হয় তাতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু বা অন্য কারো প্রতিই মন বেশি করে ঝুঁকে পড়ে, বিশেষ করে এক শ্রেণীর শোষক জাহিল অর্থলোভী গদীনশিন পীর যখন মানত মানার এক জাল বিস্তার করে দিয়েছে সমস্ত সমাজের ওপর, তখন মূর্খ লোকেরা ও অজ্ঞ লোকেরা এ জালে সহজেই ধরা পড়ে যেতে পারে, নিমজ্জিত হতে পারে কঠিন শিরক এর অন্ধ গহবরে। এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা দরকার যে, যদি কোনো বিশেষ জায়গার বিশেষ লোকদের জন্যে টাকা পয়সা বা কোনো মাল খরচ করার মানত করা হয়, তবে সে টাকা ইত্যাদি সেখানেই খরচ করতে হবে ইসলামে এমন কোনো জরুরী শর্ত নেই।
হানাফী ফিকহের কিতাবে লিখিত হয়েছে-
কেউ যদি বলে, অমুক দিন আল্লাহর নামে কিছু দান করা আমার ওপর ওয়াজিব কিংবা বলে অমুক স্থানের মিসকীনদের জন্য কিছু সদকা দেয়া ওয়াজিব, তাহলে দিন ও স্থানের কয়েদ পালন করা জরুরী হবেনা।
অর্থাৎ, যে কোনো দিন ও যে কোনো স্থানের গরীবদের মধ্যে দান করলেই মানত পূরণ হয়ে যাবে।
কবর যিয়ারত বিদয়াত
ইসলামে কবর যিয়ারত করা জায়েয ও সুন্নাত সমর্থিত। কিন্তু বর্তমানে কবর বিশেষ করে পীর অলী বলে কথিত লোকদের কবরকে কেন্দ্র করে দীর্ঘকাল ধরে যা কিছু হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ বিদয়াত, ইসলাম বিরোধী এবং সুস্পষ্ট শিরক, তাতে কোনো সন্দেহই থাকতে পারেনা।
কবর যিয়ারত সম্পর্কিত হাদীসসমূহ থেকে জানা যায়, ইসলামের প্রাথমিক যুগে কবর যিয়ারত করার অনুমতি ছিলনা। পরে সে অনুমতি দেয়া হয়। এ পর্যায়ে নবী করীম(স) এর একটি কথাই বড় দলীল। তিনি বলেছেনঃ আরবী(******)
-আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু এখন বলছি তোমরা কবর যিয়ারত করো।
অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ আরবী(*******)
-তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কবর যিয়ারত করতে চায়, তবে সে তা করতে পারে। কেননা কবর যিয়ারত মানুষকে পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
ইমাম নবয়ী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ সকলেই এ ব্যাপারে একমত যে, কবর যিয়ারত করা মুসলমানদের জন্য সুন্নাত সমর্থিত।
হযরত আনাস(রা) বর্ণিত হাদীসে এ ব্যাপারে আরো একটি বিস্তারিত কথা বলা হয়েছে। নবী করীম(স) বলেছেনঃ আরবী(********)
-আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে প্রথমে নিষেধ করেছিলাম কিন্তু পরে আমার নিকট স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এ কবর যিয়ারতে মন নরম হয়, চোখে পানি আসে এবং পরকালকে স্মরণ করিয়ে দেয়। অতএব তোমরা কবর যিয়ারত করো। কিন্তু তা করতে গিয়ে তোমরা অশ্লীল, গর্হিত ও বাজে কথাবার্তা বলোনা।
ইবনুল হাজার আল আসকালানী লিখেছেনঃ অশ্লীল কথা এবং অবাঞ্চনীয় অতিরিক্ত কথাবার্তা অর্থাৎ অশ্লীল, অপ্রয়োজনীয় ও অবাঞ্চনীয় কথাবার্তা কবরস্থানে বেশি করে বলা নিষিদ্ধ।
হযরত ইবনে আব্বাস(রা) বলেছেন-রাসূলে করীম(স) অভিশাপ বর্ষণ করেছেন কবর যিয়ারতকারী মেয়েলোকদের ওপর এবং তাদের ওপরও, যারা কবরের ওপর মসজিদ, গুম্বদ বা কোব্বা ইত্যাদি নির্মাণ করে।
