জি-১ মানব ভ্রাতৃত্ব ও সমতা-১
প্রশ্ন :
১. এই কোসে©র পূবে©র সিরিজ সমূহের সাথে মানব ভ্রাতৃত্ব ও সমতার সম্পক© কি?
২. ইসলামের সামাজিক বিধানের প্রধান ক্ষেত্রগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা দিন?
৩. প্রায় সব ধম© বিশ্বাসেই মানব ভ্রাতৃত্ব ও সমতার প্রসঙ্গটি গুরুত্বের সাথে এসেছে, এক্ষেত্রে ইসলামের পৃথক কোন বিশেষত্ব আছে কি?
৪. মানব ভ্রাতৃত্ব ও সমতার বিষয়টি কিভাবে ঈমান ও আকীদার সাথে সম্প©কিত?
৫. ইসলামের নৈতিক বিধান কিভাবে সমতা ও ভ্রাতৃত্বের সাথে সম্পকি©ত?
৬. আদম (আ:) ও হাওয়া (আ:)- এর কাহিনী কিভাবে কুরআনে বণি©ত হয়েছে? এক্ষেত্রে কুরআনের বণ©নার সাথে অন্যান্য ধম©গ্রন্থের পাথ©ক্য আছে কি?
উত্তর:
১. বত©মান প্রসঙ্গ ও পূর©বতী© সিরিজ সমূহের সম্পক©
ইসলামী শিক্ষা সিরিজের প্রথম পাঁচটি পর্© মূলত: তাওহীদ, রেসালাত প্রথাগত ইবাদত (Worship)-এর উপর
আলোকপাত করা হয়েছে। ইসলামের নৈতিক শিক্ষা আলোচিত হয়েছে ষষ্ঠ পর্বে। ইসলাম একটি পূর্ণ©vঙ্গ জীবন
ব্যাবস্থা, অন্যান্য ধমে©র মত কিছু আচার অনুষ্ঠান সব©স্ব ধম© নয়। এই দ্বীন বা জীবন ব্যাবস্থায় নিদে©শনা রয়েছে বিশ্বাস (ঈমান) ও ইবাদত (Worship) সংক্রান্ত বিষয়ে, নৈতিক বিষয়ে, রাজনৈতিক, অথ©নৈতিক, সামাজিক সহ মানব জীবনের সব বিষয়ে। কাজেই আগের সিরিজগুলোর আলোচনার ধারাবাহিকতাই বত©মান সিরিজ।
২. ইসলামের সামাজিক বিধানের প্রধান ক্ষেত্রগুলো
ইসলামের সামাজিক বিধানের অন্ত©ভূক্ত বিষয়গুলোকে আমরা দু‘টো প্রধান ভাগে আলোচনা করতে পারি :
ক) আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী ইসলামের বিশ্বাস, নৈতিক শিক্ষা ও মূলনীতিসমূহ সমাজ জীবনকে কতুটুকু প্রভাবিত করতে পারে। এসব বিশ্বাস ও নৈতিক শিক্ষার মধ্যে নিহিত আছে মানুষের মাঝে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, ন্যায়বিচার, ভারসাম্যপূণ© জীবন পরিচালনা ও পারস্পরিক সহযোগিতার মূলনীতিসমূহ।
খ) পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পক© প্রসঙ্গে ইসলামী বিধানের আলোচনার মাধ্যমেও আমরা ইসলামের সমাজিক নীতির ধারণা পেতে পারি। কারণ পরিবারই হচ্ছে সমাজ ব্যাবস্থার প্রাথমিক ইউনিট।
৩. মানব ভ্রাতৃত্ব সমতা সম্পকে© ইসলামী বিধানের বিশেষত্ব
মানব ভ্রাতৃত্ব ও সমতা সম্পকে© ইসলাম ও অন্যান্য মতাদশে©র মাঝে প্রধান সামঞ্জস্য হচ্ছে মানুয়ের উৎপত্তি সম্পকি©ত সাধারণ বিশ্বাস। ওহীপ্রাপ্ত ধম©-বিশ্বাসীগণ (খ্রিষ্টান, ইহুদি, মুসলমান) মনে করেন যে মানুষের উৎপত্তি
আদম (আঃ) এবং বিবি হাওয়া (আঃ) থেকে। যারা এর বিপক্ষে বলেন (বিবত©নবাদীগণ), তাদের মত হলো মানুষ বানর বা অন্য প্রাণীর উন্নত সংস্করণ। মুসলিমরা এ ধারণায় দীক্ষিত যে, সকল মানুষ এক পিতা-মাতার সন্তান। এক্ষেত্রে মানবতাবাদ বিষয়ে ইসলামের সাথে অন্যান্য ধমে©মতের পাথ©ক্য নিম্নরূপ:
ক) প্রাচ্যের প্রাচীন ধমে©র ন্যায় ইসলাম এটা সমথ©ন করে না যে, মানুষকে বিভিন্ন বণ© ও গোত্রে বিভক্ত করে জন্ম দেয়া হয়েছে। বরং ইসলাম এই শিক্ষাই দেয় যে প্রত্যেক মানুষকেই আল্লাহ মানবীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ করে তৈরি করেছেন।
খ) দ্বিতীয়ত ইসলাম এ ধারণা দেয় যে আল্লাহ কেবল কোন বিশেষ সম্প্রদায় বা জাতির প্রভু নন। তিনি হচ্ছেন রাব্বুল আলামীন (জগৎসমূহের প্রভু) এবং রাব্বুন নাস (সমগ্র মানবজাতির প্রভু)। এখানেই ইসলামী মানবতার বিশ্বজনীনতা।
গ) অন্যান্য ধম©গ্রন্থে আদম (আ:) ও বিবি হাওয়া (আ:)- এর কাহিনী নেহায়েৎ গল্পের মতই বণি©ত হয়েছে।যাতে শিক্ষণীয় কিছুই নেই।অথচ কুরআনে তাদের ঘটনাগুলো এমনভাবে বণি©ত হয়েছে যে, যার মাধ্যমে সমগ্র মানবজাতির একই উৎস থেকে সৃষ্ট হবার এবং বিশ্বভ্রাতৃত্বের ধারণা জন্ম দেয়।
৪.মানব ভ্রাতৃত্ব ও সমতা ইসলামের ঈমান ও আকীদার সাথে সম্পৃক্ত
তৌহিদ তথা একত্ব বাদেই ইসলামের সারকথা। একক সত্ত্বা আল্লাহ সমগ্র বিশ্বজগতের স্রষ্টা এবং পালনকতা© এই ধারণা থেকেই তার সৃষ্ট মানবজাতির মধ্যে সমতা, একতা ও ভ্রাতৃত্বের ধারণা সৃষ্টি হয়। কারণ একই সৃষ্টা সকল মানুষ তা সে সাদা, কালো, নয় বা নারী হোক সকলকেই সৃষ্টি করেছেন। সবাই সেই একই প্রভুর বান্দা। অন্যদিকে যদি আল্লাহর ক্ষমতা ও আধিপত্যের এক বা একের অধিক শরীক থাকত তাহলে মানুষের সমতা ও ভ্রাতৃত্ব সম্ভব হত না। সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে, মানুষের ভ্রাতৃত্ব ও একতার ক্ষেত্রে একত্ববাদ (তৌহিদ) অবশ্যই উল্লেখযোগ্য ভূমিকার দাবীদার।