হযরত আয়েশা(রা) তাঁর মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় বলেছিলেন-আল্লাহ তা‘আলা লানত করেছেন ইহুদী ও খৃস্টানদের ওপর এজন্য যে, তারা তাদের নবী-রাসূলের কবরকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে।
আর গুম্বদ বা কোব্বা নিষিদ্ধের কারণ হচ্ছে- তাতে করে ধন মালের অপচয় হয়, কারো কোনো উপকার সাধিত হয়না। আর কবরস্থানে মসজিদ বানান হলে কবরের প্রতি অধিক সম্মান প্রদর্শন করা হয়। তা থেকে বিরত রাখাই এ নিষেধের উদ্দেশ্য।
অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ আরবী(***********)
-কবর যিয়ারতকারী মেয়েলোক এবং তার ওপর যারা বাতি জ্বালায় তাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলা অভিশাপ করেছেন।
আর একটি হাদীসে বলা হয়েছে এভাবে-আরবী(********)
-কবরকে পাকা-পোক্ত ও শক্ত করে বানাতে, তার ওপর কোনোরূপ নির্মাণ কাজ করতে, তার ওপর বসতে এবং তার ওপর কোনো কিছু লিখতে নবী করীম(স) সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করেছেন।
নবী করীমের ফরমান অনুযায়ী বলা যায় যে, কবরকে কেন্দ্র করে এসব কাজ করা মহা অন্যায়, অবাঞ্জনীয়। আর যারা একাজ করে তারা নিকৃষ্টতম লোক। নবী করীম(স) নিজে নিজের সম্পর্কে দো‘আ করেছেন এই বলেঃ আরবী(*********)
-হে আল্লাহ! তুমি আমার কবরকে কোনো পূজ্যমূর্তি বানিয়ে দিওনা। বস্তুত যে জাতি তাদের নবী রাসূলের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে, তাদের ওপর আল্লাহর গজব তীব্র হয়ে উঠছে।
এ হাদীসের তাৎপর্য্ সুস্পষ্ট। কবরের দিকে মুখ ফিরিয়ে সিজদা করা, কবরকে কিবলার দিকে রেখে নামাজ পড়া শরীয়তে সুস্পষ্ট হারাম। হযরত জুনদুব ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম(স) মুসলমানদের লক্ষ্য করে ইরশাদ করেছেনঃ আরবী(*********)
-সাবধান হও, তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা নবী-রাসূল ও নেক লোকদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছিল। তোমরা কিন্তু সাবধান হবে, তোমরা কখনো কবরকে মসজিদ বানাবেনা। আমি এ থেকে তোমাদের স্পষ্ট নিষেধ করছি।
কবরকে কেন্দ্র করে যে ওরশ ও মেলা অনুষ্ঠিত হয় তা ইসলামে নিষিদ্ধ। হযরত আবু হুরায়রা(রা) বলেনঃ আরবী(*********)
-রাসূলে করীম (স) কে বলতে শুনেছিঃ তোমরা তোমাদের ঘরকে কবরস্থানে পরিণত করোনা(অন্তত নফল নামায নিজেদের ঘরেই পড়বে)। আমার কবর কেন্দ্রে মেলা বসাবেনা, তোমরা আমার প্রতি দুরুদ পাঠাবে। যেখানে থেকেই তোমরা দুরুদ পাঠাওনা কেন, তা অবশ্যই আমার নিকট পৌছবে।
এ কারণেই কবরকে কোনো স্পষ্ট ও উন্নত স্থানরূপে নির্মিত করতেও নিষেধ করা হয়েছে। নবী করীম(স) হযরত আলী(রা) কে এ দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন-আরবী(*********)
-সব মূর্তি চুরমার করে দিবে এবং সব উচ্চ ও উন্নত কবর ভেঙ্গে সমান ও মাটির সাথে একাকার করে দিবে। এ থেকে যেন কোনো প্রতিকৃতি ও কোনো কবর রক্ষা না পায়। (হাদীসটি সহীস মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত। এর বর্ণনাকারী আবুল হাইয়্যাজ আল আমাদী। হযরত আলী(রা) তাঁকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-রাসূল(স) আমাকে যে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, আমি ও কি তোমাকে সে দায়িত্ব দিয়ে পাঠাবোনা? খলীফাতুল মুসলিমীন হিসেবেই হযরত আলী(রা) তাঁকে এই দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন।)
এসব কয়টি হাদীস থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে কবর যিয়ারত করা সাধারণ মুসলমানদের জন্যই নিষিদ্ধ ছিলো। নিষেধের কারণ এখানে স্পষ্ট বলা হয়নি। তবে অন্যান্য কারণের মধ্যে এও একটি বড় কারণ অবশ্যই ছিল যে, কবর পূজা জাহিলিয়াতের জমানায় একটি মুশরিকী কাজ হিসেবে আরব সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। মুসলমান হওয়ার পরও কবর যিয়ারতের ব্যাপক সুযোগ থাকলে তওহীদবাদী এ মানুষের পক্ষে কবর পূজার শিরক এ নিমজ্জিত হয়ে পড়ার বড় বেশি আশংকা ছিল। কিন্তু পরে যখন ইসলামী আকীদার ব্যাপক প্রচার ও বিপুল সংখ্যক লোকের মন-মগজে তা দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়, পূর্ণ বাস্তবায়িত হয় ইসলামী জীবনাদর্শ, তখন কবর যিয়ারতের অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু সে অনুমতি কেবল পুরুষদের জন্য, মেয়েদের তা থেকে বাদ দিয় রাখা হয়। শুধু তা-ই নয়, কবর যিয়ারত করতে মেয়েদের যাওয়ার ব্যাপারটিকে ইসলামের দৃষ্টিতে অভিশাপের কাজ বলে ঘোষণা করা হয়।
এ পর্যায়ে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী লিখেছেনঃ আরবী(********)
-আমি বলছি, শুরুতে কবর যিয়ারত নিষিদ্ধ ছিল। কেননা তা কবর পূজার দ্বার খুলে দিত। কিন্তু পরে যখন ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হলো এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর ইবাদত হারাম হওয়ার ব্যাপারে তাদের মন-মগজ স্থির বিশ্বাসী হলো, তখন কবর যিয়ারত করার অনুমতি দেয়া হয়।
অবশ্য মেয়েলোকদের কবর যিয়ারত করতে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো কোনো ফিকাহবিদ সামান্য ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাঁরা এক দিকে নিষেধ ও অপর দিকে অনুমতি- এ দুয়ের মাঝে সামঞ্জস্য স্থাপনের উদ্দেশ্যে বলেছেন- নেককার লোকদের কবর যিয়ারত করে বরকত লাভ করা বৃদ্ধা মেয়েলোকদের জন্য জায়েয, তাতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু যুবতী মেয়েলোকদের পক্ষে মাকরূহ তাহরীম।
কবর যিয়ারত করতে অনুমতি দেয়ার কারণ হাদীসে বলা হয়েছে-তাতে মানুষের মন নরম হয়, চোখে পানি আসে এবং পরকালের কথা মনে আসে। মনে আসে, কবরস্থ সব লোকই একদিন তাদেরই মতো জীবিত ছিল। কিন্তু আজ দুনিয়ার বুকে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। এমনিভাবে তাদেরও সব মানুষেরই এরূপ পরিণতি দেখা দিবে। এ থেকে কারোরই রেহাই নেই। এতে করে যিয়ারতকারীর মনে পরকালের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের এক প্রয়োজনীয় ভাবধারা জাগে। আর ইসলামে তা বিশেষভাবে কাম্য।