শুধু একত্ববাদেই নয়, ইসলাম আরও শিক্ষা দেয় যে হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে পরবতী সমস্ত নবী রাসূল যেমন, নূহ (আঃ), ঈসা (আঃ), মূসা (আঃ), হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) প্রত্যেকেই ছিলেন পরস্পর ভাইয়ের মত। তাঁরা সবাই ছিলেন মানব জীবনের জন্য আদশ© স্বরূপ। তাঁদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছিল স্ব-ম্ব উম্মতের পথপদশ©ক রূপে। তাঁরা সবাই নিম্নোক্ত বিষয়গুলো মানুষের কাছে প্রচার করতেন ঃ
ক) আল্লাহর উপর ঈমান সংক্রান্ত জ্ঞান।
খ) আত্মজ্ঞান – পৃথিবীতে আমাদের দায়িত্ব, কত©ব্য ও আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য।
গ) জীবন পরিচালনা সম্পকি©ত জ্ঞান।
ইসলামের এ শিক্ষা থেকে এটা নিশ্চত হয় যে, যারা এসব নবী ও রাসূলগণের প্রতি আনুগত্য প্রদশ©ণ করেন ও
তাদের অনুসরণ করেন তারা সবাই একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।
৫. ইসলামের নৈতিক বিধান এবং মানব ভ্রাতৃত্ত্ব ও সমতা
ইসলামে ধম© ও রাষ্ট্র আলাদা নয়। বরং জীবনের সমস্ত দিকে এক অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সুতরাং বিশ্বাস, ইবাদত, নৈতিক বিধান, অথ©নৈতিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন, সামাজীক জীবন এগুলো একে অপরের সাথে সম্পকি©ত। কাজেই মানব ভ্রাতৃত্ব ও একতা সম্পকি©ত ইসলামের শিক্ষা নৈতিক শিক্ষার উপরই ভিত্তি করে গঠিত। ইসলামের নৈতিক শিক্ষা ব্যাক্তিগতভাবে মদ্যপান, জুয়াখেলা, ব্যাভিচার, সুদগ্রহণ ইত্যাদি নিষেধ করে। এই নিষেধাজ্ঞার একটা সামাজিক সুফলও আছে। কারণ যারা এসব কাজ করে তারা শুধু তাদের নিজেদের ক্ষতিই করছেনা বরং সমাজেও এর কুপ্রভাব পড়ছে। একইভাবে ইসলাম যে নৈতিক গুণাবলীর কথা অন্ত©ভূক্ত করে সেগুলো শুধুমাত্র ব্যাক্তিগত সুখের জন্যই নয় বরং সমষ্টিগত সামাজিক কল্যাণের বটে। সমাজে মানুষ যদি দায়িত্বশীল, ক্ষমা, সহানুভূতি এসব গুণের চচা© করত এবং বিশ্বাসী হত তাহলে সমাজে তার সুফল পরিলক্ষিত হত। একইভাবে এ গুণগুলোর অনুপস্থিতি সমাজে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
৬. হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া (আঃ)-এর কাহিনী যেভাবে বণি©ত হয়েছে [সূত্র নিদে©শিকাঃ আল কুরআন- ২০:১২২]
কুরআনে বণি©ত হযরত (আঃ) ও বিবি হাওয়া (আঃ)- এর কাহিনী ইসলামের ভ্রাতৃত্ব ও সমতার বিধানের ভিত্তি প্রদান করেছে। সমগ্র কুরআনের মূলভাবের একটা অংশ হলো এ কাহিনী। এর সবচেয়ে আকষ©ণীয় বিষয়গুলো হলোঃ
ক) কুরআন আদি পাপের দোষ শুধুমাত্র বিবি হাওয়া (আঃ)- এর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়নি। আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া (আঃ) উভয়কেই সমভাবে আল্লাহর অবাধ্যতার জন্য ও শয়তানের প্ররোচনায় পড়ার দোষারোপ করা হয়েছে। সমতা ও ভ্রাতৃত্বের বিষয়ে এ ঘটণার বিশেষ ব্যঞ্জনা রয়েছে। কারণ মানুষের অধঃগমনের জন্য শুধুমাএ মানবজাতির একটা অংশকে (মহিলা) দোষী করা হয়নি, যা বাইবেলে লক্ষ্য করা যায়। এভাবে আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ)- বণ©না করতে গিয়ে কুরআন পুরুষ ও নারীর সমতার বিষয়টিকে তুলে ধরেছে।
খ) কুরআনের বণ©নায় দেখা যায় আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ) অনুশোচনাগ্রস্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রাথ©না করেন এবং তাঁর কাছ ক্ষমা পান। এ ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে ইসলামে আদি পাপ বলতে কোন কথা নেই। যেমন কোন কোন ধমে© ধারণা করা হয় যে মানবজাতির আদি পাপ হযরত হাওয়া (আঃ) করেছিলেন যার শাস্তি স্বরূপ মানুষ দুনিয়াতে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কুরআন থেকে এটাই প্রমাণীত হয় যে, আল্লাহতায়ালা নিছক শাস্তিস্বরূপ মানুষকে দুনিয়াতে পাঠাননি। বরং আল্লাহর খলিফা হিসেবে মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর মিশন সফল করতে প্রেরিত হয়েছেন।
এভাবেই আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ)- এর কাহিনী আনুগত্য ও আনুগত্যহীনতার পরিণতীর প্রতীকী বণ©না হিসেবে এসেছে। সাথে এটাও প্রমাণীত হযেছে যে আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং তিনি মানুষকে উত্তম সৃষ্টি হিসেবে মনোনীত করেছেন। তাদেরকে এ দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের জন্য নিদে©শনাসহ প্রেরণ করেছেন। এভাবে আল্লাহর সৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান এবং লিঙ্গ, জাতি, বণ©, গোত্র ও জন্ম পরিচয়ের উদ্ধে© তার ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।
জি- ২ মানব ভ্রাতৃত্ব ও সমতা- ২
প্রশ্ন ঃ
১. কুরআনে আদম (আঃ) এবং বিবি হাওয়া (আঃ)- এর কাহিনী কিভাবে বণি©ত হয়েছে? এই বণ©নার সাথে মানব
ভ্রাতৃত্ত্ব এবং সমতার বিষয়টি কতটুকু সংযুক্ত?