কিন্তু কবর নির্মাণ সম্পর্কে এ হাদীসসমূহে দু’টো কড়া নিষেধ উদ্ধৃত হয়েছে। একটি এই যে, কবরস্থানে মসজিদ নির্মাণ করা চলবেনা। কেননা তা করা হলে মানুষ মসজিদের মতো কবরের প্রতিও ভক্তিভাজন হয়ে পড়তে পারে, কবরের প্রতি দেখাতে পারে আন্তরিক সম্মান ও শ্রদ্ধা। আর এ জিনিসই হলো শিরক এর উৎস। কবরগাহে মসজিদ বানানোর প্রচলন মুসলিম সমাজে দীর্ঘদিন থেকে চালু হয়ে আছে। অলী-আল্লাহ বলে কথিত কোনো লোকের কবর এখন কোথাও পাওয়া যাবেনা, যার নিকট মসজিদ নির্মাণ করা হয়নি। আর এসব কবরস্থানই শিরক ও বিদয়াতের লীলাকেন্দ্র হয়ে রয়েছে। বহু শত রকমের বিদয়াত মুসলিম সমাজে এখান থেকেই বিস্তার লাভ করেছে। বস্তুত এসব হচ্ছে ইসলামের তওহীদী আকীদায় শিরক এর বিদয়াতের অনুপ্রবেশ।
হাদীস অনুযায়ী কবরের ওপর কোনো কিছু নির্মাণ করাই হারাম। ইমাম শাওকানী পূর্বোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ
-এ হাদীসে এ কথার দলীল পাওয়া গেল যে, কবরের ওপর কোনো কিছু নির্মাণ করাই হারাম।
শুধু তা-ই নয়, কবরের ওপর কিছু লিখাও হারাম। তিরমিযী শরীফে বর্ণিত হাদীসে অন্যান্য কথার সাথে এ বাক্যাংশটুকুও রয়েছে। -কবরের ওপর কিছু লেখাও নিষেধ।
অর্থাৎ কবরে মৃত ব্যক্তির নাম, জন্ম ও মৃত্যুর সন-তারিখ কিংবা কোনো মর্সিয়া বা শোক গাঁথা লেখা নিষিদ্ধ। শরীয়তে নাম লেখা আর অন্য কিছুই লেখা হারাম হওয়ার ব্যাপারে পার্থক্য করা হয়নি।
মাওলানা ইদরীস কান্দেলভী এ সম্পর্কে ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ এ কথার দু’টো অর্থ হতে পারেঃ একটি হচ্ছে কবরের ওপর ইট পাথর দিয়ে কোনো নির্মাণ কাজ করা কিংবা এ পর্যায়ের অন্য কোনো কাজ আর দ্বিতীয় হচ্ছে, কবরের ওপর কোনো চাঁদর, তাবু ইত্যাদি টানিয়ে দেয়া। আর এ দু’ধরনের কাজই নিষিদ্ধ। প্রথমটি নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ আগেই বলা হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি এজন্য যে, তাও প্রথমটির মতই নিষ্ফল, অর্থহীন কাজ। এতে অর্থের অপচয় হয় আর তা হচ্ছে জাহিলিয়াতের লোকদের কাজ।
জনসাধারণ শরীয়তের মূল বিধানের সাথে পরিচিত নয় বলে তারা সব অলী-আল্লাহ বলে পরিচিত লোকদের কবরের কোব্বা নির্মিত ও তার প্রত্যেকটির ওপর নাম ও অন্যান্য জিনিস লিখিত দেখে মনে করে যে, এ বুঝি শরীয়ত সম্মত কাজ, অন্তত এতে শরীয়তে কোনো দোষ নেই। অথচ তা সবই ইসলামে নিষিদ্ধ। হাদীসে এ পর্যায়ে বিপুল সংখ্যক কথা রাসূলে করীম(স) থেকে বর্ণিত এবং কিতাবসমূহে উদ্ধৃতি হয়েছে। এসব হাদীস সম্পর্কে ইমাম হাকিম লিখেছেনঃ
-কবরের ওপর কোনো কিছু লিখতে নিষেধ করা হয়েছে যে হাদীসে তার সবকটিই বিলকুল সহীহ। কিন্তু তদনুযায়ী আমল করা হচ্ছেনা। কেননা সর্বত্র মুসলিম ইমামদের কবরের ওপর কিছু না কিছু লিখিত দেখা যায়। পরবর্তী লোকেরা পূর্ববর্তী লোকদের কাছে এসব শিখছে (ও জায়েয বলে মনে করছে)।
আসলে এ আমল না নবী করীম(স) থেকে প্রমাণিত না সাহাবীদের থেকে। পরবর্তীকালের লোকেরাই উদ্যোক্তা। কিন্তু তারা ছিল এমন লোক যাদের কথা বা কাজ শরীয়তে দলীলরূপে গৃহীত নয়। এ পর্যায়ে ইমাম যাহবী লিখেছেন-ইমাম হাকিমের উপরোক্ত কথা কোনো কাজের কথা নয়। আসলে কোনো সাহাবীই উক্ত নিষিদ্ধ কাজটি করেননি। এ হচ্ছে উত্তরকালের উদ্ভাবিত একটি কাজ-বিদয়াত। কোনো কোনো তাবেয়ী এবং তাদের পরবর্তীকালের লোকেরাই উদ্ভাবন করেছেন। নবী করীম(স) এর এ নিষেধ তাঁদের নিকট পৌছায়নি।
আর পাক ভারতে প্রখ্যাত মনীষী কাযী সানাউল্ল্যাহ পানিপত্তি লিখেছেনঃ
-আউলিয়াগণের কবর প্রসঙ্গে তাদের কবরকে উন্নত করা, তার ওপর গম্বুজ নির্মাণ, ওরস অনুষ্ঠান করা, চেরাগ বাতি জ্বালানো সম্পূর্ণ বিদয়াত। এর মাঝে কতগুলো হারাম মাকরুহ(তাহরীম)। নবী করীম(স) যারা কবরে বাতি জ্বালায় ও মানত করে তাদের ওপর লা‘নত করেছেন। বলেছেন-না আমার কবরের ওপর উৎসব পালন করবে, না তাকে সেজদার স্থান বানাবে, না এরূপ কোনো মসজিদে নামায পড়বে। না কোনো নির্দিষ্ট তারিখে সেখানে একত্রিত হবে। নবী করীম(স) হযরত আলী(রা) কে পাঠিয়েছিলেন এ নির্দেশ দিয়ে যে, উঁচু কবর ভেঙ্গে সমান করে দেবে এবং প্রতিকৃতি যেখানেই পাবে মুছে দিবে।
সহীহ হাদীসে প্রমাণ রয়েছে, নেককার অলী লোকদের কবরস্থানে মসজিদ নির্মাণ করা সাধারণ ও মূর্খ লোকদের একটি চিরন্তন স্বভাব। হযরত আয়েশা(রা) বলেনঃ নবী করীম(স) যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত, তখন তাঁর স্ত্রী মারিয়া আবিসিনিয়ায় তার দেখা গীর্জার কথা রাসূল(স) এর নিকট উল্লেখ করেন। সে সময় উম্মে সালমা ও উম্মে হাবীবা(রা)ও উল্লেখ করেন তাঁদের দেখা সে গীর্জাসমূহের সৌন্দর্য্ ও তাতে রক্ষিত সব ছবি ও প্রতিকৃতির কথা। এসব কথা শুনে নবী করীম(স) মাথা ওপরে তুললেন এবং বললেনঃ আরবী(********)
-এসব ছবি ও প্রতিকৃতির ইতিহাস হলো এই যে, তাদের মধ্য থেকে কোনো নেককার(আমাদের ভাষায় কোনো পীর বা অলী-আল্লাহ বলে কথিত) ব্যক্তি যখন মরে গেছেন, তখন তার কবরের ওপর তারা মসজিদ নির্মাণ করেছে। অতঃপর তার মধ্যে এসব ছবি ও প্রতিকৃতি সংস্থাপিত করেছে। আসলে এরা হলো আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম লোক।
এ হাদীসও প্রমাণ করে যে, কারো কবরকে কেন্দ্র করে মসজিদ নির্মাণ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। কেননা আশংকা রয়েছে, সাধারণ লোকেরা কবরের সাথে সেরূপ ব্যবহারই করবে, যা করছে এসব অভিশপ্ত যেমনে করবে।
বস্তুত বর্তমানকালেও কোনো নামকরা বা খ্যাতনামা ‘অলী’(?)আলিম বা খ্যাতনামা পীরের মাজার খুব কমই দেখা যাবে, যার ওপর কোনো গুম্বদ বা কোব্বা নির্মিত হয়নি। নাম ও জন্ম-মৃত্যুর তারিখ এবং তৎসহ মর্সিয়া গাঁথা লেখা হয়নি। এসব কাজ যেমন হাদীসের স্পষ্ট বরখেলাপ, তেমনি তওহীদী আকীদারও সম্পূর্ণ পরিপন্থী। রাসূলে করীম(স) ইসলামের মৌল ভাবধারা তওহীদী আকীদার সুষ্ঠ হেফাজতের জন্যই এ সব কাজ করতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু রাসূলের এ সুস্পষ্ট নিষেধ নির্ভয়ে অমান্য করে পীর অলী-আল্লাহ বলে কথিত লোকদের, রাজনৈতিক নেতাদের ও প্রখ্যাত ব্যক্তিদের কবরের ওপর বানান হয়েছে ও হচ্ছে কুম্বদ, কোব্বা, স্মৃতি, মিনার প্রভৃতি আর তার ওপর লেখা হচ্ছে তাদের নাম, জন্ম-মৃত্যুর তারিখ ও শ্রদ্ধাঞ্জলী বা মর্সিয়া গাঁথা। কিন্তু এগুলো যে বিদয়াত এবং ইসলামের সম্পূর্ণ খেলাফ কাজ তাতে কোনো ঈমানদার মানুষেরই একবিন্দু সন্দেহ থাকতে পারেনা।