২. মানব ভ্রাতৃত্ব এবং সমতার বিষয়ে কুরআনে সুনিদি©ষ্ট কোন উদ্বৃতি আছে কি?
৩. সমতার এই মৌলিক কাঠামোতে মযা©দার ভিত্তিতে মানুষকে পৃথক করার কোনো মানদন্ড ইসলামে আছে কি?
উত্তর ঃ
১. কুরআনে আদম (আঃ) এবং বিবি হাওয়া (আঃ) সংক্রান্ত কুরআনের কাহিনীর সাথে মানব ভ্রাতৃত্ব ও সমতার সম্পক© [আল কুরআন ২:২৮-৩৮, ৩৮:৭১, ৭:১১]
হযরত আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া (আঃ)- এর প্রসঙ্গ কুরআনের বেশ জায়গায় এসেছে। সূরা বাকারার ২৮ থেকে ৩৮ আয়াতে বিস্তৃতভাবে পুরো ঘটনা বণি©ত হয়েছে। প্রথম মানব-মানবীর ব্যাপারে কুরআনের বণ©নার গুরুত্বপূণ© দিকগুলো হচ্ছেঃ
ক) আল্লাহ মানুষ তৈরির আগেই পৃথিবী তৈরি করেছেন এবং এতে মানুষের স্বচ্ছন্দ অবস্থানের পরিবেশ ও উপাদান নিশ্চিত করেছেন। কাজেই পৃথিবীতে মানুষের আগমন আল্লাহর পূব© পরিকল্পিত ইচ্ছা। এটা কারো পাপের ফল নয়।
খ) যখন আল্লাহ সকল ফেরেশতাদের ডেকে বললেন যে তিনি দুনিয়াতে তাঁর খলিফা (দূত, প্রতিনিধি) প্রেরণ করতে চান তখন ফেরেশতারা শঙ্কা প্রকাশ করল যে এরা হয়ত দুনিয়াতে অন্যায় ও পাপ কাজে লিপ্ত হবে। এখন প্রশ্ন হলো ফেরেশতারা পূব© থেকেই এমন ধারণা কেন করল। এর একটা উত্তর হতে পারে এই যে ফেরেশতারা যখন জানলো মানুষকে মাটি থেকে তৈরি করা হবে তখন তারা ধারণা করল পাথি©ব পাপের কবলে তারা পড়তে পারে। প্রথম মানব-মানবী মাটি খেকে তৈরি হয়েছেন এবং তাদের থেকেই সমগ্র মানবজাতির সৃষ্টি। সেহেতু এই মানবকূল এর মধ্যে কেউ কারো চেয়ে শ্রেষ্ঠ বা কেই অতি মানব এমন দাবি করা অসম্ভব।
গ. যখন ফেরেশতারা মানুষের সম্ভব্য অবাদ্যতার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন তখন আল্লাহ বলেন, আমি যা জানি
তোমরা তা জান না, যার অথ© হচ্ছে আল্লাহ মানুষকে সেই জ্ঞান দিয়েছেন যা ফেরেশতাদের দেননি। কুরআনের মতে জ্ঞান হচ্ছে পৃথিবীর সব বস্তুর নাম, আল্লাহর বিধান বোঝার ও পালন করার যোগ্যতা এবং হক ও বাতিলের পাথ©ক্য করার সামথ©। হক অথবা বাতিল যে কোন পন্থা গ্রহণের স্বাধীনতাও মানুষকে দেওয়া হয়েছে। এসব জ্ঞানের ব্যাপারেও কোনো মানুষেরই অন্য কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করার কোন সুযোগ নেই।
ঘ. আল্লাহ কতৃ©ক ফেরেশতাদের আদম (আঃ)- কে সিজদা দানের (সম্মান প্রদশ©নের) আদেশের মধ্যে সাব©কভাবে সমগ্র মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্ব ও মযা©দার বিষয়টিই নিশ্চিত হয়েছে।
ঙ. এসব আয়াতের মাধ্যমে জাতীয়তা, লিঙ্গ বা অন্যান্য ভিত্তিতে মানুষের উপর মানুষের দাবিটি বাতিল প্রমাণিত হয়। আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ)- এর কাহিনী এই শিক্ষাই দেয় যে সকল মানুষের উৎপত্তি স্থাল একই এবং একই মিশন সাধনের জন্য তাদের পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। তাদের সবাই সৎ আমলের মাধ্যমে আল্লাহর তুষ্টি অর্জন করতে পারে। আবার তাদের সবাই শয়তানের প্ররোচনায় ও পড়তে পারে। এক্ষেত্রে কেউই ভুলের উদ্ধে© নয়।
২. মানব ভ্রাতৃত্ব এবং সমতার বিষয়ে কুরআনে সুনিদি©ষ্ট উদ্বৃতি
[আল কুরআনঃ ২:২১, ২:১৬৮, ৪:১-২, ১৯:৯৩-৯৫]
কুরআনে কয়েকটি সুনিদি©ষ্ট উদ্বৃতির মাধ্যমে মানব জাতির মধ্যকার সাম্যের বিষয়টি বণি©ত হয়েছে। প্রথমত, মানুষকে সম্বোধন করার ব্যাপারে কুরআনে সাধারণত “ইয়া আইয়ুহান্নাস” (হে মানবজাতি) এই বাক্য ব্যাবহার করা হয়েছে। এখানে মানুষের মাঝে সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্র, মুসলিম ও অমুসলিম কোনো ভেদ করা হয়নি। আল্লাহ সবাইকে সমভাবে সম্বোধন করেছেন। এ ধরনের সম্বোধন এই ধারণার জন্ম দেয় যে একই স্রষ্টা সকল মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। দ্বিতীয়ত, সূরা বাকারার ১৬৮ আয়াতে ঘোষিত হয়েছে যে আল্লাহর প্রদত্ত নেয়ামতসমূহ সকল মানুষের সমান ভোগাধিকার রয়েছে।
তৃতীয়ত, কুরআন নর ও নারীর সমান মযা©দা ঘোষণা করে মায়ের বিশেষ সম্মান দিয়েছে। কুরআন স্পষ্টভাবে নর ও নারীর একক উৎসস্থলের কথা বণ©না করে উভয়ের সমঅধিকারের কথা বণনা করা হয়েছে। সব©শেষে বো যায় কুরআনে বার বার সকল মানুষকে শেষ বিচারের দিন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াবার কথা বলেছে। কেউ সেদিন বিচার এর উদ্ধে© থাকবে না। এটাও মানব সাম্যেরই ঘোষণা দেয়।