ওপরের দলীলভিত্তিক আলোচনা থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিতে হলো যে, কবর উঁচু করা, তার ওপর কোব্বা নির্মাণ করা, মসজিদ বা নামায পড়ার স্থান নির্ধারণ, তাকে সর্বসাধারণের যিয়ারতগাহে পরিণত করা-কবরের পাশ্বে লোকদের দাঁড়ানোর জন্য ব্যালকনি তৈরি করা-এই সবই অত্যন্ত ও সুস্পষ্ট নিষিদ্ধ কাজ। এই ব্যাপারে রাসূলে করীম(স) কখনও অভিশাপ বর্ষণ করেছেন সেই লোকদের ওপর যারা এসব করে।
আবার কখনও তিনি বলেছেন- আরবী(*****)
-সেই লোকদের ওপর আল্লাহর গজব অত্যন্ত তীব্র ও প্রচন্ড হয়ে এসেছে যারা তাদের নবী-রাসূলগণের কবরসমূহকে মসজিদ বানিয়েছে।
তাই কখনও তিনি নিজেই ঐ কাজ যারা করে তাদের ওপর আল্লাহর গজব তীব্র ও কঠিন হয়ে বর্ষিত হওয়ার জন্য দো’আ করেছেন। সহীহ হাদীসেই তার উল্লেখ রয়েছে।
আবার কখনও তিনি সেই ধরনের সব কবর কোব্বা ইত্যাদি ধ্বংস করার জন্য দায়িত্ব দিয়ে লোক পাঠিয়েছেন। কখনও তিনি এই কাজকে ইয়াহুদী ও খ্রীস্টানদের কাজ বলে অভিহিত করেছেন। কখনও বলেছেনঃ তোমরা আমার কবরকে মূর্তি বানিয়ে অনুরূপ আচরণ করোনা। আবার কখনও বলেছেন-আরবী(******)
-তোমরা আমার কবরকে ঈদের ন্যায় উৎসবের কেন্দ্র বানিওনা।
অর্থাৎ এমন একটি মৌসুম বা সময় নির্ধারণ করে সেই সময় আবার কবরস্থানে লোকজন একত্রিত করে উৎসব করোনা। যেমন করে কবর পূজারীরা করে থাকে। তথায় তারা নানা অনুষ্ঠান পালন করে। কবরে অবস্থান গ্রহণ করে। ওরা আসলেও কার্য্ত আল্লাহর ইবাদত সম্পূর্ণ পরিহার করে কবর বা কবরস্থ ব্যক্তির ইবাদতে মেতে যায়। নবী করীম(স) এইসবকে তীব্র ভাষায় ও অত্যন্ত কঠোরতা সহকারে প্রতিরোধ করেছেন। আর আজ তাঁরই উম্মাহ হওয়ার দাবিদার অলী-আল্লাহ, পীর শায়খ, ইত্যাদির ছদ্মাবরণ ধরে মানুষকে কবর পূজারী বানাচ্ছে। কোথাও কোথাও আল্লাহকে হটিয়ে নিজেরাই মানুষের মা‘বুদ হয়ে বসেছে। সেখানে-তাদের প্রতি মুরীদরা-ভক্তরা-সেই ভক্তি শ্রদ্ধা ও আচার আচরণ করে, যা একান্তভাবে আল্লাহরই প্রাপ্য।
এ শুধু বিদয়াত নয়, এ হচ্ছে প্রচন্ড শিরক। তওহীদী ইসলামের দোহাই দিয়ে শিরক এর পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে এমন দরগাহ মুসলিম দুনিয়ার সর্বত্রই বিরাজ করছে।
কবর জিয়ারতের নিয়ম
ইমাম নববী লিখেছেনঃ‘যিয়ারতকারীর কর্তব্য কবরস্থানে উপস্থিত হয়ে প্রথমে সালাম করবে এবং কবরস্থ সকলের রূহের প্রতি মাগফিরাত রহমত নাযিল হওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট দো’আ করবে।’ এই সালাম ও দো’আ তা-ই হওয়া উচিত, যা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া কুরআনের আয়াত-সূরা বা রাসূল(স) থেকে বর্ণিত দো’আও পাঠ করা যেতে পারে।
ইমাম শাফেয়ী ও তাঁর সব সঙ্গী সাথী মনীষীবৃন্দ সর্বসম্মতভাবে এ নিয়মেরই উল্লেখ করেছেন। ইমাম আবুল হাসান মুহাম্মদ ইবনে মরযুক জাফরানী একজন মুহাক্কিক ফকীহ ছিলেন। তিনি বলেছেনঃ কবরকে হাত দ্বারা জড়িয়ে ধরবেনা, স্পর্শ করবেনা, কবরকে চুমু দেবেনা, কবর জিয়ারতের সুন্নাতী নিয়ম এই।
আবুল হাসান আরো বলেছেনঃ কবর ধরা, স্পর্শ করা ও তাকে চুমু দেয়া-যা বর্তমানকালের সাধারণ মানুষ করছে-নিঃসন্দেহে বিদয়াত, শরীয়তে নিষিদ্ধ, ঘৃণিত। তা পরিহার করা এবং যে তা করে তাকে এ থেকে বিরত রাখা একান্তই কর্তব্য।
আবু মুসা এবং খোরাসানের সুবিজ্ঞ ফিকহবিদরা বলেছেন যে, কবর স্পর্শ করা, চুমু দেয়া খ্রীস্টানদের অভ্যাস। মুসলমানদের জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেননা নির্ভূলভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, কবরের প্রতি কোনোরূপ তা’জীম দেখানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
হাফিজ ইবনে কায়্যিম লিখেছেন, নবী করীম(স)কবর যিয়ারত করতেন, করতেন কবরস্থ লোকদের জন্য দো’আ করার উদ্দেশ্যে, তাদের প্রতি দয়া দেখাবার জন্য ও তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ইস্তিগফার করার উদ্দেশ্যে।
অতঃপর লিখেছেনঃ এরূপ যিয়ারত করাকেই রাসূলে করীম(স) তাঁর উম্মতের জন্য সুন্নাত করে পেশ করেছেন এবং এ-ই তাদের জন্য শরীয়তী পন্থা ও নিয়ম করে দিয়েছেন।
কবরস্থানে উপস্থিত হয়ে মুসলমানরা কি বলবে এবং কি করবে, শরীয়তে তারও নির্দেশ রয়েছে। হাফেজ ইবনে কাইয়্যেম লিখেছেনঃ আরবী(*******)
-মুসলমান যখন কবর যিয়ারত করবে, তখন বলবেঃ আসসালামু আলাইকুম, হে কবরস্থানবাসী মুমিন মুসলমানগণ, আমরাও আল্লাহ চাইলে তোমাদের সাথে মিলিত হবো। এখন তোমাদের জন্য ও আমাদের নিজেদের জন্য আল্লাহর নিকট কল্যাণ ও শান্তি কামনা করছি।
অতঃপর তিনি লিখছেনঃ মুশরিকরা কিন্তু এরূপ করতে অস্বীকার করছে। তারা কবরস্থানে শিরক করে, আল্লাহর সামনে মৃত লোকদের নাম নিয়েই দোহাই দেয়, তাদের অসীলা বানায় ও তাদের নামে কসম করে। মৃত লোকদের নিকট নিজেদের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য দো’আ করে, সাহায্য প্রার্থনা করে, তার দিকে তাওয়াজ্জুহ করে। আর এসব করে তারা রাসূলের হেদায়াতের বিরুদ্ধতা করে। কেননা রাসূলের হেদায়াত তো হলো তওহীদ এবং মৃত লোকদের প্রতি দয়া প্রদর্শন। আর মুশরিকদের পন্থা হলো শিরক এবং নিজেদের ও মৃত লোকদের প্রতি যাবতীয় অন্যায় চালিয়ে দেয়া।
আজমীর শরীফে খাজা মঈনউদ্দীন চিশতীর কবরে তাঁকে লক্ষ্য করে যে দো’আ করা হয়, তাতে খাজা বাবাকে ঠিক আল্লাহর আসনেই বসানো হয়(নাউজুবিল্লাহ)।
তাতে বলা হয়ঃ আল্লাহকে মাহবুব কি তুরবত কা তামাচ্ছুক শায়মা সোওদা কী আজমাত কা তামাচ্ছুক, আপনে দরওয়াজা সে নেয়ামত বখশে দিজিয়ে। -এই বিশ্বসংসারের পালনকর্তা আল্লাহর তুমি প্রিয় বান্দা। আল্লাহ তোমার কথা শোনেন। তাই আজ সন্ধ্যা বেলায় তোমার দুটি অবোধ সন্তান তোমার দরবারে হাযির হয়েছে। বাবা তুমি এদের বিদ্যা দাও, বুদ্ধি দাও, অর্থ-যশ-খ্যাতি প্রতিপত্তি দাও।
…… তোমার অপার করুণাধারার মতো এদের জীবনে যেন প্রেম নীতি অনন্তকালের জন্য অটুট থাকে। বাবা আমার। খাজা সাহেব আমার অন্ধের যষ্টির মতো তুমিই এদের একমাত্র ভরসা, তুমিই এদের অন্ধকারের আলো, সব বিপদের একমাত্র সহায়।
তুমি দুনিয়ার বাদশাহ, গরীবের একমাত্র পালনকর্তা, তোমার নামে ডুবে যাওয়া মানুষ ভেসে উঠে, অন্ধকার দুঃখের মহাসাগর হাসতে হাসতে পার হয়।
বলা হয়ঃ কোনো ভয় নেই, কোনো চিন্তা নেই, বাবা আপনাদের খুশী করাবেনই। বাবা বড় স্নেহপরায়ণ। যে ছেলেমেয়েরা এখানে ছুটে আসে বাবা তাদের দুঃখ দেখে সহ্য করতে পারেননা।
………..কাল আবার আসবেন। বাবা খুশী হবেন। (নাউজুবিল্লাহ)।