৩. মানুষের মযা©দা বিষয়ক কুরআনের মানদন্ড [আল কুরআন ঃ ৪৯:১৩, ৩০:২২]
এটা স্পভাবেই কুরআনে বণি©ত হয়েছে যে, আধ্যাত্মিক এবং মানবিক মানদন্ডে সকল মানুষই এক। রঙ, জাতীয়তা, গোত্র ইত্যাদির ভিত্তিতে কেউকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়নি। কিন্তু ভালো আর মন্দ কখোনই এক হতে পারে না। এজন্যই ইসলামে ভালো আর মন্দের ভিত্তিতে মানুষকে মযা©দা দেবার এক অনুপম মানদন্ড দেয়া হয়েছে।
“(আল্লাহর দৃষ্টিতে) তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যাক্তি শ্রেষ্ঠ যে বেশী তাকওয়াসম্পন্ন (সৎকম©শীল)।”
অথা©ৎ আল্লাহর দৃষ্টিতে মযা©দার ভিত্তিতে মানুষকে পৃথক করার একমাত্র মানদন্ড হচ্ছে সততা এবং খোদাভীতি (আরবীতে তাকওয়া) । তাকওয়া বলতে ব্যাপক অথে© সকল ভালো কিছুকেই বোঝায়। এ সততা মানে বিশ্বাসের সততা, নৈতিকতায় উত্তম এবং অন্যান্য মানুষের সাথে সম্পক© রক্ষা উত্তম হওয়া। কুরআনে আরও বলা হয়েছে য়ে আল্লাহ মানুষকে বিভিন্ন জাতিতে ভাগ করে সৃষ্টি করেছেন ‘যেন তারা পরস্পরকে জানতে পারে’। এক্ষেত্রে বাইবেলে বণি©ত মানুষকে বিভিন্ন জাতিতে ভাগ করার কারণটি তুলনা করা যেতে পারে। বাইবেলে বলে যে, আল্লাহ মানুষকে বিভিন্ন জাতি ও ভাষায় ভাগ করেছেন, এই ভয়ে য়ে নচেৎ তারা খুব ক্ষমতাশালী হয়ে যাবে। (বাবেল টাওয়ার নিমা©ণ কাহিনী প্রসঙ্গ) অথচ কুরআনে এই ভেদটি একটি নেয়ামত হিসেবে এসছে যাতে মানব বৈচিত্র্য পূণ©তা পেতে পারে বিভিন্ন ভাষাগোত্র ও জাতীয়তার সম্মিলন।
জি- ৩ মানব ভ্রাতৃত্ব ও সমতা-৩
প্রশ্ন ঃ
১. মানব ভ্রাতৃত্বের বিষয়ে রাসূল মুহাম্মদ (সাঃ)- এর দৃষ্টিভঙ্গি কি ছিল?
২. ইসলামে বণি©ত সমঅধিকার অন্য ধমা©বলম্বীদের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হবার কোনো উদাহরণ আছে কি?
৩. কুরআন সমগ্র মানবজাতিকে সমোবাধন করেছে কিন্তু তবুও বেশ কয়েক জায়গায় বিশেষভাবে মুসলিম বা বিশ্বাসীদের সম্বোধন করা হয়েছে। এক্ষত্রে এমন ধারণার উদ্রেক হতে পারে কি যে কুরআনে মানব ভ্রাতৃত্ব্ ও সমতার ধারনা উপেক্ষিত হয়েছে?
৪. যারা মুসলমানদেরকে জন্মগত মুসলিম, নওমুলিম (ইসলাম গ্রহণকারী) অথবা পিতা মুসলিম হবার সুবদে মুসলিম এমনভাগ করতে চায় তার সমথ©নে ইসলামে যুক্তি আছে?
উত্তর ঃ
১. মানব ভ্রাতৃত্বের বিষয়ে রাসূল মুহাম্মদ (সাঃ)- এর দৃষ্টিভঙ্গি [আল কুরআন ১৮:২৮]
মানব ভ্রাতৃত্বের বিষয়ে রাসূল মুহাম্মদ (সাঃ)- এর দৃষ্টিভঙ্গি সকল ক্ষেত্রে পরিস্কার। যথাঃ
ক) যে সময়টাতে চচে© নিজে খোদায়ী কালামের একক ব্যাখ্যাদাতা ছিল এবং তারা নিজেদেরকে আল্লাহর মুখপাত্র হিসেবে দাবী করত সে সময় মুহাম্মদ (সঃ) শেখালেন যে যদিও আলেমরা সম্মানিত ব্যাক্তি; কিন্তু তাদের কথা খোদায়ী কথার সমতুল্য হতে পারে না। সেজন্য ইসলামে চাচে©র মতো কোনো ইনস্টিটিউট নেই। রাসূল (সাঃ) এটা নিশ্চিত করেছেন যে ধমে© সাধারণ জনগণের উপর প্রাধান্যকারী এমন জনগোষ্ঠী নেই।
খ) তিনি আরও শিখিয়েছেন যে নবী রাসূলগণ সহ সকল মানুষই সমান। তিনি তাঁকে পূজা করতেও নিষেধ করতেন।
গ) তিনি শিখিয়েছেন যে সব মানুষ সমান বিধায় কোন মানুষ অপর কোন মানুষকে সেজদা করতে বা তার কাছে মাথা নত করতে পারবে না। শুধু আল্লাহর কাছেই মানুষ মাথা নত করবে।
ঘ) তিনি যখন কোন সভা-সমাবেশে যোগ দিতেন তখন সামনে আসন নেবার জন্য রোকজন ঠেলাঠেলী না করে নিকটতম জায়গায় বসে পড়তেন। তিনি বণ©, গোত্র, পোশাক, সম্পদ এসবের বিবেচনায় মানুষকে ভাগ করার বিরূদ্ধে বলতেন। মানব সমতার বিষয়ে তাঁর শেষ বাণী পাওয়া যায় তাঁর বিদায় হ্বজের ভাষণে- “হে মানবজাতি তোমাদের আল্লাহ এক, পিতা এক, সুতরাং কোন অনারবদের উপর কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শুধুমাত্র খোদাভীতির ভিত্তিতেই তোমাদের মযা©দার পাথ©ক্য হতে পারে।” এটা লক্ষ্য করার মত যে প্রথম যাঁরা রাসূল (সাঃ)- এর দাওয়াত কবুল করে মুসলমান হয়েছিলেন তাঁরা বিভিন্ন সামাজিক অবস্থান এবং জাতীয়তা থেকে এসছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন হযরত আবু বকর (রাঃ) যিনি আরবের একজন বিশিষ্ট ধনী এবং সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তি ছিলেন। বিল্লাল (রাঃ) ছিলেন একজন নিগ্রো ক্রীতাদাস, শুয়াইব (রাঃ) ছিলেন রোমান, সালমান (রাঃ) পাশী©। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর সবাই সম ভ্রাতৃত্বের অংশীদার হয়ে গিয়েছিলেন। কোন কোন কুরাইশ নেতা রাসূল (সাঃ) কে বলতেন যে আমরা তোমার দ্বীন কবুল করতাম যদি গরীব এবং নীচ ব্যাক্তিরা এটা কবুল না করত। তাদের এই কথার জবাবে রাসূল (সাঃ) বলতেন, “হে আল্লাহ আমি যেন একজন দরিদ্র হিসেবেই জীবন ধারণ করি, মৃত্যূবরণ করি এবং হাশরের দিনে দরিদ্রদের সাথেই অবস্থান করি।”
২. সমঅধিকার অন্য ধমা©বলস্বীদের ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হবে কি?[আল কুরআন ৪:৯২]
কুরআন এবং রাসূল (সাঃ) এর জীবনে অমুসলিমদের ক্ষেত্রেও সমঅধিকার দেবার প্রমাণ আছে। কুরআনে দুঘ©টনাবশত কোন ব্যাক্তির মৃত্যূর ক্ষেত্রে মৃত ব্যাক্তির পরিবারকে যে ক্ষতিপূরণ দেবার বিধান রয়েছে তা মুসলিম অমুসলিম উভয়ের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। কুরআন এবং হাদিসে মুসলিম রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকদের জানমাল ইজ্জতের মযা©দা মুসলিম নাগরিকের মতই সমভাবে দেয়া হয়েছে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যাক্তি মুসলিম রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিককে আঘাত করে সে যেন আমাকেই আঘাত করে।”
প্রথম দিকের মুসলিম শাসকরা রাসূল (সাঃ) এই আদেশ বুঝতেন এবং যথাযথভাবে পালন করতেন। আবু প্রণীত ‘খারাচ’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে মুসলিম রাষ্ট্রে অবস্থানরত ইহুদি, খ্রিষ্টানসহ সবার সাথে ভাল ব্যবহার করতে হবে। এসব প্রমাণাদীর আলোকে ওইসব মনীষী (যেমন, প্রফেসর ডাব্লিউ স্মিথ). যারা বলেন ইসলামে অমুসলিমদের মযা©দা রক্ষার কোন নিদেশনা নেই তাদের কথা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। ইসলামে মুসলিম অমুসলিম সুসম্পক© ও সমঅধিকার রক্ষায় সুস্পষ্ট নিদে©শনা রয়েছে।
৩. যেসব ক্ষেত্রে কুরআন শুধুমাত্র বিশ্বাসীদের সম্বোধন করেছেন তার ব্যাখ্যা [আল কুরআন ২:২৫৬, ৩:৭৫, ১০:১৯]
যদিও ইসলাম সকল মানবকে একসাথেই বলেছে আল্লাহর আনুগত্য করার কথা কিন্তু তবুও কখনো কখনো শুধু বিশ্বাসীদের সম্বোধন করতে হয়েছে তাদের বিশেষ কাজ যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রোজা, যাকাত ইত্যাদি সম্পকে© নিদে©শনা দিতে। ইসলামের দৃষ্টিতে মুমীনদের ভ্রাতৃত্ব প্রকৃত অথে© মানব ভ্রাতৃত্বের কোন বিকল্প বা প্রতিপক্ষ নয় বরং এটা ব্যাপকভাবে মানব ভ্রাতৃত্বের সীমার মধ্যেই বিশেষভাবে মুমীনদের জন্য প্রযোজ্য। তার উপর ইসলাম মুসলমানদের জাতি, ধম© নিবি©শেষে সকল মানুয়ের মযা©দা ও সম্মান প্রদানের নিদে©শ দিয়েছে। মুসলিম অমুসলিম উভয়ের স্বাথ© ব্যবহারের জন্য একক নৈতিক বিধান ইসলামে দেওয়া হয়েছে। সাথে সাথে এক খোদা, এক শেষ নবী, এক কিতাব এবং আখেরাতে বিশ্বাসীদের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের উৎসাহিত করা হয়েছ্। এছাড়াও ইসলাম শিক্ষা দেয় সহনশীলতার। এখানে বলা হয়েছে আল্লাহ চাইলে গোটা মানব সমাজকে এক জাতিতে পরিণত করতেন।
৪. জন্মগত মুসলমান, নওমুসলিম এবং পিতা অথবা মাতা মুসলিম হবার সুবাদে মুসলমান-এমন বিভক্তির ব্যাপারে ইসলামের অবস্থানঃ [আল কুরআন ৩০:৩০, ৯:১১]
সকল মানুষই জন্ম নেয় মুসলিম হিসেবে। সকল শিশু আল্লাহর প্রতি আত্মসমপ©ণের (ফিতরা) অঙ্গীকার নিয়েই জন্ম নেয়। এই সুবাদে সব শিশুই মুসলিম। যখন একজন ব্যাক্তি তার পিতা মাতার ধম© ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করে তখন প্রকৃতপক্ষে সে তার মূল ধমে© ফিরে আসে। কাজেই জন্মগত মুসলমান, নওমুসলিম আর পিতা অথবা মাতার মুসলিম হবার সুবাদে মুসলিম- এমন বৈশিষ্ট্যর ভিত্তিতে মুসলমানদের ভাগ করা ইসলাম সম্মত নয়। বিশ্বাস হচ্ছে বান্দা এবং আল্লাহর মধ্যে। কোন মুসলমানকে কাফের ঘোষণার অধিকার কারো নেই। কেউ এ ধমে© গ্রহণ করতে চাইলে বাধা দেবার অধিকারও কারো নেই।
জি- ৪ বিশ্বাসের ভ্রাতৃত্ব (ইসলামের ভ্রাতৃত্ব)
প্রশ্ন ঃ
১. আরবী ভাষী মুসলমানদের অন্যান্য ভাষাভাষীদের উপর কোন শ্রেষ্ঠ্ত্ব আছে কি?
পবিত্র ভূমি ও মদিনার আশে পাশের বাসিন্দাদের কোন বিশেষ মযা©দা আছে কি?