মৃত ব্যক্তির দাফন কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর মৃতের মাগফিরাত চেয়ে দো’আ করা রাসূলে করীমের আমল থেকে জায়েয বলে প্রমাণিত।
হাদীসে বর্ণিত হয়েছেঃ আরবী(********)
-নবী করীম(স) যখন মৃত ব্যক্তির দাফনের কাজ সম্পন্ন করতেন তখন সেখানে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং লোকদের বলতেনঃ তোমরা তোমাদের এই ভাইয়ের জন্য মাগফিরাতের দো’আ করো। কবরে সে যেন দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত ও স্থির হয়ে থাকতে পারে, সে জন্যে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করো। কেননা এখন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
মনে রাখতে হবে, এ হলো দাফন কাজ সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর দো’আ করা। এ তো সম্পূর্ণ জায়েয। কিন্তু বর্তমানে সাধারণ প্রচলনে দেখা যায়, এ দিকে জানাযার নামায পড়া হলো, আর অমনি কিছু একটা পড়ে দো’আ করার জন্য হাত তোলা হলো। অথচ ইসলামী শরীয়তে এ কাজ মাকরূহ! তৃতীয় শতকের ফকীহ ইমাম আবু বকর ইবনে হামীদ(রহ)বলেনঃ জানাযা নামাযের পরই আলাদা করে দো’আ করা মাকরূহ(তাহরীম)।
শামসুল আয়েম্মা হাওয়ানী ও শায়খুল ইসলাম আল্লামা মগদী বলেনঃ জানাযা নামাযের পরে দো’আর জন্য কেউই দাঁড়াবেনা।
এমনিভাবে ফতোয়ার সিরাজিয়া(১ম খন্ড,১৪পৃ.), জামউর রমুজ(১ম খন্ড,১৭৪পৃ.),বহরুর রায়েক (২য় খন্ড, ১৮৩ পৃ.) প্রভৃতি গ্রন্থে এ কথা লিখিত রয়েছে।
মুল্লা আলী আল কারী বলেনঃ জানাযা নামায পড়া হয়ে যাওয়ার পরই মৃতের জন্য দো’আ করবেনা। কেননা এতে মূল জানাযা নামাযের ওপর অতিরিক্ত কিছু করার মতো হয়।
তাহলে প্রমাণিত হলো যে, যিয়ারতের জন্য গিয়ে কবরস্থ লোকদের কল্যাণের জন্য দো’আ করা ছাড়া মুমিন মুসলমান যিয়ারতকারীর আর কিছু করার নেই, নেই অন্য কোনো কাজ করার মতো, নেই কোনো কথা বলবার মতো। এ দৃষ্টিতে স্পষ্ট বোঝা যায়, কবরস্থানে গিয়ে মুসলমানরা বর্তমানে যা কিছু করছে, তা শুধু বিদয়াতই নয়, শিরকও। অনুরূপভাবে “আল্লাহ তা’আলা সর্বশক্তির উৎস” এই ইয়াকীন ও বিশ্বাস অন্তরে বজায় রেখে কোনো মাখলুকের নিকট বা জীবিত অবস্থায় বা মৃত্যুর পর- কোনো কিছুরই অলৌকিক ধরনের কাজের সাহায্য চাওয়াও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ শিরক এবং মুসলিম সমাজে তার প্রচলন তওহীদী আকীদার বিরুদ্ধে শিরকের বিদয়াত।
কুরআন তিলাওয়াত তো কুরআন হাদীস উভয়ের ভিত্তিতেই অত্যন্ত সওয়াবের কাজ বলে প্রমাণিত। কবরের নিকট বসে কুরআন তিলাওয়াতেও বাহ্যত কোনো দোষ দেখা যায়না। কিন্তু এ পর্যায়ে ফিকাহ এর কিতাবে বলা হয়েছেঃ কবরের নিকট কুরআন পাঠ করার ব্যাপারে ফিকহবিদদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। ইমাম শাফেয়ী ও মুহাম্মদ ইবনে হাসান বলেছেন, তা পড়া মুস্তাহাব। এতে মৃত ব্যক্তি কুরআনের সোহবতের বরকত পেতে পারে। কাযী ইয়াজ ও মালিকী মাযহাবের ক্বিরানী উভয়ই তাঁদের সাথে একমত। কিন্তু ইমাম মালিক ও ইমাম আবু হানীফা(রহ) এ কাজকে মাকরূহ মনে করছেন। কেননা এ কাজের সমর্থনে সুন্নাতের কোনো দলীল পাওয়া যায়নি।