২. উম্মাহ শব্দের প্রকৃত অথ© কি এবং ‘জাতি’ শব্দের প্রচলিত ধারণা থেকে পৃথক কিভাবে?
৩. ইসলামের ভ্রাতৃত্ব (brotherhood of faith)বা উম্মাহর ধারণা সময়ের এবং ভৌগলিক সীমা অতিক্রম করে কিভাবে?
৪. রক্তের সম্পক© কি ইসলামের ভ্রাতৃত্বের উপরে স্থান পায়?
৫. ইসরামের ভ্রাতৃত্বকেই সবাই আগে স্থান দিয়েছে এমন কোন মানব সমাজের উদাহরণ আছে কি?
উত্তরঃ
১. আরবী ভাষী হওয়ার বা পবিত্র ভূমি ও মদিনার আশে পাশের অধিবাসী হবার মধ্যে কোন শ্রেষ্ঠত্ব বা বিশেষ মযা©দা আছে কি?
যদিও আরবী জানার মধ্যে সুস্পষ্ট কল্যাণ নিহিত আছে এ ভাষাতেই কুরআন নাযিল হয়েছে, তবুও এমন ধারণ ভুল যে কোন মুসলমান যিনি আরবী জানেন না তিনি আরবীভাষীর চেয়ে কোন ভাবে নিন্ম মযা©দার। আল্লাহর বাণী হিসেবে কুরআন বিশেষ মযা©দা প্রাপ্ত। কোন ভাষা এমনকি আরবী ও এমন মযা©দার অধিকারী নয়।
একইভাবে রাসূল (সাঃ) এর পূণ্যভূমিতে থাকতে পারা সৈাভাগ্যের এত কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু মুসলমান হিসেবে সেখানকার অধিবাসীরা অন্য এলকার মুসলমানদের উপর কোন রকম শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার হতে পারে না। ইসলাম সব ধরণের সংকীণ© জাতীয়তাবাদ অস্বীকার করে। এখানে শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তি হচ্ছে জ্ঞান অজ©ন এবং জীবনে তার অনুসরণ (তাকওয়া)।
২.‘উম্মাহ’ শব্দের অথ© এবং ‘জাতি’ শব্দের প্রচলিত ধারণা থেকে এর পাথ©ক্য
জাতি’ বলতে প্রচলিত ধারণায় কোন নিদি©ষ্ট ভাষাবাসী অথবা কোন নিদি©ষ্ট ভৌগলিক এলাকার জনগণ অথবা একই ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক জনগোষ্টিকে বুঝায়॥ পক্ষান্তরে উম্মাহ বলতে এমন এক জনগোষ্ঠিকে বুঝায় যার অন্ত©ভুক্ত পৃথিবীর সব©কালের সব©দেশের সকল বিশ্বাসীরা। এটা জাতির চেয়ে অনেক উদার ও ব্যাপক ধারণ॥ ইসলাম সংকীণ© জাতীয়তাবাদ বিশ্বাস করেনা। পৃথিবীর দুটি মহাযুদ্ধসহ প্রায় সব বিপয©য়ের মূল কারণ সংকীণ© জাতীয়তাবাদ। এক হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেন- “সে আমাদর অন্ত©ভূক্ত নয় যে আসাবীয়া (Fanatical parochialism বা nationalism) (জাতীয়তাবাদে) প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দেয়।“ জৈনিক সাহাবী যখন আসাবীয়ার ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন তখন, রাসূল (সাঃ) বলেন- “আসাবীয়া হচ্চে, যখন এক জাতি আরেক জাতির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করে এবং তাদের অধিকারকে অস্বিকার করে, যখন কোন জাতির লোকজন তাদের লোকদের অন্যায় এবং ভূলগুলোকে সমথ©নে দেয় শুধুমাত্র জাতীয়তার কারণে।”
৩. ইসলামের ভ্রাতৃত্ব কিভাবে কাল (সময়কে) অতিক্রম করে
সূত্র- [আল কুরআন- ৪৯:১০, ৫৯:১০, ২৩:৫১-২, ২১:৯২]
কুরআনে বণি©ত উম্মাহ শব্দ শুধূ মাত্র গোটা বিশ্বের সকল দেশের সকল ঈমানদারকেই অন্ত©ভূক্ত করেনা বরং তা পৃথিবীর আদি থেকে শুরু করে আজ পয©ন্ত সকল ঈমাদারকে সংযুক্ত করে। এভাবে কুরআনে যখন বলা হয় সকল ঈমানদার ভাই ভাই তখন তা হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) পয©ন্ত সকল নবী রাসূলের অনুসারীদের অন্ত©ভূক্ত করে। সকল বিশ্বাসী একই ভ্রাতৃত্ব এবং জাতির অন্ত©ভূক্ত । এভাবে ইসলাম আল্লাহ কতৃ©ক প্রেরিত সকল নবী রাসূল ও ঐশী কিতাবকে স্বীকৃতি দিয়ে লাভ করেছে বিশ্বজনীনতা। আর সব সংকীণ©
মতবাদ যা শুধু কোন বিশেষ গোত্র বা বিশেষ নবীর অনুসারীকেই স্বীকৃতি দেয় সেসব থেকে ইসলামের পাখ©ক্য এখানেই।
৪. রক্তের সম্পক© কি ইসলামের ভ্রাতৃত্বের উপর স্থান পায়
সূত্র- [আল কুরআন- ৯:২৪, ৩১:১৫]
ইসলামে রক্ত সম্পক©সহ অন্য সকল সকল সম্পকে©র উপরে বিশ্বাসের সম্পক© স্থান পায়। ইসলামের ভ্রাতৃত্বের ভিত্তি যেহেতু আল্লাহর উপর বিশ্বাস এবং ভালবাসা সেহেতেু এই ভ্রাতৃত্বের উপর রক্তের সম্পর্ককে স্থান না দেয়ার ব্যাপারে সতক© করা হয়েছে (যদিও রক্তের সম্পক©কে রক্ষা করা এবং সম্মান করার ব্যাপারে মুমিনদের নিদে©শ দেয়া হয়েছে)। মুমিনদের ইসলামী ভ্রাতৃত্ব এবং রক্তের সম্পকে©র মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে বলা হয়েছে। যদি কারো রক্তের সম্পকি©ত ব্যাক্তি বা সআমী বা স্ত্রী অবিশ্বাসীদের অন্ত©ভূক্ত হয় তবে সেই সম্পক©কে বিশ্বাসের উপর স্থান দিতে নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি অবিশ্বসী আত্মীয় সম্পকে© হাশরের ময়দাসে সুপারিশ ও করা যাবে না।
৫. রক্তের সম্পকে©র উপর ইসলামের ভ্রাতৃত্বকে স্থান দেয়ার উদাহরণ
সূত্র- [আল কুরআন- ১১:৪৬, ৯:১১৪, ৬৬:১০-১১]
কুরআন্ এমন চারটি উদাহরণ আছে। প্রথম উদাহরণ হচ্ছে হযরত নূহ (আঃ) এর নৌকায় অবিশ্বাসী ছেলে আরোহণ করেনি। দ্বিতীয় উদাহরণ যেখানে সন্তান বিশ্বাসী পিতা অবিশ্বাসী যেমন, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) মুতি© নিমা©তা পিতার সাতে সম্পক©চ্ছেদ করেন। তৃতীয় উদাহরণ হযরত লুত (আঃ) এবং তাঁর স্ত্রী। এখানে হযরত রুত (আঃ) বিশ্বসী এবং স্ত্রী অবিশ্বাসীদের দলে। চতুথ© উদাহরণ ফেরাউন এবং তাঁর স্ত্রী। ফেরাউনের হুমকি সত্তেও তাঁর বিশ্বসী স্ত্রী ঈমান ত্যাগ করেনি। এসব উদাহরণে দেখা যায় বিশ্বসী নবী বা বান্দাগণ তাদের অবিশ্বাসী স্বামী , স্ত্রী বা সন্তানের সাজা রোধ করতে পারেনি।
জি- ৫ সামাজিক সম্পক© ও বন্ধু নিবা©চন
প্রশ্ন ঃ
১. ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় বন্ধুত্বের গুরূত্ব ও ভূমিকা কি?
৩. এমন কোন ক্ষেত্র আছে কি যেখানে মুসলমানদের খোলাখুলি মেশা ঠিক নয়?
৪. কোনটাকে ইসলাম বন্ধুত্বের সঠিক ভিত্তি মনে করে?
৫. কোন কোন কান বন্ধুত্বকে নষ্ট করে?
উত্তর ঃ
১. ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় বন্ধুত্বের গুরূত্ব ও ভূমিকা
সূত্র নিদে©শিকা ঃ আল কুরআন ২৫:২৭-৩০, ৪৩:৬৫-৬৭
শুধূমাত্র ইসরামের তাগিদেই নয় বরং সামাজিক দিক থেকেও বন্ধুত্বের গুরূত্ব অপরিসীম। এর কারণ এই যে, একজন ব্যাক্তির মানসিক গঠন, চিন্তাশক্তি ওআচার আচরন বিকাশে বন্ধুত্বের গুরূত্বপূণ© ভুমিকা আছে। উপরন্তু বন্ধত্ব একজন ব্যাক্তির অধ্যাত্মিক বিকাশে ও নৈতিক উন্মেষের সাহায্য করে। সুতরাং এ থেকে এটাই অনুমিত হয় যে, একটা সমাজের সাফল্য নিভ©র করে সেই সমাজের সদস্যদের পারস্পরিক বন্ধুত্বপূণ© সম্পকে©র উপর।
ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বন্ধুত্ব যদি আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও প্রগাঢ় বিশ্বাসের উপর ভিত্তিকরে স্থাপিত হয় তবে এটা আশীবা©দ স্বরূপ। যদি সম্পক© অন্যান্য নগণ্য বিষয়ের উপর ভিত্তি করে স্থাপিত হয় তবে তা বেশিদিন স্থায়ী হয়না। কুরআন ও হাদিস যে বন্ধুত্ব মানুষকে অপেক্ষাকৃত ভাল মুসলমান বানাবার পরিবতে© তাকে সত্য ও সরল পথ থেকে বিচুত্য করে তার বিরুদ্ধে সতক© করে দিয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ নবী করিম (সাঃ) এরশাদ করেন, “ব্যাক্তি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর জীবনধারা ও চিন্তা চেতানা অনুসরণ করে। সুতরাং তোমরা প্রত্যেকেই বন্ধু নিবা©চনে সতক© হও।”
কুরআন এ ব্যাপারে সতক© করে এভাবে যে, শেষ বিচারের দিন অবিশ্বাসীদের মধ্যে অনেকেই নিদারুণ মনস্তাপে ভুগবে। কারণ তারা অনুধাবন করবে যে, এ ধরনের বন্ধুত্যের কারণে তারা সত্যপথ হতে বিচুত্য হয়েছিল। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা সতক© করেছেন এভাবে যে, যে অবিস্বাসী বন্ধুগণ কেয়ামতের দিন শত্রুতে পরিণত হবে।
২. ইসলামের শিক্ষায় বৈরাগ্যবাদের কোন স্থান আছে কি
সূত্র নিদে©শিকা ঃ আল কুরআন ৫৭:২৭
যদিও ইসলাম সবিস্তারে মানুষ ও আল্লাহর মধ্যকার সম্পকে©র কথা বলে তথাপি একে কোন একক ব্যাক্তির ধম©বিশ্বাস বলা যায় না। ইসলাম শিক্ষা হলো দুনিয়াদারী থেকে সম্পূণ©রূপে বিচ্ছিন্ন থাকা উচিত নয়। কুরআনের বরাত দিয়ে নবী করিম (সাঃ) বৈরাগ্যবাদের নিন্দা করেছেন। যদিও আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় বৈরাগ্যবাদের মাধ্যমে আল্লাহর ধ্যানে সারা জীবন উৎসগ© করা যায় ও পবিত্র ধম©গ্রন্থ পাঠ কর্ আধ্যাত্মিকতার চরম স্তরে উপনীত হওয়া যায় তথাপী এটা ইসরামের আদশ© নয় কারণ এটা সমাজ পরিবত©নের বদলে ব্যাক্তির মুক্তির প্রচেষ্টা মাত্র। অপরদিকে ইসলাম মানুষকে পারস্পরিক মেলামেশায় উৎসাহিত করে। ইসলাম বিশ্বাসীদের এক অপরকে জানার জন্য সমন্বিত কায©ক্রম ও সহযোগিতায় উৎসাহ দেয়।
ইসলামের অনেক ইবাদত ব্যাক্তিভাবে করা যায় না বরং দরবদ্ধ বাবে করতে হয় (যেমন- জানাজার নামাজ, হ্বজ, আল্লাহর পথে জিহাদ ইত্যাদি) উপরন্তু, রাসূল (সাঃ) দৈনিক নামাজসমূহ জামায়াতে পড়ার তাগিদ দিয়েছেন যদি মাত্র দুজন লোকও হয় তবুও।
৩. যেসব ক্ষেত্রে মুসলমানদের খোলাখুলি মেশা ঠিক নয়
সূত্র নিদে©শিকা ঃ আল কুরআন ৬:৭০
যে সব লোক ঈমানকে ঠাট্টার বিষয় মনে করে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে সে সব লোকের সাথে মিশতে মুসলিমরা বাধ্য
নয়। এসব লোক থেকে দূরে থাকার জন্য ইসলাম শিক্ষা দেয়। কোন অবস্থাতেই এদের সাথে বন্ধুত্ব করা ঠিক হবেনা। তাছাড়া কোন নিদি©ষ্ট চক্র বা সমাজ যদি খারাপ হয় এবং কারও পক্ষে যদি এতে ঢুকে এর অবস্থার পরিবত©ণ করা সম্ভব না হয় তবে তার উচিৎ ঐ গোষ্ঠি বা সমাজ ত্যাগ করা। যদি কোন বিশ্বাসী ব্যাক্তির এমন কোন সামথ্য© থাকে যা দ্বারা সে ঐ সব খারাপ কাজ বা অপকম© শুধরাতে পারে তাহলে তার উচিৎ হবে সে চেষ্টা চালিয়ে ঐ সমাজ বা গোষ্ঠিকে সঠিক পথে আনা, যদি সে ব্যাথ© হয় তবে সে সঙ্গ ত্যাগ করাই তার জন্য যথাথ© হবে। নবী করিম (সাঃ) যখন জিজ্ঞাসা করা হল কোন ধরণের লোক সব©শেষ্ঠ্র, তিনি উত্তর দিলেন, “যে ব্যাক্তি আল্লাহর পথে জান, মাল ও সময় ব্যায় করে লড়াই করে। এরপর সেই ব্যাক্তি শ্রেষ্ঠ যে অসৎ ও অনাচারপূণ© সমাজ থেকে নিজেকে পৃথক রাখে।”
এটাই সত্য যে, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতেও কিছু লোক অবশ্যই থাকবে যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের রজ্জুকে আকড়ে থাকবে। তাঁর দেয়া অপরিবত©নীয় নৈতিক আচরণের নিয়ম নীতিকে অনুসরণ করবে ও সমন্বিত প্রচেষ্টায় বিশ্বসীদের দল গঠন করবে। কেউ বিচ্ছিন্ন থাকার চেয়ে এটাই বেশী বাঞ্চনীয়।
৪. ইসলামের দিক থেকে নিখুত বন্ধুত্বের ভিত্তি
সূত্র নিদে©শিকা ঃ আল কুরআন ৪৯:১১
কুরআন ও রাসূলের হাদিস থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে জানা যায় যে, যে বন্ধুত্ব আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বাস এবং তার পথ অন্বেষণের উদ্দেশ্য থেকে সৃষ্ট তাই নিখুত ভিত্তির উপর স্থাপিত। অপরদিকে যে বন্ধুত্ব কোন বিশেষ স্বাথ©রক্ষায়, সামাজিক শ্যেণী বা ভৌাগলিকতার উপর ভিত্তি করে স্থাপিত সেটা নিখুত নয়। হাদিসে লিপিবদ্ধ আছে যে, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, যারা একে অপরকে আমার জন্য ভালোবাসে তাদেরকে কেয়ামতের দিন আমি আমার ছায়ায় আশ্রয় দিব যেদিন আমি ছাড়া আর কোন আশ্রয়দাতা থাকবে না।
যেসব পন্থা বন্ধুত্ব সৃষ্টিতে উৎসাহ যোগায়
কুরআন ও রাসূলের হাদিস অনুসারে, আট প্রকার নিদি©ষ্ট পন্থা বন্ধুত্ব সৃষ্টিতে উৎসাহ দেয়ঃ
ক. দুনী©তি, শঠতা ও অহংকার বজ©ন। কারণ এগুলো মানুষের হৃদয়ের আন্তরিকতা ও সরলতাকে ধংস করে।
খ. সামাজিক সৌজন্যবোধ, যেমন, একজন মুসলিম তার সহচরকে তার নাম ও কোথা থেকে এসছে জিজ্ঞাসা করা।
গ. যদি কোন ভাই বা বোন কে আল্লাহতায়ালাকে বিশ্বাসের কারণে ভালবাসে তাহলে সে যেন অন্যদেরকে সেটা জানায়।
ঘ. ঘনিষ্ট বন্ধুদের বাড়ীতে যাওয়া। এটা বন্ধুত্ব সৃষ্টিতে উৎসাহ যোগায়। বেহেশতের শুভ সংবাদ তাদের জন্য যারা বন্ধুর বাড়ী যায়, অন্য কোন কারণে নয় শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
ঙ. উপহার সামগ্রী আদান প্রদান।
চ. ক্ষমাশীল ও দয়ালু হওয়া।
ছ. ভোজের দাওয়াত গ্রহণ করা।
জ. নিঃস্বাথ© হওয়াঃ নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, যতক্ষণ পয©ন্ত তোমরা নিজেদের জন্য যা পছন্দ কর তোমার ভাই এর জন্য তা পছন্দ না কর, ততক্ষণ তোমারা প্রকৃত মুমিন নও, বিশেষতঃ যদি সেই ভাই অভাবী হয়।
৫. রক্ষাথে© যে সব কাজ পরিত্যাগ করা দরকার
ক. কোন মুসলমান ভাইকে ব্যাঙ্গ করা থেকে বিরত থাকা।
খ. তাকে শ্লেষ না করা এবং তার অনুভূতিতে আঘাত হানা থেকে বিরত থাকা।
গ. যে নাম সে পছন্দ করেনা সেই নামে তাকে না ডাকা।
ঘ. বন্ধুদের গীবত না করা ও গোয়েন্দাগীরী এড়িয়ে চলা।
ঙ. বিনয়ী হওয়া ও চালবাজী বজ©ন করা।
চ. বন্ধুর কোন কাজের পিছনে অসৎ উদ্দেশ্য আরোপ বজ©ন করা।
ছ. এমন কাজ বজ©ন করা যা ভ্রাতৃত্বের পথে হুমকি স্বরুপ ঃ অথা©ৎ মদ্যপান, জুয়াখেলা, ঠকবাজী ইত্যাদী বিষয়ে ইসলামী বিধানের দিকে খেয়াল রাখা।
জ. তিন বা তিনের অধিক মানুষ একত্রিত হলে যে কোন দুজন ব্যাক্তিগত আলাপচারিতায় মেতে উঠা ঠিক নয়, বিশেষ করে যদি সে কথোপকথন অন্যরা শুনতে না পায়।
য. যদি বাদানুবাদ দেখা হয়, তবে একজন দায়িত্ববান মুসলমানের কত©ব্য হবে সেটা মিটমাট করা।